Bangla - ভ্রমণ

কাঞ্চনজঙ্ঘা: একটি শেষ চিঠি

Spread the love

ঋদ্ধিমান চক্রবর্তী


পর্ব : চিঠির খামে কাঞ্চনজঙ্ঘা

পুজোর ঠিক আগের দিন সকালে মিঠির চিঠিখানা হাতে আসে—একটা পুরোনো বাদামি খামে, অদ্ভুত সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা ‘মিতালী সেন’ নামটা ঠিক তার ছেলেবেলার ডাকনামের পাশে। তবে এই ডাকনামটা আজ বহু বছর কেউ ডাকে না, এমনকি নিজের কাছেও মিঠি অনেককাল হয়ে গেছে মিসেস মিতালী বসু। কিন্তু চিঠিটা খুলতেই মনে হল, সময় যেন উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করেছে।

প্রেরক: প্রমথেশ চৌধুরী।
ঠিকানা: সেন ভিলা, হিলকার্ট রোড, দার্জিলিং।
তারিখ: ১৯৮৬।

মিঠি শিউরে উঠেছিল।
১৯৮৬?
তা হলে এই চিঠিটা এখন তার হাতে পৌঁছেছে ৩৯ বছর পরে?

চিঠির ভাঁজে আরও ছিল একটি ছোট স্কেচ—হাতের আঁকা, পেনসিলে আঁকা কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া, এক কোণে লেখা ‘১৪ সেপ্টেম্বর, সকাল ৫টা, সি আর দত্ত রোডের বারান্দা থেকে দেখা’। তার নিচে ছোট করে লেখা:
“তোর জন্য রেখে গেলাম। যদি একদিন কখনও ফিরে আসিস।”

মিঠির মাথার ভেতর কান্নার মতো শব্দ হচ্ছিল।
সে জানত চিঠির লেখক—প্রমথেশ কাকা। তার বাবা, অসিত সেনের প্রাণের বন্ধু। সেই যে একবার কাকা হঠাৎ চলে গিয়েছিলেন দার্জিলিংয়ে শিক্ষকতা করতে, আর কলকাতায় ফিরেই আসেননি। তখন মিঠি ক্লাস সেভেনে পড়ে। তারপর হঠাৎ একদিন শুনেছিল কাকা নিরুদ্দেশ। কাকা ছিলেন একটু অন্যরকম, গম্ভীর অথচ মায়াবি, কলকাতার কোলাহলে ক্লান্ত হয়ে যিনি পাহাড়ে গিয়ে এক অদ্ভুত নিস্পৃহ জীবনে নিজেকে মুছে ফেলেছিলেন।

কিন্তু এই চিঠি?

“তুই যদি কোনওদিন আমার রেখে যাওয়া চিঠিটা পড়িস,” কাকা লিখেছেন, “তাহলে বুঝবি, আমি তোর সঙ্গে শেষবার কাঞ্চনজঙ্ঘার আলো ভাগ করে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সময় আমায় দেয়নি।”

মিঠির বুকের মধ্যে কেমন একটা চিনচিনে ব্যথা।
সে ব্যথা পুরোনো—যে ব্যথা একদিন বুকের ভেতর জমে গিয়েছিল, আটকে পড়েছিল বাবার নির্দেশে, সমাজের চোখে, ছাত্রীবেলার দ্বিধায়।
প্রমথেশ কাকা তখন মিঠির থেকে অনেকটাই বড়—তাঁর বয়স প্রায় বাবার সমান। তবু মিঠির মনে হয়েছিল, কাকার চেয়ে বেশি কেউ ওকে বুঝতে পারে না।

 

মিঠি জানে, জীবন অনেকটা জলবাহী কাঁচের মতো—চোখের সামনে ভাঙে না, কিন্তু তাতে জন্ম নেয় অসংখ্য রেখা, যেগুলো আমরা এড়িয়ে যাই।
আজ হঠাৎ সেই রেখাগুলো আলোতে ধরা পড়েছে।

চিঠিটা নিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে বারান্দায়। নিচে বসন্তপুরের পাড়ায় গাঢ় ছায়া, পুজোর প্রস্তুতি চলছে। আর তার মাথায় শুধু একটা ভাবনাই ঘুরপাক খায়—
সে কি দার্জিলিং যাবে? এখন? এই বয়সে? এই সংসার, সন্তান, সব ছেড়ে?

তার মেয়ে অন্বেষা তখন দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে।
“মা, তুমি কাঁদছ?”

মিঠি চমকে উঠে মুচকি হাসে, “না রে, পুরোনো চিঠি পেয়েছি, তাই একটু মন খারাপ।”

“চিঠি?”
অন্বেষা অবাক—এই ডিজিটাল যুগে চিঠি যেন গল্পের বস্তু।

মিঠি চিঠিটা তুলে ধরে।
“তোকে কখনও বলিনি—আমি ছোটবেলায় দার্জিলিং গিয়েছিলাম একবার। তারপর আর কোনওদিন যাইনি। এবার মনে হচ্ছে… আবার গেলে কেমন হয়?”

“তুমি একা যাবে?”
“হয়তো… কেউ একজন অপেক্ষা করে আছেন। অনেকদিন ধরে।”

সেদিন রাতেই মিঠি পুরোনো অ্যালবাম খুলে বসে।
একটা সাদাকালো ছবি—ছবি তোলার সময় ছাত্রী সেজে দাঁড়িয়েছিল সে, পাশে প্রমথেশ কাকা। ছবিটা দেখে মনে হয় না কিছু।
কিন্তু তখন?
তখন ছবি তোলার মুহূর্তেই কাকা বলেছিলেন, “একদিন তোকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখাব। একেবারে ভোরবেলা, যখন আলো ঠিক মধুর মতো চুঁইয়ে পড়ে পাহাড়ের গায়ে।”

সে কথা সে ভুলে গিয়েছিল।

আজ মনে পড়ছে।

আর মনে হচ্ছে—সময় কখনও শেষ হয় না, যদি তার একটা বাকি কথা থাকে। সেই বাকি কথাই হয়তো এখন হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

মিঠি ঠিক করে, সে যাবে। আগামী শনিবারই।
ট্রেনের টিকিট দেখে, নিউ জলপাইগুড়ি পর্যন্ত পাওয়া গেছে, তারপরে গাড়ি।

বাড়ির সবাই খুব অবাক। কেউ কেউ হাসে, কেউ বলে, “এই বয়সে পাহাড়ে একা একা যাওয়ার দরকার কী?”

কিন্তু মিঠির মুখে অদ্ভুত এক শান্তি।

সে শুধু জানে, একটা চিঠি পৌঁছেছিল।
একটা অপেক্ষা এখনো শেষ হয়নি।

পর্ব : হিলকার্ট রোডের খোঁজ

নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের ছাদে যখন ধোঁয়ামেশানো আলো ঝিমোয়, তখন ঘড়িতে সকাল সাতটা। মিঠির হাতে একটা ছোট ট্রলি, আর ব্যাগের ভিতর কেবল কয়েকটা শাড়ি, ওষুধপত্র, আর সেই পুরোনো চিঠি ও স্কেচ। চারদিকের কোলাহল তার কানে আসছে ঠিকই, কিন্তু ভেতরের জগৎ যেন কুয়াশায় মোড়া।

চল্লিশ বছর পর দার্জিলিং ফিরে আসা—এই ভাবনাটাই তাকে ধাঁধার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। সে বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছে—কেন এই যাত্রা? একজন নিখোঁজ মানুষের খোঁজে? নাকি নিজের ভেতরের সেই কিশোরী মেয়েটিকে, যে একদিন কাঞ্চনজঙ্ঘার আলোয় প্রেমের গন্ধ পেয়েছিল?

স্টেশন থেকে বেরিয়ে সে একটা প্রাইভেট গাড়ি ঠিক করে। ড্রাইভার ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, “দিদি একা যাচ্ছেন? ট্যুরিস্ট না কি?”

মিঠি হাসে, “না ভাই, আমি খুঁজতে যাচ্ছি একটা ঠিকানা।”

ড্রাইভার যেন কিছুক্ষণ চুপ করে দেখে তাকে, তারপর বলল, “ঠিকানা হারায় গেলে, পাহাড়ে ফিরে পায় অনেকেই।”

রাস্তাটা কুয়াশায় ভেজা। ধীরে ধীরে সমতল বদলে যাচ্ছে পাহাড়ি চড়াই-উৎরাইয়ে। পথের পাশ ঘেরা বাঁশ, রডোডেনড্রনের গাছ, আর মাঝে মাঝে উঁকি দেওয়া চা-বাগানের কুয়াশা।

মিঠি গাড়ির জানালার কাচে ঠেকিয়ে রাখে কপাল। ছেলেবেলার স্মৃতিগুলো ধীরে ধীরে উঁকি দেয়—প্রমথেশ কাকার সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা, কাকার বাঁধানো খাতা ভর্তি কবিতা, আর সেই এক বিকেলে তার মুখে বলা কথা—

“তুই যখন নিজের চোখে কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রথম আলো দেখবি, বুঝবি ভালোবাসা কেমন করে আলো ছড়ায়। তোর চোখেই দেখব আমি।”

তখন সে বুঝতে পারেনি ওই কথার গভীরতা।

দুপুর নাগাদ তারা পৌঁছায়। শহরটা অনেক বদলে গেছে। এখন কাঁচা কাঠের বাড়ির জায়গায় রঙিন গেস্টহাউস, মোবাইল টাওয়ার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে, চায়ের দোকানেও ওয়াই-ফাই। তবু পাহাড়ের ঘ্রাণ একই রকম, নিঃশব্দ ধরা দেয়।

গাড়িটা থামে হিলকার্ট রোডে। মিঠি নেমে পড়ে—চিঠিতে লেখা সেন ভিলা খুঁজতে।

সেই রাস্তা ধরে এগোতেই, পুরোনো কাঠের এক দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় সে। নামফলকে ধুলো জমে আছে, কিন্তু নিচে খোদাই করা আছে: SEN VILLA

তবু যেন বাড়িটা বেঁচে আছে—তার বারান্দা থেকে এখনও দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। মিঠির বুকটা কেঁপে ওঠে। ছবির সেই স্কেচের ব্যালকনি এইটাই। ঠিক এইখান থেকেই কাকা বলেছিলেন—“তোর জন্য রেখে গেলাম।”

বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করে। কলিং বেল নেই। কাঠের দরজায় আলতো করে তিনবার টোকা দেয় সে।

দরজা খোলে এক বৃদ্ধা। সাদা চুল, উলের চাদর গায়ে জড়ানো, কপালে ছোট টিপ।

“কে?”
“আমি মিতালী সেন। কলকাতা থেকে এসেছি। আমি… আমি প্রমথেশ চৌধুরীর এক পরিচিত। চিঠি পেয়েছিলাম কিছুদিন আগে…”

মহিলা তাকিয়ে থাকেন। যেন শুনছেন, আবার যেন শুনছেন না।

তারপর ধীরে ধীরে বলেন, “তুমি সেই মিঠি?”
মিঠির মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়।
“আপনি আমাকে চেনেন?”

“আমি রত্নাদি। আগে এখানে রান্নার কাজ করতাম। এখন এই বাড়িটা দেখাশোনা করি। প্রমথেশ বাবু তোমার কথা বলতেন… শেষ দিন পর্যন্ত।”

“শেষ দিন পর্যন্ত?” মিঠির গলা শুকিয়ে আসে।
“তিনি মারা গেছেন?”

রত্নাদি মাথা নাড়েন, চোখ নামিয়ে বলেন, “প্রায় দশ বছর হলো। এক রাতেই হঠাৎ। তবে তার আগে বলেছিলেন—যদি কোনওদিন মিঠি আসে, যেন বারান্দার সেই টেবিলের খাতাটা তাকে দিই।”

মিঠির হাত ঠান্ডা হয়ে আসে। সময় যেন থমকে গেছে।

রত্নাদি ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে একটা পুরোনো কাঠের টেবিল থেকে একটা মলিন খাতা নিয়ে আসেন। খাতার ওপরে প্রমথেশ কাকার হাতের লেখা—তোর জন্য দ্বিতীয় চিঠি

মিঠি খাতা খুলে প্রথম পাতায় দেখে শুধু একটাই লাইন—

“তুই কি সত্যিই চলে এলি, নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি?”

সেদিন সন্ধেয় দার্জিলিংয়ের বাতাসে একটা অন্য রকম গন্ধ ছিল। মিঠি বারান্দায় বসে, কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকিয়ে থাকে। বরফে ঢাকা শৃঙ্গ ধীরে ধীরে গোলাপি হয়ে উঠছে।

খাতার পাতায় লেখা—

“তুই যখন এই চিঠি পড়ছিস, তখন আমি হয়তো আর এই পৃথিবীতে নেই। কিন্তু তোকে বলার ছিল অনেক কথা। আমি তোর সঙ্গে কেবল প্রেম করিনি, আমি তোকে বিশ্বাস করেছিলাম—একজন মানুষ হিসেবে। তোকে দেখেই আমি প্রথম বুঝেছিলাম, ভালোবাসা কীভাবে সময়কে পেরিয়ে যায়। আমি তোর হয়ে কিছু রেখে যেতে চেয়েছিলাম—এই পাহাড়, এই আকাশ, আর আমার অসমাপ্ত কথারা…”

মিঠির চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
সে জানে, এই পাহাড়ে সে কিছু খুঁজতে আসেনি।
সে ফিরতে চেয়েছে। নিজের ফেলে আসা এক চিরকালীন প্রেমের কাছে।

পর্ব : অমর কাব্যের বারান্দা

ভোরবেলা কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়াগুলো যখন প্রথম সোনালি আলোয় রাঙা হয়ে ওঠে, তখন মিঠি বারান্দার কাঠের চেয়ারটায় বসে খাতাটা কোলে নিয়ে পড়ছিল। পাহাড়ে এই সময়টা যেন অন্য এক ঘোর, যেন প্রকৃতি ধীরে ধীরে মানুষের হৃদয়ের পর্দা সরিয়ে দেয়। নিস্তব্ধতা শব্দের চেয়ে গভীর হয়ে আসে।

খাতার পাতাগুলোতে কালো কালিতে কাকার হাতের লেখা—ঝরঝরে, কোথাও কোথাও অস্পষ্ট, কোথাও বা অস্থির। প্রথম দিককার লেখাগুলো যেন আত্মপ্রতিকৃতির মতো, নিজের জীবনের সঙ্গে বোঝাপড়ার প্রয়াস। তারপর পরেই মিঠির নাম এসেছে—নানা ভাবে, নানা অনুভবে।

“তুই চলে যাওয়ার পর আমি অনেক দিন তোর চিঠির অপেক্ষায় ছিলাম। জানতাম তুই লিখবি না। তবুও, বারান্দার টেবিলে চিঠি রাখতাম, যেন তুই যদি হঠাৎ চলে আসিস, দেখবি আমি অপেক্ষা করছিলাম। পাহাড় জানে, অপেক্ষা কখনও মিথ্যে হয় না।”

মিঠির মনে পড়ে, কলেজে ভর্তি হয়ে যাবার আগের সেই সময়—বাড়ির চাপ, আত্মীয়স্বজনের ফিসফাস, আর একদিন বাবার ঠান্ডা গলায় বলা কথা, “মিঠি, প্রমথেশকে আর দেখা লাগবে না। তার বয়স অনেক, আর এই সম্পর্ক ভবিষ্যৎহীন।”

মিঠি মাথা নিচু করে সেদিন চুপ করে ছিল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এক সমুদ্র বয়ে গিয়েছিল।

এখন সেই সমুদ্র যেন এই পাতার শব্দে ফিরে এসেছে।

“তুই যদি একদিন আমার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে আসিস, তবে বুঝবি—ভালোবাসা কীভাবে পাহাড়ের মতো স্থির হতে পারে, আর সময়ের মতো বয়ে যেতে পারে।”

পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে মিঠির চোখ পড়ল এক কবিতায়। নাম—অমর কাব্যের বারান্দা। হয়তো কাকার লেখা, হয়তো কোনওদিন কেবল তার জন্যই।

অমর কাব্যের বারান্দা
ভোর হলে তোকে ডাকি
তুই কি শুনিস?
চুপ করে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার মতন
তোরও কি মন কাঁদে?

বারান্দায় রাখা চেয়ারে
আজও পড়ে থাকে তোর চুলের গন্ধ
যেন ফেলে যাওয়া স্বপ্নগুলো
ঘুরে ফিরে বসে পড়ে সন্ধ্যে নামলেই।

তুই এলি না। তবুও লিখে গেলাম
একটা অমর কাব্যতোকে নিয়ে।
যার শেষে লেখা নেই,
কেবল অপেক্ষা।

কবিতার প্রতিটি শব্দ যেন বুকে গেঁথে যায়। মিঠি জানে না, কেন সে এত বছর এইসব থেকে নিজেকে দূরে রেখেছিল। তার সংসার ছিল, স্বামী ছিল, সন্তানও—কিন্তু হৃদয়ের এক অংশ কেমন যেন স্থির হয়ে গিয়েছিল কাকার বিদায়ের সঙ্গে।

বারান্দা তখন রোদে ভরে উঠছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা এখন ধীরে ধীরে সাদা থেকে রূপালী হয়ে যাচ্ছে। মিঠি সেই আলোয় হাত রাখে। যেন কাকার ছোঁয়া পায়।

এই বাড়ির প্রতিটা কোণ থেকে একেকটা কথা যেন তাকে ডাকছে। কিচেনে এখনও পুরোনো পিতলের কেটলি। ডাইনিং টেবিলে কাঠের দাগ। দেয়ালে কাকার প্রিয় কবি জীবনানন্দের একটা লাইন খোদাই করা ফ্রেমে—
“আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে…”

রত্নাদি এসে বলে, “আজ রাতে আপনি থাকুন দিদি। কাল সকালে আমরা বনভিলা যাই। সেখানে প্রমথেশ বাবুর প্রিয় জায়গা ছিল—পাহাড়ের গায়ে বসে লিখতেন। ওখানেই আপনি তার শেষ চিঠিটা পাবেন।”

মিঠি অবাক, “আরও একটা চিঠি আছে?”

রত্নাদি হেসে বললেন, “হ্যাঁ। উনি বলতেন—যদি মিঠি একদিন আসে, তাকে সবটা দিতে হবে একসঙ্গে না। কারণ প্রত্যেকটা চিঠির মধ্যে একেকটা স্তর আছে। ধীরে ধীরে বুঝতে হবে।”

রাতের দার্জিলিং এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় ঘেরা। বাইরের বাতাসে ঠান্ডা, কিন্তু মিঠির মনে একরকম উষ্ণতা।

সে বারান্দায় বসে কাঞ্চনজঙ্ঘার ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ মনে পড়ে—তারা একবার অঙ্ক কষে বের করেছিল দূরত্ব। কলকাতা থেকে দার্জিলিং—৬৭০ কিলোমিটার। কিন্তু হৃদয়ের দূরত্ব কেউ মেপে দেখেনি।

হঠাৎ তার ফোনে মেসেজ আসে—অন্বেষার।

“মা, তুমি ঠিক আছো তো? তুমি কেমন আছো সেখানে?”

মিঠি টাইপ করে—

“আমি… ফিরে গেছি। খুব ভালো আছি। তুমি একদিন আমার সঙ্গে এখানে আসবি তো?”

পর্ব : বনভিলার একলা দুপুর

পরদিন সকালটা ছিল কুয়াশায় মোড়া। দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি হাওয়ায় ভেসে ছিল গরম চায়ের গন্ধ, আর দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় সোনালি রোদ লেগে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল মেঘের আস্তরণে। মিঠি তখন সেন ভিলার গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রত্নাদির জন্য অপেক্ষা করছে। তার ট্রলি ব্যাগ আর কোলের খাতাটা হাতে নিয়ে সে বুঝতে পারছিল—এই যাত্রা অন্য কিছু, কেবল ভ্রমণ নয়, বরং এক অলিখিত সংলাপের শেষ অংশে পৌঁছনো।

রত্নাদি এলেন একটা ছোট জীপ নিয়ে। ড্রাইভারের পাশে বসে বললেন, “বনভিলা এখান থেকে একটু দূরে, কিন্তু খুব নির্জন জায়গা। প্রমথেশ বাবু ওখানেই বেশি সময় কাটাতেন শেষদিকে। ওখানে বসেই চিঠি লিখতেন, ছবি আঁকতেন।”

গাড়ি যখন পাহাড়ি রাস্তা ধরে নামতে শুরু করল, মিঠির মনে হল সে যেন সময়ের গভীরে প্রবেশ করছে—একটা ঘূর্ণি, যেখানে একদিকে অতীতের শব্দেরা ডাকছে, অন্যদিকে নিজের জীবনের প্রশ্নগুলো তিরতির করে জেগে উঠছে।

প্রায় পঁচিশ মিনিট পর তারা পৌঁছায় বনভিলা—একটা ছোট, কাঠের তৈরি একতলা ঘর, ছাদের ওপরে সবুজ শ্যাওলার ছাপ, আর চারপাশে বিশাল পাইন গাছ। বাড়িটার ঠিক পেছনেই খাড়া ঢাল, নিচে সবুজ উপত্যকা। ওপাশে দূরে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা—কিন্তু একেবারে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে, যেন পাহাড়টাও এখানে আরেকটা ব্যক্তিত্ব, যেন সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে কারও অপেক্ষায়।

রত্নাদি বললেন, “আপনি একা থাকুন কিছুক্ষণ। ভেতরে একটা টেবিলের ড্রয়ারে আরেকটা খাতা আছে, সেটা হয়তো আপনার জন্যই রেখে গিয়েছিলেন।”

মিঠি একা ঢুকে পড়ে বনভিলার ভিতরে। ভেতরে আসবাব বলতে একখানা কাঠের টেবিল, একটা চেয়ার, একপাশে বুকশেলফ, আর অন্য পাশে পুরোনো একটা খাট। টেবিলের ওপরে কাচের জারে শুকনো গোলাপের পাঁপড়ি রাখা, পাশে একটা পাথরের ছাঁদে পেনসিল, কলম, আর একটা খোলা নোটবুক। যেন কেউ লিখতে লিখতেই উঠে গেছে, আর ফিরে আসেনি।

সে ধীরে ধীরে ড্রয়ার খুলল।
সেখানে একটা খাতা। বাঁধানো, হলুদ হয়ে যাওয়া পাতাগুলো।
প্রথম পাতায় লেখা—

তোর জন্য তৃতীয় চিঠিএকলা দুপুরে

“মিঠি,
যদি তুই এখান পর্যন্ত এসে থাকিস, বুঝি তুই শুধু আমাকে খুঁজতে আসিসনি। তুই নিজেকেও খুঁজছিস।

আমি তো তোকেই রেখে গিয়েছিলাম এই পাহাড়ে। কলকাতার স্যাঁতসেঁতে দেওয়াল, সমাজের নিয়মে তোকে পাওয়া যেত না। তাই তোকে এই আলোতে, এই পাহাড়ে, এই নির্জনতায় রেখে দিয়েছিলাম।

আমি জানতাম, তুই ফিরবি।

বনভিলার এই ঘরে আমি বসে বুঝেছিলাম—প্রেম কেবল শরীর বা কাছে থাকার হিসেব নয়। প্রেম অনেকটা গাছের পাতার মতো—একসময় ঝরে, কিন্তু তার ছায়া থেকে যায়।

আমি তোকে ছুঁতে চাইনি, আমি তোকে রক্ষা করতে চেয়েছিলাম।

সেইজন্যই তোকে বলিনি শেষ মুহূর্তে—আমার অসুস্থতার কথা, আমার একাকিত্বের কথা। কারণ তুই যদি ফিরিস, সেটা যেন কেবল ভালোবাসার টানে হয়, করুণার নয়।

এই বনভিলায় আমার সব লেখা, সব অসমাপ্ত গল্প, সব আঁকা রেখেছি।
যদি তোর ইচ্ছা হয়, তুই সেগুলো শেষ করিস।
কারণ তুই তো আমার অনূর্ধ্ব ছায়া।

তোকে শেষ আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো দেখা দিয়েছিলি—নির্মল, দূরের, অথচ আশ্রয় হয়ে।

আর একটা কথা—
আমি তোকে ভালোবাসি, আজও।
— প্রমথেশ”

মিঠি খাতা বন্ধ করে টেবিলে রেখে দেয়। জানালার বাইরে কাঞ্চনজঙ্ঘা তখন সাদা-নীল আলোর দোলায় হাসছে।

তার মনে হচ্ছিল, পাহাড়, আকাশ, গাছ, বাতাস—সব যেন তাকে চেনে। যেন তারা সকলেই জানে, এই গল্প অনেক আগেই লেখা হয়ে গিয়েছিল, এখন কেবল তা খোলার পালা।

ঘরের কোণে একটা ট্রাঙ্ক চোখে পড়ে। খুলে দেখে—অনেক পুরোনো কাগজপত্র, জলরঙে আঁকা ছবি, আর কিছু ছোট নোট। একটা স্কেচবুকে আঁকা মিঠির মুখ—তাঁর সেই ক্লাস নাইনের সময়ের ছবি থেকে আঁকা, কিন্তু আরও গভীর, আরও পরিণত।

মিঠির চোখে জল আসে না। শুধু একটা গাঢ় নিশ্বাস ফেলে সে ছবিটার ওপর হাত রাখে।

বাইরে বেরিয়ে সে রত্নাদির দিকে তাকায়।
“আমি কি এখানে কিছুদিন থাকতে পারি?”
রত্নাদি হেসে বলেন, “আপনি তো এ বাড়িরই কেউ। প্রমথেশ বাবু বলতেন, একদিন যখন মিঠি আসবে, তখন এখানে নতুন করে জীবন শুরু হবে।”

মিঠি বনভিলার দিকে তাকিয়ে আবার বারান্দায় দাঁড়ায়।
সে জানে, এই গল্পে পুনর্মিলনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো উপলব্ধি। ভালোবাসা সবসময় থাকতেই হবে এমন নয়—কিন্তু সে যদি একবার সত্যি হয়ে থাকে, তবে সময় তার থেকে কিছু নিতে পারে না।

পর্ব : অন্তর্গত প্রেমের দিনলিপি

মিঠি বনভিলায় রয়ে গেল। প্রথমে দু’দিন, তারপর আরও চারদিন। শহরের চাকচিক্য, মোবাইলের অ্যালার্ট, রান্নার প্রেসার, এমনকি কোর্টের কেসের দিনও ধরা থাকল না—সে কেবল থাকল পাহাড়ের কোলে, এক অদ্ভুত সংলাপে লিপ্ত হয়ে।

প্রতিদিন সকালে সে হাঁটত উপত্যকার দিকে, ফার্নের ঘাস ছুঁয়ে যেত তার পায়ের আঙুল, আর ফিরে এসে বসত বারান্দার কাঠের চেয়ারে—যেখানে প্রমথেশ কাকা বসতেন।

তবে আজ সকালটা আলাদা। আজ সে কাকার পুরোনো খাতা নিয়ে বসেছে—যেটা রত্নাদি বলেছিলেন ‘দিনলিপি’, কিন্তু আসলে সেটা ছিল আত্মার ডায়েরি। কাগজের পাতায় কোনও তারিখ নেই, কোনও সাল-বর্ষ-কাল নেই। আছে শুধু একটি দীর্ঘ বর্ণনা—অন্তরের।

“আজ আবার স্বপ্নে দেখলাম, তুই একটা ট্রেন থেকে নামছিস। হালকা নীল শাড়ি, চোখে টান দেওয়া কাজল, আর তোর মুখে একটা অভিমান।

আমি বললাম, ‘মিঠি, এতো দেরি করলি কেন?’

তুই বললি, ‘তুমি তো ডাকোনি!’

আমি হাসলাম, বললাম, ‘তাই বলে আসবি না?’

তুই আমার দিকে তাকিয়ে বললি, ‘আমি তো আসিনি, আমি তো থেকে গেছি। তোমার প্রতিটা লেখায়, প্রতিটা ছায়ায়, প্রতিটা নির্জনতায়।’

তারপর ঘুম ভেঙে গেল।

আমি জানি, এই স্বপ্ন নয়—এটাই বাস্তব।”

মিঠির মনে পড়ে, সে অনেকবার কাকার কাছ থেকে দূরে যেতে চেয়েছিল, কারণ সমাজের চোখ, আত্মীয়দের প্রশ্ন, এমনকি নিজের ভেতরের দ্বন্দ্ব তাকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল অন্য জীবনে।
তবুও কোথাও যেন সে একটা জায়গায় আটকে গিয়েছিল, আর সেই আটকে থাকার জবাবটাই এখন এই খাতার পাতায় পাতায় খুঁজে পাচ্ছে।

খাতায় লেখা আরেকটা অংশ মিঠির বুকের ভেতর থরথর করে কাঁপিয়ে তোলে—

“তুই জানিস, আমি তোকে কোনোদিন নিজের করতে চাইনি। আমি তোকে একটা জায়গা দিতে চেয়েছিলাম—যেখানে তুই নিজের মতো করে বড় হতে পারিস।

ভালোবাসা কেবল অধিকার নয়। সেটা দায়, তা একা বয়ে নিয়ে চলা যায়।

তুই যদি কেবল একটিবার বলতি—‘আমি আসব না’, আমি তাও অপেক্ষা করতাম।

কারণ তোর ‘না’-র ভেতরেও আমি তোকে খুঁজে পেতাম।

তুই জানিস, আমি কখনো বিয়ে করিনি। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতাম, ‘আমার স্ত্রী পাহাড় হয়ে গেছে। তাকে ছুঁতে গেলেই সে মেঘে রূপ নেয়।’”

মিঠি দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকে খাতাটা হাতে। সূর্যের আলো বারান্দার কাঠে এসে পড়ে—আঁকা হয়ে থাকে তার গায়ে। পাখির ডাক, কুয়াশার গন্ধ, হাওয়া বয়ে আনে দূরের ঘণ্টার শব্দ—সব মিলিয়ে যেন এক ছায়াময় রাগিণী বেজে ওঠে।

তার ফোন অফ। তার দিনলিপি জেগে উঠছে।

সে ভাবতে থাকে—এত বছর ধরে সে আসলে কিসের খোঁজ করছিল?
এক সফল সংসার? নাম? স্বীকৃতি?
নাকি… সেই এক বিকেলের আলোয় তার মুখের দিকে তাকানো চোখদুটোকে?

বিকেলে রত্নাদি এসে বলে, “আপনি যদি চান, এইসব লেখা আপনার কাছে রাখতে পারেন। প্রমথেশ বাবু বলতেন, ‘আমার লেখা তখনই শেষ হবে, যখন ও পড়বে।’”

মিঠি খাতা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে।
সে জানে, এই খাতাগুলোর ভাঁজে কেবল কাকার নয়, তার নিজেরও গল্প আছে।

সেই রাতটায় মিঠি এক স্বপ্ন দেখে।

সে নিজেকে দেখে যুবতী রূপে, সাদা শাড়িতে, হাতে একটা খাতা। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কাকা, ঠিক যেভাবে একদিন সে বিদায় নিয়েছিলেন—চোখে অসমাপ্ত কিছু বলার ব্যাকুলতা।

মিঠি বলে, “এইবার আমি লিখব, কাকা।”
প্রমথেশ কাকা হেসে বলেন, “তুই তো লিখেই যাচ্ছিস, মিঠি। নিজের চোখে।”

পর্ব : শেষ ট্রেনের আলো

দার্জিলিং স্টেশনের সেই ক্ষীণ রেললাইন—যেখানে টয় ট্রেন সাপের মতো বেঁকে যায় পাহাড়ের শরীর ছুঁয়ে, সেখানে সন্ধেবেলা এক নিঃসঙ্গ আলো জ্বলছে। মিঠি চুপ করে দাঁড়িয়ে। তার হাতে ছোট একটা খাম—প্রমথেশ কাকার লেখা শেষ চিঠি, যেটা সে এইমাত্র পেয়েছে রত্নাদির কাছ থেকে। চিঠিটা অন্য খাতাগুলোর মতো কবিতার ছাঁদে নয়, এটা অনেকটা… বিদায়ের মতো।

রত্নাদি বলেছিলেন, “প্রমথেশ বাবু লিখে গিয়েছিলেন—যেদিন মিঠি ফিরে আসবে, সেদিন ওকে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এই খামটা দিতে হবে। কারণ, ভালোবাসারও শেষ ঠিকানার দরকার হয়।”

মিঠি খামটা খুলে। ভিতরে মাত্র একটি লাইন।

“যদি কখনও ট্রেন ছাড়ার আগেই পৌঁছাস, তাহলে জেনে নিস, আমি অপেক্ষা করছিলাম।”

তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
চল্লিশ বছর আগে, ঠিক এই প্ল্যাটফর্মে, সে এসেছিল একা। তার ব্যাগে ছিল কাকার একটা চিঠি, কিন্তু সে পৌঁছাতে পারেনি সময়মতো।
ট্রেন তখন ছেড়ে গিয়েছিল, আর কাকা ছিলেন সেই ট্রেনে।

সেই ছিল তাদের শেষ দেখা।

সে স্টেশনের বেঞ্চে বসে পড়ে।
আজ না গেলে আর কোনো আক্ষেপ থাকবে না। কারণ আজ সে জেনেছে—প্রেমের অর্থ সময়ের ওপর নির্ভর করে না, শরীরের অনুপস্থিতি তাকে নিঃশেষ করে না।

মিঠি চোখ বন্ধ করে দেখে—একটা ট্রেন এগিয়ে আসছে, ধোঁয়ার সঙ্গে বাজছে এক পুরোনো বাঁশির সুর। কাকার মুখ ঝাপসা, কিন্তু ঠোঁটের কোণে সেই চেনা হাসি।

সে আবার সেই ছোট মেয়েটা হয়ে যায়, যে একদিন বলেছিল, “আমি আবার আসব, কাকা। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখব তোমার চোখ দিয়ে।”

রাতের ঘরে ফিরে সে রত্নাদিকে বলে, “আমাকে একটা টেবিল আর কাগজ দিতে হবে। আমি কিছু লিখব। এবার আমার পালা।”

রত্নাদি মৃদু হেসে বলেন, “আপনি লিখবেন তো শুধু চিঠি নয়, ইতিহাস।”

পরদিন ভোরে মিঠি বারান্দায় বসে। কাঞ্চনজঙ্ঘা তার রুপোলি চূড়া নিয়ে উঠছে ধীরে ধীরে, ঠিক যেমন প্রমথেশ কাকা লিখেছিলেন—
“ভালোবাসা যখন ফিরে আসে, তখন তার ছায়াও আলো হয়ে যায়।”

মিঠির কলম চলছে। সে লিখছে না শুধু কাকার কথা—সে লিখছে তাদের না বলা প্রেমের ইতিহাস, এক জোড়া মানুষের তীর্থযাত্রা—যাদের মধ্যে ছিল অদৃশ্য চুক্তি।

পেছনের দেয়ালে সে লিখে রাখে একটা লাইন—নিজের তৈরি করা, নিজের ভিতর থেকে উঠে আসা:

“প্রেমকে কখনও ফেরাতে নেই, যদি সে দেরি করে পৌঁছায়, জানবে সে পাহাড় পেরিয়ে আসছে।”

পর্ব : অবশেষে কাঞ্চনজঙ্ঘা

সকাল সাতটা। আকাশ এক ফালি নীল আর সোনালি রঙে মেশা। বনভিলার বারান্দা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন একটু বেশি উজ্জ্বল, একটু বেশি কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। মিঠি হাতে তুলে নেয় সেই খাতাটা—যেখানে কাকা রেখে গিয়েছেন ভালোবাসার অনন্ত আলেখ্য। এবার সে লিখবে, তার ভাষায়। যেন একটা গল্প শুরু হয়েছিল যেটা কেবল শুনেই গিয়েছিল সে, আজ সেই গল্পের শেষ অধ্যায় তার হাতে।

প্রথম পাতায় লিখল—
অবশেষে কাঞ্চনজঙ্ঘা। প্রমথেশের চোখ দিয়ে দেখা আমার সকাল।

হাত কাঁপছিল। তবু শব্দ আসছিল নিজে থেকেই। যেন ভেতরে জমে থাকা হিমবাহ গলছে কাগজের ওপর।

“আজ আমি প্রথমবার কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখছি, সত্যিকারের চোখে।

এত বছর ধরে যা দেখেছি, তা ছিল স্মৃতির, আক্ষেপের, অথবা কল্পনার পাহাড়।

কিন্তু এই পাহাড় নয়, বরং তার পাশে যে আলোটা প্রতিদিন জন্ম নেয়, আমি তা দেখছি।

প্রমথেশ,

তুমি যে আলো আমাকে দিতে চেয়েছিলে, এত বছর পর সে আলো নিজেই এসে পড়েছে আমার চোখে।

এখন বুঝি, প্রেম আসলে উপস্থিতি নয়, প্রস্তুতি।

সেই প্রস্তুতির শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে আমি তোমাকে বলছি—

আমি আসিনি দেরিতে, আমি এসেছি ঠিক সময়মতো।

যখন পাহাড় আমাকে ডাকেনি, আমি কেবল তাড়া খেয়েছি।

কিন্তু আজ পাহাড় চুপ করে তাকিয়ে আছে—এই নীরবতাই তো ভালোবাসার সবচেয়ে সৎ ভাষা।”

ঘরের এক কোণে, কাঠের তাকের ওপর রাখা কাকার প্রিয় বইগুলোর পাশে একটা পুরোনো ক্যামেরা। ফিল্ম ক্যামেরা। রত্নাদি বললেন, “ওনার শেষ কিছু ছবি ছিল—তুলেছিলেন কাঞ্চনজঙ্ঘার রোজকার বদলানো মুখ। ওগুলো আপনার জন্য রেখেছিলেন।”

মিঠি ক্যামেরার ভেতরের রোল বের করে এনে কাছের একটা স্টুডিওতে দিয়ে এল। দুপুরে ফোন এল স্টুডিও থেকে—
“দিদি, পুরোনো ছবি খুবই সুন্দর, তবে একটাতে অবাক লাগল… আপনি কি জানেন, একটা ছবিতে আপনার ছোটবেলার স্কেচের সঙ্গে মেলানো মুখ আছে? যেন ক্যামেরায় কেউ আপনাকে ছবির মতো এঁকে তুলেছে।”

মিঠি চুপ করে থাকল।
সে জানে, কাকা কখনও তাকে চোখ দিয়ে আঁকেননি, বরং হৃদয়ের ভিতর দিয়ে ধীরে ধীরে সাজিয়েছেন।

সেই রাতেই মিঠি ঠিক করল, সে কলকাতায় ফিরবে না।

সে রত্নাদিকে বলল, “এই বনভিলাকে আমি চালিয়ে যেতে চাই। এখানে লেখালেখি, বই পড়া, কিছু ছোট ছোট পাঠচক্র… হয়তো কিছু বাচ্চাদের জন্য লেখার কর্মশালা করব। আমি চাই এখান থেকে নতুন কিছু শুরু হোক—যেটা কাকার স্বপ্ন ছিল।”

রত্নাদি বললেন, “এই পাহাড়ে আপনি যেভাবে ফিরে এসেছেন, ঠিক সেভাবেই অনেক মানুষ একদিন ফিরে আসবে… নিজেদের ফেলে আসা প্রেম, শব্দ, বা সত্তাকে খুঁজতে। বনভিলা শুধু কাকার নয়, এখন আপনারও আশ্রম।”

সপ্তাহ খানেক পর মিঠি একটা নোটিশ দেয় সেন ভিলার গেটের বাইরে:

প্রেমিকদের জন্য একটি বারান্দা।
যেখানে কেউ কাউকে ছুঁতে আসে নাশুধু আলো ভাগ করে নেয়।

পর্ব : রোদ্দুরের চিঠি

সেই রাতে, কাঞ্চনজঙ্ঘার নিচে বনভিলার বারান্দায় বসে মিঠি যখন চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁইয়ে ছিল, তখন সে ভাবছিল—এই পাহাড়ের কাছে প্রেমের সংজ্ঞা কেমন সহজ, অথচ কেমন অসীম। রোদের মতো। ছুঁয়ে যায়, তাপ দেয়, কিন্তু আঁকড়ে ধরে না। সে এখন এই পাহাড়ের রোদের মতোই লিখতে শিখছে।

রত্নাদি প্রতিদিন সকালে পাহাড়ি লাল চালের খিচুড়ি আর কফি এনে দেন। মিঠি এখন দিন শুরু করে চিঠি লিখে—নিজের কাছে, কাকার নামে, ভবিষ্যতের পাঠকের জন্য। প্রতিটি চিঠি সে ভাঁজ করে রেখে দেয় বনভিলার টেবিলের ওপরের খামে।

আজ সে চিঠি লিখেছে নিজের মেয়ে অন্বেষাকে।
চিঠির শুরু—

“তুই যখন এই চিঠি পাবি, আমি হয়তো তোর চোখের সামনে থাকব না।

কিন্তু আমি থাকব একটা পাহাড়ের শিকড় হয়ে।

তুই যদি কোনওদিন বুঝতে চাস, একজন মানুষ কীভাবে প্রেমের জন্য জীবনের শেষবেলায় নতুন করে জন্ম নিতে পারে—তাহলে একবার এসে এই বনভিলার বারান্দায় বসিস।

আমি তোর জন্য রেখে যাব কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রথম আলো।”

অন্বেষা তাকে ফোন করে প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, “মা, তুমি কেন ফিরে আসছ না?”

মিঠি হেসে বলে, “কারণ আমি আসলে কোনওদিন যাইনি।”

বিকেলে সে পাহাড়ি ছোট কিছু ছেলেমেয়েকে নিয়ে বসে গল্পের ক্লাস নেয়। পাহাড়ের ছায়ায় বসে তারা শেখে কল্পনা করতে, ছবি আঁকতে, চিঠি লিখতে। এক ছোট্ট মেয়ে, নাম দীপান্বিতা, একদিন বলে বসে—

“ম্যাডাম, আপনি কি প্রেম করে ফেলেছেন পাহাড়ের সঙ্গে?”

মিঠি অবাক হয়ে হেসে ফেলে। তারপর ভাবে, কী সুন্দর করে বলেছে মেয়েটা।
প্রেম তো ঠিক এমনই—যাকে বোঝানো যায় না, কিন্তু যার প্রমাণ গন্ধ হয়ে থাকে বাতাসে।

সন্ধের ঠিক আগে রত্নাদি এসে একটা খাম এনে দিলেন।

“এই চিঠিটা আপনার জন্য নয়। এটা ছিল প্রমথেশ বাবুর লেখার টেবিলের নীচে আটকে। আপনি চলে আসার পর বের করেছি। মনে হলো, আপনার লেখা চিঠির উত্তর। শুধু তার পাঠক হয়তো আপনি নন।”

মিঠি অবাক। খামটা খুলে দেখে, ভেতরে কোনও নাম নেই। শুধু এক পাতার লেখা—

“এই পাহাড়ে যে আসে, সে একা আসে না।

সে তার প্রশ্ন নিয়ে আসে, তার না বলা কথাগুলো নিয়ে আসে।

আর এখান থেকে যে ফিরে যায়, সে আর আগের মানুষ থাকে না।

যদি কোনওদিন কেউ এসে পড়ে এই চিঠি, তাকে বলো—

জীবনের সবচেয়ে গভীর প্রেম সে পায় তখনই, যখন সে নিজের কাছেই প্রেমিক হয়ে ওঠে।”

চিঠিটা পড়ে মিঠি বুঝে গেল, এটা ঠিক প্রমথেশ কাকার লেখা নয়। হয়তো কোনও এক আগন্তুক, হয়তো কাকার পরবর্তী কোনও অতিথি, যে একদিন এসেছিল ঠিক তার মতো করেই। বনভিলা যেন এক ছায়া—যেখানে প্রতিটা মানুষ নিজেকে নতুন করে খুঁজে পায়।

মিঠি সেই চিঠিটা নতুন একটা খামে ভরে রেখে দিল বারান্দার টেবিলে, কাকার খাতাগুলোর পাশে। আর পাশে একটা ছোট নোট লিখল—

যে এই চিঠি খুলবে, সে যেন একদিন নিজের মতো করে লিখে নতুন কোনও চিঠি রেখে যায়। এটাই এই বাড়ির নিয়ম।

রাতে, কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে থাকতে মিঠির মনে হলো—
এই পাহাড়, এই আলো, এই নির্জনতা—সব মিলে তৈরি হয়েছে এক আশ্রয়। ভালোবাসার জন্য, যন্ত্রণার জন্য, অথবা কেবল নিজের সঙ্গে কথা বলার জন্য।

সে জানে, এখানে তার লেখা চিঠিগুলো একদিন হয়তো আর কেউ পড়বে না।
কিন্তু পাহাড় জানবে, সে এসেছিল।

পর্ব : আলো ফিরে আসে

আলো ফিরছে।
সেই আলো যেটা কেবল আকাশে নয়, বরং একটা মানুষের চোখে এসে পড়ে, তার অন্তরকে ছুঁয়ে যায়।

আজ বনভিলার বারান্দায় বসে মিঠির মনে হচ্ছিল—সে যেন আস্তে আস্তে অন্ধকার থেকে আলোয় উঠে এসেছে। প্রমথেশ কাকার রেখে যাওয়া চিঠি, স্মৃতি, অসমাপ্ত স্বপ্ন আর শব্দেরা তাকে এক নতুন জীবন দিয়েছে—যেখানে প্রতিটা সকাল আরেকটা খোলা পৃষ্ঠা।

অন্বেষা এবার আর শুধু ফোনে কথা বলছে না। সে মায়ের নতুন ঠিকানার ছবি দেখতে চায়, ভিডিও চায়। একদিন হোয়াটসঅ্যাপে লিখল—

“মা, তোমার গলা শান্ত শোনাচ্ছে। আগের মতো বিরক্ত লাগছে না তোমার কণ্ঠে।”

মিঠি হেসে উত্তর দিয়েছিল,

“শান্তি আসলে কাঞ্চনজঙ্ঘার একটা ভাষা, মা শিখে নিয়েছে।”

সেই রাতে মিঠি ঘরের একটা কোণে রাখা প্রমথেশ কাকার পুরোনো সানগ্লাস খুঁজে পেল। সানগ্লাসের ফ্রেমে একটা ছোট নোট ফিট করে ছিল—যেন কাকা সবকিছুই আগেই জানতেন।

“যদি কখনও তোকে রোদ্দুরে চোখ মেলে তাকাতে হয়, তখন এই চশমাটা পরে নিস। এতে তোর দেখা আলো একটু মৃদু হবে, কিন্তু তোর ভিতরের আলো জ্বলে উঠবে।”

মিঠি জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। পাইন গাছের মাথায় রাতের চাঁদ ধরা পড়েছে। দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা এখন কেবল ছায়া, কিন্তু সেই ছায়ার মধ্যেও আলো খেলা করছে।

পরদিন সকালে বনভিলার গেটে এক ভিন্ন ধরনের শব্দ শুনে মিঠি বেরিয়ে এল।

একজন যুবক দাঁড়িয়ে—চোখে বিস্ময়, হাতে ক্যামেরা, গলায় একটা কাপড়ের ঝোলা। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে বাড়ির প্ল্যাকার্ডের দিকে।

প্রেমিকদের জন্য একটি বারান্দা
যেখানে কেউ কাউকে ছুঁতে আসে না
শুধু আলো ভাগ করে নেয়।

ছেলেটা বলল, “এই লেখাটা… আমি অনেক বছর ধরে খুঁজছিলাম এটা কে লিখেছেন। আমার মা একবার এই বাক্য লিখে আমার বাবাকে চিঠি দিয়েছিলেন, যখন তিনি হিমালয়ের পাদদেশে নিখোঁজ হন। সেই চিঠি আজও আমাদের বাড়ির মন্দিরে রাখা আছে। আমি বিশ্বাস করি, সে চিঠির উৎস এখানেই।”

মিঠির গলা শুকিয়ে এল।
সে শুধুই বলল, “তুমি কি প্রমথেশের…?”

ছেলেটা হেসে বলল, “নাহ। আমি সেই অচেনা প্রেমিকদের একজন, যাদের কারও কথা লেখা হয়নি। কিন্তু সেই লেখার মধ্যেই আমরা থাকি।”

সন্ধ্যায় মিঠি সেই ছেলেটিকে নিয়ে বারান্দায় বসে। পাহাড় নিঃশব্দ। চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে। কাঞ্চনজঙ্ঘার গায়ে আলোর শেষ স্রোত।

ছেলেটা তার ক্যামেরা বের করে বলে, “আমি একটা ছবি তুলব। কিন্তু আপনার নয়, এই বারান্দার। এই আলোয় যে গল্প লেখা হচ্ছে, তা ধরে রাখতে চাই।”

মিঠি চুপচাপ মাথা নাড়ে।
ছবির শাটার ক্লিক করে।
আলো সেই মুহূর্তে ফ্রেমবন্দি হয়ে যায়।

সেদিন রাতে, মিঠি নিজের খাতায় আরেকটা চিঠি লেখে।

“এই পাহাড়ে আমি ফিরে এসেছি, কিন্তু সঙ্গে নিয়ে এসেছি আরও কিছু হারিয়ে যাওয়া পথিককে।

আমি এখন বুঝি, ভালোবাসা কখনও হারায় না।

সে শুধু রূপ বদলায়—কখনও চিঠি হয়ে, কখনও পাহাড়, কখনও বারান্দা।

সে ফিরবেই। ঠিক নিজের সময় মতো।

আলো ফিরে আসে।”

পর্ব ১০: শেষ চিঠির দিন

শেষের দিন বলে হয় না।
তবে কিছু দিন থাকে, যেদিন মনে হয়, একটা গল্প তার পূর্ণতা পেয়েছে।
আজ তেমনই এক দিন।

বনভিলার বারান্দায় বসে মিঠি শেষ চিঠিটা লিখছে। হাতে সেই পরিচিত কলম, কাগজে এখনও কাকার গন্ধ লেগে আছে যেন, আর সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা তার চূড়ার সাদা আলো নিয়ে বসে।
শান্ত। দৃঢ়। প্রহরীর মতো।

চিঠির উপরে লিখল—

শেষ চিঠি নয়, শুরু করার শেষ কথা।

“প্রমথেশ,

এতদিন ধরে যে সবকিছু লিখিনি, আজ লিখছি।

আমি তোমাকে চেয়েছিলাম। তা লুকিয়ে রাখিনি।
আমি ভয় পেয়েছিলাম—সমাজকে, বাবাকে, এমনকি তোমাকেও। কারণ তুমি আমার চোখে এক দেবতা ছিলে, আর দেবতাদের ছোঁয়া যায় না।

আমি জানি, তোমার চলে যাওয়া ছিল অভিমান নয়, মুক্তি।

আজ এত বছর পরে, পাহাড়ে ফিরে এসে আমি বুঝতে পেরেছি—তুমি আমাকে ভালোবাসা শেখাওনি, তুমি ভালোবাসাকে নিজেই হয়ে উঠেছিলে।

তুমি আমার জীবনের না-ঘটা প্রেম, যার জন্য আমার ভিতরটা বরাবর অন্ধকার থাকত।
আজ তা আলোকিত।

আমি এখন প্রতিদিন নতুন চিঠি লিখি, নতুন মুখ দেখি, নতুন আলোর ছায়া আঁকি।

কিন্তু কোনওদিন যদি আমার শব্দগুলো কাঁপে, কলম থেমে যায়, বুঝবে—আমি আবার তোমার দিকে তাকিয়ে আছি।

শেষ কথা বলার মতো কোনও শব্দ নেই।
কেবল একটি অনুভব—
তুমি ছিলে। আছো। থাকবে।

— মিঠি”

চিঠিটা লেখা শেষ হলে সে খামে ভরে বারান্দার টেবিলের নিচে গুঁজে রাখে, ঠিক যেমন কাকা রেখে যেতেন।

তারপর হাঁটতে হাঁটতে যায় পাইন গাছের নিচে।
সেখানে কাঠের ছোট্ট সাইনবোর্ড:
এই জায়গায় প্রেম রেখে যাওয়া যায়। কে রেখে গেছে, তা জানা নেই।

মিঠি বোর্ডে চক দিয়ে আরেকটা লাইন যোগ করে—

“যদি কারও চিঠি অসমাপ্ত থেকে যায়, সে যেন এখানে এসে শেষ করে।”

দুপুরের দিকে অন্বেষা আসে। মা–মেয়ের এই দেখা অনেকদিন পর।
অন্বেষা চুপচাপ বসে, পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি এখানে একা ছিলে, অথচ আমি কখনও ফোন না করে থাকতে পারিনি। এখন বুঝি, একা থাকাটাও একধরনের সম্পূর্ণতা।”

মিঠি মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসে।
সে জানে, ভালোবাসা রক্তের সম্পর্ক নয়, অনুভবের চর্চা।
যে নিজেকে ভালোবাসতে পারে, সে একদিন অন্যদের হৃদয়ের আলপথে পৌঁছাতে পারে।

সন্ধ্যার পর রত্নাদি বারান্দায় এসে দাঁড়ান।
“আপনি কি এবার ফিরবেন?”

মিঠি মাথা নাড়ে।
“না। আমি থাকব। কিন্তু এবার শুধু প্রেমিকাদের মতো নয়, পাহাড়ের প্রহরীর মতো। আমি পাহাড়া দেব সেইসব চিঠির, যারা এখনও লেখা হয়নি।”

সেই রাতে, কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় এক দণ্ড গোলাপি আলো পড়ে।
মিঠি জানে, কাকা এখন আর একটি নাম নয়—একটি আলো।
আর সেই আলোতেই সে তার সমস্ত অতীত, সমস্ত ভুল, সমস্ত আক্ষেপকে গলিয়ে দিয়েছে।

বিছানার পাশে রাখা খাতার শেষ পাতায় সে লিখে রাখে—

“ভালোবাসার গল্পে পরিণতি থাকে না।

কেবল বারান্দা থাকে, আর পাহাড়।

আর কিছু চিঠি, যেগুলো কখনও ডাকবাক্সে পাঠানো হয় না,

শুধু রেখে যাওয়া হয়—অপেক্ষার পাশে।”

শেষ

WhatsApp-Image-2025-07-14-at-12.47.48-PM-2.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *