Bangla - রহস্য গল্প

কালাপাহাড়ের কুয়াশা

Spread the love

প্রতুল মন্ডল


নভেম্বরের হিমেল সকাল। শিয়ালদহ থেকে ছুটে আসা দার্জিলিং মেল ধীরে ধীরে পাহাড়ের কোলে ঢুকছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকা ঋত্বিক চৌধুরীর চোখে ছিল গভীর এক কৌতূহল—একটা অদ্ভুত টান। অভিষেক তার সঙ্গী, যার চোখে-মুখে রোমাঞ্চের ঝলক থাকলেও সে ছিল মূলত ছুটি কাটাতে এসেছে, হিমালয়ের শান্তি আর কিছু ইনস্টাগ্রাম-যোগ্য ছবি তুলতে। ওরা দুজনেই কলকাতা থেকে বেরিয়ে পড়েছে কাজের ক্লান্তি ঝেড়ে একটু প্রকৃতির কাছে যেতে, কিন্তু ঋত্বিক জানে, এই ভ্রমণ শুধু অবকাশ নয়। গত ছ’মাসে তার হাতে কোনও ‘কেস’ আসেনি, অথচ এই পাহাড়ি গ্রাম ‘চান্দাক’-এর আশেপাশে কয়েকজন পর্যটক হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ার খবর এক অখ্যাত অনলাইন ব্লগে পড়ে সে স্থির করে, এই ঘটনা আরেকটু গভীরে দেখা দরকার। অভি প্রথমে রাজি ছিল না, বলেছিল, “ছুটি মানেই পাহাড়, রোম, ঘুম আর মোমো।” কিন্তু ঋত্বিক যখন পুরোনো নথির ছবি দেখিয়েছিল, যেখানে ১৮৫৭ সালের পর থেকে বারবার এই এলাকায় ‘বিপদজনক পাহাড়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তখন অভি একটু নরম হয়। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ি মানুষ, কুয়াশা ভরা বাতাস, আর শীতে জমে থাকা পথের মধ্যে দিয়ে ওরা একটা জিপ ভাড়া করে রওনা দেয় চান্দাক গ্রামের দিকে। ড্রাইভারের নাম তেনজিং, গম্ভীর মুখ, চোখে অদ্ভুত একটা শূন্যতা। যেই না ঋত্বিক casually জিজ্ঞেস করে ফেলেছিল, “কালাপাহাড় কি এই গ্রামের কাছাকাছি?” তেনজিং চমকে গিয়েছিল। তার হাতের আঙুল শক্ত হয়ে স্টিয়ারিং চেপে ধরে বলেছিল, “ও নাম আর নেবেন না সাহেব…সেই পাহাড় অভিশপ্ত। এখনও যারা যায়, তারা আর ফিরে আসে না।”

পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চলছিল দুলতে দুলতে, যেন কোনও পুরানো কাহিনির পাতায় ঢুকে পড়েছে তারা। গাছপালা ঘন হচ্ছে, কুয়াশা ঘনীভূত, দূরের পাহাড় সাদা চাদরের মতো আচ্ছন্ন। সেই দৃশ্য যেন বাস্তবের থেকেও বেশি অবাস্তব। অভি একবার বলে উঠল, “ভাই, আমি কিন্তু সত্যি ভয় পাচ্ছি রে! এই জায়গাটার একটা অন্যরকম গন্ধ আছে।” ঋত্বিক তখন সোজা জানালার দিকে তাকিয়ে, চোখে একাগ্রতা। সে অনুভব করছিল, এই পাহাড় কেবল ভূগোল নয়, একটা বিশাল ইতিহাস বইয়ের মতো, যার পাতাগুলি মুছে ফেলা হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে। হঠাৎ পথের মোড়ে এক বুড়ো লামা দাঁড়িয়ে ছিল, তার গায়ে গেরুয়া বস্ত্র, হাতে কাঠের মালা। সে চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ফিরে যান…কালাপাহাড় ডাকছে না, সে শিকার করছে।” তেনজিং ব্রেক কষল, তারপর বিনা বাক্যব্যয়ে আবার গাড়ি চালাতে শুরু করল। অভি তখন গলা নামিয়ে বলল, “ঋত্বিক, আমাদের প্ল্যানটা কি ঠিক ছিল?” ঋত্বিক শান্ত গলায় জবাব দিল, “যেখানে ভয়, সেখানেই রহস্য।” চান্দাক গ্রামে পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল। ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম, নির্জন, কয়েকটা কাঠের বাড়ি, পাহাড়ি দোকান। লোকসংখ্যা নগণ্য। গ্রামের প্রবেশদ্বারেই একটি বড় সাইনবোর্ডে লেখা ছিল: “অবাঞ্ছিত কুয়াশার জন্য ৭টার পর বাইরে না যাওয়ার অনুরোধ রইল।” অভি পড়ে বলল, “কুয়াশা আবার অবাঞ্ছিত হয় নাকি?” ঋত্বিক শুধু চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে সেই পাহাড়ের দিকেই, যেটা গ্রামের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে ঘন সবুজে ঢেকে, আর তার মাথার চারপাশে ঘন কুয়াশার মুকুট। সেখানেই কালাপাহাড়।

রাত নেমে এলে হঠাৎই আবহাওয়া বদলে যায়। গ্রামের ঘরগুলির মধ্যে হালকা আলো জ্বলে ওঠে। বাইরে ঝিঁঝিঁর ডাক থেমে গিয়ে অদ্ভুত নীরবতা নামে। হোমস্টেতে থাকার ব্যবস্থা হয়, যেখানে বয়স্ক এক পাহাড়ি মহিলা মালতি তাদের জন্য রাতের খাবার তৈরি করছিল। খাবার টেবিলে বসে সে বলল, “আজ সকালে একজন পর্যটক হারিয়ে গেছে। সে গিয়েছিল সেই পাহাড়ের ধার ঘেঁষে ছবি তুলতে। ফেরেনি।” অভির মুখ থমকে যায়। ঋত্বিক জিজ্ঞাসা করে, “পুলিশ?” মহিলা মাথা নাড়লেন, “পাহাড় জানে কী আছে ওখানে। কিন্তু মানুষ বিশ্বাস করে না। কেউ খোঁজে সোনা, কেউ ছবি তোলে…কিন্তু কেউ ফেরে না।” রাতে শুতে যাওয়ার আগে ঋত্বিক তার নোটবুকে লিখে রাখে: “একটি পাহাড় যার নামের চারপাশে গুজব জড়িয়ে আছে, এবং যেটা লোকচক্ষুর আড়ালে কিছু লুকিয়ে রাখছে—এটা কেবল গল্প নয়।” অভি জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বলে, “দেখ, ওই পাহাড়টা কেমন যেন নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে…ওর মধ্যে একটা শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ যেন শুনতে পাচ্ছি।” রাত বাড়ে। ঘর অন্ধকার হয়ে আসে। এবং দূর পাহাড় থেকে যেন কুয়াশার ভিতর দিয়ে ভেসে আসে এক চাপা ধ্বনি—না বুঝতে পারা এক ভাষায়, না শুনতে পারা এক ডাক। কালাপাহাড় যেন ধীরে ধীরে ডাকে… তার পরবর্তী শিকারকে।

ভোরবেলা ঠান্ডার কামড় আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। চান্দাক গ্রামের হোমস্টের উঠোনে দাঁড়িয়ে অভি গরম কফির কাপ হাতে যখন সূর্যোদয়ের ছবি তুলছিল, তখনই হঠাৎ এক দৌড়তে আসা বালকের চিৎকারে গ্রামজুড়ে শোরগোল পড়ে যায়। “ভাইজু, আরেকজন নাই! হোটেল থেকে গেছেন পাহাড়ের দিকে, কিন্তু ফিরেনি।” সাদা কুয়াশার চাদরের নিচে পুরো গ্রাম যেন জমে গেল মুহূর্তে। কাঁপা গলায় অভি বলল, “ঋত্বিক, এ তো সত্যি সিরিয়াস!” ঋত্বিক তখন ঘুম থেকে উঠে বুট পরে উঠোনে বেরিয়েছে। সে গম্ভীর গলায় জানতে চায়, “শেষ কোথায় দেখা গেছে?” বালক জানায়, লোকটা গতকাল বিকেলে একা পাহাড়ের পায়ের ধারে ঘুরছিল ছবি তুলতে। তারপর আর কেউ তাকে দেখেনি। ঋত্বিক আর অভি সাথে সাথে ঘটনাস্থলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মালতি দিদা প্রথমে বাধা দিলেন, বললেন, “ওদিকে গেলে আর ফিরবেন না বাবারা। অনেক চেষ্টা হয়েছে, কেউ পারেনি।” কিন্তু ঋত্বিকের মধ্যে তখন কাজ করছে অভ্যন্তরীণ ছটফটানি—রহস্য তার রক্তে, অদৃশ্যতা তাকে টানে, আর এই পাহাড়ে কিছু একটা আছে যা লুকিয়ে আছে সমাজের চোখের আড়ালে।

ওরা তিনজন, সঙ্গে সেই বালক টুকাই, যায় পাহাড়ের দিকে। পথ যত এগোয়, তত কুয়াশা ঘন হয়। চারপাশে গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকছে না। একটা জায়গায় এসে টুকাই দেখায়, “এইখানে স্যার দাঁড়িয়ে ছিলেন, ছবি তুলছিলেন।” মাটিতে তখনও ফেলে রাখা ছিল একজোড়া ছেঁড়া চটি, কিছু জুতোয় পা চিহ্ন, আর একটা ক্যামেরার লেন্স কভার। যেন কেউ হঠাৎ বাতাসে মিলিয়ে গেছে। চারদিকে কোনো রক্ত, কোনো আঁচড় নেই, শুধু কুয়াশা। ঋত্বিক মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে দেখল, কিছু গাছের ডালের অংশ ভাঙা, যেন কেউ টেনে নিয়ে গেছে। অভি ভয়ভয়ে বলল, “তুই তো বলেছিলি এটা হয়তো গুজব, কিন্তু এটা তো বাস্তব!” ঋত্বিক মুখে কিছু না বলে পকেট থেকে তার ছোট নোটপ্যাডে লিখে নেয় পর্যবেক্ষণ: “টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়নি, বরং বাতাসের মধ্যে লোপাট। সম্ভবত শব্দহীন অপসারণ। কুয়াশার মোটা স্তর এখানে ব্যতিক্রমী।” হঠাৎ সে অনুভব করল—পাহাড় তাকে ‘পর্যবেক্ষণ’ করছে। এই কুয়াশা যেন শুধু প্রকৃতি নয়, কিছু বা কেউ এর মধ্যে আছে। কিছুক্ষণ পরে একজোড়া চোখ ঝলসে উঠল গাছের ভেতর—মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। টুকাই চিৎকার করে বলল, “ওইটা আমি আগেও দেখেছি! কালাপাহাড়ে যাওয়ার আগে সব সময় এই চোখ দেখা যায়!” অভি সিঁটিয়ে উঠল, “ভাই, আমরা কি ফিরে যাব?” ঋত্বিক মাথা নাড়িয়ে বলল, “যতক্ষণ না আমরা জানছি আসলে কী ঘটছে, ততক্ষণ ফিরে যাওয়া মানে হলো ভয়কে জয় দিতে না পারা।” সেই সময়ে পাহাড় থেকে একটি পুরোনো বাঁশি বাজনার মতো শব্দ ভেসে আসে—অপরিচিত, অথচ যেন ডাকের মতো।

গ্রামে ফিরে তারা খোঁজ নেয় পাহাড়ের ইতিহাস সম্পর্কে। প্রাথমিকভাবে কেউ মুখ খোলে না, যেন এক অলিখিত চুক্তি আছে নীরবতার। তখন গ্রামের এক বৃদ্ধ এসে বলে, “কালাপাহাড় শুধু একটা জায়গা নয়—ওটা এক দুঃখ। বহু বছর আগে এখানে এক দল পাহাড়ি পুরোহিত থাকতেন। তারা পাহাড়ের গুহায় কিছু লুকিয়েছিলেন—ধন না অভিশাপ, কেউ জানে না। তারপর এক এক করে ওরা হারিয়ে যায়। ইংরেজরা এসেছিল, তারাও গিয়েছিল কালাপাহাড়ে…আর ফেরেনি। এরপর থেকে কুয়াশা সেই পাহাড়কে ঘিরে রাখে। দিনের আলো এলেও ওটা থাকে ধোঁয়ায় ঢেকে। লোকেরা বলে, কেউ ডাকলেই কালাপাহাড় সাড়া দেয়।” সেই বৃদ্ধের নাম থুপেন লামা—সারা গ্রামে তার সম্মান আছে, কিন্তু সে নিজেকে পাহাড় থেকে দূরে রাখে। সে বলে, “আমি কেবল একটি মেয়েকে জানি যে এই পাহাড়ের আসল কথা জানে—লেমা ভুটিয়া। তার ঠাকুরদা ছিলেন শেষ মানুষ যিনি কালাপাহাড়ে গিয়েছিলেন ও ফিরে এসেছিলেন, তবে পাগল হয়ে।” অভি সন্দেহভরে বলল, “এটা লোককথা, না কি ভয় ছড়ানোর চেষ্টা?” কিন্তু ঋত্বিক জানে, সমস্ত লোককাহিনির পিছনেই কোথাও একটা বাস্তব থাকে, যার খোঁজ পেলেই রহস্য ভেদ করা সম্ভব হয়। সন্ধ্যে নামে, আর গ্রামের প্রতিটি ঘর জানালায় কাঠের খিল এঁটে নেয়। বাতাস থেমে যায়, কিন্তু পাহাড়ের দিক থেকে যেন একটা নীরব, ভারি উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। ঋত্বিক চুপচাপ বসে থাকে জানালার ধারে, আর ভেতরে ভেতরে অনুভব করে, “এই পাহাড় আমার কিছু চায়… হয়তো উত্তর, হয়তো সত্য, হয়তো শিকার।”

সকালবেলা রোদ উঠলেও চান্দাকের আকাশে যেন এক বিষণ্ণতা ছায়া ফেলেছিল। পাহাড়ের মাথার উপর কুয়াশার সাদা পুঁতি এখনও থমকে ছিল, একটুও নড়েনি রাতে। ঋত্বিক চা খেতে খেতে জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে ভাবছিল, এমন কী আছে কালাপাহাড়ে, যা এত মানুষের মন থেকে শব্দ কেড়ে নেয়? ঠিক তখনই মালতি দিদা দরজায় কড়া নাড়লেন। “লেমা এসেছে,” তিনি বললেন, “তোমরা যদি সত্যিই জানতে চাও, ও-ই একমাত্র পথ।” সামনের উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বয়সে হবে বাইশ-তেইশ, গাঢ় নীল পশমী চাদর পেঁচানো, হাতে বাঁশের লাঠি, চোখে পাহাড়ি রোদে পোড়া তীক্ষ্ণ চাহনি। সে শান্ত গলায় বলে, “আমি লেমা ভুটিয়া। শুনেছি, কালাপাহাড় নিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন। আমি আপনাদের সেখানে নিয়ে যেতে পারি, তবে শর্ত একটাই—সত্য জানার জন্য ভয়কে পাশে রাখতে হবে।” অভি মুখ টিপে হাসে, “তুমি তো সিনেমার মতো কথা বলছো।” কিন্তু ঋত্বিক জানে, এ মেয়ে শুধু গাইড নয়, সে এই রহস্যেরই একটা জীবন্ত সূত্র। লেমা বলে, “আমার ঠাকুরদা ছিলেন তাশি ভুটিয়া। তিনি একমাত্র মানুষ, যিনি কালাপাহাড়ে ঢুকে ফিরেছিলেন জীবিত। কিন্তু ফিরে এসে আর কখনো কথা বলেননি। শুধু পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতেন, আর কখনো কখনো হঠাৎ কেঁপে উঠতেন। তাঁর লেখা ডায়েরিটা আজও আছে আমাদের কাছে। তাতে শুধু একটাই বাক্য বারবার লেখা—‘ও আমাদের দেখছে।’”

ঋত্বিক ও অভি লেমার সাথে তার বাড়িতে যায়। পাহাড়ের ঢালে একটি ছোট্ট কাঠের কুঁড়েঘর, চারপাশে জংলি ফুল আর পাহাড়ি ঘাসে ঘেরা। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার, এক কোণে কাঠের পুরনো তাক, যার মধ্যে থেকে লেমা একটানা মলিন চামড়ার বাঁধাই করা ডায়েরি বের করে দেয়। ডায়েরির পাতা খুলতেই ধুলোর গন্ধে ভরে যায় ঘর। তাতে লেখা—”১লা মে, ১৯৭২—আজ আমি পাহাড়ের গুহায় ঢুকলাম। কুয়াশা গা ঘিরে ধরেছিল, আর আমি বুঝতে পারছিলাম, কেউ আমাকে দেখছে। আমি চলেছি সোজা, কিন্তু রাস্তা ঘুরে বারবার একই জায়গায় ফিরে আসছি। তারপর একটা শব্দ শুনি—একটা মৃদু বাঁশির ডাক, যেন বাতাস গিলে ফেলছে আওয়াজটাকে।” ঋত্বিক ডায়েরির পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে দেখে, এক জায়গায় আঁকা আছে এক অদ্ভুত প্রতিকৃতি—মানুষের আকৃতি, কিন্তু চোখ নেই। অভি চমকে উঠে বলে, “এটা কি ওই রক্ষক?” লেমা মাথা নাড়ে, “লোককাহিনি বলে, কালাপাহাড় রক্ষা করে এক অভিশপ্ত আত্মা। সে নাকি পাহাড়ের ধন পাহারা দেয়, আর কেউ যদি তার সীমা অতিক্রম করে, তাকে সে ‘ফিরিয়ে’ নেয়।” ঋত্বিক তখন বলে, “এই ধনটা কী?” লেমা বলে, “অনেক বছর আগে কিছু তিব্বতি সন্ন্যাসী এই গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁরা নাকি নিজেদের গোপন মন্ত্র, পুঁথি, আর কিছু অলৌকিক রত্ন পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে রাখেন, যাতে শত্রুরা তা না পায়। তারপর তারা পাহাড়কে মন্ত্রপূত করে দেন—যাতে কেউ তা ছুঁতে না পারে। কালাপাহাড় সেই পাহাড়, সেই গুহা।” অভি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, “পুরোটাই তো অলীক শোনাচ্ছে। কে জানে এসব সত্যি কি না!” লেমা চুপচাপ বলে, “আমার ঠাকুরদা ওরকম অলীক জিনিস দেখে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন।”

ঋত্বিক তখন উঠে দাঁড়াল, জানালার দিকে তাকিয়ে রোদের মধ্যে ছায়ার নাচ দেখে বলল, “এই গল্প যতই অলীক শোনাক, সত্য কিন্তু লুকিয়ে থাকে চোখের আড়ালে। আমার মনে হচ্ছে, আমাদের কালাপাহাড়ে যেতেই হবে।” লেমা সতর্ক করে, “কিন্তু রাতের সময় নয়। কুয়াশা ঘন হলে, তুমি বুঝতেই পারবে না কোথায় আছো।” অভি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলে, “তুই বলছিস তো যাব, কিন্তু আমি জানাচ্ছি—যদি গুহার ভেতর ওই চোখ দুটো দেখি, দৌড়ে আগে আমি পালাবো!” লেমা হালকা হাসে, তবু চোখে আতঙ্কের রেখা স্পষ্ট। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, পরদিন সকালে সূর্য ওঠার পর, তারা তিনজন মিলে কালাপাহাড়ের পাদদেশে যাবে, যেখানে সেই গুহার মুখ নাকি ধ্বংসাবশেষের মধ্যে আজও লুকিয়ে আছে। সন্ধ্যাবেলায় ফেরার সময় ঋত্বিক আবার একবার ডায়েরির শেষ পাতাটা পড়ে—তাতে লেখা আছে, “যখন কুয়াশা কথা বলে, মানুষ বোবা হয়ে যায়। আর যারা শুনতে পায়, তারা আর কল্পনায় নয়, বাস্তবেই হারিয়ে যায়।” সেই রাতে ঘুমানোর আগে ঋত্বিক তার ডায়েরিতে লেখে, “পাহাড় শুধু শৈল নয়—সে ইতিহাস, সে হিংসা, সে নিরব সাক্ষ্য। কালাপাহাড়ের কুয়াশা এখন আমার চেতনার এক প্রহরী—এক অজানা সত্যের দরজায় আমি দাঁড়িয়ে।”

ভোরের আলো পাহাড় ছুঁয়ে নেমে এসেছে গ্রাম্য উপত্যকায়। পাহাড়ি পাখির ডাক আর দূর থেকে ভেসে আসা নদীর শব্দে ঘুম ভাঙল অরুণ আর নীলয়ের। আগের রাতের সেই বৃদ্ধ লোকের কথা যেন মাথায় ঘুরছে এখনও — “কালাপাহাড় কিছু গোপন রাখে, আর কিছু গোপন চায়।” সকালের খাবার খেয়ে, নিজেদের ব্যাগপত্র নিয়ে তারা বেরিয়ে পড়ল বৃদ্ধের দেওয়া দিকনির্দেশ অনুসারে, পশ্চিমদিকের পাহাড় চূড়ায়। পথ অনেকটা দুর্গম, মাঝে মাঝে বাঁশঝাড়ের ঘন জঙ্গল, কুয়াশার আস্তরণে ঢেকে যাওয়া গিরিপথ। অরুণের হাতে রয়েছে একটি ছোট্ট নোটবই, তাতে আঁকা নক্সা এবং তারকাঁটা দিয়ে চিহ্নিত একটি জায়গা — কালাপাহাড়ের দক্ষিণগাত্রে একটি গুহা, যা নাকি পুরানো তিব্বতীয় সন্ন্যাসীদের উপাসনার স্থান ছিল। পথে যেতে যেতে দু’জনে অনেক পুরনো শিলালিপি দেখতে পেল — সেখানে তিব্বতীয় ভাষায় কিছু খোদাই করা, কিছুটা মোচড়ানো ও অর্ধেক ঢেকে যাওয়া লেখা। নীলয় ছবি তুলতে ব্যস্ত, আর অরুণ সেই লেখাগুলো গবেষণার নেশায় খুঁটিয়ে দেখে চলেছে।

পাহাড়ের মধ্যভাগে এসে তারা দেখতে পেল একটি পুরনো, শিকল দিয়ে আটকে রাখা গুহার মুখ। আশেপাশে কুণ্ডলীকৃত পাথরের মতো দেখতে কিছু মূর্তি — যেন পাহাড়ের এক গোপন চক্ষু তাদের চুপচাপ দেখে চলেছে। অরুণ শিকলটা খুলতে চাইলে নীলয় বাধা দিল — “এটা তো হয়তো কারও ব্যক্তিগত জায়গা…”, কিন্তু অরুণ বলল, “যদি সত্যিই এখানে কিছু লুকানো থাকে, তাহলে সেটা কারও ব্যক্তিগত থাকার কথা নয়। আমরা সত্যি খুঁজতে এসেছি, ভয় পেলে চলবে না।” শিকল খোলার সাথে সাথেই যেন একটা শীতল হাওয়া বয়ে এল ভিতর থেকে — হাওয়ার মধ্যে ভেসে এল শুষ্ক আগরউডের গন্ধ আর প্রাচীন ধূপের আবেশ। ভিতরে ঢুকে পড়ে তারা দেখতে পেল বহু পুরনো এক চিত্রাঙ্কিত গুহা — গুহার দেয়ালে আঁকা রয়েছে অদ্ভুত সব দৃশ্য: কালো পাহাড়, রক্তবর্ণ সূর্য, এবং এক পুরুষ যার হাতে রয়েছে একটি রত্নখচিত তরবারি। সেই ছবির নিচে খোদাই করা রয়েছে কিছু লিপি, অরুণের মতে, এটা পুরনো নেপালি ও তিব্বতীয় মিশ্র লিপি, যার অর্থ দাঁড়ায় — “অভিশপ্ত রত্ন, পাহাড়ে শয়ন করে, রক্ষককে হারিয়ে অভিশাপ ছড়ায়।”

গুহার ভিতরে আরেকটু এগোতেই তারা দেখতে পেল একটি সিঁড়ি, যা নীচের দিকে নামছে। সিঁড়ি অনেক পুরনো, জায়গায় জায়গায় ধসে পড়েছে, তবুও দু’জনে সাহস করে নেমে গেল। নিচে নামতেই তারা এসে পড়ল এক গোলাকৃতি কক্ষে — সেখানে মাঝখানে রাখা একটি পাথরের বেদী, তার ওপরে একটি ঢেকে রাখা কাঠের বাক্স। বাক্সটা খুলতেই দেখা গেল একটি প্রাচীন তাম্রপাত — তাতে খোদাই করা এক মানচিত্র। মানচিত্রে চিহ্নিত কয়েকটি স্থান, একটি রক্তরঙ চিহ্নিত বিন্দু — যেটা সম্ভবত সেই গুপ্তধনের স্থান। ঠিক তখনই হঠাৎ গুহার দেয়াল কেঁপে উঠল, যেন কোনও গোপন যন্ত্র চালু হয়ে গেছে। বাতাসে ধূপের গন্ধ বেড়ে গেল, আর শোনা গেল অস্পষ্ট গুঞ্জন — যেন শতাব্দী প্রাচীন কোনও মন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছে আকাশের ভেতর থেকে। অরুণ আর নীলয় বুঝতে পারল, তারা শুধু ইতিহাসের গহ্বরে ঢোকেনি — বরং কোনও অভিশপ্ত রহস্যকে আবার জাগিয়ে তুলেছে। পাহাড়ের ছায়া এখন তাদের অনুসরণ করছে।

সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই অর্ণবের গায়ে কাঁপুনি দিয়ে উঠল। বাইরের তাপমাত্রা গতকাল রাতের চেয়ে অনেক কম, জানলার কাচ জুড়ে হালকা শিশিরের রেখা। শঙ্কর ইতিমধ্যেই উঠে পড়েছে, একটা লাল রঙের চা মগ হাতে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। পাহাড়ের ওপারে কুয়াশার ঘন আস্তরণ, যেন কিছু একটা লুকিয়ে রাখছে প্রকৃতি। অর্ণব বলল, “আজ তো মনে হচ্ছে পথ বন্ধ থাকবে।” শঙ্কর হালকা হাসল, “ঠিক সেই কারণেই আজই রওনা দিতে হবে। যতক্ষণ না ঘন কুয়াশা জমে, তার আগেই পৌঁছতে হবে সেই পুরনো মঠের ধ্বংসাবশেষে।” দু’জনে তাড়াতাড়ি প্রস্তুতি নিল, ছোট ব্যাগে শুধু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র – টর্চ, দড়ি, ম্যাপ, আর সেই পুরনো দলিলের স্ক্যান কপি। তারা চলল স্থানীয় গাইড নামগিয়ালের সাথে, যিনি আজ তাদের নিয়ে যাবেন সেই লুকানো উপত্যকার পথে, যেখানে লোকমুখে শোনা যায় বহু যুগ আগে এক গুপ্তধনের খোঁজে প্রাণ হারিয়েছিলেন কিছু অভিযাত্রী। পাহাড়ি পথ ছিল দুর্গম, মাঝে মাঝে পাথরখণ্ড গড়িয়ে আসছিল উপরের খাড়াই থেকে, নামগিয়াল সাবধানে তাদের পথ নির্দেশ দিচ্ছিল। কিছুদূর এগিয়ে এক জায়গায় এসে সে থেমে গেল, “এই পথটার নাম ‘লামা-পথ’। বহু বছর কেউ আসেনি এদিকে। সাবধানে চলুন।” চারপাশে গভীর নিরবতা, কেবল বাতাসে পাতার শব্দ আর মাঝে মাঝে পাহাড়ি পাখির ডাক।

জঙ্গল ঘন হয়ে উঠতে লাগল। বুনো ঝোপঝাড় আর নাম না-জানা বৃক্ষ দিয়ে ভরা অঞ্চলটা যেন নিঃশব্দে কোনো অজানা ইতিহাস বলছিল। অর্ণবের মনে হতে লাগল যেন কেউ বা কিছু তাদের চোখে চোখে রাখছে। হঠাৎই সামনের পথটা একটু খোলামেলা হয়ে এল, আর সেখানে এক বিশালাকার পুরনো পাথরের গেট – অর্ধেক ভেঙে পড়া, কিন্তু তাতে খোদাই করা এক রহস্যময় চিহ্ন এখনও স্পষ্ট। অর্ণব দলিলের ছবির সাথে মিলিয়ে দেখল – হ্যাঁ, এটাই সেই চিহ্ন, যে জায়গাটির কথা বলা হয়েছিল সেই প্রাচীন স্ক্রিপ্টে। গেটের পাশ দিয়ে ঢুকতেই তারা দেখতে পেল এক লম্বা পথ, যা সরু হয়ে ঢুকে যাচ্ছে এক অন্ধকার গুহার মধ্যে। নামগিয়াল একটু থেমে বলল, “এটা ‘চোমো লুং’ – মানে ‘শয়তানের ফুসফুস’। বহু আগে এক লামা বলেছিলেন, এই গুহার মধ্যেই গুপ্তধনের চিহ্ন আছে, কিন্তু এ পথের ভেতরে ঢুকলে কেউ আর ফেরে না।” শঙ্কর উত্তেজনায় বলল, “আমরা এসেছি, আর এত সহজে ফিরে যাব না।” টর্চ জ্বালিয়ে, ধীর পায়ে তারা এগোতে লাগল সেই গুহার ভেতরে। প্রতিটি পা ফেলতে হচ্ছিল সতর্কভাবে – মাটি অসমান, পাথর ভেজা আর স্যাঁতসেঁতে। মাঝে মাঝে গুহার ছাদের ফাঁকে ঝুলন্ত stalactite-এর ফোঁটা পড়ছিল তাদের কাঁধে।

গুহার ভিতর ঢুকতেই এক অদ্ভুত গন্ধ আর অনুভূতি চারদিক ঘিরে ধরল। টর্চের আলোয় দেখা গেল গুহার দেয়ালে কিছু আঁকা – কেউ বা অনেক আগে দেয়ালে রঙ দিয়ে এক রহস্যময় চিত্র এঁকেছে, যা দেখতে অনেকটা তিব্বতী বৌদ্ধ চিত্রকলার মতো, কিন্তু কোথাও যেন একটা অস্বাভাবিকতা ছিল। হঠাৎ অর্ণব থেমে গেল – এক কোণায় পড়ে থাকা একটি কাঠের বাক্স তার চোখে পড়েছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে সে খুলল বাক্সটা, আর ভিতরে পাওয়া গেল একটা ধাতব পাত্র – যার গায়ে আবার সেই একই রহস্যময় চিহ্ন। শঙ্কর বলল, “এটা হয়তো সেই পাত্র, যার মাধ্যমে অভিশাপ শুরু হয়েছিল।” অর্ণব লক্ষ করল পাত্রের পাশে কয়েকটি পুরনো হাড়গোড়, বোঝা গেল কেউ বহু বছর আগে এখানে মারা গিয়েছিল। আতঙ্কে গলা শুকিয়ে এল শঙ্করের, “চল, এখান থেকে বেরোই। আমরা যা খোঁজার, তার ছায়া পেয়েছি।” কিন্তু ঠিক সেই সময়ে কাঁপুনি দিয়ে ওঠে গুহার মাটি – যেন পাহাড় কেঁপে উঠেছে! পেছনে তাকাতেই তারা দেখল, গুহার মুখ বন্ধ হয়ে গেছে পাথরের ধ্বসের কারণে। নামগিয়ালের মুখ ফ্যাকাশে, “এটা ছিল সেই অভিশপ্ত চিহ্নের ফাঁদ! আমাদের এখনই বেরোতে হবে অন্য কোনো পথ দিয়ে, নইলে…” বাক্যটা শেষ করতে পারল না সে – গুহার ভেতর গভীর অন্ধকারে যেন এক অদৃশ্য ছায়া নড়ে উঠল, এবং তাদের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। অর্ণব বুঝে গেল, এই অভিশাপ শুধু কাহিনী নয় – এটা বাস্তব, আর কালাপাহাড়ের কুয়াশার আড়ালে কোনো এক অতিপ্রাকৃত রহস্য দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করে আছে, ফের নতুন প্রাণ চুষে নিতে…

ঝরনার ধারের ঘন জঙ্গলে সেই রাতে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল। পাহাড়ি বাতাসে যেন কাঁপছিল গাছের ডালপালা, আর গা ছমছমে একটা ঠান্ডা হাওয়া জড়িয়ে ধরেছিল গোটা অঞ্চলটাকে। অর্জুন আর রাহুল তখন ত্রিনয়ন মন্দির থেকে ফিরে এসেছে, কিন্তু দু’জনের মনেই একটা অদ্ভুত অস্বস্তি কাজ করছিল। অর্জুন বারবার পকেট থেকে পুরনো মানচিত্রটা বের করে দেখে, আর রাহুল জানলার ধারে বসে ঠোঁটে সিগারেট ঠেকিয়ে সেই দূরের কালো পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই জায়গায় যেন সময় থেমে গেছে—একটা ভয় আর রহস্যে মোড়া জায়গা, যার গভীরে লুকিয়ে আছে বহু প্রাচীন অভিশাপ। সেই রাতে গ্রামের প্রৌঢ়া মেয়ে কেদারা দি এসে জানায়—এক সময় কালাপাহাড় ছিল এক তান্ত্রিকের সাধনার জায়গা। সেই তান্ত্রিক নাকি অভিশাপ দিয়ে গেছেন, কেউ যদি পাহাড়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে গুপ্তধনের সন্ধান করে, তাহলে তার রক্ত দিয়েই সেই সিঁড়ি রঞ্জিত হবে। অর্জুন শুনে বলে ওঠে, “তাহলে কি এতদিন যারা নিখোঁজ হয়েছে, তারা সেই অভিশপ্ত গুহার খপ্পরে পড়েছে?” কেদারা দি শুধু ঠান্ডা গলায় বলে, “ছায়ারা ওদের নিয়ে গেছে।” এই ‘ছায়া’ শব্দটা যেন গোটা ঘরটাকে জমিয়ে দিল। কে এই ছায়া? কী তার রূপ? কেন সে পাহাড়ের প্রহরী হয়ে আছে?

পরদিন সকালে তারা স্থানীয় এক বৃদ্ধ পাণ্ডার কাছে গিয়ে আরও তথ্য সংগ্রহ করে। তাঁর নাম রামেশ্বর ঝা। তিনি জানালেন, তাঁর ঠাকুরদা ছিলেন ব্রিটিশ আমলে এক পাহাড়ি মন্দিরের পুরোহিত। সেই সময়েও কয়েকজন সাহেব সেই গুহায় প্রবেশ করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু এক রাতেই তারা উধাও হয়ে যায়। পরে গ্রামের এক রাখাল বলে যে সে কালাপাহাড়ের ঢালুতে ছায়ার মতো কিছু দেখেছিল—অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক কুয়াশা! রাহুল হেসে বলে, “ছায়া আবার অর্ধেক মানুষ হয় নাকি?” কিন্তু অর্জুন বুঝতে পারে, এই গল্পগুলো শুধু রূপকথা নয়। গ্রামের মানুষের আতঙ্কের ভেতরে কোথাও সত্য লুকিয়ে আছে। তারা ফিরে এসে মানচিত্রটা আবার খুঁটিয়ে দেখে। হঠাৎই অর্জুন লক্ষ্য করে, গুহার চিহ্নের পাশে একটা ছোট লেখা আছে—“ত্রিনয়ন দেখিলে পথ খুলিবে, কিন্তু যাত্রা করিলে কালের ছায়া ছুঁইবে।” এটা কি কোনো ধাঁধা? রাহুল বলে, “ত্রিনয়ন মানে তো তিন চোখ। তাহলে মন্দিরের মূর্তির চোখের দিকেই কি কোনও ইঙ্গিত আছে?” তারা ফিরে যায় মন্দিরে, খুঁটিয়ে দেখে মূর্তির চোখ। মূর্তির তৃতীয় চোখটা যেন সূর্যোদয়ের দিকে স্থির। তারা বুঝতে পারে, মানচিত্রে দেওয়া ‘ত্রিনয়নের দৃষ্টি’ মানে সূর্য ওঠার দিক—পূর্ব দিকে পাহাড়ের কোনায় কোনো গুহা থাকতে পারে। শুরু হয় নতুন অভিযান, যেখানে প্রকৃতি আর অতিপ্রাকৃত একসাথে তাদের পথ রোধ করতে চায়।

বিকেলের দিকে হঠাৎ ঘন কুয়াশায় চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে। পাহাড়ি বনের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা এক জায়গায় পৌঁছে যায়, যেখানে গাছের ছায়াগুলো যেন বেশি ঘন, বেশি নীরব। হঠাৎ পিছন থেকে একটা গর্জন শোনা যায়। দু’জনেই থেমে যায়। সামনে ধোঁয়ার মতো একটা অবয়ব—মানুষের মতো, কিন্তু মুখ নেই, পা নেই, কেবল কালো ঘূর্ণি! অর্জুন ধাতস্থ হয়ে পকেট থেকে মশাল বার করে জ্বালিয়ে তোলে। আলোয় সেই ছায়া কেঁপে ওঠে, তারপর মিলিয়ে যায়। রাহুল ভয় পেয়ে বলে, “এটা… এটা তো সত্যি কিছু ছিল!” তারা দ্রুত পাথরের গায়ে আঁকা চিহ্নগুলো দেখে—তান্ত্রিক লিপি, যেগুলো কেদারা দি আগেই দেখিয়েছিল। এই জায়গা সম্ভবত সেই গুহার প্রবেশদ্বার। অর্জুন পাথরের ওপর হাত রাখতেই একধরনের কম্পন অনুভব করে। সে বলে ওঠে, “এই পথেই যেতে হবে, রাহুল।” কিন্তু প্রবেশ করার আগে তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে নেয়—এই গুহার ভেতর ঢোকার পর হয়তো আর ফিরে আসা হবে না। এই অধ্যায়ে রহস্য শুধু গভীর হয় না, ছায়ার অস্তিত্ব বাস্তব হয়ে ওঠে। এখন কেবল তাদের সাহস আর বুদ্ধিই পারে কালাপাহাড়ের অভিশপ্ত ইতিহাসকে উন্মোচন করতে।

চন্দনপুর গ্রামের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে দীপ্ত ও অর্ক অভূতপূর্ব এক দৃশ্যের মুখোমুখি হয়। একেবারে নিচে, পাহাড়ের গায়ে, ঝোপঝাড়ের আড়ালে দেখা মিলেছিল একটি সংকীর্ণ গুহার মুখ, যেটি ছিল শ্যাওলা আর ঝুলে পড়া লতাগুল্মে ঢাকা। হঠাৎ করে অর্কের পা পিছলে গেলে মাটি খসে পড়ে, আর তাতেই গুহার মুখটা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দীপ্ত চিৎকার করে উঠে বলল, “এটাই হতে পারে সেই গোপন প্রবেশপথ, যেটার কথা পুরোনো সেই তাম্রলিপিতে বলা আছে!” অর্ক কিছু না বলে দীপ্তর পেছন পেছন এগিয়ে গেল। গুহার মুখের সামনে দাঁড়াতেই তাদের গা শিরশির করে উঠল—গুহা থেকে বেরোচ্ছে এক অদ্ভুত ঠান্ডা বাতাস, যার সঙ্গে মিশে আছে পচা কাঠ আর শ্যাওলার গন্ধ। টর্চের আলো জ্বালিয়ে তারা ধীরে ধীরে প্রবেশ করল ভিতরে। প্রথমে সঙ্কীর্ণ পথ, তারপর একটু প্রশস্ত অংশ—এভাবেই গুহার গভীরে প্রবেশ করতে করতে তারা লক্ষ্য করল, গুহার দেয়ালে খোদাই করা কিছু প্রতীক—সাপ, বাঘ, আর এক হাতে শূলধারী কোনো অচেনা দেবতা। অর্ক বলল, “এগুলো তো আদিবাসী চিত্রকলা! এর মানে গুহাটা বহু পুরোনো।” দীপ্ত কিছুক্ষণ দেয়ালের দিকেই তাকিয়ে রইল, তারপর চাপা গলায় বলল, “আমরা ঠিক পথেই এসেছি। গুপ্তধনের রাস্তা এদিকেই হবে।”

তারা আরও কিছুটা এগোতেই হঠাৎ এক পাথরের স্তম্ভের গা ঘেঁষে একটা চিৎকার ভেসে এল। ভেসে এল আরেকটা—একটা মানুষের গোঙানির শব্দ। দীপ্ত সঙ্গে সঙ্গে ইশারা করে অর্ককে থামিয়ে দেয়, আর নিঃশব্দে সামনে এগোয়। একটু পরেই তারা দেখতে পায়—একটা বড় খোলা জায়গা, যার মাঝখানে জ্বলে উঠেছে মৃদু আগুন, আর সেই আগুনের পাশে বাঁধা এক মানুষ—দেহজুড়ে আঘাতের চিহ্ন, মুখ ঢাকা। আগুনের আলোয় তারা দেখতে পেল, চারপাশে কয়েকটা ছায়ামূর্তি, যাদের চোখে বিদ্বেষ, গলায় রুদ্র হাসি। দীপ্ত চেনা গলায় চিৎকার করে উঠল, “তপনদা!” অর্ক হতভম্ব হয়ে পড়ে। দীপ্তর সাংবাদিক বন্ধু তপন ঘোষ, যে এক সপ্তাহ আগে নিখোঁজ হয়েছিল, সে-ই বন্দি হয়ে রয়েছে এই গুহার মধ্যে। ছায়ামূর্তিগুলোর একজন সামনে এগিয়ে এসে মুখোশ খুলল—তারা দেখতে পেল, সে সেই গ্রামেরই পুরোহিত শিবনাথ। দীপ্ত চিৎকার করে উঠল, “আপনি! এতদিন আপনি গ্রামের মানুষদের ভয় দেখিয়ে লোকজনকে সরিয়ে দিচ্ছিলেন! কিন্তু কেন?” শিবনাথ থমথমে গলায় বলল, “এই পাহাড়ের নিচে লুকিয়ে আছে প্রাচীন সন্ন্যাসী সমাজের গুপ্তধন। যারা সত্যের খোঁজ করে, তাদেরই এর পথ দেখানো হয়। কিন্তু যারা কৌতূহলী হয়ে আসে, তারা শাস্তি পায়।” দীপ্ত সাহস করে বলল, “তাহলে আপনি শাস্তি দেবার অধিকার পেলেন কোথা থেকে?” উত্তরে শিবনাথ কেবল হাসল—ঠান্ডা, নির্দয় এক হাসি, যেটা দীপ্তর মেরুদণ্ড বেয়ে ঠান্ডা জল বয়ে দিল।

আলো নিভে এল হঠাৎই, গুহা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল অন্ধকার। শোনা গেল গর্জন, যেন পাহাড় নিজের বুক কাঁপিয়ে ওঠে। দীপ্ত আর অর্ক বুকে সাহস নিয়ে সামনে ছুটে যায়—তারা পৌঁছে যায় সেই স্থানে যেখানে এক পাথরের মূর্তি—এক সন্ন্যাসীর—পায়ের নিচে খোদাই করে রাখা ছিল তাম্রলিপির লেখা। দীপ্তর হাতে থাকা পুরোনো স্ক্রল মিলিয়ে দেখে সে ঠিক সেই জায়গায় পৌঁছেছে। মূর্তির চোখের ভেতর ঢোকানো ছিল ছোট একটি রত্নখচিত কৌটো—যেটির মধ্যে ছিল প্রাচীন সন্ন্যাসীদের গোপন নথি, আর একটি মানচিত্র। অর্ক সেই কৌটো তুলতে গিয়েই অনুভব করল, পায়ের নিচে মাটি নড়ছে—গুহা কাঁপতে শুরু করেছে। “দ্রুত বেরোতে হবে,” দীপ্ত চিৎকার করে বলে। গুহার দেয়াল ধসে পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে তপনদাকেও। দুজনে মিলে তাকে মুক্ত করে কাঁধে ভর দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। গুহার মুখে পৌঁছাতেই ভিতরে প্রবল শব্দে ধ্বংস হয়ে যায় প্রাচীন সেই চন্দনপুর গুহা। পাহাড় আবার নিস্তব্ধ, কুয়াশা আবার ঘন হয়ে এসেছে। কিন্তু দীপ্ত জানে, এখনো খেলা বাকি। কারণ সে যা পেয়েছে, তা শুধু শুরু—এক অভিশপ্ত ইতিহাসের দরজা মাত্র।

দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার মুখে অরণ্য যেন আরও নিস্তব্ধ হয়ে উঠল। চারদিকের নিস্তব্ধতার মধ্যে শুধু পাহাড়ি ঝর্ণার ধ্বনি আর পাখিদের ডাক। সেই নিস্তব্ধতা চিরে অর্ণবের কণ্ঠ—”তোমরা ঠিক আছো তো?” ধূম্র ও তানিয়া একসাথে হ্যাঁ বলল, কিন্তু তাদের কণ্ঠে ছিল চাপা আতঙ্কের ছায়া। কালাপাহাড়ের প্রাচীন গুহার প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে তারা বুঝল, এই জায়গার গভীরে কিছু আছে—যা হয়তো মানুষের চেনা জগতের বাইরের। শীতল বাতাসের ধাক্কা, গুহার দেওয়ালের অদ্ভুত খোদাই আর কিছু সাদা, নীলাভ ছোপে আঁকা প্রতীকে ধূম্রের মনে হল, তারা কোনো আদি গোত্রের প্রাচীন নিদর্শনের মুখোমুখি। প্রবেশপথের পাশের শিলায় ছিল এক চক্রাকারে ঘূর্ণায়মান ধাতব বাটনের মতো কিছু। তানিয়া জিজ্ঞেস করল, “এগুলো কি কোনো রহস্যময় দরজা খুলবে?” ধূম্র তার পকেট থেকে পুরোনো নকশাটা বের করে আনল, যা তারা আগের রাতে হেমন্তর ট্রাঙ্কে পেয়েছিল। নকশার কোণে ওই প্রতীকগুলোর মতো কিছু ছিল, এবং তার পাশে লেখা ছিল “সপ্তচক্র স্পন্দনে গুহা উন্মুক্ত”। অর্ণব প্রথমে ভাবল এটা হয়তো রূপকথার অংশ, কিন্তু যখন তারা প্রতীকের মতো বাটনগুলোকে নির্দিষ্ট ক্রমে চাপ দিল, হঠাৎ গুহার গভীর থেকে ভেসে এল ধাতব ঘর্ষণের এক গম্ভীর শব্দ। শিলাপাথরের একটি গোপন দরজা ধীরে ধীরে পাশ বরাবর সরে গেল, উন্মোচিত হল এক সরু অন্ধকার সুড়ঙ্গ। তিনজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে, নিঃশব্দে মাথা নাড়ে; তারপর ধীরে ধীরে তারা ভিতরে প্রবেশ করল।

গুহার ভিতরে ঢুকতেই তাদের কাঁধে পড়ল ঠান্ডা জলের ফোঁটা—ছাদের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছে জল। ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় দেখা গেল দেয়ালে আঁকা আরও চিত্রকলা, যেন এক বিস্মৃত সভ্যতার সাক্ষ্য বহন করছে। গুহার মাঝখানে পৌঁছে তারা দেখতে পেল একটি প্রশস্ত চৌবাচ্চার মতো খাঁজ, যার চারদিকে স্থাপন করা আছে সাতটি পাথরের স্তম্ভ। প্রতিটি স্তম্ভে খোদাই করা এক-একটি মানবমূর্তি—কারো হাতে অস্ত্র, কারো হাতে শঙ্খ, আবার কেউ বসে আছে ধ্যানমগ্ন ভঙ্গিতে। স্তম্ভগুলোর ঠিক মাঝখানে ছিল একটি বেদির মতো প্ল্যাটফর্ম, যেখানে পড়ে ছিল একটি কাঁসার সিন্দুক। ধূম্র এগিয়ে গিয়ে সিন্দুকটি খুলল, আর তানিয়া বিস্ময়ে বলে উঠল, “এ তো সেই হারিয়ে যাওয়া তাম্রপত্র!” পাতাটির একদিকে খোদাই করা ছিল কিছু সংস্কৃত লিপি, যা পড়া তখনই সম্ভব হল না। কিন্তু পাতার অপর পাশে ছিল একটি মানচিত্র—পাহাড়ের গহীনে থাকা এক গোপন স্থানের দিক নির্দেশনা। অর্ণব বলল, “তাহলে এইটাই আমাদের পরবর্তী গন্তব্য।” ঠিক সেই মুহূর্তেই গুহার দেয়ালের একাংশে চাপা গর্জনের মতো শব্দ উঠল, আর বাতাস হয়ে উঠল ভারি, ঘন। আলো নিভে গেল হঠাৎ। অন্ধকারের মধ্যে তারা শুনতে পেল সাপের ফোঁসফোঁসানি, পাথরের ঘর্ষণ আর কে যেন গুটিগুটি পায়ে চলার শব্দ। ধূম্র ফিসফিস করে বলল, “তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে। এখানে আমরা একা নেই।”

তারা গুহা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল, কিন্তু বুঝল পথটা যেদিকে দিয়ে এসেছিল, সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। আলো জ্বালাতেই দেখা গেল, তারা এক নতুন চেম্বারে এসে পড়েছে, এবং এই চেম্বারে কয়েকটি জ্বলন্ত টর্চ ঝুলছে দেওয়ালে। এদিকটা অপেক্ষাকৃত বেশি যত্নে রাখা, যেন কেউ আজও এখানে আসে। হঠাৎ করেই একপ্রান্তে দেখা গেল একটা ছায়ামূর্তি—সে এগিয়ে এল ধীরে ধীরে। তানিয়া চিৎকার করে উঠল, “ওই লোকটা তো সেই বুড়ো সন্ন্যাসী, যাকে আমরা গ্রামে দেখেছিলাম!” সন্ন্যাসী তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা সাতচক্রের দ্বার উন্মোচন করেছ, এখন তোমাদের জ্ঞান ও সাহসের পরীক্ষা হবে।” তার কথার ভঙ্গিতে ছিল না কোনো ভয়, বরং এক গম্ভীর প্রত্যয়। সে জানাল, এই গুহার অন্তরে লুকিয়ে আছে এক প্রাচীন শক্তি, যা একদা কালাপাহাড়ের উপর অভিশাপ এনে দিয়েছিল। যারা প্রকৃত সত্য খুঁজতে চায়, তাদের এই সাতটি স্তম্ভের প্রতীক বুঝতে হবে এবং সেগুলিকে সঠিকভাবে পুনর্সংলগ্ন করতে হবে, নয়তো তারা এখানেই হারিয়ে যাবে, ঠিক যেমন হারিয়ে গেছে বহু অভিযাত্রী। ধূম্র তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেয়, তারা ফিরে যাবে না। কালাপাহাড়ের কুয়াশার আসল রহস্য উদঘাটন করতে হলে, এই সাতচক্র রহস্য সমাধান করতেই হবে। উত্তেজনা, ভয় আর আগ্রহে থরথর করে উঠল তাদের মন। পরবর্তী অধ্যায়ে, গুহার গভীরে আরও কী প্রতীক্ষা করে আছে, তা জানতে তারা এগিয়ে গেল অন্ধকারের দিকে, হাতে কেবল একটি মানচিত্র, আর হৃদয়ে এক দুর্দমনীয় কৌতূহল।

তিনদিনের টানা খোঁজাখুঁজির পর, অবশেষে আরিয়ান আর সম্যক এমন একটি সূত্র খুঁজে পেল যা পাহাড়ের অতল গুহার পথে তাদেরকে নিয়ে যাবে। রাত তখন প্রায় দশটা, ঘন কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে পুরো কালাপাহাড়, গা ছমছমে নীরবতা ভেদ করে মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে নিচের গ্রামের দিক থেকে। স্থানীয় এক বৃদ্ধ, নাম গোপাল তামাং, গোপনে তাদের ডেকে এনে বলেছিল—”তোমরা যদি সত্যিই জানতেও চাও কালাপাহাড়ে কী ঘটে, তবে কাল রাত তিনটার সময় বাঁশবনের পিছনে যে পাথরের গুহা, সেখানেই যেতে হবে।” কথা অনুযায়ী, আরিয়ান আর সম্যক সেদিন গভীর রাতে রওনা দেয়, হাতে টর্চলাইট, ব্যাগে শুধু দরকারি সরঞ্জাম আর বুক ভরা কৌতূহল। পাথরের গুহা খুঁজে বের করতে সময় লেগে যায় প্রায় একঘণ্টা। চারপাশ এতটাই ঘন কুয়াশায় ঢেকে ছিল যে নিজেদের পা-ও তারা দেখতে পাচ্ছিল না। শেষে খুঁজে পায় সেই রহস্যময় গুহা—বাঁশের ঝোপের আড়ালে চাপা পড়ে থাকা, প্রাকৃতিক ভাবে গঠিত এক গিরিখাতের মতো ফাঁক।

গুহার ভেতরে প্রবেশ করতেই টের পাওয়া গেল ঠান্ডার তীব্রতা আরও বাড়ছে, যেন ভিতরটা হিমশীতল বরফঘর। প্রাচীন কাল থেকে কেউ এই পথ দিয়ে হেঁটেছে কি না সন্দেহ—কারণ গুহার দেয়ালে কালো ছোপ ছোপ শিলালিপি, যার বেশিরভাগই অসম্পূর্ণ আর অচেনা ভাষায় লেখা। সম্যক তার মোবাইল দিয়ে ছবি তুলছিল, আর আরিয়ান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল দেয়ালের প্রতিটি চিহ্ন। হঠাৎ এক জায়গায় হাত রাখতেই শব্দ হয় “খটাস”—পাথরের দেয়ালের একটা অংশ সরে গিয়ে উন্মোচিত হয় এক গোপন দরজা। দরজার ভিতরে ছোট্ট একটা চেম্বার, সেখানে একাধিক ছোট ছোট মূর্তি, ধুলোয় ঢাকা ধাতব থালা-বাটি, আর একটা ছোট সিন্দুক। সেই সিন্দুক খুলতেই দেখা গেল একটা খয়েরি রঙের চামড়ার ডায়েরি, যার উপর তাম্রাক্ষরে লেখা ‘অভিশপ্ত উত্তরাধিকার’। এই ডায়েরিটাই বদলে দিল তাদের অনুসন্ধানের গতি। ডায়েরির পাতা উল্টে উল্টে জানা যায়, সেই অভিশাপের ইতিহাস—তিব্বতের এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসী, নাম ছিল ‘পেমা রিনচেন’, যিনি পাহাড়ে একটি অসাধারণ ধন লুকিয়ে রেখেছিলেন, সাথে একটি অভিশাপ—”যে ভুলে ঢুকবে, সে আর ফিরে পাবে না আপন আলো, গিলে নেবে তাকে কুয়াশা।”

আরিয়ান আর সম্যক ডায়েরি পড়ে শিউরে ওঠে। এই গুহাই সেই স্থান, এবং এই গুহার ভেতরেই কোথাও লুকিয়ে আছে সেই ধন—যার খোঁজে এত বছর ধরে বহু মানুষ এসে নিখোঁজ হয়েছে। এখন বোঝা যাচ্ছে, তারা কেউই আর ফিরে যেতে পারেনি কারণ গুহার ভেতরে ছিল এক তান্ত্রিক ফাঁদ, এক অলৌকিক প্রভাব। গুহার ভিতরদিকের দেয়ালে একটা গোলাকার ঘূর্ণি চিহ্ন ছিল, যা দেখে আরিয়ান নিশ্চিত হয়—এটাই সেই ‘কুয়াশার দরজা’, যেটা খোলে ঠিক ভোর হওয়ার আগমুহূর্তে। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, পরদিন আবার ফিরে আসবে ভালো করে প্রস্তুতি নিয়ে, কারণ সামনে আছে এমন এক রহস্য যা শুধু ইতিহাস নয়, গোটা গ্রামের ভবিষ্যতও বদলে দিতে পারে। গুহা থেকে বেরিয়ে আসার সময়, পেছন থেকে হালকা বাতাসের মতো একটি শীতল ফিসফিসানি কানে এল—”ফিরে এসো, উত্তরাধিকারী…” সম্যক থমকে যায়, আরিয়ানও দাঁড়িয়ে পড়ে। কিন্তু চারপাশে কেউ নেই—শুধু কুয়াশা, আর পাহাড়ের গভীর নিঃশব্দতা।

১০

দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি হাওয়া যেন নতুনভাবে বয়ে চলেছে। কুয়াশা আজও ঘন, কিন্তু ভয় আর ছায়ার গন্ধ নেই তাতে। কালাপাহাড়ের গুহায় রুদ্র, অভি, আর স্নিগ্ধা ফিরে গিয়েছিল শেষবারের মতো, সেই গুপ্তধনের শেষ রহস্য উন্মোচনের জন্য। ভেতরে ঢুকে ওরা আবিষ্কার করে এক পুরনো খাঁজকাটা দরজা—যেটা আগে চোখে পড়েনি। স্নিগ্ধা জানায়, এই দরজা সম্ভবত এক ‘ধর্মচক্র প্রাচীন সিল’, যার পিছনে থাকত বৌদ্ধ মঠের পবিত্র বস্তুর গোপন কক্ষ। দরজার গায়ে লেখা ছিল একটি সংস্কৃত শ্লোক, যার অর্থ দাঁড়ায়—“যে ঋদ্ধি-সিদ্ধির লোভে আসবে, সে ছায়া হয়ে হারিয়ে যাবে। আর যে ত্যাগ করতে শিখেছে, সে-ই আলো পাবে।” রুদ্র বুঝতে পারে, এ গুপ্তধন শুধুই সোনা-রুপো নয়, বরং ইতিহাস, আত্মত্যাগ আর মানবতাবাদের এক নিদর্শন। দরজা খোলার পদ্ধতি ছিল জটিল ধাঁধায় ঘেরা, কিন্তু অভি ও রুদ্র মিলে শ্লোকের বর্ণনা অনুযায়ী বুদ্ধ মূর্তির সামনে বিশেষ পাথরে চাপ দিলে দরজা খুলে যায়। ভিতরে পাওয়া যায় পুরনো দলিল, কিছু মূল্যবান শিল্পকর্ম, আর একখানা চিঠি—যা সেই প্রাচীন ভিক্ষু পদ্মবংশের লেখা। সেখানে তিনি অভিশাপের পেছনের কারণ বর্ণনা করেছিলেন—যারা লোভের কারণে এই মঠের বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, তারা মৃত্যুর পরও এই পাহাড়ে আবদ্ধ থেকেছে। আর প্রতি বছর নির্দিষ্ট পূর্ণিমার রাতে তারা এক নির্দিষ্ট আত্মা খুঁজে বেড়ায়, যার মধ্য দিয়ে তারা মুক্তি পাবে।

গুপ্তধনের সন্ধান শেষ হলেও অভি জানায়, এখানে এখনো এক কাজ বাকি—তাদের পাওয়া দলিলগুলো সরকারি হস্তে তুলে দেওয়া। রুদ্র এতে সম্মত হয়, এবং স্থানীয় পুলিশ ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহযোগিতায় কালাপাহাড়কে সুরক্ষিত ঐতিহাসিক অঞ্চল ঘোষণা করা হয়। গ্রামের মানুষরা প্রথমে আতঙ্কিত থাকলেও ধীরে ধীরে পাহাড়ের ইতিহাসের মাহাত্ম্য বুঝতে শেখে। স্নিগ্ধা আবার কলকাতায় ফিরে যায়, কিন্তু যাওয়ার আগে সে রুদ্রকে এক চিঠি দেয়—যেখানে সে তার অনুভূতির কথা জানায়, আর লিখে, “অভিশাপ ছিল মানুষের ভয়ের ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু তুই ভয়কে জয় করেছিস, রুদ্র। সেটাই সত্যিকারের মুক্তি।” রুদ্র সেই চিঠি নিজের ডায়েরির মাঝে রেখে দেয়, তার জীবনের অন্যতম মূল্যবান ‘ধন’ হিসেবে। অভি ফিরে যায় তার সাংবাদিক জীবনে, তবে সে জানায়, তারা দুজনের এই অভিযান নিয়ে সে একটি ডকুমেন্টারি বানাবে, যাতে মানুষ জানে—কীভাবে ইতিহাস, গল্প, আর মানুষের মন একসঙ্গে বোনা থাকে এই রকম অভিশপ্ত জায়গার ভিতরে।

শেষ দৃশ্যটা হয় রুদ্রর বাড়ির বারান্দায়, যেখানে সে বসে আছে এক কাপে ধোঁয়া ওঠা চায়ের সঙ্গে। তার হাতে সেই প্রাচীন চিঠি, চোখে এক গভীর প্রশান্তি। বাইরে আবার কুয়াশা নামে—একটু ঘোলাটে, একটু রহস্যময়। কিন্তু এবার রুদ্র জানে, তার ভেতর কোনো ভয় নেই, নেই কোনো ছায়া। কালাপাহাড় এখন আর কোনো অভিশাপের পাহাড় নয়—এটা ইতিহাস, সাহস আর বন্ধুত্বের এক নিরব সাক্ষী। বন্ধ দরজার ওপারে যে গল্প, রুদ্ররা তা খুলে দিয়েছে, আর তাতেই এক নতুন আলোর পথ তৈরি হয়েছে—যেখানে কুয়াশা থাকলেও, আর অন্ধকার নেই।

সমাপ্ত

1000046322.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *