Bangla - রহস্য গল্প

কাগজের মানুষ

Spread the love

সৌরভ রায়


এক

বহু বছর পর পাহাড়ের পাদদেশে পুরনো কাঠের বাড়িটায় ফিরেছেন অনিরুদ্ধ মুখার্জি। সময়টা নভেম্বরের শেষ, হিমেল বাতাস জানালার কাঁচে ঘষটে যাচ্ছে, আর গাছের ডালপালা কেমন যেন সুর করে কাঁপছে। কলকাতার শহুরে কোলাহল থেকে পালিয়ে আসা এই লোকটা একসময় নামী সাইকোলজিকাল থ্রিলার লেখক ছিলেন, কিন্তু গত ছয় বছর ধরে তার কলমে শব্দ নেই, চরিত্র নেই, কেবল এক শূন্যতা। বাড়িটা ছোট, কাঠের, একটু ঝুঁকে পড়েছে যেন সময়ের ভারে, কিন্তু তবু গৃহস্থালি আবহে নরম একটা শান্তি আছে এখানে। একসময় এই বাড়ির ঘরে ঘরে শব্দ ভেসে বেড়াত—পাখির ডাক, টাইপরাইটারের শব্দ, আর মাঝেমধ্যে হাসির ছায়া। এখন শুধুই নীরবতা, আর তাতে ভর করে আছে অনিরুদ্ধর ক্লান্ত মুখ, চোখে চশমা, সাদা হয়ে যাওয়া দাড়ি আর মুখে এক চিরন্তন দুশ্চিন্তা। তার লেখার টেবিলটি জানালার পাশে, যেখানে সন্ধ্যাবেলায় পাহাড়ে রোদ ঝরে পড়ে; কিন্তু সারা দিন তা অব্যবহৃত থাকে—যেন এক মৃত মঞ্চ, অপেক্ষায় নিজের নাট্যকারের।

তবে এই নির্জনতা ভেঙে গেল ঠিক সাত দিনের মাথায়। একদিন সন্ধ্যায়, যখন অনিরুদ্ধ চুপ করে বসে ছিল ঘরে, তখন পুরনো কাঠের সিঁড়ি যেন হালকা করে শব্দ করল, নিচতলার লিভিং রুম থেকে আসা এক অচেনা গন্ধ বাতাসে মিশে গেল। সে ভেবেছিল, হয়তো পুরনো কাঠ, অথবা রান্নাঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে ঢোকা শীতের স্রোত। কিন্তু কিছু ছিল অন্যরকম—কিছু অস্বাভাবিক, যেন কেউ আছে তার বাড়িতে। টেবিলের ওপরে রাখা খাতা খুলে, ছুঁয়ে দেখল—খুলে রাখা পাতায় এক নাম লেখা ছিল—“মায়া।” সে এই নামটিকে চেনে, অনেক দিন আগে একটা থ্রিলার উপন্যাস শুরু করেছিল যার কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিল এই মায়া নামের এক রহস্যময়ী নারী। কিন্তু সে তো শেষ অবধি লিখেইনি গল্পটা—কেবল কয়েকটি পরিচ্ছেদ, কয়েকটি বৈশিষ্ট্য, আর কিছু অনুভব। সমস্যা হল, সে গতকাল রাতে এই নাম লিখেছে কিনা—তা তার মনে নেই। সেই রাতেই সে যেন স্বপ্নে এক মহিলাকে দেখেছিল, তার গলা ভারী, কন্ঠে কুয়াশার মত ছোঁয়া, আর চোখের দৃষ্টিতে ছিল এক অদ্ভুত চুম্বকত্ব। ঘুম ভেঙে যায়, ঘামে ভেজা বিছানা, আর দরজার ওপাশে একটানা পায়ের শব্দ। কিন্তু ঘরে কেউ ছিল না।

এরপর প্রতিদিনই মায়া যেন একটু একটু করে জীবন্ত হয়ে উঠতে লাগল। একদিন লেখার সময় সে হঠাৎ অনুভব করল, কেউ তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ঘুরে তাকিয়ে কিছুই পেল না, কিন্তু সেই মুহূর্তে বাতাসটা থমকে গিয়েছিল, পেনের কালিও যেন অস্থির হয়ে উঠেছিল। রাতে চায়ের কাপ ঠাণ্ডা হয়ে যায়, কিন্তু সেই কাপ কখনও কখনও একটু সরানো পাওয়া যায়, যেমনটা ছিল না আগে। অনিরুদ্ধ নিজেই অবাক—সে কি ভুলে যাচ্ছে সবকিছু? নাকি কেউ এসে কিছু বদলে দিচ্ছে? তার কল্পনা চরিত্র কি শুধুই কল্পনা? নাকি তার নিজেরই মন তাকে প্রতারণা করছে? এতদিন পর ফের লেখার ইচ্ছেটা ফিরে এল, কিন্তু সেই ইচ্ছের পেছনে কেমন যেন এক অদৃশ্য হাত রয়েছে—যে তাকে লিখতে বাধ্য করছে, চরিত্র তৈরি করতে বলছে, আর মাঝে মাঝে সেই চরিত্রগুলো নিজের ইচ্ছেমতো গল্পে ঢুকে পড়ছে। মায়া এখন শুধু লেখার পাতায় নেই, সে যেন আস্তে আস্তে অনিরুদ্ধর জীবনে জড়িয়ে যাচ্ছে—তার নিঃসঙ্গতা ভেঙে দিয়ে, কিন্তু একই সঙ্গে এক অজানা আতঙ্কও বয়ে আনছে, যেমন করে কাগজের মানুষ কখনও কখনও নিজের লেখককেই গ্রাস করে নেয়।

দুই

রাত তখন গভীর, চারপাশে নিস্তব্ধতা এমন ঘন যে নিজের নিঃশ্বাসের আওয়াজকেও তীব্র মনে হয়। অনিরুদ্ধ বিছানায় শুয়ে, ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন, চোখ বন্ধ করলেই মায়ার মুখ ভেসে ওঠে—একজন নারী, যার চোখে আছে ছায়া, অথচ তাতে টানও আছে, আকর্ষণও আছে। হঠাৎ সে শুনতে পেল, কাঠের মেঝের ওপর ধীর পায়ের শব্দ—টুক… টুক… এক ধরণের ভারসাম্যহীন ছন্দে এগিয়ে আসছে কারও পা। বুক ধকধক করতে থাকে তার, শ্বাস আটকে আসে। শব্দটা দরজার কাছে এসে থামে, কিন্তু দরজাটা খোলে না। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সে যেন কারও উপস্থিতি অনুভব করে, কিন্তু চোখে কিছুই পড়ে না। সে ধীরে ধীরে উঠে বসে, আলো জ্বালায়, এবং দেখে খোলা দরজার নিচ দিয়ে কারও ছায়া সরে গেল। সে দৌড়ে ছুটে যায়, কিন্তু করিডোর ফাঁকা—দেয়ালে তার নিজেরই ছায়া কাঁপছে, জানালার ফাঁক দিয়ে আসা জ্যোৎস্নায় হালকা আলো ফুটে উঠেছে। এই মুহূর্তে তার মনে হয়, সে হয়তো ঘুমের মধ্যে কল্পনা করছে—কিন্তু পরদিন সকালে লেখার টেবিলে রাখা খাতার পাতা খুলে দেখে, রাতেই সে কিছু লিখেছে—অর্থবোধক বাক্য, সম্পূর্ণ বর্ণনা—মায়া একটি সাদা শাড়ি পরে, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে অনিরুদ্ধকে দেখছে।

এই লেখাগুলো তার নিজের হাতের লেখা—কিন্তু সে নিজে কিছুই মনে করতে পারছে না। এমন ঘটনা এরপর ক্রমাগত ঘটতে থাকে। কখনও দরজার কাছে পানির ছিটে, কখনও জানালার কাচে চাপা হাতের ছাপ, কখনও বাতাসে একটি সুগন্ধ ভেসে বেড়ায়, যা অদ্ভুতভাবে পরিচিত। সে খেয়াল করে, লেখার খাতার পাশে রাখা তার পুরনো টাইপরাইটারটি মাঝে মাঝে নিজের থেকেই শব্দ করতে শুরু করে—একেকটা শব্দ, একেকটা বাক্য—যা হুবহু মিলছে তার পুরনো অসমাপ্ত গল্পের সঙ্গে। এক দুপুরে, যখন সে বইয়ের তাক গোছাচ্ছিল, হঠাৎ একটা ফাইল পড়ে যায়—তাতে ছিল সেই পুরনো গল্পের কয়েকটা পাতার ছায়ালিপি, যার মূল চরিত্র ছিল ‘রবিন’। সে পাতাগুলো তুলে নিতে গিয়ে দেখে, সেখানে রক্তের মতো লাল কালি দিয়ে লেখা কিছু লাইন—‘তুমি ভুল করেছো, অনিরুদ্ধ। আমিও এসেছি।’ শরীরের ভেতরে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায় তার, যেন চোখের সামনে যা দেখছে তা বাস্তব নয়, অথচ অনুভব করছে ঠিকই।

সে এখন ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে, কেবল মায়া নয়—তার অতীতের অন্যান্য চরিত্ররাও যেন ফিরে আসছে। লেখার খাতায় ছড়িয়ে পড়ছে তাদের নাম, সংলাপ, ইতিহাস, এমনকি অপরাধের ছায়া। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো, তার নিজের জীবন কেমন করে যেন এই গল্পের কল্পনাকে অনুসরণ করছে। সে একরকম বাধ্য হয়ে লিখে চলেছে, যেন তার নিজের ইচ্ছা নেই, কলমটি কারো হাতের ক্রীড়ানক হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে সে নিজের ঘরে বসে আয়নার দিকে তাকায়, আর মনে হয়, যে মানুষটি সেখানে আছে সে নিজে নয়—বরং সে-ই কাগজের মানুষ, যে প্রতিদিন একটু একটু করে বাস্তব হচ্ছে, যার স্মৃতি আর কল্পনার মধ্যে পার্থক্য মুছে যাচ্ছে। এমন এক মুহূর্তে সে উপলব্ধি করে, নিজের বাড়িতে সে আর একা নেই—কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, সঙ্গে কে আছে? একজন কল্পনার নারী, নাকি এক ভয়ঙ্কর ছায়া, যাকে সে একসময় নিজেই সৃষ্টি করেছিল?

তিন

ঘুম থেকে জেগে উঠে অনিরুদ্ধ প্রথমেই টের পেল, কিছু একটা পাল্টে গেছে। জানালার পর্দা টেনে রাখা, অথচ আলো প্রবেশ করছে অস্বাভাবিক রকমের তীব্রতায়—জ্যোৎস্না নয়, সূর্যও নয়, যেন কোনো ধূসর আলো সারা ঘর জুড়ে ঢুকে গেছে। বিছানার পাশে রাখা পানির গ্লাসে ফেনা জমে উঠেছে, আর লেখার টেবিলটা যেন আরও একটু সামনে এগিয়ে এসেছে, যদিও সে স্পষ্ট মনে করতে পারছে না কোনো আসবাব সরানো। সে টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখে, খাতার পাতায় এক নতুন পরিচ্ছেদ লেখা, যার মধ্যে রয়েছে এক ভয়াবহ চরিত্রের উদ্ভব—নাম: রবিন। অনিরুদ্ধর হাত কাঁপে, কারণ রবিন কেবল একটি চরিত্র নয়, বরং তার নিজের লেখা প্রথম উপন্যাসের সবচেয়ে অন্ধকার দিক। ঠান্ডা মাথার খুনি, যে ভিকটিমদের সঙ্গে মানসিক খেলা খেলত, আর তার পদ্ধতি ছিল নিখুঁত ও নির্মম। কিন্তু সে উপন্যাস সে শেষ করেনি, বরং অর্ধেক লেখা রেখে দেওয়া হয়েছিল ড্রয়ারে—যে কেউ পড়ার কথা নয়।

এই পরিস্থিতিতে অনিরুদ্ধর মন ভেঙে পড়ে—কেন হঠাৎ রবিন ফিরে এল তার কাহিনিতে? সেই অসমাপ্ত উপন্যাসের খুনি চরিত্র এখন তার বর্তমান সময়ের লেখায় ফিরে আসছে, নিজের মতো করে চলাফেরা করছে পাতায় পাতায়, সংলাপ বলছে, এমনকি পেছন থেকে অনিরুদ্ধর গলায় নিঃশ্বাস ফেলছে বলে তার মনে হচ্ছে। ওই রাতে আবার ঘটল অদ্ভুত এক ব্যাপার—একটা চিঠি পাওয়া গেল দরজার নিচ দিয়ে গলানো, যেন কেউ বাইরে দাঁড়িয়ে রেখে গেছে। চিঠিতে লেখা, “যখন লেখক নিজেই ভুলে যায় কে লিখছে, তখন কাগজই হয়ে ওঠে আয়না।” হস্তাক্ষর ছিল অপরিচিত, কিন্তু শব্দগুলো তার ভেতরের গভীর ভয়কে নাড়া দিল। সে রাতেই খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল একটি ছায়ামূর্তি, যার মুখ নেই, চোখ নেই, কেবল এক জোড়া চপল হাত—যা বারবার অনিরুদ্ধর লেখার খাতা ছুঁয়ে দেখছিল, আর নিজের অস্তিত্বের চিহ্ন রাখছিল যেন।

পরদিন সকালে কাগজের এক কোণে একটা রক্তের দাগ দেখা গেল—যেন কেউ আঙুল কেটে লিখতে চেয়েছে কিছু। অনিরুদ্ধ মনে করার চেষ্টা করল—সে কি নিজেই রাতের বেলা কিছু লিখেছে? কিন্তু তার হাতের আঙুলে কোনো চিহ্ন নেই। এরই মধ্যে তার ভেতরে একটি গোপন ভয় কাজ করতে থাকে—রবিন কি কেবল গল্পের চরিত্র নয়? সে কি অনিরুদ্ধর নিজেরই কোনো ছায়া, যাকে সে এতদিন লুকিয়ে রেখেছিল নিজের ভিতর? হতে পারে, রবিন তার মানসিক বিভক্তির এক অন্ধকার দিক, যাকে সে কেবল কাগজে বন্দি রাখার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু এখন সেই কাগজটাই যদি ছিঁড়ে যায়? আর তখনই, লেখার খাতার একেবারে শেষ পাতায় সে দেখতে পায় একটি বাক্য—“এবার তুই মরবি, লেখক।” আর সেই বাক্যটাও লেখা নিজের হাতেই, কিন্তু তার মনে পড়ে না সে কখন লিখেছে। বাতাসটা যেন ভারী হয়ে আসে, দেয়ালের ঘড়ি থেমে থাকে, আর দূরে কোথাও থেকে এক ঠান্ডা হাসির আওয়াজ ভেসে আসে—এমন এক হাসি, যা সে কেবল রবিনের কল্পনায় শুনত, কিন্তু এবার সেটা বাস্তব।

চার

সকালে ঘুম ভাঙতেই অনিরুদ্ধ দেখে তার ফোনে প্রচুর মিসড কল, এবং এক অপরিচিত নাম্বার থেকে একটি ভয়েস মেইল। গলায় ছিল পুলিশি দৃঢ়তা—“আপনার এলাকায় গতরাতে একটি খুনের ঘটনা ঘটেছে, অনুগ্রহ করে যোগাযোগ করুন।” তার শরীর হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে গেল, মনে পড়ল সেই অদ্ভুত শব্দ, জানালার পাশে ছায়া দেখা, আর সেই শেষ বাক্য—“এবার তুই মরবি, লেখক।” গলায় যেন কেউ শ্বাস আটকে দিচ্ছিল, গলার কাছটা কুঁচকে আসছিল দুশ্চিন্তায়। সে কোনোভাবে নিজেকে সামলে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে, এবং ঘণ্টাখানেকের মধ্যে একজন পুলিশ অফিসার এসে হাজির হয় তার বাড়িতে—ইন্সপেক্টর দীপ্তিমান চক্রবর্তী। গম্ভীর মুখ, চোখে সন্দেহ, ঠোঁটে বিনয়ী কিন্তু দৃঢ় কথা। তিনি অনিরুদ্ধকে জানান, কাছাকাছি একটি পাহাড়ি ট্রেইলে একজন পর্যটকের মৃতদেহ পাওয়া গেছে, গলায় তার কাটা দাগ, ঠোঁটে একটা কাগজের টুকরো গুঁজে দেওয়া, আর আশেপাশে কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই—একেবারে নিখুঁত খুন। অনিরুদ্ধ স্তব্ধ হয়ে যায়। সে জানে এই স্টাইল কার—রবিন। এইরকম খুনের প্যাটার্ন সে এক দশক আগে লিখেছিল, এবং গল্পটা ছিল অপ্রকাশিত।

ইন্সপেক্টর চক্রবর্তী অনিরুদ্ধর মুখোমুখি বসে প্রশ্ন করতে শুরু করেন। তার সোজা প্রশ্ন—“আপনার এই কটেজে আপনি একা থাকেন?” অনিরুদ্ধ একটু দ্বিধা করে বলেন—“হ্যাঁ…মানে না…আমি একা থাকি, তবে…” তার গলায় আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখে ইন্সপেক্টরের চোখে কৌতূহল জেগে ওঠে। “তবে কী?” — অনিরুদ্ধ চুপ করে থাকে। সে কী করে বলবে যে তার সঙ্গে একজন কাল্পনিক নারী থাকে, একজন চরিত্র, যার অস্তিত্ব সে অনুভব করে, কিন্তু যার কোনো প্রমাণ নেই? সে কী করে বলবে, রবিন একজন কাগজের খুনি, কিন্তু এখন সেই খুনি বাস্তবে ঘুরে বেড়াচ্ছে? ইন্সপেক্টর চক্রবর্তী আবার প্রশ্ন করেন—“আপনি কিছুদিন ধরে লেখালেখি করছেন?” অনিরুদ্ধ মাথা নাড়ে, “হ্যাঁ, সামান্য কিছু…কয়েকটা পুরনো গল্প ঘাঁটছিলাম।” তখন ইন্সপেক্টর একটা সাদা খাম বাড়িয়ে দেন, যেটা মৃতদেহের পকেট থেকে পাওয়া গেছে। খামে ছিল একটি কাগজের টুকরো, তাতে লেখা ছিল—“দ্বিতীয় অধ্যায়, পৃষ্ঠা ৩৭, রবিন।” অনিরুদ্ধ আতঙ্কে কাঁপতে থাকে—এটা তারই লেখা, তারই অসমাপ্ত উপন্যাসের একটি অধ্যায়!

অনিরুদ্ধর মাথার ভেতর যেন বিস্ফোরণ ঘটে—সে কি আসলেই এতটাই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে যে সে নিজের গল্পকে বাস্তব করে ফেলছে? নাকি তার আশেপাশে কেউ আছে, যে তার লেখা পড়ছে, অনুসরণ করছে, এবং তার চরিত্রের মতো করে খুন করছে? সে কি একা? মায়া কি শুধুই কল্পনা? নাকি মায়াই রবিনকে জাগিয়ে তুলেছে? সেই রাতে, ইন্সপেক্টর চলে যাওয়ার পর, অনিরুদ্ধ আবার খাতার দিকে তাকায়—তার লেখা যেন নিজের ইচ্ছেতে এগোচ্ছে, প্রতিটা শব্দ যেন জ্যান্ত, আর প্রতিটা বাক্য যেন রক্তে ভেজা। সে লিখছে—“রবিন রাতের অন্ধকারে ফের ঘরে ফিরে আসে, মুখে হাসি, হাতে রক্তমাখা ছুরি। লেখকের দিকে তাকিয়ে বলে—‘তুই লিখলি, আমি করলাম।’” সেই মুহূর্তে, খাতার পাতার কোণ থেকে একটা ছায়া যেন নড়ছে বলে মনে হয় তার, আর জানালার বাইরে থেকে ভেসে আসে সেই ঠান্ডা হাসি—যেটা কেবল রবিনের মুখে মানায়। সেই মুহূর্তে অনিরুদ্ধ নিশ্চিত হয়, কাগজের চরিত্ররা আর কাগজে নেই—তারা এখন মাংস আর হাড় নিয়ে হাঁটছে, শ্বাস নিচ্ছে, আর সম্ভবত খুন করছে। আর সে? সে কেবল সেই গল্পের লেখক নয়, সে-ই সেই গল্পের পরবর্তী শিকার।

পাঁচ

ইন্সপেক্টর দীপ্তিমান চক্রবর্তী নিজেকে যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন দীর্ঘ কর্মজীবনে—অদ্ভুত ঘটনা, প্রেতাত্মা, অলৌকিকতা এসব তিনি কখনও পাত্তা দেন না। কিন্তু এই পাহাড়ি কটেজের নির্জনতা, একা বসবাসকারী একজন লেখক, তার অসমাপ্ত গল্পের চরিত্রের মতো ঘটতে থাকা খুন—সব কিছু যেন এক রহস্যময় পর্দায় মোড়া। সকালে আবার ফিরে এসে তিনি অনিরুদ্ধর টেবিল, লেখা খাতা, পুরনো টাইপরাইটার, বইয়ের তাক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। তিনি খেয়াল করেন, খাতায় যেসব ঘটনা লেখা আছে, তার অনেক কিছুই এক ধরনের আগাম বিবরণ, যেন ভবিষ্যতের চিত্রনাট্য। তিনি চুপ করে অনিরুদ্ধর দিকে তাকিয়ে বলেন, “আপনি জানেন, আপনার লেখা বাস্তবে ঘটে যাচ্ছে। আপনি কি নিশ্চিত যে এগুলো কেবল গল্প?” অনিরুদ্ধ অসহায়ের মতো মাথা নেড়ে বলেন, “আমি জানি না কীভাবে এগুলো হচ্ছে…আমি তো কল্পনা করি…কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় ওরা আমার সঙ্গে কথা বলে।” ইন্সপেক্টর দীপ্তিমান প্রথমবারের মতো থমকে যান।

তিনি নিজের খাতায় কিছু নাম নোট করেন—‘মায়া’, ‘রবিন’, ‘কালো ছায়া’, আর ‘তৃতীয় অধ্যায়’। এরপর বলেন, “আপনার লেখাগুলোর কোথাও কি এমন কিছু আছে, যা আগামী কিছু ঘটনার ইঙ্গিত দিতে পারে?” অনিরুদ্ধ থতমত খেয়ে বলে, “আমি এখনও কিছু লিখিনি, তবে মনে হচ্ছে আমার হাত চালাচ্ছে কেউ আরেকজন।” ইন্সপেক্টর এবার একটু এগিয়ে এসে বলেন, “আপনি কি গতরাতে একা ছিলেন?”—এই প্রশ্নে অনিরুদ্ধ চুপ করে থাকে। কারণ সে জানে, মায়া তার সঙ্গে ছিল। সে তার মুখ স্পর্শ করেছিল, পাশে বসেছিল, আর বলেছিল, “লিখে যাও, অনিরুদ্ধ…আমি আছি।” কিন্তু মায়ার কোনো প্রমাণ নেই—না কোনো চুল, না কোনো পদচিহ্ন, না কোনো ছায়া। এমনকি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোর পরেও কিছু ধরা পড়ে না। ইন্সপেক্টর বুঝতে পারেন, লেখক হয়তো সত্য বলছে, কিন্তু সেই সত্যটি বাস্তবের নয়, বরং মনস্তত্ত্বের গভীর গহ্বরে ডুবে থাকা এক বিকৃত আয়না, যেটা এখন বাস্তবতাকে বিকৃত করে তুলছে। তিনি বলেন, “তাহলে হয় আপনি মিথ্যা বলছেন, নয় আপনি নিজেই জানেন না আপনি কী করছেন।”

তারপর ইন্সপেক্টর বাড়ি ছাড়ার আগে ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে বলেন, “আমি ফিরে আসব, কিন্তু এবার হয়ত একজন সাইকিয়াট্রিস্টও সঙ্গে আসবেন।” অনিরুদ্ধর মাথা তখন দুলছে—সে নিজের হাতে রাখা লেখা পড়ছে, আর সেখানেও ইন্সপেক্টরের নাম উঠে এসেছে। একটা নতুন পরিচ্ছেদে লেখা—“ইন্সপেক্টর চক্রবর্তী ঘরে ফিরে আসেন না, কারণ তাঁর গলায় জড়ানো ছিল একটা ছায়া। ছায়াটা ছিল মায়ার।” এই বাক্য পড়ে তার হাত থেকে খাতা পড়ে যায়। সে তড়িঘড়ি করে বাইরে তাকায়, কিন্তু পাহাড়ে কুয়াশা জমে আছে, আর দূরের গাছের ফাঁকে সে যেন দেখতে পায় মায়ার মুখ, হেসে যাচ্ছে ঠান্ডা চোখে। তখনই সে বুঝে ফেলে, এই গল্প এখন আর তার নয়—গল্প তার মধ্যে দিয়ে নিজেকে লিখে চলেছে। আর ইন্সপেক্টর? সে এখন আর তদন্তকারী নয়—সে এই গল্পের পরবর্তী অধ্যায়ের মুখ্য চরিত্র, যার ভাগ্যও হয়তো লেখা হয়ে গেছে, রক্তে, ছায়ায়, আর কল্পনার হাড়গোড় দিয়ে তৈরি এক কাগজের দেহে।

ছয়

অনিরুদ্ধর ঘুম ভাঙে হঠাৎই, রাতের শেষভাগে, যখন জানালার কাঁচে কুয়াশা জমে এক অদ্ভুত ছায়ামূর্তি তৈরি করছে। বাতাস নিঃশব্দে গাছের ডাল নাচিয়ে যাচ্ছে, আর সেই শব্দ যেন কারও নিঃশ্বাস ফেলার মতো মৃদু অথচ থমথমে। সে বিছানা ছেড়ে জানালার কাছে আসে—তখনই তার চোখে পড়ে, দূরের পাহাড়ে ছোট্ট একটা আলো নড়ছে, যেন কেউ হাতে লণ্ঠন নিয়ে হেঁটে আসছে কুয়াশার ভেতর দিয়ে। বুকের ভেতর চিনচিনে একটা ভয় আর কৌতূহল একসঙ্গে জমতে থাকে। সে ছাদে উঠে যায়, মাথার ওপরে আকাশ চাপা হয়ে আছে, তারাগুলো যেন ছাইয়ে ঢাকা। লণ্ঠনের আলোটা এখন তার দৃষ্টিসীমার কাছাকাছি, কিন্তু আলোটাকে যে বহন করছে, সে যেন কুয়াশার গায়ে তৈরি মুখ—আলো কাঁপছে, ছায়া ঘুরছে, কিন্তু শরীর নেই। শুধু একটা মুখ, হেঁটে আসে কুয়াশা ছেঁদ করে। সেই মুখটা চেনা—মায়ার মুখ, কিন্তু এখন আর কোমল নয়, বরং যেন কাঁচে খোদাই করা ভয়াবহ বিকৃতি, চোখের তারা দুটো শূন্য, ঠোঁটগুলো চেপে ধরা, আর গলার নিচে কিছু নেই—শুধু কুয়াশা।

অনিরুদ্ধ ছাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে, কাঁধ কাঁপছে, কিন্তু দৃষ্টি সরাতে পারছে না সেই ভেসে আসা মুখ থেকে। মুখটা এবার যেন ফিসফিসিয়ে কিছু বলছে, কিন্তু শব্দ পৌঁছায় না। সে ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে শুধু একটা বাক্য পড়তে পারে—“আমি ফিরে এসেছি।” তখনই হঠাৎ করে মুখটা মিলিয়ে যায়, আর সেই মুহূর্তেই ঘরের ভেতর থেকে শব্দ আসে—সে দৌড়ে নিচে নামে, দেখে টেবিলের ওপর তার খাতা আবার খোলা, টাইপরাইটারে সদ্য লেখা হয়েছে কিছু শব্দ—“ছাদের কুয়াশা থেকে সে ফিরে আসে, এবার তাকে নিয়ে যেতে।” তার পায়ের নিচে ঠান্ডা হয়ে আসে মেঝে, আর বাতি গুলো টিমটিম করে জ্বলে ওঠে একে একে। সে বোঝে এই মুহূর্তে সে একা নেই। দরজার ফাঁক দিয়ে একটা ছায়া ঢুকেছে ঘরে, দেয়ালে দীর্ঘ একটা প্রতিবিম্ব পড়ছে, অথচ সামনে কেউ নেই। সে পেছন ফিরে তাকায়—শূন্যতা। কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই সে মুখটা দেখতে পায়।

সে তখন টাইপরাইটারটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় মেঝেতে, কিন্তু তাতেও কিছু বন্ধ হয় না। শব্দ আসতেই থাকে—টিক-টিক-টিক—নিজে থেকেই কী-বোর্ড চলতে থাকে, অদৃশ্য কারও আঙুলের ছাপ ফেলে। দেওয়ালে মায়ার ছবির বদলে এখন এক অদ্ভুত মুখ আঁকা—হাসি নেই, চোখগুলো লাল টকটকে, যেন রক্ত জমে আছে। অনিরুদ্ধ চিৎকার করে ওঠে, কিন্তু সেই চিৎকার শব্দ আকারে বেরোয় না, বরং যেন গলায় আটকে যায়, পেছন থেকে কেউ ঠেলে ধরে তার কণ্ঠনালী। তখনি সে জ্ঞান হারায়, পড়ে যায় মেঝেতে। তার শেষ দেখা দৃশ্য—ছায়াটা তার ঘাড়ে ঝুঁকে এসে ফিসফিসিয়ে বলছে, “তুমি যখন লিখো, আমি জেগে উঠি।” পরদিন সকালে অনিরুদ্ধর শরীর খাটে পাওয়া যায়, চোখ খুলে সে শুধু বলে, “মুখটা ফিরে এসেছে, এবার ও আমার নাম জানে…” আর খাতার নতুন পাতায় লেখা, “এই অধ্যায়ে লেখক নয়, চরিত্র মরবে—তাকে লেখা থামাতে হবে, না হলে কুয়াশার মুখ কেবল লেখার মধ্যেই নয়, বাস্তবেও ছড়িয়ে পড়বে।”

সাত

অনিরুদ্ধর চেতনা ধীরে ধীরে ফিরে আসে এক ভয়াল ভারে মোড়া সকালে, যেখানে ঘরজুড়ে ছড়িয়ে আছে গন্ধহীন কিন্তু ভীষণ ভারী এক স্তব্ধতা, যেন শব্দেরও সাহস নেই এ ঘরে ঢোকার। আগের রাতের আতঙ্ক তার স্নায়ুর গায়ে আঁচড় কেটে গেছে—কিন্তু সে ভুলে যেতে পারছে না টাইপরাইটারে আপনাআপনি লেখা লাইন, সেই ভেসে আসা মুখ, সেই অদৃশ্য প্রতিরূপ। কিন্তু এবার সে শুধু ভয়ে পালানোর পথ খোঁজে না—সে বুঝেছে, যতদিন না সে লেখার মধ্যে ঢুকে মুখোমুখি হয় সেই “মুখ” এর, ততদিন সে রেহাই পাবে না। সে টাইপরাইটার তুলে আবার টেবিলে রাখে, ভাঙা কী-বোর্ড জোড়া লাগিয়ে নতুন কাগজ রাখে, আর লিখতে শুরু করে—“যে মুখ কুয়াশার ভিতর থেকে এসে লেখকের চিন্তায় গেঁথে যায়, সে মুখ কি কেবল ছায়া, না কি সে প্রতিচ্ছবি, বাস্তবের ফাটলে থাকা আরেকটা অস্তিত্ব?” লিখতে লিখতে তার আশেপাশে আবার গাঢ় হয়ে ওঠে বাতাস, শব্দ থেমে যায়, কিন্তু শব্দহীনতার মধ্যেও শোনা যায়—আসছে সে। দরজার গায়ে ছায়া পড়ে, কিন্তু দরজা খোলা নেই—ছায়াটা যেন দরজার কাঁচে তৈরি নয়, বরং মনে তৈরি।

সে হঠাৎ করে আয়নার দিকে তাকায়—ঘরের কোণে রাখা পুরোনো আয়নাটা, যা এতদিন ঢাকা ছিল কাপড়ে, হঠাৎ যেন তাকে ডাকে। সে কাপড়টা সরায়, আয়নার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে এক মানুষ—অথচ সে নিজে নয়। সেই ছায়া তার চোখে তাকায়, আর অনিরুদ্ধ যেন তলিয়ে যেতে থাকে সেই দৃষ্টির গভীরে। আয়নার মানুষটি তার মতোই, কিন্তু চোখের মধ্যে ভয় নেই, বরং এক নির্মম শান্তি, ঠোঁটে একরকম হালকা ব্যঙ্গভঙ্গিমা। আয়নার অনিরুদ্ধ টাইপরাইটারে হাত রাখে—আয়নার মধ্যে—আর সেই মুহূর্তে বাস্তব টাইপরাইটারে শব্দ লেখা শুরু হয়। বাস্তবের অনিরুদ্ধ হাত সরিয়ে নেয়, কিন্তু শব্দ থামে না—“তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ, এখন আমি লিখব তোমাকে।” আয়নার প্রতিচ্ছবি ধীরে ধীরে ঘরের পেছনের দেওয়ালে একটা ফাটল তৈরি করে, আর সেই ফাটল যেন আলো গিলে নেয়। ফাটলের ওপারে একটা করিডোর দেখা যায়, ঝাপসা, কিন্তু অদ্ভুতভাবে পরিচিত—এটা যেন সেই উপন্যাসের গুহা, যে উপন্যাস সে শেষ করতে পারেনি। অনিরুদ্ধ বোঝে, এই করিডোর লেখার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে, আর সেখানে ঢুকতে হলে তাকে লিখেই পথ খুলতে হবে।

সে টাইপরাইটারের সামনে বসে, এবার আর কাঁপে না হাত, সে লেখে—“আমি সেই করিডোরে হাঁটছি, যেখানে দেয়াল ছুঁয়ে যায় সময়ের আগের স্মৃতি, আর প্রতিটি দরজার ওপাশে এক একটি মুখ অপেক্ষায় থাকে—মায়ার মুখ, তার নিজের মুখ, আর সেই মুখ যার নাম নেই, কেবল ভয়।” লেখার সাথে সাথে করিডোরে সে নিজেকে দেখতে পায়—হাঁটছে, দেয়ালের গায়ে হাত রেখে, আর হঠাৎই দেয়ালের ফাঁক দিয়ে একটা হাত বেরিয়ে আসে, টেনে নেয় তাকে ফাটলের ভিতরে। বাস্তবের অনিরুদ্ধ চোখ বন্ধ করে ফেলে—এবার সে জানে, সে তার লেখার চরিত্র নয়, বরং লেখা এখন তাকে চালাচ্ছে। করিডোরের শেষ প্রান্তে এক বিশাল আয়না দেখা যায়—আর সেখানে সে দেখে মায়ার মুখ, কিন্তু সেই মুখের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে আরেকটা সত্তা, যা মায়াকে অনুকরণ করেছে, এক বিকৃত মায়া—যার মুখে কোনও রক্ত নেই, চোখে আলো নেই, কেবল মুখ ভরা চাহনি—লিখতে বাধ্য করার, লিখতেই বাঁচার। সেই আয়না এখন ঘরের মধ্যেই ফুটে ওঠে—আর প্রতিটি শব্দ লিখলেই আয়না একটু করে ঝাপসা থেকে স্বচ্ছ হয়, যতক্ষণ না সে দেখতে পায়, সে নিজেই সেই প্রতিচ্ছবির গভীরে ঢুকে পড়েছে, আর ঘরের চারপাশে আয়নার মতো দেওয়াল গড়ে উঠছে, তাকে বন্দী করে এক কাল্পনিক কিন্তু নির্মম বাস্তবের গহ্বরে।

আট

ঘুম ভাঙার পরে অনিরুদ্ধ নিজেকে দেখতে পায় একটি সম্পূর্ণ অপরিচিত ঘরে, কিন্তু অদ্ভুতভাবে এই ঘরটিও যেন তার লেখার কোনও পুরোনো খসড়া থেকে উঠে এসেছে—দেয়ালে ঝোলানো মলিন ফ্রেম, জানালার বাইরে এক অন্তহীন কুয়াশা, আর মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা পুরনো খাতা, কলম, ছেঁড়া টাইপরাইটার রিবন। সে প্রথমে ভাবে, সে স্বপ্ন দেখছে, কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি সে বুঝে যায়—এটি সেই আয়নার ফাঁদ, যেখানে প্রতিচ্ছবিরা আসল মানুষকে আটকে রাখে, আর নিজেদের জগৎ তৈরি করে তার স্মৃতির ভিতর দিয়ে। ঘরটা নিঃশব্দ, কিন্তু নিঃশব্দতার মধ্যেও অনিরুদ্ধ টের পায়—সে একা নয়। হঠাৎই দেয়ালের এক কোণ থেকে একটি দরজা উন্মুক্ত হয়, আর সেখান থেকে বেরিয়ে আসে সেই বিকৃত মায়া—যার চোখে মায়ার আদল, কিন্তু চোখের মধ্যে কোনও অনুভব নেই, কেবল এক নিষ্ঠুর আত্মবিশ্বাস। সে ধীরে ধীরে অনিরুদ্ধর দিকে এগিয়ে আসে, তার ঠোঁট নড়ে, কিন্তু গলা থেকে কোনও শব্দ বেরোয় না, যেন তার বলা কথাগুলো কেবল অনিরুদ্ধর মাথার ভেতরেই বাজে—“তুমি আমাকে বানিয়েছিলে, এখন তুমি আমায় দেখছ। কিন্তু তুমি যদি মুখ ফিরিয়ে নাও, আমি তোমার জায়গা নেব।” অনিরুদ্ধ কাঁপতে কাঁপতে বলে, “তুমি মায়া নও। তুমি কে?” বিকৃত মায়া হেসে বলে, “তুমি যা লিখেছিলে, তারই ফাঁদে তুমি পড়েছ। এখন তুমি কেবলই ছায়া, আর আমি হলাম সত্যি।”

হঠাৎ করেই ঘরটা কাঁপতে থাকে, জানালার কাঁচ ফেটে পড়ে, আর বাইরে সেই করিডোরের ছায়া গড়াতে থাকে ভেতরে। অনিরুদ্ধ বুঝতে পারে, এই ঘর লেখার ফাঁদ—প্রতিটি বর্ণ, প্রতিটি বাক্য এখানে বাস্তব হয়ে ওঠে, আর যদি ভুল কিছু লেখো বা ভুল কিছু ভাবো, সেটা ছড়িয়ে পড়ে বাস্তবের মতোই। সে নিজের পকেটে হাত ঢোকায়—সেখানে এখনো সেই পুরনো নোটবুকটা আছে, যেখানে সে প্রথমবার লিখেছিল “মায়া” চরিত্রটিকে। সে খোলে সেই নোটবুক, আর দেখে, মায়ার গল্পের পৃষ্ঠাগুলোতে নতুন করে লেখা হয়ে গেছে অদ্ভুত সব লাইন, যেগুলো সে কখনও লেখেনি—“সে দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে, তার লেখককে খুঁজছে, কারণ লেখকই তাকে ফেলে গেছে মাঝপথে।” অনিরুদ্ধর মনে পড়ে, সে কখনই মায়ার গল্প শেষ করেনি, শেষ করার আগেই তার ভয় বেড়ে গিয়েছিল, আর সে পালিয়ে গিয়েছিল বাস্তব জীবনে। কিন্তু এখন গল্প তাকে ছাড়বে না, কারণ সে গল্প তারই আত্মার ফাঁদ। হঠাৎ সে দেখতে পায়, ঘরের আয়নাটা ভাঙা—কিন্তু প্রতিটি টুকরোর ভিতর দিয়ে তাকালে দেখা যায় আলাদা আলাদা দৃশ্য: এক জায়গায় মায়া হাসছে, আরেকটায় কাঁদছে, কোথাও বা সে অন্ধকারে হাঁটছে কারো হাত ধরে।

আয়নার টুকরোগুলো যেন আর শুধুই প্রতিচ্ছবি নয়—এগুলো সময়ের টুকরো, মনে গাঁথা কল্পনার আলাদা আলাদা রূপ। অনিরুদ্ধ এখন বুঝে যায়, এই ফাঁদ থেকে বেরোতে হলে তাকে নিজেই গল্পটাকে শেষ করতে হবে—যেভাবে সে ভয় পেয়েছিল, সেভাবে নয়, বরং যা সত্যি লেখা দরকার, তা লিখেই। সে টাইপরাইটার তুলে নেয়—হ্যাঁ, এই ঘরেই এক কোণে আছে সেই পুরনো টাইপরাইটার, যার উপর এক ছায়া পড়ে আছে ঠিক যেমন তার গল্পে বর্ণনা ছিল। সে বসে, কাগজ ঢোকায়, আর চোখ বন্ধ করে লিখতে শুরু করে—“মায়া জানত, সে বাস্তব নয়, কিন্তু তার অনুভব ছিল বাস্তবের মতোই। আর তাই সে লেখককে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল, যাতে লেখার শেষে একটা রূপরেখা থাকে, যেখানে সে হারিয়ে যাবে না, বরং মুক্তি পাবে।” প্রতিটি বাক্যে ঘরের দেওয়াল বদলে যেতে থাকে—দেয়ালের ছায়া সরে গিয়ে আলো আসে, মেঝের ফাটল বন্ধ হয়, আর বিকৃত মায়া পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে গলে যেতে থাকে কুয়াশার মধ্যে। অনিরুদ্ধ শেষ বাক্য লিখে ফেলে—“তখন লেখক বুঝল, প্রতিটি চরিত্রেরও মুক্তি দরকার, কারণ লেখা যতটা লেখকের, ততটাই তার চরিত্রদেরও।” সেই মুহূর্তে ঘরের মাঝে এক দরজা খুলে যায়, ঠিক যেখানে আয়নাটা ছিল। সে দাঁড়ায়, আর ফিরে তাকায় শেষবার—আয়নার টুকরোগুলো এখন ফাঁকা, প্রতিচ্ছবি নেই, কেবল তার নিজের মুখ, ভয়হীন, শান্ত, সত্যিকার লেখকের মতো।

নয়

বাইরের ঝড় ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল, অথচ ইথানের মনোভাব ছিল আরও বেশি অন্তর্গত তোলপাড়ে ভরা। তার লেখার ঘরটা অন্ধকার, শুধু ডেস্ক ল্যাম্পের আলোয় ছায়ারা লুকোচুরি খেলছিল। কাগজে কাগজে ছড়ানো অসংখ্য পাণ্ডুলিপি, আর একটিমাত্র খোলা খাতা—যেখানে শেষ লেখা হয়েছিল: “তারা জানত না, ঘরে আরও কেউ আছে।” ইথান লিখেছিল সেটা ঘুমোতে যাওয়ার আগে, কিন্তু জেগে উঠে সে দেখল সেই লাইনটা রক্ত দিয়ে মুছে দেওয়া, অক্ষরের জায়গায় রক্তাক্ত ছাপ, যেন আঙুল টেনে লেখাটা মুছে দিয়েছে কেউ। বুকের ভিতরটা ধকধক করতে লাগল। সে মনে করল, ওটা নিশ্চয়ই তার ভুল—আঙুল কেটে গিয়েছিল কখনও, রক্ত লেগে গিয়েছে। কিন্তু কিছুই মনে করতে পারল না। আয়নায় নিজের চেহারা দেখল—ক্লান্ত, কুয়াশায় ঢাকা চোখ, অথচ এক চিলতে অদ্ভুত ঠান্ডা হাসি তার ঠোঁটের কোণে, যেন অন্য কেউ ভেতর থেকে হাসছে।

পুলিশের একজন অফিসার সেই বিকেলেই আবার এসেছিলেন। তদন্তকার্যের অগ্রগতি নিয়ে প্রশ্ন করতে করতে হঠাৎই অফিসার মজুমদার প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনি কি একা থাকেন, ইথানবাবু? আপনি কি নিশ্চিত?” প্রশ্নটা স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু গলায় একটা ভিন্ন স্বর ছিল—যেন তিনি কিছু জানেন, কিছু লুকোচ্ছেন। ইথান জবাব দিল, “অবশ্যই আমি একা থাকি, আমার তো কেউ নেই,” কিন্তু অফিসারের চোখে এক মুহূর্তের জন্য চমকে উঠল কিছু—যা ইথানের মনে কাঁপন ধরাল। তারা চলে গেলে ইথান কাগজপত্র গুছাতে গিয়ে খেয়াল করল—একটা পুরনো খাতা, যেটা সে বহুদিন আগেই ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল, আবার ফিরে এসেছে। তার ভেতর পুরনো একটি গল্প—একজন লেখক যার লেখা চরিত্র বাস্তবে আসে, আর শেষ দৃশ্যে লেখকের নিজেরই মৃত্যু হয়। কে ফিরিয়ে রাখল সেই খাতা? আর কীভাবে? সে জানত, এটা কোনো অলৌকিকতা নয়, কোনো এক গভীর বাস্তব দুঃস্বপ্ন, যা লেখা থেকে জীবনে ঢুকে পড়েছে।

রাত বাড়তেই শব্দ আসতে লাগল—দরজার আড়ালে চুলচেরা পাতার খসখসানি, যেন কেউ কাগজ দিয়ে তৈরি শরীরে ধীরে ধীরে হাঁটছে, প্রতিধ্বনি তৈরি করছে। ইথান হালকা পায়ে উঠে বারান্দা অবধি গিয়ে দেখল—নিচের সিঁড়িতে রক্তের মতো লাল দাগ, যা ধাপে ধাপে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে অন্ধকারের দিকে। ভেতরে কারও নিশ্বাসের শব্দও শুনতে পেল সে, হালকা, তবু প্রকট। সে কাঁপতে কাঁপতে নিজের লেখার ঘরে ফিরে এলো, দরজা আটকে দিল। কিন্তু তখনই সে অনুভব করল—ঘরে সে একা নেই। ডেস্কের পাশে রাখা চেয়ারটা ঘোরানো ছিল। এখন সেটা তার দিকে মুখ করে। আর সেখানেই বসে আছে একটা মানুষের মতো কিছু—কিন্তু তার চেহারা ছিল পুড়ে যাওয়া কাগজে গঠিত, চোখের জায়গায় শুধুই ফাঁকা ছিদ্র, আর বুকের ওপর একটা কলম গোঁজা, যেন অস্ত্র। ইথান চিৎকার করতে পারল না। শব্দ আটকে গেল গলায়। চরিত্রগুলো সত্যিই এসেছে—তবে সে কি এখনও লেখক, নাকি শুধু গল্পের আরেকটি চরিত্র মাত্র?

দশ

ইথান ভয়ে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল সেই বস্তুটির দিকে, যার শরীর পুড়ে যাওয়া কাগজের মতো আর চোখের জায়গায় ফাঁকা ছিদ্র—ঠিক তার নিজেরই লেখা একটা পুরনো গল্পের চরিত্রের মতো। আস্তে আস্তে সেই কাগজ-মানব উঠে দাঁড়াল, শরীর থেকে পচা কালি আর পোড়া কাগজের গন্ধ ছড়াতে লাগল, আর ইথান যেন ঠিক তৎক্ষণাৎ বুঝে গেল—সে আর নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণে নেই। তার সমস্ত লেখা, যে গল্পগুলো সে দুঃস্বপ্নে লিখেছিল বা ছিঁড়ে ফেলেছিল, সবই ফিরে এসেছে, তার ঘরের চারপাশে কাগজের ভুতুড়ে অস্তিত্ব হয়ে। ওরা এখন চায় শেষ লাইন। ওরা চায় গল্পের সমাপ্তি, সেই সমাপ্তি যেখানে লেখকও থাকে না। দরজার বাইরে কারা যেন আস্তে আস্তে দরজায় আঘাত করছিল, যেন কেউ অপেক্ষা করছে তার চিৎকার শোনার জন্য, অথচ তার গলা যেন থেমে গেছে কোনো অভিশপ্ত নীরবতায়। তার ডেস্কে রাখা খাতাটা হঠাৎ নিজে নিজেই খুলে গেল—শেষ পাতায় লেখা ছিল না কিছুই, সাদা। আর সেই সাদা পাতায় কালি ছড়াতে লাগল অদৃশ্য হাতে—“ইথান অলরেডি ডেড।” তার নিজের হাত তখন কলম তুলে নিচ্ছে, সে চাইছে থামাতে, কিন্তু হাত আর নিজের ছিল না।

হঠাৎ করে আলো নিভে গেল। পুরো ঘরটা ঢেকে গেল অন্ধকারে, কিন্তু সেই অন্ধকার ছিল না নিঃসঙ্গ। অন্ধকারের মধ্যেই যেন শত শত কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে উঠল—সব চরিত্র, সব গল্প, সব কাল্পনিক ভূত—যাদের সে সৃষ্টি করেছিল, হত্যা করেছিল, বিস্মৃত হয়েছিল—তারা ফিরেছে, প্রতিশোধ নিতে নয়, বরং তাকে তাদের একজন করে তুলতে। এক পৃষ্ঠায় একের পর এক লাইন ভেসে উঠতে লাগল—ইথান হাঁটছে বারান্দায়, ইথান দেখছে নিজেকে আয়নায়, ইথান বুঝতে পারছে সে আর বাস্তব নয়। সে আয়নায় তাকিয়ে দেখল—সে নিজেই কাগজ হয়ে গেছে। তার চোখ এখন ফাঁকা, শরীর থেকে গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে ছিঁড়ে যাওয়া শব্দ, অক্ষর, বাক্য। সে তখন বুঝল—গল্পটা শেষ হয়নি কখনো। বরং প্রতিবার সে যখন একটা গল্প শেষ ভেবে কলম নামিয়েছে, ওরা জেগে উঠেছে, অপেক্ষা করেছে এই দিনটির জন্য। সে শুধু লেখক নয়, এখন আরেকটা কল্পিত চরিত্র—নিজের তৈরি মরণকাব্যের এক অনুচ্ছেদ।

ভোর হওয়ার আগে তার ডেস্কে পড়ে থাকা খাতার পৃষ্ঠাগুলো সব ভরে গেছে লেখা দিয়ে—অথচ সে কিছুই লেখেনি। শেষ পাতায় লেখা ছিল একটি মাত্র লাইন—“এই ছিল ইথানের গল্পের শেষ, কিন্তু আমাদের শুরুর কালি মাত্র।” তারপর সকালবেলায় পুলিশ যখন বাড়িতে আসে, তারা দেখে ইথানের ঘর খোলা, কিন্তু ভেতরে কেউ নেই। ডেস্কে পড়ে থাকা খাতাটি খুলতেই দেখা যায়, প্রতিটি পৃষ্ঠায় লেখা এক ভয়াবহ, অজানা কাহিনি—আর শেষ লাইনের নিচে রক্তাক্ত ছাপের মতো হাতের ছোঁয়া। কেউ বলে ইথান পাগল হয়ে পালিয়েছিল, কেউ বলে ওটা একটা আত্মহত্যা। কিন্তু যে অফিসার প্রথম খাতাটা হাতে নেয়, তার চোখ ফাঁকা হয়ে যায়, ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে, এবং সে নিজেই খাতার এক কোণে কলম দিয়ে লিখে ফেলে: “Let the next story begin…”—ঠিক যেমন ইথান একদিন শুরু করেছিল। একেকজন লেখকের গল্প শেষ হয় কালি দিয়ে, আর কিছু গল্প—শুরুই হয় রক্ত দিয়ে।

শেষ

 

1000048201.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *