শঙ্খ সেন
অজানা ডাক
কলকাতার একটি প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ছাত্রী সুমি। বয়স তেইশ, তীব্র কৌতূহল এবং অদম্য সাহস তার মধ্যে মিশে রয়েছে। সে বিশ্বাস করে, পুরোনো গল্পগুলো সত্যি না হলেও, তাদের মধ্যে কিছু না কিছু গভীর অর্থ থাকে। কিন্তু এই বিশ্বাস কখনোই এত শক্তিশালী হয়ে উঠেনি যতটা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যখন সে প্রথমবারের মতো গ্রামে গিয়েছিল, যেখানে কালীপুরাণের রহস্যময় পুস্তকটির কথা শোনা গিয়েছিল।
সুমি একটি গবেষণার কাজের জন্য গ্রামে আসছিল, এক অজানা সত্ত্বা, এক রহস্যময় পুস্তক এবং কিছু পুরনো প্রাচীন উপাখ্যান তাকে ডেকেছিল। তার সহকারী, সঞ্জীব, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো পুরাণবিদ্যা বিভাগের গবেষক, তাকে এই গ্রাম সম্পর্কে তথ্য দিয়েছিল। সঞ্জীব জানত না যে এই গ্রামটি এতটা গভীর এবং অতীতের জটিলতা তার বর্তমানের সাথে সম্পর্কিত।
গ্রামের নাম রামপুরা। এটি নদীর তীরবর্তী একটি ছোট, একাকী গ্রাম, যেখানে সবাই একে অপরকে জানে এবং এখানে কিছু প্রাচীন রীতিনীতি চর্চা হয়, যা আধুনিক জগতের মানুষের কাছে অজানা। সুমি জানতো, এই গ্রামে কালীপুরাণ নামে এক পুস্তক লুকিয়ে রাখা হয়েছে, যা শুধু আধ্যাত্মিক শক্তি নয়, জীবন ও মৃত্যুর ওপারের জগতে প্রবেশের পথ খুলে দেয়।
গ্রামে আসার পর সুমি প্রথম যেটা লক্ষ্য করল, তা হলো—গ্রামবাসীরা অত্যন্ত গম্ভীর এবং এক ধরনের অদ্ভুত গোপনীয়তা তাদের মধ্যে বিরাজ করছে। গ্রামের পুরনো মন্দিরের পাশের একটা ছোট্ট ঘরে থাকলেও, সুমি ঠিক বুঝতে পারছিল না, কেন সবাই এতটা ভীত? কেন কেউ তাকে তার গবেষণার বিষয়ে খোলামেলা কথা বলছিল না?
একদিন, যখন সুমি গ্রামের এক বৃদ্ধ মহিলা, পদ্মিনী, এর কাছ থেকে কিছু পুরনো কথিকা শুনছিল, তখন পদ্মিনী বলল, “তুমি জানো না, মেয়েমানুষেরা যতটা মন্দ কিছু জানে, ততটাই তাকে সাবধানে রাখা উচিত। কালীপুরাণ, যেটি তুমি খুঁজছো, সে সত্ত্বা বড় ভয়ঙ্কর। এই পুস্তক যেই মুষ্টিতে নিয়েছে, তার জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছে।”
সুমি তাতে আগ্রহী হয়ে উঠল, কিন্তু কিছুটা ভয়ও পেল। কেন যে গ্রামবাসীরা এই পুস্তক নিয়ে এতটা ভয় পাচ্ছে? কিছু দিন বাদে, সুমি চুপচাপ পদ্মিনীকে অনুসরণ করে এক গভীর বনাঞ্চলে চলে যায়, যেখানে গ্রামের পুরনো মন্দিরটি রয়েছে। সেখানে পৌঁছতেই, সে দেখে, মন্দিরটি বহুদিন ধরে পরিত্যক্ত, পুরনো পোড়ানো ছাদ এবং ফাটল ধরা দেয়াল তার চারপাশে। মন্দিরের সামনে এক ছোট্ট পথ চলে গেছে, যেখানে কিছু কঙ্কালাবশেষ পড়ে রয়েছে।
“এই মন্দিরটাই কালীপুরাণের আসল পুস্তক লুকিয়ে রাখে,” পদ্মিনী বলল, তার চোখের কোণ থেকে ভয় চেপে গিয়ে।
সুমি সেখান থেকে ফিরে আসে, তবে তার মনে গেঁথে যায় এক অদ্ভুত টান—একটা অজানা ডাক। সে জানতো, তার অনুসন্ধান ঠিক শুরু হয়নি। তবে কিছু একটা ছিল, যা তাকে এখানে টেনে নিয়ে এসেছে। তার চোখে আর এক পৃথিবী ছিল, যেখানে পুরোনো পুরাণগুলি জীবন্ত হয়ে উঠেছিল।
সুমির মনে প্রশ্ন জন্ম নেয়—কী এমন রহস্য আছে এই গ্রামে, যা এই পুস্তককে ঘিরে গোপন রাখা হয়েছে? সে সিদ্ধান্ত নেয়, সে এই রহস্য খুঁজে বের করবে, এবং যদি তা সম্ভব হয়, তবে এই কালীপুরাণের পুস্তকটি উদ্ধার করবে, যা হয়তো তার জীবনের সবচেয়ে বড় গবেষণা হতে পারে।
স্বপ্নের অন্ধকার
সুমি গ্রামে ফিরে আসে, কিন্তু তার মন এখনও মন্দিরে ছড়িয়ে থাকা অজানা রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট। পদ্মিনীর বলা কথাগুলি তার মাথা থেকে সরছিল না—কালীপুরাণের পুস্তক, যা এত বছর ধরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, তার সঙ্গে কিছু অদ্ভুত সম্পর্ক রয়েছে। এমন কিছু ছিল, যা তার সাধনায় প্রবেশ করেছিল, কিন্তু সেই শক্তির টান তাকে আরও গভীরে টেনে নিত।
সুমি প্রতিদিন নতুন কিছু জানতে চেয়েছিল, কিন্তু গ্রামবাসীরা অদ্ভুতভাবে মুখ বন্ধ রাখছিল। সন্ধ্যাবেলা, যখন সুমি মন্দিরের পাশ দিয়ে হাঁটছিল, তখন সে আবার সেই অদ্ভুত অনুভূতি অনুভব করল—এক অদৃশ্য শক্তি তার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে শ্বাস নিতে পারছিল না, মনে হচ্ছিল যেন কিছু একটা তাকে অন্ধকারে টানছে।
তবে, একদিন রাতে, তার স্বপ্নে কিছু ভীষণ অদ্ভুত ঘটল। সে ছিল একটি বিরাট কালো অরণ্যে, যেখানে ছায়া ছড়িয়ে ছিল। তার সামনে এক বিশাল মূর্তি দাঁড়িয়ে ছিল, যার চোখ দুটি ছিল আগুনের মতো উজ্জ্বল। মূর্তিটির মুখে এক অদ্ভুত হাসি ছিল, যেন সে জানত সুমির সমস্ত ভয় এবং কৌতূহল। সেই হাসি ছড়িয়ে পড়ছিল চারপাশে, আর সে শোনাল, “তুমি কি জানো, আমি তোমার জীবনের রূপান্তর ঘটাতে এসেছি?”
সুমি ভয় পাচ্ছিল, কিন্তু তার পা যেন জমে গিয়েছিল, সে নিজেকে সরাতে পারছিল না। তক্ষুনি মূর্তিটি কথা বলল, “তুমি যে পুস্তকটির সন্ধানে এসেছো, তা তোমাকে আমার কাছে আনতে হবে। কারণ তুমি আমার একজন নির্বাচিত যাত্রী।”
পরক্ষণে, সুমি উঠে বসল, ঘরটিতে ফিরে আসতে গিয়ে এক অজানা অনুভূতির মধ্যে। তার হৃদপিণ্ড দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছিল। সেই স্বপ্ন যেন সুমি বাস্তবিকভাবে অনুভব করছিল—কালী, বা কালীপুরাণ, কিছু একটা ছিল যা তাকে ডেকেছিল। কিন্তু কি? কেন? সুমি জানত না, তবে সে জানতো, তার জীবনে কিছু একটা ঘটতে চলেছে।
পরের দিন সকালে, সুমি তার গবেষণার জন্য আবার গ্রামবাসীদের কাছে তথ্য সংগ্রহ করতে বের হলো। কিন্তু আজ তাকে অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়তে হলো। গ্রামে ঢুকতেই, সুমি দেখতে পেল যে এক একজন গ্রামবাসী তার দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তাদের চোখে এক ধরনের সন্দেহ, এক ধরনের অদৃশ্য আতঙ্ক ছিল। এই বিষয়টি তাকে আরও বিভ্রান্ত করল, আর তার মনে এক প্রশ্ন উঠল—এই গ্রামে কেউ কি জানে, যে সে আসলে কালীপুরাণের পুস্তক খুঁজতে এসেছে? অথবা, গ্রামবাসীরা কি জানে, যে কালীপুরাণের শক্তি আসলে সুমির মধ্যে আছে?
সুমি তখন সিদ্ধান্ত নিল, সে আজ আর শুধু গল্প শুনবে না। সে তার প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজে বের করবে। সে আগে থেকেই জানতো, মন্দিরের কাছের সেই abandoned জায়গায় পুস্তকটি থাকতে পারে, কিন্তু সে আরেকটু নিশ্চিত হতে চাইল। সে নির্জন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মন্দিরের দিকে গেল, কিন্তু সেখানেও সে এক ভয়ানক অস্বস্তি অনুভব করল। মন্দিরের সিঁড়ি থেকে উঠে, সে দেখতে পেল এক অদ্ভুত আচ্ছন্ন পরিবেশ। প্রতিটি পাথর, প্রতিটি চিহ্ন যেন তাকে নিজেকে অনুসন্ধান করতে উত্সাহিত করছে, তবে সেই অনুসন্ধান কী তাকে কোথায় নিয়ে যাবে—তাতে কিছুই বলা যাচ্ছিল না।
সে যখন মন্দিরের ভিতরে ঢুকতে যাচ্ছিল, তখন এক অদ্ভুত ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করল। পুরো মন্দিরের ভিতরে যেন কিছু একটা চলছিল, কিছু একটা ছিল যা তাকে লক্ষ্য করছিল। মন্দিরের দরজা খুলতেই, সুমি একটি পুরনো ঘর দেখতে পেল, যেখানে কোনোরকম আলো ছিল না, কিন্তু ভিতরে এক ধরনের অদ্ভুত ঝাঁঝালো শক্তি ছিল। এই শক্তি যেন তার শরীরের প্রতিটি কোণে প্রবাহিত হচ্ছিল।
সুমি মন্দিরের ভিতর এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে, তার মধ্যে একটা অদ্ভুত উপলব্ধি জন্ম নিল—যতটুকু সে কালীপুরাণের পুস্তক সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল, ততটুকু সে যেন নিজেকে তার চেয়েও গভীরে ফেলতে শুরু করেছিল। তার মনে হচ্ছিল, পুস্তকটি শুধু একটি গবেষণার বস্তু নয়, বরং একটি অভিশাপও হতে পারে।
সে ভেবেছিল, যদি পুস্তকটি খুঁজে বের করে, তবে তা তার গবেষণার সেরা কাজ হয়ে উঠবে। কিন্তু যদি সেটি তার জীবনের সবচেয়ে বড় বিপদ হয়ে ওঠে? এই অদ্ভুত চিন্তা সুমি মনে আনল, তবে সেও জানতো, একবার শুরু করলে আর পিছিয়ে আসা যাবে না।
সুমি মন্দিরের এক কোণায় পৌঁছালে, এক অদ্ভুত পুস্তক তার চোখে পড়ল। এটি মাটি থেকে আধা-খুলে ছিল, আর তার উপর ঝুলে থাকা এক প্রাচীন লাল ধ্বজা আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছিল।
“এটাই কি কালীপুরাণ?” সুমি নিজের মনে বলল।
নিরাজের সাক্ষাৎ
সুমি মন্দিরের অভ্যন্তরে সেদিন সন্ধান করছিল, এবং তার চোখে পড়েছিল সেই পুরনো পুস্তকটি। কালীপুরাণ। এর গায়ে অদ্ভুত লেখা ছিল, যা পড়তে তার অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু তার আগ্রহ এতটাই প্রবল ছিল যে, সে নিজেকে বিরত রাখতে পারল না। পুস্তকটি হাতে নিয়ে সে অনুভব করল যেন একটা অদৃশ্য শক্তি তাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
ঠিক তখনই, সুমি আচমকা শুনতে পেল এক পুরুষ কণ্ঠ। “তুমি কি জানো, তোমার হাতে যা, তা এক ভয়ঙ্কর শক্তির উৎস।”
সুমি চমকে উঠল। কণ্ঠটা পরিচিত মনে হলেও, সে চিহ্নিত করতে পারছিল না। সে দ্রুত পুস্তকটি রেখে ঘুরে দাঁড়াল। তখন তার চোখে পড়ল এক যুবক, কালো পোশাকে, তার চোখে গভীর অন্ধকার, এবং মুখে এক ধরনের স্নিগ্ধ রহস্য। সে যুবক ছিল নিরাজ।
“তুমি… তুমি তো নিরাজ, হ্যাঁ?” সুমি প্রশ্ন করল, কিছুটা বিস্মিত। সে গ্রামে এসেই শুনেছিল এই নাম। নিরাজ ছিল গ্রামের একজন স্থানীয় যুবক, কিন্তু তার সম্পর্কে কেউ স্পষ্ট কিছু জানত না। বেশিরভাগ সময় সে একা থাকত এবং তার মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত আভা।
নিরাজ এক চমকদার হাসি দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমি নিরাজ। কিন্তু তোমাকে বলি, সুমি, যে পথে তুমি পা রেখেছো, তা অন্ধকারের দিকে চলে যায়। তুমি যদি কালীপুরাণের পুস্তক খুঁজে বের করার চেষ্টা করো, তবে তুমি শুধুমাত্র নিজের নয়, সমস্ত গ্রামবাসীর জন্য বিপদ ডেকে আনবে।”
সুমি, যিনি তার মনের মধ্যে অজস্র প্রশ্ন জমে উঠছিল, নিরাজের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি জানো কিছু এই সম্পর্কে? কেন সবাই এত ভয় পায় এই পুস্তককে?”
নিরাজ একটু নীরব হয়ে গেল। তারপর সে বলল, “আমার পূর্বপুরুষরা এই পুস্তক এবং কালীপুরাণের অভিশাপের মধ্যেই আটকা পড়েছিল। বহু বছর আগে, আমার প্রপিতামহ, বিক্রম, এই পুস্তকটি খুঁজে পায় এবং চেষ্টা করেছিল এটি ব্যবহার করতে। তবে, তার পরিণতি ছিল ভয়ঙ্কর—গ্রামের সমস্ত মানুষ ধ্বংস হয়ে যায়। আমার পরিবার কালীপুরাণের অভিশাপের শিকার।”
সুমি অবাক হয়ে শুনছিল। “তাহলে তুমি কেন এই পুস্তক নিয়ে এত চিন্তা করছো?”
নিরাজ এক নিঃশ্বাসে বলল, “কারণ এই পুস্তকটির শক্তি এমন, যা খোলামেলা হাতে নিতে গেলে কেবল মৃত্যুই অপেক্ষা করে। আমি জানি, তোমার মতো একজন আধুনিক শিক্ষিত মানুষ এ সব বিশ্বাস করবে না, কিন্তু বিশ্বাস করো, কালীপুরাণ যে শক্তি ধারণ করে, তা শুধু জীবনের জন্য নয়, মৃত্যুর জন্যও।”
সুমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তার মাথায় আরও হাজারো প্রশ্ন ছিল, কিন্তু তার মধ্যে একটি অদ্ভুত অনুভূতি তাকে ঘিরে ধরেছিল—এই নিরাজ, যে এত বছর ধরে এই পুস্তক নিয়ে চিন্তা করেছিল, সে কি তার দিকে এক অদ্ভুত সঙ্কেত ছড়িয়ে দিতে চাইছে?
“তুমি কি আমাকে কিছু শিখাবে?” সুমি অবশেষে বলল। “আমি তো শুধু গবেষণা করতে এসেছি, কিন্তু আমি জানি, এই গ্রামে কিছু আছে যা আমাকে জানতে হবে। আমি তোমার সহায়তা চাই।”
নিরাজ হেসে বলল, “যদি তুমি আমার সহায়তা চাও, তবে তোমাকে প্রথমে বুঝতে হবে, কালীপুরাণের শক্তি কেবল শত্রুদের ধ্বংস করে না, এটি তোমার নিজের মনও আছড়ে ফেলতে পারে। এটি তোমার আত্মাকে শুষে নেবে।”
সুমি এবার বেশ সিরিয়াস হয়ে বলল, “আমি ভয় পাচ্ছি না। আমি জানি, এই পুস্তক, এই শক্তি, আমাকে সত্যের দিকে নিয়ে যাবে। আমি যা খুঁজছি, তা আমি পাবো।”
নিরাজ হালকা এক নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তবে মনে রেখো, সুমি, কিছু জিনিস মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। এটি এক অশুভ শক্তি, যা পুরোপুরি তোমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিন্তু তুমি যদি প্রস্তুত থাকো, তবে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।”
নিরাজ ও সুমি একে অপরকে এক মুহূর্ত চুপচাপ দেখে থাকল, যেন বুঝতে পারছিল না, তাদের এই জার্নি তাদের কোথায় নিয়ে যাবে। তবে সুমি জানত—এটা শুধু গবেষণার জন্য নয়, এটা তার জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। কালীপুরাণের পুস্তক যা কিছু বলছে, তার মন্ত্র, তার শক্তি, তাকে এসব সব জানতে হবে। এবং সে জানতো, নিরাজ, এই রহস্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
“কীভাবে শুরু করা যাবে?” সুমি প্রশ্ন করল।
নিরাজ তার চোখে অদ্ভুত এক মেকামি হাসি দিয়ে বলল, “এটা সহজ না, সুমি। তবে প্রথমেই, তোমাকে ঐ মন্দিরে ফিরে যেতে হবে, এবং একে অপরের সম্মুখীন হতে হবে। আমরা একসাথে এই শক্তির মুখোমুখি হবো।”
লুকিয়ে রাখা পুস্তক
সুমি এবং নিরাজ একসাথে মন্দিরের দিকে হাঁটছিল। মন্দিরটি গ্রাম থেকে অনেক দূরে, শ্যামল বন দিয়ে ঘেরা এক নিঃসঙ্গ স্থানে, যেখানে মানুষের পদচারণা ছিল খুবই কম। সুমি জানত, আজকের দিনটি তার জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হতে চলেছে। কালীপুরাণের পুস্তক, যা এতদিন অবাস্তব মনে হয়েছিল, আজ তা তার হাতের মধ্যে ছিল—এবং এই পুস্তক কেবল একটি গবেষণার বস্তু ছিল না, বরং একটি বিপজ্জনক শক্তির উৎস ছিল।
মন্দিরে পৌঁছানোর পর, সুমি দেখল, পুরনো পাথরের মন্দিরটির গেটটি খুলে ছিল, অথচ কিছুদিন আগেও তা বন্ধ ছিল। যেন কেউ আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষা করছিল। সুমি একটু তাড়াতাড়ি ঢুকতে চাইল, কিন্তু নিরাজ তাকে থামিয়ে দিল। তার মুখের অভিব্যক্তি ছিল খুবই গম্ভীর।
“সুমি, এখানে কিছুটা সাবধান হও। পুস্তকটি অনেক বড় কিছু ঘটাতে পারে। আমরা যদি এখানে ভুল কিছু করি, তবে আমাদের সবার জন্য বিপদ হতে পারে,” নিরাজ বলল, তার গলা বেশ কাঁপছিল।
সুমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, কিন্তু তার ভিতরে এক প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। তার মনে হচ্ছিল, এই পুস্তক তার কেবল একাডেমিক গবেষণার জন্য নয়, বরং তার আত্মা, তার জীবনকে বদলে দেবে।
মন্দিরের অভ্যন্তরে ঢুকে, তারা একটি ভাঙা পাথরের চোরাবালিতে পা রাখল। ঘরটি অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল, তবে এক কোণে কিছু অদ্ভুত আলোকিত ছিল, যেন একটি রহস্যময় উৎস থেকে আলো বেরিয়ে আসছিল। সুমি সামনে এগিয়ে গেল, এবং সেখানে দেখতে পেল এক পুরনো মন্ত্রপত্র। সেই মন্ত্রপত্রে কিছু বিশাল পুরানো অক্ষর ছিল, যা সুমি আগে কখনও দেখেনি।
“এটা হলো সেই পুস্তক,” নিরাজ বলল, “আমার পূর্বপুরুষেরা এটি রেখেছিল। আমাদের পেছনে যে ইতিহাস রয়েছে, তা এই মন্ত্রপত্রের মধ্যে লুকিয়ে আছে। কিন্তু তোমার জানা উচিত, এই মন্ত্রপত্রটি একটি তান্ত্রিক শক্তির অংশ। যদি তুমি একে ঠিকভাবে ব্যবহার না করতে পারো, তবে সেই শক্তি তোমার পক্ষে বিপদ ডেকে আনবে।”
সুমি ওই পুস্তকটি হাতে তুলে নিয়ে খুব সাবধানে খুলল। তার চোখের সামনে থাকা অক্ষরগুলোর মাঝে যেন কোনো অদ্ভুত শক্তি প্রবাহিত হচ্ছিল। পুস্তকটির পৃষ্ঠা উল্টালে, সে দেখতে পেল একটি রূপকথার মতো চিত্র—কালীদেবী, এক হাতে খড়গ, অন্য হাতে শিবের শব। তার চোখ দুটি অগ্নির মতো জ্বলছিল, আর তার চারপাশে এক ভয়াবহ শক্তি আচ্ছন্ন ছিল। সুমি জানত, যে কেউ এই পুস্তকটি খোলার সাহস পায়, তার জীবন আর কখনও আগের মতো থাকবে না।
“এই পুস্তকটি যতটা ভয়ের, ততটাই আকর্ষণীয়। কালীপুরাণের শক্তি, যা কিছু তারা জানত, তা আজকে তোমার হাতে,” নিরাজ বলল, “কিন্তু তুমি জানো, যে কেউ এটি নিয়ে প্রবৃত্ত হয়েছে, সে কখনো শান্তিতে থাকতে পারেনি। কখনো তার আত্মা শান্তি পায়নি। তুমি যদি এটা ধরে রাখো, তুমি যা চাও, তা পাবে—কিন্তু তার বিনিময়ে কিছু বড় মূল্য দিতে হবে।”
সুমি কোনো উত্তর দিল না। সে শুধু পুস্তকটির পৃষ্ঠাগুলো দেখছিল, অনুভব করছিল যেন ওই পুরনো অক্ষরগুলি তাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছিল। কালীদেবীর শিকল ছিঁড়ে ফেলা শক্তি, যা না চাইলে কেউ কখনও উপলব্ধি করতে পারবে না।
ঠিক তখনই, মন্দিরের দরজায় একটি অদ্ভুত আওয়াজ শুনে সুমি ফিরে তাকাল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল এক ব্যক্তি, যার মুখ অন্ধকারে ঢাকা ছিল। নিরাজ তাকে দেখেই সোজা উঠে দাঁড়াল।
“কী ঘটছে, নিরাজ?” সুমি হড়বড় করে বলল। “এটা কি কেউ গ্রাম থেকে?”
নিরাজ কাঁপা গলায় বলল, “এই ব্যক্তি আমাদের আগেই জানত। সে এখানে থাকতে এসেছে।”
সুমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। পুরনো পাথরের মধ্যে পা রাখার আওয়াজ শুনে, সেই ব্যক্তি সামনে এগিয়ে আসল। তার চোখ দুটি এক ভয়ঙ্কর অভিব্যক্তি প্রকাশ করছিল। সুমি অনুভব করল, এই ব্যক্তি তাদের জন্য কোনো সাধারণ অতিথি নয়, বরং তাদের সাথে কিছু ভয়ঙ্কর সম্পর্ক রয়েছে।
“তুমি কালীপুরাণের পুস্তকটি হাতে পেয়েছো, সুমি,” সেই ব্যক্তি বলল, “এটা তোমার দিকেই আসা ছিল। কিন্তু তুমি কি জানো, যাদের হাতে এই পুস্তক আসে, তারা একদিন কালীদেবীর শিকার হয়ে যায়?”
সুমি ধীরে ধীরে পিছনে সরে গেল। তার ভেতরে অদ্ভুত অনুভূতির জন্ম নিল। সে জানতো, এই ব্যক্তির কথা সত্যি হতে পারে, কিন্তু সে কি এই পুস্তকটির শক্তি মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে?
ঠিক তখন, সেই ব্যক্তি আরও কাছে এগিয়ে এল এবং বলল, “তোমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ঐ পুস্তকটি তোমাকে চিরকাল বদলে দেবে। কিন্তু মনে রেখো, তোমার জীবন আর আগের মতো থাকবে না।”
কালীদেবীর উত্তরণ
গ্রামের ছোট মন্দিরের ভিতরে একটি অদ্ভুত অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছিল। সুমি পুস্তকটি হাতে ধরে ছিল, আর সেই ব্যক্তির কথা যেন তার মন থেকে সরছিল না—“যাদের হাতে কালীপুরাণ আসে, তারা একদিন কালীদেবীর শিকার হয়ে যায়।” সে ভাবছিল, যদি তার হাতের পুস্তক সত্যিই কোনো অমঙ্গল ডেকে আনে, তবে তার জীবনের কী হবে? সে কি তার হাতে নিয়ে আসা শক্তির বিপদ সম্পর্কে পুরোপুরি জানত?
তার চোখে রুক্ষতা আর আতঙ্কের ছায়া ছিল, কিন্তু তার সঙ্গে অন্য এক ধরনের উত্তেজনাও অনুভব হচ্ছিল। সে জানত, এই পুস্তক তার জীবনের সবচেয়ে বড় সুযোগ হতে চলেছে—তবে সেই সুযোগের দাম কতটা মহামূল্য, তা এখনো সে বুঝতে পারছিল না। তবুও, এই শক্তির মায়ায় সে আকৃষ্ট হচ্ছিল।
“এটা সবার জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে, কিন্তু আমি এই শক্তি উপভোগ করতে চাই। আমি চাই জানার শেষ সীমা পর্যন্ত পৌঁছাতে। আমি চাই কালীপুরাণের গোপনীয়তা উন্মোচন করতে,” সুমি মনে মনে ভাবছিল। তার চোখে আগ্রহ এবং ভয়ের মিশ্রণ ছিল।
নিরাজ তাকে দেখছিল, তার চোখে এক অদ্ভুত উদ্বেগ। “তুমি যা চাও, তা তুমি পাবে। কিন্তু মনে রেখো, শক্তির দাম অনেক বড়। এই পুস্তক তোমার জীবনকে পুরোপুরি বদলে দেবে—এটা শুধু তোমার নয়, পৃথিবীর জন্যও বিপদ হতে পারে।”
সুমি নিরাজের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ ছিল। তারপর সে বলল, “তুমি কি জানো, যে শক্তি আমি খুঁজছি, সেটি আসলে কি? তুমি জানো কালীপুরাণের পুস্তক আমাদের জীবন বদলে দিতে পারবে, কিন্তু কেন আমরা এটা খুঁজছি? কেন তুমি আমাকে সাহায্য করতে চাইছো?”
নিরাজ গভীর শ্বাস নিয়ে বলল, “তুমি জানো, সুমি, আমি এই পুস্তকের শক্তির হাত থেকে পালিয়ে এসেছি। আমার পূর্বপুরুষরা এটা ব্যবহার করেছিল, আর তাদের সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছিল। এখন আমার কাজ হলো, এই শক্তিকে তোমার হাত থেকে মুক্ত করা। আমি জানি, তুমি কালীপুরাণের মন্ত্র পাবে, কিন্তু তার সাথে সঙ্গে তোমাকে সেই মন্ত্রের বিপদও বহন করতে হবে।”
সুমি মাথা নেড়ে বলল, “আমি ভয় পাই না, নিরাজ। আমি যদি এমন কিছু জানি যা কখনো কেউ জানেনি, তবে আমি কেন তা দিকভ্রান্ত হয়ে ফিরিয়ে আনব?”
তারা উভয়েই মন্দিরের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল, যেখানে এক অদ্ভুত নিরবতা ছিল। মন্দিরের দেয়ালগুলো অতীতের অন্ধকারের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। একসময়, সুমির মনে হলো যেন পুরো মন্দিরটি কাঁপছে। সে অনুভব করল, পুস্তকটির মধ্যে এক অদ্ভুত শক্তি জেগে উঠছে।
ঠিক তখন, এক বিশাল গর্জন শোনা গেল। পুরো মন্দিরটি কাঁপতে শুরু করল, যেন পৃথিবী নিজে জেগে উঠেছে। সুমি অস্থিরভাবে পুস্তকটির পৃষ্ঠাগুলো উল্টাতে শুরু করল। পুস্তকটি এক লোমহর্ষক আলো ছড়িয়ে দিল, আর তার মধ্যে কালীদেবী দেখতে পেল—এক অসীম শক্তির মূর্তি, তার চোখে এক বিরাট আগুন জ্বলছিল, আর তার চারপাশে রক্তিম শিখা ঘুরছিল। কালীদেবী তার চোখের তেজ দিয়ে সুমির দিকে তাকাল, যেন তার আত্মাকে আছড়ে ফেলছে।
“এটাই কালীপুরাণের শক্তি,” নিরাজ তার দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা তোমার আত্মাকে খেয়েছে, সুমি। কালীদেবী যদি তোমার আত্মা গ্রহণ করে, তবে তুমি আর আগের মতো থাকবে না। তোমার জীবনে এক বিশাল পরিবর্তন আসবে, এবং হয়তো তুমি নিজে জানতেও পারবে না, তুমি কোথায় গিয়েছিলে।”
সুমি হঠাৎ তার চোখে চরম আতঙ্ক অনুভব করল। কালীদেবীর চোখের তেজ যেন তার মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছিল। তার শরীর অস্থির হয়ে উঠেছিল। সে বুঝতে পারছিল না, কালীদেবী আসলে তাকে কী করতে চাচ্ছে। কালীপুরাণের শক্তি, যার মধ্যে সে হাত দিয়েছিল, তা এখন তাকে ভক্ষণ করতে চায়।
কালীদেবী হঠাৎ তার গলা দিয়ে কথা বলল, “তুমি যখন আমার শক্তি গ্রহণ করছো, তখন তোমার জীবন অন্ধকারে ভরে যাবে। তুমি যদি সত্যিই জানতে চাও, তাহলে আমাকে মুক্তি দাও। তুমি আমার পূজা করো, তুমি আমিই হয়ে যাও, আমি তোমার মাংস হয়ে যাব। তুমি নিজেকে ধ্বংস করতে চাও?”
সুমি তার ভয়কে অতিক্রম করতে চাইল, কিন্তু সে জানত, এই শক্তি তাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে দেবে না। তার সমস্ত শরীর যেন কাঁপতে লাগল। তার চোখের সামনে কালীদেবীর সেই ভয়ঙ্কর মুখ, তার চোখের জ্বলন্ত আগুন, এবং সেই অদ্ভুত আওয়াজগুলো তার মনের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছিল।
“তুমি কি প্রস্তুত?” কালীদেবী আবার বলল, “তুমি কি জানো, যে শক্তির সন্ধানে তুমি এসেছিলে, তা তুমি রক্ষা করতে পারবে না। তুমি যদি আমাকে গ্রহণ করতে চাও, তবে তুমি আমারই অংশ হয়ে যাবে। তুমি নিজেকে, পৃথিবীকে ধ্বংস করো।”
সুমি তার হাতের পুস্তকটি আরও শক্তভাবে আঁকড়ে ধরল, আর চোখে এক নতুন বিশ্বাস জ্বলে উঠল। “আমি ভয় পাচ্ছি না,” সে বলল, “কালীপুরাণের শক্তি আমার হাতের মধ্যে থাকবে। আমি যা চেয়েছি, তা আমি পাবো। কালীদেবী, তুমি যদি আমার আত্মা চাও, তবে আমি তোমাকে আমার শক্তি দিয়ে দেব।”
কালীদেবী হঠাৎ যেন মৃদু হেসে বলল, “তাহলে শুরু হোক তোমার নতুন জীবন। শুরু হোক তুমিই কালী।”
অন্ধকারের দিকে পতন
সুমি অনুভব করল, সে এক ভয়াবহ অন্ধকারে পড়তে শুরু করেছে। কালীদেবীর শক্তি যেন তার আত্মার গভীরে প্রবাহিত হচ্ছিল, তার শরীর ও মনকে এক অবশ শক্তিতে পরিণত করছিল। মন্দিরের চারপাশে এক অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, এক ধরনের আবেগপূর্ণ নীরবতা, যেখানে শুধু কালীদেবীর প্রভুতো শক্তির ধ্বনি শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল। সুমি আর কখনো এইরকম অনুভূতি অনুভব করেনি—তার আত্মা যেন খালি হয়ে যাচ্ছিল, একমাত্র কালীপুরাণের রহস্যময় শক্তি তার ভিতরে প্রবাহিত হচ্ছিল।
নিরাজ, যিনি সুমি থেকে এক পদক্ষেপ দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, তার চোখে ছিল এক অজানা আতঙ্ক। সে জানত, কালীপুরাণের পুস্তক যে শক্তি ধারণ করে, তা কোনো সাধারণ শক্তি নয়—এটা একটি বিপজ্জনক শক্তি, যা একবার গৃহীত হলে, পৃথিবীকে ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। নিরাজ সুমির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি জানো না, সুমি, তুমি কি করছে। কালীদেবীকে এইভাবে ডেকে আনা বিপদজনক।”
সুমি কিছুটা কেঁপে উঠেছিল, তবে তার চেহারা আর আগের মতো ছিল না। তার চোখে এক অদ্ভুত ঝলকানি, যেন এক নতুন শক্তির প্রভাব তার ওপর পড়েছে। সে এক গভীর শ্বাস নিয়ে বলল, “আমি জানি, নিরাজ। কিন্তু এখন আর পিছু হটতে পারব না। আমি এই শক্তি নিতে চাই। আমি জানি, এর মূল্য অনেক বেশি। কিন্তু আমি প্রস্তুত।”
নিরাজ সুমির দিকে এক তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর মাথা নিচু করে বলল, “তুমি যা চাও, তা তুমি পাবে, কিন্তু তুমি কি জানো, কালীদেবী তোমাকে শুধু শক্তি দেবে না, তোমার জীবনকে ভেঙে ফেলবে? তোমার সমস্ত অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত—এটা সব মুছে ফেলবে।”
সুমি নিরাজের কথাগুলো শুনে কিছুটা চুপ ছিল, তবে তার মনোযোগ কেবল পুস্তকের দিকে ছিল। তার পক্ষে আর পিছিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। কালীপুরাণের পুস্তক এবং কালীদেবীর শক্তি একসাথে তার ভেতরে প্রবাহিত হচ্ছিল, যেন তাকে একটি নতুন পৃথিবীতে নিয়ে যেতে চাইছে। সে জানতো, যে শক্তি তার হাতে আসছে, তা শুধু তাকে নয়, সমস্ত গ্রামকে বদলে দেবে।
কালীদেবীর শক্তি তাকে আরো গভীরে নিয়ে যাচ্ছিল। তার চারপাশে এক মূর্তিমান গা dark ় অন্ধকার তৈরি হচ্ছিল, যেন সে নিজেই সেই অন্ধকারের অংশ হয়ে যাচ্ছিল। সুমি জানতো, তার আর ফিরে আসার উপায় নেই—এটা এক অতীতের গাঁথন এবং ভবিষ্যতের অভিশাপের মধ্যবর্তী যাত্রা। কালীদেবী তাকে কখনো আর নিজেকে ফিরে পেতে দেবে না।
তবে, যখন সুমি তার হাতে থাকা পুস্তকটি শক্তভাবে ধরে রেখেছিল, তখন তার মনে এক নতুন অনুভূতি জন্ম নিল। সে জানলো, তাকে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জীবন শুরু করতে হবে। কালীদেবী তাকে যে ক্ষমতা দিচ্ছিল, সেটি তাকে অনন্ত শক্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, কিন্তু এর মানে ছিল—তার সমস্ত মানবিকতা হারিয়ে যাবে।
“তুমি যদি আমাকে এই শক্তি নিতে দাও, তবে আমাকে তোমার পথে চলে যেতে হবে, কালী। আমাকে পুরোটাই গ্রহণ করতে হবে,” সুমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বলল।
কালীদেবী, যিনি সুমির ভিতরে প্রবাহিত হচ্ছিলেন, তখন তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি এক নতুন জীবন পাবে, সুমি। কিন্তু মনে রেখো, তুমি আর আগের মতো কখনো থাকতে পারবে না। এই শক্তি তোমার আত্মাকে সন্নিবিষ্ট করে দেবে, তবে সেই শক্তির মূল্য তুমি কতটুকু বুঝবে, তা তুমি নিজেই দেখবে।”
সুমি গা dark ় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে হতে এক গভীর শ্বাস নিল। তার ভেতরে এক অদ্ভুত শান্তি এবং উৎকণ্ঠা ছিল। সে জানতো, এই শক্তি তাকে আক্রমণ করবে, কিন্তু সে একেই চেয়েছিল—এই অমর শক্তি, যা এক চিরন্তন পরিবর্তন আনবে তার জীবনকে।
তবে, যখন সুমি তার নতুন জীবনকে গ্রহণ করছিল, তখন তার মনের মধ্যে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—সে কি আসলেই প্রস্তুত ছিল এই শক্তি নিতে? এই শক্তির পথে চলতে চলতে, তার নিজের মানুষ হওয়া কি শেষ হয়ে যাবে? কি হতে চলেছে তার ভাগ্য?
সুমি এখন এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছিল, কিন্তু একসাথে তার কাছে একটি ভয়ও ছিল। সে জানতো, কালীদেবীর শক্তির অধিকারী হয়ে, তার জীবন কি সত্যিই শান্তির দিকে যাবে? নাকি তার আত্মাকে শত্রুতে পরিণত করবে? সমস্ত প্রশ্নের উত্তর শুধুমাত্র সময়ই জানাবে, কিন্তু এখন সুমির সামনে ছিল শুধুমাত্র অন্ধকারের পথ।
“এখন তুমি শুরু হতে চলেছো,” কালীদেবী বললেন, “এখন তুমি আমার শক্তির অংশ।”
শক্তির প্রলোভন
সুমি এক অদ্ভুত অবস্থা অনুভব করছিল—তার দেহের প্রতিটি কোষে শক্তির তীব্র প্রবাহ। কালীপুরাণের পুস্তকটি তার হাতে ছিল, আর তার ভিতর থেকে এক ভীষণ শক্তি নির্গত হচ্ছিল। কালীদেবী, যার চোখের আগুন আর অশ্রদ্ধা যেন তাকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে, তার আত্মাকে প্রবাহিত করছিল। সে জানত, এই শক্তি তার জীবনে এক চিরকালীন পরিবর্তন আনতে চলেছে—এক শক্তি যা আগে কখনো সে অনুভব করেনি। কিন্তু সেই শক্তির সাথে তার অস্তিত্বের যে দ্বন্দ্ব ছিল, তা তার মনে সন্দেহও তৈরি করছিল।
নিরাজ, যিনি ইতিমধ্যেই তার ভয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারছিল না, সুমির দিকে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল। তার চোখে এক সজাগ উদ্বেগ ছিল। সে জানত, কালীপুরাণের পুস্তকটি যে শক্তি ধারণ করে, তা শুধু সুমির নয়, বরং পৃথিবীর জন্যও বিপদজনক। এই শক্তির প্রলোভন এত তীব্র যে, সুমি তা গ্রহণ করার জন্য যে কোনো কিছু করতে প্রস্তুত ছিল।
“সুমি, তুমি কি জানো, তুমি যে শক্তি গ্রহণ করতে যাচ্ছো, তা পুরোপুরি তোমাকে বদলে দেবে? তুমি যে ক্ষমতা চাইছো, তা তোমার আত্মাকে চিরকাল অন্ধকারে হারিয়ে ফেলতে পারে,” নিরাজ বলল, তার গলায় উৎকণ্ঠা ছিল।
সুমি মাথা নেড়ে বলল, “আমি জানি, নিরাজ। তবে আমি এই শক্তির প্রলোভনে আটকা পড়তে চাই না। আমি জানি, কালীদেবী আমাকে শুধুমাত্র শক্তি দিতে আসেনি, সে আমাকে একটা পথ দেখাতে এসেছে। আমি সেই পথেই হাঁটবো।”
নিরাজ তার চোখ বন্ধ করে, এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল, “তুমি যদি পথে চলে যাও, তবে আর পেছনে ফিরতে পারবে না। এই শক্তি তোমাকে গ্রহণ করবে, কিন্তু তোমার মানবিকতা তোমার থেকে চলে যাবে। তুমি যে শক্তি চাও, তা তুমি জানো না—তবে আমি জানি, তোমার জন্য এটি এক অভিশাপ হতে পারে।”
কিন্তু সুমি নিরাজের কথা শুনছিল না। তার মধ্যে কালীপুরাণের শক্তি প্রবাহিত হচ্ছিল, আর সে জানত—এটি তার জীবনের সবচেয়ে বড় সুযোগ। সে জানতো, এই শক্তি তাকে এক নতুন দিগন্তে নিয়ে যাবে, যেখানে পৃথিবী আর স্বপ্নের সীমারেখা মিলিয়ে যাবে।
নিরাজ শেষ পর্যন্ত সুমির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি যদি এই পথ চলতে চাও, তবে আমি আর কিছু বলব না। আমি তোমার পাশে থাকতে পারি না। কালীদেবী তোমার পথপ্রদর্শক হয়ে উঠবে, কিন্তু তুমি একে পরিণত করতে গেলে, তার গতি তুমি বুঝতে পারবে না। তবে, তুমি প্রস্তুত কি না, তা শুধু তোমার উপর নির্ভর করবে।”
সুমি, একে অপরকে যাচাই না করেই, পুস্তকটি আরও শক্তভাবে আঁকড়ে ধরল। তার শরীরে শক্তির ঢেউয়ের মতো এক তীব্র অনুভূতি শিরা বেয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল। তার চোখের সামনে সাদা আলো ঝলমল করতে শুরু করেছিল, আর সেই আলো তার চারপাশে কালীদেবীর উপস্থিতি অনুভব করছিল।
“এখন তুমি আমার। তুমি যে শক্তির সন্ধান চেয়েছিলে, আমি তা দিয়েছি,” কালীদেবী তার মধ্যে প্রবাহিত হয়ে বললেন। “তুমি আমাকে বিশ্বাস করেছো। তবে তুমি জানো, তুমি যে শক্তি নিয়েছো, তা তোমার সমস্ত অস্থিরতা, সমস্ত অন্ধকারকেও শোষণ করবে। তুমি এই শক্তি ব্যবহার করলেই, তোমার হৃদয়ের সকল দুর্বলতা অদৃশ্য হয়ে যাবে।”
সুমি সেই শক্তি গ্রহণ করে মাথা নত করে বলল, “আমি প্রস্তুত। আমি যা চাই, তা আমি পাবো।”
তবে, সুমির ভিতরে কিছুটা শঙ্কা ছিল। সে জানত, তার আত্মা শোষিত হতে চলেছে, কিন্তু সে কিছুতেই ফিরে আসতে চায়নি। শক্তির প্রতি তার আকর্ষণ এতটাই প্রবল ছিল যে, সে নিজেকে হারাতে চেয়েছিল। তার সামনে এক নতুন পৃথিবী খুলে যাচ্ছিল—এক পৃথিবী যেখানে কেবল শক্তিই রাজ করবে, এবং মানুষ তার অস্তিত্বকে শুধুমাত্র শক্তির দ্বারা সংজ্ঞায়িত করবে।
তবে, সুমি জানত, একবার যদি সে এই শক্তির পথ বেছে নেয়, তবে তার জন্য আর কোনো পথ থাকবে না। সেই পথে হাঁটলে, তার মানবিক দিক হারিয়ে যাবে, এবং সে কালীদেবীর প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। তবে সে ভাবল, তার কাছে যদি সমস্ত দুনিয়ার শক্তি এসে যায়, তবে কেমন হবে?
সে এক নতুন দৃষ্টিতে তাকাল—এটা ছিল তার সিদ্ধান্তের মুহূর্ত। সে জানত, এ পথ এক রকম নিরন্তর অন্ধকার, কিন্তু একই সঙ্গে, এটি তার আত্মার মুক্তির পথও হতে পারে।
“আমি যা চেয়েছি, তা আমি পাবো,” সুমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বলল, “এই শক্তি আমাকে নতুন জীবন দেবে, নতুন ক্ষমতা দেবে। আর আমি প্রস্তুত।”
কালীদেবী, যেন সুমির সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট, এক রহস্যময় হাসি দিয়ে বললেন, “তাহলে শুরু হোক তোমার নতুন জীবন, সুমি। তুমি এখন আমার এবং আমি তোমার।”
সুমি এক চরম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তার পথ চলা শুরু করল, জানিয়ে দিল, এই শক্তির সাথে এক নতুন পরিচয় পেতে চায়। তার জীবন, তার অস্তিত্ব এখন কেবল কালীদেবীর পদচিহ্নে ছিল।
অন্তর্দ্বন্দ্ব
সুমি তার নতুন শক্তির মধ্যে ডুবে গিয়েছিল, আর সেই শক্তি তাকে একটি অদ্ভুত স্নিগ্ধতা এবং অশান্তি দিচ্ছিল। কালীদেবী তার সঙ্গে ছিলেন, তার অন্তরে ছড়িয়ে পড়ছিল সেই অমর শক্তি, আর তার চারপাশে প্রতিটি পদক্ষেপে এক নতুন পৃথিবীর জন্ম হচ্ছিল। তবে, সুমি জানতো, এই শক্তি একদিকে যেমন তাকে অসীম ক্ষমতা দিচ্ছিল, তেমনি অন্যদিকে তার মানসিক স্থিরতা আর আত্মবিশ্বাসও ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছিল।
কালীপুরাণের পুস্তকটি এখন তার মনের গভীরে একটি কাল্পনিক স্বপ্নের মতো স্থানে পরিণত হয়েছে। সুমির কাছে এটি আর শুধুমাত্র একটি পুস্তক ছিল না, এটি ছিল তার জীবনের নতুন রচনা, একটি অদৃশ্য শক্তি যা তাকে যে কোনো সীমা ছাড়িয়ে যেতে প্ররোচিত করছিল। কালীদেবীর উপস্থিতি তার সঙ্গেই ছিল—তিনি সবসময় তাকে স্পর্শ করছিলেন, তার আত্মাকে আদর করছিলেন, কিন্তু সেই আদরেও ছিল এক ভয়ানক শূন্যতা। সুমি জানত, কালীদেবী তাকে ভয়ানক শক্তি দিচ্ছেন, কিন্তু সেই শক্তির বিনিময়ে সে কী হারাচ্ছে, সে কি সেটা বুঝতে পারছে?
নিরাজ, যিনি দীর্ঘ সময় ধরে সুমির পাশে ছিল, এখন আরও বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল। সে সুমির প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছিল, কিন্তু সে জানতো, কালীপুরাণের শক্তি এমন একটি শক্তি যা একজনকে তার আত্মার গভীরে শোষণ করে ফেলে। সুমি এই শক্তির লোভে পড়ে একসময় তার মানবিকতাকে হারিয়ে ফেলবে, এই আশঙ্কা তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। একদিন, নিরাজ সুমির সামনে এসে দাঁড়াল।
“সুমি, আমি জানি, তুমি এই শক্তির সাথে তোমার জীবন বদলাতে চাও। তবে মনে রেখো, এই শক্তি তোমার আত্মাকে বিলীন করে দেবে। তুমি যদি সত্যিই কালীদেবীকে পূজা করতে চাও, তবে তোমাকে নিজেকে বিপদে ফেলতে হবে না। তুমি যদি একবার অন্ধকারে ঢুকে পড়ো, তবে আর ফিরে আসা সম্ভব হবে না,” নিরাজ গম্ভীর হয়ে বলল।
সুমি নিরাজের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি জানি, নিরাজ। কিন্তু তুমি জানো, আমি কেবল শক্তি চাইনি, আমি সত্যিও খুঁজতে চেয়েছি। আমার জীবনের লক্ষ্য যদি কেবল শক্তি অর্জন হতো, তবে আমি সেগুলোর জন্য না চলতে, আমি চলেছি জানার জন্য। কালীপুরাণের মন্ত্রের মধ্যে কিছু এমন সত্য আছে, যা পৃথিবীর কেউ জানে না। এবং আমি সেটি জানতেই চেয়েছি। কালীদেবী আমাকে পথ দেখাচ্ছেন, আর আমি সেই পথে যাচ্ছি।”
নিরাজ মাথা নীচু করে নীরব হয়ে থাকল। সুমি বুঝতে পারছিল, সে যা করছে, তা কেবল তার জন্য নয়, গ্রামবাসীদের জন্যও বিপদ ডেকে আনবে। কালীদেবীর শক্তি গ্রহণ করার সাথে সাথে, সে তার অস্তিত্বের সবচেয়ে গভীর এবং অন্ধকার দিকের মধ্যে প্রবেশ করছিল। সে তার আত্মাকে শক্তির কাছে তুলে দিয়েছে, কিন্তু সেই শক্তির দাম কী হতে চলেছে?
সুমি একদিন গভীর রাতে একা বসে ছিল, কালীদেবীর মন্ত্রে মগ্ন। তার চারপাশে অন্ধকার, কিন্তু তার ভিতর এক রহস্যময় আলো জ্বলছিল। সে অনুভব করছিল যে, কালীদেবী তার মধ্যে এক নতুন জীবন দিচ্ছেন, কিন্তু সেই জীবনের সঙ্গে একটি বিশাল খরচও রয়েছে—তার মানবিক অনুভূতি, তার মনোভাব, তার সম্পর্ক, সব কিছুই হারিয়ে যেতে পারে। সে কেবল নিজের অস্তিত্বের নতুন পথের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছিল।
হঠাৎ তার চোখে পড়ল একটি অদ্ভুত দৃশ্য—একটি কালো মূর্তি, কালীদেবীর মুখ, সেদিনের মতো একই আগুনে জ্বলন্ত চোখ। মূর্তিটি এক অদ্ভুতভাবে জীবিত হয়ে উঠল। কালীদেবী তার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “তুমি কি এখন তোমার সিদ্ধান্তের ফল বুঝতে পারছো, সুমি?”
সুমি সজাগ হয়ে উঠল, “তুমি আমাকে যে শক্তি দিয়েছো, আমি তা ব্যবহার করতে চাই, কিন্তু আমি জানি না, সেই শক্তির প্রভাব আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে। আমি নিজেকে হারাতে চাই না, কালী। তুমি আমাকে সেই পথ দেখাও, যেখানে আমি আর কাউকে ক্ষতি না করেই এই শক্তির ব্যবহার করতে পারি।”
কালীদেবী এক গভীর হাসি দিয়ে বললেন, “তুমি যদি এই শক্তির প্রলোভনে পড়ে, তবে তোমার পথ আর তুমি বুঝতে পারবে না। তবে, তোমার বিশ্বাস যদি সত্যি হয়, তবে তুমি একদিন ফিরে পাবে—তোমার আত্মাকে, তোমার মানবিকতা। তবে তার জন্য তোমাকে আমাকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে হবে। আমি তোমার আত্মাকে পরীক্ষা করছি, সুমি।”
সুমি এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। সে জানত, কালীদেবী তাকে যে শক্তি দিচ্ছেন, তা সম্পূর্ণভাবে তার আত্মাকে পরিবর্তন করে ফেলবে। তবে, সে কি প্রস্তুত ছিল সেই পরীক্ষায় পাস করতে? তার ভিতরের অন্তর্দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হচ্ছিল। একদিকে, সে চাইছিল শক্তি গ্রহণ করতে, কিন্তু অন্যদিকে, সে জানত, এই শক্তি তাকে মানবিকতার বাইরে নিয়ে যেতে পারে।
তবে, সুমি জানত, তার সিদ্ধান্ত একদিন সঠিক হবে। সে কালীদেবীর শক্তি গ্রহণ করে নিজের পথ চলতে শুরু করবে—যাতে তার মানবিকতা হারিয়ে না যায়, সেই প্রচেষ্টা করেই।
চূড়ান্ত তান্ত্রিক অভিসম্পাত
সুমি তার শক্তির ভেতর গভীরভাবে প্রবাহিত হচ্ছিল, আর কালীপুরাণের পুস্তক তাকে এক নতুন জীবনের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। সেই শক্তি, যা তাকে এত দিন স্বপ্নের মতো আবদ্ধ রেখেছিল, এখন তার ভিতর এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি হয়ে উঠছিল। সে জানত, তাকে আরও একটি বাধা অতিক্রম করতে হবে—এক চূড়ান্ত অভিসম্পাত, যা তাকে কালীদেবীর পূর্ণ ক্ষমতায় পৌঁছাতে সাহায্য করবে, কিন্তু তার পেছনে একটি ভয়ানক মূল্যও রয়েছে।
নিরাজ তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, তার মুখে এক অদ্ভুত মুগ্ধতা এবং ভয়—ভয় যে, সুমি এখন কোথায় যাচ্ছে, এবং এই শক্তির খেলার পরিণতি কী হতে পারে। সে জানত, সুমি কালীদেবীর পূজা করতে চায়, কিন্তু সে জানত না যে, সেই পূজা তাকে কতটা শোষিত করবে।
“তুমি প্রস্তুত তো, সুমি?” নিরাজ সুমির দিকে তাকিয়ে বলল। তার গলার সুরে কোনো শক্তি ছিল না, শুধুই উদ্বেগের অনুভূতি ছিল।
সুমি তার চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিল। তার ভিতরে কালীদেবীর শক্তি প্রবাহিত হচ্ছিল, যেন তিনি নিজেই তাকে পরিচালনা করছেন। তার চোখের সামনে এক অদ্ভুত দৃশ্য ভেসে উঠল—এটি ছিল সেই চূড়ান্ত অভিসম্পাতের দৃশ্য, যেখানে কালীদেবী তাকে নিজের পূর্ণ শক্তি গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত করছেন।
“হ্যাঁ,” সুমি শেষ পর্যন্ত বলল, “আমি প্রস্তুত। আমি জানি, এটাই আমার শেষ পরীক্ষা। কিন্তু আমি জানি, আমাকে এটা গ্রহণ করতে হবে, যদি আমি সত্যিকার অর্থে কালীদেবীকে পূর্ণভাবে ধারণ করতে চাই।”
“তবে, সুমি, তুমি কি জানো, তোমার যদি আত্মা হারিয়ে যায়, তাহলে তুমি আর ফিরে আসতে পারবে না?” নিরাজ প্রশ্ন করল, তার চোখে এক ধরনের দ্বিধা ছিল। “এই শক্তির সাথে একবার মিশে গেলে, তুমি নিজেকে হারিয়ে ফেলবে। তুমি জানো না, এই পথ ঠিক কোথায় নিয়ে যাবে।”
সুমি এক মুহূর্ত নীরব ছিল, তারপর সে বলল, “আমি জানি, নিরাজ। কিন্তু আমি জানি না, আর কোনো পথ আমার সামনে নেই। আমি এই শক্তির মধ্যে আটকা পড়েছি, এবং আমি জানি, একে গ্রহণ করলে আমি নিজেকে খুঁজে পাবো না, তবে এটি আমাকে সেই জায়গায় নিয়ে যাবে, যেখানে আমি পৃথিবী এবং সৃষ্টির আসল অর্থ বুঝতে পারব।”
নিরাজ সুমির দিকে এক দীর্ঘ দৃষ্টিতে তাকাল। সে বুঝতে পারছিল, সুমি তার সিদ্ধান্তে স্থির। কালীদেবী তার ভিতর প্রবাহিত হচ্ছিল, এবং সুমি আর পিছনে ফিরে আসতে পারবে না। একমাত্র পথ ছিল কালীদেবীর পূজা সম্পূর্ণ করা, কিন্তু এর মূল্য যে অত্যন্ত ভয়ানক হতে পারে, তা সে জানত।
সুমি তার হাতের পুস্তকটি শক্তভাবে ধরল। তার চোখে এক নতুন শক্তি জ্বলছিল, যেন কালীদেবী তাকে নিজ হাতে গড়ে তুলছেন। তাকে এক গভীর অন্ধকারে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এবং সে জানত, সেই অন্ধকারই তাকে নতুন জীবনে প্রবাহিত করবে।
এখন, চূড়ান্ত তান্ত্রিক অভিসম্পাতের সময় এসেছিল। সুমি মন্দিরের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে ছিল, কালীদেবীর শক্তিতে এক নতুন দৃষ্টিতে প্রবাহিত। তার সামনে এক বিশাল মূর্তি দাঁড়িয়ে ছিল—কালীদেবীর। তার চোখ জ্বলছিল আগুনের মতো, এবং তার চারপাশে রক্তিম শিখা ঘুরছিল। সুমি জানত, সে তার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিসম্পাতের জন্য প্রস্তুত।
সুমি পুস্তকটি খুলে উচ্চস্বরে মন্ত্র উচ্চারণ করতে শুরু করল। কালীদেবী, যিনি তার মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছিলেন, তাকে এক অসীম শক্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সুমি জানত, এই শক্তি তার মধ্যে এমন এক অন্ধকার তৈরি করবে, যা সে কখনোই পছন্দ করবে না। তার আত্মা কালীদেবীর হাতে চলে যাবে, কিন্তু তার জন্য মূল্য দিতে হবে—এটা তার জানা ছিল।
মন্দিরের বাতাস গরম হয়ে উঠল, এবং কালীদেবীর শক্তি যেন পুরোপুরি তার ভেতরে প্রবাহিত হচ্ছিল। সে অনুভব করছিল যে, তার সমস্ত দেহের কোষে কালীদেবীর শক্তি অশুভ গতিতে প্রবাহিত হচ্ছে। তার দেহ যেন নিজেই আরেক জীবন্ত অস্তিত্বে পরিণত হচ্ছিল—কালীদেবীর অংশ হয়ে যাচ্ছিল।
ঠিক তখন, সুমি অনুভব করল—এটা তার জন্য এক চূড়ান্ত পরীক্ষা। তাকে শুধু শক্তি গ্রহণ করতে হবে না, তাকে সেই শক্তির সঙ্গে একত্রিত হতে হবে। কালীদেবী তার আত্মাকে নিজের মধ্যে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন, এবং সুমি এবার সেটা বুঝতে পারছিল। কালীদেবী তাকে এক নতুন জীবন দিতে চেয়েছিলেন, তবে সেই জীবনে আর কোনো মানবিকতা, কোনো দ্বন্দ্ব থাকবে না। সে কেবল শক্তি আর অন্ধকারে বিভূত হয়ে যাবে।
কালীদেবী তার সামনে এক অপার্থিব আভা ছড়িয়ে বললেন, “তুমি আর ফিরে আসবে না, সুমি। তুমি এখন আমার অংশ। এই শক্তির সঙ্গে একসাথে তুমি পৃথিবীকে আবার নতুন করে রচনা করবে। তবে মনে রেখো, একবার যদি তুমি এই পথে চলে আসো, তবে আর কোন পথ নেই।”
সুমি এক গভীর শ্বাস নিয়ে বলল, “আমি প্রস্তুত।”
পর্দা উন্মোচন
সুমি অনুভব করছিল, কালীদেবীর শক্তি তার মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছিল, কিন্তু সেই শক্তি তার আত্মাকে এক কঠিন পরীক্ষা দিচ্ছিল। মন্দিরের চারপাশে এক অদ্ভুত নীরবতা ছিল, যেন পৃথিবীও এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সুমি জানত, সে কালীদেবীকে পূর্ণভাবে গ্রহণ করেছে, কিন্তু এর মানে কী? সে কি তার মানবিকতা হারিয়ে ফেলবে? তার অস্তিত্বের এই নতুন পর্যায়ে সে কি নিজেকে বুঝতে পারবে?
কালীদেবী তার চারপাশে ছড়িয়ে দেওয়া আলো দিয়ে সুমির অন্তরাত্মাকে স্পর্শ করছিলেন, এবং সুমি অনুভব করছিল যেন তিনি তার জীবনের সমস্ত দিক খুলে দিয়েছেন। তার চোখের সামনে এক বিশাল অন্ধকার, কিন্তু সেই অন্ধকারের মধ্যে কিছু ছিল যা তাকে শান্তি এবং শক্তি দিচ্ছিল। সে জানত, সে এক নতুন স্তরে পৌঁছেছে, কিন্তু সে বুঝতে পারছিল না, সে কি পেছনে কিছু হারিয়ে ফেলেছে?
কালীদেবী, যিনি এক অদৃশ্য শক্তি হয়ে সুমির মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছিলেন, সুমির চোখে এক রহস্যময় হাসি দিয়ে বললেন, “তুমি এখন আমার। তোমার শক্তি আর মানবিকতা একত্র হয়ে গেছে। তুমি যা চেয়েছিলে, তা তুমি পেয়েছো। কিন্তু এখন, তুমি এক নতুন জীবনের মধ্যে আছো। তুমি আর ফিরে আসতে পারবে না।”
সুমি কষ্টকরভাবে শ্বাস নিয়ে বলল, “তাহলে, আমি এখন কী করবো, কালী? আমি জানি, তুমি আমাকে শক্তি দিয়েছো, কিন্তু আমি কি নিজেকে খুঁজে পাবো?”
কালীদেবী তার কাছে আরও কাছাকাছি এসে বললেন, “তুমি যদি ক্ষমতা চাও, তবে তোমাকে সব কিছু ত্যাগ করতে হবে। আমি তোমাকে জানার পথ দিয়েছি, কিন্তু সেই পথের প্রতিটি পদক্ষেপে এক নতুন সংগ্রাম থাকবে। তোমার আত্মা, তোমার দেহ—এগুলি সব কিছু আমি গ্রহণ করেছি। এখন, তুমি তার শক্তি ব্যবহার করো, তবে তুমি আর আগের মতো থাকবেনা।”
সুমি আরও একবার গভীরভাবে শ্বাস নিল। তার ভিতর এক অদ্ভুত বিশালতা অনুভূত হচ্ছিল। তার চোখে কালীদেবীর সেই আগুনের মতো চোখের ছাপ ছিল, তার চারপাশে এক অসীম শক্তির প্রবাহ। সে জানত, এটি শুধু একটি পরীক্ষা নয়—এটি ছিল তার আত্মার জন্য এক চূড়ান্ত যাত্রা। কালীদেবীর শক্তি যদি সত্যি তাকে নতুন জীবন দেয়, তবে সেই জীবনে আর কোনো দ্বন্দ্ব, কোনো ভীতি থাকবে না। তবে, এর বিনিময়ে তাকে কতটা ত্যাগ করতে হবে, সেটা সে পুরোপুরি বুঝতে পারছিল না।
“কালী,” সুমি অবশেষে বলল, “তুমি যা আমাকে দিয়েছো, তা আমি গ্রহণ করেছি। আমি জানি, আমাকে হয়তো অনেক কিছু ছেড়ে দিতে হবে, কিন্তু আমি সেই পথে এগোতে চাই। আমি এই শক্তি দিয়ে সত্যিকার অর্থে পৃথিবী পরিবর্তন করতে চাই।”
কালীদেবী এক মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, “তুমি প্রস্তুত, সুমি। তুমি এখন আমার অঙ্গ হয়ে উঠেছো। তোমার পক্ষে সব কিছু সম্ভব, কিন্তু মনে রেখো—যতটা শক্তি তুমি চাও, ততটাই তোমাকে নিজের ভিতর থেকে সেই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তুমি যদি নিজেকে হারিয়ে ফেলো, তবে তুমি আর কখনো ফিরে আসতে পারবে না।”
সুমি, এক গভীর শ্বাস নিয়ে, নিজেকে তৈরি করল। সে জানত, সে যে পথে চলতে চলেছে, সেখানে কোনো প্রত্যাবর্তন নেই। কালীপুরাণের শক্তি তাকে এক নতুন পৃথিবীতে নিয়ে যাবে, তবে সে কি সেই পৃথিবীকে ধারণ করতে পারবে? তার মানবিকতা, তার অনুভূতি—এসব কিছু তাকে ছেড়ে যেতে হবে। সে এক নতুন জীবনে প্রবাহিত হচ্ছিল, এক নতুন ক্ষমতার দিকে।
“তাহলে, শুরু হোক,” সুমি বলল, তার মুখে এক দৃঢ় চিত্ত, “আমি তোমার পথ ধরছি, কালী।”
তখন মন্দিরের আকাশে এক অদ্ভুত আলো ছড়িয়ে পড়ল, এবং কালীদেবী তার আশীর্বাদ দিয়ে সুমির ভিতরে প্রবাহিত হলেন। সুমি জানত, এখন তার জীবনের পুরনো দ্বন্দ্ব, পুরনো ভয় সব কিছু একে একে অদৃশ্য হয়ে যাবে। কালীদেবীর শক্তি তার মধ্যে প্রবাহিত হয়ে, তাকে নতুন জীবনের পথে চালিত করবে।
যতদূর সে এগিয়ে যাবে, ততই সে বুঝতে পারবে, কালীদেবী তাকে ক্ষমতার যাত্রায় আগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু সেই যাত্রার মূল্য অনেক বেশি। এই শক্তির বিনিময়ে তার নিজের অস্তিত্বের চূড়ান্ত পরীক্ষা অপেক্ষা করছে।
সুমি এক নতুন শক্তির মাঝে ডুবে গেল, জানিয়ে দিল—তার আত্মা কালীদেবীর সঙ্গে এক হয়ে গেছে, আর সে এই শক্তির পথে অগ্রসর হবে। আর এই যাত্রায়, তার নিজের মানবিকতা আর কিছুই থাকবে না।
এটি ছিল তার পর্দা উন্মোচন—এক নতুন জীবনের, এক নতুন শক্তির, এক নতুন অস্তিত্বের।
শেষ