চৈতালি ঘোষ
কলকাতার এক আর্দ্র গ্রীষ্মের দুপুরে সায়ন্তনী মুখার্জী তার চেম্বারে বসে ছিল, ডেস্কে জমে থাকা কেস ফাইলের পাতাগুলো উল্টাচ্ছিলেন। জানলার বাইরে থেকে ভেসে আসছিল রাস্তার গরম ধুলো আর রিকশাওয়ালার ক্লান্ত গলার আওয়াজ। এদিনটা অন্য দিনের মতোই ছিল, যতক্ষণ না দরজায় ধীর, দ্বিধাগ্রস্ত কড়া নাড়ার শব্দ হয়। “ভেতরে আসুন,” বলতেই দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা যায়, এক তরুণী — বয়স তিরিশের কম — সাদামাটা কটন সালোয়ারে, মুখে চাপা আতঙ্কের ছাপ। তার হাতে এক পাতলা ফাইল আর একটি ছোট ব্যাগ। চেয়ার টেনে বসতে বললেও মেয়েটি প্রথমে বসেনি, যেন নিজেকে সামলাতে পারছে না। অবশেষে বসে, এক গ্লাস জল হাতে নিয়েই সে ফাইলটি সায়ন্তনীর দিকে বাড়িয়ে দেয়। ফাইল খুলে প্রথম পাতাতেই চোখে পড়ে — “অর্জুন সেনগুপ্ত” নামটি, যা কলকাতার যে কোনো সংবাদপত্রে মাঝেমধ্যেই শিরোনামে আসে। শিল্পপতি, দাতব্য সংস্থার মুখপত্র, রাজনৈতিক দাতার তালিকায় শীর্ষস্থানীয়। কিন্তু পাতার নিচের দিকে লেখা অভিযোগের ভাষা একেবারেই ভিন্ন— যৌন হয়রানি, ভয় দেখানো, এবং শারীরিক নির্যাতনের বিবরণ। সায়ন্তনী প্রথমে ভ্রূ কুঁচকে পড়লেন, কারণ এর আগে এরকম মামলায় অনেক সময় প্রমাণের ঘাটতি, রাজনৈতিক প্রভাব, আর ভুক্তভোগীর ভয় কেসকে শুরু হওয়ার আগেই শেষ করে দেয়। তবুও, এই তরুণীর চোখে যে ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে একরাশ দৃঢ়তা দেখা যাচ্ছে, সেটি তাকে থামিয়ে দেয়।
তরুণীর নাম ছিল কাবেরী দত্ত। বয়স ২৪, একটি প্রাইভেট ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে কাজ করত, যা প্রায়ই অর্জুন সেনগুপ্তর কর্পোরেট প্রোজেক্টে যুক্ত হতো। প্রথম কয়েক মাস সব স্বাভাবিক থাকলেও, একদিন রাতের অফিস মিটিং শেষে অর্জুন ব্যক্তিগতভাবে কাবেরীকে গাড়িতে করে নামানোর প্রস্তাব দেন। সেখান থেকেই শুরু হয় ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা— গাড়িতে তার অশোভন স্পর্শ, হোটেলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি, এবং পরে চাকরি হারানোর ভয় দেখিয়ে চুপ থাকার নির্দেশ। কাবেরী প্রথমে কিছু বলেনি, কারণ জানত অর্জুনের বিরুদ্ধে কথা বলা মানে নিজেকে সর্বনাশের মুখে ফেলা। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ আগে, কোম্পানিতে তার পদত্যাগের পর, সে সাহস করে সব কথা লিখে রাখে এবং আইনগত পথে এগোতে চায়। সায়ন্তনী মন দিয়ে সব শুনছিলেন, মাঝে মাঝে নোট নিচ্ছিলেন। প্রশ্ন করছিলেন প্রমাণ নিয়ে— কাবেরীর কাছে কয়েকটি রেকর্ড করা ফোনকল ছিল, যেখানে অর্জুনের কণ্ঠে হুমকি স্পষ্ট। এগুলো শোনার পর সায়ন্তনীর সন্দেহের জায়গা আর রইল না যে বিষয়টি কেবল অভিযোগ নয়, বাস্তব। তবুও তিনি জানতেন, অর্জুনের বিরুদ্ধে মামলা মানে সাপের গর্তে হাত ঢোকানো। প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক এক মুহূর্তে সব উল্টে দিতে পারে।
অবশেষে তিনি চুপচাপ ফাইলটি বন্ধ করে কাবেরীর দিকে তাকালেন। “আপনি নিশ্চিত তো, যে আপনি এটা চালিয়ে যেতে চান?” — সায়ন্তনীর কণ্ঠে ছিল সতর্কতার সাথে সহানুভূতি। কাবেরী নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “আমি আর ভয় পাব না, মিস মুখার্জী। যা হয়েছে তা লুকিয়ে রাখলে আমার বাকি জীবনটা অভিশাপে কাটবে।” এই উত্তর শোনার পর সায়ন্তনীর মনে একরকম সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত হয়ে যায়। তিনি মামলাটি নেওয়ার কথা বলে কাবেরীকে কিছু প্রাথমিক নির্দেশ দেন— কীভাবে নিজেকে নিরাপদ রাখতে হবে, কারো সঙ্গে এ বিষয়ে কথা না বলা, আর ফোনকল, মেসেজ ও ইমেইলের ব্যাকআপ রেখে দেওয়া। চুক্তিপত্র সই হওয়ার পর কাবেরী চলে গেলে, সায়ন্তনী কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ বসে থাকেন, যেন নিজের ভেতর দিয়ে মামলার ভবিষ্যৎ লড়াইয়ের ছবি আঁকছেন। জানেন, এই সিদ্ধান্ত তার নিজের পেশাগত জীবনেও এক নতুন অধ্যায় শুরু করবে— হয়তো বিপদও ডেকে আনবে।
সেদিন সন্ধ্যায়, চেম্বার থেকে বেরিয়ে যখন তিনি নিজের গাড়িতে উঠলেন, তখনই প্রথম অদ্ভুত কিছু চোখে পড়ে। বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা একটি কালো SUV, যার জানালাগুলো কালো কাচে ঢাকা, যেন ভেতরে কেউ বসে নজর রাখছে। গাড়িটি কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে থাকার মতো অবস্থানে থাকে, তারপর ধীরে ধীরে চলে যায়। প্রথমে বিষয়টিকে কাকতালীয় মনে হলেও, বাড়ি ফেরার পথে আরেকবার সেটি চোখে পড়ে, এবার খানিকটা দূরে। তার মনে হালকা অস্বস্তি দানা বাঁধে, তবে তিনি নিজেকে বোঝান, হয়তো ভুল দেখছেন। কিন্তু রাতের খাবারের পর, বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে রিজওয়ান আহমেদের সঙ্গে মামলার প্রাথমিক আলোচনা করতে করতে যখন নিচে তাকালেন, তখনই দেখলেন একই গাড়ি রাস্তার কোণে দাঁড়িয়ে আছে, হেডলাইট নিভিয়ে। এবার আর সন্দেহের অবকাশ রইল না— কাবেরীর মামলা হাতে নেওয়ার মুহূর্ত থেকে কিছু একটা বদলে গেছে। তিনি সিগারেট জ্বালিয়ে দীর্ঘ টান দিয়ে ভাবলেন— লড়াইটা কেবল আদালতে নয়, রাস্তাতেও হবে। আর এই লড়াইয়ের প্রথম রাতের প্রহরী যেন কালো কাচের পেছনে বসেই তার প্রতিটি পদক্ষেপ মেপে নিচ্ছে।
***
পরদিন সকালে সায়ন্তনী মুখার্জী কাবেরীর জবানবন্দি ও প্রমাণাদি নিয়ে থানায় পৌঁছালেন। গরমে ভ্যাপসা বাতাস, ফাইলের ভার আর মানসিক চাপ মিলিয়ে তিনি যেন আগেই কিছুটা ক্লান্ত ছিলেন। রিসেপশনে ডিউটিতে থাকা কনস্টেবল ফাইলের দিকে একবার তাকিয়ে চুপচাপ সায়ন্তনীকে অফিসারের রুমে পাঠালেন। কিন্তু ইন্সপেক্টরের মুখের অভিব্যক্তি দেখেই তিনি বুঝলেন, কাজটা সহজ হবে না। অভিযোগ শোনার পরও ইন্সপেক্টর কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন, “ম্যাডাম, এ ধরনের মামলা খুব স্পর্শকাতর। প্রথমে আমাদের উচ্চপদস্থদের অনুমতি নিতে হবে।” অনুমতি নেওয়া বলতে আসলে বিলম্ব ঘটানো— সায়ন্তনী এটা ভালো করেই জানতেন। তিনি যুক্তি দিলেন যে প্রমাণ স্পষ্ট, তাই দেরির কোনো কারণ নেই। কিন্তু ইন্সপেক্টর কেবল অস্বস্তিকর হাসি দিয়ে বললেন, “আপনি জানেন তো, অর্জুন বাবুর নাম জড়ালে পুরো শহরে ঝড় উঠবে। আমরা চাই না ভুল কিছু হোক।” তার এই ‘ভুল কিছু’ কথাটি আসলে ক্ষমতাবানদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্যই বলা, যা সায়ন্তনীকে ভিতর থেকে ক্ষুব্ধ করে তুলল। ঘণ্টা খানেক কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি ও অজুহাতের পর অবশেষে তিনি স্পষ্ট বুঝে গেলেন— আইন বইতে যা লেখা আছে, বাস্তবে তার প্রয়োগের পথের সামনে এক বিরাট প্রাচীর দাঁড়িয়ে আছে, যার নাম ক্ষমতা।
সায়ন্তনী থানার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ফোন বের করলেন। স্ক্রিনে ভেসে উঠল রিজওয়ান আহমেদের নাম— কলকাতার পরিচিত অনুসন্ধানী সাংবাদিক। কয়েকদিন আগে এক কোর্টরুমে দেখা হয়েছিল, তখন তিনি মামলার কথা কৌতূহল নিয়ে শুনেছিলেন। ফোন ধরতেই ও প্রান্ত থেকে নিচু গলায় রিজওয়ান বলল, “আপনি থানায় আছেন, তাই তো?” সায়ন্তনী কিছুটা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কীভাবে জানলে?” রিজওয়ান হেসে বলল, “আমার সূত্র আছে, আর আপনার গতিবিধি নিয়ে এখন অনেকেই খবর রাখছে।” তারপর গম্ভীর কণ্ঠে যোগ করল, “অর্জুন সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে এটাই প্রথম অভিযোগ নয়। অন্তত পাঁচজন নারী এর আগে অভিযোগ করেছে, কিন্তু কেউই কোর্ট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি।” এই তথ্য সায়ন্তনীর মনে তীব্র ধাক্কা দিল। তিনি জানতেন অর্জুন ক্ষমতাবান, কিন্তু এত মানুষের কণ্ঠকে একসঙ্গে স্তব্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা— সেটা ভয়ঙ্কর। রিজওয়ান বলল, “প্রমাণ আছে, কিন্তু সেগুলো মালিকরা লুকিয়ে রেখেছে বা ধ্বংস করেছে। মিডিয়ার বড় অংশ অর্জুনের হাতের মুঠোয়। কেউ খবর ছাপালে পরদিন সেই সাংবাদিকের চাকরি যায়।” সায়ন্তনী জানলেন, কেবল আইনি পথে নয়, এই লড়াইয়ের আরেকটি অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্র আছে— তথ্যের যুদ্ধক্ষেত্র।
দুপুরে সায়ন্তনী চেম্বারে ফিরে এলেন। টেবিলের উপর কাবেরীর ফাইলটি খোলা ছিল, পাশে কফির মগ। তিনি জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের রাস্তায় চোখ বুলালেন। কালো SUV আজও ওদিকে দাঁড়িয়ে আছে, যেন তার প্রতিটি পদক্ষেপ নজরে রাখছে। এই নজরদারির চাপ ক্রমে মানসিকভাবে তাকে ক্লান্ত করে তুলছিল, তবুও তিনি জানতেন, ভয় দেখানোই এর উদ্দেশ্য— যাতে তিনি পিছু হটেন। তিনি কাগজে কিছু নোট লিখতে শুরু করলেন— থানার গড়িমসি, রাজনৈতিক প্রভাবের সম্ভাব্য পথ, এবং রিজওয়ানের দেওয়া অতিরিক্ত ভুক্তভোগীদের খোঁজ। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন, থানার অজুহাতের অপেক্ষা না করে সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যাবেন অভিযোগ দায়ের করতে, যাতে আইনি প্রক্রিয়ায় আর বিলম্ব না হয়। এর মধ্যেই রিজওয়ান তাকে হোয়াটসঅ্যাপে কয়েকটি নাম পাঠাল, যারা নাকি অর্জুনের হাতে নির্যাতিত। সায়ন্তনী জানতেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করাও ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু সত্যকে আদালতে তুলে ধরতে হলে এই সাক্ষ্য প্রয়োজন।
সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে শহরের ব্যস্ততা একটু থিতিয়ে এলো, কিন্তু সায়ন্তনীর মন তখনো উত্তপ্ত। তিনি একা চেম্বারে বসে ফাইলের পাতায় আঙুল বোলাচ্ছিলেন, যেন প্রতিটি শব্দ তার মস্তিষ্কে পুড়ে যাচ্ছে। বাইরে গলির অন্ধকারে আবারও সেই কালো SUV দাঁড়িয়ে। এবার গাড়ির জানালা অল্প নামানো, ভেতরে কারও সিলুয়েট বোঝা যাচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য সায়ন্তনীর মনে হলো— এই কেস নিলে কেবল আইনি নয়, হয়তো শারীরিক নিরাপত্তারও মূল্য চুকাতে হবে। কিন্তু ঠিক পরের মুহূর্তেই নিজের ভেতরের কণ্ঠ বলল— ভয়কে যদি জায়গা দাও, তবে কাবেরীর মতো শত কণ্ঠ চিরদিন স্তব্ধ থাকবে। তিনি টেবিলের বাতি নিভিয়ে ব্যাগ কাঁধে তুলে নিলেন, আর মনে মনে স্থির করলেন— ক্ষমতার এই প্রাচীর ভাঙতে যতই সময় লাগুক, লড়াই থামানো যাবে না। এই প্রাচীরের পেছনে শুধু একজন নয়, অগণিত মুখ লুকিয়ে আছে, যারা অপেক্ষা করছে কেউ যেন প্রথম আঘাতটা করে।
***
গরমে ভরা এক দুপুরে সায়ন্তনী মুখার্জী ব্যস্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে একজনকে খুঁজছিলেন। কয়েকদিনের অনুসন্ধানের পর অবশেষে তিনি অর্জুন সেনগুপ্তের প্রাক্তন সচিব অন্যন্যা ঘোষের ঠিকানা পেয়েছেন। মাঝবয়সী এই নারী হঠাৎ করেই কয়েক বছর আগে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন, আর তারপর থেকে সংবাদমাধ্যম বা সহকর্মীদের সামনে আর আসেননি। সায়ন্তনী জানতেন, অন্যন্যা হয়তো অর্জুনের অফিসে কাজ করার সময় এমন কিছু দেখেছেন বা শুনেছেন যা কেসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। তিনি অন্যন্যার বাড়ির পুরোনো, হলদেটে রঙের দরজায় কড়া নাড়লেন। দরজা খুলতেই সামনাসামনি এক ক্লান্ত চোখের নারী— চুলে পাকা রঙ, মুখে অনিদ্রার চিহ্ন। “আমি সায়ন্তনী মুখার্জী, অ্যাডভোকেট,” পরিচয় দিয়ে সায়ন্তনী বলতেই অন্যন্যার মুখে এক অস্বস্তিকর কঠোরতা ফুটে উঠল। “আমি কথা বলতে চাই না,” বলে দরজা বন্ধ করার চেষ্টা করলেন তিনি। সায়ন্তনী দ্রুত বললেন, “আপনি যা জানেন, তা অনেকের জন্য ন্যায়বিচারের পথ খুলে দিতে পারে।” দরজার ফাঁক দিয়ে অন্যন্যা একবার রাস্তার দিকে তাকালেন, যেন নিশ্চিত হচ্ছেন কেউ নজর রাখছে কি না, তারপর নিচু গলায় বললেন, “আপনি জানেন না এরা কতটা শক্তিশালী… আমার পরিবার আছে।”
সায়ন্তনী অনুরোধ করলেন অন্তত পাঁচ মিনিট কথা বলার জন্য। অনিচ্ছাসত্ত্বেও অন্যন্যা তাকে ভেতরে ডাকলেন। ঘরের কোণে পুরোনো সোফায় বসে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে অন্যন্যা বললেন, “অর্জুন বাবু কখনো সরাসরি আমার সঙ্গে বাজে ব্যবহার করেননি, কিন্তু আমি দেখেছি… তার কেবিনের বন্ধ দরজার আড়ালে অনেক কিছু ঘটে গেছে। ফাইল, ইমেইল, অডিও রেকর্ড— সব কিছু একসময় আমার ডেস্কের মধ্য দিয়ে গিয়েছে।” সায়ন্তনীর চোখে কৌতূহলের ঝিলিক। তিনি ধীরে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার কাছে কি সেইসব এখনো আছে?” অন্যন্যা একটু চুপ করে রইলেন, যেন ভেতরের দ্বন্দ্বের সঙ্গে লড়ছেন। “কিছু আছে… কিন্তু আমি যদি সেগুলো আপনাকে দিই, আমার জীবন শেষ।” তার কথায় ভয় আর অসহায়তার মিশ্র সুর স্পষ্ট ছিল। সায়ন্তনী শান্ত কণ্ঠে বললেন, “আমি আপনার পরিচয় গোপন রাখব, আইনি সুরক্ষাও নিশ্চিত করব।” কিন্তু অন্যন্যা শুধু মাথা নেড়ে বললেন, “আপনি বুঝবেন না, এখানে সুরক্ষা বলে কিছু নেই।” তবুও বিদায়ের সময় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তিনি ফিসফিস করে বললেন, “হয়তো আমি আপনাকে ফোন করব… সময় হলে।”
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে শুরু করল, আর সায়ন্তনী ট্যাক্সিতে চেপে বাড়ি ফিরছিলেন। অন্যন্যার কথাগুলো তার মাথায় ঘুরছিল। যদি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ থেকে থাকে, তবে সেটা মামলার জন্য এক বড় হাতিয়ার হতে পারে। কিন্তু সেই প্রমাণের হাতছানি যেমন শক্তিশালী, তেমনই ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি জানতেন, অন্যন্যা যদি মুখ খোলে, অর্জুনের দিক থেকে চাপ, হুমকি, এমনকি শারীরিক ক্ষতির সম্ভাবনা প্রবল। ফোনে রিজওয়ানকে ঘটনাটা বলতেই সে গম্ভীর হয়ে বলল, “অন্যন্যা ঘোষের নাম একসময় আমারও কানে এসেছিল, কিন্তু কেউ তাকে খুঁজে পায়নি। সাবধান থাকুন, তারা বুঝে যাবে আপনি কী খুঁজছেন।” রিজওয়ানের এই সতর্কবার্তা সায়ন্তনীর মনে একধরনের অদৃশ্য আতঙ্ক তৈরি করল। তিনি জানালার বাইরে তাকালেন— রাস্তায় মানুষের ভিড় কমে এসেছে, আলো-আঁধারির মধ্যে অচেনা গাড়িগুলো যেন বেশি করে চোখে লাগছে।
রাত ন’টার দিকে তিনি বাড়ি পৌঁছালেন। অ্যাপার্টমেন্টের গেটে দাঁড়ানো প্রহরীকে হালকা হাসি দিয়ে ভিতরে ঢুকলেন, কিন্তু সিঁড়ি ভাঙার আগে হঠাৎই চোখে পড়ল— রাস্তার কোণে একটি গাঢ় নীল সেডান, ইঞ্জিন বন্ধ, কিন্তু ভেতরে বসা মানুষের ছায়া স্পষ্ট। এই গাড়ি তিনি আগে কখনো দেখেননি, কিন্তু গাড়ির দিক থেকে যেন তার দিকে নজর রাখা হচ্ছে। মাথায় হালকা শীতল স্রোত বয়ে গেল। ফ্ল্যাটে ঢুকে পর্দা টেনে দিলেন, তবুও মনে হচ্ছিল বাইরের অন্ধকারে কেউ যেন তার প্রতিটি নড়াচড়া মেপে রাখছে। রান্নাঘরে গিয়ে জল খেলেন, কিন্তু বুকের ভেতরের অস্বস্তি কাটল না। বারান্দার এক ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখলেন— গাড়িটি এখনও আছে, যেন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে। সায়ন্তনী তখন বুঝলেন, অন্যন্যাকে খুঁজে বের করা আর তার কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার চেষ্টায় তিনি অর্জুনের লোকদের সরাসরি নজরে চলে এসেছেন। এই নীরব গাড়ি যেন এক অঘোষিত বার্তা দিচ্ছে— “আমরা জানি তুমি কোথায়, আর তুমি কী করছ।” কিন্তু সায়ন্তনী মনের ভেতরে আরও শক্ত হলেন; ভয়কে তিনি স্বীকার করলেন না, বরং মনে মনে স্থির করলেন, এই নজরদারি যতই ঘন হোক, তিনি পিছু হটবেন না, কারণ অন্যন্যার ফিসফিসানি প্রমাণ করে দিয়েছে— সত্য এখনও কোথাও বেঁচে আছে।
***
সকালে অফিসে ঢুকেই সায়ন্তনী মুখার্জী অনুভব করলেন কিছু একটা অস্বাভাবিক। টেবিলের উপর কাগজপত্রের ছড়াছড়ি, ড্রয়ার আধখোলা, আর দেয়ালের আলমারির তালা ভাঙা। চোখে পড়তেই বুক ধক করে উঠল— কাবেরীর মামলার মূল নথিগুলো নেই। তিনি দ্রুত পুরো অফিস তল্লাশি করলেন— সিডি, পেনড্রাইভ, কপি সব গায়েব। সহকারী অঞ্জন ভয়ে কাঁপা গলায় বলল, “ম্যাডাম, আমি কাল রাত আটটার পর অফিসে ছিলাম না… সকালে এসে দেখি এ অবস্থা।” সায়ন্তনী সঙ্গে সঙ্গে থানায় গেলেন অভিযোগ জানাতে। কিন্তু পুলিশ রিপোর্ট লিখে ফেলল “অজানা চোরের দ্বারা সাধারণ চুরি” হিসেবে। তিনি যতই বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে এটি সাধারণ চুরি নয়, বরং একটি পরিকল্পিত নথি-গায়েবের ঘটনা, ততই অফিসাররা গড়িমসি করল। একজন কনস্টেবল ঠান্ডা কণ্ঠে বলল, “ফাইল হারিয়ে গেলে নতুন কপি বানান, এতে এমন কিছু হয়নি যে দেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে।” এই অবহেলা সায়ন্তনীর মনে ক্ষোভ জাগাল, কারণ তিনি জানতেন, নথি হারানোর অর্থ হলো মামলার ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাওয়া, আর অর্জুনের পক্ষের জন্য সেটাই সবচেয়ে বড় সুবিধা।
থানা থেকে বেরিয়ে তিনি রিজওয়ান আহমেদকে ফোন করলেন। রিজওয়ান যেন আগেই বিষয়টি জানত। নিচু গলায় সে বলল, “আমার সূত্র বলছে, গত রাতে আপনার অফিসে যারা ঢুকেছিল, তারা অর্জুনের সিকিউরিটি টিমের লোক। তারা সাধারণ চোর নয়— এরা পেশাদার, প্রমাণ মুছে ফেলতে পারদর্শী।” সায়ন্তনীর কপালে ঘাম জমে উঠল, রিজওয়ান যোগ করল, “আপনার অফিসে কোনো সিসিটিভি ছিল না, তাই প্রমাণ মিলবে না। এটাই ওদের কৌশল— প্রথমে প্রমাণ গায়েব, তারপর ভয় দেখানো।” রিজওয়ান আরও জানাল, এই চুরির খবর বাইরে না ছড়ানোর জন্য অর্জুনের লোকজন স্থানীয় কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে চাপ দিয়েছে। সায়ন্তনী তখন বুঝলেন, এটি আসলে মামলার বিরুদ্ধে প্রথম সরাসরি আঘাত, যা শুধু তার পেশাগত অবস্থান নয়, মানসিক স্থিরতাকেও টলিয়ে দিতে চায়। ফোন কেটে দিয়ে তিনি চুপচাপ চেম্বারের দিকে হাঁটলেন, মাথার মধ্যে দ্রুত নতুন পরিকল্পনার খসড়া তৈরি হচ্ছিল— প্রমাণ পুনর্গঠন, সাক্ষীদের সুরক্ষা, আর তথ্য গোপন রাখার ব্যবস্থা।
বিকেল নাগাদ সায়ন্তনীর মেন্টর, অভিজ্ঞ আইনজীবী দেবাশিস দত্ত, খবর পেয়ে সরাসরি তার অফিসে এলেন। ধূসর স্যুট, তীক্ষ্ণ চোখ, আর গলায় একধরনের গুরুগম্ভীর দৃঢ়তা— দেবাশিস যেন এই পরিস্থিতির জন্যই তৈরি। সায়ন্তনীর বর্ণনা শোনার পর তিনি ধীরে সিগারেট ধরিয়ে বললেন, “এখন থেকে প্রতিটি পদক্ষেপ যুদ্ধের মতো ভাবতে হবে। তুমি যেটাকে শুধু মামলা ভাবছ, ওরা সেটাকে যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে ফেলেছে।” তিনি সতর্ক করলেন যে অর্জুনের মতো প্রভাবশালী মানুষরা শুধু আইনি লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ থাকে না; তারা প্রতিপক্ষের মানসিক ভরসা ভেঙে দিতে চায়। “তুমি এখন ওদের লক্ষ্যবস্তু। তোমার সময়, অর্থ, মানসিক শক্তি— সব আক্রমণের মুখে পড়বে,” দেবাশিস বললেন। সায়ন্তনী চুপচাপ শুনছিলেন, কিন্তু চোখে কোনো ভয়ের ছাপ ছিল না। বরং তিনি আরও সজাগ হলেন। দেবাশিস পরামর্শ দিলেন, সমস্ত নথির ডিজিটাল ব্যাকআপ তৈরি করতে, একাধিক নিরাপদ স্থানে কপি রাখতে, আর সাক্ষীদের যোগাযোগের পথ গোপন করতে।
সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করল, কিন্তু সায়ন্তনীর মনে হাওয়া বইছিল অন্য রকম— প্রস্তুতির। তিনি টেবিলের উপর নতুন ফাইল সাজাতে লাগলেন, পুরোনো নথির যতটুকু কপি আছে তা আলাদা করে রাখলেন, আর নতুন প্রমাণ সংগ্রহের পরিকল্পনা করলেন। বাইরে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল, আর শহরের শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল। তবুও তার মনে হচ্ছিল, এই অদৃশ্য যুদ্ধের প্রথম রাউন্ড ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে, আর তিনি তাতে সরাসরি পা রেখেছেন। জানালার ফাঁক দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখলেন— কালো SUV আবারও দাঁড়িয়ে আছে, হেডলাইট নিভিয়ে। এবার গাড়িটিকে দেখে তার বুক ধক করে উঠল, কিন্তু দেবাশিসের কথা মনে পড়ল— “প্রতিটি পদক্ষেপ যুদ্ধের মতো ভাবতে হবে।” তিনি বুঝলেন, এই যুদ্ধ এখন আর কেবল আদালতের ভেতরে সীমাবদ্ধ নেই, বরং তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে গ্রাস করছে। তবুও তিনি জানতেন, পিছিয়ে গেলে ন্যায়বিচারের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে, আর সে দায় তিনি নিতে প্রস্তুত নন।
***
বিকেলের দিকে সায়ন্তনী মুখার্জী যখন অফিসের শেষ কাগজপত্র গোছাচ্ছিলেন, তখন সহকারী এসে জানাল— একজন “ব্যবসায়ী” তার সঙ্গে জরুরি কথা বলতে চান। লোকটি চেম্বারে ঢুকতেই সায়ন্তনীর মনে সন্দেহ জাগল। সাদা লিনেন শার্ট, দামি সুগন্ধি, আর আচরণে অতিরিক্ত ভদ্রতা— এগুলো যেন ইঙ্গিত দিচ্ছিল, সে কেবল মধ্যস্থতাকারী। লোকটি নিজের নাম প্রকাশ না করে বলল, “অর্জুন সেনগুপ্ত আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন।” ফাইলের মতো একটি খাম টেবিলের উপর রাখা হল। সায়ন্তনী খাম খুলে দেখলেন— ডলার গোনা যায় এমন মোটা অঙ্কের প্রতিশ্রুতিপত্র এবং বিদেশের একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে চাকরির অফার লেটার। লোকটি শান্ত কণ্ঠে বলল, “আপনি যদি মামলাটি এখানেই শেষ করে দেন, তাহলে এই অফার আজ রাতের মধ্যেই কার্যকর হবে। আপনার পরিবার, আপনার ভবিষ্যৎ— সব সুরক্ষিত থাকবে।” সায়ন্তনী ঠান্ডা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনারা মনে করেন ন্যায়বিচার বিক্রির জিনিস?” লোকটি হালকা হাসল, “ন্যায়বিচার আর ক্ষমতা আলাদা বিষয়, মিস মুখার্জী। আপনি যদি না বোঝেন, তাহলে বোঝার সময় এসেছে।” এই কথার মধ্যে যে শীতল হুমকি লুকিয়ে ছিল, তা সায়ন্তনী অনুধাবন করলেন।
তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে খামটি লোকটির দিকে ঠেলে দিলেন। “আমার উত্তর আপনি বুঝে গেছেন,” সায়ন্তনী বললেন দৃঢ় কণ্ঠে। লোকটির চোখে এক মুহূর্তের জন্য বিরক্তি দেখা দিল, তারপর সে উঠে দাঁড়াল। বিদায়ের সময় দরজার কাছে থেমে সে বলল, “আপনি সুযোগ হারাচ্ছেন, ম্যাডাম। আর যারা সুযোগ হারায়, তারা পরে বাঁচে না।” দরজা বন্ধ হয়ে গেলে ঘরে একধরনের ভারি নীরবতা নেমে এল। সায়ন্তনী জানতেন, এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পরের ধাপ হবে আরও কঠিন। রিজওয়ানকে ফোনে ঘটনা বলতেই সে গম্ভীর হয়ে বলল, “এটা শুধুই টাকার প্রস্তাব ছিল না— এটা ছিল তোমার সীমা পরীক্ষা। এখন তারা অন্য পথে নামবে।” কথাগুলো তার মনে গেঁথে রইল, যেন অদৃশ্য এক সতর্কবার্তা। তবুও তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ— এই মামলা থেকে সরে দাঁড়ানো তার পক্ষে অসম্ভব।
পরদিন সকালে অফিসে যাওয়ার আগে সায়ন্তনী গাড়ি নিয়ে বের হলেন। শহরের ভেতরের ব্যস্ত রাস্তাগুলো পার হচ্ছিলেন, তখনই হঠাৎ ব্রেক চাপতে গিয়ে বুঝলেন— ব্রেক কাজ করছে না। সামনের সিগন্যালে গাড়িগুলো থেমে আছে, তিনি মরিয়া হয়ে হ্যান্ডব্রেক টানলেন, গিয়ার বদলালেন, আর শেষ মুহূর্তে ফুটপাথে গড়িয়ে গাড়ি থামাতে সক্ষম হলেন। হৃদস্পন্দন তখন দ্রুত, হাতে ঘাম জমেছে। পথচারীরা এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল তিনি ঠিক আছেন কি না। একজন মেকানিক ডেকে আনা হল, সে গাড়ির নিচে একবার উঁকি দিয়েই বলল, “ম্যাডাম, আপনার ব্রেক কেটে দেওয়া হয়েছে। এটা দুর্ঘটনা নয়।” কথাটি শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সায়ন্তনীর মনে আগের দিনের কথোপকথন ভেসে উঠল— “যারা সুযোগ হারায়, তারা পরে বাঁচে না।” এবার বিষয়টি নিছক কাকতালীয় মনে হল না। এটা ছিল স্পষ্ট হত্যাচেষ্টা।
ঘটনার পর দেবাশিস দত্ত তার কাছে এসে বললেন, “এখন তারা খোলাখুলি আক্রমণ শুরু করেছে। তুমি এখনও যদি ভয় না পাও, তাহলে সাবধানতা বাড়াও।” রিজওয়ানও জানাল, তার সূত্র বলছে এই কাজ অর্জুনের লোকদেরই, আর পুলিশকে আগেই ‘ম্যানেজ’ করা হয়ে গেছে যাতে বিষয়টি দুর্ঘটনা হিসেবে নথিভুক্ত হয়। রাতে সায়ন্তনী একা বসে গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে দীর্ঘ সময় চুপ করে রইলেন। জানালার বাইরে অন্ধকারে দূরের লাইটগুলো ঝাপসা হয়ে আসছিল, কিন্তু মনে হচ্ছিল প্রতিটি আলো যেন এক একটি অদৃশ্য চোখ, যা তার প্রতিটি পদক্ষেপ নজরে রাখছে। তার মনে কোনো দুর্বলতা আসেনি, বরং এক তীব্র দৃঢ় সংকল্প জন্ম নিয়েছিল— যদি এত চাপ আর হুমকি আসে, তবে এর মানে সত্যিই তারা ভয় পাচ্ছে। আর সেই ভয়ই প্রমাণ, যে লড়াই তিনি করছেন, সেটিই সঠিক পথে এগোচ্ছে।
***
রাতের আঁধারে, এক কাপ কালো কফি হাতে নিয়ে রিজওয়ান আহমেদ বসেছিল তার ছোট্ট এডিটিং রুমে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে ভেসে উঠছিল কয়েকশো পৃষ্ঠার নথি, ব্যাংক লেনদেনের হিসাব, শেয়ার বাজারে হঠাৎ অস্বাভাবিক উত্থান-পতনের গ্রাফ, আর বিদেশি অ্যাকাউন্টের তথ্য। এগুলো সবই অর্জুন সেনগুপ্তের সাম্রাজ্যের অন্ধকার দিকের দলিল। এই প্রমাণগুলো তার কাছে পৌঁছেছে এক গোপন সূত্রের মাধ্যমে— এমন একজন, যিনি অর্জুনের কোম্পানিতে কাজ করেন এবং জীবন ঝুঁকিতে ফেলে তথ্য ফাঁস করেছেন। রিজওয়ান জানত, এগুলো প্রকাশ করলে শুধু মামলার গতি বদলাবে না, বরং অর্জুনের ক্ষমতার ভিত্তিও কেঁপে উঠবে। পরদিন ভোরে, তিনি তার অনলাইন নিউজ পোর্টালে শিরোনাম করলেন— “শিল্পপতি অর্জুন সেনগুপ্তের আর্থিক দুর্নীতি: কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ”। খবরটি মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে গেল, সোশ্যাল মিডিয়ায় দফায় দফায় শেয়ার হতে লাগল। বিভিন্ন চ্যানেল ফোনে রিজওয়ানকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকতে লাগল, এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জাতীয় মিডিয়ার ক্যামেরা সায়ন্তনীর চেম্বারের বাইরে ভিড় জমাল।
সেদিন দুপুরে, সায়ন্তনী যখন আদালত থেকে ফিরছিলেন, তখনই সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে ধরল। মাইক্রোফোনের বৃষ্টি, ক্যামেরার ঝলকানি, আর একের পর এক প্রশ্ন— “ম্যাডাম, এই দুর্নীতির প্রমাণ কি মামলার সাথে যুক্ত হবে?”, “আপনি কি মনে করেন আর্থিক দুর্নীতি ও যৌন হয়রানির মামলার মধ্যে যোগসূত্র আছে?”, “অর্জুন সেনগুপ্ত বলছেন, এগুলো রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, আপনার মন্তব্য?” সায়ন্তনী ধৈর্য ধরে উত্তর দিলেন, “আমাদের মামলা যৌন হয়রানি ও ন্যায়বিচারের জন্য, কিন্তু যেকোনো অপরাধীর পুরো চরিত্র জানা গুরুত্বপূর্ণ। আর্থিক দুর্নীতি দেখায়, ক্ষমতা কিভাবে অপব্যবহার করা হয়।” এই বক্তব্য জাতীয় নিউজ চ্যানেলে বারবার প্রচারিত হল, ফলে মামলাটি একেবারে দেশের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এলো। তবে এই প্রচারের সঙ্গেই শুরু হল এক নতুন ধরণের যুদ্ধ— চরিত্রহননের অভিযান। অর্জুনপক্ষের নিয়ন্ত্রিত কিছু পত্রিকা ও অনলাইন পোর্টাল খবর ছাপাতে লাগল— “সায়ন্তনীর বিদেশি ফান্ডিংয়ের প্রমাণ”, “অভিযোগকারিণীর সাথে আইনজীবীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক” ইত্যাদি। উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট— জনমতকে তার বিরুদ্ধে ঘুরিয়ে দেওয়া।
সন্ধ্যার দিকে রিজওয়ান ফোন করল, কণ্ঠে উদ্বেগ স্পষ্ট— “তুমি এখন তাদের মূল লক্ষ্যবস্তু, সায়ন্তনী। আমি জানি তোমাকে ঘিরে যা লেখা হচ্ছে, তা মিথ্যা, কিন্তু জনগণ সবসময় সত্য-মিথ্যা যাচাই করে না।” একই সময়ে সায়ন্তনীর মা ফোনে কেঁদে ফেললেন, “মা, তোমার ছবি আজ টিভিতে দেখাল… বলছে তুমি টাকা খেয়ে কাজ করছো!” সায়ন্তনী চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। ব্যক্তিগত অপমানের এই ঢেউ তার মনকে আঘাত করছিল, কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন, এটাই অর্জুনের কৌশল— আইনি লড়াইয়ের বাইরে এসে নৈতিকতা আর বিশ্বাসযোগ্যতার মঞ্চে তাকে হারানোর চেষ্টা। দেবাশিস দত্ত তাকে সতর্ক করলেন, “এখন মিডিয়াকে মিত্র আর শত্রু দুই দিকেই দেখতে হবে। যে সাংবাদিকরা সত্য খুঁজছে, তাদের সাথে যোগাযোগ রেখো। আর যারা কেবল মিথ্যা ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে মানহানি মামলা করতে প্রস্তুত থাকো।”
রাত গভীর হলে সায়ন্তনী একা বসে দিনের ঘটনাগুলো ভাবছিলেন। বাইরে বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছিল, আর রাস্তায় মাঝে মাঝে পুলিশের গাড়ি ছুটে যাচ্ছিল সাইরেন বাজিয়ে। তার মনে হচ্ছিল, এই লড়াই এখন আর কেবল আদালতের ভেতরে সীমাবদ্ধ নেই— এটা একটি জনসমক্ষে খোলা যুদ্ধে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রমাণ, গণমাধ্যম, এবং জনমত— তিনটিই অস্ত্র। জানালার কাচে বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছিল, কিন্তু তার চোখে দৃঢ়তা ঝলমল করছিল। তিনি জানতেন, অর্জুন যতই হুমকি, মিথ্যা আর চাপ সৃষ্টি করুক না কেন, এখন পিছিয়ে যাওয়া মানে হবে সব সত্যের পরাজয়। আর সে পরাজয় তিনি স্বেচ্ছায় মেনে নেবেন না।
***
সকালবেলা আদালতের প্রস্তুতি নিতে নিতে সায়ন্তনী খবর পেলেন— দেবাশিস দত্ত, তার বহু বছরের মেন্টর ও সহযোদ্ধা, হঠাৎই এই মামলার দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। অফিসে পৌঁছাতেই দেখলেন, দেবাশিস নিজের টেবিল গুছিয়ে নিচ্ছেন। তার মুখে একধরনের অস্বাভাবিক নীরবতা, চোখে যেন অজানা ভার। সায়ন্তনী বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কি সত্যিই এই মুহূর্তে মামলাটা ছেড়ে দিচ্ছেন? এতদূর এসে?” দেবাশিস শুধু মাথা নেড়ে বললেন, “তুমি এই লড়াইটা চালিয়ে যাও, সায়ন্তনী। আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।” তার কণ্ঠে ক্লান্তি, ভেতরে লুকিয়ে থাকা ভয় এবং অনিচ্ছার মিশ্রণ ছিল। এরপর আর কিছু না বলে তিনি চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেলেন। সেদিন দুপুরে, এক বিশ্বস্ত সূত্র রিজওয়ানের কাছে খবর দিল— রাজনৈতিক চাপ, ব্যক্তিগত নিরাপত্তার হুমকি, এবং পারিবারিক ভয় দেখিয়ে দেবাশিসকে নীরব করে দেওয়া হয়েছে। সায়ন্তনীর জন্য এটা ছিল এক গভীর আঘাত; তিনি ভাবলেন, “যদি আমার সবচেয়ে কাছের মানুষও এই চাপে ভেঙে পড়ে, তবে আমার জন্য তারা কী প্রস্তুত রেখেছে?”
ঠিক এই হতাশার মধ্যেই, অন্ধকারে এক আলোর রেখা হয়ে হাজির হলেন অন্যন্যা ঘোষ। প্রাক্তন সচিব, যিনি এতদিন ভয়ে মুখ খুলতে চাননি, এক সন্ধ্যায় সায়ন্তনীর বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালেন। তার হাতে একটি ছোট পেন-ড্রাইভ, আর চোখে অদ্ভুত এক দৃঢ়তা। বসার ঘরে বসেই তিনি বললেন, “আমি আর চুপ থাকতে পারছি না, মিস মুখার্জী। এই ড্রাইভে এমন কিছু আছে যা অর্জুনকে আদালতের সামনে নগ্ন করে দেবে।” সায়ন্তনী অবাক হয়ে দেখলেন, ভিডিও ফাইলটিতে অর্জুন সেনগুপ্ত নিজে ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছেন, এবং স্পষ্টভাবে হুমকি দিচ্ছেন— “ও যদি মুখ খোলে, আমি তার জীবন শেষ করে দেব।” অন্যন্যা কাঁপা কণ্ঠে বললেন, “এটা আমি আমার অফিস ডেস্কে লুকানো রেকর্ডার দিয়ে তুলেছিলাম। জানতাম, একদিন কাজে লাগবে।” ভিডিওতে শুধু কণ্ঠ নয়, অর্জুনের চেহারাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, যা প্রমাণ হিসেবে নিঃসন্দেহে শক্তিশালী।
এই প্রমাণ হাতে পেয়ে সায়ন্তনী জানতেন, এটি মামলার গতিপথ আমূল বদলে দিতে পারে। কিন্তু একইসাথে তিনি বুঝলেন, অন্যন্যার এখন বিপদ আরও বেড়ে গেল। “তুমি এখন সবার আগে তাদের টার্গেট হবে,” সায়ন্তনী সতর্ক করলেন। অন্যন্যা নির্লিপ্ত মুখে বললেন, “আমি বহুদিন ধরে পালিয়ে পালিয়ে বেঁচেছি। এবার পালাব না।” এই সাহসিকতা সায়ন্তনীর মনে নতুন করে শক্তি যোগাল। রিজওয়ান প্রমাণের একটি নিরাপদ কপি তৈরি করল এবং বিদেশি সার্ভারে আপলোড করে দিল, যাতে স্থানীয়ভাবে মুছে ফেললেও তথ্য হারিয়ে না যায়। দেবাশিসের প্রস্থান যদিও দলের ভিতরে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করেছিল, কিন্তু অন্যন্যার এই সাহসিক উপস্থিতি সেই শূন্যতা আংশিক পূরণ করল। সায়ন্তনী ভাবলেন— বিশ্বাসঘাতকতা যতই গভীর হোক না কেন, একজন মানুষের সত্য বলার সাহস সবকিছু বদলে দিতে পারে।
রাত গভীর হয়ে এলে সায়ন্তনী একা বসে দিনের ঘটনাগুলো মনে করছিলেন। তার মনে হচ্ছিল, এই লড়াই যেন এক দাবার খেলা— যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে কেউ না কেউ হঠাৎ বোর্ড ছেড়ে যাচ্ছে, আবার কেউ নতুন করে বোর্ডে প্রবেশ করছে। দেবাশিস হয়তো চাপে নীরব হয়েছেন, কিন্তু তার জায়গায় অন্যন্যার মতো একজন উঠে এসেছেন, যিনি ভয় না পেয়ে সব উজাড় করে দিয়েছেন। জানালার বাইরে শহরের আলো ঝলমল করছিল, কিন্তু সেই আলোয়ও যেন এক অদৃশ্য অন্ধকার ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছিল— ক্ষমতার ভয়ঙ্কর ছায়া, যা মানুষকে কেনে, চুপ করায়, অথবা মেরে ফেলে। তবু সায়ন্তনীর মনে স্পষ্ট ছিল, এখন আর ফেরার পথ নেই। হাতে থাকা ভিডিও সাক্ষ্য তার জন্য শুধু প্রমাণ নয়— এটা এক প্রতিজ্ঞা, যে এই যুদ্ধ শেষ হবে সত্য প্রকাশের মাধ্যমেই, যে কোনো মূল্যে।
***
সকাল থেকেই কলকাতা সেশন কোর্টের সামনে যেন এক যুদ্ধক্ষেত্রের পরিবেশ। টিভি চ্যানেলের ভ্যান, সাংবাদিকদের ভিড়, পোস্টার হাতে দাঁড়ানো দু’পক্ষের সমর্থক— কেউ চিৎকার করছে “অর্জুন সেনগুপ্ত নির্দোষ!”, কেউ আবার স্লোগান তুলছে “ন্যায় চাই, অপরাধীর শাস্তি চাই!”। সায়ন্তনী মুখার্জী কালো শাড়ি পরে, হাতে গুছিয়ে রাখা মামলার নথি নিয়ে আদালতে প্রবেশ করলেন। ভেতরে ঢুকতেই অর্জুনের ব্যারিস্টার দল একেবারে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে দাঁড়াল। প্রথমেই তারা যৌন হয়রানির অভিযোগের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে সায়ন্তনীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন তুলল— “মিস মুখার্জী, আপনি কি স্বীকার করেন যে অভিযোক্তার সাথে আপনার ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে? এটা কি সত্য নয় যে আপনি রাজনৈতিক ফান্ডিং পেয়েছেন এই মামলা চালানোর জন্য?” তাদের উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট— তার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করা এবং মামলার আসল বিষয় থেকে আদালতের মনোযোগ সরিয়ে দেওয়া।
সায়ন্তনী গভীর শ্বাস নিয়ে দাঁড়ালেন এবং একদম নির্ভীক কণ্ঠে বললেন, “মহামান্য বিচারপতি, ব্যক্তিগত সম্পর্কের অভিযোগের সঙ্গে এই মামলার মূল বিষয়ে কোনও আইনি সম্পর্ক নেই। আমার পেশাগত দায়িত্ব হল একজন ভুক্তভোগীর পক্ষে আইনের মাধ্যমে ন্যায় বিচার পাওয়া, ব্যক্তিগত আক্রমণ প্রতিহত করা নয়। যদি পক্ষের আইনজীবী কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেন যা এই মামলার যৌন হয়রানির ঘটনার সাথে সরাসরি যুক্ত, তাহলে আমি উত্তর দেব। অন্যথায়, এটি কেবলমাত্র ভুক্তভোগীকে অপমান এবং আদালতের সময় নষ্ট করার প্রচেষ্টা।” আদালত নীরব হয়ে গেল, এবং বিচারপতি স্পষ্ট করে জানালেন যে ব্যক্তিগত অপপ্রচার নয়, মামলার বিষয়বস্তুতে মনোযোগ দিতে হবে। অর্জুনের দল বাধ্য হয়ে মূল যুক্তিতে ফিরল, কিন্তু তখন সায়ন্তনীর হাতে ছিল শক্তিশালী প্রমাণ ও সাক্ষ্য, যা তাদের প্রতিটি যুক্তিকে আইনের ধারায় ভেঙে দিচ্ছিল।
ঠিক যখন আদালতের তর্ক-বিতর্ক চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন রিজওয়ান নিঃশব্দে পেছনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করল এবং সায়ন্তনীর কাছে ফিসফিস করে বলল, “আমাদের নতুন সাক্ষী এসেছে।” সায়ন্তনীর চোখে বিস্ময়— নতুন সাক্ষী? রিজওয়ান কণ্ঠ নিচু করে বলল, “অর্জুনের প্রাক্তন ড্রাইভার। সে এমন কিছু দেখেছে আর শুনেছে যা মামলাকে শেষ করে দিতে পারে।” আদালতে কিছুক্ষণ বিরতি হলে ড্রাইভারকে সাক্ষী হিসাবে আনা হল। তার নাম রমেশ, মধ্যবয়সী এক মানুষ, চোখে ভয় আর সংকল্পের মিশ্রণ। রমেশ শপথ নিয়ে বলল, “আমি নিজে মিস্টার সেনগুপ্তকে অভিযোক্তার বাড়ির সামনে নিয়ে গেছি, সেদিন যেদিন ঘটনা ঘটেছিল। গাড়িতে ফেরার পথে আমি স্পষ্ট শুনেছি তিনি ফোনে কাউকে বলছেন— ‘ও যদি মুখ খোলে, আমি ওকে শেষ করে দেব।’” এই বক্তব্য আদালতে এক অস্বস্তিকর নীরবতা তৈরি করল, কারণ রমেশের বিবৃতি অন্যন্যার ভিডিও রেকর্ডের সাথে পুরোপুরি মিলে যাচ্ছিল।
দিন শেষে আদালত মুলতবি হলে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সাংবাদিকরা সায়ন্তনীকে ঘিরে ধরল। তিনি সংক্ষেপে বললেন, “আজ আমরা আদালতে প্রমাণ করেছি যে ক্ষমতা ও অর্থ দিয়ে সত্যকে চিরকাল চাপা রাখা যায় না। নতুন সাক্ষীর উপস্থিতি মামলার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে, এবং আমি আশা করি বিচারব্যবস্থা সত্যকে প্রতিষ্ঠা করবে।” রিজওয়ান একপাশে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসল, কিন্তু সে জানত, এই যুদ্ধ এখানেই শেষ নয়। আদালতের ভেতরে জয়লাভের পর এখন অর্জুনের পক্ষ বাইরে নতুন করে আক্রমণ শুরু করবে— হয়তো আরও ভয়ংকরভাবে। সায়ন্তনী গাড়িতে উঠে জানালার বাইরে তাকিয়ে ভাবলেন, এই মামলা শুধু একজন নারীর ন্যায়বিচারের জন্য নয়, বরং এমন এক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো যেখানে ক্ষমতাবানরা ভাবেন— তারা সবসময় অক্ষত থাকবে। এখন তিনি নিশ্চিত, চূড়ান্ত রায় পর্যন্ত তার লড়াই থামবে না, যে মূল্যই দিতে হোক না কেন।
***
আদালতে রমেশের সাক্ষ্য প্রকাশের পর পরিস্থিতি দ্রুত বদলে গেল। পরদিন সকালে সায়ন্তনীর চেম্বারে রমেশ এসে আরও কিছু তথ্য দিল, যা শুনে তার হাতের কফির কাপ থমকে গেল। রমেশ বলল, “ম্যাডাম, আমি এতদিন ভয় পেয়েছিলাম বলে সব বলিনি। মিস্টার সেনগুপ্ত শুধু ওই মেয়েটির সাথেই না… অনেক বছর ধরে একই কাজ করছে। তার অফিসের ভেতরে গোপন রুম আছে, যেখানে অনেক মেয়েকে নিয়ে যাওয়া হত। আমি দেখেছি, কিছু মেয়েকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে— কাজের নামে, কিন্তু আসলে…” রমেশ থেমে গেল, চোখের কোণে জল এসে পড়ল। সায়ন্তনী গা শিরশির করে উঠলেন— যৌন হয়রানি মামলার পেছনে আরও ভয়ঙ্কর এক মানবপাচারের জাল লুকিয়ে আছে। এই তথ্য মামলাকে আরেক ধাপ এগিয়ে দিল, কারণ এখন বিষয়টি শুধু ব্যক্তিগত অপরাধ নয়, বরং আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্রের সাথে যুক্ত হয়ে গেল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রিজওয়ানকে ডেকে বললেন, “এগুলো এখনই ডকুমেন্ট করো, এবং বিদেশি মানবাধিকার সংস্থায় পাঠিয়ে দাও। অর্জুনের পক্ষে এটা ধামাচাপা দেওয়া সম্ভব হবে না।”
সংবাদ মাধ্যম নতুন প্রমাণ হাতে পেয়ে যেন বিস্ফোরিত হয়ে উঠল। টিভি চ্যানেলগুলোতে সারাদিন ধরে ব্রেকিং নিউজ— “শিল্পপতি অর্জুন সেনগুপ্ত মানবপাচার চক্রে জড়িত?” জাতীয় পর্যায়ের সাংবাদিকরা কলকাতায় ভিড় করল, আর সামাজিক মাধ্যমে মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ল। কিন্তু এই মুহূর্তেই অর্জুনের পক্ষ তাদের “শেষ চাল” খেলল— তার আইনজীবীরা আদালতে আবেদন করল যে রমেশের সাক্ষ্য ভুয়া এবং ষড়যন্ত্রমূলক। একইসাথে, রিজওয়ানের ফোনে হুমকি আসতে শুরু করল, আর সায়ন্তনীর বাড়ির বাইরে অপরিচিত লোকজন ঘোরাঘুরি করতে লাগল। তবুও সায়ন্তনী জানতেন, এই নতুন তথ্য আদালতের হাতে পৌঁছানো মানেই অর্জুনের সাম্রাজ্যে চূড়ান্ত আঘাত হানা। ঠিক তখনই খবর এল— অর্জুন গোপনে দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করছে। তার প্রাইভেট জেট মাঝরাতে উড়াল দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
রিজওয়ান এই খবর গোপন সূত্রে পেয়ে তৎক্ষণাৎ সায়ন্তনীকে জানাল। তারা তড়িঘড়ি পুলিশ কমিশনারের সাথে যোগাযোগ করলেন, কিন্তু প্রথমে কমিশনার দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন— “আপনারা জানেন, এর রাজনৈতিক প্রভাব কতটা বড় হতে পারে?” সায়ন্তনী দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “স্যার, আপনি যদি এখন ব্যবস্থা না নেন, তাহলে আগামীকাল সারা দেশ জানবে— কলকাতা পুলিশের সামনে থেকেই একজন অপরাধী পালিয়ে গেছে।” কথাটা কাজ করল। সেই রাতেই বিশেষ পুলিশ দল বিমানবন্দরে অভিযান চালাল। ঠিক উড়াল দেওয়ার আগে অর্জুনের জেটকে রানওয়েতে থামিয়ে দেওয়া হল। ক্যামেরার ফ্ল্যাশের ঝলকানিতে, স্যুট পরা অর্জুনকে হাতকড়া পরিয়ে গাড়িতে তোলা হল। তার মুখে প্রথমবারের মতো আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট ছিল, যা এতদিন তার দাম্ভিকতার আড়ালে লুকিয়ে ছিল।
সায়ন্তনী সেই রাতের দৃশ্যটা মনে গেঁথে রাখলেন— বিমানবন্দরের আলো, পুলিশের কড়া মুখ, সাংবাদিকদের হুড়োহুড়ি, আর একজন প্রভাবশালী মানুষকে আইনের সামনে মাথা নোয়াতে বাধ্য করার মুহূর্ত। তবুও তিনি জানতেন, এটা শেষ নয়। আদালতে রায় আসতে এখনও সময় লাগবে, আর অর্জুনের প্রভাবশালী বন্ধুরা নিশ্চুপ বসে থাকবে না। কিন্তু এই গ্রেফতার ছিল প্রতীকী— যে বার্তা দিল, ক্ষমতা যত বড়ই হোক, সত্যের হাত থেকে পালানো যায় না। রিজওয়ান একপাশে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বলল, “এটা ছিল শেষ চাল, আর আমরা সেটা উল্টে দিয়েছি।” সায়ন্তনী জানালার বাইরে তাকিয়ে ভাবলেন, এই লড়াইয়ের প্রতিটি মুহূর্তই হয়তো তার জীবনের গল্প হয়ে থাকবে— গল্প, যা প্রমাণ করবে যে ন্যায়বিচারের পথ যতই কঠিন হোক, শেষ পর্যন্ত সেটাই জিতে যায়।
***
শীতের এক কুয়াশামাখা সকাল, আদালতের রায় ঘোষণার দিন। কলকাতা সেশন কোর্টের সামনে অগণিত মানুষের ভিড়— নারী অধিকার সংগঠনের কর্মী, সাংবাদিক, সাধারণ মানুষ, এমনকি সেই তরুণীর পরিবারও, যার সাহসী অভিযোগ থেকে এই লড়াই শুরু হয়েছিল। সায়ন্তনী মুখার্জী কালো শাড়ি পরে, ঠান্ডা সকালের বাতাসে দৃঢ় পায়ে আদালতে প্রবেশ করলেন। এই কালো শাড়ি এখন কেবল তার ব্যক্তিগত পোশাক নয়— এটি হয়ে উঠেছে এক প্রতীক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর, ভয়কে অগ্রাহ্য করার। ভেতরে বিচারপতি রায় পড়তে শুরু করলেন, প্রতিটি শব্দ যেন সময়কে ধীরে ধীরে ভেদ করে আসছে— “অভিযুক্ত অর্জুন সেনগুপ্ত দোষী প্রমাণিত… যৌন হয়রানি, মানবপাচার ও অপরাধী ষড়যন্ত্রের দায়ে…” কোর্টরুমে এক মুহূর্তের জন্য নীরবতা, তারপর চারপাশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া— আনন্দাশ্রু, হতাশা, ক্ষোভের গুঞ্জন। সায়ন্তনীর হাতে ধরা ফাইল কাঁপছিল, কিন্তু তার চোখে ছিল দৃঢ় আলো— এই মুহূর্ত, এই রায়, কেবল একটি মামলার জয় নয়, বরং একটি ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করার সাহসের প্রতিফলন।
রায় ঘোষণার পর আদালতের বাইরে সাংবাদিকরা প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল সায়ন্তনীর দিকে। ক্যামেরার ফ্ল্যাশের ঝলকানি, মাইক্রোফোনের জটলা— “আপনার অনুভূতি কী?” সায়ন্তনী শান্ত কণ্ঠে বললেন, “এই জয় আমার নয়, এটি সেই নারীদের, যারা বছরের পর বছর ভয় আর চাপে মুখ বন্ধ রেখেছিলেন। এই কালো শাড়ি কেবল একটি রঙ নয়, এটি প্রতীক— যে প্রতিটি নারীর কণ্ঠস্বর শোনা উচিত, এবং অন্যায়কারীর শাস্তি হওয়া উচিত।” তার বক্তব্য সরাসরি লাইভ টেলিকাস্টে গেল, আর সেই মুহূর্তেই সামাজিক মাধ্যমে #কালোশাড়িরভোর হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করতে শুরু করল। সারা দেশের মানুষ এই রায়ের খবর শেয়ার করছিল, কেউ সায়ন্তনীর ছবি প্রোফাইল পিকচার বানাচ্ছিল, কেউ আবার নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছিল সাহস জোগাতে।
কিন্তু সবকিছুর মাঝেও সায়ন্তনী জানতেন, লড়াই এখানেই শেষ নয়। আদালতের রায় হয়তো অর্জুনের বিরুদ্ধে, কিন্তু তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক এখনো সক্রিয়। পরদিন রাতেই তার বাসার বাইরে অচেনা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল, আর রিজওয়ান এক গোপন সূত্র থেকে জানাল— “এখনও হুমকি শেষ হয়নি।” সায়ন্তনী জানতেন, ক্ষমতাবান অপরাধীরা শেষ চেষ্টা করবে ভয় দেখানোর, হয়তো তার জীবনও ঝুঁকিতে ফেলবে। কিন্তু এবার তিনি আর একা নন— তার পাশে দাঁড়িয়েছে অসংখ্য নারী, মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক, এমনকি সাধারণ মানুষও। ফোনে প্রতিদিন আসে ধন্যবাদ আর সমর্থনের বার্তা, যা তাকে মনে করিয়ে দেয়, এই জয় শুধু কাগজে-কলমে নয়, মানুষের মনেও জায়গা করে নিয়েছে।
সেই রাতে সায়ন্তনী বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, হাতে এক কাপ চা। দূরে শহরের আলো জ্বলজ্বল করছে, কিন্তু আকাশে এখনো হালকা কুয়াশা। তিনি ভাবলেন, এই মাসগুলোতে কত কিছু বদলে গেছে— ভয়, লড়াই, বিশ্বাসঘাতকতা, আবার নতুন করে সাহস পাওয়ার মুহূর্তগুলো। “কালো শাড়ির ভোর” তার কাছে এখন জীবনের এক অধ্যায়, যা প্রমাণ করে যে ন্যায়বিচারের পথে যত বাধাই থাকুক, লড়াই চালিয়ে গেলে পরিবর্তন সম্ভব। ভোরের প্রথম আলো যখন আকাশে ফুটে উঠল, সায়ন্তনী অনুভব করলেন, এই আলো শুধু সূর্যের নয়— এটি সেই আশার আলো, যা প্রতিটি নারীর চোখে একদিন জ্বলে উঠবে, যখন তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। আর তিনি জানতেন, তার এই লড়াই হয়তো অনেকের জন্য সেই আলোর প্রথম ঝলক হয়ে থাকবে।
শেষ