Bangla - রহস্য গল্প

কালরাত্রির ছায়া

Spread the love

সৌরদীপ মুখোপাধ্যায়


পর্ব ১ : অশুভ নিমন্ত্রণ

কলকাতার শীতের শুরু। সন্ধ্যা নামতেই শহর জেগে উঠছে দীপাবলির আলোয়, আর দক্ষিণ কলকাতার পুরোনো বনেদি পাড়ায় লাহিড়ীবাড়ির কালীপুজোকে ঘিরে চারদিকে হৈচৈ। লাহিড়ীবাড়ির পুজো শুধু দেবতার কাছে ভক্তি নিবেদন নয়, বরং পাড়ার এক সামাজিক উৎসব, যেখানে কয়েক প্রজন্ম ধরে জড়ো হয় মানুষ।

ঋদ্ধিমান মিত্র, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, লোকসংস্কৃতির ছাত্র। তাঁর কাছে এই নিমন্ত্রণ ছিল অদ্ভুত। লাহিড়ীবাড়ির এক তরুণী, অর্পিতা, হঠাৎ একদিন লাইব্রেরিতে এসে তাঁকে বলেছিল—
“আমাদের বাড়ির পুজোয় এ বছর আপনাকে অবশ্যই আসতে হবে। হয়তো আপনার পড়াশোনার কাজে লাগবে।”

ঋদ্ধিমান প্রথমে অবাক হলেও, ভেবেছিল এ হয়তো গবেষণার একটা সুযোগ। কিন্তু অর্পিতার চোখের ভেতর অদ্ভুত এক আতঙ্ক ঝলসে উঠেছিল, যেটা তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল।

লাহিড়ীবাড়ি ছিল একেবারে প্রাচীন ধাঁচের। লোহার গেট, ভেতরে উঠোন, মন্দির ঘর, আর চারপাশে উঁচু দেওয়াল। পুজোর রাতে মন্দিরে ঢুকতেই ঋদ্ধিমান দেখল মূর্তির সাজসজ্জা বিশাল। চারপাশে প্রদীপ, ধূপ, চন্দন, আর ঢাকের বাজনা।

কিন্তু তাঁর নজর গেল অন্য দিকে। মন্দিরের এক দেওয়ালে অদ্ভুত আঁকিবুকি। মনে হলো, কারো হাতে খোদাই করা কিছু অচেনা চিহ্ন। তন্ত্রমন্ত্রের মতো লাগছিল।

অর্পিতা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল—
“ঋদ্ধিমানদা, আমি জানি, আপনি এসব পড়াশোনা করেন। দেখুন তো, এই চিহ্নগুলো চেনা মনে হচ্ছে?”

ঋদ্ধিমান সেই দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ শরীরের ভেতর ঠান্ডা স্রোত বইতে দেখল। চিহ্নগুলো কোনো সাধারণ দাগ নয়, এগুলো প্রাচীন অঘোরী তান্ত্রিক চক্রের প্রতীক। যেটা সাধারণত ব্যবহৃত হয়… বলিদান বা আঘাতের আগে।

ঢাকের শব্দ বেড়ে উঠছিল, ভিড় জড়ো হচ্ছিল। পূজার আরতি শুরু হতে চলেছে। কিন্তু ঋদ্ধিমান বুঝতে পারল, এই রাত শুধু পুজোর রাত নয়—
এখানে কোনো অশুভ কিছু লুকিয়ে আছে।

 

পর্ব ২ : রক্তচিহ্ন

ঢাকের শব্দ, শাঁখের ধ্বনি আর পূজার আরতিতে চারদিক ভরে উঠেছে। কিন্তু ঋদ্ধিমান দাঁড়িয়ে আছে যেন সময় থেমে গেছে। তাঁর চোখ আটকে আছে ওই দেওয়ালের অদ্ভুত খোদাই করা প্রতীকের দিকে। আলো-আঁধারির ভেতরেও মনে হচ্ছিল প্রতীকগুলো যেন একটু একটু করে ঝলসে উঠছে।

অর্পিতা ফিসফিস করে বলল,
— “দেখলেন? আমি জানতাম, এ বছর কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটবে। আমার ঠাকুমা বলতেন, আমাদের পুজোয় এক অভিশাপ আছে।”

ঋদ্ধিমান ভ্রূ কুঁচকে তাকাল,
— “অভিশাপ? আপনি সিরিয়াস?”

অর্পিতা কিছু বলার আগেই হঠাৎ ঢাকের তালে ঢেকে গেল সব শব্দ। মূর্তির সামনে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু হয়েছে। সবাই মাথা নিচু করে প্রণাম করছে। ঠিক তখনই হঠাৎ মূর্তির দু’চোখ থেকে যেন গড়িয়ে পড়ল লালচে তরল।

চিৎকার পড়ে গেল ভিড়ে।
“রক্ত! রক্ত বেরোচ্ছে!”

কেউ কেউ ভয়ে দৌড়ে পালাতে চাইছে, আবার অনেকে হাত জোড় করে প্রণাম করছে, বলছে “মা জাগ্রত হয়েছেন।”

ঋদ্ধিমান এগিয়ে গিয়ে মাটিতে পড়া তরলটা ছুঁয়ে দেখল। আঠালো, আর গন্ধটা অদ্ভুত। পাকা লোহা বা মরচের মতো একটা গন্ধ। রক্তের মতোই দেখাচ্ছে, কিন্তু সে নিশ্চিত কিছুটা তৈরি।

তবে ভিড়ের মধ্যে আরেকটা অস্বস্তিকর ব্যাপার ঘটছিল। অর্পিতার কাকা, দীপঙ্কর লাহিড়ী, যিনি বাড়ির কর্তা, তাঁর মুখে অদ্ভুত এক অস্বস্তি। বারবার ভিড়কে শান্ত করতে চাইছিলেন।

— “কিছু হয়নি! এ কেবল রঙের সমস্যা। পুজো থামানো যাবে না।”

কিন্তু লোকজন মানছে না। চারদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ল। কেউ বলছে এটা অলৌকিক, কেউ বলছে অশুভ সংকেত।

ঋদ্ধিমান তখনই লক্ষ্য করল, মন্দিরঘরের মেঝেতে কয়েক ফোঁটা লাল তরলের মধ্যে একটা ছোট্ট কাগজ ভিজে আছে। ভিড়ের ঠেলাঠেলির মধ্যে সেটা প্রায় কারো চোখে পড়েনি। ঝুঁকে সেটি তুলে নিল সে।

কাগজে অদ্ভুত কালো কালিতে লেখা কয়েকটা শব্দ—
“অমাবস্যায় রক্ত চাই।”

শরীর কেঁপে উঠল ঋদ্ধিমানের।
কারও ইচ্ছাকৃতভাবে সাজানো খেলা এটা। আর সেই খেলার কেন্দ্রবিন্দু এই পুজো।

রাত গভীর হল। পূজা যেমন চলছে, তেমনি ভেতরে অস্থিরতা বাড়ছে। অর্পিতা বারবার উদ্বিগ্ন হয়ে ঋদ্ধিমানকে বলছিল,
— “দয়া করে আপনি থাকুন। আমি জানি, কাল রাতেই সব ঘটবে।”

কিন্তু কী ঘটবে, তা কেউ আন্দাজ করতে পারছিল না।

পরের সকালে যখন আলো ফুটল, তখনই লাহিড়ীবাড়ি কেঁপে উঠল দ্বিতীয়বার।

মন্দিরঘরের ভেতর পাওয়া গেল দীপঙ্কর লাহিড়ীর মৃতদেহ। তাঁর গলা কাটা, চারপাশে ছিটকে থাকা রক্তে আবারও দেখা যাচ্ছে সেই অদ্ভুত প্রতীক—
যেটা ঋদ্ধিমান আগের রাতে দেওয়ালে দেখেছিল।

এবার আর কেউ বলল না অলৌকিক। সবাই বুঝল—
এটা খুন।

পর্ব ৩ : তদন্তের আঁচ

সকালের আলো লাহিড়ীবাড়ির আঙিনায় পৌঁছনোর আগেই হাহাকার ছড়িয়ে পড়েছে। পরিবারের ছোট থেকে বড়—সবার মুখে ভয়ের ছাপ। পূজোর আনন্দ এক মুহূর্তে কেঁপে গেছে। পুলিশ এসেছে, চারদিক ঘিরে রেখেছে।

দীপঙ্কর লাহিড়ীর মৃতদেহ মন্দিরঘরের মাঝখানে। তাঁর চোখ উল্টে আছে, গলা থেকে কাটা রক্ত চারদিকে গড়িয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছে। আর সেই রক্তের ভেতর আবারও আঁকা হয়েছে অদ্ভুত প্রতীক। যেন কেউ সচেতনভাবে চিহ্নটা এঁকেছে।

পুলিশের ইনস্পেক্টর, অরিন্দম ঘোষ, কঠিন গলায় বলল—
— “এটা স্রেফ খুন। কালীপুজোর অজুহাতে কেউ পুরোনো বিদ্বেষ মেটাতে চেয়েছে। পরিবারের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”

ঋদ্ধিমান চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু তাঁর মাথার ভেতর দ্রুত ঘুরছিল প্রশ্ন। কে এই প্রতীক আঁকছে? কেন বিশেষভাবে কালীপুজোর দিনই এ কাজ হচ্ছে?

অর্পিতা তখন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। পুলিশ তাঁকেও প্রশ্ন করল,
— “আপনার বাবা-মা?”
অর্পিতা উত্তর দিল,
— “মা মারা গেছেন ছোটবেলায়। বাবা থাকেন বিদেশে। আমি কাকাবাবুর কাছে বড় হয়েছি।”

ইনস্পেক্টরের চোখে সন্দেহের রেখা ফুটল, কিন্তু কিছু বলল না।

ঋদ্ধিমান এগিয়ে গিয়ে নিচু গলায় অরিন্দমকে বলল,
— “স্যার, এই প্রতীক সাধারণ কোনো চিহ্ন নয়। এগুলো অঘোরী তান্ত্রিকদের ব্যবহৃত চক্রচিহ্ন। বলিদান বা ভীতি তৈরি করার জন্য ব্যবহার হয়।”

অরিন্দম প্রথমে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলেও পরে চুপ করে গেল। কারণ প্রতীকটা সত্যিই অদ্ভুত।

এরপর শুরু হল জিজ্ঞাসাবাদ।

পরিবারের ভেতরের দ্বন্দ্ব

প্রথমেই উঠল সম্পত্তির প্রসঙ্গ। লাহিড়ীবাড়ির বিপুল জমিজমা আর বাড়ি ঘিরে আগে থেকেই দ্বন্দ্ব চলছিল। দীপঙ্করের মৃত্যুর মানে হতে পারে—কেউ উত্তরাধিকারীর জায়গা পেতে চাইছে।

অর্পিতার দূর সম্পর্কের দাদা, অমিতাভ, বারবার বলে যাচ্ছিল,
— “এ সব তন্ত্রমন্ত্রের বাজে গল্প! আসল কথা হচ্ছে, বাড়ি নিয়ে লড়াই চলছিল। কাকাবাবু অনেককে বঞ্চিত করতে চাইছিলেন।”

অন্যদিকে, দীপঙ্করের স্ত্রী রুমা দেবী, যিনি বছর কয়েক আগে আলাদা থাকতে শুরু করেছিলেন, হঠাৎ সেদিন রাতেই ফিরে এসেছেন। তাঁর উপস্থিতি নিয়েও ফিসফিসানি চলছে।

ঋদ্ধিমান লক্ষ্য করছিল, প্রতিটি মানুষের চোখে ভয় আছে, কিন্তু সেই ভয় একই রকম নয়। কেউ ভয় পাচ্ছে পুলিশের, কেউ আবার ভয় পাচ্ছে কোনো অজানা রহস্যের।

অর্পিতার স্বীকারোক্তি

সন্ধ্যার পর অর্পিতা ঋদ্ধিমানকে একপাশে টেনে নিল।
— “ঋদ্ধিমানদা, আপনাকে একটা কথা বলব। প্রতিজ্ঞা করবেন কাউকে বলবেন না।”
— “বলুন।”
— “প্রতিবছর কালীপুজোর রাতে এই বাড়িতে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। ঠাকুমা বলতেন, বহু বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা এক বিরল প্রতিমা চুরি করে আনেন বীরভূমের এক শ্মশান থেকে। সেই প্রতিমাই দিয়ে প্রথম কালীপুজো শুরু হয়েছিল। কিন্তু প্রতিমার সঙ্গে ছিল অভিশাপ—যতদিন প্রতিমা থাকবে, ততদিন রক্ত চাইবে।”

ঋদ্ধিমানের শরীর শিরশির করে উঠল।
— “তাহলে আপনারা ওই প্রতিমা এখনো রেখেছেন?”
অর্পিতা মাথা নেড়ে বলল,
— “না। বছর কুড়ি আগে সেটা হঠাৎ হারিয়ে যায়। আর তার পর থেকেই প্রতি কয়েক বছরে অদ্ভুত মৃত্যু ঘটছে। আমি ভয় পাচ্ছি, এ বছর আবারো সেই অভিশাপ ফিরে এসেছে।”

ঋদ্ধিমান জানত, অভিশাপ বলে কিছু নেই। কিন্তু ঘটনা ক্রমশ তান্ত্রিক রহস্যের দিকে টেনে নিচ্ছে।

রক্তচিহ্নের খোঁজ

রাত বাড়তেই পুলিশ মন্দিরঘর খালি করে দিল। ঋদ্ধিমান আবারও সেই প্রতীকগুলোর কাছে গেল। খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে খেয়াল করল, রক্তের মধ্যে প্রতীক আঁকা হলেও এর ভেতর ছোট্ট এক অক্ষর লেখা—“শূন্য”।

শূন্য মানে কী? শূন্য কি কারো নাম, নাকি কোনো দলের ইঙ্গিত?

হঠাৎ পিছন থেকে মৃদু হাসি শোনা গেল। ঋদ্ধিমান ঘুরে দেখল অমিতাভ দাঁড়িয়ে আছে।
— “আপনি বড্ড বেশি কৌতূহলী, মিত্রবাবু। সাবধান থাকবেন। এই বাড়ি কখনো বাইরের কাউকে ক্ষমা করে না।”

ঋদ্ধিমান ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল,
— “ক্ষমা না করলে কি শাস্তি দেয়?”
অমিতাভ শুধু হেসে চলে গেল।

ঋদ্ধিমান বুঝল, খুন শুধু পারিবারিক ষড়যন্ত্র নয়। এর পেছনে লুকিয়ে আছে বহু পুরনো এক তন্ত্রকাহিনি।

এবং সেই কাহিনি নতুন করে রক্ত চাইছে।

 

পর্ব ৪ : অগ্নিশিখার ছায়া

পুলিশ লাহিড়ীবাড়ির প্রধান দরজা সিল করে দিয়েছে। বাইরের লোকজন কেউ ঢুকতে পারবে না, আবার ভেতরের কেউ বেরোতেও পারবে না। যেন অদৃশ্য এক কারাগার তৈরি হয়েছে পুরোনো বনেদি বাড়িটাকে ঘিরে।

ঋদ্ধিমান দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। রাতের অন্ধকারে মোমবাতির আলোয় চারদিক অদ্ভুত নিস্তব্ধ লাগছে। ঢাক আর আতসবাজির শব্দ পুজোর রাতে বাইরে কানে আসছে, অথচ বাড়ির ভেতরে এক চাপা ভয় জমে উঠছে।

রহস্যময় অতিথি

ঠিক তখনই গেটের বাইরে পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করতে করতে ঢুকলেন এক মাঝবয়সী মহিলা। গাঢ় শাড়ি, কপালে সিঁদুর নেই, চোখে কালো কাজল মাখা। তাঁর হাতের মধ্যে একটা পুরোনো নকশা করা বাক্স।

ইনস্পেক্টর অরিন্দম রেগে উঠলেন,
— “আপনি কে? অনুমতি ছাড়া ঢুকলেন কীভাবে?”

মহিলা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
— “আমার নাম অগ্নিশিখা। আমি তান্ত্রিক সাধনা করি। লাহিড়ীবাড়ির পুজোর সঙ্গে বহু বছর ধরে আমাদের আশ্রমের যোগ আছে। এই মৃত্যু দেখে আমি এসেছি।”

পরিবারের কয়েকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। কেউ বলল, অগ্নিশিখা নাকি আগেও এই পুজোয় হাজির হয়েছিল, আর সে এসেই অদ্ভুত কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল।

ঋদ্ধিমান কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেল।
— “আপনি জানেন প্রতীকটার মানে কী?”
অগ্নিশিখা ধীরে ধীরে বাক্সটা খুললেন। ভেতরে রাখা আছে কয়েকটা হলদেটে তালপাতার পুঁথি। সে দেখাল এক পুরোনো চিত্র, যেখানে আঁকা আছে সেই একই প্রতীক।

— “এটা ‘শূন্য মণ্ডল’। অঘোর সাধনার এক নিষিদ্ধ প্রতীক। বলা হয়, এর ডাক এলে রক্ত ছাড়া শান্তি মেলে না।”

শূন্যর গোপন ইতিহাস

অর্পিতা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করল,
— “আপনি কি বলছেন, এটা আবার সক্রিয় হয়েছে?”
অগ্নিশিখা মাথা নেড়ে বলল,
— “হ্যাঁ। অনেক বছর আগে লাহিড়ীবাড়ির পূর্বপুরুষরা এক ‘শূন্যনাথ’ নামে তান্ত্রিককে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন এক বিরল সাধক, যিনি দেবীকে আহ্বান করতে রক্ত ব্যবহার করতেন। পরে তাঁকে বিশ্বাসঘাতকতা করে হত্যা করা হয়। সেই থেকে অভিশাপ এই পরিবারকে তাড়া করছে।”

ঋদ্ধিমান শুনতে শুনতে ঠান্ডা দম ফেলল। ইতিহাস আর বর্তমান যেন একসাথে গাঁথা হচ্ছে।

তদন্তের নতুন মোড়

কিন্তু ইনস্পেক্টর অরিন্দম এসব মানতে নারাজ।
— “ম্যাডাম, এগুলো লোকবিশ্বাস। আমি খুঁজছি খুনিকে। এই বাড়ির ভেতরেই সে আছে।”

ঋদ্ধিমান চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভাবছিল। হয়তো অরিন্দম যুক্তির পথে সঠিক, কিন্তু প্রতীকগুলো, মৃতদেহের ভঙ্গি, আর সেই কাগজের বার্তা—সবকিছু কেবল কাকতালীয় হতে পারে না।

গোপন সাক্ষাৎ

রাত গভীর হতে হতে ঋদ্ধিমান যখন নিজের ঘরে ফিরছিল, তখন অর্পিতা হঠাৎ এসে বলল,
— “আমার সঙ্গে আসুন।”

সে নিয়ে গেল বাড়ির পুরোনো ভাণ্ডার ঘরে। ধুলোমাখা তাক, ভাঙা প্রতিমা, আর কোণে এক পুরোনো বাক্স। অর্পিতা বাক্স খুলে দেখাল—
ভেতরে আছে কিছু ভাঙা মূর্তির টুকরো, আর এক অদ্ভুত কালো পাথরের মুখোশ।

— “এটাই সেই হারিয়ে যাওয়া প্রতিমার অংশ।”

ঋদ্ধিমান স্পর্শ করতেই শরীর কেঁপে উঠল। পাথরটা অস্বাভাবিক ঠান্ডা, যেন বহুদিনের অন্ধকারে ডুবে আছে।

অর্পিতা ফিসফিস করে বলল,
— “আমি ভয় পাচ্ছি। বাবার মৃত্যুর পর এবার হয়তো আমার পালা।”

ঋদ্ধিমান কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু হঠাৎ বাইরে থেকে পায়ের শব্দ আসতে লাগল। কেউ একজন খুব আস্তে আস্তে ভাণ্ডারের দিকে এগিয়ে আসছে।

দরজার ফাঁক দিয়ে তারা শুধু এক জোড়া চোখ দেখল—লালচে আলোয় জ্বলজ্বল করছে।

পর্ব ৫ : লাল চোখের মালিক

ভাণ্ডারঘরের অন্ধকারে সেই জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করছিল। অর্পিতা ভয়ে ঋদ্ধিমানের হাত শক্ত করে চেপে ধরল। বাইরে থেকে পায়ের শব্দ ঘনিয়ে এলো।

ঋদ্ধিমান দ্রুত বাক্সের ঢাকনা বন্ধ করে দিল, আর অর্পিতাকে ইশারা করল চুপ থাকতে। দরজাটা কিঞ্চিৎ খুলে গেল।

ভেতরে ঢুকল অমিতাভ। তার চোখে আলো পড়েছিল লালচে, কিন্তু সেটা ছিল একটা কাচের রিফ্লেকশন। হাতে টর্চ। ঠোঁটে অদ্ভুত এক বাঁকা হাসি।

— “আহা, তোরা দু’জন এখানে কী করছিস?”

ঋদ্ধিমান গম্ভীর স্বরে বলল,
— “আমরা শুধু পুরোনো প্রতিমার টুকরোগুলো দেখছিলাম।”

অমিতাভ হেসে বলল,
— “সেটা তোর কাজ না, মিত্রবাবু। পরিবারে যত ইতিহাস আছে, বাইরের লোকের জানার দরকার নেই। তুই ভালো করে বলছি—এইসব খোঁজাখুঁজি বন্ধ কর।”

তার চোখে হঠাৎ এমন এক হুমকি জ্বলে উঠল যে অর্পিতা কেঁপে উঠল।

সন্দেহের জাল

অমিতাভ চলে গেলে অর্পিতা ধীরে ধীরে বলল,
— “ও কিছু জানে। নিশ্চয়ই ওর হাত আছে এই ঘটনার সঙ্গে।”

ঋদ্ধিমান মাথা নাড়ল।
— “প্রমাণ ছাড়া কাউকে দোষ দেওয়া যাবে না। তবে অমিতাভ কিছু লুকোচ্ছে, এটা নিশ্চিত।”

ঠিক তখনই বাইরে হইচই শুরু হল। পুলিশ সবাইকে উঠোনে ডেকেছে।

ইনস্পেক্টর অরিন্দম ঘোষণা করলেন,
— “আমরা বাড়ির ভেতরে তল্লাশি চালিয়েছি। মন্দিরঘরের পিছনের ঘরে একটুকরো কাপড় আর ছুরি পেয়েছি। ছুরিতে রক্তের দাগ আছে। আমরা সন্দেহ করছি—খুনি এখানেই লুকিয়েছে।”

সবাই আতঙ্কে চেয়ে রইল। ছুরিটা দেখে রুমা দেবী হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন,
— “এটা দীপঙ্করের নিজের! ও সবসময় মন্দিরে রাখত। কেউ ওটা দিয়ে খুন করেছে।”

অগ্নিশিখার সতর্কবাণী

অগ্নিশিখা এগিয়ে এসে বললেন,
— “শুধু ছুরি নয়। এই খুনের পেছনে অদৃশ্য শক্তির টান আছে। শূন্য মণ্ডল একবার জেগে উঠলে একাধিক বলিদান চাই।”

অরিন্দম বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল,
— “এগুলো বাজে কথা। খুনি এখানেই আছে।”

কিন্তু অগ্নিশিখার কণ্ঠস্বর যেন বজ্রপাতের মতো গম্ভীর ছিল।
— “আরেকটা মৃত্যু ঘটবে। কাল অমাবস্যার রাত। সেই রাতে রক্ত চাইবে।”

এই কথা শুনে সবার বুক কেঁপে উঠল।

গোপন কাগজ

ঋদ্ধিমান নিজের ঘরে ফিরে এল। মাথা কাজ করছে না। সে বের করল আগের রাতে পাওয়া ভেজা কাগজটা। তাতে লেখা ছিল— “অমাবস্যায় রক্ত চাই।”

আজ অগ্নিশিখা একই কথা বলল। কাকতালীয়? নাকি দুজন একই সূত্র থেকে বার্তা পাচ্ছে?

সে কাগজটা আলোয় ধরতেই দেখতে পেল লেখার নিচে হালকা চাপে আঁকা আরেকটা শব্দ—
“অর্পিতা।”

ঋদ্ধিমানের বুক ঠান্ডা হয়ে গেল। কেন অর্পিতার নাম লেখা? সে কি টার্গেট? নাকি কেউ চাইছে সন্দেহ অর্পিতার উপর গিয়ে পড়ুক?

অর্পিতার আতঙ্ক

ঋদ্ধিমান বিষয়টা সরাসরি অর্পিতাকে বলল না। শুধু জিজ্ঞেস করল,
— “তোমার কখনো মনে হয়েছে, কেউ তোমাকে ফলো করছে?”

অর্পিতা ভয়ে মাথা নেড়ে বলল,
— “হ্যাঁ। পূজোর কয়েকদিন আগে থেকে রাতে জানলার বাইরে ছায়া দেখতে পাই। কিন্তু কারো মুখ ধরা যায় না।”

হঠাৎ বাইরে থেকে এক ঝড়ো হাওয়া এসে জানলার শিক কাঁপিয়ে দিল। আলো নিভে গেল। ঘর অন্ধকারে ঢেকে গেল।

অন্ধকারে অর্পিতা ফিসফিস করে বলল—
— “ঋদ্ধিমানদা… মনে হচ্ছে কেউ এই মুহূর্তেই আমাদের দেখছে।”

 

পর্ব ৬ : ছায়ার ফাঁদ

ঘর অন্ধকারে ডুবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জানলার শিক নড়ে উঠল। যেন বাইরে কেউ হাত বুলিয়ে গেল। অর্পিতা কেঁপে ঋদ্ধিমানের বাহু আঁকড়ে ধরল।

ঋদ্ধিমান টর্চ জ্বালিয়ে জানলার কাছে এগোল। বাইরে উঠোনে ফাঁকা, শুধু শুকনো পাতা উড়ছে। কিন্তু মাটিতে স্পষ্ট দেখা গেল পায়ের ছাপ। কারও ভারী বুটজুতো।

সে নিচু গলায় বলল,
— “কেউ আমাদের ঘিরে রেখেছে।”

নতুন প্রমাণ

পরদিন সকালে পুলিশ আবার খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে মন্দিরের পেছনের অরণ্যঘেঁষা অংশে এক অদ্ভুত জিনিস পেল। গাছের গুঁড়িতে পেরেক মারা ছিল একটি লাল কাপড়। তাতে সিঁদুর মাখানো আর মাঝখানে এক হাড়ের টুকরো ঝোলানো।

অগ্নিশিখা দেখে গম্ভীর মুখে বললেন,
— “এটা শূন্যনাথের তন্ত্রচিহ্ন। যার নামে এই মণ্ডল। এখানে যদি কেউ বলিদান দেয়, তার আত্মা নাকি শূন্যে আটকা পড়ে।”

ইনস্পেক্টর অরিন্দম বিরক্ত হয়ে বললেন,
— “অবশেষে তান্ত্রিক নাটক শুরু হলো। কিন্তু আমি জানি, এ সব সাজানো ভয় দেখানো খেলা।”

ঋদ্ধিমান চুপচাপ ভাবছিল। কাপড়ের গিঁটে লুকোনো ছিল আরেকটা ছোট কাগজ। সে খেয়াল করে দেখল, তাতে কেবল একটা শব্দ লেখা—
“দ্বিতীয়।”

মানে কি দ্বিতীয় মৃত্যু আসন্ন?

পারিবারিক দ্বন্দ্ব

অমিতাভ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল,
— “খুনির হাত পরিষ্কার! রুমা মাসি ফিরেছে অনেক বছর পর। কাকাবাবুর সঙ্গে ওর দ্বন্দ্ব ছিল। ও-ই খুন করেছে।”

রুমা দেবী কেঁদে বললেন,
— “আমি ফিরেছি মিটমাট করতে, খুন করতে নয়।”

কিন্তু সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছিল। পুলিশ সবাইকে আলাদা করে নজরদারির মধ্যে রাখল।

ঋদ্ধিমানের আবিষ্কার

রাতে ঋদ্ধিমান একা একা মন্দিরঘরে গিয়ে প্রতীকগুলোর উপর ঝুঁকল। হাতে টর্চের আলো ফেলে খেয়াল করল—চিহ্নগুলো আসলে একটা সিরিজের মতো। প্রতিটি প্রতীক আসন্ন ঘটনার ইঙ্গিত।

প্রথম প্রতীক = মৃত্যু।
দ্বিতীয় প্রতীক = বলিদান।
তৃতীয় প্রতীক (আধাআধি আঁকা আছে) = আগুন।

মানে কি পরের মৃত্যু আগুনে ঘটবে?

ঠিক তখনই সে শুনল পায়ের শব্দ। ঘুরে দেখল অগ্নিশিখা দাঁড়িয়ে আছে।
— “আপনিই খুঁজছেন উত্তর? সাবধান হোন। যারাই শূন্য মণ্ডলের রহস্য জানার চেষ্টা করেছে, তারা বাঁচেনি।”

ঋদ্ধিমান প্রশ্ন করল,
— “আপনি কেন এসেছেন এখানে?”
অগ্নিশিখার চোখে ছায়া খেলে গেল।
— “কারণ আমি জানি, এই বাড়ির অমাবস্যা রাত কখনো শান্ত হয় না।”

দ্বিতীয় মৃত্যু

রাত তখন ঘনিয়েছে। সবাই ঘুমে ঢলে পড়ছিল। হঠাৎ এক চিৎকারে গোটা বাড়ি কেঁপে উঠল।

সবাই দৌড়ে গেল পেছনের গুদামঘরে। দরজা ভাঙতেই দেখা গেল—অমিতাভ পড়ে আছে, গায়ের কাপড়ে আগুন লেগে ছড়িয়ে পড়েছে। শরীরটা অর্ধেক দগ্ধ। চারদিকে জ্বলছে খড়ের গাদায় আগুন।

চোখ উল্টে যাওয়ার আগে সে শুধু একটা নাম বলল—
— “অর্পিতা…”

অর্পিতা ভয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল।

এবার আর সন্দেহ সীমাবদ্ধ থাকল না। সবাই চোখ ফেরাল অর্পিতার দিকে।

 

পর্ব ৭ : সন্দেহের ভার

গুদামঘরের আগুন অনেক কষ্টে নিভল। অমিতাভের অর্ধদগ্ধ দেহ সবার সামনে পড়ে আছে। তার শেষ উচ্চারণ—“অর্পিতা”—এখন লাহিড়ীবাড়ির প্রতিটি সদস্যের মনে একটিই ধারণা জন্ম দিয়েছে।

অরিন্দম ঘোষ গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
— “এখন আর দ্বিধার অবকাশ নেই। মৃত অমিতাভ নিজেই নাম বলে গিয়েছেন। অর্পিতা লাহিড়ী, আপনাকেই আমরা সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করছি।”

অর্পিতা ভয়ে ও হতাশায় এক ঝটকায় চিৎকার করে উঠল,
— “না! আমি নির্দোষ! আমি কিছু করিনি। আমার কাকাও নয়, অমিতাভদাও নয়। কেউ ইচ্ছে করে আমার নাম টেনে আনছে।”

সে কেঁদে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। পরিবারের অন্যরা ফিসফিস করে বলছিল, “তাই তো, অর্পিতা সবসময় অদ্ভুত ছিল”, “ও-ই না কি পূজোয় অশুভ কিছু ঘটবে বলছিল?”, “হয়তো সত্যিই…”

ঋদ্ধিমানের প্রতিবাদ

ঋদ্ধিমান হঠাৎই এগিয়ে এল।
— “ইনস্পেক্টর ঘোষ, এটা অন্যায়। মৃত মানুষ শেষ মুহূর্তে যা বলে তা সবসময় সত্যি নয়। ভয়, আতঙ্ক আর বিভ্রমে মুখ থেকে নাম বেরোতে পারে। কোনো প্রমাণ ছাড়াই অর্পিতাকে দোষী বানানো ঠিক হবে না।”

অরিন্দম ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
— “তাহলে আপনার মতে, কে খুনি?”

ঋদ্ধিমান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দিল,
— “যে প্রতিবার ঘটনার পর প্রতীক আঁকছে, সেই খুনি। কিন্তু সে অর্পিতা নয়।”

বাড়ির অশান্তি

সেই রাতটা লাহিড়ীবাড়ির জন্য দুঃসহ হয়ে উঠল। পরিবারের সদস্যরা আলাদা আলাদা ঘরে বন্দি। বাইরের গেটে পুলিশ পাহারা। অথচ ভিতরের দেয়ালের ভেতরেই কেউ একজন অন্ধকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

রুমা দেবী অর্পিতাকে কোলে নিয়ে কাঁদছিলেন। তাঁর চোখেও সন্দেহের রেখা, কিন্তু মাতৃত্ববোধে মেয়েটিকে আড়াল করছিলেন।

শূন্য মণ্ডলের তৃতীয় দাগ

ঋদ্ধিমান আবার মন্দিরঘরে ঢুকল। প্রতীকগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখল, তৃতীয় প্রতীক—আগুন—এবার সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। সত্যিই দ্বিতীয় মৃত্যু ঘটেছে আগুনে।

তারপরের প্রতীক আধাআধি আঁকা আছে। দেখতে এক শিকল বা বাঁধনের মতো। এর মানে কী হতে পারে? কারাগার? বন্দি? নাকি কারো আটকা পড়া আত্মা?

সে খেয়াল করল, প্রতীকের নিচে এবার আরেকটা শব্দ খোদাই—“তৃতীয়।”

মানে কি, তৃতীয় মৃত্যু আসছে?

অগ্নিশিখার রহস্য

ঋদ্ধিমান ঘর থেকে বেরোতেই অগ্নিশিখা তার সামনে এসে দাঁড়াল।
— “আপনি অযথা এই প্রতীক নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছেন। এসব না জানাই ভালো।”

ঋদ্ধিমান তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল,
— “কেন? আপনি কি জানেন পরের মৃত্যু কাকে চাইছে?”

অগ্নিশিখা নিঃশ্বাস ফেললেন,
— “অমাবস্যার রাতে শূন্যনাথ যে জেগে ওঠে, তাকে আর আটকানো যায় না। এবার বলি চাইবে পরিবারের একজনের। যদি সে না পায়, তাহলে বাড়ির বাইরের কেউ মরবে।”

ঋদ্ধিমান কড়া স্বরে বলল,
— “আপনি অনেক কিছু জানেন, অথচ আমাদের বলেন না। আপনার ভূমিকা কি কেবল দর্শকের?”

অগ্নিশিখার ঠোঁটে রহস্যময় হাসি ফুটল।
— “দর্শক নই। আমি নিজেই এই অভিশাপের উত্তরাধিকারী।”

এই কথা বলে সে হঠাৎ অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

অর্পিতার প্রতি আক্রমণ

রাত তখন গভীর। সবাই ঘুমোতে চেষ্টা করছে। হঠাৎ অর্পিতার ঘর থেকে চিৎকার শোনা গেল।

ঋদ্ধিমান দৌড়ে গিয়ে দেখল—অর্পিতা বিছানায় শুয়ে, তার গলার কাছে বাঁশি-সদৃশ একটা ধারালো অস্ত্র ঠেকানো। ঘরে অদ্ভুত এক ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে। মুখ ঢেকে রেখেছে কাপড়ে।

ঋদ্ধিমান ঝাঁপিয়ে পড়তেই ছায়ামূর্তি অস্ত্র ফেলে জানালা দিয়ে ঝাঁপ দিল। বাইরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

মেঝেতে পড়ে থাকা অস্ত্রটা তুলে নিতেই দেখা গেল, তার হাতলে খোদাই করা এক শব্দ—
“শূন্য।”

 

পর্ব ৮ : কারাগারের প্রতীক

অর্পিতাকে রক্ষা করা গেল বটে, কিন্তু মেঝেতে পড়ে থাকা অস্ত্র সবার মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিল। অস্ত্রের হাতলে খোদাই করা “শূন্য” শব্দটা যেন অদৃশ্য ছায়ার মতো পুরো লাহিড়ীবাড়িকে ঘিরে ফেলল।

ইনস্পেক্টর অরিন্দম গম্ভীর গলায় বললেন,
— “এবার আর কোনো সন্দেহ নেই। খুনি প্রতিটি ঘটনার পর বার্তা দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের হাতে সময় কম। আগামীকাল অমাবস্যা। তার আগে তাকে ধরতে হবে।”

কিন্তু কাকে সন্দেহ করা যায়? প্রত্যেকেই যেন নিজেদের মুখোশ পরে আছে।

অর্পিতার কান্না

অর্পিতা চুপচাপ বসে কাঁদছিল। ঋদ্ধিমান তার পাশে গিয়ে বসে বলল,
— “তুমি শক্ত হও। কেউ তোমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।”

অর্পিতা চোখ ভেজা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
— “ঋদ্ধিমানদা, যদি আমি-ই খুনি হই?”

ঋদ্ধিমান অবাক হয়ে তাকাল।
— “তুমি কী বলছ!”
— “আমি মাঝে মাঝে ব্ল্যাকআউট হয়ে যাই। কিছু মনে থাকে না। হয়তো সেই সময়… আমি জানি না।”

ঋদ্ধিমান তার হাত শক্ত করে চেপে ধরল।
— “না, এটা সম্ভব নয়। তোমার মন নিয়ে কেউ খেলছে।”

গোপন কক্ষ

সন্ধ্যার পর বাড়ির এক কোণে পুলিশ তল্লাশি চালাতে গিয়ে হঠাৎ একটি গুপ্ত দরজা আবিষ্কার করল। পুরোনো কাঠের আলমারির পেছনে লুকনো ছোট্ট কক্ষ। দরজা খুলতেই ভেতরে পাওয়া গেল ধূপের গন্ধ, পাটের দড়ি, আর মাটিতে আঁকা কালো রঙের প্রতীক।

কক্ষের মাঝখানে রাখা ছিল লোহার শিকল। শিকলে বাঁধা শুকনো রক্তের দাগ।

ঋদ্ধিমান অবাক হয়ে বলল,
— “এটাই সেই প্রতীক! শিকল বা কারাগার… আমি মন্দিরঘরে দেখেছিলাম। মানে খুনি এখানেই তার সাধনা চালাচ্ছে।”

অরিন্দম কপাল কুঁচকে বললেন,
— “এই ঘর এতদিন কেউ জানত না?”

রুমা দেবী ফিসফিস করে বললেন,
— “দীপঙ্করই তালা মেরে রেখেছিলেন। বলতেন, ওটা ব্যবহার করা যাবে না।”

তাহলে দীপঙ্কর জানতেন কিছু? আর সেই জানাটাই কি তাঁর মৃত্যুর কারণ?

রহস্যের নতুন সূত্র

ঋদ্ধিমান মাটিতে খেয়াল করল—শুকনো রক্তের দাগের পাশে রাখা একখানা খাতা। পাতাগুলো অর্ধেক জ্বলে গেছে। কিন্তু যা পড়া গেল তাতে লেখা—
“শূন্য মণ্ডলের তিন দীক্ষা—
প্রথম: মৃত্যু।
দ্বিতীয়: আগুন।
তৃতীয়: বাঁধন।
চতুর্থ: আত্মাহুতি।”

ঋদ্ধিমানের বুক কেঁপে উঠল। মানে এখনো দুটো ধাপ বাকি।

অগ্নিশিখার স্বীকারোক্তি

রাতে সবাই যখন ঘরে ফিরছিল, তখন অগ্নিশিখা ঋদ্ধিমানকে একপাশে ডেকে নিল।
— “তুমি যা পড়েছ, সেটা সত্যি। শূন্যনাথের সাধনা চার ধাপে সম্পূর্ণ হয়। আর শেষ ধাপ মানে প্রাণ বিসর্জন। যদি সেটা রোখা না যায়, এই বাড়ি থেকে কেউ বাঁচবে না।”

ঋদ্ধিমান প্রশ্ন করল,
— “কিন্তু কে করছে এই সাধনা?”

অগ্নিশিখার চোখে জল এসে গেল।
— “আমি জানি, এই অভিশাপ আমাদের পরিবার থেকেই শুরু হয়েছিল। আমি সেই উত্তরাধিকার বহন করছি। কিন্তু এ খুন আমি করিনি। কেউ আমাকে ব্যবহার করছে।”

ঋদ্ধিমান অবাক হয়ে তাকাল।
— “মানে আপনি লাহিড়ীবাড়ির রক্ত?”

অগ্নিশিখা মাথা নিচু করে বলল,
— “হ্যাঁ। আমি দীপঙ্করের অবৈধ কন্যা।”

বন্দি অর্পিতা

রাত গভীর হলে আচমকা হইচই শুরু হল। অর্পিতা ঘরে নেই।

সবাই খুঁজতে খুঁজতে মন্দিরঘরে গিয়ে দেখে—অর্পিতা শিকলে বাঁধা, মুখে কাপড় গোঁজা। তার চোখে আতঙ্কের ছাপ।

প্রতীকের তৃতীয় ধাপ—বাঁধন—সত্যি হয়ে গেছে।

পর্ব ৯ : অমাবস্যার রাত্রি

কালো আকাশে চাঁদ নেই। শুধু জ্বলজ্বলে তারা, আর দূরে বাজির আওয়াজ। কিন্তু লাহিড়ীবাড়ির ভেতরে অমাবস্যার রাত যেন নেমে এসেছে আরও গাঢ় অন্ধকার হয়ে।

অর্পিতা শিকলবন্দি, মুখে কাপড় গোঁজা। পুলিশ, ঋদ্ধিমান, অগ্নিশিখা—সকলেই দাঁড়িয়ে আছে মন্দিরঘরের সামনে। চারদিকে ছড়িয়ে আছে আতঙ্ক, সন্দেহ আর অজানা শিহরণ।

ইনস্পেক্টর অরিন্দম কড়া গলায় বললেন,
— “এবার শেষ করতে হবে। খুনিকে আজই ধরতে হবে।”

শূন্য মণ্ডলের ছায়া

ঋদ্ধিমান আবার সেই প্রতীকগুলোর দিকে তাকাল। প্রথম মৃত্যু, দ্বিতীয় আগুন, তৃতীয় বাঁধন—সবই ঘটেছে। এবার বাকি শুধু চতুর্থ—আত্মাহুতি।

তার বুক কেঁপে উঠল। যদি সত্যিই কোনো শয়তানি পরিকল্পনা হয়, তবে শেষ ধাপে কারো প্রাণ বিসর্জন দেওয়া হবে। আর অর্পিতা হয়তো সেই বলির পাঁঠা।

রহস্যের জাল ফাঁসছে

অগ্নিশিখা তখন ধীরে ধীরে বলল,
— “শূন্য মণ্ডল একা কেউ আঁকতে পারে না। এর জন্য লাগে অন্তত দুজন দীক্ষিত। একজন নেতৃত্ব দেয়, আরেকজন পূর্ণ করে।”

ঋদ্ধিমান বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল,
— “মানে খুনি একজন নয়?”

অগ্নিশিখা মাথা নেড়ে বলল,
— “হ্যাঁ। দুই মুখোশ একসঙ্গে কাজ করছে।”

এই কথা শুনে সবার মনে ভয় আরও বেড়ে গেল।

গোপন আঘাত

হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। চারদিক আঁধারে ঢেকে গেল। সেই অন্ধকারে মন্দিরঘরে ঢাকের মতো শব্দ উঠল। কেউ যেন মেঝেতে জোরে জোরে আঘাত করছে।

টর্চ জ্বালাতেই দেখা গেল—অরিন্দম ঘোষ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। তাঁর মাথায় আঘাত, রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

কেউ একজন পুলিশ ইনস্পেক্টরকেও নিস্তেজ করে দিয়েছে!

উন্মোচনের মুহূর্ত

ঋদ্ধিমান অন্ধকারের মধ্যে দেখল, মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছে রুমা দেবী। তাঁর হাতে ধূপকাঠির মতো লম্বা ছুরি, আর চোখে এক অদ্ভুত জ্যোতি।

— “হ্যাঁ, আমি-ই এই সাধনা পূর্ণ করছি। দীপঙ্কর আমাদের বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। সে শূন্যনাথকে হত্যা করেছিল, অথচ শক্তি নিজের জন্য লুকিয়ে রেখেছিল। আমি আজ সেই শক্তিকে ফিরিয়ে আনব।”

সবাই হতবাক। রুমা দেবী এতদিন আড়ালে থেকে খেলা চালিয়ে যাচ্ছিলেন!

কিন্তু ঋদ্ধিমান লক্ষ্য করল, তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে আছে অমিতাভের দগ্ধ দেহ নয়, বরং এক ছায়া—যেন কোনো অদৃশ্য সঙ্গী।

অগ্নিশিখা কেঁপে উঠল,
— “না! তুমি একা নও। তোমার সঙ্গে দ্বিতীয় দীক্ষিতও আছে। সে কে?”

ঠিক তখনই মন্দিরঘরের একপাশ থেকে বেরিয়ে এল সেই ছায়া—
অগ্নিশিখা নিজেই।

চমকপ্রদ মোড়

সবাই স্তম্ভিত। অগ্নিশিখা ঠান্ডা গলায় বলল,
— “হ্যাঁ। আমি স্বীকার করছি। আমি এই সাধনার উত্তরাধিকার বহন করি। আমার মা ছিলেন শূন্যনাথের শিষ্যা। আমি জন্মেছি অভিশাপ নিয়ে। দীপঙ্কর আমাকে অস্বীকার করেছিল। তাই আজ রক্তে রক্ত ধুয়ে নিচ্ছি।”

অর্পিতা শিকলবন্দি কেঁদে উঠল।
ঋদ্ধিমান দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— “তাহলে তোমরা দুজন মিলে এই খুনগুলো করেছ?”

রুমা দেবী হেসে উঠলেন,
— “খুন নয়, দীক্ষা। প্রতীক সম্পূর্ণ করার জন্য তিনটি বলি দরকার ছিল। এখন বাকি শুধু আত্মাহুতি। আজ রাতে সেই হবে।”

তারা দুজন মূর্তির সামনে অগ্নিকুণ্ড জ্বালাল। ধূপ, চন্দন, আর গাঢ় লাল সিঁদুর ছড়িয়ে পড়ল। শিকলবন্দি অর্পিতাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হল আগুনের সামনে।

চূড়ান্ত লড়াইয়ের শুরু

ঋদ্ধিমান ঝাঁপিয়ে পড়ল। পুলিশের বাকি লোকজনও এগিয়ে এল। কিন্তু রুমা আর অগ্নিশিখার চোখে তখন অদ্ভুত এক উন্মাদনা।

ঢাকের শব্দ যেন কোথা থেকে বাজতে লাগল, আগুন আরও উঁচু হয়ে উঠল।

চতুর্থ প্রতীক সম্পূর্ণ হওয়ার পথে।

পর্ব ১০ : শেষ বলিদান

আগুনের জ্বালা মন্দিরঘরের প্রতিটি দেয়ালে প্রতিফলিত হচ্ছে। ধূপের গন্ধ, আতসবাজির শব্দ, আর কালীমূর্তির চোখে অদ্ভুত এক দীপ্তি। মনে হচ্ছে যেন দেবী নিজেই নেমে এসেছেন বিচার করতে।

অর্পিতা শিকলবন্দি, চোখে ভয়ের ছায়া। রুমা দেবী ও অগ্নিশিখা সামনে দাঁড়িয়ে মন্ত্র জপছে—
“ওঁ কালী কালী মহাকালী, শূন্যে শূন্যে প্রলয় দাও…”

আগুনের তাপে তাদের চুল উড়ছে, গলায় ধ্বনিত হচ্ছে উন্মাদ হাসি।
ঋদ্ধিমান চিৎকার করে উঠল,
— “থামো! এটা কোনো তন্ত্র নয়, এটা খুন!”

রুমা দেবী এক পা এগিয়ে বলল,
— “তুমি বুঝবে না, মিত্রবাবু। এটা শুরু হয়েছিল বহু আগে। দীপঙ্কর প্রতিজ্ঞা করেছিল, শূন্যনাথের শক্তি দেবে। কিন্তু সে প্রতারণা করেছিল। আমি তার প্রতিশোধ নিচ্ছি।”

ঋদ্ধিমান বুঝতে পারল, এ শুধু প্রতিশোধ নয়—এ এক বিকৃত বিশ্বাস, যেটা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বেঁচে আছে।

আগুনের বৃত্ত

হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকাল। অগ্নিশিখা অগ্নিকুণ্ডে কিছু ছুঁড়ে দিল। আগুন হঠাৎ অস্বাভাবিক লাল হয়ে উঠল। চারদিকে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল, ঢাকের শব্দ যেন কানে বাজল।

অর্পিতা চিৎকার করে উঠল,
— “ঋদ্ধিমানদা! বাঁচান!”

ঋদ্ধিমান পাগলের মতো শিকল খুলতে ছুটল। পুলিশ ইনস্পেক্টর অরিন্দম অচেতন অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে উঠে এসে বন্দুক তাক করল অগ্নিশিখার দিকে।

— “থামুন! হাত তুলুন!”

কিন্তু ততক্ষণে রুমা দেবী আগুনের ভিতরে পা বাড়িয়ে দিয়েছে। তার মুখে বিকৃত হাসি—
— “এই হল আত্মাহুতি! এবার মণ্ডল সম্পূর্ণ!”

চূড়ান্ত বিস্ফোরণ

এক মুহূর্তের মধ্যে আগুন তীব্র আলো ছড়িয়ে বিস্ফোরণের মতো শব্দ করে উঠল। মন্দিরঘর কেঁপে উঠল। ধোঁয়ার ঘন মেঘে কিছু দেখা যাচ্ছিল না।

যখন ধোঁয়া কেটে গেল, দেখা গেল রুমা দেবী আর নেই। আগুন নিভে এসেছে। মূর্তির চোখে আর সেই লাল আভা নেই, বরং যেন শান্ত, প্রশান্ত।

অগ্নিশিখা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে, নিস্তব্ধ। তার ঠোঁটে রক্তের ফোঁটা, কিন্তু মুখে এক প্রশান্ত হাসি।
সে ফিসফিস করে বলল,
— “মণ্ডল শেষ হয়েছে… শূন্য ফিরে গেছে শূন্যে…”
তারপর নিঃশব্দে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল।

পরিসমাপ্তি

সকাল হলে সূর্যের আলোয় লাহিড়ীবাড়ি আবার জীবন্ত হয়ে উঠল, কিন্তু আগের মতো নয়। প্রতিটি দেয়ালে পোড়া চিহ্ন, আর বাতাসে এক অদ্ভুত শূন্যতা।

অর্পিতা হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে মন্দিরঘরে দাঁড়াল। ঋদ্ধিমান তার পাশে।
— “সব শেষ?”
ঋদ্ধিমান মাথা নাড়ল,
— “হ্যাঁ, কিন্তু শেষ মানেই মুক্তি নয়। এই বাড়ির ইতিহাস রয়ে যাবে।”

অর্পিতা নিঃশব্দে বলল,
— “আমি পুজোটা বন্ধ করে দেব। মায়ের পায়ের কাছে শুধু আলো রাখব, রক্ত নয়।”

ঋদ্ধিমান তাকে দেখে হাসল,
— “তবেই হয়তো শূন্য সত্যিই শেষ হবে।”

বাইরে বাজির শেষ শব্দটা মিলিয়ে গেল, সূর্যের আলো মন্দিরঘরের গায়ে পড়ল। ধূপের গন্ধ মিশে গেল সকালের হাওয়ায়।

আর লাহিড়ীবাড়ির আঙিনায় প্রথমবারের মতো, বহু বছরের মধ্যে, নিঃশব্দ শান্তি নামল।

সমাপ্ত

82ba95fd-5d13-40cd-85cd-bd705c4acdeb.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *