Bangla - তন্ত্র

কালো আকাশে রক্তচন্দ্র

Spread the love

কল্যাণ মুখার্জী


শ্মশান ঘাটে সেই রাতে যেন অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল। চারিদিকে ঘন কুয়াশার চাদর, দূরে শ্মশানের পুরনো বটগাছের ডালে ডালে বাদুড়ের কর্কশ ডাক, আর মাঝেমধ্যেই কুকুরের হাহাকার যেন ভয়কে আরও ঘনীভূত করে তুলছিল। অমাবস্যার ঘন অন্ধকার নয়, তবু পূর্ণিমার আলোয় চারদিক সাদা হয়ে উঠলেও সেই আলোতে ছিল এক অস্বাভাবিক রক্তাভ আভা। যেন চাঁদ নিজেও এই রাতের সাক্ষী হতে গিয়ে অচেনা কোনো রূপ ধারণ করেছে। গ্রামের মানুষজন শ্মশানের সীমানা থেকে দূরে, পুকুরপাড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে আতঙ্কে তাকিয়ে ছিল। কারও চোখে ভীতি, কারও চোখে কৌতূহল, কিন্তু সবার মনে একই প্রশ্ন—আজ রাতেই কি ভৈরবনাথ তাঁর বহুদিনের সাধনার সফলতা অর্জন করতে চলেছে? সেই ভৈরবনাথ, যাকে একসময় নিছক এক ঘুরে বেড়ানো তান্ত্রিক মনে করা হতো, আজ তাঁর চারপাশে অশুভ এক আবহ তৈরি হয়েছে।

অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে শুকনো কাঠ সাজানো, তার উপরে গুঁড়ো চন্দন, নীলকণ্ঠ পাথর আর ভেষজ ধূপকাঠি ছড়িয়ে রাখা হয়েছে। বাতাসে ধূপের ঘন গন্ধ, যার সঙ্গে মিশে আছে পোড়া কাঠের ধোঁয়া। ভৈরবনাথ ধীরে ধীরে বসে পড়লেন কুণ্ডের সামনে। তাঁর গায়ের কালো অঙ্গরাখা চারপাশের অন্ধকারে মিশে গেল, কপালে জ্বলে উঠল রক্তচন্দনের টিপ। গলায় বিশাল রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে লাল কাপড়ে বাঁধা ত্রিশূল। তাঁর মুখে কোনো কথা নেই, কিন্তু চোখ দুটো অগ্নিদীপ্ত—যেন তিনি এই মুহূর্তে পৃথিবীর সব আলো নিজের মধ্যে টেনে নিতে পারেন। গ্রামের বৃদ্ধারা ফিসফিস করে বলছিল—“আজ যে পূর্ণিমা, তার সঙ্গে যদি আবার রক্তচন্দ্র ওঠে, তবে অশুভ শক্তি জেগে উঠবেই।” কথাটা ভয়ের সঙ্গে মিশে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। শিশুরা আঁকড়ে ধরেছিল মায়েদের আঁচল, আর পুরুষরা দ্বিধায় কাঁপছিল—কেউ ভৈরবনাথকে থামাতে চায়, আবার কেউ ভেবেছিল, হয়তো সে সত্যিই ঈশ্বরীয় শক্তির অধিকারী হয়ে উঠতে চলেছে।

হঠাৎ করেই ভৈরবনাথ মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন। গম্ভীর, কর্কশ অথচ অদ্ভুতভাবে সুরেলা সেই মন্ত্রধ্বনি শ্মশানের প্রতিটি কোণায় প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। চারিদিকে যেন পাখির ডাক থেমে গেল, বাতাস থমকে দাঁড়াল। আগুন ধীরে ধীরে জ্বলে উঠতে লাগল, প্রথমে ক্ষীণ শিখা, পরে তীব্র লেলিহান জ্বালা। সেই আলোয় ভৈরবনাথের মুখ ভৌতিকভাবে ফুটে উঠল—কখনও তার চোখ জ্বলন্ত কয়লার মতো লাল, কখনও আবার মুখে ছায়ার ছোপ। মানুষজন ভয়ে আরও দূরে সরে গেল, কিন্তু চোখ সরাতে পারল না। এক বৃদ্ধা নিজের কপালে চড় মারতে মারতে কাঁদছিল—“এ কি করছিস ভৈরবনাথ, আমাদের সর্বনাশ করে দিবি না তো?” কিন্তু তাঁর কান আর কোনো মানবকণ্ঠ শুনতে পাচ্ছিল না। তাঁর মন, প্রাণ, দেহ—সব মিশে যাচ্ছিল সেই মন্ত্রোচ্চারণের স্রোতে।

চাঁদ ধীরে ধীরে আকাশের মাঝ বরাবর উঠে এল। তখনই গ্রামের মানুষজন বুঝতে পারল, এই পূর্ণিমা আর সাধারণ পূর্ণিমা নয়। চাঁদের সাদা আভা হঠাৎই রক্তাভ হতে শুরু করেছে, যেন কারও অদৃশ্য হাত তাকে লাল রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে। সেই আলো ছড়িয়ে পড়তে লাগল শ্মশানের চারপাশে, শীতল সাদা আলো বদলে গেল রক্তিম তাপে। গাছপালার ছায়া দীর্ঘ হয়ে কাঁপতে লাগল, যেন ভূতুড়ে নাচ শুরু হয়েছে। ভৈরবনাথ হঠাৎ হাত উঁচিয়ে এক অদ্ভুত ধ্বনি উচ্চারণ করলেন—সেই ধ্বনি মানুষের নয়, পাখির নয়, বরং মাটির নিচ থেকে ওঠা কোনো অশুভ গর্জন। গ্রামের মানুষের বুক কেঁপে উঠল, কারও কারও হাত থেকে প্রদীপ পড়ে গেল। বাতাস ভারী হয়ে উঠল, আর মনে হলো—আজ রাতের এই আগমনী কেবল এক তান্ত্রিকের সাধনার সূচনা নয়, বরং এক অভিশপ্ত শক্তির জন্মলগ্ন।

অগ্নিকুণ্ডের আগুন আস্তে আস্তে লেলিহান হয়ে উঠছিল। কাঠের টুকরো, শুকনো পাতা, আর ভেষজের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। ভৈরবনাথ চোখ বন্ধ করে গভীর ধ্যানে ডুবে গেলেন, ঠোঁটে মন্ত্র, বুকের ভেতর শ্বাসপ্রশ্বাসে অদ্ভুত ছন্দ। তাঁর কণ্ঠের মন্ত্রোচ্চারণ কখনও গম্ভীর, কখনও কর্কশ, আবার কখনও যেন সঙ্গীতের মতো বয়ে চলছিল। শ্মশানের প্রতিটি কোণে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল সেই অদ্ভুত ধ্বনি, যেন মৃত আত্মারাও শোনার জন্য উঠে এসেছে। রাত তখন ক্রমে গভীর হচ্ছে, কুকুরের ডাক থেমে গেছে, বাদুড়ও যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। শুধু আগুনের শিখা আর ভৈরবনাথের মন্ত্র মিলেমিশে এক ভয়ঙ্কর আবহ তৈরি করছিল। তাঁর চোখ হঠাৎ খুলল, আর সেই চোখে তখন জ্বলছিল অদ্ভুত আগুনের প্রতিফলন। গ্রামের দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো আতঙ্কে কেঁপে উঠল—এ কি মানুষ, নাকি কোনো অশুভ সত্তা?

মন্ত্রোচ্চারণ ক্রমশ জোরালো হতে থাকল। ভৈরবনাথ কখনও হাত আকাশের দিকে তুলছেন, কখনও আবার কুণ্ডের ভেতর তিল আর ঘি ছুঁড়ে দিচ্ছেন। প্রতিটি ছোঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে আগুন আরও জ্বলে উঠছিল, যেন আগুন নিজেই ক্ষুধার্ত হয়ে উঠেছে। বাতাস হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে এল, অথচ আগুন থেকে ভেসে আসছিল প্রচণ্ড তাপ। চারপাশে যেন এক অদৃশ্য চাপা শব্দ শোনা যাচ্ছিল, ঠিক বজ্রপাত হওয়ার আগে আকাশ যেমন গর্জে ওঠে, সেই রকম। শ্মশানের বটগাছের ডাল কেঁপে উঠল, পাখিরা আতঙ্কে উড়ে গেল, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল সবকিছু। ভৈরবনাথের কণ্ঠ আরও কর্কশ, আরও গম্ভীর হয়ে উঠল। মনে হচ্ছিল, সে কেবল মানুষ নয়, কোনো অচেনা শক্তির বাহক হয়ে গেছে। গ্রামের এক বৃদ্ধ কাঁপতে কাঁপতে বলল, “এই মন্ত্র আমি চিনি না… এটা কোনো শুভ মন্ত্র নয়।” কিন্তু ততক্ষণে সবাই যেন ভয়ের শিকলে বাঁধা পড়ে গেছে।

আকাশে তখন চাঁদ উঠেছে সর্বোচ্চ শিখরে। পূর্ণিমার সাদা রূপালী আভা হঠাৎই বদলে যেতে শুরু করল। প্রথমে ম্লান হল, তারপর লালচে হল, আর মুহূর্তের মধ্যে সেই চাঁদ রক্তাভ আলোয় জ্বলে উঠল। আকাশ যেন লাল আগুনে ভরে উঠেছে। গ্রামের মানুষ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল—রক্তচন্দ্র! কারও মুখ থেকে আতঙ্কে বেরোল চাপা চিৎকার, কারও ঠোঁট নিঃশব্দে কেঁপে উঠল। কেউ কপালে হাত ঠেকিয়ে নাম নিচু করল, কেউ আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “এটা সর্বনাশের সংকেত।” শ্মশানের অন্ধকার আলোয় রক্তচন্দ্রের আভা ছড়িয়ে পড়ল, প্রতিটি ছায়া হয়ে উঠল লম্বা, বিকৃত আর ভৌতিক। ভৈরবনাথ সেই আভায় আরও উন্মত্ত হয়ে উঠলেন, তাঁর মুখে অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল। তিনি বুঝলেন, আজ তাঁর সাধনা সফল হয়েছে—কিন্তু অজান্তেই তিনি এমন এক শক্তিকে জাগিয়ে তুলেছেন, যেটা মানুষের নিয়ন্ত্রণে আনা অসম্ভব।

অগ্নিকুণ্ড থেকে তখন ধোঁয়া উঠতে শুরু করেছে, কিন্তু সেই ধোঁয়া আর সাধারণ ধোঁয়া নয়। ধীরে ধীরে তা কালো ছায়ার মতো আকার নিচ্ছে। প্রথমে আকারটা অস্পষ্ট, কিন্তু মুহূর্তে তাতে ফুটে উঠল লাল জ্বলন্ত দুটি চোখ। সেই চোখ থেকে ভেসে এল হাহাকার, যেন বহু শতাব্দী ঘুমিয়ে থাকা কোনো সত্তা হঠাৎ জেগে উঠেছে। গ্রামের মানুষ আতঙ্কে পিছিয়ে গেল, কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়ল। ভৈরবনাথ দাঁড়িয়ে রইলেন সেই আগুনের সামনে, তাঁর ঠোঁট থেকে এখনও মন্ত্র বেরোচ্ছে, কিন্তু তাঁর চোখে তখন ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। তিনি বুঝতে পারলেন, যে শক্তিকে তিনি আহ্বান করেছেন, তা আর তাঁর আয়ত্তে নেই। বাতাস ভারী হয়ে উঠল, মাটিতে শীতল কম্পন বয়ে গেল, আর রক্তচন্দ্রের আলোয় পুরো শ্মশান যেন এক অভিশপ্ত ভূমিতে পরিণত হল। এইভাবেই সেই রাতের অগ্নিসাধনা কেবল এক তান্ত্রিকের সফলতার মুহূর্ত নয়, বরং এক ভয়ঙ্কর অভিশাপের সূচনা হয়ে উঠল।

অগ্নিকুণ্ডের ভেতর থেকে উঠতে থাকা ধোঁয়া যেন আর সাধারণ ধোঁয়া নয়, বরং এক অদ্ভুত জীবন্ত সত্তায় পরিণত হচ্ছিল। প্রথমে ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাক খেয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে সেই কুণ্ডলী একত্রিত হয়ে এক ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করতে লাগল। শ্মশানের বাতাস হঠাৎ এত ভারী হয়ে উঠল যে গ্রামের মানুষজন নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না। কেউ কপালে হাত ঠেকিয়ে মন্ত্র জপতে লাগল, কেউ আবার আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ধোঁয়ার ভেতর থেকে হাহাকার মিশ্রিত এক শব্দ ভেসে এল, যা মানুষের গলার আওয়াজ নয়—বরং মৃতের আত্মা যেন শূন্যে কেঁদে উঠেছে। ভৈরবনাথ প্রথমে হাত উঁচিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ চালিয়ে যেতে লাগলেন, মনে করলেন শক্তিকে বশে আনা যাবে। কিন্তু ধোঁয়ার আকার যখন আস্তে আস্তে মানুষের উচ্চতার থেকেও উঁচু হতে শুরু করল, তখন তাঁর হাত কেঁপে উঠল। অগ্নিকুণ্ডের চারদিকে ছড়িয়ে পড়া ছায়া যেন তাঁকে ঘিরে ধরতে চাইছিল।

ধোঁয়ার সেই অদ্ভুত সত্তা মুহূর্তে রূপ বদলাতে লাগল। কখনও মনে হচ্ছিল সে এক কালো ঘূর্ণিঝড়, আবার কখনও যেন আগুনের আভা মিশে গিয়ে ভয়াবহ দানবীয় রূপ নিচ্ছে। আর তখনই দেখা গেল—অন্ধকার ছায়ার ভেতরে জ্বলছে দুটি লালচে চোখ, ঠিক যেন রক্তে ভরা। সেই চোখে তাকানো মাত্রই মনে হচ্ছিল, এক অদৃশ্য শক্তি বুকের ভেতর থেকে প্রাণ শুষে নিচ্ছে। গ্রামের মানুষ ভয়ে চিৎকার করে উঠল, কেউ কেউ দৌড়ে পালিয়ে গেল, কিন্তু তবুও বেশ কয়েকজন ভয়ে জমে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বাতাসে অদ্ভুত গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল—যেন পোড়া মাংস আর গলিত রক্তের দুর্গন্ধ। শ্মশানের আশেপাশের শ্মশানবৃক্ষ কাঁপতে লাগল, পাতা ঝরে পড়ল, আর বটগাছের শেকড় মাটির উপর উঠে এল। ভৈরবনাথ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন। এত বছর ধরে সাধনা করে তিনি এই মুহূর্তের অপেক্ষা করেছিলেন, কিন্তু তিনি বুঝতেই পারেননি শক্তি একবার জাগ্রত হলে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

ছায়ামূর্তির রক্তচোখ ভৈরবনাথের দিকে স্থির হয়ে গেল। সে মুহূর্তে ভৈরবনাথের মনে হল তাঁর বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে যাচ্ছে। মন্ত্রোচ্চারণের গলা থেমে গেল, ঠোঁট কাঁপতে লাগল। হঠাৎ এক প্রচণ্ড বাতাসের ঝাপটা এসে তাঁকে প্রায় ফেলে দিল। আগুনের শিখা উল্টোদিকে দুলতে লাগল, ধোঁয়া ছড়িয়ে ছড়িয়ে অদ্ভুত আকার নিতে লাগল। মনে হচ্ছিল সেই ছায়া তাঁকে নিজের মধ্যে টেনে নিতে চাইছে। ভৈরবনাথ মরিয়া হয়ে আবার মন্ত্র পড়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাঁর গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। চোখে আতঙ্ক স্পষ্ট হয়ে উঠল। তিনি বুঝলেন, নিজের লোভে তিনি এমন এক শক্তিকে জাগিয়েছেন যার অস্তিত্ব মানুষের বোধগম্যতার বাইরে। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামের মানুষজনও বুঝতে পারল, এখন আর এই তান্ত্রিকের কোনো ক্ষমতা নেই। ছায়ামূর্তিই এখন নিয়ন্ত্রক, আর ভৈরবনাথ হয়ে গেছে তার প্রথম শিকার।

এক ঝটকায় ছায়ামূর্তি আকাশের দিকে উঠে আবার নেমে এল, তার চোখদুটি লাল আগুনের মতো জ্বলতে লাগল। মাটিতে কম্পন শুরু হল, চারপাশের বাতাসে অদ্ভুত হাহাকার বয়ে গেল। মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ল, কেউ কান ঢাকল, কেউ ছুটে পালাতে চাইলো, কিন্তু কোথাও আশ্রয় নেই। ভৈরবনাথ আতঙ্কে পিছিয়ে গেলেন, কিন্তু তাঁর পায়ের নিচে মাটি যেন আটকে দিল তাঁকে। মনে হচ্ছিল অদৃশ্য কোনো শক্তি তাঁকে ছায়ামূর্তির দিকে টেনে নিচ্ছে। তাঁর চোখ ভিজে উঠল আতঙ্কে, ঠোঁট থেকে নিরর্থকভাবে বেরোলো মন্ত্রের টুকরো। কিন্তু তখনই তিনি বুঝলেন, সব শেষ। যে শক্তির অধিকারী হতে তিনি জীবন কাটিয়েছেন, সেই শক্তি এখন তাঁকে গ্রাস করতে উদ্যত। রক্তচন্দ্রের লাল আলোয় শ্মশান ভেসে উঠল এক অদ্ভুত নরকীয় রূপে, আর গ্রামের মানুষজন সেদিন প্রথম দেখল—কোনো সাধক যখন অজ্ঞান লোভে অভিশপ্ত শক্তিকে আহ্বান করে, তখন প্রকৃতি নিজেই তাকে শাস্তি দেয়।

সকাল হলেও গ্রামের পরিবেশে কোনো আলো বা উচ্ছ্বাস ছিল না। সূর্য উঠেছে ঠিকই, কিন্তু তার আলো যেন কুয়াশার মোটা আস্তরণের মধ্যে আটকে গেছে। ভোরবেলার পাখিদের ডাক আজ শোনা গেল না, কেবল হঠাৎ হঠাৎ অকারণে কাকের অশুভ ডাক ভেসে আসছিল। গ্রামের মানুষের চোখ লালচে, কারও মুখ ফ্যাকাশে। অনেকেই সারা রাত ঘুমোতে পারেনি, কারণ শ্মশান থেকে আসা আগুন আর ধোঁয়ার দৃশ্য তাদের মনে গভীর ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। সকালবেলায় গৃহস্থরা যখন গোয়ালঘরে গেল, তখন দেখা গেল তিনটি গরু একসঙ্গে মৃত হয়ে পড়ে আছে—না কোনো আঘাত, না কোনো অসুখের চিহ্ন। কারও গলা থেকে শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বেরোল, “এটা অশুভ শক্তির কাজ।” আবার কেউ বলে উঠল, “ভৈরবনাথের সাধনা গ্রামকে অভিশপ্ত করে দিয়েছে।” এই মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তে না পড়তেই গ্রামের এক প্রান্ত থেকে আবার কান্নার শব্দ ভেসে এল—সেখানেও দুটি ছাগল হঠাৎ পড়ে গিয়ে মারা গেছে। মানুষ ভয়ে ছুটোছুটি শুরু করল, সবাই একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে শুধু আতঙ্ক পড়তে লাগল।

মানুষের শরীরেও অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা দিতে লাগল। গ্রামের কয়েকজন যুবক হঠাৎ প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ে গেল, কিন্তু তাদের শরীরে কোনো রোগের ছাপ নেই। কারও চোখে হঠাৎ রক্তলাল আভা জেগে উঠছে, আবার কারও ঠোঁট থেকে অচেনা শব্দ বেরোচ্ছে, যা তাদের নিজেদের ভাষা নয়। মায়েরা আতঙ্কে সন্তানদের আঁকড়ে ধরল, পুরুষেরা ভয়ে ঘরে তালা লাগিয়ে বসে রইল, কিন্তু কেউ জানে না—এ ভয়ের থেকে লুকিয়ে থাকার জায়গা কোথায়। সকালে হাট বসার কথা ছিল, কিন্তু আজ একটিও দোকান খোলেনি। চায়ের দোকানের ভেতরে টালির চাল থেকে ঝরে পড়ছে অদ্ভুত কালচে ছোপ, যেন রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। মানুষজন মাথা নিচু করে ফিসফিস করতে লাগল, “রক্তচন্দ্র উঠেছিল রাতে… তার পরই এই অভিশাপ।” ভয়ের স্রোত এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছিল যে কারও মুখে স্বাভাবিক কথা শোনা যাচ্ছিল না, সবার চোখে শুধু আতঙ্ক আর সন্দেহ।

ঠিক তখনই গ্রামের প্রাচীন শিবমন্দিরের ঘন্টা বাজল। পুরোহিত রঘুনন্দন মহন্ত ধীরে ধীরে মন্দির থেকে বেরিয়ে এলেন। বয়স হয়েছে, সাদা দাড়ি বুকে নেমে এসেছে, কপালে ভস্মের টিপ, হাতে ত্রিশূল-চিহ্নিত লাঠি। গ্রামবাসীরা তাঁর দিকে ছুটে গেল—কেউ কাঁদছে, কেউ হাত জোড় করছে, কেউ আবার ভয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রঘুনন্দন সবার মুখের দিকে তাকালেন, তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “আমি জানতাম এই রাত আসবে। রক্তচন্দ্র যখন ওঠে, তখন অশুভ শক্তি ঘুম থেকে জেগে ওঠে। ভৈরবনাথের লোভই আমাদের এ বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে।” তাঁর চোখে যেন গভীর দুঃখের ছাপ ফুটে উঠল। তিনি ব্যাখ্যা করলেন, শাস্ত্রে লেখা আছে—শ্মশান যখন পূর্ণিমার রাতে জাগ্রত হয়, তখন অগ্নিসাধনা যদি কলুষিত মনে করা হয়, তবে তা অশুভ শক্তিকে ডেকে আনে। গ্রামের মানুষ আতঙ্কে একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল, “তাহলে এখন আমাদের কী হবে?” পুরোহিত নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “এখন লড়াই ছাড়া আর কোনো পথ নেই। আমাদের বিশ্বাস, প্রার্থনা আর সাহসই কেবল এই অশুভ শক্তির মোকাবিলা করতে পারবে।”

কিন্তু মানুষের মনে ভয় এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে কেউ সামনে আসতে চাইছিল না। কেউ বলল, “আমরা তো সাধারণ মানুষ, এ দানবীয় শক্তির সঙ্গে কীভাবে লড়ব?” আবার কেউ কাঁদতে কাঁদতে বলল, “শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে, আমরা কি সবাই শেষ হয়ে যাব?” এইসব কান্নার মধ্যেই রঘুনন্দন কণ্ঠ দৃঢ় করলেন, “যদি আমরা এক না হই, তবে এই গ্রাম ধ্বংস হবেই। এখন সময় এসেছে নিজেদের ভয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর।” তাঁর চোখে দৃঢ় বিশ্বাস জ্বলছিল। তবে ভেতরে ভেতরে তিনিও জানতেন, পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। রাতে যে ছায়ামূর্তি জন্ম নিয়েছিল, তা কেবল একটি অশুভ উপস্থিতি নয়—এটি ধ্বংসের দূত। আর তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে শুধু বিশ্বাস নয়, ত্যাগও প্রয়োজন হবে। গ্রামের মানুষ তখনও বিভ্রান্ত ও ভীত, কিন্তু তাদের মনে প্রথমবারের মতো এক ঝলক আশার আলো জেগে উঠল—যদি রঘুনন্দন সত্যিই পথ দেখাতে পারেন, তবে হয়তো অভিশাপ থেকে মুক্তির আশা এখনও আছে।

সেদিন রাতটিও ছিল ভয়ার্ত নিস্তব্ধতায় ভরা। রক্তচন্দ্র মিলিয়ে গেলেও তার ছাপ যেন গ্রামজুড়ে রয়ে গিয়েছে। প্রতিটি গৃহস্থের ঘরে আলো জ্বলছিল, কিন্তু সেই আলোতে কোনো স্বস্তি ছিল না, বরং ভয়ের ছায়া যেন আরও ঘন হয়ে উঠেছিল। কমলা সেদিন ছেলেকে নিয়ে এক কোণে বসেছিল। তার একমাত্র সন্তানই তার জীবনের ভরসা, স্বামীকে বহু আগেই হারিয়েছে। সন্তানের কাঁধে মাথা রেখে সে বারবার ঈশ্বরকে ডাকছিল, “হে মহাদেব, অন্তত এই ছেলেটাকে তুমি রক্ষা কর।” কিন্তু রাত যত গভীর হচ্ছিল, ততই কমলার মন অশান্ত হয়ে উঠছিল। হঠাৎ সে খেয়াল করল—ছেলেটি আর তার পাশে নেই। প্রথমে মনে করল হয়তো পাশের ঘরে গেছে, কিন্তু চারিদিক খুঁজে কোথাও তাকে পাওয়া গেল না। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল, গলা শুকিয়ে গেল। কমলা ছুটে বেরিয়ে পড়ল অন্ধকারে, কাঁপা গলায় ডাকতে লাগল, “রে অমল! অমল, কোথায় গেলি রে?” তার ডাকে যেন শূন্যতা আরও ভারী হয়ে উঠছিল।

গ্রামের মানুষ তার আর্তনাদ শুনে ছুটে এল। হাতে মশাল নিয়ে সবাই আলাদা হয়ে খুঁজতে লাগল। কেউ পুকুরপাড়ে গেল, কেউ ধানের খেতে, কেউবা মন্দিরের আঙিনায়। কিন্তু কোথাও শিশুর কোনো হদিস নেই। মশালের আলোয় সবাইকে অস্থির মনে হচ্ছিল, যেন প্রতিটি ছায়া ভয়ঙ্কর কোনো সংকেত। কমলা ভয়ে ভেঙে পড়লেও খুঁজে বেড়ানো থামাল না। তার পায়ের চোটে রক্ত পড়ছিল, কিন্তু সে টেরও পাচ্ছিল না। গ্রামের মহিলারা তাকে সান্ত্বনা দিতে চাইছিল, কিন্তু সে কাঁদতে কাঁদতে শুধু বলছিল, “আমার অমলকে দাও, সে ছাড়া আমি বাঁচব না।” যখন সবাই হতাশ হয়ে পড়ছিল, তখন এক যুবক দৌড়ে এসে চিৎকার করল, “শ্মশানের দিক থেকে কিছু দেখা যাচ্ছে!” সবাই মুহূর্তে কেঁপে উঠল। শ্মশানের নাম উচ্চারণ হলেই ভয় ছড়িয়ে পড়ছিল এখন। তবুও কিছু সাহসী মানুষ এগিয়ে গেল। কমলাও তাদের সঙ্গে দৌড়ে চলল, কারণ মাতৃত্ব তাকে ভয় ভুলিয়ে দিয়েছে।

শ্মশানের কাছে গিয়ে সবাই থমকে দাঁড়াল। আগের রাতের আগুন নিভে গেছে, কিন্তু ছাইয়ের উপর এখনও ধোঁয়া উঠছে। আর তার কিছু দূরে, ভাঙা বটগাছের শেকড়ের কাছে, শিশুটি অচেতন হয়ে পড়ে আছে। কমলা ছুটে গিয়ে অমলকে তুলে নিল বুকে, বুকের ভেতর তার হৃদস্পন্দন তখনও টের পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তার চোখ দুটি বন্ধ, ঠোঁট ফ্যাকাশে। কমলা কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে ডাকতে লাগল, “অমল! চোখ খোল, মা, আমি এসেছি।” তখনই হঠাৎ শিশুটি ধীরে ধীরে চোখ খুলল। সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল—কারণ সেই চোখে সাধারণ শিশুর চাহনি ছিল না। চোখ দুটি জ্বলছিল অস্বাভাবিক রক্তিম আভায়। সেই আভা যেন আগের রাতের রক্তচন্দ্রের প্রতিচ্ছবি। উপস্থিত সবাই আতঙ্কে পিছিয়ে গেল, কেউ কেউ চিৎকার করে বলল, “অশুভ শক্তি ওকে গ্রাস করেছে।” কেউ আবার ফিসফিস করে বলল, “ওকে ফিরিয়ে আনা যাবে না।” কমলার কানে কিছুই পৌঁছাল না। সে শুধু ছেলেকে আঁকড়ে ধরে বুকের কাছে টেনে নিল।

শিশুটির চোখের সেই লাল আভা আরও তীব্র হয়ে উঠছিল। তার নিঃশ্বাস ভারী, বুক ওঠানামা করছে দ্রুত ছন্দে। গ্রামের পুরুষেরা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল, যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না কী করা উচিত। কেউ ভয় পাচ্ছিল ছেলেটিকে স্পর্শ করতে, আবার কেউ ভাবছিল শ্মশানের ছায়া গ্রামে টেনে আনতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু কমলা তখন সবার সামনে দাঁড়িয়ে এক অদম্য শক্তির পরিচয় দিল। সে গলা উঁচু করে বলল, “এ আমার ছেলে, কেউ ওকে আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না। আমি মায়ের শক্তিতে ওকে ফেরাব।” তার গলার দৃঢ়তা সবাইকে চমকে দিল। এত ভয়ের মাঝেও এক অসহায় মা যে সাহস দেখাতে পারে, তা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। তার বুকের ভেতর অমল শুয়ে আছে, আর তার চোখের সেই রক্তচাপা আলোয় অশুভ শক্তির উপস্থিতি স্পষ্ট হলেও কমলা থামল না। সে বারবার ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে ঈশ্বরের নাম জপতে লাগল। সেই দৃশ্য দেখে গ্রামের অনেকের বুকেও সাহসের আলো জ্বলে উঠল। তারা বুঝল—অশুভ শক্তির মুখোমুখি হতে হলে ভয় নয়, বরং বিশ্বাসই হতে পারে আসল অস্ত্র। সেই রাতে কমলার মাতৃত্ব ছিল গ্রামের সবার কাছে প্রথম প্রতিরোধের প্রতীক।

রাত তখন গভীর, চারদিকের অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে। দূরে শেয়ালের ডাক, বাতাসে ভেসে আসা পোড়া কাঠ আর ছাইয়ের গন্ধ—সবকিছু যেন গ্রামটিকে আরও ভীতিকর করে তুলছিল। সেই অন্ধকার চিরে শ্মশানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল গ্রামের এক যুবক—অমরেশ। বুকের ভেতর ভয় ঢেউ তুলছিল ঠিকই, কিন্তু তার চোখে ছিল এক অটল দৃঢ়তা। গ্রামে দিনকে দিন যেভাবে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছিল, শিশুদের কান্না আর মায়েদের চোখের জল যেভাবে জমতে শুরু করেছিল, অমরেশ বুঝেছিল—আর দেরি করলে সর্বনাশ অবধারিত। হাতে কেবল একটি মশাল আর কোমরে বাঁধা লাঠি, তবুও তার পদক্ষেপে ছিল এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। শ্মশানের ভেতরে ঢুকতেই বাতাস ভারী হয়ে উঠল, যেন শত মৃত আত্মার নিঃশ্বাস মিশে আছে সেখানে। তার বুক কেঁপে উঠলেও সে নিজেকে সামলে নিল। চোখের সামনে ভেসে উঠছিল কমলার অমলকে বুকে আঁকড়ে ধরা রক্তচোখওয়ালা সেই মুহূর্ত। সে ফিসফিস করে বলল, “না, আমি আর কাউকে এভাবে হারাতে দেব না।”

শ্মশানের কেন্দ্রে এসে থামতেই সে এক ভয়ার্ত দৃশ্য দেখতে পেল। ভাঙা চিতার ছাইয়ের ওপরে ধোঁয়ার মতো পাক খেয়ে উঠছে এক অস্পষ্ট ছায়া। প্রথমে মনে হচ্ছিল ধোঁয়ার স্তম্ভ, কিন্তু ধীরে ধীরে তা মানুষের আকার নিচ্ছিল। আর সেই আকারের চোখদুটো জ্বলছিল অগ্নির মতো লাল আভায়। ছায়ামূর্তির হাতদুটি ছাইয়ের ওপর প্রসারিত, যেন প্রতিটি মৃতদেহের ছাই থেকে কোনো অদৃশ্য শক্তি শুষে নিচ্ছে। অমরেশ নিঃশ্বাস আটকে তাকিয়ে রইল। তার মনে হচ্ছিল—প্রতিটি কণায় যেন অশুভ শক্তি ছড়িয়ে পড়ছে, আর সেই শক্তিই গ্রামকে গ্রাস করছে। মুহূর্তের জন্য ভয় তাকে অবশ করে দিল, মনে হল এখনই ফিরে যাওয়া উচিত। কিন্তু পরক্ষণেই তার ভেতরের অন্যরকম শক্তি মাথা তোলে। সে মনে মনে নিজের বাবার কথা মনে করল, যিনি একসময় গ্রামের রক্ষক ছিলেন, সাহসের সঙ্গে ডাকাতদের প্রতিহত করেছিলেন। সেই রক্ত অমরেশের শরীরেও বইছে। সে দাঁত চেপে বলল, “যতই ভয় দেখাও, আমি পিছিয়ে আসব না।”

ছায়ামূর্তি হঠাৎ থেমে অমরেশের দিকে ফিরল। তার রক্তচোখ অন্ধকার ভেদ করে যেন সরাসরি তার আত্মার ভেতর ঢুকে যেতে চাইছিল। মুহূর্তে মনে হল বুক থমকে গেছে, পায়ের তলায় মাটি নেই। কিন্তু অমরেশ বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মশালটা উঁচিয়ে ধরে গর্জে উঠল, “তুই হয়তো মৃতের ছাই থেকে শক্তি খুঁজিস, কিন্তু আমি জীবিতদের বিশ্বাস থেকে শক্তি নেব। এই গ্রাম তোর নয়, এই গ্রাম আমাদের।” ছায়ামূর্তি কোনো শব্দ করল না, কেবল বাতাসে আরও ভারী অন্ধকার ছড়িয়ে দিল। আগুনের শিখা কেঁপে উঠল, বাতাস ঝড়ের মতো বয়ে গেল। অমরেশ বুঝতে পারল—এ লড়াই শুধু শারীরিক নয়, মানসিকও। তাকে ভয় দেখিয়ে ভেঙে দেওয়াই এই শক্তির উদ্দেশ্য। কিন্তু সে ভয়কে অস্বীকার করল। নিজের ভেতরে বারবার মন্ত্রের মতো আওড়াল—“আমি এই গ্রামের সন্তান, গ্রামকে রক্ষা করব।” তার এই দৃঢ়তায় যেন এক মুহূর্তের জন্য বাতাস থেমে গেল। ছায়ামূর্তির চোখে ক্ষোভের ঝলক দেখা দিল।

অমরেশ সেদিন শ্মশানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করল—যতই শক্তিশালী হোক না কেন এই অশুভ ছায়া, সে একে গ্রাম থেকে তাড়াবেই। এই প্রতিজ্ঞা শুধু তার ব্যক্তিগত সংকল্প ছিল না, পুরো গ্রামের হয়ে তার দেওয়া এক অঙ্গীকার। সে জানত সামনে দিনগুলো আরও ভীতিকর হবে, হয়তো মৃত্যু পর্যন্তও তাকে স্পর্শ করবে। তবু সে পিছিয়ে আসেনি। বুকের ভেতর সাহসের আগুন জ্বেলে বলল, “আমি অমরেশ, আমি ভয়কে জিততে দেব না। যতক্ষণ নিঃশ্বাস আছে, আমি লড়ব।” তার কণ্ঠের দৃঢ়তা শ্মশানের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিল, বাতাসে ভেসে গেল তার শপথ। ছায়ামূর্তি আবার শক্তি শোষণ করতে শুরু করল, কিন্তু অমরেশ তখনই পিছিয়ে আসার বদলে আরও এক পা এগিয়ে গেল। সেই দৃশ্য যেন ভবিষ্যতের লড়াইয়ের পূর্বাভাস—একদিকে অশুভ শক্তির ক্রমবর্ধমান অন্ধকার, আর অন্যদিকে একজন সাধারণ যুবকের অবিচল প্রতিজ্ঞা। সেই রাতে অমরেশের বুকের মধ্যে জন্ম নিল গ্রামের একমাত্র আলোকশিখা, যা হয়তো আসন্ন অন্ধকারকে ঠেকাতে পারবে।

ভোরের আলো ফুটলেও গ্রাম জুড়ে ছিল নিস্তব্ধতার এক অদ্ভুত চাপা ভার। পাখির ডাক ছিল কেমন যেন থেমে যাওয়া, গরু-ছাগলের হাহাকার মিলিয়ে গিয়েছিল ভয়ংকর নীরবতায়। গ্রামবাসীরা যেন নিজেদের ঘরে বন্দী হয়ে পড়েছিল, জানালার ফাঁক দিয়ে উদ্বিগ্ন চোখে বাইরের পৃথিবী দেখছিল। এমনই এক সকালেই মন্দিরের পুরোহিত রঘুনন্দন মহন্ত ডেকে পাঠাল গ্রামের কয়েকজন প্রবীণকে। তার চোখের নীচে ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু দৃষ্টিতে ছিল এক তীব্র উদ্বেগ। হাতে ধরা পুরোনো এক শাস্ত্রগ্রন্থ, যার পাতাগুলো হলুদ হয়ে ভেঙে পড়ার মতো। সবাইকে সামনে বসিয়ে রঘুনন্দন গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল, “রক্তচন্দ্র উঠেছে, এ আর সাধারণ পূর্ণিমা নয়। শাস্ত্রে লেখা আছে—যখন রক্তচন্দ্র পৃথিবীকে ঢেকে দেয়, তখন মৃতদের অশুভ শক্তি জাগতে শুরু করে। সেই শক্তি ভয়ের ওপর বাঁচে, রক্তের ওপর বাঁচে, আর ধীরে ধীরে গ্রাস করে সমস্ত জীবিতকে।” তার কথায় সবাই আতঙ্কে কেঁপে উঠল। নারীরা আঁচল দিয়ে মুখ চেপে কান্না রোধ করল, পুরুষদের বুক কেঁপে উঠল, কিন্তু রঘুনন্দন হাত তুলে সবাইকে থামাল। “ভয় পেয়ে কোনো লাভ নেই। শাস্ত্রে সমাধানও আছে—এই অশুভ শক্তিকে থামানোর একমাত্র পথ হলো অগ্নির শুদ্ধ শক্তি। অগ্নি যেমন জীবন দেয়, তেমনি অশুভকেও ভস্ম করতে পারে।”

কথাগুলো শুনে উপস্থিত সবার মনে সামান্য আশা জন্ম নিল। কিন্তু রঘুনন্দনের কণ্ঠ আরও গাঢ় হয়ে উঠল। সে বইয়ের পাতায় আঙুল রেখে পড়তে লাগল, প্রাচীন সংস্কৃত মন্ত্রের শব্দগুলো গ্রামবাসীর কানে যেন রহস্যের সুরের মতো বাজতে লাগল। তারপর বলল, “শক্তিকে ফিরিয়ে দিতে হলে যে তাকে জাগিয়েছে, তাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। অন্য কোনো উপায় নেই। শ্মশানের মন্ত্রভঙ্গ হয়েছে ভৈরবনাথের হাতে। তাই তাকে-ই এই শক্তিকে ফিরিয়ে দিতে হবে।” এক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধতা নেমে এল। ভৈরবনাথের নাম উচ্চারিত হতেই সবার মনে ভয়ের সঙ্গে ঘৃণার ঢেউ বয়ে গেল। সেই তান্ত্রিকই তো এ বিপদ ডেকে এনেছে, তার লোভ আর অহংকারেই গ্রাম আজ অন্ধকারে ঢেকে গেছে। কেউ কেউ দাঁত চেপে অভিশাপ দিল, কেউ আবার মাথা নেড়ে বলল—“হ্যাঁ, ওকেই শোধ দিতে হবে।” কিন্তু রঘুনন্দন হাত তুলে তাদের থামাল। “মনে রেখো, বলিদান শুধু দেহের নয়, আত্মারও। ভৈরবনাথ যদি নিজেকে অগ্নির হাতে সমর্পণ না করে, তাহলে এই অভিশপ্ত শক্তি কোনোদিন নিঃশেষ হবে না।” তার কথায় সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। যে মানুষটি একদিন গ্রামের ভয়ে অন্ধকারে তান্ত্রিক সাধনা করত, সেই মানুষকেই কি এখন নিজের জীবন দিয়ে গ্রামকে রক্ষা করতে হবে?

রঘুনন্দন নিজেই সেই রাতে ভৈরবনাথকে খুঁজে বের করতে বেরোল। শ্মশানের অন্ধকার গলিপথ পেরিয়ে, শুকনো পাতার খসখস শব্দ পায়ে লেগে, অবশেষে সে খুঁজে পেল ভৈরবনাথকে—এক ভগ্ন কুটিরের ভেতর বসে, চোখে আতঙ্ক আর অপরাধবোধের ছাপ নিয়ে। ভৈরবনাথের চেহারা আগের মতো আর তেজী ছিল না, বরং নিস্তেজ, ভীত, ভেঙে পড়া। রঘুনন্দনের আগমন দেখে সে প্রথমে চমকে উঠল, তারপর কাঁপা কণ্ঠে বলল, “আমি জানতাম না এমন হবে। আমি ভেবেছিলাম শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। কিন্তু…” তার গলা আটকে গেল, চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। রঘুনন্দন শান্ত গলায় বলল, “তুই জানতিস না, কিন্তু শাস্ত্র জানত। তুই লোভ করেছিস, অহংকার করেছিস, তার ফল আজ গোটা গ্রাম ভুগছে। এখন আর পালিয়ে বাঁচবি না। তোর হাতেই সমাধান।” ভৈরবনাথ মাথা নিচু করে রইল। মাটির দিকে তাকিয়ে হাত কাঁপছিল, যেন ভেতরে এক অস্থির দ্বন্দ্ব চলছে—বাঁচার ইচ্ছে আর অপরাধবোধের শাস্তির মধ্যে। রঘুনন্দন ধীরে বলল, “একজন সাধকের আসল শক্তি মন্ত্রে নয়, ত্যাগে। তুই যদি সত্যি সাধক হস, তবে গ্রামের জন্য নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ কর।”

দীর্ঘ নীরবতার পর ভৈরবনাথের বুক থেকে ভারী শ্বাস বেরোল। সে মাথা তুলল, চোখে ভয়ের পাশাপাশি এক অদ্ভুত শান্তির আভা দেখা দিল। গলা কাঁপলেও দৃঢ় সুরে বলল, “যদি আমার মৃত্যুতে গ্রাম বাঁচে, তবে আমি পিছিয়ে আসব না। আমি নিজের ভুলের জন্য দায় স্বীকার করব।” রঘুনন্দন গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল, যেন তাকে শেষবারের মতো যাচাই করছে। তারপর মৃদু স্বরে বলল, “তাহলে প্রস্তুত হ।” ভৈরবনাথ চোখ বন্ধ করে দীর্ঘক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে রইল, তারপর মাটিতে হাত ছুঁয়ে প্রণাম করল। যেন সে বুঝে নিয়েছে—তার সাধনার আসল ফল এটাই, আত্মত্যাগ। বাইরে তখন রাত নেমে এসেছে, দূরে আকাশে আবার রক্তচন্দ্র উঁকি দিচ্ছে। বাতাস ভারী হয়ে উঠছে, যেন ছায়ামূর্তি আরও শক্তিশালী হচ্ছে। কিন্তু সেই অন্ধকারের মাঝেই রঘুনন্দন ও ভৈরবনাথের প্রতিজ্ঞা যেন আলো হয়ে জ্বলে উঠল। শ্মশানের আগুন আরেকবার জ্বালানো হবে, তবে এবার তা লোভ বা শক্তির জন্য নয়—গ্রামকে মুক্ত করার জন্য।

গ্রামের আকাশে সেদিন চাঁদটা ছিল ভয়ংকর লাল আভায় মোড়া। বাতাসে এক অদ্ভুত গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল, যেন পোড়া মাংস আর পচা মৃতদেহের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। গ্রামের প্রতিটি বাড়ি অন্ধকারে ঢাকা, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সবাই আতঙ্কে জেগে আছে। হঠাৎ করেই দূরে শ্মশানের দিক থেকে এক অমানবিক আর্তনাদ শোনা গেল। মানুষ দরজার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখে—এক বিশাল ছায়ামূর্তি ধোঁয়ার মতো আকাশ ছুঁয়ে গ্রামের দিকে এগিয়ে আসছে। তার লাল চোখে যেন আগুন জ্বলছে, আর তার প্রতিটি পদক্ষেপে মাটি কেঁপে উঠছে। মুহূর্তেই গ্রামে চিৎকার আর কান্নার শব্দ উঠল। কারও ঘরের বেড়া ভেঙে গেল, কারও উঠোনে পশুপাখি মরে গেল। আতঙ্কে মানুষ দিশেহারা হয়ে দৌড়াতে লাগল, কেউ দক্ষিণে, কেউ উত্তরে, কিন্তু ছায়ামূর্তি যেন সবকিছুকে ঘিরে ফেলছে। এই ভয়ের মধ্যেই কমলা তার সন্তানকে বুকে চেপে ধরে দিশেহারা হয়ে ছুটছিল। কিন্তু ছেলেটির চোখে তখনো সেই অদ্ভুত লাল আভা, আর কমলা বুঝতে পারছিল—যদি ছায়ামূর্তির দৃষ্টি আরেকবার তার সন্তানের ওপর পড়ে, তবে সে আর বাঁচবে না।

ঠিক সেই সময় গ্রামের যুবক অমরেশ এগিয়ে এল। হাতে একটা লম্বা লাঠি, চোখে জেদ আর বুক ভরা সাহস। সে চিৎকার করে সবাইকে এক জায়গায় জড়ো হতে বলল। তার গলার দৃঢ়তায় গ্রামের মানুষ একটু থামল, যেন ভয় পেরিয়ে আশার আলো দেখতে পেল। অমরেশ চারদিকে তাকিয়ে বলল, “আজ ভয় পেয়ে পালালে আমরা কেউ বাঁচব না। একসাথে লড়তে হবে, একসাথে দাঁড়াতে হবে। অশুভকে রুখতে পারলে তবেই বাঁচব।” তার কণ্ঠে দৃঢ়তা ছড়িয়ে পড়ল। কমলা, কাঁদতে কাঁদতে, সন্তানকে আঁকড়ে ধরে তার পাশে এসে দাঁড়াল। আরও কয়েকজন যুবক লাঠি, কুড়াল, মশাল হাতে এগিয়ে এল। তারা জানত—এ লড়াই সাধারণ নয়, এ লড়াইয়ে প্রাণ হারাতে হবে। কিন্তু অমরেশের চোখে তারা দেখেছিল দৃঢ়তা, তাই পিছু হটার সাহস আর কেউ পেল না। তখনই মন্দিরের দিক থেকে পুরোহিত রঘুনন্দনের মন্ত্রোচ্চারণ শোনা গেল। তার কণ্ঠ গভীর, ভারী, যেন আকাশ কাঁপিয়ে দিচ্ছে। শাস্ত্র থেকে শেখা মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে সে মন্দিরের চত্বরে অগ্নিকুণ্ড জ্বালাতে শুরু করল। শুষ্ক কাঠে আগুন ধরতেই শিখা লেলিহান হয়ে উঠল, আর সেই শিখার আলোতে গ্রাম যেন খানিকটা আলোকিত হল।

ছায়ামূর্তি গ্রামে ঢুকে পড়ল। তার বিশাল শরীরটা ধোঁয়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিল, একেকবার তার ছোঁয়ায় গাছ শুকিয়ে যাচ্ছিল, কুয়োর জল কালো হয়ে উঠছিল। মানুষ ভয়ে কাঁপছিল, কিন্তু রঘুনন্দনের মন্ত্র আর অগ্নিকুণ্ডের শিখা যেন ছায়ামূর্তিকে সামান্য পিছিয়ে দিচ্ছিল। অমরেশ তখন গ্রামের যুবকদের নিয়ে এগিয়ে গেল। তারা মশাল ছুঁড়ে ছায়ার দিকে মারতে লাগল। আগুন লাগলেই ছায়ামূর্তির শরীরে হাহাকার ভেসে উঠত, যদিও মুহূর্তের মধ্যেই সে আবার ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে পড়ত। অমরেশ বুঝতে পারল—শক্তিটা অগ্নিকে ভয় পাচ্ছে, কিন্তু সম্পূর্ণ ভস্ম করার জন্য আরও কিছু চাই। কমলা সেই সময়ে ছেলেকে আঁকড়ে ধরে মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করতে লাগল, যেন তার সন্তানের চোখের লাল আভা অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু ছায়ামূর্তির ক্রোধ যেন আরও ভয়ংকর হয়ে উঠল। সে মন্দিরের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল, তার ভয়ংকর লাল চোখ অগ্নিকুণ্ডের শিখায় আটকে গেল। বাতাস হঠাৎ ঝড়ের মতো বয়ে গেল, শিখা দুলে উঠল, মন্ত্রের শব্দ আরও তীব্র হয়ে উঠল।

শেষ মুহূর্তে, রঘুনন্দন উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলল, “অগ্নি পবিত্র! অগ্নি ধ্বংসাত্মক! অশুভকে গ্রাস কর!” মন্ত্রের শক্তি আর অগ্নির লেলিহান শিখা একসাথে ছায়ামূর্তিকে আঘাত করল। মুহূর্তেই চারদিক আলোয় ভরে উঠল। অমরেশ লাঠি হাতে সেই আলোয় ছুটে গিয়ে ছায়ামূর্তিকে আঘাত করল, আর গ্রামের মানুষ তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে চিৎকার করে উঠল। ধোঁয়ার দেহটা কাঁপতে কাঁপতে ছড়িয়ে পড়ল, আর ভয়ের রাত যেন এক ঝটকায় আরও ভয়ংকর হয়ে উঠল। ছায়ামূর্তি গর্জন করতে করতে পিছিয়ে গেল, কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। রক্তচন্দ্র তখনো আকাশে ঝুলে ছিল, আর অশুভ শক্তি যেন সেই লাল আভা থেকে নতুন করে শক্তি নিচ্ছিল। গ্রামবাসীরা শ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল—লড়াই শুরু হয়েছে, কিন্তু শেষ কোথায়, তা কেউ জানে না। অমরেশ ঘামভেজা মুখে লাঠি শক্ত করে ধরল, রঘুনন্দন আবার নতুন মন্ত্র শুরু করল, আর কমলা তার সন্তানকে আঁকড়ে ধরে মায়ের শক্তি দিয়ে প্রার্থনা করতে লাগল। সেই রাতের লড়াই ছিল ভয়ের সঙ্গে, মৃত্যুর সঙ্গে, অশুভের সঙ্গে—কিন্তু তার মাঝেই জন্ম নিচ্ছিল গ্রামের মানুষের অদম্য ঐক্য।

রক্তচন্দ্রের লাল আভা তখন আকাশকে অগ্নির মতো জ্বালিয়ে তুলেছে। মন্দিরের আঙিনায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো আতঙ্কে কাঁপছে, অথচ তাদের চোখে আশা আর ভয় মিশে আছে। অগ্নিকুণ্ডের শিখা ধীরে ধীরে আকাশ ছুঁতে চাইছে, আর তার আলোয় ছায়ামূর্তির বিকৃত দেহটা ফুটে উঠছে। বিশাল সেই ছায়া বাতাসকে দমিয়ে ফেলছে, মানুষের নিশ্বাস ভারী হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ এক ঝটকায় ছায়ামূর্তি ঝড়ের মতো নড়ে উঠল। তার হাতের মতো লম্বা ধোঁয়ার শাখা বাড়িয়ে অগ্নিকুণ্ডকে ঢেকে দিতে চাইছে। মুহূর্তেই আগুন দপদপ করে নিভে আসতে লাগল। শিখার আলো কমতেই গ্রামবাসীর বুক কেঁপে উঠল। আতঙ্কের চিৎকার উঠল চারদিক থেকে—যেন আলো হারালে তাদের প্রাণও অন্ধকারে ডুবে যাবে। রঘুনন্দন মন্ত্রোচ্চারণে গলা ফাটিয়ে চলেছে, কিন্তু ছায়ার শক্তি এত প্রবল যে, মন্ত্র যেন কেবল বাতাসে হারিয়ে যাচ্ছে। সেই ভয়ার্ত সময়ে অমরেশ যুবকদের নিয়ে সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারা লাঠি, মশাল ছুঁড়ে ছায়াকে ঠেকাতে চাইল, কিন্তু প্রতিবারই ছায়া তাদের আঘাত ফিরিয়ে দিচ্ছিল। অমরেশ মাটিতে পড়ে গেলেও আবার উঠে দাঁড়াল, চোখে আগুনের মতো দৃঢ়তা। তবু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল—শুধু সাহস আর মন্ত্রে এই শক্তিকে রোখা যাবে না।

ঠিক তখনই ছায়ার কালো দেহের ভেতরে কোথাও ভৈরবনাথকে দেখা গেল। সে দাঁড়িয়ে আছে, আতঙ্কে ভরা মুখ, কপালে ঘাম, চোখে অনুশোচনা। এই ভয়ংকর শক্তি সে-ই জাগিয়ে তুলেছিল, নিজের লোভে আর গর্বে। কিন্তু এখন সেই শক্তি গ্রামটাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। প্রথমে ভৈরবনাথ পেছন ঘুরে পালাতে চাইল। তার মনে হচ্ছিল—বেঁচে থাকলেই হয়তো পরে উপায় খুঁজে বের করা যাবে। কিন্তু পরমুহূর্তেই তার দৃষ্টি পড়ল গ্রামবাসীর দিকে। কমলা তার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছে, অমরেশ রক্তাক্ত শরীর নিয়ে ছায়ার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, রঘুনন্দন শেষ শক্তি দিয়ে মন্ত্র পড়ছে। ভৈরবনাথের বুক কেঁপে উঠল। হঠাৎ সে যেন শুনতে পেল শাস্ত্রের সেই বাক্য—“অশুভ শক্তি জাগালে তাকে দমন করতে হবে আত্মবলিদানের মধ্য দিয়ে।” তার কানে যেন বজ্রপাতের মতো বেজে উঠল এই সত্য। ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে সে বলল, “আমাকেই শেষ করতে হবে… আমাকেই।” মুহূর্তের ভেতরেই তার শরীর কাঁপতে শুরু করল, যেন এক অদৃশ্য শক্তি তাকে ভেতর থেকে টানছে। সে বুঝতে পারল, পালিয়ে বাঁচা যাবে না। তারই সৃষ্ট অশুভকে গ্রাস করার জন্য তার জীবনই প্রয়োজন।

ভৈরবনাথ ধীরে ধীরে অগ্নিকুণ্ডের দিকে এগোতে লাগল। তার প্রতিটি পদক্ষেপ ভারী, তবু দৃঢ়। চারপাশে কান্না আর চিৎকার শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু তার কানে যেন কিছুই ঢুকছিল না। গ্রামের মানুষ বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল। রঘুনন্দন বুঝতে পেরে চিৎকার করে বলল, “হ্যাঁ, এটাই একমাত্র পথ! তোমার বলি ছাড়া ওকে থামানো যাবে না!” ভৈরবনাথ থেমে দাঁড়াল, চোখ তুলে তাকাল আকাশের রক্তচন্দ্রের দিকে। এক মুহূর্তের জন্য তার চোখে ভয় মুছে গিয়ে শান্তির আভা ফুটে উঠল। সে হাত তুলে মন্ত্র পড়তে শুরু করল, নিজের প্রাণশক্তিকে যেন আগুনে সঁপে দিচ্ছিল। ছায়ামূর্তি হাহাকার করে তার দিকে ঝাঁপিয়ে এল, তাকে আটকাতে চাইছিল, কিন্তু তখন অগ্নিকুণ্ডের শিখা যেন ভেতর থেকে জেগে উঠল। আগুন ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে, লেলিহান শিখা আকাশ ছুঁয়ে উঠল। ভৈরবনাথ শেষবারের মতো গ্রামবাসীর দিকে তাকাল—চোখে অনুশোচনা, কিন্তু তার থেকেও বেশি আত্মত্যাগের দীপ্তি। তারপর হঠাৎ নিজের শরীরটা অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করল। মুহূর্তের মধ্যে আগুন তার শরীরকে গ্রাস করল, চারদিক থেকে মন্ত্রের শব্দ বজ্রধ্বনির মতো প্রতিধ্বনিত হল।

অগ্নিকুণ্ডে ভৈরবনাথের দেহ পুড়তে শুরু করতেই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। ছায়ামূর্তির লালচোখ কেঁপে উঠল, তার বিশাল দেহ থরথর করে কাঁপতে লাগল। সে চিৎকার করে উঠল—এক অমানবিক, কানে বিদ্ধ করা চিৎকার, যা আকাশ-মাটি কাঁপিয়ে দিল। আগুনের প্রতিটি শিখা যেন তার ভেতর ঢুকে তাকে গ্রাস করতে লাগল। গ্রামবাসী আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলল, কেবল আলো আর শব্দ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। ছায়ামূর্তির দেহ একে একে ছাই হয়ে মাটিতে ঝরে পড়তে লাগল, তার ভয়ংকর লাল চোখ নিভে গেল। রক্তচন্দ্রের আকাশ ধীরে ধীরে ম্লান হতে শুরু করল, লাল আভা মিলিয়ে গিয়ে পূর্ণিমার স্বাভাবিক সাদা আলো ফিরে এল। মানুষজন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, যেন বুঝতেই পারছিল না—এ কি সত্যি, না কি দুঃস্বপ্ন। ধোঁয়ার গন্ধ, আগুনের দপদপ শব্দ, আর পোড়া দেহের গন্ধ মিশে গিয়ে এক ভয়ংকর নীরবতা তৈরি করল। রঘুনন্দন কাঁপতে কাঁপতে বলল, “শেষ হয়েছে… ভৈরবনাথের আত্মবলিতে অশুভ শক্তি ধ্বংস হয়েছে।” কমলা বুকের ভেতর থেকে গভীর নিশ্বাস ছাড়ল, তার সন্তানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, আর অমরেশ আকাশের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “সে শেষ পর্যন্ত নিজের ভুল শোধরাল।” গ্রাম আবার নীরবতায় ডুবে গেল, কিন্তু সেই নীরবতা ছিল মুক্তির।

রাতভর ভয় আর লড়াইয়ের পর ভোরের আলো ধীরে ধীরে গ্রামটিকে ঘিরে ধরল। আকাশে তখনও রক্তচন্দ্রের আভা মৃদু ঝিকমিক করছে, তবে তার দীপ্তি যেন নিভে আসছে। ভোরের প্রথম আলো যখন গ্রামবাসীর চোখে পড়ল, সবাই একসঙ্গে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল—যেন এই আলো তাদের নতুন জন্ম দিল। রক্তচন্দ্রের ভয়াবহ উপস্থিতি ধীরে ধীরে আকাশ থেকে মিলিয়ে গেল, আর সাদা পূর্ণিমার আলো ফিরে এসে গ্রামের ঘরে ঘরে আশ্বাস ছড়িয়ে দিল। গ্রামবাসী শ্মশানের দিক থেকে ভেসে আসা ধোঁয়ার গন্ধ পেয়ে কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে রইল। কেউ কথা বলল না, কেবল সবার মুখে একই প্রশ্ন—সব শেষ হয়েছে তো? সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে পুরোহিত রঘুনন্দনের কণ্ঠ ভেসে উঠল, গম্ভীর কিন্তু প্রশান্ত, “হ্যাঁ, ভয়ের অধ্যায় শেষ হয়েছে। ভৈরবনাথের আত্মত্যাগেই অশুভ শক্তি ধ্বংস হয়েছে।” তার কণ্ঠে দৃঢ়তার সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের বিষণ্নতা ছিল, কারণ যেভাবেই হোক, একজন মানুষ নিজের ভুল শোধরাতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে। এই বাক্য শুনেই মানুষের বুক থেকে একরাশ বোঝা নেমে গেল। অনেকেই কেঁদে ফেলল, কেউবা ভৈরবনাথের জন্য প্রার্থনা করল। ভোরের আলোয় গ্রাম যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেল।

কমলা তার সন্তানকে বুকে আঁকড়ে ধরে বসে ছিল। শিশুটি এখন অচেতন অবস্থা কাটিয়ে ধীরে ধীরে চোখ খুলছে। তার চোখে আর সেই লাল আভা নেই—বরং শিশুর চোখে ফুটে উঠেছে নিষ্পাপ কৌতূহল। কমলার চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল, কিন্তু সে আর দুঃখের অশ্রু ছিল না, ছিল স্বস্তি আর আনন্দের। তার মনে হচ্ছিল, যেন সে সন্তানকে নতুন করে ফিরে পেয়েছে। গ্রামের মহিলারা তাকে ঘিরে দাঁড়াল, কেউ সান্ত্বনা দিল, কেউ শিশুটির কপালে হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করল। অমরেশ দাঁড়িয়ে দূর থেকে এই দৃশ্য দেখছিল। তার চোখে গভীর ক্লান্তি, শরীরে রক্তাক্ত ক্ষত, তবু মুখে তৃপ্তির ছাপ ফুটে উঠছিল। সে জানত, গ্রামকে বাঁচাতে তারা সবাই প্রাণপণ চেষ্টা করেছে, আর ভৈরবনাথের আত্মবলিদান সবকিছুর সমাপ্তি টেনেছে। তার চোখে এক ঝলক ভবিষ্যতের ছবি ভেসে উঠল—একটা গ্রাম যেখানে ভয় আর অশুভ শক্তির বদলে আলো, শান্তি আর ভালোবাসা থাকবে। কমলার দিকে তাকিয়ে তার হৃদয়ে এক অদ্ভুত টান অনুভব করল, যেন এই সংগ্রামের ভেতর দিয়ে তাদের সম্পর্ক এক নতুন অর্থ পেল। কমলার চোখেও সেই আলো ধরা দিল, যেখানে কেবল মাতৃত্ব নয়, ভবিষ্যতের আশ্বাসও ছিল।

গ্রামের পুরুষরা ও যুবকেরা একসঙ্গে শ্মশানের দিকে এগোল। তারা ভৈরবনাথের নাম উচ্চারণ করছিল, কেউ কেউ চোখ মুছছিল। আগুনের জায়গায় এখন কেবল ছাই আর অঙ্গার পড়ে আছে। সেই ছাইয়ের ভেতরে কোথাও কোথাও ছোট ছোট শিখা এখনও জ্বলছিল, যেন ভৈরবনাথের আত্মার দীপ্তি। মানুষজন হাঁটু গেড়ে প্রণাম করল, কেউ ফুল ছড়িয়ে দিল, কেউবা মাথা নত করল নিঃশব্দ শ্রদ্ধায়। রঘুনন্দন সবাইকে বলল, “আমরা তাকে ভুলতে পারব না। ভুল করেছিল, কিন্তু সেই ভুলের দায় সে নিজের জীবনের বিনিময়ে শোধ করেছে। আজ থেকে তাকে আমরা অভিশপ্ত তান্ত্রিক হিসেবে নয়, এক আত্মত্যাগী মানুষ হিসেবে স্মরণ করব।” এই বাক্য শোনার পর গ্রামের মানুষজন ভৈরবনাথের নাম আর গলায় কাঁপন নিয়ে উচ্চারণ করল না, বরং মমতা আর শ্রদ্ধা দিয়ে ডাকতে লাগল। তারা প্রতিজ্ঞা করল, এই ঘটনার শিক্ষা কখনও ভুলবে না। তবে সেই সময়ই, যখন সবাই মাথা নিচু করে প্রার্থনায় ব্যস্ত, তখন এক যুবক হঠাৎ অঙ্গারের দিকে তাকিয়ে দেখল—একটা ছোট অঙ্গার এখনও নিভে যায়নি। শিখাটি দুর্বল হলেও জ্বলছে, আর তার ভেতর যেন এক ক্ষীণ লাল আভা ঘুরপাক খাচ্ছে। যুবকের বুক কেঁপে উঠল, সে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু রঘুনন্দনের দৃষ্টি তাকে থামিয়ে দিল। পুরোহিতের চোখে গভীর উদ্বেগের ছায়া ফুটে উঠল।

গ্রামের মানুষ ধীরে ধীরে ফিরে গেল। শিশুদের হাসি, মহিলাদের স্বস্তির নিশ্বাস, পুরুষদের প্রশান্ত মুখ গ্রামটিকে আবার প্রাণবন্ত করে তুলল। সেদিন রাতেই গ্রামের আকাশে পূর্ণিমার সাদা আলো আবারও শান্তি নিয়ে এলো, পাখির ডাক শোনা গেল, গৃহস্থের উঠোনে ধূপ জ্বলল, আর মানুষজন নতুন করে ঘুমোতে পারল। কিন্তু শ্মশানের ভেতর সেই একটুকরো অঙ্গার এখনও ধিকিধিকি জ্বলছিল। চারপাশে অন্ধকার নেমে এলেও অঙ্গারের লাল আভা যেন জেদ করে বেঁচে রইল। যেন সেটা এক ভয়ংকর বার্তা দিচ্ছিল—অশুভ শক্তি হয়তো পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি, হয়তো একদিন আবার ফিরে আসবে। হয়তো অন্য রূপে, অন্য সময়ে, কিন্তু সেই ভয় আবারো গ্রামকে স্পর্শ করবে। রঘুনন্দন গভীর রাত পর্যন্ত শ্মশানের দিকে তাকিয়ে রইল। তার ঠোঁট নড়ে উঠল, “আজ শান্তি ফিরে এসেছে… কিন্তু আগামীতে? আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।” এই কথার ভেতরেই লুকিয়ে ছিল এক অদৃশ্য আতঙ্ক। ভোরের আলোয় গ্রাম নতুন জীবন পেলেও, অঙ্গারের সেই শিখা যেন ভবিষ্যতের এক অনিশ্চিত পথের ইঙ্গিত দিয়ে গেল।

শেষ

1000055450.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *