Bangla - তন্ত্র

কালো আষাঢ়ের রাত

Spread the love

ভাস্কর রায়


আষাঢ়ের দিনগুলোতে গ্রামটা যেন সবসময়ই এক অদ্ভুত অশুভ আবহে ঢেকে থাকত। নদীর পাড় থেকে শুরু করে পুকুরঘাট পর্যন্ত, চারদিক যেন স্যাঁতস্যাঁতে বাতাসে ভারী হয়ে উঠত। সেদিনও বিকেল থেকেই মেঘ জমতে শুরু করেছিল আকাশে। কালো মেঘের দল যেন ঝাঁকে ঝাঁকে এসে একত্রিত হয়েছে গ্রামটার ওপর, যেন গোটা আকাশটাকে গিলে খাবে। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই মেঘের গর্জনে গ্রাম কেঁপে উঠল। মাটির কুঁড়েঘরের ভেতরে মহিলারা তাড়াতাড়ি প্রদীপ জ্বালিয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রার্থনা করতে লাগল। খড়ের ছাউনি ভিজে জলে টপটপ করে পড়ছিল, আর শিশুরা কোলের ভেতরে লুকিয়ে আতঙ্কে চুপ হয়ে গেল। গ্রামে তখন ভয় আর অশুভ সংকেতের গন্ধ ছড়িয়ে আছে। মানুষজন বলাবলি করছিল—এবারের অমাবস্যাটা নাকি সহজে কাটবে না। কারণ, শ্মশানঘাট থেকে আগের রাতে কেউ কেউ অদ্ভুত আওয়াজ শুনেছে, আর গোকুলের স্ত্রীর শপথ, সে নাকি দেখেছে ছায়ার মতো কিছু শ্মশান থেকে গ্রামমুখো আসছে।

রাত বাড়তেই ঝড়ের দমক আরও তীব্র হয়ে উঠল। হঠাৎ করেই বজ্রপাতের মতো এক দম আলো ছুটে এল শ্মশানঘাটের দিক থেকে। গ্রামের কুকুরগুলো একসঙ্গে হাউহাউ করে উঠল, গরুগুলো গোয়ালঘরে ভয়ে গুঁতোগুঁতি শুরু করল। গ্রামের মানুষের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। এমন সময় পল্টু, সেই গ্রামের খেপা ছেলে, ছুটে এসে চিৎকার করে উঠল—“শ্মশানে আগুন! আগুন লেগেছে!” লোকজন সাহস করে বাইরে বেরিয়ে দেখে, সত্যিই শ্মশানঘাটের দিকটা যেন লাল আভায় ঝলমল করছে। বজ্রপাতের আলোর সঙ্গে মিলেমিশে সেই দৃশ্য আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। ঠিক তখনই তারা দেখতে পেল এক অদ্ভুত ছায়া, ধীরে ধীরে শ্মশানঘাট থেকে গ্রামমুখো এগিয়ে আসছে। লোকটা লম্বা কালো আলখাল্লায় ঢাকা, কপালে লাল-সাদা চন্দনের টানা দাগ, হাতে রুদ্রাক্ষের মালা ঝুলছে, আর চোখদুটো যেন জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো। তার হাতে ঝোলানো আছে এক পিতলের ঘন্টা, আর অন্য হাতে ধরা একটি খুলি। সেই ভয়ঙ্কর চেহারার মানুষটি গ্রামে এসে দাঁড়াতেই লোকজন চমকে পিছিয়ে গেল।

গ্রামের মাঝখানে এসে লোকটি গম্ভীর গলায় ঘোষণা করল—“ভয় পেয়ো না, আমি করালনাথ। তোমাদের রক্ষা করতে এসেছি।” তার কণ্ঠস্বর যেন একসঙ্গে বজ্রপাত আর ঝড়ের মতো কেঁপে উঠল চারপাশে। কিন্তু রক্ষার প্রতিশ্রুতিতেও কেউ আশ্বস্ত হতে পারল না, কারণ তার চেহারা, তার উপস্থিতি—সবকিছুতেই যেন ভয়ের গন্ধ। অজয় চৌধুরী, গ্রামের প্রধান, সাহস করে এগিয়ে এসে বলল—“আপনি কে? কেন এসেছেন হঠাৎ এই রাতে?” করালনাথ শুধু রহস্যময়ভাবে হেসে বলল—“আজ অমাবস্যা, অশুভ শক্তির খেলা শুরু হয়েছে। এই গ্রাম অভিশপ্ত, আমি না থাকলে কাল ভোর তোমরা বাঁচতে না।” কথা শেষ করেই সে মাটিতে বসে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করল। মাটির ওপর সিঁদুর দিয়ে আঁকতে লাগল অদ্ভুত সব চিহ্ন। গ্রামবাসীরা দূর থেকে দাঁড়িয়ে ভয়ে আর বিস্ময়ে সেই দৃশ্য দেখল। কারো মনে আশা জাগল, কেউ ভাবল এ লোক বোধহয় সত্যিই রক্ষা করবে। কিন্তু অনেকের বুকের ভেতর তীব্র আতঙ্ক ঢুকে পড়ল—কারণ কেউ জানত না এই লোকটা আসলে দেবতার দূত, নাকি অশুভ শক্তির সঙ্গী। সেই আষাঢ়ের অমাবস্যার রাতেই গ্রাম যেন বুঝে গেল—এরপর আর কিছুই আগের মতো থাকবে না।

করালনাথের আগমনের পর থেকে গ্রামজুড়ে যেন এক অদৃশ্য অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছিল। সবাই মিলে মাটির চৌকাঠে বসে ফিসফিস করে গল্প করছিল, শিশুরা বড়দের আঁচল আঁকড়ে ছিল, আর মহিলারা ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বেলে কালীঠাকুরের নাম জপছিল। অজয় চৌধুরী, গ্রামপ্রধান, সেই রাতেই নিজের উঠোনে করালনাথকে থাকার ব্যবস্থা করলেন। একটি খালি ভাঙাচোরা গোয়ালঘর ঝাড়ামোছা করে সেখানে তাঁকে আশ্রয় দেওয়া হল। তবে নিজের মনেই দ্বিধায় ভুগছিলেন অজয়—একদিকে গ্রামের মানুষের চাপ, অন্যদিকে নিজের অন্তরের অস্বস্তি। করালনাথের কণ্ঠস্বর, তার চোখের জ্যোতি, আর অদ্ভুত মন্ত্রপাঠে তিনি বুঝতে পারছিলেন—এ লোক সাধারণ কেউ নয়। কিন্তু একইসঙ্গে তিনি অনুভব করছিলেন, এর মধ্যে এমন এক শীতল ভয় আছে যা মানুষের আত্মা পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়। তবু অজয় ভাবলেন, যদি এই লোকটি সত্যিই গ্রামের ক্ষতি আটকাতে পারে, তবে তাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করাটা বোকামি হবে। সেই কারণেই তিনি করালনাথকে আশ্রয় দিলেন, তবে নিজের অন্তরে একটা কঠিন প্রশ্ন নিয়ে—এই সিদ্ধান্তের ফল কী হবে?

পরদিন সকালে রঘু দাস, গ্রামের পুরনো ঝাড়ফুঁকওয়ালা, এসে সরাসরি অজয় চৌধুরীকে বলল—“ওকে আশ্রয় দিয়ে বড় ভুল করছেন, চৌধুরীমশাই। এই লোক সাধু নয়, তান্ত্রিক। তার চোখে আগুন, তার মন্ত্রে মৃত্যু। এ যদি গ্রামে থাকে, তবে দুঃখকষ্ট আরও বাড়বে।” রঘু দাসের কণ্ঠে স্পষ্ট আতঙ্ক ও রাগ ছিল। সে জানত, তার বহু বছরের গ্রামীণ ভরসা হয়তো করালনাথ এসে কেড়ে নেবে। কিন্তু শুধু ঈর্ষা নয়, ভেতরে ভেতরে রঘু সত্যিই এক অদ্ভুত অশুভ ছায়া অনুভব করছিল। তার শরীর কেঁপে উঠত যখন সে করালনাথকে দূর থেকে দেখত, যেন সেই চোখের জ্বালায় তার সমস্ত মন্ত্রই ফিকে হয়ে যাচ্ছে। অজয় তার যুক্তি শুনল, কিন্তু চুপ করে রইল। সরাসরি অস্বীকার করল না, আবার সমর্থনও করল না। শুধু মনে মনে ভেবে চলল—রঘুর কথা যদি সত্যি হয়, তবে গ্রাম বিপদে পড়বে। আর যদি করালনাথই প্রকৃত রক্ষাকর্তা হয়, তবে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া মানে হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।

অন্যদিকে, গ্রামের সাধারণ মানুষদের মনোভাব ছিল একেবারে ভিন্ন। গোকুল মণ্ডল, এক সাধারণ কৃষক, সেই রাতের ভয়াবহ বজ্রপাতের পর থেকেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে করালনাথ না এলে তারা সবাই ধ্বংস হয়ে যেত। সে বারবার লোকজনকে বলছিল—“তোমরা কি দেখোনি? বজ্রপাতের আলোয় শ্মশান যেন আগুনে জ্বলছিল! আর সে এসে মন্ত্র পড়তেই শান্ত হল সবকিছু। ও না থাকলে আজ আমরা কেউ বেঁচে থাকতাম না।” গোকুলের মতো আরও অনেকে একই বিশ্বাসে আস্থা রাখতে লাগল। তারা ভোরবেলা গোয়ালঘরে গিয়ে পশুপাখিদের অবস্থা দেখে বুঝল—আতঙ্ক এখনও আছে, কিন্তু আগের মতো অস্থিরতা নেই। এ থেকেই তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে করালনাথের আগমনই তাদের মুক্তির ইঙ্গিত। মহিলারা ঘরে ঘরে দেবতার নামে শপথ করে বলল—“ওকে থাকতে দাও, ওর হাতেই গ্রাম রক্ষা হবে।” এভাবে গ্রামের মধ্যে বিভাজন তৈরি হতে শুরু করল—একদিকে রঘু দাস ও তার অনুসারীরা, যারা বিশ্বাস করছিল করালনাথ অশুভ; আরেকদিকে সাধারণ গ্রামবাসী, যারা ভয়ে বা আশায়, তাকে ঈশ্বরের দূত ভেবে বসেছিল। অজয় চৌধুরী মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়লেন—তার দ্বিধা আরও ঘনীভূত হল। তিনি বুঝতে পারলেন, এখন থেকে প্রতিটি সিদ্ধান্ত শুধু গ্রামের নয়, তার নিজেরও ভাগ্য নির্ধারণ করবে। সেই আষাঢ়ের দিনেই গ্রামের আকাশে কালো মেঘ জমল শুধু প্রকৃতির নয়, মানুষের মনেও।

কাদম্বরী ছিল গ্রামের একা মেয়ে, বছর পঁচিশের তরুণী, বিধবা জীবনের ভার নিয়ে একাকীত্বে দিন কাটত তার। বিধবার সাদা শাড়ি, চুপচাপ স্বভাব আর বাড়ির কোণে বসে থাকা তার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। তবে তার চোখে ছিল এক গভীর রহস্যময়তা, যা গ্রামবাসী বুঝে উঠতে পারত না। অনেকেই বলত, সে নাকি রাতের অন্ধকারে প্রায়ই জানালার পাশে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন কারও সঙ্গে নীরবে কথা বলে। করালনাথের আগমনের পর থেকেই গ্রামে ফিসফিস শুরু হয়—“ও মেয়েটা একদিন না একদিন বিপদ ডেকে আনবেই।” তান্ত্রিকের অদ্ভুত দৃষ্টি যেন কাদম্বরীর গায়েই আটকে থাকে, আর কাদম্বরীও যেন অদ্ভুত এক আকর্ষণে তার কাছে টেনে যায়। প্রথম রাতে সবাই যখন নিজেদের ঘরে ভয়ে গুটিসুটি মেরে বসে ছিল, তখন কাদম্বরী দূর থেকে দেখেছিল করালনাথ উঠোনের কোণে বসে মন্ত্রোচ্চারণ করছে। অন্ধকার আকাশের নিচে, ধূপের ধোঁয়া আর জ্বালানো প্রদীপের আলোয় তার ঠোঁট নড়ছিল এক অচেনা ভাষার ছন্দে। সেই মন্ত্রের আওয়াজ যেন কাদম্বরীর বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে, তার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সে চুপচাপ জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিল, কিন্তু হঠাৎই মনে হল করালনাথ সরাসরি তার চোখে তাকিয়ে আছে। কাঁপতে কাঁপতে সে জানালার পর্দা টেনে দিল, অথচ মনে হল, তার ভেতরে অদৃশ্য কেউ ঢুকে পড়েছে।

রাত বাড়তেই কাদম্বরীর ঘুম এল না। হঠাৎ করেই সে এক ভয়াবহ স্বপ্নে ডুবে গেল। স্বপ্নে সে দেখল—এক শ্মশানের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে, চারদিক অন্ধকার, আর শূন্যে নড়ছে আগুনের লেলিহান শিখা। বাতাসে ভেসে আসছে ভয়ংকর মন্ত্রোচ্চারণ, সেই স্বর যেন করালনাথের। হঠাৎ সে দেখল, ধোঁয়ার ভেতর থেকে এক ছায়া এগিয়ে আসছে, যার কোনো মুখ নেই, শুধু লালচে দুটি জ্বলন্ত চোখ। ছায়াটা ধীরে ধীরে তার দিকে এগোতে লাগল, আর তার কানে যেন শোনা গেল করালনাথের গম্ভীর গলায় আওয়াজ—“বলিদান… বলিদান…” চিৎকার করতে গিয়েও কণ্ঠে শব্দ বেরোল না, শরীর নড়ল না। হঠাৎ করেই সে ধড়মড় করে জেগে উঠল, গলায় ঘাম জমে আছে, বুক ধড়ফড় করছে। চারপাশে নিস্তব্ধতা, শুধু দূরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখল, উঠোনে করালনাথ দাঁড়িয়ে আছে, চোখদুটো অদ্ভুত জ্যোতিতে জ্বলছে। তার মনে হল, স্বপ্ন আর বাস্তব একে অপরের সঙ্গে মিশে গেছে।

এই ঘটনার পর থেকেই গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ল। মহিলারা কুপির আলোয় একে অপরকে বলাবলি করত—“কাদম্বরীকে কি তবে তান্ত্রিক বলি দেবে?” কারও কারও মতে, করালনাথের মতো শক্তিশালী তান্ত্রিকরা সাধারণত বিধবাদেরই টেনে নেয় তাদের পূজায়, কারণ তারা নাকি দেবী ও অশুভের মাঝামাঝি অবস্থায় থাকে। রঘু দাস তো সরাসরি অজয় চৌধুরীকে বলল—“এই মেয়েকে সাবধানে রাখুন, ওকে ওরা নেবে।” কিন্তু অজয় দ্বিধায় পড়ে গেলেন—একদিকে গ্রামের মানুষের ভয়, অন্যদিকে কাদম্বরীর নীরব সম্মতি যেন করালনাথের দিকেই ঝুঁকে আছে। গোকুলদের মতো অনেকে আবার মনে করল, যদি কাদম্বরীর বলি দিয়েই গ্রাম বেঁচে যায়, তবে সেটা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। অথচ কাদম্বরী নিজেই বুঝতে পারছিল, কিছু একটা অদৃশ্য বাঁধনে সে জড়িয়ে পড়েছে। সে ভয় পাচ্ছিল, কিন্তু একইসঙ্গে করালনাথের রহস্যময় দৃষ্টি তাকে অদ্ভুত এক টানে টেনে নিচ্ছিল। গ্রামে তখন আষাঢ়ের মেঘ যেমন আকাশ ঢেকে রেখেছিল, তেমনি সন্দেহ, আতঙ্ক আর ফিসফিসানি ঢেকে রাখছিল মানুষজনের মন। কাদম্বরীর ছায়া যেন ধীরে ধীরে গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল, আর সবাই বুঝতে পারছিল—অশুভ খেলার মূল চাবিকাঠি হয়ে উঠছে এই নিঃসঙ্গ তরুণী।

পল্টুর চোখে ঘুম আসে না সেই রাতে। নদীর ধারে ঝোপঝাড়ের আড়ালে বসে সে গোপনে দেখছিল করালনাথকে, গ্রামের রহস্যময় তান্ত্রিককে, যে দিনের বেলায় সবার সামনে নিরীহ বৃদ্ধের মতো ঘুরে বেড়ালেও রাত নামলেই অদ্ভুত সব কাজকর্মে লিপ্ত হয়। পল্টু প্রথমে ভেবেছিল, হয়তো সে ভুল দেখছে, কিন্তু নিজের চোখে স্পষ্ট দেখল করালনাথ শ্মশানের কালো মাটিতে রক্ত দিয়ে বড় বড় চক্র আঁকছে, মাঝখানে মাথার খুলি রেখে মন্ত্র উচ্চারণ করছে। তার গলা এত ভারী, যেন মৃতরা মাটি ফুঁড়ে উঠে আসবে। বাতাস ভারী হয়ে উঠল, চারপাশে অদ্ভুত গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল—কখনো পচা মাংসের, কখনো পোড়া ধূপের মতো। পল্টুর হাত-পা কাঁপছিল, কিন্তু তবুও চোখ সরাতে পারছিল না। তার মনে হচ্ছিল, সে এক ভয়ানক গোপন ব্যাপারের সাক্ষী হয়ে যাচ্ছে। মন্ত্রোচ্চারণের ফাঁকে ফাঁকে করালনাথ ছাগলের রক্ত দিয়ে মাটিতে নকশা আঁকছিল, আর আঙুল দিয়ে মাথার খুলির গহ্বরে রক্ত ঢালছিল। হঠাৎ শ্মশানের কুকুরগুলো অদ্ভুতভাবে হুক্কাহুয়া করতে শুরু করল, আর সেই শব্দে পল্টুর গা শিরশির করে উঠল। সে বুঝতে পারল, এই মানুষটা নিছক সাধক নয়—তার ভিতরে কিছু অন্ধকার, অজানা শক্তির খেলা আছে।

পরদিন সকালেই পল্টু গ্রামের চৌমাথায় গিয়ে চেঁচিয়ে বলল, “আমি নিজের চোখে দেখেছি! করালনাথ রক্ত দিয়ে চক্র আঁকছে শ্মশানে। ওর মন্ত্র শুনলে হাড়ও কেঁপে ওঠে!” কিন্তু গ্রামবাসীরা হাসতে শুরু করল। কেউ বলল, “ও খেপা পল্টু, সবসময় কল্পনা করে গল্প বানায়।” কেউ আবার ঠাট্টা করে বলল, “কোনদিন ভূতও দেখেছিস নাকি?” পল্টু যতই শপথ করে বলল, ততই লোকজন তার কথা বিশ্বাস করল না। তবে ভেতরে ভেতরে তারা অস্বস্তি বোধ করছিল, কারণ গত কয়েক সপ্তাহ ধরে গ্রামে অদ্ভুত কিছু ঘটছিল। কারও গরু হঠাৎ রাতে খোঁয়াড় থেকে উধাও, কারও ছাগল সকালে দেখা যাচ্ছে না, আবার কোথাও কোথাও পাড়ার কুকুর হারিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে সবাই ভেবেছিল, বাঘ বা শেয়াল এসব প্রাণী ধরে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে—কোনও রক্তের দাগ নেই, কোনও লড়াইয়ের চিহ্ন নেই, প্রাণীগুলো যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। পল্টুর কথার সঙ্গে এই ঘটনাগুলো মিলে যাওয়ায় কয়েকজনের মনে সন্দেহ জাগল। তারা মুখে কিছু বলল না, কিন্তু চোরা চোখে করালনাথের দিকে তাকাতে শুরু করল।

গ্রামের বাতাস ধীরে ধীরে ভারী হয়ে উঠছিল। দিনে চাষবাস, মাঠে কাজকর্ম চললেও রাতে লোকজন ভয়ে ঘরে তালা দিয়ে বসে থাকত। বাইরে কুকুরের ডাক, বনের পাখির অচেনা শব্দ আর অদৃশ্য ছায়ার মতো এক শীতল অনুভূতি সবার গায়ে কাঁটা দিত। পল্টু বারবার বলছিল, “ওই বুড়োটা কিছু করছে! তোমরা বিশ্বাস করো না, কিন্তু একদিন তোমাদের ঘর থেকেও কিছু হারাবে।” তার কথায় অজান্তেই লোকজনের মন কেঁপে উঠছিল। বিশেষ করে বাচ্চারা ভয়ে সন্ধ্যার পর বাইরে বেরোতে চাইত না। তারপর হঠাৎ একদিন গ্রামের প্রায় নতুন বাছুরও অদৃশ্য হয়ে গেল। মালিক লোকজনকে বলল, সে রাতে খোঁয়াড়ের পাশে ঘুমাচ্ছিল, তবুও কিছু টের পায়নি। সেই ঘটনার পর গ্রামের কয়েকজন গোপনে মিলে আলোচনা করল—পল্টু হয়তো একেবারে ভুল বলেনি। কেউ কেউ সাহস করে করালনাথের বাড়ির চারপাশ ঘুরে দেখার চেষ্টা করল, কিন্তু কোনও অস্বাভাবিক চিহ্ন পেল না। তবুও অজানা ভয়ের ছায়া গ্রামে নেমে এল। পল্টু, যে এতদিন সবাইকে হাসাত, এবার তার কথার গুরুত্ব বেড়ে গেল। কিন্তু সে জানত, যা সে দেখেছে, তা কেবল গ্রাম হারিয়ে যাওয়া পশুর ব্যাপার নয়; করালনাথের আবির্ভাবের পেছনে কোনও ভয়ঙ্কর অন্ধকার রহস্য লুকিয়ে আছে, যার ফাঁস হলে গোটা গ্রাম কেঁপে উঠবে।

ভোরের প্রথম আলো ফুটতেই গ্রামের মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি মিলিয়ে গেল নিস্তব্ধতায়, আর তখনই দেখা গেল অদ্ভুত দৃশ্য—সিঁড়ি বেয়ে শিবলিঙ্গের পাদদেশ পর্যন্ত লালচে দাগ ছড়িয়ে রয়েছে, যেন রাতের আঁধারে কেউ রক্ত ঢেলেছে পাথরের গায়ে। ভক্তরা মন্দিরে ঢুকতেই আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে; কেউ বলে এটা পশুবলি, কেউ আবার ফিসফিস করে বলে, “না, এটা মানুষের রক্ত।” ভয়ে কাঁপতে থাকা পুরোহিত শশাঙ্কবাবু তাড়াহুড়ো করে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দিলেন, কিন্তু খবর ইতিমধ্যেই গ্রামময় ছড়িয়ে পড়েছে। সকলে দল বেঁধে মন্দিরের উঠোনে জড়ো হল, মুখে ভয় আর অস্বস্তির ছাপ। সেই ভিড়ের মাঝেই হুঙ্কার দিয়ে উঠে দাঁড়াল রঘু দাস—গ্রামের সাহসী চাষি, যিনি বরাবর তন্ত্রমন্ত্রের বিরুদ্ধে। সে সবার সামনে ঘোষণা করল, “এটা করালনাথ তান্ত্রিকেরই কাজ। গ্রামকে ভয় দেখিয়ে নিজের দাপট জমাতে চায়। এই সব রক্ত আর ছলনার পেছনে তারই হাত আছে।” গ্রামের মানুষ তার কথায় সমর্থন জানালেও চোখেমুখে ছিল স্পষ্ট আতঙ্ক—কারণ করালনাথের নাম নিলে সবার বুকেই যেন শীতল স্রোত বইত। তবু রঘু দাস দৃঢ় কণ্ঠে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল, “তান্ত্রিক যদি এত শক্তিশালী হয়, তবে আমার সামনে এসে প্রমাণ করুক, নইলে সবাই জানবে সে ভণ্ড।”

রঘুর এই দুঃসাহসিক ঘোষণায় গ্রামের বাতাসে যেন বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা দিল। সন্ধ্যা নামতেই খবর পৌঁছল করালনাথের কানে। কালো চাদর জড়ানো সেই ভয়ংকর তান্ত্রিক ক্রোধে লাল চোখ করে সোজা মন্দিরের সামনে হাজির হল, আর তার দৃষ্টি খুঁজে নিল রঘুকে। চারদিকের মানুষ ভয়ে একে একে পিছু হটল, শুধু রঘুই বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। করালনাথ হাড়হিম করা কণ্ঠে বলল, “আমাকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস করেছিস? তোকে আমি অভিশাপ দিচ্ছি, তোর শরীর শুকিয়ে যাবে, রক্তে আগুন জ্বলবে, আর তুই দিনের আলোয় পাগলের মতো চিৎকার করে মরবি।” কথাগুলো বলতে বলতেই সে মুঠো ভর্তি ভস্ম আকাশে ছড়িয়ে দিল, আর ভিড়ের মাঝে হঠাৎ এক অদ্ভুত শীতলতা নেমে এল। রঘু প্রথমে সাহসী ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে থাকলেও মিনিট খানেকের মধ্যেই তার শরীর থরথর কাঁপতে শুরু করল, চোখ লাল হয়ে উঠল, আর বুক থেকে অদ্ভুত হাঁপ ধরা আওয়াজ বেরোতে লাগল। ভিড় আতঙ্কে ছত্রভঙ্গ হল, কেউ আবার দৌড়ে তার হাত ধরে তাকে টেনে বাড়ির দিকে নিয়ে গেল। সারা গ্রাম নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল, শুধু শোনা যাচ্ছিল রঘুর হাহাকার। করালনাথ তখন ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি টেনে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকার গলির ভেতরে।

পরদিন সকালেই রঘুর অবস্থা গুরুতর হলো। গ্রামের চিকিৎসক কিংবা ওঝা কেউই তার অসুখের কারণ খুঁজে পেল না—শরীরে কোনো ক্ষত নেই, তবু অদ্ভুত জ্বালা তাকে পাগলের মতো করে তুলেছে। তার স্ত্রী আর সন্তানরা কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে উঠল, আর গ্রামের মানুষজন ভয়ে মুখে কুলুপ আঁটল। সবার চোখে তখন একটাই প্রশ্ন—করালনাথের এই অভিশাপ থেকে কি মুক্তি পাওয়া সম্ভব? মন্দিরের রক্তের দাগও তখনও শুকিয়ে গিয়ে ইটের গায়ে কালচে ছোপ ফেলে রেখেছে, যেন গ্রামের মাটিতে আতঙ্কের চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। লোকেরা আলোচনায় ফিসফিস করে বলছিল, “এবার সত্যিই অশুভ শক্তি গ্রামটাকে ঘিরে ফেলেছে।” সন্ধ্যা নামতেই বাড়িঘরের দরজা আগেভাগেই বন্ধ হতে শুরু করল, শিশুদের খেলা থেমে গেল, মাঠে আর কেউ থাকল না। হঠাৎ করে যেন অদৃশ্য ছায়ার একটা ভারী পর্দা গ্রামটাকে ঢেকে ফেলল। বাতাসে একটা চাপা গুমোট গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল, আর প্রত্যেকেই অনুভব করছিল—এ গ্রামে শান্তি ভেঙে গেছে, এখন শুধু ভয় আর অজানা অশুভ শক্তির প্রতাপ।

করালনাথের কণ্ঠ যেন বজ্রপাতের মতো গর্জে উঠল সভামঞ্চে বসা সবার ওপর, যখন সে বলল—“গ্রামকে রক্ষা করতে হলে দেবীর পূজার জন্য এক তরুণী চাই। সেই তরুণীকে অর্ঘ্য না দিলে দোষে দগ্ধ হবে এই গ্রাম।” কথাটা বলা মাত্রই হুহু করে উঠল গঞ্জনাভরা ফিসফিসানি। মাঠের মাঝখানে দাঁড়ানো গ্রামপ্রধান অজয় চৌধুরীর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল; তার হাতের লাঠি কাঁপতে লাগল। সে কাঁপা গলায় প্রতিবাদ করল, “এ কি কথা? মানুষের প্রাণকে বলি দিয়ে কোনো দেবী প্রসন্ন হন না। আমরা তো দেবতার ভক্ত, পিশাচের নয়!” কিন্তু তার প্রতিবাদের গলায় ভয়ের কাঁপুনি স্পষ্ট ছিল। মেঘাচ্ছন্ন আকাশের নিচে, বাতাসে কেমন একটা অস্বস্তির ভার জমে উঠছিল, আর করালনাথের জ্বলন্ত চোখ সবার ভেতরে প্রবেশ করে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছিল। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ানো মানুষগুলো একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল, যেন তারা নিজেদের মনের গভীরে লুকানো ভয়টা ঢাকতে চাইছিল। একজন বয়স্ক মহিলা ফিসফিস করে বলল, “যদি না দিই, তবে গ্রাম জুড়ে কালো রোগ নামবে, সন্তান মারা যাবে।” আরেকজন যুবক চাপা গলায় বলল, “তান্ত্রিকের ক্ষমতার কথা শোননি? ও যা বলে, সত্যি হয়ে যায়।” এইসব ভীতির মাঝেই করালনাথ শীতল কণ্ঠে ঘোষণা করল, “আজ রাতের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তরুণীকে চাই, নাহলে কাল সকালেই দুর্ভোগ শুরু হবে।” যেন অন্ধকারকে আরও গভীর করে তুলল তার প্রতিটি শব্দ।

গ্রামপ্রধান অজয় চৌধুরী বুকের ভেতরে ক্রোধ আর ভয়ের দ্বন্দ্ব বয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সে জানত, করালনাথের শর্ত মানলে মানবিকতার অপমান হবে, আবার প্রতিবাদ করলে গ্রামের মানুষই তার বিরুদ্ধে যাবে। এদিকে ভিড়ের ভেতরে ফিসফাস ক্রমশ দানা বাঁধছিল। কে সেই তরুণী হবে? হঠাৎই সবার চোখ ঘুরে গেল বিধবা কাদম্বরীর দিকে। কালো শাড়ি গায়ে, অনুজ্জ্বল চোখে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা কাদম্বরী যেন এক অদৃশ্য আঘাতে থরথর করে কেঁপে উঠল। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকেই গ্রামে তার ঠাঁই তেমন নেই; সমাজ তাকে সর্বদা অবহেলা করেছে। আজ সেই দুর্বলতাকেই হাতিয়ার করে তুলল মানুষ। কাদম্বরীর শরীরের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল, সে বুঝতে পারছিল—তার দিকে গ্রামবাসীর দৃষ্টি কেমনভাবে গেঁথে বসছে। একজন বলল, “ও তো একা, ওকে দিলেই কারো ক্ষতি হবে না।” আরেকজন যোগ করল, “ওর জীবনে কী-ই বা আছে? গ্রামের সবার বাঁচার জন্য একজনের প্রাণ যাক না।” কথাগুলো শুনে অজয় চৌধুরীর রক্ত গরম হয়ে উঠল। সে গর্জে উঠল, “চুপ করো! এইভাবে কারো দিকে আঙুল তুলতে নেই। কাদম্বরীও মানুষ, তারও বাঁচার অধিকার আছে।” কিন্তু তার কণ্ঠে যে দুর্বলতা লুকানো ছিল, তা গ্রামের সবাই বুঝে ফেলল। করালনাথ দূর থেকে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি টানল, তার চোখের দৃষ্টি যেন কাদম্বরীকে শিকার ভেবে স্থির হয়ে রইল।

কাদম্বরী এদিকে নিজের বুকের ভেতরে ঝড় সামলাতে চেষ্টা করছিল। সমাজের তাচ্ছিল্য, অপমান, একাকীত্ব—সবকিছু যেন আজ নতুন করে তার বুকে আঘাত হানছিল। সে চিৎকার করে বলতে চাইছিল, “আমিও বাঁচতে চাই, আমিও তো তোমাদেরই মতো একজন মানুষ।” কিন্তু ঠোঁট থেকে শব্দ বেরোল না, শুধু বুক ভরে নিঃশ্বাস উঠছিল। হঠাৎ করেই সে অনুভব করল—গ্রামের অন্ধকার তাকে গ্রাস করতে আসছে। করালনাথের চোখের ভয়ঙ্কর আলো, গ্রামবাসীর নির্মম দৃষ্টি, আর নিজের অসহায় অবস্থার মিশ্রণে কাদম্বরীর মনে হচ্ছিল—সে যেন মাটির নিচে ধসে যাচ্ছে। চারপাশের লোকেরা ফিসফিস করতে করতে এক অদ্ভুত সমঝোতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল; তারা ভাবছিল, একজন বিধবার প্রাণ গেলে যদি গ্রাম বাঁচে, তবে ক্ষতি কী? এই ভয় আর স্বার্থপরতার মিলিত রূপই যেন গ্রামটিকে আরও নিষ্ঠুর করে তুলল। অজয় চৌধুরী আবার গর্জে উঠল, “আমি থাকতে কোনো মেয়েকে বলি দেওয়া হবে না। তোমরা যদি মানুষ হও, তবে মনে রেখো—অন্যের প্রাণ দিয়ে নিজের ভয় মেটানো কাপুরুষতা!” তার কণ্ঠে শেষ পর্যন্ত সাহসের ঝলক দেখা গেল, যদিও সে জানত করালনাথ চুপ করে থাকবে না। করালনাথ ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে শীতল হেসে বলল, “গ্রামপ্রধান, কথায় কিছু হয় না। কাল ভোরের আগে যদি তরুণী না পাই, তবে তোমাদের ভাগ্য অন্ধকার ছাড়া কিছু নয়।” আকাশে হঠাৎ একঝলক বিদ্যুৎ খেলে গেল, আর গ্রামের বুক ভরে উঠল আরও তীব্র ভয়ের আঁধারে।

আষাঢ়ের অমাবস্যার রাত যেন এক অদ্ভুত কালো পর্দায় গ্রামটিকে ঢেকে ফেলল। আকাশের বুক চিরে বিদ্যুতের ঝলকানি, তারপরই কানে কাঁপিয়ে দেওয়া বজ্রধ্বনি—এমন এক ভয়ঙ্কর পরিবেশ, যেখানে মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস পর্যন্ত আতঙ্কে ভারী হয়ে যাচ্ছিল। ঝড়ের দমকা হাওয়ায় গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ছিল, কুকুররা অকারণেই হাহাকার করছিল, আর আকাশের মেঘ গর্জন করছিল অজানা ক্রোধে। এই ভয়াবহ আবহের মাঝেই করালনাথ কালো চাদরে ঢেকে কাদম্বরীকে টেনে নিয়ে চলল শ্মশানঘাটের দিকে। গ্রামের লোকেরা নিজেদের ঘরে দরজা জানালা বন্ধ করে আতঙ্কে গুটিয়ে বসে রইল, বাইরে বেরোনোর সাহস কারও ছিল না। কিন্তু খেপা পল্টু আর কয়েকজন সাহসী যুবক অন্ধকারের ভেতরে নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করছিল। তাদের বুক ধড়ফড় করছিল, তবু মনে হচ্ছিল—আজ যদি সত্য না জানা যায়, তবে গ্রামটা চিরকালের মতো অভিশপ্ত হয়ে যাবে। পল্টুর চোখে দেখা পড়ল, করালনাথ শ্মশানের মাটিতে রক্ত দিয়ে আবারও জটিল চক্র আঁকছে, চারপাশে কাক ডাকছে কর্কশ সুরে, আর ভাঙা চিতার ছাইয়ে হাওয়া যেন ভৌতিক সুর তুলছে। কাদম্বরী কাঁপতে কাঁপতে হাত জোড় করল, তার চোখ ভিজে উঠল আতঙ্ক আর অসহায়তায়, কিন্তু তান্ত্রিক তাকে আরও শক্ত করে ধরে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করল।

পল্টু আর তার সঙ্গীরা দূর থেকে দৃশ্যটা দেখছিল, তাদের গা শিউরে উঠছিল প্রত্যেক মুহূর্তে। করালনাথের গলার মন্ত্রোচ্চারণ ধীরে ধীরে বজ্রধ্বনির সাথে মিলেমিশে এক অদ্ভুত গর্জনে পরিণত হচ্ছিল। তার কণ্ঠে যেন মানবীয় কিছুই অবশিষ্ট ছিল না, বরং তা কোনো অশুভ শক্তির আহ্বান। হঠাৎ বজ্রপাতের আলোয় দেখা গেল—চক্রের ভেতরে ছায়ার মতো কিছু নড়ে উঠছে। অন্ধকার থেকে ধোঁয়ার মতো আকার নিয়ে একেকটা ভয়ঙ্কর ছায়া উঁকি দিচ্ছে, আর করালনাথ হাত উঁচিয়ে তাদের আহ্বান জানাচ্ছে। তখনই পল্টুর মনের ভেতর স্পষ্ট হলো—করালনাথ আসলে গ্রামকে রক্ষা করছে না, বরং অশুভ শক্তিকেই শক্তিশালী করছে। এই মন্ত্রের মাধ্যমে সে ছায়াদের ডেকে আনছে, যারা গ্রামটিকে গ্রাস করবে। পল্টু নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না; এতদিন যাকে গ্রামের মুক্তিদাতা ভেবেছিল অনেকে, সে আসলে মৃত্যুর দূত। সাহসী যুবকেরা একে অপরের হাত শক্ত করে ধরল, তাদের মনে হচ্ছিল এখনই কিছু না করলে কাদম্বরী প্রাণ হারাবে, আর গোটা গ্রাম ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে এগোনোও সহজ নয়—চক্রের চারপাশে অদ্ভুত বাতাস বইছিল, যেন অদৃশ্য দেওয়াল তৈরি হয়েছে।

কাদম্বরী তখন আতঙ্কে অসহায় চোখে চারপাশে তাকাচ্ছিল, আর তার বুকের ভেতর থেকে নিঃশব্দে একটাই শব্দ বেরোচ্ছিল—“বাঁচাও।” হঠাৎ যেন ঝড় আরও প্রবল হলো, বজ্রপাতের আলোয় শ্মশান এক মুহূর্তের জন্য ভয়ঙ্কর রূপ নিল—ভাঙা চিতা, ছাই, আর করালনাথের দেহে এক অদ্ভুত ছায়ার আবরণ। কাদম্বরী বুঝতে পারল, যদি কেউ তাকে না বাঁচায়, তবে আজ রাতেই সে অশুভ শক্তির বলি হবে। ঠিক তখনই পল্টু আর তার সঙ্গীরা সাহস সঞ্চয় করে সামনে এগোল, চিৎকার করে উঠল, “থামো করালনাথ! আমরা জানি তুমি ভণ্ড! তুমি দেবতার নাম করে পিশাচদের ডেকে আনছো।” তাদের চিৎকার বজ্রের গর্জনের সাথে মিশে চারদিক কাঁপিয়ে দিল। করালনাথ চোখ তুলে তাকাতেই তার মুখে বিকৃত হাসি ফুটল, আর সে বলল, “দেরি হয়ে গেছে। আজ অশুভ শক্তি জন্ম নেবে, আর তোমাদের গ্রাম তার শিকার হবে।” মন্ত্রোচ্চারণ আরও তীব্র হলো, ছায়াগুলো ঘনীভূত হতে লাগল। কিন্তু সাহসী যুবকেরা পিছিয়ে গেল না। তারা জানত, এখনই যদি আক্রমণ না করে, তবে আর কোনোদিন গ্রামটাকে রক্ষা করা যাবে না। এক ঝড়ো রাতে, অমাবস্যার এই আঁধারে, মানুষ আর অশুভ শক্তির মধ্যে লড়াই শুরু হলো—যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল কেবল ভয়, মৃত্যু আর আশার শেষ আলো।

অমাবস্যার রাতের শেষ প্রহরেও আকাশের গর্জন থামেনি। ঝড়ের দমকা হাওয়ায় গাছগুলো ছিঁড়ে পড়ছিল, বজ্রের আলোর ঝলকানিতে শ্মশানঘাট বারবার ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছিল। করালনাথ তখনও রক্তমাখা চক্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, কাদম্বরীকে টেনে ধরে ভয়াল মন্ত্রপাঠ চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সেই ভয়াবহ মুহূর্তে গ্রামবাসী আর ঘরে বসে থাকল না। বহুদিনের আতঙ্ক আর সন্দেহ সেদিন একসাথে রূপ নিল প্রতিরোধে। হাতে বাঁশ, লাঠি, মশাল নিয়ে পুরুষেরা বেরিয়ে এল; মহিলারা ভয় সামলেও তাদের সাথে দাঁড়াল, আর শিশুরাও চিৎকারে সাহস জুগিয়ে দিল। সামনে দাঁড়াল মৃত্যুপথযাত্রী রঘু দাস—যে অভিশাপের কারণে দিন দিন ক্ষয় হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে তার ভেতর জমে থাকা সাহস জেগে উঠল। তার শরীর কাঁপছিল, চোখে জ্বালা, কিন্তু গলা ফাটিয়ে সে চ্যালেঞ্জ করল, “করালনাথ, তুই দেবতার ভক্ত সেজে পিশাচদের আহ্বান করেছিস। আজ গ্রামবাসী তোকে রুখবেই!” তার কণ্ঠ বজ্রধ্বনির সাথে মিশে উঠতেই জনতার হুঙ্কার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। করালনাথ এক মুহূর্তের জন্য থমকালেও হাসি চেপে রাখতে পারল না। ঠোঁটে ব্যঙ্গ টেনে বলল, “তোমাদের এই লাঠি, এই মশাল দিয়ে কি অশুভ ছায়া থামানো যায়?” কিন্তু তার কণ্ঠে সেই অটল দৃঢ়তা আর রইল না, কারণ মন্ত্রপাঠের শক্তি গ্রামবাসীর সমবেত চিৎকারে দুলতে শুরু করেছিল।

ঝড়ের মধ্যে বজ্রপাতের পর বজ্রপাত হচ্ছিল, আর প্রতিটি আলোয় দেখা যাচ্ছিল ছায়াগুলোর কেমন অস্থির হয়ে উঠছে। করালনাথ মরিয়া হয়ে মন্ত্র জপ চালিয়ে যাচ্ছিল, কাদম্বরীকে চক্রের ভেতরে টেনে রাখছিল, কিন্তু তখনই রঘু দাস মাটিতে ভেঙে পড়ে গিয়েও শেষ শক্তি দিয়ে এক মুঠো ভস্ম ছুঁড়ে দিল চক্রের ওপর। সঙ্গে সঙ্গেই ভয়াবহ বিস্ফোরণের মতো শব্দ হলো, চক্রের আঁকা দাগে আগুন ধরে গেল, শ্মশানঘাটের ছাই অগ্নিশিখায় জ্বলে উঠল। চারদিকের ছায়াগুলো বিকট শব্দে চিৎকার করে ধোঁয়ায় মিলিয়ে গেল। গ্রামের মানুষ হুঙ্কার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল, লাঠি আর মশালের আঘাতে বাতাসে ভয়ের দেয়াল ভেঙে গেল। কাদম্বরী ছিটকে বেরিয়ে এল চক্র থেকে, তার চোখে অশ্রু আর মুক্তির একসাথে ঝলক। করালনাথ ক্রুদ্ধ হয়ে হাত উঁচিয়ে চিৎকার করল, “তোমরা থামাতে পারবে না! আমি অমর! আমি ফিরে আসব!” কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে বজ্রপাত শ্মশানঘাটের মাঝখানে আছড়ে পড়ল। আগুন জ্বলে উঠল চারপাশে, যেন অন্ধকারকে গ্রাস করে নিচ্ছে। গ্রামবাসীরা ভয়ে ও বিস্ময়ে দেখল—আগুনের ভেতরে করালনাথের দেহ ঢাকা পড়ছে, আর তার কালো চাদর ছাইয়ের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে ঝড়ো হাওয়ায়। মন্ত্রভঙ্গ হওয়ার সাথে সাথে চারপাশের বাতাস হঠাৎ হালকা হয়ে গেল, ঝড় যেন এক মুহূর্তে থেমে গেল, আর ভয়ঙ্কর আওয়াজগুলো মিলিয়ে গেল অদ্ভুত নীরবতায়।

ভোরের আলো ফুটতেই শ্মশানঘাটে ছড়িয়ে ছিল কেবল ছাই, ভাঙা চক্র আর জ্বলা কাঠের গন্ধ। কাদম্বরী মাটিতে বসে আকাশের দিকে তাকাল, তার চোখে বিস্ময়, বেঁচে থাকার স্বস্তি আর শূন্যতা একসাথে ভেসে উঠল। গ্রামের মানুষ তাকে ঘিরে দাঁড়াল, কেউ কাঁদছিল, কেউ চিৎকার করে বলছিল, “অশুভ শেষ! গ্রাম বাঁচল!” কিন্তু অজয় চৌধুরীর চোখে দেখা গেল উদ্বেগের ছায়া। সে ধীরে বলল, “শেষ হলো তো? নাকি সে আবার ফিরে আসবে?” সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল, কারণ করালনাথের দেহ কেউ খুঁজে পেল না। শুধু আগুনে পোড়া ছাই, আর চারপাশে ছড়ানো এক রহস্যময় নীরবতা। রঘু দাসের নিথর দেহ পড়ে রইল শ্মশানের পাশে, সে নিজের শেষ শক্তি দিয়ে গ্রামকে রক্ষা করেছে। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মানুষ কাঁদল, কিন্তু তাদের বুকের গভীরে প্রশ্নটা থেকে গেল—করালনাথ কি সত্যিই মারা গেল, নাকি আগুনের ধোঁয়া মিশে তাকে অন্য কোনো গ্রামে নিয়ে গেল? বাতাসে যেন ফিসফিস করে সেই প্রশ্ন ভেসে উঠল। “কালো আষাঢ়ের রাত শেষ হলো, কিন্তু অন্ধকার কি সত্যিই শেষ হলো?” গ্রামের মানুষের মনে এক অদৃশ্য ছায়া রয়ে গেল—যেন তারা জানত, একদিন কোথাও আবার সেই রহস্যময় তান্ত্রিক অশুভ শক্তি ডেকে আনবে, আর তখন আবার কোনো গ্রাম তার ভয়ে কাঁপবে। কালো আষাঢ়ের রাত শেষ হলো, কিন্তু তার গল্পের ছায়া রয়ে গেল যুগযুগ ধরে।

1000056231.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *