সুমন দাস
১
শিলচরের একান্ত কোণে, যেখানে সরু গলি ছুঁয়ে উঠে যায় পাহাড়ের ঢালে এবং সেখানেই ছড়িয়ে আছে কামাক্ষ্যা মন্দিরের প্রাচীন কমপ্লেক্স—সেখানকারই এক জনমানবহীন অংশে দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষ পুরোনো গ্রন্থাগার, ‘তান্ত্রচক্র পাঠাগার’। লাল ইটের দেয়ালে শ্যাওলা জমেছে, কাঠের জানালার পাল্লা আধা খোলা, যেন কেউ সদ্যই ভিতরে ঢুকেছে—বা বেরিয়ে এসেছে। এখানে কর্মরত গ্রন্থাগারিক সায়ন্তন রক্ষিত, নিজেকে খুব সাধারণ মানুষ বলেই ভাবেন। ইতিহাসের ছাত্র হলেও জীবনের কোনো দিকেই তিনি সাহসী পদক্ষেপ নেননি। দিনগুলো কাটে ধুলো ঝাড়া, বই গোছানো, আর কামাক্ষ্যার মন্দিরে যাত্রার আগে কিছু সাধুদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে। কিন্তু সেইদিন সকালটা ছিল অস্বাভাবিক। বাতাসে এক রকম কাঁপুনি ছিল, এবং গ্রন্থাগারে ঢোকার মুখে একটা পুরোনো ঝাঁপসা তালা নিজে থেকেই খুলে পড়ে যায় মেঝেতে। সে মুহূর্তে কিছু বোঝার আগেই তার চোখে পড়ে দেয়ালের পেছনে খচিত একটা লুকানো দরজার রেখা। কৌতূহলে, না কি অবচেতনে টান পড়ে—সে চাপ দেয় প্রাচীন পাথরের ইটের গায়ে। গুঞ্জনধ্বনি, যেন অন্ধকারের মধ্যে কেউ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। দরজাটি অদ্ভুতভাবে খুলে যায়, ধুলোর মেঘ উড়ে উঠে, আর তার ভিতরে দেখা যায় এক সিঁড়ি, যা নামছে নীচের দিকে, অন্ধকারে।
সিঁড়ির শেষপ্রান্তে নামতেই সায়ন্তনের মনে হল, কেউ যেন তাঁর মনের মধ্যে কথা বলছে। ঘরের মেঝে ওয়াটার-ড্যামেজড পুরোনো পুঁথি ও তালপাতার কুৎসিত গন্ধে ভরা, আর এক কোণে রাখা ধাতব বাক্সের ভিতর সেই রহস্যময় গ্রন্থ—‘কালতান্ত্র’। হাতের আলোর সাহায্যে সায়ন্তন যখন ধীরে ধীরে বাক্সের ঢাকনা খুললেন, ভেতর থেকে গা শিউরে ওঠা এক ঠান্ডা বাতাস বেরিয়ে এল। বইটির উপরিভাগে পোড়া কাপড়ে মোড়া ছিল একটা মানুষের পাঁজরের টুকরো, যার গায়ে লেখা ছিল—“জাগিও না তাকে”। সায়ন্তনের শরীর হিম হয়ে যায়, কিন্তু যুক্তিবাদী মন বলে, এসব নিছক তন্ত্রবিদ্যার ভয় দেখানোর পন্থা। সে কাপড় সরিয়ে পুঁথির প্রথম পাতাটি উল্টাতেই মৃদু গর্জনের মত আওয়াজ হয় ঘরের কোণ থেকে। হঠাৎই বাতি নিভে যায়, আর বইয়ের উপরিভাগে ছায়া পড়ে—যা কারো ছিল না। সেই মুহূর্তে, সায়ন্তন নিজের ভিতরে এক গলার আওয়াজ শোনে—“প্রহর শুরু হল”। সে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দরজাটা আবার বন্ধ করে দেয়, কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার সময় অনুভব করে যেন কেউ অদৃশ্য চরণে তাকে অনুসরণ করছে। উপরে উঠে দরজাটি বন্ধ করে চাবি ঘোরাতেই শব্দ আসে—না ঘরের ভিতর থেকে, বরং নিজের বুকের ভেতর থেকে। যেন কালো কোনো অভিশাপ তার শরীরে ঢুকে গেছে, এবং বইটি এখন তার ছায়া।
সেদিনের পর থেকে সায়ন্তনের জীবনে ছোট ছোট পরিবর্তন শুরু হয়। প্রথমে ঘুমের ভেতরে কথা শুনতে পায়—প্রাচীন সংস্কৃত ভাষায় উচ্চারিত মন্ত্র। তারপর, কাজের টেবিলের উপর ছড়ানো বইগুলোর পাতায় নিজে নিজেই নড়াচড়া শুরু হয়, যেন বাতাস ছাড়া কোনো শক্তি ওগুলো উল্টাচ্ছে। এমনকি একদিন, এক সাধু যিনি প্রায় প্রতিদিন কামাক্ষ্যার শিবমূর্তির কাছে ধ্যান করতেন, হঠাৎই সায়ন্তনের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন—“তুমি তাকে জাগিয়েছো, এখন শুধু রক্ষাকর্তা তোমায় রক্ষা করতে পারবে।” সেই প্রথম সায়ন্তন শুনল ‘রক্ষাকর্তা’ শব্দটি। এরপরই গ্রন্থাগারে এল ভৃগুরাম—এক রহস্যময় বৃদ্ধ, যিনি বলেন, “কালতান্ত্র এখন তোমার সঙ্গে বাঁধা, যতদিন না তাকে আবার আবদ্ধ করতে পারো, ততদিন তোমার রাত্রি হবে তার প্রহর।” প্রথম অধ্যায় শেষ হয় এক রাতে সায়ন্তনের স্বপ্নের ভেতর এক নারীস্বরের করুণ আর্তি—“আমি মুক্তি চাই না… আমি ক্ষমা চাই।” ঘেমে উঠা সায়ন্তন উঠে বসে, দেখে জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে এক ছায়ামূর্তি, যার চোখ নেই—তবুও সে তাকিয়ে আছে।
২
ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর সায়ন্তনের চারপাশটা যেন বদলে গিয়েছিল। সকালটা ঠিক ছিল, কিন্তু বাতাসে যেন কোনো ভারী কিছু ভেসে বেড়াচ্ছিল—অদৃশ্য, অথচ ছোঁয়া যায় এমন কিছু। কফির কাপ হাতে নিয়ে যখন সে জানালার পাশে দাঁড়ায়, তখন দেখে জানালার কাঁচের ওপাশে সেই ছায়ামূর্তির কুয়াশা লেগে আছে, ঠিক যেন কেউ সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেছে কিছুক্ষণ আগে। সে মুহূর্তে তার হাতে ধরা কাপের ভিতরের কফিতে এক অদ্ভুত ঘূর্ণি তৈরি হতে থাকে, যেন কিছু চৌম্বক শক্তি কাপটাকেও প্রভাবিত করছে। অফিসে গিয়ে, পুরোনো দপ্তরের নোট ঘাঁটতে গিয়ে সে আবিষ্কার করে গ্রন্থাগারের পুরোনো নথিপত্রে এক ম্লান নাম—‘গুরু অধিরা’, যিনি একসময় এখানে “তন্ত্ররক্ষক” হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন এবং যিনি নিখোঁজ হন ১৮৯৯ সালে এক অমাবস্যার রাতে। সায়ন্তনের ভেতরে এক জিজ্ঞাসা জন্মায়—এই পুঁথি কেবল একটি বই নয়, বরং এক মহাকালের সীলমোহর, যা কেউ বা কিছু খুলতে চায় না, খুললেই ছিন্ন হবে এক প্রাচীন শৃঙ্খল। বিকেলের দিকে গ্রন্থাগারে এক নতুন আগন্তুক আসেন—গায়ত্রী বোরঠাকুর, এক গবেষক যিনি কামাক্ষ্যার লৌকিক দেবী-উপাসনা নিয়ে গবেষণা করছেন। তার প্রথম কথাই ছিল, “আপনি কি কালতান্ত্রের কথা শুনেছেন?” মুহূর্তেই সায়ন্তনের মুখ শুকিয়ে যায়।
গায়ত্রী একটু পরেই বুঝে ফেলেন, সায়ন্তন কিছু লুকোচ্ছে। তিনি জানান, তাঁর দাদু ছিলেন কামরূপের এক তান্ত্রিক, যিনি ‘কালতান্ত্র’ নামে একটি নিষিদ্ধ পুঁথির সন্ধান করেছিলেন এবং তার কিছু অংশ উদ্ধারের আগে-ই রহস্যজনকভাবে প্রাণ হারান। সেই সূত্রেই তিনি এই গ্রন্থাগারে এসেছেন, কারণ শেষ সূত্র এখানেই থেমে গিয়েছিল। সায়ন্তনের চোখে-মুখে আতঙ্ক, দ্বিধা—কিন্তু একটা ভরসাও জন্মায়। প্রথমবারের মত, সে এই গোপন দায়িত্বে একা নয়। গায়ত্রী যখন পুঁথির ইতিহাস ব্যাখ্যা করতে শুরু করেন, সায়ন্তনের চারপাশ ঘন হয়ে আসে এক অলৌকিক আবহে। তিনি বলেন, এই গ্রন্থে লেখা আছে এক অপূর্ণ যজ্ঞের কথা, যা শুরু করেছিল এক সাধিকা, কিন্তু মৃত্যুর আগেই সেই সাধনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তার আত্মা এখন বাঁধা এই পুঁথির ভিতরেই, এবং সেই আত্মা কখনো পবিত্র, আবার কখনো বিভীষিকা। পুঁথির প্রতিটি পৃষ্ঠায় অদৃশ্য অক্ষরে লেখা কিছু মন্ত্র গায়ত্রী দেখতে পান, যেগুলো সায়ন্তনের চোখে দৃশ্যমানই নয়—যা প্রমাণ করে পুঁথিটি পরিবর্তিত হচ্ছে ধীরে ধীরে। তারা সিদ্ধান্ত নেন, সেই লুকানো ঘরে আবার প্রবেশ করতে হবে—আরও গভীরে, কারণ সম্ভবত পুঁথির নীচেই লুকিয়ে আছে প্রকৃত ‘সীলচিহ্ন’, যা এক আত্মাকে বন্দি রেখেছে সহস্র বছর ধরে।
সন্ধ্যার দিকে, তারা একসাথে সেই গোপন চেম্বারে প্রবেশ করে। এবার গায়ত্রী সাথে নিয়ে আসে একটি তামার কাঁসার ঘট, একটি প্রাচীন পুঁথির ভাষ্য এবং রুদ্রাক্ষে বাঁধা এক তাবিজ। নিচের ঘর এখন আরও ঠান্ডা, আরও ভয়ানক। তারা যখন পুঁথিটি খুলে বসে, সেই মুহূর্তে সমস্ত বাতি নিভে যায় এবং এক অন্ধকার ছায়া ছুঁয়ে যায় তাদের শরীর। সেই মুহূর্তে পুঁথির পাতার উপর লেখা হয়—“প্রহর প্রথমের শুরু। দেহ নয়, মন জাগাও। সে আসছে।” হঠাৎই পেছনের দেয়াল থেকে বেরিয়ে আসে ভৃগুরাম—তার চোখে অগ্নিদৃষ্টি, কণ্ঠে ঝাঁঝ—“তোরা বুঝতে পারছিস না, যাকে বাঁচাতে চাইছিস, সে নিজেই মৃত্যু।” গায়ত্রী তাঁর দিকে পা বাড়াতেই, হঠাৎ একটি শক্তি উভয়কে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ঘরের দুই প্রান্তে। সেই মুহূর্তে ঘরের মেঝে ফেটে উঠে ওঠে ধোঁয়া, আর তার মাঝে দেখা যায় এক নারীস্বর—মাথায় জটা, চোখে অগ্নি, কিন্তু কণ্ঠে আকুতি—“আমি সাধিকা ছিলাম… আমাকে বাঁধা হয়েছিল বিশ্বাসঘাতে…” অন্ধকার গিলে ফেলে সেই মূর্তি, কিন্তু তার শব্দ রয়ে যায় বাতাসে। সায়ন্তন কাঁপতে কাঁপতে বলে ওঠে—“ও নিছক আত্মা নয়, ও চাইছে ক্ষমা। তবে কিসের জন্য?” গায়ত্রী মৃদুস্বরে উত্তর দেন—“এই প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত তুই শান্তি পাবি না, আর ও থামবে না।”
৩
পরদিন সকালে কামাক্ষ্যার পাহাড়চূড়া জুড়ে ঘন কুয়াশা। পাখির ডাক পর্যন্ত থমকে গেছে—কোনো অদৃশ্য ভয় যেন প্রকৃতিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। সায়ন্তন আর গায়ত্রী আগের রাতে যা দেখেছিল, তা যেন বাস্তব এবং স্বপ্নের সীমানায় দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু একটা জিনিস স্পষ্ট—পুঁথির ভেতরের সেই সাধিকা সত্যিই বেঁচে আছেন, এক অলৌকিক অস্তিত্বে, সময়ের বাইরে, অথচ সময়কে ছুঁয়ে। গায়ত্রী এবার পত্রালাপ শুরু করে তার অসমীয় পুরোনো তান্ত্রিক পরিবারে থাকা এক বৃদ্ধার সঙ্গে—তাঁর নাম পুষ্পবালা দেউরী, যিনি জীবিত থাকলেও কথা বলেন স্বপ্নে। সেই রাতে সায়ন্তনের ঘুম ভেঙে যায় ঠিক ৩:১১ মিনিটে। সে জানালার কাচে দেখে নিজের প্রতিবিম্ব—কিন্তু মুখটা তার নিজের নয়। যেন চোখদুটো অন্য কারো, অতীত থেকে দেখা দিচ্ছে। বইয়ের তাক থেকে সেই মুহূর্তে একটি পুঁথি নিজে নিজেই পড়ে যায়—আর ভিতরে গোঁজা কাগজে লেখা—“অধিরার দিনলিপি, ১৮৯৯”। এই নামটি সেই রক্ষাকর্তার, যিনি একশ বছরের বেশি আগে নিখোঁজ হয়েছিলেন। সায়ন্তন আর গায়ত্রী মিলে পড়তে শুরু করে সেই হাতের লেখা, যেটা এখনো অক্ষত। অধিরা লিখেছেন, তিনি এই পুঁথির রক্ষাকর্তা, কিন্তু পুঁথির ভিতরেই লুকানো আছে এক আশীর্বাদপ্রাপ্ত সাধিকা—বিরজা—যাকে দেবী স্বয়ং আশীর্বাদ করেছিলেন, অথচ প্রতারিত হয়ে বন্দী হন এক তান্ত্রিক যজ্ঞে।
বিরজার কাহিনি ধীরে ধীরে খোলে। তিনি ছিলেন কামরূপের এক ব্রাহ্মণ কন্যা, যার ভিতরে জন্ম থেকেই ছিল কিছু অলৌকিক শক্তি—স্বপ্নের মাধ্যমে দূরদৃষ্টি, মন্ত্রে বস্তু নাড়ানোর ক্ষমতা, এবং দেবীমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে অবচেতন ভাবনা প্রকাশ করার ক্ষমতা। সমাজ তাঁকে ‘পবিত্র’ ভাবলেও, তন্ত্রপন্থী গোষ্ঠীরা তাঁকে ‘উপকরণ’ ভেবেছিল। এক নিষিদ্ধ যজ্ঞের সময় তাঁকে বলি দেওয়া হয়, কিন্তু তাঁর আত্মা বন্দী হয় কালতান্ত্র পুঁথির এক ‘অন্তর্বন্ধনে’। সেই শক্তি কখনো জাগ্রত হলে সৃষ্টি ও ধ্বংস দুই-ই সম্ভব—এই কথাই অধিরা লিখেছেন তার দিনলিপিতে। গায়ত্রী এই পড়ে বলে ওঠে—“তাহলে পুঁথির ভিতরে আসলে ‘আত্মা’ নয়, এক অসমাপ্ত সাধনা।” কিন্তু প্রশ্ন জাগে—কে বা কারা এখন পুঁথির জাগরণ চায়? আর কেন? এই সময়ই গ্রন্থাগারে আগমন ঘটে এক প্রৌঢ় মহিলার, যিনি নিজের পরিচয় দেন—শ্রেয়সী ভট্টাচার্য, একজন ইতিহাসবিদ, যিনি তান্ত্রিক সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি দাবি করেন, পুঁথির আসল অংশটি এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি—যেটা সম্ভবত মাটির নিচে এক প্রাচীন ‘তন্ত্রগর্ভে’ রক্ষিত। এবং সেখানেই লুকিয়ে আছে ‘সীলচিহ্ন’—যা একবার সরানো হলে আত্মা মুক্ত হবে।
রাত্রি নামতেই সায়ন্তনের ঘুমের মধ্যে আবার ফিরে আসে বিরজার কণ্ঠস্বর—এবার সে কাঁদছে না, বরং হুঁশিয়ারি দিচ্ছে। “তারা আসছে, সায়ন্তন। আমি মুক্তি চাইনি, কিন্তু আমাকে টেনে আনা হচ্ছে। কেউ পুঁথি ভাঙতে চাইছে।” সেই একই সময় গায়ত্রী খেয়াল করে, পুঁথির পাতাগুলি কিছুটা পোড়া, আর এক পাতায় অদ্ভুত লালচে দাগ—যা রক্তের মতন। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, রাতেই পুরোনো গ্রন্থাগারের নীচে থাকা সেই সিঁড়ি থেকে আরও নিচে যাবে। সেই রাতে তারা মাটির নিচে আরও এক দরজার সন্ধান পায়—মাটি দিয়ে ঢাকা, ধাতব সীলমোহরে খচিত লেখা: “ইহা খোলিলে, কাল প্রবেশ করিবে।” ভৃগুরাম আবার হাজির হন, এবার তাঁর শরীর রক্তাক্ত, কিন্তু চোখে এক অপার্থিব শান্তি। তিনি বলেন—“তোমাদের কেউ একজন হবে রক্ষাকর্তা, আর অন্যজন হবে সাক্ষী।” সেই মুহূর্তে চারদিক আলোয় ভরে যায়, আর বাতাসে ভেসে আসে বিরজার গলা—“জাগরণ শুরুর পূর্বে সত্য জানতে হবে, নয়তো তা হবে ধ্বংসের উৎস।” দরজার ওপাশে ঘূর্ণির মত শব্দ, আর গল্প এখানে পৌঁছায় এক মোড়ে—আত্মা কি আদৌ মুক্তি চায়, নাকি পুঁথিই চায় নতুন প্রহর রচনা করতে?
৪
দরজাটি ছিল লোহার, অথচ তাতে স্পর্শ করতেই মাটি ও পাথরের শীতলতায় শরীরটা কেঁপে ওঠে সায়ন্তনের। তার ডান পাশে দাঁড়িয়ে গায়ত্রী মন্ত্রোচ্চারণে তামার ঘট আর রুদ্রাক্ষের মালা ছুঁইয়ে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে চারপাশের বাতাস, যা ভারী হয়ে উঠছে প্রতিটি নিঃশ্বাসে। কিন্তু সেই দরজাটি খুলতে গেলে কেবল শারীরিক শক্তি নয়, কিছু ‘আনুমতি’ লাগে—এই কথা তাদের জানিয়ে গেল ভৃগুরাম। তিনি বলেন, “যে রক্তে পুঁথির সীল আঁকা, তাকে না চেনা পর্যন্ত দরজা খুলবে না।” সেই মুহূর্তে দরজার ধাতব গায়ে নিজেদের ছায়া দেখতে পায় সায়ন্তন—কিন্তু একটি ছায়া বেশি। কে যেন দাঁড়িয়ে আছে পিছনে। তারা দ্রুত পেছন ফিরে তাকায়—কিন্তু কেউ নেই। আবার দরজার গায়ে চোখ ফেলতেই দেখা যায় সেই বাড়তি ছায়াটি ধীরে ধীরে নিজের চেহারা নিচ্ছে—এক তরুণী, জটা চুল, কপালে চন্দনছাপ, মুখে বিষাদের রেখা। গায়ত্রী কেঁপে উঠলেও সায়ন্তন জিজ্ঞেস করে—“তুমি বিরজা?” মূর্তিটি মাথা নাড়ে না, কিছু বলে না—তবে তার চোখ দুটি কাঁদে। ঠিক তখনই গায়ত্রী এক আশ্চর্য কথা বলে—”এই দরজার ওপাশে প্রবেশ করার আগে আমাদের দেখতে হবে সত্যিটা—কে প্রথম বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল।”
রাত বাড়তেই তারা ফিরে আসে গ্রন্থাগারের পাঠকক্ষের এক পুরোনো কাঠের টেবিলে, যেখানে ‘অধিরার দিনলিপি’র শেষ পৃষ্ঠাগুলি পড়তে শুরু করে। সেখানে প্রথমবার সায়ন্তন ও গায়ত্রী জানতে পারে, যে সাধিকা বিরজা আসলে কামরূপের এক শক্তিশালী তান্ত্রিক পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন। সেই পরিবার, যাদের তত্ত্বে নারীশক্তিকে বলির উপাদান ভাবা হতো, বিরজার উদ্ভাসিত শক্তিতে আতঙ্কিত হয়ে যায়। তখনই তারা তাকে ‘দেবীর উৎসর্গ’ বলে এক তান্ত্রিক যজ্ঞের কেন্দ্রে বসিয়ে আত্মত্যাগে বাধ্য করে। কিন্তু বিরজা আত্মত্যাগ না করে এক প্রাচীন মন্ত্র উচ্চারণ করেন—যা তাকে ‘মৃত্যুর পরবর্তী স্তরে’ পৌঁছে দেয়, যেখানে সে চেতনা হারায় না, বরং চিরচেতন অবস্থায় থেকে যান কালতান্ত্র পুঁথির গভীরে। গায়ত্রী এও বলে, এই পুঁথিটি একটি নথি নয়, এক জীবন্ত মন্দির—যেখানে শুধু লেখাগুলি নয়, আত্মাও আবদ্ধ। সায়ন্তনের ঘাড়ে তখন তীব্র জ্বালা—আর গায়ত্রী তার পেছনে এক পুরোনো চিহ্ন দেখে—তিনবিন্দু যুক্ত বৃত্ত, যা রক্ষাকর্তার জন্মছাপ। অর্থাৎ, সায়ন্তন ছিল পূর্বনির্ধারিত উত্তরসূরি। ভৃগুরাম জানতেন, কিন্তু অপেক্ষায় ছিলেন যতক্ষণ না পুঁথি নিজে তাকে ‘চিহ্নিত’ করে।
সেই রাতে তারা একসঙ্গে আবার নিচের দরজার সামনে যায়। ভৃগুরাম বলেন—”এইবার যদি প্রবেশ করো, ফেরার পথ থাকবে না। পুঁথি তোমাদের স্বপ্নেও নিয়ে যাবে নিজস্ব ‘রূপরহস্যে’।” সায়ন্তন যখন দরজায় হাত রাখে, চারপাশের বাতাস দাঁড়িয়ে যায়। ঘূর্ণি উঠে, রুদ্রাক্ষ নিজে নিজেই চঞ্চল হয়ে ওঠে। দরজা খুলতেই তারা নামে আরেক ধাপে, যেখানে চারিদিকে তামার পাত্র, পোড়া সুরা, জপের মালা আর পাথরের গায়ে খোদাই করা এক নাম—“বিরজা আত্মা-সাধনা কক্ষ”। সেই ঘরের মাঝখানে পড়ে আছে এক যজ্ঞবেদি, আর তার কেন্দ্রস্থলে এক শূন্য পাত্র—যেখানে আগে রক্ত ছিল। গায়ত্রী সামনে এগিয়ে যায়, আর বলে—“এইখানেই তাঁকে বলি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু আত্মা ছিন্ন না হয়ে বন্ধ হয়ে যায় এই স্থানেই।” হঠাৎ সেই ঘর জ্বলে ওঠে এক তীব্র আলোয়, এবং মাঝখানে আবির্ভূত হয় বিরজা—কিন্তু এবার তিনি কাঁদছেন না, বরং বলছেন—“এত দেরি করলে কেন? আমি মুক্তি চাই না, আমি চাই তারা জানুক আমি কীভাবে মরিনি, আমি কিভাবে বেঁচে আছি।” গায়ত্রী ফিসফিস করে—“বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল তোমাকে, আত্মার শুদ্ধতায় বন্দি করে।” আর ঠিক তখনই এক কণ্ঠস্বর—ভিন্ন এক পুরুষ কণ্ঠ—গর্জে ওঠে ঘরের কোনা থেকে—“মিথ্যা! ও ছিল অস্ত্র, আর আজও আমি ওকে ব্যবহার করব!” সায়ন্তন আর গায়ত্রী পিছনে তাকায়—সেখানে দাঁড়িয়ে এক অপরিচিত পুরুষ, চোখ দুটো লাল, আর কপালে আঁকা সেই একই তিনবিন্দু চিহ্ন—কিন্তু এইবার তা পুঁথির রক্ষার জন্য নয়, বরং পুঁথি ভাঙার জন্য।
৫
সেই পুরুষ, যিনি নিজেকে ‘অগ্নিবজ্র’ বলে পরিচয় দেয়, তার চোখের তীব্রতা যেন অন্ধকারে আগুন ধরিয়ে দেয়। তার মাথা পর্যন্ত ঢাকা গেরুয়া পোশাক, কণ্ঠে কর্কশ সুরে উচ্চারিত হয় প্রাচীন তান্ত্রিক মন্ত্র—যার প্রতিধ্বনি মুহূর্তেই প্রতিফলিত হয় চারপাশের দেয়ালে। গায়ত্রী প্রথমে আঁচ করতে পারেননি, তবে সায়ন্তনের মনে পড়ে যায় অধিরার লেখা কিছু ভগ্ন বাক্য—“একজন ‘প্রতিকারক’ জন্মায় রক্ষার বিপরীতে, যার কাজ হবে সীল ভাঙা, আত্মাকে জাগানো, এবং পুঁথির ব্যাকরণ মুছে ফেলা। সে-ও রক্তে রক্ষাকর্তা, কিন্তু হৃদয়ে বিভ্রান্ত।” অগ্নিবজ্র সেই বিভ্রান্ত উত্তরসূরি, যাকে এক গোপন সংগঠন—‘কালদ্রষ্টা সংঘ’—বাল্যকাল থেকে গড়ে তুলেছে শুধুমাত্র একটি উদ্দেশ্যে: বিরজাকে মুক্ত করা নয়, তাকে ব্যবহার করে পুনর্জাগৃত করতে এক অসম্পূর্ণ তান্ত্রিক শক্তিকে। সে বলে—“তোমরা ওকে দয়া করছো, অথচ জানো না, এই আত্মাই পৃথিবী পাল্টাতে পারে। ওর শক্তিতে জগতের নিয়ম রচনা সম্ভব।” ভৃগুরাম তখনই সামনে এসে বলেন—“পৃথিবী যদি রক্তে লেখা হয়, তবে সে গ্রন্থ শয়তানের, দেবীর নয়।” কিন্তু অগ্নিবজ্র ইতিমধ্যেই যজ্ঞবেদির কেন্দ্রের শূন্য পাত্রে রক্ত ছুঁড়ে দেয়—নিজের আঙুল কেটে। মাটিতে যেন চিৎকার ওঠে, আর পুঁথির অক্ষরগুলো হঠাৎ করে নিজে নিজেই পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে। বাতাস থেমে যায়, আর বিরজার ছায়া, কুয়াশার মধ্যে থেকে দৃশ্যমান হয়—এবার সে শক্তি এবং ক্রোধের মূর্তি।
সায়ন্তনের হাত থেকে পড়ে যায় পুঁথির একটি খণ্ড, যেটা কেউ আগে খোলেনি। খণ্ডটি খুলতেই একটি ছোট্ট চিত্র অঙ্কিত পৃষ্ঠা বের হয়—সেখানে দেখা যায় একটি চক্রের মাঝখানে একজন নারী—তার মাথার চারপাশে আগুনের ফলা, চোখে অন্ধকারের রেখা। গায়ত্রী সেই চিত্র দেখে কাঁপতে কাঁপতে বলে—“এটা বিরজা নয়, এটা সেই রূপ যা তন্ত্র পূর্ণ হলে ধারণ করেন। এই রূপ যদি বাস্তবে আসে, কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণে থাকবে না।” অগ্নিবজ্র তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে—“তোমরা ভাবো তন্ত্র মানেই ধ্বংস? আমি বলছি, তন্ত্র মানেই সৃষ্টির বিকল্প ব্যাকরণ!” সেই মুহূর্তে বিরজার আত্মা বলে ওঠে—“আমাকে কেউ মুক্তি দাওনি, আমি নিজেই বাঁচতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আজ আবার… আমায় অস্ত্র বানাতে চাচ্ছো!” ঘরটা কাঁপে, এবং আগুন জ্বলে ওঠে যজ্ঞবেদির চার কোণে। সায়ন্তন ভীত হলেও সামনে এগিয়ে এসে বলে—“তুমি চাইলে আমি রক্ষাকর্তার ছাপ ফিরিয়ে নেব, যদি তুমি নিজের ইচ্ছায় মুক্তি চাও।” বিরজার আত্মা তখন বলে—“তুমি আমায় শুনছো, এটাই আমাকে শান্তি দেয়। কিন্তু তারা শুনবে না—তারা চায় আমাকে ব্যবহার করতে।”
ঘরের ভেতরে চতুর্মাত্রিক চাপ তৈরি হতে থাকে—দেয়াল থেকে রক্তরেখা গড়িয়ে পড়ে, বাতাস ঘন হয়ে যায়, শব্দ থেমে যায়, শুধু মন্ত্রের আওয়াজ বেড়ে চলে। তখনই গায়ত্রী একটা সঙ্কেত বোঝে—যজ্ঞবেদির ঠিক নিচে আছে মূল ‘আত্মসংবরণ’-এর চিহ্ন, যেটা স্পর্শ করলে আত্মা আবার নিরব হয়ে যাবে, কিন্তু সেই কাজ করতে হলে কাউকে আত্মার ভার বহন করতে হবে। সায়ন্তনের চোখে তখন এক বিশ্বাস, এক আত্মত্যাগের ইচ্ছা। সে যজ্ঞবেদির নিচে হাত রাখতেই আগুন লাফিয়ে ওঠে, বিরজা চিৎকার করে বলে—“না! আমি চাইনি তুই পোড়িস! আমি চেয়েছিলাম শুধু কেউ আমায় বুঝুক!” কিন্তু ঠিক তখনই ভৃগুরাম তার রুদ্রাক্ষ মালাটি ছুড়ে দিয়ে অগ্নিবজ্রের কপালে আঘাত করে। অগ্নিবজ্র ধপ করে পড়ে যায়, আর পুঁথির পৃষ্ঠা শেষবারের মত উল্টে যায়। ঘরের আলো নিভে যায়, শুধু মাঝখানে বিরজার ছায়া দাঁড়িয়ে থাকে—এক অদ্ভুত শান্তি নিয়ে, যেন সে আর কাঁদছে না। গায়ত্রী ধীরে ধীরে বলে—“তাকে শোনানোই ছিল মূল মুক্তি। তন্ত্রের যুদ্ধ হয় শ্রুতির ভিতর, হাতিয়ারের ভিতর নয়।” সেই মুহূর্তে পুঁথির খোলা পাতায় ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে একটি বাক্য—“তন্ত্র নিষ্পাপ, যারা ব্যবহারে পাপ রচনা করে, তারাই শাস্তিযোগ্য।”
৬
সেদিন রাতটা ছিল নির্বাক, যেন পুঁথি নিজেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে দীর্ঘ অতীতের ভার বইতে বইতে। সায়ন্তন ঘুমিয়ে পড়ে না, বরং বসে থাকে যজ্ঞবেদির পাশে, যেখানে কিছুক্ষণ আগেই এক আত্মার গর্জন, অনুরোধ ও অভিশাপ একসঙ্গে মিশেছিল বাতাসে। গায়ত্রীও নিশ্চুপ, তার চোখে প্রশ্ন: যদি বিরজা মুক্ত হয়, তবে পুঁথির পরিণতি কী? আত্মা যদি সত্য হয়, তবে ইতিহাস ভুল ছিল—এবং ইতিহাস যদি ভুল হয়, তবে আমরা যারা তাতে বিশ্বাস করি, তারা কারা? ভৃগুরাম মাটিতে বসে প্রাচীন এক মানচিত্র খোলে—পাথরের ওপরে আঁকা চক্র, যা নির্দেশ করে পুঁথির জন্মস্থান। তিনি বলেন, “এই গ্রন্থ কামাক্ষ্যার নয়, এটি কামরূপ থেকে আগত, যেখানে প্রথম নারীতন্ত্রের সাধনাকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল পুরুষতান্ত্রিক প্রহরীর দ্বারা। বিরজা ছিল সেই সাধনার শেষ ধারক।” গায়ত্রী চমকে যায়—কারণ তার পরিবারও ছিল সেই কামরূপের এক শাখার অংশ। তার অর্থ দাঁড়ায়, সে নিজেও ইতিহাসের ভেতর বন্দি ছিল—এবং তার উপস্থিতি এখানে পূর্বনির্ধারিত ছিল না, বরং পুঁথি নিজে তাকে ডেকেছে। এই মুহূর্তে, ভৃগুরাম তাদের সামনে এক কবচ তুলে ধরেন—একটি ধাতব গোলক, যার ভিতরে এক শব্দ গুনগুন করে: “অন্তঃসত্ত্ব আত্মা”।
পৃথিবীর যেকোনো আত্মিক রেকর্ডই সময়ের বাইরে থেকে যায়—এমনই ছিল ‘কালতান্ত্র’—যেখানে শব্দ, মন্ত্র ও স্মৃতি একসঙ্গে বাঁধা। গায়ত্রী ধীরে ধীরে কবচটির কেন্দ্রে হাত রাখে, আর তখনই তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক বিস্মৃত অধ্যায়: একটি বিশাল যজ্ঞমঞ্চ, কেন্দ্রে বিরজা বসে আছে, তার চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে সাতজন তান্ত্রিক। তাদের একজন, মুখ ঢাকা, হাতে রক্তমাখা দণ্ড—সে-ই সেই “প্রথম বিশ্বাসঘাতক”, যাকে অধিরা কখনো চিহ্নিত করতে পারেননি। গায়ত্রী বুঝতে পারে, এই স্মৃতি শুধুই অতীত নয়—এটা এখনো চলছে। আর সেই বিশ্বাসঘাতক, যে বিরজাকে আত্মারূপে বন্দি করেছিল, তার উত্তরাধিকার এখনও জীবিত—এবং তার পরিচয় সায়ন্তনের পরিবারেই নিহিত। এই কথাটি প্রকাশের পর সায়ন্তন যেন অবশ হয়ে যায়। ভৃগুরাম বলেন, “তুমি রক্ষাকর্তা, ঠিকই—but একজন রক্ষাকর্তার পূর্বপুরুষই সেই সাধিকাকে ব্যবহার করেছিল। অতএব, মুক্তির জন্য তোমাকেই দিতে হবে প্রায়শ্চিত্ত।” এ যেন এক রক্তচিহ্নের পুনর্জন্ম—শরীর নয়, হৃদয়ের ভেতরে জ্বলতে থাকা আগুন, যা সত্য বুঝে নিতে চায়। সায়ন্তন তখন সিদ্ধান্ত নেয়—এই পুঁথি শুধু রক্ষা নয়, শুদ্ধিকরণ-এর দাবি করে।
রাত গভীর হলে তারা আবার পুঁথিটি নিয়ে আসে সেই ‘তন্ত্রগর্ভ’ ঘরে। কবচটি পুঁথির ওপরে রাখা হলে পাতাগুলি একে একে খুলতে থাকে, আর আত্মার ভাষায় লেখা হয়—“তাঁরা আমায় থামাতে চেয়েছিলেন, আমি থেমে গেছি। এবার কি তাঁরা শুনবেন আমার কথা?” গায়ত্রী হাত রাখে পাতায়—আর শব্দ ভেসে ওঠে: “আমি চাই এই ব্যাকরণ ভেঙে যাক, আমার কথা শুধু শুনে যাক। তবেই আমি যাব।” ভৃগুরাম বলে—“তন্ত্র কখনো ক্ষমা চায় না, কিন্তু আত্মা চায়। তাকে ক্ষমা দিলে, সে রক্ষা হয়।” তখনই সায়ন্তন তার নিজের রক্ত ছুঁইয়ে দেয় শেষ পাতায়, আর বলে—“তোমার জন্য আমি নয়, আমার পূর্বপুরুষরা অপরাধী ছিল। আমি কেবল শ্রোতা, বিচারক নই।” সেই মুহূর্তে একটি আলো উঠে আসে পাতার মধ্য থেকে, বিরজার মুখ ফুটে ওঠে চৈতন্যরূপে। তিনি বলেন—“আমার আর কিছু প্রয়োজন নেই। আমি শুধু চাই, ভবিষ্যতের কেউ যেন পেছনে বন্ধ করে না রাখে আর এক নারীকে, এক মন্ত্রকে, এক কণ্ঠকে।” সেই সঙ্গে পুঁথির শেষ পৃষ্ঠা বন্ধ হয়—নিজে থেকে। এবং তার চারপাশে ধ্বনি ওঠে—এক পবিত্র মন্ত্র, যা আগে ছিল না: “বিমুক্তা বিরজা, বিবর্তনে মন্ত্রা।”
৭
পুঁথির শেষ পাতাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও কামাক্ষ্যার পাহাড় যেন স্তব্ধ থাকে আরও কয়েক ঘণ্টা। সেই নীরবতা কেবল বাইরের ছিল না, সায়ন্তনের ভিতরেও যেন এক শূন্যতা, এক গভীর নিঃশ্বাস তৈরি হয়। বিরজা চলে গেছে—অথচ কোথাও সে রয়ে গেছে। তার কথা, তার রাগ, তার অভিমান—সব কিছু মিশে গেছে পুঁথির ভাঁজে, আবার ছড়িয়ে পড়েছে সেই তন্ত্রগর্ভ ঘরের দেয়ালজুড়ে। গায়ত্রী মৃদুস্বরে বলে, “বিরজার প্রস্থান আসলে আত্মার নয়, ইতিহাসের সরে যাওয়া। আমরা এতদিন যা পড়েছি, তা শুধু পুরুষের লেখা। আজ, আমরা একজন স্তব্ধ নারীকে শুনেছি।” ভৃগুরাম ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ান—চোখে এক ধরনের শান্তি, যেন বহু বছরের তপস্যার ফল পেয়েছেন। তিনি বলেন, “কালতান্ত্র কখনোই কেবল পুঁথি ছিল না। এটা ছিল আত্মার পাঠশালা। যারা ওকে পড়ে, তারা আসলে নিজেদের পড়ে।” সেই রাতে গ্রন্থাগারের ভিতর বাতাস ছিল শান্ত, কিন্তু বাইরের আকাশজুড়ে দেখা যায় এক উজ্জ্বল ধূমকেতু—যা নাকি ১০০০ বছর আগে দেখা গিয়েছিল ঠিক বিরজার বলিদানের রাতেই। গায়ত্রী ফিসফিস করে বলে, “সম্ভবত এটাই চিহ্ন, যে তার আত্মা এবার সত্যিকারের নিঃশ্বাস নিতে পারছে।” সায়ন্তনের গলা জড়িয়ে আসে। সে কিছু বলে না, কেবল পুঁথিটিকে আবার চামড়ার খাপে ঢুকিয়ে রাখে, এইবার নিজে থেকে নয়, সম্মানের হাতছোঁয়ায়।
পরের দিন সকালে গ্রন্থাগারে আগত লোকেরা হঠাৎ লক্ষ্য করেন—পুরনো দেয়ালের একটি খাঁজ থেকে আলতো আলো পড়ছে। সেখানে লেখা—“যা রচিত হয়েছিল রক্তে, আজ তা মুছে গেল শ্রুতিতে।” গায়ত্রী এবং সায়ন্তন পরস্পরের চোখে তাকায়, যেন বুঝে যায় তাদের কাজ এখানেই শেষ নয়—এখান থেকে শুরু হবে নতুন অধ্যায়, যেখানে ইতিহাস আবার লেখা হবে, এইবার ভিন্ন কালি দিয়ে। তারা সিদ্ধান্ত নেয় ‘তান্ত্রচক্র পাঠাগার’ এখন শুধুই পুঁথি সংরক্ষণের জায়গা নয়, বরং সত্য ইতিহাসের কেন্দ্র, যেখানে নারীর কথা, মন্ত্রের আদি উৎস, আত্মার ব্যথাও স্থান পাবে। গায়ত্রী তার গবেষণার থিসিসে প্রথমবার লিখে ফেলেন—“প্রাচীন পুঁথিগুলি কেবল ধর্ম বা তন্ত্র নয়, ওরা একেকটা আত্মার নিঃশ্বাস। আমরা যদি শ্রবণ না করি, তবে একদিন আবার তারা ফিরে আসবে, শুনতে বাধ্য করাতে।” ভৃগুরাম তারপর হঠাৎ চলে যান—কোথায়, কেউ জানে না। শুধু একটি চিঠি রেখে যান—“রক্ষাকর্তা হিসেবে তুই সফল হস। তবে এই ভূমি চুপ করে থাকে না, কে কখন জেগে ওঠে—সেটাই তোর পরবর্তী প্রহর।” চিঠির নিচে তার হাতের লেখা একটি মন্ত্র—যেটা আজও কোনো তান্ত্রিক পাঠ্যপুস্তকে লেখা নেই।
রাত গভীর হলে, সায়ন্তন একা বসে থাকে পুঁথির সামনে, আলো-আঁধারিতে। পেছনে গায়ত্রী এসে বসে। দু’জনেই জানে, বিরজার মুক্তির পরেও এখনো অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। যেমন—কে ছিল সেই সাত তান্ত্রিক? কারা লিখেছিল কালতান্ত্রের মূল সংস্করণ? আর সেই অগ্নিবজ্র কোথায়? সে কি মারা গেছে, না কি আত্মা নিয়ে মিশে গেছে পুঁথির অন্ধকার ভাঁজে? হঠাৎ সায়ন্তনের কানে ভেসে আসে এক অনুচ্চারিত শব্দ—একদম মৃদু—যা কেবল সে শুনতে পায়, আর কেউ নয়। সেই শব্দ বলে—“রক্ষাকর্তা মাত্র শোনে না, সে শুনিয়ে দেয়। এইবার তুই লিখ।” সেই মুহূর্তে তার চোখ চলে যায় খোলা নোটবুকের পাতায়, যেখানে কোনো কলম ছুঁয়েই না, অথচ আঁকা হয়ে যায় প্রথম অক্ষর—”বিরজার কথা”। সে বুঝে যায়, পুঁথির পরের অধ্যায় এখন তার হাতেই লেখা হবে—কিন্তু এবার ‘কাল’-এর দ্বারা নয়, আলো-তান্ত্রের ভিতর দিয়ে।
৮
শীতল জানলার ধারে বসে সায়ন্তন এখনো সেই নোটবুকের প্রথম পাতার দিকে তাকিয়ে থাকে—যেখানে অদৃশ্য কালি দিয়ে লেখা হয়েছে “বিরজার কথা”। সে জানে, এটা কেবল একটি আত্মার শেষ উচ্চারণ নয়, বরং এক অসমাপ্ত ইতিহাসের নতুন সূচনা। গায়ত্রী চুপচাপ তার পাশে বসে, যেন সেই নিরবতা দিয়েই সায়ন্তনের ভিতরের দোলন বুঝতে চায়। তারা দু’জনেই অনুভব করে, তাদের জীবনে ঘটেছে এমন কিছু, যা ব্যাখ্যা করা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায় দেহের প্রতিটি শিরায়। এমন অভিজ্ঞতা যা লিখতে গেলেই শব্দ ছোট মনে হয়, অথচ না লিখে থাকলেও ভিতরে একটা শূন্যতা গেঁথে যায়। সেই মুহূর্তে, কামাক্ষ্যার শিখরে আবার ভেসে ওঠে সেই ধূমকেতু—শুধু আলোর রেখা নয়, এক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।
সেই রাতে সায়ন্তন প্রথমবার নিজের পূর্বপুরুষদের নাম ও কাজ নিয়ে পড়তে শুরু করে—যেখানে এক পৃষ্ঠায় লেখা ছিল এক গোপন নাম: “ভাস্করানন্দ”—যিনি ছিলেন সেই সাত তান্ত্রিকের অন্যতম, যাঁরা বিরজাকে আত্মারূপে বন্দি করেছিলেন। তারই উত্তরাধিকার হিসাবে সায়ন্তন আজ আত্মদহন পেরিয়ে পরিশুদ্ধির রাস্তায় হাঁটছে। ভাস্করানন্দের দোষ তার নয়—কিন্তু ইতিহাসের ঋণ শুধু নাম নয়, কাজেও ফেরত দিতে হয়। গায়ত্রী এক নতুন প্রকল্প শুরু করেন—”তন্ত্র ও নারীকথা: একটি শোনার ইতিহাস”—যেখানে পুঁথি, গান, মুখে মুখে প্রচলিত দেবী-কাহিনি, এবং সাধিকা বিরজার মতো নিঃশব্দ বিপ্লবীদের নিয়ে রচনা হবে এক মুক্ত পাঠ্যগ্রন্থ। পুঁথির গোপন কক্ষে তৈরি করা হয় একটি সঙ্গৃহালয়, যেখানে রাখা হয় কালতান্ত্র পুঁথির অনুলিপি—কিন্তু মূল পুঁথি আর কারো চোখে পড়ে না। কারণ সায়ন্তন বুঝে যায়—পুঁথিকে রক্ষা করার আসল অর্থ, তার ব্যবহার নয়, বরং তার স্তব্ধতা বজায় রাখা।
শেষ অধ্যায়ে আমরা দেখি, বছরখানেক কেটে গেছে। গায়ত্রী এখন পুরাতত্ত্ব বিভাগে পাঠদান করেন, আর সায়ন্তন এখন সেই গ্রন্থাগারের তত্ত্বাবধায়ক নয়—একজন শ্রোতা-রূপে, যিনি মানুষের কথাগুলো, তাদের ভুলে যাওয়া আত্মকথনগুলো সংরক্ষণ করেন। কিন্তু এক রাতে, অমাবস্যার বাতাসে, সে যখন পাথরের ছাদে বসে থাকে, তার হাতে ধরা সেই পুরোনো কবচটি হঠাৎ জ্বলে ওঠে এক অদ্ভুত সবুজ আলোয়। সেখানে একটা কণ্ঠস্বর—পরিচিত, অথচ ভিন্ন—ফিসফিস করে বলে,
“তুই লিখলি… এখন কে শুনবে তোকে?”
সায়ন্তন মাথা নিচু করে, জবাব দেয়—
“যারা নিজের আত্মার কাহিনি হারিয়ে ফেলেছে, তারা। আমি লিখব তাদের জন্য, যেন তারা জানে, আত্মা কেবল মৃত্যুর পরে নয়, বেঁচে থাকাকালেও বন্দি হতে পারে।”
ঠিক তখনই পেছনের দেয়ালে নিজে থেকে খুলে যায় এক পাতিনির্মিত দরজা, আর ভিতরে দেখা যায় অসংখ্য পাণ্ডুলিপি—অলিখিত, অপঠিত, অব্যক্ত। কালতান্ত্রের ঠিক পরে শুরু হয় নতুন এক নাম—
“অমৃততন্ত্র”—যেখানে আত্মা নয়, ‘শ্রবণ’ হবে মন্ত্র।
সমাপ্ত