দেবদত্তা মুখার্জী
১
সকাল সাতটা। কলকাতার শহর তখন ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। রোদ যেন আলগোছে সলতে পাকিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে শহরের কংক্রিটের দেয়াল বেয়ে। শিয়ালদহ স্টেশনের কাছাকাছি রোডের পাশ দিয়ে দ্রুত হাঁটছে মোহনা চক্রবর্তী, কাঁধে অফিস ব্যাগ, চোখে এক অদৃশ্য ক্লান্তির ছাপ। চারপাশে গাড়ির হর্ন, বাসের ইঞ্জিনের গর্জন, হকারের চিৎকার—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত কোলাহল। কিন্তু সেই কোলাহলের ভেতরেও যেন মোহনাকে ঘিরে আছে এক নিরবতা। পায়ের নিচে ফ্লাইওভারের ছায়া, ঘাম ভেজা দুপুরের গন্ধ লেগে থাকা বাসস্টপ, এবং তবু মনে হয়—মোহনা যেন হেঁটে চলেছে এক কাঁচের তৈরি অদৃশ্য ঘরের ভেতর দিয়ে। লোকে তাকায়, কেউবা অফিসগামী মেয়ের সাফল্য দেখে প্রশংসা করে, কেউবা আড়ালে ফিসফিস করে — “একটা মেয়ে, তাও এত বয়সে বিয়ে হলো না!” মোহনার কানে সেই শব্দেরা আসে না, অথচ আসে। ব্যস্ত শহরের মানুষের ভিড়ে, সে নিজেকে বারবার খুঁজে পায় একা, নীরব। অফিস বিল্ডিংয়ের কাচের দরজায় প্রতিফলিত নিজের অবয়ব দেখে হঠাৎ মনে হয় — এই মেয়েটা কে? ওই হাসি মুখটা কি সত্যিই তার? নাকি সেই মুখের আড়ালে লুকিয়ে আছে ক্লান্ত এক নারী, যে কেবল সমাজের চোখে নিজেকে শক্ত দেখানোর অভিনয় করছে? লিফটে চেপে ওঠার সময় মোহনা দেখে, অন্য সহকর্মীরা হালকা গল্প করছে, মোবাইলে মেসেজ চেক করছে, কিন্তু তার হাত যেন পকেটে থাকা ফোনের দিকে বাড়ে না। ফোনের স্ক্রিনে প্রতিফলিত হবে তার সেই অভ্যন্তরীণ শূন্যতা, যা সে দিনের পর দিন লুকিয়ে রাখে।
অফিসের কামরার শীতল বাতাসে গা শিরশির করে ওঠে। কর্পোরেট অফিসের চকচকে টেবিল-চেয়ার, সাদা দেওয়াল, ল্যাপটপের আলো—সবই এত নিখুঁতভাবে সাজানো, যেন ভেতরের সমস্ত অগোছালো অনুভূতিকে চাপা দিতে উদ্যত। বসের কেবিনের কাঁচের দেওয়াল থেকে সে দেখতে পায়, একজন নতুন ইন্টার্ন বসের সঙ্গে কথা বলছে, চোখে মুখে আতঙ্ক আর আশার মিশ্র প্রতিচ্ছবি। মোহনার হঠাৎ নিজের শুরুর দিনের কথা মনে পড়ে যায়—যখন সেও ঠিক এমনভাবে একদিন এসেছিল। কত স্বপ্ন ছিল, কত উচ্চাকাঙ্ক্ষা। আর আজ? আজ সে শুধুই বেঁচে থাকে একরকম রোবটিক জীবনে, যেখানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত টাইমলাইন ফলো করা, প্রেজেন্টেশন বানানো, ক্লায়েন্ট মিটিং করা ছাড়া অন্য কোনও স্বতঃসিদ্ধ সত্তা নেই। একেকটা ক্লিক, একেকটা মাউস স্ক্রল, একেকটা ইমেল সেন্ট—সবকিছুই যেন এই কাঁচের ঘরের ভেতর তার দমবন্ধ করা নিঃশ্বাস। লাঞ্চব্রেকেও মোহনা আলাদা বসে থাকে জানালার ধারে, এক কাপ চা হাতে নিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। বাইরে যে শহর সে দেখে—সেটা আর তার আপন মনে হয় না। সেই চেনা কলকাতা যেন আজ বড় অচেনা। ট্যাক্সির হর্ন, ফুটপাতের ভিড়, দূরের ফ্লাইওভারে গাড়ির স্রোত—সব যেন এক অদৃশ্য দূরত্বে। এমনকি সহকর্মীদের হাসি, মজা, গল্পও আজ তার কাছে কেবলই এক ধরনের শব্দ, যা কানে ঢোকে, কিন্তু হৃদয়ে লাগে না।
দিনশেষে, সন্ধ্যের ম্লান আলোয় মোহনা আবার সেই চেনা রাস্তা ধরে হাঁটে। ব্যাগের স্ট্র্যাপ একটু আলগা হয়ে পড়েছে, টানা ব্যস্ত দিনের পর শরীরে ক্লান্তি জমে গেছে। কিন্তু সে হাঁটে, যেন দৌড়ে পালাতে চায় সেই অদৃশ্য কাঁচের ঘর থেকে, যে ঘর তৈরি হয়েছে শহরের চোখরাঙানি, সমাজের শর্ত আর নিজের ভেতরের আতঙ্ক দিয়ে। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর একটা অটোতে উঠে বসে, জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। শহরের আলো-আঁধারি, রোডলাইটের তলা দিয়ে ছুটে যাওয়া পথের রেখা দেখে তার মনে হয়—এই শহর, এই আলো, এই কোলাহল আসলে কার জন্য? কিসের জন্য সে এই ভিড়ে প্রতিদিন নিজেকে হারিয়ে ফেলে? বাসায় পৌঁছে দরজা বন্ধ করে দেয়ার পর জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। দূরে ফ্লাইওভারের হেডলাইটের ঝলকানি দেখে তার মনে হয় — সমাজ, পরিবার, অফিস — সবাই যেন বাইরে থেকে তার জীবনের কাঁচের ঘরের দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু কেউ তার নিঃসঙ্গতা ছুঁতে পারছে না। সেদিন রাতে মোহনা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ, শহরের কোলাহলে নিজের নিস্তব্ধতা খুঁজে পায়, আর ভাবে—এই কাঁচের ঘর সে কবে ভাঙতে পারবে?
২
বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চাবি খুঁজছিল মোহনা। অটো থেকে নামার পর ক্লান্ত পা যেন ভারী হয়ে এসেছে দিনের শেষে। দরজা খুলতেই বাবার গলার আওয়াজ পেল — “তুই এলি মা?”। বাবার সেই মৃদু কণ্ঠে লুকানো দুশ্চিন্তা, কেমন এক আশঙ্কা মিশে থাকে আজকাল, যা মোহনা দিনের পর দিন টের পায়। ঘরে ঢুকে ব্যাগটা রাখার আগেই বাবার মুখের দিকে একবার তাকায় সে। মহেশ্বর চক্রবর্তী, অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক, আজকাল আর স্কুলে যান না, দিনের বেশির ভাগ সময় ঘরের মধ্যে বা বারান্দায় চুপচাপ বসে থাকেন। কিন্তু মেয়ের জন্য তার চোখে সদা চিন্তার ছায়া। মোহনার চোখে পড়ে বাবা আবার বিয়ের প্রসঙ্গ তোলার জন্য প্রস্তুত। চুপচাপ হাত-মুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলের পাশে বসে সে। টেবিলে রাখা গরম ভাতের গন্ধও যেন মনকে সান্ত্বনা দিতে পারছে না আজ। মহেশ্বর ধীরে কাছে এসে বসে, গলা নিচু করে বললেন, “শুন মা, তোর মা বেঁচে থাকলে হয়তো বলতো না… কিন্তু আমি তো শেষের দিকে এসেছি… তোকে দেখে যেতে চাই নিশ্চিন্ত হয়ে।” সেই এক কথার ভার যেন সারা ঘরকে আরও ভারী করে তোলে। মোহনা চুপচাপ খেতে থাকে, কিন্তু গলার কাঁটা যেন নামছে না। বাবার কণ্ঠে মায়া, অসহায়তা, আর সমাজের চাপ মিশে থাকে, যা সে অস্বীকার করতে পারে না। মহেশ্বর আবার বলেন, “তুই এত বড় অফিসে কাজ করিস, তোর মতো মেয়ে পাত্রের অভাব হয়? একটু তোর জন্য খোঁজ নিতে দে না মা।” কথাগুলো সহজ অথচ বুকে বিঁধে যায়।
সেই রাতে ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে মোহনা বাবার কথা ভাবতে থাকে। বাইরে ফ্লাইওভারের হেডলাইটের রেখা, দূরের গাড়ির হর্ন — সবকিছু মিলে এক অদ্ভুত নীরবতা তৈরি করে ঘরের ভেতর। বাবার কণ্ঠের দুশ্চিন্তা, পাড়ার নন্দিনী কাকিমাদের ফিসফাস, সহকর্মীদের পরোক্ষ কৌতূহল — সব যেন একসঙ্গে চাপ ফেলছে তার মনের ওপর। সে জানে, বাবা খারাপ চায় না, কিন্তু সমাজের চোখে বাঁচার চেষ্টাই তাকে এই চাপ দিতে বাধ্য করছে। কিন্তু তার প্রশ্ন, কেন এই সমাজে মেয়ের সাফল্য মাপা হয় কেবল বিয়ের মানদণ্ডে? সে চায় না কেবল বিয়ের কারণে নিজের স্বপ্নের, নিজের বেছে নেওয়া জীবনের সঙ্গে আপস করতে। বাবা বোঝেন না, সে চায় না কোনও জোড়াতালি দেওয়া সম্পর্ক, যেখানে শুধু সমাজকে খুশি করতে হবে। জানালার কাঁচে হাত রেখে সে দেখে, বাইরের আলো ভাঙছে, কাচের টুকরোর মতো ছড়িয়ে পড়ছে ঘরের ভেতর। তার জীবনও কি সেই কাঁচের মতো? ভাঙলে কেবল কেটে যাবে হাত, তবু নতুন আলো ঢুকবে? বাবার মুখের দুশ্চিন্তা, সমাজের শাসন, নিজের স্বপ্নের টানাপোড়েন — সব মিলিয়ে এক অস্থির রাত নামে তার ঘরে।
পরের দিন সকালে বাবার মুখে আর কোনও কথা নেই। চুপচাপ পেপার পড়ছেন, কিন্তু পেপারের আড়ালে লুকিয়ে আছে সেই চেনা দুশ্চিন্তার ছায়া। মোহনা অফিসের জন্য তৈরি হতে হতে বাবার দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কত অসহায় এই মানুষটা, সমাজের শাসনের ভয়ে মেয়েকে হারিয়ে ফেলছেন দিনে দিনে। মোহনা কাছে গিয়ে বাবার কাঁধে হাত রাখে — “বাবা, আমি ভালো আছি। তুমি এত ভেবো না।” মহেশ্বর চমকে তাকান মেয়ের দিকে, সেই চেনা মায়াভরা চোখে। তিনি কিছু বলেন না, কেবল মাথা নেড়ে পেপার ভাঁজ করতে থাকেন। সেই ভাঁজের শব্দ যেন মোহনার বুকে এক অদৃশ্য চাপ তৈরি করে। অফিসের দিকে বেরিয়ে পড়ে সে, কিন্তু মনের ভেতর বেজে চলে বাবার কণ্ঠের সেই অসহায় আর্তি — “একটা পাত্র খুঁজে নিস না মা!”। মোহনা ভাবে, এই শহর, এই সমাজের কাঁচের ঘর থেকে সে কীভাবে বেরোবে? তার নিজের স্বাধীনতা, তার নিজের বেঁচে থাকার আনন্দ — সব কি শেষ পর্যন্ত সমাজের দেওয়া এক ছাঁদে বন্দি হয়ে যাবে?
৩
রাত নেমেছে শহরের বুকজুড়ে। কলকাতার গলিপথগুলো যেন ধীরে ধীরে নিস্তব্ধতার চাদরে ঢেকে গেছে। দূরের ফ্লাইওভারে গাড়ির হেডলাইটের আলো মাঝে মাঝে কাঁচের জানালায় এসে প্রতিফলিত হয়, ঘরের ভেতর অদ্ভুত এক আভা ফেলে যায়। মোহনা চুপচাপ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে, কপাল ঠেকিয়ে দেয় শীতল কাঁচে। সেই কাঁচের স্পর্শে ঠান্ডা লেগে যায় শরীরের ভেতর অবধি। তার ভেতরটা জুড়ে এক অস্থিরতা, এক শূন্যতা ঘুরপাক খায়। চারপাশের এই কাঁচের ঘরের দেয়াল যেন তাকে আরও বেশি একা করে তুলেছে। সে দেখে নিচের রাস্তায় দু-একটা মানুষ হেঁটে যাচ্ছে, কেউ হয়তো বাড়ি ফিরছে, কেউ হয়তো জীবনের ক্লান্তি টেনে নিয়ে চলেছে। কিন্তু সেই মানুষগুলো তার থেকে কত দূরে! মোহনা ভাবে, সে কি শুধুই এই কাঁচের ঘরের বাসিন্দা? বাইরে থেকে যার জীবনে আলো দেখা যায়, কিন্তু ভেতরে যার নিস্তব্ধতা আর অন্ধকার কেউ দেখতে পায় না? হঠাৎ এক মুহূর্তে চোখ বুজে ফেলে সে। অভিষেকের মুখটা মনে পড়ে যায় — সেই প্রাক্তন প্রেমিক, যে একদিন তার জীবনের কেন্দ্রে ছিল।
মনে পড়ে সেই দিনগুলো, যখন অভিষেকের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল কলেজের করিডরে। কত সহজ, কত স্বপ্নমাখা সেই দিনগুলো। সলজ্জ হাসি, লুকিয়ে চাওয়া, রাত জেগে ফোনে গল্প করা—সব কিছু যেন গত জীবনের মতো দূরে সরে গেছে। অভিষেকের চোখের দিকে তাকিয়ে সে একদিন ভেবেছিল, এই চোখের প্রতিশ্রুতিই হয়তো তার জীবনের স্থায়ী ঠিকানা হবে। অথচ কী সহজে ভেঙে গিয়েছিল সেই স্বপ্নের ঘর। প্রেমের নামে প্রতারণা, সম্পর্কের নামে মিথ্যা—সব কিছু আজও তাকে তাড়া করে ফেরে। অভিষেকের চলে যাওয়া মানে শুধু প্রেম হারানো নয়, নিজের উপর ভরসা হারানো। মোহনা জানে, সেই ব্যর্থ সম্পর্কের পর সে আর কারও উপর ভরসা করতে পারেনি। বাবার মুখের দুশ্চিন্তা, নন্দিনী কাকিমাদের কথা, অফিসের সহকর্মীদের কৌতূহল—সব মিলে তার মনে এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিয়েছে, যেটা সে নিজেই ভাঙতে পারে না। জানালার কাঁচে ঠোঁট চেপে ধরে সে, যেন অশ্রু গোপন করতে চায়। কিন্তু চোখের কোণে জমে থাকা জল জানালার কাঁচের মতোই স্বচ্ছ, যা লুকিয়ে রাখা যায় না।
রাত বাড়তে থাকে। জানালার বাইরে রাতের বাতাস শহরের কোলাহল ভেঙে আনতে চায় শান্তি। কিন্তু মোহনার মন যেন আরও বেশি অশান্ত হয়ে ওঠে। সে ভাবে—এই জীবনে কী চায় সে? সমাজের নিয়ম মেনে বাঁচা? না নিজের মতো করে বেঁচে থাকা? জানালার বাইরে দূরে তাকিয়ে সে ভাবে, সেই যে কাঁচের ঘর, যার মধ্যে সে বন্দি—তাতে কারা দেওয়াল তুলেছে? বাবা? সমাজ? নাকি সে নিজেই? জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক নিঃশব্দ নারীর মন আজ বিদ্রোহ করতে চায়, কিন্তু ভয়ও পায়। ভয়—অসফলতার, সমাজের চোখে একা থাকার তকমার, আর সবচেয়ে বড় ভয়—নিজের ভেতরের শূন্যতার। বাইরে ফ্লাইওভারের হেডলাইটের আলো ক্ষণিকের জন্য জানালার কাঁচে এসে পড়ে আর ছায়া ফেলে ঘরের মেঝেতে। সেই ছায়ার রেখা যেন বলছে—সব কিছু অস্থায়ী, সব কিছু ক্ষণিকের। মোহনা ধীরে জানালার কাঁচে হাত বুলিয়ে দেয়, ঠান্ডা সেই কাঁচে যেন তার নিজের হৃদয়ের শীতলতা টের পায়। আর ভাবে—এই কাঁচের ঘর ভাঙবে কবে? কবে সে সত্যিই মুক্তি পাবে এই একাকীত্বের শৃঙ্খল থেকে?
৪
রোববারের সকালটা অন্য দিনের চেয়ে একটু আলাদা। শহরের কোলাহল কম, রাস্তাঘাটে গাড়ির হর্নের তাড়া নেই। ঘড়ির কাঁটা তখন প্রায় ন’টার কাছাকাছি। মোহনা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল, এক কাপ কফির মগ হাতে। দূরের আকাশে মেঘের ভাজের মধ্যে দিয়ে রোদের ছটা আসছিল। এমন সময় নিচের দিক থেকে ভেসে এল চেনা গলা — নন্দিনী কাকিমার। কাকিমা তখন পাশের ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে বললেন, “মোহনা মা, কেমন আছো? আজকাল তো আর দেখাই পাওয়া যায় না!” কথার মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, এক ধরনের আড়ালভরা তিরস্কার লুকানো থাকে। মোহনা হাসিমুখে উত্তর দিল, “ভালো আছি কাকিমা। অফিস নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকি। তাই…” কিন্তু নন্দিনীর মুখের সেই কৌতূহলী দৃষ্টি আর থামে না। তিনি আবার বলেন, “তোমার বাবা খুব চিন্তায় থাকে মা। জানো তো, মেয়েরা তো বেশি দিন একা থাকলে লোকে কত কী বলে! এত ভালো চাকরি করছো, ভালো পরিবার — তোমার তো বিয়ে হয়ে যাওয়া উচিত ছিল!” এইসব কথাগুলো একের পর এক এসে আঘাত করতে থাকে মোহনার মনের দরজায়। সে বাইরে থেকে হাসি ধরে রাখে, কিন্তু ভেতরে এক অজানা অস্বস্তি চেপে বসে।
মোহনা ব্যালকনি ছেড়ে ঘরে ঢুকে জানালার পর্দা টেনে দেয়, যেন নন্দিনীর দৃষ্টি আর তার জীবনকে স্পর্শ করতে না পারে। কিন্তু শব্দগুলো বাতাসের মতই ঘরে ঢুকে পড়ে — “এ বয়সে একা মেয়ে নিয়ে লোকে কথা তো বলবেই।” ঘরের ভেতর অদৃশ্য এক অন্ধকার নেমে আসে তার মনে। সে ভাবে, কেন প্রতিবার মেয়েদের জীবন কেবল বিয়ের শর্তে মাপা হবে? কেন সমাজের চোখে সাফল্য মানেই বিয়ে? বাইরে থেকে সে যতই হাসি মুখ রাখুক, যতই শক্ত মেয়ের পরিচয় দিক — এ সমাজ যেন তাকে প্রশ্ন করতে ছাড়ে না। সেই কাঁচের ঘরের দেয়াল আরও পুরু হয় নন্দিনীর কথায়। বাইরে নীল আকাশ, রোদেলা সকাল, অথচ মোহনার মনে যেন এক অদৃশ্য মেঘের ছায়া। বারবার সে অনুভব করে, এই শহরের প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি পরিচিত মুখ যেন তার ব্যক্তিগত জীবনের ওপর অধিকারবোধ দেখায়। তার একাকীত্ব যেন সবার আলোচনার বিষয়। জানালার ধারে বসে সে ভাবে — সমাজের এই চোখরাঙানি থেকে মুক্তি কবে মিলবে?
বিকেলের দিকে, সেই অস্বস্তি আর চেপে রাখতে না পেরে মোহনা ফোন করে শ্রেয়াকে। কণ্ঠস্বরে ক্লান্তি লেগে থাকে, একরাশ হতাশা মিশে থাকে শব্দে। শ্রেয়া বুঝতে পারে, কিছু একটা হয়েছে। মোহনা বলে, “শ্রেয়া, এই কাঁচের ঘরের ভেতর বাঁচতে বাঁচতে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। বাইরের লোকে কী ভাবে, কী বলে — এই নিয়েই যেন আমাদের বাঁচা-মরা। এভাবে কি জীবন চলে?” শ্রেয়া তাকে শান্ত করতে চেষ্টা করে, বলে, “শোন, তুই নিজের মনকে শক্ত কর। লোকে কী বলছে সেটা নয়, তুই কী চাইছিস সেটা বড় কথা।” কিন্তু মোহনা জানে, সমাজের এই শাসন, এই কৌতূহল থেকে মুক্তি সহজ নয়। ঘরের ভেতর নীরবতা নেমে আসে। বাইরের পাখির ডাক, দূরের গাড়ির শব্দ — সবকিছু মিলে এক ধরনের কোলাহল তৈরি করে, আর সেই কোলাহলের মধ্যে মোহনা আরও বেশি বুঝতে পারে — সে কাঁচের ঘরের ভেতর আজ বড় বেশি বন্দি। আর সেই ঘরের দেয়াল তোলার পিছনে একলা সে দায়ী নয়, এই সমাজও দায়ী, এই কাকিমার মত হাজার মানুষের কথার বোঝা দায়ী। মোহনা নিজের হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে আর ভাবে — এই কাঁচের ঘর, এই কথার দেয়াল একদিন সে ভেঙে ফেলবেই।
৫
সন্ধ্যার নরম আলোয় কলকাতার এক চায়ের দোকানের কোণায় বসে আছে মোহনা আর শ্রেয়া। দু’জনের সামনে ধোঁয়া ওঠা কাপ, টেবিলের উপর ছড়ানো বিস্কুটের প্যাকেট, আর চারপাশে ব্যস্ত মানুষের কোলাহল। কিন্তু সেই কোলাহলের মধ্যে মোহনা আর শ্রেয়া যেন নিজেদের এক নিভৃত জগতে ঢুকে গেছে। মোহনার মুখে ক্লান্তির রেখা স্পষ্ট, চোখে লুকোনো যন্ত্রণা—যা দিনের পর দিন জমে আছে বুকের ভেতরে। শ্রেয়া চুপচাপ তাকিয়ে থাকে বন্ধুর দিকে। কতদিন ধরেই সে জানে, মোহনা নিজের মধ্যে কী বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে, কিন্তু আজ যেন সেই বোঝা কথার রূপ নিয়েছে। মোহনা নিচু গলায় বলে ওঠে, “শ্রেয়া, জানিস… কখনও কখনও মনে হয় আমি এক অদৃশ্য কারাগারে বেঁচে আছি। সবাই আমাকে দেখে, আমার সাফল্য দেখে, কিন্তু কেউ বোঝে না এই দেওয়ালের ওপারে কতটা শূন্যতা আছে।” শ্রেয়া কিছু বলে না, কেবল মৃদু হাসে, আর বন্ধুর কাঁধে আলতো হাত রাখে। বাইরে দূরের রাস্তায় গাড়ির হেডলাইট ঝলকায়, বাতাসে চায়ের গন্ধ ভাসে, কিন্তু সেই মুহূর্তে মোহনার ভেতরটা যেন আরও বেশি ভারী হয়ে আসে।
মোহনা ধীরে ধীরে নিজের মনের কথাগুলো বলতে শুরু করে। অভিষেকের প্রতারণা, বাবার চাপ, পাড়ার মানুষের মন্তব্য, অফিসের কোল্ড-প্রফেশনাল পরিবেশ—সবকিছু একে একে যেন এক ভয়ানক গল্পের মতো উঠে আসে তার মুখে। সে বলে, “আমি কী চাই, সেটা জানার আগে সবাই ঠিক করে দিয়েছে আমার জন্য কী ভালো। যেন আমার নিজের স্বপ্ন, নিজের ইচ্ছে কোনও দামই রাখে না।” শ্রেয়া চুপ করে শুনে যায়, কারণ সে জানে, এই কথা গুলো বলা খুব দরকার মোহনার জন্য। তারপর নরম গলায় বলে, “মোহনা, সমাজ তো কথা বলবেই। কিন্তু তুই যদি নিজের স্বপ্নের জন্য লড়তে না পারিস, তবে তো সত্যিই এই কাঁচের ঘর চিরকাল তোর চারপাশে থেকে যাবে।” মোহনা জানে, শ্রেয়া ঠিক বলছে, কিন্তু সেই ঘর ভাঙার সাহস খুঁজে পেতে তার সময় লাগছে। বাইরের চায়ের দোকানের কোলাহল, রাস্তার ব্যস্ততা, আর এই দুই বন্ধুর নিঃশব্দ কথোপকথন মিলিয়ে এক অদ্ভুত আবহ তৈরি হয়।
রাতের দিকে দু’জনে একসাথে দোকান থেকে বেরোয়। রাস্তার লাইটগুলোর হলদেটে আলোয় মুখোমুখি দাঁড়ায় তারা। শ্রেয়া বলে, “তুই যা খুশি করিস, তোর পাশে আমি আছি। কিন্তু নিজের জন্য বাঁচতে শিখ।” মোহনা চুপ করে থাকে। দূরে ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে গাড়ি ছুটে যায়, সেই শব্দ যেন তাকে মনে করিয়ে দেয়—জীবন থেমে থাকে না। দু’জনে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে, শহরের কোলাহলের মধ্যে হারিয়ে যায় তাদের ছায়া। কিন্তু সেই রাতে ঘরে ফিরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে মোহনা ভাবে—এই কাঁচের ঘর ভাঙার লড়াই শুরু করতে হবে। শ্রেয়ার কথাগুলো মনে পড়ে—“নিজের জন্য বাঁচতে শিখ।” জানালার বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে প্রথমবার নিজের ভেতরে সাহসের উষ্ণতা অনুভব করে, যদিও সেই সাহস এখনো ক্ষীণ, কিন্তু উপস্থিত।
৬
সকালবেলায় মোহনা যখন অফিসের দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢোকে, তখন চারপাশের ব্যস্ততা আর কোলাহল যেন তাকে এক অদৃশ্য দেওয়ালের মধ্যে ঠেলে দেয়। কর্পোরেট অফিসের সেই চেনা শীতল বাতাস, উজ্জ্বল আলো, টাইলস মেঝেতে হিলের শব্দ—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত যন্ত্রবৎ পরিবেশ তৈরি করে। সহকর্মীরা কেউ ল্যাপটপ স্ক্রিনের দিকে চোখ গেঁথে আছে, কেউ কফির কাপ হাতে হাসিমুখে গল্প করছে, আর কেউ হয়তো বসের তোষামোদে ব্যস্ত। মোহনা নিজের ডেস্কে বসে ল্যাপটপ খুলে, ইমেইল চেক করতে করতে এক ধরনের অবসন্নতা টের পায়। প্রতিটি ইমেইল যেন এক নতুন বোঝা, প্রতিটি টাস্ক যেন আরও একটুখানি শ্বাসরোধের শৃঙ্খল। সহকর্মী রাহুল পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে কটাক্ষ করে বলে ওঠে, “তুমি তো খুব সিরিয়াস! একটু হালকা হও না, লাইফে ফান লাগে!” কথাটা শুনে বাইরে থেকে হালকা হেসে দেয় মোহনা, কিন্তু ভেতরে রক্ত গরম হয়ে ওঠে। এদের কাছে তার পরিশ্রমের মানে বোঝা যায় না। অফিসের কাঁচের দেওয়ালের মধ্যে বসে সে আরও বেশি একা হয়ে পড়ে, বাইরে থেকে সবাই দেখে, কিন্তু কেউ বোঝে না তার মনের ভেতরের অশান্তি।
মধ্যাহ্নভোজের সময় ক্যান্টিনে গিয়ে মোহনা টেবিলের কোণে বসে থাকে, কাঁটাচামচ দিয়ে প্লেটে রাখা খাবার না চাইতেই নাড়া চাড়া করে। সহকর্মীরা পাশের টেবিলে বসে হালকা হাসি-মজা করছে — কেউ কারো নতুন প্রজেক্টের গল্প বলছে, কেউ অফিস পলিটিক্স নিয়ে ঠাট্টা করছে। সেই হাসির শব্দ তার কানে ঢোকে, কিন্তু মন ছুঁতে পারে না। কিছুক্ষণ পর বস রঞ্জন ঘোষ ক্যান্টিনে ঢুকে তাকে দেখে ডেকে পাঠান। কাঁচের কেবিনে বসে রঞ্জন মুখে হাসি ধরে রেখে তীক্ষ্ণ গলায় বলেন, “মোহনা, তোমার কাজ ঠিক আছে, কিন্তু তোমাকে আরও বেশি সোশালি ইনভলভ হতে হবে। এই গম্ভীর মুখে টিম স্পিরিট তৈরি হয় না, বুঝেছো?” কথাগুলো মোহনার বুকে কাঁটার মত বিঁধে যায়। সে জানে, সে কাজের মানুষ, টিমের জন্য নিজের সময়, শ্রম সব ঢেলে দেয়, তবু অফিসের এই ‘শো’ এর খেলার বাইরে থাকায় তার দোষ। বসের কথাগুলো শুনে সে মাথা নোয়ায়, উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না। কাঁচের কেবিনের জানালা দিয়ে বাইরের মেঘলা আকাশ দেখে সে ভাবে—কতটা অভিনয় করতে হবে এই জীবনে? কতটা মুখোশ পরতে হবে যাতে সবাই খুশি থাকে?
দিনশেষে, রাতের দিকে, মোহনা যখন নিজের ঘরে ফিরে আসে, তখন তার মনে হয় — অফিসের কাঁচের দেওয়াল আর জীবনের কাঁচের ঘর একরকম। দুটোই বাইরে থেকে সুন্দর আর নিখুঁত দেখায়, কিন্তু ভেতরে দম বন্ধ করা নিঃসঙ্গতা আর অশান্তি জমে থাকে। সে দরজা বন্ধ করে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। অফিসের টানাপোড়েন, বসের কথার বিষ, সহকর্মীদের কটাক্ষ — সব মিলিয়ে এক অদৃশ্য অশান্তির ঢেউ বয়ে যায় তার মনের ভেতর। শহরের নীল আলো, দূরের ফ্লাইওভারের গাড়ির হেডলাইট যেন কাঁচের জানালায় এসে প্রতিফলিত হয় আর তাকে মনে করিয়ে দেয় — সে এক কাঁচের ঘরে বন্দি, যেটা সে নিজেই ভাঙতে ভয় পায়, কিন্তু ভাঙতে চায়। মোহনা ভেতরে ভেতরে অনুভব করে, আর বেশিদিন এই অশান্তি তাকে আটকে রাখতে পারবে না। সে লড়াই শুরু করবেই, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার লড়াই।
৭
শহরের বৃষ্টি ভেজা এক সন্ধ্যা। জানালার কাঁচ বেয়ে টপটপ করে জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে, আর ঘরের ভেতর সেই জলরেখা যেন এক অদৃশ্য দাগ ফেলে যাচ্ছে মোহনাদের জীবনে। সারা দিন অফিসের ক্লান্তি, বসের কটাক্ষ, সহকর্মীদের মজা, সমাজের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন—সব মিলিয়ে আজ তার মনে কেমন এক ঝড় বইছে। জানালার ধারে বসে সে বাইরের ঝাপসা আলোয় ভেজা শহরটাকে দেখে, আর ভাবে—আজ অনেক হয়েছে। আর নয়। কাঁচের এই ঘর, যেটা এতদিন তাকে বন্দি করে রেখেছে, আজ তার ফাটল ধরেছে। সে ভাবে—জীবনটা কি শুধুই অন্যের শর্তে বাঁচার জন্য? আজ এতদিন পর প্রথমবার তার ভেতর থেকে বিদ্রোহের সুর জেগে ওঠে। বৃষ্টি তার মনের অস্থিরতাকে যেন আরও জাগিয়ে দেয়। প্রতিটি ফোঁটার শব্দে সে যেন শুনতে পায় নিজের হৃদয়ের ধুকধুকানি—যেখানে লুকিয়ে আছে সাহস, লুকিয়ে আছে প্রশ্ন, লুকিয়ে আছে মুক্তির ডাক।
সেই রাতে মোহনা ল্যাপটপ খুলে বসে। সে লিখতে শুরু করে নিজের মনের কথা—যা এতদিন চেপে রেখেছিল। টাইপের শব্দ ঘরের নীরবতাকে ভেঙে ফেলে। “আমাকে আর তোমরা নিয়ন্ত্রণ করবে না। আমার বেঁচে থাকা, আমার সুখ, আমার স্বপ্ন—সব আমার নিজের। সমাজের চোখরাঙানি, নন্দিনীর প্রশ্ন, বসের মন্তব্য, অফিসের মুখোশ পরা মানুষ—আর নয়। আমি আমার মতো করে বাঁচব।” প্রতিটি শব্দ লিখতে লিখতে সে যেন নিজেকে হালকা বোধ করে। এতদিন যেসব কথা বুকের মধ্যে পাথরের মতো চেপে ছিল, আজ সেই কথাগুলো বেরিয়ে আসতে থাকে অজানা সাহসে ভর করে। সে জানে, এটা হয়তো সমাজের চোখে বিদ্রোহ, কিন্তু তার কাছে এটা বেঁচে থাকার লড়াই। ঘরের বাতাস যেন বদলে যায়, কাঁচের ঘরের অদৃশ্য দেয়ালে প্রথমবার ছোট ছোট ফাটলের রেখা দেখা যায়। বাইরে বৃষ্টি থেমে গিয়ে এক ধরনের নির্মল নীরবতা নেমে আসে। সেই নীরবতা যেন মোহনাকে আশ্বাস দেয়—তার ভেতরের যুদ্ধ শুরু হয়েছে।
রাত গভীর হতে থাকে। মোহনা জানালার কাঁচে হাত রেখে বাইরের ভেজা শহরটাকে দেখে। সে ভাবে—এই শহরটা, এই আলো-ছায়ার খেলা, এই ভেজা রাস্তা, এই কোলাহল—সব তার চেনা, তবু কত অচেনা ছিল এতদিন। আজ মনে হয়, সে নিজেই এতদিন নিজের শত্রু হয়ে বেঁচে ছিল। জানালার কাঁচে তার প্রতিফলন ভেসে ওঠে—এক ক্লান্ত, কিন্তু দৃঢ়চেতা নারী, যে এবার সত্যিই লড়াই শুরু করতে চায়। বাইরে ফ্লাইওভারের লাইটগুলো একে একে নিভে যায়, কিন্তু তার মনে আলো জ্বলে ওঠে। সে জানে, এই কাঁচের ঘরের ফাটল একদিন বিস্ফোরণ ঘটাবে, আর সেই দিনেই সে আসল মুক্তি খুঁজে পাবে। নিজের দিকে তাকিয়ে সে ধীরে বলে ওঠে, “আমি পারব। আমাকে পারতেই হবে।”
৮
রাতের অন্ধকার কাটিয়ে ধীরে ধীরে ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ছে শহরের আকাশে। জানালার কাঁচ বেয়ে প্রথম সূর্যকিরণ পড়তেই মোহনার ঘর যেন এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতায় ভরে ওঠে। কাঁচের জানালায় তার নিজের প্রতিফলন দেখে সে প্রথমবার মনে করে—এই প্রতিফলন শুধু সমাজের তৈরি ফ্রেম নয়, এটা তার নিজের তৈরি। ঘুমহীন রাত কাটিয়ে ভোরের প্রথম আলোয় তার মনে হয়—এক নতুন পথ শুরু করার সময় এসে গেছে। ভেতরের ক্লান্তি, ভয়, শূন্যতা—সবকিছু যেন ধীরে ধীরে সরতে শুরু করে। বাইরে পাখির ডাক শোনা যায়, আর সেই ডাক তার কানে এক নতুন জীবনের আহ্বান হয়ে পৌঁছে যায়। সে ভাবে, এতদিন ধরে যে কাঁচের ঘর তাকে বেঁধে রেখেছিল, সেই ঘরের ফাটল দিয়ে এই আলো ঢুকে পড়েছে। এখন শুধু সেই আলোকে মেনে নিতে হবে, তাকে আঁকড়ে ধরতে হবে।
মোহনা ল্যাপটপের পাশে রাখা নিজের ডায়েরি খুলে বসে। এই ডায়েরির পাতাগুলো অনেকদিন খালি ছিল, কারণ সে নিজের অনুভূতি লিখতে ভুলেই গিয়েছিল। আজ সেই পাতায় বড় বড় অক্ষরে লিখে যায়—“আমি নিজেকে তৈরি করব নতুন করে। সমাজের শাসন, কৌতূহল, কথার বোঝা আমার পায়ের শিকল হবে না আর।” প্রতিটি অক্ষর যেন তার সাহসের প্রতিচ্ছবি। বাইরে ভোরের আলো আরও স্পষ্ট হয়, শহরের গলিতে গলিতে দোকানপাট খুলতে শুরু করে, জীবনের চাকা আবার ঘুরতে থাকে। কিন্তু আজকের সকালটা মোহনার কাছে আলাদা। আজ সে ঠিক করে—অফিসের নকল হাসির জগৎ, সমাজের চাপের শিকল—সব ভেঙে দিয়ে নিজের মতো করে বাঁচবে। হয়তো এই যাত্রা কঠিন হবে, হয়তো একলা লড়তে হবে, কিন্তু সে জানে—এই লড়াই শুরু করা খুব দরকার।
সকালবেলায় বেরিয়ে পড়ে সে। মুখে এক নতুন দৃঢ়তা, চোখে আত্মবিশ্বাসের ঝলক। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মোহনা ভাবে—এই শহর, এই আলো, এই কোলাহল তাকে আর তেমনভাবে বন্দি করতে পারবে না। সে ভাবে, অফিসে গিয়ে প্রথমবার নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে দেবে, নিজের মনের কথা বলবে। আর শুধু অফিস নয়—বাবার সঙ্গেও, সমাজের সঙ্গেও সে লড়াই করবে নিজের স্বপ্নের জন্য। হাওয়ার ঝাপটায় চুল উড়ে আসে মুখের ওপর, কিন্তু সে থামে না। ফ্লাইওভারের পাশে দাঁড়িয়ে সে দূরের আকাশের দিকে তাকায়, যেখানে ভোরের আলো আর মেঘের ভাজ মিশে এক নতুন ছবি আঁকছে। মনে হয়, এই নতুন ভোর তার নিজের জন্য। নিজের সাহস, নিজের লড়াই, নিজের তৈরি করা এক নতুন কাঁচের ঘর—যার দেওয়াল হবে স্বপ্নের, আর ভিত হবে নিজের ইচ্ছের।
৯
অফিসের দরজা পেরিয়ে যখন মোহনা নিজের ডেস্কে বসে, তখন তার ভেতরে এক অজানা দৃঢ়তা অনুভব করে। কর্পোরেট অফিসের চেনা সেই কাচের দেওয়াল, উজ্জ্বল আলো আর ব্যস্ত সহকর্মীদের কোলাহল আজ যেন তাকে ততটা তাড়িত করতে পারে না। রাহুল পাশ দিয়ে হেঁটে যায়, চোখের ইশারায় ইঙ্গিত করে—“আজও সেই গম্ভীর মুখ?” মোহনা এবার হালকা হেসে উত্তর দেয়, কিন্তু সেই হাসির মধ্যে লুকিয়ে থাকে আত্মবিশ্বাস। আজ সে ঠিক করেছে, আর কারও কথায়, কারও ছলনায় নিজেকে ছোট করবে না। বস রঞ্জন ঘোষ যখন কেবিনে ডেকে পাঠায়, তখন সে শক্ত মনের সঙ্গে দরজা পেরিয়ে ঢোকে। রঞ্জন বলেন, “মোহনা, তোমার কাজ ভালো, কিন্তু আরও স্মার্ট হতে হবে। টিম ম্যানেজ করতে শিখতে হবে, সোশালি মেলামেশা করতে হবে।” মোহনা এবার ধীরে, কিন্তু স্পষ্ট গলায় বলে ওঠে, “স্যার, কাজের জন্য আমি আছি। কিন্তু নিজেকে প্রমাণ করতে অফিসের বাইরে মুখোশ পরে ঘুরতে চাই না। আমি আমার কাজ দিয়ে কথা বলি, আর সেটা যথেষ্ট।” রঞ্জন প্রথমে অবাক হয়, তারপর মুখ শক্ত করে চুপ করে থাকে। সেই কাচের কেবিনের ভেতর প্রথমবার মোহনা নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে পায়।
সেই দিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে বাবা মহেশ্বর চক্রবর্তী টিভি বন্ধ করে তাকে কাছে ডাকেন। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলেন, “মা, তোর জন্য পাত্র খোঁজার কথা বলেছি। তোর মতামত না জানলে কি করে ঠিক করব বল?” এই প্রশ্নের জন্যই তো মোহনা দিনের পর দিন মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেছে। কিন্তু আজ সে ভয় পায় না। সে বাবার মুখোমুখি বসে বলে, “বাবা, আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। আমার নিজের স্বপ্নগুলো আছে, যেগুলো পূরণ করা বাকি। তুমি বলো, তুমি কি খুশি হবে যদি আমি শুধু সমাজের চোখে ভালো থাকার জন্য নিজের ইচ্ছে মেরে ফেলি?” মহেশ্বর স্তব্ধ হয়ে যায়। মেয়ের মুখের দৃঢ়তা, চোখের আত্মবিশ্বাস তার চেনা নয়। এতদিন যাকে সে দুর্বল ভেবেছে, আজ সেই মেয়ের চোখে আগুন দেখে সে চুপ করে থাকে। টেবিলের চায়ের কাপের গরম ধোঁয়া যেন ঘরের শূন্যতায় মিলিয়ে যায়। মোহনা উঠে দাঁড়ায়, বাবার কাঁধে হাত রাখে, আর ভাবে—লড়াই আজ শুরু হয়েছে।
রাতের দিকে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে মোহনা বাইরে ফ্লাইওভারের আলো-ছায়ার খেলা দেখে। আজ এই শহরটা, এই কাচের জানালা, এই ঘর—সবকিছু নতুন মনে হয়। এতদিন যে কাচের ঘর তাকে বন্দি করেছিল, আজ সেই ঘরে প্রথম ফাটল ধরেছে তার নিজের হাতে। বাইরে দূরের আকাশে মেঘ সরিয়ে চাঁদ দেখা যায়। মোহনা ভাবে, এই লড়াই সহজ হবে না। অফিসের মুখোশ পরা মানুষ, সমাজের কটাক্ষ, নন্দিনী কাকিমার মন্তব্য—সব কিছুই থাকবে। কিন্তু আজ সে জানে, তার ভেতরে যে আগুন জ্বলে উঠেছে, সেটাকে আর সহজে নিভিয়ে ফেলা যাবে না। সে জানে, লড়াইয়ে সে একা, তবু আজকের রাতের আকাশের মতো তার মনের আকাশও পরিষ্কার। সে নিজের ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি টানে আর ভাবে—এই শুরু, এই পথ শেষ পর্যন্ত সে চলবে, কারণ এ তার নিজের জন্য, নিজের বেঁচে থাকার জন্য।
১০
শহরের ভোর আজ অন্যরকম। জানালার কাঁচ বেয়ে সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়তেই ঘর ভরে যায় উজ্জ্বল আলোয়। মোহনা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। এই শহর, এই আলো-ছায়ার খেলা, এই কোলাহল—সব কিছুকে সে আজ অন্য চোখে দেখে। এতদিন যেটা তার কাছে শিকল ছিল, সেই কাঁচের ঘরের দেয়াল আজ তার কাছে চ্যালেঞ্জ। ভেতরে এক অজানা শক্তি অনুভব করে সে। নিজের লেখা ডায়েরির পাতা উল্টায়, যেখানে লেখা আছে তার প্রতিটি লড়াইয়ের কথা, প্রতিটি বেদনার মুহূর্ত, প্রতিটি আশা আর হতাশার কাহিনি। সে ভাবে—আর পিছিয়ে যাওয়া নয়। আজ সে শেষবারের মতো নিজের জন্য দাঁড়াবে। অফিসের মুখোশধারী মানুষগুলো, সমাজের রক্তচক্ষু, পাড়ার নন্দিনী কাকিমার কৌতূহলী চোখ—সবকিছুর উত্তর দেবে সে নিজের কাজ, নিজের স্বাধীনতা দিয়ে।
মোহনা সেই দিন অফিসে যায় এক নতুন উজ্জীবিত চেহারা নিয়ে। বসের কেবিনে গিয়ে স্পষ্টভাবে নিজের ইচ্ছে জানিয়ে দেয়—সে চায় নতুন প্রজেক্টের দায়িত্ব, নিজের ক্ষমতা প্রমাণ করার সুযোগ। বস প্রথমে অবাক হয়, তারপর ধীরে সম্মতি জানায়, কারণ মোহনাকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয় আর। সহকর্মীরা তার পরিবর্তন লক্ষ করে, কেউ সহানুভূতি মেশানো দৃষ্টি দেয়, কেউ চুপ করে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। মোহনা কারো দিকে তাকিয়ে ব্যাখ্যা দিতে চায় না। অফিসের কাঁচের দেওয়ালগুলো আজ তার কাছে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়। কাজ শেষ করে বিকেলে সে বাবা মহেশ্বরের সামনে দাঁড়ায়। দৃঢ় কণ্ঠে জানায়—“বাবা, তুমি যদি আমাকে সত্যিই ভালোবাসো, তবে আমার ইচ্ছে বোঝার চেষ্টা করো। বিয়ে এখন আমার প্রাধান্য নয়। আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।” মহেশ্বর চুপ করে থাকে অনেকক্ষণ, তারপর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নোয়ায়। এই নীরব সম্মতি মোহনার কাছে সবচেয়ে বড় বিজয়।
রাতের দিকে জানালার ধারে বসে মোহনা বাইরের শহরটাকে দেখে। কাঁচের জানালায় প্রতিফলিত নিজের মুখ দেখে সে মনে করে—এই প্রতিফলন আর কাঁচের ঘরের বন্দিনী নারীর নয়। এখন সে নিজের লড়াইয়ে নিজেই সেনাপতি। দূরে ফ্লাইওভারের লাইটগুলো একে একে নিভে যায়, আকাশে তারা ঝিকিমিকি করে। মোহনার মনে হয়, সেই তারাগুলো তার জন্য জ্বলছে। সে জানে, এই লড়াই এখানেই শেষ নয়, বরং শুরু। কিন্তু আজ সে মুক্তির দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। কাঁচের ঘরের দেয়ালে যে ফাটল ধরেছিল, আজ সেই দেয়াল ভেঙে নতুন জীবনের আলো ঢুকতে শুরু করেছে। সে জানে—ভবিষ্যতের পথে ঝড় আসবে, কিন্তু সে সেই ঝড়কে মুখোমুখি করতে প্রস্তুত। কারণ আজ থেকে সে নিজের জীবনের জন্য নিজেই দায়ী।
***
ছয় মাস কেটে গেছে। শহরের ব্যস্ততা, আলো-ছায়ার খেলা আগের মতোই রয়েছে, কিন্তু মোহনাদের জীবন বদলে গেছে অনেকখানি। সেই কর্পোরেট অফিসে এখন মোহনা নিজেই নতুন প্রজেক্ট লিড, যেটা সে নিজের দক্ষতায় অর্জন করেছে। কাঁচের দেওয়ালের সেই পুরনো কেবিনে এখন সে নিজের জায়গা তৈরি করেছে—যেখানে মুখোশের আড়ালে থাকা নয়, বরং কাজের গুণে সম্মান পাওয়া যায়। সহকর্মীরা এখন তার নেতৃত্বে অনুপ্রাণিত হয়, তার সাহসের গল্প ছড়িয়ে পড়ে নতুন কর্মীদের মধ্যে। বস রঞ্জন ঘোষও আজকাল তার সামনে ভদ্রতায় কথা বলেন। অফিসের সেই দেওয়ালগুলো, যেগুলো একদিন তাকে বন্দি করেছিল, আজ সেই দেওয়ালগুলো যেন তার সাফল্যের গল্পের সাক্ষী। বাইরে ফ্লাইওভারের গাড়ির আলো-ছায়ার মতোই মোহনার জীবনও নতুন ছন্দে ধাবিত হচ্ছে, যেখানে আছে নিজের জন্য লড়াই করার আনন্দ, নিজের জন্য গড়া স্বপ্নের বাস্তব রূপ।
বাড়ির ছবিটাও পাল্টেছে। বাবা মহেশ্বর চক্রবর্তী হয়তো পুরোপুরি সমাজের শাসন ভুলতে পারেননি, কিন্তু মেয়ের চোখের দৃঢ়তা তাকে বদলে দিয়েছে। সন্ধেবেলায় চায়ের কাপে বসে বাবা-মেয়ে আজকাল অনেক কথা বলেন—কখনও অফিসের প্রজেক্টের গল্প, কখনও সমাজের দৃষ্টি নিয়ে হাসাহাসি, আবার কখনও নিঃশব্দে পাশে বসে থাকা। নন্দিনী কাকিমার প্রশ্ন আর মোহনাকে আর বিদ্ধ করে না, বরং সে মৃদু হেসে নিজের পথে হাঁটে। পাড়ার মানুষও আজকাল মেনে নিয়েছে—মোহনা অন্যরকম, আর সে নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রক। ঘরের কাঁচের জানালা, যে জানালা দিয়ে সে একদিন কেবল বাইরের আলো-ছায়া দেখত, আজ সেই জানালা খুলে দেয়ার সাহস পেয়েছে সে। জানালার ধারে বসে সে ভাবে—জীবনের কাঁচের ঘর ভেঙে যাওয়ার পর, যে মুক্ত হাওয়া এসে তাকে ছুঁয়েছে, সেটাই তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
রাতের আকাশে তারা ঝিকিমিকি করে, শহরের ফ্লাইওভারের লাইটের রেখা ছুঁয়ে। মোহনা জানালার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে থাকে। তার ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা—“কাঁচের ঘর ভাঙা মানে শুধু সমাজের শাসন অতিক্রম করা নয়, নিজের মনের ভয়গুলো অতিক্রম করা। আর আমি পেরেছি।” বাইরে দূরের আকাশে নতুন চাঁদ ওঠে, আর সেই চাঁদের আলোয় সে দেখে—জীবনের নতুন পথ খুলে গেছে তার জন্য। একদিনের সেই কাঁচের ঘর আজ শুধু স্মৃতি, আর সে স্মৃতি তাকে আরও শক্ত করে, আরও এগিয়ে যেতে শেখায়। সে জানে, জীবনের পথে ঝড় আসবে, কিন্তু সে প্রস্তুত, কারণ সে আজ সত্যিই মুক্ত।
___