সন্দীপন বিশ্বাস
অন্ধকারে মোড়া সেই গ্রামে দীপঙ্কর সেনের আগমন যেন এক অদ্ভুত পূর্বাভাসের মতো ছিল। কলকাতার ইতিহাসবিদ ও লেখক হিসেবে তার নাম ছড়িয়ে পড়েছিল, আর তাই গবেষণার তাগিদেই সে এই দূরবর্তী গ্রামে আসে। গ্রামের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা কালী মন্দিরের পাশে কূপটির কথা সে অনেক আগে থেকেই শুনে এসেছে—লোকমুখে কিংবদন্তির মতো ছড়িয়ে থাকা গল্প যে, রাত নামলেই এই কূপ থেকে অশুভ ছায়ারা বেরিয়ে আসে। শোনা যায়, বহু বছর আগে এখানে এক তান্ত্রিক সাধক তপস্যা করত, আর কূপের অন্ধকার গভীরে তার আত্মা এখনও বন্দী আছে। দীপঙ্কর প্রথম দিনেই গ্রামে পৌঁছে বুঝতে পারে, এখানকার মানুষদের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। দিনের আলোতে গ্রামটি দেখতে সাধারণ হলেও সূর্য ডুবতেই অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা নেমে আসে, যেন বাতাসও ভারী হয়ে ওঠে। দীপঙ্কর কৌতূহলী দৃষ্টিতে চারপাশ লক্ষ্য করে—মাটির বাড়ি, সরু কাঁচা রাস্তা, দূরে পুকুরের জলে ঝিলিক, আর মাঝেমধ্যে ভেসে আসা ধূপ-ধুনোর গন্ধ, যা মন্দির ঘিরে থাকা রহস্যকে আরও ঘন করে তোলে।
প্রথম রাতে, কাগজে-কলমে কিছু নোট নিয়ে দীপঙ্কর কূপের দিকে হাঁটতে থাকে। গ্রামের বৃদ্ধ ভাসু দাস তাকে সতর্ক করে দিয়েছিল, “রাতে ওই কূপের ধার ঘেঁষিস না বাবা। অনেকেই গেছে, ফেরেনি।” কিন্তু কৌতূহল আর গবেষণার নেশা দীপঙ্করকে টেনে নিয়ে যায়। কূপটির কাছে পৌঁছেই সে অনুভব করে চারপাশে এক অদ্ভুত শীতলতা, যেন হঠাৎ করে হাওয়া থেমে গেছে। মাটির ওপর শুকনো পাতার খসখস শব্দও থেমে যায়। কূপের পাড়ে গিয়ে দাঁড়াতেই মনে হয় যেন অন্ধকার তাকে ঘিরে ধরছে। ঠিক তখনই দূরের মন্দির থেকে শঙ্খধ্বনি ভেসে আসে, আর তার সঙ্গে মিশে যায় এক অদ্ভুত শিস দেওয়ার মতো আওয়াজ, যা স্পষ্টতই কোনো মানুষের নয়। দীপঙ্কর চোখ কুঁচকে তাকায়, আর দেখতে পায়—কূপের অন্ধকার জলরাশির ওপরে এক কালো ছায়া ধীরে ধীরে উঠে আসছে। প্রথমে মনে হয় হয়তো কোনো ভ্রম, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সেই ছায়া কূপের ধার পর্যন্ত উঠে আসে, যেন তাকে লক্ষ্য করে তাকিয়ে আছে। দীপঙ্করের বুক ধড়ফড় করতে থাকে, অথচ সে নড়তে পারে না। চারপাশের গাছে ঝিঁঝিঁর ডাক হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়, আর অস্বাভাবিক নীরবতার ভেতরে ছায়াটি ক্রমে আরও স্পষ্ট হয়।
হঠাৎই বাতাসে ভেসে আসে মাটির সোঁদা গন্ধ, কিন্তু তার সঙ্গে এক অচেনা গন্ধ মিশে থাকে—যেন পুরনো কিছু পুড়ে যাওয়া ছাই, যার গন্ধ নাকে লাগে কটু আর ভারী। দীপঙ্কর বুঝতে পারে, এই কূপ কোনো সাধারণ জায়গা নয়। গ্রামের লোকেরা যাকে ভয় পায়, তা নিছক কুসংস্কার নয়; সত্যিই এখানে অশুভ কিছু বাস করছে। এক মুহূর্তের জন্য দীপঙ্করের মনে হয় ছায়াটি হাত বাড়িয়ে তাকে টেনে নিচ্ছে, কূপের ভেতরে টেনে নিয়ে যাবে। সে আতঙ্কে চোখ বুজে ফেলে, আর ঠিক তখনই মন্দির থেকে ভেসে আসে ঘণ্টার শব্দ। শব্দের তীব্রতায় ছায়াটি যেন মিলিয়ে যায় কূপের গভীর অন্ধকারে, আর চারপাশের বাতাস আবার স্বাভাবিক হয়। দীপঙ্কর হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে বসে পড়ে, বুকের ভেতর ঢেউ খেলানো ভয়ের সঙ্গে লড়াই করে। কিন্তু ভয়ের পাশাপাশি তার মনে জন্ম নেয় আরও প্রবল কৌতূহল—এই কূপের আসল রহস্য কী? অশুভ ছায়াটি কি সত্যিই তান্ত্রিকের আত্মা, না কি এর পেছনে অন্য কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে? গ্রামের মানুষ হয়তো উত্তর জানে, কিন্তু তারা মুখ খুলতে চায় না। এই রাতেই দীপঙ্কর ঠিক করে, সে কোনো মূল্যে এই কূপের ইতিহাস উন্মোচন করবে— এমনকি যদি তার জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ে।
–
ভোরবেলা দীপঙ্কর সেন তার নোটবুক হাতে নিয়ে বেরোলো গ্রাম ঘুরে দেখার জন্য। আগের রাতের অভিজ্ঞতা তাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, তাই এবার আর একা নয়—কলকাতা থেকে আসা ফটো সাংবাদিক রিয়া চ্যাটার্জীকে সঙ্গে নিয়েই গ্রাম ঘোরার সিদ্ধান্ত নিল। রিয়া তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও বন্ধু, এবং অজানা বিষয় অনুসন্ধানে তার আগ্রহ দীপঙ্করের মতোই প্রবল। দু’জনে যখন কাঁচা রাস্তা ধরে এগোচ্ছিল, তখন গ্রামের মানুষের চোখে স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ দেখতে পেল। গ্রামের এক কোণে বসা বৃদ্ধারা তাদের থেমে থেমে বলল, “ওই কালীকূপটা অভিশপ্ত। রাত নামলেই তন্ত্রসাধকেরা সেখানে আসে। আগুন জ্বালিয়ে মন্ত্র পড়ে, আর কূপের জলকে নাকি তারা ব্যবহার করে কালো শক্তি জাগাতে।” রিয়া বিস্ময়ে চোখ বড় করে চারপাশের মানুষের মুখ দেখতে লাগল, ক্যামেরার ভিউফাইন্ডার দিয়ে কয়েকটি মুহূর্তও ধরে রাখল। অন্যদিকে দীপঙ্কর নোটবুকে তাদের বর্ণনা লিখে রাখছিল, প্রতিটি শব্দ যেন ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠছিল। গ্রামের এক যুবক ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জানাল, গত মাসে নাকি তার এক বন্ধু কূপের ধার ঘেঁষে গিয়েছিল; ফিরে আসার পর থেকে ছেলেটি অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে, হঠাৎ জ্ঞান হারানো, রাতে চিৎকার করা, আর কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া। এসব শুনে গ্রামের মানুষের আতঙ্ক যেন আরও প্রবল হয়ে উঠল, এবং তাদের চোখেমুখে স্পষ্ট বার্তা—কূপের কাছে গেলেই সর্বনাশ নিশ্চিত।
এমন সময়ে মন্দিরের দিক থেকে এগিয়ে এলেন গ্রামের পূজারি ও তান্ত্রিক-জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি, পণ্ডিত কুমারীশ্বর। লম্বা দাড়ি, গায়ে গেরুয়া বস্ত্র, চোখে অদ্ভুত দীপ্তি—তার উপস্থিতিতেই গ্রামের মানুষদের ভেতর ভয়ের সঙ্গে এক ধরনের শ্রদ্ধার মিশ্রণ দেখা গেল। দীপঙ্কর ভদ্রভাবে তাঁকে প্রণাম জানিয়ে বলল, “পণ্ডিতমশাই, আমরা কূপের ইতিহাস জানতে চাই। এর পেছনে কী রহস্য লুকিয়ে আছে?” কুমারীশ্বর কিছুক্ষণ নীরব থেকে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন, “সব কথা বলা যায় না। কিছু রহস্য আছে, যা জানলেও মানুষের ক্ষতি হতে পারে। তবে এতটুকু বলতে পারি—ওই কূপে বহু বছর আগে এক তন্ত্রসাধক অমরত্ব লাভের সাধনা করেছিল। সে শক্তি অর্জনের জন্য মানব বলিও দিয়েছিল, আর তার আত্মা কূপের গভীরে বন্দী হয়ে আছে। রাত নামলে সেই আত্মা মুক্তি চায়, তাই অশুভ ছায়া দেখা যায়।” তাঁর কথায় রিয়ার চোখ বিস্ময়ে চকচক করে উঠল, কিন্তু দীপঙ্করের মনে সন্দেহ জাগল—এ কি সত্যিই অতিপ্রাকৃত ঘটনা, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো চক্রান্ত আছে? কুমারীশ্বর আরও রহস্যময় ভঙ্গিতে বললেন, “তুমি যদি সত্যিই কূপের রহস্য জানতে চাও, তবে সাবধান থেকো। ওটা শুধু কূপ নয়, মানুষের লোভ আর পাপের স্মৃতিস্তম্ভ।” এই ইঙ্গিতপূর্ণ কথাগুলো শোনার পর গ্রামের মানুষদের মধ্যে কানাঘুষো শুরু হলো, কেউ কেউ ভয়ে পেছন ফিরল, আবার কেউ কেউ কৌতূহলী দৃষ্টিতে দীপঙ্করের দিকে তাকিয়ে রইল।
গ্রামের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দীপঙ্কর ও রিয়া বুঝতে পারছিল, কূপ নিয়ে মানুষের মধ্যে যেমন আতঙ্ক, তেমনি এক ধরনের অলিখিত নিয়মও গড়ে উঠেছে। কেউ সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে বেরোয় না, কেউ কূপের দিক ঘেঁষেও যায় না। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কূপের গল্প শুনে আঁতকে ওঠে, আর বয়স্করা নিজেদের বাঁচানোর জন্য নিয়মিত কালীপুজো করে। দীপঙ্করের মনে হচ্ছিল, এই কূপ যেন পুরো গ্রামটার মানসিক অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। রিয়া ফিসফিস করে বলল, “তুমি লক্ষ্য করেছ? প্রত্যেকের চোখেমুখে একই ভয়। যেন তারা জানে, যেকোনো সময় বিপদ নেমে আসতে পারে।” দীপঙ্কর মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, কিন্তু তার চোখে তখনও কুমারীশ্বরের রহস্যময় দৃষ্টি ভাসছিল। তিনি কী জানেন, যা গ্রামের মানুষ জানে না? আর কেন তিনি এতটা গোপনীয়তার আড়ালে রাখছেন সত্যটা? এইসব প্রশ্ন দীপঙ্করের মনে ক্রমে তীব্র হয়ে উঠতে লাগল। গ্রামবাসীর আতঙ্ক, তন্ত্রসাধকদের উপস্থিতি আর পণ্ডিতের অদ্ভুত ইঙ্গিত—সবকিছু মিলিয়ে দীপঙ্কর নিশ্চিত হলো, কালীকূপের রহস্য কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। এর পেছনে লুকিয়ে আছে এক জটিল, ভয়ঙ্কর ইতিহাস, যা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হলে হয়তো গোটা গ্রামের ভাগ্যই বদলে যাবে।
***
রাত নামতেই গ্রাম জুড়ে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এল। দিনের বেলা কুঁচকানো মুখে আতঙ্কের ছাপ নিয়ে যে মানুষগুলো কূপের কথা বলছিল, তারাই এখন ঘরের ভেতরে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। বাইরে শুধু বাতাসের হাহাকার আর দূরের কুকুরের হুক্কাহুয়া শোনা যাচ্ছে। দীপঙ্কর সেন ও রিয়া চ্যাটার্জী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আজই প্রথমবার তারা কূপের চারপাশে বিস্তারিত তদন্ত করবে। হাতে টর্চ, নোটবুক আর রিয়ার ক্যামেরা—এই নিয়েই তারা মন্দিরপথ ধরে এগোল। কালী মন্দিরের লাল আলো কূপের দিকে হালকা ছায়া ফেলছিল, আর সেই আলোয় দু’জনের ছায়া যেন আরও দীর্ঘ হয়ে ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছিল। কূপের কাছে যেতেই চারপাশের বাতাস হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে গেল, যেন অদৃশ্য কারও উপস্থিতি আছে। রিয়া নিচু গলায় বলল, “তুমি অনুভব করছ? এই শীতলতা স্বাভাবিক নয়।” দীপঙ্কর মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, কিন্তু তার চোখ তখন কূপের দেওয়ালের দিকে। ওখানে সে দেখতে পেল, শ্যাওলা আর ভাঙা ইটের মাঝখানে অদ্ভুত কিছু দাগ খোদাই করা আছে, যা সাধারণত চোখে পড়ে না। সে নোটবুকে আঁকতে শুরু করল, আর রিয়া ক্যামেরার ফ্ল্যাশে ছবি তুলল। ফ্ল্যাশের আলোয় মুহূর্তের জন্য দেখা গেল কূপের জলে কিছু নড়ছে, কিন্তু আলো মিলিয়ে যেতেই আবার সব শান্ত।
ঠিক তখনই কূপের ভেতর থেকে ভেসে এলো এক অদ্ভুত শব্দ—যেন মন্ত্রোচ্চারণ, কিন্তু অস্পষ্ট আর ভারী। শব্দটা এত গভীর থেকে আসছিল যে, কারও কণ্ঠস্বর বলে মনে হচ্ছিল না, বরং কূপের অন্ধকার নিজেই যেন শব্দ তৈরি করছে। রিয়া শিহরিত হয়ে চারপাশে তাকাল, আর তার ক্যামেরা লেন্সে ধরা পড়ল ঝাপসা এক ছায়া, যা মুহূর্তের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেল। সে কেঁপে উঠে বলল, “দীপঙ্কর, আমি ঠিক দেখেছি! কেউ বা কিছু আমাদের নজর রাখছে।” দীপঙ্কর ঠোঁট কামড়ে চুপ করে গেল, কিন্তু তার বুকের ভেতরেও ধকধক শব্দ বাড়ছিল। তবু ভয়কে সরিয়ে দিয়ে সে কূপের পাড়ে ঝুঁকল। আলো ফেলতেই দেখা গেল, কূপের ভেতরের ইটের দেওয়ালে খোদাই করা আছে কয়েকটি প্রাচীন প্রতীক—ত্রিভুজ, বৃত্ত, আর এক ধরনের জটিল জ্যামিতিক নকশা, যার মাঝখানে কালীমূর্তির মতো এক ভয়ঙ্কর মুখ ফুটে উঠেছে। দীপঙ্কর ফিসফিস করে বলল, “এগুলো তন্ত্রসাধনার চিহ্ন। এগুলো এখানে কেন খোদাই করা হলো?” রিয়া উত্তেজিতভাবে ছবি তুলতে তুলতে উত্তর দিল, “এটা প্রমাণ করে যে গ্রামবাসীরা মিথ্যে বলেনি। সত্যিই এখানে তান্ত্রিকরা কোনো সময়ে শক্তি আহরণের চেষ্টা করেছে।” দু’জনেই আরও নিচে আলো ফেলতে গিয়ে লক্ষ্য করল, কূপের জলে লালচে রঙের দাগ ভেসে আছে, যা জল নয়—বরং রক্তের দাগের মতো মনে হচ্ছে। মুহূর্তেই তাদের বুক কেঁপে উঠল, আর অজানা এক আতঙ্ক ঘিরে ধরল।
এরপর হঠাৎ চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। গাছের ডালপালা অকারণে কাঁপতে শুরু করল, অথচ বাতাস বইছিল না। মন্দিরের ঘণ্টা কোথাও থেকে বাজতে লাগল, যদিও তখন মন্দিরে কেউ ছিল না। দীপঙ্কর ও রিয়া একে অপরের দিকে তাকাল, চোখেমুখে স্পষ্ট উদ্বেগ। ঠিক তখন কূপের ভেতর থেকে কালো ধোঁয়ার মতো কিছু একটা ভেসে উঠল, আর তার সঙ্গে ভেসে এলো ঘন শ্বাস নেওয়ার মতো শব্দ। তারা বুঝতে পারল, কূপ শুধু স্থাপত্য নয়—এটা যেন এক জীবন্ত সত্তা, যার ভেতরে অশুভ কিছু বন্দী আছে। রিয়া হাত কাঁপতে কাঁপতে ছবি তুলল, কিন্তু ছবিতে শুধু অন্ধকার ছাড়া কিছু ধরা পড়ল না। দীপঙ্কর সাহস জুগিয়ে বলল, “আমাদের এই প্রতীকগুলো খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে। এর ভেতরেই লুকিয়ে আছে কূপের রহস্য।” কিন্তু মনের ভেতর সে জানত, এই তদন্ত যত এগোবে, ততই তারা বিপদের গভীরে প্রবেশ করবে। কূপের প্রতীক আর অদ্ভুত ছায়া তাদের প্রথম তদন্তেই জানিয়ে দিল—এটা নিছক কুসংস্কার নয়, বরং বাস্তব ও অতিপ্রাকৃতের সীমারেখায় দাঁড়ানো এক ভয়ঙ্কর সত্য, যা তাদের প্রতিটি পদক্ষেপকে বিপদে ফেলতে চলেছে।
***
দীপঙ্করের মনে কৌতূহলের আগুন আরও জ্বলে উঠেছিল, যখন গ্রামের এক বৃদ্ধ তাকে বলেছিলেন যে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি আগে এই কূপের চারপাশে রাত্রে অদ্ভুত ধূপকাঠির গন্ধ ছড়াতো এবং শোনা যেতো মন্ত্রপাঠের গুঞ্জন। সেই সূত্র ধরে তিনি ঠিক করলেন গ্রামীণ পুরনো গ্রন্থগুলো ঘেঁটে দেখা দরকার। গ্রামে ভগ্নদশাগ্রস্ত এক জমিদার বাড়ির পাঠাগার বহু বছর ধরে বন্ধ পড়ে ছিল। ধূলিমলিন কাঠের আলমারি খুলে তিনি হাতে পান একাধিক তালপাতার পুঁথি এবং পুরোনো ছাপার বই। অনেকগুলোই পোকায় খাওয়া, অক্ষরগুলো মুছে গেছে, তবু ধৈর্য ধরে তিনি প্রতিটি পড়তে শুরু করলেন। দিনের আলোয় ম্লান অক্ষরের সারি ধীরে ধীরে ফুটে উঠলো, আর তার চোখে ধরা দিল অদ্ভুত সব বর্ণনা—‘কূপকুণ্ডে স্থিত তত্ত্বসাধনা’, ‘অঘোর মন্ত্রের আবাস’, ‘রক্তবিন্দু অর্পণ’। এসব শব্দ পড়তে পড়তে দীপঙ্করের শরীর শীতল হয়ে উঠলো, কারণ বোঝা যাচ্ছিল এই কূপ সাধারণ কোনো জলধারার উৎস নয়, বরং বহু বছর ধরে তন্ত্রসাধনার কেন্দ্রস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। গ্রন্থগুলোতে আরও উল্লেখ আছে, রাতের আঁধারে নির্দিষ্ট তিথিতে সাধকরা এখানে জমায়েত হতো, তাদের মন্ত্র উচ্চারণে নাকি অদ্ভুত কম্পন ছড়িয়ে পড়তো পুরো গ্রাম জুড়ে। সেই সময় গ্রামবাসীরা ভয়ে বাড়ির বাইরে পা রাখতো না, আর যারা সাহস করে জানালার ফাঁক দিয়ে তাকাতো, তারা বলতো কূপের ভেতর থেকে যেন নীলাভ আগুনের শিখা বেরিয়ে আসছে।
পুঁথির ভেতর আরও গভীরে গেলে দীপঙ্কর জানতে পারলেন যে এই কূপ আসলে কোনো দৈবিক বা পবিত্র উৎস থেকে তৈরি নয়, বরং এটি তৈরি করেছিলেন এক অজ্ঞাত তান্ত্রিক সম্প্রদায়। তাদের নাম ইতিহাসে স্পষ্টভাবে মুছে দেওয়া হলেও ইঙ্গিত মেলে তারা ছিল ‘কালোচণ্ডী সাধক’ নামের একটি দল, যারা মূলত রাতের আঁধারে রক্তসাধনা করতো। বলা হয়েছে, তারা বিশ্বাস করতো পৃথিবীর গহীনে বাস করা শক্তিগুলোকে আহ্বান করে মানুষের ভাগ্য, মৃত্যু আর পুনর্জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এজন্য তারা এই কূপের চারপাশে বিভিন্ন প্রতীক আঁকতো, কালো সুতোর গিঁট বেঁধে ঝুলিয়ে রাখতো এবং প্রতিটি সাধনার শেষে কূপের জলে রক্ত অর্পণ করতো। এক পর্যায়ে নাকি এরা এতটাই ক্ষমতালোভী হয়ে ওঠে যে, গ্রামবাসীদের অশান্তি এবং রাজার নিষেধাজ্ঞার পরও গোপনে সাধনা চালিয়ে যায়। গ্রামের কিছু কিংবদন্তিতে শোনা যায়, একবার এক সাধক গভীর মন্ত্রোচ্চারণের সময় হঠাৎ কূপের ভেতর তলিয়ে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। লোকেরা বিশ্বাস করেছিল, কূপের নিচে অদৃশ্য কোনো অশুভ শক্তি সক্রিয়, যে নিয়মিত আত্মাহুতি চায়। এই সব বর্ণনা পড়ে দীপঙ্করের কপালে ঘাম জমলো। একদিকে তিনি বিস্মিত, অন্যদিকে ভয়ের শিহরণ বয়ে গেল শরীর জুড়ে। ইতিহাস শুধু অতীতের কথা বলে না, মাঝে মাঝে বর্তমানের ভয়াবহতারও সূত্র দেয়—এমনটাই তিনি অনুভব করছিলেন।
দীপঙ্করের চোখে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে তথ্য ধরা দিল, তা হলো একটি গোপন সূত্র। পুঁথিতে উল্লেখ আছে, এই কূপের শক্তি নাকি আজও সক্রিয় এবং প্রতি একশো বছরে একবার তা পুনর্জীবিত হয়। তখন কূপ থেকে রহস্যময় আলো, অদ্ভুত শব্দ এবং আকস্মিক নিখোঁজ হওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে থাকে। শেষবার এই পুনর্জাগরণ ঘটেছিল উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, যখন নাকি গ্রামের কয়েকজন যুবক হঠাৎ করেই হারিয়ে যায়। তারপর থেকে এই কূপ বন্ধ করে দেওয়া হয়, উপরে লোহার শিকল দিয়ে আটকানো হয়েছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই বাঁধন দুর্বল হয়ে গেছে। পুঁথির শেষে সতর্কবার্তাও লেখা ছিল—“যে এই কূপের দ্বার খোলে, সে মৃত্যুর আহ্বান জানায়।” দীপঙ্কর বইটি হাত থেকে নামাতে পারছিলেন না। বাইরের গোধূলির আলো ঘরে ঢুকছিল, ধুলোয় ভরা বাতাসে জমে ছিল ভুতুড়ে নীরবতা। তিনি বুঝলেন, গ্রামবাসীদের কথিত অদ্ভুত গন্ধ, মন্ত্রপাঠ আর নিখোঁজ হওয়ার পেছনে আসলে বহু শতাব্দীর গোপন ইতিহাস জড়িয়ে আছে। এখন প্রশ্ন হলো—কেউ কি ইচ্ছাকৃতভাবে আবার এই কূপকে সক্রিয় করেছে? আর যদি তা-ই হয়, তবে তার উদ্দেশ্য কী? চিন্তাগুলো দীপঙ্করের মনে ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘুরতে লাগলো, আর তিনি অনুভব করলেন, সামনে হয়তো এমন এক সত্য উদঘাটন অপেক্ষা করছে, যা শুধু ইতিহাস নয়, বর্তমানকেও রক্তাক্ত করে তুলতে পারে।
***
সেই রাতটা যেন অন্যরকম ছিল। আকাশ জুড়ে মেঘের আস্তরণ, চাঁদের আলো যেন হঠাৎ কোথাও গিলে গেছে, আর চারপাশের গ্রাম নিস্তব্ধ। দীপঙ্কর ও রিয়া দুজনেই প্রস্তুত ছিল—নোটবুক, টর্চ আর ক্যামেরা নিয়ে তারা কালী মন্দিরের পথ ধরে এগোলো। পথটা ছিল আঁকাবাঁকা, কাদা মাখানো, দু’পাশে বিশাল অশ্বত্থ আর বটগাছ দাঁড়িয়ে ছিল নিঃশব্দ প্রহরীর মতো। হাওয়া বইছিল না, অথচ পাতাগুলো কাঁপছিল যেন অদৃশ্য কারও উপস্থিতিতে। তারা কূপের কাছে পৌঁছাতেই বুঝল বাতাসের ঘনত্ব বেড়ে গেছে, নিশ্বাস নেওয়াটাও কঠিন হয়ে উঠছে। দীপঙ্কর ফিসফিস করে বলল, “রিয়া, আজ রাতটা অন্য রকম লাগছে।” রিয়া মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, কিন্তু চোখ তখন ক্যামেরার লেন্সে। হঠাৎ করে কূপের ভেতর থেকে ভেসে এলো গুঞ্জনের মতো শব্দ—মন্ত্রপাঠের মতো, যদিও কোনো ভাষায় তা স্পষ্ট নয়। কণ্ঠগুলো যেন একসাথে অনেকগুলো মানুষ ফিসফিস করছে, আবার মুহূর্তে নিস্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। দু’জনেই দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। এরই মধ্যে মন্দিরের ঘণ্টা একবার বেজে উঠল, অথচ মন্দির তখন খালি।
তারপরই ঘটলো অদ্ভুত ঘটনা। কূপের অন্ধকার জল থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো এক ছায়ামূর্তি। প্রথমে ঝাপসা, যেন কুয়াশার দল, কিন্তু ধীরে ধীরে তা আকার নিতে লাগল। অস্বাভাবিক লম্বা দেহ, হাত-পা যেন মানুষের মতো হলেও অদ্ভুত বেঁকে গেছে, আর চোখের জায়গায় শুধু জ্বলজ্বলে ফাঁপা গর্ত। দীপঙ্কর বুক ধড়ফড় করতে লাগলো, অথচ দৃষ্টি সরাতে পারল না। রিয়ার হাত কাঁপছিল, তবু সে ক্যামেরায় দৃশ্যটা ধরার চেষ্টা করল। ফ্ল্যাশের আলো ছায়াটিকে মুহূর্তের জন্য স্পষ্ট করল, আর তখনই বোঝা গেল—এটা নিছক কোনো আলো-আঁধারির খেলা নয়। ছায়াটির দেহ থেকে ঘন অন্ধকার ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে পড়ছিল, যা চারপাশের গাছপালাকে ঢেকে দিচ্ছিল। সেই মুহূর্তে রিয়া এক তীব্র ঠান্ডা অনুভব করল, যেন বরফের স্রোত তার শরীর ভেদ করে যাচ্ছে। ছায়ামূর্তিটি তাদের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো, আর প্রতিটি পদক্ষেপে মাটি যেন কেঁপে উঠছিল। দীপঙ্কর সাহস করে টর্চের আলো ফেলতেই আলো ম্লান হয়ে গেল, যেন আলোও এই সত্তার সামনে নিস্তেজ। রিয়া আতঙ্কিত গলায় বলল, “এটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়… এটা জীবিত নয়, অথচ বেঁচে আছে!”
হঠাৎ ছায়াটি ভয়ঙ্কর শব্দ করে উঠল—কোনো মানুষের গলা নয়, বরং অদ্ভুত গর্জনের মতো। শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠল, আর কূপের জল যেন একসাথে উথলে উঠল। দীপঙ্কর বুঝল তারা এখন এক অশুভ শক্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছে, যার উদ্দেশ্য তাদের ভয় দেখানো নয়, বরং তাড়িয়ে দেওয়া। ছায়াটি হাত তুলতেই হিমেল বাতাসের ঝড় বয়ে গেল, দুজনেই প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। সেই মুহূর্তে রিয়া চিৎকার করে উঠল, “দীপঙ্কর, আমাদের এখান থেকে বেরোতে হবে!” কিন্তু দীপঙ্করের চোখ তখনও কূপের দেওয়ালে খোদাই করা প্রতীকের দিকে। ছায়ার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে প্রতীকগুলো অদ্ভুত আলোতে জ্বলে উঠছে—লালচে, রক্তের মতো। মনে হচ্ছিল কূপের ভেতর থেকে কোনো শক্তি বেরিয়ে এসে ছায়াটিকে জীবন্ত করেছে। দীপঙ্কর দ্রুত রিয়ার হাত ধরে টেনে নিল, আর দু’জনেই দৌড়ে দূরে সরে গেল। কিন্তু যাওয়ার আগে দীপঙ্কর স্পষ্ট দেখল, ছায়াটি ধীরে ধীরে আবার কূপের ভেতরে মিলিয়ে যাচ্ছে, অথচ তার ফাঁপা চোখদুটো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। সেই দৃষ্টিতে ছিল ভয়, সতর্কবার্তা আর এক ধরনের অশুভ প্রতিশ্রুতি। কূপের চারপাশ আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল, কিন্তু তাদের দুজনের মনে স্থির হলো—এই ছায়া নিছক কল্পনা নয়, বরং বহু শতাব্দীর অশুভ শক্তির জাগ্রত রূপ, যার রহস্য ভেদ করা সহজ হবে না।
***
পরদিন ভোরে দীপঙ্কর আর রিয়ার চোখে ঘুম ছিল না। আগের রাতের অভিজ্ঞতা তাদের কাঁপিয়ে দিয়েছিল, তবু কৌতূহল আর সত্য জানার তাগিদ তাদের গ্রাস করেছিল। গ্রামের প্রাচীন মন্দিরের পণ্ডিত কুমারীশ্বর, যিনি সাধারণত গম্ভীর আর নীরব মানুষ হিসেবে পরিচিত, তাঁর কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল দীপঙ্কর। মন্দির তখন ভোরের আলোয় স্নান করছে, ধূপকাঠির গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে, অথচ পণ্ডিতের চেহারায় ছিল অস্বাভাবিক গাম্ভীর্য। দীপঙ্কর যখন কূপের রাতের ঘটনার বর্ণনা করল, পণ্ডিতের চোখে হঠাৎ ভয় আর দ্বিধার ছায়া ফুটে উঠল। দীর্ঘক্ষণ নীরব থাকার পর তিনি গভীর শ্বাস নিয়ে বললেন, “তুমি যা দেখেছো, তা মায়া নয়, সন্তান। এই কূপের মধ্যে এমন কিছু বন্দি রয়েছে, যা মানুষের চোখে ধরা দেওয়ার কথা নয়। তোমার সাহস আছে বলে দেখেছো।” রিয়া বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, আর দীপঙ্কর বুঝতে পারছিল—আজ হয়তো বহুদিন ধরে লুকিয়ে থাকা রহস্যের দরজা খুলে যাবে।
পণ্ডিত ধীরে ধীরে জানাতে শুরু করলেন গ্রামে বহু পুরনো এক ঘটনার কথা। অনেক বছর আগে, প্রায় দেড় শতাব্দী পেরিয়ে গেছে, গ্রামে একদল তন্ত্রসাধক এসে বসতি গড়ে তোলে। তারা দাবি করত, তারা দেবীর উপাসক, কিন্তু আসলে তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। এই কূপ তারা বানায়, শুধু জল সংগ্রহের জন্য নয়, বরং এটিকে তারা বানায় শক্তির আসন—এক অদৃশ্য দরজা, যার ভেতর দিয়ে তারা অলৌকিক শক্তিকে আহ্বান করতে পারবে। সাধকরা বিশেষ রাতে, বিশেষ মন্ত্রোচ্চারণ আর রক্তবলি দিয়ে কূপকে সক্রিয় রাখত। গ্রামের মানুষ ভয়ে কিছু বলতে পারত না, কারণ সাধকদের মধ্যে একজন ছিল প্রবল প্রভাবশালী—তাকে সবাই ‘অঘোরী শিবানন্দ’ নামে চিনত। শোনা যায়, এই শিবানন্দই প্রথম কূপের ভেতর থেকে অদ্ভুত ছায়াটিকে জাগিয়ে তোলে, যা আসলে এক অভিশপ্ত আত্মা। পণ্ডিতের কণ্ঠ গাঢ় হয়ে উঠল, “এই আত্মা কোনো সাধারণ ভূত নয়। এটি আসলে এক পুরোনো তান্ত্রিক, যাকে বহু বছর আগে গ্রামের মানুষ জীবন্ত অবস্থায় কূপের ভেতরে ফেলে দিয়েছিল। তার ক্রোধ আর অপূর্ণ সাধনার শক্তি মিলেই তাকে অশুভ রূপে পুনর্জন্ম দিয়েছে।” দীপঙ্কর শুনে শিউরে উঠল। সে ভাবত কূপের রহস্য শুধু অতীতের কোনো তান্ত্রিক আচার, কিন্তু এখন স্পষ্ট হলো, এর ভেতর আছে জীবন্ত অভিশাপ, যা এখনও সক্রিয়।
রিয়া ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে আমাদের সামনে যে ছায়াটিকে দেখেছি… সেটা কি ওই অভিশপ্ত আত্মা?” পণ্ডিত চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়লেন। তারপর তিনি বললেন, “হ্যাঁ, তবে তার আসল শক্তি এখনো প্রকাশ পায়নি। তুমি যা দেখেছো, তা কেবল এক আভাস। তন্ত্রসাধকেরা বিশ্বাস করত, যদি সেই আত্মার শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তবে অমরত্ব পর্যন্ত লাভ সম্ভব। কিন্তু কোনো মানুষ এই শক্তিকে ধারণ করতে পারবে না, কারণ এটি শুধু ধ্বংস ডেকে আনে।” এরপর তিনি এক ভয়ঙ্কর সত্য জানালেন—প্রতি একশো বছরে একবার এই কূপের শক্তি পূর্ণ জাগ্রত হয়, আর তখন গ্রামে ঘটে অদ্ভুত সব ঘটনা—মানুষ হারিয়ে যায়, পশুপাখি মারা যায়, আর বাতাসে ভেসে আসে রক্তের গন্ধ। শেষবার এই ঘটনা ঘটেছিল উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, যখন কয়েকজন তরুণ গ্রামবাসী হঠাৎ নিখোঁজ হয়েছিল। গ্রামের প্রবীণরা মিলে তখন কূপকে লোহার শিকল দিয়ে বন্ধ করে রাখে, কিন্তু সেই বাঁধন সময়ের সাথে দুর্বল হয়েছে। দীপঙ্কর গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল, আর তার মনে হচ্ছিল—এবার ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে।
পণ্ডিত হঠাৎ খুব নিচু গলায় বললেন, “তুমি যদি সত্যিই এই রহস্য উদ্ঘাটন করতে চাও, তবে সাবধান। কূপে যা আছে, তা মানুষকে কেবল ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। তবে একটা উপায় আছে—গ্রামের এক প্রাচীন মন্ত্র, যা এই অশুভ শক্তিকে পুনরায় বন্দি করতে সক্ষম। কিন্তু সেই মন্ত্র জানে কেবল আমার পরিবার, আর তা উচ্চারণ করলেই সাধকদের আত্মা ক্রুদ্ধ হয়ে উঠবে।” দীপঙ্করের চোখে দৃঢ়তার ঝলক ফুটে উঠল। সে জানত, এ রহস্য উন্মোচন না করলে গ্রামে আরও বিপদ নেমে আসবে। পণ্ডিত শেষবারের মতো বললেন, “এই কূপ কেবল জল নয়, এটি অভিশপ্ত আত্মার দরজা। আর মনে রেখো, দরজা একবার খুললে, তা বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব।” এই সতর্কবাণী শুনে রিয়া আর দীপঙ্কর দুজনেই স্তব্ধ হয়ে গেল। তারা বুঝল, কূপের ভেতরে যা আছে, তা শুধু ইতিহাস নয়, বরং বর্তমানের সবচেয়ে বড় ভয়ঙ্কর বিপদ—এক অশুভ শক্তি, যার সঙ্গে তাদের সরাসরি লড়াই অবশ্যম্ভাবী।
***
রাতের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা আর পণ্ডিত কুমারীশ্বরের কথাগুলো দীপঙ্কর ও রিয়ার মনে অদ্ভুত এক অস্থিরতা তৈরি করেছিল। তারা বুঝতে পারছিল, কূপের রহস্য কেবল পুরনো তান্ত্রিক আচার বা কুসংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর পেছনে আছে আরও গভীর ষড়যন্ত্র। তাই তারা পরদিন সকালে আবার কূপের আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করতে গেল। সূর্যের আলোয় কূপটা দেখতে শান্ত ও নিরীহ লাগছিল, যেন আগের রাতের অশুভ ছায়াগুলো নিছক স্বপ্ন। কিন্তু কাছাকাছি গেলে তারা খেয়াল করল—কূপের পাথরের দেওয়ালে অদ্ভুত কিছু দাগ খোদাই করা আছে, যা তারা আগে খেয়াল করেনি। দীপঙ্কর সাবধানে হাত বুলিয়ে দেখল, আর বুঝতে পারল এগুলো সাম্প্রতিক সময়ে খোঁদাই করা হয়েছে, প্রাচীন নয়। প্রতীকগুলো দেখতে অনেকটা তান্ত্রিক চিহ্নের মতো হলেও, ভেতরে লুকিয়ে আছে আধুনিক কৌশল। এর মানে কেউ এখনো সক্রিয়ভাবে এই কূপকে ব্যবহার করছে। রিয়া ক্যামেরায় সব ছবি তুলল, আর দু’জনেই অবাক হয়ে ভাবতে লাগল—কে এমন কাজ করছে? গ্রামে কি এখনো কেউ আছে, যারা তন্ত্র সাধকের উত্তরসূরি, অথবা তাদের মিশনে জড়িত?
বিকেলের দিকে তারা গ্রামে ফিরে এসে কয়েকজন প্রবীণ ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলল। অনেকে ভয়ে মুখ খুলতে চাইছিল না, কিন্তু একজন বৃদ্ধ কৃষক সাহস করে বললেন, “সবাই ভাবে ওসব পুরনো কথা, কিন্তু আসলে তা নয়। আজও কিছু লোক রাতে এখানে গোপনে মন্ত্রপাঠ করে। আমরা দেখেছি, মাঝেমধ্যেই গ্রামের দু-একজন প্রভাবশালী মানুষ কূপের দিকে যায়।” দীপঙ্কর ও রিয়া অবাক হয়ে শুনল। তারা নাম জানতে চাইলে কৃষক ভয় পেয়ে মুখ বন্ধ করে ফেলল। তবে পরে আরেকজন মহিলা ফিসফিস করে জানালেন, গ্রামের মহন্ত হরিদাস, জমিদারের নাতি বিশ্বজিৎ, আর কিছু রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি প্রায়ই কূপের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে। দীপঙ্করের মনে তৎক্ষণাৎ সন্দেহ জাগল—এরা হয়তো কূপের শক্তিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইছে। রিয়া যুক্তি করল, “যদি সত্যিই ষড়যন্ত্র থাকে, তবে এর উদ্দেশ্য একটাই—অশুভ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা অর্জন।” তখনই দীপঙ্করের মনে পড়ল পণ্ডিত কুমারীশ্বরের সতর্কবাণী—এই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেই বিপদ নেমে আসবে। তারা বুঝল, ষড়যন্ত্রের ছায়া ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে।
সেই রাতে দীপঙ্কর আর রিয়া লুকিয়ে কূপের কাছে অবস্থান নিল। ঘড়িতে তখন প্রায় মধ্যরাত, চারপাশে শ্মশানঘাটের মতো নীরবতা। হঠাৎই তারা লক্ষ্য করল, তিন-চারজন মানুষ কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা অবস্থায় কূপের কাছে এলো। তাদের মধ্যে একজনের হাতে ছিল তেলের প্রদীপ, আর অন্যজনের হাতে একগাদা লাল ফুল ও ধূপকাঠি। দীপঙ্কর শ্বাস বন্ধ করে দেখছিল—তারা কূপের চারপাশে চক দিয়ে প্রতীক আঁকছে, আর মন্ত্রপাঠ করছে। আলোতে রিয়া ফিসফিস করে চিনে ফেলল, “ওই লোকটা… ও তো জমিদারের নাতি বিশ্বজিৎ!” দীপঙ্কর অবাক হয়ে তাকাল। তারা আরও খেয়াল করল, মহন্ত হরিদাসও সেই দলে আছে। মুহূর্তেই তাদের সন্দেহ নিশ্চিত হলো—ষড়যন্ত্রটা আসলেই গ্রামের ভেতরকার প্রভাবশালী মানুষদের দ্বারা পরিচালিত। তারা শুধু পুরনো কাহিনির উত্তরসূরি নয়, বরং নতুন প্রজন্মের তান্ত্রিক শক্তির লালসায় মগ্ন। কূপের চারপাশে মন্ত্রপাঠ শুরু হতেই বাতাস ভারী হয়ে উঠল, আবারও কূপের গভীর থেকে গুঞ্জনের শব্দ উঠতে লাগল। দীপঙ্কর ও রিয়া আতঙ্কে একে অপরের হাত শক্ত করে ধরল। তারা জানল, এ ষড়যন্ত্র আর শুধু গুজব নয়—এখন তা ভয়ঙ্কর বাস্তব, আর তাদের সামনে আসল সত্য উন্মোচনের লড়াই শুরু হয়ে গেছে।
***
দীপঙ্কর ও রিয়া বহু রাত ধরে কূপের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে তথ্য জোগাড় করছিল। গ্রামের লোকেরা তাদের সাবধান করেছিল—“কূপের রহস্যের কাছে যেও না, ওখানেই বহু প্রাণ হারিয়েছে।” কিন্তু দু’জনের কৌতূহল এবং সত্য উদঘাটনের সংকল্প তাদের পিছিয়ে যেতে দেয়নি। অষ্টমীর রাতে তারা আবার কূপের ধারে হাজির হয়। চারপাশে ছিল ঘন অন্ধকার, শুধু জোনাকির আলো টুকরো টুকরো আলোকবিন্দুর মতো ছড়িয়ে ছিল। দীপঙ্করের হাতে ছিল টর্চলাইট, আর রিয়া নোটবই আঁকড়ে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ কূপের ভেতর থেকে ভেসে এল অদ্ভুত গুঞ্জন, যেন অসংখ্য মানুষ একসঙ্গে ফিসফিস করছে। তারা কান খাড়া করল—মনে হচ্ছিল কণ্ঠস্বরগুলো অনুনয় করছে, আবার কোনোটা ভয়ঙ্কর হুমকি দিচ্ছে। রিয়া আতঙ্কিত চোখে দীপঙ্করের হাত চেপে ধরল। মুহূর্তের মধ্যেই টর্চলাইট নিভে গেল। অন্ধকারে যেন আরও গাঢ় হলো সেই গুঞ্জন, কূপের জল যেন অস্থিরভাবে ছলাৎছল শব্দ করে উঠল। তখনই হঠাৎ এক অদৃশ্য ছায়া ঝড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের ওপর। দীপঙ্করকে মনে হলো কেউ তাকে টেনে নিচে নামিয়ে দিতে চাইছে, আর রিয়াকে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে। প্রাণপণ লড়াই করে দীপঙ্কর তার হাত রিয়ার হাতে শক্ত করে গেঁথে দিল, যেন দু’জন একসাথে থাকলে অন্তত টিকে থাকতে পারবে।
গ্রামের ভেতরে তখন আতঙ্কের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে। কিছু লোক বলছিল তারা দূর থেকে দেখেছে কূপের ধারে আলোকবৃত্তের মতো কিছু একটা ঘুরছে, আবার কারও মতে মানুষের চিৎকার শোনা গেছে। অশুভ ছায়া যেন এবার প্রকাশ্যে তাদের চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। দীপঙ্কর ও রিয়ার শরীর ভারী হয়ে আসছিল, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, যেন অদৃশ্য হাত গলা চেপে ধরেছে। সেই মুহূর্তে দীপঙ্কর হঠাৎ মনে করল পুরনো গ্রন্থে পড়া কিছু মন্ত্রের কথা, যা অশুভ শক্তিকে কিছুটা দূরে সরাতে পারে। কাঁপতে কাঁপতে সে মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করল। আশ্চর্যজনকভাবে কণ্ঠস্বর থমকে গেল, কূপের জল শান্ত হলো, আর ছায়াগুলো একটু দূরে সরে দাঁড়াল। রিয়া চোখ মেলে দেখল, চারপাশে যেন অন্ধকারের ভেতর অসংখ্য রক্তচোখ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। দু’জন বুঝল, তারা এখানে বেশিক্ষণ থাকলে আর ফিরে যেতে পারবে না। তাই সুযোগ বুঝে দৌড়ে গ্রামমুখী পথে ছুটল। পিছন থেকে আবারও শোনা গেল সেই গর্জনমিশ্রিত ফিসফিসানি—যেন অশুভ শক্তি প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করছে।
গ্রামে ফিরে দু’জনের অবস্থা দেখে সবাই ভয় পেয়ে গেল। তাদের পোশাক ছিঁড়ে গেছে, শরীরে আঁচড়ের দাগ, আর চোখদুটো ভয়ে উন্মাদ মানুষের মতো। বৃদ্ধারা কাঁপতে কাঁপতে বলল—“ওই শক্তি জাগিয়ে তুলেছ, এখন আর পিছু হটার পথ নেই।” গ্রামের পুরোহিতও এসে জানালেন, কূপের অভিশাপ অনেক পুরনো, আর সেই অশুভ আত্মারা কাউকে সহজে বাঁচতে দেবে না। কিন্তু দীপঙ্কর, যতই আতঙ্কিত হোক, হাল ছাড়ল না। সে জানাল, সত্য প্রকাশ না করলে গ্রামকে রক্ষা করা যাবে না। তবে আপাতত তাদের কৌশল পাল্টাতে হবে, কারণ সরাসরি কূপের রহস্য খোঁজার চেষ্টা এখন আত্মঘাতী। রিয়া তখনও ভয়ে কাঁপছিল, কিন্তু দীপঙ্করের দৃঢ় কণ্ঠ তাকে সামান্য সাহস দিল। রাতটা গ্রামে ভয় আর অনিশ্চয়তায় কেটে গেল। প্রত্যেকে জানত, কূপের রহস্য উন্মোচনের পথ যত এগোচ্ছে, ততই মৃত্যু আর অন্ধকার আরও কাছে চলে আসছে। তবুও দীপঙ্কর ও রিয়া সিদ্ধান্ত নিল—অস্থায়ীভাবে পিছু হটলেও, একদিন এই রহস্যের চূড়ান্ত সমাধান তারা করবেই। কিন্তু সেই রাত থেকেই তারা বুঝতে পারল, অশুভ ছায়া আর শুধু কূপে সীমাবদ্ধ নেই—এখন তা তাদের চারপাশে সর্বক্ষণ ঘিরে আছে।
***
অতীতের ভয়াবহ রাতের অভিজ্ঞতা দীপঙ্কর ও রিয়াকে একদিকে আতঙ্কিত করেছিল, অন্যদিকে তাদের সত্য উদঘাটনের সংকল্প আরও দৃঢ় করেছিল। বারবার কূপের ধারে অশুভ ছায়ার দেখা পাওয়ার পর দীপঙ্কর ভাবছিল, এর মূল রহস্য কোথাও গভীরে লুকিয়ে আছে। দিনের বেলা কূপ একেবারেই নিরীহ ও শান্ত মনে হলেও রাত নামলেই এর ভেতর থেকে রহস্যময় গুঞ্জন ও ছায়ার জন্ম হচ্ছে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই সে পুরনো গ্রন্থ, পুঁথি এবং মানচিত্র নিয়ে পড়াশোনা শুরু করে। রিয়া তাকে সাহায্য করছিল প্রতিটি তথ্য নথিভুক্ত করতে। তখনই তারা আবিষ্কার করে এক অদ্ভুত তথ্য—কূপটি আসলে সরল কোনো পানীয় জলসংগ্রহের জায়গা নয়, বরং এর নিচে একটি গোপন চেম্বার রয়েছে। কয়েক শতাব্দী আগে তান্ত্রিক সাধকেরা সেই চেম্বার ব্যবহার করত শক্তি আহরণের জন্য। চেম্বারের দেয়ালে নাকি এমন কিছু প্রতীক খোদাই করা আছে, যা এখনো অশুভ শক্তিকে সক্রিয় করে রাখে। দীপঙ্কর বুঝল, সেই শক্তির প্রতিফলনই ছায়া আকারে প্রকাশ পায়। একথা মাথায় আসতেই তার মনে পড়ল কূপের ভেতরে অদ্ভুত প্রতীক ও শব্দের কথা, যা তারা প্রথম তদন্তে খুঁজে পেয়েছিল। ধীরে ধীরে সবকিছু জোড়া লাগতে লাগল।
তবে এই গোপন তথ্য তারা নিজেরাই পুরোপুরি উন্মোচন করতে পারল না। তাই তারা আবার আশ্রয় নিল পণ্ডিত কুমারীশ্বরের কাছে। পণ্ডিত প্রথমে খুব দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, কারণ তিনি জানতেন, এই সত্য প্রকাশ মানেই নিজের জন্য বিপদ ডেকে আনা। কিন্তু দীপঙ্কর ও রিয়ার দৃঢ়তা দেখে তিনি নরম হলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, “হ্যাঁ, কূপের নিচে একটি চেম্বার আছে। বহু বছর আগে আমার পূর্বপুরুষরা সেখানে গিয়ে কিছু অংশ সিল করে দেন, যাতে তান্ত্রিক শক্তি বেরোতে না পারে। কিন্তু সেই সিল অনেকটা ভেঙে গেছে। তাই আবার অশুভ শক্তি ছায়া হয়ে উপরে উঠছে। আর এই শক্তিকে গ্রামের কয়েকজন প্রভাবশালী মানুষ তাদের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে।” পণ্ডিত জানালেন, চেম্বারে নামার পথ অত্যন্ত বিপজ্জনক, তবে সত্য জানার জন্য তাদের সেখানে নামতেই হবে। রিয়া প্রথমে আতঙ্কিত হলেও দীপঙ্করের অটল দৃষ্টিতে সাহস খুঁজে পেল। রাতের অন্ধকারে নয়, বরং ভোরের আলো ফোটার আগে তারা পণ্ডিতকে নিয়ে কূপের ধারে গেল। দড়ি বেঁধে তারা ধীরে ধীরে কূপের গভীরে নামতে লাগল। ঠান্ডা, ভ্যাপসা বাতাস আর অদ্ভুত গন্ধ চারপাশ ঘিরে ফেলেছিল। টর্চের আলোয় তারা দেখতে পেল এক লুকানো ফাঁক, যেখান দিয়ে চেম্বারে প্রবেশ করা যায়।
চেম্বারে ঢুকেই তারা স্তব্ধ হয়ে গেল। অদ্ভুত নকশা ও প্রতীক চার দেয়ালে খোদাই করা, লালচে কালিতে লেখা কিছু মন্ত্র, আর মাঝখানে এক ভগ্ন মূর্তি, যেটি কালী দেবীর রূপে নির্মিত হলেও বিকৃতভাবে মন্ত্রে আচ্ছন্ন। সেই প্রতীক ও মূর্তির আভা থেকেই ছায়ার জন্ম হচ্ছিল। দীপঙ্কর বুঝল, এটি কোনো অলৌকিক ভূতের কাজ নয়, বরং বহু বছরের তান্ত্রিক প্রভাব, অভিশাপ ও মানসিক আতঙ্কের সম্মিলিত রূপ। পণ্ডিত কুমারীশ্বর হাত জোড় করে বললেন, “এই চেম্বারের শক্তিকে শুদ্ধ করতে হবে, না হলে এটি গ্রামকে ধ্বংস করবে।” তারা খেয়াল করল, দেয়ালের ভেতরে কিছু গোপন খোপ আছে, যেখানে পুরনো সময়ের তান্ত্রিকদের ব্যবহৃত নানা দ্রব্য রাখা। রিয়া ছবি তুলতে চাইলে দীপঙ্কর থামিয়ে দিল—“এটা গবেষণার বিষয় নয়, এখন জরুরি হলো এটিকে নিরস্ত করা।” পণ্ডিত একটি প্রাচীন মন্ত্র জপ করতে লাগলেন, যার সঙ্গে সঙ্গেই চেম্বারের ভেতর অদ্ভুত কাঁপুনি শুরু হলো। যেন অশুভ শক্তি প্রতিরোধ করতে চাইছে। ছায়াগুলো চোখের সামনে নড়াচড়া করতে লাগল, কখনো মানুষের অবয়ব, কখনো বিকৃত মুখ। কিন্তু দীপঙ্কর আর রিয়া এবার ভয় পেল না, তারা জানত সত্যের কাছে পৌঁছেছে। অবশেষে পণ্ডিতের মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে চেম্বারের ভেতরের বাতাস ভারী হয়ে আবার ধীরে ধীরে শান্ত হলো। দীপঙ্কর অনুভব করল, শতাব্দীর রহস্য অবশেষে তাদের চোখের সামনে উন্মোচিত হয়েছে—অশুভ ছায়া আর ভূত নয়, বরং এক অভিশপ্ত ইতিহাসের অবশেষ, যা তান্ত্রিক শক্তির প্রভাবে সৃষ্টি হয়েছিল। তারা যখন চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল, ভোরের আলো ফুটে উঠছিল। দীপঙ্করের মনে হলো, অন্ধকার ভেদ করে অবশেষে সত্যের আলোয় পা রাখল তারা। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে সব শেষ—বরং এখনই শুরু হলো গ্রামের মুক্তির যুদ্ধ।
***
ভোরের প্রথম আলো যখন গ্রামের আকাশ ছুঁয়ে দিল, তখন কালী মন্দিরের পাশের সেই অভিশপ্ত কূপ যেন নতুন রূপে জেগে উঠল। দীর্ঘ রাতের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার পর দীপঙ্কর, রিয়া ও পণ্ডিত কুমারীশ্বর একসাথে উঠে এলেন কূপের গোপন চেম্বার থেকে। চারপাশে পাখিদের কিচিরমিচির, সকালের আলোয় জোনাকিদের মিলিয়ে যাওয়া—সবকিছু যেন নতুন সূচনার প্রতীক হয়ে দাঁড়াল। গ্রামের মানুষরা দূর থেকে উদ্বিগ্ন চোখে অপেক্ষা করছিল, কারণ আগের রাতের অদ্ভুত আলো, ছায়া আর শব্দ তারা সবাই প্রত্যক্ষ করেছিল। যখন তিনজনকে জীবিত ও সুস্থ অবস্থায় কূপ থেকে বেরোতে দেখল, তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সবাই। দীপঙ্কর তাদের সামনে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় বলল, “অভিশাপ ভাঙা হয়েছে। এই কূপ আর কারও ক্ষতি করবে না।” কথা শুনে গ্রামবাসীরা আনন্দে কেঁদে ফেলল। দীর্ঘদিনের আতঙ্ক যেন তাদের বুক থেকে সরে গিয়ে নতুন আশার আলো জ্বালিয়ে দিল। সেই মুহূর্তে কালী মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি বাজল, যেন দেবী নিজে আশীর্বাদ দিলেন এই গ্রামকে।
দীপঙ্কর ও রিয়া কয়েকদিন ধরে কূপের চারপাশে পর্যবেক্ষণ চালাল। আর কোনো অশুভ ছায়া দেখা গেল না, রাতের বেলায় আর কোনো গুঞ্জন বা অদ্ভুত শব্দ শোনা গেল না। গ্রামের প্রবীণরা বললেন, “অনেক বছর পর এই কূপকে আবার পবিত্র মনে হচ্ছে।” পণ্ডিত কুমারীশ্বর প্রস্তাব দিলেন, কূপকে ঘিরে একটি প্রতিরক্ষামূলক আচার পালন করা হোক, যাতে ভবিষ্যতে কোনো তান্ত্রিক বা অসৎ শক্তি এটি ব্যবহার করতে না পারে। গ্রামবাসীরা একযোগে সেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করল। নারীরা ফুল দিয়ে কূপ সাজাল, পুরুষরা প্রদীপ জ্বালাল, আর শিশুরা খুশিতে কূপের চারপাশে খেলতে শুরু করল। বহুদিনের ভয় কাটিয়ে তারা বুঝল, এই কূপ শুধু অশুভের কেন্দ্র নয়, বরং তাদের গ্রাম্য ঐতিহ্যের অংশ, যাকে ভালোবাসা ও সম্মান দিয়ে রক্ষা করতে হবে। রিয়া সবকিছু নোট করছিল, ছবি তুলছিল, আর দীপঙ্কর তার গবেষণার খাতায় প্রতিটি ঘটনা লিখে রাখছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল এই সত্যকে শুধু গ্রামে সীমাবদ্ধ না রেখে বৃহত্তর জগতে প্রকাশ করা, যাতে মানুষ বুঝতে পারে কুসংস্কার, ভয় আর অন্ধকারের পেছনে লুকিয়ে থাকে ইতিহাস, মানুষের বিশ্বাস আর অতীতের অপব্যবহার।
অবশেষে দীপঙ্কর ও রিয়া তাদের গবেষণা শেষ করে গ্রামবাসীর হাতে সেই নথি তুলে দিল। গ্রামবাসীরা প্রথমবার বুঝতে পারল, কূপ তাদের পূর্বপুরুষদের আধ্যাত্মিক সাধনার নিদর্শন, যেটিকে বিকৃত করেছিল কিছু লোভী ও ক্ষমতালোভী মানুষ। এখন থেকে তারা কূপকে পবিত্র জলাধার হিসেবে ব্যবহার করবে এবং কোনো তান্ত্রিক সাধনা সেখানে চলতে দেবে না। গ্রামের তরুণরা মিলে কূপের চারপাশে সুরক্ষার ব্যবস্থা করল, যাতে বাইরে থেকে কেউ এসে অপব্যবহার করতে না পারে। কালী মন্দিরের সঙ্গে কূপের সম্পর্ক নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো—একটি ভয়ঙ্কর রহস্য থেকে মুক্তির প্রতীক হয়ে উঠল তা। গ্রামবাসীরা দীপঙ্কর ও রিয়াকে ধন্যবাদ জানাল, কারণ তাদের সাহস ও অধ্যবসায় ছাড়া এই রহস্য চিরকাল অন্ধকারে ঢাকা পড়ে থাকত। বিদায় নেওয়ার আগে দীপঙ্কর মৃদু হেসে বলল, “যে অন্ধকার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, তার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে আলোর বীজ। শুধু তাকে দেখতে শেখা দরকার।” রিয়া চোখে জল নিয়ে মাথা নাড়ল। গ্রাম আবার শান্ত হলো, রাত নামলেও আর কেউ ভয় পেল না। কালীকূপ আর অভিশাপের প্রতীক নয়, বরং ইতিহাস আর সাহসের গল্প হয়ে উঠল।
***