Bangla - নারীবিষয়ক গল্প - ভ্রমণ

কাশ্মীর, চারটি হৃদয়

Spread the love

ঋতা মিত্র


উত্তরের ডাক

কলকাতার এক গরম বিকেল। ছেলের হোমওয়ার্ক শেষ করিয়ে চায়ের কাপ হাতে বসেছিল মেঘনা। জানলার ধারে বসে থাকা সেই একচিলতে সময়টা তার খুব নিজের। সোফার পাশের টেবিলে পেতলের কেটলিতে আধখানা কফি পড়ে আছে, ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মনের ভেতরটা তখন উত্তপ্ত—আবারও সেই পুরনো ক্লান্তি, কেটে যাওয়া দিনের ভার।

হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল—ইরা কলিং।

“হ্যাঁ বল, তুই কেমন আছিস?” মেঘনা কথা বলতে বলতেই জানলার বাইরে তাকাল।

“শুনবি? এবার আর ভাবনা নয়—চল, পালিয়ে যাই। দু-একদিনের জন্য, কাশ্মীর ঘুরে আসি?”

ইরার গলায় যেন একটা অদ্ভুত আবেগ, মেঘনার শরীরের ভিতর দিয়ে ঠান্ডা একটা শিহরণ বয়ে গেল।

“সত্যি বলছিস?”

“একদম। আর শুধু আমি আর তুই না—রূপা আর শ্রীময়ীকেও বলব। চারজনে একসাথে, আর কেউ না। একবার নিজের জন্য বাঁচা যাক না!”

মেঘনা একটু থেমে বলল, “আচ্ছা, করেই ফেলি তবে।”

‘জাস্ট আস, উইথ কফি’—এই নামে হোয়াটসঅ্যাপে একটা নতুন গ্রুপ তৈরি হল। চার বান্ধবী—মেঘনা, ইরা, রূপা, শ্রীময়ী—সেই গ্রুপে সকাল, দুপুর, রাতে কথা বলতে লাগল। কেউ বলছে সোনারগাঁওয়ের শাড়ি আনতে হবে ঠান্ডার জন্য, কেউ খুঁজছে হাউসবোট বুকিংয়ের লিংক।

রূপা একটু চিন্তায় ছিল। স্বামী অর্ণব গত ছ’মাস ধরে একটানা কাজ করছে, ছেলের স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা সামনে, আর শ্বশুরমশাইয়ের হাঁটুর ব্যথাটা নতুন করে শুরু হয়েছে।

“জানিস মেঘু, আমার একটু ভয় করছে। যাব কি না বুঝতে পারছি না,” রূপা একদিন রাতে ফোনে বলল।

“শোন, তোদের সবাইকে সামলাস, ঠিক আছে। কিন্তু নিজের কথাটাও শুনে দেখ। এই কয়টা দিন যদি নিজেকে দিস, তোর মনটাই তো ঠিক হয়ে যাবে।”

রূপা চুপ করে গেল। মেঘনার কথাগুলো তার হৃদয়ের কোথায় যেন বাজল।

৫ এপ্রিল, ২০২৪

চার বান্ধবী পৌঁছাল শ্রীনগর। ডাল লেকের ধারে নেমে প্রথমে তারা এক মুহূর্ত নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল। যেন স্বপ্নে এসেছে, সেই ছবির মতো জল, সেই বরফঢাকা পাহাড়, আর সেই শান্ত হাওয়া—যেটা কেবল গল্পে পড়া হত।

“এই জলে আমার যেন কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি,” মৃদু হেসে বলল শ্রীময়ী।

তার কথা শুনে বাকিরা তাকাল।

শ্রীময়ী, শাখারীপাড়ার মেয়ে, এখন স্কুলের ইংরেজির শিক্ষিকা। স্বামী চলে গিয়েছে বহু বছর, ছেলেকে একাই মানুষ করছে। তার হাসির আড়ালে একটা দীর্ঘ একাকীত্ব আছে, সেটা ওরা জানে।

“তোর কান্নার সঙ্গে আমার ক্লান্তি মিশিয়ে দিলে, এই জল আরও গভীর হয়ে যেত,” বলল ইরা।

তারা হেসে উঠল। সেই হাসিতে ছিল ক্লান্তি, ছিল অভিমান, আর ছিল নতুন একটা জগতের সম্ভাবনা।

হাউসবোটে পৌঁছে সবাই জুতো খুলে পা ডুবিয়ে দিল জলে। জল ঠান্ডা, কিন্তু আরামদায়ক।

মেঘনা বলল, “এই পাঁচদিন কেউ অফিসের মেইল দেখবে না, কেউ হোয়াটসঅ্যাপে ক্লাসরুম আপডেট দেবে না, কেউ ঘরের বাজার নিয়ে ভাববে না। শুধুই আমরা।”

ইরা একটা কাহওয়ার চায়ের অর্ডার দিল। সেই গরম চায়ের কাপ হাতে হাউসবোটের ছাদে বসে চারজন একে অপরকে নতুন চোখে দেখছিল।

“তোদের জানি অনেক বছর, কিন্তু যেন আজ নতুন করে চিনছি,” রূপা বলল।

সন্ধ্যায় তারা উঠল শিকারা ভ্রমণে। চারদিকে ল্যাম্পপোস্টের আলো পড়ে ডালে রূপোলি ছায়া ফেলছে। ওই ঝিরঝিরে ঠান্ডায় মোড়া জড়িয়ে তারা গান ধরল—“এই পথ যদি না শেষ হয়…”

গানের ফাঁকে ফাঁকে নিজেদের পুরনো গল্প উঠে এল।

“মনে আছে, কলেজে বলতাম লাদাখে যাব?”

“হ্যাঁ, শেষমেশ কেউই তো যেতে পারিনি।”

“আজ কাশ্মীর এলাম, একদিন লাদাখও যাব,” বলল শ্রীময়ী।

তাদের কথায় ছিল ভাঙা স্বপ্ন, আবার গড়া সাহস। বয়স যেন কোনও প্রতিবন্ধকতা নয়—মনের মুক্তিই আসল।

রাতের খাবারে গরম রগনজোশ আর কাশ্মীরি পোলাও খেতে খেতে রূপা হঠাৎ বলল, “তোরা জানিস, আমি কখনোই স্বপ্নে একা ঘোরা কল্পনা করিনি। সবসময় চারপাশে দায়িত্ব, শৃঙ্খলা… একটা খাঁচার মতো। এই ট্রিপটা হয়তো একফোঁটা হাওয়া সেই খাঁচার ভিতর ঢুকে দিয়েছে।”

ইরা তার হাত চেপে ধরল। শ্রীময়ী বলল, “এটা পালানো নয় রে। এ হচ্ছে ফিরে পাওয়া। নিজের কাছে ফিরে আসা।”

রাতে তারা হাউসবোটের বিছানায় শুয়ে গল্প করছিল। জানলার বাইরে ডাল লেকের জল আলতো করে ঢেউ তুলছে। কেউ বলছিল ছেলেবেলার কথা, কেউ কলেজের প্রেম, কেউ সংসারের হাঁপানির গল্প।

শেষে তারা চুপ করে গেল।

মেঘনা বলল, “এটা একটা যাত্রার শুরু। শুধুই ভ্রমণ নয়, নিজেদেরকে ফিরে পাওয়ার পথ।”

চাঁদের আলো জানলা পেরিয়ে এসে পড়ছিল শ্রীময়ীর মুখে। সে চোখ বন্ধ করল, আর মনে মনে বলল—“এই আমি, আজ নিজেকে আবার চিনলাম।”

শ্রীনগরের সকালে মেয়েরা

ভোরবেলা, হাউসবোটের খুপরি জানলা দিয়ে কাশ্মীরের প্রথম রোদ এসে পড়েছিল মেঘনার চোখে। সে ধীরে ধীরে উঠে জানলার পর্দাটা সরাল। ডাল লেক তখনও ঘুমে কাতর। জলটায় একধরনের ধূসর রঙ লেগে আছে, যেন স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝখানে ঝুলে থাকা এক মুহূর্ত।

চায়ের কেটলি ধোঁয়া ছাড়ছে, কোথাও যেন কাঠের ঠকঠক শব্দ। চারিদিকে একধরনের নির্জনতা—শান্ত, অথচ প্রাণময়।

“উঠে পড়িস রে সবাই,” মেঘনা গলা তুলে বলল, “কাশ্মীর আমাদের অপেক্ষা করছে।”

ইরা চাদর মুড়ি দিয়ে মুখ ঢেকে বলল, “এখনই? একটু ঘুমোতে দে না… কাল রাতে প্রায় তিনটা অবধি গল্প করেছি।”

“আরও ঘুমোলে রূপার নাক ডাকার শব্দে হাউসবোট ডুবে যাবে!”—শ্রীময়ীর ঠাট্টায় সবাই হেসে উঠল।

স্নান করে, হালকা মেকআপে, রঙিন উলের পোশাক পরে, তারা চারজন যখন ডাল লেকের ধার দিয়ে হাঁটছিল, তখন তাদের মনে হচ্ছিল তারা যেন কোনও সিনেমার দৃশ্যের ভেতর ঢুকে পড়েছে।

মেঘনা লাল মাফলারে নিজেকে জড়িয়েছিল, শ্রীময়ী পরেছিল মাটি রঙের শাল। রূপা প্রথমবার ঠান্ডার দেশে এসে এতটা স্বচ্ছন্দ ছিল না। কিন্তু ইরা তার গলায় একটা স্কার্ফ জড়িয়ে দিয়ে বলল, “চল, আজকে আমরা শুধু মেয়েরা। দুনিয়ার বাকি সবকিছু বন্ধ।”

একটা হোটেলের ঘরে বসে তারা কাহওয়ার চা আর তাজা নান খাচ্ছিল। চায়ের কাপ হাতে মেঘনা বলল, “জানিস, গত এক বছরে আমি একটা দিনও নিজের মতো কাটাইনি। কেবল অফিস, ছেলে, রান্না, সংসার। আমি যে আর কে, সেটাই ভুলে গিয়েছিলাম।”

“আমিও,” শ্রীময়ী চুপচাপ বলল, “স্কুল, হোমওয়ার্ক খাতা, ছেলের মেনু ঠিক করা—এর মাঝে আমি কোথায় ছিলাম জানি না। আজ সকালে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, ওই মুখটা আমি চিনিও না।”

ইরা বলল, “তাই তো এসেছি এখানে। নিজেদের আবার খুঁজে পাওয়ার জন্য। কাশ্মীরের প্রতিটা সকাল যেন আমাদের নতুন করে গড়ছে।”

সকালটা কাটল শ্রীনগরের বিখ্যাত মুঘল গার্ডেনে। চারজনই যেন সময় ভুলে গিয়েছিল—শালিমার, নিশাত, আর চাশমা শাহী যেন কেবল ফুল, জল আর পাথরের বাগান নয়, বরং ছিল একেকটা গল্পের পাতায় হারিয়ে যাওয়ার ফাঁক।

রূপা গার্ডেনের ধারে বসে ছিল একা। একহাতে তার চটি খুলে রাখা, অন্য হাতে মোবাইল, কিন্তু স্ক্রিনে চোখ ছিল না। তার চোখ সোজা সামনের ছোট্ট একটা কিশোরী দম্পতির দিকে—হাতে হাত রেখে ঘুরছিল তারা।

ইরা এসে পাশে বসে বলল, “কি ভাবছিস?”

“ভাবছি… আমি কোনওদিন নিজের জন্য এমন করে ভালবাসা চেয়ে দেখেছি কি?” রূপার গলা ভারি হয়ে এল।

“আমরা মেয়েরা অনেক সময় ভালোবাসার বদলে দায়িত্ব মেনে নিই। আর এক সময় সেটা এমন অভ্যেস হয়ে যায় যে বুঝতেই পারি না, আমরা নিজেকে ফেলে দিচ্ছি।”

সন্ধের দিকে তারা গেল স্থানীয় বাজারে। কারিগরদের হাতে তৈরি পশমিনা শাল, কাঠের তৈরি হ্যান্ডক্র্যাফটস, আর মাটির ছোট্ট সামগ্রী—সবকিছুতেই ছিল একটা অপূর্ব ঘরোয়া সৌন্দর্য।

শ্রীময়ী একটা ছোট্ট কাশ্মীরি চুলের ক্লিপ কিনল। মেঘনা তাকিয়ে বলল, “ওটা নেবি?”

“হ্যাঁ, জানিস তো, বিয়ের পর থেকে কোনোদিন নিজের জন্য এভাবে সাজিনি। আজ মনটা চাইছে।”

“সাজ না রে, আবার শুরু কর নিজেকে। বয়স, সন্তান, সংসার—সব পেরিয়ে নিজের ভেতরের মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়।”

রাতে হাউসবোটে ফিরে সবাই বিছানায় এল। বাইরে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির কাছাকাছি, কিন্তু হাউসবোটের ভেতর গরম কাঁথা আর হালকা আলোয় মনটা উষ্ণ হয়ে উঠেছিল।

তারা মোবাইল ফোন দূরে রেখে শুধু নিজেদের কথা বলছিল। স্মৃতি, অপূর্ণতা, স্বপ্ন—সব কিছুই এক এক করে উঠে এল।

রূপা একবার বলল, “এই যে কদিন ধরে আছি, একটা কথাও স্বামীকে ফোন করিনি। অথচ কোনো অপরাধবোধ হচ্ছে না।”

মেঘনা হেসে বলল, “কারণ এই ক’টা দিন তুই তোর নিজের সঙ্গে ছিলিস, অন্য কারও নয়।”

সেই রাতে শ্রীময়ী তার ডায়েরির পাতায় লিখল—

“কাশ্মীরের এই সকালে আমি নিজের প্রতিচ্ছবি আবার চিনলাম। এই পরিচয় হারিয়ে ফেলেছিলাম, আবার ফিরে পেলাম—এই তিনজন মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে।”

গুলমার্গে চারটি ছায়া

সকালের প্রথম আলোয় ডাল লেকটা আরও স্বচ্ছ, শান্ত আর মায়াবী হয়ে উঠেছে। হাউসবোটের বারান্দা থেকে চার বান্ধবী চোখ রাখল দূরের পাহাড়ে—সেই পাহাড়, যেখানকার পেছনে অপেক্ষা করছে গুলমার্গ। আজ তাদের তৃতীয় দিন, এবং এই দিনের অপেক্ষা যেন সবার মনে একটা কিশোরীর মতো উচ্ছ্বাস এনে দিয়েছে।

ইরা বলল, “আজ কিন্তু গুলমার্গে গিয়ে আমি স্কিইং করব! অন্তত চেষ্টা করব।”

রূপা একটু ভ্রু কুঁচকে বলল, “তোকে বরফে পিছলে পড়ে যেতে দেখার জন্য আমি রাজি।”

সবার হাসির মাঝে মেঘনা বলল, “চল, নিজেদের সীমা ছাড়িয়ে কিছু করি আজ। হয়তো ভয় পাব, কিন্তু সাহসটাও তো দেখাতে হবে!”

টার্মোফরমাল জ্যাকেট, কান ঢাকা টুপিসহ তারা যখন গুলমার্গের পথে চলল, তখন যেন চারজন চাররকম গল্পের চরিত্র হয়ে উঠল—অভিমান, সাহস, ভয় আর আনন্দ একসাথে বহন করছে। গাড়ির জানলা দিয়ে দেখতে দেখতে তারা উঠতে লাগল উঁচুতে—পাইন গাছের সারি, বরফে ঢাকা খোলা জমি, আর মাঝে মাঝে ছুটে যাওয়া ইয়াকের পাল।

গুলমার্গ পৌঁছেই তারা নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকল—চারদিক বরফে ঢাকা, যেন স্বর্গের মাটিতে নেমে এসেছে।

“এটা কি স্বপ্ন?” মৃদুস্বরে বলল শ্রীময়ী।

“না রে, এটাই আসল। তবে এতদিন ধরে আমরা চোখ বন্ধ করে ছিলাম বলে দেখতে পাইনি,” বলল মেঘনা।

গন্ডোলা রাইডে উঠে ওরা চারজন যখন গুলমার্গের দ্বিতীয় স্তরে পৌঁছল, তখন হাওয়ার গতি অনেক বেড়ে গিয়েছে। বরফে ঢাকা ধূসর আকাশ আর সাদা জমির মাঝে যেন তারা চারটে ছোট্ট বিন্দু।

রূপা ভয় পেতে লাগল। একধরনের অসহায়তা, ক্লান্তি, আর ভিতরে গুমরে থাকা ভয়—যেটা এতদিন চেপে রেখেছিল, আজ বরফের মাঝে বেরিয়ে পড়ল।

“আমি না হয় নেমে যাব,” সে বলল।

ইরা তার হাত চেপে ধরল, “তুই কি জানিস, তোর ভয় পাওয়াটা আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু তুই যখন ভয়কে জিতে ওঠিস, সেই মুহূর্তটাই আমাদের কাছে প্রেরণা।”

রূপা চুপ করে গেল। গলায় একটা অদ্ভুত ঢেউ উঠছিল। চারপাশে তুষারপাত শুরু হল।

একটা স্থানীয় স্কি ইনস্ট্রাকটর এসে বলল, “চেষ্টা করে দেখুন না ম্যাডাম। স্কি করাটা আপনার ভেতরের মেয়েটাকে আনন্দ দেবে।”

সেই মুহূর্তে রূপা নিজের ভিতরের দ্বন্দ্বের কাছে হার মানল না। সে হাঁটু বেঁকিয়ে দাঁড়াল, হাত বাড়িয়ে স্কি স্টিক ধরল, আর ধীরে ধীরে বরফের ঢালে গড়িয়ে গেল।

পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মেঘনা, ইরা আর শ্রীময়ী হাততালি দিয়ে উঠল। যেন রূপা শুধু স্কি করছে না, সে তার নিজের ভয়কে চূর্ণ করে এগিয়ে যাচ্ছে।

গরম কফির কাপ হাতে একটা কাঠের কটেজে বসে চারজনে বরফ দেখতে দেখতে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। বাইরে ঝিরঝির তুষারপাত, ভেতরে লোহার চিমনির আগুনে গরম।

“জীবনটা এরকম হতেই পারত, জানিস?” বলল শ্রীময়ী।

“এই যে বরফ, নরম, সুন্দর—আসলে তীব্র ঠান্ডার প্রতীক, কিন্তু আমাদের জন্য একটা স্বপ্নের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবনও তো তাই, না?” ইরা বলল।

মেঘনা বলল, “একদিনের গুলমার্গ, আমাদের পুরো জীবনের মানচিত্র বদলে দেবে এটা ভাবিনি। কিন্তু এই অনুভূতিটা মনে থেকে যাবে আজীবন।”

সন্ধে হয়ে এল। চারজনে ফিরে চলল হাউসবোটে। গাড়ির ভিতর নিঃশব্দতা। ক্লান্ত শরীর, কিন্তু তৃপ্ত মন। হঠাৎ রূপা বলল—

“তোমরা জানো, আজ বরফে পিছলে পড়ার ভয়টা আমি হারিয়েছি। শুধু স্কি নয়, জীবনের অনেক কিছুতে প্রথমবার সাহস দেখালাম আমি।”

ইরা মুচকি হেসে বলল, “তাহলে এবার তোকে নিয়ে হিমালয়ে ট্রেক করতে হবে।”

সবার মুখে হাসি ফুটল। সেই হাসি কেবল বন্ধুত্বের নয়, একে অপরকে নতুন করে আবিষ্কারের।

রাতের ডাল লেক আবারও নিঃশব্দ, গভীর। হাউসবোটের জানলায় ঠেকা দিয়ে শ্রীময়ী চেয়ে আছে বাইরে। তার ডায়েরির পাতায় সে লিখল—

“আজ গুলমার্গে আমি শুধু বরফে হাঁটি নি, বরং সাহসের পথে একটা পদক্ষেপ নিয়েছি। আর সেই পথে আমার পাশে ছিল তিনজন মেয়ে, যাদের সঙ্গে আমি হারিয়ে যেতে পারি, আবার নিজেকে ফিরে পেতেও পারি।”

তুষার, চিঠি আর চুপ করে বলা কথা

সকালটা ছিল যেন কোনো সাদা পাতার মতো—পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা তুষার, হালকা মেঘের গন্ধ, আর ভেজা কাঠের ঘ্রাণ। আজ ছিল তাদের চতুর্থ দিন, আর আজই তারা ঠিক করেছিল—না কোথাও যাবে, না কিছু করবে। শুধু নিজেদের সঙ্গে একটু সময় কাটাবে।

হাউসবোটের বারান্দায় বসে রূপা বলল, “জানিস তো, আজ আমি কাউকে ফোন করিনি। ছেলে, স্বামী—সব মনে পড়ছে, কিন্তু মনে হচ্ছে এই নীরবতাটাও দরকার।”

ইরা মুচকি হেসে বলল, “এই নীরবতা আসলে চিৎকারের চেয়েও শক্তিশালী।”

শ্রীময়ী তখন চুপ করে একটা খাম বের করল। সাদা খাম, হাতের লেখা একেবারে চেনা।

মেঘনা বলল, “ওটা কি?”

শ্রীময়ী ধীরে ধীরে বলল, “তিন বছর আগের একটা চিঠি। আমার মা লিখেছিল, মরার আগের সপ্তাহে। তখন খোলা হয়নি। আজ খুলব ভাবছি।”

হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে গেল চারপাশ।

চিঠির শব্দ যেন পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল—

“তুই যত ব্যস্ত হ, নিজেকে কখনও হারিয়ে ফেলিস না। তোর ভিতরের মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখিস। সংসার করিস, কিন্তু নিজের খেয়ালও রাখিস।”

চোখে জল নিয়ে শ্রীময়ী বলল, “মা ঠিক বলেছিল। এতদিন শুধু সবার দায়িত্বে নিজেকে ভুলি গেছি।”

বিকেলে তুষারপাত শুরু হল। ছোট ছোট ফ্লেক্স নেমে আসছে গাছের পাতায়, জানলার কাঁচে, আর তাদের মনের ভিতরে।

মেঘনা বলল, “এই বরফ পড়ার শব্দ শুনেছিস কখনও? মনে হয়, কেউ আমাদের না বলা কথাগুলো চুপিচুপি শুনছে।”

রূপা একরাশ চুপ করে বসে ছিল। তারপর বলল, “আজ একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। মা আবার বাঁচে উঠেছে, আমায় বলছে—‘এই ক’দিনেই কেন এত শান্ত হয়ে গেলি?’”

ইরা তার কাঁধে হাত রাখল, “কারণ এই ক’দিনে আমরা নিজেদের মতো করে আবার বাঁচছি।”

রাত নামল দ্রুত। হাউসবোটের ভেতরে কেরোসিন হিটার জ্বলছে, মোটা কাঁথার তলায় চারটি মেয়ে। কেউ মুখে কিছু বলছে না, শুধু চোখ দিয়ে কথা বলছে। বাইরে তুষারপাত, আর ভেতরে চারটি হৃদয়ের কথা।

ইরা হঠাৎ বলল, “তোমরা কি জানো, আমাদের এই যাত্রাটা একরকম চিঠি। আমরা নিজেরা নিজেদের লিখছি—জীবনের এক নতুন অধ্যায়।”

মেঘনা বলল, “আর সেই চিঠিতে কোনো ঠিকানা নেই, শুধু অনুভব আছে।”

রাতের শেষ ভাগে শ্রীময়ী তার ডায়েরিতে লিখল—

“আজ আমরা চারজন, তুষারের মতো ধীর আর নিঃশব্দ, অথচ ভেতরে ঝড়। চিঠির মতো নিজের ভিতরের কথা খুলে লিখলাম আজ। এই বন্ধুত্ব, এই মেয়েদের সঙ্গে কাটানো নিঃশব্দতা—এর চেয়ে গভীর আর কিছু হয় না।”

পাহাড়ে হারানো পথ, আর নিজের খোঁজ

গাড়ির জানলা দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিল পাহাড়ি রাস্তা। একদিকে গা ছমছমে খাড়া ঢাল, অন্যদিকে বরফে ঢাকা সরু পথ। আজ তারা যাচ্ছিল পহেলগামে—কাশ্মীরের এক অপার্থিব সুন্দর কোণা, যেখানে নদী, পাহাড় আর নিঃশব্দতা মিশে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা তৈরি করে।

ইরা বলল, “এই জায়গাটা যেন ঠিক গল্পের বই থেকে উঠে আসা। আর আজকের এই দিনটা, মনে হয় আমাদের নিজেদের খুঁজে পাওয়ার দিন।”

শ্রীময়ী জানলা দিয়ে তাকিয়ে বলল, “আজ আমি কিচ্ছু প্ল্যান করিনি। আজ শুধু হেঁটে যেতে চাই, যেখানে চোখ যাবে, পা যাবে… আর মনও।”

পহেলগামে নামার পরেই তারা চারজন হাঁটা শুরু করল। পাশে বয়ে চলা নদী লিদ্দার, তার জল এতটা স্বচ্ছ যে পাথরের রেখাগুলোর রং পর্যন্ত আলাদা করে দেখা যায়। ঠান্ডা হাওয়া মুখে এসে লাগছিল, কিন্তু মন যেন একেবারে গরম হয়ে উঠছিল—ভালোলাগায়।

একটা পাথরের উপর বসে মেঘনা বলল, “তোরা জানিস, আমার মা একটা সময় খুব বড় গায়ক হতে চেয়েছিল। কিন্তু সংসারের ভিড়ে সব ভুলে গিয়েছিল। আমি সেই একই পথে হাঁটছিলাম… কিন্তু এই ট্রিপটা আমাকে থামিয়েছে।”

রূপা বলল, “তোদের শুনিয়েছিস কখনও তুই গান গাস?”

“না। বাথরুম ছাড়া কোথাও নয়,” মেঘনা হেসে বলল।

ইরা বলল, “আজ গাই… পাহাড় শুনবে। নদী শুনবে। আমরা শুনব।”

মেঘনা হালকা গলায় গেয়ে উঠল—

“এমন এক দিন যাবে,

যখন আমি ফিরে তাকাব

আর দেখব—আমি নিজের মতো ছিলাম।”

চোখ বুজে সবাই শুনছিল। যেন সেই গানের প্রতিটি শব্দ পাহাড়ে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরছিল তাদের হৃদয়ে।

হেঁটে হেঁটে তারা একটা পুরোনো কাঠের কুঁড়েঘর দেখতে পেল। পাশে একজন বয়স্ক কাশ্মীরি মহিলা বসে ছিলেন, উলের কাপড় বুনছেন। তাদের দেখে বললেন, “ভেতরে এসো। চা খাবে? মেয়েদের এখানে একা ঘুরতে দেখা খুব ভালো লাগে।”

ওরা চারজন একসাথে চেয়ারে বসল। গরম কাহওয়ার চা, আর সেই মহিলার গল্পে হারিয়ে যেতে লাগল তারা।

“আমি একসময় অনেক দূরপাল্লার ট্রেক করতাম,” মহিলা বললেন, “কিন্তু একসময় বিয়ে, সংসার, সন্তান—সব এসে জীবন পালটে দিল। এখন আর হাঁটা হয় না… কিন্তু আমার চোখ হাঁটে। প্রতিদিন।”

শ্রীময়ী মুগ্ধ হয়ে বলল, “আপনার গল্প শুনে মনে হচ্ছে, আমাদের নিজেদের জীবনের মানচিত্র আবার এঁকে নিতে হবে।”

চা খাওয়া শেষ করে তারা যখন আবার রওনা দিল, তখন সূর্য ঝুঁকে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। পাহাড়ের গায়ে রোদ আর ছায়ার খেলা—একদিকে আলো, আরেকদিকে একরাশ ছায়া।

পথে একসময় ইরা পিছিয়ে গেল। বাকিরা বুঝতে পারল না সে কোথায় হারিয়ে গেল।

মেঘনা প্রথম টের পেল, “ইরা নেই! ও কোথায় গেল?”

তারা তিনজনে ছুটে ছুটে ইরাকে খুঁজতে লাগল। শেষমেশ একটি ছোট বাঁকের পাথরের ধারে তাকে পাওয়া গেল। সে একা বসে ছিল, চোখে জল, আর সামনের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে।

“কি হল রে?”—শ্রীময়ী দৌড়ে কাছে এসে বসে পড়ল।

ইরা বলল, “আমি সব কিছু ঠিক করে চলেছি এতদিন… সংসার, সন্তান, স্বামী, কাজ… শুধু একটা জিনিস ঠিক করিনি—আমি নিজে কেমন আছি।”

“তোর কান্না করাটাও দরকার ছিল, জানিস,” মেঘনা বলল, “এই পাহাড়, এই বন্ধুরা—তোর কান্নার সাক্ষী হয়ে থাকবে। আর এরপর থেকে, তুই ঠিক করবি নিজের মতো করে হাঁটবি।”

রাতে হাউসবোটে ফিরে শ্রীময়ী লিখল তার ডায়েরিতে—

“আজ পাহাড়ে আমরা শুধু পথ হারাইনি, বরং নিজেকে ফিরে পেয়েছি। এই মেয়েরা, এই বন্ধুত্ব, এই অশ্রু আর সাহস—এই হল আমাদের সত্যিকারের যাত্রা।”

 বিদায়ের আগে শেষ সকালের প্রতিশ্রুতি

সকালটা কেমন অচেনা। ডাল লেকের পাড়ে সেই চেনা হাউসবোট, পাহাড়ে ঝুলে থাকা মেঘ, শীতের শিশিরে সিক্ত জানলা—সব একই আছে, কিন্তু মনে হচ্ছে কিছু একটা পাল্টে গেছে।

শ্রীময়ী চোখ মেলে তাকাল, প্রথম আলো এসে পড়েছে কাঠের দেওয়ালে। ও পাশের বিছানায় রূপা তখনও ঘুমচ্ছে, মুখে একরাশ শান্তি। ইরা চুপ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে, আর মেঘনা ব্যাগ গোছাচ্ছে।

এই ছিল তাদের শেষ দিন। ফিরে যাওয়ার দিন।

সংসার, কাজ, সন্তান আর দায়িত্বের দিকে ফেরত যাওয়ার দিন।

কিন্তু ফিরে যাওয়ার আগে, নিজেদের সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার।

ব্রেকফাস্ট টেবিলে সবাই চুপ। শুধু গরম রুটির গন্ধ আর পাইন গাছের পাতার মধ্যে ভেসে আসা শালিকের ডাক।

মেঘনা বলল, “এই পাঁচটা দিন… আমি জীবনের একদম অন্যরকম ভার্সন দেখলাম। একরকম নিজেকে। জানিস তো, এই আমি—এই হাঁটা, গাওয়া, চুপ করে থাকা আমি—কতদিন ধরেই যেন হারিয়ে ছিলাম।”

ইরা মৃদু হেসে বলল, “তোর সেই আমি আমাদেরও নতুন করে চিনতে সাহায্য করেছে। আসলে আমরা চারজনই তো নিজেদের খুঁজতে এসেছিলাম। হয়তো পুরোটা পাইনি, কিন্তু দিকটা পেয়েছি।”

তারা চারজনে আবার হাউসবোটের ছাদে উঠল। দূরের পাহাড়ের গায়ে তখন আলোর খেলা, ছোট ছোট শাল গাছে রোদ কাচের মত ঝিকমিক করছে।

শ্রীময়ী বলল, “আমরা সবাই ফিরে যাব, আবার সেই চেনা জগতে। কিন্তু একটা প্রতিজ্ঞা করব? প্রতি বছর এই কয়েকটা দিন আমরা রাখব নিজেদের জন্য।”

রূপা চোখ তুলে তাকাল, “হ্যাঁ, শুধু বাঁচার জন্য নয়—নিজেদের ভালোবাসার জন্যও।”

মেঘনা বলল, “আর এই বন্ধুত্ব, এই কান্না, এই হাঁটাচলা, এই কথা—সব লিখে ফেলব। মনে রেখে দেব।”

ইরা ডায়েরির একপাতা ছিঁড়ে চার ভাগ করল। প্রত্যেককে একটা করে অংশ দিয়ে বলল, “এইটুকু কাগজে লিখে ফেল আজকের কথা। যে কথাগুলো আমরা কাউকে বলিনি—কিন্তু নিজেদের বলার ছিল।”

চুপ করে তারা লিখল। একেকজনের কাগজে উঠে এল শব্দ—

“ভয়”, “ভুলে যাওয়া”, “চাই আমি”, “আবার বাঁচব”।

চারটে শব্দ, চারটে গল্প, চারটে যাত্রা।

সেগুলো একটা খামে ভরে, পাহাড়ের দিকে মুখ করে রাখল তারা।

ইরা বলল, “যেখানেই থাকি, মনে রাখব—আমরা চারজনে একবার পাহাড়ে গিয়ে নিজেদের কথা বলেছিলাম। চুপ করে, জোর করে নয়… ভালোবেসে।”

এয়ারপোর্টে যখন গাড়ি দাঁড়াল, তখন আকাশ ছিল একেবারে পরিষ্কার। যেন তাদের মনের মতই হালকা হয়ে গেছে। ব্যাগ হাতে চারজন দাঁড়িয়ে, চশমা-পরা চোখে আর আবছা মুখে একটা প্রতিশ্রুতি।

“চল তবে, আবার সেই চেনা জীবন, কিন্তু নতুন করে,” বলল মেঘনা।

“নতুন আমি নিয়ে,” যোগ করল রূপা।

“আর এই গল্পটা সঙ্গে করে,” বলল শ্রীময়ী।

“কারণ আমরা চারজন জানি—একবার কাশ্মীর গেলে মনটা আর আগের মতো থাকে না,” শেষ কথা বলল ইরা।

শেষ পাতায় শ্রীময়ীর ডায়েরিতে লেখা রইল—

“আমরা ফিরছি। আবার রান্নাঘর, অফিস, স্কুল, বাজার, ঘর গোছানো, ফোন কল, রিপোর্ট কার্ড, মিটিং…

কিন্তু এবার আমাদের পেছনে আছে পাহাড়, তুষার, গান, চিঠি, কান্না আর চারটি হৃদয়ের বন্ধন।

আমরা একবার সত্যি সত্যিই নিজেদের ভালোবেসেছিলাম—কাশ্মীরে, সেই কয়েকটা দিনে।”

সমাপ্ত

Lipighor_1749455206195.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *