অভ্রাংশু দত্ত
অধ্যায় ১ – হারানো পান্ডুলিপি
কলকাতার রাত কখনোই পুরোপুরি ঘুমোয় না। দক্ষিণ শহরতলির রাস্তাগুলোতে আলো-অন্ধকারের খেলা যতই সস্তা ল্যাম্পপোস্টে ঝিলমিল করুক, কালীঘাট মন্দির চত্বর যেন অন্য এক জগতের ছায়ায় ঢাকা থাকে। মন্দিরের চৌহদ্দিতে শঙ্খ আর ঘণ্টার ধ্বনি মিলেমিশে যায় গঙ্গার স্রোতের দূরবর্তী শব্দের সঙ্গে। কিন্তু আজ রাতটা অন্যরকম। অয়ন মুখার্জি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, হাতে একটি পুরনো টর্চ আর নোটবুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দক্ষিণ প্রাচীরের কাছে—যেখানে সাধারণ ভক্তরা কখনো যায় না।
সে আসলে খুঁজছে এক গোপন সূত্র। সপ্তাহ খানেক আগে মন্দিরের পুরনো ভাণ্ডারঘরে সংস্কারের সময় মজুরেরা ভাঙা ইটের দেয়ালের ফাঁক থেকে একটা অদ্ভুত কাগজের খণ্ড পেয়েছিল। হলদেটে, প্রায় ঝুরঝুরে কাগজের গায়ে লেখা ছিল কিছু অচেনা অক্ষর। মন্দির কমিটি এটাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু অয়ন যখন খণ্ডটা দেখল, তার বুক কেঁপে উঠল। সে বুঝল—এটা কোনো সাধারণ লিপি নয়। এগুলো প্রাচীন তন্ত্রশাস্ত্রের সংকেত, যার নাম সে বইয়ে পড়েছিল: অমায়া তন্ত্র।
আজ সেই কাগজের খণ্ড ফেরত নেওয়ার জন্যই সে এসেছে। মন্দিরের এক বৃদ্ধ পুরোহিত, হরি ভট্টাচার্য, যিনি ইতিহাসের প্রতি কৌতূহলী, গোপনে অয়নকে বলেছিলেন—“ওটা স্রেফ কাগজ নয়। পাণ্ডুলিপির টুকরো। একে যারা ছুঁয়েছিল তাদের মধ্যে দু’জন আজও অসুস্থ। সাবধানে থেকো।”
অয়ন ভেবেছিল, হয়তো গুজব। কিন্তু তার গবেষণার অন্তর্দৃষ্টি বলেছিল, এই পান্ডুলিপি আসলে এক গুপ্ত শক্তির চাবিকাঠি।
মন্দিরের গা ছমছমে করিডর পেরিয়ে সে ভাণ্ডারঘরের ভেতরে ঢুকল। বাতাসে ধূপ-ঘামের মিশ্র গন্ধ। টর্চের আলোয় ধুলো ভাসছে। কাঠের আলমারিগুলোতে স্তুপ করে রাখা আছে ভাঙা মূর্তি, ছেঁড়া কাপড়, পুরনো ভক্তিগীতি। এক কোণায় মাটির হাঁড়িতে মুড়ে রাখা খণ্ডটা লুকোনো ছিল।
অয়ন কাগজটাকে আলতো করে তুলতেই হাওয়ায় হঠাৎ একটা ভারি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল—যেন জ্বলা সরষের তেল আর ভেজা মাটির গন্ধ একসঙ্গে। তার শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেল। কাগজে কালো কালি দিয়ে আঁকা কিছু চিহ্ন, মন্ত্রের টুকরো, আর নিচে লাল রঙের রেখা—যেন রক্ত দিয়ে লেখা।
সে নোটবুকে দ্রুত আঁকতে শুরু করল প্রতিটি চিহ্ন। তখনই বাইরে থেকে একটা শব্দ এল—ধুপধাপ করে কারও হাঁটার আওয়াজ।
অয়ন গা সেঁধিয়ে গেল অন্ধকারে। ভেতরে ঢুকল দু’জন লোক। তাদের কণ্ঠস্বর নিচু, কর্কশ—
“ওটা এখানেই আছে?”
“হ্যাঁ, নেতা বলেছে আজ রাতেই নিয়ে যেতে হবে। কালকের যজ্ঞের আগে পাওয়া না গেলে বিপদ।”
অয়নের বুকের ভেতর হিম শীতলতা ছড়িয়ে গেল। কাকে বলছে এরা? কে সেই নেতা? আর কোন যজ্ঞের কথা হচ্ছে?
এক মুহূর্তে বুঝতে পারল, সে একা নয়। আর পান্ডুলিপিটা নিয়ে শুধু সে নয়, আরও কেউ মরিয়া হয়ে উঠেছে।
সে কাগজটাকে বুকের ভেতর চেপে ধরল। ঠিক সেই সময় আলমারির ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়ল টর্চের এক ঝলক আলো, আর লোকগুলোর চোখে ধরা পড়ল অয়নের ছায়া।
“কে ওখানে?”
অয়ন আর দেরি করল না। দরজা ভেঙে সে ছুটে বেরোল করিডর ধরে। ঘণ্টার শব্দ যেন আরও জোরে বাজতে লাগল, গঙ্গার স্রোত যেন গর্জে উঠল—কালীঘাটের রাত আজ আর শান্ত নয়।
অধ্যায় ২ – মন্ত্রের ছায়া
অয়ন দৌড়ে মন্দিরের গলি পেরিয়ে এলো, বুক ধড়ফড় করছে, কানে যেন ঘণ্টার শব্দ আটকে আছে। অন্ধকার রাতের হাওয়া কপালে এসে লাগল, তবু শরীরের ঘাম শুকোল না। বুকের ভেতরে লুকোনো সেই হলদেটে খণ্ড যেন ভারি হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছিল কাগজ নয়—ওটা একটা জীবন্ত প্রাণী, দপদপ করছে তার শিরার ভেতর।
রাস্তার মাথায় পৌঁছে সে এক মুহূর্ত থামল। পেছন ফিরে দেখল—গলির ভেতর দুটো ছায়া নড়ে উঠছে। তারাও ছুটছে। অয়ন তৎক্ষণাৎ রিকশা থামিয়ে উঠে পড়ল। রিকশাওয়ালা বিস্মিত চোখে তাকাল, “বাবু, এত রাতে কোথায় যাবেন?”
অয়ন তাড়াহুড়ো করে বলল, “রাসবিহারী—চলো!”
রিকশা কাঁপতে কাঁপতে এগোতেই অয়ন বুক থেকে কাগজটা বের করল। ম্লান রাস্তার আলোয় আবার তাকাল সে। অক্ষরগুলো যেন ছটফট করছে, একেকটা রেখা কাঁপছে টর্চের আলোয়। সে ভেবেছিল স্রেফ প্রাচীন লিপি—কিন্তু এগুলো যেন শ্বাস নিচ্ছে।
হঠাৎ একটা অক্ষর থেকে লাল আভা ছড়িয়ে উঠল। রিকশাওয়ালা ঘাড় ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল, “বাবু, আলোটা কই থেকে আসছে?”
অয়ন তাড়াতাড়ি খণ্ডটা গুটিয়ে নিল। বলল, “কিছু না—পুরোনো কাগজ।”
কিন্তু তার ভেতরে ভয় জমাট বাঁধতে লাগল। মন্ত্রের ছায়া কি এখনই সক্রিয় হয়ে উঠছে?
ফ্ল্যাটে পৌঁছে দরজা বন্ধ করে সে টেবিলে কাগজটা রাখল। লাইট জ্বালিয়ে বারবার চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিল চিহ্নগুলোর উপর। নোটবুকে আঁকা ছবিগুলো মিলিয়ে দেখল। কোথাও যেন পড়া যায়—
“অগ্নিকুণ্ডে দেহ, শূন্যে চেতনা, রক্তে শক্তি।”
এই তিনটা লাইন যেন বুকের ভেতর ঢুকে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল—এগুলো উচ্চারণ করলেই কিছু ঘটে যাবে।
অয়ন নিজেকে বোঝাল—না, আমি গবেষক, বৈজ্ঞানিক। এসব কুসংস্কার হতে পারে, কিন্তু প্রমাণ চাই। সে ফিসফিস করে প্রথম শব্দটা পড়ল—
“অগ্নিকুণ্ডে…”
কথাটা উচ্চারণ করা মাত্র ঘরের আলো দপ করে নিভে গেল। টিউব লাইটের ভেতর থেকে ধোঁয়ার গন্ধ বেরোল। জানালা দিয়ে এক ঝটকা হাওয়া এসে কাগজটাকে উড়িয়ে দিল মেঝেতে। অয়ন থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল।
কিছুক্ষণ পর লাইট আবার জ্বলে উঠল। চারপাশ স্বাভাবিক। কিন্তু তার বুক ধড়ফড় করছে, ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ।
সে কাগজটা তুলতে হাত বাড়াতেই হঠাৎ টেবিলের কাচের গ্লাস ভেঙে পড়ল। অয়ন পিছিয়ে গেল। ভাঙা টুকরোগুলোয় যেন আলো ঝলক খেলল, আর ভেতরে সে দেখল—অস্পষ্ট এক মুখ। রক্তমাখা চোখ, শূন্যে ভেসে থাকা।
অয়ন চোখ মুছে আবার তাকাল—না, কিছুই নেই। শুধু ভাঙা গ্লাস। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে বুঝল, মন্ত্র সক্রিয় হয়েছে।
পরদিন সকালে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেল। প্রাচীন লিপির অধ্যাপক অনিরুদ্ধ সেনগুপ্তকে দেখাল নোটবুকের আঁকা প্রতিলিপি।
অধ্যাপক কিছুক্ষণ দেখে বললেন, “এগুলো সাধারণ মন্ত্রচিহ্ন নয়। দেখো—এই বাঁক, এই বৃত্ত—এসব ‘বেদসূত্র’ থেকে আলাদা। এটা tantric cryptography। গোপন মন্ত্র যাতে সাধারণ চোখে ধরা না পড়ে, তার জন্য এইভাবে লেখা হত।”
অয়ন জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু এগুলো কি পড়া যায়?”
অধ্যাপক ভুরু কুঁচকে বললেন, “পুরো পান্ডুলিপি ছাড়া কঠিন। তবে এই শব্দটা—দেখছ?—‘অগ্নিকুণ্ড’। এর মানে আগুন, বলি, দাহ। আর পাশে লাল দাগগুলো কালি নয়—রক্তের ছাপ। সম্ভবত যাঁরা লিখেছিল, তাঁদের রক্ত ব্যবহার করা হয়েছিল।”
অয়ন শিউরে উঠল। “তাহলে এটা কি মানুষ হত্যা করার মন্ত্র?”
অধ্যাপক গম্ভীর হয়ে বললেন, “তন্ত্রে মৃত্যু মানেই শেষ নয়। অনেক সময় মৃত্যু হচ্ছে শক্তিকে রূপান্তর করার পথ। কারা এটা চাইছে?”
অয়ন থম মেরে গেল। রাতের সেই দুটো ছায়া মনে পড়ল। নেতা, যজ্ঞ—এইসব কথাগুলো কানে বাজল।
অধ্যাপক তাকালেন তার চোখে, “অয়ন, সাবধানে থেকো। এরা যদি সত্যি সক্রিয় হয়, তবে শুধু তুমি নয়, শহরটাই বিপদে পড়বে।”
বিকেলের দিকে অয়ন কলেজ স্ট্রিটের এক বইয়ের দোকানে ঢুকল। গোপনে সে খুঁজছিল অমায়া তন্ত্রের কোনো উল্লেখ। এক পুরোনো বই পেল—“তান্ত্রিক লিপির অভিধান”। বইটা উল্টে সে দেখতে পেল কিছু চিহ্নের মিল আছে। সেখানে লেখা—
“এই লিপি সক্রিয় হলে মৃত আত্মাদের দ্বার খোলে।”
অয়ন বুক কেঁপে উঠল। রাতের মুখটাকে সে ভুলতে পারছিল না।
হঠাৎই দোকানের বাইরে হৈচৈ শোনা গেল। কেউ একজন চিৎকার করছে, “চোর! ধরো!”
অয়ন তাকিয়ে দেখল, এক লোক দৌড়ে পালাচ্ছে। হাতে মোটা একটা ফাইল। চোখে পড়ল এক মুহূর্তের জন্য—ফাইলের মলাটে লাল রঙে লেখা Codex।
লোকটা হঠাৎ অয়নের সামনে এসে ধাক্কা খেল। তার হাতে কাগজের খণ্ডটা তখনও ছিল। ধাক্কায় দুটো কাগজ মিশে গেল এক মুহূর্তে।
আর তখনই চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল। যেন দোকানের বাতি নিভে গেছে, রাস্তার গাড়ির শব্দ বন্ধ। লোকগুলো, দোকানি—সব স্থির হয়ে গেছে।
অয়ন টের পেল, তার বুকের ভেতর কাগজ দপদপ করছে। মন্ত্র আবার সক্রিয় হলো।
তার কানে বাজল অদ্ভুত এক শব্দ, যেন বহু মানুষের একসঙ্গে মন্ত্রোচ্চারণ—
“রক্তে শক্তি, রক্তে মুক্তি…”
অয়ন চিৎকার করে উঠল, “থামো!”
এক ঝলক আলো ফুটে উঠল। চারপাশ আবার স্বাভাবিক। লোকটা আর নেই। শুধু মাটিতে পড়ে আছে একটা ছেঁড়া কাগজের অংশ।
অয়ন কাগজটা হাতে তুলে নিল। দেখল—এবার মন্ত্রের বাকিটা মিলেছে।
“অগ্নিকুণ্ডে দেহ, শূন্যে চেতনা, রক্তে শক্তি, জনসমুদ্রে শাসন।”
সে নিঃশ্বাস নিতে পারল না। এখন সে নিশ্চিত—এটা নিছক মন্ত্র নয়। এটা মানুষের চেতনা দখল করার অস্ত্র।
অয়ন ঘরে ফিরে সারারাত জেগে রইল। জানালার বাইরে অমাবস্যার আকাশ। দূরে কুকুরের ডাক। হাতে ধরা খণ্ডদুটো টেবিলে রেখে সে বারবার পড়ছিল। প্রতিবার পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই চারপাশে ছায়া নড়ে উঠছিল।
মাঝরাতে হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। অয়ন আঁতকে উঠল।
“কে?”
কোনো উত্তর নেই। আবার কড়া নাড়া।
সে দরজা খুলে দেখল—সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক বৃদ্ধ ভিখিরি। চোখ দুটো অদ্ভুত লালচে। সে হেসে বলল,
“বাবু, কাগজ পেয়েছো তো?”
অয়ন স্থির হয়ে গেল। কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল তার।
ভিখিরি এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল,
“পাঠ করো না, নয়তো তুমি-ই হবে প্রথম বলি।”
এরপরই লোকটা অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকার গলিতে।
অয়ন দরজা বন্ধ করে কাগজের দিকে তাকাল। তখনই মন্ত্রের শব্দ আবার তার কানে বাজল—
“জনসমুদ্রে শাসন…”
তার শরীর কাঁপতে লাগল। মন্ত্রের ছায়া এখন শুধু চারপাশে নয়, তার নিজের ভেতরেও ঢুকে পড়ছে।
অধ্যায় ৩ – রক্তের শপথ
কলকাতার রাতের কুয়াশা নেমে এসেছে। ছাদের ধারে দাঁড়িয়ে অয়ন গঙ্গার দিকের আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। অন্ধকার যেন আরও গভীর হয়েছে। টেবিলের ওপর রাখা পান্ডুলিপির খণ্ডদুটো মাঝে মাঝেই মৃদু আলো ছড়াচ্ছিল। অয়ন জানে—এই আলো বিদ্যুতের খেলা নয়। এ এক জীবন্ত প্রতিক্রিয়া।
ভেতরে ভেতরে তার মনে হচ্ছিল, কাগজগুলো তাকে ডাকছে। যেন কণ্ঠে ফিসফিস করছে, “আমায় পূর্ণ করো, নইলে তোমার শ্বাস থেমে যাবে।”
সেই মুহূর্তে তার মাথায় ঝড়ের মতো ফিরে এল ভিখিরির সতর্কবাণী— “পাঠ করো না, নয়তো তুমি-ই হবে প্রথম বলি।”
কিন্তু গবেষকের জেদ তাকে থামতে দিল না। অয়ন জানে, ইতিহাসের অনেক বড় আবিষ্কারই প্রথমে ভয় আর রক্তের মধ্যে দিয়ে জন্ম নিয়েছিল।
পরদিন সকালে সে ছুটে গেল জাতীয় গ্রন্থাগারের বিরল পাণ্ডুলিপি বিভাগে। পুরোনো তালাশের মধ্যে যদি কিছু পাওয়া যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা খুঁজে শেষে সে পেল একটা বই—“শ্মশান তন্ত্র: রুদ্র অধ্যায়”। বইটার পাতাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে পড়ছিল। হঠাৎ চোখ আটকে গেল এক জায়গায়—
“অগ্নিকুণ্ডের মন্ত্র তখনই পূর্ণ শক্তি পায় যখন তার সঙ্গে যুক্ত হয় ‘রক্তের শপথ’। তন্ত্রপাঠের পর যে মানব বলি দেওয়া হয়, তার রক্ত দিয়েই লিপি আঁকা হয়। সেই রক্তেই সীলমোহর হয় মন্ত্রের।”
অয়ন স্তব্ধ হয়ে গেল। গায়ে কাঁটা দিল। মানে—এই পান্ডুলিপির শক্তি সক্রিয় করতে হলে মানুষের রক্তের প্রয়োজন।
গ্রন্থাগারের নির্জন করিডর ধরে বেরিয়ে আসতে আসতে অয়নের মনে হচ্ছিল, তার চারপাশে কেউ হাঁটছে। পেছনে তাকাল—কেউ নেই। কিন্তু বুকের ভেতরে চাপা ধকধকানি থামল না।
হঠাৎই বাইরে থেকে ফোন এল। অধ্যাপক অনিরুদ্ধ সেনগুপ্ত।
“অয়ন, আজই আমার কাছে চলে আসো। তোমাকে জরুরি কিছু বলতে হবে।”
অয়ন অবাক হল। “স্যার, কী হয়েছে?”
“এখানে ফোনে বলা যাবে না। সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে এসো। মনে রেখো, এখন যাদের সঙ্গে তোমার দেখা হচ্ছে, সবাই বন্ধু নয়।”
সন্ধ্যায় বেলগাছিয়ার পুরোনো দোতলা বাড়িতে পৌঁছে অয়ন। অল্প আলো জ্বলছে, বাড়ির চারপাশে অদ্ভুত নীরবতা। দরজা খুললেন অধ্যাপক নিজে। মুখ ফ্যাকাশে, চোখ লালচে। তিনি টেবিলে বসে অয়নকে ইশারায় ডেকে নিলেন।
“তুমি যে খণ্ড পেয়েছো, আমি জানি সেটা কী।”
অয়ন চমকে উঠল, “স্যার, আপনি জানেন?”
অধ্যাপক ধীরে বললেন, “ওটা অমায়া তন্ত্রের চতুর্থ অধ্যায়ের অংশ। নাম—‘রক্তের শপথ’। এই অংশেই বলা আছে কিভাবে মন্ত্র ব্যবহার করে হাজার হাজার মানুষের চেতনা দখল করা যায়।”
অয়ন কণ্ঠ শুকিয়ে গেল। “কিন্তু কে ব্যবহার করত এগুলো?”
অধ্যাপক তাকালেন তার দিকে। “শক্তিশালী পরিবার, রাজারা, আবার কখনও বিদ্রোহীরা। কিন্তু মনে রেখো, একে সক্রিয় করতে হলে বলির প্রয়োজন। আর সেই বলি শুধু মানুষই হতে পারে।”
অয়ন কাঁপা গলায় বলল, “মানে তো… হত্যাই আসল শর্ত?”
অধ্যাপক মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বললেন, “হত্যা নয়—এটা ছিল ‘শপথ’। যে রক্ত দেওয়া হত, তা আসলে প্রতিজ্ঞা করত তন্ত্রকে। একবার সেই শপথ দিলে পুরো বংশ আবদ্ধ হয়ে যেত এই শক্তির সঙ্গে।”
অয়ন কথা বলার আগেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। দু’জন অচেনা লোক ঢুকে পড়ল ঘরে। কালো পোশাক, চোখে কড়া দৃষ্টি।
তাদের একজন বলল, “অধ্যাপক, নেতা পাঠিয়েছে। সময় ফুরিয়ে আসছে। পান্ডুলিপিটা দরকার।”
অয়ন অবাক হয়ে তাকাল। “আপনারা এখানে কিভাবে—?”
অধ্যাপক থেমে গেলেন। অয়ন দেখল, তাঁর মুখে অদ্ভুত দ্বিধা। এক মুহূর্ত যেন তাঁর চোখে ভয়, অপর মুহূর্তে অদ্ভুত প্রশান্তি।
লোকগুলো কাছে আসতে অয়ন চেয়ার ঠেলে দাঁড়াল। তার বুকের কাছে খণ্ডটা গুঁজে রাখা।
“না, এটা আমি দিতে পারব না।”
লোকদুটো গম্ভীর হাসল। “তাহলে তুমি-ই হবে প্রথম বলি।”
অধ্যাপক হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠল।
“না! আজ নয়। অয়ন এখনও দরকার।”
অয়ন অবাক হয়ে তাকাল। “স্যার, আপনি…?”
অধ্যাপক চোখ নামিয়ে বললেন, “আমি বাঁচিনি এতদিন শুধু গবেষক হয়ে। আমিও একসময় এই তন্ত্রের পথিক ছিলাম। এখন আর সময় নেই, অয়ন। তারা চাইবে তোমাকে ব্যবহার করতে।”
লোকগুলো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। একজন ছুরি বের করল। অয়ন ঘাবড়ে গেল। কিন্তু তখনই অধ্যাপক নিজের আঙুল কেটে মেঝেতে আঁকতে লাগলেন এক অদ্ভুত চিহ্ন। রক্তে আঁকা মন্ত্র।
ঘর কেঁপে উঠল। বাতাস হুহু করে বইতে লাগল। ছুরিওয়ালা লোকটা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।
অন্যজন ভয়ে পালিয়ে গেল।
অয়ন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। “স্যার, এটা কী করলেন?”
অধ্যাপক হেসে বললেন, “এই হলো রক্তের শপথ। নিজের রক্ত দিয়েও তন্ত্র সক্রিয় করা যায়। কিন্তু মনে রেখো—প্রতিটি শপথের দাম আছে।”
তিনি হঠাৎ কাশতে লাগলেন। ঠোঁট থেকে রক্ত ঝরতে লাগল।
অয়ন ছুটে এল। “স্যার!”
অধ্যাপক ফিসফিস করে বললেন, “অয়ন, যদি সত্যিই জানতে চাও, তাহলে কালীঘাটের দক্ষিণের শ্মশানে যাও। ওখানেই আসল যজ্ঞ হবে। আর মনে রেখো—তুমি একা নও। তোমার রক্তও তারা চাইবে।”
এই কথা বলেই তিনি হঠাৎ জ্ঞান হারালেন।
অয়ন আতঙ্কে দৌড়ে বেরিয়ে এলো। রাস্তায় বাতি দপদপ করছে। বুকের ভেতর পান্ডুলিপি যেন আগুনের মতো গরম।
সে বুঝল—এই লড়াই কেবল ইতিহাস জানার লড়াই নয়। এটা তার নিজের অস্তিত্বের লড়াই হয়ে উঠছে।
রক্তের শপথ হয়ে গেছে। আর এখন থেকে সে আর স্রেফ গবেষক অয়ন নয়—সে এই তন্ত্রযুদ্ধের অংশ হয়ে গেছে।
অধ্যায় ৪ – রাজনৈতিক গোপন খেলা
কলকাতার সকালের রাস্তা তখনও পুরোপুরি ভিড়ে ভর্তি হয়নি। গঙ্গার দিক থেকে কুয়াশা ভেসে আসছে, চায়ের দোকানগুলোতে টগবগে কেটলির গন্ধ। অয়ন কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ট্যাক্সি ধরল। সারা রাত সে ঘুমোয়নি। অধ্যাপক অনিরুদ্ধের বাড়িতে যা ঘটল, তার ভেতরটা এখনও কাঁপছে। রক্তের মন্ত্র, ছুরি হাতে লোকগুলো, আর অধ্যাপকের শেষ সতর্কবার্তা—সব মিলিয়ে তার মাথায় একটা মাত্র শব্দ ঘুরছে—“যজ্ঞ।”
অয়ন জানে, কেউ একজন, হয়তো কোনো প্রভাবশালী শক্তি, এই মন্ত্র ব্যবহার করতে চাইছে। আর সেটা করতে গেলে শুধু শ্মশান নয়, লাগবে রাজনীতি। ক্ষমতা ছাড়া হাজার মানুষের চেতনা দখল করার প্রচেষ্টা অসম্ভব।
ট্যাক্সি নামল বিধানসভা চত্বরে। অয়ন অনেক ভেবে এসেছে—সরাসরি কিছু জানার একটাই জায়গা আছে। তার কলেজের পুরোনো বন্ধু, এখন রাজনৈতিক রিপোর্টার, অদ্বৈত ঘোষ।
অদ্বৈতের সঙ্গে দেখা হলো এক কফি হাউসের ভেতর। সিগারেটের ধোঁয়া, বকবকানি, মগভর্তি কফি—সব মিলিয়ে গুমোট পরিবেশ।
“অয়ন, তুই হঠাৎ আমাকে খুঁজছিস কেন?” অদ্বৈত চোখ ছোট করে তাকাল।
অয়ন ধীরে বলল, “কোনো বড় যজ্ঞের আয়োজন কি হতে চলেছে শহরে? ধর্মীয় নয়—রাজনৈতিক।”
অদ্বৈত থমকে গেল। এক চুমুক কফি খেয়ে বলল, “তুই কালীঘাটের খবর জানিস না? মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ পাল ঠিক করেছে পূর্ণিমার রাতে হাজারো ভক্তকে জড়ো করবে। নাম দেবে ‘শক্তি সম্মিলনী’। বলা হচ্ছে, এটা দেবীর আরাধনা। কিন্তু ভিতরের কথা আলাদা।”
অয়ন এগিয়ে এল, “আলাদা মানে?”
অদ্বৈত ফিসফিস করে বলল, “শোনা যাচ্ছে, সেখানে বিশেষ এক পুঁথি ব্যবহার করা হবে। মন্ত্র উচ্চারণ করে জনতার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা হবে। লোকটা শহরকে নিজের কবজায় নিতে চাইছে।”
অয়ন ঠাণ্ডা হয়ে গেল। তার বুকের ভেতর খণ্ডগুলো যেন আরও গরম হয়ে উঠল।
সেদিন বিকেলেই অয়ন গেল কালীঘাটের কাছাকাছি এক রাজনৈতিক কার্যালয়ে। দূর থেকে দেখল বিশাল ব্যানার, নেতা রবীন্দ্রনাথ পাল জনতার দিকে হাত নাড়ছেন। গলায় ঝোলানো মালা, চারপাশে উল্লাস। কিন্তু অয়ন লক্ষ্য করল, নেতার চোখে অদ্ভুত এক শূন্যতা। যেন তিনি কিছু দেখছেন যা অন্যরা দেখে না।
পাল হঠাৎই মঞ্চ থেকে নামলেন, অয়নকে ভিড়ের মধ্যে দেখতে পেলেন। কেমন যেন চেনা চেনা ভঙ্গিতে এগিয়ে এলেন।
“তুমি-ই অয়ন মুখার্জি, তাই না? গবেষক?”
অয়ন চমকে উঠল। “আপনি আমাকে চেনেন?”
পাল হেসে বললেন, “গবেষকরা সবকিছুর খোঁজ করেন। কিন্তু কিছু জিনিস আছে যেগুলো গবেষণার জন্য নয়—শক্তির জন্য। তুমি সেটা পেয়েছো।”
অয়ন শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা ঘাম নামতে লাগল। নেতার ইঙ্গিত স্পষ্ট—তিনি জানেন পান্ডুলিপির কথা।
রাতেই অয়ন ফোন পেল অদ্বৈতের কাছ থেকে।
“দোস্ত, সাবধানে থাকিস। আমার কাছে খবর এসেছে, পাল-এর লোকজন তোকে ফলো করছে। ওরা জানে তোর কাছে কিছু আছে। যদি সম্ভব হয়, আজ রাতেই শহর ছাড়।”
অয়ন জানে পালানো কোনো সমাধান নয়। সে ঠিক করল সত্যি জানতেই হবে।
সেই রাতে সে গোপনে ঢুকল এক পুরোনো বাড়িতে, যেখানে পালের ঘনিষ্ঠ অনুগামীরা মিটিং করছে। অন্ধকারে জানলার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে অয়ন শুনল তাদের আলোচনা।
“যজ্ঞের জন্য খণ্ডটা আমাদের হাতে আনতেই হবে।”
“অধ্যাপক সেনগুপ্ত ব্যর্থ হয়েছে।”
“অয়ন মুখার্জি এখন টার্গেট।”
অয়ন গা শিউরে উঠল। হঠাৎই ভেতরে পাল ঢুকলেন। তাঁর কণ্ঠ গর্জে উঠল—
“খণ্ড ছাড়া যজ্ঞ হবে না। কিন্তু খণ্ড আমার হাতেই আসবে। ওটা আমায় বেছে নিয়েছে।”
তিনি হাত তুলে মন্ত্রোচ্চারণ করতে লাগলেন। অয়ন স্পষ্ট শুনতে পেল—“অগ্নিকুণ্ডে দেহ, শূন্যে চেতনা, রক্তে শক্তি, জনসমুদ্রে শাসন।”
কথার সঙ্গে সঙ্গে ঘর কাঁপতে লাগল। বাতি নিভে গেল। অয়ন দেখল ভেতরে ধোঁয়ার মধ্যে ভেসে উঠছে অস্পষ্ট মানবমূর্তি। মৃত যোদ্ধারা যেন দাঁড়িয়ে আছে নেতার চারপাশে।
অয়ন ভয়ে পিছু হটল। তার মাথায় শুধু একটাই ভাবনা—এটা আর কোনো ধর্মীয় আচার নয়, এটা রাজনৈতিক অস্ত্র।
ভোররাতে ঘরে ফিরে সে বুঝল, খণ্ডগুলোর আসল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এগুলো এখন শুধু তার হাতে থাকা কাগজ নয়, নেতার লোভ, রাজনীতির ষড়যন্ত্র, আর মৃত আত্মাদের সঙ্গে বাঁধা পড়া এক ভৌতিক চুক্তি।
অয়ন আয়নায় নিজের চোখের দিকে তাকাল। মনে হলো তার ভেতরেও মন্ত্র ঢুকে গেছে। চোখের গভীরে শূন্যতা দেখা দিল।
সে ধীরে ফিসফিস করে বলল,
“আমি যদি হারাই, শহরও হারাবে।”
অধ্যায় ৫ – প্রাচীন তন্ত্রশালা
কালীঘাটের দক্ষিণে, গঙ্গার ধারে অচেনা এক সরু গলি। শোনা যায়, সেখানে একসময় শ্মশান ছিল। এখন ভাঙাচোরা ঘরবাড়ির ফাঁকে গজিয়ে উঠেছে নতুন দালান, দোকান, মন্দিরের প্রসাদ বিক্রির স্টল। তবু রাত নামলে গলিটা যেন অন্য এক সময়ে সরে যায়। অয়ন আজ সেই গলিতে ঢুকেছে।
অধ্যাপক অনিরুদ্ধের শেষ নির্দেশ ছিল—“শ্মশানে যাও।” আর রাজনৈতিক নেতার যজ্ঞের আভাস তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে, খণ্ডগুলোর রহস্য না জানলে সে বাঁচবে না।
গলির শেষে একটি লোহার গেট। মরচে ধরা, তালা ভাঙা। ভেতরে ঢুকতেই হিমেল বাতাস এসে লাগল, অথচ চারদিকে গরম গ্রীষ্মের রাত। গেট পেরোতেই ভেতরে এক অদ্ভুত প্রাঙ্গণ—মাঝখানে ভাঙা চত্বর, চারদিকে ছেঁড়া শিকড় বেরোনো ইটের দেওয়াল। দেয়ালে কালো কালি আর লাল রঙে আঁকা মন্ত্রচিহ্ন।
অয়ন ধীরে ধীরে ভেতরে এগোতেই মাটির নিচ থেকে ভেসে উঠল এক কণ্ঠ—
“অবশেষে এলে।”
অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল এক বৃদ্ধ তান্ত্রিক। লম্বা দাড়ি, কপালে রক্তের টিপ, গায়ে ছেঁড়া ধুতি। চোখে এক অদ্ভুত শীতলতা।
অয়ন কাঁপা গলায় বলল, “আপনি কে?”
বৃদ্ধ বলল, “আমি এই তন্ত্রশালার রক্ষক। নাম আমার অরুণেশ। শত বছর ধরে আমরা পাহারা দিচ্ছি অমায়া তন্ত্রের টুকরোগুলো।”
অয়ন বুকের ভেতর খণ্ডদুটো শক্ত করে চেপে ধরল। “তাহলে আপনি জানেন এগুলো কী?”
অরুণেশ ধীরে ধীরে হাসলেন। “এগুলো মন্ত্র নয়, এগুলো দরজা। প্রতিটি খণ্ড মানে একেকটি দরজার চাবি। যখন সব মিলবে, তখন খুলবে ‘শূন্যদ্বার’। সেই দরজার ওপারে শুধু মৃত্যু নয়—চেতনার রাজ্য।”
অয়ন হিম হয়ে গেল। “চেতনার রাজ্য?”
অরুণেশ চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকালেন। “একটা জগৎ আছে যেখানে মানুষের ভয়, স্বপ্ন, স্মৃতি সব জমা থাকে। যিনি সেই জগৎ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, তিনি হাজার হাজার মানুষের মন দখল করতে পারবেন। নেতারা সেটাই চাইছে।”
অয়ন ফিসফিস করে বলল, “তাহলে যজ্ঞটা…?”
“হ্যাঁ,” অরুণেশ উত্তর দিলেন। “শ্মশানে যজ্ঞ মানেই মৃত আত্মাদের আহ্বান। তাদের রক্তে তৈরি হবে শপথ। আর সেই শপথ দিয়ে নেতারা দখল করবে জনসমুদ্রে চেতনা। তুমি যে খণ্ড পেয়েছো, সেটা ছাড়া যজ্ঞ পূর্ণ হবে না।”
অয়ন থমকে গেল। “তাহলে আমি কী করব?”
বৃদ্ধ তান্ত্রিক এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রাখল। হাতটা বরফের মতো ঠাণ্ডা।
“তুমি গবেষক। তোমার হাতে খণ্ড এসেছে মানে তন্ত্র তোমাকে বেছে নিয়েছে। এখন তোমাকে ঠিক করতে হবে—তুমি রক্ষক নাকি ধ্বংসকারী।”
অয়ন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলল, “কিন্তু এই শক্তি যদি ভালো কাজে ব্যবহার হয়?”
অরুণেশ হঠাৎ হেসে উঠলেন। “ভালো? শক্তি কখনও ভালো বা মন্দ নয়। ব্যবহারকারীর লোভই ঠিক করে তার রূপ। মনে রেখো, প্রতিটি খণ্ড রক্ত চাইবে। আর প্রতিটি রক্ত মানে আরও গভীর বন্ধন।”
হঠাৎ প্রাঙ্গণের বাতাস বদলে গেল। দূরে ঘণ্টার শব্দ, ধূপের গন্ধ। মাটির ফাঁক দিয়ে ধোঁয়া উঠতে লাগল। অয়ন দেখল, অরুণেশ হাত উঁচু করে মন্ত্র পড়ছেন—
“অগ্নিকুণ্ডে দেহ, শূন্যে চেতনা…”
তার চারপাশে ছায়ারা ভেসে উঠল। মৃত যজ্ঞকারীরা, ফ্যাকাশে মুখ, চোখে রক্তরঙ। তারা ঘিরে ধরল অয়নকে।
অয়ন ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল। “এরা কারা?”
অরুণেশ বললেন, “এরা রক্ষক। তারা শপথ দিয়েছে বহু বছর আগে। তাদের রক্তে লেখা হয়েছে এই চিহ্ন। তুমি যদি সত্যি এগোতে চাও, তবে তোমাকেও শপথ দিতে হবে।”
অয়ন শিউরে উঠল। “মানে, আমাকে রক্ত দিতে হবে?”
বৃদ্ধ ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, “অল্প রক্ত। তবেই খণ্ডগুলো তোমার আনুগত্য মানবে।”
অয়ন দ্বিধায় পড়ে গেল। কিন্তু মনে পড়ল অধ্যাপকের কথা, রাজনৈতিক নেতার যজ্ঞ, শহরের বিপদ। যদি সে খণ্ডগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তবে পালই সেগুলো ব্যবহার করবে।
সে দাঁত চেপে হাতের আঙুল কেটে দিল। কয়েক ফোঁটা রক্ত পড়ে গেল মাটির উপর আঁকা মন্ত্রচিহ্নে।
তৎক্ষণাৎ আলো ঝলসে উঠল। খণ্ডগুলো অয়নের হাতে কাঁপতে লাগল। মনে হলো ওরা যেন আনন্দে গর্জন করছে।
অরুণেশ বললেন, “এখন থেকে তুমি বাঁধা পড়লে। খণ্ডগুলো তোমার রক্ত চেনে। পাল যদি ওগুলো দখল করতে চায়, তাকে তোমার জীবনও নিতে হবে।”
অয়ন নিঃশ্বাস নিতে পারল না। এখন সে জানল—সে শুধু গবেষক নয়, খণ্ডের রক্ষকও।
বৃদ্ধ তান্ত্রিক ধীরে বললেন, “যজ্ঞের দিন এগিয়ে আসছে। সময় অল্প। তুমি যদি প্রস্তুত না হও, শহর ডুবে যাবে।”
অয়ন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তার হাতে রক্তমাখা খণ্ড, চারপাশে মৃত আত্মাদের ছায়া, আর সামনে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র।
তার মনে হলো—এ লড়াই থেকে আর ফেরার উপায় নেই।
অধ্যায় ৬ – অশরীরীর আগমন
অয়নের হাত থেকে রক্ত ঝরছিল, অথচ সে কোনো ব্যথা অনুভব করছিল না। মন্ত্রচিহ্নে রক্ত পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে আলোকজ্বালা উঠেছিল, তা এখন নিভে এসেছে, কিন্তু চারপাশের বাতাস এখনও ভারি। মনে হচ্ছিল যেন অদৃশ্য কারও চোখ তাকে ঘিরে আছে।
অরুণেশ তান্ত্রিক চুপ করে বসে আছেন। তাঁর দৃষ্টি স্থির, ঠোঁট নড়ছে নিঃশব্দে। অয়ন বুঝল, তিনি কোনো অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে কথা বলছেন।
হঠাৎই মাটির ভেতর থেকে শোঁ শোঁ শব্দ উঠল। অয়ন তাকিয়ে দেখল, মাটির ফাঁক দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, ধোঁয়ার ভেতর গাঢ় ছায়া গড়ে উঠছে। ধীরে ধীরে সেই ছায়া আকার নিচ্ছে—একটি লম্বা দেহ, চোখ দুটো জ্বলছে লাল অঙ্গারের মতো।
অয়ন আঁতকে উঠল। “এটা কী?”
অরুণেশ শান্ত গলায় বললেন, “এরা অশরীরী। শপথে বাঁধা আত্মারা। যজ্ঞের মন্ত্রে এদের ডাকা যায়। ওরা প্রহরী, আবার শিকারিও।”
অয়ন পিছু হটতে চাইছিল, কিন্তু অশরীরী তার দিকে এক ঝটকায় তাকাল। চোখের লাল আলো অয়নের বুক ভেদ করে ঢুকে গেল। মুহূর্তে তার মাথায় ভেসে উঠল শত শত মুখ—কেউ চিৎকার করছে, কেউ রক্তে ভেসে যাচ্ছে, কেউ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
সে কাঁপতে কাঁপতে ফিসফিস করে বলল, “এরা কারা?”
অরুণেশ বললেন, “যাদের রক্ত দিয়ে মন্ত্র লেখা হয়েছে, এরা তাদেরই আত্মা। ওরা মুক্ত নয়, শপথের বাঁধনে চিরকাল ঘুরছে।”
অয়ন বুকের ভেতর হাত দিয়ে অনুভব করল খণ্ডগুলো আরও গরম হয়ে উঠছে। যেন অশরীরীরা ওগুলো চিনে ফেলেছে।
হঠাৎই একটা অশরীরী এগিয়ে এসে অয়নের সামনে দাঁড়াল। তার অঙ্গারচোখে প্রতিফলিত হলো অয়নের মুখ। অয়ন শুনতে পেল ভেতর থেকে গলা ভেসে আসছে—
“রক্ত দিয়েছো তুমি। এখন তুমি আমাদের।”
অয়ন আতঙ্কে বলল, “না! আমি শুধু গবেষণা করছি।”
অশরীরী ফিসফিস করল, “তুমি শপথ নিয়েছো। পালাতে পারবে না।”
তার ঠাণ্ডা শ্বাস অয়নের গায়ে লাগতেই শরীর কেঁপে উঠল।
অরুণেশ গম্ভীর কণ্ঠে মন্ত্র পড়তে লাগলেন। তখনই অশরীরীরা একটু দূরে সরে গেল। কিন্তু তাদের চোখ এখনও অয়নকে বিদ্ধ করছে।
অরুণেশ বললেন, “তারা এখন থেকে তোমার ছায়ার মতো থাকবে। খণ্ড তোমার, তাই তোমার জীবনও তাদের সঙ্গে বাঁধা। মনে রেখো, যদি তুমি শপথ ভাঙো, তারা তোমাকেই ছিঁড়ে খাবে।”
অয়ন স্তব্ধ হয়ে গেল।
সেই রাতেই অয়ন বাড়ি ফিরে এসে দরজা বন্ধ করল। কিন্তু নিঃশব্দ ঘরের অন্ধকারেও সে বুঝতে পারছিল, কেউ আছে। আয়নায় তাকিয়ে দেখল—তার পেছনে অস্পষ্ট ছায়া দাঁড়িয়ে আছে।
সে মাথা ঝাঁকিয়ে চোখ মুছল—আবার তাকাল—কিছু নেই। কিন্তু ঘুমোতে গেলেই কানে শোনা গেল সেই একই ফিসফিসানি—
“তুমি আমাদের… তুমি আমাদের…”
ক্লান্ত অয়ন খাটে শুয়ে ভাবছিল, যদি এগুলো শুধু ভ্রম হয়? হয়তো রক্তের কারণে তার মাথায় বিভ্রম হচ্ছে? কিন্তু বুকের ভেতর রাখা খণ্ডগুলো মাঝে মাঝে নিজে থেকেই কাঁপছিল।
রাত যত গভীর হচ্ছিল, অশরীরীদের উপস্থিতি তত স্পষ্ট হচ্ছিল। জানালার বাইরে ভেসে আসছিল হাহাকার। হঠাৎ দরজায় ধাক্কা। অয়ন উঠে দাঁড়াল।
“কে?”
কোনো উত্তর নেই।
দরজা খুলতেই দেখা গেল—সামনে দাঁড়িয়ে আছে অধ্যাপক অনিরুদ্ধ। চোখ ফ্যাকাশে, শরীর কাঁপছে।
“অয়ন…” তিনি ফিসফিস করে বললেন, “ওরা এসেছে। আমি তাদের ঠেকাতে পারছি না।”
অয়ন অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু স্যার, আপনি তো… আপনি তো সেদিন…”
অধ্যাপক কাঁপা গলায় বললেন, “আমি বেঁচে আছি ঠিকই, কিন্তু অশরীরীরা আমার শপথও ধরে ফেলেছে। আমি ওদের থামাতে পারব না। শুধু তুমি পারবে। কারণ খণ্ড তোমার।”
তারপরই তিনি হঠাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। অয়নের চোখের সামনে আবার ভেসে উঠল সেই ছায়ারা—একটা, দুটো, তারপর আরও অনেক। ঘর ভরে গেল অশরীরীতে।
অয়ন টেবিল থেকে খণ্ড তুলে নিল। সে বুঝল, এদের নিয়ন্ত্রণ করার একটাই উপায়—মন্ত্র। বুকের ভেতর থেকে আওয়াজ উঠল—
“অগ্নিকুণ্ডে দেহ…”
অয়ন দাঁত চেপে পড়ল, “অগ্নিকুণ্ডে দেহ, শূন্যে চেতনা, রক্তে শক্তি, জনসমুদ্রে শাসন।”
অবাক হয়ে দেখল, অশরীরীরা মুহূর্তে থমকে গেল। তাদের চোখের আগুন নিভে এল। তারা মাটিতে ঝুঁকে পড়ল, যেন কারও কাছে প্রণাম করছে।
অয়ন ভয়ে, বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। সে প্রথমবার বুঝল—খণ্ডের ওপর তারই অধিকার হয়েছে। অশরীরীরা এখন তার শপথে বাঁধা।
কিন্তু সেই মুহূর্তেই জানালার বাইরে ভিড় জমল। অয়ন ছুটে গিয়ে দেখল—নেতা রবীন্দ্রনাথ পালের লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। হাতে মশাল, মুখে হিংস্র হাসি।
একজন চিৎকার করে বলল, “খণ্ডটা দাও, নইলে আজই শেষ।”
অয়ন বুঝল, বিপদ এখন দ্বিমুখী। একদিকে অশরীরীর ছায়া, অন্যদিকে মানুষের লোভ।
পেছনে তাকিয়ে দেখল—অশরীরীরা এখনও মাটিতে ঝুঁকে আছে।
অয়ন বুকের ভেতর থেকে কাগজটা শক্ত করে ধরল। তার ঠোঁট কাঁপছিল, তবু সে নিজেকেই বলল—
“এখন খেলা শুরু হলো।”
অধ্যায় ৭ – বন্দি আত্মা
অয়ন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে নেতার লোকজন, ভেতরে অশরীরীদের ভিড়। চারপাশে এক অদ্ভুত চাপা অন্ধকার। কিন্তু অদ্ভুতভাবে লোকগুলো ভেতরে ঢুকতে সাহস পাচ্ছে না। তারা দূর থেকে তাকিয়ে আছে, যেন ভয়ের বাঁধনে আটকে গেছে।
অয়ন টের পেল, এ ভয়ের উৎস তার হাতের খণ্ড। অশরীরীরা তাকে ঘিরে রেখেছে, এবং তারা যেন ওর শরীরের চারপাশে এক অদৃশ্য প্রাচীর তুলে দিয়েছে।
লোকগুলো কিছুক্ষণ গর্জন করল, তারপর পিছু হটল। অয়ন দরজা বন্ধ করে ভেতরে ফিরে এল। ঘর এখন নিস্তব্ধ, শুধু অশরীরীদের ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে—
“ওকে মুক্ত করো… ওকে মুক্ত করো…”
অয়ন কাঁপা গলায় বলল, “কাকে?”
এক অশরীরী মাথা তুলল, তার চোখের লাল আলো নিভে নিভে উঠছিল।
“আমাদের রাণী… বন্দি আছে খণ্ডের ভেতরে… ওকে মুক্ত করো…”
অয়ন স্তব্ধ হয়ে গেল। “রাণী?”
অশরীরী বলল, “সে-ই তন্ত্রের উৎস। শতাব্দী আগে তাকে রক্তের শপথে বাঁধা হয়েছিল। তার আত্মা বন্দি আছে এই কোডেক্সে। যতক্ষণ সে মুক্ত না হবে, মন্ত্র পূর্ণ হবে না।”
অয়ন বুকের ভেতর খণ্ডগুলো আঁকড়ে ধরল। মনে হলো সত্যিই কাগজের ভেতর কোনো নিশ্বাস আটকে আছে।
রাতভর অয়ন ঘুমোতে পারল না। খণ্ডগুলো টেবিলে রেখে সে বসে রইল। চারপাশে মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখল, যেন আলো তাকে ভরসা দেয়। কিন্তু আলোতেও ছায়া লেগে আছে।
খণ্ডের উপর আঙুল রাখতেই সে শুনতে পেল এক নারীর কণ্ঠ—
“আমায় মুক্তি দাও…”
অয়ন আঁতকে উঠল। কণ্ঠটা তার মাথার ভেতর নয়, খণ্ডের ভেতর থেকে আসছে। কণ্ঠটা একদিকে আবেদনময়, অন্যদিকে হিংস্র।
সে ফিসফিস করে বলল, “তুমি কে?”
উত্তর এলো—“আমি দেবযানী। রক্তের রাণী। আমার রক্তে লেখা হয়েছিল প্রথম মন্ত্র। আমায় তারা শপথে বন্দি করেছিল। শত বছর ধরে আমি এভাবে পড়ে আছি।”
অয়ন স্তব্ধ। তার চোখের সামনে যেন ভেসে উঠল এক ছবি—এক নারী, সাদা শাড়ি, কপালে লাল টিপ, চোখে অসীম যন্ত্রণা। চারপাশে শ্মশানের আগুন, মন্ত্রপাঠের ধ্বনি।
অয়ন কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “তুমি মুক্তি চাইছো কেন?”
নারীর কণ্ঠ গর্জে উঠল—
“মুক্তি চাই, কারণ আমি বন্দি। মুক্তি চাই, কারণ এ পৃথিবীর শক্তি আমার। আমাকে মুক্ত করলেই তুমি পুরো মন্ত্রের অধিকারী হবে। পুরো জনসমুদ্র তোমার হবে।”
অয়নের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। সে বুঝল—এই আত্মাকে মুক্ত করা মানেই অকল্পনীয় শক্তি পাওয়া। কিন্তু একইসঙ্গে ভয়ও জন্মাল—যদি এই রাণী মুক্ত হয়ে সবকিছু গ্রাস করে?
সকালে সে আবার গেল অরুণেশ তান্ত্রিকের কাছে।
“অরুণেশ, খণ্ডে এক নারীর আত্মা বন্দি। সে নিজেকে রক্তের রাণী বলছে। সত্যি কি এটা?”
অরুণেশ ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ। দেবযানী ছিল এক রাজবংশের কন্যা। তাকে তন্ত্রযজ্ঞে বলি দেওয়া হয়েছিল। তার আত্মাকেই বাঁধা হয়েছিল শপথে। সে-ই এই তন্ত্রের মূল শক্তি।”
অয়ন আতঙ্কে বলল, “তাহলে যদি তাকে মুক্ত করি?”
অরুণেশের চোখ গাঢ় হয়ে উঠল। “তাহলে মন্ত্র পূর্ণ হবে। তুমি অসীম শক্তি পাবে। কিন্তু মনে রেখো—দেবযানী মুক্তি চাইছে শুধু শক্তি দেবার জন্য নয়। সে নিজেও এই পৃথিবীতে ফিরে আসতে চাইছে। আর সে ফিরে এলে মৃত্যু আর অশান্তি ছাড়া কিছুই থাকবে না।”
অয়ন চুপ করে গেল। তার ভেতরে লড়াই শুরু হলো। একদিকে গবেষকের কৌতূহল—অজানা সত্য জানতে হবে। অন্যদিকে মানুষের ভয়—যদি শহর ধ্বংস হয়ে যায়?
সেদিন সন্ধ্যায় অয়ন একা বসেছিল ফ্ল্যাটে। ঘরে প্রবল বাতাস ঢুকল, মোমবাতিগুলো একে একে নিভে গেল। অন্ধকার যেন আরও গাঢ় হলো। টেবিলের উপর রাখা খণ্ডগুলো কাঁপতে লাগল, যেন ভেতরে কিছু মুক্তি পাওয়ার জন্য ছটফট করছে।
অয়ন কাগজগুলোর দিকে ঝুঁকল। সেই একই নারীকণ্ঠ আবার ভেসে এলো—
“আমায় মুক্ত করো… অয়ন… তোমাকেই বেছে নিয়েছি।”
অয়ন কেঁপে উঠল। তার নাম ধরে ডাকছে!
সে কাঁপা গলায় বলল, “তুমি কীভাবে আমার নাম জানো?”
খণ্ডের ভেতর থেকে উত্তর এলো—
“যে খণ্ড রক্ত নেয়, সে রক্তের স্মৃতিও নেয়। তোমার রক্ত আমার ভেতরে আছে। তোমার শ্বাস, তোমার ভয়, তোমার স্বপ্ন—সব আমি জানি।”
অয়ন স্তব্ধ হয়ে গেল। যেন তার শরীরের ভেতরও এখন এই আত্মার অংশ বাস করছে।
হঠাৎই আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখল সে। কিন্তু প্রতিচ্ছবির চোখ তার নিজের নয়—সেগুলো গভীর লাল, নারীসুলভ দৃষ্টি। প্রতিচ্ছবি ঠোঁট নড়াল, অথচ অয়নের ঠোঁট নড়ে না।
“আমায় মুক্তি দাও, আমি তোমায় সব দেব।”
অয়ন চোখ মুছে আবার তাকাল—প্রতিচ্ছবি স্বাভাবিক। কিন্তু বুকের ভেতরে কাঁপন থামল না।
সেই রাতে ঘুম এল না। বারবার অদ্ভুত স্বপ্নে সে ডুবে যাচ্ছিল। স্বপ্নে দেখল এক মহাযজ্ঞ—শ্মশানের মাঝখানে আগুন জ্বলছে, চারপাশে তান্ত্রিকেরা মন্ত্র পড়ছে। আগুনের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে দেবযানী—রক্তে ভেজা শাড়ি, মুখে ভয়ংকর শান্তি। সে হাত বাড়িয়ে বলছে—
“এসো… আমার সঙ্গে এসো…”
অয়ন ঘাম ভেজা শরীর নিয়ে উঠে বসলো। জানালার বাইরে ভোর হয়ে গেছে, কিন্তু মাথার ভেতরে এখনও সেই ডাক বাজছে।
সকালে ফোন এল অদ্বৈতের কাছ থেকে।
“অয়ন, আজ খবর পেয়েছি। নেতা রবীন্দ্রনাথ পাল যজ্ঞের জন্য বিদেশি পণ্ডিতদেরও ডেকেছে। শুনছি, তারা বিশেষ এক ‘রাণী আত্মা’ মুক্ত করার পরিকল্পনা করছে। এটা কি তুই যা বলছিলি তাই?”
অয়ন থমকে গেল। তার সন্দেহ সত্যি। পালও জানে দেবযানীর বন্দিত্বের কথা।
অয়ন কাঁপা কণ্ঠে বলল, “অদ্বৈত, যদি তারা সত্যিই তাকে মুক্ত করে, শহর শেষ।”
অদ্বৈত চিৎকার করল, “তাহলে তুই থামাবি না কেন? খণ্ড তো তোর কাছে।”
অয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “কিন্তু যদি আমিই তাকে মুক্ত করি? যদি সে আমার নিয়ন্ত্রণে আসে?”
ফোনের ওপারে নীরবতা। তারপর অদ্বৈত বলল, “অয়ন, শক্তি কখনো কাউকে সম্পূর্ণ নিজের করে নেয় না। শক্তিই মানুষকে নিজের দাস বানায়। বুঝে সিদ্ধান্ত নিস।”
সেদিন রাতে আবার অয়ন খণ্ডের সামনে বসল। চারদিকে ঘন নীরবতা। বাইরে কুকুর হাহাকার করছে।
সে খণ্ডগুলোর উপর হাত রাখল। ফিসফিস করে বলল, “দেবযানী, তুমি সত্যিই মুক্তি চাইছো?”
নারীকণ্ঠ নরম হয়ে এলো—
“আমি শুধু মুক্তি চাই, অয়ন। শত বছর ধরে বন্দি। যারা আমাকে বলি দিয়েছিল, তারা চলে গেছে। তুমি যদি আমাকে মুক্ত করো, আমি তোমার হবো। তুমি হবে হাজারো মানুষের স্বপ্নের রাজা।”
অয়ন দ্বিধায় পড়ে গেল। তার ভেতরে বিজ্ঞানীর কৌতূহল ও মানুষের ভয় একসঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হলো।
ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ল কেউ।
অয়ন দরজা খুলল—সামনে দাঁড়িয়ে অরুণেশ তান্ত্রিক। তাঁর চোখে আতঙ্ক।
“অয়ন, শোনো। ওকে মুক্ত করো না। দেবযানী একবার মুক্ত হলে আর কোনো শপথে বাঁধা যাবে না। সে তোমার হাত ছাড়িয়ে যাবে, পালের হাত ছাড়িয়ে যাবে। তখন শহর শুধু রক্ত আর ছাই হয়ে যাবে।”
অয়ন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াল। “কিন্তু যদি আমি না করি, পাল করবে।”
অরুণেশ কাছে এসে ফিসফিস করলেন, “তাহলে তোমার কাজ হবে ওকে ধ্বংস করা। কিন্তু মনে রেখো, ধ্বংস মানেই নিজের রক্তও উৎসর্গ করতে হবে।”
অয়ন হিম হয়ে গেল।
সেই রাতে অয়ন জানালার ধারে বসে ছিল। খণ্ডগুলো সামনে রাখা। অশরীরীরা নিঃশব্দে ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখে কেবল শূন্যতা।
অয়ন খণ্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করল,
“আমি তোমায় মুক্ত করব না। আমি তোমায় ধ্বংস করব।”
মুহূর্তে ঘর কেঁপে উঠল। খণ্ড থেকে নারীকণ্ঠ বজ্রের মতো গর্জে উঠল—
“তুমি সাহস করছো আমাকে অস্বীকার করতে? আমি রক্তের রাণী! আমি তোমার ভেতরে আছি!”
অয়ন বুক চেপে ধরল। শরীরের ভেতর আগুন জ্বলছে। সে বুঝতে পারল, দেবযানী শুধু কাগজে বন্দি নয়—তার নিজের রক্তেও এখন বন্দি।
তার কানে বাজল অসংখ্য নারীর চিৎকার, রক্ত ঝরার শব্দ, শ্মশানের আগুনের দপদপানি।
অয়ন হাঁপাতে হাঁপাতে জানালার দিকে তাকাল। দূরে শহরের আলো নিভে আসছে। মনে হলো, দেবযানীর ছায়া এখন পুরো শহরের ওপর নেমে আসছে।
অয়ন চোখ বন্ধ করে শপথ করল—
“যদি ধ্বংস করতে হয়, আমি ধ্বংসই করব। কিন্তু তোমাকে মুক্ত করব না।”
তার বুকের ভেতর যেন বজ্রাঘাত হলো। খণ্ডগুলো চিৎকার করে উঠল। অশরীরীরা কাঁপতে কাঁপতে দেয়ালের দিকে সরে গেল।
আর খণ্ডের ভেতর থেকে নারীকণ্ঠ এক অমানবিক হাসি ছড়িয়ে দিল—
“তাহলে খেলা শুরু হলো, অয়ন। তুমি আমার শত্রু। আর শত্রু মানেই প্রথম বলি।”
অধ্যায় ৮ – রাজনৈতিক মহাযজ্ঞ
রবীন্দ্রনাথ পালের ঘোষণা শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে—“শক্তি সম্মিলনী”। পাগলাটে উৎসাহ, প্রতিটা মিডিয়া স্লট, পোস্টার, হাসিখুশি জনসভা; কিন্তু মুখের হাসির তলায় লুকোনো ছিল অন্য কিছু—অত্যন্ত পরিকল্পিত, সুচারু এক ষড়যন্ত্র। রাত জেগে শহর যেন সেই প্রস্তুতির সঙ্গে শ্বাস ফেলছে। অয়ন সেই শ্বাসমিশ্র কুয়াশায় ডুবে দাঁড়িয়ে আছে—তার হাতে কেবল দুইটি খণ্ড, চারপাশে অশরীরীর ছায়া।
গণজমায়েতের দিন সন্ধ্যার আগেই কালীঘাট মন্দিরের আঙিনায় এক বিশাল মঞ্চ তৈরী করা হলো। মঞ্চে দেবীর প্রতিমা উঁচু, চারপাশে মশাল আর ধূপের সারি। তুষারসাদা শাড়ি পরা পুরোহিতেরা শৃঙ্খলাবদ্ধ। বিশাল উচ্চারণ, ভক্তদের ভিড়, সব মিলিয়ে একটা উৎসব—তবে অয়নের চোখে তা সব পরিকল্পিত; সে জানে এখানে মূল অনুষ্ঠানটা ভিন্ন হবে।
অদ্বৈত, রাতের সংবাদপত্রের এক বেকুল রিপোর্টার, ক্যানভাস ব্যাগে ক্যামেরা ঢুকিয়ে এসে অয়নের পাশে দাঁড়াল। তার চোখে দৌড়ছে উদ্বেগ।
“তুই কি প্রস্তুত?” সে ফিসফিস করে বলল।
অয়ন মাথা নেড়ে বলল, “প্রস্তুত। শুধু একটাই ভয়—এখানে শুধু ধর্মের খেলা নয়; এটা ক্ষমতার খেলা। তারা দেবযানীর খণ্ড কাজে লাগাতে চাইছে।”
অদ্বৈত কাঁধ চেপে ধরল, “আমরা দু’জনেই জানি—খণ্ড নেই, তারা সে শক্তি পাবে না। তবু তারা চেষ্টা করবে। আজ রাতেই সব শেষ হয়ে যেতে পারে।”
সূর্য ডুবতেই মঞ্চ আলোকিত হলো—হাজার মানুষের কণ্ঠে শুভেচ্ছা, স্লোগান, আবেগ। পালের কণ্ঠ গর্জে উঠল। তিনি দীর্ঘ বক্তব্য দিলেন—দেশের পুনর্গঠন, ঐতিহ্য, মানুষের একতাবাঁধনের কথা। লোকেরা জোড়া হাতে সাড়া দিল। কিন্তু অয়ন জানে—পালের মিষ্টি কথার প্রতিটি বচনেই লুকেছে যন্ত্রের তান।
রাত অন্ধকার বসে পড়ল। পর্দার মতো অন্ধকারে মঞ্চের সামনে বসানো কুণ্ডে আগুন জ্বালানো হলো। পুরোহিতেরা মাঠে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালেন। অগ্নিকুণ্ডে মশালগুলি জ্বলে উঠল; কণার-কণার ভিতর থেকে যেন ভয়ানক শব্দ ভেসে উঠল—এক অদ্ভুত তাল, হূদয়স্পন্দন।
অয়ন ভিড়ের ভেতর হেঁটে মন্দিরের পূর্বপ্রান্তের পাদভূমিতে পৌঁছে গেল। তার পা কাঁপছে, কিন্তু মনে এক অদ্ভুত স্থিরতা। খণ্ডগুলো তার কাঁধের পেছনে লুকানো; অশরীরীর ছায়াটা তার পায়ে জড়িয়ে আছে যেন ছায়ার থাবা।
মঞ্চে এসে পুরোহিতরা চাবি আনলেন—কিন্তু চাবিটি মঞ্চে দিলেন না; তারা কুণ্ডের পাশে সেলে রাখা একটি লোহার বাক্স খুলল—তার ভেতরে রাখা ছিল সেই ‘Codex’—এক মোটা মলাটে লেখা পাণ্ডুলিপি। পালের অনুগামীরা সহজেই তা মঞ্চের দিকে নিয়ে এলো।
অয়নের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। মুহূর্তেই বুঝতে পারল—এটা পরিকল্পিত লোভ; লোকেরা ভিড়ে, আবেগে, ধ্বনি ও আলোয় মুগ্ধ থাকবে—আর পালের লোকেরা তাদের গোড়া থেকে একটিভেশন করবে।
প্রধান পুরোহিত মন্ত্রপঠনে উঠল। মন্ত্রধ্বনি মিশে যেতে লাগল মানুষের মুখছত্রে—সবাই ধীরে ধীরে সুর মিলে বলছে। অগ্নিকুণ্ডে মশাল গাঢ় শিখায় নাচছে; ধূপের ধোঁয়া উথলে উঠছে।
অয়ন থমকে গেল। সে বুঝতে পারল—আদতে এই মন্ত্র একটা কোড। ধোঁয়ার ধারা, মশালের জ্বলন, মানুষের সুর—সব মিলিয়ে এক সংকেত তৈরি হচ্ছে, যে সংকেতটি তখনই সক্রিয় হবে যখন কোডেক্সের পুরো পাণ্ডুলিপি সম্মিলিতভাবে পড়া হবে। আর সেই কালে পালের হাতে খণ্ডগুলো থাকলে—তারা সহজেই সেই সংকেতকে জনসমুদ্রে ছড়িয়ে দিতে পারবে।
অদ্বৈত নীরবে অয়নের কাঁধে আঘাত করল—তার ক্যামেরা হাতে। “আমি ঠিক ইনডিসক্রিট হবে,” সে বলল। “আমি লোকের ভিড়ের ভেতর ক্যামেরা ঢুকিয়ে দেব; যদি কিছু হয়, আমি লাইভ করব।”
অয়নের চোখে একটা ধোঁয়া কেটে গেল—সে জানে লাইভ হলে খবর ছড়াবে, কিন্তু তাতে লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে পারে, ঘটনাকে থামাতে পারে—বা, বরং, নেতার উদ্দেশ্যই যদি তা হয়—ভয় ছড়িয়ে শক্তি জাগ্রত করা? বিস্ময় আর অনিশ্চয়তার মধ্যে সে অদ্বৈতকে কাঁধে ধাক্কা দিল।
পুরোহিতেরা ক্রমশ বলছে—রক্তের শপথের প্রসঙ্গ; মঞ্চে ছেঁড়া কাগজের খণ্ডগুলো মিলিয়ে পড়া হচ্ছে। অয়ন কাঁধে টান দিল—এবারই সে বুঝল, পালের লোকজন কৌশলে খণ্ডগুলো মঞ্চের কাছে নিয়ে গেছে।
দেশের হাজার হাজার কণ্ঠ একসাথে মন্ত্রপঠনে ডুবে গেল—ধ্বনি এতটাই সমান, এতটাই সুরেলা যে মানে এক বিরাট জাল, এক বিশাল জাল যেখানে চরিত্ররা বসে আছে। অগ্নিকুণ্ড থেকে ওঠা ধোঁয়া যেন আকাশে ঢেউ তুলছে। অয়নের বুক চিতকার করলো—“এটা থামান!” তিনি চেষ্টা করল, কিন্তু ভিড়ের ভেতর তার কণ্ঠ ভেসে গেল না।
মঞ্চে স্লো-রিকানের মতো ধাপে ধাপে পাণ্ডুলিপির অধ্যায়গুলো পড়তে শুরু হলো—প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে মঞ্চে থাকা পুরোহিতরা অঙ্গ দ্বারা চিহ্ন করছিল। প্রত্যেক চিহ্নে ভিড়ের মধ্যে অশরীরীরা—কীভাবে জানে?—অভিহিত সাড়া জানাচ্ছে; অয়নের মনেই ভেসে উঠল, যে তারা মঞ্চের সংকেত অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে।
হঠাৎই পালের কণ্ঠ একবার উচ্চ হল—তিনি ঘোষণা করলেন—“এ তো আমাদের নবজাগরণ! আজ আমরা দেবযানীর মুক্তি দিব!” মঞ্চে রাখা কাগজগুলো একত্র করে ফেলতে বললেন তিনি। পালের লোকরা এগিয়ে এলো। অয়ন বুঝল, এখনই সেই মুহূর্ত—যদি খণ্ডগুলো মঞ্চে পড়ে যায়, সিস্টেম সম্পূর্ণ সক্রিয় হবে।
তার পায় তখন কাঁপল। তিনি জানালার পাশ থেকে ভিড়ের ভেতর ঢুকে পড়লেন, অদ্বৈত সাথে। ক্যামেরার লেন্স যেন সবকিছু শুষে নিচ্ছে—একটু হলে খবর পাড়াতে পারে। অয়ন মৃদু কণ্ঠে বলল, “আমি এগুলো নিতে পারি, ধরে রাখো।”
অদ্বৈত মাথা নেড়ে, “তুই করিস না—তারা তোকে চিনে ফেললে—”
কিন্তু সময় আসা মাত্রই পালের লোকজন খণ্ডগুলো মঞ্চের দিকে নিয়ে এলো। অয়ন ঝাঁপিয়ে পড়ল। হাত তুলেই খণ্ড কেড়ে নিল—তার হৃদয় যেন থমকে গেল। মঞ্চে থাকা পুরোহিতরা চিৎকার করে উঠল—“খণ্ড কেড়ে নেওয়া হলো!” ভিড়ের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হল।
পাল নিজে মঞ্চ থেকে নেমে এলো। তার চোখে সেই পূর্বের শূন্য চাহনি। তিনি হাঁফিয়ে বললেন, “তোমরা কি বুঝো না—এটা শুধু একটা অনুষ্ঠান নয়? এটা আমাদের ভবিষ্যৎ!”
অয়ন গলা চেপে কাঁদতে যথার্থভাবে বলল, “তুমি ভুল করছো, পাল। তুমি মানুষের মস্তিষ্ক বাজেয়াপকরণ করতে চাইছো—এটা কোনো উদযাপন নয়।”
পালের হাতে রাগ জাগলো। তিনি অয়নকে গ্রেপ্তারের সংকেত দিলেন। লোকজন রোষ নিয়ে মিছিল শুরু করল। অয়নকে ঘিরে ঘিরে চাপে ফেলল, শোরগোল বাড়ল।
এই বিশৃঙ্খলার মাঝেই অদ্বৈত লাইভে ধরল, তাঁর ক্যামেরা একবাক্যে শহরব্যাপী ঘটনাকে ছুঁয়ে দিল—আর সেই সঙ্গে মঞ্চ থেকে উচ্চারিত যে মন্ত্রের গুঞ্জন, সেটাও সবাই শুনতে পেল। হাজার হাজার মানুষ—কেউ-ই হয়তো তা বোঝেনি—কিন্তু অশরীরীর ছায়ারা ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করল; ভীড়ে অনেকে অচেতন হয়ে পড়ল।
মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে হাত জোর করে মন্ত্র পাঠানোর ঠিক সময় পালের লোকেরা অয়নকে ধরা—from all sides. But at that instant, a piercing scream slices the air—someone in the crowd collapses, eyes rolling back. The ritual’s initial effect ripples; a few begin to chant unconsciously. Ayon realizes partial activation already happening.
অধ্যায় ৯ – কালীঘাটে রক্তপাত
কালীঘাটের গলি আর মন্দিরচত্বর যেন এক যজ্ঞক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। হাজার মানুষের গলা একসঙ্গে উঠেছে মন্ত্রোচ্চারণে। আকাশ কেঁপে উঠছে, বাতাসে ধূপ আর ঘামের মিশ্র গন্ধ। আগুন জ্বলছে অগ্নিকুণ্ডে, ধোঁয়া আকাশে পাক খাচ্ছে।
মঞ্চের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ পাল হাত তুলেছেন। তাঁর চোখে জ্বলছে অদ্ভুত আগুন—অর্ধেক ধর্মীয় উন্মাদনা, অর্ধেক ক্ষমতার লোভ। তাঁর চারপাশে অনুগত পুরোহিতরা কোডেক্সের পাণ্ডুলিপি খুলে রেখেছে। আর জনগণ স্লোগান তুলছে—“শক্তি… শক্তি… শক্তি!”
অয়ন ভিড়ের মধ্য থেকে কষ্টে সামনে এগিয়ে আসছে। তার হাতে খণ্ডগুলো লুকানো, বুকের ভেতরে ধড়ফড় করছে। চারপাশে ছায়া ঘিরে আছে, অশরীরীরা তাকে অনুসরণ করছে। অদ্বৈত পিছনে ক্যামেরা নিয়ে হাঁপাচ্ছে—“লাইভ চলছে, অয়ন। পুরো শহর দেখছে।”
অয়ন দাঁত চেপে ফিসফিস করল, “শহরকে আজ রক্তে ডুবতে দেবে, যদি আমরা কিছু না করি।”
হঠাৎই মঞ্চ থেকে বজ্রের মতো কণ্ঠে পাল ঘোষণা করল—
“আজ দেবযানী রাণীর মুক্তি হবে। তার আত্মা আমাদের শক্তি দেবে, আমাদের শত্রু নিঃশেষ করবে। অগ্নিকুণ্ডে রক্ত পড়বেই, আর সেই রক্তে জন্ম হবে নতুন রাজ্যের।”
শব্দের সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিকুণ্ড থেকে শিখা ছুটে উঠল। চারপাশের মানুষের চোখ কেমন যেন শূন্য হয়ে গেল, তারা সবাই একসঙ্গে গুনগুন করতে শুরু করল।
অয়ন আতঙ্কে বুঝল—মন্ত্র আংশিক সক্রিয় হয়ে গেছে। জনসমুদ্রে স্লোগানের ছন্দ আসলে চেতনার ফাঁদ।
ঠিক তখনই এক পুরোহিত সামনে এনে ফেলল এক তরুণকে। তার হাত বাঁধা, মুখে রক্ত। ভিড় চিৎকার করে উঠল। পাল গর্জন করে বলল—
“প্রথম রক্ত, প্রথম শপথ!”
অয়ন দৌড়ে চিৎকার করল, “না!”
কিন্তু লোকেরা শুনল না। পুরোহিত তরুণের বুকের রক্ত ফোঁটা অগ্নিকুণ্ডে ফেলতেই শিখা তীব্র লাল হয়ে উঠল। মাটির ভেতর থেকে কেঁপে উঠল অশরীরীদের গর্জন।
অদ্বৈত কাঁপা হাতে ক্যামেরা তুলল। “অয়ন, এটা লাইভে যাচ্ছে! সবাই দেখছে, সারা কলকাতা!”
অয়ন জানত, দৃশ্য দেখা মানেই থামানো নয়। লোকেরা বিস্ময়ে তাকাবে, ভয়ে শিউরে উঠবে, কিন্তু মন্ত্র থামবে না।
মঞ্চে পাল নিজে কোডেক্স হাতে তুলে নিল। সে উচ্চারণ করল—
“অগ্নিকুণ্ডে দেহ, শূন্যে চেতনা…”
হাজার মানুষ একসঙ্গে আওয়াজ তুলল। অয়ন বুক থেকে খণ্ড বের করল। কাগজগুলো জ্বলে উঠল তার হাতে। চারপাশের অশরীরীরা হাহাকার করে উঠল।
অয়ন দাঁত চেপে একই মন্ত্র পড়ল, কিন্তু শেষ শব্দটা বদলে দিল—
“…জনসমুদ্রে শাসন নয়, মুক্তি।”
মুহূর্তেই অগ্নিকুণ্ডের আগুন উল্টোদিকে ঘুরে গেল। ধোঁয়ার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল অসংখ্য মুখ—হাজার মৃত আত্মার আর্তনাদ। তারা ভিড়ের মানুষের মাথার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। চিৎকার, কান্না, রক্তে মিশে গেল সব।
ভিড় ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। কেউ দৌড়াচ্ছে, কেউ মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। মন্দিরচত্বর রক্তে ভিজে যাচ্ছে।
পাল মঞ্চে দাঁড়িয়ে গর্জন করল, “তুমি আমার বিরুদ্ধে দাঁড়ালে, অয়ন? তুমি বুঝতে পারছো না—এই শক্তি ছাড়া এই শহর বাঁচবে না।”
অয়ন রক্তমাখা খণ্ড তুলে ধরল। “শহরকে বাঁচাতে শক্তি নয়, মুক্তি চাই। দেবযানীকে মুক্ত করলে শহর পুড়ে যাবে।”
পাল বিকট হাসল। তার চোখে শূন্যতা আরও গভীর হলো। সে নিজের হাত কেটে কোডেক্সের উপর ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ছিটিয়ে দিল।
অগ্নিকুণ্ড থেকে বেরোল এক অমানবিক নারীকণ্ঠ—
“আমি মুক্ত!”
অয়ন বুক চেপে ধরল। দেবযানী বেরিয়ে আসছে। তার আত্মা ভিড়ের ওপর নেমে আসছে।
অদ্বৈত চেঁচিয়ে উঠল, “অয়ন, কিছু কর! না হলে সবাই মরবে।”
অয়ন চোখ বন্ধ করল। খণ্ডগুলো নিজের বুকে চেপে বলল—
“আমার রক্ত দিয়েই শপথ হবে। কিন্তু শপথ হবে ধ্বংসের।”
সে নিজের হাত কেটে খণ্ডের উপর রক্ত ছিটিয়ে দিল।
হঠাৎই বজ্রপাত হলো। আগুন কেঁপে উঠল, ভিড় থেমে গেল। অশরীরীরা একসঙ্গে চিৎকার করে অদৃশ্য হয়ে গেল। পাল মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, চোখ ফাঁকা। কোডেক্স জ্বলে ছাই হয়ে গেল।
কিন্তু মাটিতে রক্ত ছড়িয়ে রইল। মন্দিরের সিঁড়ি, চত্বর, গলি—সব রক্তে ভিজে গেছে। মানুষ বাঁচল, কিন্তু শহর দেখল এক অমানবিক রক্তপাত।
অয়ন হাঁপাতে হাঁপাতে দাঁড়াল। তার হাতে জ্বলন্ত ক্ষত, মুখে ক্লান্তি। অদ্বৈত কাঁদতে কাঁদতে ক্যামেরা নামাল।
“তুই নিজের রক্ত দিলি, অয়ন। তুই কি বাঁচবি?”
অয়ন ম্লান হাসি দিল। তার চোখে এক অদ্ভুত শূন্যতা নেমে এসেছে।
“আমি জানি না, অদ্বৈত। হয়তো আমিও এখন বন্দি হয়ে গেলাম। কিন্তু শহরটা অন্তত আজ রক্তপাতের মধ্যেও বেঁচে থাকল।”
অধ্যায় ১০ – শেষ কোডেক্স
কালীঘাটের রাত রক্তে ভিজে গেছে। মন্দিরের সিঁড়িতে মশালের আলো নিভে আসছে, অগ্নিকুণ্ড ঠাণ্ডা ছাই হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের ভিড় ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে, কেউ কাঁদছে, কেউ চুপচাপ বসে আছে, কেউবা এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না কী ঘটল।
অয়ন দাঁড়িয়ে আছে মাঝচত্বরে, হাতে ক্ষতবিক্ষত আঙুল, বুকের কাছে এখনও ধরা পাণ্ডুলিপির খণ্ড। অদ্বৈত দূরে বসে ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে আছে, ক্যামেরা মাটিতে পড়ে গেছে, ব্যাটারি নিঃশেষ। শহরের হাজার মানুষের চোখে-চোখে এক অদ্ভুত আতঙ্ক ও স্বস্তি মিশে আছে—যেন মৃত্যুর মুখ থেকে হঠাৎ ফিরে এসেছে তারা।
পাল পড়ে আছে মাটিতে। তার দৃষ্টি ফাঁকা, ঠোঁট শুকনো। জীবিত কি মৃত—কেউ বলতে পারছে না। পুরোহিতেরা পালাতে পালাতে অন্ধকারে মিশে গেছে।
অয়ন নিঃশ্বাস নিল। তার মাথার ভেতরে এখনও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দেবযানীর কণ্ঠ।
“তুমি আমায় মুক্ত করোনি, তুমি আমায় ধ্বংসও করোনি। তুমি আমায় নিজের রক্তে বেঁধেছো।”
সে জানে, দেবযানী পুরোপুরি চলে যায়নি। তার আত্মা এখনও বেঁচে আছে, অয়নকেই শিকল করে বেঁধেছে।
ভোর হতে না হতেই পুলিশের ভিড় এলো। চারপাশে ক্যামেরা, সাংবাদিকদের চিৎকার, হাহাকার। কিন্তু এই ভিড়ের মধ্যেও কেউ অয়নের কাছে আসতে সাহস পেল না। তার শরীরের চারপাশে যেন অদৃশ্য অশরীরীরা প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে।
অদ্বৈত এগিয়ে এলো। তার চোখে অশ্রু।
“অয়ন, তুই এখন কী করবি?”
অয়ন ধীরে বলল, “আমি আর গবেষক নই। আমি আর মানুষও নই পুরোপুরি। আমি এখন শেষ কোডেক্সের বাহক।”
অদ্বৈত স্তব্ধ হয়ে গেল।
কয়েকদিন পর শহর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলো। সংবাদপত্রে ছাপা হলো—“কালীঘাটের বিভীষিকা: রাজনৈতিক যজ্ঞে মৃত্যু ও রক্তপাত।” সরকারী রিপোর্টে লেখা হলো, ‘গুজব ও উন্মাদনার কারণে জনতার ভিড়ে বিশৃঙ্খলা।’ দেবযানী বা অশরীরীর নাম একবারও উল্লেখ হলো না।
অদ্বৈত চেষ্টা করল সত্যিটা ছাপাতে। কিন্তু প্রতিটি সংবাদপত্রেই তার লেখা কেটে ফেলা হলো। শুধু এক লাইনে ছাপা হলো—
“একজন গবেষক অয়ন মুখার্জি এখন নিখোঁজ।”
হ্যাঁ, নিখোঁজ।
অয়ন সত্যিই শহর ছেড়ে চলে গেছে। গঙ্গার তীরে বসে সে খণ্ডগুলো একে একে আগুনে ফেলতে চাইছিল। কিন্তু প্রতিবার আগুনে ধরাতেই খণ্ডগুলো জ্বলার বদলে তার রক্তে মিশে যাচ্ছিল। যেন কাগজ এখন তার শিরার ভেতরে।
সে বুঝল, আর কোনো ধ্বংস নেই। শেষ কোডেক্স এখন তার শরীর।
তার কানে আবার ভেসে এলো দেবযানীর কণ্ঠ—
“তুমি আমাকে মুক্ত করোনি, তুমি আমাকে বেঁধেছো। এখন তুমি-ই আমার বাহন।”
অয়ন আকাশের দিকে তাকাল। ভোরের সূর্য উঠছে। কিন্তু সেই আলোয়ও তার চোখে অদ্ভুত অন্ধকার ঝিলিক দিচ্ছে।
সন্ধ্যার দিকে সে পৌঁছাল দক্ষিণেশ্বর ঘাটে। গঙ্গার জলে ভেসে যাচ্ছে শবদেহ, ফুল, ধূপকাঠি। অয়ন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে অশরীরীরা। কেউ তাদের দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু তারা আছে।
এক বৃদ্ধ সাধু তার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “বাবা, তোমার চোখে আমি শূন্য দেখছি। তুমি কে?”
অয়ন ম্লান হাসি দিল।
“আমি অয়ন নই। আমি শেষ কোডেক্স।”
সাধু ভয়ে সরে গেল।
রাত গভীর হলো। শহরের আলো একে একে নিভে গেল। কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকানগুলো বন্ধ হলো। কিন্তু কারও মনে হলো, শহরের কোথাও একজন একা হাঁটছে, তার চারপাশে ছায়ার ভিড়।
সে মানুষ নয়, সে দেবযানীর বাঁধনে বাঁধা—শেষ কোডেক্স।
অয়ন ধীরে ধীরে ফিসফিস করল—
“তন্ত্র কখনও শেষ হয় না। কেবল নতুন রূপ নেয়। আর আমি সেই নতুন রূপ।”
তার হাসি ভেসে গেল রাতের আকাশে। গঙ্গার ঢেউয়ে মিলিয়ে গেল।
সমাপ্ত