Bangla - নাটক

কালাপাহাড়ের ছায়া

Spread the love

সৌভিক রায়চৌধুরী


পর্ব ১

বর্ষার বিকেল। গৌড়ের আকাশে কেবলই মেঘ জমছে। দূরে বাজ পড়ে, নদীর ধারে শাল, সেগুন আর কদম গাছের পাতা ভিজে নেমে আসে। দূর থেকে দেখা যায়, নদী যেন আছড়ে পড়ছে নিজেই নিজের বুকের ওপর। সেই জলপথ ধরে ধেয়ে আসছে এক একলা ঘোড়সওয়ার—ঘোড়ার খুরের শব্দ ডুবে যাচ্ছে বৃষ্টির ছন্দে। তার মাথায় পাগড়ি, চোখে তীক্ষ্ণ ছায়া, কপালে গাঢ় চিন্তার রেখা। সে কালাপাহাড়, নবাব সুলেমান কররানির সেনাপতি। কিন্তু তার জন্মনাম ছিল রামপ্রসাদ। একদা হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান, আজ ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত চরিত্রদের এক—ভাঙন, রূপান্তর, এবং আগুনের প্রতীক। এই পথ আজ যুদ্ধের জন্য নয়। এই পথ আজ তাকে নিয়ে যাচ্ছে তার অতীতের কাছে, এমন এক নারীর কাছে, যার মুখ সে আজও কল্পনায় গড়ে তোলে কষ্টিপাথরে।

শ্রীমতি। যাকে সে একদিন ভালোবেসেছিল একান্তে, নীরবতায়, কেবল তার চোখের ভাষায়। তারা একসাথে বসে পিতার পাঠশালার পেছনের পুকুরঘাটে সন্ধে দেখত, কলাপাতায় মুড়ে পান্তাভাত খেত, মেঘের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন আঁকত। শ্রীমতির কণ্ঠে ছিল গঙ্গার ঘ্রাণ, তার হাঁটায় ছিল শঙ্খের ধ্বনি। কিন্তু সমাজের চোখে সে শুধু ছিল এক ব্রাহ্মণ কন্যা, যার সঙ্গে প্রেম মানে পাপ, ধর্মভ্রষ্টতা, এবং মৃত্যুর শাস্তি। একদিন, এক তর্কে সে বলেছিল, “কেন আমরা মূর্তিকে পুজো করি, যদি ঈশ্বর সর্বত্র?” সেই প্রশ্নই তার পতনের শুরু। গৃহ থেকে বিতাড়িত, সমাজ থেকে নির্বাসিত, পিতার অভিশাপে সে হয়ে উঠল এক ভাস্কর যার নিজের চিত্র আর কেউ আঁকতে চায় না।

তখনই সে পৌঁছেছিল নবাব সুলেমান কররানির দরবারে। কররানি তাকে জায়গা দিয়েছিলেন, সম্মান দিয়েছিলেন, নিজের ধর্ম দিয়েছিলেন। রামপ্রসাদ হয়ে উঠেছিল কালাপাহাড়—এক যোদ্ধা, যার হাতে খর্জুরগাছের মতো ভেঙে পড়েছে বহু মন্দির, যার নামে কাঁপে রাজপুরুষ, রাজপুরী, এবং রাজগুরু। ইতিহাস তাকে বলে ধর্মদ্রোহী, হিন্দুধর্মের শত্রু। কিন্তু সে নিজের চোখে দেখে নিজেকে শুধু একজন মানুষ, যে বিশ্বাস করেছে, ভাঙা ছাড়া নতুন সৃষ্টি হয় না।

আজ দশ বছর পর, এক শিষ্য তার কানে খবর দিয়েছিল—এক পাহাড়ি গ্রামে, নদীর ধারে এক প্রাচীন শৈব মন্দিরে থাকেন এক যোগিনী। গেরুয়া বসন পরিহিতা, নিরবতা যার ওড়না, স্তব যার ধ্বনি। কেউ জানে না তার নাম। কিন্তু সে জানে। অন্তর বলে—সে শ্রীমতি। তাই আজকের এই যাত্রা। আজকের এই বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যা তার পুরোনো জীবনের দরজায় ফিরে যাওয়ার দিন। তার ঘোড়া থামে একটি শালগাছের ছায়ায়। দূরে ধোঁয়ার মতন ভেসে ওঠে সেই মন্দির, যার শিখর এখনো আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখে। পাথরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে তার মনে পড়ে সেই দিনটা, যেদিন সে প্রথম শ্রীমতির কপালে চন্দন দিয়েছিল। তখন শ্রীমতি বলেছিল, “এই চিহ্ন কখনও মুছবে না।” অথচ এখন… এখন সে নিজেই এক শূন্যতার মূর্তি।

মন্দিরের চাতালে পৌঁছে দেখে, বাতি জ্বলছে না, কেবল ধূপের ধোঁয়া। ভেতরে একা বসে আছে এক নারী, মুখ ঢাকা, চোখ বন্ধ। স্তবের মাঝে কেবল একটি শব্দ—”মুক্তি”। কালাপাহাড় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সে জানে না কী বলবে। ‘ক্ষমা’ শব্দটা তার মুখে মানায় না, ‘ভালোবাসি’ শব্দটা এখন অনেক পুরোনো। তার ভিতরে যুদ্ধ চলে—যে রামপ্রসাদ ছিল, সে চিৎকার করে ফিরে আসতে চায়; আর যে কালাপাহাড় হয়ে উঠেছে, সে তাকে চাপা দিতে চায়। হঠাৎ নারীর চোখ খোলে। সেই চোখে নেই কোনো কাঁপন, নেই কোনো বিস্ময়, নেই কোনো প্রতিক্রিয়া। শুধু একটি দৃঢ় স্বর, যার মধ্যে ভয় নেই, প্রেম নেই, অভিমানও নেই—শুধু এক পরম দৃষ্টি।

“তুমি ফিরে এসেছো,” সে বলে।
“হ্যাঁ,” কালাপাহাড়ের ঠোঁটে শব্দ আসে কষ্টে।
“কেন?”
“জানার জন্য—তুমি কেমন আছো।”
“জীবনের সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে এসেছো, যা একদিন ছুঁড়ে দিয়েছিলে?”
কালাপাহাড় চুপ করে থাকে।
“তুমি আর আমি দুই পাড়ের দুই ধ্যান—তুমি ভাঙা চাও, আমি নির্মাণ। তুমি আগুন, আমি জল। আমরা এক হতে পারি না,” শ্রীমতির চোখে যেন শতাব্দীর ক্লান্তি।
“কিন্তু প্রেম?”
“প্রেম তো ছিল। এখন নেই। এখন শুধু বোধ।”
বাতাসে শঙ্খ বাজে দূরে কোথাও। কালাপাহাড় বুঝে যায়, এই যাত্রা তার নয়, এই মন্দির এখন আর তার শরণ নয়। সে ধীরে ঘুরে দাঁড়ায়।

হঠাৎ পিছন থেকে ভেসে আসে শব্দ—”তুমি যদি চাও, আমি একবার চোখে তাকাতে পারি। শেষবার।”

সে ঘুরে তাকায়। সেই চোখ—যার দিকে তাকিয়ে একদিন সে বিশ্বাস করেছিল, ঈশ্বরের রূপ মানুষের মধ্যেই বাস করে। এখন সে চোখ যেন এক আকাশ, যার কোনো তলা নেই। সেই দৃষ্টিতেই সে দেখে তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নের উত্তর।

তারপর, কোনো শব্দ না করে, কালাপাহাড় আবার ঘোড়ায় চড়ে। পিছনে পড়ে থাকে সেই মন্দির, সেই চোখ, আর এক ছায়ামূর্তি—যার নাম হয়তো ইতিহাসে লেখা থাকবে না, কিন্তু তার হৃদয়ে থাকবে চিরকাল।

পর্ব ২

ঘোড়ার খুরে জল ছিটিয়ে উঠছে—দূর, অন্ধকারে হারিয়ে যায় সেই শব্দ, যেমন করে শ্রীমতির চোখ হারিয়ে গিয়েছিল এক অদৃশ্য স্থিতির মধ্যে। কালাপাহাড় সেদিকে আর ফিরে তাকায় না। কারণ সে জানে, কিছু চোখের ভেতর একবার দেখলেই সমস্ত সঞ্চিত ধ্বংসের শক্তি ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। সে সেই চোখের সামনে দুর্বল হতে চায় না। চায় না, ইতিহাসের যোদ্ধা হয়ে প্রেমিকের অপমান সে নিজের কাঁধে বহন করুক।

সে একটানা ঘোড়া ছোটায় দক্ষিণ দিকে। বৃষ্টি থেমেছে, কিন্তু মাটির গন্ধ এখনো ভারী। পথজুড়ে জল কাদা আর ছেঁড়া পল্লব। রাত বাড়ে। মাথার ওপরে কেবল গাঢ় আকাশ, মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ এসে দেখিয়ে দিয়ে যায়, এই বাংলার ভূমি ঠিক কতটা কোমল আবার কতটা নৃশংস হতে পারে।

কিন্তু তার মনে শান্তি নেই। অস্থিরতা, প্রশ্ন আর স্মৃতির ভিড়ে দম বন্ধ হয়ে আসে। এই পনেরো বছরে সে কত মন্দির ভেঙেছে! বাঁশবন, গাছতলা, নদীর কূলে বসে প্রাচীন যে দেবতাদের গড়ে তুলেছিল তার পূর্বপুরুষেরা, তাদের চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছে নিজের হাতে। অথচ আজ মনে হয়, সে যেন তার নিজেরই কিছু ভেঙে ফেলেছে—একটা অলিখিত আত্মা, যাকে সে লুকিয়ে রেখেছিল ইতিহাসের পাতায়।

কালাপাহাড় থামে এক পুরনো সড়কে, যেখানে আগে ছিল একটি হাট। এখন ভগ্ন মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট নদী। সেখানে বসে থাকা একজন বৃদ্ধ ভিক্ষুক, যার চোখে চামড়ার মতো পাতা, মুখে দীর্ঘ দাঁড়ি। বৃদ্ধ তাকায় না, বলে—”কালাপাহাড়?”

সে চমকে ওঠে। “তুমি চেনো আমাকে?”

“চিনি না, তবে বাতাস চেনে। নদীর শব্দ চেনে। তারা বলছে, তুই এখানে ফিরবি।”

কালাপাহাড় বসে পড়ে কাদামাটিতে। “বৃদ্ধ, তুমি কি জানো, আমি কী খুঁজছি?”

“প্রশ্ন।” উত্তর আসে সহজ ভাষায়।

“না, আমি উত্তর খুঁজছি।”

বৃদ্ধ হেসে বলে, “একই তো কথা। যারা সত্যিকারের প্রশ্ন করতে পারে, তারাই উত্তর পায়। বাকিরা শুধু যুদ্ধ করে।”

বাতাস থেমে যায়। দূরের শালবনে পাখিরা নড়েচড়ে ওঠে। কালাপাহাড়ের চোখ বুজে আসে। কিছুক্ষণ কেবল স্তব্ধতা। হঠাৎ বৃদ্ধ আবার বলে ওঠে, “তুই একটা পথ বেছে নিয়েছিস, যেটা কেউ নেয় না। না মুসলমান, না হিন্দু—তুই দুইয়ের বাইরে এক জ্বালামুখ। আগুন যা দেবে, তা আলো নয়, ছাই।”

“তবু আমি সেই আগুনে হাঁটছি,” কালাপাহাড় জবাব দেয়, “কারণ আমি চাই, কেউ আর ঠাকুরঘরে জন্মে বিদ্বেষ না পাক। কেউ আর ভালোবাসার জন্য সমাজচ্যুত না হোক। কেউ আর পাথরের মূর্তিকে ভালোবেসে মানুষকে ঘৃণা না করুক।”

“তুই যা চাইছিস, সেটা ঈশ্বরও চায় না।” বৃদ্ধ ফিসফিস করে।

কালাপাহাড় উঠে দাঁড়ায়। বুকের ভেতরে আগুন পুড়ে যায়। সে বুঝে, কেউ তাকে বুঝবে না—না ইতিহাস, না ঈশ্বর, না মানুষ। তার এই পথ নিজস্ব, একা, রক্ত ও বিশ্বাসে গড়া। সে হাঁটে সেই নদীর ধার ধরে, যাতে তার প্রতিফলনে নিজেকে দেখতে না হয়। কারণ সে জানে, এখন তার চোখে ঈশ্বর নেই—আছে কেবল প্রতিশোধের ধ্বংসস্তূপ।

সকাল হয়। এক নতুন গ্রামে পৌঁছায় সে—নাম চিহ্নহীন। পাহাড়ের নিচে কিছু কুঁড়েঘর, ধানের মাঠ, আর এক প্রাচীন শিবমন্দির। এই মন্দির এখনো অক্ষত। জনশ্রুতি আছে, এই মন্দির রক্ষা পায় কারণ এক নারী নাকি নিজেকে উৎসর্গ করেছিল দেবতার রক্ষায়। কালাপাহাড় এই গল্প শুনেছে বহুবার। কিন্তু এবার, এবার সে ভাঙতে চায় না।

সে দাঁড়িয়ে থাকে সেই মন্দিরের সামনে, মাটির মন্দির, যার গায়ে খোদাই আছে—নারীর নাচ, গানের দৃশ্য, প্রেম আর প্রার্থনা। তার ভেতরে একটি বিরাট শিবলিঙ্গ। পাথরের উপরে কিছু পায়রার পালক, কিছু সুগন্ধি ফুল শুকিয়ে আছে। কেউ একজন এখনো প্রতিদিন পূজা দেয়।

ঠিক তখনই সে দেখে, এক তরুণী আসছে হাতে প্রদীপ নিয়ে। পরনে সাদা শাড়ি, মুখ ঢাকা, কিন্তু চোখজোড়া প্রবল। সে আসে, প্রদীপ রাখে, জল ঢালে শিবলিঙ্গে, এবং পায়ে এক ফোঁটা কাঁদা লেগে গেলেও থামে না। কালাপাহাড় চুপচাপ তাকিয়ে থাকে।

হঠাৎ মেয়েটি তার দিকে ফিরে বলে, “আপনি ভেঙে দেবেন না তো?”

“না,” কালাপাহাড় বলে, “আজ আমি কিছু ভাঙতে আসিনি।”

“তবে কেন এসেছেন?” মেয়েটির প্রশ্ন।

“দেখতে—যা আমি ভাঙিনি, তা এখনো টিকে আছে কিনা।”

তরুণী মাথা নিচু করে বলে, “ভালোবাসা কখনো ভাঙে না। শুধু রূপ বদলায়।”

কালাপাহাড় চুপ করে থাকে।

“আপনি কি সেই কালাপাহাড়?” মেয়েটি জানতে চায়।

সে মাথা নেড়ে বলে, “আমি সেই মানুষ, যাকে সবাই ভয় পায়। অথচ আমি নিজেকে যতবার ভেঙেছি, অন্যদের সেই সুযোগই দিইনি।”

“তাহলে আজ একবার নিজেকে ক্ষমা করুন,” মেয়েটি বলে, “তবেই হয়তো আপনি শ্রীমতির চোখ ভুলতে পারবেন।”

এই নাম শুনেই তার ভিতরে যেন বজ্রপাত হয়। সে উঠে দাঁড়ায়। “তুমি কে?”

“একজন যার গল্প ইতিহাসে নেই, কিন্তু যাদের চোখে তুমি লেখা আছো।”

কালাপাহাড় সেদিন আর কিছু বলে না। সে রাতটা কাটায় সেই মন্দিরের পাশে। জোনাকির আলোয় সেই মন্দির যেন কোনো যুদ্ধ চায় না। চায় শুধু শান্তি।

পরদিন সকালে, সে এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নেয়। এবার সে উত্তর বাংলার দিকে যাবে—তথাকথিত সেই মন্দির-পথের বিপরীতে, যেখানে তার নাম লিখে রাখা আছে এক দানব হিসেবে। সে নিজেকে এবার প্রশ্ন করতে চায়, ভাঙা আর গড়ার মাঝখানে সত্যি কেউ বাঁচে কিনা।

পর্ব ৩

উত্তরবাংলার দিকে যাওয়ার পথে, কালাপাহাড় থামল এক জনমানবহীন গ্রামে—নাম শ্মশানপুর। কখনো এখানে শ’খানেক পরিবার ছিল, এখন কেবল গাছের ফাঁকে ভেঙে পড়া কুঁড়েঘর আর পুরনো কুপ। বাতাসে মৃত ফুলের গন্ধ, আর কোথাও কোথাও ছেঁড়া ওড়না, কাদায় গড়িয়ে পড়া পুরোনো পুতুল—সব যেন অতীতের কোনো কান্নার কাটা টুকরো। ঘোড়া হাঁটছিল ধীরে, যেন এই নির্জনতাকে সম্মান জানাতে চায়। কালাপাহাড় নেমে পড়ল। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছল এক পোড়া মন্দিরের কাছে। সে জানে না কবে পুড়েছে, কে পুড়িয়েছে। কিন্তু পাথরের গায়ে লেখা খোদাই আজও জেগে আছে—‘শ্রীশ্রী বসন্তেশ্বর মহাদেব’। শিলালিপিতে হাত বোলাল কালাপাহাড়। ঠান্ডা পাথরে যেন এক সময়ের আগুন এখনো জমে আছে।

কিন্তু ঠিক সেই সময়, পিছন থেকে এক ছেলেমেয়ের হাসির শব্দ ভেসে এল। চমকে ঘুরল সে। দূরে, একটা বটগাছের নিচে, এক জীর্ণ চোঙা হাতে এক বৃদ্ধ গান ধরেছে—
“তোমার নাম যে কেউ রাখেনি,
তবু তুমি ছুঁয়ে আছো।”

কালাপাহাড় এগিয়ে গেল। “তুমি এই ধ্বংসাবশেষে কী করছো?”

বৃদ্ধ কাঁপা গলায় হেসে বলল, “আমিই তো এই ধ্বংসাবশেষ।”

“তুমি এখানে থাকো একা?”

“না, আমি থাকি আমার ছায়া আর স্মৃতির সঙ্গে।”

“এই গ্রাম কি তুই পুড়িয়েছিস?” বৃদ্ধের চোখে দৃষ্টি।

কালাপাহাড় কিছু বলে না। মাথা নিচু করে।

বৃদ্ধ চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, “আমার মেয়ে ছিল। নাম ছিল দময়ন্তী। সে গান গাইত, সকাল হলে বউ-ঝিদের সঙ্গে নদীতে যেত, শিবরাত্রির রাতে উপবাস করত। তুমি যখন এসেছিলে, সে তখন ফুল সাজাচ্ছিল দেবতার চরণে। তারপর কী হয়েছিল জানি না—শুধু দেখি মন্দিরে আগুন, মাটি কাঁদে, আর সেই থেকে এই গ্রাম নাম নেয়—শ্মশানপুর।”

কালাপাহাড়ের গলা শুকিয়ে আসে। বহু বছর ধরে বহু মন্দির ভেঙেছে সে, বহু গ্রাম জ্বালিয়েছে—ধর্মের নামে, আদর্শের নামে, অথবা নিছক প্রতিশোধের নামে। কিন্তু প্রতিটি আগুনের মধ্যেই কোনো দময়ন্তীর চুল পুড়েছে, কোনো শিশুর কৌতূহল মরে গেছে, কোনো মা তার ছেলেকে খুঁজে ফিরে গেছে এক জীবনের জন্য।

“আমি,” সে বলে, “তোমার মেয়েকে খুঁজে পাইনি। কিন্তু আমি খুঁজে পাই আমার নিজের মৃত্যুকে, প্রতিটি শ্মশানে।”

“তোমার ভেতর কি কিছু বেঁচে আছে?” বৃদ্ধ প্রশ্ন করে।

“না। আমি এখন কেবল ছায়া। এমন ছায়া, যে আলো ছুঁতে ভয় পায়।”

বৃদ্ধ বলে, “তবে বসো, আমি তোমার জন্য ভাত রেঁধেছি।”

কালাপাহাড় চমকে যায়। “তুমি জানো আমি কে?”

“জানি। তবু রেঁধেছি। কারণ আমার ক্ষুধা নেই, কিন্তু তোমার আছে। পেটেরও, হৃদয়েরও।”

এক পুঁথির পাতার মতো নিঃশব্দে সন্ধ্যা নামে। মাটির চুলায় ধোঁয়া উঠছে। কালাপাহাড় বসে পড়ে, একটি পাথরের উপর। বৃদ্ধ নিয়ে আসে খড়ের পাতায় ভাত, মুগডাল আর বেগুনভাজা। অদ্ভুত—এই মানুষটার হাতে কোনো ঘৃণা নেই, কোনো অভিমানও নেই। কেবল এক পিতার শান্তি, যে বিশ্বাস করে, যা হারিয়েছে তা কখনোই পুরোপুরি হারায় না—জন্ম নেয় অন্য কোথাও, অন্য নামে।

ভাত খেতে খেতে কালাপাহাড় জিজ্ঞেস করে, “তুমি এখানে থেকো কেন? চলে যাওনি কেন অন্য কোথাও?”

“এই মাটিতে আমি মেয়ের হাঁটুর দাগ দেখেছি। ওর গলার সুর শোনা যায় রাতে। আমি কোথায় যাব বলো?”

একটা নিঃশ্বাস পড়ে ঘরের ভিতর। বাতাসে হঠাৎ শিবস্তুতির মতো কোনো গানের সুর ভেসে আসে—অদূরে, ভাঙা মন্দিরের দিক থেকে। কালাপাহাড় উঠে দাঁড়ায়। “এই গান?”

বৃদ্ধ কাঁপা গলায় বলে, “ও আমার মেয়ে নয়, তবে তার মতন। সে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আসে, গান গায়, ফুল দেয়, তারপর চলে যায়।”

কালাপাহাড় ধীরে ধীরে এগোয় সেই গানের দিকে। অন্ধকারে দেখা যায়, এক ছায়ামূর্তি বসে আছে ভাঙা সিঁড়িতে। হাতে খোলা পুঁথি, ঠোঁটে স্তব, গলায় কুসুমমালা। আলো নেই, তবু চোখদুটো স্পষ্ট জ্বলজ্বল করে। সে থামে না, তাকায় না, গাইতে থাকে। কালাপাহাড় তার পাশে বসে। একসময় গান থেমে যায়।

“তুমি কে?” জিজ্ঞেস করে সে।

“একটা নাম কি চাই?”

“তুমি শ্রীমতি নও, তবে তারই মতন।”

“আমি দময়ন্তী নই, কিন্তু আমি সেই গান, যা ভাঙা ঘরের মধ্যে থেকেও জীবিত।”

কালাপাহাড় চুপ করে থাকে। দীর্ঘ সময়, কোনো শব্দ নেই। তারপর সে ফিসফিস করে, “তুমি ঘৃণা করো না আমাকে?”

“আমি তোমার মধ্যে ভয় দেখি, বিদ্বেষ না।”

“তবে আমি যে…”

“তুমি যা করেছো, সেটা হয়তো ভুল। কিন্তু তুমি এখন যা করছো, সেটা কি ঠিক নয়?”

কালাপাহাড় উত্তর দিতে পারে না। তার ভিতরে ঝড় ওঠে—ভাষাহীন ঝড়, যা কেবল স্রোতের মতো নিজেকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। অনেক বছর পর আজ সে চিৎকার করতে ইচ্ছা করে, কাঁদতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সে জানে না, কার সামনে কাঁদবে।

“আমার কি মুক্তি আছে?” সে জিজ্ঞেস করে।

“মুক্তি কোনো পূজায় নয়, কোনো ধর্মে নয়। মুক্তি আছে ক্ষমায়। অন্যকে নয়—নিজেকে ক্ষমা করতে শেখো।”

সেই রাতে, কালাপাহাড় ঘুমায় না। পাথরে মাথা রেখে সে শোনে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে মন্দিরের ছাদে। যেন দেবতারা কাঁদছে না, গান গাইছে।

শ্মশানপুরের রাত তাকে বলে—ভাঙা জায়গা থেকেই শুরু হয় নতুন গাঁথা।

পর্ব ৪

সকালের আলো উঠতেই শ্মশানপুরের নিস্তব্ধতা খানিকটা নড়ে ওঠে। কালাপাহাড় চোখ মেলে দেখে, তার পাশের ঘর ফাঁকা। সেই গান-গাওয়া মেয়েটি নেই। বাতাসে থাকে কেবল শুকনো ধূপের গন্ধ আর রাতের ভেজা মাটি। বাড়ির উঠোনে বৃদ্ধ তখনো বসে, হাতে একখণ্ড কাঠ, যা সে ঘষে ঘষে আগুন তোলার চেষ্টা করছে। সেই দৃশ্যটা বড় পরিচিত—কোনো এক জন্মে, কোনো এক সকালে, কালাপাহাড় নিজেও এমন কাঠ ঘষেছিল, দেবতার পূজার জন্য প্রদীপ জ্বালাতে চেয়েছিল। এখন আর কোনো প্রদীপ নেই, এখন শুধু ধোঁয়া।

“তুমি চলে যাচ্ছো?” বৃদ্ধ তার দিকে না তাকিয়ে প্রশ্ন করে।

“হ্যাঁ,” কালাপাহাড় উত্তর দেয়, “এই জায়গা থেকে আমার কিছু পাওয়ার নেই, শুধু শাস্তি আছে।”

“সব শাস্তি কি কাউকে ভেঙে দেয়? কখনো কখনো শাস্তিই তো মানুষকে চিনিয়ে দেয় নিজেকে।”

কালাপাহাড় মাথা নিচু করে ঘোড়ায় ওঠে। তার চোখের নিচে গাঢ় কালি, আর ঠোঁটের কোনে জমে থাকা নীরবতা। শ্মশানপুরকে পেছনে রেখে সে আবার পথ ধরে, এবার উত্তর বাংলার দিকে। এই যাত্রা নিছক ভ্রমণ নয়, এটা আত্মা খোঁজার চেষ্টা। সে খুঁজছে সেই দগ্ধ মানুষের মুখ, যাদের ধ্বংস তার নামে লেখা আছে। সে খুঁজছে এমন কারো চোখ, যারা ভয়ে পালিয়ে যায়নি, বরং দাঁড়িয়েছিল তার সামনে অশ্রু ছাড়া।

দুপুর নাগাদ সে পৌঁছায় রাজগঞ্জের ঘন পল্লীতে। এই অঞ্চল ছিল একসময় চণ্ডীমন্দিরের জন্য বিখ্যাত। কথিত আছে, এই মন্দিরে একসময় মা চণ্ডীর প্রাচীন মূর্তি ছিল—লাল কষ্টিপাথরে খোদাই করা, এমন এক রূপ যার দিকে তাকালে মানুষ ভয়েও কাঁপত, ভক্তিতেও। কিন্তু বহু বছর আগেই সেই মূর্তি নাকি হঠাৎ হারিয়ে যায়—কে নিয়েছে, কেউ জানে না। কেউ বলে, কালাপাহাড়ই ভেঙেছিল, কেউ বলে, নিজেই গায়েব হয়ে গিয়েছিল মা।

এই জায়গা তাকে স্বাগত জানায় না। সে গ্রামে ঢুকতেই কয়েকজন যুবক ছুটে যায় বাড়ির ভিতর, বুড়োরা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে—না ঘৃণা, না আতঙ্ক, কেবল এক বঞ্চিত প্রত্যাহারের দৃষ্টি। এমন দৃষ্টি কালাপাহাড় বহুবার দেখেছে—জীবনের প্রতিটি ধ্বংসের পরে, এই দৃষ্টি এসে চুপচাপ বুকের মধ্যে কাঁটা বসিয়েছে।

সে থামে চণ্ডীমন্দিরের ভগ্নপ্রায় দ্বারে। মাটির উপরে ধুলো, দরজায় তালা। সে হাত দিয়ে ছোঁয় সেই তালা, কিন্তু খোলে না। এমন সময় এক কিশোর আসে তার পাশে দাঁড়িয়ে বলে, “তুমি যদি চাও, আমি চাবি দিতে পারি।”

কালাপাহাড় তাকায় ছেলেটির দিকে। “তুমি আমাকে চেনো?”

“চিনি না। কিন্তু দাদু বলতেন, একদিন একটা মানুষ আসবে, যে এই মন্দিরের ভেতরে যেতে চাইবে। চাবিটা আমরা রেখে দিয়েছি অনেকদিন ধরে—কারণ বিশ্বাস করি, ভাঙা কিছু নিজেই কখনো নিজেকে সারায় না। তাকে ফিরিয়ে আনতে হয়।”

কালাপাহাড় হতবাক। সে চাবি নেয়। দরজা খোলে। ভিতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সে এক অদ্ভুত গন্ধ পায়—কিছু পচা ফুল, কিছু পুরোনো ধূপ, আর যেন এক ভয় আর ভক্তির মিশ্র গন্ধ। মন্দিরের ভিতরে মা চণ্ডীর কোনো মূর্তি নেই। কেবল এক খালি চৌকি, যার উপরে কুসুমমালা শুকিয়ে আছে। পাশে রাখা একটা পুরোনো ঝাঁপিতে কিছু কাঁচা সিঁদুর, ঘুঁটে আর তুলসীপাতা।

তবে মাটিতে আঁচড়ের দাগ দেখা যায়—জানলা দিয়ে আলো এসে সেই দাগে আলতোভাবে পড়ে যেন বলতে থাকে, “এখানে কেউ ছিল, আর কেউ থাকবে।”

হঠাৎ একটা শব্দ হয়—ধরফড়। কালাপাহাড় ছায়ার মত ঘুরে দাঁড়ায়। দেখল, এক মধ্যবয়স্ক নারী ঢুকছে। পরনে হালকা সাদা কাপড়, চোখে নির্ভীক দৃষ্টি। সে বলে, “তুমি কালাপাহাড়, তাই তো?”

সে উত্তর দেয় না।

“তুমি জানো, এই মন্দিরে আমি পুজো দিই প্রতি বৃহস্পতিবার। মা নেই, তবু আমি দাঁড়িয়ে থাকি তাঁর সামনে। কারণ ঈশ্বর সব সময় মূর্তির মধ্যে থাকেন না, থাকেন কারও সাহসে। তুমি সাহস পাবে একদিন?”

“তুমি কি আমাকে ঘৃণা করো না?” কালাপাহাড় ফিসফিস করে।

“আমি ঘৃণা করতে শিখিনি। ঘৃণা করলে তো মানুষ হয়ে যাই তোমার মতো। আমি নারী, আমি পাথর ঠেলে বের হওয়া জল—আমি ক্ষমা করতে জানি।”

তার ভিতরে একটা কিছু যেন চিৎকার করে উঠে। এই নারী কোনো মহাপুরুষ নয়, কোনো ইতিহাসের পৃষ্ঠা নয়—তবু তার মুখে যে শান্তি, তা একশো ধর্মগ্রন্থের থেকেও গভীর। কালাপাহাড় চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন এই মুহূর্তটিকে চিরকালের জন্য নিজের মধ্যে ভরে রাখে।

“তুমি কী চাও?” সে জিজ্ঞেস করে।

“তুমি আবার গড়ো—ভেঙেছ অনেক, এবার তৈরি করো। একটা গল্প গড়ো, যেখানে ঈশ্বরও কাঁদে মানুষের সঙ্গে।”

সন্ধে নামে ধীরে ধীরে। দূরে বাজ পড়ে। মেঘ জমে মাথার উপর। কিন্তু এবার কালাপাহাড় সেই মেঘকে ভয় পায় না। সে জানে, এই পৃথিবীতে এখনও কিছু মানুষ আছে যারা তার নাম শুনে পিছিয়ে যায় না, বরং সামনে এসে দাঁড়ায়—চোখে জল, কিন্তু কণ্ঠে শঙ্খ।

সে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে বেরোয়। হাতে চাবিটা ধরে। পেছনে সেই নারী বলে ওঠে, “তুমি শ্রীমতিকে খুঁজছো এখনো?”

কালাপাহাড় থমকে দাঁড়ায়।

“তুমি কি জানো কিছু?”

“আমি জানি, কেউ একজনে রোজ সন্ধ্যায় পাথরের পাশে বসে অপেক্ষা করে—তুমি তাকে কি দেবে? প্রতিশোধ, নাকি ক্ষমা?”

কালাপাহাড় চুপ করে থাকে। তার ভিতরে পাথর নড়ে ওঠে, আর জলে পড়ে সেই পুরোনো ছায়া—একটা মেয়ে, যার চোখ ছিল নদীর মতো।

পর্ব ৫

পিছনে চণ্ডীমন্দিরের ধ্বংসস্তূপ, সামনে অজানা পথ। কালাপাহাড় এবার হাঁটছে পায়ে, ঘোড়াকে ছেড়ে দিয়েছে খোলা প্রান্তরে। সে চায় হেঁটে যেতে—মাটির ধুলোয় পা পড়ুক, শরীরে লাগুক বাতাস, ঘাম আর ক্লান্তিতে সে যেন বুঝতে পারে—একটা জীবনের ওজন কেমন হয়। বহু যুদ্ধজয়ের পর তার কাঁধে যে ভার জমে উঠেছে, তা এখন রক্তের নয়, স্মৃতির।

সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে, রাত নামে ধীরে। উত্তর বাংলার সীমান্তে এক জলা অঞ্চল—ডুয়ার্সের প্রান্তে, ছোট একটি গ্রাম যার নাম কেউ উচ্চারণ করে না, শুধু বলে “অন্তর্জল”। স্থানীয় লোককথা বলে, এই গ্রামে কেউ একবার এলে সহজে ফিরে যেতে পারে না। কোনো এক নদী এখানে এসে পথ হারিয়ে ফেলেছিল একদিন, আর সেই জলের গভীরে ডুবে গেছে কত মানুষের নাম, ইতিহাস আর কান্না।

কালাপাহাড় সেই গ্রামের প্রবেশদ্বারে পৌঁছায় ঠিক এমনই এক ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে। নদীর পাশ দিয়ে কাঁচা রাস্তা, দুপাশে ঘন বন। পায়ে পায়ে সে হাঁটে, আর হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যায় পুরোনো সেই দৃষ্টিগুলো—শ্রীমতির চোখ, সেই মেয়েটি যার নাম জানা যায় না, শ্মশানপুরের ধ্বংসস্তূপ, কিংবা চণ্ডীমন্দিরের নির্ভীক পুজারিনী।

অন্তর্জল গ্রামে ঢুকতেই সে এক অদ্ভুত সুর শুনতে পায়—না গান, না আর্তনাদ, কিছু একটা মাঝখানে ঝুলে থাকা কণ্ঠস্বর। যেন পাথরের নিচ থেকে কেউ ডাকছে, অথবা বাতাসে জলরাশি গুনগুন করছে বিস্মৃত কোনো স্তোত্র। গ্রামের একপ্রান্তে জোড়ামাঠ, যার পাশে এক ঝাঁপসা পুকুর। তার ধারেই বসে আছে একজন নারী—অন্ধকারে মুখ দেখা যায় না, তবে চুল খোলা, কাঁধে ধুলো, আর কপালে কিঞ্চিৎ আলোর রেখা।

কালাপাহাড় ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়।

“তুমি জানো, এই জল কাদের কাঁদা?” নারীর কণ্ঠ শীতল।

সে কিছু বলে না।

“এই জলের নিচে পাথর চাপা আছে, আর সেই পাথরের নিচে মানুষ। তোমার মতো মানুষেরা যারা এসেছিল ইতিহাস হাতে, অথচ রেখে গিয়েছিল ছায়া।”

কালাপাহাড় থেমে যায়।

“তুমি কি সেই কালাপাহাড়?” নারী এবার ফিরে তাকায়। চোখে ভয় নেই, বরং কৌতূহল।

“আমি সেই মানুষ,” সে বলে, “যাকে সবাই চেনে এক নামে, অথচ কেউ চেনে না আসলে কে ছিল সে।”

নারী চুপ করে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, “তুমি কি বিশ্বাস করো, মানুষ বদলাতে পারে?”

“আমি এখন বিশ্বাস করতে চাই,” কালাপাহাড় বলে।

“তাহলে শোনো,” নারী বলে, “এই অন্তর্জল গ্রামের পুকুরের জল সরল নয়। এখানে যখন কেউ নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে, তখন সে দেখে তার সবচেয়ে গভীর ভয়, তার সবচেয়ে সত্যিকারের রূপ। তুমি যদি সাহস রাখো, তাহলে এই পুকুরে মুখ ডুবাও। দেখো, কে তুমি আসলে।”

কালাপাহাড় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তার শরীর ভারী হয়ে আসে। মনের ভিতরে ঝড় ওঠে—কী দেখতে পাবে সে? রক্তমাখা হাত, চোখে জ্বালা, না কি সেই বালকের মুখ যে একদিন শঙ্খ বাজিয়ে স্নানঘাটে মন্ত্র বলত?

সে হাঁটে, ধীরে পুকুরের ধারে যায়। জলের ওপর জোছনার আলো পড়ে ছড়িয়ে আছে। সে হাঁটু গেড়ে বসে। তার দুই হাত কাঁপে। তারপর সে চোখ বন্ধ করে, মুখ ডুবিয়ে দেয় জলে।

এক মুহূর্ত—তারপর সমস্ত কিছুর স্তব্ধতা।

সে দেখে, ভেসে উঠছে একের পর এক মুখ—শ্রীমতির, তার পিতার, সেই বৃদ্ধের, সেই নামহীন কিশোরীর, সেই পুজারিণীর—সবার চোখে একই প্রশ্ন—”তুমি কেন?” তারপরে সে দেখে এক শিশুর মুখ, যার গালে কালি, চোখে বিস্ময়—আর সেই মুখ হঠাৎই তার নিজের মতো হয়ে ওঠে। রামপ্রসাদ। সেই ছেলেটি, যে মাটির মূর্তি গড়ত, যে একদিন ঈশ্বরকে বুঝতে চেয়েছিল নিজের মতো করে।

জল থেকে মাথা তোলে কালাপাহাড়। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তার চোখে জল। সে বুঝে যায়—সে মানুষ ছিল, মানুষ আছে, আর মানুষ থাকবেই। ধর্ম, বিশ্বাস, ক্ষমতা—সব কিছুর ভিতরে একটাই সত্য আছে—ভয় আর ভালোবাসা।

“তুমি কী দেখলে?” নারী জিজ্ঞেস করে।

“আমি দেখেছি নিজেকে,” সে বলে, “যাকে এত বছর আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম—মৃত্যুর আড়ালে, যুদ্ধের পেছনে, ইতিহাসের শব্দে।”

“তুমি তাহলে এখন প্রস্তুত,” নারী বলে, “তোমাকে যেতে হবে সেই পাহাড়ে—যেখানে তুমি প্রথম ভালোবেসেছিলে, আর প্রথম অভিশপ্ত হয়েছিলে।”

“কোন পাহাড়?”

“নাম নেই তার, মানুষ ডাকে ‘অমর পাহাড়’। সেখানেই শেষ হবে তোমার এই পথ—নতুন এক সূর্য উঠবে, অথবা সমস্ত আলো নিভে যাবে চিরতরে।”

কালাপাহাড় চুপ করে থাকে। এখন তার ভয় নেই, কেবল প্রস্তুতি আছে। সে উঠে দাঁড়ায়।

পেছনে তাকালে দেখবে, সেই নারী নেই। পুকুরধারে কেবল এক জোনাকি উড়ে বেড়ায়। বাতাসে গন্ধ, আর অদৃশ্য সেই গান আবার শোনা যায়।

সেই রাতে, কালাপাহাড় অন্তর্জল গ্রাম পেরিয়ে রওনা দেয় পাহাড়ের দিকে। ইতিহাস তখন তার কাঁধ থেকে নেমে আসে—আর উঠে দাঁড়ায় এক নীরব মানুষ, যে প্রেমের খোঁজে একদিন হয়ে উঠেছিল মৃত্যুর প্রতীক, আর এখন খুঁজছে নিজের মুক্তি—অন্তর্জলের গভীরতা পেরিয়ে।

পর্ব ৬

পাহাড় দূরে ছিল না, কিন্তু কাছে পৌঁছাতে যেন জীবনের সমস্ত পর্ব পেরিয়ে যেতে হচ্ছিল। কালাপাহাড় চলছিল নিঃশব্দে—পায়ের নিচে পাথর, চারপাশে কুয়াশা, মাথার ওপরে একটি মাত্র তারা, যা রাতের আঁধারে একটুকরো দিশা হয়ে উঠেছিল। অন্তর্জল ছেড়ে আসার পর সে আর কোনো মানুষের মুখ দেখেনি, কোনো শব্দ শুনেনি। তার চলার সঙ্গী শুধু হাওয়ার শোঁ শোঁ, আর তার ভিতরের এক অপরিসীম শূন্যতা। শূন্যতাই তো শেষ সত্য—যেখানে মানুষ মুখোশ খুলে দাঁড়ায়।

অমর পাহাড়—নামটা উচ্চারণ করলেই কোনো কারণে গলা শুকিয়ে আসে। কেউ কেউ বলে, এই পাহাড়ের চূড়ায় ঈশ্বরের অভিশাপ আছে, আবার কেউ বলে, এখানে নাকি এক অলৌকিক যোগিনী বাস করতেন, যাঁর চোখে তাকালে নিজেকেই দেখা যায় উল্টোমুখে। কালাপাহাড় এগিয়ে যায়, কারণ এটাই তার শেষ গন্তব্য—জন্ম আর মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রাচীন শিলাস্তম্ভ, যার সামনে সে একদিন দাঁড়িয়েছিল, এক কিশোর হিসেবে, শ্রীমতির হাত ধরে।

হ্যাঁ, শ্রীমতির সঙ্গে এখানে সে এসেছিল একবার। পাহাড় তখন ছিল মেঘে ঢাকা, আর তাদের বুক জুড়ে ছিল প্রথম প্রেমের অনিশ্চয়তা। সেদিন শ্রীমতি বলেছিল, “এই পাহাড়ে চূড়ায় দাঁড়িয়ে কেউ মিথ্যে বলতে পারে না। যা বলবে, তাই চিরকাল সত্য হয়ে থাকবে।” রামপ্রসাদ তখন মুচকি হেসে বলেছিল, “তাহলে আমি বলছি, আমি তোমাকে চিরকাল ভালোবাসি।” শ্রীমতি চোখ বন্ধ করে বলেছিল, “তাহলে সেটাই থাকবে, যতদিন এই পাহাড় আছে।”

আজ সেই পাহাড়ের পাদদেশে ফিরে এসে কালাপাহাড় বোঝে, সময় কেবল ইতিহাসকে পাল্টায়নি, পাল্টেছে বিশ্বাসের রূপ। সে উঠে যায় ধীরে ধীরে, পাথর বেয়ে, লতাগুল্ম পেরিয়ে, শরীর কেটে যায়, রক্ত পড়ে, কিন্তু থামে না। এই পাহাড়ই এখন তার তীর্থ। এখানে হয় সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে, নয়তো চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যাবে।

পথে সে দেখে এক জীর্ণ আশ্রম, পাথরের তৈরি, চারদিকে গাছের ছায়া। সেখানে বসে আছেন এক বৃদ্ধা—সাদা চুল, মাটির রঙের কাপড়, গলায় রুদ্রাক্ষ, হাতে একটি ভাঙা ঝাঁপি। কালাপাহাড় থামে।

“তুমি কি জানো, এ পাহাড়ের চূড়ায় কী আছে?” সে জিজ্ঞেস করে।

বৃদ্ধা তাকিয়ে বলেন, “একটা প্রশ্ন, যার উত্তর কেউ জানে না। তুমি যদি খোঁজো, হয়তো পাবে; তবে পেতে হলে তোমাকে সব ছেড়ে দিতে হবে—তোমার নাম, তোমার পরিচয়, এমনকি তোমার কালাপাহাড় হয়ে ওঠাও।”

“আমি তো তাই-ই চাই।” কালাপাহাড় বলে।

“তবে এগিয়ে যাও,” বৃদ্ধা বলেন, “তবে মনে রেখো, শেষ উত্তর সেই পাবে, যে প্রশ্ন করতে জানে, উত্তর চাইতে নয়।”

কালাপাহাড় আবার উঠে পড়ে। এবার পথ আরো কঠিন। পাথর ভেজা, লতা পিচ্ছিল, কিন্তু তার ভিতরে এক আশ্চর্য ধৈর্য গড়ে উঠেছে। রাতের মধ্যভাগে সে পৌঁছায় পাহাড়ের চূড়ায়—এক প্রশস্ত সমতল, মাঝখানে এক প্রস্তর বেদি, তার উপর খোদাই করা প্রতীক—না হিন্দু, না মুসলমান, না বৌদ্ধ, কেবল এক গোল চক্র যার মাঝে চোখের মতন একটি বিন্দু।

কালাপাহাড় সেই বেদিতে বসে। তার সামনে দূরে, আকাশে, ছড়িয়ে আছে লক্ষ লক্ষ তারা। পেছনে পুরো পৃথিবী—তার যুদ্ধ, তার ধর্ম, তার প্রেম, তার ব্যর্থতা। এখানে সে একা, কিন্তু একা মানে নিঃসঙ্গ নয়—একা মানে নিরাবরণ।

সে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। বাতাসে শিস, তার ঠোঁটে নিঃশব্দ স্তব—যেটা সে ছোটবেলায় পিতার পাঠশালায় শিখেছিল। আজ সেই স্তব আর কোনো দেবতার উদ্দেশে নয়—এটা নিজের জন্য, নিজের ভিতরের অন্ধকারের জন্য। হঠাৎ, এক কণ্ঠ শোনা যায়—”তুমি কি রামপ্রসাদ?”

সে চোখ খোলে। আলো ছড়িয়ে পড়ছে বেদির ওপর। সামনে দাঁড়িয়ে শ্রীমতি। কেমন যেন মেঘে ঢাকা তার রূপ, অথচ চোখ দুটো ঠিক আগের মতোই—স্পষ্ট, অথচ গভীর।

“তুমি এখানে?” সে ফিসফিস করে।

“তুমি তো এসেছো আমায় খুঁজতে,” শ্রীমতি বলে, “তাই আমি এসেছি নিজের ছায়া নিয়ে।”

“তুমি কি বাস্তব?” সে জিজ্ঞেস করে।

“বাস্তব হচ্ছে যা তুমি বিশ্বাস করো। তুমি তো আমায় সবসময় নিজের ভেতরে রেখেছো, তাই আমি এসেছি এই পাহাড়ে, যেখানে তুমি একদিন বলেছিলে ভালোবাসো।”

কালাপাহাড় কাঁপে। “আমি অনেক ভুল করেছি, অনেক কিছু ভেঙেছি। কিন্তু তোমাকে ভুলিনি।”

“আমি জানি,” শ্রীমতি এগিয়ে আসে, “তোমার সেই ভালোবাসাই তোমাকে এই পাহাড়ে টেনেছে, এই ছায়ার মুখোমুখি করেছে।”

“তুমি কি আমাকে ক্ষমা করো?” তার চোখ ভিজে আসে।

“আমি তো তোমাকে কখনো দোষ দিইনি। তোমার যুদ্ধ ছিল তোমার নিজের সঙ্গে। আমি শুধু চাই, তুমি নিজেকে ক্ষমা করো।”

কালাপাহাড় হঠাৎ বুঝতে পারে, তার ভিতরের ভয় গলে যাচ্ছে। তার শরীর হালকা লাগছে, মাথার উপর তারার আলো যেন তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সে মাটিতে বসে পড়ে—না, এবার ভেঙে পড়া নয়, এবার মাথা নত করে একটি প্রণাম।

শ্রীমতির ছায়া ঝাপসা হয়ে যায় বাতাসে।

“আমি আবার কোথায় তোমায় পাব?” সে জিজ্ঞেস করে।

একটি শব্দ ভেসে আসে বাতাসে—”নিজের মধ্যে।”

রাত পার হয়, ভোর ওঠে। পাহাড়ের গায়ে আলো পড়ে। কালাপাহাড় এবার চূড়া থেকে নিচে নেমে আসে। তার চোখে দৃষ্টি পরিষ্কার, মুখে থিতুতা। সে জানে, এবার তাকে ফিরে যেতে হবে—ধ্বংসের পথ নয়, গড়ার পথে। ফিরে যেতে হবে সেইসব জায়গায় যেখানে সে আগুন রেখেছিল, এবার সেখানে জলের ধারা ফেলবে।

রামপ্রসাদ ফিরে এসেছে—কালাপাহাড়ের ছায়া থেকে বেরিয়ে।

পর্ব ৭

ভোরের আলো ক্রমশ নিচে নামে পাহাড়ের গা বেয়ে। মেঘ সরে গিয়ে প্রকাশ পায় নিচের উপত্যকার বিস্তার—গাঢ় সবুজ বন, দূরের দৃষ্টিতে ক্ষীণ নদী, আর কয়েকটি ছোট ছোট জনপদ যাদের ছায়া আবছা। কালাপাহাড়, না, এখন আর সেই নামটাও যেন মানায় না, কারণ আজকের সকাল রামপ্রসাদের ফিরে আসার সকাল।

চূড়া থেকে নামতে নামতে তার শরীর ভারমুক্ত, যদিও পায়ের আঘাত, ক্ষত, কাঁটা—সবই আছে। কিন্তু এই ব্যথা যেন আত্মার কোনো চিহ্ন নয়, বরং নতুন জীবনের প্রথম পথ। বহু বছর পর সে আবার নিজেকে অনুভব করছে মানুষ হিসেবে—না যোদ্ধা, না সেনাপতি, না বিধ্বংসী চরিত্র—শুধু একজন, যে ভালোবাসা ও উত্তরাধিকার নিয়ে ফিরে আসছে নিজের মানুষদের মাঝে।

নামতে নামতে সে দেখতে পেল সেই বৃদ্ধা, যিনি আগের দিন বলেছিলেন, “সব ছেড়ে দিলে তবেই সত্যকে পাওয়া যায়।” বৃদ্ধা আজ তাকে দেখে মাথা নিচু করে বলেন, “তুমি ফিরে যাচ্ছো?”

রামপ্রসাদ মৃদু হেসে বলেন, “হ্যাঁ, আমি ফিরে যাচ্ছি। তবে পথটা আলাদা হবে এবার। এবার আমি গড়তে চাই।”

“তবে শোনো,” বৃদ্ধা বলে, “ফিরে যাওয়া মানে শুধু পায়ে হেঁটে যাওয়া নয়—মানতে হবে, শুনতে হবে, সহ্য করতে হবে। যারা তোমায় আজও ঘৃণা করে, তাদের দৃষ্টি এড়ানো সহজ নয়।”

“আমি আর দৃষ্টি এড়াব না,” রামপ্রসাদ বলে, “আমি তাদের সামনে দাঁড়াতে চাই, বলার জন্য নয়, শোনার জন্য।”

তার চোখে এমন আলো যে পাহাড়ের আলোও কিছুটা লজ্জা পায়।

দুই দিন ধরে সে হাঁটে। পথের মাঝে ছোট ছোট নদী, বনভূমি, জনপদ, ঝর্ণা—সব পেরিয়ে, ক্ষুধা আর ক্লান্তির সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভেতরের এক একটি স্তর যেন খসে পড়ে। মাঝেমধ্যে কেউ কেউ তাকে চিনে ফেলত—চোখ বড় করত, মুখ ঘুরিয়ে নিত, কেউ আবার তাকে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ত। কিন্তু সে থামত না, প্রতিবার মাথা নিচু করে চলে যেত। এই নীরবতা তার অস্ত্র নয়, তার প্রার্থনা।

তৃতীয় দিনে সে পৌঁছে যায় শ্রীহট্টর এক উপকণ্ঠে—একটি গ্রাম যার নাম ছিল বিষ্ণুনগর। এখানে সে প্রথম যুদ্ধ করেছিল নবাবের সৈন্যদলে নাম লেখানোর পরে। এখানে সে প্রথম মন্দির ভেঙেছিল, তার পিতার বন্ধুর দ্বারা নির্মিত একটি কালিকা মন্দির। সেই রাতেই সে প্রথম রক্ত দেখেছিল, প্রথম কান্না শুনেছিল।

গ্রামে ঢোকার সময় একদল যুবক চেঁচিয়ে ওঠে—“ওই যে, ওই তো কালাপাহাড়! মন্দির-ভাঙা পাপী!”

রামপ্রসাদ থেমে যায়। সে পালিয়ে যায় না, যেমনটা আগে অনেকবার করেছে। সে দাঁড়িয়ে পড়ে মাঠের মাঝে, দুহাত ছড়িয়ে বলে, “আমি সেই কালাপাহাড়, যে ভাঙতে জানত, কিন্তু গড়তে শিখেনি। আমি আজ এসেছি শুধু একটি কথা বলার—ক্ষমা চাইতে নয়, কারণ তা আমার অধিকার নয়; এসেছি তোমাদের চোখের দিকে তাকাতে, যাদের আমি ভয় পেতাম একদিন।”

গ্রামের মানুষজন ছুটে আসে। কেউ মুখে গালি দেয়, কেউ জুতো ছুঁড়ে মারে, কেউ বাচ্চাদের চোখ ঢেকে নেয়। কিন্তু রামপ্রসাদ নড়েও না। তার দৃষ্টি স্থির, তার কণ্ঠ নরম।

একজন বৃদ্ধা এগিয়ে এসে বলে, “তুমি আমাদের পুজোর ঘর জ্বালিয়েছিলে, আমাদের বিশ্বাস ভেঙেছিলে। কেন এসেছো আবার?”

“কারণ আমি বুঝেছি, বিশ্বাস ভাঙা যায় না,” সে বলে, “আমি বুঝেছি, পাথর ভেঙে ফেলা যায়, কিন্তু মানুষের চোখে ঈশ্বর থেকে যান। আমি আজ এসেছি তাদেরই চরণ ধুতে, যাদের চোখে আমি ছিলাম দৈত্য।”

সেই বৃদ্ধা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর পেছন থেকে এক বালিকা দৌড়ে এসে তার হাতে একটি পদ্মফুল দিয়ে যায়—নীরবে, কোনো কথা না বলে।

রামপ্রসাদ তা নিয়ে মাথায় ঠেকায়।

সেইদিন সন্ধ্যায় গ্রামের কাছে একটি পোড়া চণ্ডীমণ্ডপের পাশে সে বসে থাকে, একলা, নিঃশব্দে। হঠাৎ কয়েকজন এসে দাঁড়ায় পাশে—একজন বালক বলে, “আমরা একটা নতুন মন্দির বানাতে চাই। তুমি কি মাটি কাটবে আমাদের সঙ্গে?”

সে এক মুহূর্ত থেমে যায়। তার আঙুলে এখনও কাটা দাগ, হাত কাঁপে। কিন্তু সে উঠে দাঁড়ায়। “হ্যাঁ,” সে বলে, “আমি এবার গড়তে চাই, সেই বিশ্বাস, যা আমি নিজেই একদিন ভেঙে ফেলেছিলাম।”

রাত্রি নামে। আকাশে তারা উঠে আসে। মাঠে কুয়াশা জমে, কিন্তু সেই কুয়াশার ভিতরে এবার কোনো ভয় নেই। শুধু আছে কিছু ছেলে, কিছু মেয়ে, কিছু প্রবীণ মুখ—আর তাদের পাশে এক আগুন-ঝরা ইতিহাসের মানুষ, যে আজ আবার মাটি ছুঁয়ে দাঁড়াতে শিখছে।

সে দিন শেষ হয় পদ্মফুলের ঘ্রাণে, এক শিশু কণ্ঠে স্তব পাঠে, আর রামপ্রসাদের মুখে নিরব, অব্যক্ত কিন্তু প্রবল আশ্বাসে।

পর্ব ৮

পদ্মফুল হাতে নিয়ে রামপ্রসাদ বসে থাকে চণ্ডীমণ্ডপের পোড়া ইটের পাশে। আকাশে অন্ধকার জমছে, দূরের বাঁশঝাড়ে শিয়াল ডাকে, আর বাতাসে কুয়াশার গন্ধ। কিন্তু তার বুকের ভিতরে আজ একটা আশ্চর্য নিঃস্তব্ধতা। বহুদিন পর এই নীরবতা ভয়ের নয়, আত্মগ্লানির নয়, বরং এক গভীর প্রতিশ্রুতি—নতুন করে গড়ে তোলার প্রতিজ্ঞা। পদ্মফুলটি সে বারবার দেখে, যেন এই ফুল তাকে বলছে—‘তুমি পারবে।’

পরদিন ভোরেই মাটি কাটার কাজ শুরু হয়। গ্রামবাসীদের মধ্যে প্রথমে সন্দেহ ছিল, কেউ কেউ কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকছিল দূরে দাঁড়িয়ে, আর কিছু যুবক কাঁধে কোদাল নিয়ে দাঁড়িয়েছিল দ্বিধায়। কিন্তু যখন তারা দেখে কালাপাহাড় নামে পরিচিত সেই ভয়ঙ্কর মানুষ নিজ হাতে কোদাল তুলছে, তার পায়ের নিচে পাথর গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, তখন ধীরে ধীরে লোকজন এগিয়ে আসে। প্রথমে একজন, তারপর দু’জন, তারপর পুরো দল।

সকাল গড়িয়ে দুপুর আসে। রামপ্রসাদ কাদা মাখা শরীর নিয়ে বসে পড়ে একটা গাছের নিচে। তখন এক তরুণী জল নিয়ে আসে তার জন্য—চোখে বিস্ময়, মুখে নীরব সম্মান। সে মাথা নিচু করে বলে, “তুমি কি আমাদের জন্যই ফিরেছো?”

রামপ্রসাদ হেসে বলে, “আমি আমার নিজের জন্য ফিরেছি। আর সেই পথে তোমরা আছো বলেই এ ফেরা অর্থ পেয়েছে।”

তরুণী চলে যায়। রামপ্রসাদ বুঝতে পারে, বিশ্বাস তৈরি হয় ধীরে ধীরে, ঠিক যেমন নদী মাটি কাটতে কাটতে পথ গড়ে তোলে—এক দিনে নয়, এক জীবনে।

তারপর কয়েকদিন কেটে যায়। পোড়া মন্দিরের জায়গায় ধীরে ধীরে এক নতুন কাঠামো উঠে আসে—এবার আর কোনো পাথরের শিবলিঙ্গ নয়, কোনো রাজা বা নবাবের দান নয়, কেবল গ্রামের মানুষের হাতে গড়া এক স্তম্ভ—যেখানে থাকবে আলো, থাকবে মাটি, থাকবে ফুল আর প্রার্থনার স্থান। মূর্তি নয়, এই মন্দিরে থাকবে এক ফাঁকা চৌকি, যেখানে কেউ নিজের মতো করে ভাববে তার ঈশ্বরকে।

একদিন সন্ধ্যায়, চূড়ান্ত কাঠামো গাঁথা শেষ হওয়ার দিন, রামপ্রসাদ একা বসে থাকে নতুন নির্মিত স্তম্ভের সামনে। সে চোখ বুজে আছে, হাতে ধরা কিছু তুলসীপাতা। হঠাৎ সে শুনতে পায় এক পরিচিত কণ্ঠ।

“তুমি জানো তো, সবাই পারেও না এই রকম করে ফিরে আসতে।”

সে চোখ খোলে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই তরুণী, যার চোখে সে শ্রীমতির ছায়া দেখতে পায়, যার কথায় বারবার ফিরে আসে এক মায়াময় বাস্তবতা।

“তুমি এসেছো আবার?” রামপ্রসাদ বলে।

“আমি কোথায় যাইনি। আমি তো সেই চোখ, যে দেখে যায় ইতিহাসের পেছনে লুকিয়ে থাকা মানুষটাকে। তুমি সেই মানুষ, যাকে আমি হারিয়ে ফেলিনি।”

“তুমি কে?” সে আবার জিজ্ঞেস করে।

“আমি মূর্তি নই, আমি ঈশ্বর নই, আমি শাস্ত্রও নই। আমি সেই গান, যেটা কেউ মনে রাখে না, কিন্তু মন যদি ভালো থাকে, আপনিই গেয়ে ওঠে।”

রামপ্রসাদের গলা কেঁপে ওঠে। “তবে আমাকে আশীর্বাদ দাও, যেন আমি এই নতুন জীবনে, এই নতুন বিশ্বাসে কোনো আগুন না রাখি।”

তরুণী হাসে। “তুমি নিজেই এখন আশীর্বাদ। তুমি যে ফিরে এসেছো, সেটাই তো সবচেয়ে বড় প্রার্থনা।”

সে চলে যায়, আবার সেই বাতাসের সঙ্গে মিলিয়ে যায়। রামপ্রসাদ বোঝে, কিছু ছায়া থাকে, যেগুলো তোমার জীবনের অন্ধকারে আলো হয়ে থাকে। তুমি তাদের স্পর্শ করতে পারো না, কিন্তু তারা তোমার পথ দেখায়।

সেই রাতেই গ্রামের লোকজন একত্রিত হয় নতুন মন্দির প্রাঙ্গণে। কেউ প্রদীপ জ্বালায়, কেউ ফুল আনে, কেউ কীর্তন গায়। কিন্তু কোনো পুরোহিত নেই, কোনো মন্ত্র নেই, শুধু মানুষের সম্মিলিত কণ্ঠে একটাই শব্দ—“শুভ্রতা।”

রামপ্রসাদ দাঁড়িয়ে থাকে স্তম্ভের সামনে, চোখে জল। তাকে কেউ পুরোহিতের আসনে বসায় না, কিন্তু সবার চোখে সে যে শ্রদ্ধার ছায়া দেখে, তা তাকে ভাসিয়ে দেয়। মন্দিরের পাশে এক বৃদ্ধ বলে ওঠেন, “আজ আমরা সবাই মিলে একটা নতুন বিশ্বাস গড়লাম—এটা কোনো ধর্ম নয়, এটা রক্ত-মাটি-ভালোবাসার গাঁথা।”

সেই দিন রাতে রামপ্রসাদ আর ঘরে ঘুমায় না। সে মন্দিরের পাশে বসে থাকে। তার চারপাশে জোনাকি জ্বলে, দূরের বন থেকে ভেসে আসে পাখির ডাক। সে অনুভব করে, তার ভেতরের অন্ধকার আস্তে আস্তে আলোয় রূপ নিচ্ছে।

কিছুক্ষণ পর এক শিশু এসে তার কোল ঘেঁষে বসে। শিশুটি বলে, “তুমি আমাদের দাদু হয়ে যাবে?”

রামপ্রসাদ হেসে বলে, “আমি যদি পারি, তবে হব।”

শিশুটি মুচকি হাসে, বলে, “তাহলে আমি তোমার কাছে গল্প শিখব।”

সেই মুহূর্তে কালাপাহাড় নামে পরিচিত যে মানুষটা ছিল, সে চিরতরে মরে যায়।

আর জন্ম নেয় একজন নতুন রামপ্রসাদ—যিনি আগুন নয়, এখন কেবল গল্প বলেন।

পর্ব ৯

রামপ্রসাদের চারপাশে এখন আর কোনো যুদ্ধ নেই, কোনো তরবারির ঝনঝনি নেই, এমনকি কেউ তার নাম বললে চুপ করে পড়ে না বাতাস। বিষ্ণুনগরের সেই নতুন মন্দির আজ গ্রামের মানুষদের প্রাণকেন্দ্র, আর তার ঠিক পাশে, একটি ছোট কুঁড়েঘর—যেখানে থাকে রামপ্রসাদ, আর আসে গ্রামের শিশুরা, কিশোরেরা, যুবকেরা—গল্প শুনতে, ছবি আঁকতে, গান গাইতে।

কিন্তু এই শান্তি এমন সহজে গড়ে ওঠেনি। প্রতিটি প্রহরে, প্রতিটি নতুন ভোরে সে এক ধরনের অদৃশ্য আত্মজিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে যায়—সত্যিই কি সে ক্ষমা পেয়েছে? সত্যিই কি মানুষ তাকে গ্রহণ করেছে? নাকি এটা কেবল সময়ের এক ঢেউ, যেটা একদিন আবার সরেও যেতে পারে?

এক সন্ধ্যায়, যখন সব শিশু ঘরে ফিরে গেছে, মন্দিরে প্রদীপ নিভে আসছে, তখন রামপ্রসাদ বসল খোলা উঠোনে। হাতে ছিল পুরনো এক খাতা, যেখানে সে লিখে রেখেছে নিজের কৃতকর্ম, নিজের যুদ্ধ, নিজের পাপ—কোনো অলংকার ছাড়া, কেবল সত্য।

সে ভাবল, “এই খাতা কেউ পড়লে কী ভাববে? আমি কি ইতিহাসে ফিরে যেতে পারব, নাকি কেবল ছায়া হয়ে রয়ে যাব?”

ঠিক তখনই, পেছনে এসে দাঁড়ায় সেই কিশোর, যে প্রথমদিন চণ্ডীমন্দিরের চাবি দিয়েছিল।

“তুমি লিখছো?” সে প্রশ্ন করে।

“হ্যাঁ,” রামপ্রসাদ বলে, “নিজের কথা, নিজের পাপ, নিজের যন্ত্রণা।”

“তবে বইয়ের নাম কী হবে?”

রামপ্রসাদ একটু ভেবে বলে, “ছায়ার ইতিহাস।”

কিশোর বসে পড়ে তার পাশে। “তুমি জানো তো, ছায়া কখনো নিজে কিছু করে না, সে কেবল তোমার সাথে থাকে। তুমি যে পথ চলে গিয়েছিলে, সেই পথের ছায়াই এখন তোমাকে ঘিরে রেখেছে। এই ইতিহাস যদি কেউ পড়ে, তাহলে সে বুঝবে—যে মানুষ ভাঙে, তারও একটা ভেতর থাকে, যে কাঁদে, যে ভালোবাসে।”

রামপ্রসাদের গলা কাঁপে। “তুমি কি সত্যিই বিশ্বাস করো, আমি বদলে গেছি?”

“আমি তোমার গল্প শুনেছি, তোমার হাতের কাটা দাগ দেখেছি, আর দেখেছি সেই চোখ, যেখানে এখন রক্ত নয়, শুধুই অনুতাপ আর ভালোবাসা। যদি তুমি বদলাতে না, তবে এই মন্দিরও গড়ে উঠত না।”

সেই রাতে রামপ্রসাদ অনেকটা সময় বসে থাকে খাতা নিয়ে। সে লিখে:

“আমি সেই মানুষ, যে মূর্তি ভেঙে ভুল ভেবেছিল, ভালোবাসার নাম দিয়েছিল আগুন। আমি সেই মানুষ, যে শাস্তি দিয়েছে, অথচ জানত না, কার জন্য দিচ্ছে। আমি কালাপাহাড় ছিলাম—ধর্মান্তরিত বলে নয়, যুদ্ধপ্রেমী বলে নয়, বরং আমি ছিলাম এক ব্যর্থ প্রেমিক, যে সমাজের নিষ্ঠুরতায় নিজেকে বিসর্জন দিয়েছিল। আজ আমি লিখছি, আমার নিজের বিচারপত্র। এই ইতিহাসে আমার কোনো জেতা নেই, কেবল স্বীকারোক্তি আছে। যারা পড়বে, তারা বুঝবে—ভুল যে করে, সেই যদি নিজেকে খুঁজে পায়, তবে তার চেয়ে সাহসী আর কেউ নেই।”

একসময় রাত পেরিয়ে ভোর আসে। খাতার পাতা বন্ধ হয়, আর উঠোনে বসে রামপ্রসাদ চোখ মেলে দেখে—পূর্বদিকে সূর্য উঠেছে, আর সেই আলোয় তার মুখ যেন অনেক উজ্জ্বল লাগে।

কিন্তু এই আলো দীর্ঘস্থায়ী হয় না।

সেইদিন দুপুরে গ্রামে এসে নামে একটি হাতি। তার পিঠে বসে রয়েছে রাজশক্তির বার্তাবাহক—এক সুলেমানি দূত, নবাবের ঘনিষ্ঠ। সে মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, “কালাপাহাড়! নবাবের সৈন্যদল ফিরে আসছে। তোমার জন্য চিঠি এসেছে। তুমি এখনো সেনাপতি কি না, তা ঠিক হবে আজ।”

গ্রাম থমকে যায়। চারদিকে নীরবতা।

রামপ্রসাদ এগিয়ে আসে। হাতির পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে সে চিঠি নেয়। খামে নবাবের সীলমোহর, কিন্তু চিঠির ভাষা রক্তশীতল:

“তুমি কি সত্যিই আমাদের ছেড়ে চলে এসেছো? তুমি কি ধর্মের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো? ফিরে এসো, নয়তো তুমি ঘোষিত হবে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে। যদি ফিরে না আসো, তোমার মাথার দাম ধার্য হবে পঞ্চাশ হাজার মোহর।”

এই বার্তা পড়েই গ্রামের লোকেরা কাঁপতে থাকে। কেউ কেউ পিছু হটে, কেউ কেউ চোখে সন্দেহ নিয়ে তাকায়। রামপ্রসাদ বুঝে যায়—একটা শুদ্ধির যাত্রা সম্পূর্ণ হলেই তো হয় না, সেটাকে রক্ষা করতেও হয়।

সে শান্ত গলায় বলে, “আমি নবাবের সৈন্য ছিলাম, সত্যি। কিন্তু আমি কখনোই কারও অন্ধ দাস ছিলাম না। আমি তার বাহিনী ত্যাগ করেছি, কারণ আমি আমার ভুল বুঝতে শিখেছি। যদি আমার এই ফিরে আসা পাপ হয়, তবে আমি সেই পাপ মাথায় তুলে নেব। কিন্তু আমি আর যাব না। আমি এই মাটির, এই মানুষের, এই শিশুর গল্প বলা লোক।”

কিছুক্ষণ নীরবতা।

তারপর সেই কিশোর, যাকে সে নিজের প্রথম শ্রোতা ভাবে, সামনে এগিয়ে এসে দাঁড়ায়। “তুমি আমাদের দাদু, আমাদের গল্পওয়ালা। তুমি যেখানে থাকবে, আমরা সেখানেই থাকব।”

এক একজন করে মানুষ তার পাশে দাঁড়াতে থাকে। কেউ হাত ধরে, কেউ ঘাড়ে হাত রাখে, কেউ চোখে জল মুছে বলে, “তুমি যদি কালাপাহাড় হয়ে থাকো, তবে এবার আমরা হবো পাহাড়ের আলো।”

সুলেমানি দূত হতভম্ব। সে বোঝে, এই মানুষটিকে শুধু হুকুমে বাঁধা যাবে না।

হাতি ফিরে যায়। দূর থেকে শোনা যায় তার ঘণ্টার শব্দ, যেন ধ্বংস হয়ে যাওয়া অতীতের শেষ প্রস্থান।

সন্ধ্যায় রামপ্রসাদ আবার বসে খাতা নিয়ে। শেষ পৃষ্ঠায় সে লেখে:

“যে ইতিহাস আমাকে কালাপাহাড় বানিয়েছিল, আজ সেই ইতিহাসকে আমি ছায়া বানিয়ে রেখে গেলাম এই বইয়ের পাতায়। আমি জানি, সব মানুষ ক্ষমা করতে পারে না, সব চোখ ভালোবাসতে জানে না। কিন্তু যারা জানে, তাদেরই সঙ্গে আমি নতুন পথ বানাবো। আমার নামের পাশে থাকুক একটি প্রশ্নচিহ্ন—সেই প্রশ্ন, যা আমাকে আজকের রামপ্রসাদ করে তুলেছে।”

পর্ব ১০

শীতল এক সকালে, বিষ্ণুনগরের আকাশে ছড়িয়ে পড়ে ধোঁয়া, কুয়াশা আর মাটির গন্ধ। মাঠে শিশুরা দৌড়ায়, বৃদ্ধেরা বসে থাকে মন্দির চত্বরের ধারে, আর মাঝখানে রামপ্রসাদ—হাতে খাতা, চোখে স্থিরতা। আজ সে বুঝে গেছে, ইতিহাস মানে কেবল তারিখ নয়, যুদ্ধ নয়, ধর্মও নয়—ইতিহাস একেকজন মানুষের হৃদয়ের গভীরতম সংকট, যা তারা পাথরের ভিতরে গেঁথে রেখে দেয়, শতাব্দী ধরে।

সেদিন সকালে, সে শেষ পৃষ্ঠা লেখে। একটানা লিখে যায় এমনভাবে, যেন তার কলম আর কাঁপে না, ভাষা আর লজ্জা পায় না—

“আমি রামপ্রসাদ। একসময় ছিলাম কালাপাহাড়। আমার হাতে মন্দির ভাঙার ইতিহাস আছে, পুড়ে যাওয়া দেবদারু গাছের গন্ধ আছে, কষ্টিপাথরে গড়া শ্রীমতির মুখ আছে। আমি ধর্ম পাল্টেছিলাম, কিন্তু হৃদয় কখনো পাল্টাতে পারিনি। আমি যা ভেবেছিলাম সত্য, সে ছিল আমার নিজের ক্ষত। আমি ভেবেছিলাম, ঈশ্বরকে খুঁজতে হলে আগুন ধরাতে হয়, কিন্তু এখন বুঝেছি—ঈশ্বর থাকে জলে, বাতাসে, ভালোবাসার নিরব প্রার্থনায়।

আমি একদিন যাকে ভালোবেসেছিলাম, তার চোখে আমি নিজেকে হারিয়েছিলাম। আজ আমি চাই, যারা আমায় চিনবে, তারা চোখ রাখুক এই মানুষটার ভিতরে—not the destroyer, but the one who dared to return.”

খাতা বন্ধ করে সে চেয়ে দেখে উঠোনের এক কোণে একটি বালক চুপ করে বসে। তাকে দেখে মৃদু হেসে রামপ্রসাদ বলে, “তুমি বসে আছো কেন?”

বালক বলে, “আমি ভাবছিলাম, গল্প কি সবসময় শেষ হয় দাদু?”

রামপ্রসাদ একটু চুপ করে, তারপর বলে, “সব গল্পের শেষ হয় না। কিছু গল্প ছায়া হয়ে রয়ে যায় বাতাসে, যেমন আমি রয়ে গেছি এই মাটি আর মানুষের মুখে।”

“তুমি কি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে?” বালক সরাসরি প্রশ্ন করে।

“না,” রামপ্রসাদ মৃদু হাসে, “আমি যদি শরীরে না-ও থাকি, আমি থাকবো এই খাতার পাতায়, এই মাঠে ছড়িয়ে থাকা শব্দে, আর তোমার মুখে বলা গল্পে।”

সেই রাতেই গ্রামে আয়োজন হয় একটি নতুন উৎসবের—‘ভাঙা থেকে গড়া’র দিন। কোনো ধর্ম নেই এই উৎসবে, নেই কোনো প্রতিমা। কেবল আলো, কেবল গল্প, কেবল গান। কিশোররা পড়তে শুরু করে রামপ্রসাদের খাতা থেকে, ছোট ছেলেমেয়েরা নাটক করে তার জীবনের কাহিনি অবলম্বনে। বাতাসে বাজে বাঁশির সুর, ঢোলের তালে কাঁধে কাঁধ মিলে যায় এক নতুন বিশ্বাসে।

মধ্যরাতে রামপ্রসাদ একা বসে থাকে নতুন মন্দিরের চৌকাঠে। সবাই তখন আলোর উৎসবে মগ্ন, আর সে চেয়ে থাকে আকাশের দিকে—যেখানে লক্ষ লক্ষ তারা, আর প্রতিটা তারার মাঝে সে খুঁজে পায় একেকটা মুখ—শ্রীমতি, সেই নাম না জানা তরুণী, সেই বৃদ্ধ, সেই জলঘেরা অন্তর্জল গ্রাম, সেই পাহাড়চূড়ার স্তব, আর সব শেষে নিজেরই মুখ—রক্তমাখা, পরিশ্রান্ত, অথচ এখন শুদ্ধ।

তখনই তার পাশে এসে বসে সেই মেয়েটি—হয়তো কল্পনা, হয়তো বাস্তব, হয়তো শ্রীমতির ছায়া, হয়তো তারই নির্মিত বিবেক।

“সব পেয়েছো?” সে জিজ্ঞেস করে।

“না,” রামপ্রসাদ মৃদু হেসে বলে, “সব কখনো পাওয়া যায় না। কিন্তু আমি যা হারিয়েছিলাম, তার কিছুটা ফিরে পেয়েছি—স্মৃতির মধ্যে দিয়ে, মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে।”

“তোমার কি ভয় নেই আর?” মেয়েটির কণ্ঠ যেন বাতাসের মতোই কোমল।

“ভয় এখনো আছে,” সে বলে, “কিন্তু ভয়ই তো মানুষকে জীবিত রাখে। আমি এখন সেই ভয়কে আপন করে নিয়েছি।”

“তুমি কি আবার রামপ্রসাদ হয়েছো?”

সে কিছু বলে না। শুধু মেয়েটির দিকে তাকায়, তার মুখে আলো পড়ে, যেন জোনাকি। তারপর সে বলে, “আমি এখন কেবল একজন মানুষ, যে আর ঈশ্বর হতে চায় না। যে শুধু চাই, অন্য কেউ যেন আর আমার মতো পথ না নেয়—যা ভাঙে শুধু, গড়ার আশা ছাড়া।”

মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়। “তাহলে আমি চলে যাই।”

“তুমি কে?” রামপ্রসাদ জিজ্ঞেস করে।

“আমি তোমার প্রতিফলন,” সে বলে, “আমি সেই ছায়া, যাকে তুমি ভালোবেসেছিলে, ঘৃণা করেছিলে, পালিয়ে বেড়িয়েছিলে, আর শেষে গ্রহণ করতে শিখেছো।”

সে মিলিয়ে যায় বাতাসে।

সকালে, যখন উৎসবের রেশ কাটতে শুরু করেছে, গ্রামবাসীরা খুঁজে পায় রামপ্রসাদকে মন্দিরের পাশে ঘুমিয়ে। তার হাতে খোলা খাতা, মুখে হালকা হাসি।

কেউ ডাক দেয়। সে জাগে না।

তখন সেই কিশোর, যে প্রথম তাকে চাবি দিয়েছিল, সে এসে বলে, “ওনি ঘুমিয়ে গেছেন গল্পের মধ্যে। আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন—ভুল থেকে ফেরার সাহসটাই সবচেয়ে বড় দেবতা।”

গ্রামের প্রবীণ পুরুষ, নারী, আর শিশুরা মিলে সিদ্ধান্ত নেয়—রামপ্রসাদের খাতা গ্রন্থাকারে সংরক্ষিত হবে। নাম রাখা হবে:
“কালাপাহাড়ের ছায়া: একজন মানুষের অন্ধকার থেকে আলোর যাত্রা”

এই গ্রন্থ পাঠ করা হবে বছরের এক বিশেষ দিনে, মন্দিরের সেই ফাঁকা চৌকিতে বসে, যেখানে প্রতিমা নেই, কেবল আলো ও বাতাস। মানুষ আসবে, শুনবে, এবং নতুন করে নিজের ভুল বুঝে পথ বদলাবে।

আর সে চিরদিন রয়ে যাবে মানুষের কণ্ঠে, শিশুর গল্পে, বাতাসে ভেসে আসা সেই স্তবের সুরে।

কালাপাহাড় ইতিহাসে একজন অভিশপ্ত যোদ্ধা,
রামপ্রসাদ মানুষের মাটিতে একজন আলো।

(সমাপ্ত)

1000025091.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *