Bangla - ভূতের গল্প - রহস্য গল্প

কালের কণ্ঠ

Spread the love

অমিতাভ মাইতি


কলকাতার পুরনো রেলস্টেশনের সেই নির্জন প্ল্যাটফর্মে প্রথম পা রাখতেই অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়ের মনে অদ্ভুত এক উত্তেজনা জেগে ওঠে। সকালবেলার হালকা কুয়াশার মধ্যে প্ল্যাটফর্মের ধুলো জমে থাকা সিমেন্টের রঙ ধূসর এবং শীতল, যেন সময় নিজেই এখানে থমকে গেছে। চারপাশে ভিড়ের কোনো চিহ্ন নেই, শুধু কখনো কানে ভেসে আসে দূরের ট্রেনের হালকা সড়কঘর্ষণ বা মাটিতে ধ্বনিত ধাতব চাকার শব্দ। অনির্বাণের চোখে ধরা পড়ে প্ল্যাটফর্মের প্রান্তে ছায়ামূর্তি—একটি অচেনা ছায়া, যা ঠিক মানুষের মতো হলেও বিস্তৃত আলোয় মিলিয়ে গেলে স্পষ্ট রূপ বোঝা যায় না। তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হচ্ছে, কিন্তু একই সঙ্গে অদ্ভুতভাবে শান্ত। বাতাসে একটি নিঃশব্দ, ভীষণ ঘন নীরবতা ভেসে বেড়াচ্ছে, যা যেন বলছে—“এখানে সবকিছু সহজভাবে দেখা যায় না।” অনির্বাণ নিজের হাতের ত্বক অনুভব করতে পারেন, যা হালকা শীতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে কাঁপছে। সে লক্ষ্য করে, প্ল্যাটফর্মের একপ্রান্তে এক বৃদ্ধ লোক টুপির কোলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন, যেন তিনি কোনোরকম অপেক্ষার মধ্যে রয়েছেন। সেই মুহূর্তে অনির্বাণ বুঝতে পারে যে, এই স্থানটি শুধু একটি রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্ম নয়—এটি যেন কোনো লুকানো ইতিহাস এবং অনাকাঙ্ক্ষিত গল্পের সংযোগস্থল।

অনির্বাণ কিছুটা এগোতে চেষ্টা করে, কিন্তু প্রতি পদক্ষেপে তার চারপাশের বায়ুতে অদ্ভুত এক পরিবর্তন লক্ষ্য করে। বাতাস যেন হঠাৎ ভারী হয়ে গেছে, এবং দূরে অজানা কোনো কণ্ঠস্বর একবার, দুইবার ধ্বনি তুলতে থাকে, যা স্পষ্টভাবে কিছু বলছে না, কিন্তু অনির্বাণের কানে চেনা শব্দের মতো প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করছে। সে ঘনিষ্ঠভাবে চারপাশে তাকায়—একটি ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা কোনো সাধারণ যাত্রী এ ধরনের শব্দ তৈরি করতে পারে না। একই সঙ্গে, তার দৃষ্টির কোণে অদ্ভুতভাবে লাফিয়ে ওঠা ছায়ামূর্তিগুলো স্থান পরিবর্তন করছে। কখনও এগুলো প্ল্যাটফর্মের প্রান্তে, কখনও আবার বাতাসের মাঝে ভেসে বেড়াচ্ছে। অনির্বাণ নিজেকে বলছে, “সবকিছুই কল্পনার ফল হতে পারে,” কিন্তু ভেতরের কিছু অংশ তাকে সচেতন করে, যেন এই স্থান সত্যিই অদ্ভুত কিছু লুকিয়ে রেখেছে। এই অনুভূতি তাকে আরও গভীরভাবে এই প্ল্যাটফর্মে টেনে নিয়ে যায়।

হঠাৎ, প্ল্যাটফর্মের অন্য প্রান্তে অজয় সেনকে দেখা যায়—একজন মাঝবয়সী, শান্ত স্বভাবের যাত্রী, যিনি নিয়মিত এই স্টেশনে ভ্রমণ করেন। অজয় অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে হালকা একটি হাসি দেয়, কিন্তু তার চোখে যে অদ্ভুত সংযোজন রয়েছে, তা বোঝা যায়—প্রায় যেন তিনি জানেন এই প্ল্যাটফর্মে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনাগুলি। অজয়ের উপস্থিতি অনির্বাণকে কিছুটা স্বস্তি দেয়, কিন্তু একই সঙ্গে রহস্যের গভীরতা বাড়ায়। প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে, অনির্বাণ অনুভব করে যে এই স্থানটি শুধুমাত্র শারীরিক বা বাস্তব নয়; এটি হয়তো কোনো অতিপ্রাকৃত ইতিহাসের সাক্ষী, যেখানে সময় এবং বাস্তবতার সীমা মিশে গেছে। সে শ্বাস নিয়ে চারপাশের ছায়া, নীরবতা এবং ভেসে আসা অজানা কণ্ঠস্বরগুলো পর্যবেক্ষণ করতে থাকে, এবং হঠাৎ তার মনে হয়—এই প্ল্যাটফর্ম তার জন্য শুধু একটি অভিজ্ঞতা নয়, বরং কোনো রহস্যের প্রাথমিক সংকেত। সেখানে দাঁড়িয়ে অনির্বাণের মনে এক অদ্ভুত আবিষ্কারের অনুভূতি জাগে—যে আবিষ্কার তার জীবনের রূপান্তর ঘটাতে পারে, কিন্তু তার পথ অন্ধকার এবং অজানা।

প্ল্যাটফর্মের সেই অদ্ভুত নীরবতার মধ্যেই অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় হঠাৎ শুনতে পায় এক অচেনা কণ্ঠস্বর। প্রথমে সে নিশ্চিত হতে পারে না—শব্দটি কি আসলেই তার কানে এসেছে, নাকি তার মন কল্পনাচক্রে একটি খেলা খেলছে। কণ্ঠটি স্পষ্টভাবে কিছু বলে না, কিন্তু শব্দের তালে তালে এমন এক অদ্ভুত ভাবনা, যা যেন আগামী দিনের ঘটনা সম্পর্কে ইঙ্গিত দিচ্ছে। অনির্বাণের হৃদস্পন্দন তীব্র হয়; সে এক পলক দাঁড়িয়ে থাকে, আশেপাশে তাকায়, কিন্তু প্ল্যাটফর্মে কোনো মানুষ দেখা যায় না। বাতাসে অদ্ভুতভাবে থমথমে প্রতিধ্বনি ভেসে আসে, যেন প্রতিটি শব্দ ধীরে ধীরে তার চেতনায় গেঁথে যাচ্ছে। প্রথমবারের মতো সে অনুভব করে, এই প্ল্যাটফর্ম শুধু রেলপথের সংযোগস্থল নয়, এটি হয়তো কোনো অতিপ্রাকৃত জ্ঞান বা সময়ের সাথে সংযোগ স্থাপনের দরজা। সে মনে মনে নিজের বুদ্ধিকে প্রশ্ন করে—“সবকিছু কি কল্পনা, নাকি সত্যিই কেউ বা কিছু আমাকে বার্তা পাঠাচ্ছে?” এই দ্বন্দ্ব তাকে আরও গভীরে নিয়ে যায়।

অনির্বাণ যতক্ষণ প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকে, ততক্ষণই শব্দগুলো আরও জোরে এবং আরও স্পষ্ট হয়ে আসে। কখনও কণ্ঠটি নরম, কখনও আবার হঠাৎ কেঁচে ওঠার মতো; একটি অদ্ভুত সঙ্গীতের মতো ধ্বনি, যা তার মনকে ধরে রাখে। প্রথমে ভয় তাকে সবকিছু বন্ধ করে দিতে চায়—তার শরীর কাঁপছে, হাতে মৃদু ঘাম জমেছে, এবং চোখ দিয়ে অজানা আতঙ্কের জল ঝরে। কিন্তু একই সঙ্গে একটি গভীর কৌতূহল তাকে বাধ্য করে, যেন জানতে চায়—এই বার্তা আসলে কী বা কাকে নির্দেশ করছে। অনির্বাণ ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে, শব্দটি যে কোনো স্বাভাবিক মানুষের কণ্ঠ নয়; বরং এটি যেন কোনো সময় বা বাস্তবতার বাইরে থেকে এসেছে। প্রতিটি শব্দে ভবিষ্যতের ঝলক, অসমাপ্ত ঘটনা এবং অজানা পরিণতির ইঙ্গিত রয়েছে। সে বুঝতে পারে যে, প্ল্যাটফর্মের এই নিঃশব্দ নীরবতা এবং ছায়ামূর্তির আড়ালে যে শক্তি কাজ করছে, তা শুধুমাত্র শারীরিকভাবে নয়, মানসিক ও আত্মিকভাবে তাকে প্রভাবিত করছে।

এই প্রথম “ভবিষ্যতের খবর” শোনার পর অনির্বাণের মধ্যে ভয় এবং কৌতূহলের মিশ্রণ চরমে পৌঁছায়। সে মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকে—এটি কি কোনো সতর্কবার্তা, নাকি শুধু তার কল্পনাশক্তির খেলা? প্ল্যাটফর্মের অন্য প্রান্তে হঠাৎ অজ্ঞাত একজন ব্যক্তি আংশিকভাবে উপস্থিত মনে হয়, যেন সে তার দৃষ্টির কোণে অদৃশ্য থেকে লক্ষ্য করছে। অনির্বাণ চেষ্টা করে তাকাতে, কিন্তু লোকটি অদৃশ্য হয়ে যায়, শুধু হালকা ছায়া এবং বাতাসে অদ্ভুত কম্পন রেখে যায়। এই ঘটনার পর তার মনে হয়, সে এখন শুধুমাত্র প্ল্যাটফর্মের অংশ নয়; বরং কোনো বৃহত্তর রহস্যের মধ্যে প্রবেশ করেছে, যেখানে সময়, স্থান এবং ঘটনা একে অপরের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিশে আছে। অনির্বাণের ভয় ক্রমশ একটি গভীর কৌতূহলে পরিণত হয়—যেখানে তার মন বারবার সেই অজ্ঞাত কণ্ঠের দিকে টান খায়, এবং পাঠকও এই অদ্ভুত, রহস্যময় এবং অতিপ্রাকৃত পরিবেশের সঙ্গে তার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেয়।

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় প্ল্যাটফর্মে অদ্ভুত “ভবিষ্যতের খবর” শোনার অভিজ্ঞতা রুমি চক্রবর্তীর সঙ্গে ভাগ করতে বসলেন। রুমি, যিনি যুক্তিবাদী এবং বিশ্লেষণাত্মক মনের অধিকারী, প্রথমে কিছুটা অবিশ্বাস প্রকাশ করলেন। অনির্বাণের বর্ণনা শোনার পর তিনি বললেন, “অনির্বাণ, এমন ঘটনা কল্পনা বা উত্তেজনার ফলও হতে পারে। কখনও কখনও মন নিজেই এমন গল্প তৈরি করে, যা বাস্তবের সঙ্গে মিশে যায়।” তবে অনির্বাণের চোখে ভয় ও সত্যের মিলিত প্রকাশ দেখে রুমি বুঝতে পারে, তার বন্ধু এ বিষয়টি নিয়ে মজা করছে না। তারা বসে কলকাতার পুরনো রেলস্টেশনের ইতিহাস এবং অতিপ্রাকৃত ঘটনা সংক্রান্ত নথিপত্র খুঁজতে শুরু করে। অনির্বাণ জানালেন, প্ল্যাটফর্মের চারপাশের স্থাপনাগুলো বহু পুরনো, এবং অনেক প্রাচীন কাহিনী রয়েছে যেখানে মানুষ অদ্ভুত ছায়া বা অজ্ঞাত কণ্ঠ শুনেছেন। রুমি তখন কম্পিউটার খুঁজে স্থাপত্য ও স্থানীয় ইতিহাস সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করেন।

রুমি ও অনির্বাণের অনুসন্ধান যত গভীর হয়, ততই প্ল্যাটফর্মের অতীত রহস্যের জট খুলতে থাকে। তারা জানতে পারে, ষাটের দশকে এই প্ল্যাটফর্মের অনেক যাত্রী একই ধরনের অজানা কণ্ঠ শুনে ভীত হয়েছেন, যা পরবর্তীতে সংবাদপত্রেও স্থান পেয়েছিল। রুমি যুক্তি দেখাতে চেষ্টা করে বলেন, “এটি হয়তো কোনো ধ্বনিতত্ত্বের ফল, বা বাতাস ও কাঠামোর মিলে তৈরি কোনো প্রতিধ্বনি। অনেকবার মানুষ অতীতের ঘটনার সঙ্গে যুক্তি খুঁজে নতুন গল্প বানায়।” কিন্তু অনির্বাণ অনুভব করেন, যা তিনি শুনেছেন তা যুক্তির সীমার বাইরে। প্ল্যাটফর্মের নিঃশব্দতা, হঠাৎ ছায়ামূর্তির উপস্থিতি, এবং কণ্ঠের স্পষ্টতা—সবই এক প্রকার অতিপ্রাকৃততার ইঙ্গিত দেয়। রুমি, যা-ই হোক, তা যাচাই করতে চায়, এবং অনির্বাণও সে সঙ্গে রাজি হয়; তারা সিদ্ধান্ত নেয়েন, সরাসরি প্ল্যাটফর্মে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করবেন। এই পর্যবেক্ষণের প্রস্তুতি নেওয়া এবং তথ্য সংগ্রহের মধ্যেই তাদের মধ্যে কৌতূহল এবং উদ্বেগ ক্রমশ মিশে যায়।

শেষে তারা একসাথে প্ল্যাটফর্মে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন, যেখানে অনির্বাণ তার অভিজ্ঞতা পুনরায় যাচাই করবেন এবং রুমি যুক্তিবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে তত্ত্ব যাচাই করবেন। রুমি স্থানীয় রেলকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন, এবং জানতে পারেন, প্ল্যাটফর্মের নির্দিষ্ট কিছু সময়ে অনিয়মিত ঘটনা ঘটেছে, যা কেউ সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেনি। তারা দেখতে পান, ছায়ামূর্তিগুলো নির্দিষ্ট সময়ে স্থির থাকে, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাদের নিয়ন্ত্রণ করছে। অনির্বাণ এবং রুমি একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করতে করতে অনুভব করেন, যে এই প্ল্যাটফর্মের রহস্য শুধুমাত্র অতীতের ঘটনা নয়; এটি কোনো বৃহত্তর, অজানা শক্তির ইঙ্গিত বহন করছে।

রুমি চক্রবর্তী গভীর মনোযোগ নিয়ে প্ল্যাটফর্মের অতীত অনুসন্ধান শুরু করলেন। তিনি পুরনো নথিপত্র, সংবাদপত্রের আর্কাইভ এবং স্থানীয় ইতিহাসের বই খুঁজতে লাগলেন। তার লক্ষ্য ছিল—যে “অদ্ভুত কণ্ঠ” এবং ছায়ামূর্তির কথা অনির্বাণ বলেছিল, তার পেছনের বাস্তবতা বোঝা। সে প্রতিটি পুরনো প্রতিবেদনের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করছিল; অনেকগুলো ঘটনা যেখানে যাত্রীরা হঠাৎ এক অজানা কণ্ঠ শুনে আতঙ্কিত হয়েছেন বা ছায়া দেখেছেন। কিছু প্রতিবেদনে এমনও লেখা ছিল, যা তখনকার দিনে সমালোচকরা অন্ধকার এবং কল্পনাশক্তির খেলায় ফেলে দিয়েছিলেন। রুমি লক্ষ্য করলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে, কিন্তু কখনও তা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়নি। তিনি নিজেকে ভাবলেন, হয়তো এই প্ল্যাটফর্মের স্থাপত্য, বাতাসের গতি বা অন্য কোনো বাস্তব কারণ থাকতে পারে, কিন্তু কিছু তথ্য এতটাই রহস্যময় যে তা সহজ যুক্তিতে মেলানো যায় না।

অন্বেষণের সময় অজয় সেনের সাহায্য রুমির জন্য অমূল্য প্রমাণিত হয়। অজয়, যিনি নিয়মিত এই প্ল্যাটফর্মে যাতায়াত করেন, ছোটখাটো তথ্য এবং স্থানীয় কথাবার্তা শেয়ার করেন। তিনি জানান, বহু বছর ধরে যাত্রীরা অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন—কখনও কেউ দেখে অচেনা ছায়ামূর্তি ভেসে বেড়াচ্ছে, কখনও হঠাৎ শোনা যায় অজ্ঞাত কণ্ঠ, যা বাস্তবিকভাবে কেউ উচ্চারণ করতে পারে না। রুমি এই তথ্যগুলোকে তার বিশ্লেষণের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন, এবং লক্ষ্য করেন যে কিছু ঘটনা ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, কিন্তু কিছু একেবারেই অজানা এবং ব্যাখ্যাতীত। অজয়ের দেওয়া ছোটখাটো তথ্যও তখন রহস্যের আকার আরও বড় করে, যেন প্ল্যাটফর্মের প্রতিটি প্রান্তে লুকিয়ে আছে কোনো অতিপ্রাকৃত গল্প। রুমি বুঝতে পারেন, এই স্থানটি শুধুমাত্র শারীরিক বাস্তবতার অংশ নয়; এটি অতীত, অতিপ্রাকৃত এবং মানুষের মনোভাবের এক অদ্ভুত মিশ্রণ।

রুমি যখন প্রতিটি নথি এবং তথ্য যাচাই করে যাচ্ছেন, তখন তার মধ্যে একটি গভীর উপলব্ধি জন্মায়—প্ল্যাটফর্মের ইতিহাস এবং রহস্যের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম সংযোগ রয়েছে, যা সময় এবং বাস্তবতার সীমা অতিক্রম করে। কিছু ঘটনা সত্যিই ঘটেছে এবং তা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু কিছু ঘটনা এতটাই অজানা যে তা কোনো যুক্তির সীমার মধ্যে ফেলা যায় না। রুমি অনুভব করেন, এই রহস্য শুধুমাত্র অতীতের কাহিনী নয়; বরং এটি এখনো প্ল্যাটফর্মের মধ্যে জীবিত, এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করছে।

প্ল্যাটফর্মের নীরবতা আরও ঘন হয়ে আসে, এবং হঠাৎই সেই অজ্ঞাত ব্যক্তি আবার উপস্থিত হয়। অনির্বাণের দৃষ্টি ঠিক তার দিকে আটকায়—ছায়ার মতো অন্ধকাররেখা, যা স্পষ্ট রূপ ধারণ করে না, শুধু একটি উপস্থিতির অনুভূতি ছড়ায়। তার পদক্ষেপ শুনতে পাওয়া যায় না, তবুও বাতাসে অদ্ভুত কম্পন অনুভূত হয়। অনির্বাণ শ্বাস আটকে তাকিয়ে থাকে, কারণ এবার কেবল শব্দ নয়, বরং ব্যক্তি নিজেই যেন প্রকটভাবে তার সামনে উপস্থিত হয়েছে। হঠাৎই সেই অজ্ঞাত কণ্ঠ স্পষ্টভাবে তার কানে ধাক্কা দেয়, আর অনির্বাণ শুনতে পায় ভবিষ্যতের কিছু খবর—একটি ঘটনা যা তার জীবনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। শব্দগুলো এতই স্পষ্ট এবং তীক্ষ্ণ যে অনির্বাণ বুঝতে পারে, এটি কোনো সাধারণ কল্পনা নয়। তার শরীর কেঁপে ওঠে, হাতগুলো হালকা কাপতে শুরু করে, এবং হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়।

অজ্ঞাত কণ্ঠের উপস্থিতি এবং বার্তাগুলি অনির্বাণকে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বে ফেলে। সে একদিকে ভয় পায়—কারণ যা শুনেছে তা এতটাই অপ্রত্যাশিত এবং বিপজ্জনক যে তা মোকাবেলা করা সহজ নয়। অন্যদিকে, তার মনোরঞ্জনের উৎসাহও তীব্র, কারণ এটি এমন কোনো তথ্য যা তার জীবন এবং চারপাশের ঘটনাকে সম্পূর্ণ নতুন আলোতে দেখাতে পারে। কণ্ঠটি কখনও কোমল, কখনও তীব্র, কখনও চাপের মতো, যেন সে শুধু বার্তা দিচ্ছে না, বরং অনির্বাণকে পরীক্ষা করছে। অনির্বাণ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করে, কিন্তু বার্তার প্রকটতা এবং অজ্ঞাত ব্যক্তির রহস্যময় উপস্থিতি তাকে আবদ্ধ করে। প্ল্যাটফর্মের বাতাসে হালকা কম্পন, ছায়ার অদৃশ্য নড়াচড়া, এবং শব্দের প্রতিধ্বনি—সবই এক অদ্ভুত একাত্ম শক্তি তৈরি করে, যা অনির্বাণের ভয় এবং উত্তেজনাকে একত্রিত করে।

এই ঘটনার মধ্য দিয়ে কাহিনীতে প্রথমবারের মতো অতিপ্রাকৃত উপাদান প্রবেশ করে। অজ্ঞাত কণ্ঠ কেবল ভবিষ্যতের খবর প্রদান করছে না; এটি অনির্বাণের চেতনার গভীরে প্রবেশ করে, তাকে ভাবাচ্ছে, বুঝতে চেষ্টা করাচ্ছে, এবং পরীক্ষা করছে। অনির্বাণ অনুভব করে, এই প্ল্যাটফর্মের রহস্য শুধুমাত্র ইতিহাস বা অতীতের গল্প নয়—এটি এক ধরণের জীবন্ত শক্তি, যা সময়ের সীমা অতিক্রম করতে সক্ষম। তার ভয় এবং উত্তেজনা একসঙ্গে বৃদ্ধি পায়, কারণ সে বুঝতে পারে, যা ঘটছে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

অজ্ঞাত কণ্ঠের ভবিষ্যতের খবর শোনার পর অনির্বাণের জীবন ক্রমশ পরিবর্তিত হতে থাকে। প্রথমদিকে তিনি নিজের কাজে মনোযোগ রাখতে পারছিলেন না; নতুন তথ্য এবং বার্তাগুলোর প্রভাব তার প্রতিদিনের রুটিনে প্রবেশ করে। অফিসে ছোটখাটো ভুল বাড়তে থাকে, মিটিংয়ে মনোযোগ কমে যায়, এবং সহকর্মীরা তাঁর আচরণে অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করে। এছাড়া ব্যক্তিগত জীবনেও প্রভাব পড়ে—বন্ধু এবং পরিবারকে তিনি ঠিকমতো সময় দিতে পারছেন না। রুমি এই সময়ে অনির্বাণকে মানসিক সমর্থন দেয়, তাকে বুঝিয়ে বলেন যে, সব কিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে হলেও তার মনের স্থিরতা বজায় রাখা জরুরি। রুমি তার যুক্তিবাদী মন দিয়ে অনির্বাণকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন, এবং তাকে মনে করিয়ে দেন যে, পরিস্থিতি যতই জটিল হোক, তাদের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারে।

অজয় সেনও অনির্বাণকে কিছু সতর্কতা দেন। তিনি জানিয়ে দেন, এই প্ল্যাটফর্মে যা ঘটে যাচ্ছে, তা শুধুমাত্র একটি অভিজ্ঞতা নয়; এটি অনির্বাণের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। অজয় বলেন, “তুমি যতই প্রস্তুত হও, এই ধরনের তথ্য কখনও কখনও আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে উল্টে দিতে পারে। সাবধান হও, কিন্তু ভয় পেও না।” অনির্বাণের মধ্যে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব তৈরি হয়—একদিকে ভবিষ্যতের খবর জানার উত্তেজনা, অন্যদিকে জীবনের নিয়মিত কাজের চাপ এবং সম্পর্কের দায়িত্ব। সে বুঝতে শুরু করে, এই নতুন অভিজ্ঞতা শুধুমাত্র আতঙ্ক বা রহস্য নয়; এটি তার ব্যক্তিত্ব এবং জীবনের সিদ্ধান্তগুলোর ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে।

একই সময়ে, এই ঘটনা অনির্বাণ এবং রুমির সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করে। রুমি অনির্বাণের সঙ্গে বসে পরিকল্পনা করতে থাকেন, নথি এবং পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ করেন, এবং একে অপরের সঙ্গে কথোপকথনে তারা এক ধরনের মানসিক সমন্বয় তৈরি করেন। এই সমর্থন অনির্বাণকে স্থিরতা দেয়, কিন্তু রহস্য আরও জটিল হয়ে ওঠে—কারণ ভবিষ্যতের বার্তা আরও স্পষ্ট, আরও প্রভাবশালী, এবং অনেকাংশে অজানা।

অনির্বাণ এবং রুমি উপলব্ধি করেন, যে প্ল্যাটফর্মের রহস্য কেবল শোনার বা পর্যবেক্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি তাদের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলছে। অজ্ঞাত কণ্ঠের বার্তা এবং প্ল্যাটফর্মের অতিপ্রাকৃত উপাদান অনির্বাণের কাজ, সম্পর্ক এবং মানসিক অবস্থায় ক্রমশ প্রভাব ফেলছে। প্রথম দিকে তারা উভয়ই ভয় পেয়েছিলেন—ভয় যে শুধুই অজ্ঞাত কণ্ঠের কারণে নয়, বরং এটি জীবনের নিয়মিত নিয়ন্ত্রণকে কিভাবে হেলাফেলা করছে তার। অনির্বাণর ভয় এবং উত্তেজনার মধ্যে অদ্ভুত এক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়; সে জানে যে ভবিষ্যতের খবর জেনে তার জীবন সহজ হতে পারে, কিন্তু একই সঙ্গে এটি বিপদও ডেকে আনতে পারে। রুমি তার যুক্তিবাদী মন দিয়ে অনির্বাণকে বোঝান, যে শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণ বা অনুমানই যথেষ্ট নয়; তারা সিদ্ধান্ত নিতে হবে—এই প্ল্যাটফর্মের ক্ষমতা এবং অজ্ঞাত কণ্ঠের উদ্দেশ্য পরীক্ষা করা।

উভয়েই পরিকল্পনা শুরু করেন, প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ এবং ছোটখাটো পরীক্ষা করার। তারা নোটবুক, ক্যামেরা, এবং সরল মনোবিজ্ঞান ব্যবহার করে প্রতিটি ঘটনা এবং শব্দের তীব্রতা, স্থান, সময় এবং ধ্বনিতত্ত্ব বিশ্লেষণ করতে থাকেন। তারা লক্ষ্য করেন যে, প্ল্যাটফর্মের নির্দিষ্ট প্রান্তে এবং নির্দিষ্ট সময়ে কিছু অদ্ভুত প্রতিধ্বনি ঘটে, যা অন্য সময়ে হয় না। রুমি যুক্তি দেখিয়ে বলেন, “এটি কেবল ঘন নিঃশব্দ বা হাওয়ার ধ্বনি নয়, বরং এটি কোনো পরিকল্পিত বা স্বতঃসিদ্ধ ঘটনা। আমাদের লক্ষ্য হবে, এটি কেন এবং কিভাবে ঘটছে তা বোঝা।” অনির্বাণও ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে, যে এই প্ল্যাটফর্ম শুধুমাত্র অতীতের ঘটনা বা অজ্ঞাত কণ্ঠের স্থান নয়; এটি একটি জীবন্ত রহস্য, যা ভবিষ্যতের ঘটনার দিকে ইঙ্গিত দেয় এবং তাদের পরীক্ষা করে।

পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্মের প্রভাব এবং অজ্ঞাত কণ্ঠের উদ্দেশ্য কিছুটা পরিষ্কার হতে শুরু করে। অনির্বাণ উপলব্ধি করেন, কণ্ঠ কেবল ভবিষ্যতের খবর দিচ্ছে না; এটি তাদের প্রতিক্রিয়া, মনোভাব এবং সিদ্ধান্তের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করছে। রুমি এবং অনির্বাণ একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করে বোঝার চেষ্টা করেন, যে কোন বার্তা বাস্তব এবং কোনটি অতিপ্রাকৃত। তারা বুঝতে পারে, এই বিপদ এবং পরীক্ষা তাদের মানসিক শক্তি, সংবেদনশীলতা এবং কৌতূহলকে তীক্ষ্ণ করছে।

অনির্বাণ ও রুমি ক্রমশ বুঝতে শুরু করেন যে প্ল্যাটফর্মের রহস্য কেবল অতীতের ঘটনা নয়; বরং এটি অতীত ও ভবিষ্যতের এক অদ্ভুত সংযোগস্থল। তারা প্রতিটি নথি, সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, এবং প্ল্যাটফর্মে তাদের নিজের পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ করে। প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি অজ্ঞাত কণ্ঠ, এবং প্রতিটি ঘটনার সময়কে মিলিয়ে তারা দেখতে পান একটি ধাঁধার মতো নিখুঁত প্যাটার্ন। রুমি যুক্তি এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ধরে রাখেন যে, কিছু ঘটনার পুনরাবৃত্তি শুধু সমসাময়িক কাণ্ড নয়; এটি ভবিষ্যতের দিকে ইঙ্গিত করছে। অনির্বাণের মনোযোগ এবং কৌতূহল ক্রমশ তীব্র হয়, কারণ প্রতিটি তথ্য তাকে একটি নতুন দিক দেখাচ্ছে, এবং সবশেষে এটি পরিষ্কার হচ্ছে যে প্ল্যাটফর্মের অতীত ইতিহাস এবং অজ্ঞাত কণ্ঠ ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ঘটনাগুলোর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।

অজয় সেনও এই পর্যায়ে তাদের সাহায্য করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে। তিনি পুরনো রেলকর্মীদের কথোপকথন এবং স্থানীয় কিংবদন্তি শেয়ার করেন, যা প্রমাণিত করে যে প্ল্যাটফর্মে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা ইতিহাসের অংশ। তার দেওয়া তথ্য অনির্বাণ এবং রুমির জন্য মূল চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে। তারা প্রতিটি ঘটনাকে সময়ের ক্রমে সাজিয়ে রাখেন এবং ধীরে ধীরে দেখতে পান, প্ল্যাটফর্মের প্রতিটি অদ্ভুত ঘটনার পেছনে এক ধরনের গাণিতিক এবং প্রতিসাম্যপূর্ণ নিদর্শন লুকানো। এটি শুধু অতীতের প্রমাণ নয়; বরং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা এবং সতর্কবার্তার দিকেও ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই পর্যবেক্ষণ অনির্বাণ এবং রুমিকে শক্তি দেয়, এবং তারা বুঝতে পারেন, যে তারা রহস্যের এক অর্ধেক সত্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছেন।

শেষে, অনির্বাণ এবং রুমি একত্রে সমস্ত তথ্য যাচাই করে এবং একটি যৌক্তিক বিশ্লেষণ তৈরি করেন। তারা দেখেন, প্ল্যাটফর্মের অতীত, অজ্ঞাত কণ্ঠ এবং ভবিষ্যতের বার্তার মধ্যে একটি সূক্ষ্ম এবং অবিচ্ছিন্ন সংযোগ রয়েছে। ছায়ামূর্তিগুলো, বাতাসের কম্পন, এবং প্রতিধ্বনি কেবল নির্দিষ্ট সময়ে এবং নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে ঘটে, যা প্রমাণ করে এটি স্বতঃসিদ্ধ নয়। রুমি এবং অনির্বাণ উপলব্ধি করেন যে, রহস্যের সমাধান কেবল তথ্যের সন্নিবেশ নয়; এটি মানসিক প্রস্তুতি, পর্যবেক্ষণ, এবং সাহসিকতার ফল।

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়ের মনে একটি অদ্ভুত উত্তেজনা এবং ভয় মিলেমিশে কাজ করছে যখন সে প্ল্যাটফর্মের চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়। এই মুহূর্তে তার সব আগের অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ একত্রিত হয়—অতীতের ছায়া, অজ্ঞাত কণ্ঠের বার্তা, এবং রুমির সহায়তায় সংগৃহীত তথ্য সবই তার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। অনির্বাণ বুঝতে পারেন, এটি শুধু একটি পরীক্ষা নয়; এটি তার মানসিক শক্তি, সাহসিকতা এবং নিজের বিশ্বাসের সত্যতা যাচাই করার মুহূর্ত। প্ল্যাটফর্মের নীরবতা যেন তার মনকে আরও স্পষ্টভাবে শোনাচ্ছে, প্রতিটি ছায়া এবং কম্পন তার সতর্কতা বাড়াচ্ছে। তিনি ধীরে ধীরে পদক্ষেপ বাড়ান, এবং মনে করেন যে, এবার কেবল পর্যবেক্ষণ বা ধারণা নয়—প্রত্যক্ষভাবে সবকিছু যাচাই করতে হবে।

পরীক্ষার শুরুতেই অনির্বাণ অনুভব করেন কণ্ঠের বার্তাগুলি শুধু শোনা নয়, বরং প্রতিটি শব্দ এবং প্রতিধ্বনি বাস্তবে ঘটবে এমন ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রতিটি বার্তা তার মনের ভিতরে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়, এবং প্ল্যাটফর্মের ছায়া তার দিকেই ঘুরে আসে। প্রথমে কিছু বার্তা বাস্তবায়নের চেষ্টা ব্যর্থ হয়, যা তার ভয়কে আরও বাড়িয়ে দেয়। তবে ধীরে ধীরে তার দৃষ্টি, মনোযোগ এবং বিশ্লেষণ ক্ষমতা একত্রিত হয়ে বার্তার প্রভাব বোঝার সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। অনির্বাণ বুঝতে পারেন যে, বার্তা শুধুমাত্র ভবিষ্যতের ঘটনা নয়; এটি তার নিজের প্রতিক্রিয়া, মানসিক স্থিতি এবং সাহসিকতার ওপর নির্ভর করছে। রুমি তার পাশে দাঁড়িয়ে মানসিক সমর্থন দেয়, এবং অজয়ের পূর্বের সতর্কতা মনে করিয়ে দেয়—যে এই পরীক্ষা কেবল সত্য যাচাই নয়, বরং তার নিজের ভিতরের শক্তিকে পরীক্ষা করার সুযোগ।

শেষপর্যায়ে, অনির্বাণ বার্তাগুলোর প্রভাব এবং বাস্তবতার মধ্যে সুক্ষ্ম মিল খুঁজে পান। তিনি উপলব্ধি করেন যে, প্ল্যাটফর্মের রহস্য কেবল অতীত বা ভবিষ্যতের তথ্য নয়; বরং এটি তার মন, সাহসিকতা, এবং রুমির সঙ্গে সম্পর্কের দৃঢ়তার পরীক্ষা। প্রতিটি বার্তা এবং প্রতিধ্বনি সফলভাবে যাচাই হয়, এবং অনির্বাণের মধ্যে আত্মবিশ্বাস এবং স্থিরতা তৈরি হয়।

অনির্বাণ, রুমি এবং সেই অজ্ঞাত ব্যক্তির মধ্যে এক অদ্ভুত মিলন ঘটে, যখন সব রহস্যের চাবিকাঠি ধীরে ধীরে তাদের সামনে উন্মোচিত হয়। প্ল্যাটফর্মের নীরবতা, ছায়ামূর্তি এবং অজ্ঞাত কণ্ঠ—সবই একটি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বহন করছিল। অনির্বাণ বুঝতে পারেন, “ভবিষ্যতের খবর” শুধুমাত্র একটি সতর্কবার্তা বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পূর্বাভাস নয়; এটি মানুষের মনকে পরীক্ষার মাধ্যমে প্রস্তুত করার একটি মাধ্যম। প্রতিটি বার্তা ছিল তার অন্তর্দৃষ্টি এবং পর্যবেক্ষণের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য, যাতে সে নিজেই পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করতে শিখে। রুমি এই মুহূর্তে অনির্বাণকে বোঝান, যে প্ল্যাটফর্মের অতিপ্রাকৃত শক্তি শুধুমাত্র তথ্য প্রেরণ করছে না; এটি মানুষের মানসিক শক্তি, সংবেদনশীলতা এবং সাহসিকতার সঙ্গে খেলা করছে, যেন তারা নিজেরাই সত্য এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়।

অজয় সেন এবং অন্যান্য প্রাপ্ত তথ্যের সাহায্যে তারা বুঝতে পারেন, প্ল্যাটফর্মের অতীত ইতিহাস এবং ঘটনার পুনরাবৃত্তি কেবল অজানা শক্তির খেলা নয়; বরং এটি একটি সুক্ষ্ম সিস্টেম, যা সময়ের ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে। অজ্ঞাত ব্যক্তি, যিনি প্রথমে কেবল ছায়া এবং প্রতিধ্বনি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, আসলে সেই শক্তির মধ্যস্থতা হিসেবে কার্যকর হচ্ছেন। তিনি তাদেরকে সরাসরি নির্দেশনা দেন না, বরং পর্যবেক্ষণ এবং সিদ্ধান্তের মাধ্যমে শেখার সুযোগ দেন। অনির্বাণ এবং রুমি লক্ষ্য করেন, এই রহস্য তাদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেছে—মানসিক শক্তি, বিশ্লেষণ ক্ষমতা এবং একে অপরের প্রতি বিশ্বাসের শক্তি পরীক্ষা করা হয়েছে। ধীরে ধীরে তারা উপলব্ধি করেন যে, প্ল্যাটফর্ম এবং অজ্ঞাত কণ্ঠের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো মানুষের অন্তর্দৃষ্টি এবং আত্মবিশ্বাসকে প্রখর করা, যেন তারা নিজেই জীবনের জটিল সিদ্ধান্তে সচেতন ও সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারে।

শেষে, সব তথ্য, পর্যবেক্ষণ এবং প্রমাণ একত্রিত হয়ে চরিত্রদের মধ্যে শান্তি এবং নবরূপের উপলব্ধি জন্মায়। অনির্বাণ বুঝতে পারেন, প্ল্যাটফর্মের ক্ষমতা বা ভবিষ্যতের বার্তা কেবল জানার জন্য নয়; এটি শেখার এবং আত্ম-উন্নয়নের জন্য। রুমি তার যুক্তিবাদী দৃষ্টিকোণ এবং মানসিক সমর্থনের মাধ্যমে অনির্বাণকে আরও দৃঢ় করে তোলে, আর অজয় ও অজ্ঞাত ব্যক্তির উপস্থিতি পুরো পরিস্থিতিকে বাস্তব ও অতিপ্রাকৃতের মধ্যে একটি নিখুঁত সংযোগে পরিণত করে।

****

1000062223.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *