কেশব চক্রবর্তী
অধ্যায় ১ – রাতের কালীঘাট
রাত নেমে আসে কালীঘাটের সরু গলিগুলোয় যেন ছায়ার আঁচড়, আর সেই আঁধারের মধ্যে ঢোকে এক অদ্ভুত স্থিরতা। মন্দিরের ঘন্টার টিকটিকি দূরে গুনগুন করে, আর মানুষের ঢল ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে। হরিপদ, যিনি প্রতিদিনের মতো মন্দিরের পাশে তার ফুলের টিকিতে বসে বিক্রি করেন, আজ রাতটা কিছুটা ভিন্ন মনে করছিলেন। গলির বাতাস হঠাৎই অস্বাভাবিকভাবে শীতল হয়ে আসে, এমনভাবে যেন ঘন কুয়াশার মতো অদৃশ্য হাত তাঁর গায়ে লেগে থাকে। হরিপদ লক্ষ্য করেন, মন্দিরের আলো দূরে আরও ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে, আর সেই ক্ষীণ আলোর মাঝে হঠাৎ এক নীলবসনা মানুষ প্রবেশ করে। সাধকের গায়ে শুধু নীল কাপড়, মুখ অজানা ও চোখ অদ্ভুতভাবে দীপ্তিময়। তাঁর পদচারণায় যেন ধুলোর ঘ্রাণের সঙ্গে মাটির গভীর শ্বাসের প্রতিধ্বনি মিশে যায়। হরিপদ প্রথমে ভেবেছিলেন হয়তো কোনো ভিক্ষুক, কিন্তু সাধকের চেহারায় যে অদ্ভুত আকর্ষণ এবং ভয়ঙ্কর রহস্য তারাও খুঁজে পাচ্ছিল, তা সহজে কোনো সাধারণ মানুষের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। চারপাশের বাতাসের মধ্যে অদ্ভুত মন্ত্রস্বর ঝাঁঝালো ছন্দে ভেসে আসে, যেন কেউ গলির অদৃশ্য কোণ থেকে গান করছে, কিন্তু গলিতে কেউ নেই। হরিপদ জোর করে নিজের চোখে বিশ্বাস করার চেষ্টা করলেও, হৃদয় থেকে ভয় যেন অচেনা দমনে জেগে উঠে।
হরিপদ পালাতে চাইলে হঠাৎ অনুভব করেন, তাঁর পা যেন মাটিতে জমে গেছে। গলির বাতাস যেন তাঁর দমকে দমকে শ্বাসকে আঁকড়ে ধরে, আর নীলবসনা সাধকের উপস্থিতি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গলির ছায়াগুলি তার চারপাশে নাচতে থাকে, এবং মন্ত্রস্বরগুলো যেন সরাসরি হরিপদের মনে প্রবেশ করতে চায়। তিনি একপ্রকার অদ্ভুত অনুভূতিতে ভরপুর হয়ে যান; মনে হয় তিনি এই সাধকের চোখে নিজের জীবনের সমস্ত দুর্বলতা, ভয় ও অপরাধ দেখতে পাচ্ছেন। হরিপদের মনে প্রশ্ন জাগে, “এ কি বাস্তব নাকি কোনো স্বপ্নের প্রতিফলন?” কিন্তু কোনও উত্তর নেই—শুধু নীলবসনা সাধকের অদ্ভুত দৃষ্টিতে জড়িয়ে থাকা গলির রহস্যময় পরিবেশ। তিনি হঠাৎ ফিরে তাকান, গলির প্রান্তে ধূসর আলো ম্লানভাবে ছড়িয়ে আছে, যেন সময় নিজেই থেমে গেছে। হরিপদ সিদ্ধান্ত নেন দ্রুত পালানোর, কিন্তু পদে পদে যেন গলির ছায়া তাকে ধেয়ে আসে। অবশেষে, তিনি শক্তভাবে চোখ বন্ধ করে গলিটি অতিক্রম করেন এবং সরে আসেন। বাইরে এসে হঠাৎ বাতাসের তাপমাত্রা স্বাভাবিক মনে হয়।
পরবর্তী দিনগুলিতে গলির অদ্ভুত অভিজ্ঞতা ধীরে ধীরে শহরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ফুল বিক্রেতা হরিপদের কাহিনী প্রথমে কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু রাতের কালীঘাটে যারা একা হেঁটে যান, তাদেরকেও অজানা মন্ত্রস্বর শুনতে পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলতে থাকেন, “সাধকটি বাস্তব নয়, তিনি এক অসীম তন্ত্রের শক্তি, যার কাছে গলির সব রহস্য লুকিয়ে আছে।” আরেকদল মানুষ মনে করে, এটি হয়তো কেবল হরিপদের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া—কিন্তু যারা গলিতে একা যান, তারা জানেন সত্যিই কিছু অদৃশ্য শক্তি সেখানে উপস্থিত। মন্দিরের পাশে গলির বাতাসে এখনও সেই অদ্ভুত শীতলতা লেগে থাকে, আর নীলবসনা সাধকের উপস্থিতি মনে করিয়ে দেয় যে, কালীঘাট শুধু দেবীর মন্দির নয়; এটি এমন এক রহস্যময় স্থান, যেখানে সময় ও বাস্তবতার সীমারেখা মিশে যায়, এবং প্রতিটি অন্ধকার কোণেই লুকিয়ে থাকে অজানা ভয় ও বিস্ময়। হরিপদের চোখে দেখা সেই প্রথম রাতের স্মৃতি, এখন গলির মানুষের গল্পের অংশ হয়ে উঠেছে, যা শোনা মাত্রই বুকের ভেতর অদ্ভুত শিহরণ জাগায়।
অধ্যায় ২ – সাংবাদিকের কৌতূহল
অনির্বাণ মুখার্জি, কলকাতার একটি প্রভাবশালী দৈনিকের কৌতূহলী সাংবাদিক, শহরের অদ্ভুত ও রহস্যময় ঘটনার খোঁজে সবসময় নজর রাখতেন। একদিন তিনি খবর পান যে কালীঘাটের মন্দিরের পাশের এক গলিতে মানুষ অদ্ভুত এক নীলবসনা সাধকের দেখা পেয়েছে, যাকে কেউ বাস্তব মনে করে না আর কেউ তাকে রহস্যময় শক্তি ধারণকারী বলে বিশ্বাস করে। এই খবরটি পড়ে অনির্বাণের কৌতূহল চরমে পৌঁছে যায়। তার মনে আসে—ভৌতিক ও অলৌকিক ঘটনা সবসময়ই মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস ও ভয় উভয়ই জাগিয়ে তোলে, আর সাংবাদিক হিসেবে এই ঘটনা তার ক্যারিয়ারের জন্য এক স্বপ্নের মতো সুযোগ। সে ঠিক করে যে, নিজে গিয়ে এই ঘটনার সত্যতা খুঁজে বের করবে। অনির্বাণ নিজের রেকর্ডার, ক্যামেরা, ও নোটবুক নিয়ে রাতের কালীঘাটের অন্ধকারের দিকে পা বাড়ায়। গলির প্রতিটি ছায়া যেন তার চোখে আরও গভীর রহস্যের স্বাদ আনছে, আর বাতাসে অদ্ভুত শীতলতা তাকে সতর্ক করছে। প্রতিটি পদে পদে অনির্বাণ অনুভব করেন যে, শুধু কাহিনিই নয়, গলির নিজস্ব আত্মা ও ইতিহাসও তাকে গ্রাস করতে শুরু করেছে।
কালীঘাট পৌঁছানোর পর, অনির্বাণ সরাসরি ফুল বিক্রেতা হরিপদের সঙ্গে কথা বলেন, যিনি প্রথম দেখেছিলেন নীলবসনা সাধককে। হরিপদ ভয়ের সঙ্গে তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন, তবে অনির্বাণ লক্ষ্য করেন যে, ভয়ের পেছনে কৌতূহলও প্রবলভাবে লুকিয়ে আছে। হরিপদের কথাগুলো শুনে অনির্বাণ বুঝতে পারেন যে, এই ঘটনা শুধুই চোখে দেখা নয়, বরং গলির অদৃশ্য শক্তি ও অতিপ্রাকৃত আবহাওয়ার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। এরপর অনির্বাণ সরাসরি সরলা দিদিমণির খোঁজ করেন, যিনি দীর্ঘদিন ধরে কালীঘাটের গলিতে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনা সম্পর্কে জানেন। সরলা দিদিমণি, যিনি তার জীবনের বহু বছর ধরে এই গলির রহস্যময় ছায়ামূর্তি দেখেছেন, তাকে স্বাগত জানান। তার কথায় অনির্বাণ জানতে পারেন যে, নীলবসনা সাধক শুধুই এক ব্যক্তিত্ব নয়, বরং গলির একটি প্রাচীন তান্ত্রিক শক্তির প্রতীক, যা বহু বছর ধরে মানুষের চোখে অদৃশ্য থেকেছে। সরলা দিদিমণি তার নিজের অভিজ্ঞতার কাহিনি শোনান—কিভাবে শৈশব থেকে রাতের গলিতে অদ্ভুত ছায়া দেখা যেত, অচেনা মন্ত্রস্বর শুনতে যেত, এবং কখনও কখনও এমনকি বাতাসের সঙ্গে কথোপকথনের মতো অনুভূতি হতো। অনির্বাণ শোনেন যে, কিছু সময়ে এই সাধক মানুষের দৃষ্টিকে পরীক্ষা করে, তাদের ভয় ও কৌতূহলকে উস্কে দেয়, আর সেইভাবে গলির রহস্য ক্রমশ প্রকট হয়।
অনির্বাণের কৌতূহল ক্রমশ তীব্র হয়ে ওঠে, এবং তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে শুধু শোনার চেয়ে বেশি জানতে হবে; তাকে গলিতে রাতের সময় নিজে উপস্থিত থাকতে হবে। সরলা দিদিমণি সতর্ক করেন যে, যারা একা গলিতে যান, তারা কখনও কখনও বাস্তবতার সীমা অতিক্রম করতে পারে। কিন্তু অনির্বাণ এক সাংবাদিক হিসেবে ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করেন না। তিনি গলির প্রতিটি কোণ, প্রতিটি ছায়া, এবং বাতাসের অদ্ভুত শীতলতা মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। সে খুঁজে পেতে চায় সেই অস্পষ্ট ও রহস্যময় সত্য—নিলবসনা সাধক বাস্তব কিনা, নাকি এটি কেবল গলির লোককাহিনির অংশ। সরলা দিদিমণি তাকে অতীতের গল্প শোনান, যেখানে বহু বছর ধরে গলির মানুষরা অদ্ভুত ছায়া এবং মন্ত্রস্বর দেখেছেন, যা শুধুই ভয় তৈরি করে না, বরং গলির নিজস্ব আত্মাকে প্রতিফলিত করে। অনির্বাণ এই কাহিনিগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারেন যে, এই অনুসন্ধান শুধু সংবাদ সংগ্রহ নয়, বরং এক গভীর অলৌকিক অভিযানের প্রারম্ভ—যেখানে ইতিহাস, রহস্য, এবং অদৃশ্য শক্তি একত্রিত হয়ে তাকে নতুন বাস্তবতার সঙ্গে পরিচয় করাবে। তার মনে ঠিক তখনই দৃঢ়ভাবে স্থির হয় যে, সে এই রাতের গলিতে প্রবেশ করবে, সরাসরি সেই নীলবসনা সাধকের মুখোমুখি হবে, এবং কালীঘাটের অন্ধকারের অন্তর্নিহিত রহস্যকে প্রকাশ করবে, যা বহু বছর ধরে শহরের মানুষের মধ্যে গোপন রয়ে গেছে।
অধ্যায় ৩ – সরলার গল্প
সরলা দিদিমণি নরম কণ্ঠে বললেন, “অনির্বাণ, তুমি হয়তো ভাবছ, এ সব গল্প কল্পনার জন্ম। কিন্তু আমি বহু বছর ধরে এই গলির ভেতরের রহস্য দেখেছি। প্রায় চল্লিশ বছর আগে, এক তরুণ তন্ত্রী এখানে সাধনার জন্য আসতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ, দিনের আলোতে প্রায় অদৃশ্য থাকতেন এবং রাতের অন্ধকারে শুধুমাত্র তার তন্ত্রসাধনার প্রভাব ফেলতেন। তার সাধনার লক্ষ্য ছিল এমন এক অদৃশ্য শক্তিকে জাগ্রত করা যা কেবল মনুষ্যসাধ্য নয়, বরং সময় ও বাস্তবতার সীমারেখা অতিক্রম করতে পারে। কিন্তু একদিন, তিনি এমন এক তান্ত্রিক আচরণ করেছিলেন যা তার নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। প্রচণ্ড তন্ত্রিক শক্তির সঞ্চালন ও একাকীত্বের মধ্যে তিনি মারা যান, কেউ জানে না ঠিক কীভাবে। তখন থেকেই এই গলিতে নীল কাপড়ে মোড়ানো একটি ছায়া মাঝে মাঝে দেখা যায়। আমি বিশ্বাস করি, এটি ওই তরুণ তন্ত্রীর অসমাপ্ত সাধনার আত্মা, যিনি অমাবস্যার রাতে বিশেষভাবে ফিরে আসেন। রাতের অন্ধকারে তাঁর উপস্থিতি স্পষ্ট হয়, এবং কখনও কখনও গলির বাতাসে অচেনা মন্ত্রস্বর ভেসে আসে, যা কেবল ভয়ই নয়, অদ্ভুত আকর্ষণও তৈরি করে।”
অনির্বাণ তার চোখ বড় করে সরলা দিদিমণির দিকে তাকালেন। তিনি কখনও এমন গল্প শোনেননি, যেখানে অতিপ্রাকৃত ঘটনা এবং বাস্তব ইতিহাসের সংমিশ্রণ এত স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়। সরলা দিদিমণি বললেন, “তুমি ভাবো না যে এটি কেবল ভয় দেখানোর কৌশল। আমি বহুবার নিজে রাতের গলিতে দেখেছি সেই ছায়াকে। কখনও সে শুধু গলির প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকে, কখনও ধীরে ধীরে সামনে আসে। সে মানুষ নয়, তবে অতিপ্রাকৃত শক্তির পরিচয় বহন করে। যারা একা তার সামনে দাঁড়িয়েছে, তাদের মধ্যে নানা ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে—কেউ পালিয়েছে, কেউ স্থির হয়ে দেখেছে, কেউ আবার মন্ত্রস্বর শুনে অচেতন হয়ে পড়েছে। তবে যে দৃষ্টিকোণ থেকে আমি দেখেছি, ছায়াটি শুধুই ভয় তৈরি করে না, বরং সে যেন অসমাপ্ত সাধনার প্রতি ন্যায্য সম্মান দাবি করছে। এটি অতীতের এক তন্ত্রীর শক্তি, যা এখনও গলির মধ্যে শ্বাস ফেলে। তুমি যদি সত্যি দেখতে চাও, তবে প্রস্তুত থাকতে হবে শুধু চোখের জন্য নয়, মন ও আত্মার জন্যও।”
অনির্বাণ মনে মনে গভীরভাবে সেই কথাগুলো চিবিয়ে নিলেন। গলির প্রতিটি কোণ যেন সরলা দিদিমণির কথার সঙ্গে একযোগে স্পন্দিত হতে লাগল। তিনি বুঝতে পারলেন যে, কেবল খবরের জন্য নয়, বরং একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে তিনি এমন এক সত্যের সামনে দাঁড়াবেন যা বাস্তব ও অতিপ্রাকৃতের সীমারেখা অতিক্রম করবে। সরলা দিদিমণি আরও বললেন, “অনির্বাণ, তুমি যখন এই ছায়ার দিকে তাকাবে, তখন তুমি শুধুই তাকে দেখবে না, তার অতীত, তার সাধনা, তার অসমাপ্ত আকাঙ্ক্ষা এবং তার আত্মার টানও অনুভব করবে। এটি কেবল ভয়ের অভিজ্ঞতা নয়, বরং এক তন্ত্রীর আত্মার সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের সুযোগ। যারা এটি অনুধাবন করতে পেরেছে, তারা জানে যে এই ছায়ার উপস্থিতি একটি সতর্কবার্তা—অসমাপ্ত সাধনা কখনও নিঃশেষ হয় না, এবং অন্ধকারে যা শুরু হয়, তা প্রায়শই দিনের আলোতে প্রতিফলিত হয়।” অনির্বাণ সেই রাতে সরলা দিদিমণির চোখে গভীর সত্যের ছাপ দেখতে পেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, কালীঘাটের এই গলি শুধুমাত্র মন্দিরের পাশে থাকা একটি সাধারণ রাস্তা নয়, বরং এক তন্ত্রীর চিরন্তন ছায়ার আবাসস্থল, যেখানে অতীত ও বর্তমান এক হয়ে অদ্ভুতভাবে প্রবাহিত হয়, এবং যার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা মানে হলো সময় ও বাস্তবতার সীমা অতিক্রম করা।
অধ্যায় ৪ – প্রথম মুখোমুখি
গভীর রাতের অন্ধকার কালীঘাটের গলিকে ঘিরে ধরে এমনভাবে যে, প্রতিটি ছায়া যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। অনির্বাণ মুখার্জি একাকী দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন, হাতে ক্যামেরা, হৃদয়ে কৌতূহল আর ভয়ের অদ্ভুত মিশ্রণ। বাতাস হালকা হলেও, মনে হচ্ছিল যে প্রতিটি শ্বাস যেন তার বুকের ভেতর ঢুকছে না, বরং বাইরে ঠান্ডা অদৃশ্য শক্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে। সরলা দিদিমণির কথাগুলো তার মনে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল—“যখন সে আসে, তখন শুধু চোখ খুলে দেখো না, মনও প্রস্তুত রাখো।” অনির্বাণ জানতেন, রাতের এই অন্ধকারে যা ঘটবে, তা শুধু ক্যামেরার লেন্সে ধরা পড়বে না, বরং তার অভিজ্ঞতার সঙ্গে চিরস্থায়ীভাবে যুক্ত হবে। হঠাৎ, গলির এক প্রান্ত থেকে নীরবতার ভেতর এক অদ্ভুত ঝিকমিক করা নীল আলো আসে। আলোটি ধীরে ধীরে সামনে আসে, আর অনির্বাণের চোখের সামনে ধীরে ধীরে দেখা দেয় সেই নীলবসনা সাধক। তার চোখে জ্বলে উঠছে অদ্ভুত জ্যোতি, ঠোঁট যেন অচেনা মন্ত্র উচ্চারণ করছে, কিন্তু শব্দ নেই, শুধু এক ধরনের অন্তঃস্বরের কম্পন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে।
অনির্বাণ চমকে যায়, হৃদয় ধুকপুক করছে, কিন্তু তিনি স্থির থাকার চেষ্টা করেন। সাধকের উপস্থিতি কেবল অদ্ভুত নয়, বরং এমন এক শক্তি বহন করে যা সরাসরি মানুষের অনুভূতির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। বাতাস যেন হঠাৎ গর্জে ওঠে, প্রতিটি দিক থেকে শব্দের অনুরণন তাকে ঘিরে ধরে। পেছনের ছায়া গুলিও অদ্ভুতভাবে নাচতে থাকে, এবং নীলবসনা সাধকের প্রতিটি আন্দোলন যেন বাতাসের সঙ্গে এক সঙ্গীত তৈরি করছে। অনির্বাণ ক্যামেরা তুলে ছবি তুলতে চায়, কিন্তু যখন ছবি পরে পর্যালোচনা করে, তখন বুঝতে পারে—কেবল নীল আলো ধরা পড়েছে, সাধক বা তার ছায়ার কোনো স্পষ্ট চিহ্ন নেই। ছবিটি যেন প্রমাণ করে, যে ঘটনা বাস্তব হলেও, মানব চোখ এবং প্রযুক্তি উভয়কেই এটি ধরা সম্ভব নয়। অনির্বাণের ভয় ক্রমশ বাড়ছে, কিন্তু সঙ্গে কৌতূহলও তীব্র হচ্ছে—কীভাবে এমন একটি অবিশ্বাস্য দৃশ্য বাস্তবে ঘটছে, তা বোঝা তার জন্য এক অসীম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাধকের দিকে তাকিয়ে অনির্বাণ অনুভব করেন, শুধু ছবি তোলা নয়, বরং তিনি এক ধরনের যোগাযোগের অংশ হয়ে গেছেন। বাতাসে মন্ত্রস্বরের মতো কম্পন, চোখের জ্যোতি, এবং নীল আলো—এগুলি একত্রে এমন একটি বাস্তবতা তৈরি করছে যা মানুষের সাধারণ বোঝার বাইরে। অনির্বাণের মন ভরে যায় বিস্ময়, ভয়, এবং রহস্যের সংমিশ্রণে। সাধক হঠাৎই ধীরে ধীরে দূরে সরে যায়, বাতাস আবার স্থির হয়, এবং গলির অন্ধকার তার আগের নিরব অবস্থায় ফিরে আসে। অনির্বাণ ক্যামেরা বন্ধ করেন, কিন্তু হৃদয়ে সেই দৃশ্য অমোচনীয়ভাবে খোদিত হয়ে থাকে। তিনি বুঝতে পারেন যে, এই রাতের মুখোমুখি দেখা শুধু সংবাদ সংগ্রহ নয়, বরং একটি অভিজ্ঞতা—যেখানে মানুষ, অতিপ্রাকৃত এবং ইতিহাসের ছায়া এক হয়ে যায়। এবং এই অভিজ্ঞতা তাকে অনিশ্চয়তার এক গভীর স্তরে নিয়ে যায়, যা তার জীবনের সমস্ত অনুসন্ধানকে নতুন অর্থে মেলায়, এবং কালীঘাটের রাতের সেই অদ্ভুত, নীল আলো তাকে চিরকাল অনুসরণ করবে।
অধ্যায় ৫ – শাস্ত্রীর সতর্কতা
অনির্বাণ মুখার্জি তার অনুসন্ধানের পরিধি আরও বাড়াতে ত্রিলোচন শাস্ত্রীর কাছে যান, যিনি কলকাতার পুরনো তান্ত্রিক ও অলৌকিক জ্ঞানের খণ্ডগ্রন্থগুলোর উপর প্রখর দৃষ্টি রাখেন। শাস্ত্রীজি ছিলেন সেই ধারা-প্রবাহের একজন জ্ঞাতজ্ঞ, যিনি শহরের ভৌতিক ঘটনা ও তন্ত্রসাধনার ইতিহাসে অভিজ্ঞ। অনির্বাণ তাদের বাড়ির অন্ধকার কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করলেন, যেখানে দেয়াল জুড়ে শাস্ত্রীজির সংগ্রহকৃত প্রাচীন গ্রন্থ, মন্ত্রপত্র এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের নোটসেলাই রাখা। শাস্ত্রীজি ধীরে ধীরে চোখ মেলেই বললেন, “অনির্বাণ, তুমি যে গলিতে নীলবসনা সাধক দেখেছ, সেটি সাধারণ কোনো মানুষ নয়। সম্ভবত সে জীবিত কোনো সিদ্ধপুরুষ, যিনি মহাসিদ্ধির দ্বারে রয়েছেন। এমন শক্তিকে অসাবধানভাবে পরীক্ষা করা বিপজ্জনক। তুমি যে কৌতূহল নিয়ে সেখানে গিয়েছ, তা মানবিক, কিন্তু মানবিক কৌতূহল ও অতিপ্রাকৃত শক্তির মধ্যে সীমা থাকে—যদি সীমা অতিক্রম করো, অন্ধকার তোমাকেও গ্রাস করতে পারে।” অনির্বাণ গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। তার মনে হচ্ছিল, শাস্ত্রীজির কথাগুলো কেবল সতর্কবার্তা নয়, বরং একটি অভিজ্ঞতার আভাস, যা তাকে প্রমাণ করছে যে, নীলবসনা সাধকের উপস্থিতি কেবল ভয় নয়, বরং এক মহাসিদ্ধির শক্তির প্রতীক।
শাস্ত্রীজি আরও বললেন, “সিদ্ধপুরুষরা যখন অসীম শক্তির দ্বারে পৌঁছায়, তখন তাদের উপস্থিতি সাধারণ চোখে ভিন্নভাবে প্রতিফলিত হয়। তোমরা যা দেখছ, তা শুধুই ছায়া বা আলো নয়; এটি সেই শক্তির আভা, যা সময় এবং বাস্তবতার সীমানা অতিক্রম করে। নীলবসনা সাধক একটি নিখুঁত সংযোগের ধাপের মধ্যে রয়েছেন, এবং যারা তার সাথে সরাসরি মুখোমুখি হয়, তারা শুধু দৃষ্টির সঙ্গে নয়, মন ও আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। যদি তুমি প্রস্তুত না হও, তবে তার শক্তি কেবল তোমাকে অভিজ্ঞতা দেবে না, বরং তোমার নিজস্ব ভয় ও অশান্তিকে প্রকট করে তুলবে।” অনির্বাণ অনুভব করলেন যে, শুধু কৌতূহল বা সাহস দিয়ে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। শাস্ত্রীজির কথা তার মনে এক ধরণের সতর্কতা ও ভয় সৃষ্টি করল—এটি শুধুই অনুসন্ধানের নয়, বরং এক ধরনের আত্মপরীক্ষার পরিস্থিতি।
পরবর্তী সময়ে, শাস্ত্রীজি অনির্বাণকে কিছু প্রাথমিক নির্দেশ দেন। “যদি তুমি সত্যিই জানতে চাও, তবে শুধু চোখের শক্তি নয়, হৃদয় এবং মনকে প্রশিক্ষণ দাও। গলিতে প্রবেশের আগে শান্ত থাকো, নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করো, এবং অদ্ভুত ঘটনার সময় শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণে রাখো। নীলবসনা সাধকের শক্তি কেবল আক্রমণমূলক নয়; সে প্রয়োজনে মানুষের ভয় ও কৌতূহলকে পরীক্ষা করে, এবং যার সঙ্গে সে সংযোগ স্থাপন করে, তার মধ্যে অসম্পূর্ণতা খুঁজে বের করে।” অনির্বাণ প্রতিটি কথাই মনোযোগ দিয়ে নোট করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, নীলবসনা সাধকের রহস্যময় উপস্থিতি কেবল সংবাদ বা রিপোর্টের জন্য নয়, বরং মানুষের আত্মার গভীর স্তরকে স্পর্শ করে। শাস্ত্রীজির এই সতর্কতা তাকে বুঝিয়ে দিল যে, কালীঘাটের রাতের গলিতে প্রবেশ মানে শুধুমাত্র অনুসন্ধান নয়, বরং এক অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ—যা তাকে বদলে দিতে, ভয় দেখাতে এবং কখনও কখনও অভিজ্ঞতার চূড়ান্ত সীমারেখা দেখাতে পারে।
অধ্যায় ৬ – অমাবস্যার রাত
অমাবস্যার রাত কালীঘাটের গলিকে এমন এক অদ্ভুত আবহে ঘিরে রাখে, যা দিনে কখনো দেখা যায় না। গলির প্রতিটি কোণ, প্রতিটি ছায়া যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে, বাতাসে অদ্ভুত শীতলতা ঘনিয়ে আসে এবং দূরের মন্দিরের ঘণ্টার আওয়াজও যেন বেশি গভীর, ধীর ও প্রতিধ্বনিত। হরিপদ, যিনি প্রতিদিনের মতো ফুল বিক্রি করতেন, আজ রাতের অন্ধকারে এমন কিছু দেখলেন যা তার জীবনের সবচেয়ে গভীর ভয়কে জাগিয়ে তুলল। তিনি দেখলেন নীলবসনা সাধক সেই অমাবস্যার রাতেও গলিতে উপস্থিত—কিন্তু এইবার তার চারপাশে অগ্নিশিখার মতো নীল আলো জ্বলছে। আলো শুধু দ্যুতি নয়, বরং ধীরে ধীরে ছায়ার সঙ্গে মিলেমিশে এক অদ্ভুত কম্পন তৈরি করছে, যেন গলির বাতাস নিজেই তার উপস্থিতি অনুভব করছে। হরিপদের চোখে সাধকের এই রূপ অত্যন্ত অতিপ্রাকৃত মনে হল; তার দৃষ্টিতে এমন এক শক্তির ছাপ ফুটে উঠছে যা শুধু চোখে নয়, মনেও স্পন্দন জাগাচ্ছে। সরাসরি তার উপস্থিতি অনুভব করতে গিয়ে হরিপদ বুঝতে পারলেন, এটি কোনো সাধারণ মানুষের কাজ নয়—এটি এক অসমাপ্ত সাধনার আত্মা, যিনি এখনও শান্তি পাননি, এবং তার শক্তি গলির প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে আছে।
সরলা দিদিমণি কাঁদতে কাঁদতে অনির্বাণ ও হরিপদকে বলেন, “এ আত্মা শান্তি পায়নি। বহু বছর ধরে সে এই অন্ধকারে আটকে আছে, নিজের সাধনা অসম্পূর্ণ রেখে। যে কেউ তার সামনে দাঁড়ায়, তার ভয় ও কৌতূহল অনুভব করতে হয়। সে শুধু দৃশ্য নয়, সে অনুভূতি, শক্তি এবং অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতার এক জীবন্ত প্রতিফলন।” অনির্বাণ মনোযোগ দিয়ে শুনলেন এবং বুঝতে পারলেন যে, এই রাতের ঘটনাটি শুধু সংবাদ বা অনুসন্ধানের জন্য নয়, বরং মানুষের আত্মার গভীর স্তরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের এক অভিজ্ঞতা। হরিপদের চোখে জ্বলছে সেই নীলশিখা, বাতাসে কম্পন অনুভূত হচ্ছে, আর অনির্বাণের মন ভরে উঠল এক অদ্ভুত মিশ্রণ—ভয়, বিস্ময় এবং রহস্যের গভীরতা। অনির্বাণ তার ক্যামেরা ও মোবাইল নিয়ে ভিডিও করার চেষ্টা করলেন, যেন এই অভিজ্ঞতাকে সংরক্ষণ করতে পারেন। কিন্তু যখন মোবাইলের স্ক্রিনে দৃশ্যটি ধরা পড়ার কথা, হঠাৎ করে মোবাইল নিজেই বন্ধ হয়ে যায়। বারবার চেষ্টা করলেও, প্রতিটি ডিভাইস কাজ করতে অস্বীকার করল। যেন অদৃশ্য শক্তি নিজেই প্রতিরোধ করছে, যা ভিডিওর মাধ্যমে ধরা পড়ার চেষ্টা করছে।
অনির্বাণ তখন বুঝতে পারলেন, কেবল প্রযুক্তি দিয়ে এই শক্তিকে ধারণ করা সম্ভব নয়। বাতাসে ভেসে থাকা মন্ত্রস্বর, নীল আলো এবং সাধকের উপস্থিতি—সব মিলিয়ে এক ধরনের বাস্তবতা তৈরি করছে যা মানুষের জ্ঞানের বাইরে। সরলা দিদিমণি এবং হরিপদ নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন, চোখে অশ্রু আর হৃদয়ে গভীর শিহরণ। অনির্বাণ নিজেকে স্থির করার চেষ্টা করলেন, তার সমস্ত মনোযোগ বর্তমান মুহূর্তে ফোকাস করতে, যেন অতিপ্রাকৃত শক্তির সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করা যায়। সেই সময়ে হরিপদ লক্ষ্য করলেন, নীলবসনা সাধকের চারপাশে আলো অল্প অল্প নাচছে, কখনও শিখার মতো উঁচু হচ্ছে, কখনও আবার ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। বাতাস যেন গর্জে ওঠে, প্রতিটি দিক থেকে কম্পন অনুভূত হচ্ছে, আর অনির্বাণ বুঝলেন যে, এটি শুধুই ভয় বা কল্পনা নয়—এটি বাস্তব, জীবন্ত, এবং অসমাপ্ত সাধনার আত্মার এক চিরন্তন উপস্থিতি। সেই রাতের অভিজ্ঞতা অনির্বাণের মনে অমোচনীয়ভাবে খোদিত হয়ে গেল; প্রযুক্তি তাদের সীমারেখার বাইরে, কিন্তু চোখ, মন ও আত্মার মাধ্যমে তারা সরাসরি সেই শক্তির সংস্পর্শে পৌঁছেছিল। সেই অমাবস্যার রাত কেবল একটি ঘটনা নয়, বরং কালীঘাটের অন্ধকারের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত এক অতিপ্রাকৃত অধ্যায়, যা ভয়, বিস্ময় এবং রহস্যকে একসাথে মিশিয়ে চিরস্থায়ীভাবে হৃদয়ে বেঁধে রাখল।
অধ্যায় ৭ – সত্যের পথে
অনির্বাণ মুখার্জি গভীর অনুসন্ধানে নামলেন, যেন নীলবসনা সাধকের রহস্যের পিছনে লুকিয়ে থাকা ইতিহাসের আবহ বের করতে পারেন। তিনি কালীঘাটের পুরনো রেকর্ড ও গ্রন্থাগার ঘেঁটে দেখলেন, স্থানীয় বৃদ্ধ লোকজনের সঙ্গে আলাপ করলেন, এবং সরলা দিদিমণির দেয়া তথ্যকে আরও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করলেন। অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে তিনি জানতে পারলেন যে, প্রায় চল্লিশ বছর আগে শিবপদ নামের এক তরুণ তন্ত্রী এই গলিতে সাধনার জন্য বসেছিলেন। শিবপদ ছিলেন অত্যন্ত নিবেদিত ও তন্ত্রসাধনায় দক্ষ, একাকী পথচারি, যার চোখে লক্ষ্মণীয় এক দীপ্তি এবং মনোযোগের গভীরতা ছিল। কিন্তু তার জীবনের সময়সীমা মানুষের মতোই সীমিত—সাধনার মধ্যেই হঠাৎ হৃদরোগে তিনি মারা যান। অনির্বাণ জানতে পারলেন, শিবপদ কখনও স্বামী, পিতা বা শিষ্যদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না; তার জীবন কেবল সাধনা ও তান্ত্রিক অধ্যয়নের জন্য উৎসর্গ করা ছিল। তার মৃত্যুর খবর শোনার পরও গলিতে লোকেরা নানা গল্প শোনাতেন—কেউ বলতেন, তার শক্তি এখনও অব্যক্ত, কেউ বলতেন, তার ছায়া নীলবসনা হয়ে ফিরে এসেছে, যেন অসমাপ্ত সাধনার প্রতীক হয়ে।
অনির্বাণ আরও গভীরভাবে খোঁজ নিলেন এবং শিবপদের জীবনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস খুঁজে পেলেন। দেখা গেল, মৃত্যুর আগে শিবপদ এক অদ্ভুত কথা বলেছেন, যা আজও স্থানীয়দের মধ্যে চর্চিত—“আমার সাধনা অসমাপ্ত, আমি ফিরব।” সেই কথাটি কেবল একটি ভবিষ্যৎবাণী নয়, বরং নীলবসনা সাধকের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। অনির্বাণ বুঝতে পারলেন যে, যারা গলিতে তাকে দেখেছেন, তারা আসলে শিবপদের আত্মার উপস্থিতি অনুভব করেছেন—অসমাপ্ত সাধনার টানে ফিরে আসা। গলির অন্ধকারে নীল আলো, বাতাসে কম্পন, এবং অচেনা মন্ত্রস্বর—সব মিলিয়ে শিবপদের শক্তির প্রকাশ, যা মৃত্যুর পরও বিদ্যমান। অনির্বাণের মনে হলো, এই ঘটনা শুধুই অতিপ্রাকৃত নয়, বরং এক ইতিহাস ও সত্যের সংমিশ্রণ, যা বহু বছর ধরে মানুষকে বিস্ময় ও ভয়ে মুড়িয়ে রেখেছে। তিনি বুঝতে পারলেন যে, খবর সংগ্রহ বা ছবি তোলার চেষ্টা এখানে যথেষ্ট নয়; সত্য খুঁজতে হলে তাকে শিবপদের অতীত ও তার শক্তির প্রকৃতির গভীরে প্রবেশ করতে হবে।
অনির্বাণের অনুসন্ধান ক্রমশ আরও সংগতিপূর্ণ হয়ে ওঠে। তিনি স্থানীয় লোকজনের কথা অনুযায়ী জানতে পারলেন, শিবপদের সাধনা কখনও সাধারণ মানুষের মতো ছিল না; তার তান্ত্রিক সাধনা এত শক্তিশালী ছিল যে, মৃত্যুর পরও তার আত্মা স্বতঃসিদ্ধভাবে ফিরে আসে। গলিতে যারা রাতের অন্ধকারে একা গিয়েছেন, তারা শুধু তার ছায়া দেখেননি, বরং তার অসমাপ্ত সাধনার প্রভাব অনুভব করেছেন। অনির্বাণ বুঝতে পারলেন, নীলবসনা সাধকের উপস্থিতি কেবল ভয় দেখানোর জন্য নয়; এটি এক সতর্কবার্তা—অসমাপ্ত সাধনা কখনো নিঃশেষ হয় না। এই উপলব্ধি তার মনকে আরও স্থির করে, এবং অনুসন্ধানকে আরও গভীর ও নিবিড় করার প্রেরণা দেয়। অনির্বাণ উপলব্ধি করলেন, সত্যের পথে এগোনোর মানে শুধু চোখের সামনে ঘটছে তা দেখা নয়, বরং অতীত, ইতিহাস, এবং অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা, যা তাকে শিবপদের অসমাপ্ত সাধনার রহস্যের আরও কাছাকাছি নিয়ে যাবে।
অধ্যায় ৮ – সাধকের আহ্বান
রাতের অন্ধকার কালীঘাটের গলিতে ঘন হয়ে আসছিল, আর অনির্বাণ মুখার্জি একাকী, কাঁপতে কাঁপতে, কিন্তু অদ্ভুতভাবে স্থির মনে কালের বিরুদ্ধে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তার হাতে ছিল শুধু ক্যামেরা ও নোটবুক, কিন্তু আজ তার চোখ ও মন প্রস্তুত ছিল অন্য এক অভিজ্ঞতার জন্য। বাতাসে অদ্ভুত শীতলতা, অচেনা কম্পন এবং দূরের মন্দিরের ঘণ্টার নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি—সব মিলিয়ে যেন একটি অন্তর্নিহিত শক্তি তাকে ঘিরে ধরেছিল। হঠাৎ, গলির এক প্রান্ত থেকে নীলবসনা সাধকের উপস্থিতি স্পষ্ট হয়ে উঠল। তার চোখে জ্বলে উঠল আগুনের মতো আলো, এবং ঠোঁট যেন অচেনা মন্ত্র উচ্চারণ করছে, যদিও শব্দ স্পষ্টভাবে শোনা যায়নি। অনির্বাণ অনুভব করলেন, সবকিছু যেন স্থির, কিন্তু সাথে সাথে তার চারপাশের সময় ও স্থান এক অদ্ভুত কম্পনে ভাসছে। বাতাসে মন্ত্রস্বর ভেসে আসছে, যা শুধু তার কানে নয়, তার হৃদয়েও প্রবাহিত হচ্ছে। শরীর ধীরে ধীরে অচেতনভাবে শক্তিহীন হয়ে যাচ্ছে, মনের নিয়ন্ত্রণও যেন কমতে শুরু করেছে।
অনির্বাণ স্থির থাকার চেষ্টা করলেন, তার মনকে সমস্ত ভয় ও কৌতূহল থেকে আলাদা করে শুধু অনুভূতির দিকে কেন্দ্রীভূত করলেন। সাধকের চোখের আগুন যেন তার আত্মার ভিতরে প্রবেশ করতে চাচ্ছিল, প্রতিটি দিক থেকে শক্তির কম্পন তাকে ঘিরে ধরে। হঠাৎ তার কানে একটি অদ্ভুত, গভীর স্বর এসে ধরা দিল—“অসমাপ্তি… পূর্ণ করো…”। শব্দটি এত গভীর ও শক্তিশালী যে, অনির্বাণের মনের সমস্ত অবচেতন অংশও তা অনুভব করতে পারল। প্রতিটি সেলুলার অনুভূতি যেন একই সঙ্গে সচল হয়ে উঠল, শরীর শক্তিহীন হলেও মন একটি অসীম তীক্ষ্ণতা ও সংযোগ অনুভব করল। অনির্বাণ বুঝতে পারলেন, এটি কোনো সাধারণ আহ্বান নয়; এটি শিবপদ বা নীলবসনা সাধকের অসমাপ্ত সাধনার প্রতি এক প্রেরণা, যা শুধুমাত্র ভয়কে না দেখিয়ে আত্মার গভীরে প্রবেশ করতে চায়।
সাধকের উপস্থিতি ক্রমশ ঘন হয়ে আসছিল। বাতাসে মন্ত্রস্বরের কম্পন, চোখের আগুনের মতো আলো, এবং শরীরের শক্তিহীনতার সঙ্গে মিলিয়ে অনির্বাণ এক ধরনের অলৌকিক সংযোগ অনুভব করলেন। তিনি বুঝলেন, এই মুহূর্তটি শুধুমাত্র এক মানবিক মুখোমুখি দেখা নয়, বরং এক গভীর তান্ত্রিক অভিজ্ঞতা, যেখানে অতীত, শক্তি, এবং অসমাপ্ত সাধনা একত্রিত হয়ে মানুষের মনের গভীর স্তরে প্রবেশ করছে। হঠাৎই তার মধ্যে একটি ধ্বনিময় দৃঢ়তা জন্ম নিল—সে জানল, অসমাপ্ত সাধনাকে পূর্ণ করা কেবল শিবপদের আত্মার জন্য নয়, বরং নিজের সাহস, মনোযোগ এবং সংযোগের শক্তিকে প্রমাণ করার এক পরীক্ষা। অনির্বাণ ধীরে ধীরে সমস্ত ভয়কে পেছনে ফেলে স্থিরভাবে দাঁড়ালেন, এবং সেই মুহূর্তে তার মনে হল, অসমাপ্তি পূর্ণ করার আহ্বান কেবল সাধকের নয়—এটি তার নিজের আত্মার জন্যও। বাতাস ধীরে ধীরে শান্ত হলো, মন্ত্রস্বর মিলিয়ে গেল, কিন্তু চোখের আগুন এবং অনির্বাণের অভিজ্ঞতা চিরকাল তার মনে খোদিত হয়ে থাকল, কালীঘাটের সেই রাতের অমোচনীয় স্মৃতি হয়ে।
অধ্যায় ৯ – আত্মার মুক্তি
অনির্বাণ মুখার্জি এবং সরলা দিদিমণি ত্রিলোচন শাস্ত্রীর তত্ত্বাবধানে প্রস্তুতি নিলেন এক বিশেষ মন্ত্রপাঠের জন্য, যা বহু প্রাচীন তান্ত্রিক শাস্ত্র অনুসারে অসমাপ্ত সাধনার আত্মাকে শান্তি দেওয়ার জন্য করা হয়। ত্রিলোচন শাস্ত্রী জোর দিয়ে বললেন, “এই মন্ত্রপাঠ শুধু শব্দ নয়; এটি শক্তি, মন এবং আত্মার একত্রিকরণ। সবাইকে স্থির ও মনোযোগী থাকতে হবে। মনে রাখো, নীলবসনা সাধক জীবন্ত শক্তি, তার সঙ্গে সংযোগ মানে শুধু ভয় নয়, বরং দায়িত্বও।” রাতের অন্ধকার কালীঘাটের গলিকে এমন এক নীরবতা ঘিরে ধরল, যা আগে কখনো অনুভূত হয়নি। বাতাসে অদ্ভুত কম্পন, দূরের মন্দিরের ঘণ্টার নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি, এবং নীল আলো—সব মিলিয়ে যেন এক অতিপ্রাকৃত অবস্থা তৈরি করল। অনির্বাণ মন্ত্রপাঠের প্রতিটি শব্দের সঙ্গে নিজের মন ও হৃদয় একত্রিত করলেন, এবং সরলা দিদিমণি গভীরভাবে ধ্যানমগ্ন হয়ে প্রতিটি মন্ত্র উচ্চারণ করলেন। ধীরে ধীরে বাতাসে একটি শান্তি প্রবাহিত হতে লাগল, যা আগে কেবল অন্ধকার ও ভয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
মন্ত্রপাঠ চলাকালীন নীলবসনা সাধকের উপস্থিতি ক্রমশ ধীরে ধীরে নরম হয়ে এল। আগের মতো চোখে আগুনের মতো জ্যোতি নেই, ঠোঁটের মন্ত্রস্বরও একধরনের স্নিগ্ধতা আর শান্তিতে পরিণত হয়েছে। অনির্বাণ এবং সরলা দিদিমণি একে অপরের দিকে তাকিয়ে অনুভব করলেন যে, শক্তি শুধুমাত্র বিস্তারমান নয়, বরং প্রশমিতও হতে পারে। নীল আলো, যা আগে গলিকে এক অদ্ভুত কম্পনে ভাসিয়ে রেখেছিল, ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগল, বাতাসের ঠান্ডা অনুভূতিও শান্ত হয়ে এল। অনির্বাণ বুঝতে পারলেন যে, এটি কোনো সাধারণ দৃশ্য নয়; এটি এক ধরনের আত্মার মুক্তির অভিজ্ঞতা, যেখানে অতীত, শক্তি এবং মানবিক সংযোগ একসাথে মিলিত হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করছে। সরলা দিদিমণির চোখে অশ্রু, তবে এক ধরনের আনন্দময় শান্তি, যা বহু বছর ধরে অভিজ্ঞতা না করা মানুষের হৃদয়ে বিরলভাবে জন্ম নেয়।
শেষমূহুর্তে, নীলবসনা সাধক সম্পূর্ণভাবে মিলিয়ে গেলেন, শুধু একটি নিঃশব্দ নীরবতা রয়ে গেল। অনির্বাণ অনুভব করলেন, দীর্ঘ সময় ধরে যা ভয় ও রহস্যের আড়ালে লুকিয়ে ছিল, তা এখন শান্তি ও পূর্ণতার রূপে প্রকাশিত হয়েছে। গলির অন্ধকার, বাতাসের কম্পন, নীল আলো—সব মিলিয়ে একটি অমোচনীয় শান্তির আবরণ তৈরি করল। ত্রিলোচন শাস্ত্রী মৃদু কণ্ঠে বললেন, “অসমাপ্ত সাধনা পূর্ণ হলো। আত্মা মুক্তি পেল।” অনির্বাণ এবং সরলা দিদিমণি মিলে দীর্ঘ নিশ্বাস নিলেন, অনুভব করলেন যে, কেবল ঘটনা নয়, বরং তাদের নিজের মন ও আত্মাও এই অভিজ্ঞতায় প্রশান্তি পেয়েছে। কালীঘাটের রাতের সেই রহস্যময় অন্ধকার এখন শুধুই স্মৃতি হয়ে রয়ে গেল, যা ভয়, বিস্ময় এবং অতিপ্রাকৃত শক্তির এক অভিজ্ঞতার চূড়ান্ত বিন্দুতে পৌঁছে আত্মার শান্তি প্রতিষ্ঠা করল।
অধ্যায় ১০ – কিংবদন্তির সমাপ্তি
নীলবসনা সাধকের আত্মার মুক্তির পর কালীঘাটের গলিটি যেন আগের দিনের মতো নিরিবিলি হয়ে ফিরে এসেছে। রাতের অন্ধকারে বাতাসের কম্পন আর অচেনা মন্ত্রস্বর নেই, নীল আলো মিলিয়ে গেছে, এবং গলির সমস্ত কোণ আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছে। স্থানীয় মানুষজন এখন আর ভয় পায় না, হরিপদ তার ফুলের দোকান নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন, এবং সরলা দিদিমণিও তার দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যস্ত। অনির্বাণ মুখার্জি এই পরিবর্তন অনুভব করলেন, কিন্তু মাঝে মাঝে তিনি অদ্ভুতভাবে অনুভব করেন, যেন কেউ এখনও তাকে দেখছে। এটি কোনো ভয়ের অনুভূতি নয়, বরং এক ধরণের সংযোগ—শিবপদ বা নীলবসনা সাধকের অসমাপ্ত সাধনার শক্তি তার মন ও হৃদয়ে এখনও প্রবাহিত হচ্ছে। তিনি বুঝতে পারলেন যে, এই অভিজ্ঞতা শুধু ঘটনাবলীর নথি নয়, বরং মানুষের চেতনার গভীর স্তরেও স্পর্শ রেখেছে। প্রতিটি রাতে, অনির্বাণ যখন কালি ঘাটের অন্ধকারের স্মৃতি মনে করেন, তখন তার মনে এক অদ্ভুত শান্তি ও গভীর অনুধাবন জন্ম নেয়, যা মানুষকে ভয় ও বিস্ময়ের সীমারেখার বাইরে প্রবাহিত হতে শেখায়।
অনির্বাণ অনুভব করলেন যে, শিবপদের অসমাপ্ত সাধনা কেবল অতিপ্রাকৃত শক্তি নয়, বরং মানুষের আত্মার গভীর সম্ভাবনার প্রতীক। এই অনুভূতি তাকে নতুন দিশা দেখালো—কীভাবে ইতিহাস, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, এবং অলৌকিক ঘটনার সংমিশ্রণ মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। তিনি বুঝতে পারলেন, নীলবসনা সাধকের গল্প কেবল ভয়ের বা রহস্যের নয়; এটি শিক্ষা দেয় যে, মৃত্যু মানুষের সাধনার সমাপ্তি নয়। অনির্বাণের মধ্যে জাগলো একটি দায়িত্ববোধ—এই অভিজ্ঞতা, যা সে স্বচক্ষে দেখেছে, তা শুধু নিজের মনে সংরক্ষণ করা যথেষ্ট নয়। তাকে মানুষকে জানাতে হবে, বোঝাতে হবে যে কিছু সাধনা অসমাপ্ত থাকে, এবং সেই অসম্পূর্ণতা কখনও কখনও অতীত ও বর্তমানের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। সরলা দিদিমণির কথাগুলো তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল—“অসমাপ্ত সাধনা কখনো নিঃশেষ হয় না।”
শেষমূহুর্তে, অনির্বাণ স্থির সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি নীলবসনা সাধকের ইতিহাস, শিবপদের জীবন, এবং তার অসমাপ্ত সাধনার প্রভাব নিয়ে একটি বই লিখবেন। বইটি শুধু একটি ঘটনার বর্ণনা নয়, বরং মানুষের জন্য এক ধরনের প্রেরণা—যাতে তারা বুঝতে পারে, মানবিক সীমা, মৃত্যু, এবং অতিপ্রাকৃত শক্তির মধ্যেও এক ধরণের সংযোগ স্থায়ী থাকে। অনির্বাণের লেখায় থাকবে কালীঘাটের সেই রাতের অভিজ্ঞতা, হরিপদ ও সরলা দিদিমণির সাক্ষাৎ, এবং নীলবসনা সাধকের উপস্থিতি। তিনি আশা করলেন, এই বই পাঠককে ভয় দেখানোর জন্য নয়, বরং মনে করিয়ে দেবে যে, অতীতের শক্তি, অসম্পূর্ণ সাধনা, এবং মানুষের আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। কালীঘাটের গলির রহস্য চিরকালের জন্য কিংবদন্তি হয়ে রইল, আর অনির্বাণের লেখা বই সেই কিংবদন্তিকে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেবে—যাতে মানুষ জানে, কিছু সাধনা মৃত্যুর পরও অসম্পূর্ণ থেকে যায়, এবং সেই অসম্পূর্ণতার মধ্যে লুকিয়ে থাকে সত্যের শক্তি।
শেষ




