অভিজিৎ রায়
পর্ব ১
কালো মেঘে ঢাকা সন্ধেটা যেন গ্রামের বুক থেকে আলোটুকু শুষে নিয়েছিল। নদীর ধারে পেঁচানো পথ দিয়ে হাঁটছিল অর্ণব। কলকাতা থেকে সে এসেছিল কিছু কাজের সূত্রে, কিন্তু এই গ্রামে এসে তার মনে হচ্ছিল, শহরের ব্যস্ততা থেকে মুক্তি পাওয়া মানে এই নয় যে মন শান্ত হয়ে যাবে। বরং প্রকৃতির অন্ধকারের ভেতরেই এক অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা ঘিরে ফেলছিল তাকে। গ্রামটার নাম কাশীপুর, লোকসংখ্যা অল্প, আর চারদিকে ঘন জঙ্গল। তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল এক পুরোনো বাড়িতে—লোকেরা যাকে বলে মজুমদারদের পরিত্যক্ত ভিটে।
লোকজন তাকে আগেই সাবধান করেছিল, রাত হলে যেন একা বাইরে না বেরোয়। অর্ণব ভেবেছিল, এগুলো নিছক গ্রামীণ গুজব, যেখানে ভূতের গল্প দিয়ে মানুষ নিজেদের ভয় দেখায়। কিন্তু বাড়ির ভেতরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই তার শরীরের ভেতর দিয়ে এক শিরশিরে শীতলতা বয়ে গিয়েছিল। মোটা ধুলো জমে থাকা আসবাব, অন্ধকারে ভরা বারান্দা আর ভাঙাচোরা দরজার কপাট—সব মিলিয়ে যেন অতীতের কোনো দুঃস্বপ্ন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রথম রাতে কিছুই হল না। বাতাসে শালপাতার খসখসানি, দূরে শেয়ালের ডাক—এসবকে অর্ণব স্বাভাবিক বলেই মেনে নিল। কিন্তু দ্বিতীয় রাতে অদ্ভুত কিছু ঘটল। হঠাৎ রাত দুটো নাগাদ তার ঘুম ভেঙে গেল। কানে এল কারও ফিসফিসানি—কোনো নারীকণ্ঠ, খুব মৃদু, কিন্তু স্পষ্ট। শব্দটা বারান্দার দিক থেকে আসছে। অর্ণব ভেবেছিল হয়তো তার কানে ভ্রম হয়েছে। তবু বুক ধুকপুক করতে করতে সে উঠে দাঁড়াল। মশালের আলো হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই দেখল—ফাঁকা অন্ধকার, শুধু শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু ফিরে আসার সময় তার চোখ আটকে গেল সিঁড়ির মাথায়। মেঝেতে ভিজে মাটির দাগ—যেন কেউ ভেজা পা টেনে হেঁটে গেছে। অথচ বাইরে তো বৃষ্টি হয়নি সেদিন। অর্ণব কাঁপতে লাগল। নিজের ঘরে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে সে অনেকক্ষণ পর্যন্ত শুয়ে রইল, চোখের পাতা এক করতে পারল না।
ভোর হলে সে পাশের বাড়ির এক বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করল, “এই ভিটেটা নিয়ে এত ভয় পাওয়ার কী আছে? আমি তো কাল রাতে অদ্ভুত আওয়াজ শুনলাম।” বৃদ্ধ অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “ওই বাড়িতে একসময় মজুমদার সাহেবের মেয়ে থাকত। সুন্দরী, কিন্তু অভিশপ্ত। বিয়ের রাতেই সে গলায় দড়ি দেয়। তারপর থেকে বহু লোক নাকি রাতের বেলা তার কান্না শুনেছে। আমরা ওদিকে পা দিই না।”
অর্ণব যুক্তিবাদী, ভূতের গল্পে বিশ্বাস করে না। তবু ভিতরে ভিতরে এক অজানা ভয় জমাট বাঁধছিল। সন্ধ্যা নামতেই আবার চারদিক স্তব্ধ হয়ে এল। সেই রাতে জানলার বাইরে ছায়ার মতো কিছু নড়াচড়া করছিল—সে কি বাতাসে দুলতে থাকা গাছের ছায়া, নাকি সত্যিই কেউ দাঁড়িয়ে? অর্ণবের বুক কেঁপে উঠল। সে সিদ্ধান্ত নিল, এই রহস্য তাকে ভেদ করতেই হবে।
কিন্তু সেই রাতে যা ঘটল, তা তার বিশ্বাসকে সম্পূর্ণ ভেঙে দিল। ঘড়িতে তখন প্রায় আড়াইটে। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল। একবার নয়, বারবার। টক্ টক্ শব্দে ঘরটা কেঁপে উঠছিল। ভয়ে জমে গিয়েছিল অর্ণব। কাঁপা হাতে দরজা খুলতেই সে দেখল—ফাঁকা অন্ধকার, কেউ নেই। শুধু হাওয়ায় ভেসে আসছিল ভিজে মাটির গন্ধ।
তারপর, হঠাৎই, কানে বাজল এক দীর্ঘশ্বাস—ঠিক তার কানের কাছে। সে ছুটে দরজা বন্ধ করল। বুক ধড়ফড় করতে লাগল এত জোরে যে মনে হচ্ছিল ভেঙে পড়বে। বিছানায় বসে সে বুঝল, এবার তাকে সত্যিই সত্যিই খুঁজে বের করতে হবে, কী লুকিয়ে আছে এই পরিত্যক্ত ভিটের ভেতরে।
পর্ব ২
রাতের সেই নিঃশ্বাসের পর অর্ণব ঠিক করল ভোর হতেই বাড়িটার প্রতিটি কোণা খুঁজে দেখবে, কারণ ভয়ের সঙ্গে বসবাস করলে ভয়ই স্বাভাবিক হয়ে যায়—আর সে কোনোদিন ভয়ের সঙ্গে সমঝোতা করতে শেখেনি; দরজার কপাট ঠেলে রোদ উঠতেই সে বারান্দা, আঙিনা আর পিছনের জঙ্গলের ধার ধরে ঘুরল, পুরোনো ভিটের চারদিকে শ্যাওলা-পড়া দেওয়াল, নুয়ে পড়া শিমুলগাছ, আর সব থেকে অস্বস্তির—কুয়োটা; কুয়োর মুখে পাথরের বৃত্ত, শ্যাওলা এত ঘন যে দেখে মনে হয় সবুজ চামড়া গজিয়েছে, জলচোখা ডোবা—তার ভেতর থেকে হালকা এক দমকা বাতাস যেন উঠে এসে অর্ণবের কানের কাছে ফিসফিস করল; “ফিরিয়ে দাও”—সে চমকে ওঠে, তারপর নিজের ওপরেই রাগ হয়—এই শব্দ হয়ত পাতার ঘর্ষণ, কল্পনা; তবু কুয়োর ঠান্ডা নিঃশ্বাস যেন তার পিঠ বেয়ে নেমে যায়; দুপুরের দিকে পাশের বাড়ির কমলা কাকিমার সঙ্গে দেখা, বয়স সত্তর ছুঁইছুঁই, চোখে সাদা মেলানো ছায়া, তিনি সোজা বললেন, “মজুমদারদের কন্যে ইন্দ্রাণী—তাকে যে যেভাবে মনে রেখেছে, কেউ বলে সে নিজেই গলায় দড়ি দিয়েছিল, কেউ বলে বিয়ের শাপমুক্তি পায়নি বলে তাকে তুলেছিল… কিন্তু আমি জানি, ওই রাতটা কুয়োটা খেয়েছিল তার শাড়ির রং, তারপর থেকে যখন-তখন ভেজা পায়ের দাগ ওঠে” —“ইন্দ্রাণী?”— অর্ণব নামটা মুখে নিলে কাকিমার গলায় এক ধরনের ভয় ঢুকে গেল, “নাম ধরে ডাকিস না, নাম ডাকা মানে দরজা খোলা”; অর্ণব হেসে উড়িয়ে দিলেও নামটা মাথায় গেঁথে রইল, নামের ভিতরে যেন কুয়োর গা-ঢাকা জল; বিকেলের দিকে সে আবার ঘরে ফিরে এল, ভিটের ভেতর ছায়া একটু একটু করে গাঢ় হয়, জানালা দিয়ে হাওয়া ঢোকে, ধুলো উড়ে, খাটের নীচে শূন্যতা; সে সিদ্ধান্ত নিল আজ রাতে পরীক্ষা করবে—দরজার সামনে ছাই ছড়িয়ে রাখল, নিজের জুতোর পাটি দরজার ভেতর আড়াআড়ি রেখে দিল, মোবাইলের রেকর্ডার অন করে ঘরের মাঝখানে রেখে দিল, আর বেডসাইড টেবিলে একটি টর্চ, একটা জংধরা ছুরি যা রান্নাঘরে পড়েছিল; সন্ধ্যা নামতেই আচমকা মিষ্টি ফুলের গন্ধ উঠল, কদম না বেল—বুজতে পারল না, কিন্তু গন্ধের সঙ্গে সঙ্গে যেন ভেজা মাটির নোনাস্বাদও মিশে আসে; সে টেবিলল্যাম্প নিবিয়ে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে রইল, ঘড়ির কাঁটা ধীরে ধীরে এগোয়, বাইরে পেঁচার ডাক বিরতি দিয়ে ফিরে আসে, দূরে শিয়াল গর্জে ওঠে, তারপর সব থেমে যায়—এক ধরনের স্তব্ধতা, যেন শব্দগুলোও ভয়ে আড়াল নিয়েছে; আড়াইটার কাঁটা পেরোতেই প্রথম টোকা—টক্; অর্ণব বুক চেপে ধরে শোনে, দ্বিতীয়, তৃতীয়; দরজার ফাঁক দিয়ে টর্চের রেখা ফেলতে গিয়ে সে অনুভব করল—তার হাত কাঁপছে, যদিও সে নিজেকে বোঝাল, “আমি তো কেবল যাচাই করছি, সত্যি আছে কি নেই”; দরজা খুলতেই টর্চের অন্ধ আলো করিডরের মেঝেতে পড়ল—আর তার গা ঠান্ডা হয়ে গেল: ছাইয়ের ওপর সাদা ভেজা পায়ের ছাপ—বাম, ডান, বাম—শিশির নয়, জলের বিঁধে থাকা ভার, যেন জল থেকে উঠে আসা কারও কনট্যুর, আর সেই দাগগুলো ঘরের ভেতরের দিকে নয়, বারান্দা থেকে ভেতরে ঢুকেছে; অর্ণব একবার হড়কে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে টর্চের আলো ধরে ধরে দাগগুলো অনুসরণ করল—ওগুলো সোজা নিয়ে গেল ভেতরের আনসার ঘরের দিকে, যেটা সে এখনও খুলে দেখেনি; তালা নেই, শুধু কপাট ভাঙা, কিন্তু বহুদিন কেউ ঢোকেনি বুঝতে পারা যায় গন্ধে—ভেজা কাঠ, ফাঙ্গাস, পুরোনো কাপড়; ভেতরে ঢুকতেই টর্চের আলো এক জায়গায় আটকে গেল—একটা আয়না, পর্দা দিয়ে ঢাকা; অর্ণব পর্দাটা সরাতেই আয়নার কালো পিঠ থেকে ধুলো উড়ল, কিন্তু যা তাকে স্তব্ধ করল তা আয়নার প্রতিফলন নয়, আয়নার চৌকাঠে নখ দিয়ে আঁচড়ে লেখা—অস্পষ্ট, তবু পড়া যায়: “ফিরিয়ে দাও”; তার বুকের ভেতর কিছুর ধাক্কা লাগে—ফিরিয়ে দাও কাকে, কী; ঠিক তখনই পেছন থেকে জলের ফোঁটার টুপটাপ শব্দ; সে ঘুরে দাঁড়িয়ে টর্চ ধরল—কোণের কাঠের ট্রাঙ্ক, ওপরে সাদা শাড়ির ভাঁজ, আর তার প্রান্ত থেকে জল পড়ছে, অর্থাৎ একদম ভেজা, কিন্তু ঘরে তো জল নেই, বৃষ্টিও পড়ছে না; অর্ণব ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে শাড়িটার একপ্রান্ত তুলতেই শীতলতা তার আঙুল থেকে কাঁধে উঠল—ভেজা কাপড় যেন জীবন্ত; শাড়ির ভেতর গুঁজে রাখা ছোট্ট লাল বাক্স, পুরোনো সিন্দুরদানি, ঢাকনা খুললেই ভেতরটা ফাঁকা, কিন্তু ঠোঁটের কাছে নিয়ে গেলে তীব্র লৌহের গন্ধ—রক্তের মত, না, হয়ত পুরোনো ধাতু—সে ঢাকনা বন্ধ করতেই পেছনে নরম নূপুরের শব্দ; অর্ণব জমে গেল, টর্চের আলো আয়নায় ফিরে এসে তার নিজের ভয়-ভরা চোখ দেখাল, এবং সেই চোখের পেছনে—আয়নার কাচের ভিতর, খুব সামান্য, একটুখানি—একটা মেয়ের কপালের সিঁদুরছায়া; সে টর্চ সরিয়ে আবার দিল, নেই; “কে?”—অর্ণবের গলায় কাঁপুনি, শব্দ বেরোল শুকনো; ঠিক তখনই রেকর্ডারের লাল আলো নিজে নিজে নিভে গেল—ব্যাটারি তো পূর্ণ ছিল; অন্ধকার ঘন হয়ে নামল, টর্চের বৃত্তের বাইরে এক ধরনের ঠান্ডা ছায়া বসে আছে; “ইন্দ্রাণী”—নামের উচ্চারণ নিজেরই অজান্তে ঠোঁট ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই বারান্দার দিকে যেন দূর থেকে হাওয়া দৌড়ে এল, দরজা খোলা থাকলে এমন হয়, কিন্তু দরজা তো সে আড়াআড়ি জুতোর পাটি রেখে আটকে রেখেছিল—সে এক দৌড়ে গিয়ে দেখল জুতো নিজে নিজেই একপাশে সরে গেছে, ছাইয়ের ওপর দিয়ে নতুন নতুন ভেজা পায়ের ছাপ ঢুকছে এবং… এখন দাগের রং বদলে গেছে—পানির জল নয়, হালকা লালচে—আলতা? রাতবেলায় কে আলতা মেখে হাঁটে; তার মাথা ঘুরে যায়, কিন্তু টর্চ ধরে সে দাগগুলোর পিছু নিল—সেগুলো এবার নিয়ে যাচ্ছে সিঁড়ির খাড়া ধাপ বেয়ে বাড়ির চিলেকোঠায়; চিলেকোঠায় উঠে সে বুঝল এই বাড়ির হৃদয়টা ওখানেই—ছাদের বাঁশের কড়িবরগা, মাঝখানে এক চকচকে লোহার কাঁটা, মনে হয় এখানে এককালে দড়ি ঝুলত; কড়িবরগার নিচে দাঁড়াতেই একটা শিস দেয়া হাওয়া বয়ে গেল, আর আলতার পায়ের দাগগুলো এসে থেমে গেল ওই কাঁটার ঠিক নীচে; অর্ণব টর্চটা মেঝেতে রেখে উপরের দিকে তাকাল—মনে হল, অন্ধকারের ভেতর থেকে একটা শরীর ঝুলছে—না, নেই; সে চোখ মুছে আবার তাকাল, তবু বুকের ভিতর দড়ি টান টান হল যেন; চিলেকোঠার কোণে একটা কাঠের বাক্স খুলতেই পুরোনো ছবি—বিয়ে বাড়ি, লণ্ঠনের আলোয় মেয়েটা বসে আছে, চোখ নামানো, নাম লেখা নিচে ফিকে কালি—“ইন্দ্রাণী”; ছবির কিনারায় জলের দাগ, এবং ছবির ওপরেই এক চুলের মতো পাতলা দড়ির আঁশ লেগে আছে—ছবিকে ছুঁতেই কানের কাছে ফিসফিসানি—“জলটা ফেরাও, আমার জল”—অর্ণব গা শিউরে ওঠে, “কোন জল?”—অন্ধকারে বাতাসের ঘূর্ণি, টর্চ নিভে যাওয়ার আগে ক্ষীণ আলোয় সে দেখল—ভেজা শাড়ির প্রান্ত টেনে নিয়ে যাচ্ছে আলতার পায়ের দাগগুলোর মেয়ে—টর্চ পুরো নিভে গেল; সে হাতড়ে মোবাইলটা চালু করতেই স্ক্রিনে অনলক না করেই ছবি ভেসে উঠল—কুয়োর মুখ, তার নিজের তোলা নয়; মোবাইলের স্পিকারে নিজে নিজে রেকর্ড প্লে—একটা ঘষঘষে নারীস্বরে একটাই বাক্য, বারবার, প্রত্যেকবার একটু কাছাকাছি, “কুয়োটা খোল, আমি উঠতে পারিনি”; অর্ণব বুঝল—“ফিরিয়ে দাও” মানে কাউকে ফিরিয়ে দেওয়া নয়, জলটাকে ফিরিয়ে দেওয়া, বা জলের ভেতর যা আটকে আছে তাকে; সে দৌড়ে নেমে এল, বারান্দা পেরিয়ে কুয়োর ধারে—রাতের কুয়ো কালো চোখের মতো তাকিয়ে আছে, কুয়োর গা দিয়ে জল টুপটাপ; সে এমাথা ওপার মাথা দেখে বুঝল, কেউ একটা সদ্য বসেছিল কিনা, শ্যাওলার ওপর মোমবাতির গলানো দাগ—কেউ কি এখানে আহ্নিক করেছে; সে বালতি নামাতে গেলেই দড়িটা নিজে নিজে নেমে গেল, বাড়তি হাত ছাড়া—সরে গিয়ে আবার টান খেয়ে উঠল, বালতির ভেতর ঘন অন্ধকার; হঠাৎ বালতি ভারী—অনেক ভারী; অর্ণব দুহাতে টেনে তোলে—জল নয়, জমাট কাদা, আর কাদার ভেতর লালচে কাপড়, আলতার গন্ধ, কাঁচের ভাঙা চুড়ি; সে ভয় আর কৌতূহলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কাপড়টা ঝেড়ে ফেলতেই ভেতর থেকে একটা ছোট্ট তামার লকেট পড়ে যায়—লকেট খুলতেই ভেতরে দুটো নাম—একটা “ইন্দ্রাণী”—আরেকটা মুছে গেছে, শুধু “নি…ন” বোঝা যায়; “নির…”? সে উচ্চারণ করতেই কুয়োর ভেতর থেকে দমকা হাওয়া উঠে এসে তার কপালে ভিজে ঠান্ডা স্পর্শ রেখে গেল, যেন কেউ শীতল আঙুল দিয়ে ইশারা করল—“বুঝেছ?”; তখনই কুয়োর পাথরের বৃত্তের ওপরে আলতার পায়ের দাগ এসে থেমে দাঁড়াল, যেন কেউ তার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে আছে, কাঁধে শীতল নিশ্বাস, আর সেই অনাহূত, অদৃশ্য কণ্ঠ এবার প্রথমবারের মতো স্পষ্ট বাংলায় বলল, খুব ধীরে, ঠান্ডা সুরে—“মিথ্যে কাহিনি ছড়ানো থামাও, আমাকে ফিরিয়ে দাও সত্যিতে”—অর্ণব বুঝল, এই ভিটের ভূত ভয় দেখাতে আসেনি, বরং সত্যি চাইতে এসেছে; কিন্তু সত্যি কী—খুন নাকি আত্মহত্যা—কে “নি…ন”, কুয়োর ভেতর কোন স্মৃতি আটকে আছে—সে উত্তরের মতো কিছু বলার আগেই কুয়োর অন্ধকারে একটা ছায়া নড়ে উঠল, যেন জলের তলায় চোখ খুলে কেউ তাকাল, আর সেই তাকানিতে অর্ণব হঠাৎ দেখল—নিজেকেই—চিলেকোঠার কড়িবরগায় ঝুলতে—ঘাড়ে দড়ি, চোখে ভয়; সে চিৎকার করে উঠল, কিন্তু গলা থেকে শব্দ বেরোল না, হাওয়ায় শব্দ আটকে গেল; টর্চটা হঠাৎ আবার জ্বলে উঠল এবং চিলেকোঠার দিকে রাস্তার ওপর—আলতার পায়ের দাগ নতুন করে চড়া রংয়ে উঠে এল—উপরে, আরও উপরে, কড়িবরগার দিকে—যেন কাউকে নিয়ে যাচ্ছে—আর অর্ণব বোঝল, আজ রাত শেষ হবে না যদি সে কুয়োতে নামতে না শেখে।
পর্ব ৩
অর্ণবের শরীর জুড়ে অদ্ভুত এক টান পড়ছিল, যেন অদৃশ্য কারও হাত তাকে কুয়োর মুখের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কপালে তখনও ভেজা ঠান্ডা স্পর্শ লেগে আছে। সে হঠাৎ হুঁশ ফিরিয়ে নিল—নিজেকে বোঝাল, এভাবে যদি ভয়কে জিততে দেয় তবে আর বাঁচবে না। সে মোবাইলের আলো জ্বালল, কিন্তু স্ক্রিনে আবার সেই একই ছবি—কুয়োর গা, অন্ধকারের ভেতর একটা নারীর চোখ ভেসে উঠছে। মোবাইল বন্ধ করতে চাইলে কাজ করল না, বারবার স্ক্রিনে ভেসে উঠল নামটা—“ইন্দ্রাণী।” অর্ণব গলা শুকিয়ে গেলেও দম নিয়ে কুয়োর ধারে বসল। বালতি টেনে তুলে শূন্যে নামাল, এবার দড়ি নিজে থেকে নামছিল না। কুয়োর ভেতরের জল কালো, কিন্তু তার তলায় যেন কিছু নড়ছে—একটা কাপড়? নাকি মানুষের চুল? হঠাৎ বালতির দড়ি টান মেরে চেপে ধরল কেউ। অর্ণব ভয় পেয়েও জোর দিয়ে টানল, কিন্তু দড়ি ছিঁড়ে গেল। নিচ থেকে ভেসে উঠল কর্কশ হাসি, যেন ভেজা গলায় কেউ কাঁদতে কাঁদতে হেসে উঠছে।
অর্ণব দৌড়ে ঘরে ফিরে এল। দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল, তবু কান থেকে সেই হাসি সরল না। রাতভর সে বিছানায় উল্টেপাল্টে কাটাল। ভোরে চোখ লেগে আসতেই হঠাৎ আবার সেই কণ্ঠস্বর—“কুয়োটা খোল…” সে চমকে জেগে উঠল, কিন্তু সূর্য উঠেছে, আশেপাশে কেউ নেই।
দিনের আলোয় সাহস একটু ফিরে এল। গ্রামটার লোকদের সঙ্গে কথা বলতে হবে ঠিক করল সে। বাজারে গিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে আড্ডা জুড়ল। গ্রামের লোকজন মজুমদারদের বাড়ি নিয়ে কথা বলতে চাইছিল না। কিন্তু এক বুড়ো মানুষ, নাম অজিত, শেষে ফিসফিস করে বলল, “শোনো বাবু, ইন্দ্রাণীকে মানুষ ভাবে আত্মহত্যা করেছে। আসল কাহিনি আলাদা। তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল এক জমিদারের ছেলের সঙ্গে। ছেলেটির নাম নিরঞ্জন। লোকটা নিষ্ঠুর ছিল। কথিত আছে, বিয়ের রাতেই ঝগড়া বাঁধে। ইন্দ্রাণী কেঁদে বাড়ি ফেরে, আর সেই রাতেই গলায় দড়ি…” অজিত থেমে গেল, চোখে ভয়, “কিন্তু অনেকে বলে, সে আসলে কুয়োয় পড়ে যায়, আর নিরঞ্জন তাকে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। পরদিন সকালে তার দেহ মেলে গলায় দড়ি দেওয়া অবস্থায়, যেন সাজানো।”
অর্ণব শিউরে উঠল। নিরঞ্জন—নামটার প্রথম অক্ষরই তো মুছে যাওয়া লকেটে দেখা গিয়েছিল। “নি…ন।” তবে কি সেই নামই খুঁজে ফিরছে ইন্দ্রাণী?
সন্ধের পর থেকে ভয়ানক অস্বস্তি শুরু হল। আকাশে হঠাৎ মেঘ জমে গেল, বাতাসে ধুলো উড়ল। অর্ণব ভেবেছিল এবার গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু তার ভেতরের যুক্তিবাদী মানুষ জেদ ধরল—রহস্য না ভেঙে সে যাবে না। রাতে আবার দরজায় টোকা এল। এবার টর্চ হাতে নিয়ে সে দাঁড়াল না, বরং দরজার ওপারে উচ্চস্বরে বলল, “কে তুমি? কী চাইছ?”
কোনও উত্তর এল না। কিছুক্ষণ পর টেবিলের ওপর রাখা লকেটটা নিজে নিজেই খুলে গেল। ভেতরের নামগুলো আবার জ্বলজ্বল করে উঠল—“ইন্দ্রাণী” আর “নিরঞ্জন।” এবার অর্ণব স্পষ্ট দেখতে পেল। তার বুক ধকধক করছিল। ঠিক তখনই জানলার ওপারে ছায়ার মতো কিছু নড়ল। অর্ণব জানলার কাছে গিয়ে আলো ফেলল। বাইরে কেউ নেই। কিন্তু কাঁচে প্রতিফলিত হলো এক নারীর মুখ—চোখদুটো লালচে, ঠোঁটে ভিজে রক্তের দাগ, সিঁথিতে সিঁদুর। সে নরম গলায় বলল, “আমাকে ফিরিয়ে দাও।”
অর্ণব পিছিয়ে এল। ঘরটা হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে গেল, যেন শীতের কুয়াশা ঢুকে পড়েছে। তার কানে বাজতে লাগল পায়ের নূপুরের শব্দ, সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে ওপরে উঠছে। সে বুঝল, আবার সেই চিলেকোঠা। সাহস করে সিঁড়ি বেয়ে উঠল। ওপরে পৌঁছেই দেখল, কড়িবরগার নিচে দুলছে সাদা শাড়ি পরা ছায়া। হাওয়ায় ভেসে উঠছে শাড়ির আঁচল, আর চোখে তাকিয়ে আছে অর্ণবের দিকে।
সে চিৎকার করতে গিয়ে গলায় আওয়াজ পেল না। ছায়াটা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু ঠিক তার জায়গায় পড়ে রইল একটা পুরোনো চিঠি। অর্ণব তুলে নিল। চিঠির কালি ঝাপসা, তবু পড়া গেল কয়েকটা শব্দ—“নিরঞ্জন… বিশ্বাসঘাতকতা… কুয়ো… আমাকে বাঁচাও।”
অর্ণব ঘরে ফিরে চিঠিটা বারবার পড়তে লাগল। ভয় আর কৌতূহল একসঙ্গে জড়িয়ে ধরছিল তাকে। পরিষ্কার, এই ভূত কোনও কল্পনা নয়। ইন্দ্রাণী কিছু বলতে চাইছে। তার মৃত্যুর সত্যিটা।
রাত বাড়তে থাকল। হঠাৎ রেকর্ডারের ভেতর আবার শব্দ—কিন্তু এবার ফিসফিস নয়। এক নারীকণ্ঠ স্পষ্ট বলছে, “আমি উঠতে পারিনি। আমাকে টেনে নামানো হয়েছিল। তারপর দড়ি বাঁধা হয় আমার গলায়।” অর্ণব স্তব্ধ। কুয়োর জল, ভেজা শাড়ি, লকেট, চিঠি—সব এক সুতোর মতো জুড়ে গেল।
সে বুঝল, ইন্দ্রাণী আত্মহত্যা করেনি। তাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। হয়তো নিরঞ্জনের হাতে। ভূত প্রতিশোধ চাইছে না—চাইছে সত্যি প্রকাশ পাক।
কিন্তু কীভাবে প্রকাশ পাবে? কে শুনবে? আর এই বাড়ির দেয়ালেই বা কত অন্ধকার জমে আছে? অর্ণব জানে না। সে শুধু জানে, ইন্দ্রাণীকে ফিরিয়ে দিতে হলে তাকে কুয়োর ভেতর নামতেই হবে। আর সেই অন্ধকারে কী আছে, তা জানার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে।
বাইরে তখন ঝড় উঠছে। বাড়ির দরজা কাঁপছে। কুয়োর দিক থেকে আসছে শোঁ শোঁ হাওয়ার শব্দ। অর্ণব অনুভব করল—আজ রাতেই তাকে নামতে হবে কুয়োর গভীরে। নইলে আর ফেরার পথ থাকবে না।
পর্ব ৪
রাতটা যেন অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে এক অঘোষিত যুদ্ধে নামার মতো ছিল। অর্ণব জানত, এখন পালিয়ে গেলে আর কোনোদিন এই রহস্য উন্মোচন করতে পারবে না। জানালার বাইরে তখন ঝড়ের শব্দ, বাতাসে গাছের ডালপালা কাঁপছে। পুরো গ্রামটা ঘুমিয়ে, কেবল মজুমদারদের ভিটের ভেতর আলো নিভে–জ্বলে উঠছে অদ্ভুত ছন্দে। অর্ণব মশালের মতো টর্চ হাতে নিল, কোমরে দড়ি বাঁধল, আর বুকের কাছে গুঁজে রাখল সেই লকেট আর পুরোনো চিঠিটা। মনে হচ্ছিল, ইন্দ্রাণীর গলায় দড়ি পড়ার আগে শেষ চিৎকার এখনও বাতাসে ঝুলে আছে।
সে কুয়োর ধারে এসে দাঁড়াল। মেঘের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো পড়েছে কুয়োর পাথরে। শ্যাওলা ভিজে চকচক করছে। ভেতর থেকে শোঁ শোঁ শব্দ, যেন অন্ধকার নিজেই নিশ্বাস নিচ্ছে। অর্ণব দড়ি বেঁধে ধীরে ধীরে নামতে শুরু করল। প্রথমে শুধু ঠান্ডা বাতাস, তারপর জলের ছিটে, শেষে একেবারে কুয়োর ভেতরের গা ছমছমে অন্ধকার। হাতের টর্চের আলো পাথরের দেওয়ালে পড়ছে। ভেতরের জলটা একদম স্থির নয়, ঢেউ খেলছে যেন কেউ নীচে নড়ছে।
হঠাৎ তার চোখে পড়ল কুয়োর দেওয়ালে আঁচড়ের দাগ—লম্বা নখ দিয়ে টানা, অসংখ্য। যেন কেউ একসময় মরিয়া হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিল। অর্ণবের বুক হুহু করে উঠল। টর্চ ঘুরিয়ে জলের গায়ে আলো ফেলতেই সে দেখতে পেল—শাড়ির আঁচল ভেসে আছে, সাদা রঙ, কিন্তু ডুবন্ত। আর তার ভেতরে জড়ানো হাতের হাড়গোড়ের মতো কিছু এক ঝলক। অর্ণব ভয়ে চোখ বন্ধ করল।
ঠিক তখনই কানে এল কণ্ঠস্বর—স্পষ্ট, ভিজে, কাঁদো কাঁদো—“আমাকে বাঁচাও।” সে টর্চের আলো ফেরাল। জলের ওপর অর্ধেক ভেসে উঠেছে এক নারীমুখ। চুল ভিজে মুখ ঢেকেছে, চোখ দুটো জ্বলছে অস্বাভাবিক আলোয়। ঠোঁট নড়ছে, শব্দ বেরোচ্ছে কুয়োর দেওয়ালে প্রতিধ্বনির মতো—“সত্যিটা বলো… সত্যিটা ফিরিয়ে দাও।”
অর্ণব চিৎকার করে উঠল, “আমি কীভাবে বলব? কার সত্যি?”
মুখটা ডুবে গেল আবার, জলের ঢেউ হুহু করে ছড়িয়ে পড়ল। কুয়োর ভেতরে বাতাস ভারী হয়ে গেল। হঠাৎ দড়ি যেন কারও হাতে কাটা গেল। অর্ণব ঝপাং করে জলে পড়ে গেল। ঠান্ডা জলে শরীর জমে যাচ্ছিল। উপরে উঠতে চাইলে অদৃশ্য হাত তাকে টেনে নিচে নামাচ্ছিল। চারদিকে শুধু কালো অন্ধকার আর ভেজা শরীরের গন্ধ।
হঠাৎ সে অনুভব করল, কেউ তাকে জড়িয়ে ধরছে। দু’হাত ঠান্ডা, কিন্তু শক্তিশালী। অর্ণব ছটফট করতে করতে তার মুখের কাছে আলো ফেলল। দেখল, সাদা শাড়ি পরা মেয়েটি তাকে আঁকড়ে ধরেছে। চোখে দুঃখের আগুন, ঠোঁটে এক ফোঁটা রক্তের মতো দাগ। “নিরঞ্জন…” সে নাম উচ্চারণ করতেই কুয়োর জল ফেনিয়ে উঠল। অর্ণব বুঝল, ভূত তাকে নিরঞ্জন ভেবে জড়িয়ে ধরেছে।
“আমি নিরঞ্জন নই!” অর্ণব গলায় জোর আনতে চেষ্টা করল। “আমি অর্ণব। শহর থেকে এসেছি। আমি তোমার গল্পটা শুনতে চাই। সত্যিটা জানতে চাই।”
মেয়েটির চোখে হাহাকার ফুটল। ধীরে ধীরে সে হাত ছাড়ল। তারপর অদ্ভুতভাবে জল শান্ত হয়ে গেল। অর্ণব কোনওভাবে কুয়োর দেওয়াল ধরে উপরে উঠল। নিঃশ্বাস নিতে নিতে বাইরে এল। শরীর কাঁপছে, কাপড় ভিজে সয়লাব। কুয়োর ধারে বসতেই আবার সেই লকেটটা মাটিতে ঝলমল করে উঠল। এবার ভেতরের নামের পাশে রক্তের দাগের মতো লেখা ফুটে উঠল—“হত্যা।”
অর্ণব কুয়োর দিকে তাকাল। তার মনে হচ্ছিল, ইন্দ্রাণী বারবার বলতে চাইছে—তার মৃত্যু আত্মহত্যা নয়, হত্যা। আর হত্যাকারী নিরঞ্জন। কিন্তু প্রমাণ? প্রমাণ কোথায়?
পরের দিন সকালে অর্ণব সরাসরি গ্রামের মন্দিরের পুরোহিতের কাছে গেল। পুরোহিত বহুদিন ধরে গ্রামেই আছেন। তিনি গম্ভীর মুখে বললেন, “বাবা, যা জানিস তা গোপন করিস না। এই মেয়েটির আত্মা শান্তি পাচ্ছে না। নিরঞ্জন কলকাতায় গিয়ে বড় লোক হয়েছিল। পরে গোপনে মারা যায়। কিন্তু ওর অপরাধ চাপা পড়ে থাকে। ইন্দ্রাণীর আত্মা এখনও কুয়োর ভেতর বন্দি।”
অর্ণব ভাবল, তবে কি সত্যিই এ কাজ ওর? নিরঞ্জনের অপরাধ ঢাকা পড়ে গেছে। আর ইন্দ্রাণী আজও মুক্তি পায়নি।
সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে আবার কুয়োর ধারে এল। এবার সে জোরে বলল, “ইন্দ্রাণী, আমি জানি তোমার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। আমি সত্যিটা প্রকাশ করব। তুমি যদি আমাকে পথ দেখাও।”
এক মুহূর্তের জন্য সব স্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর জলের ভেতর থেকে ভেসে উঠল সাদা শাড়ির একপ্রান্ত। বাতাসে ফিসফিসানি—“চিলেকোঠা… দড়ি… বাক্স।”
অর্ণব বুঝল, তাকে আবার ওপরে যেতে হবে। চিলেকোঠায় সে ফিরে গেল। সেখানে যে বাক্সটা আগে খুলেছিল, এবার তা আরও খানিকটা সরে গিয়েছে। ভেতরে ছিল আরও কিছু কাগজ, অর্ধেক পচে গেছে। কিন্তু একটা পাতায় স্পষ্ট লেখা—“নিরঞ্জন আমার নয়।” নিচে সই—ইন্দ্রাণী।
অর্ণবের শরীরে শিরশিরানি। এ যেন স্পষ্ট প্রমাণ, ইন্দ্রাণী বিয়ে মানতে চায়নি। হয়তো জোর করা হয়েছিল। আর না মানায় তাকে হত্যা করা হয়।
ঠিক তখনই হঠাৎ চারপাশে ঠান্ডা ছড়িয়ে পড়ল। বাতাস নিস্তব্ধ। পেছনে পায়ের শব্দ। অর্ণব ঘুরতেই দেখল, আলতার দাগ আবার ছড়িয়ে আসছে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। আর সেই দাগের ঠিক মাঝখানে এক ছায়া দাঁড়িয়ে আছে—চোখ দুটো লাল, ঠোঁটে করুণ হাসি।
“তুমি আমার কথা শুনবে তো?” ইন্দ্রাণীর কণ্ঠস্বর।
অর্ণব মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ। আমি তোমার সত্যি সবাইকে জানাব।”
হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া বইল। ছায়াটা মিলিয়ে গেল। মেঝেতে শুধু পড়ে রইল একগুচ্ছ চুড়ি—ভাঙা, রক্তমাখা।
অর্ণব কাঁপতে কাঁপতে বুঝল, খেলা এখন শেষ হয়নি। এই বাড়ির প্রতিটি দেওয়ালে ইন্দ্রাণীর কান্না আটকানো আছে। তাকে মুক্তি দেওয়া মানে কেবল রহস্য ফাঁস করা নয়—বরং প্রমাণ করে দেখানো, যে নিরঞ্জন খুন করেছিল।
কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেল—প্রমাণ কীভাবে দেবে সে? এই গ্রামে তো সবাই মনে করে, ইন্দ্রাণী আত্মহত্যা করেছিল। কে বিশ্বাস করবে একজন শহুরে মানুষকে, যে বলছে ভূতের সঙ্গে তার কথা হয়েছে?
আরও বড় প্রশ্ন—যদি ইন্দ্রাণী সত্যিই তাকে ব্যবহার করতে চায়, তবে সে কি বাঁচবে? নাকি এই কাহিনির শেষেও তার নিজের গলায় দড়ি পড়বে?
পর্ব ৫
অর্ণবের ভেতরে যেন একটা ভার জমে গেল। চারপাশে দিনের আলো থাকলেও তার মনে হচ্ছিল, মজুমদার ভিটে শুধু রাতেই নয়—দিনেও জীবন্ত হয়ে আছে। ইন্দ্রাণীর চোখের সেই শূন্যতা, তার ঠান্ডা কণ্ঠস্বর, ভাঙা চুড়ি আর লাল দাগ, সব যেন বুকের ভেতর দড়ি বেঁধে রাখছে। বাইরে পাখির ডাক, বাজারের শব্দ, সবকিছুর ওপরে একটা নীরব চাপা টান টের পাচ্ছিল সে।
গ্রামের লোকজনের কাছে গেলে তারা মুখ ঘুরিয়ে নিল। যেন অর্ণব কিছু অশুভ জেনে ফেলেছে। কমলা কাকিমা একবার শুধু বললেন, “ছেলেটা, সাবধানে থেকো। ওর নাম যতবার মুখে নেবে, ততবার ও তোমার কাছে আসবে। মুক্তি চাইবে।”
অর্ণব হেসে জবাব দিল, “মুক্তি চাইলে তো আমাকে সত্যিটা জানতে হবে।”
কিন্তু ভেতরে ভেতরে কাঁপছিল সে। রাতে ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করে যখন টেবিলের ওপর রাখা লকেটটার দিকে তাকাল, দেখল ভেতরের অক্ষরগুলো যেন বদলে যাচ্ছে। “ইন্দ্রাণী” নামটা ঝাপসা হয়ে গেল, কেবল ঝরে পড়া অক্ষরের মতো পড়ে রইল—“রাণী।” আর পাশের নাম “নিরঞ্জন”-এর ওপর লালচে দাগ।
সে বুঝল, ইন্দ্রাণী তার জীবনের গল্প খণ্ড খণ্ড করে দেখাচ্ছে।
সেই রাতেই ঘরে শোয়া ছিল অর্ণব। আকাশে বজ্রপাত হচ্ছিল। জানলার কাঁচে আলো পড়ে আবার অন্ধকার হচ্ছিল। ঠিক তখনই হাওয়ার ঝাপটা এসে জানলার কপাট খুলে দিল। টর্চ হাতে জানলার দিকে এগোতেই অর্ণব দেখল, জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সাদা শাড়ি পরা ছায়া। ভিজে কাপড় থেকে টপটপ জল পড়ছে। চোখে তাকানো, ঠোঁটে কোনও কথা নেই।
অর্ণব গলা শুকিয়ে গেলেও সাহস করে বলল, “তুমি সত্যিই কী চাও? আমি কী করতে পারি?”
ছায়াটা ঠোঁট নাড়ল। শব্দ এল না, কিন্তু কানে বাজল স্পষ্ট বাক্য—“প্রমাণ… দড়ি… কুয়ো।”
অর্ণব বুঝল, চিলেকোঠার দড়িটাই আসল। সেই দড়িই প্রমাণ, যা দিয়ে ইন্দ্রাণীর মৃত্যু সাজানো হয়েছিল।
পরদিন সকালে সে আবার চিলেকোঠায় গেল। কড়িবরগার ওপরে সত্যিই একটা পুরোনো দড়ি গুঁজে রাখা ছিল। শুকনো হলেও দড়ির গায়ে লালচে দাগ। টেনে নামাতেই তার বুক কেঁপে উঠল। দড়িটার একপ্রান্তে মেয়েদের চুল আটকে আছে। এতদিন সেটা হয়তো কেউ খেয়ালই করেনি।
অর্ণব দড়িটা বুকে নিয়ে নিচে নামল। কিন্তু তখনই শুনল পেছনে নূপুরের টুংটাং শব্দ। ঘুরতেই চিলেকোঠার কোণে দাঁড়িয়ে আছে সেই ছায়া। চোখে আগুন, ঠোঁটে হাহাকার।
“আমার সত্যি…” কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
অর্ণব বলল, “আমি সত্যিটা জানাব। তোমাকে মুক্তি দেব। কিন্তু তুমি আমাকে ছেড়ে দাও।”
ছায়াটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। কিন্তু বাতাসে রক্তমাখা গন্ধ ভেসে রইল।
অর্ণব গ্রামে গিয়ে অজিতবাবুকে দড়িটা দেখাল। বুড়ো হতবাক হয়ে গেল। কাঁপা গলায় বলল, “এটা তো সেই রাতের দড়ি! পুলিশকে খবর দেওয়া হয়নি, শুধু সবাই ভেবেছিল আত্মহত্যা।”
অর্ণব বলল, “এটা আত্মহত্যা নয়, হত্যা। প্রমাণ এটাই।”
কিন্তু গ্রামের অন্যরা বিশ্বাস করল না। তারা বলল, “ও ভিটেতে থাকা মানেই মাথা খারাপ হওয়া। ভূতের গল্প বানাচ্ছে।”
অর্ণব ভীষণ অসহায় বোধ করল। কিন্তু সে জানত, দড়িটা আসল প্রমাণ। আর কুয়োর ভেতর নিশ্চয়ই আরও কিছু আছে।
সেই রাতে অর্ণব কুয়োর পাশে বসে রইল। হাওয়া বইছিল শোঁ শোঁ করে। হঠাৎ কুয়োর ভেতর থেকে ভেসে উঠল লম্বা সাদা হাত, যেন কেউ টেনে আনছে ভেজা কাপড়। অর্ণব দেখল, হাতে একটা পুরোনো খাতা। হাতটা কুয়োর বাইরে বাড়িয়ে দিল, তারপর মিলিয়ে গেল। খাতাটা ভিজে, অর্ধেক ছেঁড়া। পাতাগুলো খুলতেই পড়া গেল কিছু শব্দ—“নিরঞ্জন… হিংস্র… আমার মৃত্যু আসছে।”
অর্ণব শিউরে উঠল। এ যেন ইন্দ্রাণীর শেষ লেখা, হয়তো ডায়েরি।
ঠিক তখনই চারপাশের অন্ধকারে হাওয়া থেমে গেল। কানে বাজল কর্কশ পুরুষকণ্ঠ—“চুপ করো!”
অর্ণব চমকে উঠল। এই কণ্ঠ তো ভূতের নয়, যেন জীবিত কারও। চারপাশে তাকাতেই সে বুঝল, অদৃশ্য আর দৃশ্যের মাঝখানে একটা নতুন খেলা শুরু হয়েছে।
হঠাৎ ঘরের ভেতর থেকে টেবিলে রাখা লকেটটা ঝনঝন করে উঠল। খুলে গিয়ে ভেতরের নামগুলো আবার ভেসে উঠল। এবার “নিরঞ্জন”-এর অক্ষরগুলো আগুনের মতো জ্বলছিল, আর ইন্দ্রাণীর নামটা যেন কাঁদছিল।
অর্ণব বুঝল, নিরঞ্জনের আত্মাও শান্তি পায়নি। হয়তো অপরাধের ছায়ায় সে আটকে আছে।
সে মাটিতে বসে বলল, “তোমরা দুজনেই মুক্তি চাও। আমি কেবল সত্যিটা জানাতে পারব। ইন্দ্রাণীকে হত্যা করা হয়েছে, এটা প্রমাণ করব।”
চারপাশের বাতাসে একটা ভারী চাপ পড়ল। হাওয়া বইতে লাগল, নূপুরের শব্দ মিশল বজ্রপাতের গর্জনে। কুয়োর ভেতর থেকে ভেসে উঠল দুই ছায়া—একটি নারী, একটি পুরুষ। নারী ছায়া কাঁদছে, পুরুষ ছায়া দাঁত চেপে তাকিয়ে আছে।
অর্ণব শিউরে উঠল। বুঝল, নিরঞ্জনের আত্মাও এখানে। তার আর ইন্দ্রাণীর মধ্যে চিরন্তন লড়াই চলছেই।
ঠিক তখনই কণ্ঠস্বর বাজল, একসঙ্গে—একজন নারীর, একজন পুরুষের।
“আমাকে বাঁচাও।”
“আমাকে আড়াল করো।”
অর্ণব ভয় আর দায়িত্বের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইল। সামনে ঝড়, পিছনে অন্ধকার। তার হাতে দড়ি, লকেট আর ভেজা খাতা।
এই মুহূর্তে যদি সে সঠিক পদক্ষেপ না নেয়, তবে হয়তো চিরদিনের মতো এই ভিটের সঙ্গে আটকে যাবে।
সে ঠান্ডা গলায় বলল, “আমি সত্যিটা প্রকাশ করব। তোমাদের লড়াই আমার নয়। কিন্তু পৃথিবী জানুক, ইন্দ্রাণীর মৃত্যু ছিল হত্যা।”
বজ্রপাত চমকাল আকাশ। ছায়াগুলো মিলিয়ে গেল। বাতাস আবার থেমে গেল।
কিন্তু অর্ণব বুঝতে পারল, লড়াই শেষ হয়নি। কেবল শুরু।
পর্ব ৬
অর্ণব সারা রাত ঘুমোতে পারল না। দড়ি, খাতা আর লকেট—এই তিনটে বস্তু তার ঘরের মাঝখানে টেবিলের ওপরে রাখা ছিল। আলো নিভিয়ে শুয়ে থাকলেও মনে হচ্ছিল, অদৃশ্য কারও দৃষ্টি ঘরের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাইরে কুকুর ডাকছে, দূরে বাজপাখির হাহাকার। অথচ সবচেয়ে ভয়ানক ছিল নিস্তব্ধতা—যেন সবকিছু থেমে গেছে, শুধু টেবিলের ওপরে বস্তুগুলো শ্বাস নিচ্ছে।
ভোরের দিকে চোখ লেগে এলে হঠাৎ একটা স্বপ্নে সে দেখল—ইন্দ্রাণী শাড়ি ভিজে কুয়োর ধারে বসে আছে। তার পাশে নিরঞ্জন দাঁড়ানো, মুখে ঘৃণার ছাপ। ইন্দ্রাণী বলছে, “আমাকে ফেরত দাও আমার সত্যি।” নিরঞ্জন কড়া চোখে তাকিয়ে বলছে, “চুপ করো। এ বাড়ি আমার।” স্বপ্নের মধ্যে অর্ণব চিৎকার করতে গিয়েও পারল না। গলা শুকিয়ে গেল। চমকে জেগে উঠে দেখল, জানালার কাঁচ ভিজে আছে, অথচ বাইরে বৃষ্টি হয়নি।
অর্ণবের মাথায় তখন একটাই ভাবনা—এই সত্যিটা তাকে প্রমাণ করতে হবে। নইলে এই ভিটের অন্ধকার থেকে সে মুক্তি পাবে না। সে ডায়েরির ভেজা পাতাগুলো শুকোতে দিল। অক্ষরগুলো অর্ধেক গলে গেলেও কিছু শব্দ স্পষ্ট পড়া যাচ্ছিল—“নিরঞ্জন… সহ্য করা যায় না… আমাকে ফেলে দেবে… আমি চাই না…” এই টুকরো টুকরো বাক্যই ইঙ্গিত দিচ্ছিল, ইন্দ্রাণীর মৃত্যু স্বাভাবিক নয়।
দিনের বেলায় সে আবার বাজারে গেল। গ্রামবাসীরা তার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাল। কেউ কাছে এল না। কেবল অজিতবাবু একপাশে ডেকে বললেন, “তুমি খুব গভীরে নেমে পড়েছ। ও ভিটের ছায়া থেকে বাঁচা মুশকিল।”
অর্ণব বলল, “ইন্দ্রাণীকে হত্যা করা হয়েছে। এই দড়ি আর ডায়েরি তার প্রমাণ।”
অজিত দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “প্রমাণ দেখানোর লোক কোথায়? পুলিশ এখানে আসবে না। পুরোনো ঘটনা, কাগজপত্র নেই। সবাই ভেবেছে আত্মহত্যা। তাছাড়া নিরঞ্জনের পরিবার একসময় ক্ষমতাবান ছিল। তাদের নাম নেওয়াই ছিল অপরাধ।”
অর্ণব দৃঢ় গলায় বলল, “তাহলে আমি শহরে নিয়ে যাব প্রমাণ। সবাইকে জানাব।”
কিন্তু মনের গভীরে সে জানত, সহজ হবে না। ইন্দ্রাণীর আত্মা তাকে ছাড়বে না যতক্ষণ না সে সত্যি পুরোপুরি উন্মোচন করে।
সেই রাতে আবার ভয়ঙ্কর কিছু ঘটল। অর্ণব টেবিলে বসে ডায়েরি পড়ছিল। হঠাৎ খাতার পাতা নিজে থেকে উল্টোতে লাগল। বাতাস নেই, তবু পাতাগুলো যেন কারও হাতে উল্টোচ্ছে। শেষ পাতায় থেমে গেল। তাতে লেখা ছিল—“আমাকে ঠেলে দিল। আমি উঠতে পারিনি।” লেখাটা ভিজে, কিন্তু স্পষ্ট। অর্ণবের চোখে অন্ধকার নেমে এল।
ঠিক তখনই দরজায় টোকা পড়ল। অর্ণব সাহস করে দরজা খুলল। বাইরে কেউ নেই। কিন্তু মেঝেতে আলতার ভেজা দাগ আবার দেখা গেল। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে। অর্ণব টর্চ হাতে দাগগুলোর পিছু নিল।
চিলেকোঠায় গিয়ে সে জমে গেল। কড়িবরগার নিচে দড়িটা দুলছে। অথচ সে তো দড়ি খুলে টেবিলে রেখেছিল। চোখ মুছে আবার দেখল—সত্যিই দড়ি ঝুলছে। তার নিচে দাঁড়িয়ে আছে সাদা শাড়ি পরা ছায়া। এবার স্পষ্ট মুখ দেখা যাচ্ছে। চোখ দুটো ফাঁপা, ঠোঁটে ব্যথার রেখা।
ইন্দ্রাণী ধীরে ধীরে বলল, “আমাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল।”
অর্ণব জবাব দিল, “আমি জানি। নিরঞ্জন তোমাকে হত্যা করেছিল।”
হঠাৎ ঝড়ের মতো আওয়াজ উঠল। দড়িটা দুলতে লাগল। ছায়াটা তীব্র গলায় চেঁচিয়ে উঠল, “না! আমি শান্তি চাই। আমাকে মুক্তি দাও। সত্যিটা প্রকাশ করো।”
অর্ণব কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আমি শহরে নিয়ে যাব প্রমাণ। সবাই জানবে।”
ইন্দ্রাণীর ছায়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। কিন্তু তার কণ্ঠস্বর এখনও বাতাসে বাজছিল—“ফিরিয়ে দাও আমার সত্যি।”
সকালে অর্ণব খেয়াল করল, টেবিলে রাখা দড়িটা সত্যিই নেই। যেন রাতের বেলায় ছায়াটা তা নিয়ে নিয়েছে। কেবল চুড়ির টুকরো আর ডায়েরির ভেজা পাতা রয়ে গেছে।
অর্ণব ঠিক করল, আর দেরি নয়। শহরে ফিরে যাবে। কিন্তু ট্রেন ধরতে গ্রাম ছাড়ার সময় হঠাৎ তার কানে ভেসে এল নারীকণ্ঠ—“যেতে পারবে না।”
সে ঘুরে তাকাল। কেউ নেই। তবু মাটিতে ভেজা আলতার দাগ দেখা গেল। দাগগুলো সোজা গিয়ে মজুমদার ভিটের দিকে মিলিয়ে গেল।
অর্ণবের বুক কেঁপে উঠল। বুঝল, ইন্দ্রাণী এখনও তাকে ছাড়তে রাজি নয়। সত্যিটা ফাঁস না হওয়া পর্যন্ত এই বাড়ির সঙ্গে তার টান কাটবে না।
সে আবার বাড়ির ভেতরে ফিরে গেল। এবার কুয়োর ধারে দাঁড়াতেই কুয়োর জল হঠাৎ ফেনিয়ে উঠল। ভেতর থেকে ভেসে উঠল কর্কশ পুরুষকণ্ঠ—“মিথ্যে রটাচ্ছিস।” অর্ণব বুঝল, নিরঞ্জনের আত্মাও এখানে আটকে আছে।
তখনই দুই দিক থেকে দুই কণ্ঠস্বর ভেসে এল—
ইন্দ্রাণী: “আমাকে মুক্তি দাও।”
নিরঞ্জন: “আমার অপরাধ ঢাকো।”
অর্ণব দু’হাতে কান ঢেকে বসে পড়ল। তার সামনে যেন দুই আত্মার চিরন্তন দ্বন্দ্ব। সে জানত, একজনকে শান্তি দিতে হলে অন্যজনকে প্রকাশ করতে হবে।
সেই মুহূর্তে হঠাৎ কুয়োর ধারে রাখা খাতা থেকে আলো বেরোল। পাতায় নতুন অক্ষর ফুটে উঠল। অর্ণব পড়ে শুনল—“আমি নিরঞ্জনের হাতে মারা গেছি।”
অর্ণবের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। এই কথাটাই তো প্রমাণ! ইন্দ্রাণীর আত্মা নিজেই লিখে দিল সত্যিটা।
হাওয়া এক ঝলক বইল। কুয়োর জল আবার শান্ত হয়ে গেল। ইন্দ্রাণীর কণ্ঠস্বর মৃদু ভেসে এল—“এবার… বলো সবার কাছে।”
অর্ণব হাঁটু মুড়ে বসে প্রতিজ্ঞা করল, “আমি তোমার সত্যিটা পৃথিবীর কাছে প্রকাশ করব।”
আকাশে তখন ভোরের আলো ফুটছিল। তবু তার মনে হচ্ছিল, ঝড় আসছে। কারণ নিরঞ্জনের আত্মা নিশ্চয়ই এত সহজে ছাড়বে না।
পর্ব ৭
অর্ণব ভোরের আলোয় দাঁড়িয়ে বুঝল, এই ভিটে তার দিনগুলো গোনা শুরু হয়েছে। সত্যি বেরোনো সহজ নয়। ইন্দ্রাণীর আত্মা শান্তি চাইছে, নিরঞ্জনের আত্মা ঢাকতে চাইছে অপরাধ। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সে—একজন শহুরে মানুষ, যার হাতে কেবল ভেজা খাতা, ভাঙা চুড়ি আর লকেট। কিন্তু এগুলোই হয়তো একদিন প্রমাণ হয়ে উঠবে।
গ্রামের মানুষজনকে কিছুটা বোঝানোর চেষ্টা করল অর্ণব। বলল, “এই বাড়ি কেবল ভূতের ভয় নয়, একটা হত্যার ইতিহাস বহন করছে। ইন্দ্রাণী আত্মহত্যা করেনি, খুন হয়েছে।” কিন্তু কেউ বিশ্বাস করল না। তারা বলল, “তুমি মাথা খারাপ করেছ, দালানবাড়িতে থাকলে সবারই হয়।”
অর্ণব জানত, এই প্রমাণ শহরে নিয়ে গিয়েই কাজে লাগাতে হবে। তাই সে ডায়েরি আর লকেট ব্যাগে ভরল। দড়ি যদিও আর তার কাছে নেই—সে রাতে ছায়ার সঙ্গে মিলিয়ে গেছে। তবু যা আছে তাই যথেষ্ট।
কিন্তু ভিটে যেন তাকে যেতে দিতে চাইছিল না। দরজার বাইরে বেরোতে গেলেই কানে বাজছিল নারীকণ্ঠ—“থেমে যাও।” অর্ণব গলা শুকিয়ে গেলেও দৃঢ় থাকল। মনে মনে বলল, “আমি থামব না। তুমি আমাকে মুক্তি দিতে ডাকছ, আমিও তোমার সত্যিটা উন্মোচন করব।”
সন্ধ্যার দিকে ফের ভয়ঙ্কর কিছু ঘটল। অর্ণব ঘরে বসে ডায়েরির পাতায় চোখ রাখছিল। হঠাৎ খাতাটা নিজে নিজেই খুলে গেল। একেবারে মাঝখানের পাতায় থেমে গেল। সেখানে লেখা—“যদি আমি না থাকি, নিরঞ্জন আমাকে কুয়োতে ফেলবে।” অর্ণবের বুক কেঁপে উঠল। এর মানে তো ইন্দ্রাণী আগেই বুঝতে পেরেছিল তার মৃত্যুর পরিকল্পনা।
হঠাৎ বাতাস নিস্তব্ধ হয়ে গেল। ঘরের ভেতর ঠান্ডা ছড়িয়ে পড়ল। অর্ণব টর্চ হাতে নিল। টেবিলের ওপর রাখা লকেটটা ঝনঝন শব্দ করতে লাগল। খুলে গিয়ে ভেতর থেকে ভেসে উঠল লাল আলো। আর সেই আলো ঘরের দেয়ালে প্রতিফলিত হলো—এক পুরুষ মুখ। চোখে আগুন, ঠোঁটে বিষ।
“চুপ করো,” গর্জে উঠল কণ্ঠস্বর। “আমার নাম নেবে না। আমি নিরঞ্জন। এই বাড়ি আমার।”
অর্ণব স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বুঝল, নিরঞ্জনের আত্মা এখন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
ঠিক তখনই জানলার বাইরে সাদা শাড়ি পরা ছায়া ভেসে উঠল। চোখে হাহাকার, ঠোঁটে ভিজে কান্না। সে বলল, “ও আমার সব সত্যি চেপে দিয়েছিল। তুমি আমার হয়ে বলো।”
নিরঞ্জনের ছায়া হাওয়ায় কেঁপে উঠল। “মিথ্যে! ও আমার মানহানি করতে চাইত।”
ঘরের ভেতর ঝড়ের মতো আওয়াজ উঠল। টেবিলের ওপর রাখা খাতা উড়ে গিয়ে মেঝেতে পড়ল। পাতাগুলো ছড়িয়ে গেল। প্রতিটি পাতার ওপর রক্তের মতো অক্ষর ফুটে উঠল—“খুন।”
অর্ণব কানে হাত দিল। মাথার ভেতর একসঙ্গে বাজতে লাগল দুই কণ্ঠস্বর।
ইন্দ্রাণী: “আমাকে মুক্তি দাও।”
নিরঞ্জন: “আমাকে আড়াল করো।”
অর্ণব বুঝল, এক সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। সে টেবিলের ওপরে লকেটটা তুলে নিল। জোরে বলল, “আমি সত্যিটাই প্রকাশ করব। তুমি যদি খুন করে থাকো, তবে তোমার নামও উচ্চারণ হবে।”
হাওয়ায় অদ্ভুত কম্পন হলো। নিরঞ্জনের ছায়া গর্জে উঠল, “তাহলে তুই মরবি।”
অর্ণব টর্চের আলো ছায়ার দিকে ফেলতেই সেটা মিলিয়ে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই ঘরের দরজা জোরে ধাক্কা খেল। যেন অদৃশ্য হাত সেটা ভাঙতে চাইছে।
অর্ণব দরজা বন্ধ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। শরীর কাঁপছিল। সে বুঝল, যুদ্ধ এখন শুরু হয়েছে।
পরের দিন সকালটা অস্বাভাবিক শান্ত ছিল। সূর্যের আলো বারান্দায় ছড়িয়ে পড়েছে। অর্ণব মনে মনে ভাবল, হয়তো রাতের ভয় কেটে গেছে। কিন্তু কুয়োর ধারে যেতেই দেখল, মাটিতে আবার আলতার ভেজা দাগ। দাগগুলো সোজা গিয়ে থেমে আছে কুয়োর মুখে।
সে দড়ি নামাল। বালতি উঠল ভেজা কাপড় নিয়ে। শাড়ির আঁচল, লাল দাগ লেগে আছে। তার ভেতরে লুকোনো একটা কাঠের বাক্স। খুলতেই ভেতর থেকে পড়ে গেল কয়েকটা পুরোনো গয়না, আর একখানা ছেঁড়া ফটো।
ফটোয় দেখা গেল ইন্দ্রাণী আর নিরঞ্জন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ইন্দ্রাণীর মুখে অদ্ভুত ভয়। আর নিরঞ্জনের চোখে হিংস্র আনন্দ। ফটোর পিছনে লেখা—“আমার নয়।”
অর্ণব কেঁপে উঠল। বুঝল, এটাই ইন্দ্রাণীর শেষ প্রমাণ।
হঠাৎ পিছন থেকে ঠান্ডা স্পর্শ। ঘুরতেই দাঁড়িয়ে আছে সাদা ছায়া। মুখে করুণ হাসি। “এখন তুমি বুঝেছ।”
অর্ণব মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ। আমি সবাইকে বলব।”
তখনই বাতাসে কর্কশ গর্জন। নিরঞ্জনের কণ্ঠস্বর বাজল, “তুই বাঁচবি না। কেউ জানবে না।”
কুয়োর জল হুহু করে উঠল। কালো ঢেউ কুয়োর মুখ ছাপিয়ে উঠল। ছায়া মিলিয়ে গেল। অর্ণব পেছনে হোঁচট খেল।
বুকের ভেতর স্পষ্ট হলো—এখন আর শুধু প্রমাণ নয়। তার জীবনটাই প্রশ্ন।
সেই রাতে ঘরে শোয়া ছিল অর্ণব। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখল, টেবিলের ওপরে রাখা ফটো নিজে থেকে জ্বলে উঠছে। আগুনে গা ধরা নেই, তবু ছবির ভেতরে নিরঞ্জনের মুখ লাল আলোতে জ্বলছে।
আরেকটা কণ্ঠস্বর কানে এল—ইন্দ্রাণীর, “তুমি দেরি করো না। সত্যিটা এখনই বলো। নইলে তুমিও আটকে যাবে।”
অর্ণবের বুকের ভেতর কাঁপুনি উঠল। সে জানল, তার হাতে সময় খুব কম। নিরঞ্জনের ছায়া ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে। আর ইন্দ্রাণী মরিয়া হয়ে মুক্তি চাইছে।
বাড়ির দেয়াল থেকে ভিজে জলের দাগ বেয়ে নামছিল। মনে হচ্ছিল, পুরো ভিটেটা কেঁদে উঠছে।
অর্ণব বুঝল, আসল যুদ্ধ আসতে চলেছে।
অর্ণব জানত, মজুমদার ভিটে আর কেবল একটা ভুতুড়ে বাড়ি নয়—এটা যেন একটা আদালত, যেখানে ইন্দ্রাণী আর নিরঞ্জনের আত্মা লড়ছে। একজন সত্যিটা প্রকাশ করতে চাইছে, আরেকজন ঢাকতে চাইছে। মাঝখানে সে একমাত্র সাক্ষী, যার হাতে খণ্ডিত প্রমাণ।
রাত যত এগোচ্ছিল, ভিটেটা ততই জীবন্ত হয়ে উঠছিল। জানলার ফাঁক দিয়ে ঢুকছিল ভিজে কুয়াশা, মেঝেতে জমছিল আলতার পায়ের দাগ। টেবিলের ওপর রাখা খাতা আবার খুলে যাচ্ছিল বাতাস ছাড়াই। পাতাগুলো উল্টে গিয়ে থেমে গেল এক লাইনে—“আমি উঠতে পারিনি। আমাকে টেনে নামানো হয়েছিল।”
অর্ণব বুক চেপে ধরল। এবার সব স্পষ্ট—ইন্দ্রাণীকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল।
হঠাৎ দরজায় ধাক্কা। শক্ত, ভয়ঙ্কর। টর্চ হাতে এগিয়ে গেল সে। দরজা খুলে দেখল, বাইরে ফাঁকা বারান্দা। কিন্তু বারান্দার মেঝেতে দাঁড়িয়ে আছে পুরুষ ছায়া। নিরঞ্জনের মুখ। চোখ লাল, দাঁত কিড়মিড় করছে।
“চুপ করো!” ছায়া গর্জে উঠল। “আমার নাম আর মুখে নিও না। ও আমার স্ত্রী ছিল। মানতে চাইনি। তাই শাস্তি পেয়েছে।”
অর্ণব সাহস করে বলল, “তুমি তাকে হত্যা করেছ। প্রমাণ আমার কাছে আছে।”
হঠাৎ হাওয়া বইল। ছায়াটা ঝাপটা মেরে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ঘরের ভেতর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। মেঝেতে রাখা খাতা উড়ে গিয়ে দেয়ালে আছড়ে পড়ল। পাতাগুলো ছিঁড়ে মেঝেতে ছড়িয়ে গেল। প্রতিটি পাতার ওপর রক্তমাখা শব্দ ফুটে উঠল—“খুন… খুন… খুন।”
অর্ণব ঘামতে লাগল। কিন্তু তার বুকের ভেতর দৃঢ়তা বাড়ল। সে জোরে বলল, “আমি সত্যিটা বলব। তোমার অপরাধ চেপে রাখব না।”
নিরঞ্জনের ছায়া চেঁচিয়ে উঠল। হাওয়ায় বজ্রপাতের মতো আওয়াজ হলো। হঠাৎ ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। টর্চও নিভে গেল। অর্ণব কেবল অনুভব করল—ঠান্ডা হাত তার গলা চেপে ধরছে। সে শ্বাস নিতে পারছিল না। ছটফট করতে করতে ফিসফিস করে বলল, “ইন্দ্রাণী… আমাকে বাঁচাও।”
অন্ধকারের ভেতরেই আলো ঝলকে উঠল। সাদা শাড়ি পরা নারীর ছায়া জানলা দিয়ে ভেসে এলো। তার চোখে জল, ঠোঁটে ব্যথার রেখা। সে হাত বাড়াল। নিরঞ্জনের ছায়া গর্জে উঠল, “না!”
দুই ছায়া লড়ে উঠল একে অপরের সঙ্গে। হাওয়া ঘূর্ণি তুলল। অর্ণব মেঝেতে পড়ে রইল, শ্বাস নিতে নিতে। তার চোখের সামনে ঘটল এক অদ্ভুত যুদ্ধ—দুই আত্মার। একদিকে পুরুষের নিষ্ঠুর গর্জন, অন্যদিকে নারীর কান্না।
অবশেষে হাওয়া থেমে গেল। ছায়াগুলো মিলিয়ে গেল। ঘরে রয়ে গেল কেবল দড়ির টুকরো আর ভাঙা চুড়ি। অর্ণব বুঝল, যুদ্ধ শেষ নয়। কেবল এক বিরতি।
ভোর হলে সে আবার কুয়োর ধারে গেল। এবার কুয়োর জল শান্ত। কিন্তু ভেতরে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত প্রতিফলন—তার নিজের মুখ, কিন্তু গলায় দড়ি বাঁধা। অর্ণব আঁতকে উঠল। কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “যদি সত্যিটা না বলো, তুমিও আটকে যাবে।”
অর্ণব প্রতিজ্ঞা করল, “আমি বলব। তোমাকে মুক্তি দেব।”
তখনই কুয়োর ভেতর থেকে ধীরে ধীরে ভেসে উঠল একটা বাক্স। অর্ণব টেনে তুলল। ভিজে কাঠের বাক্সটা খুলতেই ভেতরে পেল কিছু পুরোনো কাগজ। একখানা ফিকে কালি লেখা চিঠি—“নিরঞ্জন আমার নয়। আমি বাধ্য হচ্ছি। যদি কিছু হয়, জেনে রেখো, আমি চেয়েছিলাম মুক্তি।” সই—ইন্দ্রাণী।
অর্ণবের চোখে জল এসে গেল। প্রমাণ এখন আরও স্পষ্ট। ইন্দ্রাণীর লেখা নিজেই জানিয়ে দিচ্ছে তার মৃত্যু ছিল হত্যা।
কিন্তু ঠিক তখনই চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। হাওয়া শোঁ শোঁ করে উঠল। গর্জন ভেসে এল—“কেউ জানবে না।” নিরঞ্জনের কণ্ঠস্বর।
অর্ণব বাক্স বুকে চেপে ধরে বলল, “সবাই জানবে। এই প্রমাণ আমি শহরে নিয়ে যাব।”
হাওয়ায় ঝড় উঠল। কুয়োর জল ফেনিয়ে উঠল। হঠাৎ ভিজে হাত তার কাঁধে স্পর্শ করল। অর্ণব ঘুরে দেখল—ইন্দ্রাণীর ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। চোখে শান্তি, তবু অশ্রু।
“ধন্যবাদ,” সে ফিসফিস করে বলল। “এখন তুমি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাও। নইলে ও তোমাকে মারবে।”
অর্ণব পিছনে তাকাল। বারান্দার অন্ধকারে আবার ভেসে উঠেছে নিরঞ্জনের মুখ। চোখে আগুন, ঠোঁটে বিষ।
অর্ণব দৌড় দিল। ভিটে পেরিয়ে গ্রামের দিকে ছুটল। পেছনে বাজতে লাগল গর্জন—“তুই মরবি।”
গ্রামের মোড়ে পৌঁছেই সে হাঁপাতে হাঁপাতে থেমে গেল। চারপাশে সকাল নেমে এসেছে, কিন্তু তার বুকের ভেতর এখনও অন্ধকার ঝড়।
সে জানল, সত্যিটা প্রকাশ করতে তাকে শহরে ফিরতেই হবে। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেল—নিরঞ্জনের আত্মা কি তাকে যেতে দেবে?
পর্ব ৯
অর্ণব বুঝতে পারছিল, এবার আর দেরি করলে সর্বনাশ। মজুমদার ভিটের অন্ধকার তাকে গ্রাস করার আগে শহরে পৌঁছতে হবে। তবু এক অদ্ভুত বাঁধন তাকে আটকে রাখছিল। যত দূরে যাওয়ার চেষ্টা করছে, ততবারই যেন পায়ের নিচে শেকড় গজাচ্ছে, অদৃশ্য দড়ি টেনে ধরছে।
ব্যাগে ভেজা খাতা, চিঠি আর লকেট গুঁজে নিল সে। সকালবেলায় গ্রামের স্টেশন থেকে ট্রেন ধরার প্ল্যান করল। বেরোবার সময় কমলা কাকিমা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় বললেন, “ছেলে, সাবধানে যাস। ওর ছায়া যদি তোর পিছু নেয়, তবে আর রক্ষা নেই।”
অর্ণব মাথা নাড়ল, কিন্তু জবাব দিল না। কাকিমার চোখে এমন ভয় ছিল যে বুকের ভেতর তারও শীতল স্রোত বইল।
স্টেশনের পথে হাঁটতে হাঁটতে চারপাশে বারবার অদ্ভুত শব্দ শুনছিল সে। হাওয়ায় নূপুরের টুংটাং, কানে ফিসফিসানি—“থামো… থামো।” সে জানত, ইন্দ্রাণী নয়—এটা নিরঞ্জনের কণ্ঠ। আতঙ্কে গা শিউরে উঠলেও ব্যাগের ভেতরের কাগজপত্রে হাত রাখতেই ভেতরে ভেতরে সাহস জেগে উঠল।
স্টেশনে পৌঁছে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াতেই হঠাৎ ট্রেন দেরি হলো। ঘোষণার আওয়াজ ভেসে এল—“প্রচণ্ড ঝড়ের কারণে গাড়ি দেরি করবে।” অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঠিক তখনই টানেল থেকে হঠাৎ ভিজে বাতাস এসে কানে বাজল, “যেতে পারবি না।”
সে ঘুরে তাকাল। ভিড়ের মাঝে স্পষ্ট দাঁড়িয়ে আছে নিরঞ্জনের ছায়া। চোখে আগুন, ঠোঁটে বিষ হাসি। লোকজন কিছু টের পেল না। কিন্তু অর্ণবের কাছে ছায়াটা সত্যি।
অর্ণব দৌড় দিল স্টেশন ছেড়ে। পিছনে ভেসে আসছিল গর্জন—“তুই মরবি, কেউ জানবে না।”
সে সোজা ফিরে এল মজুমদার ভিটের কাছে। মনে হচ্ছিল, যতই পালানোর চেষ্টা করবে, ছায়া তাকে আবার ফিরিয়ে আনবে। কুয়োর সামনে দাঁড়িয়ে হাপাচ্ছিল সে।
ঠিক তখনই কুয়োর জল শান্তভাবে উথলে উঠল। ফেনার ভেতর থেকে ইন্দ্রাণীর মুখ ভেসে উঠল। চোখে জল, ঠোঁটে মৃদু হাসি।
“ভয় পেও না,” সে ফিসফিস করে বলল। “তুমি আমার প্রমাণ বাঁচিয়েছ। এখন কেবল শেষ পদক্ষেপ।”
অর্ণব কাঁপা গলায় বলল, “কী করব?”
কুয়োর ভেতর থেকে কণ্ঠ এল, “চিলেকোঠায় যা। সেখানে আরও কিছু আছে। যা লুকিয়ে রেখেছিল নিরঞ্জন।”
অর্ণব বুকের ভেতর সাহস সঞ্চয় করল। আবার চিলেকোঠায় উঠল। ধুলো, অন্ধকার, আর ভাঙা কাঠের গন্ধ। কোণে রাখা পুরোনো ট্রাঙ্কটাকে এবার ভালো করে টানল। ভেতরে সাদা কাপড়ে মোড়ানো একগুচ্ছ কাগজ পেল। খুলতেই বেরোল বিবাহনামা—ইন্দ্রাণী আর নিরঞ্জনের বিয়ের কাগজ। কিন্তু সেখানে ইন্দ্রাণীর সইয়ের জায়গা ফাঁকা। তার পাশে কেবল আঙুলের ছাপ—জোর করে নেওয়া।
অর্ণব শিউরে উঠল। এ তো স্পষ্ট প্রমাণ—ইন্দ্রাণী জোর করে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। আর নিরঞ্জন সেই কাগজ আড়াল করেছিল।
ঠিক তখনই কড়িবরগার নিচে দড়ি দুলতে শুরু করল। অর্ণব চোখ মুছে দেখল—দড়ি থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে। অন্ধকারে নিরঞ্জনের মুখ ভেসে উঠল।
“তুই কিছুই করতে পারবি না। এ কাগজ কেউ দেখবে না।”
অর্ণব টর্চ জ্বালিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “এবার শেষ। তুই যতই আটকাস, আমি প্রমাণ নিয়ে যাব।”
নিরঞ্জনের ছায়া হিংস্র হয়ে উঠল। দড়ি ছিঁড়ে নেমে এসে অর্ণবের গলা জড়িয়ে ধরল। শ্বাস বন্ধ হয়ে এল তার। শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল।
ঠিক সেই মুহূর্তে জানলা ভেঙে ভেতরে ঢুকল সাদা ছায়া। ইন্দ্রাণী। চোখে শান্তির আলো, হাতে ভাঙা চুড়ি। সে দড়ির ওপর হাত রাখতেই অদৃশ্য আগুন জ্বলে উঠল। নিরঞ্জনের ছায়া চেঁচিয়ে উঠল—“না!”
আওয়াজে পুরো চিলেকোঠা কেঁপে উঠল। বাতাস ঝড়ের মতো বয়ে গেল। অর্ণব মুক্ত হয়ে মাটিতে পড়ল।
ইন্দ্রাণীর কণ্ঠ ভেসে এল, “তাড়াতাড়ি চলে যাও। প্রমাণ নিয়ে যাও।”
অর্ণব ট্রাঙ্ক থেকে কাগজপত্র গুটিয়ে ব্যাগে ভরল। দৌড়ে নিচে নামল। বারান্দা পেরোতে না পেরোতেই কানে বাজল কর্কশ গর্জন—“তুই মরবি।”
কুয়োর জল উথলে উঠে বারান্দা ভিজিয়ে দিল। জল থেকে হাত বেরিয়ে আসছিল, কালো, শ্যাওলা ঢাকা। হাতগুলো টেনে ধরছিল অর্ণবকে। সে মরিয়া হয়ে দৌড় দিল। পিছনে হাওয়ায় চিৎকার ভেসে আসছিল—“আমার অপরাধ কেউ জানবে না।”
অর্ণব গ্রাম পেরিয়ে ছুটতে লাগল। রাস্তায় লোকজন তাকিয়ে রইল, কিন্তু সে থামল না। বুকের ভেতর একটাই প্রতিজ্ঞা—শহরে গিয়ে প্রমাণ প্রকাশ করবে।
কিন্তু মনে হচ্ছিল, ছায়া এখনও পিছু নিচ্ছে। পায়ের শব্দে মাটি কাঁপছিল। কানে বাজছিল নূপুরের মিশ্রণ আর কর্কশ গর্জন।
অর্ণব বুঝল, শেষ লড়াই এখনও বাকি।
পর্ব ১০
অর্ণব শহরের পথে বেরিয়ে পড়ল। ব্যাগের ভেতরে ভেজা খাতা, লকেট আর জোর করে নেওয়া বিয়ের কাগজপত্র—সব যেন আগুন হয়ে তাকে জ্বালাচ্ছে। ট্রেনের কামরায় বসে জানালার বাইরে তাকিয়েছিল সে। কিন্তু প্রতিটি স্টেশন পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত একটা চাপ অনুভব করছিল। কানে শোঁ শোঁ শব্দ, ফিসফিসানি—“ফিরে যা… ফিরে যা…”। যাত্রীদের ভিড়ের মাঝেও যেন ছায়া বসে আছে এক কোণে।
ট্রেন হঠাৎ থেমে গেল অজানা এক স্টেশনে। আলো নিভে গেল। কামরার অন্ধকারে অর্ণব টর্চ জ্বালাতেই দেখল—সামনের সিটে বসে আছে নিরঞ্জনের ছায়া। লালচে চোখ, ঠোঁটে বিষাক্ত হাসি।
“তুই কি ভেবেছিস, কাগজে-খাতায় প্রমাণ লুকিয়ে রাখলে কেউ বিশ্বাস করবে? আমি মরেও এই কাহিনি ঢেকে রাখব।”
অর্ণব বুক চেপে ধরল। তবু জোরে বলল, “তুমি তাকে খুন করেছিলে। ইন্দ্রাণী আত্মহত্যা করেনি। প্রমাণ আমার কাছে আছে।”
নিরঞ্জন দাঁত কিড়মিড় করে গর্জে উঠল। কামরার জানলা ভেঙে হাওয়া ঢুকে পড়ল। যাত্রীরা টেরই পেল না। যেন অদৃশ্য যুদ্ধ চলছে শুধু অর্ণবের চারপাশে।
ঠিক তখনই কানে এল নরম কণ্ঠস্বর—ইন্দ্রাণীর। “ভয় পেও না। তুমি আমার সত্যি বাঁচিয়েছ। এখন তোমাকেও বাঁচতে হবে।”
টর্চের আলোয় মুহূর্তের জন্য দেখা গেল, নিরঞ্জনের ছায়া ও ইন্দ্রাণীর ছায়া মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। দু’জনের মাঝে বসে আছে অর্ণব, কাঁপা শরীর নিয়ে। হাওয়া ঘূর্ণি তুলল, জানলার কাঁচ ভাঙল। শেষে আলো জ্বলে উঠতেই ছায়াগুলো মিলিয়ে গেল। ট্রেন আবার চলতে শুরু করল।
অর্ণব শহরে পৌঁছল এক ভোরে। ক্লান্ত, জ্বরগ্রস্ত শরীর নিয়ে সে সোজা গেল থানায়। কাগজপত্র আর খাতা জমা দিল। অফিসাররা প্রথমে বিশ্বাস করেনি। কিন্তু ইন্দ্রাণীর হাতে লেখা সেই চিঠি, ফাঁকা সইয়ের জায়গা, খাতার ভেজা অক্ষর—সব দেখে তারা স্তব্ধ। মামলার খতিয়ান খোলা হলো পুরোনো রেকর্ড থেকে। জানা গেল, নিরঞ্জনের নাম একসময় সন্দেহের তালিকায় এসেছিল। কিন্তু প্রমাণের অভাবে মামলা চাপা পড়েছিল।
এবার আর চেপে রাখা গেল না। কাগজপত্র সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল। শহরের খবরের কাগজে শিরোনাম হলো—“কাশীপুরে আত্মহত্যা নয়, হত্যা: ইন্দ্রাণীর মৃত্যুর রহস্য উন্মোচিত।” গ্রাম কেঁপে উঠল। মজুমদার ভিটের সামনে ভিড় জমল মানুষে মানুষে। সবাই বলল, এতদিন যা ভূতের গল্প ভেবে এসেছে, তা আসলে চাপা দেওয়া সত্যি।
অর্ণব আবার কাশীপুরে ফিরল। এবার ভয়ে নয়, দায়িত্বে। কুয়োর ধারে দাঁড়াল সে। চারপাশে মানুষের কোলাহল ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। ভোরের আলোয় কুয়োর জল ঝকঝক করছে।
সে নিচু গলায় বলল, “ইন্দ্রাণী, আমি কথা রেখেছি। সবাই এখন জানে তোমার মৃত্যু ছিল হত্যা।”
হঠাৎ কুয়োর জল হালকা ঢেউ তুলল। বাতাসে মিষ্টি ফুলের গন্ধ ভেসে এল। তারপর খুব মৃদু, শান্ত কণ্ঠস্বর—“ধন্যবাদ।”
অর্ণব চোখ মুছে দেখল, কুয়োর ভেতর থেকে সাদা শাড়ির আঁচল ভেসে উঠছে। ধীরে ধীরে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। চোখে আর ভয় নেই, আছে শান্তি।
কিন্তু তখনই হাওয়ায় বাজল কর্কশ পুরুষকণ্ঠ—“মিথ্যে! কেউ আমাকে দোষী বলতে পারবে না।” চারপাশে হঠাৎ ঠান্ডা ছড়িয়ে পড়ল। গাছপালা দুলে উঠল। মনে হলো, নিরঞ্জনের আত্মা এখনও মুক্তি পায়নি।
অর্ণব বুক শক্ত করল। কণ্ঠে দৃঢ়তা এনে বলল, “তুমি খুন করেছ। পৃথিবী জানে। আর তোমার জন্য আর আড়াল নেই।”
আকাশে বজ্রপাত চমকাল। তারপর দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ ভেসে এলো—“আমি বন্দি থাকব।” হাওয়া ধীরে ধীরে থেমে গেল।
কুয়োর জল শান্ত হয়ে গেল। পাখির ডাক ভেসে এল। অর্ণব অনুভব করল, ইন্দ্রাণী মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু নিরঞ্জন তার অপরাধের ছায়া নিয়েই বদ্ধ থাকল।
গ্রামে ফিরেই সে মানুষের ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে বলল, “এই ভিটে আর ভূতের ভয় নেই। এখানে কেবল এক নারীর অদৃশ্য কান্না ছিল। এখন তার আত্মা শান্তি পেয়েছে।”
মানুষজন হাতজোড় করে কুয়োর ধারে দাঁড়াল। কেউ চোখের জল মুছল। আর ভিটের দেয়ালে জমে থাকা অন্ধকার যেন একটু একটু করে ফিকে হয়ে গেল।
রাতে অর্ণব সেই পুরোনো ঘরে শুল। জানলার বাইরে চাঁদের আলো। বাতাস শান্ত। প্রথমবার ভেতর থেকে সে অনুভব করল, মজুমদার ভিটে আর তাকে কাঁপাচ্ছে না।
হঠাৎ ঘুম ভাঙল মাঝরাতে। মনে হলো, কারও নরম কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে—“আমি মুক্ত।” চোখ খুলে দেখল, জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সাদা শাড়ি পরা মেয়েটি। মুখে শান্তির হাসি। তারপর মিলিয়ে গেল চাঁদের আলোয়।
অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার মনে হলো, এক ভারী দায়িত্ব শেষ হলো। ভয় নয়, শান্তির স্মৃতি রেখে গেল এই বাড়ি।
তবু কুয়োর ধারে গেলে আজও মাঝে মাঝে হাওয়ায় বাজে কর্কশ গর্জন—“কেউ জানবে না।” মানুষ বলে, সেটা নিরঞ্জনের আত্মা। কিন্তু তার পর আর কখনও কেউ দেখেনি ভেজা শাড়ির ছায়া বা আলতার দাগ।
অর্ণব শহরে ফিরে গেল। তার কাহিনি বই হয়ে বেরোল—“কাশীপুরের ভিটে।” মানুষ পড়ল, শিহরিত হলো। কিন্তু অর্ণব জানত, ওটা কেবল গল্প নয়—ওটা ছিল সত্যি।
আজও সে চোখ বন্ধ করলে শুনতে পায় ইন্দ্রাণীর শেষ কথা—“ধন্যবাদ।” আর সেই কণ্ঠস্বরেই যেন সব ভয় মিলিয়ে যায়।
সমাপ্ত