অরিন্দম লাহিড়ী
পর্ব ১: রেখার ভেতর লুকোনো মুখ
কলকাতার বর্ষার দিনগুলোর আলাদা একটা গন্ধ আছে। ভিজে মাটির সঙ্গে পুরোনো বইয়ের পাতা মিশে এক ধরনের স্যাঁতসেঁতে শ্বাস ছড়িয়ে দেয় শহরের অলিগলিতে। আড্ডাতলার সেই ভাঙাচোরা চায়ের দোকানটার সামনে বৃষ্টির ফোঁটা তিরতির করে ঝরছিল টিনের চাল থেকে। দোকানটা শহরের পুরোনো সাংবাদিক, লেখক, চিত্রশিল্পীদের এক অদ্ভুত আড্ডাখানা। সেই দোকানের কোণের টেবিলে বসেছিল অরিজিৎ সেন—চল্লিশের কোটায় পৌঁছে যাওয়া এক কার্টুনিস্ট। তার চুলগুলো কিছুটা অগোছালো, চোখের নিচে কালো দাগ, আঙুলে শুকিয়ে যাওয়া কালির ছোপ।
অরিজিৎ সেই দিন একটা নতুন কাজ আঁকছিল। কাগজে আঁকা মানুষগুলো তার কাছে শুধুই ব্যঙ্গাত্মক চরিত্র নয়, যেন তারা জীবন্ত হয়ে ওঠে। আজকের কাজ ছিল এক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের ছবি। অরিজিতের ব্যঙ্গচিত্রগুলো বহুবার বিতর্ক তুলেছে, তার আঁকায় রাজনৈতিক শ্লেষ এত ধারালো হয় যে অনেকেই তাকে ভয় পায়। আজকের ছবিটিতে লোকটার চওড়া মুখ, ছোট চোখ, আর নীচু হাসি। চোখ দুটোকে সে এমনভাবে এঁকেছিল যেন কাগজ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
অরিজিৎ আঁকা শেষ করে সিগারেট ধরাল। হঠাৎই তার মনে হল, ছবিটার চোখ যেন তাকে তাকিয়ে আছে। সে এক ঝটকায় খাতা বন্ধ করে ফেলল। মিনিট পাঁচেক পর আবার খাতা খুলতেই অবাক হয়ে গেল—পাতাটা ফাঁকা। কালির দাগ নেই, ছবির কোনো চিহ্ন নেই। কেবল এক ফ্যাকাশে রেখা, যেন কেউ ছবিটা মুছে দিয়েছে।
বাড়ি ফিরে অরিজিৎ ঘটনাটা ঝেড়ে ফেলতে চাইল। কিন্তু রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে শহরে অন্য খবরে গুঞ্জন উঠল। স্থানীয় এক সংবাদপত্র জানাল, ওই একই রাজনীতিবিদকে রাত আটটার সময় অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তি ফোন করে হুমকি দিয়েছে। ফোনের ভাষা ছিল অদ্ভুতভাবে অরিজিতের কার্টুনে লেখা ক্যাপশনের মতো। খবর শুনে অরিজিতের হাত ঠান্ডা হয়ে গেল। কাকতাল? নাকি ছবির মধ্যেই কোনো অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে?
পরদিন দুপুরে নিজের স্টুডিওতে বসে অরিজিৎ পরীক্ষার মতো করে আরও কয়েকটা ছবি আঁকল। এক ব্যবসায়ীর মোটা শরীর, এক পুলিশ অফিসারের গম্ভীর মুখ, আর রাস্তার এক ভিখিরির নুয়ে পড়া কাঁধ। প্রতিটি মুখের চোখ সে গভীর মনোযোগ দিয়ে এঁকেছিল। আর প্রতিটি আঁকায় সেই একই অস্বস্তি ফিরে এল—চোখগুলো যেন জীবন্ত, যেন নড়ে উঠবে।
সন্ধ্যা নাগাদ খবর এলো—এক ব্যবসায়ীর অফিসে অগ্নিকাণ্ড, একজন পুলিশ অফিসার নিখোঁজ, আর শহরের এক ভিখিরি হঠাৎ উধাও। অরিজিৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। ঘটনাগুলো হুবহু তার আঁকার প্রতিচ্ছবি।
এবার সে বুঝল, এটা নিছক কাকতাল নয়। কিন্তু তাহলে কীভাবে সম্ভব? তার কলম কি হয়ে উঠছে অপরাধের অস্ত্র? নাকি কেউ তার আঁকা দেখে অপরাধ ঘটাচ্ছে? অরিজিতের মস্তিষ্কে প্রশ্নের পর প্রশ্ন ঘুরতে লাগল।
রাত গভীর হলো। জানলার বাইরে বৃষ্টি থেমে গিয়ে কেবল ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছিল কড়িকাঠ বেয়ে। অরিজিৎ তার ছোট্ট স্টুডিওর ভেতরে বসে নতুন খাতা খুলল। বুকের ভেতর ধুকপুকানি বাড়ছিল, কিন্তু কৌতূহল তাকে থামতে দিল না। কলমের নিবে কালো কালি ভরে সে আঁকতে শুরু করল এক নতুন মুখ।
ধীরে ধীরে চোখ, নাক, ঠোঁট ফুটে উঠল কাগজে। কিন্তু মুখটা যতই স্পষ্ট হচ্ছিল, অরিজিতের বুক ততই কেঁপে উঠছিল। কারণ ছবিটা কারও নয়—ওটা ছিল তার নিজের মুখ।
চোখদুটো গভীর কালো, ঠোঁটে এক অদ্ভুত শূন্য হাসি। ছবিটা যেন তাকে আয়নার মতো প্রতিফলিত করছে, কিন্তু বিকৃত, ভয়ঙ্করভাবে। হঠাৎ মনে হল, আঁকা মুখটা চোখ টিপল।
অরিজিৎ খাতা বন্ধ করে দিল, ঘর অন্ধকার করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুম তাকে ছুঁতে পারল না। বাইরের রাস্তার বাতি থেকে আসা হলুদ আলো জানলার ফাঁক দিয়ে তার টেবিলের ওপর পড়ছিল। সেই আলোয় মনে হচ্ছিল স্কেচবুকটা ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে।
তার মনে হল—আজকের রাতেই হয়তো কিছু একটা শুরু হলো, যা সে নিজেও থামাতে পারবে না।
পর্ব ২: অন্ধকারে আঁকা লাইন
সকালটা শুরু হয়েছিল অন্য সব দিনের মতোই। জানলার বাইরে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু বাতাসে এখনো ভেজা মাটির গন্ধ লেগে আছে। অরিজিৎ বিছানা থেকে উঠে খোলা স্কেচবুকটার দিকে তাকাল। আগের রাতে আঁকা ছবিটার কথা মনে পড়তেই তার বুকের ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে গেল। খাতা খুলে দেখল—পাতাটা এখনো ভরে আছে তার নিজের মুখ দিয়ে। চোখদুটো স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে, যেন রাতের ঘটনার পরেও ছবিটা জীবন্ত রয়ে গেছে।
সে তাড়াহুড়ো করে খাতা বন্ধ করল, মুখ ধোতে গেল। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে ভয় লাগছিল। কারণ ছবির সেই চোখ যেন তার নিজের চোখকেই বদলে দিয়েছে। নিজেকে অচেনা লাগছিল।
সকালের চা খেতে খেতে সে ঠিক করল খাতা আর তুলবে না। কিন্তু অদ্ভুত এক টান তাকে আবার টেবিলের দিকে ফিরিয়ে আনল। সে ভাবল, যদি সত্যিই এই ছবিগুলো অপরাধ ডেকে আনে, তবে তাকে খুঁজে বের করতে হবে এর উৎস। হয়তো সে কল্পনা করছে। হয়তো মানসিক চাপের কারণে সব ঘটছে।
সে খাতা খুলল, আরেকটা নতুন মুখ আঁকতে শুরু করল—এক অপরিচিত তরুণী। চুল কাঁধ অব্দি, মুখে একরকম শান্ত অভিব্যক্তি, কিন্তু চোখদুটো অদ্ভুত ফাঁকা। আঁকার পর তার ভেতর দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। মনে হচ্ছিল মেয়েটি শ্বাস নিচ্ছে, মুখ খুলে কিছু বলতে চাইছে।
ঠিক তখনই ফোন বেজে উঠল। নম্বর অচেনা। রিসিভ করতেই এক অচেনা নারীর কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল—
“দয়া করে আমার স্বামীর খুনের কার্টুন আঁকবেন না… আমি জানি আপনার আঁকা সত্যি হয়ে যায়।”
অরিজিৎ চমকে উঠল। সে উত্তর দিতে পারল না। লাইন কেটে গেল।
ঘটনাটা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল যখন দুপুরে খবরের কাগজে ছাপা হল—এক অজ্ঞাতপরিচয় তরুণীকে সাউদার্ন অ্যাভিনিউ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তার চেহারার বিবরণ পড়ে অরিজিৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। কারণ সেটা ছিল তার সকালের আঁকা ছবির প্রতিরূপ।
সে বুঝল, এখন আর পিছু হটার পথ নেই। কে এই মানুষগুলো যারা ছবির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে? কিভাবে তাদের খবর পৌঁছে যাচ্ছে তার কাছে?
অরিজিৎ সন্ধ্যায় আড্ডাতলার সেই চায়ের দোকানে গেল। বন্ধু জয়ন্ত, সাংবাদিক, সেখানে বসেছিল। অরিজিৎ তাকে সব খুলে বলতে চাইল কিন্তু আবার থেমে গেল। যদি ও ভেবে বসে পাগল হয়ে যাচ্ছে? তবে জয়ন্ত হঠাৎই মজার ছলে বলে উঠল—
“তোর কার্টুনগুলো নাকি এখন নাকি পুলিশের নজরে। কয়েকটা ঘটনা হুবহু মিলে যাচ্ছে। সাবধানে থাকিস।”
অরিজিতের গলায় শুকনো কফ আটকে গেল। পুলিশও খেয়াল করছে?
রাত নামল। বৃষ্টি আবার শুরু হল। বাড়ি ফেরার পর অরিজিৎ নিজেকে আটকাতে পারল না। সে আবার খাতা খুলল। এ বার সে এক রিকশাওয়ালার ছবি আঁকল। ক্লান্ত চোখ, পায়ের শিরা টানটান, মুখে অনন্ত পরিশ্রমের দাগ। ছবি আঁকার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে হঠাৎই কর্কশ ব্রেকের শব্দ শোনা গেল। সে জানলার কাছে দৌড়ে গেল—রাস্তার মোড়ে এক রিকশাওয়ালা ট্রাকের ধাক্কায় ছিটকে পড়েছে।
অরিজিৎ আতঙ্কে পিছিয়ে গেল। এইবার সন্দেহের আর জায়গা রইল না। তার আঁকা সত্যিই বাস্তব হয়ে যাচ্ছে।
ভয়ে সে স্কেচবুক ছিঁড়ে ফেলতে চাইল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, পাতা ছিঁড়লেই কালি গায়েব হয়ে যাচ্ছে, পাতাটা আবার ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি ছবিগুলোকে মুছে দিচ্ছে, কিন্তু ঘটনার প্রমাণ রেখে যাচ্ছে বাইরে।
রাত বাড়তে লাগল। হঠাৎই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ এল। প্রথমে ভেবেছিল ভুল শুনছে। কিন্তু আওয়াজ আবার এল। দরজা খুলতেই বাইরে কেউ নেই, শুধু মেঝেতে পড়ে থাকা একটা ভাঁজ করা কাগজ।
কাগজটা খুলতেই অরিজিৎ-এর মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। কারণ তাতে তার নিজের আঁকা ছবি—সে-ই, অরিজিৎ সেন। ছবির নিচে লেখা:
“আগামী সাতদিনের মধ্যে তোমার পালা।”
পর্ব ৩: কালির ফাঁদে
রাতটা অরিজিৎ প্রায় জেগেই কাটাল। বিছানায় শোয়েছিল বটে, কিন্তু ঘুম তার চোখ ছুঁয়েও গেল না। মনের ভেতর যেন একটা তীক্ষ্ণ কাঁচ ভাঙার শব্দ চলছিল বারবার। টেবিলে রাখা কাগজটা—যেখানে তার নিজের মুখ আঁকা আর নিচে লেখা সেই অদ্ভুত বার্তা—বারবার তার দিকে তাকাচ্ছিল যেন।
“আগামী সাতদিনের মধ্যে তোমার পালা।”
শব্দগুলো যেন হাড়ে হাড়ে ঢুকে যাচ্ছিল। কে লিখল এটা? আর কিভাবে পেল তার আঁকা ছবিটা? যদি কেউ সত্যিই তার স্কেচবুকের ওপর নজর রাখে, তবে সে কতটা নিরাপদ?
সকালে খবরের কাগজে প্রথম পাতায় বড় শিরোনাম—“চেনা রাজনীতিবিদ নিখোঁজ।” ছবির নিচে লেখা তার শেষ দেখা গিয়েছিল আগের রাতেই। অরিজিৎ খবরটা পড়ে শিউরে উঠল। কারণ সেই মানুষটিকে সে প্রথম আঁকেছিল। তখনই তার মনে হল, এ খেলা শুধু কাকতাল নয়, পরিকল্পনা করে কেউ তার আঁকাকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে।
সে সিদ্ধান্ত নিল, তাকে কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতে হবে। বন্ধু জয়ন্ত, যিনি সাংবাদিক, তার কাছেই যাওয়া সবচেয়ে নিরাপদ। দুপুরে সে জয়ন্তের অফিসে পৌঁছাল। ঘরে পুরোনো কাগজের গন্ধ, টাইপ মেশিনের শব্দ, আর চা খাওয়ার কাপে কাপে ভাঁজ জমে থাকা কালি। জয়ন্ত তাকে দেখে হাসল, “কি রে, আজ আবার কোন চরিত্র আঁকলি?”
অরিজিৎ দ্বিধা করল। তারপর খাতার কিছু পাতা খুলে জয়ন্তকে দেখাল। পাতাগুলো ফাঁকা। অরিজিৎ নিজেও থমকে গেল। সে তো জানে পাতাগুলোতে ছবি ছিল। ব্যবসায়ী, পুলিশ, ভিখিরি—সব। কিন্তু এখন একটাও নেই। কেবল সাদা কাগজ।
“তুই আমাকে নিয়ে মজা করছিস নাকি?”—জয়ন্ত ভ্রু কুঁচকে বলল।
অরিজিৎ ব্যাকুল হয়ে উত্তর দিল, “বিশ্বাস কর, ছবি ছিল। তারপর ঘটনার সাথে মিলে গেল। আর গত রাতে…”
সে থেমে গেল। জয়ন্ত যদি না বিশ্বাস করে? যদি ভাবে ওর মানসিক সমস্যা হয়েছে?
কিন্তু জয়ন্ত হঠাৎ শান্ত গলায় বলল, “দেখ, তোর মুখে টেনশন স্পষ্ট। যদি সত্যিই কিছু ঘটে থাকে, তোকে প্রমাণ জোগাড় করতে হবে। না হলে কেউ বিশ্বাস করবে না।”
অরিজিৎ মাথা নাড়ল। প্রমাণ—এই শব্দটা তার মাথায় ঢুকে গেল। হ্যাঁ, তাকে প্রমাণ চাই।
সেই রাতে সে স্টুডিওতে ক্যামেরা বসাল। খাতার সামনে ছোট্ট একটা ভিডিও ক্যামেরা চালু রেখে দিল। তারপর আবার ছবি আঁকতে শুরু করল। এ বার এক তরুণ ছেলের মুখ, কলেজ পড়ুয়া মনে হয়। চোখে স্বপ্ন, কিন্তু ঠোঁটে যেন লুকোনো ক্ষোভ। আঁকার পর অরিজিৎ গভীর শ্বাস নিল। এবার যদি ছবিটা হারিয়ে যায়, তবে ক্যামেরায় ধরা পড়বে।
অরিজিৎ খাতা বন্ধ করল, আলো নিভিয়ে বিছানায় গেল। বুক ধকধক করছিল। মাঝরাতের দিকে হঠাৎ সে ঘুম ভেঙে উঠল—স্টুডিওর ভেতর থেকে হালকা খসখস শব্দ আসছে। ধীরে ধীরে দরজা খুলে সে ভেতরে ঢুকল। খাতা খোলা, কিন্তু হাত দিয়ে কেউ ছোঁয়নি। পাতাটা একেবারে ফাঁকা। ছবিটা নেই।
ক্যামেরা!
অরিজিৎ তাড়াতাড়ি ফুটেজ চালাল। কয়েক মিনিট দেখার পর তার বুক হিম হয়ে গেল। ক্যামেরায় দেখা গেল—অন্ধকার ঘরে খাতা নিজে থেকেই খুলে গেল, পাতার ওপর আঁকা মুখ ধীরে ধীরে কালি মুছে মিলিয়ে গেল। আর মিলিয়ে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে, ছবির চোখদুটো হঠাৎ ক্যামেরার লেন্সের দিকে তাকাল।
অরিজিৎ চিৎকার করে ক্যামেরা বন্ধ করে দিল। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।
ঠিক তখনই ফোন বেজে উঠল। আবার অচেনা নম্বর। রিসিভ করতেই শীতল কণ্ঠস্বর শোনা গেল—
“ভালো করছিস। ছবিগুলো আঁকতে থাক। শহরের সত্যিকারের মুখগুলোকে প্রকাশ কর। আর মনে রাখ, সময় খুব কম।”
অরিজিৎ কেঁপে উঠল। “কে তুমি?”
লাইন কেটে গেল।
সকালে খবর এলো—এক কলেজ ছাত্র আত্মহত্যা করেছে। কাগজে ছাপা ছবি দেখে অরিজিৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। হুবহু তার আঁকা ছবির মতো।
এখন আর কোনো সন্দেহ নেই। কেউ একজন তাকে ব্যবহার করছে। কে যেন চায় অরিজিৎ অপরাধের ভবিষ্যদ্বাণী আঁকুক। কিন্তু এই ক্ষমতা কি তার নিজের? নাকি কেউ তার কালি আর খাতার ভেতর দিয়ে অদৃশ্য শক্তি চালাচ্ছে?
সেই রাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অরিজিৎ হঠাৎ দেখল তার চোখের ভেতরেও এক অদ্ভুত আলোর ছটা। মনে হল তার ভেতরে অন্য কেউ ঢুকে বসে আছে। আয়নায় প্রতিফলনটা যেন ফিসফিস করে বলল—
“তুমি কেবল হাত। আমি কালি।”
অরিজিৎ পিছিয়ে গেল, কিন্তু পা জমে গেল মেঝেতে। বুকের ভেতর একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল—এ খেলাটা কোথায় গিয়ে থামবে? আর সাত দিনের পর সত্যিই যদি তার পালা আসে?
পর্ব ৪: আঁকার আড়ালে চোখ
পরপর কয়েকটা রাত না ঘুমোনো মানুষ যেমন থাকে, অরিজিৎ ঠিক তেমনই হাঁটছিল। চোখ লালচে, দাড়ি অগোছালো, শরীর কাহিল। হাতে ধরা স্কেচবুক এখন তার কাছে বিষের মতো মনে হচ্ছিল। তবু বুকের গভীরে এক অদ্ভুত টান তাকে বারবার খাতার পাতার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।
জয়ন্তকে ফোন করতে চেয়েছিল সে, কিন্তু আবার থেমে গিয়েছিল। সাংবাদিক বন্ধু কি এত অস্বাভাবিক গল্প বিশ্বাস করবে? বরং উল্টো তার পাগলামি প্রমাণ হয়ে যাবে না তো? কিন্তু অন্যদিকে, ঘটনাগুলোও আর গোপন রাখার মতো নয়। পুলিশের চোখেও সব খবর পৌঁছে গেছে।
সকালের কাগজে আবার শিরোনাম—“কলেজ ছাত্রের আত্মহত্যার রহস্য।” খবরের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া এক লাইন—“শহরের কার্টুনিস্ট অরিজিৎ সেন-এর আঁকা চিত্রের সঙ্গে আশ্চর্য মিল।” যদিও সরাসরি তার নাম লেখা হয়নি, কিন্তু ইঙ্গিত স্পষ্ট।
অরিজিতের বুক ধড়ফড় করে উঠল। কেউ তার পেছনে লেগেছে, খবর ফাঁস করছে। কে?
সন্ধেবেলা সে আড্ডাতলার চায়ের দোকানে গেল। অল্প আলো, বৃষ্টিভেজা রাস্তা, সিগারেটের ধোঁয়ায় ভরা বাতাস। জয়ন্ত বসেছিল একটা টেবিলে, সঙ্গে আরও দু-একজন সাংবাদিক। অরিজিৎ চুপচাপ পাশে গিয়ে বসতেই জয়ন্ত কানে কানে বলল—
“শোন, সাবধানে থাকিস। তোর নাম ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশের চোখে তুই ‘ইন্টারেস্টিং পারসন’। তোর আঁকা জিনিসপত্র ওরা খুঁজবে।”
অরিজিৎ উত্তর দিল না। শুধু চারপাশটা খেয়াল করছিল। যেন কেউ তাকিয়ে আছে। দোকানের কোণের অন্ধকারে দুটো চোখ ঝিলিক মেরে উঠল বলে তার মনে হল। সে হঠাৎ চমকে উঠে তাকাল, কিন্তু সেখানে কেউ নেই।
বাড়ি ফেরার পথে অরিজিৎ খেয়াল করল, এক কালো মোটরবাইক অনেকক্ষণ ধরে তার পেছনে আসছে। গলিপথে ঢুকতেই বাইকটা হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। সে গা শিউরে উঠে দৌড়ে বাড়ি ঢুকল।
রাত গভীর হলে স্কেচবুক খুলে সে এবার এক অপরিচিত মুখ আঁকতে শুরু করল। চোরা চাহনি, ঘাড়ে দাগ, ঠোঁটে ধূর্ত হাসি। আঁকা শেষ করে যখন খাতা বন্ধ করল, তখনই বাইরের গলি থেকে ভেসে এল মানুষের আর্তনাদ। জানলা দিয়ে উঁকি মেরে সে দেখল—এক লোক রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে, ঠিক সেই মুখ।
অরিজিৎ ভয় পেয়ে খাতা সরিয়ে ফেলল। এবার নিশ্চিত হলো—কেউ তার আঁকা কাজে লাগাচ্ছে। কিন্তু কিভাবে?
পরের দিন ভোরে দরজার নিচে গুঁজে দেওয়া হল এক খাম। ভিতরে একটাই কাগজ—অরিজিতের আগের আঁকা ছবিগুলো প্রিন্ট আকারে। আর নিচে টাইপ করা লাইন:
“তুমি আঁকবে। আমরা চালাব।”
অরিজিৎ কাগজ মুঠো করে ফেলল। এখন পরিষ্কার—কেউ তার আঁকার শক্তি জানে। তারা চায় তাকে দিয়ে সব কাজ করাতে। কিন্তু তারা কারা? অপরাধী চক্র? গুপ্ত সংগঠন? নাকি আরও অদ্ভুত কিছু?
সে সিদ্ধান্ত নিল, সত্যিটা বের করতেই হবে।
বিকেলে জয়ন্তকে নিয়ে গিয়ে বসাল নিজের স্টুডিওতে। ক্যামেরার ফুটেজ দেখাল—যেখানে ছবিগুলো নিজেরাই মিলিয়ে যাচ্ছিল। জয়ন্ত প্রথমে স্তম্ভিত, তারপর চাপা গলায় বলল—
“এটা যদি সত্যি হয়, তবে তুই এখন অনেক বড় খেলায় ঢুকে গেছিস। হয়তো তোকে ব্যবহার করছে এমন এক দল, যারা অপরাধের আগে ছবি তৈরি করে জনমনে আতঙ্ক ছড়াতে চায়। কিংবা আরও ভয়ঙ্কর কিছু।”
অরিজিৎ অবিশ্বাসের চোখে তাকাল। “কিন্তু আমি কেন?”
জয়ন্ত উত্তর দিল না। শুধু একটা কথা বলল—“আজ রাতে তোর সঙ্গে থাকব আমি।”
রাত নেমে এলে দুজনেই স্টুডিওতে বসেছিল। স্কেচবুক টেবিলে খোলা, আলো কমানো। অরিজিৎ হাত কাঁপতে কাঁপতে কলম ধরল। আঁকতে শুরু করল এক অচেনা ছেলের মুখ। জয়ন্তও মন দিয়ে তাকিয়ে রইল।
আঁকা শেষ হতেই দুজনের চোখ কপালে উঠল। কারণ খাতার পাতায় ফুটে উঠেছিল জয়ন্তর মুখ।
অরিজিৎ আতঙ্কে কলম ছুঁড়ে ফেলল। জয়ন্ত ফ্যাকাসে মুখে কাগজের দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েক মুহূর্ত পর বাইরের গলি থেকে শোনা গেল চিৎকার, তারপর গুলির শব্দ।
দুজনেই ছুটে জানলার কাছে গিয়ে দেখল—এক যুবক রাস্তায় গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়েছে। মুখটা অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু তার পরনে জয়ন্তর মতোই জামা।
অরিজিৎ ফিসফিস করে বলল—“এটা শুধু কাকতাল নয়, জয়ন্ত। কেউ আমাদের চোখের সামনেই খেলা খেলছে।”
পর্ব ৫: অদৃশ্য আঁকাবাঁকা পথ
রাতের গুলির শব্দ যেন এখনো কানে বাজছে। অরিজিৎ আর জয়ন্ত জানলার ধারে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। বাইরে পুলিশের গাড়ি এসে ভিড় করল, ভিড় জমল গলিপথে। কিন্তু আশ্চর্যভাবে, নিহত যুবকের পরিচয় কেউ স্পষ্ট বলতে পারল না। পুলিশ লাশ তুলে নিয়ে গেল, ভিড় ছত্রভঙ্গ হলো।
অরিজিৎ কাঁপা গলায় বলল, “তুই দেখেছিস তো? আমি আঁকার পরেই ঘটনা ঘটল।”
জয়ন্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “এটা আর কাকতাল নয়। কেউ তোর আঁকা ব্যবহার করছে, আর সেটা সময়মতো ঘটিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কারা?”
অরিজিৎ মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, “আমাকে খাম পাঠিয়েছিল ওরা। তাতে লেখা ছিল—‘তুমি আঁকবে। আমরা চালাব।’ মানে ওরা চায় আমি অপরাধের নকশা আঁকি, তারপর ওরা সেটা বাস্তবায়ন করে।”
জয়ন্ত কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “এর মানে একটা সংগঠন কাজ করছে। হয়তো কোনো গোপন দল, যারা তোর প্রতিভাকে অস্ত্র করছে। আমাদের সেটা খুঁজে বের করতে হবে।”
সূত্রের খোঁজ
পরের দিন সকালেই জয়ন্ত তার সাংবাদিক সূত্র কাজে লাগাল। কয়েকটা পুরোনো ফাইল খুলল সে, যেখানে শহরে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনাগুলোর রেকর্ড আছে—বিনা কারণে নিখোঁজ, অঘটন, অজ্ঞাত খুন। প্রতিটা ঘটনার সঙ্গে রহস্যজনক ছবি বা পোস্টার জড়িত ছিল। আর সেই ছবিগুলোর আঁকার ধরন অরিজিতের আঁকার সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিলে যায়।
অরিজিৎ স্তম্ভিত। “মানে, আমার আগে আরও কেউ ছিল?”
জয়ন্ত মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ, হয়তো তোর মতোই কোনো শিল্পী। আর তাদেরও কেউ ব্যবহার করেছিল। এরা শিল্পীদের দিয়ে অপরাধের ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করায়। একে বলে ‘ভিজ্যুয়াল টেরর’। ছবির ভেতরে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া।”
অরিজিতের মেরুদণ্ডে ঠান্ডা শিহরণ নেমে গেল।
প্রথম ছায়া
বিকেল নাগাদ অরিজিতের দরজায় আবার একটি খাম এসে পড়ল। এবার খাম খুলতেই ভেতরে শুধু একটি ঠিকানা লেখা কাগজ: “কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের পুরোনো গুদামঘর। রাত বারোটায়।”
অরিজিৎ কাগজটা জয়ন্তকে দেখাল। দুজনেই জানল, এটা ফাঁদও হতে পারে, আবার সত্যি সূত্রও। তবু যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
রাত বারোটায় তারা পৌঁছল গুদামঘরের কাছে। জায়গাটা অন্ধকার, চারপাশে ভাঙা ইটপাথর, লোহার রড। ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল দেয়ালে সারি সারি আঁকা ছবি—অচেনা মুখ, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ। ছবিগুলো একে অপরের ওপর চাপা পড়ে গেছে, কিন্তু প্রতিটা ছবির চোখে একই শূন্যতা।
হঠাৎ অন্ধকার থেকে কারও কণ্ঠস্বর ভেসে এল—
“স্বাগতম, অরিজিৎ সেন। তোমার হাত অনেক দূর যাবে।”
অরিজিৎ ও জয়ন্ত চমকে উঠল। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল এক লম্বা মানুষ, কালো কোট পরা। মুখটা বেশিরভাগ ঢাকা, কেবল ঠোঁটে বাঁকা হাসি।
“কে তুমি?”—অরিজিৎ কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল।
লোকটা ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। “আমরা ‘চোখের ঘরানা’। আমাদের বিশ্বাস, ছবিই বাস্তবকে জন্ম দেয়। তুমি কেবল আমাদের নতুন হাত। আগের হাতগুলো হয়তো থেমে গেছে, কিন্তু তোমাকে আমরা শেষ হতে দেব না।”
জয়ন্ত চিৎকার করে উঠল, “তোমরা অপরাধ ঘটাচ্ছো মানুষের আঁকাকে ব্যবহার করে!”
লোকটা হাসল। “অপরাধ? না, আমরা কেবল আঁকাকে সত্যি করে তুলি। বাস্তবকে আমরা কালি দিয়ে লিখি।”
পালানোর চেষ্টা
হঠাৎ আলো নিভে গেল। চারদিক অন্ধকার। কোথা থেকে কয়েকজন কালো কাপড়ে ঢাকা মানুষ বেরিয়ে এল। তাদের হাতে ছিল ক্যামেরা, মোবাইল, আর কালি ভর্তি বোতল। তারা ঘিরে ফেলল অরিজিৎ আর জয়ন্তকে।
একজন এগিয়ে এসে অরিজিতের হাতে একটা নতুন খাতা ধরিয়ে দিল। “আঁকো। নইলে এবার জয়ন্তকে আঁকতে হবে।”
অরিজিৎ আতঙ্কে খাতা ধরল। জয়ন্ত তাকে থামাতে চাইছিল, কিন্তু তখনই অদৃশ্য হাতে কেউ যেন পেছন থেকে তাকে চেপে ধরল। অরিজিৎ কাঁপতে কাঁপতে কলম তুলল। কিন্তু আঁকবে কি? কার মুখ আঁকবে?
হঠাৎই মাথায় এল একটা পাগলাটে বুদ্ধি। সে খাতায় আঁকল এক ফাঁকা মুখ—চোখ নেই, নাক নেই, ঠোঁট নেই। শুধু এক শূন্য সাদা মুখ। আঁকা শেষ হতেই ঘর জুড়ে বাতাস যেন ঘুরপাক খেতে লাগল। চারপাশের লোকগুলো চিৎকার করে উঠল, যেন অদৃশ্য শক্তি তাদের চোখে ঢুকে গেছে।
অবস্থার সুযোগ নিয়ে অরিজিৎ আর জয়ন্ত দৌড়ে বেরিয়ে এল গুদামঘর থেকে। অন্ধকার রাস্তা, কেবল দূরে আলো ঝিলিক দিচ্ছে। তারা হাঁপাতে হাঁপাতে থামল।
জয়ন্ত কাঁপা গলায় বলল, “তুই বুঝলি, এরা একটা সংগঠন। নাম ‘চোখের ঘরানা’। এরা শিল্পীদের দখল করে বাস্তব নিয়ন্ত্রণ করে।”
অরিজিৎ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “কিন্তু আমি কি পারব এদের হাত থেকে বেরোতে? নাকি আমার কালি এখন থেকে কেবল ওদের জন্যই বয়ে যাবে?”
অদৃশ্য অনুসরণ
বাড়ি ফিরে অরিজিৎ দেখল তার টেবিলের ওপর রাখা স্কেচবুক নিজে থেকেই খুলে আছে। পাতায় লেখা:
“তুমি পালাতে পারবে না। কালি এখন তোমার ভেতর।”
অরিজিৎ বইটা বন্ধ করে জানল—এবার থেকে খেলা আরও ভয়ঙ্কর হতে চলেছে।
পর্ব ৬: কালির ভেতরের আয়না
বৃষ্টির ভেজা ভোরে ঘুম ভাঙল অরিজিতের। চোখ খুলতেই বুক ধড়ফড় করতে লাগল। সারারাত সে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছে—কালো কালি ছড়িয়ে সমুদ্রের মতো ঢেউ তুলছে, আর সেই ঢেউয়ের ভেতর অসংখ্য মুখ ডুবে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে কয়েকটা মুখ সে চিনেছে—রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, পুলিশ অফিসার, এমনকি সেই অচেনা তরুণীও। আর সমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল সে নিজেই, হাতে কলম, আর তার আঁকা প্রতিটি রেখা ঢেউ হয়ে ছুটে যাচ্ছে মানুষের দিকে।
ঘাম ভেজা শরীর নিয়ে সে উঠে বসে দেখল, স্কেচবুক আবার খোলা। পাতার ওপর কালি ছড়িয়ে আছে, কিন্তু কোনো ছবি নেই। কালি যেন নিজে থেকেই নড়ছে, ঢেউ তুলছে।
“তুমি কেবল হাত,” মনে পড়ল আয়নার কথাটা। “আমি কালি।”
অরিজিৎ আতঙ্কে বই বন্ধ করে দিল, কিন্তু বুকের ভেতরে অদ্ভুত একটা কৌতূহলও জন্ম নিল। যদি সত্যিই তার ভেতর কোনো শক্তি থাকে? যদি সে এই শক্তিকে বুঝে নিতে পারে? হয়তো তবেই এই সংগঠনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সম্ভব।
শক্তির প্রথম পরীক্ষা
সেই বিকেলে জয়ন্ত এলো। তার মুখেও ক্লান্তি। ও বলল, “তুই আজকাল খুব আলাদা হয়ে যাচ্ছিস। চোখে অদ্ভুত জ্যোতি। সাবধানে থাকিস।”
অরিজিৎ দ্বিধা করে খাতা খুলল। বলল, “আমি একটা জিনিস পরীক্ষা করতে চাই। তুই পাশে থাক।”
সে পাতার ওপর কলম চালাতে শুরু করল। কিন্তু এবার কোনো মুখ আঁকল না। আঁকল একটা চেয়ার। সাধারণ কাঠের চেয়ার। আঁকা শেষ করতেই বুক ধকধক করতে লাগল। দুজনে তাকিয়ে রইল খাতার দিকে।
হঠাৎ কোণের বাতাস ভারী হয়ে উঠল, আর মেঝেতে যেন ছায়া ঘন হল। মুহূর্তের মধ্যে তাদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে গেল এক কাঠের চেয়ার। ঠিক সেই আঁকার মতো।
জয়ন্ত স্তব্ধ হয়ে গেল। “মানে তুই এখন শুধু ভবিষ্যদ্বাণী করছিস না… তুই বাস্তব তৈরি করতে পারছিস।”
অরিজিৎ কাঁপা গলায় বলল, “মানে কালি শুধু ঘটনা ঘটায় না, বাস্তবও গড়তে পারে।”
চেয়ারটা হঠাৎ ভেঙে পড়ল, কালি হয়ে মাটিতে মিশে গেল। দুজনেই পিছিয়ে গেল।
ভেতরের পরিবর্তন
পরের কয়েকদিন অরিজিৎ লক্ষ্য করল তার মধ্যে পরিবর্তন আসছে। খিদে কমছে, ঘুম ভাঙছে অদ্ভুত সময়ে। আঁকা না করলেও মাথায় নিজে থেকে ছবি ভেসে উঠছে। রাস্তার মানুষ, চলন্ত বাস, ভিখিরি—সবাই যেন একদিন তার স্কেচবুকের পাতায় এসে ধরা দেবে।
একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখল তার আঙুলে কালো কালি লেগে আছে, অথচ সে কলম ছোঁয়েওনি। আঙুলটা মুখের কাছে আনতেই অদ্ভুত গন্ধ—লোহার মতো ধাতব, রক্তের মতো লবণাক্ত।
মনে হল, কালি এখন তার শিরার ভেতর বয়ে যাচ্ছে।
সংগঠনের ফিসফিস
রাতের বেলা ফোন এল। একই অচেনা কণ্ঠস্বর—
“তুমি এখন শক্তি বুঝতে পারছো। এটাই আমাদের উপহার। তুমি তৈরি করো, আমরা ছড়িয়ে দিই। শহরকে আমরা তোমার চোখ দিয়ে দেখব।”
অরিজিৎ চিৎকার করে উঠল, “আমি তোমাদের জন্য আঁকব না!”
ওপাশ থেকে শীতল হাসি। “তুমি ইতিমধ্যেই আঁকছো। কালি তোমার রক্তে। তুমি পালাতে পারবে না।”
লাইন কেটে গেল।
প্রথম প্রতিরোধ
অরিজিৎ এবার সিদ্ধান্ত নিল পাল্টা কিছু করবে। যদি সে আঁকতে পারে, তবে কি সে নিজের আঁকা দিয়ে তাদের আটকাতে পারবে? সে স্কেচবুক খুলে আঁকল এক খাঁচা। লোহার খাঁচা, মোটা শিক। ছবিটা শেষ করতেই ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে গেল আসল এক খাঁচা।
সে হাঁপাতে হাঁপাতে ফিসফিস করল, “আমি যদি মানুষের জন্য কালো কালি ছড়াতে পারি, তবে আটকানোর জন্যও ব্যবহার করতে পারি।”
কিন্তু তখনই খাঁচাটা ভেঙে গেল, ছাই হয়ে মিশে গেল বাতাসে। অদৃশ্য শক্তি যেন বলল—
“তুমি আমাদের বিরুদ্ধে যেতে পারবে না।”
জয়ন্তর ভয়
জয়ন্ত এসব দেখে ভয় পেতে শুরু করল। এক রাতে সে বলল, “অরিজিৎ, আমি মনে করি তুই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছিস। যদি এই শক্তি সত্যিই থাকে, তবে তোর একার পক্ষে সামলানো সম্ভব নয়। পুলিশ, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ—কাউকে বল।”
অরিজিৎ হেসে ফেলল, এক শূন্য হাসি। “তুই বুঝিস না, জয়ন্ত। এখন আমি শুধু একজন শিল্পী নই। আমি শহরের আয়না। আমি না আঁকলে এই শহরের মুখ থাকবে না।”
জয়ন্ত ভয়ে পিছিয়ে গেল। এই মানুষটা তার বন্ধু তো? নাকি অন্য কেউ হয়ে যাচ্ছে?
রক্তের আঁকা
সেই রাতেই অরিজিৎ আবার আঁকল। কিন্তু এবার কলম নয়, নিজের আঙুল দিয়ে। আঙুলের ডগা থেকে ফোঁটা ফোঁটা কালি বেরোচ্ছিল, আর সে তা মেখে আঁকতে লাগল। আঁকল এক অচেনা মুখ—লম্বা কোট পরা, ঠোঁটে বাঁকা হাসি।
এটা সেই লোক, যাকে গুদামঘরে দেখেছিল। সংগঠনের প্রতিনিধি।
আঁকা শেষ হতেই ঘরে ঠান্ডা হাওয়া বইল। কোণের অন্ধকার ঘন হল, আর সেখানে ফুটে উঠল সেই লোক। হুবহু আঁকার মতো।
লোকটা ফিসফিস করে বলল, “অভিনন্দন, অরিজিৎ। তুমি এখন পুরোপুরি আমাদের। তোমার কালি আমাদের হাতিয়ার।”
অরিজিৎ কাঁপতে কাঁপতে বলল, “না… আমি তোমাদের চাই না।”
লোকটা হাসল। “তুমি বেছে নিতে পারবে না। কালি রক্তে ঢুকলে আর ফেরার পথ থাকে না।”
অদৃশ্য হয়ে গেল সে, কিন্তু ঘরে এখনো সেই ধাতব গন্ধ ভাসছিল।
দ্বিধার প্রান্তে
জয়ন্ত হতভম্ব। সে বলল, “এটা তো পাগলামি। তুই যদি ওদের হাতে পড়িস, শহর ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু যদি শক্তিটা সামলাতে পারিস, হয়তো এর ব্যবহার দিয়ে উল্টো ওদের থামাতে পারবি।”
অরিজিৎ আকাশের দিকে তাকাল। “কিন্তু আমি কি পারব? নাকি আমি নিজেই কালি হয়ে যাব?”
বৃষ্টি বাইরে ঝমঝম করে পড়ছিল। আর ভেতরে স্কেচবুক নিঃশব্দে খুলে যাচ্ছিল—পাতাগুলো একে একে উল্টোচ্ছে, যেন অদৃশ্য কেউ পড়ছে। আর শেষ পাতায় ফুটে উঠল এক লেখা:
“সাতদিন শেষ হতে চলছে।”
অরিজিৎ বুক চেপে ধরে বুঝল—সময় ফুরিয়ে আসছে।
পর্ব ৭: কালির আক্রমণ
অরিজিৎ টানা তিনদিন খাতা খোলেনি। তবুও তার ভেতরে কালি নড়ছিল, যেন শিরার ভেতর ঢেউ তুলছে। মাঝে মাঝে সে অনুভব করছিল, নিজের আঙুলের ডগা থেকে কালি চুঁইয়ে পড়ছে, অথচ বাইরে কোনো দাগ নেই। সে চোখ ঘষলেই চারপাশে অদ্ভুত রেখা দেখতে পাচ্ছিল—মানুষের চারপাশে যেন অদৃশ্য ছায়ার আউটলাইন।
জয়ন্ত তাকে বোঝাচ্ছিল, “তুই থেমে যা, অরিজিৎ। আর আঁকবি না। প্রতিরোধ করতে চাইলে শক্তির দিকে না তাকিয়ে বাইরে বেরোতে হবে। সংগঠনটা খুঁজে বের করতে হবে।”
কিন্তু ঠিক তখনই ঘটনাটা ঘটল।
আক্রমণের শুরু
সেই রাতে বাড়ির দরজায় ভয়ঙ্কর ধাক্কা। অরিজিৎ দরজা খোলার আগেই ভেতরে ঢুকে এল তিনজন কালো কাপড়ে ঢাকা লোক। তাদের হাতে ছিল লম্বা লাঠি, সঙ্গে ক্যামেরা। এক মুহূর্তে তারা ঘর ভরে ফেলল, আর একজন চেঁচিয়ে উঠল—
“খাতা দাও! আঁকো!”
অরিজিৎ পিছিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “আমি আর আঁকব না!”
কিন্তু তাদের একজন জয়ন্তকে ধরে টেনে নিয়ে গেল, গলায় ছুরি ঠেকিয়ে দিল। “আঁকো। নইলে তোমার বন্ধুকে কেটে ফেলব।”
অরিজিতের বুক কেঁপে উঠল। হাত কাঁপতে কাঁপতে সে স্কেচবুক খুলল। চোখের সামনে যেন কালি নিজে থেকেই ভেসে উঠছে। সে কলম ধরল না, আঙুল দিয়ে আঁকল।
কিন্তু এবার সে অন্য কিছু আঁকতে শুরু করল—একটা আগুনের রেখা। আঁকা শেষ হতেই ঘরের কোণে হাওয়ার ঝাপটা, তারপর আগুন জ্বলে উঠল। কালো কাপড়ের মানুষগুলো চিৎকার করে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। জয়ন্ত বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল।
অরিজিৎ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “দেখলি তো? আমি কেবল মুখ আঁকি না, আমি আগুনও আনতে পারি।”
জয়ন্ত ভয়ে আর বিস্ময়ে একসাথে বলল, “তুই যদি এরকম আঁকিস, তবে শহর ভস্ম হয়ে যাবে।”
সংগঠনের হুমকি
সকালের দিকেই আবার ফোন এলো। একই শীতল কণ্ঠস্বর—
“বাহ, তুমি শক্তি বুঝতে শুরু করেছ। কিন্তু মনে রেখো, এই শক্তি আমাদের। তুমি চাইলে আগুন আনতে পারো, কিন্তু আমরা চাইলে তুমিই আগুনে পুড়ে যাবে।”
অরিজিৎ দাঁত চেপে বলল, “আমি তোমাদের আঁকব না।”
ওপাশ থেকে হালকা হাসি, তারপর উত্তর—“সাত দিনের সময় শেষ হচ্ছে। যদি আমাদের জন্য না আঁকো, তবে আমরা তোমার জীবনকেই আঁকব।”
ফোন কেটে গেল।
অরিজিৎ বুঝল, ওরা এখন খেলা বদলাবে।
শক্তির সীমা
সেই রাতে অরিজিৎ নিজের ঘরে বসে পরীক্ষা শুরু করল। সে খাতায় এক গাছ আঁকল। মুহূর্তের মধ্যেই ঘরের কোণে অঙ্কুর ফেটে বেরিয়ে এলো ছোট্ট চারা। মিনিটের মধ্যে সেটা বড় হতে লাগল, শিকড় বিছিয়ে পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়ল। অরিজিৎ ভয় পেয়ে পাতাটা ছিঁড়ে ফেলতেই গাছটা মিলিয়ে গেল।
তারপর সে খাতায় একটা ঘড়ি আঁকল। ঘড়িটা বাস্তবে ফুটে উঠল, কিন্তু তার কাঁটা উল্টো ঘুরতে লাগল। তখন তার মাথায় ঝাঁকুনি দিয়ে অদ্ভুত দৃশ্য ভেসে উঠল—কিছু ঘটনার ঝলক, ভবিষ্যতের মতো। মানুষ চিৎকার করছে, শহরে আগুন, রক্ত, আর এক ছায়ামূর্তি।
সে ঘড়িটা ভেঙে দিল, কিন্তু বুকের ভেতরের কাঁপুনি থামল না।
জয়ন্তর উদ্বেগ
জয়ন্ত ভয়ে পাগল। “অরিজিৎ, এ শক্তি তোর হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। তুই এটাকে থামাতে পারবি না।”
অরিজিৎ এক অদ্ভুত শান্ত গলায় বলল, “আমি যদি থামাই, ওরা অন্য কাউকে বেছে নেবে। তাহলে কি আমার উচিত না শক্তিটাকে পুরোপুরি আয়ত্ত করা?”
জয়ন্ত উত্তর দিল না। কিন্তু তার চোখে ভয় স্পষ্ট।
মৃত্যুর ছায়া
তৃতীয় রাতে সংগঠনের পাল্টা আঘাত এলো। অরিজিৎ ঘরে একা বসেছিল। জানলার ফাঁক দিয়ে কালো কোট পরা সেই লোক ঢুকে এল—যাকে আগেও দেখেছিল।
লোকটা বলল, “তুমি আগুন আনতে শিখেছ। কিন্তু এখন দেখো আমরা কী আঁকতে পারি।”
অরিজিৎ ফিসফিস করে বলল, “তুমি তো আঁকতে পারো না।”
লোকটা ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে দিল। “আমরা আঁকি না, আমরা তোমার কালি দিয়ে লিখি।”
হঠাৎ অরিজিতের শরীর কেঁপে উঠল। মনে হল, তার আঙুল নিজের থেকেই নড়ছে। সে কলম ধরল, আর খাতায় আঁকা শুরু করল। কিন্তু সে আঁকছে না—অন্য কেউ তার হাত চালাচ্ছে।
পাতায় ফুটে উঠল এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য—এক বাড়ি ভেঙে পড়ছে, তার নিচে চাপা পড়ছে এক মানুষ। অরিজিৎ আতঙ্কে চিৎকার করল, “থামো!”
কিন্তু হাত থামল না। ছবি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে ভয়ঙ্কর আওয়াজ এল। পাশের গলির একটা পুরোনো বাড়ি ভেঙে পড়েছে, আর ভেতরে চাপা পড়েছে একজন।
অরিজিৎ খাতা ছুড়ে ফেলল। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। সে বুঝল, সংগঠন এখন তার শরীরকেও দখল করতে পারে।
প্রতিজ্ঞা
ভোরবেলা অরিজিৎ দাঁড়াল আয়নার সামনে। চোখে ভয়ঙ্কর শূন্যতা। নিজের প্রতিফলন তাকে ফিসফিস করে বলল—
“তুই পালাতে পারবি না। কিন্তু তুই লড়তে পারিস।”
অরিজিৎ ঠোঁট কামড়ে ফিসফিস করে বলল, “হ্যাঁ, আমি লড়ব। ওদের হাতে অস্ত্র হব না। কালি যদি আমার ভেতর থাকে, তবে সেই কালিকে দিয়েই ওদের শেষ করব।”
কিন্তু প্রশ্ন একটাই—সে কি সময়মতো শক্তিটা আয়ত্ত করতে পারবে?
কারণ সাত দিনের সময় প্রায় শেষ। আর সংগঠন এবার সরাসরি তার জীবনে নেমে এসেছে।
পর্ব ৮: পাল্টা আঁকাবাঁকা
রাতের পর রাত ভয়ঙ্কর ঘটনায় অরিজিৎ ক্লান্ত, কিন্তু ভেঙে পড়েনি। বরং তার চোখে এখন নতুন এক আগুন। সংগঠন তাকে দখল করতে চাইছে, কিন্তু সে ঠিক করল—এবার পাল্টা আঘাত করবে। কালি যদি সত্যিই তার ভেতর থাকে, তবে সে সেই কালির মালিক, কেবল পুতুল নয়।
পরিকল্পনার শুরু
জয়ন্ত প্রথমে অবিশ্বাসী ছিল। “তুই কি সত্যিই ওদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইছিস? এরা তো পুরো একটা গোপন সংগঠন। তুই একা কেমন করে পারবি?”
অরিজিৎ শান্ত গলায় উত্তর দিল, “আমি একা নই। আমার হাতে কালি আছে। আর তুই আছে।”
জয়ন্ত ভ্রু কুঁচকে বলল, “কিন্তু তোর আঁকা তো ওরা নিয়ন্ত্রণ করছে।”
অরিজিৎ মাথা নাড়ল। “না। আমি যদি নিয়ন্ত্রণ শিখতে পারি, তবে ওরা পারবে না। আমি এ শক্তিকে বাঁধতে শিখব।”
নিয়ন্ত্রণের প্রথম ধাপ
অরিজিৎ খাতা খুলল। এবার সে চোখ বন্ধ করে মনে মনে এক ছবি কল্পনা করল—একটা তালা। ভারী, লোহার তৈরি। চোখ খুলতেই পাতায় ফুটে উঠল সেই ছবি। তারপর সে আঁকল একটা চাবি, কিন্তু চাবিটা তালার সঙ্গে মেলাল না। শুধু রাখল পাশে।
কিছুক্ষণ পরে আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। ঘরের কোণে ঝলক দিয়ে একটা লোহার তালা তৈরি হলো। চাবিটাও বাস্তব হয়ে উঠল, কিন্তু দুটো আলাদা রইল।
অরিজিৎ ফিসফিস করে বলল, “দেখলি, আমি এবার ভাগ করতে পারি। যা আঁকি, তা মিলেও না। আমি যদি কিছু আলাদা রাখতে চাই, তবে সেটাই হবে।”
জয়ন্ত বিস্মিত। “মানে তুই কালি দিয়ে নিয়ম তৈরি করতে পারছিস।”
অরিজিৎ মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ। এটাই আমার প্রথম পদক্ষেপ। এখন আমাকে নিয়ম তৈরি করতে হবে, যেগুলো দিয়ে আমি ওদের থামাতে পারব।”
সংগঠনের পাল্টা
কিন্তু সময় তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল না। পরের দিন রাতেই সংগঠন আবার আঘাত হানল। হঠাৎ দরজার নিচ দিয়ে ঢুকে এলো একটি খাম। খুলতেই তাতে লেখা—
“তুমি যদি আমাদের জন্য না আঁকো, তবে আমরা জয়ন্তকে আঁকব।”
অরিজিৎ চোখ মুছে তাকাল জয়ন্তর দিকে। বন্ধু চুপচাপ বসে আছে, চোখে ভয়।
অরিজিৎ দাঁত চেপে বলল, “না, ওরা তোকে আঁকতে পারবে না। আমি আঁকব ওদের।”
পাল্টা আঁকা
সে খাতা খুলল। কলম হাতে নিয়ে আঁকতে শুরু করল এক ছায়ামূর্তি—কালো কোট, বাঁকা ঠোঁট, চোখে শূন্যতা। যাকে সে গুদামঘরে দেখেছিল। আঁকা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের বাতাস ভারী হয়ে গেল।
কোণে দাঁড়িয়ে উঠল সেই মানুষটা। কিন্তু এবার সে টলছিল। মুখে বিরক্তি। “তুমি… তুমি সাহস করেছ?”
অরিজিৎ ঠান্ডা গলায় বলল, “হ্যাঁ। এ কালি আমার। এবার আমি তোমাদের আঁকব।”
লোকটা চিৎকার করে উঠল। ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। মেঝেতে কালি ছড়িয়ে পড়ল, যেন সমুদ্র। কিন্তু অরিজিৎ এবার ভয় পেল না। সে খাতায় দ্রুত কয়েকটা রেখা টানল—এক খাঁচা, চারপাশে আগুনের বৃত্ত।
কালির ঢেউ মিলিয়ে গিয়ে ঘরের কোণে দাঁড়াল আগুনঘেরা এক খাঁচা। আর তার ভেতরে আটকা পড়ে গেল সেই কালো কোটওলা লোক।
লোকটা ছটফট করতে লাগল। “তুমি পারবে না… তুমি আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না…”
অরিজিৎ গর্জে উঠল, “আমি পারব।”
নতুন শক্তির ইঙ্গিত
কিন্তু ঠিক তখনই খাঁচা ভেঙে গেল। কালো কোটওলা লোক অদৃশ্য হয়ে গেল। ঘর নিস্তব্ধ।
অরিজিৎ হাঁপাতে লাগল। কালি আবার মিশে গেল মেঝেতে। জয়ন্ত ধীরে ধীরে তার কাঁধে হাত রাখল। “তুই বুঝলি, ওরা এখনো তোর থেকে শক্তিশালী। কিন্তু তুই নিয়ম তৈরি করতে পারিস। এটা আমাদের হাতিয়ার।”
অরিজিৎ মাথা নাড়ল। “আমাকে নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি শিখতে হবে। সময় কম।”
রহস্যময় সূত্র
পরের দিন সকালে জয়ন্ত খবর পেল এক গোপন সাংবাদিক সূত্র থেকে। শহরের প্রান্তে, শিয়ালদহের কাছে এক পরিত্যক্ত প্রেস ছিল—সেখানে নাকি ‘চোখের ঘরানা’র লোকেরা মিটিং করে।
অরিজিৎ শুনে বলল, “ওখানেই যেতে হবে। ওদের আঁকার আড়ালের আসল কালি খুঁজে বের করতে হবে।”
জয়ন্ত দ্বিধায় পড়ল। “কিন্তু ওরা তোকে খতম করতে চাইবে।”
অরিজিৎ দৃঢ় গলায় বলল, “হয়তো। কিন্তু আমি যদি এখন না যাই, তাহলে এই শহর একদিন কেবল কালি আর রক্তের ছায়ায় ভরে যাবে।”
যাত্রার আগে
সেদিন রাতটা অরিজিৎ একা কাটাল। স্কেচবুক টেবিলে রেখে সে দীর্ঘক্ষণ আয়নার দিকে তাকিয়ে রইল। নিজের প্রতিফলন যেন ফিসফিস করে বলছিল, “তুই আর কেবল কার্টুনিস্ট নস। তুই এখন কালি–লেখক।”
অরিজিৎ আঙুলে কালো রেখা এঁকে বলল, “আমি লেখক নই, আমি প্রতিরোধ।”
আকাশে বজ্রপাত হলো। খাতা নিজে থেকেই খুলে গেল। পাতায় ফুটে উঠল অচেনা শব্দ—
“শেষ তিন দিন।”
অরিজিৎ জানল, সময় শেষের দিকে ছুটছে। এখন তাকে শুধু বাঁচতে হবে না, আক্রমণও করতে হবে।
পর্ব ৯: কালির নগরী
রাতটা ছিল ভারী আর্দ্রতায় ভরা। কলকাতার আকাশে মেঘ জমে ছিল, কিন্তু বৃষ্টি নামেনি। শহরের আলো যেন নিভু নিভু করে জ্বলছিল। অরিজিৎ আর জয়ন্ত দাঁড়িয়ে ছিল শিয়ালদহের কাছের পুরোনো প্রেসের সামনে। ভাঙা দেওয়ালে শ্যাওলা জমে গেছে, জানালা গুলো ভাঙা, ভেতরে অন্ধকার। দূর থেকে জায়গাটা দেখে বোঝাই যায় না ভেতরে এখনো কোনো জীবন আছে।
কিন্তু অরিজিৎ অনুভব করছিল—কালি এখানে জমাট বেঁধে আছে। যেন বাতাসের ভেতরও আঁকার গন্ধ।
প্রবেশ
জয়ন্ত ফিসফিস করে বলল, “নিশ্চিত তো?”
অরিজিৎ ঠোঁট কামড়ে বলল, “এটাই তাদের আস্তানা। খেলা শেষ করতে হলে এখানেই ঢুকতে হবে।”
তারা ভাঙা গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকল। করিডোর অন্ধকার, ভেতরে ছত্রাকের গন্ধ। কিন্তু দেয়ালে আঁকা অসংখ্য মুখ। কেউ হাসছে, কেউ কাঁদছে, কেউ রক্তাক্ত। প্রতিটা মুখের চোখ একেবারে বাস্তবের মতো।
জয়ন্ত কাঁপা গলায় বলল, “এগুলো কি আসল মানুষ?”
অরিজিৎ তাকিয়ে রইল। “এরা হলো আঁকায় বন্দি আত্মা। প্রতিটা ছবির মানে একেকটা ঘটনা।”
সভাঘর
ভেতরে এগোতেই তারা পৌঁছল এক বিশাল হলঘরে। ভেতরে আলো কম, কিন্তু দেখা যাচ্ছিল কয়েক ডজন মানুষ—কালো কোট পরে, মুখ ঢাকা। তাদের সামনে রাখা বিশাল স্কেচপ্যাড, আর মাঝখানে এক টেবিলে রাখা কয়েকশো কালি ভর্তি বোতল।
সবাই যেন সম্মোহনের মতো ছবি আঁকছে। যে আঁকা শেষ করছে, হঠাৎ কোথাও একটা ঘটনা ঘটছে—কোথাও অগ্নিকাণ্ড, কোথাও রক্তপাত।
অরিজিৎ আর জয়ন্ত স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল। এ এক ভয়ঙ্কর কারখানা—যেখানে কালি দিয়ে বাস্তব বানানো হচ্ছে।
ঠিক তখনই পেছন থেকে কণ্ঠস্বর এল—
“স্বাগতম, অরিজিৎ। আমরা জানতাম তুমি আসবে।”
মুখোমুখি
অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলো সেই লম্বা কালো কোটওলা লোক। ঠোঁটে বাঁকা হাসি, চোখে শূন্যতা। এবার তার পাশে আরও কয়েকজন, হয়তো সংগঠনের নেতারা।
“তুমি অনেক শক্তিশালী,” লোকটা বলল। “তুমি আমাদের নতুন লেখক। তোমার আঁকা দিয়ে আমরা শহরকে নতুন রূপ দেব। পুরোনো শক্তি শেষ হয়েছে, এবার তোমার পালা।”
অরিজিৎ দাঁত চেপে বলল, “আমি তোমাদের হাতিয়ার হব না।”
লোকটা হাসল। “তুমি ইতিমধ্যেই আমাদের অংশ। তোমার রক্তে কালি ঢুকে গেছে।”
জয়ন্ত এগিয়ে এল। “কিন্তু ও যদি না চায়?”
লোকটা চোখ ফিরিয়ে তাকাল জয়ন্তর দিকে। “তাহলে সে ধ্বংস হবে। আর তুইও।”
প্রতিরোধ
অরিজিৎ স্কেচবুক বের করল। “আমি তোমাদের নিয়ন্ত্রণ মানি না। আমার আঁকা দিয়ে আমি তোমাদের শেষ করব।”
লোকটা হাত তুলে সংকেত দিল। সঙ্গে সঙ্গে হলঘরে বসা আঁকিয়েরা একসাথে আঁকা শুরু করল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ঘরের কোণে আগুন, ধোঁয়া, আর ছায়ামূর্তি দেখা দিল। বাস্তব যেন কালি হয়ে তাদের ঘিরে ধরল।
অরিজিৎ তাড়াতাড়ি পাতায় কয়েকটা রেখা টানল। সে আঁকল এক বিশাল ঢেউ। আঁকা শেষ হতেই আগুনের ওপর দিয়ে ছুটে এলো জল, ধোঁয়া ভিজিয়ে দিল।
লোকটা হেসে উঠল। “দেখলে? তুমি আমাদের নিয়ম মেনে খেলছ।”
অরিজিৎ দাঁত চেপে বলল, “না। আমি নিয়ম ভাঙতে শিখেছি।”
সে দ্রুত আঁকল এক ফাঁকা মুখ। চোখ নেই, ঠোঁট নেই। হঠাৎ হলঘরের অনেক আঁকিয়ের হাত থেমে গেল। তাদের মুখ থেকে কালি গলগল করে বেরোতে লাগল, চোখ ফাঁকা হয়ে গেল। যেন ফাঁকা মুখ আঁকা তাদের জীবন শুষে নিচ্ছে।
হলঘর ভরে গেল চিৎকারে।
আসল সত্য
লোকটা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “তুই বুঝলি না, অরিজিৎ। এ শহর অনেক আগে থেকেই আমাদের। প্রতিটা শিল্পীকে আমরা ব্যবহার করেছি। তুই শুধু শেষের মানুষ। কালি শেষ হলে তুই-ও শেষ।”
অরিজিৎ গর্জে উঠল, “তাহলে আমি এ কালিকে আমার নিয়মে ব্যবহার করব।”
সে পাতায় এক বিশাল আয়না আঁকল। মুহূর্তের মধ্যে হলঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেল এক বিশাল আয়না। তাতে প্রতিফলিত হলো সব কালো কোটওলা লোকের আসল মুখ—হাড় জিরজিরে, চোখ ফাঁকা, ঠোঁট বিকৃত।
আঁকিয়েরা ভয়ে আঁকতে পারল না। অনেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
লোকটা হাহাকার করে উঠল। “তুই থামাতে পারবি না… কালি তোর ভেতরেই!”
পলায়ন
ঠিক তখনই হলঘরে আলো নিভে গেল। ভেতরটা অন্ধকার, শুধু কালির গন্ধ। অরিজিৎ জয়ন্তর হাত ধরে দৌড়ে বেরিয়ে এল। করিডোরের দেয়াল থেকে আঁকা মুখগুলো ফিসফিস করছিল, “তুই পারবি না… তুই পারবি না…”
শেষমেশ বাইরে বেরিয়ে তারা হাঁপাতে লাগল। আকাশে বজ্রপাত, কিন্তু বৃষ্টি নামেনি।
জয়ন্ত কাঁপা গলায় বলল, “তুই ওদের আসল রূপ দেখেছিস। কিন্তু এভাবে থামানো যাবে না। ওরা এখনো বেঁচে আছে।”
অরিজিৎ মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ। শেষ লড়াই বাকি। আমাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ শিখতে হবে। নাহলে আমি-ই কালি হয়ে যাব।”
শেষের আহ্বান
হঠাৎ তার স্কেচবুক নিজে থেকেই খুলে গেল। পাতায় অদৃশ্যভাবে ফুটে উঠল এক শব্দ—
“আগামীকাল শেষ দিন।”
অরিজিৎ বইটা বুকে চেপে ধরল। তার চোখে জ্বলছিল এক নতুন আগুন।
“হ্যাঁ,” সে ফিসফিস করল। “শেষ দিন। এ শহর কালির হাতে যাবে না। আমি ওদের শেষ করব।”
আকাশে বজ্রপাতের আলোয় তার চোখ দুটো যেন সত্যিই কালো কালিতে ভরে উঠল।
পর্ব ১০: শেষ রেখা
আকাশ অন্ধকার, মেঘে ঢাকা। বজ্রপাতের শব্দে পুরো শহর কেঁপে উঠছিল। চারদিকে যেন অশুভ স্তব্ধতা। অরিজিৎ জানত—আজই শেষ দিন। সাত দিনের প্রতিশ্রুতি ফুরিয়েছে। কালি তার শরীরে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ কার হাতে হবে সেটা আজ স্থির হবে।
সে খাতাটা বুকে চেপে বসে ছিল। পাশে জয়ন্ত, চোখে উদ্বেগ। “তুই নিশ্চিত তো?”
অরিজিৎ শান্ত গলায় উত্তর দিল, “হ্যাঁ। পালানোর পথ নেই। ওদের শেষ করতে হবে। নইলে আমি-ই কালি হয়ে যাব।”
শহরের ওপর কালির ছায়া
হঠাৎ বাইরে অদ্ভুত আওয়াজ। শহরের নানা কোণ থেকে কালো ধোঁয়ার মতো কালি উঠতে লাগল। আকাশ যেন আঁকা রেখায় ভরে যাচ্ছে। রাস্তার মানুষ আতঙ্কে দৌড়াচ্ছে। ট্রামের গায়ে ফুটে উঠছে অদ্ভুত মুখ, বাড়ির দেয়ালে আঁকাগুলো জীবন্ত হয়ে যাচ্ছে। যেন পুরো শহর একটা বিশাল স্কেচবুকে পরিণত হয়েছে।
জয়ন্ত চিৎকার করে উঠল, “এরা পুরো শহর দখল করছে!”
অরিজিৎ দাঁড়াল। তার চোখে এবার দ্বিধা নেই। “না। শহরটা আমার ক্যানভাস। ওরা নয়।”
চূড়ান্ত মুখোমুখি
তারা পৌঁছল সেই গুদামঘরে, যেখানে আগেও সংগঠনকে দেখেছিল। এবার ভেতরে আলো জ্বলছে। শত শত আঁকিয়েরা বসে, কালো কালি দিয়ে আঁকছে। প্রত্যেক আঁকায় শহরের আরেকটা বিপর্যয় জন্ম নিচ্ছে—আগুন, বিস্ফোরণ, মৃত্যু।
মাঝখানে দাঁড়িয়ে সেই লম্বা কালো কোটওলা লোক। তার চারপাশে ধোঁয়ার ঘূর্ণি। সে গর্জে উঠল, “অরিজিৎ সেন, সময় শেষ। আজ তুমি আমাদের হাতে সমর্পিত হবে।”
অরিজিৎ খাতা খুলল। পাতার ওপর তার আঙুল কাঁপছিল, কিন্তু চোখ জ্বলছিল আগুনে। “আজ তোমাদের আঁকব আমি।”
শেষের আঁকাবাঁকা
সে এক আয়না আঁকল। মুহূর্তে হলঘরের মাঝখানে দাঁড়াল বিশাল আয়না। তাতে প্রতিফলিত হলো সব আঁকিয়ের মুখ—ক্লান্ত, বিকৃত, শূন্য। তারা আঁকা থামিয়ে ফেলল।
লোকটা হেসে উঠল। “তুই ভাবছিস আমাদের ভাঙতে পারবি? আমরা কালি, আর কালি অমর।”
অরিজিৎ দাঁত চেপে বলল, “না। কালি শুধু অস্ত্র নয়, কালি প্রতিরোধও।”
সে পাতায় আঁকল এক সূর্য। উজ্জ্বল, দহনকারী। ছবিটা ফুটে উঠতেই হলঘর আলোকিত হলো। আঁকিয়েরা চোখ ঢাকল, কালো ধোঁয়া মিলিয়ে গেল।
লোকটা চিৎকার করে উঠল। “তুই আগুন আনছিস? তুই আলো আনছিস?!”
অরিজিৎ গর্জে উঠল, “হ্যাঁ। আলোই হলো শেষ রেখা।”
আত্মত্যাগ
লোকটা হঠাৎ কালো ধোঁয়ায় মিলিয়ে এক বিশাল ছায়ারূপ নিল। তার চোখে শূন্যতা, হাতে অসংখ্য রেখা। পুরো হলঘর কাঁপতে লাগল।
অরিজিৎ জানল, শুধু আঁকায় তাকে হারানো যাবে না। তাকে নিজের কালি উৎসর্গ করতে হবে।
সে শেষ পাতায় নিজের মুখ আঁকল—চোখে আলো, ঠোঁটে দৃঢ়তা। তারপর সেই ছবিটা আঁকতে আঁকতে ফিসফিস করে বলল, “যদি আমি কালি হই, তবে আজ আমি শহরের জন্য কালি হব।”
পাতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অরিজিতের শরীর থেকে আলো বেরোতে লাগল। কালো কালি তার শিরা থেকে বেরিয়ে আয়নার ভেতরে আটকা পড়ল। ছায়ারূপ হাহাকার করে ধ্বংস হলো।
গুদামঘর ভেঙে পড়ল, কালো ধোঁয়া মিলিয়ে গেল। আঁকিয়েরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, মুক্তির মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
সমাপ্তি
কিছুক্ষণ পরে নিস্তব্ধতা। ধোঁয়া কেটে গেলে দেখা গেল—অরিজিৎ আর নেই। শুধু তার খাতা মাটিতে পড়ে আছে। শেষ পাতায় একটিমাত্র ছবি—এক সূর্য, চারদিকে আলো ছড়াচ্ছে।
জয়ন্ত খাতাটা তুলে নিল। চোখে জল গড়িয়ে পড়ল। সে ফিসফিস করে বলল, “তুই সত্যিই শহরকে রক্ষা করলি, বন্ধু।”
কয়েক সপ্তাহ পরে শহর আবার স্বাভাবিক হলো। দেয়ালের আঁকা মুখগুলো মিলিয়ে গেল। মানুষ ধীরে ধীরে ভুলে গেল এই ভয়ঙ্কর রাতগুলো।
কিন্তু জয়ন্ত ভুলল না। তার টেবিলে এখনো রাখা আছে অরিজিতের খাতা। প্রতিদিন সে খাতা খুলে দেখে, পাতাগুলো ফাঁকা।
শুধু মাঝে মাঝে, যখন ঘরে আলো কম থাকে, শেষ পাতার সূর্যটায় হালকা ঝিলিক দেখা যায়। আর দূর থেকে মনে হয়, কোনো অদৃশ্য কণ্ঠস্বর ফিসফিস করছে—
“আমি এখনো আছি। কালি শেষ হয় না, আলোও শেষ হয় না।”
***
				
	

	


