Bangla - ভূতের গল্প

কলুর কণ্ঠে সন্ধ্যাবেলা

Spread the love

সৌম্যজ্যোতি ঘোষাল


সকালটা ছিল অস্বাভাবিক রকমের শান্ত। পাখিদের কিচিরমিচির যেন কেউ কেটে নিয়েছে আকাশ থেকে। উত্তর কলকাতার বাঘবাজারের গলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে রেণুকা দেবী প্রতিদিনের মতো এসে ঢুকলেন হরিপদ দত্তর বাড়িতে। পুরনো রকমের বাড়ি, মেঝের ওপর কাঠের পাটাতন, খোলামেলা বারান্দা আর লোহার গেট। হরিপদবাবু সাধারণত খুব ভোরে উঠতেন—বারান্দায় বসে জল খেতেন, আর তার পোষা শালিখ পাখি ‘কলু’-কে খাওয়াতেন। কিন্তু আজ বারান্দার দরজা খোলা, অথচ তিনি কোথাও নেই। পাখির খাঁচা পাশে ঝুলছে, কলু ঘাড় একদিকে কাত করে তাকিয়ে আছে রেণুকার দিকে, আর বলছে সেই অদ্ভুত কথাটি—”তিনটে বাজে… ও পেছনে তাকিও না!” কাঁপা কাঁপা পায়ে রেণুকা এগিয়ে গেলেন। বারান্দার কোণায়, বাঁশের চেয়ারটিতে হরিপদবাবুর নিথর শরীর পড়ে আছে—চোখদুটো অদ্ভুতভাবে উন্মুক্ত, যেন তিনি কিছু দেখে গিয়েছেন, যা মৃত্যুর থেকেও ভয়ানক। তাঁর পাশে পড়ে থাকা চায়ের কাপ ভেঙে গিয়েছে, ছড়িয়ে পড়েছে চা আর কিছু গুঁড়ো ওষুধের মতো বস্তু। বুকের ওপর হাত রাখা, ঠোঁটে জমে থাকা কিছু বলার অক্ষমতা। চারপাশে অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা। রেণুকা চিৎকার করে উঠলেন—”দাদা! হরিপদ দাদা!” কিন্তু সেই চিৎকার ঘরের কাঠের কড়িকাঠে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এলো নিঃসাড় প্রতিধ্বনির মতো।

খবর ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগল না। দমদম থানার পুলিশ অফিসার সায়ন্তনী সেন ঘটনাস্থলে পৌঁছালেন সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে। সায়ন্তনী অভিজ্ঞ তদন্তকারী, কিন্তু এই মৃত্যুতে কিছু অস্বাভাবিকতা প্রথম দর্শনেই চোখে পড়ল। বৃদ্ধ মানুষ, চিকিৎসাধীন ছিলেন না, অথচ বারান্দায় এই ভঙ্গিমায় মৃত্যু? মৃতদেহে আঘাতের চিহ্ন নেই, রক্ত নেই, কিন্তু মুখে এক অদ্ভুত আতঙ্ক। মৃত্যু যদি হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে, তবে এমন ভয়াবহ মুখভঙ্গি কেন? পাড়ার লোকেরা বলল, গত কিছুদিন ধরেই হরিপদবাবু একটু উদ্ভট আচরণ করছিলেন—রাতে আলো জ্বেলে রাখতেন, কারও সঙ্গে ভালো করে কথা বলতেন না, কলুর খাঁচার চারপাশে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতেন। সায়ন্তনীর চোখ গিয়ে পড়ল পাখিটির দিকে। শালিখটি ঠোঁট নেড়ে আবার বলে উঠল—”তিনটে বাজে… ও পেছনে তাকিও না!” সায়ন্তনী থমকে গেলেন। এটা কি নিছক অনুশীলিত বাক্য, নাকি এর মধ্যে রয়েছে কোনো বার্তা? শালিখ পাখিরা যেমন মানুষের বলা কিছু কথা অনুকরণ করতে পারে, তেমনই তারা নিজেরাও কোনো অভ্যাস বা প্রতিক্রিয়া থেকে একই বাক্য বলতে থাকে। প্রশ্ন জাগে—এই বাক্য কে শিখিয়েছে পাখিটিকে? হরিপদ নিজে? না কি কেউ অন্য কেউ? আর এই বাক্যটির মধ্যে কি কোনো সংকেত আছে?

সায়ন্তনী এর মধ্যেই তদন্তে গতি আনতে শুরু করলেন। বাড়ির এক কোণায় তিনি একটি পুরনো ডায়েরি খুঁজে পেলেন। ডায়েরির পাতাগুলিতে কিছু এলোমেলো বাক্য লেখা ছিল—“ঘড়ির কাঁটা থেমে যাবে, কিন্তু কলুর ডাক থামবে না”… “যা দেখেছি, তা কেউ দেখেনি, কেউ জানুকও না”… “তিনটা মানেই সময় নয়, ছায়া…”। ডায়েরিটি অনেকটা উন্মাদনার মতো লেখা, যেন কেউ আতঙ্কে ভুগতে ভুগতে নিজের ভয়গুলোকে কাগজে চাপিয়ে দিচ্ছে। এদিকে হরিপদর ভাতিজা বিক্রম ঘোষ এসে হাজির হল, মুখে ভারী দুঃখের ছায়া, কিন্তু আচরণে অস্থিরতা। সে দাবি করল, এই বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী সে, আর কাকার কোনো মানসিক সমস্যা ছিল না। অথচ সে কীভাবে জানল কাকার মৃত্যুর খবর, যখন পুলিশ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কাউকে জানায়নি? আরও অদ্ভুত ব্যাপার, বিক্রমের কাছে বাড়ির মূল চাবি ছিল, অথচ সে নিজে দাবি করে, বহুদিন ধরে কাকার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। তদন্তে অল্প অল্প করে উঠে আসতে লাগল ছায়ার মতো কিছু ঘটনা, কিছু অসম্পূর্ণ কথা—আর পেছনে বারবার ভেসে উঠতে থাকল কলুর গলার সেই তীক্ষ্ণ ডাক: “তিনটে বাজে… ও পেছনে তাকিও না!”

***

দমদম থানার অফিসার সায়ন্তনী সেন মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে ছিলেন হরিপদ দত্তর বাড়ির বারান্দায়। সকাল থেকে যে কটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর কেস দেখেছেন, তার তুলনায় এইটা যেন কিছুতেই মানতে পারছেন না। পুলিশি ভাষায় এটাকে ‘নর্দমাল হার্টফেইলিওর’ বলা যেত—কিন্তু দৃশ্যটা তার মানসিক পেশিতে কাঁটা তুলে দিয়েছে। বৃদ্ধের মুখের আতঙ্ক, কলুর বারবার বলা এক অদ্ভুত বাক্য—সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, মৃত্যুটা ছিল না স্বাভাবিক। রেণুকা দেবী কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। তিনি বলছিলেন, “কাল সন্ধ্যা থেকেই উনি খুব চুপচাপ ছিলেন, ম্যাডাম… কলুর খাঁচার কাপড় বারবার টানতেন… জানালাটা বারবার দেখে বলছিলেন, ‘ওরা আবার আসবে…’” ওরা কারা? কে আসবে? সায়ন্তনীর মাথায় প্রশ্নগুলো ছায়ার মতো ঘুরপাক খেতে লাগল। তিনি বারান্দার কর্নারে একটি অ্যালুমিনিয়ামের ট্রে দেখতে পেলেন, যেটিতে কিছু চায়ের দাগ আর আধখাওয়া বিস্কুট ছিল। তার নিচে পড়ে ছিল ছোট একটি কাগজ, তাতে শুধু লেখা—“ওদের ভুলে যাস না।” ঘর তল্লাশি শুরু হল। বাড়ি ভেঙে পড়েনি, তবু সময়ের ছাপ জিনিসে জিনিসে। দেওয়ালে ধুলো জমা, অনেক ফাইল আর কাগজের স্তূপ। ঘড়ির কাঁটা তখন আটটা পঁচিশে থেমে ছিল—সেইটাই চমকে দিল সবাইকে। সময় বন্ধ? নাকি কারও হাতে থামানো?

কলুর খাঁচার পাশে বসে সায়ন্তনী কিছুক্ষণ পাখিটিকে লক্ষ্য করলেন। শালিখটি তখন ঠোঁট নিচে নামিয়ে একটা চকচকে বোতাম কুড়াতে ব্যস্ত, তারপর আবার থেমে উচ্চারণ করল—“তিনটে বাজে… ও পেছনে তাকিও না!” এখন শব্দটা যেন আরও স্পষ্ট, যেন যেন কারও রেকর্ড করা কণ্ঠে বলা—কিন্তু সেটা কাদের? হরিপদ নিজে শিখিয়েছেন? নাকি কেউ অন্য কেউ, যাকে হরিপদ ভয় পেতেন? সায়ন্তনী পশু-আচরণ বিশেষজ্ঞ ডঃ অনিরুদ্ধ বসুকে ফোন করলেন, যিনি এর আগে দুটি মামলায় পোষা প্রাণীর আচরণ বিশ্লেষণ করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিলেন। তিনি ফোনে শুনেই বললেন, “ম্যাডাম, এটা সাধারণ সংলাপ নয়। শব্দের পুনরাবৃত্তি যদি একই সময়ের মধ্যে হয়, তবে এটি একধরনের ‘triggered vocal pattern’। অনেক সময় প্রাণীরা অভ্যাসগত কথার মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট পরিস্থিতি মনে করিয়ে দিতে পারে।” সায়ন্তনী অবাক হয়ে শুনলেন, “মানে পাখিটা হয়তো কিছু বলছে, যা ঘটে গেছে?” “হ্যাঁ, কিংবা যা হরিপদ তাকে শিখিয়েছেন, কোনো কিছু ঘটনার পর কেউ যেন তা বুঝতে পারে।” বিষয়টা রোমাঞ্চকর, কিন্তু একই সাথে ভীতিকরও। সায়ন্তনী ভাবলেন, যদি সত্যিই এই পাখি একটা সংকেত বহন করে, তবে মৃত্যুর রহস্য লুকিয়ে আছে সেই সংকেতে।

তদন্ত যত এগোতে লাগল, তত যেন বাড়িটির দেওয়ালের ছায়ায় জমতে লাগল কিছু না বলা সত্য। বিক্রম ঘোষ, হরিপদর ভাতিজা, বাড়িতে এসে চেয়ারে বসে কপাল চাপড়াতে লাগল, “কাকু কি হার্ট অ্যাটাকে গেলেন? উনি তো ঠিকঠাকই ছিলেন!” মুখে দুঃখ, কিন্তু আচরণে একধরনের অস্থিরতা। সায়ন্তনী খেয়াল করলেন, সে ঘরের বিভিন্ন কোণ বারবার দেখে নিচ্ছে, যেন কিছু খুঁজছে। অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কবে এসেছেন?” বিক্রম বলল, “এই তো, খবর পেয়ে। একজন পাড়ার লোক ফোন করল।” কিন্তু পাশেই দাঁড়ানো মোহিত বলল, “ও তো সকালে সাতটার আগেই বাড়িতে ঢুকে গেছে!” সন্দেহ আরও ঘনাল। বাড়ির চাবি কোথা থেকে পেল সে? তখন বিক্রম স্বীকার করল, “আমি একবার কাকুর কাছে এসেছিলাম মাসখানেক আগে। উনি আমাকে একটা চাবি দিয়েছিলেন—বাড়ি দেখাশোনার জন্য।” সায়ন্তনী চোখ কুঁচকে দেখলেন তাকে। এটা যদি সত্যিও হয়, তাহলে সে আগে বলল না কেন? এদিকে ঘরের অন্য পাশে একটা ছোট কাঠের আলমারিতে পাওয়া গেল একটা কালো খাপের খাতা—ভেতরে কাগজের চিরকুট: “যদি এটা খুঁজে পাস, তবে জানবি আমি মরিনি… আমি অপেক্ষা করছি কলুর ডাকে।” এটা কীরকম কথা? এক মৃত বৃদ্ধ এমন কী রেখে যেতে চেয়েছেন, যা কেউ ব্যাখ্যা করতে পারছে না? সায়ন্তনী জানতেন, এই রহস্যের প্রতিটি গিঁট খুলতে হবে সময়ের আগে, কারণ তিনটে বাজে কলুর ডাক—এটা নিছক পাখির খেলা নয়, এটা হয়তো এক হত্যার প্রতিধ্বনি।

***

কলুর খাঁচার পাশে দাঁড়িয়ে সায়ন্তনী বুঝতে পারছিলেন—এই পাখিটি যেন কেবল একটা পোষা প্রাণী নয়, বরং এই গোটা কাহিনির এক জীবন্ত সাক্ষী। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি উচ্চারণ যেন ধরে রেখেছে কোনো লুকিয়ে থাকা বার্তা। পাখিটির গলায় ঘনঘন ফিরে আসছে সেই বাক্য: “তিনটে বাজে… ও পেছনে তাকিও না!” বারবার, একই টোনে, একই স্বরে। পাখিটির চোখে যেন ভয়, অভ্যাস আর সংকেত—তিনটাই একসঙ্গে মিশে আছে। ডঃ অনিরুদ্ধ বসু দুপুর নাগাদ এসে পৌঁছালেন। উচ্চতা কম, কিন্তু চোখদুটো বেজায় তীক্ষ্ণ। তিনি প্রথমেই কলুর খাঁচার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, কিছুক্ষণ শব্দ না করে পাখির গতিবিধি লক্ষ্য করলেন। তারপর কাগজে কলুর বলা বাক্যটি লিখলেন এবং সায়ন্তনীকে বললেন, “একটা জিনিস লক্ষ করেছেন? পাখিটি এই বাক্যটি নির্দিষ্ট সময়ের কিছু আগে আগে বলছে, পুরোপুরি তিনটা বাজার ঠিক আঠারো মিনিট আগে থেকে সে বারবার বলছে।” সায়ন্তনী বিস্মিত হয়ে বললেন, “মানে ওর শরীরের ঘড়ি এতটা নিখুঁত?” ডঃ বসু মাথা নেড়ে বললেন, “এটা ঘড়ি নয়, এটা মনে হয় রুটিন-বেসড ট্রিগার—অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট রোদের আলো, কোনো শব্দ, বা পরিবেশগত পরিবর্তন একে ট্রিগার করছে। কিন্তু, কথা হলো, পাখিটি এই বাক্য কেন বলছে?”

ডঃ বসু পাখির আচরণ বিশ্লেষণ শুরু করলেন। প্রথমে কিছু সহজ শব্দ শোনালেন—‘হ্যালো’, ‘চাকলেট’, ‘জল’, ইত্যাদি। কলু প্রতিক্রিয়া দিল না। কিন্তু যখন তিনি মৃদু স্বরে বললেন “তিনটে বাজে”—তখন কলু হঠাৎ তার ঠোঁট খোলার আগেই ডানা ঝাঁপটাল। এরপর নিজেই বলল, “ও পেছনে তাকিও না!” এ যেন কোনো প্রতিরক্ষামূলক আচরণ! সায়ন্তনী লক্ষ্য করলেন, যখনই কেউ কলুর মুখোমুখি হয়ে তার চোখে চোখ রাখছিল, সে চুপ থাকছিল। কিন্তু কেউ যদি পেছনে ঘুরে দাঁড়াত, তখনই সে ওই বাক্য বলছিল। ডঃ বসু বললেন, “আপনি যদি মনে করেন, এই পাখি কেবল একটি বাক্য মুখস্থ করে রেখেছে, তাহলে ভুল করবেন। এটা একটা প্রতিক্রিয়া, কিংবা বলা যায়—একটি সংকেত, যা সে শিখেছে কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে।” সায়ন্তনী বিস্মিত। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কোনো ভয়ংকর দৃশ্যের আগে যদি পাখিটি কিছু শুনত, বা দেখত, তবে কি সে সেটাকে বারবার পুনরাবৃত্তি করে মনে রাখতে পারে?” বসু বললেন, “অবশ্যই পারে। এবং এমনও হতে পারে, হরিপদবাবু নিজেই বারবার পাখিটিকে এই বাক্যটি বলতেন। হয়তো একটা ভয় তার মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল, যার উৎস আমরা এখনো জানি না।” সেই সময়েই মোহিত এসে জানাল, যে সে গত সপ্তাহে হরিপদকে অনেক রাতে ছাদে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছে। এবং তখন তিনি কলুর সঙ্গে এমনভাবে কথা বলছিলেন, যেন কাউকে ভয় পাচ্ছেন—আবার যেন পাখিটিকে কিছু শেখানোর চেষ্টা করছেন।

সেই রাতের ঘটনার সূত্র ধরে সায়ন্তনী আর ডঃ বসু বাড়ির ছাদে উঠে গেলেন। ছাদের কোণায় পুরনো একটি কাঠের টেবিল আর ল্যাম্প পড়ে ছিল—তাতে ধুলোর স্তর। কিন্তু সেই টেবিলের পাশে ছোট একটি খাঁচা দেখা গেল, মনে হয় কলুকে মাঝে মাঝে এখানে রাখা হতো। খাঁচার নিচে পাওয়া গেল একটি ছোট অডিও রেকর্ডার, যার ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে। সেটা নিয়ে নিচে নেমে পুলিশের ফরেনসিক টিমকে দিয়ে চার্জ করানো হলো। সেই রেকর্ডারে ছিল মাত্র একটি অডিও ক্লিপ—২০ সেকেন্ডের। সেখানে শোনা যাচ্ছিল হরিপদর কাঁপা কণ্ঠে বলা: “কলু… বলিস… তিনটে বাজে… ও পেছনে তাকিও না… ও পেছনে তাকালে ওরা আসে… আসে…” তারপর একটা থমথমে নিঃশব্দ। সায়ন্তনী চুপ করে বসে রইলেন, মাথায় যেন ঠাণ্ডা একটা বাতাস বয়ে গেল। ডঃ বসু ধীরে ধীরে বললেন, “এই তো প্রমাণ, উনি ইচ্ছাকৃতভাবে শিখিয়েছেন পাখিটিকে… এবং মনে হয়—তিনি কাউকে ভয় পেতেন, এমন কারও—যার অস্তিত্ব হয়তো এখনো বাড়ির কোথাও লুকিয়ে আছে। বা ছিল।” সায়ন্তনীর মনে হলো, হরিপদ হয়তো মৃত্যুর আগে চাইছিলেন তার পোষা পাখিই হয়ে উঠুক তার শেষ সত্যবক্তা। কলু আর শুধু শালিখ নয়—এখন সে এক জীবন্ত রহস্যপুঞ্জ, যার গলায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এক অব্যক্ত খুন অথবা অপরাধের বার্তা। এখন শুধু দরকার সেই সংকেতের ব্যাখ্যা খুঁজে বের করা—সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই, কারণ ‘তিনটে বাজে’ আবার আসছে।

***

ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল দশটা পেরিয়েছে, বাড়ির ভেতরে চাপা উত্তেজনা। হরিপদবাবুর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়েছে। সাংবাদিকরা বাড়ির গেটের বাইরে অপেক্ষা করছে, পাড়ার মানুষজন জটলা পাকিয়ে কানাঘুষো করছে—”ওই পাখিটা কেমন অদ্ভুত কথা বলে না ম্যাডাম!” এমন সময় বাড়ির সামনে এসে থামে একটি রূপালি রঙের স্কোডা গাড়ি। নেমে আসে একজন মধ্যবয়সী লোক—কাঠামোগতভাবে চওড়া, চোখে কালো চশমা, পরনে আধুনিক হাফ শার্ট ও ডেনিম প্যান্ট। সোজা হেঁটে এসে নিজেকে পরিচয় দেয়—“আমি বিক্রম ঘোষ, হরিপদ দত্তর একমাত্র ভাইপো। আমাকে ফোন করেছিল একজন, এই মৃত্যুর খবর দিয়ে।” তার কণ্ঠে বিষাদের চেয়েও বেশি ছিল অধিকারবোধ। সায়ন্তনী তাকিয়ে ছিলেন সন্দেহভরা চোখে। বিক্রম নিজেকে পরিচয় দেওয়ার পরেই বারবার বলছিল, “কাকু আমার কোনো কথা শুনতেন না, একলা থাকতেন… আমি তো বলতাম, আমাকে বাড়িতে থাকতে দিতে… কিন্তু উনি নিজের মতো করে চলতেন।” এ কথাগুলো শুনে সায়ন্তনীর মনে প্রশ্ন ওঠে—আপনি এতদিন দেখা করতেন না, অথচ এখন এত অধিকার? পুলিশ তাকে জিজ্ঞেস করে, “আপনার ফোন নম্বরে কে ফোন করেছিল?” সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, “একজন পাড়ার ছেলেই… নামটা ঠিক মনে নেই।” অথচ মোহিত বলেছিল, বিক্রম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিল সকাল সাতটারও আগে, যখন কেউ ফোনই করেনি। এক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে—বিক্রম কীভাবে জানল?

সন্দেহ আরও ঘনীভূত হল যখন বিক্রম এক ফাঁকে বলল, “এই বাড়ির কাগজপত্রগুলো কোথায় রাখা আছে, জানেন?” সায়ন্তনী চমকে গেলেন। একজন সদ্য মৃত বৃদ্ধ আত্মীয়ের জন্য শোক করার আগে যার চিন্তা বাড়ির দলিল নিয়ে—তার মনোভাব অস্বাভাবিকই। “আপনার কি বাড়ির কোনো চাবি আছে?” অফিসার জিজ্ঞেস করলেন। সে একটু ইতস্তত করে বলল, “হ্যাঁ… মাস দুয়েক আগে কাকু নিজেই আমাকে দিয়েছিলেন। তখন বলেছিল, যদি কিছু হয়, দেখে নিও।” কিন্তু এমন কথা আগেই সে বলেনি। এরপর বাড়ির দোতলায় উঠে সায়ন্তনী একটা ছোট লোহার আলমারি দেখতে পান, যেটি তালাবদ্ধ। জিজ্ঞেস করলে বিক্রম পকেট থেকে একটা চাবি বের করে বলেন, “এইটা দিয়েই খুলত কাকু।” তালা খুলে গেলে দেখা গেল ভেতরে কিছু পুরনো নথি, জমির কাগজ, আর একটি ধুলো-মাখা খাম—যাতে লেখা: “তাকে বিশ্বাস করা যায় না।” খামের ভেতরে ছিল একটি অর্ধেক লেখা চিঠি—হরিপদ নিজ হাতে লিখেছেন, সেই চেনা খটখটে অক্ষরে:
“বিক্রম শুধু উত্তরাধিকার চায়, সে আমায় ভয় দেখিয়েছিল। বলেছিল, আমি যদি না দিই, তাহলে আমার স্মৃতির কাছেই সে প্রতিশোধ নেবে। কলু জানে। কলু সব জানে।”

সায়ন্তনীর মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল। কলু! আবার সেই শালিখ! যে কিনা এখন এক অদ্ভুত পাখির চেয়েও বেশি, এক জীবন্ত তথ্য-ভাণ্ডার। বিক্রমকে সাময়িকভাবে বাড়ির বাইরে যেতে বলা হল। সায়ন্তনী নিচে নেমে এসে পাখির খাঁচার সামনে দাঁড়ালেন। কলু তখন চোখ বন্ধ করে মাথা ডান দিকে কাত করেছে। হঠাৎ যেন কেউ না বলেই জিজ্ঞাসা করেছে, এমনভাবে পাখিটি বলে উঠল—“পেছনে তাকিও না… তিনটে বাজে… জমির নিচে… ছায়ার ভিতর…” সায়ন্তনী কেঁপে উঠলেন। নতুন বাক্য! এখনই প্রথম বার! “জমির নিচে”? সে কী ইঙ্গিত করতে চাইছে? বাড়ির ভেতর কিছু চাপা পড়ে আছে? হরিপদ কী লুকিয়ে রেখেছিলেন? বিক্রম কী তা জানত? না কি সে-ই চেয়েছিল সেটা দখল করতে? ডঃ বসু তখনই বললেন, “এই বাক্যগুলো আসলে হয়তো হরিপদবাবুর গলায় বলা একরকম কোড—যেগুলো সে পাখিকে বারবার বলতেন যেন কিছু থাকলে ভবিষ্যতে তা উদ্ধার করা যায়। তার মানে এই বাড়ির নিচে—আক্ষরিক অর্থেই—কিছু আছে!” সায়ন্তনীর চোখ চকচক করল। হয়তো এই তদন্তের মোড় ঘুরবে সেই চাপা দেওয়া মাটির গভীর থেকে।

***

বিক্রমের আচরণ এবং কলুর নতুন উচ্চারণ—”জমির নিচে, ছায়ার ভিতর”—এই দুটি বিষয় সায়ন্তনীর মনে গভীর একটা সন্দেহের ছায়া ফেলল। হরিপদ দত্ত শুধু পাখিপ্রেমিক বৃদ্ধ নন, তিনি ছিলেন এক নিঃসঙ্গ জীবনযাপনকারী মানুষ, যাঁর অতীত ঘিরে একরাশ অজানা অধ্যায় ছিল। বাড়ির এক পুরনো ঘরে ঢুকে সায়ন্তনী খুঁজতে লাগলেন কিছু চিহ্ন—কোনো ডায়েরি, নথি, কিংবা অতীতের কোনো ছায়া, যা তার মৃত্যুর রহস্যের পেছনের পর্দা সরাতে সাহায্য করতে পারে। সে ঘরটি অন্যদের তুলনায় অন্ধকার ও চাপা; পুরনো খাট, ধুলো-মাখা বইয়ের তাক, আর একটা ডাস্টবিনে অর্ধেক পোড়া কাগজ। ঠিক আলমারির নিচে একটা কৌটো ঘষাঘষির শব্দে দৃষ্টি গেল। টেনে বার করতেই বেরোল একটি শক্ত চামড়ার বাঁধাই ডায়েরি। পাতাগুলো হলদে, কিছু ছিঁড়ে গিয়েছে, কিছুটা পানি লেগে ধোঁয়াশা হয়ে আছে, কিন্তু অক্ষরগুলো পরিষ্কার। প্রথম পাতায় লেখা:
“এই ডায়েরি আমার কথা নয়, আমার ভয়, আমার ভুল আর আমার ভবিষ্যতের শাস্তি।”

পাতা উল্টাতেই ধীরে ধীরে খুলে যেতে লাগল এক পুরনো অপরাধের পর্দা। হরিপদ লিখেছিলেন—১৯৭১ সালের এক রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় তিনি চাকরিসূত্রে জড়িয়ে পড়েছিলেন এক গভীর ষড়যন্ত্রে। একজন সমাজকর্মী, যিনি স্থানীয় জমির মালিকানায় দুর্নীতির প্রতিবাদ করেছিলেন, তাঁর নামে মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়ে তাঁকে গ্রেফতার করানো হয়েছিল। পরবর্তীতে জানা যায়, সেই সমাজকর্মী থানা হেফাজতে মারা যান, এবং সেই ঘটনার দায় পরে পড়ে যায় হরিপদের উপর, কারণ তাঁর জবানবন্দি ছিল মূল ভিত্তি। হরিপদ লিখেছেন, “আমি বুঝতাম না, কি ভয়ঙ্কর খেলায় আমি ব্যবহৃত হচ্ছি। যখন বুঝলাম, তখন থেমে যাওয়া অসম্ভব ছিল। আমি তখন চুপ করে গিয়েছিলাম, চুপ থাকার শাস্তি পেয়েছি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।” আরও একটি পাতায় লেখা—“কলু আমার কাছে ঈশ্বরপ্রদত্ত। আমি ওকে শেখাচ্ছি—যদি কেউ ফিরে আসে, যদি আমি না বাঁচি, তবে কলুই বলবে সত্যটা। তিনটে বাজে, কারণ সেই সময়ে ওরা এসেছিল। আমি পেছনে তাকিয়েছিলাম, ভুল করেছিলাম।”

ডায়েরির পরবর্তী পাতাগুলিতে হরিপদ তাঁর ভাতিজা বিক্রমকে নিয়েও কিছু মন্তব্য করেছেন। লেখা আছে, “ও আমার রক্তের সম্পর্ক, কিন্তু ওর চোখে আমি দেখি লোভ, দেখি হিংসা। ও চায় এই বাড়ি, এই জমি, কিন্তু আমি জানি, এই মাটির নিচে লুকিয়ে আছে আমার পাপের দলিল। যদি ও পায়, তবে সব নষ্ট হয়ে যাবে।” এই অংশটি পড়ে সায়ন্তনীর মনে হল, কলুর মুখে বলা “জমির নিচে” কথাটা হয়তো সরাসরি ওই জায়গার দিকেই নির্দেশ করছে। হঠাৎই ডঃ বসু এসে জানালেন, কলু আবার একই বাক্য বলছে, তবে এবার একটু নতুন ভঙ্গিতে: “ছায়া… ছায়ার ভিতর… জমির নিচে… তিনটে বাজে…” এই পরিবর্তিত উচ্চারণ ইঙ্গিত করে পাখিটি বারবার সেই ঘটনার ছায়াকে স্মরণ করছে, আর হয়তো জায়গা নির্দেশ করছে। পুলিশ তখন বাড়ির নিচতলার মেঝে পরীক্ষা করে, এবং খুঁজে পায় একটি আলগা ইটের পরপর কাঠের মেঝের পাটাতন, যা কৌতূহল বাড়ায়। খুলতেই বেরিয়ে আসে একটি ছোটো লোহার সিন্দুক, যা তালাবদ্ধ।

সিন্দুকটি ভাঙা হলে যা বের হলো, তা শুধু তদন্তকে নয়, ইতিহাসকে কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো। একাধিক ভিডিও ক্যাসেট, পুরনো পত্রিকার কাটিংস, এবং একটি ছোট রেকর্ডিং ডিভাইস। ক্যাসেটে রয়েছে স্থানীয় নেতার একটি বক্তৃতা, যিনি সমাজকর্মীর হয়ে লড়তেন, এবং যিনি হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। হরিপদের রেকর্ড করা একটি অডিও-তে তিনি বলছেন, “আমি চুপ করে থেকেছি, কারণ আমি ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু কলু ভয় পায় না… কলুর মুখে সত্য থাকুক।” সায়ন্তনীর বুঝতে আর বাকী রইল না—এই বৃদ্ধ মানুষটি মৃত্যুর বহু আগে থেকেই বুঝেছিলেন, তাঁর অতীত আর বর্তমান একদিন মুখোমুখি হবে। তিনি কলুকে তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত সাক্ষী করে তুলেছিলেন। এখন প্রশ্ন শুধু একটাই—এই সত্য যাকে ধ্বংস করবে, সে কে? বিক্রম? নাকি কেউ আরও অদৃশ্য, যাকে এখনো আমরা চিনে উঠিনি?

***

বিকেলের ছায়া বাড়ির ছাদে লম্বা হয়ে পড়েছে। দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই যেন সময় থেমে আছে—ধুলো জমে থাকা টালির ছাদ, একটি আধভাঙা বাঁশের খাটিয়া, আর ঠিক এক কোণায় পুরনো কাঠের টেবিল আর টিনের বাক্স। মোহিত, যে হরিপদর প্রতিবেশী, সায়ন্তনীকে বলছিল, “আমি দুইদিন আগে রাত একটা নাগাদ ছাদে উঠে সিগারেট খাচ্ছিলাম। তখন দেখলাম হরিপদ কাকা কলুর খাঁচা নিয়ে দাঁড়িয়ে… কারও সঙ্গে খুব আস্তে আস্তে কথা বলছিলেন। আমি দূর থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম না ঠিকঠাক, কিন্তু একসময় তাঁর গলার স্বর একটু উঁচু হয়ে যায়—তিনি বারবার বলছিলেন ‘আমি তোকে চুপ করব না… কলু জানে সব…’” তারপর হঠাৎ সব থেমে গিয়েছিল। মোহিত বলল, “আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল ম্যাডাম… কেমন একটা অদ্ভুত অন্ধকার যেন জমে ছিল ছাদের কোণে।” এই বর্ণনা শুনে সায়ন্তনীর মনে হলো—হরিপদ হয়তো সত্যিই কাউকে ভয় পেতেন, এমন কাউকে, যাকে তিনি চেনেন, যিনি নিরবিচারে বাড়িতে ঢুকতে পারতেন।

সায়ন্তনী ছাদের প্রতিটি কোণ ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। ঠিক খাটিয়ার নিচে চাপা দেওয়া একটি পুরনো প্লাস্টিকের ব্যাগ পাওয়া গেল—তার ভেতরে একটা সাদা রঙের তার ছাড়া CCTV ক্যামেরার মতো কিছু একটা রাখা। ফরেনসিক টিম সেটি খুলে দেখলে জানা গেল, এটি ছিল একটি বেসিক হোম সিকিউরিটি ক্যামেরা, যার মেমোরি কার্ড এখনো অক্ষত। সেই কার্ডটি সঙ্গে সঙ্গে পাঠানো হল বিশ্লেষণের জন্য। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফুটেজ খুলতেই সকলের শ্বাস যেন আটকে গেল। ক্যামেরার টাইমস্ট্যাম্পে দেখা যাচ্ছে—মৃত্যুর আগের রাত, ঠিক ২:৪৫ মিনিটে হরিপদ একা ছাদে হাঁটছেন, হাতে কলুর খাঁচা। তিনি বারবার বলছেন, “তুই বলিস… তোকে কেউ থামাতে পারবে না…” হঠাৎ তার পেছনে ছায়ার মতো কেউ এগিয়ে আসে—মুখ অস্পষ্ট, আলো খুব কম, তবে উচ্চতা ও চলার ভঙ্গি দেখে সায়ন্তনী কেমন যেন চেনা লাগল। সেই ছায়ামূর্তি হরিপদর সামনে এসে দাঁড়ায়, কিছু বলে, আর হরিপদ চিৎকার করে ওঠেন, “তুই পাগল হয়ে গেছিস বিক্রম! এটা তো আর সত্তরের দশক না!” ঠিক তার পর মুহূর্তে ক্যামেরা কাঁপে, দৃশ্য অস্পষ্ট হয়ে যায়, তবে শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, হরিপদ মাটিতে বসে হাঁপাচ্ছেন, আর পাখির খাঁচা তার কোলের পাশে পড়ে আছে। তারপর ক্যামেরা বন্ধ।

সায়ন্তনী চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে ভাবলেন—এই ছায়ামূর্তিটি যদি সত্যিই বিক্রম হয়, তবে তার ভেতরে কেবল লোভ নয়, পুরনো কোনো জেদের আগুনও জ্বলছে। হয়তো তার বাবার সঙ্গে হরিপদের কোনো পুরনো দ্বন্দ্ব ছিল, যা সে মনে পুষে রেখেছে। নয়তো হয়তো সে জানত হরিপদর হাতে কোনো গোপন প্রমাণ আছে, যা তাকে বিপদে ফেলতে পারে। ডঃ বসু কলুর কাছে এসে একটা কাঁচের ছোট বাক্সে রাখা কিছু পুরনো শব্দ শোনালেন—“ছাদ”, “পেছনে”, “চুপ কর”, “তুই বলবি না”—পাখিটি চুপ করে রইল। কিন্তু ডঃ বসু যখন বললেন “বিক্রম”, তখন কলু হঠাৎ ফুঁসে উঠল, ডানাগুলো ঝাঁকিয়ে বলল—“না… না… পেছনে তাকিও না!” সায়ন্তনী বুঝে গেলেন, সত্য একেবারে সামনে। হরিপদ মৃত্যুর আগে তার পোষা পাখিটিকে এমনভাবে প্রস্তুত করেছিলেন যেন সে তার হয়ে সত্য বলে যায়, এমনকি মৃত্যুর পরও। এখন সিন্দুকের প্রমাণ, ডায়েরির স্বীকারোক্তি, ক্যামেরার ছায়া—সবই মিলে যাচ্ছে বিক্রমের দিকে। কিন্তু এত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আইনি ভাষায় তাকে অভিযুক্ত করতে গেলে দরকার আরও স্পষ্ট সত্য—একটা নিশ্চিত যুক্তি। এবং সেই যুক্তিটা হয়তো এখনও লুকিয়ে আছে কলুর মুখে, হয়তো এক বাক্যে, হয়তো আরেকটি অস্পষ্ট সংকেতে।

***

ঘড়ির কাঁটা তখন দুপুর দেড়টা। পাড়ার মানুষের ভিড় কমে এলেও হরিপদ দত্তর বাড়ির ভেতর উত্তেজনার কমতি নেই। সায়ন্তনী সেন এক কোণে বসে পাতা উল্টাচ্ছিলেন হরিপদের সেই হলদে ডায়েরি, কলুর মুখে বলা প্রতিটি বাক্যের মধ্যে গোপন থাকা সম্ভাব্য সংকেতগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলেন। “তিনটে বাজে… ও পেছনে তাকিও না… জমির নিচে… ছায়ার ভিতর…”—এই কথাগুলো যেন কোনো সাংকেতিক ভাষা। ডঃ বসু হালকা গলায় বললেন, “এটা নিছক পাখির রেকর্ড করা সংলাপ নয়। আমার বিশ্বাস, হরিপদ বাবু ইচ্ছাকৃতভাবে পাখিটিকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন যাতে প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য তার নিজের মৃত্যুর পরেও একটি বার্তা বহন করে যায়।” ঠিক তখনই পুলিশের ফরেনসিক ইউনিট এসে জানাল যে সিন্দুক থেকে পাওয়া সেই ছোট রেকর্ডিং যন্ত্রে একটি ক্ষীণ শব্দ রয়েছে—যা সম্ভবত মানুষের কান ধরা পড়ার মতো নয়, তবে অডিও স্পেকট্রামে সেটা বিশ্লেষণ করা গেলে কিছু মেলে। তারা বলল, “ম্যাডাম, আমরা অডিও ফ্রিকোয়েন্সি বাড়িয়ে প্লে করেছি। শুনুন।” সায়ন্তনী হেডফোনে কানে দিয়ে শুনলেন—একজন কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে বলছে, “তোর ছায়া তোকে ছাড়বে না… আমি ফিরে আসব, কলুর ডাকেই… তিনটে বাজে…” সায়ন্তনীর মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল।

এমন সময় হঠাৎ করে কলু খাঁচায় অস্থির হয়ে উঠল। সে তার ঠোঁট দিয়ে খাঁচার লোহার তার কামড়াতে লাগল, ডানার শব্দ বাড়তে লাগল। “তিনটে বাজে… তিনটে বাজে… তিনটে বাজে… ছায়া… ছায়া… দেখিস না… পেছনে তাকাস না!” একঘেয়েমি নয়, বরং একপ্রকার আতঙ্কমিশ্রিত তাড়না যেন তার গলায় ফুটে উঠছিল। ডঃ বসু চমকে উঠলেন। “পাখিটি রেকর্ডেড ভয়েস নয়, বরং বাস্তব কোনো উপস্থিতির প্রতিক্রিয়ায় এভাবে কথা বলছে। সম্ভবত ঘরে এমন কেউ প্রবেশ করেছে, যাকে সে ভয় পায়, যাকে সে চেনে।” তখনই দরজার ধাপে ভেসে উঠল বিক্রমের ছায়া। সে বলল, “এই বাড়িতে এই পাখির জন্য এত বাড়াবাড়ি কেন? একটা পাখি কত কিছু বলতে পারে? কাকু তো পাগল হয়ে গিয়েছিলেন।” সায়ন্তনী শান্ত গলায় বললেন, “ঠিক, পাখি কত কিছু বলতে পারে না—এই প্রশ্নটাই আমরা খুঁজছি।” বিক্রম তাচ্ছিল্য করে চলে গেল, কিন্তু কলুর অস্থিরতা রয়ে গেল। সায়ন্তনী বুঝলেন, এই পাখি কেবল মৃত্যুর সাক্ষী নয়, বরং অপরাধীর উপস্থিতিতে তার প্রতিক্রিয়াও প্রকাশ করে। তাহলে? কলু কি আসলে চিনে ফেলেছে খুনিকে?

সায়ন্তনী সিদ্ধান্ত নিলেন, আর সময় নষ্ট করা যাবে না। তিনি এক ঘর অন্ধকার করে কলুকে রাখা হল টেবিলের ওপর। ঘরে ডাকা হল বিক্রমকে এবং আরও দুইজন সন্দেহভাজনকে—মোহিত ও রেণুকা দেবী। উদ্দেশ্য ছিল একটি পরীক্ষা—পাখির প্রতিক্রিয়া দেখে বোঝা, কে হরিপদের মৃত্যুর সময় ছিল তার কাছাকাছি। ঘরে একে একে ঢোকানো হল তিনজনকে। মোহিতকে দেখেও পাখিটি কিছু বলল না। রেণুকাকে দেখেও চুপ। কিন্তু যখন বিক্রম ঘরে ঢুকল, তখন কলু আচমকা বলে উঠল—“না… না… তিনটে বাজে… ও পেছনে তাকিও না… ছায়া… ছায়া… ছায়া…” তার কণ্ঠ যেন ভেঙে যাচ্ছে আতঙ্কে। সায়ন্তনী চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনার ছায়া পাখিটিকে তাড়া করে বেড়ায়, বিক্রমবাবু। আপনি নিজের কাকুকে হয়তো ঠেলে দিয়েছিলেন মৃত্যুর দিকে। আপনার বিরুদ্ধে সরাসরি সাক্ষ্য নেই, কিন্তু এই পাখিটি আপনার চোখে ভয় দেখে ফেলেছে।” বিক্রম চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, কিছু বলল না। ডঃ বসু বললেন, “এই আচরণ নিছক পাখির নয়, এটা প্রশিক্ষিত অভ্যস্ততা। এই পাখির স্মৃতি হরিপদের ভয়কে বহন করছে, এবং আপনি তার মুখোমুখি হলেই সে সেটা প্রকাশ করে।” বিক্রম তখন চাপা গলায় বলল, “আপনারা কি একটা পাখির কথা শুনে আমাকে দোষী বানাবেন?” সায়ন্তনী শান্তভাবে উত্তর দিলেন, “আমরা শুধু পাখির কথা শুনছি না, আমরা শুনছি হরিপদের রেখে যাওয়া প্রতিটি সংকেত—ডায়েরি, রেকর্ডিং, ক্যামেরার ফুটেজ… সব মিলে কলুর গলায় আজ একটা গল্প দাঁড়িয়েছে। সেই গল্পের নাম: সত্য।”

***

কলুর খাঁচার চারপাশে যেন বাতাস ঘন হয়ে উঠেছে। পাখিটা থেমে গেছে, কিন্তু তার চোখে জমে আছে একরাশ ভয়—যেটা বাচ্চাদের চোখে দেখি আমরা, যখন তারা কিছু দেখে যা বোঝাতে পারে না। সায়ন্তনী চুপ করে পাখিটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি জানতেন, যে অপরাধ চোখে হয়তো ধরা পড়ে না, সেই অপরাধ অনেক সময় প্রতিফলিত হয় আচরণে—আর এই পাখিটির আচরণ যেন সময়ের মুখপাত্র হয়ে উঠেছে। সেদিন রাতে পাখিটিকে খাঁচা থেকে বের করা হল। তাকে একটি প্রশস্ত ঘরে ছেড়ে দেওয়া হলো—মেঝেতে ছড়িয়ে দেওয়া হল কিছু পরিচিত জিনিস: হরিপদের চশমা, তার ছেঁড়া ডায়েরির একটি পৃষ্ঠা, কিছু পুরনো কাপড়, এবং একখানা ফটোগ্রাফ—যেখানে হরিপদ ও বিক্রম একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অবাক করা বিষয়, কলু সবকিছু এড়িয়ে একবার শুধু ফটোটার দিকে তাকাল, তারপর মুখ ফিরিয়ে এক কোণে চলে গেল। সে চোখ বন্ধ করল, আর ধীরে ধীরে বলতে লাগল, “ছায়া… পেছনে তাকিও না… ছায়া তোকে দেখে…” এ যেন কেবল ভয় নয়, কোনো ট্রমার অনুরণন।

ফরেনসিক টিম তখন হরিপদের মৃত্যুর রাত্রির সিসিটিভি ফুটেজ আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করছিল। ধোঁয়াশা সরিয়ে পরিষ্কার করা হলে এক অস্পষ্ট দৃশ্য পাওয়া গেল—ছাদের কোণ থেকে বেরিয়ে আসা সেই ছায়ামূর্তির হাতে ধরা ছিল কিছু একটা, মনে হচ্ছিল একধরনের লোহার রড বা পাইপ। সেই মুহূর্তে হরিপদ বসে পড়েছিলেন, আর পাখির খাঁচা পড়ে গিয়েছিল তার পা থেকে একটু দূরে। এরপরেই ক্যামেরা বন্ধ হয়ে যায়। তদন্তের ভিত্তিতে হরিপদের মাথার পশ্চাৎভাগে পাওয়া গিয়েছিল আঘাতের চিহ্ন—যা আগে ভুলবশত হার্টফেইলিওর ব্যাখ্যায় ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। এই আঘাতই তার মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ। এমন আঘাত নেহাতই দুর্ঘটনাজনিত নয়, বরং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কলুর প্রতিক্রিয়া, হরিপদের ডায়েরি, ক্যামেরার ছায়া—সব একসূত্রে মিলতে লাগল। বিক্রম চুপ করে ছিল, কিন্তু তার চোখে অস্বস্তি জমেছিল আগুনের মতো। সায়ন্তনী সিদ্ধান্ত নিলেন—এবার সময় এসেছে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার।

অফিসে বসে বিক্রমের সামনে রাখা হল হরিপদের হাতে লেখা শেষ পৃষ্ঠা, যেখানে লেখা ছিল:
“বিক্রম আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। সে বলেছে যদি জমি না দিই, তবে আমার ভয়কে সে আমার মৃত্যুর জন্য ব্যবহার করবে। আমি জানি, সে রাতে ছাদে উঠবে। কলু জানবে সব। সে তো পাখি, মানুষ নয়। পাখিরা মিথ্যে বলে না।”
সায়ন্তনী বললেন, “আপনি ছাদে গিয়েছিলেন না?”
বিক্রম কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। কাকু খাঁচা নিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন। আমি শুধু বলতে চেয়েছিলাম, এসব নাটক বন্ধ করুক। আমি গায়ে হাত তুলিনি।”
কিন্তু তখনই কলু পেছন থেকে বলে উঠল—“তুই আসবি… তোর ছায়া তোকে ছাড়বে না… তিনটে বাজে… তিনটে বাজে… ছায়া… ধাক্কা… পড়ে গেল… পড়ে গেল…”
এই প্রথমবার কলু নতুন শব্দ বলল—“ধাক্কা… পড়ে গেল।”
ডঃ বসু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “এটা শিক্ষিত প্রতিক্রিয়া নয়। এটা স্মৃতিভিত্তিক অনুরণন। সে যা দেখেছে, তাই বলছে। পাখিটি শুধু হরিপদের মুখস্থ করানো বাক্য নয় বলছে, সে নিজের চোখে যা দেখেছে, তা আজ প্রকাশ করছে।”
সায়ন্তনী এবার আর দেরি করলেন না।
তিনি বললেন, “আপনার বিরুদ্ধে এখন শুধুই প্রমাণ নয়, আপনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে সময়, স্মৃতি আর সত্য। আপনি তাকে ধাক্কা মেরে ফেলেছিলেন। কারণ সে আপনাকে জমি দিতে রাজি হয়নি। কারণ তার কাছে প্রমাণ ছিল আপনার অতীতের, যেগুলো সে লুকিয়ে রেখেছিল। আপনি ভেবেছিলেন, সে একলা মানুষ… পাখিকে দিয়ে কী হবে? কিন্তু আপনি জানতেন না, সত্য তার গলায় বন্দী হয়ে আছে। সে গলা আজ কাঁপছে, কিন্তু থেমে নেই।”

***

কলুর কণ্ঠে বলা “ধাক্কা… পড়ে গেল” শব্দযুগল যেন এক চূড়ান্ত টুকরো সত্য হয়ে আদালতের এজলাসে গুঁড়িয়ে ফেলল বিক্রম ঘোষের শেষ আত্মরক্ষার দেওয়াল। সায়ন্তনী বুঝলেন, তদন্তের এই মুহূর্তে এসে শব্দ আর অনুভবের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই—পাখিটির কণ্ঠে উচ্চারিত প্রতিটি বাক্য এখন একেকটি জবানবন্দি। পুলিশের পক্ষ থেকে বিক্রমকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রথমে সে চুপচাপ সব অস্বীকার করে, কিন্তু আদালতে পেশ করা হয় হরিপদের লেখা ডায়েরি, সিসিটিভি ফুটেজ, অডিও রেকর্ডার এবং কলুর প্রতিক্রিয়া সংবলিত ভিডিও প্রমাণ। বিচারপতি এই মামলাকে এক “অসাধারণ প্রমাণের ধারাবাহিকতা” বলে মন্তব্য করেন। বিক্রম মুখ খোলেন এক সপ্তাহ পরে—সেই সময়, যখন তার আইনজীবীও বুঝে গিয়েছেন, আর গোপন রাখার কিছু নেই। বিক্রম আদালতে দাঁড়িয়ে বলে, “আমি কাকুকে মারিনি। আমি শুধু ধাক্কা দিয়েছিলাম। ওর হাতটা উঠেছিল… আমার দিকে… আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম। কাকু পড়ে যান। মাথায় আঘাত লাগে। আমি নিচে নেমে আসি। কলু তখন খাঁচার মধ্যে ডাকছিল।” সেই ভয়ংকর স্বীকারোক্তি সেদিন শহরের পত্রপত্রিকায় হেডলাইন হয়ে ছাপা হয়—“এক পাখি বলল সত্যি, খুনি করল স্বীকার!”

এদিকে কলু এখনো বেঁচে, কিন্তু হরিপদর মৃত্যু আর তদন্তের পরে সে যেন আরও চুপচাপ হয়ে গেছে। তার মুখে মাঝে মাঝে শোনা যায় সেই পুরনো বাক্য: “তিনটে বাজে… ছায়া… না তাকাস…” তবে মাঝে মাঝে সে একেবারে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে, ডান পায়ের নখ কামড়াতে কামড়াতে। ডঃ বসু বললেন, “মানুষের মতোই, ট্রমা পাখিদেরও হয়। কলু চোখের সামনে তার একমাত্র অভিভাবককে হারিয়েছে। যে মানুষ তাকে ছোটবেলা থেকে নিজের সন্তান হিসেবেই পালন করত।” সায়ন্তনী সিদ্ধান্ত নেন—কলুকে আর এই বাড়িতে ফেলে রাখা যায় না। সায়ন্তনী নিজেই তার জন্য একটি খাঁচাবিহীন প্রাকৃতিক ঘর বানান—নিজের ফ্ল্যাটের ছাদে, গাছগাছালির মাঝে। সেখানেই এখন কলু বাস করে। মাঝে মাঝে সে ডেকে ওঠে, কিন্তু ধীরে ধীরে তার গলায় নতুন শব্দ এসেছে—“ভালোবাসি… পেছনে আর কিছু নেই… আলো… আলো…” সায়ন্তনী বুঝতে পারেন, পাখির স্মৃতি ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে শান্তিতে।

হরিপদের মৃত্যুর পর তার লেখা ডায়েরি প্রকাশিত হয় এক সংবেদনশীল বই হিসেবে—“স্মৃতির ছায়া” নামে। বইটি শহরের পাঠকমহলে আলোড়ন ফেলে দেয়। সেখানে শুধু একজন বৃদ্ধের স্বীকারোক্তিই নেই, রয়েছে একটি যুগের প্রতিফলন, রাজনীতির হিংস্রতা, আর ব্যক্তিগত অপরাধবোধের করুণ দলিল। পত্রিকায় কলুকে নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়—”শালিখ যে সাক্ষী হয়ে উঠল”, যেখানে বলা হয়, ভবিষ্যতের ফরেনসিক পদ্ধতিতে প্রাণীর আচরণভিত্তিক সাক্ষ্যকেও বিচারে বিবেচনা করার বিষয়টি ভাবা যেতে পারে। সায়ন্তনী, যিনি এই মামলার প্রতিটি স্তরকে ধৈর্য, যুক্তি ও মমতায় ধরে রেখেছেন, তাঁর নাম উঠে আসে সেরা তদন্তকারীদের তালিকায়। তবে নিজের অর্জনের চেয়ে সায়ন্তনীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে একটি ছোট জীবন—কলুর, যে তার ভাষায়, “একটি ভাঙা হৃদয় থেকে উঠে আসা, সত্যের অনুবাদ।”

***

শহরের কোলাহলের মধ্যে একটি ছোট ছাদঘেরা বারান্দা। সায়ন্তনীর নতুন ফ্ল্যাটের ছাদে তৈরি করা হয়েছে এক ছোট্ট মুক্ত পরিবেশ—সবুজ পাতার টবে ঘেরা, পাথরের ছোট ঝর্ণা, আর মাঝখানে একটি গোল কাঠের মঞ্চ—সেখানেই এখন কলুর সংসার। পাখিটির শরীরে বয়সের ভার পড়েনি, কিন্তু চোখে এসেছে একধরনের প্রশান্তি, যেন সে এখন জানে তার দায়িত্ব শেষ হয়েছে। প্রতিদিন সকালে সে উড়ে গিয়ে পাশের তালগাছটায় বসে, কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর হঠাৎ গেয়ে ওঠে—“ভালোবাসি… আলো… পেছনে তাকাস না… সামনে আলো…” এই নতুন বাক্যগুলো তাকে শেখাননি কেউ। এই শব্দগুলো যেন সে নিজেই রচনা করেছে, তার স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, আর আবেগ থেকে। সায়ন্তনী যখন টবের গাছে জল দেন, কলু নিচে নেমে আসে, মাটিতে হেঁটে বেড়ায়, কখনো কাঁধে উঠে বসে। পাখিটির আচরণ দেখে ডঃ বসু বলেছিলেন, “এ শুধু পাখি নয়, এ যেন এক জীবন্ত আত্মা, যে তার বলা শব্দ দিয়ে এক ইতিহাস বয়ে এনেছে।”

সেদিন বিকেলে সায়ন্তনী এক বন্ধুকে বলছিলেন—“তুমি জানো, কলু এখন আর ‘তিনটে বাজে’ বলে না? সে এখন বলে, ‘সময় শেষ… সময় আসে… ভালোবাসা আসে।’” বন্ধুটি অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, “ও এগুলো কোথা থেকে শিখল?” সায়ন্তনী হেসে বললেন, “হয়তো হরিপদর চেতনার কোনও অংশ কলুর মধ্য দিয়ে বেঁচে আছে। হয়তো কিছু প্রাণ, কিছু সম্পর্ক, মৃত্যুতে শেষ হয় না।” সেই কথার সময়ই সায়ন্তনীর হাতে আসে একটি চিঠি—হরিপদের সম্পত্তি বিষয়ক আদালত থেকে। তাতে জানানো হয়েছে, হরিপদ দত্ত মৃত্যুর আগে একটি উইল তৈরি করেছিলেন, যেখানে লেখা আছে:
“আমার মৃত্যুর পরে আমার সব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি আমার পোষা শালিখ কলুর দেখাশোনা ও সুরক্ষার জন্য রাখা হবে। সে যেন কখনও খাঁচায় বন্দি না থাকে।”
এই উইল শুনে সংবাদমাধ্যমে আবার উত্তেজনা। “এক পাখির নামে বাড়ি!”—হেডলাইন হয়। তবে সায়ন্তনী জানতেন, এটা শুধু বাড়ি নয়, এটা ছিল হরিপদের শেষ প্রেমের উত্তরাধিকার। পাখির কাছে নয়, সত্যের কাছে সঁপে দেওয়া উত্তরাধিকার। আর সেই সত্য আজ জীবিত—কলুর গলায়, তার আচরণে, তার নিঃশব্দ ডানায়।

এক সন্ধ্যায় হালকা বৃষ্টির মাঝে কলু ছাদে উড়ে বেড়াচ্ছিল, ডানার ছায়া ছড়িয়ে পড়ছিল চারপাশে। হঠাৎ সে এক নতুন শব্দ গেয়ে উঠল—“তুই ফিরবি… আলোয়… আমি আছি…” সেই কণ্ঠে কেমন যেন এক মানবিক উষ্ণতা ছিল। সায়ন্তনী কেঁপে উঠলেন। তিনি জানেন, এই বাক্য সে শেখেনি কারও কাছ থেকে, এই বাক্য এক আত্মা থেকে আরেক প্রাণে গেয়ে ওঠা উত্তরস্বর। পেছনে তাকিয়ে নয়, সামনে তাকিয়ে এগোনোর আহ্বান। কলু আজ আর সাক্ষী নয়, সে এক গল্পের শেষ অধ্যায়। তার গলায় আজ কোনো আতঙ্ক নেই, আছে আত্মার শান্তি। হরিপদের আত্মা হয়তো কোনোদিন মুক্তি পেয়েছে, অথবা আজও কলুর গানেই বেঁচে আছে। আর সায়ন্তনী জানেন, যতদিন কলুর কণ্ঠ থাকবে, ততদিন সত্য বেঁচে থাকবে—নীরবতা ভেদ করে, ছায়ার ভিতর দিয়ে, আলোর দিকে।

——-

1000040975.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *