সঞ্চারী নাগ
উত্তরাধিকার
চৌধুরী বাড়িটা যেন কলকাতার বুকের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এক টুকরো ইতিহাস। বাইরের রাস্তায় কোলাহল, গলিপথে ঠেলাঠেলি অটো আর ছেঁড়া পোস্টারের ভিড়, কিন্তু উঁচু পাঁচিল ঘেরা সেই বনেদি বাড়ির ভেতরে ঢুকলেই যেন সময় একেবারে অন্য গতিতে বয়ে চলে। আঙিনার মাঝখানে একটা বিশাল আমগাছ, তার চারপাশে বিক্ষিপ্ত ছায়া পড়ে আছে, আর সেই ছায়ার মধ্যে পড়ে আছে বহু প্রজন্মের অগণিত স্মৃতি। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলেই প্রথমেই চোখে পড়ে একপাশের শীতল ঘরখানা, যেখানে ঢাকা দেওয়া আছে পুরোনো কাঠের আসবাবপত্র। ধুলো জমে থাকা পর্দার ফাঁক গলে আসা আলোয় দেখা যায় দেয়ালের কোণায় দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল আয়না, লম্বা কাঠের ফ্রেমে বসানো, যার ওপরে সূক্ষ্ম খোদাই করা মূর্তি যেন মন্ত্রপূত আঙুল দিয়ে আকাশের দিকে ইশারা করছে। এই আয়নার কথাই এতদিন শোনা গেছে ফিসফাসে—”কালো দর্পণ”।
অর্পিতা চৌধুরী তখনই বাড়ির দোরগোড়ায় পা রাখল, বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষ করে সদ্য ফিরেছে। তার চোখে আধুনিকতার ঝিলিক, হাতে মোবাইল, কানে ইংরেজি গান। বাড়ির গম্ভীর পরিবেশ আর ভেতরের নিস্তব্ধতায় সে খানিকটা অস্বস্তি বোধ করল। তার মা বারবার বলে এসেছিলেন, এই বাড়ি একদিন তারই হবে, এ বাড়ির উত্তরাধিকার তার হাতেই পৌঁছাবে। অথচ অর্পিতা এইসব বিশ্বাস করে না, সে মনে করে সবই নিছক কুসংস্কার। তবু এই আয়নার গল্প ছোটবেলায় তার কানে ঢুকেছিল—যে এতে তাকায়, সে নিজের অতীত জন্মের ভয়ঙ্কর সত্য দেখতে পায়। তখনও সে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল ব্যাপারটা।
বাড়ির কর্তা অমৃতলাল চৌধুরী, তার দাদু, পাকা সাদা চুলে গাম্ভীর্য ছড়িয়ে বসেছিলেন বারান্দায়। তিনি অর্পিতাকে দেখে চোখ নামালেন, যেন কোথাও দূর থেকে ফিরে আসা আত্মীয়কে স্বাগত জানাচ্ছেন। “ফিরলি তো অবশেষে,” তিনি বললেন গলা খাঁকারি দিয়ে, “এই বাড়ি তোকে অপেক্ষা করছিল।” অর্পিতা হেসে উত্তর দিল, “বাড়ি নয় দাদু, আপনি অপেক্ষা করছিলেন।” কিন্তু তার গলার আত্মবিশ্বাসের ভেতরে চাপা কৌতূহল ছিল, বিশেষ করে আয়নাটির দিকে এক ঝলক তাকানোয়।
রাত বাড়ল। খাওয়াদাওয়া শেষে অর্পিতা তার শোবার ঘরে গেল, কিন্তু বারবার তার মনে হচ্ছিল যে কারও অদৃশ্য চোখ তাকে অনুসরণ করছে। জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে দেখল বাগানের অন্ধকারে যেন কিছু নড়ছে, কিন্তু পরক্ষণেই মিলিয়ে গেল। অর্পিতা নিজেকে বোঝাল যে এ সবই মনের ভুল। তবু আয়নার কথা মাথা থেকে নামছিল না।
পরদিন সকালে মহাশ্বেতা দেবী চৌধুরী, তার ঠাকুমা, তাকে কাছে ডাকলেন। মৃদু কণ্ঠে বললেন, “তুই এই বাড়ির বংশধর, তাই তোকে সাবধান করছি। ওই আয়নার দিকে বেশি তাকাবি না। ওখানে আমাদের পুরোনো সাধকের শক্তি বন্দি হয়ে আছে।” অর্পিতা হেসে উঠল, “ঠাকুমা, এইসব তন্ত্রমন্ত্র এখনো আপনি বিশ্বাস করেন? এটা তো কেবল পুরোনো কাচ আর কাঠের আসবাব।” মহাশ্বেতার চোখ গাঢ় হয়ে উঠল, “যা বলছি শোন, অর্পিতা। এই আয়না বহু রক্ত দেখেছে। আমাদের রক্ত।”
দিন কয়েকের মধ্যে অর্পিতা লক্ষ্য করল বাড়ির অন্য সদস্যরা আয়নার প্রসঙ্গে এড়িয়ে চলে। কেউ এর সামনে দাঁড়ায় না, কেউ এর দিকে তাকায় না। অথচ বাড়ির এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়, যিনি উত্তরাধিকারের হিসাব করতে এসেছিলেন, এক রাতে মদ্যপ অবস্থায় সেই আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। অর্পিতা দূর থেকে দেখল, লোকটা হঠাৎ স্থির হয়ে গেছে, চোখ বড় বড়, ঠোঁট কাঁপছে, যেন কিছু দেখছে যা কেউই দেখতে পাচ্ছে না। সে চিৎকার করে উঠল, “না! আমি ওকে মারিনি! আমি নির্দোষ!” মুহূর্তের মধ্যেই ধপ করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। পরে সবাই দেখল, সে মৃত।
সকলে এটাকে হৃদরোগ বলে পাশ কাটিয়ে গেল, কিন্তু বাড়ির ভিতরের হাওয়া তখনই পাল্টে গিয়েছিল। অর্পিতা ভাবল—এটা কি নিছক কাকতালীয়? নাকি সত্যিই আয়নার ভেতরে কিছু আছে? তার যুক্তিবাদী মাথা বারবার বলছিল সবই গুজব। অথচ রাতের বেলা ঘুমোতে গেলে সে অনুভব করত আয়নার পৃষ্ঠ থেকে এক অদৃশ্য চাপা টান তাকে ডাকছে, যেন কাচের ভেতরে এক অন্ধকার ছায়া তার জন্য অপেক্ষা করছে।
এভাবেই শুরু হল অর্পিতার যাত্রা—এক বনেদি বাড়ির উত্তরাধিকার থেকে এক নিষিদ্ধ আয়নার দিকে, যার ভিতরে লুকিয়ে আছে অতীত জন্মের অন্ধকার। সে তখনও জানত না এই যাত্রা তাকে কোথায় নিয়ে যাবে, কিংবা তার নিজের ভিতরের কোন অচেনা দিকটা উন্মোচিত হতে চলেছে।
প্রথম দৃষ্টি
চৌধুরী বাড়ির ঘন পরিবেশ যেন আরও ভারী হয়ে উঠল সেই মৃত্যুর পর থেকে। সবাই তাকে হার্ট অ্যাটাক বলে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও, বাড়ির ভেতরে অদৃশ্য ভয়ের স্রোত বয়ে চলছিল। করিডর দিয়ে হাঁটলেই কারও গলার খাঁকারি শুনতে পাওয়া যায়, অথচ পাশে কেউ নেই। মশারির ভেতরে হঠাৎ ঠান্ডা বাতাস ঢুকে যায়। সকলে সাবধানে এড়িয়ে চলতে শুরু করল কালো দর্পণকে। শুধু অর্পিতা মাঝে মাঝে চোখের কোণ দিয়ে তাকাত। যেন তার ভিতর থেকে কাচের গায়ে লেপ্টে থাকা ছায়া তাকে নীরব ইশারা করছে।
একদিন দুপুরে বাড়ির সবার অনুপস্থিতিতে অমৃতলালের দ্বিতীয় ছেলে অজিতলাল ঘরে ঢুকল। ব্যবসার লোক, মাথায় টাক, ভেতরে দুশ্চিন্তা জমে থাকা মানুষ। তার মনে সবসময় উত্তরাধিকার ভাগের হিসেব ঘুরপাক খেত। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে সে একবার হেসে উঠল—”তোর কী শক্তি আছে দেখি তো!” হাতে রাখা সোনার আংটি খুলে সে আয়নার গায়ে ঠুকল। আয়নার পৃষ্ঠে তরঙ্গের মতো ঢেউ খেলল। মুহূর্তেই অজিতলালের চোখ যেন উল্টে গেল। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, ঠোঁট কাঁপছে, আর শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। অর্পিতা দূর থেকে তাকিয়ে ছিল।
অজিতলাল ফিসফিস করে বলতে শুরু করল, “আমি… আমি এক সন্ন্যাসীকে ঠকিয়েছিলাম… জমি হাতিয়েছিলাম… সে আমাকে শাপ দিয়েছিল… আগুনের মধ্যে দেখছি আমি… আমি…” হঠাৎ তার গলা আটকে গেল, শ্বাসরোধ হতে লাগল। সে কাশতে কাশতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। অর্পিতা দৌড়ে গেল, কিন্তু ততক্ষণে নিথর। চোখ খোলা, তাতে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
চিৎকারে সবাই ছুটে এল। আবারও ডাক্তার এসে বলল হার্ট ফেইল। কিন্তু এবার ঠাকুমা মহাশ্বেতা ফিসফিস করে বললেন, “ওর পাপ ওকেই খেয়ে ফেলল।” বাড়ির ভেতর নিস্তব্ধতা নেমে এলো। প্রতিটি ঘরে যেন আয়নার ছায়া বিস্তৃত হতে লাগল।
সেই রাতে অর্পিতা বিছানায় শুয়ে অনেক ভেবেছিল। দুটো মৃত্যু কি সত্যিই কাকতালীয়? নাকি আয়নার ভেতরে সত্যিই আছে অদৃশ্য শক্তি? সে যুক্তিবাদী, কিন্তু তার স্বপ্নগুলো বদলে যেতে শুরু করেছিল। স্বপ্নে সে দেখত, ধূসর শ্মশান, আগুনের ধোঁয়া, আর তার নিজের মুখে অদ্ভুত মন্ত্র। সে ভয় পেত, কিন্তু আবার এক অদ্ভুত আকর্ষণ তাকে আয়নার কাছে টেনে নিয়ে যেত।
পরের দিন সকালে বাগানের দিকে হাঁটতে গিয়ে সে লক্ষ্য করল পুরোনো যজ্ঞকুণ্ড। আগাছায় ঢাকা, কিন্তু তাতে এখনও যেন পোড়া গন্ধ আছে। মনে হল যেন কালো দর্পণ আর এই যজ্ঞকুণ্ড একই সুতোয় বাঁধা। সে দাদুর কাছে জানতে চাইল, “দাদু, এই আয়নার ইতিহাস কী?” অমৃতলাল এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আমাদের পূর্বপুরুষ অদ্বৈতানন্দ ছিলেন এক তান্ত্রিক সাধক। তিনি বলতেন এই আয়না শুধু কাচ নয়, এটা আত্মার আয়না। যে এতে তাকায়, সে নিজের জন্মের দায় এড়াতে পারে না। সেই দায়ই তার মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে।”
অর্পিতা শিউরে উঠল, কিন্তু জেদও চেপে বসল। “আমি প্রমাণ করব দাদু, এসব কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। আমি নিজেই একদিন তাকাব ওই আয়নায়,” সে বলে উঠল দৃঢ় গলায়। ঠাকুমা দূর থেকে শুনে বললেন, “যা বলছিস সাবধানে বল। দর্পণ শুধু পাপ দেখায় না, উত্তরাধিকারও প্রকাশ করে।”
সেই রাতে অর্পিতা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাড়ির সব বাতি নিভে গেছে, করিডরে সাঁই সাঁই শব্দ, আর একফোঁটা হাওয়া তার গায়ে লাগছিল। সে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকাল। প্রথমে শুধু নিজের মুখই দেখল—অচেনা ক্লান্ত চোখ, ধুলো লেগে থাকা চুল। কিন্তু হঠাৎ প্রতিচ্ছবির ঠোঁট নড়ে উঠল, অথচ অর্পিতার ঠোঁট তখন স্থির। আয়নার ভেতরের অর্পিতা ফিসফিস করে বলল—”তুই জানিস না তুই কে…”
অর্পিতা হকচকিয়ে পিছিয়ে গেল। কিন্তু সেই মুহূর্তে সে দেখল কাচের ভেতরে আগুনের আলো, আর তার নিজের মুখে কালো চন্দনের রেখা আঁকা, চোখে অগ্নিদৃষ্টি। সে যেন অন্য কেউ, এক তান্ত্রিকী, যিনি রাত্রির গভীরে দাঁড়িয়ে আছেন শ্মশানের চিতার পাশে।
হঠাৎ পিছন থেকে দাদুর ডাক—”অর্পিতা!” চমকে ঘুরে তাকাল সে। আয়নার দৃশ্য মিলিয়ে গেছে, শুধু নিজের ক্লান্ত প্রতিচ্ছবি। কিন্তু তার বুকের ভেতরে ধুকপুকানি তখনও থামেনি। সে বুঝল—কালো দর্পণ তাকে ছাড়বে না।
ভাঙনের শুরু
চৌধুরী বাড়িতে মৃত্যুর ছায়া যেন স্থায়ী হয়ে বসে গেছে। অজিতলালের শবদেহ শ্মশানে যাওয়ার পর দিনই বাড়ির লোকেরা একপ্রকার হাহাকার করে উঠল—আয়নাটা সরাতেই হবে, না হলে এ বাড়ি ধ্বংস হয়ে যাবে। অমৃতলাল প্রথমে অস্বীকার করলেন, কিন্তু চাপ বাড়ল। “ওটা একটা আসবাব ছাড়া কিছু না, কিন্তু যদি সবার মনে ভয় থেকে যায়, তবে সরানোই ভালো,” তিনি গম্ভীর গলায় বললেন। শ্রমিক ডেকে আনা হল, দুজন বলশালী লোক কাচের গায়ে হাত লাগাল।
আয়নাটা সরানো সহজ ছিল না। কাঠের ফ্রেম যেন মাটির সঙ্গে শিকড় গেঁথে বসেছিল। ঘেমে নেয়ে এক শ্রমিক বিরক্ত হয়ে বলল, “সাবান-তেল মাখাতে হবে, নয়তো নড়ছে না।” আরেকজন হেসে উঠল, “এইটুকু কাচ কি নাড়াতে পারব না?” সে জোরে ঠেলা দিতেই আয়নার গায়ে টং করে শব্দ হল। হঠাৎ ঘরের ভেতর বিদ্যুৎ চলে গেল, অন্ধকারে শ্রমিকের গলা থেকে বেরোল আতঙ্কের চিৎকার। আলো ফিরে আসতেই দেখা গেল—সে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে, চোখ ফাঁকা, মুখে রক্ত জমাট। অন্য শ্রমিক পেছনে সরে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আমি আর হাত দেব না, সাহেব, এই জিনিসে কিছু আছে।”
বাড়ির ভিতরে হুলস্থুল শুরু হল। মহাশ্বেতা ঠাকুমা সিঁদুর মেখে মন্ত্রপাঠ করতে লাগলেন, অমৃতলাল রাগে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করলেন, “থামাও এসব নাটক!” কিন্তু ভয়ের দমবন্ধ পরিবেশ তখন সবাইকে ঘিরে ধরেছে। অর্পিতা চুপচাপ সব দেখছিল। তার মনে হচ্ছিল, আয়নাটা যেন কারও স্পর্শ সহ্য করতে পারে না। সে চায় নিজেকে অক্ষত রাখতে, অথচ ধ্বংসও ডেকে আনে।
রাত বাড়তেই বাড়ির করিডরগুলোতে অদ্ভুত শব্দ শোনা যেতে লাগল। কেউ যেন পায়ের শব্দ ফেলছে, কিন্তু অদৃশ্য। সিঁড়ির ধাপে কারও ভারে চাপ পড়ছে, অথচ দেখা যাচ্ছে না। অর্পিতা প্রথমে ভাবল এগুলো মনের ভুল, কিন্তু এক রাতে সে স্পষ্ট দেখল, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক কালো ছায়া। ছায়াটা মানুষ নয়, আবার পুরোপুরি অশরীরীও নয়। চোখের দিকটা ফাঁকা, যেন শূন্য গর্ত। ছায়াটা তার দিকে হাত বাড়ালো, কাচের গা বেয়ে লম্বা আঙুল এগিয়ে এলো।
অর্পিতা চিৎকার করে ঘুম ভাঙল, বুঝল এটা দুঃস্বপ্ন। কিন্তু পরের সকালে আয়নার গায়ে ধুলোয় স্পষ্ট দেখা গেল পাঁচ আঙুলের ছাপ, যেন ভেতর থেকে কেউ চাপ দিয়েছে। সে কাঁপতে কাঁপতে আঙুল বোলাল, কিন্তু চিহ্ন মুছে গেল না। ঠাকুমা ফিসফিস করে বললেন, “ছায়া জেগে উঠেছে।”
এদিকে পরিবারের অন্যদের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ছিল। কে যেন বলল, “এই বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে।” আরেকজন বলল, “বিক্রি করে দিই বাড়ি, এভাবে টিকব না।” কিন্তু দাদু অমৃতলাল গর্জে উঠলেন, “এ বাড়ি আমাদের রক্ত দিয়ে তৈরি। পালাব কোথায়? ভয় পেলে উত্তরাধিকার শেষ হয়ে যাবে।” তার কণ্ঠে গর্ব থাকলেও চোখে আতঙ্ক লুকোনো গেল না।
অর্পিতা রাতে আবার আয়নার দিকে তাকাল। এবার কাচে শুধু নিজের প্রতিচ্ছবি নয়, চারপাশে ছড়িয়ে থাকা অন্ধকারও দেখা গেল। মনে হচ্ছিল কাচের ভেতর অন্য একটা ঘর আছে, অন্য এক জগৎ, যেখানে মরা আত্মারা হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। আর প্রতিবার চোখ ফেরালেই সে টের পায় আয়নার ভেতর থেকে অদ্ভুত চাপা টান তাকে ডেকে নিচ্ছে।
দিন গড়াল। হঠাৎই বাড়ির রান্নাঘরে আগুন লেগে গেল। কেউ বুঝতে পারল না কিভাবে। পাত্রে জ্বলতে থাকা সামান্য তেল মুহূর্তে আগুনে পরিণত হল। সবাই মিলে পানি ঢেলে আগুন নেভানো গেলেও, রান্নাঘরের দেওয়ালে কাচের মতো চকচকে ছোপ রয়ে গেল—যেন কালো দর্পণের প্রতিচ্ছবি সেখানেও ছড়িয়ে পড়েছে।
অর্পিতা বুঝতে পারল—এখন আর এটাকে কুসংস্কার বলে পাশ কাটানো যাবে না। আয়নাটা তাদের জীবনে ঢুকে পড়েছে, প্রতিটি শ্বাসে ছায়া বিস্তার করছে। অথচ সে নিজের ভেতরে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব টের পেল। যুক্তিবাদী সত্তা বলছিল পালিয়ে যাওয়া উচিত, কিন্তু অজানা কৌতূহল আরেকদিকে টানছিল। আয়নার রহস্য উদঘাটন করতেই হবে, নয়তো তার ভয় তাকে খেয়ে ফেলবে।
এভাবেই চৌধুরী বাড়িতে শুরু হল ভাঙনের প্রকৃত পর্ব। প্রতিদিন আয়না একটু একটু করে বাড়ির দেয়াল চিরে অদৃশ্য অশুভ শক্তি ছড়িয়ে দিচ্ছিল, আর অর্পিতা তাতে জড়িয়ে পড়ছিল অদ্ভুত টানে।
অর্পিতার দ্বন্দ্ব
অর্পিতার মন যেন দিনকে দিন বিভক্ত হতে শুরু করল। একদিকে তার যুক্তিবাদী সত্তা—যা বিজ্ঞান, শিক্ষা আর আধুনিকতার আলোয় বড় হয়েছে—অন্যদিকে আয়নার ছায়া, যা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অজানা অন্ধকারের দিকে। সকালে সে যখন কফির কাপ হাতে বারান্দায় বসে থাকে, তখন মনে হয় সবই নিছক মনের ভ্রম। সূর্যের আলোয় ধুলো উড়ছে, গাছে পাখি ডাকছে—এখানে কোনো তন্ত্রমন্ত্র নেই। অথচ রাত নামতেই সব বদলে যায়। করিডরের বাতাস হঠাৎ থমকে যায়, জানালার কপাট থেকে আসে ভাঙা সুরের মতো শব্দ, আর দূরে কালো দর্পণ তার দিকে তাকিয়ে থাকে—চোখহীন অথচ গভীর দৃষ্টি নিয়ে।
তার ঘুম ভেঙে যেত বারবার। স্বপ্নে সে দেখত নিজের অচেনা রূপ। সে যেন শ্মশানের মাঝখানে বসে আছে, চারপাশে আগুন জ্বলছে, আর তার ঠোঁটে অচেনা মন্ত্রের আওয়াজ। জেগে ওঠার পরও ঠোঁটে সেই শব্দ লেগে থাকত। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবির ঠোঁট নড়তে দেখে সে শিউরে উঠত। একরাতে সে সাহস করে ফিসফিস করে বলল—“তুই কে?” প্রতিচ্ছবি কোনো উত্তর দিল না, কিন্তু চোখের ভেতরে গভীর লাল আভা ফুটে উঠল।
পরিবারের সবাই তখনও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছিল। দাদু অমৃতলাল গম্ভীর হয়ে সব সামলাতে চাইতেন, কিন্তু তিনিও এক রাতে শোবার ঘরে অদ্ভুত শব্দ শুনলেন—কেউ যেন মন্ত্রপাঠ করছে। খুঁজতে গিয়ে দেখলেন, শব্দটা আসছে আয়নার ঘর থেকে। তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেন, কিন্তু ভেতরে ঢোকার সাহস পেলেন না। পরে সকালে তিনি অর্পিতাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কাল রাতে তুই কি ওই ঘরে গিয়েছিলি?” অর্পিতা মাথা নেড়ে বলল, “না দাদু।” অথচ ভেতরে ভেতরে সে জানত, সে ঘুম আর জাগরণের মাঝখানে হাঁটছিল, আর তখনই আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ঠাকুমা মহাশ্বেতা আবারও সাবধান করলেন। “অর্পিতা, তুই জেদ কোরিস না। দর্পণ তোকে ডাকছে। যদি সাড়া দিস, তবে আর ফেরা হবে না।” অর্পিতা ঠোঁট চেপে বলল, “আমাকে সত্যিটা জানতে হবে ঠাকুমা। যদি সত্যিই কোনো অভিশাপ থাকে, তবে আমি ভেঙে দেব।” তার কণ্ঠে দৃঢ়তা থাকলেও হৃদয়ে ভয়ের কাঁপুনি চলছিল।
তার দ্বন্দ্ব আরও স্পষ্ট হল যখন সে নিজের শরীরে অচেনা পরিবর্তন লক্ষ্য করল। আয়নার সামনে দাঁড়ালে তার চোখ কালো হয়ে উঠত, কপালে ঘাম জমত, আর শরীর যেন নিজে থেকেই শ্বাসরুদ্ধ মন্ত্র আওড়াতে চাইত। একদিন হঠাৎ সে টের পেল, নিজের হাত দিয়ে কাঠের টেবিলে অদ্ভুত তান্ত্রিক চিহ্ন এঁকে ফেলছে। আঁকতে আঁকতে সে থেমে গেল, যেন কারও হাত তার হাতকে নিয়ন্ত্রণ করছিল।
এরপর এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। রাতে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎ কাচের ভেতরে এক অপরিচিত মুখ ফুটে উঠল—এক নারী, কপালে রক্তের টিপ, চোখে আগুনের ঝিলিক। সে হাসল, আর অর্পিতা স্পষ্ট শুনল—“তুই আমারই উত্তরাধিকার। তুই অস্বীকার করতে পারবি না।” অর্পিতা পিছিয়ে গিয়ে দৌড়ে দরজা বন্ধ করল, কিন্তু দরজার ওপাশে তখনও মৃদু হাসির প্রতিধ্বনি বাজছিল।
দিনের বেলা সে সবার সঙ্গে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করত, কিন্তু একসময় পরিবারও তার পরিবর্তন লক্ষ্য করতে লাগল। কাজের লোকেরা ফিসফিস করে বলত, “মেমসাহেবের চোখে আজকাল অন্যরকম দৃষ্টি।” তার মা ফোনে বললেন, “অর্পিতা, তুই ঠিক আছিস তো? কণ্ঠে অদ্ভুত ক্লান্তি শুনতে পাচ্ছি।” সে মিথ্যে হেসে বলল, “আমি ভালো আছি মা।” অথচ ভেতরে ভেতরে সে জানত, ধীরে ধীরে কালো দর্পণের টান তাকে গ্রাস করছে।
অর্পিতা এখন এক অদ্ভুত সঙ্কটে দাঁড়িয়ে—সে কি নিজের যুক্তি আর আধুনিকতা আঁকড়ে ধরে থাকবে, নাকি আয়নার অন্ধকার উত্তরাধিকারকে মেনে নিয়ে সত্যিটা খুঁজবে? তার দ্বন্দ্ব প্রতিদিনই বেড়ে চলছিল, আর সে বুঝতে পারছিল—এই যুদ্ধে জয়ী হতে হলে তাকে হয় নিজেকে হারাতে হবে, নয়তো নিজের অচেনা দিককে গ্রহণ করতে হবে।
অতীতের ছায়া
অর্পিতার দিনরাতের ভিতর এখন স্পষ্ট ফারাক তৈরি হয়েছে। সূর্যের আলোয় সে যেনো এখনও আধুনিক তরুণী—বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে গল্প করে, বই পড়ে, ল্যাপটপে গান চালায়। কিন্তু রাত নামলেই, কালো দর্পণ তার চারপাশে অদৃশ্য জাল ফেলে দেয়। সে যতই নিজেকে বোঝায় এগুলো নিছক বিভ্রম, ততই আয়না তার মনে প্রশ্ন তোলে। প্রতিটি রাতে ঘুম ভাঙলে সে অদ্ভুত চিহ্ন কাগজে আঁকতে বসে যায়, কখনও অর্ধেক মন্ত্র লিখে ফেলে। সকালে উঠে নিজের লেখা দেখে আঁতকে ওঠে—এ অক্ষরগুলো তো সে শেখেনি কখনও।
এদিকে বাড়ির ভেতরে মৃত্যুর ছায়া আরও গাঢ় হচ্ছে। কাজের এক পুরোনো মহিলা—যিনি বহু বছর ধরে চৌধুরী পরিবারের সেবা করেছেন—হঠাৎ এক বিকেলে অচেতন হয়ে পড়লেন। শ্বাস নিতে নিতে তিনি ফিসফিস করলেন, “আয়নার ছায়া… অন্ধকার… অদ্বৈতানন্দ ফিরে আসছে…” তারপরই তার ঠোঁট থেমে গেল। পরিবার হতবাক হয়ে গেল। ঠাকুমা মহাশ্বেতা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “সে ফিরে আসবেই। রক্তের শেকড় কেটে ফেলা যায় না।”
অর্পিতা এবার দাদুর কাছে বসে জানার চেষ্টা করল, “অদ্বৈতানন্দ কে ছিলেন? কেন সবাই তাঁর নাম শুনলেই ভয়ে কাঁপে?” অমৃতলাল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “তিনি আমাদের পূর্বপুরুষ। তন্ত্রসাধক ছিলেন, ভীষণ শক্তিশালী। তাঁর কাছে মৃত্যু ছিল খেলনা। তিনি নাকি আয়নার ভেতরে আত্মার সত্য বাঁধতে পারতেন। বলা হয়, তিনি একদিন এমন আচার করেন যাতে নিজেকেই অমর করে তুলতে চান। কিন্তু তাঁর শরীর মাটিতে হারিয়ে যায়, আত্মা বন্দি হয়ে পড়ে এই আয়নায়।” দাদুর চোখ তখন দূরে চলে যাচ্ছিল, কণ্ঠ ভাঙছিল।
অর্পিতার শরীরে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। আয়নায় যখন সে নিজের প্রতিচ্ছবিতে আগুনমাখা চোখ দেখেছিল, তবে কি সত্যিই সেই উত্তরাধিকার তার ভেতরে লুকোনো আছে? সে অস্বীকার করতে চাইছিল, কিন্তু প্রতিটি দিনই তাকে আরও কাছে ঠেলে দিচ্ছিল অদৃশ্য সত্যের দিকে।
রাতে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। ঝড়বৃষ্টির রাত, চারদিকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বাড়ি অন্ধকারে ডুবে আছে। অর্পিতা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, যেন কারও অচেনা ডাকে সাড়া দিচ্ছে। করিডর পেরিয়ে সে পৌঁছাল আয়নার ঘরে। মেঝের ধুলো সরিয়ে সে স্পষ্ট দেখল—আয়নার সামনে কিছু অদ্ভুত চিহ্ন কেটে রাখা আছে, যেন পুরোনো যজ্ঞমণ্ডপের নকশা। সেগুলো সে আগে কখনও খেয়াল করেনি। কাচের ভেতরে আবার সেই নারী ফুটে উঠল—চোখে আগুন, ঠোঁটে রক্তচন্দনের দাগ। সে হাত বাড়িয়ে বলল, “তুই আমিই… আমি তুই… মনে কর, অর্পিতা, মনে কর তোর জন্ম।”
অর্পিতা কাঁপছিল, অথচ তার শরীর এগিয়ে যাচ্ছিল আয়নার দিকে। কাচ ছুঁতেই মনে হল যেন সে অন্য এক পৃথিবীতে চলে গেছে। আগুন জ্বলছে, চারপাশে ডামরু বাজছে, নারীরা কালো পোশাকে মন্ত্র জপছে। সে নিজেকে দেখল, কপালে ভস্ম, চোখে অগ্নিদৃষ্টি, হাতে ছুরি। সে কোনও অশুভ আচার করছে। কিন্তু সেই আচার কার জন্য? কাকে উৎসর্গ করছে? উত্তরটা আসার আগেই বজ্রপাতের আলোয় ঘর কেঁপে উঠল, আর অর্পিতা ফিরে এল নিজের শরীরে। আয়নার কাচ থেকে তখন শুধু তারই মুখ তাকিয়ে আছে—ভেজা, আতঙ্কিত, বিভ্রান্ত।
পরদিন সকালে ঠাকুমা তাকে পাশে ডেকে বললেন, “তুই যতই পালাতে চাই, এই উত্তরাধিকার তুই মুছতে পারবি না। আমরা সবাই এর শিকার। কেউ না কেউ প্রতিটি প্রজন্মে দর্পণের ছায়া বহন করে। আর এ প্রজন্মে সেটা তুই।” অর্পিতা প্রতিবাদ করতে গিয়েও থেমে গেল। তার গলার ভেতরে এক অদ্ভুত শব্দ গুমরে উঠছিল—যেন মন্ত্র জপের সুর, যা সে চায়নি কিন্তু বেরিয়ে আসছিল নিজের থেকেই।
বাড়ির অন্য সদস্যরা তখন ভাবছিল কিভাবে আয়নাটা সরানো যায়। কেউ প্রস্তাব দিল ভেঙে ফেলা হোক। কিন্তু একজন পণ্ডিত এসে বললেন, “ভাঙতে গেলে বিপদ আরও বাড়বে। এটা শুধু কাচ নয়, তান্ত্রিক যন্ত্র। যন্ত্র ভাঙলে ভিতরের শক্তি বাইরে বেরোবে।” সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল।
অর্পিতা একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বুঝল, এখন আর পিছু ফেরার উপায় নেই। অতীতের ছায়া তার চারপাশে ঘিরে ধরেছে। আয়নার ভেতরে থাকা ইতিহাস যেন ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করছে। প্রশ্ন শুধু একটাই—সে কি উত্তরাধিকার মেনে নেবে, নাকি লড়াই করবে নিজের সঙ্গে?
উত্তরাধিকারীর ছাপ
অর্পিতার শরীর আর মন যেন ধীরে ধীরে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিল। দিনের বেলা পরিবারের সামনে সে এখনও আগের মতো আধুনিক, যুক্তিবাদী মেয়েটাই রয়ে গেছে—কখনও ফোনে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছে, কখনও খবরের কাগজের সম্পাদকীয় নিয়ে তর্ক করছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে টের পাচ্ছিল, তার মনের গভীরে কেউ একজন শ্বাস নিচ্ছে। কালো দর্পণের সামনে দাঁড়ালে সেই অচেনা সত্তা যেন আরও শক্ত হয়ে উঠত। প্রতিবার আয়নার প্রতিচ্ছবির সঙ্গে চোখ মেলামাত্র সে অনুভব করত তার ভেতরকার কণ্ঠস্বর জেগে উঠছে—কোনো পুরোনো মন্ত্র তার ঠোঁটে ভর করছে।
ঘরে আয়নার টেবিলের নিচে বারবার সে অদ্ভুত ছাপ খুঁজে পেত। কাঠের মেঝেতে অর্ধেক পোড়া চিহ্ন, কালো আঁকিবুঁকি, যেন আগুনের আঁচ লেগে রয়েছে। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে দেখতে পেত তার নিজের হাত কাগজে এক অজানা লিপি লিখে ফেলছে। সকালে উঠে আঁতকে ওঠে—এটা তো তান্ত্রিক অক্ষর! কখনও সে লিখত “অগ্নিমন্ত্র”, কখনও “রুদ্রবীজ”। অথচ সে এগুলো শেখেনি কখনও।
পরিবারের বাকি লোকজনও টের পাচ্ছিল তার পরিবর্তন। বাড়ির এক বৌদি একদিন তাকে বলেই ফেলল, “তোমার চোখে কেমন অদ্ভুত জ্যোতি দেখছি ইদানীং।” অর্পিতা হেসে উড়িয়ে দিলেও ভেতরে কেঁপে উঠল। আয়নার টানে সে এখন বারবার একা হয়ে পড়ছিল, সবার সঙ্গ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল।
এক বিকেলে বাগানের যজ্ঞকুণ্ডের পাশে গিয়ে সে দাঁড়াল। ঝোপঝাড় সরিয়ে দেখল, কুণ্ডের ভেতরে এখনও কালো ছাই জমে আছে। তার হাত অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেখানে গড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ যেন সে অতীতের প্রতিধ্বনি শুনতে পেল—ডামরু বাজছে, আগুনে ঘি ঢালা হচ্ছে, মন্ত্র পড়ছে অনেকগুলো গলা একসঙ্গে। সে বুঝল, এখানেই হয়েছিল সেই আচার যেখানে অদ্বৈতানন্দ আত্মাকে আয়নায় বাঁধতে পেরেছিলেন। অর্পিতা ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে লাগল, আর মনে হল তার ভেতরের অচেনা সত্তা যেন খুশি হচ্ছে, যেন শিকড় ছুঁয়ে ফেলেছে।
সেই রাতে ঘটল ভয়ঙ্কর এক ঘটনা। পরিবারের ছোট ছেলে—মাত্র পনেরো বছরের কিশোর—কৌতূহলবশত আয়নার দিকে তাকিয়ে ফেলল। মুহূর্তে সে অদ্ভুত চিৎকার করে উঠল, “আমি আগুনে পুড়ছি! আমাকে বাঁচাও!” তারপরই ধপ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সবাই ছুটে এল, কিন্তু তখন আর দেরি হয়ে গেছে। আবার মৃত্যু, আবার শোক। অর্পিতা এবার নিজের শরীর ঠান্ডা হয়ে আসতে টের পেল। সে বুঝল, মৃত্যুর এই সারি থামবে না। আর প্রতিবার মৃত্যুর দায় যেন তার কাঁধে চাপছে।
ঠাকুমা মহাশ্বেতা এবার আর চুপ রইলেন না। সবার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “অর্পিতা, আর লুকিয়ে লাভ নেই। তুই-ই আমাদের উত্তরাধিকারী। অদ্বৈতানন্দের ছায়া তোর শরীরে এসেছে।” বাড়ির ভেতর শোরগোল উঠল। কেউ বলল, “এ কেমন কথা!” কেউ আবার হাঁ করে অর্পিতার দিকে তাকাল। অর্পিতা দাঁড়িয়ে রইল স্তব্ধ, ঠোঁট শুকনো, গলা শুকিয়ে কাঠ। তার যুক্তিবাদী মাথা প্রতিবাদ করতে চাইছিল, কিন্তু হৃদয়ের গভীর থেকে আসা অচেনা কণ্ঠস্বর যেন বলছিল—“হ্যাঁ, তুই-ই উত্তরাধিকারী।”
সেই রাতে আয়নার ভেতরে প্রতিচ্ছবি আর নীরব থাকল না। সে স্পষ্ট করে শুনল—“তুই আমার রক্ত, আমার সাধনার ফসল। মৃত্যু তোর ভয় নয়, মৃত্যু তোর হাতিয়ার।” অর্পিতা বিছানায় বসে কাঁপছিল। হঠাৎ তার ঠোঁট থেকে নিজে থেকেই বেরোল মন্ত্র—“ওঁ হ্রীং কালিকায় নমঃ…” সে শিউরে উঠল। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল, কিন্তু শব্দ থামছিল না।
এখন আর পালাবার উপায় নেই, সে জানল। কালো দর্পণ তার ভিতরে ছাপ রেখে গেছে। মৃত্যুর সারি শুধু বাড়ছে, আর অর্পিতা অনুভব করছে সেই অন্ধকার উত্তরাধিকার তার রক্তে বয়ে চলেছে।
স্বীকৃতির পথে
অর্পিতা বুঝতে পারছিল, নিজের ভিতরে এক যুদ্ধ চলতে শুরু করেছে। একদিকে সে এখনও যুক্তিবাদী, আধুনিক মেয়ে—যে বিদেশে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছে, যে সবসময় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু অন্যদিকে কালো দর্পণের টান প্রতিদিন তার ভেতরের সেই অচেনা সত্তাকে জাগিয়ে তুলছিল। প্রতিটি দিন তার শরীর ভারী হয়ে আসত, যেন তার ভিতরে অন্য কেউ শ্বাস নিচ্ছে।
পরিবারের মৃত্যু আর আতঙ্কের পরিবেশে সবাই তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছিল। লোকের চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল সন্দেহ—এই মৃত্যুগুলো কি অর্পিতার সঙ্গে যুক্ত? একদিন এক আত্মীয় ক্ষেপে গিয়ে বলে ফেলল, “ও-ই অদ্ভুত সব করে বেড়াচ্ছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি ও মন্ত্র পড়ছিল রাতে।” দাদু অমৃতলাল চুপ করে গেলেন, প্রতিবাদ করলেন না, শুধু মাথা নীচু করলেন। সেই নীরবতা অর্পিতাকে আরও আঘাত করল।
কিন্তু তার ভেতরের আরেকটি কণ্ঠ তখনও শক্ত হয়ে উঠছিল। রাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে স্পষ্ট শুনল প্রতিচ্ছবির ফিসফিস—“তুই কেন অস্বীকার করছিস? সত্যি তোকে ডাকছে। তুই-ই পরবর্তী ধারক।” অর্পিতা একদম কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আমি কি তাহলে অদ্বৈতানন্দের উত্তরাধিকার? আমি কি সত্যিই শ্মশানের মন্ত্র বহন করি?” প্রতিচ্ছবি শুধু হাসল, ঠোঁট বেয়ে রক্তের রেখা নেমে এল।
এরপর থেকে অর্পিতা বদলাতে শুরু করল। সে বারবার একা চলে যেত বাগানের যজ্ঞকুণ্ডের পাশে। মাটির গায়ে আঙুল বুলিয়ে অনুভব করত আগুনের আঁচ। একদিন হঠাৎ তার হাতে লেগে গেল ছাইয়ের গুঁড়া। গন্ধটা এত পরিচিত মনে হল যে তার চোখ ভিজে গেল। যেন সেই ছাই একসময় তার নিজের ছিল, তার নিজের আচার থেকে অবশিষ্ট।
রাতে ঘরে বসে সে ডায়রির পাতায় লিখল—“আমি ভয় পাচ্ছি, অথচ আমি আকৃষ্টও হচ্ছি। আমি পালাতে চাই, কিন্তু প্রতিবারই মনে হয় আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসছে। হয়তো এটাই আমার নিয়তি।”
পরের রাতে হঠাৎ ঝড় উঠল। বিদ্যুৎ চলে গেল, বাড়ি অন্ধকারে ডুবে গেল। করিডরে সবাই আতঙ্কিত, কেউ মোমবাতি খুঁজছিল। ঠিক তখনই আয়নার ঘর থেকে আলো ছড়াল—একটি নীলাভ আলো, যা কাচের ভিতর থেকে আসছিল। সবাই দরজা বন্ধ করে দিল, কিন্তু অর্পিতা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। আলো যেন তাকে ডাকছিল।
সে কাচের সামনে দাঁড়াতেই প্রতিচ্ছবি আর তার নিজের মতো রইল না। সেখানে ফুটে উঠল এক নারী—চুল খোলা, কপালে রক্তচন্দন, হাতে ত্রিশূল। সে চেয়ে আছে অর্পিতার চোখের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে ঠোঁট নড়ে উঠল—“তুই-ই আমি। আমি-ই তুই। স্বীকার কর।”
অর্পিতার শরীর কাঁপছিল, কিন্তু ঠোঁট থেকে নিজে থেকেই বেরোল শব্দ—“আমি স্বীকার করি…” সে জানত না কাকে বলছে, জানত না কেন বলছে, শুধু অনুভব করল তার শরীর দিয়ে বিদ্যুতের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে শ্মশানের দৃশ্য ফুটে উঠল, আগুনের ভেতর সে দাঁড়িয়ে আছে, চারপাশে মানুষের ছায়া, আর তার ঠোঁটে মন্ত্র জপ।
ভয়, বিস্ময়, আকর্ষণ—সব মিলেমিশে অর্পিতা বুঝল, পালাবার পথ নেই। কালো দর্পণের শক্তি তাকে গ্রাস করেছে। এখন সে হয় পুরোপুরি মেনে নেবে, নয়তো ভস্ম হয়ে যাবে।
পরদিন সকালে সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দৃঢ় গলায় বলল, “আমি সত্য জানতে চাই। যদি আমি উত্তরাধিকার বহন করি, তবে আমাকেই শেষ করতে হবে এই অভিশাপ।” আয়নার ভেতর প্রতিচ্ছবি হেসে উঠল—একটা ভয়ঙ্কর, অমানবিক হাসি।
এভাবেই অর্পিতা স্বীকৃতির পথে পা রাখল—নিজের ভেতরে লুকোনো অন্ধকারকে মেনে নিয়ে, অভিশপ্ত ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে।
কালো দর্পণ
কালো দর্পণ যেন শেষ লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিয়ে বসে ছিল। অর্পিতা বুঝে গিয়েছিল, পালিয়ে বাঁচা যাবে না—এই অভিশাপকে ভাঙতে হলে তাকে সরাসরি মুখোমুখি হতে হবে। বাড়ির বাতাস দিনকে দিন ভারী হয়ে উঠছিল, যেন প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি জানালার ফাঁক থেকে অদৃশ্য ছায়া ঝরে পড়ছে। আত্মীয়রা অনেকেই ইতিমধ্যে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। কেবল দাদু আর ঠাকুমা রয়ে গেছেন, আর অর্পিতা নিজে।
সেই রাতে বাড়ির আঙিনায় অদ্ভুত নৈশব্দ নেমে এল। চাঁদ মেঘের আড়ালে ঢেকেছিল, শুধু ঝিঁঝিঁর ডাক কানে আসছিল। হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে এল ডামরুর শব্দ। অর্পিতা জানল, সেই ডাক তার জন্য। সে ধীরে ধীরে এগোল আয়নার ঘরের দিকে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই তার চোখ ধাঁধিয়ে গেল—ঘর ভরে উঠেছে অগ্নি-আলোয়। কিন্তু মোমবাতি নেই, প্রদীপ নেই, আলো আসছে আয়নার ভেতর থেকে।
কাচের পৃষ্ঠে তখন আর অর্পিতার প্রতিচ্ছবি নেই। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে অদ্বৈতানন্দ, সেই তান্ত্রিক সাধক, যাকে নিয়ে এতদিন কিংবদন্তি শোনা গেছে। তাঁর চোখ রক্তলাল, চুল খোলা, কপালে ভস্মের রেখা। তিনি অর্পিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুই আমার রক্ত, তুই আমার উত্তরাধিকার। এখন সময় এসেছে তোর শক্তিকে স্বীকার করার।”
অর্পিতা দাঁড়িয়ে রইল, বুকের ভেতরে ধুকপুকানি তীব্র হচ্ছিল। সে দৃঢ় গলায় বলল, “আমি যদি উত্তরাধিকারী হই, তবে এই অভিশাপ ভাঙব। আমি তোমার মতো অন্ধকারে ডুবে যাব না।” অদ্বৈতানন্দ হেসে উঠলেন—“অভিশাপ ভাঙা যায় না, মেয়ে। এটা শক্তি, এটা রক্তে লেখা। তুই চাইলেও পালাতে পারবি না।”
অর্পিতা এগিয়ে গেল আয়নার একেবারে সামনে। কাচে হাত রাখতেই শরীর কেঁপে উঠল, যেন আগুনের স্রোত বইছে শিরায় শিরায়। সে চোখ বন্ধ করে মনে করল নিজের সমস্ত স্বপ্ন, নিজের সমস্ত ভয়, আর পরিবারের একের পর এক মৃত্যুর দৃশ্য। হঠাৎ তার ঠোঁট থেকে বেরোল মন্ত্র—কিন্তু এবার মন্ত্রটা অন্যরকম, ভেতরে থেকে উঠে আসা বিদ্রোহের মন্ত্র।
আয়নার কাচ ফেটে উঠতে শুরু করল। অদ্বৈতানন্দ চিৎকার করে উঠলেন—“না! এটা করিস না!” আলো ঝলসে উঠল, ঘর কেঁপে উঠল। প্রতিটি ফাটলের ভেতর থেকে বেরোতে লাগল কালো ধোঁয়া, যেন বন্দি আত্মারা মুক্তি পাচ্ছে। সেই ধোঁয়ার মাঝে অর্পিতা দেখল অসংখ্য চোখ, অসংখ্য মুখ, যারা শতাব্দী ধরে বন্দি ছিল।
দাদু আর ঠাকুমা ছুটে এলেন। তাঁরা দেখলেন, অর্পিতা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, চুল উড়ছে ঝড়ে, চোখ জ্বলছে আগুনে। সে গর্জে উঠল—“আমি তোমার উত্তরাধিকারী, কিন্তু আমি তোর অভিশাপ বহন করব না। আমি মুক্ত করব এই বাড়িকে, এই পরিবারকে।”
শেষ মন্ত্র উচ্চারণ করতেই আয়নার কাচ ভেঙে গেল টুকরো টুকরো হয়ে। ভাঙা কাচের সঙ্গে সঙ্গে আলো নিভে গেল, শব্দ থেমে গেল, ঘর অন্ধকারে ডুবে গেল। কিছুক্ষণ পর ধুলো আর ছাই থিতিয়ে গেলে দেখা গেল—আয়না আর নেই, শুধু মেঝেতে ছড়িয়ে আছে ভাঙা টুকরো, আর অর্পিতা নিথর হয়ে শুয়ে আছে মেঝেতে।
ঠাকুমা কাঁদতে কাঁদতে তাকে কোলে তুলে নিলেন। দাদু ফিসফিস করে বললেন, “সে নিজের জীবন দিয়েই অভিশাপ ভাঙল।” কিন্তু ঠিক তখনই অর্পিতার বুক সামান্য নড়ে উঠল। সে চোখ খুলল ধীরে ধীরে, চোখে আর লাল আগুন নেই, শুধু ক্লান্তি আর শান্তির ছাপ। সে মৃদু গলায় বলল, “শেষ হয়েছে… কালো দর্পণ আর নেই।”
বাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মনে হল যেন দীর্ঘদিনের বোঝা সরে গেছে। কিন্তু করিডরের এক অন্ধকার কোণে, ভাঙা কাচের টুকরোর ওপর থেকে হঠাৎ ক্ষীণ এক ঝিলিক দেখা গেল—যেন অদ্বৈতানন্দের ছায়া এখনও কোথাও রয়ে গেছে।
শেষ




