হিমাদ্ৰী ঘোষ
১
বস্তির সকাল সবসময় একরকম শব্দে ভরা—খটাখট হাঁড়ি-বাসনের শব্দ, চায়ের দোকানের কেটলি থেকে উঠতে থাকা সিটি, ভাঙা টিনের চালের ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করা সূর্যের লালচে আলো আর তার সঙ্গে মিলেমিশে থাকা ছোট ছোট শিশুদের কোলাহল। এখানে সকাল মানেই নতুন দিনের লড়াই শুরু। কেউ ভোরেই কাজে বেরিয়ে পড়ে, কেউ বা কুপির আলো নিভিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে রাতভর ইটভাটায় কাজ করে আসার ক্লান্তি নিয়ে। মায়েদের হাঁকডাক আর কিশোরদের কাশি-মেশানো অস্থিরতা মিশে যায় বাতাসে। এর মাঝেই ঘুড়ির নাম উঠলেই বদলে যায় আবহ। যেন এক মুহূর্তের জন্য হলেও দারিদ্র্যের আঁকড়ে ধরা হাতটা আলগা হয়ে যায়, আর আকাশ থেকে নেমে আসে রঙিন আশার ছটা। ভাঙা বস্তি, পাকা রাস্তায় জমে থাকা নোংরা পানি, স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ—এসবের মধ্যে শিশুরা ঘুড়ি নিয়ে কথা বলতেই শুরু হয় হাসি, চিৎকার আর উত্তেজনা। যেন তারা সবাই ভুলে যেতে পারে যে পেট ভরে খাওয়া হয়নি, বা বাবা-মায়ের চোখে ভরপুর ক্লান্তি।
রাহুল, দলটার সবচেয়ে বড়, ভোরবেলা চায়ের দোকানে কাজে যাওয়ার আগে হাতে কাগজের টুকরো আর বাঁশের কঞ্চি নিয়ে বসে যায়। সূর্যের আলো তার চোখে পড়ে, সে ঘাম মুছে আঠা মাখতে থাকে মনোযোগ দিয়ে। বাকি বাচ্চারা একে একে তার চারপাশে জড়ো হয়—কেউ গল্প বলে, কেউ উঁকি দেয়, কেউ আবার খালি হাতে সুতো ছুঁয়ে দেখে। বস্তির ছেলেমেয়েদের কাছে রাহুল একরকম জাদুকরের মতো, কারণ সে জানে কীভাবে কাগজকে আকাশের ডানায় পরিণত করতে হয়। সাবা, একমাত্র মেয়ে, বসে বসে তার কাজ দেখে আর স্বপ্নে বিভোর হয়ে ভাবে—”একদিন আমি ডাক্তার হবো, আমার জীবনও ঘুড়ির মতো উড়বে।” মুন্না এক মুহূর্তও চুপ করে থাকে না, তার হাসি আর কৌতুক সবার মনকে হালকা করে দেয়। আলি একটু দূরে বসে থাকে, সে কম কথা বলে, তবে চোখের দৃষ্টিতে বোঝা যায়—ঘুড়ি ওড়ানোর উত্তেজনা তাকে ভেতরে ভেতরে আলোড়িত করছে। ছোট্ট গুড্ডু সবার পেছনে দাঁড়িয়ে লাফাতে থাকে, কখন যে তার হাতে সুতো ধরানো হবে, সেই আশায়।
বস্তির মায়েরা এই দৃশ্য দেখে খানিকটা হেসে নেয়। আমিনা খালা, সাবার মা, হাঁড়িতে ভাত বসাতে বসাতে বলে ওঠেন, “তোরা সারাদিন এই ঘুড়ি-ঘুড়ি করবে? পেট ভরবে কি ঘুড়ি খেয়ে?” তবুও তার চোখের কোণে চাপা মমতা লুকোনো থাকে। তিনি জানেন, এই ঘুড়িই হয়তো বাচ্চাদের মনকে জীবনের কষ্ট থেকে খানিকটা দূরে নিয়ে যায়। রাহুলের মা শীলা আবার পাশ থেকে তাকিয়ে ভাবেন—“বাবা যদি বেঁচে থাকত, তবে আজ হয়তো রাহুল পড়াশোনা করতে পারত।” কিন্তু সেই আফসোসের পরেও তিনি নিজের ছেলের হাতে তৈরি ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে খানিকটা গর্ব অনুভব করেন। কারণ কাগজের ওই টুকরোটা শুধু খেলনা নয়, ওটা তার ছেলের জেদের প্রকাশ, তার আশা বাঁচিয়ে রাখার চিহ্ন।
এভাবেই বস্তির সকাল শুরু হয়—মাটির ঘর, ভাঙা টিনের চাল, ধুলোবালির পথ, আর তার মাঝখানে রঙিন স্বপ্নের ছিটেফোঁটা। ঘুড়ির কথা উঠলেই যেন সবাই এক অন্য জগতে চলে যায়। শিশুরা হাসে, দৌড়ায়, ঝগড়া করে, আবার মিলেমিশে যায়। ভোরের আলোয় যে বস্তির ছবি ছিল শুধু কষ্ট আর ক্লান্তিতে ভরা, সেই ছবিতে ধীরে ধীরে রঙ মাখতে থাকে কাগজের ঘুড়ি। আকাশ তখনও ফাঁকা, কিন্তু বাচ্চাদের চোখে দেখা যায় সেই আকাশ ভরে উঠেছে শত শত ঘুড়ির ভিড়ে। দারিদ্র্য তাদের ঘর আটকে রাখলেও কল্পনা আটকে রাখতে পারে না। এই ভোরেই যেন শুরু হয় তাদের দিন, শুরু হয় তাদের লড়াই—যেখানে ঘুড়ি মানে শুধু খেলা নয়, বরং বেঁচে থাকার একরকম শক্তি।
২
রাহুলের দিনটা শুরু হয় অন্য সবার মতো নয়। ভোরে ঘুম ভাঙার পর থেকেই তার মাথায় ঘুরতে থাকে ঘুড়ির পরিকল্পনা। চায়ের দোকানে যাওয়ার পথে কিংবা ফেরার সময়ে সে নজর রাখে কে কোথায় কী ফেলে দিচ্ছে। রাস্তার ধারে দোকানিদের ছিঁড়ে ফেলা পোস্টার, মিষ্টির বাক্সের রঙিন কাগজ, এমনকি বাচ্চাদের খাওয়া শেষ চিপসের মোড়ক—সবকিছুই তার চোখে সম্ভাবনার খোরাক। অন্যরা যেটাকে আবর্জনা মনে করে, রাহুল সেটাকেই গড়ে তোলে একখণ্ড রঙিন স্বপ্নে। বাঁশের কঞ্চি কুড়িয়ে এনে সেগুলোকে ছেঁটে নেয় সমান আকারে, পুরোনো আঠার বোতল কেটে বের করে শুকনো অংশে একটু পানি মিশিয়ে নতুন করে বানিয়ে নেয় আঠা। তার এই একাগ্রতা দেখে মনে হয়, যেন কোনো শিল্পী মাটির দলা থেকে মূর্তি গড়ে তুলছে। বস্তির মাটির চৌকাঠে বসে, ছোট্ট পাটি পেতে, সে যত্ন করে বাঁশ কেটে, কাগজ মেপে, সুতো টেনে সাজিয়ে তোলে ঘুড়ির কাঠামো। বাকি বাচ্চারা তার চারপাশে দাঁড়িয়ে বিস্মিত চোখে দেখে—কেমন করে এই ছেলে আবর্জনা থেকে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে।
সাবা সবসময় সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয় রাহুলের কাজে। সে চুপচাপ বসে দেখে কেমন করে একটা কাগজের টুকরো আকার পেতে পেতে একসময় আকাশ ছোঁয়ার উপযোগী হয়ে ওঠে। সাবার কাছে রাহুল কেবল ঘুড়ি বানানোর কারিগর নয়, বরং একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, যে জীবনের দুঃখকষ্টকে রঙিন কাগজে মুড়ে আনন্দে রূপ দিতে পারে। মুন্না অবশ্য বসে থাকতে পারে না। রাহুল যখন বাঁশের কঞ্চিতে সুতো বাঁধতে থাকে, মুন্না মজা করে বলে ওঠে, “দেখিস, আজ আমার ঘুড়িই সবার আগে আকাশে উঠবে।” তার কথায় হাসির রোল পড়ে যায়, কিন্তু রাহুল কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। তার চোখ তখন ঘুড়ির কাঠামোয়, আঙুলগুলো নড়ছে নিখুঁত ছন্দে। আলি চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে, মাঝে মাঝে এগিয়ে এসে সুতোর টান কষে দেয়। তার হাতে সামান্য অক্ষমতা থাকলেও তার সূক্ষ্ম দৃষ্টি রাহুলকে ভুল করতে দেয় না। গুড্ডু আবার বাচ্চা সুলভ ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে ঘুড়ির কাগজ ছুঁতে চায়, কিন্তু রাহুল কোমল হেসে বলে, “অপেক্ষা কর, তুই প্রথমে এটাকে উড়তে দেখ, তারপর তোর হাতে দেব।” সেই কথায় গুড্ডুর চোখে জ্বলে ওঠে উত্তেজনার আলো।
রাহুলের মা শীলা পাশ থেকে তাকিয়ে থাকেন। ঘরের কোণে ভাঙা হাঁড়ি-মাটির পাত্র, খোলা চুলোর পাশে অল্প কিছু চাল আর ডাল—এ সব দেখেই বোঝা যায় সংসারের দৈন্য। কিন্তু এই অভাবের মধ্যেও ছেলেটির ঘুড়ি বানানোর একাগ্রতায় তার মনে এক অদ্ভুত শক্তি জাগে। তিনি ভাবেন, হয়তো ঘুড়ি কোনোদিন সংসারের ভাত জোগাবে না, তবুও এটাই তার ছেলের বাঁচার আনন্দ। বস্তির অন্যরাও মাঝে মাঝে এসে দাঁড়ায়, কেউ দেখে মুগ্ধ হয়, কেউ বলে, “এইসব ফালতু জিনিসে সময় নষ্ট কোরো না।” কিন্তু রাহুল কারও কথায় কর্ণপাত করে না। সে জানে, ঘুড়ি তার কাছে শুধু খেলা নয়, বরং একধরনের মুক্তি। যখন তার ঘুড়ি আকাশে ওঠে, তখন সে নিজেকে আর বস্তির ছেলে মনে করে না—সে তখন আকাশের মালিক, মুক্ত বাতাসের যাত্রী।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে রাহুলের হাতের কাজ শেষে তৈরি হয় একখানা ঘুড়ি। ফেলে দেওয়া কাগজ আর বাঁশের কঞ্চির তৈরি হলেও সেটার মধ্যে রঙের ছটা, আকারের নিখুঁত রেখা, সুতোর টান—সব মিলিয়ে এমন সৌন্দর্য, যেন দোকানে বিক্রি হওয়া দামি ঘুড়িকেও হার মানায়। শিশুরা উল্লাসে চিৎকার করে ওঠে, যেন কোনো অলৌকিক সৃষ্টি চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মুন্না দৌড়ে গিয়ে সুতোর রিল তুলে নেয়, সাবা হাততালি দেয়, আলির চোখে গর্বের ঝিলিক দেখা যায়, আর গুড্ডু লাফাতে থাকে আনন্দে। রাহুল হাসে না, কেবল ঘুড়ির পাতলা কাগজটা আঙুল দিয়ে আলতো ছুঁয়ে দেখে, যেন সে তার নিজের স্বপ্নকেই ছুঁয়ে দেখছে। তারপর সে ঘুড়িটাকে মাথার ওপর তুলে ধরে বলে, “এই আকাশের কোনো মালিকানা নেই, সবাই সমান, আর আমাদের স্বপ্নও একদিন এর মতোই উড়বে।” সেই মুহূর্তে মনে হয়—দারিদ্র্যের ধুলো-মলিন জীবনের ভেতরেও সৌন্দর্য জন্ম নিতে পারে, যদি কারও হাতে থাকে সেই জাদুর ছোঁয়া।
৩
সাবা বস্তির অন্য বাচ্চাদের মতো চঞ্চল নয়, সে একটু আলাদা। চুলে সবসময় হিজাব বেঁধে রাখে, চোখ দুটো বড় আর কৌতূহলে ভরা। ঘুড়ি ওড়ানোর দলে সে থাকলেও, তার হাতে কখনও সুতো ধরা পড়ে না। রাহুলের মতো কারিগরি দক্ষতা নেই, মুন্নার মতো দৌড়ঝাঁপ করার শক্তি নেই, আলির মতো ধৈর্যও নেই। তবু দলে তার আলাদা গুরুত্ব আছে। সবাই যখন ব্যস্ত থাকে ঘুড়ির বাঁশ কেটে মাপ নিতে বা সুতো মেলাতে, সাবা তখন বসে বসে গান গায়—পুরনো লোকগান, কখনওবা মায়ের কাছ থেকে শেখা দোয়া বা ছড়াগান। তার গলা মিষ্টি, সেই সুরে কাজ করতে থাকা বাচ্চাদের মনটা হালকা হয়ে যায়। যেন কঠিন বস্তির জীবনে ছোট্ট এক ঝলক উৎসবের হাওয়া বয়ে যায়। মাঝে মাঝে সে গল্পও বলে—ডাক্তারের গল্প, যিনি অসুস্থ মানুষকে সারিয়ে তোলে; কিংবা রাজকন্যার গল্প, যে দুঃখের বাঁধা ভেঙে নিজের আকাশ খুঁজে নেয়। তার বলা প্রতিটি গল্প আসলে নিজের মনের স্বপ্নের প্রতিফলন, যা সে লুকিয়ে রাখে না বরং সবার সঙ্গে ভাগ করে নেয়।
সাবার স্বপ্ন ডাক্তার হওয়া। যখনই সে বস্তির কারও অসুখ দেখে, মনের মধ্যে অদ্ভুত ব্যথা জমে ওঠে। তার মা আমিনা প্রায়ই বলেন, “মেয়ে, পড়াশোনা কর, তুই যদি মানুষ হস তবে আমাদের এই জীবন বদলাবে।” কিন্তু বাস্তবতা বড় কঠিন। টাকার অভাবে স্কুলে যাওয়া নিয়মিত হয়ে ওঠে না। তবু সাবার চোখে সেই স্বপ্ন জ্বলজ্বল করে। ঘুড়ি আকাশে উঠতে দেখলেই সে ভাবে, তার জীবনও যদি একদিন এমন উড়তে পারত—সব বাধা, সব অভাবকে ছাপিয়ে ওপরে ওঠা। আকাশের মতো সীমাহীন হতে পারা। সাবা জানে সে ঘুড়ি ওড়াতে পারে না, হাত ফসকে যাবে, সুতো ছিঁড়ে যাবে। কিন্তু তার মনের ভেতর সে প্রতিদিন নিজের একটা ঘুড়ি উড়ায়, যেখানে লেখা থাকে—“আমি একদিন ডাক্তার হবো।” বস্তির ময়লা, দুঃখ, কষ্টের মধ্যে সেই স্বপ্নটাই তাকে বাঁচিয়ে রাখে।
বাকি বাচ্চারা তাকে নিয়ে খোঁচা দিলেও সে কষ্ট পায় না। মুন্না মজা করে বলে, “সাবা, তুই শুধু গান গা, ঘুড়ি সামলাতে পারবি না।” গুড্ডু লাফিয়ে বলে, “আকাশে উড়তে গেলে তো পাখি হতে হয়।” সাবা হেসে জবাব দেয়, “তাহলে আমি পাখির গান গাইব।” তার এই সরল উত্তর সবার মুখে হাসি ফোটায়। রাহুল অবশ্য সাবাকে খুব সম্মান করে। একদিন যখন আকাশে একসঙ্গে কয়েকটা ঘুড়ি উড়ছিল, রাহুল বলেছিল, “তুই ঘুড়ি ধরতে পারিস না, কিন্তু আমাদের মনকে আকাশে তোকে দিয়েই উঠিয়ে দিই। তোর গান ছাড়া এই দলটা অসম্পূর্ণ।” সেই কথায় সাবার চোখ ভিজে উঠেছিল। কারণ সে বুঝেছিল, তার স্বপ্নকে কেউ একজন অন্তত গুরুত্ব দিচ্ছে। তার মনে হয়েছিল, একদিন যদি সে সত্যিই ডাক্তার হতে পারে, তবে সে শুধু নিজের জন্য নয়, এই পুরো বস্তির শিশুদের জন্য আকাশ ছোঁবে।
সেদিন বিকেলে আকাশে অনেকগুলো ঘুড়ি ওড়ছিল। হাওয়া ছিল দমকা, ঘুড়িগুলো কাঁপছিল, কেউ ছিঁড়ে যাচ্ছিল, কেউ আবার একে অপরের সঙ্গে লড়াই করছিল। সাবা দূর থেকে বসে সব দেখছিল। তার চোখে তখন শুধু ঘুড়ি নয়, নিজের জীবনও ভেসে উঠছিল—কখনও কেটে যাচ্ছে, কখনও টিকে আছে। কিন্তু একসময় রাহুলের বানানো ঘুড়ি বাতাসে ভেসে উঠে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল, উঁচুতে উঠতে লাগল একের পর এক। সবাই চিৎকার করল আনন্দে। সাবা তখন মনে মনে বলল, “আমার জীবনও একদিন এমনভাবে উঠবে, থামবে না, কেটে যাবে না।” সেই প্রতিজ্ঞা তার ভেতরে শক্তি হয়ে জমা হলো। ঘুড়ির আকাশ শুধু খেলার আকাশ নয়, ওটা ছিল তার স্বপ্নের আকাশ।
৪
মুন্না বস্তির সেই ছেলে, যার উপস্থিতি মানেই একরকম হইচই। ওকে দেখলে মনে হয়, দারিদ্র্য বা অভাব নামের কোনো শব্দ তার অভিধানে নেই। সকাল থেকে সন্ধ্যা, যে সময়ই হোক, তার মুখে লেগে থাকে দুষ্টু হাসি। অন্যরা যখন ঘুড়ির কাঠামো তৈরি করতে বা সুতো গুছাতে ব্যস্ত, মুন্না তখন মজার মন্তব্য ছুড়ে দিয়ে সবাইকে হাসায়। কখনও সে আঙুলে কাগজ কেটে ফেললে রাহুলকে খোঁচা দেয়—“কারিগরের আঙুলও নাকি ভোঁতা!” আবার কখনও সাবার গান শুনে বলে ওঠে—“এবার তো মনে হচ্ছে ঘুড়ি হাওয়া নয়, তোর গানের জোরেই উঠবে।” তার চিৎকার, দৌড়ঝাঁপ, অনবরত ঠাট্টা—সবকিছুই বাকি শিশুদের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, তার চোখে কখনও জীবনের কষ্টের ছাপ ধরা পড়ে না। যেন হাসিই তার একমাত্র ভাষা, একমাত্র অস্ত্র।
ঘুড়ি ওড়ানোর সময় মুন্না পুরোপুরি অন্য মানুষ হয়ে ওঠে। সে দৌড়ে যায় মাঠের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে, হাতে সুতো টানতে টানতে। আকাশে ঘুড়ি উঠতে থাকলে তার গলা থেকে বের হয় এক অদ্ভুত চিৎকার—যেন বিজয়ের স্লোগান। কেউ যদি তার ঘুড়ির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সে আরও জোরে টান মারে। আর যখন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর ঘুড়ির সুতো কেটে দেয়, তখন সে লাফিয়ে ওঠে, হাততালি দেয়, চেঁচিয়ে বলে—“এই তো মুন্নার জাদু!” তার সেই আনন্দ দেখে মনে হয়, পৃথিবীর সব জয় সে নিজের করে নিয়েছে। অন্যরা যেখানে কেটে যাওয়া ঘুড়ি দেখে আক্ষেপ করে, মুন্নার চোখে তখন ঝিলিক দেয় তৃপ্তির আলো। তার কাছে ঘুড়ি কেটে নেওয়া মানেই স্রেফ খেলার বিজয় নয়, বরং জীবনের সংগ্রামের প্রতীক—যেখানে টিকে থাকতে হলে লড়াই করতেই হবে।
কিন্তু আসল সত্যি হলো, মুন্নার ভেতরের দুনিয়া সবাই জানে না। তার বাবার মুখে প্রায়ই নেশার গন্ধ, মা সারাদিন মানুষের বাসায় কাজ করে ক্লান্ত হয়ে ফেরে, ঘরে খাবার নিয়ে টানাটানি লেগেই থাকে। এই বাস্তবতায় অন্য কোনো শিশু হয়তো চুপসে যেত, কিন্তু মুন্না হাসিকে বেছে নিয়েছে অস্ত্র হিসেবে। সে জানে, যদি কাঁদতে থাকে তবে বস্তির ধুলো-বালি, ক্ষুধা আর গালাগাল তার মনকে গ্রাস করে ফেলবে। তাই সে ঠিক করেছে, হাসির মধ্যে দিয়ে সে নিজের কষ্টকে গোপন রাখবে। ঘুড়ি যখন বাতাসে ভেসে উঠে, তখন সে মনে মনে ভাবে—“জীবন যতই কেটে যাক, আমি হাসতে হাসতেই টিকে থাকব।” এই এক বিশ্বাসই তাকে আলাদা করে তুলেছে, তাকে করেছে দলের প্রাণকেন্দ্র।
বিকেলের সোনালি আলোয় যখন বস্তির মাঠ ভরে ওঠে ঘুড়ির ভিড়ে, মুন্নার হাসি তখন যেন পুরো আকাশটাকে ভরিয়ে তোলে। রাহুলের নিখুঁত ঘুড়ি, সাবার মিষ্টি গান, আলির নিঃশব্দ মনোযোগ—সবকিছুর মাঝেও যদি কেউ শিশুদের দলটাকে এক করে রাখে, তবে সে হলো মুন্না। তার বিজয়ের উল্লাস অন্যদেরও উত্তেজিত করে তোলে, তার দৌড়ঝাঁপ দেখে গুড্ডুর মতো ছোটরা খুশিতে লাফায়। এমনকি বড়রাও যখন দূর থেকে তাকায়, তখন তাদের মুখে হাসি খেলে যায়—কারণ এই হাসিখুশি ছেলেটি মনে করিয়ে দেয়, আনন্দ খুঁজে নিতে হয় ছোট্ট মুহূর্তের ভেতরে, বড় কোনো স্বপ্নে নয়। মুন্নার হাসি তাই শুধু খেলায় জেতার উল্লাস নয়, বরং বস্তির কঠিন জীবনের বিরুদ্ধে একরকম প্রতিবাদ। যেন সে আকাশকে বলছে—“আমাদের কষ্ট যতই থাকুক না কেন, আমরা হাসতেই শিখব, আর ঘুড়ির মতো উড়ব।”
৫
আলির নাম উচ্চারণ করলেই সবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক শান্ত, স্থিরমুখী ছেলের ছবি। বাকি বাচ্চাদের মতো সে চিৎকার করে না, দৌড়ঝাঁপও করে না। এক হাতে অক্ষমতা তাকে সীমাবদ্ধ করে রাখলেও, তার চোখ আর মন যেন সব সীমা ভেঙে দিয়েছে। মাঠে যখন ঘুড়ি ওড়ানোর প্রস্তুতি চলে, তখন আলি চুপচাপ বসে সবার কাজ পর্যবেক্ষণ করে। কে সুতো টানতে গড়বড় করছে, কার ঘুড়ি কোন কোণ থেকে হাওয়ায় ভালো ভাসবে—সব হিসাব তার মাথার ভেতর চলে। তার নীরবতা আসলে কোনো অভাব নয়, বরং ভেতরের একধরনের শক্তি। অন্যরা যখন উত্তেজনায় ভুল করে বসে, তখন আলির মাপা দৃষ্টি আর ধৈর্য সেই ভুলকে ঠেকায়। সে একবার সুতো হাতে নিলে চারপাশে অন্যরাও নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকে—মনে হয় যেন কোনো গুরু তার শিষ্যদের সামনে নিজের কৌশল প্রদর্শন করছে।
শরীরের সীমাবদ্ধতা তার ভেতরের বুদ্ধি আর মনোযোগকে আরও শানিত করেছে। আলি জানে, সে দৌড়ে গিয়ে ঘুড়িকে আকাশে তুলতে পারবে না, কিন্তু বাতাসের দিক বুঝে সুতো টেনে ঘুড়িকে ধরে রাখতে সে সিদ্ধহস্ত। অনেক সময় মুন্না কিংবা গুড্ডু দৌড়ে গিয়ে ঘুড়ি তুললেও, আকাশে ঘুড়িকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব চলে আসে আলির কাঁধে। আশ্চর্যজনকভাবে, এক হাতে হলেও সে যেভাবে সুতো সামলায়, তাতে মনে হয় যেন তার আঙুলগুলো বাতাসের সঙ্গে কথা বলে। ঘুড়ি যখন কাঁপতে থাকে, অন্যরা ভয় পায় সুতো ছিঁড়ে যাবে, কিন্তু আলি ঠান্ডা মাথায় টান ঠিক করে, ঢিলা দিয়ে ঘুড়িকে নতুন ভারসাম্য খুঁজে দেয়। তার শান্ত হাসি আর স্থির দৃষ্টি সবার মনকে এক অদ্ভুত ভরসা দেয়।
রাহুল সবসময় আলির দক্ষতাকে গুরুত্ব দেয়। একদিন সে বলেছিল, “ঘুড়ি বানানো আমার কাজ, কিন্তু ঘুড়িকে আকাশে নাচাতে জানে আলি।” বাকিদের কাছে কথাটা হয়তো মজার লেগেছিল, কিন্তু সাবা বুঝেছিল এর গভীরতা। কারণ আলি প্রমাণ করেছিল—জীবনে শরীর দিয়ে মানুষকে মাপা যায় না। তার এক হাতে ঘাটতি থাকলেও ধৈর্য, মনোযোগ আর কৌশলে সে সবাইকে ছাপিয়ে যায়। সাবা মাঝে মাঝে আলিকে দেখে মনে মনে ভাবে, “যদি আমি ডাক্তার হতে পারি, তবে এ রকম শিশুদের জন্য লড়ব—যাতে কোনো অক্ষমতাকে কেউ ত্রুটি না ভাবে।” আলির নীরব উপস্থিতি তাই শুধু ঘুড়ির মাঠে নয়, সবার স্বপ্নের ভেতরেও শক্তি হয়ে বেঁচে থাকে।
এক বিকেলে, দমকা হাওয়ায় সবাই যখন ব্যস্ত নিজের ঘুড়ি সামলাতে, আলির হাতে ছিল দলের সবচেয়ে সুন্দর ঘুড়ির সুতো। বাতাস ছিল অনিয়মিত, কখনও তীব্র, কখনও থেমে যাচ্ছিল। ঘুড়ি কাঁপতে কাঁপতে প্রায় ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সবাই হাঁ করে তাকিয়ে ছিল, কেউই সাহস পাচ্ছিল না এগোনোর। সেই মুহূর্তে আলির এক হাতে ধরা সুতোই রক্ষা করল ঘুড়িটিকে। তার ঠোঁটে হালকা হাসি, চোখে অদ্ভুত শান্তি—সে ধীরে ধীরে টান দিল, আবার ছেড়ে দিল, এমন নিখুঁত ছন্দে যে ঘুড়ি মুহূর্তেই ভারসাম্য ফিরে পেল। তখন মাঠে নিস্তব্ধতা নেমে এল, শুধু চোখ ভরা শ্রদ্ধা নিয়ে সবাই তাকিয়ে রইল আলির দিকে। সেই দিন থেকে কেউ আর তাকে অক্ষম বলে ডাকেনি। বরং তারা বুঝেছিল, নীরবতার ভেতরও কত শক্তি লুকিয়ে থাকতে পারে।
৬
গুড্ডু দলের সবচেয়ে ছোট, বয়স মাত্র সাত। বাকি সবাই যখন ঘুড়ি বানানো, সুতো কাটা আর আকাশে ঘুড়ি ধরে রাখার গুরুগম্ভীর কাজে ব্যস্ত থাকে, গুড্ডুর কাজ শুধু দৌড়ে বেড়ানো। সে ঘুড়ির সুতো বয়ে আনে, দৌড়ে গিয়ে ঘুড়িকে বাতাসে ছুঁড়ে দেয়, আবার কখনও অন্যদের পাশে দাঁড়িয়ে তালি দেয়। তাকে দেখে মনে হয় যেন ঘুড়ি ওড়ানোর মাঠের আসল উচ্ছ্বাসটা সে-ই তৈরি করে। কিন্তু গুড্ডুর মনে একটাই কষ্ট ছিল—সে কখনও নিজে ঘুড়ি হাতে নেয়নি। দূর থেকে তাকিয়ে দেখত, কীভাবে মুন্না লাফিয়ে সুতো টানছে, কীভাবে আলি শান্তভাবে ভারসাম্য রাখছে, কীভাবে রাহুল নিজের বানানো ঘুড়িকে আকাশে উড়তে দেখে গর্ব করছে। গুড্ডু বারবার চাইত, একবার অন্তত সে-ও যেন সুতো হাতে নেয়। কিন্তু ছোট বলে কেউ সাহস করে তাকে দেয়নি। তার চোখে সেই আকাঙ্ক্ষার ঝিলিক প্রতিদিন জ্বলত, তবু সে মুখ ফুটে কিছু বলত না।
সেদিন বিকেলে হাওয়াটা অদ্ভুত ছিল। আকাশে মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো পড়ছিল, বাতাসও বেশ জোরে বইছিল। রাহুল নতুন একটা ঘুড়ি তৈরি করেছিল, রঙিন কাগজের টুকরো দিয়ে সুন্দরভাবে সাজানো। সবাই মিলে আকাশে ওড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঠিক তখনই রাহুল গুড্ডুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আজ তুই সুতো ধরবি।” কথাটা শুনে গুড্ডুর চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। সে তো ভাবতেই পারেনি এমন সুযোগ আসবে। প্রথমে ভয় পেয়ে বলল, “না না, আমার হাত ফসকে যাবে।” কিন্তু রাহুল মুচকি হেসে বলল, “যদি না ফসকায়? চেষ্টা না করলে কীভাবে জানবি?” মুন্না সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আজ গুড্ডুর দিন!” বাকিরাও হেসে উৎসাহ দিল। গুড্ডুর ছোট হাত কাঁপছিল, কিন্তু রাহুল তার আঙুলে শক্ত করে সুতো জড়িয়ে দিল। সেই মুহূর্তে গুড্ডুর মনে হলো, তার বুকের ভেতরটা কেমন যেন ধকধক করছে, যেন সারা পৃথিবীর ভার সে নিজের হাতে তুলে নিয়েছে।
যখন ঘুড়ি আকাশে উঠল, গুড্ডুর হাত দিয়ে প্রথমবার বাতাসের টান অনুভূত হলো। ঘুড়ি দুলছিল, কখনও কাঁপছিল, আবার বাতাসের সঙ্গে হালকা নাচছিল। গুড্ডু প্রথমে সামলাতে পারছিল না, হাত ছুটে যাবে ভেবেই আতঙ্ক হচ্ছিল। কিন্তু রাহুল পেছন থেকে তার হাত শক্ত করে ধরল, আলি ঠান্ডা গলায় বলল, “ভয় পাবি না, বাতাসের সঙ্গে খেল।” সাবা তখন গান ধরল—“ওরে আকাশ, ওরে বাতাস, নিয়ে যা আমাদের স্বপ্ন।” সেই গান যেন গুড্ডুর বুকের সাহস বাড়িয়ে দিল। সে ধীরে ধীরে নিজের হাতকে শিথিল করল, আবার টান দিল, ঠিক রাহুল যেভাবে শিখিয়েছিল। আর হঠাৎ করেই, ঘুড়ি ওপরে উঠে গেল, নীল আকাশের ভেতর ছোট্ট রঙিন বিন্দুর মতো। গুড্ডুর চোখে তখন আনন্দের ঝিলিক, তার ঠোঁটে অবিশ্বাস্য হাসি। প্রথমবার তার মনে হলো—আকাশও আসলে ছোঁয়া যায়, শুধু সাহস করে হাত বাড়াতে হয়।
সেদিন গুড্ডুর আনন্দ শুধু তার একার ছিল না। দলের সব বাচ্চাই যেন আবেগে ভেসে গেল। মুন্না দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল, বলল, “দেখলি, তুই-ও পারিস!” সাবার চোখ ভিজে উঠেছিল, তার মনে হচ্ছিল, যেন নিজের ছোট ভাইকে সে উড়তে দেখছে। আলি নীরবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, আর রাহুল গর্বে হেসে উঠল। গুড্ডুর ছোট হাতের সেই প্রথম আকাশ ছোঁয়া আসলে সবার জন্যই এক নতুন অভিজ্ঞতা ছিল। কারণ তারা বুঝল, স্বপ্নের কোনো বয়স নেই। ছোট হাত দিয়েও যদি আকাশকে স্পর্শ করা যায়, তবে কোনো বাধাই অসম্ভব নয়। গুড্ডুর মুখের হাসি সেদিন বস্তির ধুলো মুছে দিয়ে নতুন আশার আলো ছড়িয়ে দিয়েছিল। তার আনন্দমাখা চোখ যেন বলছিল—“আমারও আকাশ আছে, আমি-ও উড়তে পারি।” সেই মুহূর্তটা শুধু ঘুড়ি ওড়ানোর নয়, বরং একটা জীবন বদলে দেওয়ার ইতিহাস হয়ে রইল সবার মনে।
৭
আমিনা খালা বস্তির এক পরিচিত মুখ। বয়স হয়েছে, চুলে পাক ধরেছে, তবু তার চোখে সবসময় মমতার আলো। দিনের পর দিন তিনি দেখেছেন এই বস্তির বাচ্চাদের বেড়ে ওঠা—ক্ষুধার কষ্ট, মায়ের গালাগাল, বাবার নেশা, বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া টিনের ঘর। সবকিছুর মাঝেও তিনি দেখেছেন তাদের হাসি, দৌড়ঝাঁপ আর ছোট্ট ছোট্ট স্বপ্ন। তাই যখন বাচ্চারা মাঠে ঘুড়ি ওড়াতে নামে, খালা দূর থেকে দাঁড়িয়ে থাকেন, মাঝে মাঝে তাদের জন্য চিৎকার করে তালি দেন। তার চোখে এই খেলাটা শুধু খেলা নয়, বরং জীবনের পাঠ। তিনি জানেন, এই শিশুদের শক্ত মন দরকার—কারণ বস্তির জীবন প্রতিদিনই এক লড়াই। সেদিন বিকেলেও তিনি এসে দাঁড়ালেন মাঠের কোণে, রঙিন ঘুড়ির ভিড় দেখে তার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটল। তিনি বুঝতে পারছিলেন, এই ঘুড়িগুলো শুধু কাগজ আর সুতো নয়, এগুলো প্রতিটি শিশুর ভেতরে লুকানো স্বপ্নের প্রতীক।
শিশুরা খালাকে খুব ভালোবাসে। কারণ তিনি সবসময় উৎসাহ দেন, কখনও বকাঝকা নয়। মুন্না যখন দৌড়ে দৌড়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়, খালা এগিয়ে এসে তাকে কোলে তুলে নেন। সাবা গান ধরলে তিনি চোখ ভিজে শোনেন। আর আলির মতো নীরব ছেলেটিকেও তিনি বিশেষভাবে স্নেহ করেন—কারণ তিনি জানেন, আলির ভেতরে কতটা শক্তি লুকিয়ে আছে। খালা একদিন বাচ্চাদের বলেছিলেন, “ঘুড়ি মানে শুধু খেলা নয়, ঘুড়ি মানে মনকে আকাশের মতো বড় করে তোলা।” তার সেই কথা বাচ্চারা আজও মনে রাখে। তারা যখন আকাশের দিকে তাকায়, মনে করে তাদের স্বপ্নও ঠিক সেই ঘুড়ির মতো উড়বে। গুড্ডুর মতো ছোট্ট ছেলেটিও খালার কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে ভাবে—একদিন সে-ও বড় হয়ে ঘুড়ির মতো আকাশ ছুঁবে। খালার কণ্ঠে যে আশীর্বাদ মিশে থাকে, সেটাই যেন তাদের সাহস জোগায়।
সেদিন খালা মাঠে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, “তোরা শুধু ঘুড়ি ওড়াচ্ছিস না, তোরা নিজের জীবনকে উড়তে শেখাচ্ছিস। আকাশ ছোট না, বিশাল। তাই তোদের স্বপ্নও ছোট হলে চলবে না।” বাচ্চারা খালার চারপাশে জড়ো হলো, চুপচাপ শুনতে লাগল। তাদের মনে হচ্ছিল, যেন কোনো বইয়ের গল্প নয়, বরং জীবনের সত্যি কথা শোনাচ্ছেন তিনি। সাবা চোখে জল নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “খালা, আমি ডাক্তার হতে চাই।” খালা তার মাথায় হাত রেখে বললেন, “হবি রে মা, কেন হবে না? মন যদি আকাশের মতো বড় হয়, তবে কিছুই অসম্ভব নয়।” রাহুল তখন নিজের হাতে বানানো ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, একদিন সে-ও বড় কারিগর হবে, নিজের হাতে শুধু ঘুড়িই নয়, মানুষের স্বপ্ন গড়বে। মুন্না হাসতে হাসতে বলল, “খালা, আমি আকাশের সব ঘুড়ি কাটব।” খালা হেসে বললেন, “তা কাটিস, তবে কখনও মানুষের আশা যেন না কাটিস।” এই কথায় সবাই হেসে উঠলেও, তারা বুঝেছিল কথাটার গভীরতা।
বিকেলের বাতাস তখন আরও জোরে বইছিল। আকাশ ভর্তি রঙিন ঘুড়ি দেখে মনে হচ্ছিল যেন অসংখ্য স্বপ্ন একসঙ্গে ডানা মেলেছে। সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে খালা নিজের মনেও এক নিঃশব্দ প্রার্থনা করলেন—“হে আল্লাহ, এই বাচ্চাগুলোর স্বপ্ন যেন ভেঙে না যায়, ওদের ডানায় শক্তি দাও।” তার চোখে জল চিকচিক করছিল, কিন্তু ঠোঁটে লেগে ছিল দৃঢ় হাসি। কারণ তিনি জানতেন, প্রতিটি শিশুর মনোবলই তাদের আসল সম্পদ। আর যদি তারা আকাশের মতো বিশাল মন নিয়ে বাঁচতে শেখে, তবে একদিন তারা এই বস্তির ধুলো মুছে নতুন পৃথিবী গড়তে পারবে। সেই আশীর্বাদই যেন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল—বাচ্চাদের হাসি, ঘুড়ির ওড়াউড়ি আর বাতাসের স্রোতে মিশে গিয়ে। সেদিন থেকে শিশুদের মনে খালার কথাগুলো পাথরের মতো গেঁথে রইল: “আকাশ বড়, তোদের স্বপ্নও তেমন বড় হতে হবে।”
৮
বস্তির প্রতিটি ঘরে দুঃখ যেন সঙ্গী হয়ে থাকে। শীলা, রাহুলের মা, দিনভর মানুষের বাসায় কাজ করে। কখনও থালা বাসন মাজা, কখনও ঝাঁট দেওয়া, কখনও আবার লোকের রাগ সহ্য করা—এই নিয়েই তার দিন কাটে। সন্ধ্যায় ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে ফিরলেও ছেলের মুখ দেখে তার মন ভরে ওঠে। রাহুল যখন হাতে ঘুড়ি নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, শীলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে দূরে। তার চোখে মিশে থাকে অদ্ভুত এক আলো—একদিকে কষ্ট, অন্যদিকে আশা। সে ভাবে, তার জীবন হয়তো চিরকাল পরিশ্রম আর অবহেলায় ভরা থাকবে, কিন্তু ছেলের জন্য হয়তো অন্য রকম কিছু অপেক্ষা করছে। আকাশে ঘুড়ি যখন উড়তে থাকে, শীলার মনে হয়—রাহুলও একদিন এমনভাবেই দারিদ্র্যের গণ্ডি পেরিয়ে উঁচুতে উঠবে।
সাবার মা আমিনার গল্পও আলাদা কিছু নয়। আমিনার স্বামী অনেক আগেই সংসার ছেড়ে চলে গেছে, আরেক নারীর হাত ধরে। তাই সংসারের সব দায়িত্ব তার একার কাঁধে। দিনে রুটি বেলার কাজ, রাতে সেলাই মেশিনের শব্দ—এই হলো তার দিনযাপন। সাবাকে নিয়ে তার স্বপ্ন সীমাহীন, কিন্তু বাস্তবের হিসেব মেলাতে গেলে সেই স্বপ্ন গলা টিপে ধরে। তবুও আমিনা হাল ছাড়েননি। যখন সাবা গান ধরে, বা বন্ধুদের মাঝে গল্প করে, তখন তিনি দূর থেকে শুনে মুগ্ধ হন। তার মনে হয়, মেয়েটা যদি সত্যিই ডাক্তার হতে পারে, তবে এই বস্তির অন্ধকারে আলো জ্বালতে পারবে। সাবার চোখে যে দৃঢ়তা তিনি দেখেন, সেটা তাকে সাহস দেয়। তাই ঘুড়ির উড়ান যখন আকাশে ঝলমল করে, তিনি মনে করেন—এ উড়ানই একদিন তার মেয়েকে সত্যিকার অর্থে মুক্তি দেবে।
এই মায়েরা জানেন জীবনের কষ্ট কাকে বলে। ভোরের আলো ফোটার আগেই তাদের ঘুম ভাঙে, দিন ফুরোতে ফুরোতে শরীর ভেঙে পড়ে। তবুও তারা সন্তানের হাসি, দৌড়ঝাঁপ আর স্বপ্নকে আগলে রাখেন বুকের ভেতর। শীলা যখন রাহুলকে ঘুড়ি বানাতে দেখে, তার মনে হয়—দারিদ্র্য মানেই সবকিছুর শেষ নয়, বরং সৃষ্টিরও শুরু হতে পারে। আমিনা যখন সাবার হাত ধরে গান শুনে, তখন তার বুকের ভেতর জমে থাকা যন্ত্রণা হালকা হয়। তারা জানেন, সন্তানরা যদি আশা না ধরে রাখে, তবে এই বস্তির জীবন আরও অন্ধকার হয়ে যাবে। তাই তারা নিজেদের দুঃখ আড়াল করে রাখেন, আর সন্তানদের চোখে স্বপ্নের আলো খুঁজে পান। ঘুড়ির রঙিন কাগজ তাদের কাছে যেন জীবনের প্রতীক—ভাঙা হলেও আবার জোড়া দেওয়া যায়, ঠিক যেমন তারা নিজেদের জীবন বারবার গড়ে তুলেছেন।
সেদিন আকাশে যখন ঘুড়ি উড়ছিল, শীলা আর আমিনা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলেন। দুজনের চোখেই অদ্ভুত এক অশ্রু-হাসি। শীলা ধীরে বললেন, “আমাদের জীবন তো এমনই, কিন্তু যদি ওরা পারে…” আমিনা মাথা নেড়ে উত্তর দিলেন, “পারবেই। আকাশ ছোট নয়, আর আমাদের বাচ্চারাও ছোট নয়।” তাদের এই কথাগুলো যেন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, বাচ্চাদের কানে পৌঁছোল। শিশুরা তখন আরও জোরে দৌড় দিল, আরও উঁচুতে ঘুড়ি ওড়াল। কারণ তারা জানল—তাদের মায়ের চোখে বিশ্বাস আছে। মায়েদের দুঃখ যতই গভীর হোক না কেন, সেই বিশ্বাসই শিশুদের আশা হয়ে দাঁড়াল। আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা একসঙ্গে মনে মনে বলল—“একদিন আমরা সত্যিই আকাশ ছুঁব।”
৯
পাড়ার সেই দিনটা ছিল উৎসবের মতো। সকাল থেকেই গলিপথে হৈচৈ, ছেলেমেয়েরা দৌড়াদৌড়ি করছে, হাতে রঙিন ঘুড়ি আর সুতোয় ভরা চাকা। এই প্রতিযোগিতা প্রতিবছর হয়, কিন্তু এবার যেন অন্যরকম উত্তেজনা। কারণ ধনী পরিবারের ছেলেরা নতুন নতুন ঘুড়ি কিনে এনেছে—ঝকঝকে রঙিন কাগজে মোড়া, মজবুত বাঁশের ফ্রেম আর দামি মাঞ্জা কাটা সুতো। তাদের চোখে-মুখে অহংকার, যেন আগেই বিজয় নিশ্চিত। অন্যদিকে বস্তির বাচ্চারা নিজেরাই বানিয়েছে তাদের ঘুড়ি—রাহুলের হাতের জাদুতে তৈরি কাগজ, আঠা আর বাঁশের কঞ্চি দিয়ে গড়া অগণিত স্বপ্নের বাহক। সকাল থেকেই তারা একে অপরকে উৎসাহ দিচ্ছিল, সুতো গুছিয়ে রাখছিল, আর আকাশের দিকে তাকিয়ে মনস্থির করছিল। মাঠজুড়ে উৎসবের রঙে ভরে উঠল, আর প্রতিযোগিতা শুরু হতেই যেন হাওয়াও আরও তেজি হয়ে বইতে লাগল।
প্রথমে ধনী ছেলেরা আত্মবিশ্বাস নিয়ে ঘুড়ি তুলল আকাশে। দামি কাগজের ঘুড়িগুলো রোদে ঝলমল করতে লাগল, আর তাদের হাতে মজবুত মাঞ্জার সুতো চকচক করছিল। তারা একে অপরকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছিল, চিৎকার করে বলছিল, “দেখিস, বস্তির ছেলেদের কোনো ঘুড়ি টিকতে পারবে না।” বস্তির বাচ্চারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, চোখে দৃঢ়তা। রাহুল সবাইকে ইশারা করল, যেন ভয়ের কিছু নেই। একে একে সাবা, মুন্না, আলি আর ছোট্ট গুড্ডু তাদের ঘুড়ি ছাড়ল আকাশে। প্রথমে হাওয়ার সঙ্গে দুলছিল, কিন্তু রাহুলের কৌশলে ঘুড়িগুলো ধীরে ধীরে স্থির হয়ে উঠল। তখন শুরু হলো সত্যিকারের লড়াই। ধনী ছেলেরা তাদের সুতোয় ধারালো মাঞ্জা মাখিয়ে একে একে প্রতিপক্ষের ঘুড়ি কাটতে লাগল। কিন্তু বস্তির শিশুরা, বিশেষ করে রাহুল, অসাধারণ ধৈর্য আর বুদ্ধি দিয়ে একের পর এক আক্রমণ ঠেকাতে লাগল।
লড়াই যত এগোতে লাগল, ধনী ছেলেদের মুখে আত্মবিশ্বাস কমতে শুরু করল। একে একে তাদের ঘুড়ি কেটে নিচে পড়তে লাগল, আর মাঠজুড়ে বাচ্চাদের উল্লাসে গর্জে উঠল। মুন্নার চিৎকার, সাবার গান, গুড্ডুর হাততালি—সবকিছু মিশে এক অদ্ভুত আনন্দের স্রোত তৈরি করল। আলি তার এক হাত দিয়েও অসাধারণ দক্ষতায় সুতো নিয়ন্ত্রণ করছিল, আর সবাই তাকিয়ে অবাক হচ্ছিল। ধনী ছেলেদের দামি ঘুড়ি কেটে যেতে যেতে রাহুলের হাতে বানানো সাদামাটা কাগজের ঘুড়ি ক্রমশ উঁচুতে উঠতে লাগল। একসময় আকাশ ভর্তি রঙের ভিড়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল—সবাই কেটে গেছে, শুধু রাহুলের ঘুড়ি টিকে আছে, আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে যেন এক বিজয়ের প্রতীক হয়ে। দর্শকেরা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল—কে ভেবেছিল বস্তির ছেলেটির হাতে বানানো সস্তা উপকরণের ঘুড়ি এত শক্তিশালী হতে পারে?
শেষ মুহূর্তে চারদিকে শুধু করতালি আর উল্লাস। রাহুল দাঁড়িয়ে আছে ঘামের ভেজা কপাল নিয়ে, কিন্তু তার চোখে জ্বলজ্বল করছে অপরিসীম গর্ব। সাবা ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল, মুন্না লাফিয়ে উঠল আনন্দে, গুড্ডু খুশিতে দৌড়ে বেড়াতে লাগল। খালাও চোখে জল নিয়ে হাততালি দিলেন, আর শীলা আর আমিনা দূরে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসলেন—এ হাসির মধ্যে দুঃখ ঢাকা পড়েছিল, ছিল শুধু সন্তানের সাফল্যের গর্ব। ধনী ছেলেরা হতভম্ব হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, তাদের দামি ঘুড়ি মাটিতে পড়ে আছে, আর বস্তির বাচ্চাদের ঘুড়ি উঁচু আকাশে উড়ছে। সেই মুহূর্তে সবাই বুঝল—স্বপ্নের শক্তি, সাহস আর বুদ্ধি থাকলে দারিদ্র্য কোনো বাধা হতে পারে না। রাহুলের ঘুড়ি শুধু প্রতিযোগিতার জয় নয়, বরং ছিল এক প্রতীক—যে প্রতীক বলছে, “আকাশ সবার, স্বপ্নও সবার।”
১০
সন্ধ্যার আকাশ তখন রঙে রঙে ভরে উঠেছে। সোনালি আলো ধীরে ধীরে লালচে আভায় রূপ নিচ্ছে, আর সেই আকাশজুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে অসংখ্য ঘুড়ি। বাতাসে কেটে যাওয়া ঘুড়িগুলো গাছের ডালে আটকে গেছে, কারও ছাদে গড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু সবচেয়ে উঁচুতে এখনও টিকে আছে বস্তির শিশুদের ঘুড়িগুলো। মাঠে ভিড় করা মানুষজন উপরের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে দেখছিল—কীভাবে অল্প কাগজ, কঞ্চি আর আঠা দিয়েও এমন এক জাদু তৈরি করা যায়। শিশুরা মাটিতে বসে নেই, সবাই আকাশের সঙ্গে যেন একাত্ম হয়ে গেছে। তাদের চোখে-মুখে ক্লান্তি নেই, আছে শুধু জয়ের উজ্জ্বল আলো। তারা বুঝে গেছে, আজকের দিনটা কেবল প্রতিযোগিতার দিন নয়, বরং নিজেদের স্বপ্নকে নতুন করে দেখার দিন।
ঘুড়িগুলো উড়তে উড়তে যেন এক অদৃশ্য গল্প বলছিল। রাহুলের হাতে বানানো ঘুড়ি বলছিল শ্রম আর ধৈর্যের জয়গাথা। সাবার চোখে ঘুড়ি হয়ে উঠেছিল ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নের প্রতীক, যে একদিন এই বস্তির অসংখ্য শিশুর আর্তনাদ থামাবে। মুন্নার জন্য ঘুড়ি ছিল হাসির উৎস, তার বিজয়ের মুহূর্তকে আরও উজ্জ্বল করে তুলছিল। আলির হাতে সুতো মানেই ছিল সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে এক যুদ্ধ, যা সে জিতেছে নিঃশব্দে। আর ছোট্ট গুড্ডুর প্রথম আকাশ দেখা যেন নতুন প্রজন্মের প্রথম সাহসী পদক্ষেপ, যে হাসতে হাসতে ঘোষণা করছে—“আমিও পারব।” প্রতিটি ঘুড়ি যেন তাদের ভেতরের শক্তি আর আশা বহন করে আকাশে উড়ে যাচ্ছিল।
বড়রা দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিলেন এই দৃশ্যের দিকে। শীলা, আমিনা আর খালা চোখের জল সামলাতে পারছিলেন না। দারিদ্র্য, অভাব আর যন্ত্রণা তাদের জীবনকে প্রতিদিন ছিন্নভিন্ন করেছে, কিন্তু সেই একই জীবনে আজ প্রথমবার তারা দেখলেন আশা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বস্তির সরু গলি আর ভাঙা ঘরের সীমা পেরিয়ে তাদের সন্তানরা আকাশে নিজেদের জায়গা তৈরি করেছে। তারা জানলেন, হয়তো পথটা কঠিন, হয়তো সংগ্রাম থামবে না, তবুও শিশুদের হাতে এই ঘুড়ি তাদের বুক ভরিয়ে দিল সাহসে। কারণ ঘুড়ি কেবল খেলনা নয়, এটা হলো প্রমাণ—আকাশ বড়, স্বপ্নও তেমন বড় হতে পারে।
শেষ আলো যখন অন্ধকারে মিশে গেল, তখনও শিশুরা আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাদের চোখে একসঙ্গে একটাই প্রতিজ্ঞা—“আমরা হাল ছাড়ব না।” তারা জানে দারিদ্র্য তাদের পিছু ছাড়বে না সহজে, জানে জীবন বারবার কঠিন হয়ে উঠবে, তবুও তারা থেমে থাকবে না। কারণ ঘুড়ি তাদের শিখিয়েছে—পতন মানেই শেষ নয়, আবার উঠা সম্ভব। তাই তারা মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল, স্বপ্নগুলো একদিন সত্যি করবেই। সেই রাতের আকাশে অসংখ্য তারা যেমন ঝিকিমিকি করছিল, তেমনি বস্তির প্রতিটি শিশুর মনে জ্বলছিল নতুন আলো। ঘুড়ির আকাশ তখন কেবল রঙের খেলা নয়, বরং ছিল ভবিষ্যতের দিগন্ত—যেখানে প্রতিটি স্বপ্ন মুক্তভাবে উড়তে পারবে, ঠিক ঘুড়ির মতোই।
___




