আর্য বসু
অধ্যায় ১
কলকাতার উত্তর শহরের এক পুরনো দোতলা বাড়িতে, ভাদ্র মাসের ভ্যাপসা গরমে সন্ধ্যা নেমেছিল ভারী একটা স্তব্ধতা নিয়ে। চারদিকে পূজার আগাম প্রস্তুতির শব্দ, দূরে প্যান্ডেলের বাঁশ বাঁধার ঠুংঠাং আওয়াজ, আর ব্যস্ত রাস্তার ট্রাফিক হর্নের মাঝখানে বই, কাগজ আর কাঠের গন্ধমাখা একটা ঘরে বসে শৌনক রায় পুরোনো আলমারির তালা ভাঙার চেষ্টা করছিলেন। এটা তাঁর বাবার ঘর — প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও তন্ত্রগবেষক শিবরাম রায়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা, যেখানে কোনোদিন কেউ ঢোকার সাহস পেত না। বাবার মৃত্যুর সাত বছর পর, মা’রও চলে যাওয়ার পরে এই ঘরটাকে নতুন করে সাজানোর কথা ভেবেছিলেন শৌনক — কিন্তু ঘর খুলতেই যেন গা ছমছমে কিছুর ছায়া এসে পড়ে গিয়েছিল দেয়ালের ওপর। কাঠের মোটা কৌটো আর পাতলা ফাইল ঘেঁটে যখন একটা চামড়ার বাঁধাই ডায়েরি হাতে আসে, তখন বাইরের অন্ধকার একটু বেশি গাঢ় হয়ে উঠেছিল। ডায়েরির প্রথম পাতায় জলের দাগ আর ছেঁড়া কালি — আর একটা বাক্য যেটা স্পষ্ট করে লেখা, “চক্রব্যূহ শুরু হবে পুনর্জন্মে।” শৌনক চমকে ওঠেন। এই বাক্যটা কোথাও আগে পড়েছেন, কিন্তু ঠিক মনে করতে পারেন না। ডায়েরির ভাঁজে রাখা ছিল একটা পুরোনো মানচিত্র — তাতে বাঁ হাতের কোণে ছোটো করে লেখা “ব্রহ্মচক্রপীঠ, পুরুলিয়া”।
“ব্রহ্মচক্রপীঠ?” শব্দটা উচ্চারণ করতেই ঘরের বাতাস ভারী হয়ে আসে। এই নাম শৌনক শুনেছিলেন মাত্র একবার — বহু বছর আগে, তাঁর বাবা এক অলস দুপুরে বলেছিলেন, “তন্ত্র শুধু দর্শন না, ওটা চক্র। একবার ঢুকলে, বের হওয়া যায় না।” তখন শিশুমনে গুরুত্ব বুঝতে পারেননি তিনি, কিন্তু আজ এই নামটা যেন রক্তের ভিতর স্রোতের মতো ছুটে বেড়াচ্ছে। ডায়েরিতে লেখা ছিল কিছু বিচ্ছিন্ন লিপি — সংস্কৃত, প্রাচীন বাংলা ও কিছু অপঠিত বর্ণমালা — যা আধুনিক কোনো গবেষণার সঙ্গে মেলে না। শৌনক বুঝতে পারলেন, তিনি যা পেয়েছেন তা শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং এক বিস্মৃত সাধনার প্রবেশদ্বার। ব্রহ্মচক্রপীঠ নামটি তিনি খোঁজেন গুগলে, কোনো ফলাফল আসে না। তারপর পুরনো গ্রন্থপঞ্জি ঘেঁটে পেয়ে যান একটি রেফারেন্স — ১৮৫২ সালের এক ব্রিটিশ মিশনারির হাতে লেখা রিপোর্টে শুধু একবার নামটি উল্লেখ ছিল: “Brahmachakra Peeth, a forbidden forest temple of undivided Bengal, possibly inhabited by ‘ritual spirits’.” সেই মুহূর্তেই শৌনকের গবেষক মন আর তন্ত্রবিদ্যা নিয়ে ভয়-উৎসাহে ঘেরা কৌতূহল একসঙ্গে জেগে ওঠে। বাবা যে তাঁকে কিছু দিয়ে গিয়েছেন, সেটা এখন নিশ্চিত — প্রশ্ন একটাই, তিনি কি জানতেন এই ডায়েরির পেছনে কী আছে?
রাত বাড়তে থাকে, ঘরে আলো একপাশে দুলতে থাকে — যেন বাতি নয়, কোনো অদৃশ্য ছায়া ওকে ধাক্কা দিচ্ছে। শৌনক ডায়েরির পাতাগুলো উল্টে দেখতে থাকেন একের পর এক অচেনা মন্ত্র, যেগুলো লিখতে লিখতে শিবরাম রায়ের হাতে কালি লেগে গিয়েছিল — যেন শারীরিক যন্ত্রণায় তিনি লিখেছেন প্রতিটি অক্ষর। এক পাতায় লেখা — “কালাপাহাড় মুক্ত নয়। চক্রব্যূহ রক্ত চায়। আমার পিছু যারা আসবে, তাদের সতর্ক করছি — সময়ের আগে জেনো না কিছুই।” শৌনকের বুক কেঁপে ওঠে। কালাপাহাড় — নামটা কেমন শোনা, কেমন পুরোনো। কে ছিল সে? ইতিহাসের কোথায় তার স্থান? আর এই চক্রব্যূহ কী? তিনি আর অপেক্ষা করেন না। মধ্যরাতে নিজেকে তৈরি করেন যাত্রার জন্য — পুরুলিয়ার সেই অরণ্যের দিকে, যেখানে ইতিহাস আর অভিশাপ হয়তো একই বৃন্তে জন্মেছে। ঠিক তখনই, হাওয়ার দোলায় ডায়েরির একটা ছেঁড়া পাতা মেঝেতে এসে পড়ে — সেখানে রক্তের মতো লাল কালি দিয়ে আঁকা একটি চিহ্ন — একটি ত্রিভুজ, যার মধ্যে সাতটি বিন্দু। শৌনকের হাত অজান্তেই কাঁপে। এই চিহ্ন তার ভবিষ্যতের দরজা, নাকি মৃত্যুর? বুঝে উঠতে না পেরে সে ডায়েরি বন্ধ করে দেয়। তবুও এক জায়গায় চোখ আটকে থাকে — শেষ লাইনটা, যা তার বাবা যেন রক্ত দিয়ে লিখেছিলেন, “তুমি যদি শুরু করো, তবে শেষ করতেই হবে — নয়তো কালাপাহাড় তোমার ছায়া হয়ে থাকবে।” সেই রাতে ঘুম আসে না। শুধু দেয়ালের ঘড়ির টিকটিক আর বাতাসের নিঃশব্দ হাহাকার শুনতে শুনতে শৌনক বুঝে ফেলেন — ইতিহাস নয়, তিনি এক অভিশপ্ত সত্যের দরজায় দাঁড়িয়ে।
অধ্যায় ২
যখন ট্রেন ঝাঁকুনি দিয়ে পুরুলিয়া স্টেশনে ঢুকল, তখন সকাল নয়টা। তবু আলো যেন ধূসর, আকাশ মেঘে ঢাকা — ছায়াঘন পুরুলিয়ার গায়ে যেন একটা অদৃশ্য শীত লেগে আছে। শৌনক ব্যাগ কাঁধে চাপিয়ে স্টেশন থেকে বেরোতেই ঠোঁটে এসে লেগে গেল শুকনো মাটি, খয়েরি ধুলো আর পলিমাটির গন্ধ। ট্যাক্সির খোঁজ না করে সে সোজা হাঁটতে শুরু করল — গন্তব্য ছিল স্থানীয় গেস্ট হাউস, যেখানে তার অপেক্ষায় ছিলেন একজন। রাধিকা সেন, পুরুলিয়ার আদিবাসী সংস্কৃতি ও লোকবিশ্বাস নিয়ে গবেষণারত নৃবিজ্ঞানী। ইমেইলে তাঁর সাড়া পাওয়ার পরই শৌনক ঠিক করেছিলেন, তাঁকে সঙ্গে নিয়েই ব্রহ্মচক্রপীঠের খোঁজ শুরু করবেন। রাধিকার সঙ্গে প্রথম দেখা হয় সরু এক ধুলো-ঢাকা পথে, বাঁশঝাড়ের ছায়ায় ঘেরা এক ছোটো দোকানের সামনে। তিনি পাতলা সুতির শাড়ি পরে দাঁড়িয়েছিলেন, কাঁধে ব্যাগ, চোখে সরাসরি তাকানোর এক নির্ভার সাহস। পরিচয় পর্বের পর রাধিকা বললেন, “আপনার বাবা শিবরাম রায় সম্পর্কে আমি জানি। তন্ত্র নিয়ে এমনভাবে কেউ লেখেনি। তবে… ব্রহ্মচক্রপীঠে যাওয়ার কথা ভাবছেন শুনে একটু ভয় লাগছে।” শৌনক কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করেন, “আপনিও বিশ্বাস করেন সেখানে কিছু আছে?” রাধিকা একটু থেমে বলেন, “বিশ্বাসের কথা নয়। আমি দেখেছি। অনেক বছর আগে আমার এক সহকর্মী — দীপঙ্কর — সেই অরণ্যে গিয়েছিল। আর ফেরেনি।”
বিকেলের দিকে তাঁরা দু’জনে রওনা দেন পুরুলিয়ার সীমান্তঘেঁষা বরাবাজারের দিকে, যেখানে ঘন জঙ্গল আর পাহাড়ের ভাঁজে গড়ে উঠেছে আদিবাসী গ্রামগুলোর জটিল নেটওয়ার্ক। রাস্তা চলতে চলতে রাধিকা গল্প বলতে থাকেন — কীভাবে স্থানীয়রা এক প্রাচীন অভিশাপের কথা বলে, যা এক “তান্ত্রিকের আত্মা”কে ঘিরে রয়েছে। কেউ নাম নেয় না, কিন্তু অনেকে বলেন, “কালো পাহাড়ের ভেতরে” কিছু একটা আছে। কেউ কেউ বলে সেখানে রাত্তিরে ঢোকে না, কারণ “ধূপের গন্ধে ছায়া হাঁটে”। সন্ধ্যার ঠিক আগে তাঁরা পৌঁছান মাধবপুর নামে একটি ছোটো আদিবাসী গ্রামে। শৌনক সেই গ্রামে পা রাখতেই অনুভব করেন — এটা অন্যরকম জায়গা। ঘরবাড়িগুলো মাটির, দেয়ালে আঁকা রঙিন আলপনা — কিন্তু মানুষের মুখ গম্ভীর, চোখে ভয়। এক বয়স্কা নারী তাঁকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করেন, “আপনি চক্র দেখতে এসেছেন?” শৌনক চমকে গিয়ে বলেন, “চক্র?” তিনি জবাব না দিয়ে চলে যান, কিন্তু রাধিকা বলেন, “এখানকার মানুষদের গল্পে ‘চক্র’ মানেই মৃত্যুর কেন্দ্র। কেউ কেউ বলে, একবার শুরু হলে কেউ ফিরে আসেনি।” শৌনকের মনে পড়ে বাবার লেখা সেই লাইন — “চক্রব্যূহ রক্ত চায়”। সেই রাতে তাঁরা থাকেন গ্রামের একটি খালি ঘরে — বারান্দা দিয়ে দেখা যায় দূরে একটা ছোটো পাহাড়, আর তার গা ঘেঁষে ঘন জঙ্গল, যেন কোন সত্তা ওদের লক্ষ করছে।
রাত একটার দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় শৌনকের। বাইরে শীতল বাতাসে ধূপের মতো গন্ধ ভেসে আসছে। সে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় — দূরে পাহাড়ের গায়ে কিছু একটা নড়ছে। একটা ছায়া। সরু, লম্বা, মাথা ঢাকা। যেন হেঁটে যাচ্ছে। সে চোখ মেলে দেখতে চেষ্টা করে — আর ঠিক তখনই পাশ থেকে এক গলা বলে ওঠে, “আপনিও দেখলেন?” — রাধিকা। দু’জনে মুগ্ধ বিস্ময়ে সেই ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে — হঠাৎ করেই ছায়াটা যেন বাতাসে মিলিয়ে যায়। নীরবতা আবার গাঢ় হয়ে আসে। রাধিকা ফিসফিস করে বলেন, “এই ছায়াটা আমি আগেও দেখেছি, দীপঙ্কর হারিয়ে যাওয়ার আগের রাতেও।” শৌনকের গলা শুকিয়ে আসে — এ কি তাহলে কাকতালীয়? নাকি সত্যিই কিছু একটার ইঙ্গিত? পরদিন সকালে তাঁরা গ্রামের প্রবীণ সাধক গিরিধারী চরণ হাঁসদা-র সঙ্গে দেখা করতে যান। তিনিও এক রহস্যময় ব্যক্তি — চোখে গাঢ় সাদা ছানি, চামড়ায় ছোপ, অথচ গলায় এমন একটা মন্ত্রোচ্চারণের স্বর, যা শুনে শরীর কেঁপে ওঠে। তিনি শোনামাত্র বলেন, “ব্রহ্মচক্র খুলছে। সাতটা পথ আছে। প্রত্যেকটার গায়ে মৃত্যু লেখা। তুমি যাবে?” শৌনক কিছু না বলতেই গিরিধারী একটা পাথরে আঙুল রাখেন — সেখানে খোদাই করা সেই চিহ্ন — ত্রিভুজের মাঝে সাতটি বিন্দু।
অধ্যায় ৩
মাধবপুর গ্রামের শেষ প্রান্তে একটি শাল গাছের বনে, সকালটা শুরু হয় হালকা কুয়াশা আর পাখির ছেঁড়া ছেঁড়া ডাক দিয়ে। গিরিধারী হাঁসদার নির্দেশ মতো শৌনক ও রাধিকা পৌঁছান এক পরিত্যক্ত ঝরনা-সংলগ্ন শিলাপিঠে, যার চারপাশে গাছেদের গায়ে লাল কাপড় বাঁধা — যেন কোনো অদৃশ্য অনুশাসন জারি আছে সেই জায়গায়। এখানে পৌঁছেই শৌনক দেখতে পান পাথরের গায়ে খোদাই করা এক বৃত্ত, যার ভিতরে সাতটি বিন্দু ও এক প্রাচীন মন্ত্রের ধ্বংসপ্রাপ্ত লিপি। গিরিধারী হাঁসদা এসে দাঁড়ান সেই বৃত্তের সামনে — তাঁর চোখ যেন ফাঁকা, অথচ ভিতরে জমে আছে শতাব্দীর অভিজ্ঞতা। তিনি একখানি মাটির পাত্রে জল এনে সেটি ঘুরিয়ে রাখেন বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুতে। “এই জলচক্র,” তিনি বলেন, “প্রথম দরজা। আত্মা আর শরীরের বিভাজন এখানেই শুরু হয়। তুমি যদি প্রস্তুত হও, তবে সে জল তোমার মধ্য দিয়ে যাবে। না হলে… সে তোমায় গিলে ফেলবে।” শৌনক দ্বিধায় পড়ে যান — কিন্তু পেছনে ফেরার রাস্তা এখন আর নেই। তিনি পাথরের বৃত্তে বসেন। ঠান্ডা জল পায়ের চারপাশ ঘিরে আসে, আর গিরিধারী মন্ত্র পড়তে থাকেন এমন এক সুরে, যা শৌনক আগে কখনও শোনেননি — সেটি যেন শব্দ নয়, ধ্বনি নয়, নিঃশ্বাসের এক গভীর প্রতিধ্বনি।
জল হঠাৎ অদ্ভুত ঠান্ডা হয়ে ওঠে। মুহূর্তে যেন সময় থমকে যায় — চারপাশের শব্দ হারিয়ে যায়, শুধু শোনা যায় নিজের হৃদস্পন্দন। শৌনক চোখ বন্ধ করেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে, চোখের ভেতর ফুটে ওঠে এক দৃশ্য — যেন স্বপ্ন নয়, বাস্তব নয়, কিন্তু স্পষ্ট। তিনি দেখেন এক অন্ধকার ঘর — যেখানে তাঁর বাবা শিবরাম রায় চিৎকার করে কিছু বলছেন, কিন্তু আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। বাবার কপালে রক্ত, হাতে সেই একই চিহ্ন — ত্রিভুজের মাঝখানে সাতটি বিন্দু। আর তারপর হঠাৎ তাঁর চারপাশে জল ঘূর্ণাবর্তের মতো ঘুরতে থাকে — পাথরের গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে জলের রং লাল হয়ে যায়। শৌনক বুঝতে পারেন, এটা স্বপ্ন নয় — এটা তাঁর নিজের ভিতরে থাকা কোনো দরজা, যা প্রথমবারের মতো খোলা হয়েছে। সেই দরজার ওপারে আছে এমন কিছু, যা ভাষায় বোঝানো যায় না। যখন সে চোখ খুলে বসে ওঠেন, চারপাশে তখন নিস্তব্ধতা। গিরিধারী বলেন, “তুমি দেখেছো তাকে?” শৌনক চুপ করে থাকেন। তাঁর কাঁধ ভারী হয়ে আছে, মাথার ভেতর গমগম করছে — কিন্তু গভীর কোথাও যেন একটা চিনচিনে অনুভব, একটা সংকেত জেগে উঠেছে, যেটা আগেও ছিল, কিন্তু চাপা ছিল। রাধিকা তাঁকে প্রশ্ন করেন, “তুমি কাঁদছিলে কেন?” শৌনক বিস্ময়ে বোঝেন — তাঁর চোখ ভিজে গেছে। কিন্তু কোনো ব্যথা, কোনো ভয়, কোনো দুঃখ — কিছুই সে মনে করতে পারছে না। শুধু একটা অনুভব — যেন জল তাঁকে স্পর্শ করেনি, সে নিজেই জল হয়ে গিয়েছিল।
রাত্রি নামে। শাল গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো পড়ে পাথরের ওপর। শৌনক ডায়েরি খুলে লেখে — “আজ চক্রের প্রথম দরজা পেরোলাম। ভিতরে কেউ ডাকছে — স্পষ্ট না হলেও অনুভব করি সে কাছে আসছে।” রাধিকা তাঁকে চুপিচুপি বলেন, “তোমার বাবার সময়ও এরকমই হয়েছিল। প্রথমে স্বপ্ন, তারপর ছায়া… তারপর ছায়া রূপ নেয় মানুষের।” ঠিক তখনই গিরিধারী হাঁসদা আবার সামনে এসে দাঁড়ান। তিনি বলেন, “আগামী পূর্ণিমায় দ্বিতীয় চক্র খুলবে — কিন্তু তার আগে তুমি নিজেকে জানতে পারো কিনা, তা প্রমাণ দিতে হবে। আত্মার নিজস্ব প্রতিচ্ছবি আছে — তুমি তাকে চিনতে পারলে চক্র তোমার হবে। না হলে… তুমি চক্রের হয়ে যাবে।” এই রহস্যময় বাক্যগুলি শোনার সঙ্গে সঙ্গে বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে আসে — দূরে কোথাও বাঁশ ঝোপের ভেতরে হালকা শব্দ হয়, যেন কেউ পা টেনে হেঁটে যাচ্ছে। শৌনক আর রাধিকা তাকিয়ে থাকেন — কোনো মানুষ নয়, কোনো জন্তু নয়, কিন্তু একটা ছায়া সেখানে দুলে ওঠে… আর তারপর মিলিয়ে যায়। আর তখনই প্রথমবার, শৌনক শুনতে পান সেই নাম — ফিসফিস শব্দে, কানের গভীরে কেউ যেন বলে উঠছে — “কালাপাহাড়…”
অধ্যায় ৪
পূর্ণিমার আগের রাত। চারদিক নিস্তব্ধ। মাধবপুরের সেই শাল বনের ধারে আগুন জ্বালিয়ে বসে আছেন শৌনক, রাধিকা ও গিরিধারী হাঁসদা। আগুনের শিখা মাঝে মাঝে হেলে পড়ছে হাওয়ার ঝাপটায়, ঠিক যেমন হেলে পড়ে মানুষের বিশ্বাস — যুক্তির বিরুদ্ধে, অজানার প্রতি টান অনুভব করে। গিরিধারী তাঁর ছেঁড়া পাগড়ি খুলে হাতে রেখে বলেন, “কাল শুরু হবে দ্বিতীয় চক্র — পৃথিবীচক্র। অনেকেই ভাবে এটা সহজ। কিন্তু এই চক্রেই মানুষ সবচেয়ে বেশি হারায়।” রাধিকা একটু অস্থির ভঙ্গিতে বলেন, “তুমি এটা কেন বলছো? প্রথম চক্র তো শৌনক পেরিয়ে এসেছে।” গিরিধারী সোজা চোখে তাকিয়ে বলেন, “প্রথম চক্র ছোঁয়া যায়। দ্বিতীয় চক্র ভিতরে ঢুকে পড়ে। যেখানে নিজের সত্তার নিচে চাপা পড়ে থাকে অপরিচিত এক অস্তিত্ব।” ঠিক তখনই হাওয়ায় ভেসে আসে ধূপের গন্ধ। রাধিকা হঠাৎ চুপ করে যান। শৌনক শোনে একটা মৃদু গানের সুর — যেন কেউ দূরে বসে তান ধরছে। গিরিধারী ফিসফিস করে বলেন, “সে এসে গেছে। দ্বিতীয় চক্রের দ্বাররক্ষী। যার নাম কেউ জানে না। কিন্তু সবাই ডাকে… সাধনা।”
ছায়ার ভিতরে থেকে এক নারী এগিয়ে আসে। পায়ে ঘুঙুর নেই, তবুও হাঁটার শব্দ আছে। তার পরনে কাঁচা হলুদ শাড়ি, যার গা ছুঁয়ে রয়েছে মাটি ও ধূপের গন্ধ। মুখে এক অলৌকিক প্রশান্তি, চোখে খোঁজার অভ্যাস, আর গলার নিচে একটা ত্রিকোণ আকৃতির তাবিজ। সে সামনে এসে বসে, গিরিধারী হাঁসদার দিকে না তাকিয়ে শুধু বলে, “তোমার ছাত্র কি তৈরি?” গিরিধারী মাথা নিচু করে বলেন, “সে চক্র পেরিয়েছে, কিন্তু তার মধ্যে এখনো ‘আমি’ রয়ে গেছে।” সাধনা চোখ ঘুরিয়ে তাকায় শৌনকের দিকে। গভীরতা এতটাই তীব্র যে শৌনক চোখ নামিয়ে নিতে বাধ্য হন। “তুমি কি বুঝেছো, কাকে খুঁজতে এসেছো?” — তার প্রশ্ন। শৌনক উত্তর খুঁজতে গিয়ে বুঝে ফেলেন, তার ভিতরে সত্যিই উত্তর নেই। তার হাতের তালুতে এখনো আগের চিহ্নটি রয়েছে — ত্রিভুজের মাঝে সাতটি বিন্দু। সাধনা এগিয়ে এসে তার তালু স্পর্শ করেন, হঠাৎ যেন আগুনের মতো একটা শীতলতা প্রবাহিত হয়ে যায় শৌনকের সারা শরীরে। সে কেঁপে ওঠে। সাধনা বলেন, “এই চিহ্ন শুধু একটি চক্র নয়। এটি একটি প্রতিশ্রুতি। এই চিহ্ন যার থাকে, তার স্মৃতিকে সময় মুছে ফেলতে পারে না। এমনকি মৃত্যুও নয়।”
রাত্রি গড়িয়ে ভোর হয়। আকাশ ফিকে নীল, সূর্যের আলো এখনও জঙ্গলের ছায়া ছুঁয়ে ওঠেনি। গিরিধারী সবাইকে নিয়ে যান জঙ্গলের আরও গভীরে, যেখানে শালগাছের নিচে মাটির ওপর আঁকা রয়েছে একটি বৃত্ত, বৃত্তের মাঝে স্থাপন করা একটি পাথর — যার গায়ে খোদাই, “ভূমিচক্রঃ ত্বমস্মি”। সাধনা সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, “এ চক্রে প্রবেশ করলে মনে হবে, তুমি নিজের মধ্যে নেমে যাচ্ছ। মাটি তোমার স্মৃতি টেনে নেবে, কিন্তু যদি তুমি তোমার সত্যিকারের চেহারা চিনতে না পারো — তবে তুমি ফিরে আসবে না। শুধু ছায়া হয়ে যাবে।” গিরিধারী মাটি ছুঁয়ে বলেন, “এই চক্র সেই জায়গা, যেখানে ‘আমি’ ও ‘তুমি’ মিলেমিশে এক হয়ে যায়। বিভাজন থাকে না। স্মৃতি, যন্ত্রণা, আশা — সব একসাথে।” শৌনক মাটির ওপর বসেন। চোখ বন্ধ করেন। এক অজানা শ্বাস ফুসফুসে ঢুকে পড়ে — সে অনুভব করেন, যেন কোনও অন্ধকার ঘরের ভেতরে প্রবেশ করছেন, যেখানে দেয়ালে হাত দিয়ে এগোতে হয়, কোনো আলো নেই, শুধু ধুলোর গন্ধ আর দূর থেকে কারও ফিসফাস। হঠাৎ সে নিজেকে দেখতে পান — ছোটবেলার বাড়ি, তার বাবা মায়ের মুখ। কিন্তু সেই মুখগুলো ধীরে ধীরে কালো ছায়ায় ঢাকা পড়ে যায়। বাবার মুখটা হঠাৎ বলে ওঠে, “তুমি কেন এসেছো, শৌনক? আমায় ছাড়ো না।” সে চিৎকার করে উঠে বসে পড়ে। মাথা ঘামছে, শ্বাস ভারী। চারপাশে আবার শালগাছ, আবার সেই সকালের আলো। শুধু পাশে নেই সাধনা।
অধ্যায় ৫
সকালটা ছিল অস্বাভাবিক রকম নীরব। মাধবপুরের পাশ দিয়ে যে সরু কাঁচা পথ পাহাড়ের দিকে উঠে গেছে, সেই পথের মাথায় দাঁড়িয়ে ছিল রাধিকা, মুখে একটা চাপা আতঙ্কের ছায়া। শৌনক তখনো দ্বিতীয় চক্রের অভিজ্ঞতা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি। তাঁর শরীর স্বাভাবিক হলেও, মন যেন কুয়াশার ভেতর আটকে। সাধনা আর দেখা দেয়নি সেই রাতের পর, আর গিরিধারী হাঁসদার কথাও যেন আরও গম্ভীর হয়ে উঠেছে। “মৃতেরা সব দেখছে,” তিনি বলেছিলেন, “তোমার পেছনে যারা আছে, তারা শুধু মানুষ নয়।” সেইসময়েই গ্রামে এসে হাজির হয় এক নতুন আগন্তুক — নাম বিশ্বনাথ মিত্র, কলকাতার এক ইউটিউব রিপোর্টার, যিনি “অলৌকিক বাংলার খোঁজে” নামে একটি সিরিজ চালান।
বিশ্বনাথ নিজেকে পরিচয় দেন হাসিমুখে, ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে বলেন, “ব্রহ্মচক্রপীঠ নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি। আপনাদের অনুসন্ধান জানলে আমার কাজে খুব সাহায্য হয়।” রাধিকা স্পষ্টভাবে তাঁকে সন্দেহ করেন, কিন্তু শৌনক কিছু না বলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। বিশ্বনাথ বলে, “গতকাল রাতে আমি এই জঙ্গলের পাশে ড্রোন উড়িয়েছিলাম। ফুটেজে একটা অদ্ভুত কিছু ধরা পড়েছে — ছায়ার মতো, কিন্তু চলমান। আপনি একবার দেখবেন?” সে ফোনে একটি ভিডিও দেখায় — রাতের কালো আকাশে, বাঁশঝাড়ের পাশে হঠাৎ এক ছায়ামূর্তি চলতে চলতে থেমে দাঁড়ায়, তারপর সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকায়। ঠিক তখনই ক্যামেরা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। শৌনকের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। তিনি স্পষ্টভাবে সেই চোখদুটি দেখেছেন আগেও — তাঁর নিজের স্বপ্নে।
বিকেলের দিকে গিরিধারী হাঁসদা নির্দেশ দেন চতুর্থ চক্রে প্রবেশের প্রস্তুতি নিতে। “তেজচক্র,” তিনি বলেন, “আগুন যেখানে রূপান্তর করে, পোড়ায় না।” শৌনক বুঝতে পারেন, এখন আর পিছন ফিরে যাওয়ার রাস্তা নেই। কিন্তু ঠিক তখনই বিশ্বনাথ সিদ্ধান্ত নেন একা ঘুরে ভিডিও রেকর্ড করতে। গিরিধারী তাকে বারবার নিষেধ করেন, “এই চক্র বাইরে থেকে দেখা যায় না। যে ঢোকে, সে চিহ্ন রেখে যায়।” বিশ্বনাথ হাসেন, “চিহ্ন রেখে যাওয়া তো ভিডিওর কাজই!” সে একা চলে যায় পাহাড়ের বাঁ দিকের ঢালে, যেখানে পাথরের নিচে একটি ছোটো গুহার মতো কিছু দেখা যায়। ঘণ্টাখানেক পর সে আর ফেরে না।
রাত্রি নামে। হঠাৎ গিরিধারী হাঁসদা বলেন, “চলো। ও ফিরে আসবে না। ওর পেছনে প্রহরী ছিল।” সবাই চুপ করে থাকে। গিরিধারী আগুন জ্বালিয়ে তেজচক্র শুরু করেন — এবার আর বৃত্ত নয়, এক রূপান্তরিত কাঠামো — পাথরের পাঁচটি চূড়া, তাদের মাঝখানে শৌনক বসেন। আগুন জ্বলে ওঠে, চারপাশে এক তীব্র গন্ধ — যেন রক্ত আর ধূপ একসঙ্গে জ্বলছে। শৌনকের চোখে ভেসে ওঠে সেই আগুনে পোড়া মুখ — তাঁর পিতার, আবারও। কিন্তু এবার মুখটা চিৎকার করে বলে ওঠে, “প্রহরী জেগে উঠেছে!” সে জেগে ওঠে — রক্তভেজা মাটিতে শুয়ে রয়েছে, মুখে ধুলো, পাশে পড়ে রয়েছে বিশ্বনাথের ক্যামেরা — চূর্ণ। আর পাশে, গাছের গায়ে রক্তে লেখা একটা বাক্য — “চক্রকে থামিও না।”
অধ্যায় ৬
তেজচক্র পেরিয়ে আসার পরদিন সকাল। গিরিধারী হাঁসদা, রাধিকা আর শৌনক পাহাড়ের মাথার দিকে উঠতে শুরু করেন। শরীর গরম, বাতাস শুকনো, চারপাশে আগুনে পোড়া পাতার গন্ধ। গিরিধারী থেমে বলেন, “এর পরের পথে আমি তোমাদের সঙ্গে যেতে পারব না। আমি এখানে থেমে যাব।” শৌনক কিছু বলতে যায়, গিরিধারী হাত তুলে থামিয়ে দেন, “যে চক্রে কালাপাহাড় জেগে থাকে, সেখানে শুধুই সে মুখোমুখি হয়, যার ভিতরে ভয় আছে।” তিনি একটি তামার তাবিজ শৌনকের হাতে দেন, “এটা তার সামনে ভেঙে ফেলো, যদি সে তোমার ভিতরে ঢুকে যেতে চায়।”
পথ ক্রমে আরও নির্জন হয়। রাধিকা একসময় বলে, “তুমি জানো, কালাপাহাড় শুধু একটি আত্মা নয়। ও এক সময় ছিল সাধক। লোককথা বলে, তার নিজের গুরুই তাকে শেষ মুহূর্তে বিশ্বাসঘাতকতা করে অপূর্ণ সাধনায় ফেলে রেখেছিলেন।” শৌনক জিজ্ঞেস করে, “তাহলে সে প্রতিশোধ নিচ্ছে?” রাধিকা বলেন, “সে চায় সাধনা সম্পূর্ণ হোক, কিন্তু তার হাত ধরে — কারো, যে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারবে।” ঠিক তখনই হাওয়ার গতি বাড়ে, চারপাশে কুয়াশা জমে ওঠে। একটা গাছের নিচে দাঁড়াতেই মাটির নিচ থেকে ধোঁয়া উঠতে থাকে। শৌনক অবাক হয়ে সামনে তাকিয়ে থাকে — সাদা কুয়াশার ভেতর থেকে ধীরে ধীরে একটা অবয়ব গড়ে উঠছে।
দীর্ঘ, কঙ্কালসার শরীর, কাঁধে ছেঁড়া বস্ত্র, চোখে শূন্যতার সাদা আলো। তার পায়ের নিচে মাটি শুকিয়ে যাচ্ছে, আর মুখে এক ধরণের চিরন্তন শূন্যতা। কালাপাহাড়। সে মুখ তোলে, তার কণ্ঠের শব্দ বাতাসে ভেসে ওঠে — “তুই এলি? তুই কি জানিস, কতজন এসেছিল এর আগে? কতজন দেহ ছেড়েছে এই চক্রে?” শৌনক কিছু বলার আগেই তার দিকে ধেয়ে আসে সেই ঠান্ডা দৃষ্টি। “তুই বাবার ছেলে। তার সাধনা অসমাপ্ত। আমি জানি সে মরেনি, সে আছে তোকে ঘিরে। তোকে শেষ করতে হবে তার কাজ।”
শৌনক বলে, “আমি চাই না এই শক্তি। আমি শুধু জানতে চাই সত্যটা কী।” কালাপাহাড় হেসে ওঠে — এক ভয়ঙ্কর হাসি, যার শব্দেই যেন পাখিরা থেমে যায়। “সত্য? সত্য একটা ফাঁদ। তুই সত্য চাস, অথচ চাস না তার মূল্য দিতে। আমি মৃত্যুকে হারিয়েছি। তুই আমাকে থামাতে পারবি না।” সে এক ঝলকে সামনে এসে পড়ে — শৌনকের গায়ে ঠান্ডা ঘাম। ঠিক সেই সময়, সে গিরিধারীর দেওয়া তামার তাবিজ মুঠো করে ভেঙে ফেলে। একটা হালকা নীল আলো ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে, কালাপাহাড় কেঁপে ওঠে, তার শরীর দুলতে থাকে, সে পিছিয়ে যায়।
সে চিৎকার করে বলে ওঠে, “তুই পারবি না, ছায়া তোর পিছু ছাড়বে না। আমি তোকে ছাড়ব না!” বাতাস হঠাৎ স্তব্ধ। চারদিক নিস্তব্ধ। কালাপাহাড়ের অবয়ব মিলিয়ে যায় কুয়াশার মধ্যে। রাধিকা এসে শৌনকের কাঁধে হাত রাখে। সে ফিসফিস করে বলে, “চতুর্থ চক্র এখন খুলছে। তুমি পেরিয়ে গেলে, সে চিরতরে বেঁচে উঠবে — অথবা চিরতরে ধ্বংস হবে।”
শৌনক জানে, আর কোনো পথ নেই। তার শরীর-মন-আত্মা এখন চক্রের মধ্যেই। আর কালাপাহাড়ের ছায়া… ঠিক তার পেছনেই হেঁটে চলছে।
অধ্যায় ৭
অরণ্যের মধ্যবর্তী যে সরু পথ একসময় মিশে গিয়েছিল জঙ্গলের ঢেউয়ে, সেই পথ এখন শুষ্ক ও ভাঙাচোরা। শৌনক আর রাধিকা পৌঁছে যান একটি অদ্ভুত জায়গায় — না-শহর, না-জঙ্গল। জায়গাটির মাটি খয়েরি, আকাশ লালচে, আর বাতাসে যেন শোকের গন্ধ। এই জায়গার কোনো নাম নেই, গিরিধারী হাঁসদা শুধু বলেছিলেন, “যেখানে মৃতেরা হাঁটে, সেখানে শব্দ করতে নেই।” এখানেই চতুর্থ চক্র — “স্মৃতিচক্র”, যেখানে প্রবেশ করলে মানুষ তারই মুখোমুখি হয়, যাকে সে ভুলে গেছে।
শৌনক অনুভব করে, সময় এখানে থেমে গেছে। গাছ নেই, কুয়াশা নেই, শুধু লম্বা লম্বা ভাঙা গলি, যার দুপাশে মৃত শহরের ধ্বংসাবশেষ। কোথা থেকে যেন কুকুরের কান্নার মতো এক বিকৃত আওয়াজ ভেসে আসে। রাধিকা থমকে দাঁড়িয়ে বলেন, “তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?” শৌনক হ্যাঁ বলতে না বলতেই তার পায়ের নিচের মাটি কেঁপে ওঠে, আর মুহূর্তে সে যেন পড়ে যায় এক গহ্বরে — সময় ও বাস্তবতার সীমা ছাড়িয়ে।
সে চোখ খুলে দেখে — চারপাশে শহর, কিন্তু তার মুখচেনা। বাড়িগুলোর রঙ, জানালার কাঠ, এমনকি দোকানগুলোর নাম পর্যন্ত পরিচিত। কিন্তু সবই বিবর্ণ, যেন কোনো পুরনো ছবি। সে হেঁটে চলে এক অলস দুপুরের দিকে — যেখানে তার মা রান্নাঘরে হাঁটছেন, বাবা ডায়েরি লিখছেন, আর সে নিজে ছোট বয়সে বসে আছে বারান্দায়। কিন্তু হঠাৎ মা তাকিয়ে বলেন, “তুই ফিরলি না কেন?” বাবার চোখে জল, তিনি ডায়েরি ছুঁড়ে ফেলে দেন, আর বলে ওঠেন, “তুই তো আমায় মেরেছিস, শৌনক। আমায় পূর্ণ হতে দিলি না।”
চারপাশে অদ্ভুত শীত। স্মৃতি থেকে যন্ত্রণার কাঁটা বেরিয়ে আসছে। রাধিকা যেন দূর থেকে ডাকে, “শৌনক! এটা বাস্তব নয়! বেরিয়ে এসো!” কিন্তু তার গলা যেন সময়ের দেয়ালে আটকে যায়। ঠিক তখনই শৌনক দেখতে পান একটি ফাটল — যার ওপারে কালো ধোঁয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সেই ছায়ামূর্তি — কালাপাহাড়, এবার তার মুখের বিভ্রান্তি নেই, সে নির্ভয়ে ডাকে, “এসো। এই শহরই তোমার সত্য। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি।”
শৌনক দৌড়াতে থাকে, কিন্তু পায়ের নিচে পথ নেই। সে পড়ে যায় অন্ধকারে, আর যখন উঠতে চায় — তার সামনে এক বৃদ্ধা, যার চুল কাঁচাপাকা, গলায় পুঁতির মালা। সে ফিসফিস করে বলে, “তুই যদি এই চক্র পেরোস, তোকে ভুলে যেতে হবে সব — আমি, বাবা, মা… রাধিকা।” শৌনক থেমে যায়। প্রশ্ন করে, “তুমি কে?” বৃদ্ধা উত্তর দেয় না — শুধু বলে, “চক্রের রক্ত চাই। স্মৃতি দিয়ে না দিলে, শরীর নেবে।”
মাটিতে শৌনক হঠাৎ নিজের হাত দেখতে পায় — পাথরের মতো ভারী, আঙুলগুলো ফেটে যাচ্ছে। ঠিক তখনই, তার মনে পড়ে যায় বাবার ডায়েরির সেই শেষ বাক্য — “তুমি যদি শুরু করো, তবে শেষ করতেই হবে।” সে দাঁত চেপে বলে ওঠে, “আমি ভুলব না। আমি শেষ করব।” চোখ বন্ধ করে সে আবার স্মৃতির প্রবাহে ডুব দেয়, এবং যখন চোখ খোলে — সে ফিরে এসেছে রাধিকার পাশে, শহর আর নেই, মৃতরাও নেই।
শুধু সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিশাল দরজা — তামার তৈরী, ত্রিভুজ খোদাই করা, আর তার মাঝে লেখা — “পঞ্চম চক্র: আত্মাহুতি”।
রাধিকা কাঁপা গলায় বলে, “তুমি পেরিয়ে এসেছো। কিন্তু এর পর যা আছে… সেটা আর কেউ কখনও বর্ণনা করতে পারেনি।”
শৌনক ধীরে বলে, “আমি বেঁচে ফিরবো না হয়তো। কিন্তু সত্যটা আমি খুঁজে বের করব। কালাপাহাড়কে শেষ করতেই হবে।”
অধ্যায় ৮
রাত্রি নেমে আসে গভীর কুয়াশার আড়ালে, মাধবপুরের সেই অজানা জঙ্গলে। শৌনক, রাধিকা আর গিরিধারী হাঁসদা পৌঁছে যায় পঞ্চম চক্রের দরজার সামনে — বিশাল, চাঁদের আলোয় সোনালী করে ঝলমলানো, ত্রিভুজাকৃতির তামার দরজা। গিরিধারী হাত তুলে বলেন, “এই দরজা একবার খোলা হলে আর পিছনে ফেরার পথ থাকে না। আত্মা এখানে নিজের সর্বোচ্চ দান দিতে হয় — নিজের সবকিছু ছেড়ে দিতে হয়।” শৌনকের হাতে সেই তামার তাবিজ, যা কালাপাহাড়ের বিরুদ্ধে একমাত্র অস্ত্র।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শৌনক মনে করে, তার জীবনের সব কিছুই এখন এখানে ঝুঁকির মধ্যে। কাঁপতে থাকা হাত দিয়ে সে দরজায় স্পর্শ করে। হঠাৎ চমৎকার এক আগুনের শিখা তার চারপাশে জ্বলতে শুরু করে, কিন্তু দাহ করে না, বরং তীব্র শক্তি যোগায়। রাধিকা ফিসফিস করে বলে, “এই আগুন আত্মাহুতির আগুন। যে আত্মা একবার এতে জ্বলে ওঠে, সে নতুন রূপ নেয়।”
দরজা ধীরে ধীরে খুলতে থাকে। ভেতর থেকে আসতে থাকে এক অতীন্দ্রিয় সুর, যা শৌনকের মনের গভীরে ঢুকে পড়ে। ভেতরে ঢুকতেই সে দেখতে পায় এক বিশাল হল, যেখানে একদল তান্ত্রিক আগুনের চারপাশে ঘুরে। তাদের মুখ ঢাকা, কণ্ঠ উচ্চ, আর পা নিচে লাল সাদা রক্তের আলতা। এক মুহূর্তে কালাপাহাড় হাজির হয় তাদের মাঝখানে, তার চোখে আগুন, শরীরে অশ্রু, আর কণ্ঠে ধ্বংসের মন্ত্র।
শৌনক বুঝতে পারে, এই চক্রের শেষ ধাপ হলো নিজের আত্মাকে পুরোপুরি আগুনে দেওয়া — নিজের ভীতিকে জ্বালিয়ে ফেলা। সে নিজের মনের ভেতরকার সেই অন্ধকার, সেই ছায়া, সেই ভয়কে মোকাবিলা করতে হবে। আগুনের চারপাশে সে দাঁড়িয়ে বলে, “আমি ভয় পেতেও প্রস্তুত। আমি ফিরে আসব, এই চক্র সম্পূর্ণ করব।”
এক মুহূর্তের জন্য কালাপাহাড়ের ছায়া তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে, “তুমি সফল হলে, আমি মরে যাব। কিন্তু যদি হারো, আমি তোমার অন্তরে বাস করব চিরকাল।”
শৌনক ঝাঁপ দিয়ে আগুনের মাঝে চলে যায়। আগুনে তার শরীর পোড়তে থাকে, কিন্তু দাহ নয়, বরং শক্তি। সে নিজেকে নতুন করে তৈরি করে। আগুন নিভে গেলে, সে উঠে দাঁড়ায় — বদলে গেছে। তার চোখে আর ভয় নেই, শুধু এক অনন্য দৃঢ়তা।
রাধিকা ও গিরিধারী হাঁসদা আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে। শৌনক বলে, “চক্র সম্পূর্ণ হলো। কালাপাহাড় মারা গেছে, আর আমি ফিরে এসেছি।”
তারা বুঝতে পারে, এই যুদ্ধ শেষ নয় — কিন্তু তাদের ভেতরের অন্ধকার জ্বলন্ত আগুনে পুড়ে শেষ হয়েছে। নতুন যাত্রার শুরু।
আগুনের সেই শক্তির মধ্য দিয়ে ফিরে এসে, শৌনকের চোখে নতুন এক আভা জ্বলে ওঠে। আর্তনাদের বদলে এখন একটা গভীর শান্তি, একটা অদম্য সংকল্প। রাধিকা ও গিরিধারী হাঁসদার চোখেও সেই অনুভূতি স্পষ্ট—“তুমি সত্যিই চক্রপথ পেরিয়ে এসেছো,” গিরিধারী বলেন, “কিন্তু যাত্রার শেষ নেই। এবার শুরু হবে তোমার আসল পরীক্ষা—যুদ্ধের বাইরে, জীবনের ভিতর।”
মাধবপুরের সেই জঙ্গলের অন্ধকার থেকে বের হয়ে, শহরের দিকে ফেরার পথে, শৌনকের মনে নানা স্মৃতি ভেসে ওঠে—তার বাবা শিবরামের অসমাপ্ত সাধনা, সেই রহস্যময় তন্ত্রমন্ত্র, আর কালাপাহাড়ের ছায়া যা চিরদিন পিছু ছাড়েনি। রাধিকা বললেন, “এখন তোমাকে শুধু তন্ত্রের গোপন মুখোমুখি হতে হবে না, জীবনকেও জয় করতে হবে।”
শহরে ফিরে তারা খোঁজ পান যে, কালাপাহাড়ের অভিশাপ শুধুমাত্র অরণ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে শহরের নির্জন গলিপথ, পুরনো বাড়ির ছায়া, এমনকি মানুষের হৃদয়ে। শৌনক বুঝতে পারেন, যে যাত্রার শুরু হয়েছিল একটি রহস্যময় সাধনপীঠ থেকে, তা এখন সমাজের অন্ধকার কোণে ঢুকে গেছে।
“এখন শেষ যাত্রা শুরু,” শৌনক মনে মনে বলে, “যেখানে আমার সঙ্গে লড়বে আমার নিজের ছায়া, আমার ভয়, আর ইতিহাসের সেই কালো পর্দা।”
তারা প্রস্তুত হয় নতুন রহস্যের জন্য, যার মুখোমুখি হতে হবে শহরের গোপন করিডোরে, যেখানে ছায়া আর সত্য একাকার।
অধ্যায় ১০
অরণ্যের গভীর থেকে বেরিয়ে শহরের নির্জন কোণে পা রাখা সেই মুহূর্ত শৌনক, রাধিকা ও গিরিধারী হাঁসদার জন্য ছিল এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। পুরনো কলকাতার নন্দনপালের গলি, যেখানে সময় যেন থমকে গেছে, চারপাশে ছড়ানো ছেঁড়া দেয়াল আর ধুলোমাখা পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তারা বুঝতে পারছিল যে, এখানে গোপন রহস্যের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে। বছরের পর বছর ভেঙে পড়া বাড়িগুলো, ফাটানো জানালা, যেখানে কখনো ছিল তন্ত্র সাধনার আসর, আজ কেবল নিঃশব্দতার সাম্রাজ্য। শহরের বুকে যেন কেউ লুকিয়ে রেখেছে অতীতের আঁধার—একটা এমন গোপন যাত্রাপথ, যা অরণ্যের চক্র থেকে শুরু হয়ে আজ নাগরিক জীবনের অন্তরালে পৌঁছে গেছে। শৌনকের মনে হচ্ছিল যেন তার প্রতিটি পদক্ষেপ আজ আগের চক্রগুলোর মতো অজ্ঞাত ভয় আর উত্তেজনার সাগরে ডুবাচ্ছে। রাধিকা তাঁর পকেট থেকে পুরোনো একটি খুঁটিনাটি নোটবই বের করে দেখালেন—শিবরাম রায়ের হাত লেখা, যেখানে লেখা আছে “নন্দনপালের সেই গলিতে গড়িয়ে আছে প্রাচীন তন্ত্রের রক্ত,” এবং সেই রক্তের গন্ধ আজও যেন বাতাসে মিশে আছে। গিরিধারী হাঁসদা তাদের দিক নির্দেশনা দিয়ে বললেন, “এখানে প্রবেশ করার পর কোনো ভুল পথে গেলে ফিরে আসার পথ বন্ধ। তোমাদের মধ্যে শুধু শৌনকই শেষ সত্যের মুখোমুখি হতে পারবে।” সেই মুহূর্তে চারপাশের বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে আসে, যেন আগের সব নীরবতাকে ছিন্ন করে কোনো অতীন্দ্রিয় শক্তি তাদের ঘিরে ধরেছে। শহরের এই গলিপথের ভেতর প্রবেশ করতে গিয়েই তারা অনুভব করে—এখানে সময় আর বাস্তবতার নিয়ম ভিন্ন, অতীত আর বর্তমানের মেলবন্ধন থেকে এমন এক জটিল ক্যানভাস তৈরি হয়েছে, যেখানে প্রতিটি কোণায় গোপন গুঞ্জন, ভয়ের ছায়া আর বেদনাদায়ক স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
শহরের অন্তরালের সেই পুরনো বাড়িতে প্রবেশ করলেই তারা যেন অতীতের গোপন ফাঁদে পড়ে। মেঝেতে ধুলো, দেয়ালে পুরোনো তন্ত্র চিহ্ন, এবং ফর্সা ছায়ায় ভাসমান এক পুরোনো ফ্রেম—যেখানে দাঁড়িয়ে আছে শিবরাম রায় আর তাঁর গুরু। তাদের চোখের মাঝে যে অদ্ভুত আগুন, তা দেখে মনে হয় যেন সেই আগুন এখনও নিভে যায়নি। বাড়ির নিচতলার গোপন সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শৌনকের হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে ওঠে, মনে হচ্ছে প্রতিটি ধাপ যেন তাকে অজানা এক বাস্তবতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সিঁড়ির শেষে ছোটো একটি অন্ধকার কক্ষ, যেখানে এক কোণে রাখা ছিল অনেকগুলো পুরনো জার, তন্ত্রপত্রের গুচ্ছ, আর গাঢ় লাল রঙে খোদাই করা ত্রিভুজ চিহ্নযুক্ত পাথর। বাতাসে তখন এমন এক ঘ্রাণ ভাসছিল, যা একসঙ্গে ধূপ ও প্রাচীন রক্তের সুরভি ছিল। হঠাৎ কক্ষের বাতাসে শোনা যায় এক অদ্ভুত সুর—ধীরে ধীরে তা একটি বিষম লয় নিয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে, যেন অদৃশ্য কোনো সঙ্গীত সাধকের তন্ত্রমন্ত্র। চারপাশে অন্ধকার ছড়িয়ে পড়তে থাকে, আর সেই মুহূর্তে আবছা একটা কালো ছায়ার আবির্ভাব হয়—শহরের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা শেষ গোপন রহস্যের ছায়া। ছায়াটির আকার বড় এবং অস্পষ্ট, যেন কোনো জীবন্ত শয়তান, যাকে দেখে গিরিধারী হাঁসদা হঠাৎ বলে উঠলেন, “এটাই সে যাকে আমরা কালাপাহাড় বলি—যে কখনো মরে না, শুধু ছায়ার মতো বেঁচে থাকে।” শৌনকের হৃদয় তখন ব্যাথা আর আতঙ্কে ঠেস খায়, কিন্তু সে জানে এবার পিছু হটার কোনো পথ নেই। সে নিজের ভেতর থেকে সেই দৃঢ়তা খুঁজে বের করে, যা তাকে শেষ পর্যন্ত চক্র থেকে বের করে এনেছিল, আর এবার সেটাকেই সামনে নিয়ে আসতে হবে, কারণ কালাপাহাড়ের ছায়া ঠিক তার পিছনে হাঁটছে। রাধিকা এবং গিরিধারী হাঁসদা একান্তভাবে তাকে জানান, “এখানে তুমি একা। এই লড়াই তোমার নিজের—তুমি চক্রের শেষ স্তর পেরিয়ে যেতে পারলেই মুক্তি পাবে। অন্যথায়, কালাপাহাড় তোমাকে চিরতরে ধরে রাখবে।”
তাদের চারপাশে অন্ধকার ধীরে ধীরে আরো ঘন হয়ে আসে। শৌনকের মনে ভেসে ওঠে তার বাবার শেষ কথা, যা বহুবার তিনি পড়েছেন—“যে যাত্রা শুরু হয়, তাকে শেষ করতে হয়; মাঝপথে থামলে মৃত্যু নিশ্চিত।” সে দৃঢ় প্রত্যয়ে কণ্ঠ দিয়ে বলে ওঠে, “আমি ফিরে যাবো না। আমি শেষ করব।” এই সংকল্পের মধ্য দিয়ে সে অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যায়, যেখানে তার অপেক্ষায় রয়েছে অতীতের সব অশুভ স্মৃতি, তার নিজের ভয়, আর সেই ছায়ামূর্তি কালাপাহাড়। নিঃশ্বাস গুড়ে গুড়ে আসছে, শরীর জুড়ে অদ্ভুত এক শক্তি প্রবাহিত হচ্ছে, যেন সে আর এক নয়, বরং চক্রের এক অংশ। কিছুক্ষণ পরেই এক জায়গায় পৌঁছে সে, যেখানে আবছা আলো পড়ে, আর চারপাশে প্রচুর পাণ্ডুলিপি ছড়িয়ে রয়েছে—পুরনো তন্ত্রগ্রন্থ, যেগুলো তন্ময় চোখে পড়ে দেখে সে, এবং বুঝতে পারে যে এগুলোই ছিল বাবার অসম্পূর্ণ সাধনার রসদ। শৌনক এবার বুঝতে পারে, শুধু শক্তি নয়, সাহস আর জ্ঞানই এই লড়াইয়ে তার সঙ্গী হবে।
এইসব কাগজের মধ্যে হঠাৎ সে খুঁজে পায় এক অক্ষরবৃত্তাকার যাদুমন্ত্র, যা পুরুলিয়ার অরণ্যের সেই ব্রহ্মচক্রের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। সে চোখ বন্ধ করে মন্ত্র জপ করতে শুরু করে, তার মুখে অজানা এক প্রাচীন শব্দ ভেসে ওঠে, যেন সেই মন্ত্র ঘুমন্ত শক্তিকে জাগিয়ে তুলছে। আর ঠিক সেই সময়, অন্ধকার থেকে এক ঝলক বেরিয়ে আসে—কালো ছায়ার মত সে, কিন্তু এ বার কিছুটা মানবসদৃশ রূপে, যার চোখে দেখা যায় অনন্ত বিষাদ আর প্রবল শক্তি। কালাপাহাড়। দুজনের চোখ মুখোমুখি হয়। শৌনক জানে, এই মুহূর্তটাই শেষ লড়াইয়ের সূচনা, যেখানে জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, এবং সাহসের পরীক্ষা হবে। তার ভেতরকার সব ভয় আর সন্দেহকে পেছনে ফেলে সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, তামার তাবিজটি শক্ত হাতে ধরে রাখে, আর বলে ওঠে, “আমি শেষ করব, আর তুমিই চিরতরে হারাবে।” চারপাশের বাতাস যেন স্থবির হয়ে যায়, আর সেই অন্ধকার কক্ষ জুড়ে মন্ত্রের শব্দ ও শক্তির দোল ওঠে।
সেই সন্ধ্যা থেকে শহরের অন্তরাল যেন এক নতুন অধ্যায় শুরু করে—যেখানে অতীত আর বর্তমানের মিলন ঘটায় এক বৃহৎ যুদ্ধে। শৌনকের চোখে এক অদম্য সংকল্প জ্বলছে, তার হৃদয়ে ইতিহাসের ছায়া আর প্রাচীন শক্তির লড়াইয়ের বাণী প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এই যাত্রার শেষ নেই, কিন্তু সে জানে—যে যাত্রা শুরু করেছে, তাকে শেষ করতেই হবে, কারণ কালাপাহাড়ের ছায়া আর তার নিজের ছায়া আজ এক হয়ে গেছে।
অধ্যায় ১১
শহরের অন্তরালের অন্ধকার থেকে ফিরে আসার পর, শৌনক, রাধিকা, এবং গিরিধারী হাঁসদা এখন দাঁড়িয়ে আছে এক নতুন যাত্রার মুখোমুখি। তাদের সামনে সেই রহস্যময় চক্রের শেষ সিঁড়ি, যেখানে লুকিয়ে আছে পুরানো তন্ত্রের সব গোপন কথা, এবং কালাপাহাড়ের ছায়ার অন্তিম পরিচয়। শহরের কোলাহলে, জীবনের গুঞ্জনে যেন হারিয়ে গেছে সেই গভীর সত্য, যা এখন তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে — শুধুমাত্র সাহস আর জ্ঞানের শক্তিতে। শৌনক মনে করেন, এই যাত্রায় তার নিজের আত্মার সঙ্গেও লড়াই করতে হবে, কারণ চক্রের অন্তিম গহ্বরে পৌঁছানোর জন্য সে নিজের সব ভয়, সন্দেহ, এবং আবেগকে পরাজিত করতে হবে।
তারা পৌঁছে যায় এক পুরনো গ্রন্থাগারে, যেখানে স্থানীয় এক জ্যোতিষী তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি বলে ওঠেন, “এখানে পাওয়া যাবে সেই প্রাচীন মন্ত্র, যা শুধু তান্ত্রিক নয়, মানব মনকে মুক্তির পথ দেখায়। কিন্তু এর জন্য তোমাদের ভেতরের সব চেনা সীমা ভেঙে ফেলতে হবে।” গ্রন্থাগারের শীতল বাতাসে শৌনকের হৃদয়ে উদ্ভাসিত হয় এক অদ্ভুত আশা। সে বুঝতে পারে, এই শেষ অধ্যায়ে তাকে শুধু রহস্য উদঘাটন করতে হবে না, বরং নিজেকে খুঁজে পেতে হবে।
গ্রন্থাগারের গভীরে ঢুকে, তারা খুঁজে পায় এক রহস্যময় মন্ত্রপত্র, যার পৃষ্ঠাগুলোতে লেখা আছে এক প্রাচীন সাধকের অভিজ্ঞতা — যিনি কালাপাহাড়ের পূর্বপুরুষ এবং তার সাধনাকে শেষ করেছেন। সেই সাধকের কথা থেকে শৌনক শেখে, সত্যিকার শক্তি আসে নিজের ভেতরের অন্ধকারকে গ্রহণ করে তার সঙ্গে মিলিত হয়ে। তাই কেবল শক্তি নয়, প্রেম, করুণা, এবং ত্যাগের মাধ্যমেই কালাপাহাড়কে চিরতরে নিভিয়ে ফেলা সম্ভব।
এই উপলব্ধি নিয়ে তারা চলে যায় সেই গোপন স্থানে, যেখানে শুরু হয়েছিল সব কিছু — পুরুলিয়ার অরণ্য। তাদের সামনে এখন এক নতুন দরজা, যেখানে শুধু একটাই লেখা — “সত্যিকার যাত্রা এখন শুরু।” শৌনকের চোখে অদম্য সংকল্প, রাধিকার হৃদয় প্রশান্তি, আর গিরিধারীর অভিজ্ঞতা যেন একত্রে তাদের পথ দেখায়। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা, যে সময়েই তাদের চূড়ান্ত লড়াই শুরু হবে, যেখানে শুধুমাত্র একাই বাঁচবে — ছায়া নাকি আলো।
অধ্যায় ১২
পুরুলিয়ার অরণ্যের সেই গোপন গুহার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শৌনক, রাধিকা, ও গিরিধারী হাঁসদা অনুভব করল প্রকৃতির অদ্ভুত এক নীরবতা, যেন মুহূর্তে সময় থমকে গেছে। চারপাশ অন্ধকার, শুধুমাত্র কুয়াশার ভেতর থেকে যেন এক অশরীরী শক্তি ফুসফুসে বাতাসের মতো প্রবাহিত হচ্ছে। শৌনকের হাতে রয়েছে সেই প্রাচীন মন্ত্রপত্র এবং গিরিধারীর দেওয়া তামার তাবিজ, আর রাধিকা পাশে দাঁড়িয়ে আছে সাহস ও বিশ্বাস নিয়ে। তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল—এই গুহাতেই হবে কালাপাহাড়ের সঙ্গে চূড়ান্ত মুখোমুখি লড়াই, যেখানে শুধু শারীরিক নয়, আত্মিক শক্তিও পরীক্ষা হবে।
গুহার ভেতরে ঢুকতেই তাদের চারপাশে সময় ও বাস্তবতার বাধা ঝড়ের মত ভেঙে পড়তে থাকে। কালাপাহাড়ের ছায়া ধীরে ধীরে এক অস্বাভাবিক আকার ধারণ করে সামনে এসে দাঁড়ায়, তার চোখে প্রবল ক্রোধ আর বেদনা। শৌনক জানে, এই যুদ্ধ জিততে হলে তাকে ভেতরের অন্ধকারকে গ্রহণ করতে হবে, নিজের ভয়কে আলিঙ্গন করতে হবে। সে মন্ত্রপত্র থেকে সেই প্রাচীন মন্ত্র জপ করতে থাকে, আর তাবিজটি শক্ত হাতে ধরে কালাপাহাড়ের সামনে তুলে ধরে। আগুনের মতো এক আলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, যা ধীরে ধীরে কালো ছায়াকে ঘিরে ধরে।
যুদ্ধ শুরু হয়। ছায়া আর আলো মিলেমিশে এক মহাকাব্য রচনার মতো গড়ে ওঠে। কালাপাহাড় চিৎকার করে, “তুই শেষ করতে পারবি না!” কিন্তু শৌনকের কণ্ঠস্বর দৃঢ়, “আমি শেষ করব!” ধীরে ধীরে ছায়ার ভেতর থেকে বেদনার আবছা মায়া ঝরে পড়ে, আর কালাপাহাড় ছোট হতে শুরু করে। শেষ মুহূর্তে শৌনক নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে সেই অন্ধকারকে আলোতে রূপান্তরিত করে। গিরিধারী আর রাধিকা পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে বিস্ময়ে। শেষ পর্যন্ত, ছায়া নিভে যায়, আর গুহার মুখে সূর্যের আলো প্রবাহিত হয়।
এই লড়াইয়ের মাধ্যমে শৌনক শুধু কালাপাহাড়কে পরাজিত করেনি, বরং নিজের ভেতরের ভয় ও বেদনাকেও জয় করেছে। ইতিহাসের সেই কালো অধ্যায় শেষ হয়, আর নতুন আলোয় শুরু হয় নতুন অধ্যায়। শহর আর অরণ্য—সব মিলেমিশে এক নতুন চিরন্তন শান্তির স্বপ্ন বুনে।
সমাপ্ত