সৌমিক ভট্টাচার্য
১
পাহাড়ি রাস্তাগুলো যেন কোনও অজানা গন্তব্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল অভিজিৎ সেনগুপ্তকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের গবেষক, লোকবিশ্বাস এবং পাহাড়ি সংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘদিনের আগ্রহ ছিল তার। একটি গবেষণা প্রকল্পের সূত্রে সে এবার রওনা দিয়েছিল উত্তরবঙ্গের এক অদ্ভুত দূরবর্তী গ্রামে—সিংরিপাহাড়। ট্রেন থেকে নামার পর পায়ে হেঁটে, জিপে চড়ে, শেষমেশ খচ্চর পিঠে চেপে পৌঁছাতে হয়েছিল তাকে সেই দুর্গম স্থানে। পাহাড়গুলো যেন দাঁড়িয়ে ছিল এক অভেদ্য প্রাচীর হয়ে—মানুষের সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন, অথচ নিজেদের মতো করে সাজানো এক অলৌকিক গ্রাম। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অবস্থিত ছোট্ট গ্রামটিতে ঢুকতেই চোখে পড়ল ছায়াঘেরা গাছপালা, পাথরের বাড়ি, আর সন্ধ্যার আগেই বন্ধ হয়ে আসা কুড়িটি দরজা-জানালা। অভিজিৎ তার ক্যামেরা ও নোটবুক ব্যাগে পুরে, সোজা এগিয়ে গেল যেই মেয়েটি তার থাকার ব্যবস্থা করেছিল—গায়ত্রী। পরিচিত হয়েছিল আগে থেকেই চিঠিপত্রে। স্কুলশিক্ষিকা, গ্রামের মধ্যে অল্পশিক্ষিতদের একজন, এবং অভিজিতের গবেষণায় আগ্রহও ছিল তার। কিন্তু গ্রামের চারপাশে যেন কোনও অদৃশ্য আবরণে মোড়া এক চাপা ভয় কাজ করছিল। হাঁটতে হাঁটতে সে দেখতে পেল, রাস্তার মোড়ে কালো পাথরের তৈরি এক বিশাল কালীমূর্তি। চোখে তীব্র রাগ, জিভ বের করা, গলায় কাটা মুণ্ডের মালা। মূর্তির সামনে মোম জ্বলছে, ধূপ ধোঁয়ার ঘ্রাণ ছড়িয়ে রয়েছে চারদিকে, আর রাস্তা ফাঁকা—কোনও শব্দ নেই, কেবল হাওয়ার ফিসফিস।
গায়ত্রী তাকে অভ্যর্থনা জানাল ঠিকঠাকভাবেই, কিন্তু তার চোখের ভিতরেও একটা চেপে রাখা আতঙ্ক ছিল। “আজ সন্ধ্যার পর বাইরে বেরোনো উচিত নয়,” বলল সে। “এই সময়টা একটু… সংবেদনশীল।” অভিজিৎ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। “কেন? আজ কি কোনও উৎসব?” গায়ত্রী একটু থেমে বলল, “না… আগামী মাসে কালরাত্রি আসছে। লোকজন এখন থেকেই সাবধান থাকে।” অভিজিৎ প্রথমবার এই শব্দটা শুনল—কালরাত্রি। সে জানত, এই অঞ্চলে কালীপূজা অনেকটাই আলাদা রীতিতে হয়, কিন্তু প্রতি দশ বছর অন্তর এমন কিছু পালিত হয়, তা তার জানা ছিল না। সে গায়ত্রীর কথায় হেসে উড়িয়ে দিল, “এগুলো লোকবিশ্বাস মাত্র। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।” কিন্তু মেয়েটির মুখ থমথমে, হঠাৎ চোখ নামিয়ে বলল, “আপনি যা ভাবেন, সব সময় ঠিক হয় না। এই মন্দিরে কিছু আছে, যা আপনি বোঝেন না, এবং আমি বোঝাতে পারব না।” সেই রাতেই সে বুঝতে পারল, এই গ্রাম যুক্তির বাইরের কোনও নিয়মে চলে। রাত দশটার আগেই সব আলো নিভে গেল। জানালার ফাঁক দিয়ে অভিজিৎ দেখতে পেল, এক ছায়ামূর্তি মন্দিরের দিকে যাচ্ছে, হাতে কিছু একটা—যেন পাঁঠার মাথা। দূরে দূরে বাজতে থাকল কাঠের ঢাক, খুব ধীরে। সেই আওয়াজ যেন সময়ের সঙ্গে এক অদ্ভুত ছন্দে মিশে গেল।
পরদিন সকালে সে বেরিয়ে পড়ল কালী মন্দির দেখতে। মন্দিরটি পাহাড়ের ঢালে গড়া, পুরনো পাথর খোদাই করা স্থাপত্য। প্রবেশপথে বড় পিতলের দরজা, ওপরে ঝুলছে কয়েকটা শুকনো বেলপাতা, লাল সুতোর মালা। ভিতরে প্রবেশ করতেই যে তীব্র গন্ধ তার নাকে এল, তা ধূপ-ধূনা নয়, বরং রক্তের ঘ্রাণ। অভিজিৎ তার নাক টিপে ধরল, এবং দেখল ভেতরে একটা পুরোনো মঞ্চ, তার উপরে বিশাল এক কালীমূর্তি। পাথরের তৈরি সেই দেবীমূর্তি যেন জ্যান্ত, চোখ দুটি বড় বড় করে যেন তাকিয়ে আছে তার দিকে। পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন মাধব ঠাকুর—গ্রামের প্রধান পুরোহিত। গা ভর্তি ছাই মাখা, চোখে তীব্রতা, হাতে রুদ্রাক্ষের মালা। অভিজিৎ তার সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করে বলল, “আমি লোকবিশ্বাস নিয়ে গবেষণা করছি। শুনলাম কালরাত্রি নামে কিছু হয় এখানে?” মাধব ঠাকুর একটুও বিস্মিত না হয়ে বললেন, “হয়। আর হবে। আর আপনি এখানে থাকলে দেখতেও পাবেন।” তার গলায় যেন ছিল না ভয়, বরং ছিল নিরাবেগ এক দৃঢ়তা। অভিজিৎ তখনো বুঝতে পারেনি, সেই রাত তার জীবনের গতিপথ পাল্টে দেবে। পুরোহিত বললেন, “আপনারা শহরের মানুষ। ভাবেন সবকিছু যুক্তিতে বোঝা যায়। কিন্তু দেবী কালী—তিনি যুক্তি দিয়ে চলে না। তিনি রক্ত চায়। আর যখন সময় আসে, তিনি নিজেই সেটা নিয়ে নেন।”
রাত বাড়তেই আবার পরিবেশ পাল্টে গেল। মন্দির থেকে দূরের একটা ঘর থেকে ভেসে এল তন্ত্রমন্ত্রের মৃদু ধ্বনি। গায়ত্রী অভিজিতের পাশে এসে দাঁড়াল, কাঁপা গলায় বলল, “আপনি জানেন না, আপনি কোথায় এসেছেন। এখানে রাতের পরিণতি অনেক সময় ভোর পর্যন্ত পৌঁছায় না।” অভিজিৎ চেষ্টা করছিল নিজেকে যুক্তিবাদী ভাবতে, কিন্তু ঘর, মন্দির, পথঘাট সবকিছুতেই এক অদৃশ্য অনিচ্ছা ছড়িয়ে রয়েছে যেন। সে ভাবল, কালরাত্রি কি শুধুই আচার? না কি এর পেছনে রয়েছে এমন কিছু, যা মানুষ বোঝে না, বোঝার চেষ্টা করলেও পিছু টানে অন্ধকারে? সে জানত, গবেষণা করতে এসে শুধু তথ্য নয়, তার নিজস্ব অনুভব, ভয়, আর দৃঢ়তা নিয়েই তাকে দাঁড়াতে হবে মন্দিরের মুখোমুখি। হয়তো এই গল্পের ভিতরে এমন কিছু আছে, যা সে লিখবে না—কারণ কেউ বিশ্বাস করবে না। মোমের আলো নিভে যাওয়ার আগেই সে বুঝতে পারল—এখানে শুধু দেবী নেই, আছে এক ঘুমন্ত প্রাচীন শক্তি, যার জাগরণে সময় থমকে যেতে পারে।
২
পরদিন ভোরে অভিজিৎ ঘুম ভাঙতেই প্রথম যে জিনিসটা অনুভব করল, তা হলো ঘরের মধ্যে এক ধরনের গন্ধ—কঠিনভাবে বর্ণনা করা যায় না, যেন পুরনো রক্ত আর ধূপধূনার মিশ্রিত এক দুর্গন্ধ। জানালার কপাট খুলতেই এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস মুখে এসে পড়ল, কিন্তু তার সাথেই ঘাড়ের পেছনে কাঁটার মতো বয়ে গেল এক অনুভূতি—কেউ যেন তাকিয়ে আছে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, পাহাড়ের ঢালে বসে এক বুড়ো লোক তাকিয়ে আছে তার দিকেই। অভিজিৎ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গায়ত্রীকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, “ওই বৃদ্ধ লোকটা কে?” গায়ত্রী হালকা গলায় বলল, “ও বদ্রীনাথ দা। গ্রামে অনেক বছর ধরে আছেন। কালীমন্দির আর কালরাত্রি নিয়ে অনেক কিছু জানেন। কিন্তু সবসময় অদ্ভুত কথা বলেন। ভয় পাবেন না।” গলার স্বরে অনুরোধ থাকলেও অভিজিতের মনে তৈরি হতে লাগল অস্বস্তি। কেন কেউ সকাল সকাল তার জানালার বাইরে বসে থাকবে? সে ঠিক করল, আজই সে মন্দিরে ফিরে যাবে আরও কিছু ছবি তুলতে, খোদাইগুলো বিশ্লেষণ করবে। এবং সেইসাথে খুঁজে বের করবে—কালরাত্রির ইতিহাস কোথা থেকে এল।
মন্দিরে পৌঁছে অভিজিৎ প্রথমেই লক্ষ্য করল, পুরোহিত মাধব ঠাকুর আজ একেবারেই অন্যরকম। চুপচাপ বসে আছেন যজ্ঞকুণ্ডের সামনে, চোখ বন্ধ, ঠোঁট নড়ে চলেছে। তিনি যেন গভীর কোনো মন্ত্রপাঠে নিমগ্ন। পাশেই পড়ে আছে একটা রক্তমাখা কাপড়, যা দেখে মনে হচ্ছিল সদ্য বলি দেওয়া কোনো পাঁঠার। এই দৃশ্য দেখে অভিজিৎ আরও তীব্র আগ্রহে ঘুরতে লাগল মন্দিরের চত্বর। মাটিতে মিশে থাকা কালো পাথরের খোদাই, দেওয়ালে আঁকা বিভিন্ন কালীমূর্তি, আর একটা খুপরি ঘর—সবকিছুতেই যেন কোনও এক যুগপত ভয় এবং পবিত্রতার গন্ধ ছিল। মন্দিরের এক কোণায় সে খুঁজে পেল কিছু প্রাচীন ধাতব পাত্র, যার মুখে লিপিবদ্ধ অক্ষরগুলি আজকের বর্ণমালার থেকে আলাদা। অভিজিৎ ছবি তুলে রাখল, তার ধারণা—এই খোদাই কোনও প্রাচীন তান্ত্রিক মন্ত্রের অংশ, যেটা হয়তো একাধারে পূজার আচার এবং বলি-প্রথাকে বৈধতা দেয়। হঠাৎ, তার পেছনে পায়ের শব্দ। সে ঘুরে দেখে গায়ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির মুখ থমথমে, কপালে একটা লাল টিপ নেই, চোখে ক্লান্তি। অভিজিৎ তাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি এত সকালে এখানে?” গায়ত্রী শুধু বলল, “আজ রাতে আগুন জ্বলে উঠবে।”
গায়ত্রীর এই রহস্যময় উচ্চারণে অভিজিৎ চমকে ওঠে। সে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি বলতে চাইছ—আজ কিছু হতে চলেছে?” গায়ত্রী চুপ করে থাকে কয়েক মুহূর্ত, তারপর আস্তে বলে, “কালরাত্রির প্রস্তুতি আজ থেকেই শুরু হয়। এক মাস আগে থেকেই। আজ রাত্রে হবে প্রথম রক্তসিঁড়ি। আজ দেবীর পায়ে প্রথম বলির ছায়া পড়বে।” তার গলায় ভয় মেশানো মৃদু সম্মোহন ছিল। অভিজিৎ তার ব্যাগ থেকে নোটবুক বের করে দ্রুত কিছু টুকে নেয়। সে জানত, এমন তথ্য পাওয়া সহজ নয়। কিন্তু তার গবেষকের মন আরও জানতে চায়। “রক্তসিঁড়ি কী জিনিস?” সে জিজ্ঞেস করে। গায়ত্রী উত্তর দেয়, “প্রথম রাত্রিতে দেবীকে জানানো হয় যে তিনি স্বাগত, এবং তাঁর জন্য রক্ত প্রস্তুত। তখন আগুন জ্বলে ওঠে এমনভাবে, যেন মাটির তলায় কিছু জেগে ওঠে। আপনি দেখবেন, কিন্তু ভুলেও নামবেন না মন্দিরের নিচে।” এই শেষ কথাটাই কেমন যেন কাঁটা দিয়ে গেল অভিজিতের গায়ে। সে আর প্রশ্ন করে না। তার মাথায় তখন শুধু একটা কথাই ঘুরছে—মন্দিরের নিচে কী আছে?
রাত নামার আগেই গ্রামে এক অদ্ভুত উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। চারদিকে ধূপের গন্ধ, বাতাসে মৃদু ঢাকের শব্দ, আর গাঢ় অন্ধকার। মন্দিরের দিক থেকে দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল অগ্নিশিখার আভা। অভিজিৎ দূর থেকে দেখতে লাগল, কয়েকজন মানুষ পাথরের কাঁধে কিছু বস্তু তুলে নিয়ে যাচ্ছে, যেন কোনো বলির আয়োজন। হঠাৎ পাহাড়ের মাথা দিয়ে জ্বলতে শুরু করল বিশাল একটি আলো। আগুন যেন স্বয়ং আকাশে উঠছে। গায়ত্রী তখন তার পাশে এসে দাঁড়াল, বলল, “দেখুন, দেবী আগুন গ্রহণ করছেন।” অভিজিৎ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে। সে তার জীবনে বহু পুজো, বহু অনুষ্ঠান দেখেছে, কিন্তু এমন কিছু নয়। হাওয়ার মধ্যে যেন একরকম চাপ সৃষ্টি হচ্ছিল, কানের মধ্যে গুনগুন ধ্বনি, যেন কেউ মন্ত্র পড়ছে, অথচ কেউ চোখে পড়ছে না। আগুনের চারপাশে কয়েকজন কালো কাপড় পরা মানুষ ছায়ার মতো ঘুরছিল। তাদের মুখ দেখা যাচ্ছিল না। মাধব ঠাকুর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “এই আগুন দিয়েই জাগে দেবী। কালরাত্রি এসেছে। আর তোমার আগমনের কারণও সে জানে।” অভিজিৎ বুঝতে পারল—এই গ্রামের গল্পটা কেবল ইতিহাসের পাতায় লেখা নয়, বরং এক ভয়াবহ, রক্তাক্ত বাস্তবতা, যার মাঝে সে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে।
৩
পরদিন সকালেই অভিজিৎ স্থির করল—এবার তার দরকার প্রমাণ, ইতিহাস, এবং লিখিত কিছু তথ্য। গবেষণায় অনুভূতি কাজ করে ঠিকই, কিন্তু প্রমাণ ছাড়া তা মূল্যহীন। গায়ত্রীর সাহায্যে সে পৌঁছাল গ্রামের পুরনো পাঠাগারে, যা এক পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট গুহার মতো তৈরি। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় একটা তেঁতুলগাছের নিচে পড়ে থাকা পরিত্যক্ত ঝুপড়ি, কিন্তু ভিতরে ঢুকতেই বোঝা গেল, এখানে অতীত ঘুমিয়ে রয়েছে। কাঠের তাকগুলোতে ধুলোমাখা বই, খণ্ডিত পাণ্ডুলিপি, পোড়া চিঠি—সব মিলিয়ে যেন এক মৃত ইতিহাসের কবরখানা। এক বৃদ্ধ দায়িত্বে ছিলেন, নাম বললেন – মধুসূদন রায়চৌধুরি। তিনি বললেন, “আপনার মতো শহরের লোক আজকাল আসে না। যা খুঁজছেন, হয়তো পেয়ে যাবেন… যদি দেবী চান।” এই শেষ কথাটা শুনে অভিজিৎ একটু থমকে গেল। সে জানত, এখানকার মানুষজন কথা বলেন রহস্যে মোড়ানো ইঙ্গিতে। কিন্তু এই কথাটির মধ্যে যেন কোনো অলিখিত শর্ত ছিল। সে মাথা নাড়িয়ে বইয়ের স্তূপে ডুবে গেল।
তাকে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। তৃতীয় তাকের এক কোণায় বাঁধাইবিহীন কিছু পাতার গোছা চোখে পড়ল—ছেঁড়া, হলুদ হয়ে যাওয়া, কিছুটা জ্বলে যাওয়া কাগজ, যেগুলোয় লেখা আছে পুরনো কালি দিয়ে, হাতে লেখা এক বিবরণ। লেখকের নাম: তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ গিরি। অভিজিৎ চমকে উঠল। এই নামটি সে আগেই শুনেছে—গায়ত্রী বলেছিল, তিনি ছিলেন এই মন্দিরের আদির তান্ত্রিক, যিনি নিজের শরীর দিয়ে দেবীর আহুতি দিতেন। তার চোখ আটকে গেল এক জায়গায়: “কালরাত্রির সময় যখন সপ্ত রক্তপিণ্ড অর্পণ করা হয়, তখন মন্দিরের নিচে জেগে ওঠে ‘অঘোর শিখণ্ডী’—দেবীর প্রকট রূপ, যিনি অদেখা। তাঁকে না সন্তুষ্ট করতে পারলে, পরের দশ বছর সেই গ্রামে অকালমৃত্যু, দুর্ভিক্ষ ও ছায়ামৃত্যুর ছায়া নেমে আসে।” অভিজিৎ কাঁপা হাতে পাতাগুলো ঘাঁটতে লাগল। পরবর্তী কয়েকটি পৃষ্ঠায় লেখা ছিল বিভিন্ন নাম, যারা বলি হয়েছিল—অনেকের নামের পাশে লেখা ছিল ‘স্বেচ্ছাবলি’, আবার কিছু নামের পাশে শুধু ‘অজ্ঞাত’। কুয়াশার মতো ঘিরে ধরল একটা অনুভব—এটা কেবল মিথ নয়, বরং এমন কিছু যার নথি এখনও আছে। এবং এই সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করে সেই এক রাত্রি—কালরাত্রি।
পাণ্ডুলিপির শেষের দিকে ছিল একটি অদ্ভুত চিত্র, হাতে আঁকা। একটি কালীমূর্তি, যার মুখ কেবল কালো, কোনও চোখ নেই, কপালে তৃতীয় নয়নের জায়গায় রক্তবিন্দু। আর তার পায়ের নিচে বাঁধা একটি মানুষ, যার মুখ নেই। তার শরীর থেকে রক্তপাত হচ্ছে সাতটি পথে। এই ছবিটি দেখে অভিজিৎ অসাড় হয়ে গেল। কোথাও একটা যেন তার হৃদপিণ্ডের ছন্দ বদলে যাচ্ছিল। এই ছবিটির নিচে লেখা—“যে নিজেকে দেয়, সে ফিরে আসে না। তবে সে রয়ে যায়, দেবীর ভিতর।” তার মাথার ভেতরে যেন শব্দ উঠছিল—“রয়ে যায়… রয়ে যায়…” সে বুঝতে পারছিল, কালরাত্রির ভয় শুধু বলি নয়, এক অতল আত্মাহুতির ধারণা, যেখানে আত্মা ধ্বংস হয় না, বরং পরিণত হয় শক্তিতে। মধুসূদনবাবু তখন হঠাৎ বলে ওঠেন, “এই কাগজ গুলো আজ অবধি কেউ খুঁজে পায়নি। আপনি একাই পেলেন। বুঝলেন তো, দেবী চেয়েছেন।” সেই মুহূর্তে বাতাস নিস্তব্ধ হয়ে এল। অভিজিৎ বুঝল, সে এখন আর শুধু একজন গবেষক নয়—সে এই গল্পের অংশ।
গ্রামে ফেরার পথে পাহাড়ি রোদ গায়ে লাগছিল ঠিকই, কিন্তু তার হৃদয়ে জমে উঠছিল অদ্ভুত এক ঠান্ডা। গায়ত্রী তার পথের ধারে দাঁড়িয়েছিল, এবং অভিজিতকে দেখে বলল, “আপনি পাণ্ডুলিপি পেয়েছেন, না?” অভিজিৎ কিছু না বলে মাথা নোয়াল। মেয়েটি ধীরে ধীরে বলল, “তখন থেকেই জানতাম। আপনি এখানে আসার অনেক আগেই আপনার নাম মন্দিরে লেখা হয়েছিল।” সে স্তব্ধ হয়ে গেল। “আমার নাম? কখন?” গায়ত্রী চোখ নামিয়ে বলল, “দশ বছর আগে। শেষ কালরাত্রির পর একজন বলেছিলেন, পরবর্তী যিনি দেবীর রক্ত বন্ধ করবেন, তিনি আসবেন এক নতুন শহর থেকে। তার নাম হবে অভিজিৎ।” সে যেন তার শরীরেই আর ছিল না। বাস্তব ও অলৌকিকের সেই সূক্ষ্ম সীমানা যেটা সে এতদিন গবেষণার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিল, তা এখন নিজের শরীরেই অনুভব করতে পারছিল। এই গ্রাম তাকে ডাকেনি কেবল গবেষণার জন্য, বরং সে যেন ছিল পূর্বনির্ধারিত। এখন তার সামনে দুটি পথ—এই গাঁথা থেকে পিছু হটে পালিয়ে যাওয়া, অথবা নিজেকে জড়াতে দেওয়া সেই রাত্রির ছায়ায়, যা কেবল গল্পে পড়া যায়, কিন্তু সেখান থেকে ফেরার পথ নেই।
৪
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই পাহাড়ি গ্রামের আকাশ যেন কালো অন্ধকারে ঢেকে গেল। বাতাসের মধ্যে এক অজানা স্নিগ্ধতার বদলে ভয়ের শীতলতা ছড়িয়ে পড়ল। অর্ণবের মনে হচ্ছিল, এই সময়টাই যেন মন্দিরের প্রকৃত রূপ প্রকাশ পায়। দিগন্তে সূর্য অস্ত যেতে না যেতেই, গ্রামের কালী মন্দিরের পাশের পুরোনো শ্মশানঘাটে একটা কাঁপুনি-ধরা স্তব্ধতা নেমে এল। সেই স্তব্ধতার মধ্যে হঠাৎ এক কুকুরের আর্তনাদে অর্ণব চমকে উঠল। সে মন্দির থেকে ফিরে আসার সময়, সিদ্ধান্ত নেয় শ্মশানের পাশে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে পরিবেশটা বোঝার চেষ্টা করবে। কিন্তু যতক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়েছিল, তার মনে হচ্ছিল যেন অদৃশ্য চোখগুলো তাকে লক্ষ্য করে চলেছে। পায়ের নিচে শুকনো পাতার খসখস শব্দ, গাছের পাতা নাড়াচাড়া, এমনকি মাঝেমধ্যে পেছন থেকে কারও নিঃশ্বাসের মতো আওয়াজ—সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, এই শ্মশান শুধুই মৃতদের জায়গা নয়, কিছু অদৃশ্য অস্তিত্ব এখানে সহাবস্থান করে।
রাত যত গভীর হতে লাগল, ততই অর্ণবের আশেপাশের পরিবেশ কুয়াশার চাদরে মোড়া হয়ে পড়ল। সে বুঝতে পারল, এই শ্মশান কেবল মৃতদেহ দাহ করার স্থান নয়, বরং এখানেই এক বিশেষ রাত্রিতে ঘটে থাকে ভয়াবহ রক্তাচারের আচার। মন্দিরের প্রধান সেবায়েত কালাচরণ বাবার কথামতো, প্রতি দশ বছর অন্তর, অমাবস্যার রাতে এই শ্মশানের মধ্যেই এক ‘তান্ত্রিক যজ্ঞ’ অনুষ্ঠিত হয়—যেখানে জীবন্ত রক্তের প্রয়োজন হয় দেবীর আরাধনায়। যদিও সরাসরি বলার ভাষা ছিল না, তবু কালাচরণ আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, বহু বছর আগে গ্রামের বাইরে থেকে কেউ এসে এই উৎসর্গের জন্য নিখোঁজ হয়ে যায়। অর্ণবের বুকের মধ্যে এক অজানা আশঙ্কা ঘনিয়ে উঠল—এবছরও কি সেই দশ বছরের ব্যবধান পূর্ণ হয়েছে?
হঠাৎই ঝোপের পাশ থেকে এক ক্ষীণ আলোর রেখা দেখা গেল। প্রথমে ভেবেছিল কেউ হয়তো আগুন জ্বালিয়েছে, কিন্তু একটু ভালো করে তাকিয়ে সে বুঝল, একটি চতুষ্কোণ কাঠের ফ্রেমের ভেতর প্রদীপ জ্বলছে, এবং সেটির সামনে বসে আছে এক শ্মশ্রুমণ্ডিত তান্ত্রিক। তার চোখদুটো অদ্ভুতভাবে অর্ণবের দিকে স্থির, অথচ মুখে কোনও শব্দ নেই। অর্ণব সাহস করে এগোতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই বাতাসের দমকে প্রদীপটা নিভে গেল, আর সেই তান্ত্রিক যেন ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। ভয় ও কৌতূহলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অর্ণব বুঝে উঠতে পারছিল না—এটা কি তার মনের কল্পনা, না কি বাস্তবেরই অন্য এক পর্দা?
শ্মশান থেকে ফিরে আসার পরে, রাতে ঘরে বসে অর্ণব পুরনো নথিপত্র দেখতে শুরু করল। এক জায়গায় সে পেল একটি ১৮৫৭ সালের সংবাদপত্রের ক্লিপিং, যেখানে লেখা ছিল—“বাঙলা হিমালয়ের দক্ষিণভাগে এক অচেনা গ্রামে প্রতি দশকে একবার একজন আগন্তুক নিখোঁজ হয়, এবং গ্রামের মানুষজন তখন বলে—‘মা নিজে বেছে নেন তাঁর উৎসর্গ’। এই লেখাটি পড়ে অর্ণব শিউরে উঠল। লেখকের নাম ছিল: ড. হ্যারল্ড কুপার—এক ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ, যার মৃত্যুর কোনও রেকর্ড পাওয়া যায়নি। আর সবচেয়ে ভয়ের বিষয়, তার মৃত্যুর দিনটি ছিল সেই দশকের অমাবস্যা রাত্রি। অর্ণবের মনে হল, হয়তো আজ রাতেই সেই রাত, এবং হয়তো এবার দেবীর পছন্দের উৎসর্গ সেই-ই। অথচ এখনও তার গবেষণার অনেক বাকি, আর বাস্তব ও অদ্ভুত অতিপ্রাকৃতের সীমারেখা ক্রমশ মুছে যেতে লাগল তার সামনে।
৫
পাহাড়ের কোলে ঘেরা সেই নিঃসঙ্গ গ্রামের নীরবতা যেন হঠাৎ করেই ভারী হয়ে উঠেছিল। পূর্ণিমার রাতে মেঘের ছায়া ছড়িয়ে পড়েছিল পাহাড়ের চূড়ায়, আর তার নিচে দাঁড়িয়ে সঞ্জয় যেন একটা প্রাচীন অভিশাপের মুখোমুখি হচ্ছিল। মন্দিরের পথ ধরে এগোতে এগোতে সে লক্ষ করল, পাথরের সিঁড়িগুলোর উপর কোথাও কোথাও লালচে দাগ শুকিয়ে গেছে—ঠিক যেন রক্তের রেখা। তার হৃদয় কেঁপে উঠল। “এটা কি পুজোর সময়ের কোনো চিহ্ন? নাকি…” – মনে মনে ভাবতেই তার চোখে পড়ল, একটা ছায়া সরে যাচ্ছে সামনের গাছপালার আড়ালে। সে এগিয়ে গিয়ে ডাকল, “কে? কে ওখানে?” কিন্তু কোনো উত্তর এল না, শুধু ঝোপের পাতার নড়াচড়া থেমে গেল। বাতাসটা যেন আরেকটু ভারী হয়ে উঠল, আর কপালের ঘাম ঠান্ডা হলেও বুকের ভেতর একটা অস্পষ্ট আতঙ্ক ধাক্কা দিতে লাগল।
সেই রাতে সঞ্জয় গ্রামের পুরোনো পাণ্ডুলিপির কিছু পাতার অনুবাদ করছিল তার টিনের ট্রাঙ্কের আলোয় বসে। পুরোহিত হরিনাথ তাকে মন্দির সংক্রান্ত কিছু পুরোনো শাস্ত্র দিয়েছিলেন, যেগুলোর অক্ষর ছিল প্রায় মুছে যাওয়া অবধি বিবর্ণ। এক পৃষ্ঠায় লেখা ছিল – “দশবছরের অন্তরে কালের আহুতি লাগে; যদি না হয়, অধর্ম জেগে ওঠে। একপাটি রক্তে স্নান করুক মায়ের পায়ের তলে, তবেই থাকবে গ্রাম নিরাপদ।” সঞ্জয় যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। কোনো ধর্মগ্রন্থে এমন সরাসরি মানব বলির উল্লেখ সে আগে দেখেনি। একটা গা শিরশির করা ঠাণ্ডা তাকে ছুঁয়ে গেল। কিন্তু সে জানত, এই সত্যি প্রকাশ্যে আনতে হলে প্রমাণ চাই। ঠিক করল, কাল রাতেই সে মন্দির পাহারা দেবে। গ্রামে শোনা অদ্ভুত শব্দগুলো, মাঝে মাঝে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া পশু-পাখি—সব কিছুর সূত্র মিলবে একমাত্র সেই রাতে।
পরদিন সন্ধ্যা নামতেই সঞ্জয় তার ক্যামেরা, রেকর্ডার, নোটপ্যাড আর টর্চ নিয়ে উঠে গেল মন্দিরের পেছনের এক পুরোনো বটগাছের আড়ালে। রাত যত বাড়তে থাকল, তত গাঢ় হতে থাকল অন্ধকার, আর তার টেপরেকর্ডারে ধরা পড়তে থাকল এক অদ্ভুত গর্জনের শব্দ—যা পশুরও নয়, মানুষেরও নয়। মাঝরাতের ঠিক আগে, হঠাৎ সঞ্জয় লক্ষ্য করল এক কাঠের বালতি ভরে কেউ যেন কোনো তরল পদার্থ মন্দিরের সিঁড়ির উপর ছিটিয়ে দিচ্ছে—অন্ধকারে ভালো বোঝা যাচ্ছিল না, কিন্তু টর্চ ফেলে সে দেখে, সেই তরলটি রক্ত! তার হাত কেঁপে উঠল, ক্যামেরার লেন্স ফোকাস করতে গিয়ে সে বুঝতে পারল সেই লোকটা আর কেউ নয়, পুরোহিত হরিনাথ! সে পাথরের মত স্তব্ধ হয়ে গেল—যে মানুষ তাকে এতদিন মন্দিরের গল্প শোনাত, সে-ই কী তবে এই ‘আহুতি’র কারিগর?
সঞ্জয় কাঁপা কাঁপা হাতে রেকর্ডারের শব্দ বাড়িয়ে দিল, আর ক্যামেরায় ক্রমাগত তুলতে থাকল ছবি। কিন্তু ঠিক তখনই, যেন এক অশরীরী ছায়া গাছের গা বেয়ে উঠে এসে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। টর্চ ছিটকে পড়ে গেল দূরে, আর সে শুধু অনুভব করতে পারল যেন কেউ তার কণ্ঠর উপর হাত চাপা দিচ্ছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, চোখ ঝাপসা হচ্ছিল। কিন্তু ঠিক তখনই দূরে শাঁখ বাজল, আর সেই মুহূর্তে ছায়াটা উবে গেল। মুক্ত হয়ে পড়ে সঞ্জয় দেখল, মন্দির থেকে বেরিয়ে আসছে হরিনাথ, হাতে শাঁখ। সে বলল, “তুমি দেখেছ, তাই না? এখন বুঝতে পারছ, এটা কোনো পুজো নয়—এ এক রক্তঋণ।” সঞ্জয়ের শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। গ্রামের লোকেদের চোখে ভক্ত হরিনাথ, কিন্তু তার ভেতরেই বাস করছে এক যুগপুরুষ, যে প্রাচীন রক্তপিপাসার ধারক। কী করবে এখন সঞ্জয়? এই ভয়ঙ্কর সত্যি কি সে পৃথিবীর সামনে আনবে, না কি এই রাতই হবে তার শেষ কালরাত্রি?
৬
যেদিন সকালে ঘুম ভাঙে, সুগতর মনে হয় যেন সে কোনও দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছে। কিন্তু চোখ মেলেই দেখে, চারপাশে যে নিঃশব্দ অন্ধকার—তা স্বপ্নের নয়, বাস্তবের। হোমস্টের দরজা খোলা, বাতাসে ভেসে আসছে ধূপের গন্ধ আর দূরে কুকুরের গলা ফাটানো ডাক। সে উঠে দাঁড়িয়ে জানলার বাইরে তাকায়—দেখে মেঘে ঢাকা পাহাড়ের গায়ে যেন কোনো অশুভ ছায়া নেমে এসেছে। নিচে নামতেই সায়ন্তিকা তাকে জানায়, গতরাতের পর গ্রামে আরও দুজন নিখোঁজ, আর তাদের কেউই ফিরে আসেনি। মন্দিরের প্রধান পুরোহিত গম্ভীর মুখে বলেন, “মূর্তি জেগে উঠেছে। এবারের আহুতি হবে নিজের পছন্দে।” এই কথায় সুগত যেন হিমশীতল হয়ে যায়। কালীমূর্তির চোখ নাকি মাঝে মাঝে খুলে যাচ্ছে, এবং সেই চোখে যাকে তাকানো হয়, সে আর ফেরে না।
সুগত ঠিক করে, সে আর অপেক্ষা করবে না। সে গ্রামবাসীদের পুরোনো গল্প আর লোককথা নিয়ে জড়ো করা নথি ঘাঁটতে শুরু করে। খুঁজতে খুঁজতে পায় ১৮৯৭ সালের একটি ভগ্নপ্রায় তাম্রপত্র, যেখানে এক ব্রিটিশ পণ্ডিতের লেখা রয়েছে—”এই মন্দির নয়, এক শক্তির আধার। এখানে স্থাপন করা মূর্তিটি চৈতন্যপ্রাপ্ত—তা ঘুমায়, তবে রক্তের স্বাদে জাগে।” সেই পণ্ডিত পরে নিখোঁজ হয়েছিল। সুগতর রক্ত হিম হয়ে আসে—এই কালী মূর্তি কি শুধুই প্রতীকী নয়, সত্যিই কোনো তান্ত্রিক শক্তির আধার? সে সায়ন্তিকার সঙ্গে সব ভাগ করে নেয়, এবং তারা দুজনে সিদ্ধান্ত নেয় মন্দিরে গিয়ে মূর্তির সামনে দাঁড়াবে, মুখোমুখি হবে সেই “চোখের”।
রাতে মন্দিরের দরজা অদ্ভুতভাবে খোলা পায় তারা। ভিতরে প্রবেশ করতেই যেন একটা হিমেল স্রোত বয়ে যায় গায়ে—কোনো এক অজানা চোখ তাদের অনুসরণ করছে এমন অনুভূতি হয়। প্রদীপের আলোয় দেখা যায়, মূর্তির চোখ খোলা, আর তাতে লালচে আলো ঝলমল করছে। আচমকা বাতাস কেঁপে ওঠে, এবং সেই লাল চোখ সরাসরি তাকায় সুগতর দিকে। এক মুহূর্তের জন্য সুগত যেন শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যায়—তার মনে হয় সে আর নিজের মধ্যে নেই, সে যেন ইতিহাসের পাতায়, তান্ত্রিক যুগে ফিরে গিয়েছে। সে দেখে বলি, অগ্নি, মন্ত্র, আর কালো কাপড়ে ঢাকা মুখগুলো কালীকে জাগানোর জন্য আর্তি করছে। সেই চোখ থেকে যেন স্মৃতি প্রবাহিত হয় তার মগজে, আরেক জীবন, আরেক যুগ।
যখন সুগত ফিরে আসে বর্তমান জগতে, দেখে সে মাটিতে পড়ে আছে, আর সায়ন্তিকা কাঁদছে। মূর্তির চোখ আবার বন্ধ, বাতাস নিস্তব্ধ। কিন্তু সুগত জানে, তার মধ্যে কিছু প্রবেশ করেছে—মূর্তির স্মৃতি, শক্তি, বা অভিশাপ। সেই রাত থেকেই সে স্বপ্নে মন্দির দেখে, কালী দেখে, আর দেখে তার হাতে রক্তমাখা খড়গ। গ্রামবাসীরা ভীত, কেউ কেউ পালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সুগত বুঝে গেছে—এই বলি, এই কালরাত্রি কোনো দুর্ঘটনা নয়, এক পূর্বনির্ধারিত পরিক্রমা, আর এবার সে-ই হবে তার কেন্দ্রবিন্দু। কালরাত্রি এগিয়ে আসছে, আর তার রক্ত যেন নিজেই হাঁটছে সেই উৎসর্গের দিকে।
৭
জলন্ত মশাল হাতে শিবানী, রুদ্র এবং গ্রামের পুরোহিত জ্যোতিষানন্দ সেই গুহার গভীরে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, যেখান থেকে পাথরের অলিন্দে এক অস্পষ্ট শব্দ শোনা যাচ্ছিল—মাটির নিচ থেকে যেন কেউ ডেকে উঠছে। চারপাশে গা-ছমছমে অন্ধকার, ছাদের ফাটলে ঝুলে থাকা বাদুড়ের মৃদু ডানার আওয়াজ, আর মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছিল কাঁপা কাঁপা কান্নার ধ্বনি। গুহার দেওয়ালে খোদাই করা পুরনো লিপিগুলো জ্যোতিষানন্দ পড়তে পড়তে বললেন, “এখানে লেখা—‘রক্তে স্নাত হলে, কৃপা বর্ষে দেবী; উপবাসে ও অগ্নি যজ্ঞে খুলে নীচের দ্বার।’ মনে হচ্ছে এই গুহার নিচেই লুকিয়ে আছে সেই অদ্ভুত শক্তির উৎস।” রুদ্রের মুখে তখনও সন্দেহ আর অবিশ্বাস—সব কিছুকে অযৌক্তিক মনে হলেও মাটির নিচে যে শক্তি ক্রমশ সক্রিয় হচ্ছে, তা সে নিজ চোখে দেখেছে আগের রাতেই, যখন মন্দিরের দেওয়ালে আগুনের রেখা ঘুরে ঘুরে এক চক্র তৈরি করছিল।
চক্রাকারে পথ নিচে নামছিল, যেন তারা এক রহস্যময় কেন্দ্রে পৌঁছাতে চলেছে। হঠাৎই গুহার ভিতরে শুরু হল এক অদ্ভুত দুলুনি, মাটির নিচ থেকে যেন ফাটল ধরার আওয়াজ এল। শিবানী কাঁপা গলায় বলল, “এটা ভূমিকম্প না অন্য কিছু?” ঠিক তখনই গুহার দেয়ালের ফাটলে থেকে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করল—কালচে, কাঁচা রক্তের গন্ধমাখা ধোঁয়া। সেই ধোঁয়ার মধ্যে দেখতে পেল এক ছায়ামূর্তি—নারীমূর্তি, চুল এলোমেলো, হাতে ত্রিশূল, চোখদুটো জ্বলন্ত লাল। মুহূর্তেই সেই মূর্তি মিলিয়ে গেল, কিন্তু তার পরে বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠল—প্রাণ নেয়া ধ্বংসের বাতাস। পুরোহিত হঠাৎই পড়ে গেলেন, আর কিছুক্ষণ ছটফট করে নিথর হয়ে গেলেন। শিবানী ও রুদ্র দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে দেখল, তাঁর মুখ থেতলে গেছে, চোখদুটো বিস্ফারিত—মনে হচ্ছিল যেন তিনি কিছু দেখে চমকে গিয়েছিলেন। রুদ্র বুঝল, এখন আর পিছু হটার উপায় নেই—তারা এমন কিছু জেনে ফেলেছে, যা তাদেরকে মাফ করবে না।
তাদের সামনে খুলে গেল এক পাথরের দরজা, নিজে থেকেই। দরজার ওপারে নেমে গেছে এক সরু সিঁড়ি, জ্যোৎস্নার আলো তাতে পৌঁছায় না। নিচে নামতে নামতে তারা দেখতে পেল চারপাশে পুরনো রক্তের দাগ, শুকিয়ে গিয়েছে বহু আগে, কিন্তু গন্ধ এখনও ঘন। সেখানে পৌঁছে তারা দেখতে পেল এক বৃত্তাকারে সাজানো বহু মাথার খুলি, আর মাঝখানে এক অগ্নিকুণ্ড—যা নিভে যাওয়ার পরও মাঝে মাঝে লালচে আলো ছড়াচ্ছে। হঠাৎই কুন্ডের মধ্যে আবার আগুন জ্বলে উঠল আপনাআপনি। আগুনের মধ্যে ভেসে উঠল এক দৃশ্য—দশ বছর আগে এই মন্দিরে এক বালিকাকে বলি দেওয়া হয়েছিল। সেই বলির পর থেকেই প্রতি দশ বছর অন্তর রক্তচাহিদা ফিরে আসে। এবং এবার সেই চাহিদার পালা শিবানীর!
শিবানী চিৎকার করে উঠল, কিন্তু গুহার ভেতর সেই শব্দ যেন কোথাও হারিয়ে গেল। আগুনের মধ্যে দেখা গেল এক বিশাল ছায়া উঠে আসছে, আর সেই ছায়া বলছে—“তুমি এসেছ, কারণ আমি ডেকেছি, জন্ম থেকে তোর রক্তে আছে আমার ছায়া। মায়ের শক্তি শুধু উপাসনায় নয়, আত্মাহুতিতে!” শিবানী বুঝতে পারল, সে এই রহস্যের কেবল দর্শক নয়, সে-ই কেন্দ্র। তার দেহে বইছে এমন কিছু যা কালী মায়ের এই ভয়ঙ্কর রূপের সঙ্গে যুক্ত। রুদ্র তাকে ধরে বলল, “শিবানী, এখান থেকে বেরোতে হবে। এখনই। নইলে তুমি আর আমি, কেউই বাঁচব না।” কিন্তু ঠিক তখনই আগুনের চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা খুলিগুলো নড়ে উঠতে লাগল। যেন মাটির নিচের আত্মারা জেগে উঠছে। শিবানীর শরীর তখন জমাট বাধা, চোখে অশ্রু আর ক্রোধের মিশ্র অভিব্যক্তি—সে কি নিজেকে উৎসর্গ করবে? নাকি এই অন্ধকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে? উত্তর তখনও অজানা… গুহার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে আগুনের জ্যোতিষ্ক, আর উঠছে এক অশরীরী কণ্ঠস্বর—“রক্ত চাই… রক্ত চাই!”
৮
ঘুম ভাঙল রাতের গভীর নীরবতায়, যখন হঠাৎ মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে ভেসে এলো এক বিকট আর্তনাদ, যেন কেউ ছিঁড়ে পড়ছে অন্ধকারের চোরা গহ্বর থেকে। রুদ্র চমকে উঠল, কাঁপা হাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে উঠে দাঁড়াল। গুহার গায়ে ঝুলে থাকা বোনা ধুলোর পরত ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে, যেন কিছুর আগমন ঘনিয়ে আসছে। মন্দিরের বাইরে বের হতেই রুদ্র দেখল—সমস্ত গ্রাম যেন হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। কেউ মুখে হাত চেপে ধরে, কেউ আবার কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করছে সেই কালো অন্ধকারের দিকে। চন্দ্রবরণা দূর হয়ে গিয়েছে আকাশ থেকে, যেন কালো রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঘের প্রান্ত।
বৃদ্ধ শ্যামানন্দ তখন মন্দিরের সিঁড়িতে বসে, চোখ স্থির, ঠোঁট জোড়া, কাঁধের কাপড়ও যেন বাতাসে স্থির। রুদ্র এগিয়ে যেতেই তিনি বললেন, “এখনও সময় আছে, ত্যাগ করো… যে ফিরে গিয়েছে তারাও আর ফিরে আসে না।” কিন্তু রুদ্র থামল না, বরং ভিতরে প্রবেশ করল। মন্দিরের প্রাচীন ভেতরে ঢুকে সে আবার শুনল সেই কান্না, যা যেন এবার কারও নয়—একটি অস্তিত্বের, যাকে শব্দে ধরা যায় না। রুদ্র মাটিতে হাত রেখে অনুভব করল স্পন্দন, কাঁপন আর অতল গহ্বরে ডুবে যাওয়া এক স্রোত। দেওয়ালে আঁকা এক পুরনো দেবীচিত্র তখন যেন চোখ খুলে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। মুহূর্তের জন্য রুদ্র নিজের শরীরকে অনুভব করতে পারল না, কেবল নিঃশব্দে ভেসে চলল সেই অলৌকিক অস্তিত্বের দিকে।
ঠিক সেই সময়, সে আবিষ্কার করল মন্দিরের পেছনের প্রাচীন গুহা, যেটা পাহাড়ের গায়ে এমনভাবে লুকানো যে দিনের আলোয় তাকে বোঝা যায় না। ভিতরে প্রবেশ করতেই গুহার দেওয়াল জুড়ে ঝুলে থাকা শুকনো রক্তের ছোপ, আর মাটিতে পড়ে থাকা হাড়ের গুঁড়ো—সমস্ত কিছুই সাক্ষী বহন করছিল শতাব্দীপ্রাচীন বলির। মোমের আলোয় ভেসে উঠল কিছু উৎকীর্ণ প্রতিচ্ছবি, যেখানে এক তান্ত্রিক কালীমূর্তি রুদ্রদৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে, আর তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে শতনামী বলি পুরোহিত। রুদ্র তখন নিজের শ্বাস থামিয়ে শুনতে লাগল—এক মন্ত্র ধ্বনি, যেন মাটির গর্ভ থেকে উঠে আসছে। সে জানে না কে বলছে, কোথা থেকে বলছে, কিন্তু সেই ধ্বনি তাকে আহ্বান করছে—বলির জন্য নয়, বরং সাক্ষী হয়ে ওঠার জন্য।
হঠাৎ বাতাস ভারী হয়ে উঠল, গুহার দেয়াল কাঁপতে লাগল আর সেই প্রতিচ্ছবি যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। রুদ্র এখন আর একা নয়—চারপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে ছায়ামূর্তি, যাদের চোখ নেই, মুখ নেই, কিন্তু তারা কথা বলছে তার মনের ভিতরে। “তুমি এসেছো, কারণ তোমার ভিতরে ডাক ছিল। কালী কেবল রক্ত চায় না, চায় চেতনার জ্যোতি, যাকে অন্ধকারে জ্বালানো যায়।” রুদ্র বুঝল, সে আর শুধুই একজন গবেষক নয়—সে হয়ে উঠেছে এক মধ্যস্থ, এক প্রাচীন চক্রের অংশ যা যুগে যুগে চলে আসছে, আর এখন নতুন করে জাগতে চাইছে তার মাধ্যমে। সেই রাতে, ছায়ার আর্তনাদ আর গুহার নীরবতা মিলেমিশে এমন এক সুর বয়ে আনল, যা বাস্তব ও অবাস্তবের সীমানা সম্পূর্ণ মুছে দিল।
৯
গভীর রাতের পাহাড়ি বাতাসে হিমশীতলতা ছড়িয়ে ছিল, আর সেই হাওয়ার দোলায় যেন ছড়িয়ে যাচ্ছিল মন্দির চত্বর থেকে ভেসে আসা এক অদ্ভুত ধাতব শব্দ। আকাশে পূর্ণিমার আলো ভেসে উঠতেই চারপাশে যেন সময় থেমে গিয়েছিল। আর সেখানে দাঁড়িয়ে গবেষক অমিতাভর চোখের সামনে ফুটে উঠছিল এক ভয়াল দৃশ্য—কালীমূর্তির সম্মুখে বসে থাকা রক্তমাখা মুখের একজন বৃদ্ধ, যিনি মন্ত্রপাঠ করছিলেন এক ছন্দোবদ্ধ অথচ বিকৃত ভাষায়। সেই বৃদ্ধ যে পুরোহিত শম্ভুদারূপেই ছিলেন, তা বুঝতে অমিতাভর কষ্ট হয়নি, কিন্তু তার রূপ আর আচরণে এমন এক বদল এসেছে, যা মানুষের গণ্ডি পেরিয়ে গেছে। তিনি চোখ বন্ধ করে উচ্চারণ করছিলেন এক প্রাচীন মন্ত্র, যার প্রতিটি ধ্বনি যেন বাতাসের স্পন্দনকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল, আর মন্দিরের চারদিকে আগুনের মত লাল আলো পাক খাচ্ছিল।
অমিতাভ ছায়ায় ঢাকা কোনে দাঁড়িয়ে এই উপাচারের প্রত্যক্ষদর্শী ছিল, কিন্তু তার ভিতরে এক অদ্ভুত যুদ্ধ চলছিল—কৌতূহল, ভয়, আর এক অপরিচিত টানের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব। হঠাৎ করেই সে দেখতে পেল যে পেছনের দিক থেকে গ্রামের মানুষজন সার বেঁধে এগিয়ে আসছে, প্রত্যেকের চোখে একধরনের নিস্তব্ধ শূন্যতা। কেউ যেন তাদের সচেতনভাবে চালনা করছে—একটি চক্রবদ্ধ তান্ত্রিক শক্তি। তারা সবাই কালীমূর্তির সামনে নতমস্তকে বসে পড়ল, তারপর শম্ভু দাদার সংকেতে উঠে এলো এক তরুণী—রাধিকা। অমিতাভ চিৎকার করতে চেয়েও পারল না। গলায় যেন কিছু আটকে গেছে, পা জমে গেছে মাটির সঙ্গে। সে দেখতে পেল—রাধিকার গলায় কালো মালা, কপালে সিঁদুর, আর তার চোখে ভয় মিশ্রিত বোধহীনতা।
ঠিক সেই মুহূর্তে, কালীমূর্তির দুই চোখে যেন আগুন জ্বলে উঠল। মূর্তির সামনে রাধিকার দাঁড়ানো অবস্থানে ছায়ার মত কিছু একটা নড়ে উঠল—একটা কালো আবরণযুক্ত চেহারা, যেন আগুনের মাঝে কালী নিজেই অবতীর্ণ হয়েছেন। সেই ছায়ার সামনে দাঁড়িয়ে রাধিকা দুলে উঠল, তারপর মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু রক্ত নেই, চিৎকার নেই—শুধু নিঃশব্দ নিস্তব্ধতা। অমিতাভর শরীরের প্রতিটি স্নায়ু যেন বিকল হয়ে পড়ল, সে বুঝতে পারছিল না এটা স্বপ্ন, নাকি দুঃস্বপ্নের চেয়েও গভীর এক বাস্তবতা। ঠিক তখনই, অন্ধকার ছিন্ন করে কারা যেন ছুটে এল, তাদের হাতে ছিল আগুনের মশাল।
তারা ছিল বাইরে থেকে আসা কিছু সাধক—যারা তন্ত্রপন্থার বিপক্ষে, আর কালী উপাসনার নামে রক্তচাপানোর প্রথার বিরুদ্ধে। এই সদিচ্ছা নিয়ে তারা গ্রামে ঢুকে পড়েছিল, আর শম্ভুদার পরিচালিত সেই ভয়ংকর রাত্রিকে থামাতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি, এটি শুধুই মানসিক নয়—এটি শক্তির যুদ্ধ। শম্ভু পুরোহিত হঠাৎই আকাশের দিকে মুখ তুলে চিৎকার করে উঠলেন, আর সেই সাথে তার শরীর থেকে যেন ছুটে বেরিয়ে এল কালো ধোঁয়া। পুরো আকাশ কালো রক্তিম হয়ে উঠল। আর তখন অমিতাভ অনুভব করল—তার মনের গভীরে কালী, নারীশক্তি, ভয়, বিস্ময় আর বিশ্বাস একসূত্রে গাঁথা হয়ে যাচ্ছে। আর এই কালরাত্রির মধ্যেই সে বুঝতে পারল, মানুষ কেবল জ্ঞান দিয়ে সব ব্যাখ্যা করতে পারে না—কিছু কিছু সত্য কেবল অনুভবের জগতে থেকে যায়, রক্তের পাঁকে গেঁথে থাকা বিশ্বাসের মতো।
১০
জঙ্গলের গাঢ় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বিভূতি এক অনির্বচনীয় আলো দেখতে পেলেন, ঠিক যেন সাদা ধোঁয়ার আস্তরণ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে অদৃশ্য কোনো শক্তির ভাষ্য। চারপাশের বৃক্ষ যেন নিঃশব্দে কেঁপে উঠছে, পাতার ফাঁকে হঠাৎ হঠাৎ দেখা যাচ্ছে রক্তাভ জ্যোৎস্নার আভা, যা কোনও সাধারণ রাতের আলো নয়। তার চোখে এখন আর ভয় নেই, বরং এক অদ্ভুত আত্মসমর্পণ। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মায়া তার দিকে চেয়ে বলল, “আপনার ভিতরে দেবীকে দেখার ক্ষমতা আছে, বিভূতি বাবু। এ আপনাকে বেছে নিয়েছেন।” এই কথা শোনা মাত্র বিভূতির মনে পড়ে গেল মন্দিরের সেই অদ্ভুত অনুরণন, সেই প্রাচীন ভাষায় লেখা লিপি, এবং সবথেকে বেশি – সেই করুণ আর্তনাদ, যা প্রথমদিন রাতে শুনেছিলেন। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর যেন ধীরে ধীরে একত্রিত হচ্ছে তার মনে।
তাদের পৌঁছনোর সময় মন্দিরভূমিতে ইতিমধ্যে আগুন জ্বলছিল। পঞ্চতন্ত্রিক আবার একত্রিত হয়েছে। ত্রিভুজাকারে তাদের অবস্থান। মাঝখানে বসানো হয়েছে সেই যুবক—ভাস্কর, যার শরীর নিস্তেজ, মাথা নিচু, গলায় রক্তের দাগ। বিভূতির হৃদয় কেঁপে ওঠে; সে ছুটে যায় কিন্তু মায়া তার হাত ধরে টেনে রাখে। “এটাই নিয়ম,” সে বলে, “রক্তের আহুতি না হলে দেবী ক্ষুধার্ত থাকেন। আর ক্ষুধার দেবী ভয়ংকর।” বিভূতির ভিতর এক দ্বন্দ্ব চলতে থাকে—তাঁর যুক্তিবাদী মন এই রক্তপিপাসা মানতে পারে না, কিন্তু সেই রাতের অভিজ্ঞতা, তার চারপাশের বাস্তবতাকে এমনভাবে বদলে দিয়েছে যে যুক্তি আর ধর্মের সীমারেখা মুছে গেছে। সে দাঁড়িয়ে পড়ে। পঞ্চতন্ত্রিকরা এখন মন্ত্রপাঠ শুরু করেছে। ধূপের ধোঁয়া, মাধুকরীর গন্ধ, শঙ্খ আর ঘণ্টাধ্বনি মিলে এক ভয়াল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
মন্ত্রের ধ্বনি চূড়ান্তে পৌঁছতেই হঠাৎ এক বিকট বজ্রপাতের শব্দে কেঁপে উঠল আকাশ। তারপরই দেবীমূর্তির কপাল থেকে টপ করে একটা রক্তবিন্দু ঝরে পড়ল ভাস্করের শরীরে। পঞ্চতন্ত্রিকরা একযোগে মাথা নিচু করল, প্রণাম জানাল, আর বিভূতির সামনে উপস্থিত হল সেই রূপ—দেবী কালীর রক্তচক্ষু, জিহ্বা বার করে দেওয়া সেই আদিম, অপ্রতিরোধ্য রূপ, যার চোখে শুধুই তেজ আর ধ্বংসের আগুন। বিভূতি দেখলেন, কীভাবে ভাস্করের শরীর উঠে গিয়ে এক ঝলক আলোয় মিলিয়ে গেল। সেই আলো আবার এক পিণ্ড হয়ে দেবীমূর্তির বুকের মধ্যে প্রবেশ করল। চারপাশ নিস্তব্ধ। পঞ্চতন্ত্রিকরা উঠে দাঁড়ায়, ধীরে ধীরে মুখে হাসি ফুটে ওঠে তাদের। “দেবী তুষ্ট। দশ বছরের জন্য রক্ষা,” একজন বলে উঠল।
পরদিন সকালে মন্দিরভূমিতে কোনো চিহ্ন নেই আগের রাতের। যেন কিছুই ঘটেনি। পঞ্চতন্ত্রিকরা চলে গেছে, গ্রামবাসীরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছে। কিন্তু বিভূতির চোখে ঘুম নেই। সে জানে, সে যা দেখেছে তা শুধুই তান্ত্রিকতা বা লোকবিশ্বাস নয়—এ এক গভীরতর বাস্তবতার অংশ, যেখানে মানুষ, ঈশ্বর আর অন্ধকারের শক্তি একই স্রোতে বয়ে চলে। ভাস্করের স্মৃতি তাকে দগ্ধ করে, কিন্তু সে বুঝে গেছে—সব কিছুর একটা মূল্য আছে। সে ফিরে যায় কলকাতায়, তার গবেষণাপত্রে এই অভিজ্ঞতার প্রতিফলন তুলে ধরে, যদিও কোনো প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা তা ছাপে না। কারণ, সমাজ এমন সত্যকে গ্রহণ করতে অক্ষম। তবুও বিভূতি লিখে যায়, একের পর এক খাতা ভরে। কারণ সে জানে—আরও দশ বছর পরে, আবার সেই ‘কালরাত্রি’ ফিরে আসবে। তখন কেউ না কেউ হয়তো আবার ডাক পাবে, আর দেবী আবার তৃষ্ণার্ত হবেন রক্তের জন্য।
—
শেষ