সোহম কর্মকার
১
কলকাতার রাত যেন এক বিশেষ ছন্দে দুলে চলেছিল। দিনের সমস্ত কোলাহল স্তব্ধ হয়ে গেছে, ভিড়ভাট্টা, যানজট, হর্নের শব্দ আর লোকজনের ব্যস্ততা যেন শহরের কোথাও নেই। শুধু নিস্তব্ধতা, মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসছে পথের কুকুরের ঘেউ ঘেউ অথবা রাত জাগা ট্যাক্সির হর্ন। হাওয়ায় কুয়াশার মতো একটা ঠাণ্ডা স্যাঁতসেঁতে ভাব, যেন হাওড়া ব্রিজের নীচে গঙ্গার বুক থেকে উঠে আসছে ধোঁয়া। রাত তখন বারোটা। এই সময় খুব কম সংখ্যক ট্রাম চলে, তবু পুরনো নিয়মে হরিদাস মল্লিক তার পুরনো সবুজ রঙের ট্রাম নিয়ে বেরিয়েছে। বয়স পঞ্চান্ন ছুঁইছুঁই হলেও হাতে এখনও শক্তি আছে, চোখে আলোও আছে, তবে মনটা মাঝে মাঝে কেমন শূন্য হয়ে যায়। রাতের শিফট সে বরাবরই পছন্দ করত না, অথচ এত বছরের চাকরিতে আজও ‘না’ বলতে শেখেনি। ট্রামের লোহার চাকা রেল লাইনের সঙ্গে ধাতব সুরে টুংটাং বাজাচ্ছিল, সেই সুরে যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধ সঙ্গীত তৈরি হচ্ছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার, এতদূর পর্যন্ত একটা যাত্রীও ওঠেনি। এমন ঘটনা খুবই বিরল, এমনকি রাতের শেষ ট্রামেও সাধারণত কিছু লোক থাকে—ক্লান্ত শ্রমিক, রাতের ডিউটি শেষে ফেরা অফিসার কিংবা ভবঘুরে। কিন্তু আজ শহরটা যেন আলাদা, যেন ইচ্ছাকৃতভাবে ফাঁকা হয়ে গেছে।
হরিদাস মাঝে মাঝে পিছনে তাকাচ্ছিল। ফাঁকা ট্রামের প্রতিটি সিটে অন্ধকার ঘনিয়ে আছে। কেবল বৈদ্যুতিক বাতির হলদেটে আলো এক একটা আসনের উপর পড়ছে, যেন সেই আলো অদৃশ্য ছায়াকে দৃশ্যমান করতে চাইছে। সে ঠোঁট চেপে নিঃশব্দে ট্রাম চালিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো—কেউ কি যেন তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে? কিন্তু যতবারই মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, দেখল কিছু নেই, কেবল খালি সিট আর জানালার বাইরে দ্রুত সরে যাওয়া রাতের রাস্তা। লালবাজার পার হয়ে ট্রাম যখন পুরনো লাইনে ঢুকল, হাওয়াটা আরও ঠাণ্ডা হয়ে উঠল। কোথাও কোথাও রাস্তায় আলো জ্বলছে না, শুধু অন্ধকারে ভেসে উঠছে গাছের ছায়া, যেন লম্বা হাত বাড়িয়ে রেখেছে ট্রামের দিকে। হরিদাস অস্বস্তি চাপা দিতে সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করল, কিন্তু হাওয়া এতটা কড়া যে আগুনটাই জ্বলল না। বুকের ভেতরটা যেন বোবা এক আতঙ্কে ভরে উঠল। মনে হচ্ছিল—কিছু একটা ঘটবেই।
ঠিক তখনই ট্রাম হাওড়া ব্রিজ থেকে খানিক দূরের একটি ফাঁকা স্টপেজে এসে থামল। আশ্চর্যজনকভাবে সেখানে একটি ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে ছিল। প্রথমে হরিদাস ভেবেছিল কোনও মাতাল নাকি রাত জাগা ভবঘুরে। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন ছায়াটি কাছে এগিয়ে এলো, তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। বৃদ্ধ একজন মানুষ—মুখ কুঁচকে যাওয়া, চোখে ফাঁপা দৃষ্টি, গায়ে মলিন ধুতি-পাঞ্জাবি, মাথায় কেবল টাকের আভা। তার হাতে কোনও ব্যাগ নেই, মুখে কোনও হাসি নেই, চোখে কেবল এক ধরনের হাহাকার। ধীরে ধীরে ট্রামের সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় কানে এলো কাঠের পাটাতনের ভাঙা শব্দ। হরিদাসের গলা শুকিয়ে গেল। রাতের এই অচেনা যাত্রীকে সে কীভাবে স্বাগত জানাবে, বুঝতে পারল না। বৃদ্ধ একেবারে স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল, তারপর সোজা গিয়ে এক কোণে বসে পড়ল। আশ্চর্যের বিষয়, কোনও টিকিটের কথা বলল না, কোনও প্রশ্ন করল না। শুধু বসে রইল অন্ধকারে, জানালার বাইরে নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে।
ট্রাম আবার চলতে শুরু করল, ধাতব চাকার শব্দ আরও জোরালো হলো। এই নিস্তব্ধতার মধ্যে বৃদ্ধ হঠাৎ গলা নামিয়ে বলল—“আমি শেষ স্টপেজে নামব।” কথাটা খুবই সাধারণ শোনালেও, হরিদাসের শরীরের রক্ত যেন হিম হয়ে গেল। কণ্ঠস্বরটা শীতল, অনুভূতিহীন, যেন মানুষের কণ্ঠ নয়—বরফের ফালি দিয়ে কেটে নেওয়া শব্দ। হরিদাস কিছু বলল না, শুধু স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরে রাখল। চারপাশে শহরের আলো ঝাপসা হয়ে যেতে লাগল, ট্রামের কাচে কুয়াশা জমতে লাগল। মনে হচ্ছিল ট্রামটি কেবল রাস্তার উপর নয়, সময়ের সীমানার মধ্য দিয়ে চলেছে। সেই যাত্রার শুরু হয়েছে, কিন্তু শেষ কোথায়—তা কেউ জানে না। হরিদাস বুঝতে পারল, আজকের রাত আর পাঁচটা রাতের মতো হবে না। এই যাত্রী সাধারণ যাত্রী নয়, সে কোনও অচেনা পথিক, যে গন্তব্যের দাবি করছে মৃত্যুর ওপারে—“শেষ স্টপেজ।”
২
ট্রামের কোলাহল, ঘণ্টার আওয়াজ, চাকার ঘর্ষণে শহরের গাঢ় ব্যস্ততা যেন এক অচেনা ছন্দে বয়ে যাচ্ছিল। পরেশ পাল প্রতিদিনের মতো টিকিট কেটে যাত্রীদের দিচ্ছিল—তার কাজের অভ্যাস, মুখস্থ হয়ে যাওয়া নিয়মকানুন আর প্রতিদিনকার মুখচেনা ভিড়ের মধ্যেই দিন কেটে যায়। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যাবেলায় ট্রামটি কলেজ স্ট্রিট থেকে যাত্রা শুরু করার পর এক বৃদ্ধ যাত্রী উঠে এলেন। সাদা ধবধবে ধুতি-পাঞ্জাবি, কাঁধে ফতুয়া, আর মুখে এমন এক গভীর গাম্ভীর্য যা চারপাশের লোকজনকে অদ্ভুতভাবে স্তব্ধ করে দিল। বৃদ্ধ চুপচাপ জানালার পাশে বসে রইলেন, যেন অন্য কোনও জগতের মানুষ। পরেশ এগিয়ে গিয়ে টিকিট কাটতে বলল। বৃদ্ধ কোনও কথা না বলে সামান্য হাত বাড়ালেন। পরেশ যখন তাঁর হাতে টিকিট দিল, সেই মুহূর্তে এক অস্বাভাবিক শীতলতা তার শরীর জুড়ে বয়ে গেল। কপালের ঘাম শুকিয়ে গেল, হাত অবশ হয়ে এল, আর বুকের ভেতর চাপা এক অদ্ভুত আতঙ্ক ঘনীভূত হল। পরেশ খানিক থমকে গেলেও মুখে কিছু প্রকাশ করল না, যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসির আড়ালে তার অস্বস্তি ঢাকার চেষ্টা করল। কিন্তু বৃদ্ধ কোনো কথা বললেন না, কোনো হাসি ফুটল না তাঁর ঠোঁটে—শুধু অনন্ত স্থিরতায় জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলেন, যেন সেখানে তিনি এমন কিছু দেখছেন যা আর কারও চোখে ধরা পড়ে না।
পরেশের মনে হতে লাগল, এই বৃদ্ধ যেন ট্রামের স্বাভাবিক ছন্দের সাথে মানিয়ে নিতে পারছেন না। অন্য যাত্রীরা ভিড় জমাচ্ছে, কেউ খবরের কাগজ পড়ছে, কেউ হেসে হেসে কথা বলছে, আবার কেউ ক্লান্ত হয়ে চোখ বুজে আছে। অথচ বৃদ্ধের উপস্থিতি যেন সব কিছুর বাইরে। তাঁর চোখ দুটি জানালার বাইরে, অথচ তাতে যেন নেই এই শহরের রাস্তাঘাট বা মানুষের ভিড়—বরং গভীর শূন্যতায় ডুবে থাকা এক দৃষ্টি। পরেশ খেয়াল করল, বৃদ্ধের হাতে কোনও ঝোলা নেই, পকেট থেকে কোনও মুদ্রার শব্দও শোনা গেল না। টিকিট নেওয়ার সময় তিনি যে সামান্য হাত বাড়িয়েছিলেন, তাতেই এক অস্বাভাবিক হিমশীতল স্পর্শ, যেন তিনি রক্তমাংসের কেউ নন। পরেশ মনে মনে কাঁপতে লাগল, কিন্তু কর্তব্যবোধে নিজেকে সামলে আবার অন্য যাত্রীদের দিকে মন দিল। তবুও তার চোখ বারবার সেই বৃদ্ধের দিকে চলে যাচ্ছিল। আশ্চর্য ব্যাপার, অন্য যাত্রীরা যেন তাঁর উপস্থিতি নিয়ে কোনো কথাই বলছে না, যেন তাঁকে দেখা তাদের নজর এড়িয়ে গেছে। শুধু পরেশই যেন এক অজানা বন্ধনে বাঁধা পড়েছে, টিকিট দেওয়ার সেই স্পর্শের মুহূর্ত থেকে।
ট্রাম এগোতে লাগল ধীরে ধীরে বৌবাজার থেকে শ্যামবাজারের দিকে। রাস্তার দু’পাশে গ্যাসলাইটের ম্লান আলো, দোকানের ব্যস্ততা, মানুষের ছুটোছুটি—সবকিছুই যেমন প্রতিদিনকার মতো, তেমনই আবার অস্বাভাবিক ঠেকছিল। পরেশের কানে বৃদ্ধের নিঃশ্বাসও যেন আসছিল না, তিনি একেবারে স্থির হয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে রয়েছেন। পরেশ হঠাৎ টের পেল, ট্রামের ভিতরকার উষ্ণ গরম ভিড়ের মাঝেও তাঁর চারপাশে একটা অদ্ভুত শীতল আবহ তৈরি হয়েছে। সামনের যাত্রী হঠাৎ কাশল, পিছনের কেউ হাসল—কিন্তু বৃদ্ধ একবারও মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন না। তাঁর স্থির দৃষ্টি যেন অজানার ভিতর দিয়ে পথ খুঁজছে। পরেশের মনে পড়ল শোনা কিছু গল্প—ট্রামের এই দিকের লাইনে নাকি একসময় এক দুর্ঘটনায় বৃদ্ধ ভদ্রলোক মারা গিয়েছিলেন, যিনি প্রতিদিন একই সময়ে ট্রামে উঠতেন। গুজব ছিল, তিনি নাকি মাঝে মাঝে রাতের ট্রামে দেখা দেন, কারও চোখে পড়েন, কারও নয়। পরেশ কপাল চাপড়াল, ভেবে নিল এটা নিছক কাকতালীয়। কিন্তু বুকের ভেতরটা চাপা অস্বস্তিতে কেঁপে উঠছিল, যেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সত্যি-মিথ্যের সীমারেখা মুছে যাচ্ছে।
ট্রাম যখন বেলগাছিয়ার দিকে মোড় নিল, তখন যাত্রীরা একে একে নামতে শুরু করল। ভিড় কমে এলে বৃদ্ধকে আরও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। তাঁর চোখদুটো অস্বাভাবিক স্থির, ঠোঁটের কোণে কোনও নড়াচড়া নেই। পরেশ খেয়াল করল, ভাড়া দেওয়ার জন্য তিনি পকেটে হাত দেননি, অথচ তাঁর সিটে ছোট্ট একটি ছেঁড়া টিকিট পড়ে আছে—যেন বহু বছর আগেকার কাটা টিকিট, মলিন আর ধুলো জমা। পরেশ শিউরে উঠল। সে চেয়ে রইল বৃদ্ধের দিকে, কিন্তু বৃদ্ধের দৃষ্টি তখনও জানালার বাইরে, অচঞ্চল। ঠিক সেই সময় হাওয়ার এক ঝাপটা এসে ট্রামের ভেতর ঢুকে পড়ল, আর টিকিটটা উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ল। পরেশের কানে যেন ভেসে এল দূর থেকে ট্রামের ঘণ্টাধ্বনি, অথচ সেটি তাদের ট্রাম নয়—কোনও এক অতীতের প্রতিধ্বনি, মৃত এক যাত্রার স্মৃতি। আর বৃদ্ধ ঠিক তখনই মাথা ঘুরিয়ে একবার তাকালেন পরেশের দিকে। সেই দৃষ্টিতে এত গভীর শূন্যতা, এত অমানবিক হিমশীতলতা যে পরেশের বুক কেঁপে উঠল—মনে হল সে যেন একদম ভিতর থেকে জমে যাচ্ছে। কিন্তু মুহূর্তেই ট্রাম থেমে গেল পরের স্টপেজে, যাত্রীরা নেমে গেল, আর পরেশ যখন আবার খেয়াল করল, বৃদ্ধ কোথাও নেই। তাঁর আসন শূন্য, জানালার বাইরে কেবল অন্ধকার রাস্তা আর দূরের আলো—যেন বৃদ্ধ কখনোই ছিলেন না, বা হয়তো এখনও আছেন, অন্য কোনও অদৃশ্য যাত্রাপথে।
৩
ট্রামের ভেতর সেদিন রাতের যাত্রা ছিল যেন এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। কলকাতার পুরোনো ট্রাম লাইন ধরে ধীর গতিতে এগোচ্ছিল হরিদাসের ট্রাম, অথচ তার অন্তরে যেন এক অদ্ভুত ভার নেমে এসেছিল। প্রথমে সে ভেবেছিল দিনের ক্লান্তি হয়তো মাথায় চাপ ফেলছে, কিন্তু হঠাৎই চারপাশে কিছু অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ল। কন্ডাক্টর লক্ষ করল জানালার কাঁচে প্রতিফলিত হচ্ছে কিছু অচেনা মুখ, অথচ ভেতরে তেমন কোনো যাত্রী বসে নেই। প্রতিফলনে ভেসে উঠছে ম্লান আলোয় আবছা চোখ, পুরোনো ধুতি-পাঞ্জাবি পরা পুরুষ, শাড়ি গলায় টেনে ধরা বাঙালি বধূ কিংবা হাতে বই ধরা এক যুবক—সবাই যেন অতীতের কোনো এককালের বাসিন্দা। কাঁচের ভেতরে নেই, কিন্তু প্রতিফলনে তারা স্পষ্ট, ভুতুড়ে নীরবতায়। এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে কন্ডাক্টরের শিরদাঁড়ায় কাঁপন বয়ে গেল। সে মুহূর্তে ট্রামের ভেতর হরিদাসও অনুভব করল অদ্ভুত এক ভারী উপস্থিতি, যেন শূন্য আসনগুলো আসলে খালি নয়, অদৃশ্য কেউ বসে আছে সেখানে। বাতাসে ঘন হয়ে উঠল পুরোনো কলকাতার গন্ধ—কলেরার দিনগুলোর দুর্গন্ধ, মিলের ধোঁয়ার গন্ধ, আর কোথাও কোথাও ফুলের বকুল সুবাস।
হরিদাস চেষ্টা করল স্বাভাবিক থাকার, কিন্তু তার চোখ বারবার চলে যাচ্ছিল জানালার দিকে। প্রতিফলিত মুখগুলো ধীরে ধীরে যেন জীবন্ত হয়ে উঠছিল। একজন বৃদ্ধের মুখে ক্লান্তি, কিন্তু চোখে অদ্ভুত এক তীব্রতা; এক তরুণীর ঠোঁটে চাপা কান্না, যেন হারানো প্রিয়জনকে খুঁজছে; এক ছেলেমানুষি চেহারা তাকিয়ে আছে ফাঁকা রাস্তায়, হয়তো স্কুল ফাঁকি দিয়ে কোথাও দৌড়ে বেড়ানো অভ্যাস ছিল তার। ট্রামের ভেতর নিস্তব্ধতা জমে উঠল, যেন কলকাতার গত একশো বছরের স্মৃতি এই ছোট্ট কামরায় এসে বন্দি হয়ে গেছে। কন্ডাক্টর হাঁপাতে হাঁপাতে হরিদাসকে জিজ্ঞেস করল, “বাবু, এরা কারা? কই, কেউ তো ওঠেনি। আমি টিকিট কেটে দিইনি।” হরিদাস কোনো উত্তর দিতে পারল না, শুধু মাথা নেড়ে জানাল, “আমিও টের পাচ্ছি।” তার মনে হচ্ছিল, এই সব অদৃশ্য ছায়ারা হয়তো এককালে নিয়মিত এই ট্রামে যাতায়াত করত। সময় তাদের মুছে দিয়েছে, কিন্তু ট্রামের চাকার শব্দ, ঘণ্টার টুনটুন ধ্বনি আর লোহার দণ্ডে ধাক্কার অনুরণন হয়তো তাদের স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলছে।
কন্ডাক্টর তখন ভয়ে ভেতরে ভেতরে কাঁপছিল। সে বারবার পিছন ফিরে দেখছিল, যদি হঠাৎ কেউ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ট্রামের আলো হঠাৎ একবার ঝিকমিক করে উঠল, আর তক্ষুণি প্রতিফলিত মুখগুলো যেন একসঙ্গে নিঃশ্বাস ফেলল। চারপাশে হালকা কুয়াশার মতো একটা আস্তর ছড়িয়ে পড়ল। বাইরে রাস্তা তখন প্রায় জনশূন্য, পুরোনো কলকাতার গলির ল্যাম্পপোস্টগুলো আধো আলো ছড়িয়ে দিচ্ছিল, আর তাতে মনে হচ্ছিল প্রতিটি মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে অদৃশ্য এক পাহারাদার। হরিদাস চুপচাপ স্টিয়ারিং ধরেছিল, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, কেউ পেছন থেকে তার কাঁধে হাত রাখল। সে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল—কেউ নেই। আবারো বুকের ভেতর দমবন্ধ হওয়া শূন্যতা ছড়িয়ে পড়ল। অদৃশ্য যাত্রীদের ভার যেন আস্তে আস্তে তার শরীরকেও চাপা দিতে শুরু করেছে। সে বুঝল, এই ট্রাম আজ শুধু বর্তমানের নয়, অতীতের যাত্রীদেরও বহন করছে। কন্ডাক্টরের হাত থেকে টিকিটের কাঁচি একবার পড়ে গেল মেঝেতে, টুং করে আওয়াজ হতেই হঠাৎ ট্রামের জানালা দিয়ে ভেসে এলো এক চাপা গান—“যদি তারে নাই চিনো সে কি…”—রবীন্দ্রসঙ্গীতের কণ্ঠ, কিন্তু কণ্ঠস্বর ছিল ক্ষীণ, দূর থেকে ভেসে আসা, যেন অনেককাল আগে মারা যাওয়া কারো স্মৃতি থেকে ফেটে বেরোচ্ছে।
হরিদাস আর কন্ডাক্টর দু’জনেই নির্বাক হয়ে গেল। তাদের চোখে জল ভরে উঠল অজান্তে, যেন তারা প্রত্যক্ষ করছে একসঙ্গে বহু যুগের গল্প। মুখগুলো একে একে ঝাপসা হতে শুরু করল, কিন্তু ট্রামের ভেতর সেই ভার আর অদৃশ্য উপস্থিতি থেকে গেল। মনে হচ্ছিল ট্রামের প্রতিটি চাকা ঘূর্ণনের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের এক একটি অধ্যায় ঘুরে যাচ্ছে তাদের সামনে দিয়ে। কোথাও কলকাতার স্বাধীনতা সংগ্রামের আবহ, কোথাও দাঙ্গার আতঙ্ক, কোথাও আবার প্রেম আর বিচ্ছেদের অশ্রুভেজা স্মৃতি। ট্রাম যেন এক চলমান টাইম-মেশিন, আর তারা তারই চালক আর সাক্ষী। হরিদাস তখনও স্টিয়ারিং আঁকড়ে ধরে, কিন্তু তার ভেতরে ভেতরে এক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—কেন এই অতীতের ছায়ারা আজ ফিরে এলো? তাদের কী অসমাপ্ত থেকে গেছে? আর এই ট্রাম কি শুধু মানুষ নয়, স্মৃতিরও বাহন? উত্তরহীন এই প্রশ্নগুলো গুমরে উঠছিল, আর রাতের কলকাতা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল এই রহস্যের সাক্ষী হয়ে।
৪
পরেশ তার ঝোলায় টিকিটের খুচরো মুদ্রা আর পাঞ্চমেশিন ঠিকঠাক করে রাখছিল, এমন সময় হরিদাসকে বলল—“শুনেছ? এই লাইনেই একবার বড় দুর্ঘটনা হয়েছিল।” কথাটা যেন নিছক গল্প নয়, বরং পুরোনো ক্ষত ছিঁড়ে ফেলার মতো ভঙ্গিতে বেরোল। হরিদাস বিস্ময়ে তাকাল—“দুর্ঘটনা?” পরেশ মাথা নেড়ে চুপ করে গেল, যেন আর কিছু বলতে চায় না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ট্রামের দুলুনির মধ্যে কণ্ঠটা গাঢ় হয়ে উঠল—“অনেক বছর আগে, প্রায় পঁচিশ কি তিরিশ বছর হবে, এই একই লাইনে একটা ট্রামে ভয়াবহ আগুন লেগে গিয়েছিল। রাতের ট্রাম, শিয়ালদহ থেকে ধর্মতলা যাচ্ছিল, ঠিক এই লাইন ধরে। হঠাৎ শর্ট সার্কিট থেকে আগুন ধরে যায়, কেবিনে ছড়িয়ে পড়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। তখনকার দিনে ট্রামে এমন সুরক্ষার ব্যবস্থা ছিল না, আর ভেতরে জানালাগুলো লোহার গ্রিলে আটকানো থাকত, যাতে যাত্রীরা হুট করে লাফ দিতে না পারে। আগুনের হল্কা আর ধোঁয়া ভরে উঠতে থাকে ভেতরে, আর যাত্রীরা প্রাণের ভয়ে চিৎকার করতে করতে গ্রিল ঝাঁকাতে থাকে। পরেশ যেন দাঁতের ফাঁক দিয়ে শিস দিল—“বেঁচে ফেরেনি অনেকেই, গোটা পঁচিশেক যাত্রী অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায় সেদিন।” হরিদাসের কানে যেন শব্দটা বীভৎস চিৎকারের মতো প্রতিধ্বনিত হলো। সে অজান্তেই গলা শুকিয়ে জল খেল, কিন্তু ট্রামের ভেতর যেন সেই অতীতের দগ্ধ গন্ধটুকু ভেসে বেড়াচ্ছে।
হঠাৎ পাঠকের সামনে সেই ফ্ল্যাশব্যাক খুলে গেল, যেন ক্যামেরার লেন্সের মতো অতীতে ফেরা। রাত তখন গভীর হয়নি, কিন্তু শহরের রাস্তায় ভিড় কমতে শুরু করেছে। একটি পুরোনো ট্রাম ধীরে ধীরে এগোচ্ছে ধর্মতলার দিকে। যাত্রীরা কেউ ডুবে আছে গল্পে, কেউবা চুপচাপ জানালার বাইরে তাকিয়ে। ট্রামের ভেতরের আলো টিমটিম করছে, সেদিনও হঠাৎ আলো নিভে গিয়েছিল মুহূর্তের জন্য। আবার জ্বলে উঠল, কিন্তু সেই আলো যেন অশুভ ইঙ্গিত নিয়ে এসেছিল। একসময় সামনে থেকে ঝাঁকুনি দিয়ে শব্দ উঠল—চকচকে তারের ঘর্ষণ, আর তার সঙ্গে এক প্রচণ্ড ঝলকানি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ধোঁয়া আর আগুন ছড়িয়ে পড়ল কাঠের পাটাতনের মধ্যে। যাত্রীরা প্রথমে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি, তারা ভেবেছিল হয়তো ছোটখাটো শর্ট সার্কিট। কিন্তু ধোঁয়া যখন গলা জ্বালাতে শুরু করল, আর অগ্নিশিখা ছুটে এল জানালার কাছে, তখন শুরু হলো উন্মত্ততা। দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, চালক ও কন্ডাক্টর প্রাণপণে খুলতে চাইছিল, কিন্তু মেকানিজম জ্যাম হয়ে গিয়েছিল। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন পথচারী ছুটে আসে, কিন্তু লোহার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়ালেও যাত্রীদের বের করা যায়নি। চিৎকার, ধোঁয়া আর আগুন—শহরের রাত যেন এক দুঃস্বপ্নে ডুবে গেল।
যাত্রীদের মধ্যে ছিল এক বৃদ্ধ মানুষ—চেহারাটা কেমন যেন শান্ত, কিন্তু চোখে আতঙ্ক স্পষ্ট। তিনি প্রথমে সিটে বসেই ধোঁয়ার কারণে কাশছিলেন, তারপর হঠাৎ উঠে জানালার গ্রিল ধরে ঝাঁকাতে শুরু করেন। পাশে বসা এক তরুণী মেয়েকে তিনি বোঝাচ্ছিলেন, “বেরোতে হবে, দম বন্ধ হয়ে যাবে।” মেয়েটি কান্নায় ভেঙে পড়েছিল, কণ্ঠরোধ হয়ে যাচ্ছিল তার। বৃদ্ধ যেন নিজের শরীরকে ঢাল করে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু আগুন এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল যে কয়েক সেকেন্ডেই তাঁর কাঁধে আগুন লেগে গেল। লোকজন হাহাকার করছিল, বাইরে থেকে কেউ দমকল ডাকছিল, কিন্তু রাতের সে সময়ে আসতে দেরি হচ্ছিল। তখন ট্রামের ভেতরে ছিল এক অবর্ণনীয় দৃশ্য—মানুষ একে অপরের উপর চেপে ধরছে, কেউ গ্রিল ভাঙার চেষ্টা করছে, কেউবা দরজায় ধাক্কা মারছে। আর সেই বৃদ্ধ, যার মুখটা এখনও অনেকের স্মৃতিতে গেঁথে আছে, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টায় ছিলেন পাশের মেয়েটিকে ঠেলে বাইরে বের করে দিতে। কিন্তু পারেননি। মিনিট দশেকের মধ্যে ট্রামের অর্ধেক ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছিল। দগ্ধ শরীরগুলো উদ্ধার করা হয়েছিল অনেক পরে, আর শহরের খবরের কাগজগুলোয় সেদিন শিরোনাম হয়েছিল—“শহরের বুকে অগ্নি-ট্র্যাজেডি।”
পরেশের কণ্ঠস্বর যেন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এল, কিন্তু হরিদাসের কানে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল সেই ভয়াবহ দৃশ্য। তার চোখে যেন স্পষ্ট হয়ে উঠল দগ্ধ মুখগুলো, বিশেষত সেই বৃদ্ধ, যে অন্যকে বাঁচাতে গিয়েই নিজে আটকা পড়ে গিয়েছিল। হরিদাসের শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেল, কারণ সে হঠাৎ টের পেল—যে বৃদ্ধকে সে এতক্ষণ ট্রামে বসে থাকতে দেখছিল, তাকিয়ে থাকতে দেখছিল জানালার বাইরে, তার মুখে ঠিক সেই একই ছাপ—ধোঁয়ায় বিবর্ণ, চোখে আতঙ্ক আর অনন্ত শূন্যতা। “মানে… সে-ই কি সেই মানুষ?” প্রশ্নটা তার মনের মধ্যে আছড়ে পড়ল। হরিদাস ভয় পেয়ে জানালার বাইরে তাকাল, কিন্তু মুহূর্তেই বৃদ্ধ কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। ট্রাম এগোতে থাকে ধর্মতলার দিকে, কিন্তু হরিদাসের মনে হয় যেন ট্রামটা শুধু লোহা আর কাঠের নয়, বরং অগণিত হাহাকার আর অগ্নিদগ্ধ চিৎকারে তৈরি। অতীতের সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা যেন এখনও প্রতিটি যাত্রার সঙ্গে ছায়ার মতো পিছু নেয়, আর হয়তো সেই বৃদ্ধ আত্মা এখনও জানালার পাশে বসে রয়েছে—কাউকে না কাউকে তার গল্প শোনানোর জন্য।
৫