Bangla - ভূতের গল্প

কাঠের পুতুল

Spread the love

দর্শনা চক্রবর্তী


অধ্যায় ১:

শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে, উত্তর কলকাতার এক নিঃসঙ্গ গলির শেষে দাঁড়িয়ে ছিল পুরোনো এক বাগানবাড়ি—চুন খসা দেয়াল, উঁচু উঁচু কাঠের জানালা, আর চারপাশে পরিত্যক্ত উদ্যান যেন সময়ের ভারে অবনত হয়ে পড়েছিল। এই বাড়িটিই ছিল ঈশিতার ঠাকুরদার পৈত্রিক বাসভবন, যেখানে বহু বছর পর গ্রীষ্মের ছুটিতে মা-বাবার সঙ্গে ঘুরতে এসেছিল সে। ঈশিতা তখন আট বছরের মেয়ে—চঞ্চল, কৌতূহলী, আর কল্পনাপ্রবণ। শহরের অ্যাপার্টমেন্টের বন্দি জীবন থেকে বেরিয়ে এমন অজস্র ঘর-বেড়া, অন্ধকার করিডর আর বিশাল উঠোনে এসে তার চোখ জ্বলে উঠেছিল। বাড়ির এক কোনায় ছিল এক লাল টালির ছাতবাড়ি, যেটা আগে নাকি গুদামঘর হিসেবে ব্যবহার হতো। ঘরের দরজাটা আধখোলা পড়ে ছিল—ধুলোময় পরিবেশে হাঁপাতে হাঁপাতে ঈশিতা ঢুকে পড়ে ভেতরে, আর তখনই তার চোখে পড়ে একটি কাঠের পুতুল। পুতুলটি ছিল প্রায় এক ফুট লম্বা, হাতে তৈরি কাঠের গড়নে। মুখটা কেমন যেন নিখুঁতভাবে আঁকা—চোখদুটো বড়, গভীর, যেন তাকিয়ে আছে ঈশিতার আত্মার ভেতর দিয়ে। তার লাল ফ্রক, সোনালি আঁচড়ানো চুল, আর হাতে বাঁধা এক পুরোনো ফিতে—সবকিছুতেই যেন ছিল এক অদ্ভুত, অন্যরকম নান্দনিকতা। ঈশিতা পুতুলটিকে হাতে তুলে নেয়, আর অনুভব করে—এই পুতুলটা যেন তাকে ডাকছিল, একটা টান ছিল তার ভিতর থেকে।

ঈশিতা পুতুলটি নিয়ে ফিরে আসে মেইন বাড়ির ঘরে, মাকে বলে, “মা, দেখো কী পেয়েছি!” মা চমকে উঠে বলে, “ওটা কোথায় পেয়েছিস রে?” ঈশিতা বলে, “নিচতলার গুদামঘরে।” মা হালকা বিরক্ত গলায় বলে, “ও ঘরটায় যেতে নেই তো তোকে বলেছিলাম।” কিন্তু ঈশিতার চোখ তখন পুতুলের চোখের দিকে—সে যেন কেমন হিপনোটাইজড হয়ে গেছে। পুতুলটির নাম সে নিজেই রাখে—“এলিজাবেথ”—যদিও সে ঠিক জানে না নামটা তার মাথায় এল কীভাবে। সেই রাতে, খাওয়াদাওয়ার পর ঈশিতা ঘুমোতে যায় মায়ের সঙ্গে একই খাটে। পুতুলটিকে বালিশের পাশে রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু মাঝরাতে, ঘুমের মধ্যেই সে অনুভব করে পুতুলটা নড়ে উঠছে। চোয়াল যেন হালকা কাঁপছে, আর চোখদুটো তাকিয়ে আছে তার দিকেই—চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায়, এলিজাবেথ তার নাম নিচ্ছে কানে কানে। সে ভয়ে ঘুম থেকে উঠে বসে পড়ে, দেখে—পুতুলটা বিছানার সেই জায়গায় নেই, বরং খাটের নিচে পড়ে আছে কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিমায়, যেন ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ নামিয়ে রেখেছে।

পরদিন সকালে মা-বাবা ব্যস্ত হয়ে পড়ে পুরনো জিনিসপত্র গোছাতে, আর ঈশিতা আবার পুতুল নিয়ে ঘোরাঘুরি শুরু করে বাড়ির চারপাশে। দুলাল কাকা, বাড়ির পুরনো দেখভালকারী, একদিন হঠাৎ পুতুলটি দেখে মুখটা পাথরের মতো করে তোলে। কাঁপা গলায় বলে, “এই পুতুলটা আবার কোথা থেকে এল মা?” ঈশিতা বলে, “আমি পেয়েছি নিচতলায়। নাম দিয়েছি এলিজাবেথ।” তখন দুলাল কাকার মুখ দেখে বোঝা যায়, এই নামটা তার ভেতর এক পুরোনো ভয় জাগিয়ে তুলেছে। সে বলে, “এই নাম এই বাড়িতে আবার… ও ঘরটা খোলা ছিল?” দুলাল কাকা তড়াক করে উঠে বলেন, “মাসিমাকে বলি। এই পুতুলটা ভালো না, মা।” মা অবশ্য পাত্তা দেয় না—ভেবে নেয় হয়তো দুলাল কাকার অলীক ভয়। কিন্তু ঈশিতা বুঝতে পারে—পুতুলটি তার সঙ্গে কথা বলে। কখনো সে শোনে এক ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টে উচ্চারণিত “Come play with me”, কখনো আবার হঠাৎ চোখের কোণে দেখতে পায় পুতুলটা নিজে থেকে নড়ে উঠছে, তারপর আবার আগের জায়গায় চলে যাচ্ছে—এক রহস্যময় চক্রের মতো।

বিকেল গড়াতে গড়াতে বাড়ির পেছনের দিকটা অন্বেষণ করতে করতে ঈশিতা গিয়ে পড়ে এক জরাজীর্ণ কাঠের দরজার সামনে। দরজাটা বন্ধ, কিন্তু তালা নেই—মাথার ওপর শিকল ঝুলছে, মনে হয় একসময় সেটা ছিল, এখন খুলে রাখা। সে ঢুকে পড়ে ভেতরে, আর দেখে, একটা অদ্ভুত কক্ষ। দেয়ালে পুরনো তেলের চিত্র, মেঝেতে ছাইয়ের দাগ, আর মাঝখানে একটি কাঁচের বক্স, যেখানে রাখা আছে ছোট একটি জামা—একটা ব্রিটিশ স্টাইলের শিশুর পোশাক। সেই পোশাকের ওপর খোদাই করে লেখা: “E. Ashcroft. 1889.” ঈশিতা নামটা জোরে পড়ে—আর তখনই পুতুলটা তার কোলের মধ্যে নিজে থেকে কেঁপে ওঠে, আর ভেতর থেকে যেন আওয়াজ আসে, “You found me.” সে ভয়ে ছিটকে পড়ে যায় পেছনে, পেছনে দরজাটা বন্ধ হয়ে যায় নিজে থেকেই, আর ঘরের ভেতর একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু করে। ঈশিতা তখনও জানে না—তার খেলা শুধু একটা কাঠের পুতুলকে নিয়ে নয়, বরং এক শতাব্দী পুরোনো অভিশাপের বিরুদ্ধে, যার কেন্দ্রবিন্দু সেই নিষ্পাপ মুখওয়ালা এলিজাবেথ নামের কাঠের পুতুল।

অধ্যায় ২:

ঈশিতা সেই রাতে ঘুমাতে গিয়ে অস্বস্তি অনুভব করেছিল। পুতুলটা বিছানার পাশে বসিয়ে রাখলেও বারবার মনে হচ্ছিল, এলিজাবেথ তার দিকে তাকিয়ে আছে—চোখে চোখ পড়লেই যেন ভেতরটা হিম হয়ে আসে। মায়ের কোলে শুয়ে শুয়ে সে ঘুমানোর চেষ্টা করে, কিন্তু প্রতিবার চোখ বন্ধ করলেই এক অপরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পায়—মৃদু, শিশুসুলভ, অথচ কেমন গম্ভীর ও নির্দেশমূলক: “My name is Elizabeth. Say it.” ঈশিতা প্রথমে ভয় পেয়ে যায়, কিন্তু ধীরে ধীরে কণ্ঠটা যেন তার মনে মিশে যায়, যেন সে-ই এই কণ্ঠের ভেতরে আশ্রয় নিতে চায়। পরদিন সকালবেলা নাস্তার সময় মা জিজ্ঞেস করেন, “তুই আবার পুতুলটাকে ঘুমোতে নিচিস কেন?” ঈশিতা উত্তর দেয়, “ও একা থাকতে ভয় পায় মা।” মা হেসে উড়িয়ে দেয় কথাটা, কিন্তু দুলাল কাকা টেবিল পরিষ্কার করতে করতে বলে, “বাচ্চাদের খেলনা বড়দের নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করলে বুঝতে হবে ও খেলনা আর খেলনা নেই।” মা বিরক্ত হয়ে বলেন, “আবার পুরনো সব কথা টানছ দুলাল?” কিন্তু কাকার চোখ তখন এলিজাবেথের দিকে—যেন তার মনে পড়ছে অনেক পুরনো এক ঘটনা।

ঈশিতা সেদিন একা একা খেলার সময় পুতুলটির সঙ্গে কথাবার্তা বলতে শুরু করে। সে বলে, “তুমি কথা বলতে পারো?” পুতুলটি তো মুখ খোলে না, কিন্তু ঈশিতা যেন শুনতে পায় মনের মধ্যে গুঞ্জন—“তুমি আমাকে খুঁজে পেয়েছ। এখন আমি আবার জন্ম নিতে পারব।” ঈশিতা বলে, “তুমি কে?” আর সেই মুহূর্তে সে দেখে ঘরের কোণে রাখা আয়নার মধ্যে নিজের প্রতিবিম্ব নয়, বরং একটি সোনালি চুলওয়ালা ইংরেজ মেয়েকে—লাল জামা পরা, হাতে ছোট টেডি বিয়ার, দাঁড়িয়ে আছে। চমকে গিয়ে সে পেছনে তাকায়—ঘরে কেউ নেই। আবার আয়নার দিকে তাকায়, এবার সেখানে সে নিজেকেই দেখে, কিন্তু তার চোখের চাহনি অন্যরকম—কঠিন, ঠাণ্ডা। সে বুঝতে পারে, কিছু একটা তার মাথার মধ্যে ঢুকে পড়ছে, ধীরে ধীরে, নরম করে, যেন হাওয়ার মতো—কিন্তু সেটাই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর।

বাড়ির পেছনের ছোট্ট লাইব্রেরি ঘরে সন্ধ্যার আলোয় মায়ের পুরনো ডায়েরি পড়তে পড়তে ঈশিতা খুঁজে পায় একটি নোট—সেখানে লেখা, “১৮৯০ সালে এই বাড়িতে এক ব্রিটিশ পরিবার থাকত, মেয়েটির নাম ছিল এলিজাবেথ অ্যাশক্রফট। মেয়েটি হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায় এক পূর্ণিমার রাতে, তারপর সেই ঘরটিকে তালা মেরে বন্ধ রাখা হয়। কেউ বলে সে আত্মহত্যা করেছিল, কেউ বলে তাকে বলি দেওয়া হয়েছিল কালীপূজার রাতে। কিন্তু কেউ জানে না ওর পুতুলটা কোথায় গেল।” ঈশিতা কাঁপতে কাঁপতে ডায়েরি বন্ধ করে দেয়। তখন বাইরে ঝড় শুরু হয়ে গেছে, জানালায় বাতাস ধাক্কা দিচ্ছে, আর তার পায়ের কাছে বসে থাকা এলিজাবেথ—পুতুলটির মুখে ফুটে উঠেছে এক হালকা, নিঃশব্দ হাসি, যা সে আগেও দেখেনি।

রাত বাড়ে। মেঝেতে কাঁথা পেতে শুয়ে মা মেয়েকে ঘুম পাড়াচ্ছেন, কিন্তু ঈশিতার ঘুম আসছে না। সে চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাচ্ছে—পুরনো সেই গুদামঘর, মেঝেতে আঁকা এক বৃত্তের ভেতর একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর তাকে ঘিরে ঘোরাফেরা করছে পুতুলের মত দেখতে আরও অদ্ভুত মুখ—মাটির তৈরি মুখ, কাঠের চোখ, কেউ হেসে উঠছে, কেউ কাঁদছে, কেউ ফিসফিস করে বলছে, “She’s the one.” হঠাৎ চমকে উঠে ঈশিতা ঘুম ভেঙে দেখে—পুতুলটা নেই! সে উঠে পড়ে ঘরের চারদিকে খুঁজে দেখে—এলিজাবেথ আর বিছানায় নেই। জানালার পাশে রাখা একটি ছোট্ট চেয়ার থেকে অদ্ভুতভাবে পড়ে গেছে একটা ফুলদানী, আর তার পাশেই পড়ে আছে কাঠের একটি ছোট হাত, পুতুলের। তার ওপর লেখা ছোট অক্ষরে, পেন্সিলের দাগে—“Return me to the circle.” সেই মুহূর্তে ঈশিতা বোঝে—এটা আর খেলা নয়। এলিজাবেথ তাকে ব্যবহার করছে। কোনো এক অনন্ত পরিকল্পনার অংশ সে হয়ে উঠেছে, আর এখন তার সামনে দু’টি পথ—পুতুলকে ফিরিয়ে দেওয়া, বা নিজের শরীর দিয়ে অন্য কারোর জন্ম ঘটানো।

অধ্যায় ৩:

পরদিন সকালে ঈশিতা যেন ঘুম থেকে জেগে ওঠে এক ঘোরের মধ্যে। সে ঠিক করে উঠতে পারে না—গতরাতের ঘটনাগুলো স্বপ্ন ছিল নাকি বাস্তব। বিছানার পাশ থেকে পুতুলটি আবার ফিরে এসেছে তার জায়গায়, তার মুখে সেই একই নীরব, অথচ বিদ্রুপে ভরা হাসি। ঈশিতা এবার আর কাউকে কিছু বলে না। তার ভিতরে এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠছে, ঠিক যেমন কেউ ধীরে ধীরে অপরিচিত কোনো অস্তিত্বের প্রভাবে নিজের চেতনার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে। সে জানে, এলিজাবেথ কেবল একটি পুতুল নয়, সে একটা আত্মা—আর সেই আত্মা তাকে কিছু করতে চাইছে। দুপুরবেলা, দুলাল কাকা যখন পুরোনো লাইব্রেরির জানালা পরিষ্কার করছেন, ঈশিতা হঠাৎ বলে ওঠে, “এই বাড়িতে আগে একজন মেয়ে থাকত, না কাকা?” দুলাল কাকা চমকে তাকিয়ে বলে, “কী বললি?” সে জবাবে বলে, “লাল জামা পরা, সোনালি চুলের মেয়ে। ওর একটা পুতুল ছিল। নাম ছিল এলিজাবেথ।” দুলাল কাকা স্থির হয়ে যায়। চোখের পাতা কাঁপতে থাকে। সে নিচু গলায় বলে, “এই নাম তোর মাথায় এলো কীভাবে মা?” ঈশিতা হাসে—একটা ঠাণ্ডা, অচেনা হাসি—আর বলে, “ও বলেছে আমায়।”

ঐ দিন বিকেলে, বারান্দার কর্ণারে টাঙানো একটি পুরোনো ফটো ফ্রেম হঠাৎ ঈশিতার চোখে পড়ে। ধুলোয় ঢাকা, প্রায় অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া সেই ফ্রেমে দেখা যাচ্ছে এক ব্রিটিশ পরিবার—একজন ভদ্রলোক, পাশে তার স্ত্রী, আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক শিশু কন্যা। তার চোখদুটো পরিচিত। ঈশিতা নিশ্চিত—এ সেই মেয়ে, যাকে সে আয়নায় দেখেছে। সে ফ্রেমটা মুছে পরিষ্কার করে দেখে, নিচে লেখা আছে “The Ashcrofts – 1887, Calcutta”. তার মাথায় ঝড় বয়ে যায়—এই মেয়েটিই কি এলিজাবেথ? তখনই সে দেখে ছবির এক কোণে, কাচের নিচে কেমন যেন একটা দাগ—মাঝখানে কালো ছোপ, যেন আগুনে পুড়ে যাওয়া কিছুর ছাপ। সে ছবিটা দেয়াল থেকে খুলে নিয়ে নিজের ঘরে এনে রাখে। ঠিক তখনই পেছনে মৃদু শব্দ হয়, সে ঘুরে দেখে—পুতুলটি চেয়ার থেকে নিজে থেকে পড়ে গেছে। এবং তার বাঁ চোখের নিচে আঁকা দাগটা কিছুটা মুছে গিয়ে, উঁকি দিচ্ছে কিছু চিহ্ন—যা দেখতে অনেকটা রোমান লিপির মতো। সে বুঝতে পারে—ছবির ভেতরে, কিংবা ফ্রেমের আড়ালে লুকিয়ে আছে আরও কিছু।

রাতে আবার শুরু হয় কল্পনাজনিত না বাস্তব—তা বোঝা যায় না এমন কিছু ঘটনা। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে পড়লেও, বারবার মনে হচ্ছিল ছবির ফ্রেম থেকে কেউ তাকিয়ে আছে। এমনকি মাঝে মাঝে করিডরের ভেতরে ছোট ছোট পায়ের শব্দ শোনা যায়—টুপটাপ করে দৌড়চলা, যেন কোন শিশু অদৃশ্যভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঈশিতা একসময় উঠে ফ্রেমটা আবার খোলে—এবং দেখে, ফ্রেমের কাঠের পেছনের দিকটা একটু উঁচু হয়ে আছে। নখ দিয়ে খুঁটিয়ে তুলতেই বেরিয়ে আসে একটা মোটা হলুদ কাগজ—পুরোনো ইংরেজি হস্তাক্ষরে লেখা: “She must return. Before the moon turns red.” ঈশিতা তখনই বুঝে যায়—পূর্ণিমার রাতে কিছু একটা ঘটবে, আর সেই ঘটনার আগে পুতুলটিকে ফিরিয়ে দিতে হবে সেই রহস্যময় চক্রের মধ্যে। কিন্তু কোথায় সেই চক্র? আর কীভাবে ফিরিয়ে দেবে সে পুতুলটিকে? ঠিক তখনই পুতুলটির মুখ আবার জ্বলজ্বল করে ওঠে, আর সে প্রথমবার অনুভব করে—পুতুলটি শ্বাস নিচ্ছে। ধীরে, ভারী ভারী নিঃশ্বাস। এলিজাবেথ এখন শুধু তার ভাবনায় নয়, বরং তার ঘরের হাওয়ার মধ্যেই মিশে গেছে।

সেই রাতে, মা যখন রান্নাঘরে, তখন ঈশিতা একা বসে ছবি ও নোট নিয়ে বসে। এক জায়গায় সে দেখতে পায় কাগজে আঁকা একটি প্রতীক—মাটির ওপর আঁকার মতো একটি মায়াবী চক্র, যার চারপাশে লেখা কিছু শব্দ: “Circulus transitus. Possessio parata.” সে শব্দের অর্থ বোঝে না, কিন্তু পুতুলটা যেন বুঝতে পারে। তার ডান হাতটা নিজের থেকে পুতুলের শরীরের ওপর ছন্দে ছন্দে নড়তে থাকে—ঠিক যেমন কাউকে মন্ত্র শেখানো হয়, অথবা কাউকে দিয়ে কিছু লিখিয়ে নেওয়া হয়। ঈশিতা একরকম ঘোরের মধ্যে বলে ওঠে, “তুমি কি আমায় দিয়ে কিছু করতে চাও, এলিজাবেথ?” আর তখনই পুতুলটা প্রথমবার চোখের পাতা বন্ধ করে—ক্লান্ত, পরিতৃপ্ত অভিব্যক্তি নিয়ে, যেন সে অপেক্ষা করছে শতবর্ষ ধরে, শুধুমাত্র এমন এক মেয়ের জন্য, যে তার হয়ে আবার ফিরে আসতে দেবে পৃথিবীতে।

অধ্যায় ৪:

বাড়ির আকাশে ধীরে ধীরে জমতে থাকে পূর্ণিমার আলো—সোনালি, ঝলমলে, অথচ যেন এক চাপা আশঙ্কার পর্দা বিছিয়ে দেয় চারদিকের ওপর। ঈশিতা এখন আর আগের মতো নেই। সে শান্ত, মৃদু হাসে, মা যা বলে শোনে, কিন্তু মাঝে মাঝে নিজেই কেমন হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে—যেন কাউকে দেখছে, কথা বলছে। মায়ের চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ—সে ভাবে হয়তো নতুন পরিবেশ, পুরোনো বাড়ির ভৌতিক গন্ধ আর অতিরিক্ত কল্পনার কারণেই মেয়ে এমন করছে। কিন্তু ঈশিতার মধ্যে দিন কয়েকের মধ্যেই এমন এক পরিবর্তন এসেছে যা কেবল মা নয়, দুলাল কাকাও টের পায়। সে এক বিকেলে সাহস করে বলে, “দিদি, বাচ্চাটার চোখে এখন কিছু কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে, যেন নিজের মধ্যে নেই ও।” মা বিরক্ত হয়ে বলেন, “তুমি সবকিছুতেই ভয় পাও দুলাল। পুরোনো বাড়িতে কিছুটা অস্বস্তি হতেই পারে।” কিন্তু দুলাল কাকা চুপ করে, তারপর নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে খুঁজে বার করে একটি ছোটো রূপোর নকশা করা পেন্ডেন্ট—মাঝখানে কালো পাথরের একটি চিহ্ন। সে জানে, এই চিহ্ন দেওয়া তাবিজ তার ঠাকুরদার হাতে এক সময় পাওয়া গিয়েছিল, সেই ইংরেজদের আমলে, যখন অ্যাশক্রফটদের মেয়েটি নিখোঁজ হয়েছিল এই একই বাড়িতে। দুলাল পেন্ডেন্টটা এনে গোপনে ঈশিতার পড়ার টেবিলের ওপর রেখে আসে—কিছু না বলে, শুধু চোখে গভীর ভয় নিয়ে।

ঈশিতা সেদিন রাতেই প্রথম অনুভব করে এক ব্যথা—তার মাথার ভেতর যেন দুটো কণ্ঠস্বর যুদ্ধ করছে। একটায় তার নিজের কণ্ঠ—নিরীহ, বালিকাসুলভ, ভয় পেয়ে কাঁপছে; অন্যটায় এলিজাবেথের কণ্ঠ—ঠাণ্ডা, দৃঢ়, স্পষ্ট। সে বলে, “We are not separate anymore. You are me.” ঈশিতা আয়নায় নিজের দিকে তাকায়, দেখে তার চোখের তারা ধীরে ধীরে লালচে হয়ে উঠছে, আর তার কপালে যেন অদৃশ্য ছায়া হয়ে ভেসে উঠছে সেই প্রতীকটি—Circulus Transitus। সে বুঝতে পারে, সময় শেষ হয়ে আসছে। সে উঠে গিয়ে পেন্ডেন্টটি তুলে নেয়—আর তখনই এক বিদ্যুৎচমক এসে পড়ে টেবিলের ওপর, ঘরের বাতি নিভে যায়, জানালার পর্দা উড়ে উঠে ধাক্কা খায় আয়নায়। আয়নার গায়ে আঁকা জলছবির মতো ঝাপসা হয়ে ভেসে ওঠে এলিজাবেথের মুখ—সে তাকিয়ে আছে ঈশিতার চোখের দিকে। বলে, “The moon is coming. You know what to do.” তখন ঈশিতা প্রথমবার ভয় না পেয়ে বলে, “তুমি আমায় ব্যবহার করতে চাও?” এলিজাবেথের কণ্ঠ সাড়া দেয়, “No. I want to be you.”

বাড়ির বাতাস যেন ভারী হয়ে আসে। উঠোনে বৃষ্টির গন্ধ ছাড়া বৃষ্টি পড়ে না। পুরোনো বাড়ির করিডরগুলোতে হঠাৎ হঠাৎ টেবিল দুলে ওঠে, দেয়ালের ওপর ছায়া নড়ে, আর পেছন থেকে শোনা যায় পায়ের শব্দ—কেউ হাঁটছে না, যেন ভাসছে। মা বুঝতে পারে, কিছু একটা ঠিকঠাক নেই। সেই রাতে, মা ঈশিতাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোতে চেষ্টা করে, কিন্তু মেয়ের শরীর স্পষ্টতই ঠাণ্ডা—নিউরোলোজিকালি নয়, বরং অদ্ভুতভাবে, প্রাণহীন ঠাণ্ডা। মাঝরাতে মা ঘুম ভেঙে দেখে ঈশিতা উঠে পড়েছে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। মা ছুটে গিয়ে বলে, “তুই এখানে কী করছিস?” ঈশিতা বলে, “ও আমাকে ডাকছে। বলছে পূর্ণিমার রাতে সব ঠিক হয়ে যাবে।” মা ভয় পেয়ে যায়—ঈশিতা আগেও ঘুমের ঘোরে হাঁটত, কিন্তু আজকের মতো গভীর, স্থির, এবং অচেনা সে আগে কখনো হয়নি। মা তাকে টেনে বিছানায় নিয়ে আসে, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, কিন্তু তার মনে বারবার ভেসে ওঠে মেয়ের মুখে এলিজাবেথের ছায়া।

এদিকে দুলাল কাকা, নিজের ঘরের পুরোনো ডায়রি বের করে পড়ে। সে খুঁজে পায় এক পাতায় লেখা: “পূর্বপুরুষদের মতে, শিশুর মন সহজে ধরা পড়ে। যারা অতৃপ্ত, যারা জন্ম চায়, তারাই বেছে নেয় শিশুদের শরীর। সেই জন্ম হয় না মায়ের গর্ভে—হয় পূর্ণিমার রাতে, আত্মা যখন নতুন শরীর চায়।” তার হাতে কাঁপুনি ধরে। সে জানে, যদি পূর্ণিমা পার হয়, তাহলে আর ফেরা যাবে না। এলিজাবেথ কেবল শরীর চাইছে না, চাইছে এক নতুন জন্ম, আর ঈশিতা হয়ে উঠছে সেই অবয়ব। ঘড়ির কাঁটা তখন বলে, রাত বারোটা। চাঁদ ওঠার আর মাত্র এক দিন বাকি।

অধ্যায় ৫:

দিনটা ছিল শুক্রবার। সকাল থেকেই বাড়ির বাতাস ভারী লাগছিল। পাখিরা জানালার কাছে এসে বসেও দ্রুত উড়ে যাচ্ছে, যেন কিছু একটা এড়িয়ে চলতে চাইছে। ঈশিতা একা বসে ছিল লাইব্রেরির ঘরে, পায়ের কাছে বসে ছিল এলিজাবেথ। পুতুলটা এখন কেমন যেন আলাদা—আগে কাঠের হলেও এখন তা যেন মাংস-মজ্জায় তৈরি, ছোঁয়া দিলে নড়েচড়ে ওঠে, আর মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস নেয়ার শব্দ শোনা যায়। ঈশিতা একটা খাতা খুলে সেই চিহ্নটি আঁকছিল—Circulus Transitus—যা সে আগের রাতে স্বপ্নে দেখেছে। বারবার আঁকছে, আবার কেটে দিচ্ছে, আবার আঁকছে। সে বুঝতে পারছে না, এটা সে করছে নিজের ইচ্ছেতে না এলিজাবেথের নির্দেশে। ঠিক তখনই দুলাল কাকা ঘরে ঢোকে, তার হাতে সেই রূপোর পেন্ডেন্ট। ঈশিতা বলে, “তুমি কি ভয় পাচ্ছো কাকা?” দুলাল কাকা ধীরে বলে, “ভয় পাচ্ছি না, রক্ষা করতে চাই।” সে ঈশিতার গলায় তাবিজটি পরিয়ে দেয়। ঈশিতা প্রথমে বাধা দিতে চায়, কিন্তু এক মুহূর্তে তার শরীর কেঁপে ওঠে—পুতুলটা মেঝেতে ছিটকে পড়ে, এবং তার শরীর থেকে বেরিয়ে আসে হালকা ধোঁয়ার মতো একটি ছায়া, যা সোজা চলে যায় জানালার বাইরে। দুলাল কাকা চমকে যায়। ঈশিতা পড়ে যায় মাটিতে, কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরেই সে আবার উঠে দাঁড়ায়। তার চোখে জল, মুখে ক্লান্তি—এবং কণ্ঠস্বর সম্পূর্ণ নিজের। “আমি কোথায় ছিলাম এতক্ষণ?” বলে সে।

তবে বিষয়টা এখানেই শেষ হয় না। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাস আরও ভারী হয়ে ওঠে। মেঘমুক্ত আকাশে একটি অস্বাভাবিক বিশাল চাঁদ উঠছে—আংশিক লালাভ। মা তখন রান্নাঘরে, হঠাৎ তার কানে আসে ঘরের ভেতর থেকে ঈশিতার গলার গান—একটা ইংরেজি নার্সারি রাইম, যা সে কখনো শেখায়নি। মা অবাক হয়ে রান্না ফেলে ঘরে ছুটে যায়—দেখে, ঈশিতা আবার বিছানায় পুতুলটা নিয়ে বসে আছে, চোখ দুটো উলটে গেছে, আর সে গাইছে—“Ring around the roses, pocket full of posies…”। মা ভয়ে জড়িয়ে ধরে মেয়েকে, কিন্তু তখনই পুতুলটা নিজে থেকে উঠে পড়ে, এবং দেয়ালের দিকে হেঁটে যায়—না, হেঁটে নয়, যেন মেঝের ওপর ভেসে ভেসে চলছে। মা চিৎকার করে ওঠে। দুলাল কাকা ছুটে আসে, কিন্তু এলিজাবেথ আবার ঈশিতার দিকে ফিরে আসে, এবং তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলে, “The circle must be drawn.”

এরপরের কয়েক ঘণ্টা যেন অস্পষ্ট, স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্নের মাঝামাঝি। ঈশিতাকে রাখা হয় ঘরের মধ্যেই, দরজা বন্ধ করে। বাইরে দুলাল কাকা খুঁজে বার করে সেই পুরোনো চক্রটি আঁকার নির্দেশ—এক ধরণের রক্ষাকবচ, যা আত্মার আবেশ থামাতে পারে। চুন, লাল রঙ ও তামার গুঁড়ো দিয়ে আঁকা হয় সেই চক্র, বাড়ির পেছনের উঠোনে। চারপাশে দেওয়া হয় প্রদীপ, লবণ, আর পেন্ডেন্টটির প্রতিরক্ষামূলক ছায়া। ঠিক রাত বারোটায়, ঈশিতা নিজে থেকেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তার মুখে কোনও অনুভূতি নেই, পায়ের শব্দ নেই, আর চোখে স্পষ্ট লাল ছোপ। সে এসে দাঁড়ায় চক্রের মাঝখানে। দুলাল কাকা তখন মন্ত্র পাঠ শুরু করে—অপরিচিত এক ভাষায়, যা সে শিখেছিল তার ঠাকুরদার কাছ থেকে। তখনই আকাশ কালো হয়ে যায়, বিদ্যুৎ চমকায়, আর পুতুলটি নিজেই চক্রের বাইরে পড়ে যায়। কিন্তু যতই মন্ত্র চলতে থাকে, ঈশিতা হঠাৎ কাঁপতে থাকে, শরীর থেকে বেরিয়ে আসে এক ছায়া—মেয়েটির ছায়া—সোনালি চুল, লাল জামা, আর সেই চিরচেনা চোখ। সে বলে ওঠে, “This is my circle. You cannot stop what was promised!”

চক্রের শক্তিতে বাধা পেয়ে ছায়াটি গুঁড়িয়ে যেতে থাকে। এলিজাবেথ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। তার শরীর ছিঁড়ে যাচ্ছে আলোয়, চোখের তারা গলে যাচ্ছে আগুনে। ঈশিতা কাঁদতে কাঁদতে পড়ে যায় চক্রের মধ্যেই। শেষ মুহূর্তে, ছায়াটি বলে, “I will come back. I always do.” এবং সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের বাতি নিভে যায়, সব কিছু থেমে যায়। নিঃস্তব্ধতা। তারপর ধীরে ধীরে ঈশিতা উঠে বসে, নিঃশ্বাস নেয়। সে দেখে, তার হাত আবার নিজের হয়েছে। পুতুলটি এখন নিশ্চল, কাঠের, প্রাণহীন—যেমন ছিল শুরুতে। মা এসে জড়িয়ে ধরে ঈশিতাকে, আর দুলাল কাকা একপাশে বসে থাকে, নিঃশব্দে, যেন জানে—এই যুদ্ধ শেষ হলেও গল্পটা এখানেই শেষ নয়।

অধ্যায় ৬:

পরদিন সকালটা আশ্চর্যরকম স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। উঠোনে রোদ এসে পড়েছে, মেঘমুক্ত আকাশে শালিকেরা উড়ে বেড়াচ্ছে, আর বাড়ির বাতাসে নেই কোনো অশরীরী ভার। ঈশিতা ঘুম থেকে উঠে দেখে—তার শরীর হালকা লাগছে, মাথায় কোনো গুমোট ভাব নেই, যেন অনেকদিন পর একটা ক্লান্তির অবসান ঘটেছে। মা বারান্দায় বসে চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, আর চোখেমুখে সেই শঙ্কা আর ক্লান্তির চিহ্ন, যা একজন মা বয়ে বেড়ান রাতভর সন্তানের পাশে জেগে থেকে। ঈশিতা এসে মায়ের কোলে মাথা রাখে। তারা কিছু বলে না। দু’জনেই জানে—কিছু একটা ভয়ংকর পেরিয়ে এসেছে তারা, যদিও তার নাম দেওয়া যায় না, সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। দুলাল কাকা চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তার চোখে-মুখে সতর্কতা। ঈশিতা ধীরে জিজ্ঞেস করে, “পুতুলটা কোথায় কাকা?” দুলাল চুপ করে থাকে। কিছুক্ষণ পরে বলে, “তোর ঘর থেকে খুঁজে পাচ্ছি না। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।”

এই উত্তরের পরপরই বাড়ির মধ্যে আবার এক অস্বস্তিকর বাতাবরণ তৈরি হয়। পুতুলটা কোথায় গেল? সেই পুতুল যাকে ঘিরে এতটা অন্ধকার ঘনীভূত হয়েছিল, যাকে আটকে রাখতে হয়েছিল মন্ত্র, যাকে প্রতিরোধ করতে হয়েছিল আত্মার চক্র দিয়ে—সে কীভাবে নিজে থেকে হারিয়ে গেল? দুলাল কাকা বাড়ির প্রতিটি ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখে। বিছানার নিচ, আলমারির পেছন, ছাদের ঘর, এমনকি বাগানের আগাছার মধ্যেও। কিন্তু কোথাও নেই পুতুল। শুধু একটি জিনিস পাওয়া যায় ঈশিতার পড়ার টেবিলে—একটি ছোট্ট চিঠি, ইংরেজিতে লেখা—“Not lost. Only waiting. For the next child.” এই চিঠিটি কোথা থেকে এল, কে লিখল, কিছুই বোঝা যায় না। কাগজের ধরন দেখে মনে হয় শতাব্দী প্রাচীন, কিন্তু কালি একেবারে টাটকা। মা সেটা পড়ে আঁতকে ওঠে, দুলাল কাকার হাত থেকে চিঠিটা ছিটকে পড়ে যায় মেঝেতে। ঈশিতা কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর ধীরে বলে, “ও চলে গেছে। তবে আবার আসবে। আমি জানি।”

এরপরের কয়েকটা দিন চলতে থাকে আতঙ্ক আর আশার মিশ্র অনুভূতির মধ্যে। ঈশিতা আগের মতোই স্কুলে যায়, হাসে, খেলাধুলা করে। কিন্তু তার কিছু অভ্যাস বদলে যায়—সে এখন আয়নার সামনে খুব কম দাঁড়ায়, রাতে একা ঘুমাতে চায় না, এবং মাঝে মাঝে হঠাৎ থেমে গিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্যে। মা চেষ্টা করেন সব কিছু স্বাভাবিক রাখতে, তাকে নিয়ে বেড়াতে যান, নতুন পুতুল কিনে দেন, কিন্তু ঈশিতা আর কোন পুতুল স্পর্শ করতে চায় না। একদিন মা তার সামনে একটি সাদা তুলোর পুতুল রাখেন, কিন্তু ঈশিতা শুধু তাকিয়ে বলে, “ওর চোখ নেই। তাই ও দেখতে পাবে না। কিন্তু এলিজাবেথ দেখত সব।” মা আর কথা বাড়ান না। দুলাল কাকা সিদ্ধান্ত নেন, বাড়ির পিছনের সেই চক্র আবার মাটি দিয়ে ঢেকে দেবেন। কিন্তু যখন গিয়ে দেখেন, সেই চক্র আপনাআপনি মিশে গেছে মাটির সঙ্গে, ঠিক যেন কখনো আঁকাই হয়নি। সে জানে—এ কোন সাধারণ ছাপ নয়, আত্মার অস্তিত্ব মুছে গেলেও তার ছায়া থেকে যায়।

এর এক সপ্তাহ পর, পাড়ারই একটি ঘরে নতুন পরিবার ভাড়া আসে। স্বামী-স্ত্রী ও তাদের তিন বছরের ছোট্ট মেয়ে। ঈশিতা একদিন দূর থেকে দেখে মেয়েটিকে—হাতে একটি লাল ফ্রক, মাথায় দুই চুলে ব্যান্ড। তারা যখন সিঁড়ি দিয়ে উঠছে, ছোট্ট মেয়েটি হঠাৎ থেমে দাঁড়িয়ে নিচে পড়ে থাকা কিছু একটা তুলে নেয়—একটা ছোট কাঠের পুতুল, যেটার গায়ে সাদা পোশাক, আর চোখে একরকম নিষ্পাপ দৃষ্টি। সে পুতুলটা জড়িয়ে ধরে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “Look, Ma. She has a name. She told me it’s Elizabeth.” মা হেসে বলে, “That’s a pretty name, sweetie.” ঈশিতা তখন জানালার পাশ থেকে সবটা দেখছে। তার চোখে জল আসে না, ভয়ও নয়—শুধু এক নিঃশ্বাস দীর্ঘ সময়ের মতো বুকের ভিতর জমে থাকে। সে জানে, এই গল্প কখনো শেষ হয় না। এলিজাবেথ অপেক্ষা করে, শুধুমাত্র এক নতুন শিশুর জন্য, এক নতুন শরীরের জন্য—আর পৃথিবী তার জন্য দরজা খুলেই রাখে।

অধ্যায় ৭:

পাড়ার পুরনো বাগানবাড়ির ওপার ঘরটাতে যারা নতুন এসেছিল, তাদের মেয়েটির নাম ছিল রুহি—তিন বছর বয়স, কুঁচকে যাওয়া ফ্রক পরা, মুখে গোলগাল চেহারা আর কৌতূহলভরা চোখ। শুরুতে সবাই ভেবেছিল ও খুব শান্ত ও চুপচাপ স্বভাবের। কিন্তু আসার পরের দিন থেকেই, অদ্ভুতভাবে বদলে যেতে থাকে তার ব্যবহার। সে কথা কম বলে, খেলনা নিয়ে খেলে না, অথচ সারাদিন একটি পুতুল কোলে নিয়ে বসে থাকে—সেই পুতুল যেটা সে বাড়ির নিচে পেয়েছিল, যার মুখ কাঠের হলেও অদ্ভুতভাবে প্রাণবন্ত, এবং চোখে যেন এক চুম্বক শক্তি। রুহি প্রায় সারাদিন পুতুলটার সঙ্গে কথা বলে—কখনো হাসে, কখনো গম্ভীর হয়ে যায়, কখনো আবার নীচু গলায় কিছু ফিসফিস করে, যেন কাউকে হুকুম দিচ্ছে বা গ্রহণ করছে। প্রথম প্রথম তার মা-বাবা এটাকে শিশুসুলভ খেলা ভেবেছিলেন। কিন্তু একদিন হঠাৎ রুহির মা লক্ষ্য করেন—মেয়েটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পুতুলটা হাতে নিয়ে বলছে, “I’m ready now. Let’s play our game.” সেই কণ্ঠটা… ছিল না রুহির। সেটা ছিল যেন বড় কোনো মেয়ের, শান্ত অথচ হিমশীতল স্বরে বলা—যার প্রতিটি উচ্চারণে জড়ানো ছিল সময়ের অনেক গভীরতা।

একদিন বিকেলে, ঈশিতা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। দূরের বাগান থেকে আসছিল এক অদ্ভুত সুর—একটি ধীর লয়ের গান, যেটা সে অনেকদিন আগে শুনেছিল, এলিজাবেথের গলায়। সে ছুটে গিয়ে নিচে নামে, বাগানের ঝোপের পাশে এসে দেখে রুহি মাটির ওপর দাঁড়িয়ে হাতে পুতুল নিয়ে একই চক্র আঁকছে যা একদিন ঈশিতা নিজে এঁকেছিল অজান্তে। সেই Circulus Transitus। ঈশিতা তখন আর এক মুহূর্তও দেরি না করে ছুটে গিয়ে রুহিকে থামায়, তার হাত থেকে কাঠের পুতুলটা ছিনিয়ে নেয়। কিন্তু অবাক ব্যাপার, রুহি কাঁদে না, ভয় পায় না—বরং ঠাণ্ডা গলায় বলে, “তুমি ভয় পেয়েছো কারণ তুমি শেষ করতে দাওনি। ও এখন আমার বন্ধু। তুমি শুধু ধার নিয়েছিলে।” সেই মুহূর্তে ঈশিতা বুঝে যায়—এবার আর এলিজাবেথ কারও শরীর চাইছে না, এবার সে নিজেই চায় বন্ধু, যাকে দিয়ে নিজের ছায়াকে বাড়াতে পারবে, যেন এক আত্মার সংক্রমণ।

সেদিন রাতেই, রুহির ঘরে ঘটে এক রহস্যজনক ঘটনা। তার মা-বাবা দেখে মেয়েটা নিখোঁজ, দরজা খোলা, আর বিছানার ওপর রাখা শুধু সেই কাঠের পুতুলটা—কিন্তু এবার তার মুখে একটি হাসি আঁকা, যেটা আগে ছিল না। বাড়ির লোকজন পুলিশ ডাকে, চারদিকে তল্লাশি হয়, কিন্তু রুহির কোনও হদিস মেলে না। ঈশিতা জানত, সে কোথায় গেছে, কিন্তু কারো কিছু বলতে পারে না। তার চোখের সামনে বারবার ভেসে আসে পুতুলটা—যেটা এখন নিখোঁজ শিশুর বিছানায় পড়ে আছে, যেন কিছু রেখে গেছে—এক দৃষ্টিহীন আত্মা আরেকটা শরীরে আশ্রয় নিয়ে চলে গেছে, আর পুতুলটি রেখে গেছে পরবর্তী শিকারের অপেক্ষায়। ঈশিতা আবার তাবিজটা পরে নেয় গলায়, এবং প্রতিজ্ঞা করে—এইবার, সে প্রস্তুত। এই চক্র শেষ করতে হলে, পুতুলটাকে নষ্ট করতে হবে।

তবে সেই পুতুল কি সত্যিই নষ্ট করা যায়?

অধ্যায় ৮:

পরের দিন সকালবেলা ঈশিতা ঘুম থেকে ওঠার আগেই যেন তার শরীর জানত—আজকের দিনটা আর পাঁচটা দিনের মতো নয়। ঘরের জানালার পর্দা অকারণে নড়ে উঠছে, বাতাসে শুকনো পাতার ঘষাঘষির সঙ্গে মিশে আছে অস্পষ্ট এক শিশুকণ্ঠের হাসি। ঈশিতা বিছানা থেকে উঠে গিয়ে আয়নার দিকে তাকায়—নিজেকে দেখে না, দেখে এক সাদাটে ছায়া, চোখে লাল রেখা আর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা পুতুলের অবয়ব। মুহূর্তেই সেই প্রতিচ্ছবি মিলিয়ে যায়, কিন্তু ঈশিতার মনের মধ্যে দাগ কেটে যায়। সে জানে, এলিজাবেথ গেছে ঠিকই, কিন্তু তার ছায়া রয়ে গেছে, ছায়া যেটা অন্যদের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে—একটা সময় যার গন্তব্য হবে এক বড় অভিশাপ। সে এবার সিদ্ধান্ত নেয়—আর দেরি নয়, তাকে খুঁজে পেতে হবে সেই পুতুলকে এবং নষ্ট করতে হবে সেটাকে চিরতরে, নইলে এই “বন্ধুত্বের খেলা” একদিন পুরো শহরকে গ্রাস করবে।

দুলাল কাকার সাহায্যে সে শুরু করে পুরোনো নথি ঘাঁটতে—বাগানবাড়ির ইতিহাস, সেই ব্রিটিশ তান্ত্রিক শিশুর উপাখ্যান, এবং বিশেষত সেই Circulus Transitus চক্রের উৎস। তারা খুঁজে পায় এক শতাব্দী পুরোনো পুস্তক, যেখানে লেখা আছে—এই চক্র আসলে আত্মা ও দেহের সংযোগ ছিন্ন করার জন্য তৈরি হয়েছিল, কিন্তু যদি আত্মাটি নিজেই তা আঁকে, তাহলে সেটি বহুগুণ শক্তিশালী হয়ে উঠে, এবং ছায়ার মাধ্যমে পুনঃজন্ম নিতে পারে বিভিন্ন শরীরে। এই তথ্য পড়ে ঈশিতা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে—কারণ রুহি তো চক্রটা নিজে এঁকেছিল, যার মানে সেই ‘ছায়া’ এখন মুক্ত এবং নিরবিচারে শরীর খুঁজে বেড়াচ্ছে। তারা তখন সিদ্ধান্ত নেয়—বাড়ির উঠোনে আবার সেই চক্র আঁকবে, এবার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করবে সেই পেন্ডেন্ট, রুহির ঘর থেকে পাওয়া লাল ফ্রকের টুকরো, এবং ঈশিতার রক্ত। কারণ কেবল সেই ‘ধারক’ যিনি একবার পুতুলটিকে নিজের শরীরে ধারণ করেছেন, তার রক্তই পারবে এই চক্র সক্রিয় করতে।

রাত ঘনিয়ে আসে। উঠোনে আঁকা হয় সেই চক্র। চারদিকে লবণ, প্রদীপ, আর মাঝখানে রাখা হয় একটি কাঠের বাক্স—রুহির বিছানা থেকে উদ্ধার করা সেই পুতুলটি, যার মুখে এখনো সেই অদ্ভুত হাসি লেগে আছে। ঈশিতা মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিজের আঙুল কাটে, রক্ত ফোঁটা ফোঁটা করে মাটিতে পড়ে চক্রের কেন্দ্রে। সঙ্গে সঙ্গে বাতাস ঘন হয়ে আসে, আলো নিভে যায়, আর কুয়াশার মধ্যে স্পষ্ট হয় অনেকগুলো ছায়া—ছোট ছোট মেয়ে, যারা একে অপরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে পুতুলটির চারপাশে। তাদের মুখ নেই, কিন্তু চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। একটি ছায়া এগিয়ে এসে বলে, “তুমি এলিজাবেথকে বন্ধ করতে চাও? সে তো শুধু বন্ধু চায়।” ঈশিতা ধীরে বলে, “বন্ধুত্ব নয়, তুমি যা করছো সেটা অভিশাপ। এটা শেষ হতে হবে।” তখনই পুতুলটি উঠে আসে বাতাসে, ঘুরতে থাকে নিজের অক্ষে, আর তার কাঠের গায়ে ছড়িয়ে পড়ে ফাটল—প্রথমে সামান্য, তারপর ধ্বংসাত্মক।

এক মুহূর্তে বিদ্যুৎ চমকে চক্র আলোকিত হয়ে ওঠে, পুতুলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে কালো ধোঁয়ার মতো এক জটিল ছায়া—এলিজাবেথ, এবার আর শিশু নয়, এক ভয়ঙ্কর ছায়া-রাণী। সে গর্জন করে বলে, “বন্ধুত্ব চেয়েছিলাম, পেয়েছি বিশ্বাসঘাতকতা!” তখন দুলাল কাকা তামার মন্ত্রলিপি উঁচিয়ে ধরে, আর ঈশিতা পেন্ডেন্ট দিয়ে পুতুলটিকে ছুঁয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দে পুতুলটি চিৎকার করে ভেঙে যায়—তাকে ঘিরে থাকা ছায়াগুলো ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যায় আকাশে, চক্র জ্বলন্ত লাল হয়ে উঠে হঠাৎ নিভে যায়। চারদিকে নেমে আসে নিস্তব্ধতা, শুধু দূরে কোথাও রাতচরা পাখির ডাক শোনা যায়।

পুতুল আর নেই। চক্র নিঃশেষ। ছায়ারা মিলিয়ে গেছে, অথবা হয়তো ঘুমিয়ে গেছে কোনো গহীনে। ঈশিতা পড়ে যায়, ক্লান্ত শরীর নিয়ে, চোখ বন্ধ করে। কিন্তু তার কানে তখনো একটা ফিসফিসানি বাজে—“বন্ধু একবার পেলে, কখনও হারায় না। আবার আসব… অন্য খেলায়।”

অধ্যায় ৯:

ঈশিতা অনেকক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে পায়—তার চারপাশে তখন শুধু নিস্তব্ধতা, ভেজা মাটি আর পোড়া গন্ধে ভরা বাতাস। উঠোনের চক্র এখন আর নেই, যেন কিছুই ঘটেনি এখানে, অথচ শরীর বলে দিচ্ছিল, তার ভেতর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। দুলাল কাকা পাশে বসে কাঁপা হাতে জল দিচ্ছিলেন। মা এসে ঈশিতাকে জড়িয়ে ধরেন, মুখে কোনো শব্দ নেই, চোখে জল আর একটুখানি স্বস্তি—যা কেবল মা-ই অনুভব করতে পারেন। কিন্তু ঈশিতা জানত, এটা জয় নয়, এটা শুধু থেমে যাওয়া; এলিজাবেথ হারায়নি, শুধু খেলাটা থামিয়েছে। আর সেই ‘শেষ খেলা’ হবে কোথায়, কবে, তা কেউ জানে না। প্রশ্নটা শুধু একটা—কে হবে পরবর্তী ‘বন্ধু’?

তিনদিন পরে, পাড়ায় এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়। বাড়ির পুরনো ঘরে, যার পাশের দেয়ালে ক’দিন ধরেই এলোমেলো আঁকিবুঁকি দেখা যাচ্ছিল—আনজানা কিছু প্রতীক, ঠিক যেগুলো একসময় ঈশিতা আঁকত অজান্তে। বৃদ্ধার মুখ ছিল খোলা, চোখ ছিল বিস্ময়ে বড় হয়ে থাকা। কেউ বলে হৃদরোগ, কেউ বলে বয়েসের কারণ। কিন্তু ঈশিতা জানত, এটা কোনো সাধারণ মৃত্যু নয়। এলিজাবেথ নিজেকে নতুনভাবে তৈরি করছে, আর এবার সে আর শিশুর শরীর চায় না—সে খোঁজ করছে এক গ্রহণযোগ্য জায়গার, যেখানে তার ছায়া স্থায়ী হতে পারে। আর তার জন্য দরকার ছিল শুধু একটা “পথ”—আর ঈশিতা সেই পথটা একবার খুলে দিয়েছে। এখন বন্ধ করা অসম্ভব।

একদিন সন্ধ্যায়, ঈশিতা একা একা ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ সে দেখল দূরের ছাদের উপরে এক ছায়া—একটা ছোট্ট পুতুলের অবয়ব, যার হাত নাড়ছে ধীরে ধীরে। চোখে তখন আর কাঠের দৃষ্টি নেই, ছিল জীবন্ত চোখের মত জ্বলজ্বলে চাহনি। ঈশিতা চমকে উঠে নিচে নামতে যায়, কিন্তু সে জানে—এবার পালিয়ে কোনও লাভ নেই। এলিজাবেথ ফিরে এসেছে, কিন্তু এবার তার গন্তব্য শুধু একটি শরীর নয়—একটি সময়, একটি প্রজন্ম, একেকটা মন, যাদের মনস্তত্ত্ব দুর্বল, যাদের চিন্তা সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

সে ভাবে—তাহলে কি এই ‘পুতুল’ এক ধরনে সংক্রমণ? একটি মন থেকে অন্য মনে? এক সম্পর্ক থেকে অন্য সম্পর্কে? তার ফোনের স্ক্রিনে তখন একটা নোটিফিকেশন ভেসে ওঠে—এক অজানা নম্বর থেকে মেসেজ, শুধু এক লাইন: “Wanna play, Ishita? I have new friends now.” সঙ্গে একটি ছবি—তিনটি মেয়ে, দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে, তাদের কোলে সেই কাঠের পুতুল। ঈশিতা দেখে তাদের মুখের অভিব্যক্তি—চোখে সেই একই নিষ্পাপ অথচ ফাঁকা দৃষ্টি, যেমনটা ছিল একদিন তার নিজের চোখে।

ঈশিতা জানে, এবার আর শুধু তান্ত্রিক বৃত্ত বা রক্ত নয়, এবার তাকে নামতে হবে অন্য এক যুদ্ধক্ষেত্রে—চিন্তার, উপলব্ধির, ভয় এবং সাহসের। সে জানে, এই খেলায় তার হারার উপায় নেই, যদি সে নিজেই সেই ভয়কে নিজের ভিতরে বন্দি রাখতে পারে। কারণ, পুতুল যদি আত্মা চায়, তাহলে মন হবে তার অস্ত্র। সে টেবিলের ওপর রাখা সেই পেন্ডেন্টটা পরে নেয়, ধীরে বলে, “Let’s play one last time, Elizabeth. But this time, it’ll be my rules.”

অধ্যায় ১০:

দূরে বৃষ্টির শব্দ, যেন আকাশও জানে—এই রাতে কিছু বদলে যাবে। শহর ঘুমিয়ে, কিন্তু ঈশিতা জেগে। তার সামনে ছড়ানো পুরোনো কাগজ, টাটকা আঁকা এক মন্ত্রচক্র, আর ঘরের মাঝে রাখা সেই কাঠের পুতুল—যেটা সে কাকতালীয়ভাবে পেয়েছিল এক পুরনো জাদুদোকানের পিছনের গুদামঘরে। না, এটা আগের পুতুল নয়। এটা ছিল নতুন—কিন্তু মুখটা, চোখদুটো, কাঠের গায়ের গন্ধ… সব কিছু সেই আগেরটার মতো। যেন এলিজাবেথ নতুন শরীর পেলেও পুরোনো আত্মাকে ছাড়েনি। ঈশিতা বুঝেছে—এখন সে আর কাউকে ধরছে না, এখন সে নিজেকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্রতিটি পুতুল একেকটি বাহক, যারা শহরের বাচ্চাদের খেলনার দোকানে বসে আছে, অপেক্ষা করে কে তাকে বাড়ি নিয়ে যাবে।

ঈশিতা নিজে হাতে এঁকেছে এক প্রতিচক্র—আয়না ঘিরে তৈরি এক প্রতিবিম্ব-বাধা, যেটা প্রতিটি ছায়াকে নিজের প্রতিবিম্বে আটকে ফেলবে, বাইরে আসতে দেবে না। সেই আয়নার সামনে বসে সে মন্ত্র পড়ে, একের পর এক স্মৃতিচিহ্নকে ব্যবহার করে—রুহির ফ্রক, এলিজাবেথের পেন্ডেন্ট, নিজের হাতের রক্ত, এবং সেই পুতুলটি। চক্রের মধ্যখানে আয়না, তার বিপরীতে পুতুল, আর সবার মাঝে ঈশিতা নিজে। বাতি নিভে যায়, সময় স্থির হয়ে পড়ে, আর আয়নার ভেতর ফুটে ওঠে সেই মুখ—এলিজাবেথ, প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ রূপে দেখা দেয়। সে এখন আর শিশু নয়, এক পরিণত রাণী, চোখে কষ্ট, ঠোঁটে উগ্র হাসি।

সে বলে, “আমি শুধু চাই বন্ধু। কেউ যেন আমাকে ভুলে না যায়।” ঈশিতা তার দিকে তাকিয়ে বলে, “বন্ধুত্ব কখনও জোর করে হয় না, এলিজাবেথ। তুমি চাইলে ভালোবাসা পেতে, কিন্তু পেয়েছো ভয়। কারণ তুমি নিজেকে ভয়ঙ্কর করে তুলেছো।” এলিজাবেথ চিৎকার করে ওঠে, “ভয় তো আমাকে বানিয়েছে তোমরা। তোমাদের বিশ্বাসঘাতকতা, আমার পুড়ে যাওয়া শরীর, সেই যন্ত্রণা, যেটা শুধু শিশুর হৃদয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুরে!” চারপাশে বাতাস ছিঁড়ে যায়, আয়নার কাঁচ ফেটে যেতে চায়, কিন্তু ঈশিতা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, “তবে এসো, যাক যেটা হওয়ার। এবার শেষ হোক এই খেলা।”

চক্র জ্বলে ওঠে আগুনে, আয়না চকচকে রক্তে রাঙা হয়ে যায়। এলিজাবেথের ছায়া আয়নার ভেতর থেকে বাইরে আসতে চায়, কিন্তু প্রতিচক্র তাকে প্রতিটি গলে ফেরত ঠেলে দেয়। সে আর্তনাদ করে, প্রতিটি কাচে ফাটল ধরে—তার ছায়া অনেক জায়গায় ছড়িয়ে থাকলেও, এবার আটকে পড়েছে নিজেরই ফাঁদে। চক্রের শেষ স্তবক পাঠ করে ঈশিতা, এবং পুতুলটি কুড়িয়ে নিয়ে ছুড়ে মারে আয়নার গায়ে। কাচ চূর্ণ হয়, এক ফাটলের মধ্যে দিয়ে কালো ধোঁয়া বেরিয়ে এসে মিলিয়ে যায় বাতাসে। পুতুলটা পড়ে থাকে নিস্তেজ, কাঠ এখন আর প্রাণবন্ত নয়—একটা ফাঁকা, ঠান্ডা বস্তু মাত্র।

সকাল হয়। শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে খবরে আসে—অদ্ভুতভাবে দোকান থেকে হারিয়ে গেছে কিছু কাঠের পুতুল। কোনো ব্যাখ্যা নেই। ঈশিতা দাঁড়িয়ে থাকে জানালায়, তার চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মুখে এক শান্ত প্রকাশ। সে জানে, এলিজাবেথ চলে গেছে… হয়তো না, হয়তো আবারও আসবে অন্যরূপে। কিন্তু এখন, অন্তত এখনই, বন্ধ হয়েছে সেই ‘শেষ খেলা’। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকায়—সেখানে আর কোনো ছায়া নেই, শুধু সে নিজে, একা, নিঃশব্দে বিজয়িনী।

-শেষ-

1000029765.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *