Bangla - তন্ত্র

কালীঘাটের রক্তমালা

Spread the love

অধ্যায় ১ –

কালীঘাটের এক শীতল ভোরে, যেখানে কলকাতার ভিড় এবং অব্যক্ত কোলাহল দূরের মনে হয়, সেখানে এক প্রাচীন আশ্রমের ভিতরে রহস্যের ছায়া ঘনিয়ে উঠেছিল। ভৃগুনাথ তান্ত্রিকের পুরনো মালা, যা বহু বছর ধরে মাটির ধুলো জমিয়ে রেখেছিল, হঠাৎ করেই ভিজে ওঠে টাটকা লাল রক্তে। আশ্রমের কাঠের মেঝে অন্ধকার এবং আর্দ্রতার সংমিশ্রণে যেন আরও গভীর হয়ে উঠেছে, আর মালার রঙের সঙ্গে মিলিত হয়ে তৈরি হয়েছে এক অদ্ভুত আতঙ্কের ছাপ। স্থানীয় বাসিন্দারা একে অমাবস্যার মতো কালো অঘটনের দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখলেন; কেউ কেউ বললেন, “এটি মানুষের রক্ত নয়, কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির ছাপ।” আশ্রমের পুরনো দেয়ালে ঝুলন্ত ছবি এবং তান্ত্রিকের প্রত্নচিহ্নগুলো যেন হঠাৎই জীবন্ত হয়ে ওঠে, চুপচাপ তাকিয়ে থাকা লোকদের চোখে অনিশ্চয়তার ছায়া ফেলল। রাতের অন্ধকারে কোনো শব্দ না হলেও আশ্রমের মধ্যে যেন ভুতের পদচারণার ছায়া নেমে এসেছে।

সকালে খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কালীঘাটের স্থানীয় সংবাদপত্রের তরুণ সাংবাদিক অনিকেত ঘটনাস্থলে পৌঁছান। তিনি একটি সাদা শার্ট আর ব্লু জিন্সে ছিলেন, তার হাতে নোটবুক এবং ক্যামেরা; মনমগ্ন চেহারায় যেন তিনি ইতিমধ্যেই রহস্যের একটি অজানা সুত্র ধরে ফেলেছেন। আশ্রমের প্রবেশদ্বারে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চোখে পড়ে মালার ভিজে থাকা রক্ত, যা একটি ছোট বাটি বা পাত্রে নয়, সরাসরি মালার মুক্তার উপর জমে আছে। অনিকেতের মনে হলো, এটি কোনো সাধারণ ঘটনার চিহ্ন নয়; এখানে যেন অতীতের অসম্পূর্ণ সাধনার প্রতিধ্বনি জেগে উঠেছে। আশ্রমের ভেতরের পরিবেশ, যেখানে ধুলো এবং পুরনো কাঁটাসমৃদ্ধ পাতার গন্ধ মিলেমিশে রয়েছে, তাকে আরও অদ্ভুত করে তুলল। আশ্রমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো তান্ত্রিকের প্রতিমূর্তির চোখ যেন সরাসরি অনিকেতকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। অনিকেত নিজের কণ্ঠকে অচেতনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করল, যিনি প্রায়শই ভয়কে সংবাদে রূপান্তরিত করতে অভ্যস্ত, এবার তিনি বুঝতে পারলেন যে এই রহস্য একেবারেই মানুষের বোধগম্য সীমার বাইরে।

অনিকেত আশ্রমের ভিতরে আরও গভীরে প্রবেশ করলেন। মালার কাছে পৌঁছনোর পর, তিনি লক্ষ্য করলেন আশ্চর্যজনক কিছু ঘটনা; মালার চারপাশের মেঝেতে ছোট ছোট রক্তের দাগ, যেন কেউ বা কিছু সম্প্রতি এখানে উপস্থিত হয়েছে। প্রতিটি দাগের রেখা, প্রতিটি ছোপ যেন একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন নির্দেশ করছে—এক ধরনের অদৃশ্য আদি মন্ত্র বা সংকেতের মতো। আশ্রমের দেওয়াল ঘেঁষে থাকা কয়েকটি প্রাচীন লাঠি ও ঝুলন্ত তান্ত্রিকীয় প্রতীক যেন হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠেছে, আর বাতাসের শিসের সঙ্গে মিলিত হয়ে অনিকেতের মনকে ব্যস্ত করে রাখল। তিনি ছবি তুললেন, নোট নিলেন, এবং নিজের অভিজ্ঞ সাংবাদিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ শুরু করলেন। কিন্তু যতই তিনি গভীরে যেতেন, ততই মনে হচ্ছিল—মালা এবং তার রক্তের ঘটনাটি শুধুমাত্র একটি সাধারণ রহস্য নয়; এটি হয়তো কোনো অসম্পূর্ণ তান্ত্রিক সাধনার চূড়ান্ত প্রতিফলন, যা বহু বছরের অন্তরাল থেকে এখন প্রকাশ পাচ্ছে। অনিকেতের অন্তর জানালো, এই রহস্যের সূত্র খুঁজে বের করা তার জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে, যেখানে সত্য ও অতিপ্রাকৃতের সীমানা বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

অধ্যায় ২ –

অনিকেত আশ্রমের রঙ মাখা দেয়াল থেকে বেরিয়ে এসে কালীঘাটের পুরোনো বুড়ো মহল্লার দিকে গেলেন, যেখানে শর্মিষ্ঠা দেবী দীর্ঘদিন ধরে একাকী থাকতেন। শর্মিষ্ঠা দেবী ছিলেন বয়সের ভারে ক্রমশ ঢেকে থাকা এক রহস্যময়ী নারী, যার চোখে জীবনের অভিজ্ঞতা আর অতিপ্রাকৃত ঘটনার ছাপ একসঙ্গে ফুটে উঠত। তাঁর ছোট্ট ঘর, যেখানে পুরোনো বই, জ্যোতিষশাস্ত্রের রূপান্তরিত পাতাগুলি ছড়িয়ে ছিল, যেন ইতিহাসের কথা এবং ভৃগুনাথ তান্ত্রিকের অসমাপ্ত সাধনার গন্ধ ধারণ করেছিল। অনিকেত ঢুকতেই শর্মিষ্ঠা দেবীর চোখে অদ্ভুত জ্বলজ্বল করা অশ্রু, ও মুখে এক নীরব ভয়ের ছায়া। তিনি নিঃশ্বাস খেয়ে বললেন, “ভৃগুনাথের মালা শুধুমাত্র একটি অলঙ্কার নয়, এটি তার আত্মার প্রতীক। মৃত্যুর আগে তিনি বারবার বলেছেন—‘আমার মালা রক্ত চাইবে, না হলে সাধনা পূর্ণ হবে না।’ তুমি বুঝতে পারছ কি, অনিকেত, এটা কোনো সাধারণ তান্ত্রিক কাণ্ড নয়। মালার রক্ত কোনো সাধারণ রক্ত নয়; এটি একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার অংশ, যা সম্পন্ন না হলে সাধনার শক্তি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বহু বছর ধরে আমরা ভয় পেয়েছি, কেউ জানত না ঠিক কীভাবে এবং কখন এই মালা রক্ত চায়। কেউ কখনোও ভৃগুনাথের মৃত্যুর পর তার অসম্পূর্ণ সাধনার দিকে চোখ দেওয়ার সাহস পায়নি।”

শর্মিষ্ঠা দেবী অনিকেতকে বিস্তারিত বর্ণনা করতে লাগলেন, কিভাবে ভৃগুনাথ তান্ত্রিকের সাধনা ছিল এক বিশেষ প্রাচীন মন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত, যার উদ্দেশ্য ছিল অমরত্বের আংশিক শক্তি অর্জন। কিন্তু মৃত্যুর আগে তিনি অপরিপূর্ণ অবস্থায় থেমে যান। তাঁর শিষ্যরা, যারা সাধনার সাথেই জড়িত ছিল, তখন আশ্চর্য ও ভয়ংকর ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিল। অনিকেত খেয়াল করলেন, শর্মিষ্ঠা দেবীর কণ্ঠের স্বর যেন দম বন্ধ করে দেওয়া এক আবেগের সঙ্গে মিলেমিশে গেছে, যা অতীতের ঘটনাগুলি জীবন্ত করে তুলছে। তিনি বলেন, “ভৃগুনাথ জানতেন যে মালার শক্তি শুধুমাত্র তার নিজের রক্ত দিয়ে পূর্ণ হবে না, এটি অন্যান্য নির্দিষ্ট উপাদান ও রক্তের সংমিশ্রণ চায়। তাই সে বলেছিল—মালা রক্ত চাইবে, নইলে সাধনা পূর্ণ হবে না। আমরা তখন ভাবিনি, এটা কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। যে কোনো মানুষের রক্ত মালার ছোঁয়ায় যদি মিশে যায়, তা তার জীবনের পথে অদৃশ্য প্রভাব ফেলতে পারে।” অনিকেত নোট নিলেন, প্রতিটি শব্দ যেন রহস্যের এক নতুন স্তর উন্মোচন করছে।

শর্মিষ্ঠা দেবী আরও জানালেন যে, মালার অভিশপ্ত শক্তি শুধু রক্তের ওপর নির্ভর নয়, বরং এটি ভৃগুনাথের মৃত্যুর পরেও জীবিত ছিল। মালা নিজেই যেন তার সাধনার অসম্পূর্ণতার চিহ্ন বহন করছে; যে কোনো লোক, যে মালার সঙ্গে সম্পর্কিত হবে, সে অনিশ্চিত ভয় এবং বিপদের মুখোমুখি হবে। অনিকেত বুঝতে পারলেন, আশ্রমের মধ্যে যে অদ্ভুত রক্তপাতের চিহ্ন দেখা গিয়েছিল, তা কোনও দৈব ঘটনা নয়; এটি সরাসরি ভৃগুনাথের অসম্পূর্ণ সাধনার প্রতিফলন। শর্মিষ্ঠা দেবী শেষমেষ অনিকেতকে সতর্ক করলেন, “যে রহস্যের দিকে তুমি এগোচ্ছ, তা শুধু সাংবাদিকতার নয়, জীবনের নিরাপত্তারও। অনেকেই এই অভিশপ্ত মালার কাছে যায়নি, যারা গিয়েছে তারা আর ফিরে আসেনি বা তাদের জীবনে অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে।” অনিকেত তখন অনুভব করলেন, যে গল্পের মধ্যে তিনি প্রবেশ করেছেন, তা শুধুমাত্র অতীতের কাহিনি নয়, বরং একটি জীবন্ত অভিশপ্ত কাহিনি, যা এখন তার সামনে প্রলয়ঙ্কর রূপে ফুটে উঠছে।

অধ্যায় ৩ –

অনিকেত আর তার সতীর্থ ফটোসাংবাদিক সুবীর কালীঘাটের পুরনো আশ্রমে ফেরেন, যেটি এখন যেন এক অদৃশ্য শূন্যতার মধ্যে হারিয়ে গেছে। সকাল হোক বা বিকেল, আশ্রমের ভিতরের পরিবেশে এক অদ্ভুত শীতলতা এবং অমাবস্যার মতো ঘন অন্ধকার বিরাজ করছিল। সুবীর ক্যামেরা হাতে, আলোর দিক খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন; অনিকেত পাশে দাঁড়িয়ে নোটবুক খোলা রেখেছিলেন। তারা মালার সামনে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করলেন, কেবল দৃষ্টি নয়, যেন বাতাসও থেমে গেছে। মালার মুক্তাগুলি রক্তিম আভায় ঝলমল করছে, আর তার চারপাশে যেন কুয়াশার মতো ঘন রঙের আবরণ গঠিত হয়েছে। অনিকেত হঠাৎ বুঝলেন, এই অভিজ্ঞতা কোনও সাধারণ দৃশ্য নয়; এটি কোনো অতিপ্রাকৃত চিহ্নের আভা, যা চোখে সহজে ধরা পড়ে না, তবে ক্যামেরার লেন্সে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সুবীর ছবি তুললেন, এবং ক্যামেরার পর্দায় দেখা গেল, মালার চারপাশে রক্তিম আভা সত্যিই ফুটে উঠেছে—এক ধরনের কুয়াশার মতো, যা শীতল বাতাসের সঙ্গে নরমভাবে ভাসছে। অনিকেত এবং সুবীর দুজনেই অস্বাভাবিকভাবে চুপ হয়ে গেলেন; এই দৃশ্য যেন তাদের মনকে হিমায়িত করে দিয়েছে।

সুবীর ক্যামেরার লেন্সের মধ্য দিয়ে মালার দিকে তাকিয়ে, অনিকেত মনোযোগী হয়ে নোট করতে লাগলেন। প্রতিটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে রক্তিম আভা ক্রমশ আরও গভীর ও ছায়াময় হয়ে উঠছে, যেন মালা নিজেই প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে। অনিকেতের মনে হলো, মালার চারপাশের এই আভা কোনো সাধারণ আলো বা ছায়া নয়; এটি যেন ভৃগুনাথ তান্ত্রিকের অসম্পূর্ণ সাধনার শক্তি, যা এখন তার রহস্যময় রূপে প্রকাশ পাচ্ছে। তিনি সুবীরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই ছায়া শুধু ভিজ্যুয়াল নয়, এটি এক ধরনের শক্তির প্রতীক। আমরা যা দেখছি, তা সাধারণ মানুষের চোখে ধরা পড়বে না; তবে ক্যামেরা এটিকে স্পষ্টভাবে ধারণ করছে।” অনিকেতের মনে হলো, মালার সঙ্গে সম্পর্কিত যে কোনো পদক্ষেপ, যে কোনো নোট বা ছবি, তাকে সরাসরি অসম্পূর্ণ সাধনার প্রভাবের কাছে নিয়ে আসছে। তিনি বুঝতে পারলেন, শুধুমাত্র মালার ছবি তোলা নয়, বরং এটি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন—কারণ ছবিতেই লুকিয়ে আছে রহস্যের মূল চাবিকাঠি।

যেমনই অনিকেত ছবি পরীক্ষা করতে লাগলেন, তাঁর মনে হলো আশ্রমের বাতাসে অদ্ভুত কণ্ঠস্বর এবং নীরবতার মিশ্রণ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। রক্তিম আভা ক্রমশ নড়াচড়া করছে, যেন এটি কোনও জীবন্ত শক্তি। সুবীরের ক্যামেরায় দেখা প্রতিটি ছবিতে মালার চারপাশে কুয়াশার আভা আরও তীব্র এবং ঘন হয়ে উঠছে; কখনও এটি ধূসর রঙে, কখনও গাerা লালাভ আভায় ভেঙে পড়ছে। অনিকেত তখন নিশ্চিত হলেন, এই রহস্য সাধারণ নয়; এটি শুধুমাত্র অতীতের চিহ্ন বা ইতিহাসের প্রতিফলন নয়, বরং একটি জীবন্ত অভিশপ্ত শক্তির প্রকাশ। তিনি নোটে লিখলেন, “মালার ছবি শুধু দৃশ্য নয়, এটি শক্তির একটি চিহ্ন। এটি দেখাচ্ছে যে অসম্পূর্ণ সাধনা এখনো রক্তের আকারে জীবিত। আমাদের কাছে সময় খুব সীমিত; যদি আমরা এই রহস্যের গভীরে না যাই, তবে এর প্রভাব আমাদের হাতছাড়া হতে পারে।” অনিকেত এবং সুবীর দুজনেই তখন গভীরভাবে বুঝলেন, যে মালা এবং তার চারপাশের রক্তিম আভা, তা কেবল অলঙ্কার নয়—এটি এক অভিশপ্ত কাহিনির প্রথম দৃশ্য, যা এখন তাদের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

অধ্যায় ৪ –

অনিকেত কালীঘাটের পুরনো মন্দিরের দিকে রওনা হলেন, যেখানে তিনি আশা করেছিলেন, ভৃগুনাথ তান্ত্রিকের রহস্যের আরও কিছু সূত্র বের করতে পারবেন। মন্দিরের প্রবেশপথে এসে তিনি দেখলেন হরিপদ দত্ত, একজন বৃদ্ধ পুরোহিত, যিনি বহু বছর ধরে মন্দিরের তন্ত্র এবং প্রাচীন প্রার্থনার রক্ষা করছিলেন। তাঁর চোখে সতর্কতার ছায়া, আর চেহারায় এমন এক নিঃশ্বাসের ভার, যা শুনলেই বোঝা যায় যে এই মানুষটি অতীতের গোপন কাহিনির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। অনিকেত তাঁকে কাছে ডেকে বললেন, “পুরোহিতজি, ভৃগুনাথ তান্ত্রিকের মালার রহস্য সম্পর্কে কিছু জানেন কি?” হরিপদ ধীরে ধীরে নাকের নিচ দিয়ে দীর্ঘ শ্বাস নিলেন, তারপর কণ্ঠ মৃদু করে বললেন, “এই রহস্যের পেছনে হাত দিলে সর্বনাশ হবে, অনিকেত। যারা অতীতের শক্তির সঙ্গে খেলেছে, তারা আর ফিরে আসেনি। তুমি যদি সত্যিই জানো, তুমি তোমার জীবনের নিরাপত্তা বিপন্ন করছ।” এই সতর্কবাণী অনিকেতের মনে এক অদ্ভুত আতঙ্ক তৈরি করল। তবে, একই সঙ্গে তিনি বুঝতে পারলেন যে হরিপদ দত্ত শুধু ভয় দেখাচ্ছেন না; তিনি কিছু জানেন, যা তিনি এখনও পুরোপুরি প্রকাশ করতে সাহস পাচ্ছেন না।

অনেকক্ষণ নীরবতার পর হরিপদ ধীরে ধীরে বলেন, “তুমি যদি মনে করো যে মালা শুধু অলঙ্কার, তুমি ভুল করছ। বহুদিন ধরে আশ্রমে রাতের বেলায় অদ্ভুত মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ শোনা যায়। লোকেরা বলেছে, কেউ বা কিছু প্রতিদিন রাতের অন্ধকারে প্রার্থনা করে, কিন্তু সেখানে কেউ থাকে না। এটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনার অংশ নয়, এটি তান্ত্রিক শক্তির ছায়া—যা ভৃগুনাথের মৃত্যুর পরও আশ্রমের চারপাশে বিরাজ করছে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ এই রহস্যের সঙ্গে খেলতে পারি না।” অনিকেত কৌতূহল নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। তাঁর মনে হলো, মন্দিরের এই আভা, হরিপদ দত্তের সতর্কবাণী এবং মালার রহস্য—এগুলো একসাথে মিলিয়ে একটি বড় গোপন সূত্র প্রকাশ করতে চলেছে। হরিপদ দত্তের চোখে সেই ছায়া, যা দেখলেই বোঝা যায়, তিনি অতীতের কিছু চূড়ান্ত সত্য জানেন, কিন্তু জানানো অসম্ভব। অনিকেত লক্ষ্য করলেন, হরিপদ দত্তের হাতের অঙ্গুলিতে কিছু চিহ্ন রয়েছে, যেন তান্ত্রিকের কিছু প্রাচীন প্রতীক, যা এই রহস্যের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।

হরিপদ ধীরে ধীরে অনিকেতকে আশ্রমের অভ্যন্তরে যা কিছু ঘটেছে, তার প্রতি ইঙ্গিত দিলেন। তিনি বললেন, “রাত্রি নামলেই সেখানে কিছু অদ্ভুত শক্তি কাজ করে। কিছু লোক বলেছে, মালার চারপাশে রক্তিম আভা দেখেছে, আবার কেউ বলেছে, যে কোনও অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কেউ সাহস করে সেখানে প্রবেশ করতে চায়নি। আমি নিজেও বহুবার দেখেছি—রাতের বেলা যে মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ আসে, তা মানব কণ্ঠ নয়। এটা ভৃগুনাথ তান্ত্রিকের অসম্পূর্ণ সাধনার প্রতিধ্বনি। যিনি সাহস দেখান, তিনি শুধু রহস্যের সাক্ষী হবেন না, বরং তার নিজের জীবনও ঝুঁকির মুখে পড়বে।” অনিকেত শোনার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলেন, যে গল্পটি তিনি অনুসরণ করছেন তা কেবল অতীতের ইতিহাস নয়; এটি এখনো জীবন্ত, এবং এটি নিজের নিয়মে কাজ করছে। হরিপদ দত্তের সতর্কবাণী যেমন ভয় তৈরি করল, তেমনি অনিকেতের মনে একটি আগ্রহ জাগিয়ে দিল—যে রহস্যকে সাধারণ মানুষ এড়ায়, সেটিকে তিনি জানার চেষ্টা করবেন, কারণ এই অভিশপ্ত কাহিনির সত্য ফাঁস না হলে তার সাংবাদিক জীবনের সবচেয়ে বড় গল্প হাতছাড়া হয়ে যাবে।

অধ্যায় ৫ –

রাতের অন্ধকারে কালীঘাটের প্রাচীন আশ্রমের দিকে অনিকেত ও সুবীর ধীরে ধীরে এগোলেন। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা কাঁটাযুক্ত গাছ এবং মাটির আর্দ্রতার কারণে বাতাসে এক অদ্ভুত শীতলতা বিরাজ করছিল, যেন প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিই তাদের দিকে নজর রাখছে। অনিকেত ল্যাম্প হাতে ধরে পথ দেখছিলেন, আর সুবীর ক্যামেরা হাতে প্রস্তুত ছিল সব কিছু ধারণ করার জন্য। আশ্রমের প্রবেশপথে ঢুকতেই চোখে পড়ল মালা, যা আগের দিনের তুলনায় আরও ভিজে রক্তিম আভায় ঝলমল করছে। বাতাসে যেন হঠাৎই ঘন কুয়াশা নেমে এলো, যা মালার চারপাশকে আচ্ছাদিত করে দিল। অনিকেত অনুভব করলেন, কুয়াশার মধ্যে একটি অদ্ভুত ফিসফিসানি চলছিল—কখনও একরকম মৃদু, কখনও আবার ঘন ও চাপা। শব্দের উৎস বোঝা গেল না, তবে এটি স্পষ্ট যে, আশ্রমের প্রতিটি কোণ যেন জীবিত হয়ে উঠেছে। অনিকেত ধীরে ধীরে মালার দিকে এগোতে থাকলেন, তার হৃদস্পন্দন তীব্র হয়ে উঠল; তিনি জানতেন, যা কিছু ঘটছে তা সাধারণ নয়।

সুবীর ক্যামেরা ধরে মালার দিকে তাকিয়ে ছবি তুলতে শুরু করলেন। হঠাৎই মালার মুক্তাগুলি থেকে লাল রক্ত ঝরে পড়তে শুরু করল, যেন এটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে জীবিত হয়ে উঠেছে। রক্তের ফোঁটা মেঝেতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশা আরও ঘন হয়ে উঠল, আর ফিসফিসানির শব্দ তীব্র হয়ে গেল। অনিকেত মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ালেন, কারণ তিনি বুঝতে পারলেন যে মালা কেবল অলঙ্কার নয়; এটি সত্যিকারের এক শক্তির কেন্দ্র, যা তার আশেপাশের পরিবেশকে পরিবর্তন করতে সক্ষম। কুয়াশার মধ্যে অদ্ভুত আলো ও ছায়ার খেলা, রক্তের ঝরনাও যেন একটি অদ্ভুত নৃত্যের মতো চলে—যা অনিকেতকে না শুধুমাত্র ভয় দেখাচ্ছিল, বরং মনে করাচ্ছিল যে মালার সঙ্গে সরাসরি কোনো সম্পর্ক তৈরি হলে, তার নিজস্ব অস্তিত্বও বিপন্ন হতে পারে।

হঠাৎ সুবীরের চোখে কিছু অদ্ভুত দৃশ্য ধরা পড়ল। মালার চারপাশে কুয়াশার মধ্যে হালকা লালাভাভ আভা ফুটে উঠল, যা যেন এক অদৃশ্য হাতের মতো ছোঁয়াচ্ছে। সে দারুণ আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার করে বলল, “অনিকেৎ, চল পালাই!” এবং ঘরে ঢোকার পথ ধরে দৌড়াতে লাগল। অনিকেত হঠাৎ অনুভব করলেন, রক্তিম কুয়াশা এবং ফিসফিসানি শুধু শোনার বা দেখার জন্য নয়; এটি কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির অভিশপ্ত চিহ্ন, যা সরাসরি মানুষের অনুভূতি ও সাহসকে পরীক্ষা করে। সুবীরের দৌড়ে পালানো অনিকেতকে আরও একবার সতর্ক করল যে, এই রহস্যে এগোনোর জন্য শুধু কৌতূহল যথেষ্ট নয়; সাহস এবং সতর্কতা অপরিহার্য। অনিকেত কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে মালার দিকে তাকালেন, যা কুয়াশার মধ্যে নীরবভাবে ঝলমল করছে। তিনি বুঝতে পারলেন, মালার রহস্য কেবল অতীতের একটি গল্প নয়; এটি জীবন্ত, এবং যারা এর কাছে আসে, তাদের জীবনের নিয়মাবলী সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হতে পারে।

অধ্যায় ৬ –

অনিকেত কালীঘাটের পুরনো আশ্রমের ধূলোমাখা তাক আর মেঝেতে ছড়ানো নথি-পুঁথির মধ্যে গভীর মনোযোগ দিয়ে খুঁজতে শুরু করলেন। অনেকগুলো পুরনো কাগজ, যেগুলিতে তান্ত্রিকের অক্ষরধ্বনি এবং মন্ত্র লেখা ছিল, তাদের মাঝে ভৃগুনাথ তান্ত্রিকের অসমাপ্ত সাধনার চিহ্ন মিলল। অনিকেত প্রতিটি পৃষ্ঠার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন যে, এই নথিগুলো শুধুমাত্র রীতিনীতির দলিল নয়; এগুলো ভৃগুনাথের অভিশপ্ত শক্তির অবশিষ্টাংশ। পুঁথিতে লেখা প্রতিটি শব্দ যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে, ফিসফিস করে কথা বলে—একটি অদৃশ্য কণ্ঠ, যা অতীতের অসংখ্য রাতের প্রার্থনা এবং ক্রমশ অসম্পূর্ণ সাধনার প্রতিধ্বনি বহন করছে। অনিকেত দ্রুত নোট নিলেন, যেকোনো ভুল ব্যাখ্যা বা উপেক্ষা তার তদন্তকে বিপন্ন করতে পারে। ধীরে ধীরে তিনি উপলব্ধি করলেন, ভৃগুনাথ তান্ত্রিকের মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি ভয়ংকর “রক্তসিদ্ধি” সাধনা, যা সম্পূর্ণ হলে এক প্রকার অতিপ্রাকৃত শক্তি অর্জন করা সম্ভব হতো। তবে মৃত্যুর আগে তিনি সেটি শেষ করতে পারেননি, এবং সেই অসম্পূর্ণ সাধনা হয়তো আজও আশ্রমের প্রতিটি কোণে বিরাজ করছে।

নথি ও পুঁথি খোঁজা অব্যাহত রেখে অনিকেত একটি অদ্ভুত নকশা এবং মন্ত্রপাঠের সংমিশ্রণ খুঁজে পান। প্রতিটি নকশার রেখা, প্রতিটি অক্ষরের বিন্যাস, এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন এটি একটি শক্তিশালী তান্ত্রিক চক্রের অংশ। অনিকেত বুঝতে পারলেন, মালার রক্তিম আভা এবং আশ্রমে রাতের অদ্ভুত ফিসফিসানি সম্ভবত সেই চক্রেরই অপ্রত্যক্ষ প্রতিফলন। যেকোনো সাধারণ মানুষের জন্য এটি কেবল রহস্যময় ঘটনা মনে হতে পারে, কিন্তু তান্ত্রিকের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি এক শক্তিশালী, জীবন্ত সৃষ্টির অংশ। নথিগুলো ঘেঁটে অনিকেত আরও এক অদ্ভুত তথ্য খুঁজে পেলেন—ভৃগুনাথ মৃত্যুর আগে নিজে বলেছিলেন, যে এই সাধনা শেষ না হলে তার আত্মার অবশিষ্টাংশ মালার সঙ্গে আবদ্ধ থাকবে এবং আশ্রমের চারপাশের পরিবেশকে প্রভাবিত করবে। এটি একধরনের “জীবন্ত অভিশপ্ত শক্তি,” যা অতীত এবং বর্তমানকে একসাথে বাঁধা দিয়ে রাখে।

অনিকেত যখন নথিগুলো আরও গভীরে বিশ্লেষণ করলেন, তখন বোঝা গেল যে এই রক্তসিদ্ধি শুধুমাত্র তান্ত্রিকের অভ্যন্তরীণ সাধনার অংশ নয়; এটি মানুষের রক্ত এবং আশ্রমের শক্তিশালী প্রাচীন চিহ্নের সঙ্গে মিলিত হয়ে একটি শক্তিশালী ও বিপজ্জনক শক্তি তৈরি করেছে। নথিগুলোতে লেখা প্রতিটি শব্দ এবং চিত্র অনিকেতকে সতর্ক করল—যে কোনও ভুল পদক্ষেপ এই অভিশপ্ত শক্তিকে উদ্দীপ্ত করতে পারে। তিনি উপলব্ধি করলেন যে, মালা থেকে যে রক্ত ঝরছে এবং রাতের কুয়াশার মধ্যে যে ফিসফিসানি শোনা যায়, তা সরাসরি এই অসম্পূর্ণ রক্তসিদ্ধির প্রভাব। অনিকেত তখন নিজেকে প্রস্তুত করলেন, কারণ তার সামনে শুধুমাত্র সংবাদ সংগ্রহের কাজ নেই; বরং তিনি এখন এক প্রাচীন অভিশপ্ত শক্তির মুখোমুখি। প্রতিটি নথি, প্রতিটি পুঁথি, প্রতিটি চিহ্ন তাকে ক্রমশ আরও গভীর এবং বিপজ্জনক সত্যের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, যা তাকে আর শুধুমাত্র পর্যবেক্ষক রাখছিল না—বরং রহস্যের অংশে পরিণত করছিল।

অধ্যায় ৭ –

অনিকেত ধীরে ধীরে মালার রহস্যের গভীরে পৌঁছার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু তার মনে ক্রমশ উদয় হলো একটি ভয়ঙ্কর সন্দেহ—এই সব ভৌতিক ঘটনা কি সত্যিই অতিপ্রাকৃত, নাকি কোনো মানুষ এই সমস্ত খেলা সাজাচ্ছে? নথি-পুঁথি ও হরিপদ দত্তের সতর্কবাণী তাকে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করেছিল। অনিকেত স্থির মন নিয়ে আশ্রমের ভেতরের প্রতিটি কোণ ঘেঁটে দেখলেন। মালার চারপাশের রক্তিম আভা, কুয়াশার মধ্যে ফিসফিসানি, সবকিছুই যেন নিয়মিতভাবে ঘন্টা-ঘন্টা ঘটছে। তার মনে হলো, যদি এটি কোনো মানুষের পরিকল্পনা হয়, তবে সে খুব দক্ষ এবং অত্যন্ত সাহসী, কারণ এমন নিখুঁত পরিবেশ তৈরি করা সহজ নয়। অনিকেতের কৌতূহল এবং ভয়ের মিশ্রণ তাকে আরো গভীরে নিয়ে গেল। তিনি লক্ষ্য করলেন যে, আশ্রমের কিছু পুরনো পাটির নীচে অদ্ভুতভাবে গন্ধযুক্ত মাটির ফাঁক আছে—যেখানে নীরবতা এবং অন্ধকার একসঙ্গে মিলেমিশে একটি অদৃশ্য শক্তির ছাপ ফেলছে।

সন্ধান করতে করতে অনিকেত একটি অদ্ভুত দরজা খুঁজে পেলেন, যা আংশিকভাবে মাটিতে ঢাকা। তিনি দরজা খুলতেই একটি গোপন কক্ষের মুখোমুখি হলেন। কক্ষটি ছোট, তবু গভীর ও ভীতিকর। দেয়াল ঘন লাল দাগে আচ্ছাদিত, যা রক্তের মতো লাগছিল। দেয়ালে আঁকা অদ্ভুত প্রতীক ও মুদ্রা দেখেই বোঝা যায়, এগুলো কোনো সাধারণ চিহ্ন নয়; প্রতিটি চিহ্ন যেন ভয় ও শক্তি প্রকাশ করছে। অনিকেত ধীরে ধীরে কক্ষের ভেতর প্রবেশ করলেন। মাটিতে ছড়িয়ে থাকা কিছু অক্ষর এবং ছোট আকারের প্রতীক দেখে বোঝা গেল যে, এটি একটি ধরনের তান্ত্রিক নকশা। অনিকেত অনুভব করলেন, যে কেউ এই কক্ষ তৈরি করেছে, সে শুধু অতীতের সাধনার ধারা মেনে চলেছে না, বরং নিজের হাতের তৈরি রীতিনীতির মাধ্যমে এক শক্তিশালী অভিশপ্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। তিনি নিজের কণ্ঠকে শান্ত রাখতে চেষ্টা করলেন, কারণ কক্ষের অদ্ভুত নীরবতা এবং অদৃশ্য শক্তির চাপ তার মনকে অস্থির করে তুলছিল।

কক্ষের গভীরে অনিকেত আরও কিছু খুঁজে পেলেন—ছোট ছোট পাত্র, যেগুলোতে শুকনো রক্তের চিহ্ন এবং কয়েকটি অদ্ভুত প্রতীক। প্রতিটি প্রতীক এবং রক্তের ছোপ যেন এক বিশেষ মন্ত্রের অংশ। অনিকেত বুঝতে পারলেন, এই কক্ষটি শুধুমাত্র অতীতের তান্ত্রিক শক্তি ধারণ করছে না; এটি বর্তমানেও সক্রিয়। তিনি কৌতূহল এবং আতঙ্কের মধ্যে দোলাচল করতে থাকলেন, কারণ বোঝা যাচ্ছিল—এখানে শুধুমাত্র প্রেতের শক্তি নেই, বরং কোনো মানুষ, সম্ভবত একজন তান্ত্রিক বা রহস্যময় ব্যক্তিই এই সব ঘটনার পেছনে আছে। অনিকেত উপলব্ধি করলেন যে, এই রহস্যের অন্তর্নিহিত সত্য উদ্ঘাটন করার জন্য তাকে আরও সাহসী হতে হবে, কারণ কক্ষের প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি রক্তের দাগ এবং প্রতিটি প্রতীক তাকে সরাসরি বিপদের মুখোমুখি করছে। তিনি জানতেন, যে সত্য সামনে আসছে, তা একদিকে যেমন ভয়ঙ্কর, অন্যদিকে সাংবাদিক জীবনের সবচেয়ে বড় কাহিনী হয়ে উঠবে।

অধ্যায় ৮ –

অনেক রাতের তদন্ত ও গোপন নথি-পুঁথি ঘেঁটে অনিকেত অবশেষে এক ভয়ঙ্কর সত্যের মুখোমুখি হলেন। আশ্রমের ভেতর, মালার রক্তিম আভা, কুয়াশার ফিসফিসানি, এবং গোপন কক্ষের প্রতীক— এই সবকিছুই কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির এককল্পনা নয়, বরং এক স্বার্থান্বেষী দুষ্কৃতী দলের চালাক পরিকল্পনার অংশ। অনিকেত খুঁজে পেলেন যে, স্থানীয় কিছু ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে কুসংস্কার ছড়িয়ে আশ্রমের পরিচ্ছন্নতা এবং সংস্কৃতির নামে এক অদৃশ্য ভয় সৃষ্টি করে আসছিল। তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট—গ্রামের মানুষদের আতঙ্কিত করা, স্থানীয় সম্পত্তি ও প্রাচীন আশ্রমকে শূন্য করে নিজেদের দখলে নেওয়া। তবে এই শয়তানি খেলা শুধুমাত্র মানসিক চাপ সৃষ্টি করাই সীমাবদ্ধ ছিল না; তারা ভৃগুনাথ তান্ত্রিকের মালা ও তার অসম্পূর্ণ সাধনার গল্পকে ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে অতিপ্রাকৃত ভয় ছড়াচ্ছিল। অনিকেতের সামনে যে চিত্র ফুটে উঠল, তা ছিল নিখুঁত পরিকল্পনার মিশ্রণ—প্রাচীন কাহিনির ছায়া, রক্তিম আভা, ফিসফিসানি, সবকিছুই এই দুষ্কৃতী দলের তৈরি একটি অদৃশ্য নাটকের অংশ।

কিন্তু তদন্ত আরও গভীর হলে অনিকেত একটি চরম অদ্ভুত সত্য আবিষ্কার করলেন। দুষ্কৃতী দলের মধ্যে একজন ব্যক্তি শুধুমাত্র স্বার্থান্বেষী নয়; তিনি ভৃগুনাথ তান্ত্রিকের সত্যিকারের বংশধর। এই ব্যক্তির উদ্দেশ্য একেবারেই ভিন্ন—মালা এবং তার রক্তকে কেন্দ্র করে তন্ত্রচর্চা চালিয়ে, অসম্পূর্ণ সাধনাকে সম্পূর্ণ করতে চায়। অনিকেত বুঝতে পারলেন, যে সমস্ত অদ্ভুত ঘটনার রহস্য—মালার রক্তঝরা, কুয়াশার ফিসফিসানি, এবং রাতের অদ্ভুত ছায়া—এর মূল কারণ তিনি। সে মালার শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে আশ্রমে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে চাচ্ছে। অনিকেত ধীরে ধীরে খুঁজে পেলেন তার রহস্যময় ক্রিয়াকলাপের প্রমাণ—গোপন নথি, তান্ত্রিক প্রতীক, এবং কক্ষের ভেতরের অদ্ভুত উপকরণ। প্রতিটি প্রমাণই স্পষ্ট করছিল যে, এই ব্যক্তির হাতে থাকা ক্ষমতা শুধুমাত্র অসাধারণ নয়, বরং বিপজ্জনক, কারণ অসম্পূর্ণ রক্তসিদ্ধি এখনো ক্রমশ সক্রিয় এবং মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করছে।

অনেকটা সাহস ও সতর্কতার সঙ্গে অনিকেত সব তথ্য একত্রিত করতে থাকলেন। তিনি বোঝলেন, এই শয়তানি খেলা শুধুমাত্র স্থানীয় সম্পত্তি বা ক্ষমতার লোভের জন্য সীমাবদ্ধ নয়; এটি ভৃগুনাথের অসম্পূর্ণ সাধনার শক্তিকে ব্যবহার করে এক বিপজ্জনক তান্ত্রিক শক্তির পুনর্জন্মের চেষ্টা। অনিকেতের কণ্ঠে কম্পন এলো, কারণ সত্যটি এত গভীর এবং জটিল যে এটি শুধুমাত্র রিপোর্টিং নয়, বরং নিজের জীবনের জন্যও এক বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। তিনি স্থির হলেন—যে শয়তানি খেলাটি শুরু হয়েছে, তাকে পুরোপুরি উদঘাটন করা দরকার। এই অভিশপ্ত কাহিনির অন্তর্নিহিত সত্য প্রকাশিত হল যে, মানুষ নাকি প্রেত—এই প্রশ্নের উত্তর মিলল; প্রেত নয়, বরং এক স্বার্থান্বেষী মানুষ, তার সঙ্গে অতীতের তান্ত্রিক শক্তির সংমিশ্রণ, যা এখন অনিকেতের সামনে জীবন্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অধ্যায় ৯ –

রাতের অন্ধকারে কালীঘাটের আশ্রমের পরিবেশ ক্রমশ আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। অনিকেত ও সুবীর ধীরে ধীরে মালার সামনে পৌঁছলেন, যেখানে ভৃগুনাথের বংশধর ইতিমধ্যেই একটি তান্ত্রিক চক্র তৈরি করে বসেছিলেন। তার চোখে অদ্ভুত উন্মাদনা, আর হাতের মুদ্রা ও অঙ্গভঙ্গি ভীতিকর এক শক্তিকে আহ্বান করছিল। চারপাশে ঘন কুয়াশা নেমে এসেছে, যা মালার চারপাশকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। অনিকেত কণ্ঠে অল্প অস্থিরতা ধরে রাখার চেষ্টা করে বললেন, “সবকিছু ক্যামেরায় ধারণ করতে হবে, সুবীর।” সুবীর তার ক্যামেরা প্রস্তুত করলেন, হাত কাঁপছে, কারণ তিনি জানতেন, যা ঘটতে চলেছে তা কেবল দৃশ্য নয়, বরং এক অভিশপ্ত শক্তির প্রকাশ। মালার মুক্তাগুলি হঠাৎই রক্তিম আভায় ভিজে ওঠে, যা ঘন কুয়াশার সঙ্গে মিলেমিশে এক অদ্ভুত আলো ছড়াচ্ছে। চারপাশে ফিসফিসানি এবং অদ্ভুত শব্দের সংমিশ্রণ, যেন আশ্রমের প্রতিটি কোণ থেকে বের হচ্ছে। অনিকেত বুঝতে পারলেন, এটি শুধু একটি সাধনা নয়; এটি ভৃগুনাথের অসম্পূর্ণ সাধনার শেষ অধ্যায়, যা ক্রমশ বাস্তবায়িত হচ্ছে।

ভৃগুনাথের বংশধর মালার সামনে বসে বিভিন্ন মুদ্রা করলেন, অদ্ভুত শব্দ উচ্চারণ করলেন, এবং কয়েকটি রক্তিম পদার্থ মালার উপর ঢাললেন। অনিকেতের চোখে দৃশ্যটি এক অদ্ভুত কম্পনের মতো লাগল—মালা ধীরে ধীরে রক্তে ডুবে যাচ্ছিল, আর তার চারপাশের কুয়াশা আরও ঘন ও লালাভ হয়ে উঠছিল। হঠাৎই আশ্রমের প্রতিটি কোণ থেকে ভয়ঙ্কর শব্দ বের হতে লাগল—কখনও কণ্ঠস্বরের মতো ফিসফিসানি, কখনও গর্জনের মতো কম্পন। সুবীর ক্যামেরা ধরে প্রতিটি মুহূর্ত ধারণ করতে লাগলেন, কিন্তু তার শরীর কাঁপছে, কারণ সবকিছু খুবই বাস্তব এবং বিপজ্জনক মনে হচ্ছিল। অনিকেতও স্থির থেকে নোট নিচ্ছিলেন, তবে তার হৃদস্পন্দন তীব্র। তিনি বুঝতে পারলেন, যে কিছু ঘটে চলেছে, তা কোনো মানুষের তৈরি নয়—এটি অসম্পূর্ণ তান্ত্রিক শক্তি এবং মানুষের প্রয়াসের এক বিপজ্জনক সংমিশ্রণ।

ঘন্টা কয়েক ধরে সাধনা চলল। মালা রক্তে ভিজে গিয়েছে, কুয়াশা আরও ঘন হয়ে উঠেছে, আর আশ্রমের চারপাশে অদ্ভুত অশান্তি বিরাজ করছে। হঠাৎই ভৃগুনাথের বংশধরের চোখ থেকে এক অদ্ভুত জ্বলজ্বল করা আলো ছড়াল, যা মালার রক্তিম আভার সঙ্গে মিলিত হয়ে আশ্রমকে এক অতিপ্রাকৃত দৃশ্যে রূপান্তর করল। অনিকেত ও সুবীর সবাইকে দূরে রাখার জন্য ব্যর্থ চেষ্টা করলেও, তারা প্রাণ হাতে নিয়ে ক্যামেরায় সমস্ত দৃশ্য ধারণ করতে লাগলেন। সবশেষে, অনিকেত বুঝলেন—এই ‘শেষ সাধনা’ শুধু একটি রীতি নয়; এটি ভৃগুনাথের অসম্পূর্ণ শক্তির পুনর্জন্ম, যা কেবল মালার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। এই অভিশপ্ত রাত্রি, এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য, এবং মালার রক্তিম আভা—সবকিছু একত্রিত হয়ে অনিকেত ও সুবীরকে এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিয়ে গেল, যা তারা জীবনভর ভুলে যাবে না।

অধ্যায় ১০ –

রাতের শেষ প্রান্তে অনিকেত এবং সুবীর ধীরে ধীরে ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে যাচ্ছিলেন, তখন হঠাৎ পুলিশ এবং স্থানীয় কিছু সাহসী মানুষ দুষ্কৃতী দলটিকে ধরে ফেলল। তারা আশা করছিলেন, রহস্যের সমস্ত অন্ধকার এই মুহূর্তেই উন্মোচিত হবে, কিন্তু সত্যিকারের চমক তখনো বাকি। ভৃগুনাথের বংশধর, যিনি এত রাত জেগে মালার চারপাশে তন্ত্রচর্চা চালাচ্ছিলেন, হঠাৎই কোনও এক অদৃশ্য কারণে অন্তর্হিত হয়ে গেলেন। অনিকেতের চোখের সামনে তার অস্তিত্ব যেন বাতাসের মতো মিলিয়ে গেল—কেউ স্পর্শ করতে পারল না, কেউ দেখতে পেল না। মালা, যা দীর্ঘ রাত ধরে রক্তিম আভায় ঝলমল করছিল, ধীরে ধীরে শুকিয়ে গেল। কিন্তু আশ্রমের ভেতরে এখনও অদ্ভুত শীতলতা এবং ঘন কুয়াশার ছায়া বিরাজ করছিল। অনিকেত অনুভব করলেন, যে সমস্ত অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে, তার পেছনে শুধু মানুষের কুশীলব নয়; যেন মালা এবং তার সঙ্গে যুক্ত অতীতের শক্তি এখনও কোনোভাবে জীবন্ত।

মালার ওপর লালচে দাগ মাঝে মাঝে ফুটে উঠতে শুরু করল, যেন এটি বলতে চাইছে—অসমাপ্ত শক্তি কখনো সম্পূর্ণভাবে নিঃশেষ হয় না। অনিকেত ক্যামেরার পর্দায় সেই দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করছিলেন, আর তার মনে হচ্ছে—যে রহস্যের পিছনে তিনি এত রাত কাজ করেছেন, তার একটি অংশ এখনও অদৃশ্যভাবে উপস্থিত। তিনি বুঝতে পারলেন, দুষ্কৃতীর ষড়যন্ত্র কেবল একটি স্তর; তার নিচে রয়েছে ভৃগুনাথের অসম্পূর্ণ সাধনার প্রভাব। আশ্রমের বাতাসে, কুয়াশার মধ্যে, এবং মালার মাঝে রক্তিম আভায় যেন এখনও সেই প্রাচীন শক্তির ছায়া বিরাজ করছে। অনিকেত ভেবেছিলেন, যা ঘটেছে তা কি শুধুমাত্র মানুষের তৈরি নাটক, নাকি সত্যিই অতীতের অভিশপ্ত শক্তি এখনো কালীঘাটে মৃদুভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে? এই প্রশ্ন তার মনে গভীরভাবে জায়গা করে নিল, এবং প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে তার চেতনা আরও সতর্ক হয়ে উঠল।

সকালের আলো নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে আশ্রমের পরিবেশ কিছুটা স্বাভাবিক হল। মালা শুষ্ক, কক্ষটি শান্ত, আর দুষ্কৃতীরা বন্দি। তবুও অনিকেত অনুভব করলেন, আশ্রমের প্রতিটি কোণ এখনও অতিপ্রাকৃত উপস্থিতির প্রভাব নিয়ে ভরা। তিনি নোটবুকে লিখলেন—“রহস্য শুধু অতীতের কাহিনি নয়; এটি জীবন্ত, এটি আমাদের চারপাশে ঘনিষ্ঠভাবে অবস্থান করছে। মানুষের ষড়যন্ত্র যতই স্পষ্ট হোক, অসমাপ্ত সাধনার ছায়া কখনো পুরোপুরি নিঃশেষ হয় না।” অনিকেত এবং সুবীর ধীরে ধীরে আশ্রম থেকে বেরিয়ে এলেন, কিন্তু মালার দিকে শেষ নজর রাখার সময় মনে হল, রক্তিম আভার ছোট ছোট ছায়া এখনও কোথাও কুয়াশার মধ্যে ফুটে উঠছে। এই অভিজ্ঞতা তাদের মনে করে দিল, যে সত্য ও ছায়া, মানবীয় ষড়যন্ত্র এবং অতিপ্রাকৃত শক্তি—সবই এক অদৃশ্য সুতার মতো একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, এবং কালীঘাটের এই পুরনো আশ্রমে তার ছায়া এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে।

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *