তিস্তা বণিক
প্রথম চায়ের কাপ
নতুন চাকরি, নতুন শহর, নতুন সকাল। কৃশানী দত্তের জীবনে সবকিছুই যেন রিস্টার্ট হয়েছে। বেলেঘাটার ছোট ঘর ছেড়ে দক্ষিণ কলকাতার এই গ্লাসে ঘেরা বহুতল অফিসে প্রতিদিন সকালে পৌঁছতে পৌঁছতে তার চেহারায় এক অদ্ভুত ক্লান্তি জমা হয়, আবার ঠিক তেমনই একটা ব্যাকুল উত্তেজনাও। এক মাস হল সে এই কনটেন্ট টিমে যোগ দিয়েছে, কিন্তু এখনও কেউ খুব আপন হয়ে ওঠেনি। অফিসে ঢুকে ডেস্কে বসে, কীবোর্ডে আঙুল ছুঁইয়ে দেওয়া আর মাঝেমধ্যে জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকা—এই নিয়েই তার রোজকার।
আজকের সকালটাও তেমনই ছিল, যতক্ষণ না অবধি সে চোখ তুলে পাশের ডেস্কের দিকে তাকাল। হালকা দাড়ি, চোখে গোল চশমা, হাতে কফির মগ আর মুখে এক শান্ত হাসি। তার ডেস্কে রাখা ছোট কাঠের নেমপ্লেটে লেখা—“অভিরাজ সেন, কমিউনিকেশন টিম।”
কৃশানী চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে থাকতেই ছেলেটি হাসল। “তুমি নতুন, তাই তো?”
কৃশানী একটু চমকে উঠে বলল, “হ্যাঁ… মানে এক মাস মতো হল। কৃশানী।”
অভিরাজ হাত বাড়িয়ে দিল, “অভিরাজ। তোমাদের টিমের লোকজন তো অনেক, কিন্তু তুমিই সবচেয়ে কম কথা বলো মনে হয়।”
একটু অপ্রস্তুত হেসে কৃশানী বলল, “নতুন জায়গায় একটু সময় লাগে বুঝে উঠতে।”
“তবে আমার মনে হয়, গল্প শুরু করতে একটা চায়ের কাপই যথেষ্ট,” বলে সে তার কফির মগটা তুলে দেখাল। কৃশানী হেসে ফেলল। প্রথমবার সে বুঝল, অভিরাজের হাসির মধ্যে কিছু একটা আছে—যেটা ধীরে ধীরে ভরিয়ে দেয় চারপাশ।
এরপর দিনের পর দিন একসঙ্গে কাটতে লাগল। অফিসের ক্যান্টিনের কর্নারে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে চা খাওয়া, লিফটে ওঠার সময় ছোট হাস্যরস, কিংবা দুপুরে একসঙ্গে পাস্তা খেতে খেতে সিনেমার গল্পে হারিয়ে যাওয়া—এই সবকিছুতেই ধীরে ধীরে জমে উঠছিল এক অদৃশ্য বন্ধনের গল্প।
একদিন দুপুরে ক্যান্টিনে বসে কৃশানী জিজ্ঞেস করল, “তুমি সবসময় এত হালকা মেজাজে থাকো কীভাবে?”
অভিরাজ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “হাসতে না পারলে এই কিউবিকলের ভেতর শ্বাস নেওয়া যায় না, জানো? আমি ভাবি, যতক্ষণ আছি, একটু হাওয়া নিয়ে বাঁচি।”
সেই কথাটা কৃশানীর মনে গেঁথে যায়। সত্যিই তো, সে নিজেই তো ভুলে গিয়েছিল হাসতে। অভিরাজের কথাগুলো যেন তার বুকের কোথাও একটা নরম জায়গায় এসে বসে।
তারপর এল সেই শুক্রবার। সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা ছিল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই বৃষ্টি নামল। অফিসের জানালার কাচে টুপটাপ শব্দ পড়ছে। কৃশানী ডেস্কে একা বসে রিপোর্ট টাইপ করছিল, হঠাৎ অভিরাজ পাশে এসে দাঁড়াল।
“চল, একটু হাঁটি?”
“বৃষ্টি হচ্ছে…”
“এই তো মজা। একটা ছাতা আছে আমার কাছে।”
কৃশানী একটু দ্বিধায় পড়লেও শেষমেশ উঠে দাঁড়াল। তারা নিচে নেমে এল। ছাতা একটা, হাঁটছিল পাশাপাশি। হাতখানি ছুঁয়ে যাচ্ছিল মাঝেমাঝে।
“তুমি কবিতা পড়ো?” অভিরাজ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।
“ছোটবেলায় পড়তাম। এখন তেমন সময় হয় না।”
“সময় তো আমরা তৈরি করি, কৃশানী। ভালোবাসার মতো,” বলেই একটু থেমে থাকল।
কৃশানী তার দিকে তাকাল। ছাতার নিচে সেই চোখদুটো যেন আরও গভীর, আরও উষ্ণ লাগছিল। তারা হাঁটছিল গঙ্গার ধারের পথ ধরে। চারপাশে বৃষ্টি, আলো ঝলমলে শহর আর একটানা নিরবতা।
সেই রাতে কৃশানী বাসায় ফিরে এসে জানালার পাশে বসে চুপচাপ বসেছিল অনেকক্ষণ। অদ্ভুতভাবে মনে হচ্ছিল, কিছু একটা শুরু হয়ে গেছে। কোনো অঘোষিত চুক্তি, কোনো না বলা প্রতিশ্রুতি—যার শুরু হয়েছিল প্রথম চায়ের কাপ থেকে।
অফিসের কাজের ফাঁকে যখন অভিরাজ পাশ থেকে বলে ওঠে, “তোমার ওই স্কার্ফটা আজ খুব সুন্দর লাগছে,” তখন তার গাল লাল হয়ে যায়।
যখন সে রিপোর্ট জমা দেওয়ার সময় ভুল করে একটা লাইন বাদ দিয়ে ফেলে, তখন অভিরাজ চুপচাপ ঠিক করে দেয়।
যখন কৃশানী ছুটি নিয়ে বাড়ি যায়, অভিরাজ তাকে “শুভ যাত্রা” মেসেজ পাঠায়।
সব মিলিয়ে তাদের গল্পটা একটা ধীরে ধীরে সুর বাঁধা গান হয়ে উঠছে।
তাদের চারপাশে হাজার কাজ, হাজার মেইল, হাজার ক্লায়েন্টের ফোন—তবু দুই কিউবিকলের মাঝখানে গড়ে উঠছে এক অন্যরকম সম্পর্ক।
এটা প্রেম কি না, তারা জানে না।
তবু তারা জানে, অফিসের একঘেয়ে কিউবিকলের ভেতর কোথাও একটা জানলা খুলেছে।
সেই জানলা দিয়ে ঢুকছে হাওয়া, আর সেই হাওয়াতেই হয়তো উড়ে আসছে ভালোবাসা।
একসাথে ব্রেকিং নিউজ
সোমবার সকালটা ছিল বড্ড অস্থির। অফিসে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কৃশানী টের পেল, আজ যেন সবাই একটু বেশিই হাঁটছে, চায়ের কাপ একটু জোরেই টক্কর খাচ্ছে, আর কীবোর্ডে টাইপের শব্দটা যেন খানিকটা দ্রুত। স্ক্রিনে ব্রেকিং নিউজ: “এয়ারওয়েভ কমিউনিকেশনস মেগা মার্জার—পাঁচ বছরের সর্ববৃহৎ মিডিয়া চুক্তি”।
অফিসের মিডিয়া টিম একেবারে নড়েচড়ে বসেছে। টিম লিডার রঞ্জনা সেন চিৎকার করে বলে উঠলেন, “অভিরাজ, কৃশানী—তোমরা দু’জন ওই প্রেস রিলিজটা ফাইনাল করো। আধঘণ্টার মধ্যে ক্লায়েন্টের মেইলে পাঠাতে হবে।”
কৃশানী একটু ঘাবড়ে গেল। বড় ক্লায়েন্টের প্রেস রিলিজ লেখা, তাও আবার মার্জার বিষয়ক! প্রথম বড় দায়িত্ব বলা চলে। অভিরাজ চোখ তুলে তাকাল, তার চিরচেনা মোলায়েম গলায় বলল, “চিন্তা কোরো না। আমি ড্রাফট স্টার্ট করছি। তুমি ফ্যাক্টসটা একটু ক্রসচেক করে নিও।”
দুজন বসে পড়ল কফি মগ হাতে। অভিরাজ টাইপ করছে, কৃশানী পাশে বসে প্রেজেন্টেশন থেকে ফিগার যাচাই করছে। মাঝে মাঝে চোখাচোখি হচ্ছে, কারও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, কারও ঠোঁটের কোণে স্নিগ্ধ হাসি।
“তুমি এত দ্রুত লিখো কীভাবে?” কৃশানী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“ধাঁ করে লিখি, তারপর পঁচিশবার এডিট করি,” অভিরাজ চোখ না তুলে উত্তর দিল। “তবে তুমি পাশে বসলে লিখতে ভালো লাগে। কী এক অদ্ভুত শান্তি থাকে।”
কৃশানীর কানে যেন হালকা বাজনার মতো লাগল কথাগুলো। সে কিছু বলল না, শুধু মাথা নিচু করে ফাইলটা পড়তে থাকল, কিন্তু মনটা চলে গেল অভিরাজের কণ্ঠে লুকিয়ে থাকা মায়ায়।
ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে রিলিজ রেডি। রঞ্জনা সেন এসে দেখে বললেন, “ওয়াও! দারুণ হয়েছে। তুমি তো একদম প্রো হয়ে গেছো, কৃশানী।”
কৃশানী ধন্যবাদ জানাল, কিন্তু তার চোখ গেল পাশে বসা অভিরাজের দিকে। সে হালকা করে বলল, “দেখলে, একসাথে কাজ করতে কেমন লাগে?”
অফিস শেষ হল। সেই সন্ধ্যেবেলাটা যেন এক অন্যরকম প্রশান্তি নিয়ে এলো। কৃশানী আর অভিরাজ দাঁড়িয়ে ছিল অফিসের নিচে, হালকা আলো, ঠাণ্ডা হাওয়া।
“আজ একটা কফি খেতে পারি তো?” অভিরাজ হঠাৎ বলল।
“আজও?” কৃশানী একটু খিলখিল করে হেসে ফেলল।
“আজ স্পেশাল দিন। প্রথম ব্রেকিং নিউজ কভার করলাম তো একসাথে।”
তারা হাঁটতে হাঁটতে গেল কাছের এক ক্যাফেতে। কৃশানী জানত না কেন, কিন্তু এই সন্ধ্যেগুলো সে আলাদা করে মনে রাখছে। একটা অভ্যস্ততা তৈরি হচ্ছে, যেটা সে আগে কখনো অনুভব করেনি।
ক্যাফেতে বসে অভিরাজ বলল, “তোমার মধ্যে একটা ভরসা আছে, জানো?”
“ভরসা?”
“হ্যাঁ। আমি যখন তোমার দিকে তাকাই, মনে হয়—সব ঠিক হয়ে যাবে। এমনভাবে তাকাতে পারো তুমি।”
কৃশানী চুপ করে রইল। কখনও কখনও কোনো উত্তর না দেওয়াই সবচেয়ে সত্যি কথা বলে দেয়।
অফিসের মধ্যে এবার অন্যরকম কিছু ঘটতে শুরু করল। সহকর্মীরা চোখ টিপে হাসে, কেউ বলে, “এই দ্যাখো, আমাদের অফিস কাপল আসছে,” কেউবা বলে, “সিরিয়াস কিছু চলছে না তো?”
কৃশানী প্রথমে একটু অস্বস্তি বোধ করলেও পরে বুঝে গেল, এটাই হয় যখন কেউ কারো একটু বেশিই আপন হয়ে ওঠে। অভিরাজ এসব নিয়ে হেসে বলে, “ওরা বলবে, ওদের বলতে দাও। তুমি শুধু বোঝো, আমি যা বলছি সেটা আসল।”
“আর তুমি কী বলছো?” কৃশানী মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল।
“আমি বলছি, আমি অপেক্ষা করছি—তোমার একটা ‘হ্যাঁ’-এর জন্য।”
সে রাতটা ছিল নিঃশব্দে শব্দ তৈরি হওয়ার রাত।
তারা কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি, কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি, কিন্তু সেই রাত থেকেই গল্পটা যেন একটু গাঢ় হতে শুরু করল।
কৃশানী বুঝতে পারছিল, সে নিজে নিজের মধ্যেই বদলে যাচ্ছে। অভিরাজ শুধু একজন সহকর্মী নয়, একরকম নির্ভরতার নাম হয়ে উঠছে—একটা ইচ্ছার নাম, যা অফিসের কিউবিকল পেরিয়ে হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে।
একটা কাগজে লেখা স্বপ্ন
অফিসে ঢোকার আগে সকালবেলা বালিগঞ্জ স্টেশনের ফুটওভার ব্রিজটা কৃশানীর কাছে ধোঁয়ায় ঢাকা কবিতা হয়ে উঠেছিল। সে প্রতিদিন ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে এক মুহূর্ত, কানে হেডফোনে রবীন্দ্রসংগীত, আর চোখে রোদ-মাখা শহরের ব্যস্ততা। আজ একটু অন্যরকম লাগছিল। তার ব্যাগে ভাঁজ করা একটা কাগজ—যেটা সে অভিরাজের জন্য লিখেছে, অথচ এখনো দেয়নি।
সেই কাগজটা গতকাল রাতেই লেখা। সব কথা বলা যায় না মুখে, কিছু কিছু অনুভব কাগজেই বেশি প্রাণ পায়। কৃশানী একবার, দু’বার, দশবার পড়েছে সেই চিঠি। আর প্রতিবার পড়ার সময় তার গাল লাল হয়েছে, গলা শুকিয়ে গেছে।
অফিসে ঢুকেই অভিরাজের সঙ্গে দেখা। আজ তার চোখে ঘুম কম, মুখে হালকা গম্ভীরতা।
“রাত জেগেছিলে?” কৃশানী জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ… একটা লেখা জমা দেওয়ার ছিল। তারপর একটু ঘোরার প্ল্যান করছিলাম। কসৌলি যেতে চাইছি কিছুদিনের মধ্যে।”
“ছুটি পাবে?”
“হয়তো না, তবু ভাবতে ভালো লাগে,” বলে হেসে ফেলল অভিরাজ। “তুমি কী ভাবছো?”
কৃশানী কিছু না বলে ব্যাগে হাত দিল, কাগজটা বের করল। অভিরাজের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এটা একটু পরে পড়ো। বাড়ি গিয়ে। এখন না।”
অভিরাজ কাগজটা নিল, চোখ বড় বড় করে বলল, “চিঠি? তুমি তো মেইল ছাড়া কিছু লেখো না!”
“এইটা স্পেশাল মেইল,” মুচকি হেসে বলল কৃশানী।
দিনটা কাটল অন্যান্য দিনের মতো, কিন্তু কৃশানীর মন বারবার ছুটে গেল সেই কাগজটার দিকে। সে জানে, চিঠিটার মধ্যে কোনো অলৌকিক প্রেমের কথা নেই—শুধু কিছু সত্যি অনুভব আছে।
সে লিখেছে—
“তোমার চোখে অনেক কিছু দেখি যেটা আয়নায় আমার নিজের চোখে পাই না। তুমি বলো, আমি শান্তি দিই। অথচ আমিই তো নিজের ভিতরে একটা অস্থির নদী বইয়ে চলি।”
“যেদিন প্রথম তোমার সঙ্গে চা খেলাম, সেদিনের পর থেকেই মনে হয়েছে, শহরটা একটু বেশি বাসযোগ্য। কাজটা একটু কম ক্লান্তিকর।”
“আমি জানি না এটা ভালোবাসা কি না, কিন্তু জানি, যখন তুমি পাশে থাকো, তখন আমার একা লাগেনা। যদি তুমি একদিন অফিস না আসো, আমি অফিসের শব্দে বিরক্ত হই। তুমি এলে, সেই শব্দগুলো সংগীত হয়।”
সন্ধে নামার ঠিক আগে অভিরাজ তার ডেস্কে এসে দাঁড়াল। হাতে ছিল সেই চিঠি।
“পড়েছ?”
সে কিছু বলল না। শুধু মাথা নেড়ে বসে পড়ল কৃশানীর পাশে। কাগজটা টেবিলে রেখে বলল, “তোমার লেখার গন্ধ কেমন জানো? জলপড়া পাতার মতো। খুব নরম।”
“তুমি কি বিরক্ত হয়েছো?”
“পাগল! আমি এতদিন ভেবেছি, এই কথা গুলো কীভাবে বলব। তুমি বলে দিলে। আমার সহজ হয়ে গেল।”
একটা নীরবতা ভেসে এলো।
অভিরাজ বলল, “জানো, আমার জীবনে কখনও চিঠি পাইনি। না স্কুলে, না কলেজে, না প্রেমে। তুমি প্রথম।”
“ভালো না খারাপ?”
“ভালো। ভয়ংকর ভালো।”
হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। রঞ্জনা সেনের নম্বর।
“হ্যাঁ রঞ্জনা?”
“অভিরাজ, একটা ইমার্জেন্সি প্রেজেন্টেশন আছে কাল সকালে। তোমাকেই লিড করতে হবে।”
“বেশ, আমি রেডি। কাল সকাল আটটায় অফিসে থাকছি।”
ফোন রেখে অভিরাজ বলল, “কাল তাড়াতাড়ি আসতে হবে। প্রেজেন্টেশন আছে। চাইলে তুমিও এসো একটু আগে। আমার সাপোর্ট সিস্টেম হয়ে থেকো।”
“আমি তো সেটাই, তাই না?”
“তুমিই তো বলেছো,” হেসে বলল অভিরাজ।
কৃশানী বাড়ি ফেরার সময় জানালার ধারে বসে ভাবছিল—চিঠি, কথাবার্তা, একসঙ্গে রিপোর্ট বানানো, কফির মগ, সবকিছু মিলে এই সম্পর্কটা যেন অজান্তেই গভীর হয়ে উঠছে।
তবু একটা ভয় তার মনে ঢুকে পড়ছে। অফিসে প্রেম মানেই তো বিপদ। গসিপ, জাজমেন্ট, এমনকি হারানোর ভয়।
সে জানে না অভিরাজ এসব নিয়ে কী ভাবে। কিন্তু সে জানে, একটা কাগজে লেখা স্বপ্ন অনেক সময় বাস্তবের থেকেও সাহসী হয়।
এবং সে সাহস আজ সে দেখিয়েছে।
অফিসে গুজব
পরদিন সকালটা শুরু হয়েছিল একেবারে কড়াকড়ি নিয়মে। অভিরাজ সময়মতো অফিসে পৌঁছে প্রেজেন্টেশনের স্লাইডগুলো একবার শেষবারের মতো ঝালিয়ে নিচ্ছিল, আর কৃশানী পাশে বসে নোটস ঠিক করছিল—কে কোন পয়েন্টে কথা বলবে, কোন প্রশ্নে কী উত্তর দেওয়া যায়, তা নিয়েই ব্যস্ততা। কনফারেন্স রুমে ঢোকার আগে তাদের দুজনের চোখে চোখ পড়ল, কৃশানী মৃদু হাসল। অভিরাজ নিচু গলায় বলল, “তুমি পাশে থাকলে আমি সব পারি।”
সেই প্রেজেন্টেশন, টিমের সবার সামনে, এমনকি হেড অফ অপারেশনের সামনেও, অভিরাজ এমনভাবে কথা বলছিল যেন প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা ভঙ্গি আগে থেকেই rehearsed ছিল—কিন্তু শুধু তার সঙ্গে তার পাশে বসা সহযোদ্ধার জন্য। কৃশানীর মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তটা যেন তাদের দুজনের একসাথে জয় করা যুদ্ধ।
প্রেজেন্টেশন শেষে সকলে বাহবা দিল। কেউ বলল, “ওয়াও, ডায়নামিক ডুও!” আবার কেউ বলল, “অভিরাজ আর কৃশানী—টুগেদার অলওয়েজ পারফেক্ট।”
সেইখান থেকেই শুরু হলো ফিসফাস।
লাঞ্চ ব্রেকে ক্যান্টিনে ঢুকতেই দু’একজন চুপচাপ তাকিয়ে হেসে নিল। এক টেবিলে বসে থাকা সঞ্চারী নিচু গলায় কাহিনী বলছিল পাশের সোমকে—“তুই দেখেছিস না? কাল সন্ধ্যায় কফি শপে দেখেছি ওদের। হাসাহাসি, চোখাচোখি… সব স্পষ্ট!”
কৃশানী শুনে ফেলল কথাগুলো। একটা অদ্ভুত সংকোচে ভরে উঠল মুখটা। সে অভিরাজকে বলল না কিছু, কিন্তু মাথার ভিতর একটা চিনচিনে অস্বস্তি শুরু হল।
সন্ধ্যায় ডেস্কে ফিরে কৃশানী জানালার দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। হঠাৎ অভিরাজ পাশে এসে বলল, “চল, আজ বাড়ি যাই একসঙ্গে।”
“না, আজ থাক। আমি একটু পরে যাব।”
“কিছু হয়েছে?”
“না, ঠিক আছি।”
কিন্তু অভিরাজ বুঝতে পারল, কিছু একটা আছে।
সে ধীরে বলল, “লোকজন বলাবলি করছে, জানি। করবেই। আমাদের অফিসের ফ্লোরে AC-এর পাশাপাশি গসিপও ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু তুমি ভয় পেও না, আমি পাশে আছি।”
“আমি ভয় পাই না, অভিরাজ,” ধীরে বলে কৃশানী। “আমি শুধু ভাবছি—আমরা এই জায়গাটাকে ঠিক কেমনভাবে রাখব। আমি চাই না আমার কাজের পরিচয়ের আগে কেউ বলুক, আমি তোমার ‘someone special’।”
“তুমি আমার someone special, এ নিয়ে তো কোনো লুকোছাপা নেই। কিন্তু তুমি তোমার নিজস্ব কাজের জায়গায় আলাদা ভাবে দাঁড়াও, সেটাও আমি জানি। আর আমাদের গল্পটা কি এতটাই হালকা যে গুজবেই ভেঙে যাবে?”
কৃশানী চুপ করে গেল। বাইরে আকাশ কালো হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, বৃষ্টি নামবে আবার।
রাত্তিরে বাড়ি ফিরে কৃশানী ফোনটা বার করে দেখল—অভিরাজ একটা মেসেজ করেছে, শুধু একটা লাইন:
“যদি পৃথিবীটা জাজ করে, তুমি আমার দিকে তাকিও—আমি সব ঠিক করে দেব।”
চোখের কোণে জমে থাকা জল মুছে ফেলল কৃশানী।
সেই রাতেই সে একটা ডিসিশন নিল। পরদিন অফিসে ঢুকে সে নিজের ডেস্কে বসে, কাজ শুরু করার আগে, অভিরাজের ডেস্কের উপর একটা ছোট কাগজ রেখে দিল।
লেখা ছিল—
“চলো, আমাদের গল্পটা আমরা গসিপের আগে সত্যি করে ফেলি।”
অভিরাজ তা পড়ে কাগজটা ভাঁজ করল, বুক পকেটে রাখল, আর ধীরে কৃশানীর দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে শুরু হোক—একটা নতুন অধ্যায়।”
হাতে ধরা হেমন্ত
অফিসে ঢোকার আগে সকালবেলার হালকা রোদ গায়ে এসে পড়তেই কৃশানীর মনে হল, আজকের সকালটা একটু আলাদা। হেমন্ত এসেছে শহরে, হাওয়ায় একটা শুকনো পাতার গন্ধ। অফিসের কাঁচঘেরা করিডোরে হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হচ্ছিল, যেন কারও হাত ধরে হাঁটার ইচ্ছে হচ্ছে, আর সেই হাতটা ঠিক পাশেই আছে—চাইলেই ধরতে পারা যায়।
সেদিনের পর থেকে কিছু বদলেছে। অফিসের লোকজন জানে—তারা এখন একে অপরের “কাছে”। যদিও কেউ মুখে কিছু বলে না, তবু চোখেমুখে হাসি, চায়ের টেবিলে ঠাট্টা, কিংবা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে কিছু ইঙ্গিত—সব মিলিয়ে বোঝা যাচ্ছে, তারা আর অফিসের ছায়া নয়, বরং আলোয় আসা নাম।
কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না।
অভিরাজ আগের মতোই প্রতিদিন কৃশানীর জন্য কফির মগে ল্যাটে নিয়ে আসে, আর ডেস্কে রেখে যায় বলে—”স্মাইল করে খোলো দিনটা।”
একদিন সকালে অফিস ঢোকার আগেই কৃশানী ফোন পেল।
“আজ বিকেলে বেরোবি আমার সঙ্গে?” অভিরাজের কণ্ঠে এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস।
“কোথায়?”
“সারপ্রাইজ। শুধু বলছি—হেমন্তটা হাতে ধরে হেঁটে আসি একটু।”
সেই বিকেলটা যেন কোনও সিনেমার ফ্রেম। তারা গেছিল প্রিন্সেপ ঘাট, যেখানে গঙ্গা একটু বেশি শান্ত, আর আলো একটু বেশি নরম। অভিরাজ সঙ্গে করে এনেছিল ছোট একটা বই—নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতা সংকলন।
“তোমায় একটা কবিতা পড়ে শোনাতে চাই,” সে বলল।
কৃশানী চমকে উঠল।
“তুমি কবিতা পড়ো?”
“তুমি চিঠি লিখলে আমি কবিতা না পড়লে চলে?”
সেই ফাঁকা ঘাটে বসে, তারা দু’জনে শুনল—
“তোমার চোখে প্রেম নেই, তবু আমার বুক কাঁপে
যেমন হেমন্তে কাঁপে পাতার গায়ে পাতার ছায়া।”
কৃশানীর হাতটা অভিরাজের হাতের পাশে রাখা ছিল, কিন্তু এখনও ছোঁওয়া হয়নি। কবিতা শেষ হওয়ার পর, ধীরে ধীরে, বিনা শব্দে, সে নিজের আঙুলটা বাড়িয়ে স্পর্শ করল।
দুই হাতের স্পর্শে কোনো নাটক নেই, কোনও জোয়ার নেই—শুধু এক অবধারিত মৃদুতা।
অভিরাজ বলল, “তুমি জানো, আমি কোনওদিন প্ল্যান করে প্রেম করিনি। কিন্তু তোমার সঙ্গে প্রতিটা মুহূর্ত নিজে থেকেই কবিতায় পরিণত হচ্ছে। আমি চাই না এটাকে সংজ্ঞা দিতে, শুধু চাই বাঁচিয়ে রাখতে।”
কৃশানী বলল, “সংজ্ঞা দিলে মানুষ খোঁজে যুক্তি। আমি চাই শুধু অনুভব হোক।”
সন্ধ্যে নামছিল। গঙ্গার ওপার থেকে আলোর রেখা ভেসে আসছিল। ঘাটের ধারে কিছু নৌকা, কিছু কপোত-কপোতী, আর তাদের মাঝখানে তারা—দুজন অফিসে দেখা হওয়া, ফাইল আর প্রেজেন্টেশনের ভিড়ে প্রেম খুঁজে পাওয়া মানুষ।
ফেরার পথে দুজন চুপচাপ হাঁটছিল। কৃশানীর কাঁধে অভিরাজের হাত এল, খুব স্বাভাবিকভাবে। কৃশানী কিছু বলল না, শুধু একটু কাছে এল।
তারা বুঝেছিল—এই শহরের মাঝে, অফিসের ব্যস্ততার ভেতরেও একটা স্পেস তৈরি হয়েছে, যেখানে তারা একে অপরকে ছুঁয়ে থাকতে পারবে, একটু একটু করে বুঝে নিতে পারবে।
পরদিন সকালে কৃশানী যখন ডেস্কে এসে বসল, দেখতে পেল ডেস্কে একটা পাতা রাখা—বেলগাছের শুকনো পাতা। তার ওপরে কালো পেন দিয়ে লেখা—
“তোমার নামটাই আমার হেমন্ত।”
সে হেসে ফেলল। চারপাশের ফ্লোরে হাজার শব্দ, ক্লিক ক্লিক মাউস, ফোনের আওয়াজ—সব ছাপিয়ে একটা কথাই তখন তার কানে বাজছিল।
প্রেম শুধু একটা চুমু নয়, একটা প্রপোজাল নয়—প্রেম মানে কখনও কখনও, কারো ডেস্কে বেলপাতা রেখে যাওয়ার সাহস।
সেই সাহস তাদের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে, প্রতিদিন একটু করে।
ভাঙা ছুটির গল্প
অফিস কিউবিকলের চিরচেনা হিউম দিয়ে মোড়ানো বাতাসের মধ্যে আজ কৃশানী একটু বেশি ক্লান্ত। মাথার ভিতর গুঞ্জন করছে হাজার শব্দ, অথচ মন স্থির নয়। সে জানে না কেন, আজ সকাল থেকেই অভিরাজ ফোন ধরছে না, হোয়াটসঅ্যাপে একটা ছোট্ট নীল টিক চুপচাপ বসে আছে, অথচ ‘typing…’ লেখা আসছে না।
পাঁচদিন আগে হঠাৎই অভিরাজ বলেছিল, “চলো না, দার্জিলিং যাই। চারদিন ছুটি নিয়ে চলে যাই কলকাতার বাইরে।”
কৃশানী একটু থমকে গিয়েছিল।
“তুমি আর আমি? একসঙ্গে ঘুরতে?”
“হ্যাঁ। প্ল্যান করে তো কোনোদিন কিছু করিনি। এই প্রথম করব—তুমি আর আমি, চারদিনের ছুটি, চারটা গল্প, একটা নতুন অধ্যায়।”
কৃশানী বুঝে গিয়েছিল, এই ছুটিটা শুধুই পাহাড় দেখার ছুটি নয়। এটা একসঙ্গে থাকার সাহস, একসঙ্গে থাকার বাস্তবতা যাচাইয়ের এক ধাপ।
তবে আজ সকালেই খবর এল, অভিরাজ ছুটি বাতিল করেছে। অফিসে জরুরি মিটিং, প্রেস ক্লায়েন্টের রিপোর্ট—এইসব কারণ দেখিয়ে ছুটি ক্যান্সেল করেছে সে।
কিন্তু কৃশানীর কাছে সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো—অভিরাজ কিছু জানাল না।
সে পুরোটা জানল রঞ্জনা সেনের মুখে—“অভিরাজ কাল রাতে মেইল করেছে, ছুটি নিচ্ছে না। তুই জানিস না?”
সে তখন শুধু মাথা নাড়াল, একটা মেকি হাসি দিয়ে বলল, “ও আমাকে বলতে ভুলে গেছে মনে হয়।”
ভিতরে ভিতরে তীব্র এক অস্বস্তি জন্ম নিচ্ছিল কৃশানীর।
দুপুরে ক্যান্টিনে সবার মাঝে হাসতে হাসতে সে বসেছিল ঠিকই, কিন্তু অভিরাজকে কোথাও দেখতে পেল না। ফোন করেছিল, রিং হয়ে কেটে গেছে।
ফেরার সময় সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সে অভিরাজকে দেখতে পেল বাইক স্ট্যান্ডে। তার চোখে সানগ্লাস, মুখে সেই চিরাচরিত অভ্যস্ত হাঁসি।
“তুমি ছুটি নিলে না?” কৃশানী সরাসরি বলল।
“না, অনেক কাজ আছে। ফাইলগুলো জমা না দিলে সমস্যা হত। বুঝতেই পারছো…”
“কিন্তু আমাকে জানালে না কেন?”
“ব্যস্ত ছিলাম রে। তুই তো বুঝিসই, অফিসে কত চাপ।”
সেই ‘তুই তো বুঝিস’ কথাটাই যেন কাঁটার মতো বিঁধল কৃশানীর মনে। সে তো এতদিন ধরে একসঙ্গে কাজ করেছে, পাশে থেকেছে, গল্প ভাগ করে নিয়েছে। এখন কি সে শুধু বোঝার মানুষ হয়ে গেছে?
সে নিচু গলায় বলল, “তুমি চাইলেই বলতে পারতে, অভিরাজ। শুধু একটা মেসেজ। একটা লাইন। তাও দিলে না?”
অভিরাজ মাথা নিচু করল না। সে দাঁড়িয়ে বলল, “হয়তো আমি একটু নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। সব সময় সব কিছুর ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না।”
“তবে সব সম্পর্ক ব্যাখ্যার অভাবে ভাঙেও, জানো?” কৃশানীর গলা কাঁপছিল, কিন্তু চোখে জল আসেনি।
সেই সন্ধ্যায় সে একা হেঁটে ফিরল গঙ্গার দিকে। প্রিন্সেপ ঘাটের পাথরের সিঁড়িতে বসে রোদমাখা আকাশ দেখতে দেখতে মনে পড়ল সেই কবিতার লাইন—
“তোমার চোখে প্রেম নেই, তবু আমার বুক কাঁপে…”
তবে আজ কাঁপা বুকটা একা। আজ পাশে কেউ নেই যাকে কাঁপা শব্দে বলা যাবে, “তুমি আমাকে ব্যথা দিয়েছো।”
রাতে বাসায় ফিরে ব্যাগ থেকে বের করল সেই টিকিট বুকিংয়ের প্রিন্টআউট। তার সঙ্গে ছোট কাগজে লেখা ছিল—
“দার্জিলিং যাওয়া মানে শুধু পাহাড় নয়, তুমি আমার পাশে থাকবে কি না, সেটা জানা।”
সেই কাগজটা ছিঁড়ে ফেলল না সে। বরং রেখে দিল বুকশেলফের একেবারে পেছনের দিকে—হয়তো কোনো একদিন, গল্পটা আবার শুরু হবে এখান থেকেই।
ভাঙা ছুটির মতোই কিছু অনুভব থাকে, যা কখনও পূর্ণতা পায় না, তবু অর্ধেক থেকে গিয়েও আমাদের পাল্টে দেয়।
দূরত্বের মাইলেজ
অভিরাজ আর কৃশানীর মাঝে একটা অদৃশ্য দেয়াল দাঁড়িয়ে গেছে—না সেটা চোখে দেখা যায়, না ছুঁয়ে ফেলা যায়, তবু প্রতিটা কথার মাঝখানে, প্রতিটা ভাঙা হাসির ফাঁকে, সেই দেয়ালের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়।
গত কয়েকদিনে কৃশানী খেয়াল করেছিল, অভিরাজ আগের মতো হেসে উঠে বলে না, “চল কফি খাই,” বা সকালে অফিসে ঢোকার সময় আর “গুড মর্নিং” বলে না তাকিয়ে।
সব কথার মধ্যে যেন একটা ক্লান্তি, একটা নিরুত্তাপতা জড়ানো। অফিসের মাঝে থেকেও দুজন যেন একে অপরের থেকে অনেক দূরে—সামান্য দূরত্ব, অথচ অসহনীয়।
একদিন সকালের মিটিং শেষে কৃশানী নোটস লিখছিল ডেস্কে বসে। অভিরাজ পাশ দিয়ে গেল, কিন্তু বলল না কিছু। কৃশানী ইচ্ছে করেই জিজ্ঞেস করল, “আজ আর কথা বলবে না?”
অভিরাজ থেমে বলল, “কথা বলে কী হবে, কৃশানী? অনেক কথা তো বলেছি। তাও তো ঠিক কিছু হয়নি।”
“সবকিছু ঠিক হওয়ার কথা ছিল না। শুধু বোঝার চেষ্টা—তুমি করলেই হতো।”
“তুমি জানো না, আমি নিজের সঙ্গে লড়ছি। আমি ভয় পাই—কোনো কিছু বড্ড কাছের হয়ে গেলে সেটা হারিয়ে যায়। আগেও হয়েছে। তাই এবার একটু দূরে থাকতে চেয়েছিলাম, যাতে হারানোর ভয়টা না থাকে।”
“আর তাতে যা ছিল, সেটাও হারিয়ে যেতে বসেছে,” কৃশানীর কণ্ঠ ভেঙে গেল।
সেই মুহূর্তে অফিসে ফোন বেজে উঠল। রঞ্জনা ডেকে পাঠাচ্ছেন। কথোপকথনের মাঝখানেই তারা থেমে গেল। আর ঠিক যেমন হয়, জীবন মাঝখানে কথা রেখে এগিয়ে যায়।
সেই রাতেই কৃশানী একা একটা মেসেজ টাইপ করল—
“তুমি হয়তো ঠিকই বলেছ, খুব কাছে আসলেই ভয় হয়। কিন্তু আমি তো হারানোর ভয় পেয়ে নয়, ভালোবাসার সাহসে পাশে ছিলাম।”
মেসেজটা পাঠাল না। শুধু সেভ করে রাখল।
পরদিন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। কৃশানীকে HR ডেকে বলল, “তোমাকে দু’সপ্তাহের জন্য মুম্বাই অফিসে ট্রানজিশন প্রজেক্টে পাঠানো হচ্ছে। সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট বলেছে, তুমিই ফিট।”
মাথা ঘুরে গেল কৃশানীর। নতুন শহর, নতুন লোক, নতুন ওয়ার্কফ্লো—সবই ঠিক আছে। কিন্তু অভিরাজ?
সে নিজেকে সংযত রেখে বলল, “ঠিক আছে। কবে যেতে হবে?”
“এই শুক্রবার।”
অফিস থেকে বেরিয়ে সেদিন কৃশানী নিজেই অভিরাজের ডেস্কে এল। তার কাঁধে হাত রাখল।
“আমি মুম্বাই যাচ্ছি। দু’সপ্তাহের জন্য।”
অভিরাজ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “ভালো হবে। দূরত্ব কখনও কখনও ভেতরের সত্যিটা বুঝিয়ে দেয়।”
“তবে একটা কথা বলো,” কৃশানী চোখে চোখ রেখে বলল, “দূরত্বটা যদি সত্যিই বুঝিয়ে দেয়, যে আমরা থাকতেই পারতাম… তখন কি ফিরে আসবে?”
অভিরাজ মুখ ফিরিয়ে নিল। “আমি জানি না।”
সেই ‘জানি না’ শব্দটা সেদিন হাওয়ার মতো গায়ে লেগে রইল কৃশানীর।
শুক্রবার সকাল। মুম্বাইগামী ফ্লাইটে বসে জানলার ধারে বসেছিল কৃশানী। শহরটা নিচে ছোট হয়ে আসছিল, আর তার চোখে কেবল অভিরাজের মুখ ভাসছিল—অস্ফুট, অস্পষ্ট, অথচ কাঁপানো এক স্মৃতি হয়ে।
কখনও কখনও দূরত্ব শুধু কিলোমিটারে মাপা যায় না। কারো ‘না বলা’ কথাও হাজার মাইল দূরের চেয়ে বেশি অস্পর্শীয় হয়।
মুম্বাইয়ের অচেনা রাস্তায় নামতে নামতেই কৃশানী বুঝে ফেলল—এই গল্পটা সহজ হবে না।
তবু তার বুকের মধ্যে একটা আলতো প্রশ্ন বেজে চলছিল,
“ফিরে আসবে তো?”
মুম্বাই ডায়েরি
মুম্বাইয়ের শহরটা কৃশানীর কাছে একেবারে নতুন, অথচ অদ্ভুতভাবে চেনা মনে হচ্ছিল। হয়তো ছোটবেলায় দেখা সিনেমা, নাকি বৃষ্টিভেজা মেরিন ড্রাইভের গল্প, যেখান থেকে স্বপ্নের শুরু হয়েছিল। কিন্তু আজ সেই স্বপ্নের মধ্যে কোথাও একধরনের ফাঁকা জায়গা থেকে যাচ্ছে—একটা শূন্যতা, যেটা অভিরাজের না থাকাকে ঘিরে।
মুম্বাই অফিসের লোকজন আন্তরিক, কাজের চাপও প্রচুর। সকাল ন’টা থেকে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত শুধু মিটিং, মেইল, প্রেজেন্টেশন। তবু কৃশানী নিজের ব্যস্ততার মাঝে অভিরাজের একটা মেসেজ খুঁজে বেড়ায়। প্রথম দুদিনে কিছুই এল না। না কোনো হোয়াটসঅ্যাপ, না ইমেল, না কোনোরকম “তুমি কেমন আছো?” টাইপ একটি ছোট্ট বার্তাও।
তৃতীয় দিন রাতে মেরিন ড্রাইভে বসে কৃশানী নিজের মুঠোফোনে নিজেরই পুরোনো চিঠি খুলে পড়ছিল। সেখানে লেখা ছিল—
“আমি জানি না এটা প্রেম কি না, কিন্তু জানি, যখন তুমি পাশে থাকো, তখন আমার একা লাগে না।”
এখন পাশে কেউ নেই, আর একা লাগছে ঠিক সেই জায়গায় যেখানে একদিন একসঙ্গে বসার কথা ছিল।
চতুর্থ দিন সকালে প্রথমবার অভিরাজের মেসেজ এল—
“Hope the new office is treating you well.”
তিন লাইন। কোনো আবেগ নেই, কোনো প্রশ্ন নেই, শুধু অফিসিয়াল সৌজন্য।
কৃশানী ফোন বন্ধ করে দিল। সে ঠিক করল, আজ আর অপেক্ষা করবে না।
তবু রাত বাড়তে থাকলে মানুষ অপেক্ষার মুখোমুখি হয়েই পড়ে। মুম্বাইয়ের সেই অচেনা রুমে বসে কৃশানী নিজের ডায়েরির পাতা খুলে লিখল—
“আজ মেরিন ড্রাইভে বসে তোমার মুখ মনে পড়ল না। পড়ল তোমার না বলা কথা, তোমার চোখের ভেতরে রাখা যে ভয়টা তুমি লুকাতে পারো না—সেটা। আমি জানি, তুমি নিজেকেই ভালোবাসতে শিখো নি এখনও। তাই কাউকে ভালোবাসার ক্ষমতাটাও তোমার নিজের সঙ্গে লড়ছে প্রতিদিন। আমি তোমার হয়ে লড়তে পারি না। পারি শুধু অপেক্ষা করতে।”
পরদিন মুম্বাই অফিসে বড় একটা ক্লায়েন্ট মিটিং ছিল। কৃশানী সবার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, বুঝিয়ে যাচ্ছিল তাদের কনটেন্ট স্ট্র্যাটেজি। তার কণ্ঠে ছিল দৃঢ়তা, চোখে আত্মবিশ্বাস, অথচ ভিতরে কোথাও একটা দীর্ঘশ্বাস জমে ছিল।
মিটিং শেষে মুম্বাই টিমের কেউ একজন বলল, “তুমি ভীষণ পেশাদার, কিন্তু তোমার চোখে যেন কেউ লুকিয়ে আছে।”
কৃশানী হেসে ফেলল।
“হয়তো তাই।”
সপ্তাহের শেষে হঠাৎ এক সন্ধ্যায়, যখন ঝড়ের মতো বৃষ্টি নেমেছে মুম্বাইয়ে, ঠিক তখনই কৃশানীর দরজায় কড়া নাড়ল কেউ।
সে দরজা খুলে চমকে উঠল।
সামনে দাঁড়িয়ে অভিরাজ। ভেজা চুল, কাঁধে ব্যাগ, চোখে সেই চিরচেনা দৃষ্টি—যেটা ব্যাখ্যার চেয়ে গভীর।
“তুমি এখানে?”
“হ্যাঁ। আজ সকালেই ফ্লাইট ধরে চলে এলাম। অপেক্ষা করতে পারছিলাম না আর।”
“তুমি তো দূরে থাকতে চেয়েছিলে…”
“হ্যাঁ, কিন্তু আমি বুঝেছি, দূরত্ব কিছু শিখিয়ে দেয় ঠিকই, কিন্তু সব কিছু ঠিক করে না। তবু আজ এখানে দাঁড়িয়ে, আমি শুধু একটা কথাই বলতে এসেছি।”
কৃশানী চুপ করে তার চোখে তাকিয়ে ছিল।
অভিরাজ ধীরে বলল—
“তুমি আমার জীবনের একমাত্র এমন নাম, যেটা দূরত্বেও মুছে যায় না।”
কৃশানীর চোখে জল এল না, হাসিও এল না। শুধু দু’পা এগিয়ে এসে সে বলল, “তবে এবার ভিতরে এসো। গল্পটা শুরু হোক নতুনভাবে।”
আর সেই রাতে, মুম্বাইয়ের বৃষ্টিতে ভিজে, তারা দু’জন একসঙ্গে ছিল—শব্দহীন, প্রশ্নহীন, শুধু একসাথে।
ফেরার পথে নাম
মুম্বাইয়ের সেই বৃষ্টিভেজা রাতে কৃশানী আর অভিরাজের মাঝের দূরত্বটা যেন ধুয়ে-মুছে গিয়েছিল। কোনো নাটকীয় দৃশ্য নয়, কোনো চুমু নয়, শুধু পাশাপাশি বসে থাকা, এক কাপ আদা চা আর জানালার কাচে টুপটাপ শব্দে গড়িয়ে পড়া জল—এইটুকু দিয়েই তারা বুঝেছিল, আবার শুরু করা যায়।
পরদিন সকালে কৃশানী উঠে দেখে, অভিরাজ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে, হাতে কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট।
“এটা তোমার জন্য,” সে বলল।
প্যাকেট খুলে দেখে কৃশানী, একজোড়া কাগজের তৈরি কানের দুল—হাতের কাজ। অভিরাজ নিজে বানিয়েছে।
“স্মৃতি পকেটে রেখে দেওয়ার জিনিস নয়, পরা যায়,” অভিরাজ হেসে বলল।
“তুমি আগে এমন ছিলে না,” কৃশানী মৃদু ভ্রু কুঁচকে বলল।
“তুমি আমায় বদলে দিয়েছো,” উত্তর এল।
সেই সকালটা মুম্বাই শহরের ট্রাফিকের মতোই ভারী ছিল, অথচ দুজনের মধ্যে ছিল একধরনের নিঃশব্দ স্বস্তি। তারা জানত—সবকিছু হয়তো ঠিক হয়ে যায় না, কিন্তু ইচ্ছেটা থাকলে আবার শুরু করা যায়।
দু’দিন পর কৃশানী কলকাতায় ফিরল। ফ্লাইট থেকে নামার পর প্রথম ফোনটা সে করল মাকে, দ্বিতীয়টা অভিরাজকে।
“পৌঁছে গেছো?”
“হ্যাঁ। শহরটা আবার আমার মতো করে গন্ধ দিচ্ছে,” সে বলল।
“কাল অফিসে দেখা হবে?”
“হবে।”
সেই দেখা, অফিসের সেই প্রথম সকালটা—কেমন যেন অচেনা লাগছিল। চারপাশের লোকেরা যেভাবে তাকাচ্ছিল, যেন একটা নতুন গল্পের শুরু দেখছে।
কিন্তু এবার কৃশানী আর পাত্তা দিল না।
সে জানে, সম্পর্ক লুকিয়ে রাখা যতটা কঠিন, ঠিক ততটাই কঠিন তাকে ভাঙার ভয় নিয়ে বাঁচা।
কিছুক্ষণ পরেই অভিরাজ এসে দাঁড়াল কৃশানীর ডেস্কে।
“চা হবে?”
“হবে,” কৃশানী বলল, হেসে।
দুজন চা নিয়ে ক্যান্টিনে গেল। আজ তারা আর আলাদা করে বসেনি। একই পাশে বসে ছিল। গসিপের চোখের সামনে থেকেও তাদের চুপচাপ একসাথে বসে থাকা—তাদের গল্পের প্রকাশ্য ঘোষণা।
অফিসের এক সহকর্মী মজা করে বলল, “এবার তো অফিশিয়ালি কাপল!”
অভিরাজ হেসে বলল, “আপাতত শুধু কাপ আর চা পর্যন্ত পৌঁছেছি। বাকিটা সময় বলবে।”
সবাই হেসে উঠল।
তারা জানে, কাজের চাপ থাকবে, বিতর্ক থাকবে, হয়তো ভুল বোঝাবুঝিও হবে। কিন্তু এবার তারা একসাথে এসব পার করে যেতে চায়।
সন্ধ্যেবেলা অফিস ছুটির পর, তারা পাশাপাশি হাঁটছিল।
“তুমি কি এখনো ভয় পাও, অভিরাজ?”
“পাই। কিন্তু তোমার পাশে দাঁড়িয়ে ভয়টাকে একটু একটু করে ছোট মনে হয়।”
“আমিও ভয় পাই,” কৃশানী বলল।
“তাহলে আমরা একসাথে ভয় পেতে পারি,” অভিরাজ উত্তর দিল, হাসি গলায়।
সেই সন্ধ্যায় তারা গিয়েছিল গঙ্গার ধারে। সেই জায়গায়, যেখানে একদিন অভিরাজ কবিতা পড়েছিল।
আজ কৃশানী তার ব্যাগ থেকে একটা ছোট কাগজ বার করল।
“তোমার জন্য কিছু লিখেছি,” সে বলল।
“তুমি যেদিন কথা বললে না, আমি একা বসে রইলাম
কিন্তু জানলা বন্ধ করিনি।
হাওয়ারা এসে যদি তোমার নামে কোনও শব্দ রাখে,
তাতে যেন আমার ডাক শোনা যায়।”
অভিরাজ কাগজটা হাতে নিয়ে বলল, “তবে এবার আমারও কিছু বলা উচিত।”
সে কৃশানীর দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি আমার ভোর। যখন আলো আসে, আমি আর তোর রাত্রির গল্প মনে রাখতে চাই না।”
ফিরে আসার পথে তারা জানত—শুধু অফিস প্রেম নয়, এটা দুজন মানুষের একসঙ্গে হাঁটার গল্প।
ভবিষ্যতে কী আছে জানা নেই, কিন্তু তারা জানে, নাম আর নামে লেখা গল্প, যখনই ফিরে আসে, সেটা নতুন ভাবে জন্ম নেয়।
আর তাদের গল্প এখন শুধু একটা ‘ফিরে আসা’ নয়—
একটা নাম।
একটা হাতে ধরা ভালোবাসা।
একটা অফিসে শুরু হওয়া গল্প, যা এবার জীবন হয়ে উঠছে।
কিউবিকলের বাইরেও আমরা
বছরের শেষ দিন। ক্যালেন্ডারে লাল গোল করে ঘেরা তারিখ—৩১শে ডিসেম্বর। অফিসের করিডোরে রঙিন বাতি ঝুলেছে, রিসেপশনে ছোট একটা কেক রাখা, আর লাঞ্চের পর সবাই মুখর। কেউ সেলফি তুলছে, কেউ গসিপ করছে, কেউ বা প্ল্যান করছে কোথায় পার্টি যাবে সন্ধেয়।
অফিসের এই শেষদিনে কৃশানী ডেস্কে বসে একটু অন্যরকম অনুভব করছিল। এক বছর আগেও সে ছিল এই অফিসে এক নতুন কর্মী, পরিচিতদের ভিড়ে অচেনা, নিজের মতো চুপচাপ। আর আজ—তাকে নিয়ে কুইজ চলছে টিমের মধ্যে, অভিরাজ পাশে বসে, টুকটাক হাসি-ঠাট্টা, আর কেউ বলছে, “এই দু’জনকে আলাদা ভাবতেই পারি না।”
তারা একসঙ্গে ফাইল বানায়, ক্লায়েন্ট হ্যান্ডেল করে, আর একসঙ্গে ছুটি কাটায়, সিনেমা দেখে, কবিতা শোনে। কৃশানী ভাবছিল, এত কিছু বদলে গেল কীভাবে?
হয়তো ধীরে ধীরে।
হয়তো প্রতিদিন এক কাপ কফির সঙ্গে সঙ্গে একটা করে অভ্যাস ভাগ করে নিতে নিতে।
বিকেলে একটা ছোট ‘ফান অ্যাক্টিভিটি’ চলছিল—সবাই মজায় লিখছিল, নতুন বছরে কার জন্য কী বিশেষ বার্তা আছে। ছোট ছোট চিরকুটে সবাই নাম না লিখে কিছু কথা লিখে রাখছিল একটা বক্সে। শেষে সেই চিরকুটগুলো সবাইকে ভাগ করে দেওয়া হল।
কৃশানীর হাতে এল একটা সাদা কাগজ। তাতে লেখা—
“তুমি আমার প্রথম সকাল, প্রথম সাহস, প্রথম ঘরে ফেরা। কিউবিকলের বাইরেও তুমি আমার পৃথিবী। – T”
সে থেমে গেল। চোখের কোণে হালকা জল। ‘T’ মানে সে জানে কে। অভিরাজ কিছু বলেনি, কিন্তু পাশে বসে ছিল। মাথা নিচু, মুচকি হাসি ঠোঁটে।
কিছু কথা মুখে না বললেও বোঝা যায়।
সন্ধ্যেতে সবাই যখন বেরিয়ে যাচ্ছে পার্টিতে যাওয়ার জন্য, তখন কৃশানী আর অভিরাজ ছাদে উঠল। বেলেঘাটার আকাশে তারারা আজ একটু বেশি ঝলমল করছে বলে মনে হল।
“এই এক বছরে কী শেখালে তুমি আমাকে, জানো?” অভিরাজ বলল।
“কি?”
“ভালোবাসা মানে প্রোপোজ করা নয়, বা হঠাৎ চুমু খাওয়া নয়। ভালোবাসা মানে পাশে থাকা। অফিসের শত ব্যস্ততার মধ্যেও একফোঁটা চোখাচোখি, যা বলার মতো অনেক কিছু। আমি ভাবতাম, প্রেম আমাকে আটকে দেবে। আর তুমি প্রমাণ করলে, প্রেম আমাকে মুক্তি দিতে পারে।”
কৃশানী কিছু বলল না।
সে জানত, গল্পটা এভাবেই শেষ হওয়া উচিত—একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা, একে অপরের চোখে নতুন বছর খোঁজা, আর বুঝে যাওয়া—কিউবিকলের গণ্ডির মধ্যেও শুরু হতে পারে একটা জীবন।
কিছুক্ষণ পর অভিরাজ তার হাতে একটা ছোট রিং গুঁজে দিল। প্লাস্টিকের, কাঁচা, একদম মজার।
“এটা কোনো প্রপোজাল না,” সে বলল। “এটা শুধু মনে রাখার জন্য, আমরা একদিন এখানে দাঁড়িয়েছিলাম, আর বলেছিলাম—আমরা কিউবিকলের বাইরেও একসাথে থাকতে চাই।”
কৃশানী রিংটা হাতে পরল।
তারপর তারা দু’জনে হেঁটে গেল রাস্তার ধারে, হ্যান্ড-হোল্ডিং নয়, কিন্তু পাশাপাশি।
তাদের সম্পর্ক হয়তো কোনো দ্যুতি নিয়ে শুরু হয়নি, কিন্তু তার ভেতরে ছিল সত্যিকারের জ্যোতি।
একটা অফিসের গল্প, একটা চায়ের কাপ, একটা ভুলবোঝাবুঝি, আর সেইসব পেরিয়ে দাঁড়ানো দুটি মানুষ।
আজ তারা জানে—ভালোবাসা শুধু ব্যক্তিগত নয়, ভালোবাসা পেশাগত জায়গার মাঝেও বাসা বাঁধতে পারে।
আর কিউবিকলের পাশ থেকে যে গল্পটা শুরু হয়েছিল, সেটা এখন পরিণতি পেয়েছে—
কিউবিকলের বাইরেও, আমরা।
— সমাপ্ত —