Bangla - ভূতের গল্প

কাদার মানুষ

Spread the love

পল্লব সেনগুপ্ত


বিকেলের আলো ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে হয়ে আসছিল, যখন অনন্যা ঘোষ ছোট ট্রলারে করে নদী পার হয়ে পৌঁছাল সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। আশপাশে কেবলমাত্র কাঁকড়াভরা কাদা, উঁচু বাঁধ, এবং জলপথের ওপর একধরনের ঘন স্তব্ধতা—যেটা শহরের মানুষদের অচেনা। অনন্যা কয়েক মাসের জন্য এসেছে এক NGO-র প্রতিনিধি হিসেবে, উদ্দেশ্য—মহিলা ও শিশুদের স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাবিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। তাঁর হাতে একটা পুরনো নোটবুক, যেখানে কাজের পরিকল্পনা লিখে এসেছে, কিন্তু গ্রামের নিস্তব্ধতা আর হাওয়ার গন্ধ যেন ওই সব কাগজের যুক্তির চেয়েও বেশি বাস্তব। গ্রামের মানুষজন তাকে সম্মান দেখিয়েই স্বাগত জানাল, কিন্তু তাদের চোখে একটা নিরুত্তাপ দূরত্ব ছিল—যেমন কেউ জানে অতিথি বেশিদিন থাকবে না। সে উঠল স্থানীয় স্কুলঘরের পাশে বানানো একটুখানি কাঠের কুটিরে, যেটা NGO-র তরফে মেরামত করে দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যায়, যখন গ্রামের আলো নিভে এলো কুয়াশার মত, একটা মৃদু আওয়াজ শোনা গেল দূর থেকে—ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের গলা। তারা ছড়া কাটছে—”কাদা কাদা কালো ভাই, খেলতে যাস না, ডাক পড়লেই নিয়ে যাবে, ছায়া নাম ধরে বলবে—তুই!” অনন্যা একটু হাসল, গ্রামের ছেলেমেয়েরা হয়তো রাতের আগে খেলতে না যাওয়ার জন্য এমন ছড়া বানিয়েছে। শহরে বড় হওয়া মেয়েটির কাছে এসব কুসংস্কারই মনে হল।

পরদিন সকালেই কাজ শুরু করল অনন্যা। সে গ্রামে হাঁটল, বাড়ি বাড়ি গিয়ে কথা বলল—মহিলাদের সঙ্গে, বাচ্চাদের সঙ্গে। একটা ছোট মেয়ের দিকে তার নজর আটকে গেল—রুনু, বছর আটেকের, চোখদুটো অদ্ভুতভাবে বড় আর গভীর। সে চুপচাপ বসে ছিল কাদার ধারে একটা গাছের তলায়। অনন্যা কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এইখানে খেলছ কেন?” মেয়েটি ফিসফিস করে বলল, “আমি খেলি না দিদি, কাদার মধ্যে কেউ আছে। মা বলে, কাদা ডাকে, তাকালে টেনে নেয়।” অনন্যা কিছু বলল না—হয়তো ওর মা এসব বলে ভয় দেখায়। বিকেলের দিকে সাহেব শেখ, গ্রামের মোড়ল, তার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তাঁর চেহারায় ছিল কর্তৃত্ব আর রক্ষণশীলতা—তিনি জানালেন গ্রামের কিছু নিয়ম মেনে চললে ভাল হয়। বিশেষ করে, সন্ধ্যার পর যাতে মাঠ বা কাদা-পথে না যাওয়া হয়। অনন্যা বলল, “কেন? কোনো নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়?” সাহেব মাথা নাড়লেন, “না, তেমন কিছু না, কুসংস্কার বটে, তবে মানলে ক্ষতি নেই।” অনন্যা নোটবুকে লিখে রাখল, ‘গ্রামে কাদা নিয়ে লোকবিশ্বাস প্রবল, বিষয়টা বুঝে দেখতে হবে।’ তার মনে হয়, এসব গল্প আসলে ভয়কে শাসনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সন্ধ্যা হতেই সে আবার শুনল সেই ছড়া—এবার একটু অন্যভাবে: “কাদা কাদা খেলে খোকা, কাদার মানুষ টেনে নোকা।”

তৃতীয় দিনে সকালটা স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু দুপুর গড়াতেই বৃষ্টি শুরু হয়। হালকা, টুপটাপ। অনন্যা বারান্দায় বসে ছিল। তার চোখ পড়ল ঘরের পাশে এক দল ছেলেমেয়ে খেলছে কাদা নিয়ে। হঠাৎ সে দেখল রুনু দাঁড়িয়ে কাদার মধ্যে একদৃষ্টে কিছু দেখছে। অনন্যা এগিয়ে গেল, কিন্তু রুনু চমকে উঠে বলল, “ওটা দেখা যাবে না, দিদি। কাদার মানুষ আজ তাকিয়েছে।” কিছু বলতে গিয়ে অনন্যা থমকে গেল। দূরে কাদার মধ্যে যেন সত্যিই একটা অদ্ভুত ছায়া দুলে উঠল। সে চোখ কুঁচকে তাকাল—বাতাসে কুয়াশা জমেছে, হয়তো বৃষ্টি আর আলো মিলে প্রতিফলনের খেলা। কিন্তু ভেতরে কোথায় যেন একটা অস্বস্তি জমে উঠল। সন্ধ্যায় গ্রামের কিছু বৃদ্ধা বলল, এই সময়টা খারাপ, “ঝড়ের আগের রাত”—এই সময় নাকি ছায়ারা হাঁটে। অনন্যা হেসে বলল, “ছায়ারা তো সারাক্ষণই হাঁটে, আলো না থাকলে আমাদেরও ছায়া থাকে না।” তারা কিছু বলল না, শুধু তাকিয়ে রইল। রাতে সে জানালার পাশে বসে চা খাচ্ছিল, হঠাৎ দূর থেকে আবার ছড়া ভেসে এলো, এবার যেন কণ্ঠগুলো খালি শিশুর নয়, কিছু মিলেমিশে গেছে ছায়ার সঙ্গে—“ঝড় এলে কাদা ওঠে, কাদার মানুষ হেঁটে। তুই ভুলে যা আলো, নইলে তোর নাম ডেকে নিয়ে যাবে।” চা কাপের গরম ধোঁয়া ঠান্ডা হয়ে গেলেও, অনন্যা বুঝতে পারল তার শরীর গরম হয়ে উঠেছে—কিছু একটা… ঠিক নেই এখানে।

পরদিন সকালটা মেঘলা। পাখির ডাকও যেন আজ ক্লান্ত শোনায়। অনন্যা খুব সকালে উঠে বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। রাতের ছড়া আর সেই অদ্ভুত ছায়ার কথা বারবার মাথায় ফিরে আসছিল। সে নিজেকে বোঝাল—এই তো সুন্দরবনের প্রান্তিক এক গ্রাম, ঝড়ের আগের হাওয়ায় এমন ছায়া পড়তেই পারে, কুয়াশা তো থাকবেই। কিন্তু এক অজানা শীতলতা যেন তার হাড়ের ভেতরে জমে আছে। সে ঠিক করল—আজ গ্রামটা ঘুরে ভালোভাবে দেখবে। সকাল আটটায়, হাতে ক্যামেরা ও ডায়েরি নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল। কাদার ধারে একটি বাঁশের সাঁকো পার হয়ে সে রুনুর বাড়ির দিকে রওনা দিল। রুনু উঠোনে বসে কাঠি দিয়ে মাটি খুঁটছিল। অনন্যা তাকে কাছে ডাকল, “রুনু, গতকাল তুমি কী দেখেছিলে কাদার মধ্যে?” মেয়েটি ধীরে ধীরে তাকাল, বলল, “একটা মুখ। পুরো কাদা দিয়ে ঢাকা ছিল, চোখ ছিল লাল, ছোট ছোট করে হাঁসছিল।” অনন্যা থমকে গেল। শিশু কল্পনা অনেক কিছু বানাতে পারে, কিন্তু এই বর্ণনা অদ্ভুতভাবে নির্দিষ্ট। সে রুনুর আঁকার খাতা দেখতে চাইল। খাতার ভাঁজে এক পাতায় দেখা গেল একটা বড় কাদার গাদার মতো কিছু, তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আছে দুটো হাত আর একটা চোখ। নীচে লেখা—“ও আমার নাম বলেছিল।” অনন্যা বুঝল—এটা নিছক শিশু কল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।

গ্রামের পাশে একটা পুরনো পুকুর রয়েছে, যার চারপাশে বড় বড় গাছ, নিচু বাঁধ আর গভীর কাদা। এটি এখন আর কেউ ব্যবহার করে না। অনন্যা বিকেলে এক বৃদ্ধার কাছ থেকে জানতে পারে—এই পুকুরেই নাকি আগে একবার “অদ্ভুত” কিছু ঘটেছিল। কেউ কেউ বলে, বহু বছর আগে এক তান্ত্রিক এখানে সাধনা করত, পরে তাকে গ্রামের লোকেরা ধরার পরে কাদার মধ্যে পুঁতে দেয়। সেই থেকে প্রতি বর্ষার রাতে কেউ না কেউ কিছু অদ্ভুত দেখে, কিন্তু কেউই প্রকাশ্যে কিছু বলে না। একবার এক ছেলে খেলতে খেলতে হারিয়ে যায় কাদার ধারে, তার খোঁজ আজও মেলেনি। অনন্যা এসব শুনে মাথা নাড়ে, লেখে—“লোকজ মিথ – ভয় দিয়ে শাসন।” বিকেল গড়াতে হঠাৎ হাওয়া উঠল। মেঘের স্তর আরও ঘন হয়ে এলো। অনন্যা গ্রামের পাশের একটা বাঁশবনের ভেতর দিয়ে হাঁটছিল, হঠাৎ দেখে মাটির পাশে ছোট একটা ঘেরাটোপে কাদা গলগল করছে। পানি নেই, তবু কাদা যেন নড়ছে নিজের মত করে, যেন শ্বাস নিচ্ছে। পাশেই রুনু দাঁড়িয়ে, চোখ স্থির। অনন্যা জিজ্ঞেস করল, “কি দেখছ?” রুনু মৃদু গলায় বলল, “ও আবার ডেকেছে। আজ রাতে ওর সময়।” হঠাৎ কাদা থেকে একটা বুদ্বুদের আওয়াজ উঠল—একটা বুদবুদের ফেটে যাওয়ার শব্দ, কিন্তু তাতে যেন মানুষের হাঁচির মতন একটা গলা মিশে ছিল।

সন্ধ্যার সময় বাতাস আরও ভারী হয়ে উঠল। গ্রামের মানুষ দরজা-জানালা বন্ধ করে দিল। পুকুরপাড় থেকে একটা কাক ছিটকে উড়ে এলো—তার ডানা জড়িয়ে কাদায় পড়ে গেল। পাখিটা উঠে দাঁড়াতে পারল না, শুধু একবার চ্যাঁচিয়ে কেঁপে কেঁপে নিস্তেজ হয়ে পড়ল। অনন্যা তখন ঘরে বসে ডায়েরি লিখছিল—“কুসংস্কার ও বাস্তবের সীমারেখা কখনো কখনো মিশে যায়।” হঠাৎ বাইরে থেকে একটা ছায়া জানালার ফ্রেমে পড়ল। গায়ে কাদা, একটা হাত উঁচু। তার প্রতিফলন পুরো জানালাজুড়ে, মুখ নেই, চোখের জায়গায় যেন ফাঁকা গর্ত। অনন্যা চমকে উঠল, কিন্তু দরজার তালা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে কিছুই দেখতে পেল না। চারদিক কুয়াশা আর মৃদু বৃষ্টির শব্দে ভরে আছে। কাদার দিকে তাকাতেই মনে হল—একটা ছায়া গলগল করে নেমে গেল মাটির নিচে। ঠিক তখনই পিছন থেকে রুনুর গলা শোনা গেল—“ওর নাম জানলে, ও চলে আসে। আমি বলিনি আমার নাম, তুমি বলো না দিদি।” গলা শুনে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে এল অনন্যার। শিশুর কণ্ঠে এমন সতর্কবার্তা—তাতে যুক্তি আর তর্কের সব দেয়াল ভেঙে যায়। কাদার মানুষ… সে কি আসলেই কোনও কল্পনা নয়?

রাতটা খুব একটা ঘুম হয়নি অনন্যার। জানালার কাঁচে জমে থাকা শিশিরের ফোঁটা আর বাইরে হাওয়ায় দুলে ওঠা বাঁশগাছের পাতার শব্দ যেন গা ছমছমে করে তুলেছিল ঘরটাকে। সকালে ঘুম থেকে উঠে সে ঠিক করল, এবার গ্রামের প্রবীণ কারও সঙ্গে কথা বলতে হবে, যিনি লোককথা জানেন, গ্রামের অতীত জানেন। সাহেব শেখের সহায়তায় সে পৌঁছাল বিনোদিনী মাসির বাড়িতে—ছেঁড়া ছনের চাল, দরজার পাশে শুকনো নিমপাতা আর শিকড় বাঁধা; এক নিঃশব্দ অথচ ভারী পরিবেশ। মাসি এখন প্রায় পঁয়ষট্টি, শরীরে হাড় জিরজিরে হলেও চোখে এক অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা। অনন্যা তাকে কাদার মানুষের গল্প জিজ্ঞেস করতেই মাসি চুপ করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “তুই শুনলে কি বুঝবি, মা? তোর শহরের ঘড়ি কি কাদার সময় চিনে?” বলেই তিনি শুরু করলেন এক পুরনো ছড়া, যার প্রতিটি শব্দ যেন অনন্যার রক্ত জমিয়ে দিল—
“কাদা ডাকে চুপিচুপি, বৃষ্টির ফোঁটা বুকে,
শিশুর পায়ে হালকা কদম, ছায়া নামে সুখে।
তুই যদি শোনস তার ডাক,
ওর মুখে উঠবে তোরই নাম,
তোর ছায়াও ফিরবে না আর ঘরে।”

অনন্যা ছড়াটা শুনে হতবাক। শব্দগুলো সরল হলেও তার মধ্যে যে ভয়াবহতার সুর, তা অস্বীকার করা যায় না। মাসি বললেন, “এই ছড়াটা আমার ঠাকুমা শোনাতেন। আমার ছেলেও একবার রাতে খেলতে গিয়েছিল কাদার পাড়ে। আমি নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু ও যায়। পরদিন কেবল একটা লাল গামছা পাওয়া গেল।” অনন্যা প্রথমবারের মতো ভিতরে একটা দ্বিধা অনুভব করল—এটা কি শুধুই গ্রামীণ ভয়? না কি সত্যিই ইতিহাসে লুকিয়ে থাকা কোনও অতল রহস্য? মাসি জানালেন, এই পুকুরপাড় একসময় “জলকাদার ঠাঁই” বলে পরিচিত ছিল। যেখানে বৃষ্টি নামলেই মাটি যেন জেগে উঠত। “ওটা শুধু জল বা কাদা না মা, অনেক রক্ত, অনেক কান্না মিশে আছে ওখানে। গ্রামের লোক তান্ত্রিকটারে পুঁতে দেওয়ার পর থেকে প্রতিবার বৃষ্টির দিনে একটা ছায়া আসে। ছোটরা ওকে দেখে, বড়রা কেবল তার ছায়া টের পায়।” মাসির কথা শোনার সময় অনন্যার বুকের ভেতরে কেমন ঠাণ্ডা অনুভব হচ্ছিল।

বিকেল হতেই আবার আকাশ গুমোট হয়ে এলো। অনন্যা কুটিরে ফিরছিল, তখন সে শুনতে পেল কয়েকটা বাচ্চা আবার ছড়া কাটছে। এবার তারা যেন খেলছে না, বরং রেওয়াজ করছে কোনও পুরনো মন্ত্রের মতো—“টুকটুক বৃষ্টি নামে, কাদার ঘরে ডাক, কে যাবে এবার ছায়ার পেটে, নামটা বলেই থাক।” সেই মুহূর্তে এক ঝাপসা ঝোড়ো হাওয়া এল, চারপাশে ধুলোর ঘূর্ণি। অনন্যা কাদা-পথ ধরে হাঁটছিল, কিন্তু হঠাৎ একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনে থমকে গেল। ঝোপের ভেতরে রুনু দাঁড়িয়ে, সে জোরে জোরে বলছে—“আমি বলিনি ওকে, দিদি! আমি বলিনি!” অনন্যা ওকে কাছে ডাকতেই রুনু দৌড়ে এসে কাঁদতে কাঁদতে তার গলা জড়িয়ে ধরল। সে বলল, “কাল রাতে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল ও। আমি চোখ বন্ধ করেছিলাম, কিন্তু ওর গলা শুনলাম—‘রুনু, আমি জানি তুই দেখিস আমায়। তুই ভালো বন্ধু, তাই তোর দিদিকে বলিস না।’” অনন্যা আর কোনও কথা খুঁজে পেল না। তার মাথার ভেতর মাসির ছড়া ঘুরছিল, রুনুর ভয়, কাদার গন্ধ, আর সেই ছায়া—যা তার যুক্তির সব দরজা ভেঙে দিচ্ছিল।

বৃষ্টির দিনগুলোর মতো কেমন একটা ধূসরতা এসে বসে গেছে গোটা গ্রামের ওপর। আকাশে যেন রোদ একেবারে হারিয়ে গেছে, সবকিছু ছায়াঘেরা আর কাদায় ভেজা। কুটিরের জানালায় বসে অনন্যা খাতায় কিছু লিখছিল, কিন্তু তার চোখ আর মন বারবার ফিরে যাচ্ছিল রুনুর সেই কথাগুলোর দিকে। “তোর দিদিকে বলিস না”—একটা অস্তিত্ব, যে বেছে নিচ্ছে কার সঙ্গে কথা বলবে, আবার কার দিকে তাকিয়ে থাকবে। যুক্তিবাদী মন যতই চেষ্টায় করে ব্যাখ্যা খুঁজতে চাইছিল, ততই যেন এক অদৃশ্য কাদার মতন কিছু জেঁকে বসছিল তার চিন্তার ভেতরে। দুপুরের দিকে সে খবর পেল, গ্রামের এক কিশোর, নাম পলাশ, কাদার ধারে খেলতে গিয়ে আচমকা পড়ে যায়। গাঁয়ের লোকজন দ্রুত তাকে উঠিয়ে আনে, কিন্তু ছেলেটা তখন জোরে জোরে কাঁপছিল আর বলছিল—”ওটা তাকিয়ে ছিল আমার দিকে! ওর মুখ জলের নিচে!” খবর পেয়ে অনন্যা ছোটে সেই জায়গায়, যেখানে পলাশ পড়েছিল। একটা শুকনো কাদামাখা পুকুরের ধারে গিয়ে দাঁড়াতেই সে স্পষ্ট দেখে, এখনও সেখানে হালকা গলাগলা বুদবুদ উঠছে কাদার মধ্যে থেকে, যেন কেউ ভেতর থেকে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।

পলাশকে তার বাড়িতে নেওয়া হয়। ছেলেটা তখনও কাঁপছে, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে, আর সে বারবার বলে যাচ্ছে—“আমি বলিনি নাম, আমি বলিনি নাম!” অনন্যা তার পাশে বসে ওর হাত ধরতেই সে হঠাৎ করে চোখ বড় বড় করে তাকাল আর ফিসফিস করে বলল, “ও কাদায় ছিল না দিদি, ও কাদার নিচে ছিল… মুখটা ছিল… মুখের জায়গায় কেবল গর্ত… চোখ ছিল দুটো আগুনের মতো!” অনন্যা কোনও সান্ত্বনার কথা খুঁজে পেল না। পলাশের মা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সাহেব শেখ এলেন ঘরে, কপালে রুমাল চেপে বললেন, “এগুলো শুধু ভয়, বারবার বলেছি এই জায়গায় সন্ধ্যের পর কেউ যাবে না। পুকুরটা বন্ধ করে দেওয়া দরকার।” কিন্তু অনন্যা প্রশ্ন করল, “কিন্তু সাহেব, যদি এটা নিছক গুজব হয়, তবে ভয় এত গভীর কেন? এই শিশুরা কেন এত নির্দিষ্ট করে বলে, তারা কী দেখছে?” সাহেবের মুখ কিছুক্ষণ থেমে থাকল, তারপর কেবল বললেন, “ভয় একবার মন খেয়ে ফেললে, তা মানুষে-মানুষে ছড়িয়ে পড়ে, তুমিও বুঝবে।” কিন্তু অনন্যার মনে হচ্ছিল, এটা শুধু মনস্তত্ত্ব নয়, এর পেছনে কিছু আছে যা এখনও চোখে পড়েনি, কিন্তু অনুভবে এসে পড়েছে।

বিকেল বেলায় আবার হালকা বৃষ্টি নামে। পুকুরপাড়ে লোকজনের ভিড়, সবাই পলাশের ঘটনার কথা বলছে। কেউ বলছে “ওর ওপর ভূতে চড়েছে”, কেউ বলছে “কাদার মানুষ ডেকেছে ওকে, কিন্তু ও নাম বলেনি বলে ছেড়ে দিয়েছে।” এমন সময় বিনোদিনী মাসি ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে এলেন। সবাই চুপ করে গেল। তিনি পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ, তারপর বললেন, “এ জায়গাটা এক সময় ছিল ডাক, রক্তের ডাক। কাদার নিচে চাপা আছে শুধু শরীর না, আছে অভিশাপ। যে নাম বলে দেয়, তাকে ছেড়ে দেয় না ও।” তাঁর গলায় কোনও নাটকীয়তা ছিল না, বরং একরাশ ধকল সয়ে যাওয়া শুষ্কতা। অনন্যা ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে গেল, চোখ নামিয়ে পুকুরের কাদার দিকে তাকাল। হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্য, যেন সব শব্দ স্তব্ধ হয়ে যায়। কাদার ওপর থেকে এক বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ে নিচে—আর তাতে তৈরি হয় এক গোল রিং। রিংটার ঠিক মাঝে যেন একটা চোখ! সে ঝট করে মাথা তুলল, কিন্তু কিছু দেখা গেল না। চারপাশে শুধু নিস্তব্ধতা আর বৃষ্টির ফোঁটার টুপটাপ শব্দ। মনে হল কাদার মধ্যে যেন কেউ হাসল—কোনও শব্দ না করে, শুধু উপস্থিতির ইঙ্গিত দিয়ে।

পঁচা কাদার গন্ধ যেন শিরদাঁড়া বেয়ে হিমেল শীতলতা নামিয়ে আনল। তাপস ঠিক বুঝতে পারছিল না—এটা বাস্তব, না ঘোর? কাঠের ঘরটায় ঝড় থেমেছে ঠিকই, কিন্তু সেই রাতের নিস্তব্ধতায় মাটির নিচ থেকে যেন কেউ হাঁফাচ্ছে। বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে, আর পায়ের তলায় কাঁপুনি—মনে হচ্ছে যেন ভূমির তলা দিয়ে কিছু একটা চলছে, জীবন্ত, অনবরত। দূরের জঙ্গল থেকে একটা শব্দ এল—অদ্ভুত, যেন পাখি নয়, জন্তু নয়, মানুষও নয়। তাপস হাতে টর্চটা নিয়ে বাইরে পা রাখতেই কাদার মধ্যে একটা চলন্ত রেখা চোখে পড়ল—মানুষের শরীরের মতো কিন্তু কোনো আকার নেই, মাথা নেই, পা নেই। হঠাৎ সেটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল, কিন্তু কিছু একটা রেখে গেল পেছনে—একটা অচেনা দাগ, যেন কোনো শিশুর হাতের ছাপ, কাদায় আঁকা, কিন্তু তার আকার ছিল অস্বাভাবিক বড়ো।

সেই রাতেই তাপস গ্রামবাসীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া কুসংস্কারের পেছনের সত্য খুঁজে বের করতে চাইল। সে গিয়ে হাজির হল গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ, রঙ্গলাল দাদুর কাছে। দাদু বলল, “বাবা, এইটা গল্প নয়। আমি নিজের চোখে দেখছি। বছর চল্লিশ আগের কথা। ভোরবেলা, এমনই এক বর্ষার পর, নদীর পাড়ে একটা মেয়ের দেহ মিলল কাদার ভিতর। শরীর অক্ষত, কিন্তু চোখ খোলা, আর মুখে একটা অদ্ভুত শান্তির হাসি। কেউ জানে না কীভাবে মারা গেল। তারপর থেকে প্রতি ঝড়ের রাতে কাদা থেকে কেউ উঠে আসে—কারও ছায়া দেখা যায়, কারও শরীরে আঁচড় পড়ে, কেউ বা হারিয়ে যায়।” তাপসের মনে প্রশ্ন জাগে, তবে কি এটা কোনো ব্যাকটেরিয়া? কাদার সঙ্গে মিশে থাকা কোনো ছত্রাক? বা মিথেন গ্যাসের প্রভাব? কিন্তু এইভাবে নির্দিষ্ট শিশুরা নিখোঁজ হয়ে যাওয়া কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? রঙ্গলাল বলে, “ওরা ডাকলে, ফিরে আসা যায় না। কাদার মানুষ কাউকে একবার টেনে নিলে, ও চলে যায় ভিতরে—অন্তহীন ঘুমে।”

ঝড় থেমেছে ঠিকই, কিন্তু গ্রামের মাটি তখনো স্যাঁতসেঁতে, বাতাস ভারী। তাপস হাঁটছিল গ্রামের পেছনের কাঁচা রাস্তা ধরে, যেখানে নিখোঁজ ছেলেটির শেষ দেখা পাওয়া গিয়েছিল। হঠাৎ সে খেয়াল করল—তার পেছনে কাদা ছড়িয়ে যাচ্ছে, অথচ সে থেমে আছে। ভয় আর যুক্তিবাদে ধাক্কা লাগল একসঙ্গে। কাদার মধ্যে একটা হাতের ছাপ ফুটে উঠল, তারপর আরও একটা। হঠাৎ করেই পেছন থেকে ঠান্ডা বাতাসে তার শ্বাস আটকে এলো। সে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই মাটির নিচ থেকে কাদায় ঢাকা একটা মুখ উঠল, তার চোখ ছিল শূন্য, আর মুখে সেই একই হাসি—যেটা রঙ্গলাল বলেছিল সেই মৃত মেয়ের মুখে ছিল। আর তখনই হঠাৎ ঝড়ের মতো টর্চ নিভে গেল। কাদা যেন তাকে পায়ের গোড়া থেকে টেনে ধরল। সে হঠাৎ দৌড়ে পালাতে চাইল, কিন্তু মাটি তাকে ছাড়ছিল না। চোখের সামনে আবার সেই ছায়া—বড়ো, জ্যান্ত, তরল। কিন্তু তার মাঝে কে যেন বলল, “তুমি বুঝতে চাও? তবে এসো, দেখো আমাদের জগৎ। কাদা শুধু মাটি নয়, এখানে অনেক কিছু চাপা পড়ে আছে।” তাপস ধাক্কা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অন্ধকারের ভেতর ছুটল, পেছনে সারা রাত জুড়ে শোনা গেল সেই হাসির শব্দ, সেই পচা কাদার গন্ধ, আর কোথাও এক শিশুর কান্না।

ঝড়টা থেমে গেছে অনেকক্ষণ। চারদিক থমথমে, ঝাঁকুনিপূর্ণ নিস্তব্ধতা যেন গিলে নিচ্ছে পুরো গ্রামটাকে। দীপ্তি চোখে ঘুম নেই, সারারাত ধরে সে আলো নিভিয়ে বিছানার পাশে বসে। তার মাথায় ঘুরছে কাদায় ডোবা সেই ছায়ামূর্তির কথা। বাস্তব আর ভ্রমের সীমারেখা মিলিয়ে গেছে তার কাছে। সকালে রশিদের কথা শুনে তার বুকটা যেন কেঁপে উঠেছিল—সে জানায়, তার নাতি ইমনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কাদা খেলতে গিয়ে সে আর ফেরেনি। আশেপাশের লোকজন ভয় আর গুজবের মিশেলে কানাকানি শুরু করেছে — “কাদার মানুষ আবার ফিরে এসেছে।” দীপ্তির যুক্তিবাদী মন যুদ্ধ করছে তার ভেতরের আতঙ্কের সঙ্গে। হঠাৎই, সে সিদ্ধান্ত নেয়—এই ভয়, এই কল্পনাকে ভাঙতে হলে তাকে নিজের চোখে দেখতে হবে সত্যটা।

দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে নামতেই সে একাই বেরিয়ে পড়ে গ্রামের পেছনের সেই বড় কাদামাঠটার দিকে, যেখানে ইমন শেষবার দেখা গিয়েছিল। বাতাস ভারী, আকাশে এখনও মেঘের ছায়া। দীপ্তির হাতে একটা টর্চ, আর তার বুকের ভেতর একটা অজানা ঝড়। কাদা পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে হঠাৎ দেখে সামনে কিছু চলেছে। টর্চের আলো ফেলে দেখে, কাদার ভেতরে যেন কিছু দুলছে, যেন নিঃশব্দে কাদা ঠেলে আসছে কারো পা। সে দাঁড়িয়ে যায়। হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দের ফাঁকে সে শুনতে পায় কেমন যেন গোঁ গোঁ শব্দ, আর তখনই কাদার ভেতর থেকে উঠে আসে একটা চেহারা—চোখ নেই, নাক নেই, পুরো মুখটায় যেন কাদা মাখা, কিন্তু ঠোঁটদুটো টানানো হাসির মতো। দীপ্তি ভয়ে জমে যায়, শরীর চলতে চায় না। কিন্তু কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারে, সেই ছায়ামূর্তিটা ধীরে ধীরে পেছনের দিকে হাঁটছে—তাকে কিছু না বলেই, এক অচেনা নিশানায়।

দীপ্তি কিছুটা সাহস নিয়ে পেছন পেছন যেতে শুরু করে। সেই ছায়া এগিয়ে চলে গ্রামের এক পরিত্যক্ত খালপাড়ের দিকে। জায়গাটা জংলা, অনেকদিন কারো যাতায়াত নেই। দীপ্তি দেখে, সেখানে আগে মাটি ছিল, এখন একটা ছোটো গর্ত। কাদার মানুষ সেই গর্তের সামনে দাঁড়িয়ে নড়াচড়া থামিয়ে দেয়। দীপ্তি দূর থেকে দেখে, গর্তটার ভেতর থেকে একটা ছোটো হাত উঠে আসছে—ইমন! তার চোখে জল চলে আসে, কিন্তু ভয়ে সামনে এগোতে পারে না। ছায়ামূর্তিটা হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকায়, আবার সেই কাদা মাখা মুখে অদ্ভুত হাসি। কিন্তু এবার দীপ্তি চিৎকার না করে একটা ছবি তোলে, সেই দৃশ্যের। ছায়াটা ধীরে ধীরে কাদার মধ্যে মিলিয়ে যায়। দীপ্তি এগিয়ে গিয়ে দেখে, ইমন তখনও জীবিত—ভয়ে সংজ্ঞাহীন। সে ছেলেটাকে কোলে নিয়ে পেছনে ফিরে তাকায়, কিন্তু চারপাশ আবার নিঃসঙ্গ, নির্জন, আর নিস্তব্ধ।

ঝড় থেমে গেছে, কিন্তু আকাশ এখনো কালো। এক অদ্ভুত নিঃস্তব্ধতা নেমে এসেছে গ্রামে, যেন প্রকৃতি নিজেই কিছু লুকিয়ে রাখছে। রুদ্রর মনে হচ্ছিল, চারপাশের প্রতিটি গাছ, প্রতিটি জলকাদার গর্ত, এমনকি বাতাসও যেন কিছুর সাক্ষী। সেই রাতের কাদার মানুষের উপস্থিতি শুধু চোখের ভুল ছিল না, বরং বাস্তবতার এক অন্য রূপ। সে নিজের মোবাইল ক্যামেরায় কিছু ধরা পড়েছে কি না দেখতে গিয়ে দেখে, ভিডিও অদ্ভুতভাবে ব্ল্যাঙ্ক—শুধু হঠাৎ হঠাৎ শোনা যাচ্ছে বুদবুদ আওয়াজ, যেন কাদার তলা থেকে কেউ নিশ্বাস নিচ্ছে। এতদিন যুক্তিবাদে বিশ্বাস করা রুদ্রর ভিতরে এক অসম্পূর্ণতার কাঁপুনি বয়ে যায়। পরদিন ভোরে সে যায় গ্রামের প্রান্তে, যেখানে লতাজঙ্গলে ঢাকা একটি পুরনো ইটের মন্দির—এই মন্দির নিয়েও বহু কাহিনি আছে। গ্রামের সবচেয়ে বৃদ্ধা, মাধবী ঠাকুরমা বলেন, ওই মন্দিরের নিচেই নাকি “কাদার মানুষের ঘর”, যেখানে পঞ্চাশ বছর আগে এক মৃত তান্ত্রিকের দেহ কাদায় চুবিয়ে পুঁতে রাখা হয়েছিল। তখন থেকেই শুরু হয় শিশুদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। রুদ্রর মনে প্রশ্ন জাগে—এই তান্ত্রিক কি কাদার মধ্যেই থেকে যায়? তার শক্তি কি প্রকৃতির উপাদানের সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছে?

রুদ্র নিজে হাতে মন্দির ঘুরে দেখে, তার পেছনে একটি গভীর খাল, যেটি শুকনো মৌসুমে প্রায় অদৃশ্য, আর বর্ষায় নদীতে পরিণত হয়। সেই খালের ধারে কাদা জমে আছে, আর কাদার ওপর বিচিত্র আঁকিবুঁকি—মানুষের পায়ের ছাপ, কিন্তু অস্বাভাবিকভাবে বড় এবং গভীর, যেন সেই পদচিহ্ন মাটির ওপরে নয়, বরং মাটির নিচ থেকে উঠে এসেছে। রুদ্র সঙ্গে করে নিয়ে আসা এক স্কেচবুক খুলে চিহ্নগুলো আঁকতে থাকে। ঠিক তখনই পেছন থেকে হাওয়ার ঝাপটা আসে, আর সাথেসাথেই যেন কারো নিঃশ্বাস তার কানে লাগে—ঠাণ্ডা, ভেজা, মাটি-গন্ধমাখা নিঃশ্বাস। রুদ্র চমকে উঠে দেখে, কেউ নেই। কিন্তু তার চারপাশে কাদায় দাগ—তাজা দাগ। ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারে, এই শক্তির সঙ্গে শুধু মিথ আছে এমন নয়—এটি এক ধরণের ভূ-আধার, ভূ-চেতনা, যা মৃত আর জীবিতের মধ্যকার দূরত্ব মুছে দিতে পারে। মাধবী ঠাকুরমা বলেন, যতবার বৃষ্টিতে কাদা গন্ধ ছড়ায়, ততবার সে শক্তি সক্রিয় হয়। আর যখন শিশুদের চিৎকার শোনা যায় দূরের বাঁশবনে, তখন বোঝা যায় কাদার মানুষ শিকার করেছে।

গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ে রুদ্রর ওপর কিছুর ছায়া পড়েছে। কিছু লোক বলে, ও কাদায় হাত দিয়েছে, আর কাদা যখন শুদ্ধ নয়, তখন শরীরেও অশুদ্ধি লাগে। রুদ্রকে দূরে সরিয়ে রাখা শুরু হয়, অথচ সে তখন আরও গভীরে যেতে চায়। তার ধারণা, কাদার মানুষ আসলে কেবলমাত্র অতৃপ্ত আত্মা নয়, বরং সেই পরিবেশগত ও আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক, যা প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হলে প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হয়। সে আরো তথ্য জোগাড় করতে চায় মন্দিরের পুরনো কাগজপত্র, ম্যাপ আর সেখানকার খননের রিপোর্ট ঘেঁটে। তার মনে হয়, এই ‘কাদার মানুষ’ আদতে একটা সতর্কতা—যে মানুষ যদি প্রকৃতিকে অসম্মান করে, তবে প্রকৃতির মাঝখান থেকেই উঠে আসবে প্রতিশোধের ছায়া। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়—কে সেই প্রথম মানুষ, যাকে কাদা গ্রাস করেছিল? আর কেন কেবলমাত্র শিশুরাই এর শিকার? এক রাতে, রুদ্র সিদ্ধান্ত নেয় সে নিজেই সেই উত্তর খুঁজে বের করবে—হোক না নিজের জীবনের বিনিময়ে।

ঘোর অন্ধকারে আকাশ তখন বজ্রবিদ্যুৎ-চিত্রিত, ছিন্নভিন্ন বৃষ্টিধারার মধ্যে সুন্দরবনের সেই বিস্মৃত গ্রাম যেন ধরা পড়ে আছে কোনো প্রাচীন অভিশাপের নিঃশব্দ কবলে। অরিত্র আর চন্দনা গ্রামের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে কাদা নদীর চাঁদনী হাটে এসে মিশেছে। বৃষ্টি ও জলের ভেতর দিয়ে তাদের কণ্ঠ শোনা যায় না, শুধু ঘন কাদার ভেতর কিছু যেন নড়ছে — সেই স্পষ্ট নড়াচড়া, নিঃশব্দে কোনো কিছু উঠে আসছে, যেন মৃতের শরীর নয়, কিন্তু প্রাণীও নয়। চন্দনার চোখে ভয়, কিন্তু তার হাত শক্ত করে ধরে অরিত্র সামনে এগোয়। জলের ওপরে এক ঝলক আলো পড়তেই তারা দেখতে পায়—একটি অর্ধ-মানবাকৃতি, কাদায় গড়া শরীর, চোয়ালটা ঢলে পড়েছে, চোখদুটো যেন ফাঁকা গর্ত, আর তার শরীর থেকে গলে পড়ছে কর্দম। চন্দনা অচেতন হয়ে পড়ে যায়। অরিত্র দাঁড়িয়ে থাকে স্তব্ধ হয়ে, যেন সময় থেমে গেছে। সেই ছায়ামূর্তিটি হঠাৎ হাত বাড়িয়ে দেয়, নখগুলো যেন ঝিনুক ভাঙা কাঁটার মতো, আর তার মুখের গভীর গর্ত থেকে শুনতে পাওয়া যায় এক গম্ভীর শোঁ শোঁ শব্দ—যেন মাটির নিচে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস।

এক মুহূর্তের ঝড়ো বাতাসে চারদিকে গাছগুলো কেঁপে উঠে, এবং হঠাৎ সেই ছায়া কাদার ভেতরেই আবার ঢুকে পড়ে, কোনো শব্দ না করে। অরিত্র চন্দনাকে কাঁধে তুলে ফিরতে শুরু করে, কিন্তু তার মনে তখন অদ্ভুতভাবে বাজছে সেই শব্দ—”পিছন ফিরে তাকিও না”—যেটা ছোটোবেলায় দাদু বলতেন রূপকথার গল্পে। কিন্তু এই কাদার মানুষ তো কোনো রূপকথা নয়, এটা তার সামনে দেখা বাস্তব, যার গায়ে ছিল না কোনো যুক্তির ছোঁয়া, ছিল না বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা। গ্রামে ফিরে অরিত্র দেখে যে পুরোহিত জ্যাঠামশাই, যে তাকে সবসময় যুক্তির পাঠ দিত, সে চুপচাপ বসে আছেন আঁধারে, তার ঠোঁটে যেন চুপ করে গিলে ফেলা কোনও গল্প। চন্দনার জ্ঞান ফিরলেও তার চোখে চেনা যায় আতঙ্কের ছায়া—সে বারবার বলছে, “ওটা আমাদের ডাকছে… আমাদের নয়… আরও কাউকে…”। রাতে ঘুমোতে পারছে না কেউ, এমনকি গ্রামের কুকুরগুলোও চুপচাপ, যেন কেউ বলেছে তাদের চিৎকার করতে মানা।

পরদিন ভোরে, অরিত্র নিজে ঠিক করে, সে এই রহস্যের শেষ পর্যন্ত যাবে। গ্রামের এক বয়স্ক লোক, হরিচরণ, তাকে বলে, “যখন আমি ছোট ছিলাম, আমার দাদা বলত, কাদার মানুষ কেবল ভয় দেখায় না, যাকে চায়, তার ছায়াও নিজের করে নেয়।” এই কথার মানে তখন বোঝা যায় যখন গ্রামের এক ছেলেকে পাওয়া যায় নিখোঁজ, এবং তার ঘরে তার ছায়া দেখা যায় কাঁপতে থাকা দেয়ালে—কিন্তু ছেলেটা নেই। অরিত্র বুঝতে পারে, কাদা শুধু শরীর নেয় না, স্মৃতি আর অস্তিত্বও গিলে নেয়। তখনই সে সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে যেতে হবে সেই পুরনো চণ্ডীমণ্ডপের কাছে, যেখানে একসময় গ্রামবাসীরা পূজো দিত, কিন্তু এখন সেটা কাদার নিচে চাপা পড়ে আছে। রাত গভীর হতেই, সে একা রওনা হয়, কাঁধে টর্চ আর মনের ভেতর সাহসের শেষ কণা নিয়ে। তার পেছনে, অজানা কিছুর ছায়া পড়ছে জঙ্গলের ছায়াঘন পথ ধরে—কাদা যেন হাঁটছে, নিঃশব্দে, ধৈর্যের ছায়ায় লুকিয়ে।

ঝড়ের পরদিন সকালে গ্রামটা যেন কেমন নিঃশব্দ হয়ে গিয়েছিল। বৃষ্টির জল নেমে যাওয়ার পরও চারদিকে ছিল কাদার সমুদ্র, যেন মাটি নিজেই দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছে। হিরণ চোখে ঘুম না নিয়েই রাত কাটিয়ে দিয়েছিল, নিজের কুঁড়েঘরের সামনে বসে কেবল একটা পাথরের মতো চুপ করে। কাঁদা থেকে উঠে আসা সেই ছায়ার কথা মনে পড়লেই গা কেঁপে উঠছিল তার। সে ভাবছিল—কি ছিল সেটা? প্রকৃতির কোনো খামখেয়ালি? নাকি সত্যিই লোককথার “কাদার মানুষ”? সকালবেলা সে বেরিয়ে পড়ে শ্যামাপদর বাড়ির দিকে, কিন্তু দেখে সে রাতেই সে নিখোঁজ। আশেপাশের কেউ কিছু জানে না, কেবল অন্ধ বৃদ্ধ দাদিমা বললেন, “রাত তিনটের সময় ঘরডা ঠাস ঠাস কইরা কেহ বাইর হইলো… আর ফিরল না।”

তারা গ্রাম ঘুরে জানতে পারল—এইভাবে গত দশ বছরে মোট সাতজন নিখোঁজ হয়েছে, যার প্রত্যেকটা ঘটেছে বর্ষার রাতে, আর প্রত্যেকেই কাদার মধ্যে ছিল। হিরণ বিস্ময়ে অনুভব করল, এই গ্রামে কোথাও যেন একটা ছায়া পেছন পেছন হাঁটে, যেটা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। বনদপ্তরের পুরোনো রেকর্ড ঘেঁটে জানা গেল, একসময় এই এলাকায় ছিল একটা ছোট খনি—যেখান থেকে দুর্লভ কাদা-মাটি উত্তোলন হতো হোমিওপ্যাথিক ওষুধ তৈরির জন্য। একবার খনির এক অংশ ধ্বসে পড়ে কাদায় চাপা পড়ে যায় শ্রমিকেরা। কিন্তু সরকার চেপে যায় বিষয়টা। হিরণ ভাবল, সেই ঘটনার কোনো প্রেত প্রতিক্রিয়া কি ছায়ার মতো থেকে গেছে? সেই চাপা পড়া জীবনের হাহাকার কি আজও জ্যান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় সুন্দরবনের এই কাদামাখা জমিতে?

রাত নেমে এলে হিরণ আর একা রইল না। গুটিকতক যুবক, যাদের সে বিশ্বাস করেছিল, তারা সবাই তার সাথে চলল সেই পুরোনো খনির দিকে। পথে পথে বৃষ্টি পড়ছে ঝিরিঝিরি, বাতাসে মাটির ঘ্রাণ আর দূর থেকে শোনা যাচ্ছে নাম না-জানা কোনো পাখির কান্না। খনির ধ্বংসাবশেষে পৌঁছে তারা দেখল, সত্যিই একটা জায়গা আছে যেখানে আজও জল আর কাদার একটা ভীষণ নরম স্তর রয়েছে—যেটা অদ্ভুতভাবে শুকোয় না কখনও। হিরণ সেখানে দাঁড়িয়ে কানে পেল আবার সেই শব্দ—‘চুপচাপ থাকো…’, আর ঠিক তখনই কাদার ভেতর থেকে উঠল ফোঁস ফোঁস করে বুদবুদ, একটা ছায়া উঠতে শুরু করল ধীরে ধীরে। এবার হিরণ আর ভয় পেল না, সে এগিয়ে গেল সামনের দিকে, মাটির মানুষটির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি কে?” ছায়াটি থেমে গেল, আর এক নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল নিঃশব্দে। কিন্তু তার চারপাশে বয়ে গেল একটা ঠান্ডা বাতাস—আর হিরণ বুঝতে পারল, সে যা খুঁজতে চেয়েছিল, তার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে—কিন্তু উত্তরটা এখনো অনেক দূরে।

অবশেষে রাত নেমে আসে সুন্দরবনের সেই প্রান্তিক গ্রামে, যেখানে কাদার নিচে চাপা পড়ে থাকা শতাব্দীর রহস্য আজ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চলেছে। ঝড়ের রাতে গাছগুলো যেন দুলে উঠছিল আতঙ্কে, আর আকাশের বিদ্যুৎ চোখে যেন আগুন ঝরছিল। NGO কর্মী তীর্থ আর গ্রামবাসী বুড়ো গোবর্ধন একসাথে সেই বনের ধারে দাঁড়িয়ে, হাওয়ায় ভেসে আসা একটা অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পেল—কেউ যেন কাদার ভেতর থেকে ডাকছে, তার গলায় ছিল না দেহের উষ্ণতা, ছিল না কোনো মানুষের স্বর। বুড়ো গোবর্ধন ফিসফিস করে বলল, “ওই ডাকটা আমি চিনতে পারি… ও কাদার মানুষ।” তীর্থ মনে করছিল সে যুক্তিবাদী, কিন্তু গত কয়েক রাতের অভিজ্ঞতা তার বিশ্বাসকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। হঠাৎ, কাদার মধ্যে থেকে একটি অদ্ভুত মূর্তি উঠে এল—মানবাকৃতির, কিন্তু শরীর ছিল পচা কাদা আর শেওলা দিয়ে গঠিত। চোখদুটো ফাঁকা, যেন সেখানে কোনো আত্মা নেই, কেবল এক অন্তহীন শূন্যতা।

তীর্থ চিৎকার করে ওঠে, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর বনের নৈঃশব্দ্যে মিশে যায়। গোবর্ধন কাঁপতে কাঁপতে মন্ত্র জপ করতে থাকে—পুরানো লোককথার সেই টোটকা যা তার ঠাকুরদা তাকে শিখিয়েছিল। কাদার মানুষ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, তার হাঁটার ছন্দে কাদার তরঙ্গ ওঠে। আচমকা তীর্থের চোখের সামনে সেই কাদার মানুষ রূপ বদলাতে থাকে—সে রূপ নেয় তার হারিয়ে যাওয়া ছোট বোনের, যার মৃত্যুর কারণ আজও তীর্থ জানে না। তীর্থের হৃদয় কেঁপে ওঠে, বাস্তবতা আর অলৌকিকতার মাঝের পর্দা ছিঁড়ে ফাটল ধরে যায় তার চেতনায়। সেই মুহূর্তে গোবর্ধনের জপের শব্দ উচ্চতর হয়, আর হঠাৎ কাদার মানুষ থমকে দাঁড়ায়, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে বেঁধে রেখেছে। কিন্তু ঠিক তখনই ঝড় আরও প্রবল হয়, আর কাদা ফেটে বেরিয়ে আসে আরও অনেকগুলো ছায়া, যেন শতবর্ষ ধরে জমে থাকা ক্রোধ, ক্ষুধা, ও প্রতিশোধ একসাথে জেগে উঠেছে।

তীর্থ আর গোবর্ধন ছুটে পালাতে থাকে, কিন্তু কাদার নিচে যেন মাটি নড়ে উঠছে, তাদের পা দেবে যাচ্ছে। বহু কষ্টে একটা পোড়া গাছের নিচে আশ্রয় নিয়ে তীর্থ তার ফেলে আসা বোনের কথা ভাবে, গ্রামের সেই নিখোঁজ শিশুদের কথা ভাবে, আর বুঝতে পারে—এ কেবল ভৌতিক ঘটনা নয়, এ এক প্রজন্মের ভুল, যারা প্রকৃতিকে অবহেলা করেছিল, কাদার নিচে লুকানো শোক আর রাগকে অস্বীকার করেছিল। শেষ মুহূর্তে, বিদ্যুতের ঝলকে দেখা যায়, কাদার মানুষের মুখে একটুও দয়া নেই, কেবল চিরন্তন এক প্রতিশোধের নীরব প্রতিজ্ঞা। গল্প শেষ হয় না, বরং নতুন করে শুরু হয়—কারণ ‘কাদার মানুষ’ কেবল লোককথা নয়, সে এক অভিশাপ, যা জেগে আছে যতদিন মানুষ প্রকৃতিকে ভুলে যাবে।

***

1000046364.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *