Bangla - রহস্য গল্প

কুমিরদ্বীপের অশরীরী

Spread the love

এক

সকালবেলার আকাশে একধরনের হালকা ধূসর আভা, বাতাসে নোনা জল আর কাদার মিশ্রিত গন্ধ। কলকাতা থেকে লঞ্চে নামার পর ছোট্ট এক কাঠের বোটে পা রাখলেন ড. সমীরণ ঘোষ। সরকারি পরিবেশ গবেষণা প্রকল্পের অংশ হিসেবে এবার তাঁর গন্তব্য সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত দ্বীপ—স্থানীয়দের মুখে যার নাম কুমিরদ্বীপ। নদীর ঘোলাটে জলে বোট দুলে উঠতেই তিনি কাঁধের ব্যাগ শক্ত করে ধরে বসেন। বোটের হাল ধরে থাকা মানুষটির গায়ে মলিন ফতুয়া, চোখে চওড়া ফ্রেমের কালো চশমা, মুখে এক অদ্ভুত রুক্ষতা—সে মোক্তার শেখ। সমীরণের হাতে ধরা নোটবুকে দ্বীপের মানচিত্র, কয়েকটি গবেষণা নোট, আর বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণের সরঞ্জামের তালিকা। যাত্রা শুরুর মুহূর্ত থেকেই মোক্তার তাঁকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে। “আপনি আগে কখনও এখানে আসেননি, তাই তো?”—মোক্তারের গলায় যেন অদৃশ্য সতর্কবার্তা। সমীরণ শুধু মাথা নাড়লেন, বুঝিয়ে দিলেন তিনি বহুবার সুন্দরবনে এলেও এই দ্বীপে প্রথম। নদীর দুই ধারে জঙ্গল যেন অদ্ভুত নীরবতায় ডুবে আছে, মাঝে মাঝে শুধু শ্বাসরুদ্ধ করা সোঁদা গন্ধ আর দূরে কোন বকপক্ষীর ডাক ভেসে আসছে।

যাত্রাপথে মোক্তার নানা গল্প শোনাতে শুরু করল—ঝড়ে ভেসে যাওয়া নৌকা, নদীতে নিখোঁজ মানুষ, আর এক অদ্ভুত কাহিনি—“আমাদের এই কুমিরদ্বীপে কুমির নেই, বাবু। তাও রাতে গর্জন শোনা যায়। কেউ বলে বনবিবির রক্ষক কুমিরের আত্মা, কেউ বলে শত বছর আগে এক বিশ্বাসঘাতককে নদীতে ফেলে দেওয়ার পর থেকে তার আত্মা কুমির হয়ে ঘোরে।” সমীরণ গল্পটিকে লোককথা ভেবে হেসে উড়িয়ে দিলেও নোটবুকে তা লিখে রাখলেন। তাঁর কাছে প্রতিটি লোককাহিনি প্রাকৃতিক ঘটনার সম্ভাব্য ব্যাখ্যার সূত্র হতে পারে। কিন্তু মোক্তারের চোখে একরকম ভয় লেগেই আছে, যেন সে কিছু বলতে চায় কিন্তু নিজের মুখ বন্ধ রাখছে। নদীর মাঝখানে এসে হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্য সূর্যের আলো ম্লান হয়ে যায়, আর বাতাসে হিমেল ঠান্ডা স্রোত বয়ে আসে। সমীরণ মনে মনে ভাবলেন—এ কি শুধুই আবহাওয়ার খেলা, নাকি দ্বীপের রহস্যময়তার প্রথম ইঙ্গিত?

দুপুর গড়িয়ে বোট ধীরে ধীরে দ্বীপের ঘাটে এসে ঠেকে। চারদিকে ছোট ছোট কুঁড়েঘর, মাটির রাস্তা, আর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা কেওড়া ও গরান গাছ। দূরে দেখা যায় মাটির প্রাচীরঘেরা এক ছোট্ট মন্দির, লাল পতাকা উড়ছে—এটাই বনবিবির মন্দির, যেটির কথা মোক্তার পথে পথে বলছিল। সমীরণ বোট থেকে নেমে দেখলেন, দ্বীপে কোনও গাড়ির শব্দ নেই, কেবল বাতাসে পাতার মৃদু সড়সড়ানি। তাঁর কাঁধে ক্যামেরা, হাতে সাউন্ড রেকর্ডিং যন্ত্র, আর চোখে উৎসুক দৃষ্টি। গবেষণার জন্য তাঁকে এখানকার জীববৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণ করতে হবে, কিন্তু মনে মনে তিনি এই “কুমিরের গর্জন” রহস্যও খুঁজে বের করার পরিকল্পনা করছেন। মোক্তার ঘাটের পাশেই বোট বাঁধতে বাঁধতে বলল, “বাবু, রাতে বেশি বাইরে ঘোরাফেরা করবেন না। বিশেষ করে মন্দিরের দিকটায় নয়।” সমীরণ হেসে বললেন, “আমি বিজ্ঞানী, ভূতের ভয় পাই না।” মোক্তার কোনও জবাব দিল না, শুধু মাটির দিকে তাকিয়ে থাকল।

সন্ধ্যা নামার পর হাওয়ায় এক অদ্ভুত ভারী ভাব নেমে আসে। পশ্চিম আকাশে লালচে আলো মিলিয়ে যেতে যেতে নদীর জলে ছায়া ঘনিয়ে ওঠে। সমীরণ তাঁর থাকার কুঁড়েঘরের বারান্দায় বসে নোটবুকের পাতা উল্টাচ্ছিলেন, হঠাৎ দূর থেকে নদীর ওপার থেকে এক গর্জন ভেসে এল—গভীর, দীর্ঘ, আর শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেওয়ার মতো। তিনি থমকে গেলেন। এই শব্দ তিনি আগে কখনও শোনেননি; কুমিরের ডাকার সঙ্গে খানিকটা মিল থাকলেও তাতে যেন আরও ভারী প্রতিধ্বনি মিশে আছে, যেন জলের নিচ থেকে কেউ ডাকছে। যন্ত্রপাতি আনতে তিনি তাড়াতাড়ি ঘরের ভেতরে ঢুকলেন, কিন্তু ততক্ষণে শব্দ মিলিয়ে গেছে। চারপাশে আবার সেই আগের মতো নিস্তব্ধতা—শুধু জোয়ার-ভাটার মৃদু ঢেউয়ের শব্দ। তিনি যুক্তি খুঁজতে চেষ্টা করলেন—হয়তো বাতাসের প্রবাহে কোনও পাথুরে অংশে প্রতিধ্বনি, কিংবা কোনও বিরল পাখির ডাক। কিন্তু মনে কোথাও যেন একটা অজানা কৌতূহল আর শিরশিরে ভয় গেঁথে রইল—যেটা বিজ্ঞানও তখনই ব্যাখ্যা দিতে পারল না।

দুই

রাধিকা মণ্ডল ছিলেন দ্বীপের প্রাইমারি স্কুলের একজন শান্ত স্বভাবের শিক্ষিকা, যাঁকে পুরো গ্রাম সম্মান করত। স্কুল থেকে ফেরার পথে তিনি প্রায়ই সমীরণের সঙ্গে কয়েক কথা বলতেন, কারণ সে একমাত্র বাইরের লোক, যে এতদিন ধরে দ্বীপে থেকে নোটবুকে অদ্ভুত ঘটনা লিপিবদ্ধ করছে। সেদিন বিকেলের শেষ আলো যখন সমুদ্রের জলে লালচে প্রতিফলন ফেলছে, রাধিকা স্কুলের দরজা তালা দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। হাওয়ায় লবণাক্ত গন্ধ আর দূরে জোয়ারের শব্দ মিলেমিশে এক ধরনের ভারী নীরবতা তৈরি করেছিল। সমীরণ নোটবুক হাতে ঘাটের দিকে যাচ্ছিল, তখন রাধিকা তাঁকে থামিয়ে সরাসরি বললেন, “আপনি বনবিবির মন্দিরের কাছে রাতে যাবেন না। দিনের বেলায় যতই শান্ত দেখাক, সূর্য ডোবার পর ওই জায়গাটা আর একই থাকে না।” তাঁর কণ্ঠে দৃঢ়তা থাকলেও চোখে ছিল এক অদৃশ্য আতঙ্কের ছায়া, যা সমীরণ উপেক্ষা করতে পারলেন না।

সমীরণ কৌতূহলভরে জানতে চাইলেন, “রাতে এমন কী হয় ওখানে?” রাধিকা প্রথমে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, যেন ভাবছেন, তাঁর বলা কথা বাইরের লোকের কাছে কেমন লাগবে। তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন—“আমার বয়স তখন মাত্র বারো। বর্ষার রাত ছিল, আর বজ্রপাতের সঙ্গে সাগরের গর্জন যেন একসঙ্গে চেঁচাচ্ছিল। আমার কাকা—সত্যেন মণ্ডল—ছিলেন একজন মৎস্যজীবী, যিনি সাহসের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। সেদিন সন্ধ্যার পর তিনি কিছু মাছ ধরার ফাঁদ মেরামত করতে মন্দিরের পাশ দিয়ে জঙ্গলের দিকে গিয়েছিলেন। মা তাঁকে অনেক বার বারণ করেছিল, কারণ ওই রাতটা ছিল ‘গর্জনের রাত’—যখন আকাশ ও সমুদ্র একসঙ্গে রুদ্র রূপ ধারণ করে বলে গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে। কিন্তু কাকা হাসতে হাসতে বলেছিলেন—‘ভূতপ্রেত বলে কিছু নেই, আর বনবিবি তো রক্ষা করেন, ক্ষতি করেন না।’ সেই রাতে তিনি আর ফিরে আসেননি। পরের দিন সকালে মন্দিরের সিঁড়ির কাছে তাঁর ভাঙা লণ্ঠন পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু মানুষটা উধাও।”

তিনি থামলেন, গভীর শ্বাস নিলেন, যেন অতীতের সেই রাতের গন্ধ এখনও নাকে এসে লাগছে। সমীরণ তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন, কিন্তু যুক্তিবাদী মন বিশ্বাস করতে চাইছিল না যে এটি অতিপ্রাকৃত কিছু। তিনি বললেন, “হয়তো জোয়ারের সময় সমুদ্রে পড়ে গিয়েছিলেন, অথবা কোনো বন্যপ্রাণীর আক্রমণে—” কিন্তু রাধিকা তৎক্ষণাৎ মাথা নাড়লেন। “না, সমীরণবাবু, সেদিন সমুদ্র তীরে শান্ত ছিল। আর জঙ্গলের কোনো পশুর ছাপও পাওয়া যায়নি। গ্রাম্য বুড়োরা বলে, গর্জনের রাতে বনবিবির মন্দিরের চারপাশে ‘ছায়া মানুষ’ দেখা যায়, যারা পথভ্রষ্ট করে নিয়ে যায়। আমি জানি আপনি হয়তো এসব মানবেন না, কিন্তু নিজের চোখে যা দেখেছি, তা ভুলতে পারিনি।” সমীরণ কৌতূহল লুকোতে পারলেন না, “আপনি কী দেখেছিলেন?” রাধিকার কণ্ঠ আরও নিচু হল, “সেই রাতের মাঝরাতে, জানলার ফাঁক দিয়ে আমি দেখেছিলাম কাকার লণ্ঠনের আলো বনবিবির মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে, আর তাঁর পেছনে চলেছে অন্তত চার-পাঁচটা কালো, অস্পষ্ট অবয়ব। বজ্রপাতের আলোয় তারা মানুষের মতো, আবার পুরোপুরি মানুষ নয়। কিছুক্ষণ পর আলোটা নিভে গেল, আর তারপর কাকা আর কখনো ফিরে আসেননি।”

রাধিকার কাহিনী শুনে সমীরণের মনে অদ্ভুত মিশ্র প্রতিক্রিয়া জন্ম নিল। যুক্তির দিক দিয়ে তিনি জানেন, এসব গল্পের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, কিন্তু রাধিকার চোখে যে আতঙ্কের ঝিলিক দেখলেন, তা নিছক কল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন। তিনি চুপচাপ নোটবুকে পুরো ঘটনা লিখে নিলেন, তারিখ ও সময়সহ। রাধিকা চলে যাওয়ার সময় আবারও বললেন, “আমি আপনাকে শুধুমাত্র সতর্ক করছি, কারণ দেখছি আপনি প্রায়ই ওই এলাকায় যান। এখানে বাইরের লোকদের অজানা অনেক কিছু আছে।” সমীরণ ঠোঁটে হালকা হাসি এনে বললেন, “চিন্তা করবেন না, আমি সাবধানে থাকব।” কিন্তু মনের ভেতর কৌতূহল ক্রমশ তীব্র হচ্ছিল—যেন বনবিবির মন্দির তাঁকে নিজের রহস্য উদঘাটনে ডাকছে। সেদিন রাতেই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, রাধিকার সতর্কবার্তা উপেক্ষা করেই অন্তত একবার গোধূলির পর মন্দির পর্যন্ত গিয়ে দেখবেন, আসলে সেখানে কী ঘটে। আর ঠিক সেই সিদ্ধান্তই ছিল তাঁর অদ্ভুত অভিযাত্রার প্রথম পদক্ষেপ।

তিন

বিকেলের শেষ রোদ দ্বীপের বালুকাময় পথ ছুঁয়ে লালচে হয়ে উঠেছিল, যখন সমীরণ বদন চাটুজ্যের সঙ্গে বনবিবির মন্দিরের দিকে হাঁটছিল। মন্দিরটি ছিল দ্বীপের প্রায় মাঝামাঝি, চারপাশে উঁচু কেওড়া আর সুন্দরী গাছের জটলা, যেন প্রকৃতি নিজে একে অদৃশ্য প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রেখেছে। প্রবেশপথের ধারে ভাঙাচোরা ইটের সিঁড়ি, যার কিছু অংশ শ্যাওলা আর লতাগুল্মে ঢাকা। বদনবাবু, সাদা ধুতি আর হালকা মলিন পাঞ্জাবি পরে, এক হাতে লণ্ঠন আর অন্য হাতে পুরনো পিতলের চাবির গোছা নিয়ে এগোচ্ছিলেন। মন্দিরের মূল গম্বুজে ধূসর শ্যাওলা জমে গেছে, তবু তার গায়ে সূর্যের শেষ আলো পড়ে যেন এক রহস্যময় আভা ছড়াচ্ছিল। প্রবেশদ্বারে পাথরের দরজার পাশে বড় বড় খোদাই—জঙ্গলের পশুপাখি, নদীর ঢেউ, আর মাঝখানে বনবিবির মূর্তি, মুখে মৃদু হাসি কিন্তু চোখে কঠোরতা। সমীরণ অবাক হয়ে সব দেখছিল, আর বদনবাবু ধীর কণ্ঠে বলতে লাগলেন, “এই মন্দিরের বয়স একশো বছরেরও বেশি। তখনও নদী এতটা পেছায়নি, বর্ষার সময় জল মন্দিরের সিঁড়ি ছুঁয়ে যেত।”

মন্দিরের ভিতরে ঢুকতেই ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে বাতাস মুখে এসে লাগল। দেয়ালে তেলের কালি আর ধূপের গন্ধ মিশে এক অদ্ভুত ভারী পরিবেশ তৈরি করেছিল। মূল গর্ভগৃহে বনবিবির মূর্তির সামনে শালপাতায় রাখা আছে ফুল, প্রদীপ, আর নোনতা বাতাসে নড়া ধূপের ধোঁয়া। বদনবাবু লণ্ঠনের আলো গর্ভগৃহের পিছনের দিকে ফেলতেই সমীরণের চোখে পড়ল এক পুরনো কাঠের দরজা, যা তালাবদ্ধ। বদনবাবু চাবি দিয়ে খুলে ভিতরে নিয়ে গেলেন—এটি ছিল মন্দিরের পেছনের অংশ, যেখানে সাধারণ দর্শনার্থীরা আসে না। সেখানেই তিনি দেখালেন সেই শতবর্ষ পুরনো পাথরের খোদাই। অর্ধেক-মানুষ, অর্ধেক-কুমির—শক্তপোক্ত দেহ, আঁশে ঢাকা ত্বক, হাতের বদলে পাখনার মতো অঙ্গ, আর মুখে অদ্ভুত ভয়ঙ্কর হাসি। সমীরণ পাথরের গায়ে হাত ছুঁয়ে দেখল—ঠান্ডা, শক্ত, অথচ অদ্ভুতভাবে যেন জীবন্ত মনে হচ্ছে। বদনবাবু ধীর গলায় বললেন, “একে রক্ষক আত্মা বলে। দ্বীপের মানুষ বিশ্বাস করে, নদীর গভীর থেকে উঠে এসে সে বনবিবির মন্দির রক্ষা করে… কিন্তু যার ওপর রাগ করে, তাকে আর কেউ খুঁজে পায় না।”

বাইরে বেরিয়ে আসার সময় নদীর হাওয়া আরও ঠান্ডা হয়ে উঠল। সন্ধ্যা নেমে গেছে, আকাশে প্রথম তারা দেখা দিচ্ছে। সমীরণ দাঁড়িয়ে মন্দিরের পেছন দিকে তাকাল, যেখানে গাছের ফাঁক দিয়ে নদীর কালো জল দেখা যায়। দূরে কাঁকড়ার ডাক ভেসে আসছিল, আর জোয়ার-ভাটার গন্ধ যেন আরও প্রবল। বদনবাবু মন্দিরের দরজা তালা দিচ্ছিলেন, কিন্তু সমীরণের মন যেন পাথরের খোদাইয়ের মধ্যে আটকে ছিল। হঠাৎ, খুব ক্ষীণ হলেও স্পষ্টভাবে, নদীর দিক থেকে এক গর্জন ভেসে এল—প্রথমে মনে হল ঢেউয়ের শব্দ, কিন্তু পরক্ষণেই বোঝা গেল, এটি স্বাভাবিক নয়। তা ছিল দীর্ঘ, গভীর, আর যেন কোথাও লুকিয়ে থাকা এক বিশাল প্রাণীর ডাক। বদনবাবু যেন কিছু শুনতে পাননি, শান্তভাবে বললেন, “চলুন, অন্ধকারে নদীর পাড় ভালো নয়।” সমীরণ কিছু না বলে চুপচাপ তার সঙ্গে হাঁটতে লাগল, কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে গর্জনের ধ্বনি বারবার মনে মনে শুনছিল।

রাত গভীর হলে, সমীরণ নিজের থাকার ঘরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। দূরে মন্দিরের গম্বুজের ওপর চাঁদের আলো পড়ে সাদা আভা ছড়াচ্ছে। তার চোখ মন্দিরের দিকেই স্থির ছিল, আর কানে তখনও সেই গর্জনের প্রতিধ্বনি বাজছে। চারপাশে দ্বীপ নিস্তব্ধ, কেবল হাওয়ার সঙ্গে গাছের পাতার মর্মর শব্দ। সমীরণ নোটবুক বের করে দিনের অভিজ্ঞতা লিখতে শুরু করল—বদন চাটুজ্যের বর্ণনা, মন্দিরের ইতিহাস, পাথরের খোদাই, আর সেই অদ্ভুত গর্জন। কলমের কালো দাগ কাগজে পড়তে পড়তে যেন তার মন আরও গভীরে ডুবে গেল—এই দ্বীপে কিছু আছে, যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু শব্দে, গন্ধে, আর বাতাসের অদৃশ্য স্রোতে উপস্থিত। সে জানত, যতদিন এখানে থাকবে, সেই রহস্য তাকে তাড়া করবে। কিন্তু তখনও বুঝতে পারেনি—এটি কেবল শুরু।

চার

সন্ধ্যার আকাশে তখন ধূসর মেঘের ভিড়, বাতাসে নোনাজল আর কাদামাটির গন্ধ। সমীরণ দ্বীপের সরু কাঁচা পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল এক ছোট্ট, খড়ের ছাউনি দেওয়া বাড়ির সামনে। দরজার পাশে বাঁশের খুঁটিতে ঝুলছে শুকনো পাতা, শিকড়, আর রঙিন কাপড়ে মোড়ানো ছোটো ছোটো থলে। এখানেই থাকেন মীরা বেগম—দ্বীপের লোকজ চিকিৎসক, যাঁর ওষুধ আর ঝাড়ফুঁকের খ্যাতি নদীপারের গ্রামগুলোতেও ছড়িয়ে আছে। মীরা বেগম তাকে হাসিমুখে স্বাগত জানালেন, তবে চোখে এক ধরনের অব্যক্ত দুঃখের ছায়া স্পষ্ট ছিল। চা বানানোর জন্য মাটির হাঁড়িতে পানি বসাতে বসাতে তিনি বললেন, “শুনি তুমি বদনবাবুর সাথে মন্দিরে গেছিলে। মন্দিরের পেছনের পাথরের খোদাইটা দেখেছ নিশ্চয়? ওটার কথা ছোটবেলায় আমিও শুনতাম। বলত, যেদিন নদী থেকে গর্জন শোনা যায়, সেদিন রাতেই ওখানকার ‘রক্ষক আত্মা’ জেগে ওঠে।” সমীরণ কিছু বলার আগেই তিনি যোগ করলেন, “আমার স্বামীও এমন এক রাতে গিয়েছিল নদীর ধারে… আর ফিরে আসেনি।” তাঁর কণ্ঠে তখন এমন এক নির্লিপ্ত শীতলতা ছিল, যেন দীর্ঘদিন ধরে ক্ষত শুকিয়ে গেছে, কিন্তু দাগ রয়ে গেছে।

চা খেতে খেতে মীরা বেগম ধীরে ধীরে তার জীবনের গল্প বলতে শুরু করলেন। তার স্বামী মৎস্যজীবী ছিলেন, বলিষ্ঠ শরীর আর চিরকাল হাসিখুশি মুখ। বছর সাতেক আগে, এক বর্ষার রাতে, নদীর দিকে অদ্ভুত গর্জন ভেসে আসে—শব্দটা ছিল না স্রেফ কুমিরের ডাকে, যেন এর ভিতরে মানবীয় আর পশুর কণ্ঠ একসাথে মিশে আছে। গ্রামের লোকজন ভয়ে ঘরে লুকিয়ে ছিল, কিন্তু তাঁর স্বামী, কৌতূহল আর চ্যালেঞ্জে ভরা, হাতে লন্ঠন নিয়ে বেরিয়ে যান। মীরা বেগম অপেক্ষা করতে থাকেন, কিন্তু রাত কেটে যায়, লন্ঠনের আলো আর দেখা যায় না। পরদিন সকালে নদীর ধারে শুধু পাওয়া যায় একটি ছেঁড়া গামছা, আর কাদায় অদ্ভুত আকারের পদচিহ্ন—যা না মানুষ, না কুমিরের পায়ের মতো। সেই ঘটনার পর থেকে মীরা বেগম নির্জনতা বেছে নিয়েছেন, তবে মানুষের চিকিৎসা আর গাছগাছড়ার ওষুধ নিয়ে কাজ করে চলেছেন। তাঁর চোখের কোণে তখন নোনা জল চিকচিক করছিল, কিন্তু তিনি তা মুছে ফেললেন চুপচাপ।

মীরার মুখ থেকে শোনা এই ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি সমীরণের কৌতূহল আরও বাড়িয়ে দিল। কথার ফাঁকে মীরা তাকে দ্বীপের অতীতের আরও কিছু গল্প শোনালেন—যা তিনি শোনেননি বদন চাটুজ্যের কাছ থেকেও। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে এই দ্বীপের নদীর ধারে নাকি রহস্যময় মৃত্যু আর নিখোঁজের ইতিহাস রয়েছে। ব্রিটিশ আমলে এখানে এক নীলকুঠি ছিল, যার মালিকের কন্যা নাকি নদীতে ডুবে মারা যায় অজ্ঞাত কারণে। স্বাধীনতার পর কয়েকজন কাঠুরে ও জেলে অদৃশ্য হয়ে যায়—সব ঘটনাই ঘটে গভীর রাতে, নদীর ধারে। মানুষজন এসব নিয়ে কথা বলতে চায় না; তারা বিশ্বাস করে, এসব ‘রক্ষক আত্মা’র অভিশাপ। মীরা বললেন, “আমার ঠাকুরদা বলত, এই দ্বীপ একসময় বাণিজ্যের বড় জায়গা ছিল, কিন্তু কিছু ভয়ঙ্কর ঘটনা সব শেষ করে দেয়। নদী তখন থেকেই মানুষ গিলে খেতে শুরু করে।” মীরা যখন এসব বলছিলেন, তার চোখে একটা দৃঢ়তা ছিল, যেন তিনি নিজেও জানেন সত্যিটা কেবল লোককথা নয়—এতে আরও কিছু আছে।

রাত তখন ঘনিয়ে এসেছে, দূরে নদীর গর্জনময় স্রোত শোনা যাচ্ছে। বাতাসে হঠাৎ কেমন ঠান্ডা ভাব নেমে এল, যেন জোয়ার আসছে। সমীরণ মীরাকে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠলেন, কিন্তু দরজা পেরিয়ে যাওয়ার আগে তিনি বললেন, “যদি কোনোদিন গর্জন শোনো, নদীর ধারে যেও না। কৌতূহল মানুষের বড় শত্রু।” সমীরণ বাড়ি ফেরার পথে এক অদ্ভুত অস্বস্তি অনুভব করলেন। মনে হচ্ছিল, এই দ্বীপের মাটি, গাছ, আর নদীর জল—সবই যেন কোনো অদৃশ্য নজরে আবদ্ধ। দূরে অন্ধকারে নদীর ঢেউয়ের শব্দের সাথে যেন মিশে আছে খুব ক্ষীণ, কর্কশ গর্জন—যা তার বুকের ভেতর হিম নামিয়ে দিল। তিনি জানতেন, আজ রাতটা শান্ত হবে না।

পাঁচ

অন্ধকার নেমে এসেছে দ্বীপের ওপর। দূরে নদীর কালো জল অনন্ত এক রহস্যের মতো বইছে, মাঝে মাঝে তাতে ভেসে আসছে পচা কচুরিপানার গন্ধ। সমীরণ আজ ঠিক করেছে—কুমিরের গর্জন আর সেই অদ্ভুত শব্দের রহস্য তাকে উদ্ঘাটন করতেই হবে। সাউন্ড রেকর্ডিং যন্ত্র, মাইক্রোফোন আর একগাদা ব্যাটারি নিয়ে সে নিঃশব্দে নদীর ধারে গিয়ে বসে। আকাশে মেঘ জমে উঠেছে, চাঁদের আলো মাঝেমধ্যে মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে জলের ওপর সাদা দাগ কাটছে। সমীরণ যন্ত্রের সেনসিটিভিটি বাড়িয়ে দেয়, যাতে দূরের সামান্য শব্দও ধরা পড়ে। বাতাসে ভিজে কাঁদার গন্ধ আর শীতলতা, পেছনে দূরের বাঁশবনের ফিসফিসানি—সব মিলিয়ে তার মেরুদণ্ডে অদ্ভুত শিরশিরে অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। সে জানে, এই সময়ে কেউ নদীর ধারে আসে না; গ্রামবাসীরা বলে, রাতের নদী মানে মৃত্যু ডেকে আনা। তবুও, সমীরণ রেকর্ডিং শুরু করে, চোখে-কানে সমস্ত ইন্দ্রিয় সতর্ক রেখে অপেক্ষা করে থাকে—যেন অন্ধকারের ভেতর থেকে কিছু বেরিয়ে আসবে।

প্রথমে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর নদীর ধীর স্রোতের ছলাৎ শব্দ ধরা পড়ছিল। কিন্তু হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসে সেই কুমিরের মতো গম্ভীর গর্জন—তবে এবার সেটি যেন ভেতরে ধাতব কম্পন নিয়ে এগিয়ে আসছে। সমীরণ যন্ত্রের স্ক্রিনে অডিও ওয়েভফর্ম দেখে কপাল কুঁচকে ফেলে—এমন অসামঞ্জস্যপূর্ণ কম্পাঙ্ক কোনও প্রাণীর গলা থেকে আসার কথা নয়। তার বুকের ভেতর ধুপধুপ শুরু হয়, কিন্তু সে হেডফোনে মন দিয়ে শোনে, শব্দটি ধীরে ধীরে কাছাকাছি আসছে। হঠাৎ, জলের ওপর ঠিক মাঝ বরাবর, দুটি সবুজাভ আলো জ্বলে উঠল—আর তার সঙ্গে সঙ্গেই একটু দূরে আরেক জোড়া আলো। চারটি চোখ যেন স্থির হয়ে সমীরণের দিকে তাকিয়ে আছে। আলো দুটি কেবল পানির ওপরে ভাসছে না; মনে হচ্ছে, ওরা গভীর জলের ভেতর থেকেও জ্বলজ্বল করছে, যেন কোনও অদ্ভুত শক্তি ভেতর থেকে আলো ছড়াচ্ছে। হাওয়া থেমে গেছে, রাতটা যেন থমকে দাঁড়িয়েছে, আর সমীরণের হাতের তালু ঘামে ভিজে উঠেছে।

সে চুপচাপ ক্যামেরা চালু করার চেষ্টা করতেই যন্ত্রে হালকা এক ধরনের স্ট্যাটিক আওয়াজ শোনা গেল। তারপরে আসতে লাগল অদ্ভুত নিম্ন-কম্পাঙ্কের স্পন্দন—যা শুধু শোনা যাচ্ছে না, বরং চারপাশের মাটি, এমনকি সমীরণের হাড়ের ভেতরেও যেন ধ্বনিত হচ্ছে। তার অভিজ্ঞতা বলে, এই কম্পন প্রাকৃতিক নয়; যেন জলের তলদেশ থেকে কোনও অশরীরী শক্তি তার চারপাশের বাতাস কাঁপিয়ে তুলছে। সমীরণ আতঙ্কিত হলেও কৌতূহল ছাড়তে পারল না—সে যন্ত্রের সেটিং বদলে আরও সূক্ষ্ম রেকর্ডিং শুরু করল। সেই সময়েই, নদীর পাড়ের গাছের ছায়া থেকে যেন কারও উপস্থিতির আভাস পেল। ধীরে ধীরে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেল—মোক্তার দূরে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। কোনও শব্দ ছাড়াই, ঠায় তাকিয়ে আছে, মুখে এক অদ্ভুত, প্রায় শূন্য দৃষ্টি।

মোক্তার আচরণে কিছু একটা অস্বাভাবিকতা আছে, সেটি সমীরণ বেশ কিছুদিন ধরেই টের পাচ্ছিল, কিন্তু আজকের এই রাতের পর তার সন্দেহ আরও ঘনীভূত হল। সে ভাবল, মোক্তার হয়তো এই রহস্যময় গর্জন ও চোখের আলোর সঙ্গে কোনও যোগসূত্র রয়েছে। কিন্তু সরাসরি মুখোমুখি হওয়ার মতো পরিস্থিতি তখন নয়; নদীর ওপরে আলো-চোখ দুটি আবারও এক মুহূর্তের জন্য জ্বলজ্বল করে নিভে গেল, আর গর্জনের শেষ ধ্বনি মিলিয়ে গেল অদ্ভুত নীরবতায়। সমীরণ দ্রুত যন্ত্র গুটিয়ে নিল, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল—কেউ বা কিছু তার প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ্য করছে। ফেরার পথে বারবার সে মনে করতে লাগল, সেই চার জোড়া অশরীরী চোখের দৃষ্টি আর মোক্তারের সেই নিশ্চুপ, প্রায় ভূতুড়ে উপস্থিতি—যেন দ্বীপের গোপন অতল থেকে কোনও শক্তি ধীরে ধীরে তাকে ঘিরে ধরছে।

ছয়

অন্ধকারে ভেজা বাতাসের মধ্যে সমীরণ মোক্তারের চলাফেরার প্রতি নজর রাখছিলেন। আগের রাতের অশরীরী চোখের ঘটনার পর তাঁর মনে ভয় ও কৌতূহল সমান তালে কাজ করছে। পুরনো কিছু সূত্র ঘেঁটে তিনি জানতে পারলেন, বছর কয়েক আগে এই দ্বীপে এক বড়সড় কুমির চামড়া পাচার চক্র সক্রিয় ছিল। সেই চক্র নদীপথে চামড়া এবং মাঝে মাঝে জীবন্ত কুমিরও পাচার করত, যা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রচুর দামে বিক্রি হতো। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, এই পাচারকারীদের মধ্যে মোক্তারও ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম—যে নৌকা চালাত, নদীপথ চেনাত, আর পুলিশের নজর এড়িয়ে মাল পৌঁছে দিত। সমীরণ এই তথ্য পেয়ে চমকে উঠলেন, কারণ মোক্তার বাইরে থেকে একেবারেই সাধারণ জেলে বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে, তাঁর অতীত অন্ধকারে ঢেকে রাখা।

গল্প আরও গভীর হলো যখন সমীরণ এক বয়স্ক চা-দোকানদারের মুখে শুনলেন এক ভয়ঙ্কর কাহিনি। কয়েক বছর আগে, এক বর্ষার রাতে একটি পাচারকারী দল নদী পেরোতে গিয়ে হঠাৎ গর্জনের মতো এক অদ্ভুত শব্দ শুনতে পায়। সেই সঙ্গে দলে থাকা এক ব্যক্তি, যার নাম সাদেক, আচমকা পানির নিচে টেনে নেওয়া হয়। তার চিৎকার রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দেয়, কিন্তু কেউ তাকে উদ্ধার করতে পারেনি। কিছুক্ষণ পর নদীর জলে লাল রঙের ঢেউ ভেসে ওঠে, আর বাকি পাচারকারীরা আতঙ্কে সব ফেলে পালিয়ে যায়। পরদিন তারা গ্রামে ফিরে দাবি করে—এটা ছিল “রক্ষক আত্মা”-র কাজ, যে দ্বীপের প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য অপরাধীদের শাস্তি দেয়। এই কিংবদন্তি তারপর থেকে এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে অনেকে সত্যি বিশ্বাস করতে শুরু করে। সমীরণের মনে প্রশ্ন জাগে—এ কি নিছক কুসংস্কার, নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে আছে কোনো চতুর অপরাধ ঢাকার কৌশল?

তিনি পরবর্তী কয়েক দিন গ্রাম ও আশপাশের নদীপথ ঘুরে দেখলেন, এবং বুঝলেন যে এই গর্জনের আওয়াজ এবং অদ্ভুত আলো আসলে পাচার চক্রের জন্য এক ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হয়ে উঠেছিল। নতুন লোক বা তদন্তকারী এলে এই ভৌতিক পরিবেশ তৈরি করে তাদের ভয় দেখানো হত, যাতে তারা গভীরে অনুসন্ধান না করে। সমীরণ অনুমান করলেন যে হয়তো এই ঘটনায় জড়িত কেউ পানির নিচে বিশেষ যন্ত্র বসিয়েছিল, যা শব্দ ও আলো তৈরি করে। কিন্তু তখনই আরেকটি রহস্য জুড়ে গেল—যে রাত সাদেক মারা গিয়েছিল, সেই রাতে কোনো যন্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। তাহলে কি সত্যিই কিছু অজানা শক্তি তাকে নদীর গভীরে টেনে নিয়েছিল? এই অমীমাংসিত প্রশ্ন সমীরণের তদন্তকে আরও বিপজ্জনক করে তুলল।

মোক্তারকে সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করলে সে প্রথমে এড়িয়ে যায়, তারপর এক রাতে হঠাৎ সমীরণকে বলে—“বাবু, সব জিনিস কাগজে কলমে ধরা যায় না। এই নদী যা দেখেছে, তা মানুষকে বলতে নেই।” তার চোখে তখন এক অদ্ভুত মিশ্রণ—ভয়, অপরাধবোধ আর গোপনীয়তার ভার। সমীরণ বুঝলেন যে মোক্তারের কাছে হয়তো এমন কিছু তথ্য আছে যা সে প্রকাশ করতে চায় না, কারণ তাতে তার নিজের বিপদ হতে পারে। কিন্তু সমীরণ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ—তিনি এই গর্জনের রহস্য উন্মোচন করবেন, তা যতই পুরনো অপরাধ কিংবা অতিপ্রাকৃত গল্পের সঙ্গে যুক্ত হোক না কেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, গর্জনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সত্য হয়তো শুধু কুমির চামড়া পাচারের কাহিনি নয়—বরং দ্বীপের অন্ধকার ইতিহাসের এক গভীর অধ্যায়।

সাত

হাওয়ার বেগ বাড়তে শুরু করল সূর্য ডোবার আগেই। সমীরণ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখলেন আকাশ মেঘে ঢেকে গেছে, চারদিকে ভারী ধূসর ছায়া। বাতাসে ভেসে আসা নোনা জল আর মাটির গন্ধে মনে হল প্রকৃতি নিজেই একটা ভয়ঙ্কর সংকেত দিচ্ছে। রাধিকা তখন মন্দিরের পাশে দাঁড়িয়ে বাতাসের গতিবিধি দেখে বলল, “এমন ঝড় আমাদের আগে কখনও দেখিনি। এই দ্বীপের জন্য এটি অভূতপূর্ব।” মোক্তারও মুখে অজানা এক জোরালো ভাব নিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে ছিল, যেন সে নদীর ভয়াবহ রূপ আগে থেকেই জানে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আকাশ থেকে ভারী বৃষ্টি শুরু হয়, আর ঝড়ের সঙ্গে জলোচ্ছ্বাসে নদীর পানি দ্রুত উপচে পড়তে শুরু করে। সমীরণ, রাধিকা ও মোক্তার সবাই নদীর পাড়ে আটকা পড়ে যান, আশেপাশের গাছ ও কুঁড়েঘর ঝাঁকতে থাকে, বাতাস শিহরিত আর শব্দে পরিবেশ থরথর করে কেঁপে ওঠে।

ঝড়ের আওয়াজের মাঝেই একটি অপরিচিত গর্জন দূর থেকে শোনা গেল—পুরানো দিনের কুমিরের ডাকের মতো, কিন্তু তার থেকে অনেক বেশি গম্ভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী। সমীরণ তাকিয়ে থাকল নদীর অন্ধকার জলে, যেখানে সেই গর্জনের উৎস রয়েছে বলে অনুমান। পানি ধীরে ধীরে কেটে উঠে আসছে, আর তার সঙ্গে নদীর পানিতে বড় এক ছায়া ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে—মানুষের চোখে এক বিশাল কুমিরের মতো, যার শলাকা, চোখ আর দাঁত মলিন কালো রঙের সঙ্গে চকচক করছে। চোখ মেলে ছায়ার দিকে তাকিয়ে সবাই থমকে গেল। কিন্তু কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করলে দেখা গেল, তা কোনও বাস্তব প্রাণী নয়; বরং ঝড়, বায়ুর গতি, জলের ঢেউ আর গর্জনের শব্দের সঙ্গমে এক অদ্ভুত দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছে। বাতাসে ভেসে আসা ঝড়ের সাথে জলরাশির গর্জন মিলিয়ে এই ছায়া যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

সমীরণ মনে মনে ভাবল, এটি প্রকৃতির এক ধোঁকা, যা দ্বীপবাসীর বিশ্বাসকে শক্তিশালী করেছে। কিন্তু এই ভয়াবহ ঘটনাটি তাঁর কাছে নতুন রহস্য উন্মোচন করল—যে দ্বীপের চারপাশের এই নদী আর বৃষ্টি একসঙ্গে কীভাবে এই গর্জন ও ছায়ার সৃষ্টি করতে পারে, যা স্থানীয়রা “রক্ষক আত্মা” নামে ডাকে। মোক্তার চুপচাপ নীরব, কিন্তু তার চোখে একটা বিষন্নতা আর আতঙ্ক ছিল। রাধিকা অস্থির হয়ে বলল, “এই গর্জনের রাতে নদীর ধারে কাউকে একা রাখা যায় না। কেউ যদি যায়, সে আর ফিরে আসেনা।” সমীরণ জানতো, এই রাতটি তাঁদের জন্য এক বিপদসঙ্কুল অধ্যায় হতে চলেছে।

ঝড়ের তাণ্ডব আর গর্জনের তীব্রতা বাড়তে থাকল, সমীরণ ও অন্যান্যরা নদীর ধারে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। রাত গভীর হলো, বাতাস থমথমে হয়ে গেল, কিন্তু গর্জনের শব্দ এখনও থামেনি। সমীরণ দেখল, জল থেকে ভেসে ওঠা সেই বিশাল ছায়া আবারো এক ঝলক দেখাল, আর ধীরে ধীরে জলরাশি থেকে বিলীন হতে লাগল। তিনি নিজেকে বুঝালেন, প্রকৃতির রহস্য আর স্থানীয় বিশ্বাসের মিলনের একটা জটিল নকশা এই দ্বীপের উপর ছড়িয়ে আছে। কিন্তু এই রাত তাঁকে এক গভীর সত্যের দোরগোড়ায় নিয়ে এসেছে—যে সত্যকে জানতে গেলে তাকে আরও ভয়ংকর পথে যেতে হবে।

আট

ঝড় থেমে যাওয়ার পর সকালটি অচেনা স্নিগ্ধতায় ভরে উঠল। সমীরণ, রাধিকা ও মোক্তার মন্দিরের পাশে দাঁড়িয়ে নদীর দিক থেকে আসা শান্ত জলরাশি ও মৃদু সূর্যের আলো দেখছিলেন। গত রাতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা মনে এলেই বুক চাপড়ানোর মতো হয়। সেই সন্ধ্যা মুছে যাওয়া আগের দিনের মতো ছিল না—বাতাসে এখনও ঝড়ের শোকাল গন্ধ মিশেছিল, আর গর্জনের সেই দীর্ঘ প্রতিধ্বনি যেন এখনো তার মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এমন সময় বদন চাটুজ্যে আসেন, বৃদ্ধ মুখে একটু ক্লান্তি আর দুঃখ। তিনি বলেন, “বাবা, আজ তোমায় একটি কথা বলতে হবে, যা আমার পরিবারের সবচেয়ে গোপন ইতিহাস। আমার ঠাকুরদার কাহিনি।” সমীরণ কৌতূহল নিয়ে মনোযোগ দিলেন, কারণ এতদিন বদনবাবু যে ভয়ে অনেক কথা লুকিয়ে রেখেছেন, তার টানাপোড়েনে আজ প্রকাশ্য হল।

বদনবাবু বললেন, “আমার ঠাকুরদা ছিলেন শক্তিমান পুরোহিত, যিনি শুধু মন্দিরের কাজ করতেন না, বরং গ্রামের মানুষদের রক্ষা করত, অপরাধ দমন করত। বহু বছর আগে, এখানে এক বিশ্বাসঘাতকতা ঘটে। এক গ্রামের মানুষ তার স্বার্থে অন্যের ক্ষতি করেছিল, আর ঠাকুরদা সিদ্ধান্ত নেন তাকে শাস্তি দিতে হবে। এক গভীর রাতে, ঠাকুরদা ও তার কিছু ভক্ত ওই বিশ্বাসঘাতকের পেছনে যান। লড়াই হয়, শেষমেষ সে হত্যা করা হয়, আর তার দেহ নদীর তীরে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর থেকে, বদনবাবুর কথায়, ‘রক্ষক আত্মা’র গর্জন শোনা শুরু হয়। আমার পরিবারের লোকেরা বিশ্বাস করে, এটি সেই অভিশাপ, যা বিশ্বাসঘাতকের আত্মা থেকে আসছে। কেউ এটি ভাঙতে পারে না, কারণ এটি শুধুমাত্র শাস্তি নয়, বরং সতর্কতা।’” বদনবাবুর কণ্ঠ ছিল ভারাক্রান্ত, যেন পুরনো পাপের ভার এখনও তার কাঁধে রয়েছে।

সমীরণ যুক্তি দিয়ে বললেন, “বদনবাবু, আপনার কথায় আমি শ্রদ্ধাশীল, কিন্তু আমরা বিজ্ঞানী। আমি মনে করি নদীর নিচে এমন এক প্রাকৃতিক গুহা থাকতে পারে, যা শব্দের প্রতিধ্বনি তৈরি করে। জোয়ারের সময় বাতাস ও জল মিলিয়ে এমন কম্পন সৃষ্টি হয়, যা ‘গর্জন’ হিসেবে শোনা যায়। এছাড়া, সেই গর্জনের আওয়াজ মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য কেউ বশিয়াতে চালাতে পারেন। কিন্তু আপনার ঠাকুরদার কাহিনি ও অভিশাপের ধারণা গ্রাম্য লোকবিশ্বাসের অংশ, যা মানব মনকে সতর্ক রাখে।” বদনবাবু কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন, তারপর মৃদু হাসলেন, “হয়তো তুমি ঠিক বলছো, সমীরণবাবু। বিজ্ঞান ও বিশ্বাসের মিশেলে এক অদ্ভুত কাহিনি দাঁড়িয়ে আছে আমাদের এই দ্বীপে। তবে একটা কথা জানো, এই অভিশাপ যতই যৌক্তিক ব্যাখ্যার আওতায় পড়ুক, দ্বীপের মানুষদের মনে সেটি আছে, আর তাই তারা সম্মান ও ভয় একসঙ্গে করে।”

পরবর্তী কয়েকদিন সমীরণ নদীর নিচে গভীর অনুসন্ধান শুরু করলেন। তিনি পানির তলদেশে sonar ব্যবহার করে একটি প্রাকৃতিক গুহার সন্ধান পেলেন—যেখানে জল ঢেউয়ের শব্দ ধরা পড়ে, যা উপরে গর্জনের মতো শোনা যায়। তবে রহস্য তখনও মুছে যায়নি। মন্দিরের পাশের সেই অর্ধেক-মানুষ অর্ধেক-কুমিরের পাথরের খোদাই, মোক্তারের সন্দেহজনক আচরণ, এবং অশরীরী চোখের ঘটনাগুলো সমীরণের মনে বারবার প্রশ্ন তোলে। বদনবাবুর স্বীকারোক্তি তাকে একদিকে শান্তি দিলেও অন্যদিকে নতুন দায়িত্ব দেয়—এই দ্বীপের ইতিহাস ও রহস্য যেন এক অদৃশ্য তলদেশের মতো, যার গভীরতা অনন্ত। সমীরণ বুঝতে পারছিলেন, বিজ্ঞান আর বিশ্বাসের এক অনন্য সেতু তৈরির জন্য তাকে আরও গভীরে যেতে হবে—যেন এই দ্বীপের সব ছায়া ও গর্জনকে আলোয় নিয়ে আসা যায়।

রাতের অন্ধকারে বসে সমীরণ মন্দিরের দিক তাকিয়ে ভাবছিলেন, প্রতিটি গর্জন যেন এক নতুন অধ্যায় বলছে, আর প্রতিটি ছায়া যেন অজানা সত্যের দরজা খুলছে। তিনি জানতেন, এই দ্বীপের গোপন রহস্য উন্মোচনে তার যাত্রা এখানেই শেষ নয়, বরং এখান থেকে শুরু। আর বদন চাটুজ্যের স্বীকারোক্তি হয়তো সেই যাত্রার প্রথম সোপান, যা তাকে এক নতুন সন্ধানের পথে নিয়ে যাবে।

নয়

সমীরণ আর রাধিকা একসঙ্গে দ্বীপের পুরনো রেকর্ড ও নথিপত্র খুঁজে শুরু করলেন। গ্রামের প্রশাসনিক অফিসে জমা থাকা বিভিন্ন রিপোর্ট, পুলিশি নোট, এবং মৎস্য দপ্তরের তথ্য একত্র করে তাঁরা বুঝতে পারলেন—দ্বীপের শতাব্দী পুরনো গর্জনের পেছনে ভয়ের চাদর চাপানো একটি মানবিক ষড়যন্ত্র লুকিয়ে রয়েছে। প্রতিটি নিখোঁজের ঘটনা, হত্যা বা আড়ালে চামড়া ও কুমির পাচারের ঘটনাগুলো মিলিয়ে দেখলে দেখা যায়, সবকিছুই একটি সুসংগঠিত পাচার চক্রের অংশ ছিল। তারা বুঝতে পারলেন যে “অশরীরী কুমির” নামে প্রচলিত সেই অতিপ্রাকৃত ভয়ের গল্প শুধু লোককথা নয়, বরং অপরাধীদের আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য রচিত একটা পরিকল্পনা।

রাধিকা গভীরভাবে বললেন, “দেখো, আমাদের গ্রামগুলোতে যারা সত্যিই কথা বলতে পারে তারা অনেকটাই চুপ থাকে। কারণ এই পাচার চক্র যেমন শক্তিশালী, তেমনই বেপরোয়া। তারা বহু বছর ধরে জায়গাটা নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষকে গর্জনের ভয় দেখিয়ে, রাতে নদীর ধারে কাউকে যেতে দেয় না। যারা যায়, তারা আর ফিরে আসে না, কিংবা নিখোঁজ থাকে।” সমীরণ নথি ঘেঁটে জানতে পারলেন যে, গত দশকে অন্তত পাঁচজন জেলে এবং একাধিক কাঠুরে নিখোঁজ হয়েছেন। তদন্ত প্রতিবেদনগুলো দেখলেই বোঝা যায়, তারা সবই পাচারকারীদের গোপন তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল বা শাস্তি পেয়েছিল। তাই, নদীর ধারে গর্জনের আড়ালে একটি প্রাণঘাতী সন্ত্রাস কার্যক্রম চলছে, যা স্থানীয় মানুষদের দীর্ঘদিন ভীত করে রেখেছে।

একদিন সমীরণ মোক্তারের ওপর সন্দেহ গভীর হয়। তিনি পাল্টা খোঁজখবর শুরু করেন এবং দেখি মোক্তার এখনো পাচার চক্রের সাথে সম্পৃক্ত। সে গোপনে বেশ কয়েকবার রাতের অন্ধকারে নদী পার হয়েছে, যার ফলে সন্দেহ আরও বাড়ে। সমীরণ তার পিছু নেন, দূরের এক তুষারময় সড়কে গিয়ে দেখেন মোক্তার একটি লুকানো ঘরে পাচারকারীদের সাথে গোপন বৈঠকে আছে। সে বৈঠকে সমীরণ জানতে পারে, মোক্তার এখন আর শুধুমাত্র নৌকাচালক নয়, বরং পাচারকারীদের আড়ালে কাজ করার একটি গুপ্ত প্রতিনিধি। তিনি গভীর হতাশা অনুভব করেন, কারণ তাঁর বিশ্বাসঘাতক সেই মানুষটির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে, যার প্রতি তিনি নির্ভর করেছিলেন। কিন্তু সে বিশ্বাসঘাতকতাই ছিল এই সব অন্ধকারের মূল।

রাত্রের নীরবতায় সমীরণ ও রাধিকা পরিকল্পনা করেন, তাদের সংগ্রহ করা প্রমাণ নিয়ে তারা এবার এই পাচার চক্রকে ঘিরে ধরবে। নদীর গর্জনের পিছনে যে প্রকৃত অপরাধ লুকিয়ে ছিল, সেটা এখন সম্পূর্ণ পরিষ্কার। তারা বুঝতে পারল, যে গর্জন আসলে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখতে ব্যবহৃত হয়েছিল, আর ‘অশরীরী কুমির’ শুধুমাত্র একটি ভৌতিক মুখোশ, যার আড়ালে লুকানো হয়েছিল হত্যাকাণ্ড ও পাচার। এই আবিষ্কারে সমীরণের মনে এক অদ্ভুত শান্তি এসে দাঁড়ায়, কিন্তু সে জানে, এই যুদ্ধ এখানেই শেষ নয়। তার সামনে এখনও অনেক ধাপ, অনেক ঝুঁকি রয়ে গেছে, তবে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে এই দ্বীপকে শাস্তির চাদর থেকে মুক্ত করবে।

দশ

রাতের অন্ধকার যেন গভীর সুরে ঢেকে দিয়েছে পুরো দ্বীপটাকে। সমীরণ আর রাধিকা একসঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে মোক্তারের চলাফেরার ওপর নজর রাখছিলেন। তারা জানতেন, আজকের রাতেই অবশেষে পলের আড়ালে থাকা সত্য বেরিয়ে আসবে। নদীর ধারে গর্জনের আওয়াজ আবারও ঘনিয়ে আসছে—যা যেন অপূর্ণ রহস্যের শেষ কড়ির আওয়াজ। মোক্তার এই গর্জনের সাথে এক অদ্ভুত সম্পর্কের মতো, বারবার অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, আবার কোথাও হঠাৎ হাজির হচ্ছে। সমীরণ মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছিলেন, কারণ আজকের রাতেই তাকে মোক্তারকে ধরে ফেলতেই হবে, যতই ঝুঁকি থাকুক না কেন।

হঠাৎ মোক্তারকে নদীর এক ধারে হাতেনাতে ধরা পড়ল। সে দৌড়াতে শুরু করল, বারবার পিছু নিতে চেষ্টা করল। সমীরণ ও রাধিকা তাড়াতাড়ি তাকে আটকানোর চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু মোক্তার ছিল চতুর আর ফুরফুরে। এক মুহূর্তে, নদীর পাশে এসে সে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ল জলের গর্ভে। স্রোতের তীব্র টান তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল অন্ধকারের গভীরে। সমীরণ ও রাধিকা গর্জনের শব্দে উদ্বিগ্ন হয়ে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে রইলেন, প্রত্যাশা ও ভয়ের এক অবর্ণনীয় মিশ্রণ নিয়ে। মোক্তারের সেই ঝাঁপির সঙ্গে যেন শতাব্দীর পুরনো কাহিনি মিলে গেল—যেখানে গর্জনের রাতে কেউ নদীতে হারিয়ে যায় এবং আর ফিরে আসে না।

ঘন কালো জলের নিচে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া মোক্তার যেন স্রোতের সাথে মিলেমিশে এক ভৌতিক বীরত্বগাথা হয়ে দাঁড়াল। গর্জনের শব্দ এবার আরও তীব্র হয়ে উঠল, যেন নদীর গভীর থেকে এক শক্তি কথা বলছে। সমীরণ অবাক হয়েছিলেন, কারণ গর্জনের উৎসটি স্পষ্ট হল—নদীর তলদেশে একটি গুহা, যেখানে স্রোতের চাপ এবং বাতাসের গতিবিধি মিলিয়ে এক অদ্ভুত সুর ও কম্পন সৃষ্টি করে। এই শব্দই গর্জনের মতো শোনা যায়, যা এতদিন দ্বীপবাসীর ভয়ের উৎস। বিজ্ঞান ও বিশ্বাসের এই সংমিশ্রণ তাকে দারুণ অভিজ্ঞতা দিল। তবে তিনি জলরাশির ওপর মনোযোগ দিলে দেখতে পেলেন—পানির ওপর দু’টি সবুজাভ আলো হালকা করে জ্বলছে। যৌক্তিকভাবে সেটা প্রতিফলনের কারণেই হতে পারে, কিন্তু মনকে নিষ্প্রতিবন্ধ করানো যায় না।

সমীরণ সেই সবুজাভ আলোর দিকে বারবার তাকিয়ে থাকলেন। ভেতরে একটা অদ্ভুত অনুভূতি জাগল, যা বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা কঠিন। হতে পারে এই দ্বীপের অতলে এখনও কিছু রহস্যী শক্তি আছে, যা মানুষ বা প্রাণীর আকার ধারণ করতে পারে না। হয়তো সেই “অশরীরী কুমির” সত্যিই আছে—একটি অভিশপ্ত রক্ষক আত্মা, যাকে কেউ কখনো পুরোপুরি বুঝতে পারেনি। রাতের নীরবতা আর নদীর স্রোতের সঙ্গে সেই আলো যেন এক অদ্ভুত গল্প বলছিল, যেটা পুরনো লোককথার সাথে মিশে রয়েছে। সমীরণ জানতেন, আজকের রাত তার জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু করেছে—যেখানে বিজ্ঞান আর রহস্য একসঙ্গে চলতে পারে, এবং সে সেই দু’পথেই হাঁটবে।

সেই রাতের পর থেকে সমীরণ আর রাধিকা বুঝতে পারলেন, সত্য সবসময় সরল হয় না, এবং বাস্তব ও অতিপ্রাকৃতের মধ্যে অনেকবার পার্থক্য ধোঁয়াটে হয়ে যায়। কুমিরদ্বীপের গর্জন শুধু একটি শব্দ নয়, এটি একটি ইতিহাস, একটি সতর্কতা, আর সম্ভবত এক অদৃশ্য রক্ষক আত্মার ডাক। সমীরণ ঠিক করলেন, তিনি এই রহস্যকে একদিন পুরোপুরি প্রকাশ করবেন, তবে সতর্কতার সঙ্গে। কারণ এই দ্বীপের গোপনীয়তা শুধু অতীতেরই নয়, ভবিষ্যতেরও। এবং “অশরীরী কুমির” তার হৃদয়ে একটি চিরস্থায়ী ছাপ রেখে গেছে—যা তাকে চিরকাল স্মরণ করিয়ে দেবে প্রকৃতির অসীম রহস্য আর মানুষের কল্পনার সীমাহীনতা।

সমাপ্ত

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *