ঈশান বসু
বেলপাহাড়ি গ্রামটা দিনের আলোয় যেমন নিস্তরঙ্গ, রাতের অন্ধকারে ততটাই অজানা। সন্ধ্যে নামতেই চারপাশের কুঁড়ে ঘরগুলোতে আলো জ্বলে উঠলেও, গ্রামের এক প্রান্তে একটা জায়গা থেকে সব আলো যেন ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়—সেই জায়গাটার নাম কানা মসজিদ। মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায় তার নাম, তবে কেউ স্পষ্ট করে বলে না এর ইতিহাস। শুধু এটুকু বলে, মসজিদের পাশের পুরনো কবরস্থানে গেলে ফিরে আসা যায় না। আর যদি ফিরেও আসো, তুমি আর আগের মানুষ থাকো না।
সেই জায়গায় রাত কাটাতে এল সোহম মিত্র। শহরের ছেলে, ইউটিউবার, ভয়হীন এক যুবক যে বিশ্বাস করে, ভূত বলে কিছু নেই—যতসব মনস্তাত্ত্বিক ছায়া। “DarkLens” নামের তার ইউটিউব চ্যানেলে সে নিয়মিত প্যারানরমাল ভিজিট করে, ভৌতিক গল্প বলে, এবং ‘রিয়েল হরর’ অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেয়। এবার সে এসেছে এখানে, কানা মসজিদে, ক্যামেরা, ট্রাইপড, ইনফ্রারেড রেকর্ডার আর অজস্র কৌতূহল নিয়ে। বিকেলে সে গ্রামে এসে একটা পুরনো লজে ব্যাগ রেখে হাঁটা দিল মসজিদের দিকে। গ্রামের লোকজন সতর্ক করেছিল, “ওখানে সন্ধ্যের পর কুকুরও যায় না মশাই, আপনি মানুষ!” সোহম হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল, “আমি ভূত দেখতে এসেছি, ভয় পেতে নয়।”
রাস্তা ফুরিয়ে এলেই শুরু হয় সেই জায়গা। গায়ে হাওয়া লাগতেই ঠান্ডা শিরশিরে অনুভূতি, যেন কেউ তার ঘাড়ের কাছ দিয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। চারপাশে কুয়াশা জমেছে, অথচ সেটা আসেনি—কুয়াশা যেন ওখানেই ছিল, শুধু দেখা যাচ্ছিল না। মসজিদটা মাঝারি আকৃতির, ভাঙাচোরা দেয়াল, সাদা রঙ প্রায় মুছে গেছে। উপরে একটিই গম্বুজ, মাঝখানে বিশাল এক ফাটল, ঠিক যেন কেউ চাঁদকে কেটে দিয়েছে। পাশে ছোটো ছোটো কবর, কারও নাম আছে, কারও নেই। কিছু পাথর এমনভাবে কাত হয়ে আছে যেন নিজেই উঠে দাঁড়াতে চাইছে।
সোহম ক্যামেরা সেট করল, গলায় গোপন মাইক্রোফোন পরল, টর্চ অন করল, এবং রেকর্ডিং শুরু করল। তার কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস, “বন্ধুরা, আজ আমি এসেছি বেলপাহাড়ির কুখ্যাত কানা মসজিদের কাছে, এই কবরস্থানে যেখানে রাত নামলেই জেগে ওঠে ইতিহাসের ভুলে যাওয়া ছায়ারা। আজ আমরা জানব, ভয় আসলেই বাইরে, না কি ভেতরে।”
মাটির ঘাসে হেঁটে কবরের মাঝে ঢুকে পড়ল সে। পায়ের নিচে মাটি নরম, যেন হালকা করে কেউ খুঁড়েছে। একটা পুরনো কবরের সামনে দাঁড়াল সে, খোদাই মুছে গেলেও একটা নাম স্পষ্ট—‘রফিক’। তার মনে পড়ল, গুগলে এই নামটাই জুড়ে ছিল কানা মসজিদের সাথে। কেউ কেউ বলেছে, ইমাম রফিকুল হক নাকি ১৯৪৭ সালের দাঙ্গায় এখানে প্রার্থনার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। কেউ বলে, সে তখনো নামাজে রত ছিল, এবং মৃত্যুর পরও নামাজ থামেনি। বহু বছর পরে লোকেরা শুনেছে, রাতের বেলায় মসজিদের ভেতর থেকে আজান ভেসে আসে—কিন্তু মসজিদ বন্ধ, কোনো মুয়াজ্জিন নেই।
ঠিক তখনই পাথরের পাশ থেকে ঠকঠক আওয়াজ। সোহম চমকে ঘুরে তাকাল। মসজিদের দরজা বন্ধ, তালা ঝুলছে। তবু ভেতর থেকে যেন কেউ হাঁটছে, তার পায়ের লাঠি ঠুকছে পাথরে। সে কাছে গিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে দেখল—ভেতরটা অন্ধকার, কিন্তু ছায়ার মতো একটা অবয়ব সরে যাচ্ছে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে।
তাকে কাঁপিয়ে দিল না, বরং কৌতূহল বাড়াল। ক্যামেরা তুলল, কিছু বোঝার আগেই স্ক্রিন ব্ল্যাক হয়ে গেল। ইনফ্রারেড রেকর্ডার থেকে অদ্ভুত শোঁ শোঁ শব্দ বেরোতে লাগল, যেন বাতাসের মাঝে কেউ ফিসফিস করছে। হঠাৎ ঘাড়ে ঠান্ডা ছোঁয়া—সে পেছনে তাকিয়ে দেখল, একটা কবরের পাশে বসে আছে কেউ। সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে, নিঃশব্দে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কেবল একটি মুহূর্ত। আবার তাকাতেই কেউ নেই।
সোহম নিজের মনের সঙ্গে লড়তে লাগল। “না, এটা হ্যালুসিনেশন। ভয় পাচ্ছিস না, ক্যামেরায় কিছুই ধরা পড়েনি, মানে ছিলই না।”
কিন্তু তখনই বাতাস থেমে গেল। নিস্তব্ধতা এতটাই প্রকট হল যে নিজের নিঃশ্বাসও কানে ব্যথা দিল। আর সেই নিস্তব্ধতার মধ্যেই এক গলা ভেসে এল, একেবারে কোমল, যেন বহু বছরের মৃত আত্মার ফিসফাস—
“তুমি কি দেখবে আমায়?”
সোহম পেছনে তাকাল, কেউ নেই। ক্যামেরা বন্ধ, রেকর্ডার স্তব্ধ। সে চারদিকে তাকিয়ে দেখল, সব কবর যেন তার দিকে চেয়ে আছে। একটাই অনুভূতি—সব কিছুর মাঝে সে একা নয়।
আরও একবার সেই কণ্ঠ—
“রাত শেষ হবে না, যদি তুমি ফিরে না যাও।”
তারপর যেন সব কিছু থেমে গেল। মসজিদের দরজার নিচে, গম্বুজের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিল কিছু একটা। চোখ নেই, মুখ নেই, কেবল এক সাদা কাপড় মোড়া অন্ধ অবয়ব, যার দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে কোনও মানুষের চলন নেই। সে তাকিয়েই ছিল সোহমের দিকে।
ক্যামেরা হঠাৎ আবার চালু হল। স্ক্রিনে দেখা গেল একটা মুখ—নতুন কিছু নয়, ঠিক যেন সোহম নিজে। কিন্তু চোখ উপড়ে গেছে, ঠোঁট ছেঁড়া, গলায় ফাঁসির দাগ। সেই স্ক্রিনে একটা কথা ভেসে উঠল—“তুই যদি রফিকের নাম উচ্চারণ করিস, তুই ঘুমাতে পারবি না।”
সোহম কাঁপতে কাঁপতে ক্যামেরা নামাল। মসজিদের পেছনে কে যেন দাঁড়িয়ে ছিল। একটা হাত উঠল, আস্তে করে ইশারা করল। হাওয়ায় সেই কণ্ঠটা আবার বলল—
“চাঁদের রাতে যারা নাম নেয়, তারা আর আলো দেখতে পায় না। এবার তুই বুঝবি, কবরও জেগে উঠতে পারে।”
সোহম আর দাঁড়াতে পারল না। দৌড়ে পালাল সেই জায়গা থেকে। তার শরীরটা ঘেমে ভিজে গেছে, কিন্তু শীত বয়ে চলেছে শিরদাঁড়ার গভীর থেকে।
লজে ফিরে এসে বিছানায় বসে সে ক্যামেরা প্লে করল। স্ক্রিনে কিছু নেই। কিছুই রেকর্ড হয়নি। কিন্তু তার গলার ভেতর এখনও বাজছে সেই কণ্ঠ—“তুই যদি নাম নিস, ঘুম পাস না।” সে জানে, তার যাত্রা এখনো শেষ হয়নি। বরং শুরু হয়েছে। কানা মসজিদ, রফিক, আর সেই কবরস্থানের চাঁদ—এই তিনের ভেতরে আছে এমন এক রহস্য, যেটা শুধু ভয় নয়, বিশ্বাসও চ্যালেঞ্জ করে।
***
ঘুমাতে পারেনি সোহম। সারা রাত শুধু জানালার কাঁচে তাকিয়ে থেকেছে। একটা সময় পর চাঁদের আলো আর তার চোখের ভয়ের মধ্যে তফাৎ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। ঘড়ির কাঁটা যখন ভোর ছুঁয়েছে, তখনও সে অপেক্ষায় ছিল—এই বুঝি আবার সেই ছায়া ফিরে আসে। লজের কেয়ারটেকার সকালবেলা যখন চা দিতে এসেছিল, তার চোখেমুখে বিস্ময়, “আপনার মুখ কেন এত শুকিয়ে গেছে মশাই? অসুস্থ?”
সোহম কাঁচা গলায় বলল, “আপনারা রফিকুল হকের কথা বলেন, উনি কে ছিলেন?”
বুড়ো কেয়ারটেকার চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “ও নাম আবার নেবেন না বাবু। কাল রাত্রে কি ওখানে গিয়েছিলেন?”
সোহম কিছু বলল না। কিন্তু চায়ের কাপটা হাতে রেখে বুঝতে পারল—গ্রামের লোকজন শুধুই ভয়ে কথা চেপে রাখে না, কিছু একটা সত্যি আছে যা প্রকাশ করলে যেন ছায়াগুলো জেগে উঠবে। সে ঠিক করল, আজ তাকে খুঁজে বের করতেই হবে সেই ইতিহাস—কেন রফিকের নামের ওপর এমন নিষেধাজ্ঞা? আর তার কবরের খোদাই কেন মুছে ফেলা?
বেলপাহাড়ির পুরনো বাজারের মাথায় ছোট একটা লাইব্রেরি আছে। অন্ধকার ঘরে পাঁচশো রকম পোকা, কিন্তু বইগুলো এখনও গন্ধ ছড়ায়। লাইব্রেরির মালিক বৃদ্ধ গিরীশচরণ, যিনি পূর্বে শিক্ষক ছিলেন। তিনি সোহমের কথা শুনে বললেন, “রফিকুল হক ছিলেন এই গ্রামের প্রধান ইমাম। Partition-এর সময়কার কথা। গ্রামের হিন্দু-মুসলমান তখন সহবস্থানেই ছিল, কিন্তু বাইরের উস্কানি এসে ধ্বংস করল শান্তি। রফিকুল হক নামাজ পড়াতেন, মানুষ ভালোবাসত। কিন্তু একদিন সন্ধ্যাবেলায়, মসজিদের ভিতর নামাজরত অবস্থায়, হঠাৎই গুলির শব্দ। কেউ বলে পুলিশ, কেউ বলে উন্মত্ত জনতা। কে গুলি করেছিল কেউ জানে না। কিন্তু ওর দেহ পড়ে থাকল অনেকক্ষণ… কেউ সাহস করে ছুঁয়েও দেখেনি। তারপর একটা অদ্ভুত কাণ্ড হল।”
সোহম গিলে ফেলল প্রশ্ন, অপেক্ষা করল।
গিরীশচরণ চোখ তুলে বললেন, “রাত্তিরে কেউ একজন তাকে কাফনের কাপড়ে জড়ায়, কবর দেয় মসজিদের পাশেই। কিন্তু পরদিন সকালে লোকেরা দেখে, কবরের উপর দাঁড়িয়ে আছে রফিক নিজেই। মাথা নিচু, চোখ নেই, মুখে হাসি নেই। সে কাঁপছিল না, হাঁটছিল না, শুধু দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর হঠাৎ মিলিয়ে গেল কুয়াশার মধ্যে।”
সোহম ফিসফিস করে বলল, “তা হলে সে বেঁচে ছিল?”
গিরীশ মাথা নাড়ল, “তা জানি না। কিন্তু এরপর থেকে প্রতি চাঁদের রাতে সেই কবরের পাথর ঘামতে থাকে, মসজিদের জানালা খুলে যায়, আর রাতের বেলা কে যেন আজান দেয়। কবরের পাথরে নাম লেখা থাকত—‘ইমাম রফিকুল হক, শহীদ’। কিছুদিন পর সেটা গায়েব হয়ে যায়, কেবল খালি পাথর পড়ে থাকে।”
সোহমের মন ভরে গেল ভয়, বিস্ময় আর আগ্রহে। সে ভাবল—“চাঁদের আলোতেই কি সক্রিয় হয় সেই আত্মা? তাহলে এখন পূর্ণিমার দিকেই তো যাচ্ছে সময়। আমায় আবার যেতে হবে।”
সন্ধ্যা নামার আগেই সে তৈরি হল। এবার তার সঙ্গে ছিল আরও এক জিনিস—রেকর্ডিংয়ের পাশাপাশি একখানা চিরকুট, যেখানে লেখা, “আমি শুধু জানতে চাই, আপনি কে। আমি ভয় পেতে আসিনি।”
সন্ধ্যে সবে গড়িয়েছে, চারপাশে আবার সেই পাতলা কুয়াশা জমতে শুরু করেছে। মসজিদের পথ ধরে হেঁটে চলল সোহম। কুকুরের ঘেউ ঘেউ, বুনো পেঁচার ডাক সবই যেন দূর থেকে আসছে, কিন্তু তার পায়ের নিচে মাটি এতটাই নরম লাগছে যেন কেউ একে আগেই খুঁড়ে রেখেছে।
মসজিদের গেটের সামনে এসে দাঁড়াল সে। আজ যেন গেটের তালা নেই। জানালার কাঁচ ভাঙা, তবে ভেতরে আলো রয়েছে—কোথা থেকে তা জানা নেই। কবরস্থানের কবরগুলো যেন আরও কাছে এসেছে, একেকটা পাথর আজ বেশি উঁচু মনে হচ্ছে।
সে সামনে গিয়ে রফিকের কবরের পাশে দাঁড়াল, পকেট থেকে সেই চিরকুটটা বের করে কবরের উপরে রেখে দিল।
তারপর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল। চুপচাপ।
কিছুই হল না। না কোনো গলা, না কোনো ছায়া।
সে ভাবল, “সবটা হয়তো আমার ভ্রম ছিল। হয়তো সত্যিই কিছু নেই।”
ঠিক তখনই পিছন থেকে গলার আওয়াজ, একদম মাটি ঘেঁষা আওয়াজে কেউ বলল, “আমার নাম কে দিয়েছে তোমায়?”
সোহম ঘুরে তাকিয়ে দেখল—একটা সাদা চাদর মোড়া অবয়ব, মাথা নিচু, গায়ে ধুলো আর পচা পাতার গন্ধ।
সে জিজ্ঞেস করল, “আপনি রফিকুল হক?”
মূর্তি কিছু বলল না। কেবল হাতটা তুলল। আঙুলগুলো ছিল না, যেন পুড়ে গেছে। সে ইশারা করল মসজিদের ভেতরে যাওয়ার জন্য।
সোহম এক পা করে এগিয়ে গেল। ভেতরে ঢুকতেই চারপাশে যেন কুয়াশার পর্দা নেমে এল। কেবল ভেসে এল আজানের একদম প্রথম লাইন, নিঃসন্দেহে কারও কণ্ঠ, কিন্তু তা যেন মসজিদের ছাদের ওপর থেকে আসছে।
মেঝেতে সে দেখতে পেল কিছু লেখা, পুরনো আরবি হরফে—তার মানে বোঝা কঠিন, কিন্তু একটা শব্দ আলাদা করে স্পষ্ট করা যায়—“মাগফিরাত”—অর্থাৎ ক্ষমা।
মুহূর্তে সেই চাদরপরা ছায়া কাছে এসে দাঁড়াল। তার চোখ ছিল না, কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে ছিল। মুখ না খুলেই সে বলল—“তুই নাম নিয়েছিস আমার। এখন দেখবি কি হয় যখন কুয়াশার নিচে মুখ জেগে ওঠে।”
ঠিক তখনই মাটির নিচ থেকে গুঞ্জন শুরু হল। একটা কবর নড়ছে, মাটি যেন ওপরে উঠছে। কুয়াশার আবরণে সোহম দেখতে পেল, একটা মুখ—বৃদ্ধ, দাঁতবিহীন, গলার কাছে দাগ, আর চোখদুটো একেবারে ফাঁকা।
সেই মুখ মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল, আর বলল, “আমার কথা শুনেছিস, এখন আমার ভয় দেখবি?”
সোহম দৌড় দিল। দৌড়ে সে গেটের বাইরে গিয়ে পড়ল হোঁচট খেয়ে। মাটিতে পড়ে থাকতে থাকতে সে কাঁদতে শুরু করল।
মসজিদের ভেতর থেকে তখনও আজান ভেসে আসছিল, আর সেই কবরস্থানের কুয়াশা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল তার দিকেই।
একটা গলা ফিসফিস করে বলল, “এই কুয়াশার নিচে, কেউ আর মরে না। সবাই কেবল অপেক্ষা করে, কখন কেউ ডাকবে তাদের নাম।”
***
সোহমের পায়ের নিচে তখনও মাটি নরম। কুয়াশা যেন তার চারপাশে শিকল বেঁধে রেখেছে, নড়লেই ঘাড় ঘুরে তাকায় কেউ। কানা মসজিদ থেকে সে পালিয়ে এল বটে, কিন্তু মনে হল কিছু একটা সঙ্গে সঙ্গে এসেছে। তার চোখের পেছনে, কানের ভেতরে, অথবা বুকে ধুকপুক শব্দের গভীরে বসে গেছে সেই ছায়া। লজে ফিরে এসেই দরজা বন্ধ করল, কিন্তু ভিতরটা খালি খালি লাগছিল, যেন ঘরের মধ্যে সে একা নয়।
ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে তিনটা। ঘুম আসছিল না, শুধু মাথায় ঘুরছিল সেই শব্দ—“কুয়াশার নিচে, কেউ আর মরে না…” সোহম মাটির দিকে তাকাল, হাতের তালুতে কিছু একটার ছাপ! মাটি না, কবরস্থানের কোনো পাথরের জমে থাকা স্যাঁতসেঁতে শ্যাওলা যেন উঠে এসেছে তার গায়ে। সে টর্চের আলো ফেলে দেখল—ছাপটা মনে হচ্ছে কারও আঙুলের, যেটা তার হাত চেপে ধরেছিল কুয়াশার মধ্যে। সাদা হয়ে আছে জায়গাটা, চামড়া ঠান্ডা। একবার মনে হল—সে বেঁচে আছে তো?
সকালে সে জানলা দিয়ে দেখল, চায়ের দোকানে কিছু লোক জড়ো হয়েছে। তাদের চোখে ভয় আর প্রশ্ন। কেউ একজন তার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “মসজিদের দিকে আবার গেল?”
আরেকজন বলল, “ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে। না হলে পরের পূর্ণিমায় ওরই ডাক পড়বে।”
সোহম আর সহ্য করতে পারল না। সোজা গেল বাজারের প্রাচীন পাণ্ডুলিপি বিক্রেতার কাছে। লোকটা নামেই বিক্রেতা, আসলে তার সংগ্রহ এমন বইয়ের, যেগুলো পঁচে যায়নি সময়ের সঙ্গে। সোহম তাকে বলল, “আমি জানি এখানে কবরের ছায়া ঘুরে বেড়ায়। আমাকে সত্যিটা বলতে হবে। রফিক কি আসলেই বেঁচে ছিল?”
লোকটা তাকিয়ে বলল, “বেঁচে ছিল বললে ভুল হবে। সে একবার মরে গিয়ে ফিরে এসেছিল। কারণ, ওর মৃত্যু হয়েছিল প্রার্থনার মাঝখানে। মৃত্যু মাঝপথে হলে আত্মা পথ খুঁজে পায় না। নামাজ শেষ না হলে আত্মা চলে না।”
সোহম স্তব্ধ। “তাহলে সেই রাতের আজানগুলো…?”
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। ও এখনো নামাজ পড়ে। মুখ নেই, চোখ নেই, তবু মাটির নিচ থেকে তার কণ্ঠ ভেসে আসে। মুখোশহীন প্রার্থনা।”
সোহম জিজ্ঞেস করল, “ওর আত্মা কি বাঁধা পড়ে আছে কবরস্থানে?”
লোকটা হঠাৎ খুব নিচু গলায় বলল, “না। ও বাঁধা পড়ে আছে নামের ভেতর। যার মুখে ওর নাম উচ্চারিত হয়, তার মধ্যেই প্রবেশ করে। ওর ভয় নয়, ওর অসমাপ্ততা ছড়িয়ে পড়ে মানুষে মানুষে। তুমি ওর নাম নিয়েছ। এখন ও তোমার মধ্যেই।”
সোহমের বুকটা হঠাৎ চেপে ধরল। সে যেন শ্বাস নিতে পারছে না। রাতের বেলা সে আবার স্বপ্ন দেখল—সে মসজিদের ভেতরে একা বসে আছে, তার সামনে কুরআনের পাতাগুলো খুলে আছে, কিন্তু সব লেখা গলে গিয়ে কালো ছায়া হয়ে উঠছে। পাশ থেকে কে যেন বলে উঠল—“আল্লাহু আকবার”—কিন্তু সে গলা রক্তে ডুবে।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। চারদিকে নীরবতা। কিন্তু দরজার নিচ দিয়ে দেখা গেল—মেঝেতে কেউ হেঁটেছে। ধুলোয় পায়ের ছাপ, অথচ কেউ ঢোকেনি।
সোহম ঠিক করল, আজ রাতেই সব শেষ করবে। শেষ নামাজ। শেষ নাম। শেষ মুখোশ।
সে আবার গেল কানা মসজিদের দিকে। হাতে এবার কেবল একটা ক্যামেরা নয়, একটা মাটির প্রদীপ। শোনা যায়, মৃত আত্মার সামনে আলো ধরলে, তারা নিজের মুখ ফেরায়।
পথে হঠাৎ দেখল, এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে। চোখে সাদা পর্দা, হাতে কাঠের লাঠি।
তিনি বললেন, “ওর নাম উচ্চারণ করেছ? তবে শোনো—ও তোমার ভেতরে ঢুকে গেছে। এখন তুমি যা দেখবে, তা কেউ আর দেখতে পারবে না।”
সোহম কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “তাহলে মুক্তি কীভাবে?”
বৃদ্ধা বললেন, “প্রার্থনা শেষ করতে হবে। কিন্তু মুখোশ পরে নয়। ওর মতনই, মুখোশহীন প্রার্থনা।”
মসজিদের দরজার সামনে গিয়ে সে দেখল—আজ খোলা। ভেতরে ঢুকতেই যেন বাতাস জমে উঠল। দেয়ালজুড়ে কালো দাগ, কালি, ছেঁড়া ওড়না, নাম না জানা কারও কষ্টের কোলাহল। সামনে কবরের পাথর। সে সেখানে প্রদীপ জ্বালাল। পাথরটা ধীরে ধীরে গরম হয়ে উঠল।
ঠিক তখনই তার পিছনে দাঁড়াল সেই চাদর-মোড়া অবয়ব। মুখ নেই, তবু কথা শোনা যাচ্ছে।
“তুই আমার নাম বলেছিস। এখন শেষ কর প্রার্থনা। নইলে তোকে নিয়ে যেতে হবে।”
সোহম ধীরে ধীরে নামাজের আসনে বসল। সে জানে না নামাজ, জানে না ভাষা, তবু ভেতর থেকে ভেসে এল কিছু শব্দ, যেগুলো সে জীবনে কখনো উচ্চারণ করেনি।
হঠাৎ চারদিকে আলোর ঝলকানি। চাঁদ মাথার উপর। আর তখনই সেই মুখহীন অবয়ব সামনে এসে দাঁড়াল। প্রথমবারের মতো তার কাপড় খুলে গেল—ভেতরে কেবল অন্ধকার, নীরবতা, আর এক জোড়া শূন্য চোখ, যেগুলো কারও নয়।
তখন সেই কণ্ঠ বলল, “তুই যদি আমার মতো প্রার্থনা করতে পারিস, তবে তোর মুখও থাকবে না। থাকবি শুধু ছায়া।”
সোহম চিৎকার করল—“না! আমি বাঁচতে চাই!”
মাটির নিচ থেকে তখন একসঙ্গে শত শত গলা ফুঁসে উঠল—“তুই নাম নিয়েছিস, তোকে ফেরানো যাবে না। এখন তুইও নাম হবে, আরেকটা মুখোশহীন নাম।”
চারদিক কুয়াশায় ঢেকে গেল। প্রদীপ নিভে গেল। সোহমের শরীর কাঁপতে কাঁপতে পাথরের উপর পড়ে গেল।
শেষবারের মতো সে শুধু শুনতে পেল—
“এক নাম, এক প্রার্থনা, এক কবর। এরপর মুখ থাকবে না। শুধু ডাক।”
***
চাঁদের আলোয় সবকিছু স্বচ্ছ লাগে। কিন্তু সোহম এখন জানে—এই আলো স্বচ্ছ নয়, এই আলো ছায়ার মতো কুয়াশা বহন করে। মসজিদের পাথরে লুটিয়ে পড়ার পর যখন সে জ্ঞান ফিরে পেল, তখন সে এক অদ্ভুত আলো-অন্ধকার ঘরের ভেতর। পাশেই জ্বলছে কেরোসিনের বাতি। কে যেন ঠোঁটে আঙুল রেখে বলল, “চুপ করে থাকো। এখনো সময় আছে।”
সোহম তাকিয়ে দেখল—সেই বৃদ্ধা, যিনি তাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। নাম তার আয়েশা বিবি। তাঁকে এখন সকলে পাগলি বলেই ডাকে। কিন্তু তার চোখদুটো যেন অন্ধ নয়—বরং এমন কিছু দেখেছে যা এই জগতে কেউ দেখে না।
আয়েশা বিবি বললেন, “তুই মরিস নি। কিন্তু সোজা ফিরে এসেছিস না। তোর ছায়া এখনও আটকে আছে কবরস্থানে। আর যতক্ষণ না তুই নিজের ভয়কে চিনে ফেলবি, ততক্ষণ মুক্তি পাবি না।”
সোহম ধীরে ধীরে বলল, “ও আমার মধ্যে ঢুকে পড়েছে, তাই না? আমি তার নাম নিয়েছি, এখন আমি নিজেই তার মতো হয়ে যাচ্ছি।”
বৃদ্ধা মাথা নাড়লেন। “তুই ঠিক বলছিস। কিন্তু রফিক একটা নাম নয়, একটা অভিশাপ। এক অসমাপ্ত প্রার্থনা, যার আওয়াজ চাঁদের রাতে ছড়িয়ে পড়ে মৃতদের কানে। পূর্ণিমা যত ঘনায়, তত গভীর হয় তার আকুতি।”
সোহম জিজ্ঞেস করল, “তাহলে কী করতে হবে আমাকে?”
আয়েশা বললেন, “তোকে আবার যেতে হবে সেখানে, কিন্তু এইবার ওপরে নয়—নিচে। কবরের ফাঁক দিয়ে তুই দেখতে পাবি, সেই সময়, সেই মৃত্যু, সেই অসমাপ্ততা। সাহস থাকলে চাঁদের আলোয় তা তুলে আনবি। তবেই শেষ হবে।”
সোহম আর দ্বিধা করল না। রাতে সে বেরোল আবার। মসজিদের পাশের সেই কবরস্থান এবার কেমন যেন বড় লাগছে। পাথরগুলো যেন বেড়ে উঠেছে। পেছনের ঝোপ থেকে ভেসে আসছে নিঃশ্বাসের শব্দ, যেন মৃতরা ঘুমোচ্ছে না, কেবল অপেক্ষা করছে।
সে এসে দাঁড়াল সেই নামহীন কবরের সামনে। এবার পাথরটা যেন নিজেই সরে যেতে চায়। চাঁদের আলো ঠিক পড়ছে ফাঁক দিয়ে—তখনই দেখা গেল, নিচে একটি সুড়ঙ্গ। সে হাঁটু গেড়ে নিচে নামল। গর্তটা সংকীর্ণ, কিন্তু ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। দেয়ালে মাটির মধ্যে খোদাই করা কিছু বাক্য—সব আরবিতে, কিন্তু তার শব্দে আতঙ্ক লুকিয়ে।
শেষে সে পৌঁছাল এক অদ্ভুত কক্ষে—যেখানে একসঙ্গে রাখা বহু মুখোশ—সবই মুখ ছাড়া। আর তার সামনে দাঁড়িয়ে একটি অবয়ব, যার শরীরে মাথা আছে কিন্তু মুখ নেই।
সেই ছায়া বলল, “তুই কি প্রার্থনা শেষ করতে এসেছিস? তবে আগে সত্যিটা জান।”
সোহম চমকে গেল। সামনে এক দেয়ালে ভেসে উঠল সেই রাত—১৯৪৭ সালের, যখন রফিকুল হক নামাজে দাঁড়িয়েছিলেন। তার গলায় গুলি করেন গ্রামেরই এক লোক—যিনি ধর্মকে ব্যবহার করেছিলেন ভয় ও বিদ্বেষ ছড়াতে। রফিক মাটিতে পড়ে যান, নামাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে গ্রামের কয়েকজন তাকে নিয়ে গিয়ে কবর দেয়। মসজিদে আজান শোনা যায়, কিন্তু তখন রফিক মৃত ছিলেন না—শুধু অচেতন।
কবরের মাটির নিচে সে জেগে উঠেছিল। হাত উঠলেও কেউ শোনেনি, আওয়াজ করলেও কেউ আসেনি। কবরের নিচে সে শেষবার নামাজের বাক্য উচ্চারণ করেছিল, তারপর…
ছবিটা মিলিয়ে গেল।
ছায়া বলল, “তুই এখন জানিস সত্যি। এখন তুই বলতে পারিস—এই প্রার্থনা কি শুধুই ধর্মের, নাকি একজন মানুষের চূড়ান্ত আর্তি?”
সোহম বলল, “এটা আর্তি। একজন মানুষ, যে মৃত্যুর সময়ও ছেড়ে দিতে পারেনি ঈশ্বরকে। তাই তার আত্মা ঘুরে বেড়ায়।”
ছায়া চুপ।
তখন সোহম কবরের সেই গর্তে হাঁটু গেড়ে বসে, এক নতুন প্রার্থনা শুরু করল। কোনো নির্দিষ্ট ভাষায় নয়, হৃদয়ের ভাষায়। তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে কবরের পাথরে।
তখন হঠাৎ একটা শব্দ—দূর থেকে কেউ যেন নাম ধরে ডাকে।
“সোহম!”
সে উঠে দাঁড়ায়। কবরের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এক রাশ হয়ে তার মুখে পড়ে। সে দেখে, তার ছায়া আর তার মতো নেই—তা লম্বা, কাপড় মোড়া, মুখহীন।
ছায়াটি ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে থাকে। আর তখন প্রথমবার সেই কবরের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে একটি শব্দ—“আল্লাহু আকবার”—কিন্তু এবার রক্তমাখা নয়, নয় শীতল—বরং যেন শান্তির।
সোহম উঠে আসে মাটির ওপর। চাঁদ ঠিক তার মাথার ওপরে। কুয়াশা নেই। বাতাসে কোনো গন্ধ নেই। মসজিদ শান্ত। সেই পাথরের কবর আবার স্থির।
সে জানে—আজ কেউ আর হাঁটবে না তার পেছনে। কেউ ছায়া হয়ে ঢুকবে না তার মধ্যে।
কারণ আজ মুখোশ খুলে প্রার্থনা শেষ হয়েছে।
***
কুয়াশা সরে গেছে। মসজিদের গম্বুজের মাথায় আর শীতল বাতাস নেই। সেই প্রাচীন কবরখানার গর্তও মাটিতে ভরে গেছে, যেন কোনও দিন কিছু ঘটেনি। কিন্তু সোহম জানে, কিছু একটা বদলে গেছে চিরতরে। তার শরীর হালকা, কিন্তু মন ভারী। তবু সে জানে, সেই নামহীন কবরের আত্মা এবার সত্যি সত্যিই বিশ্রাম পেয়েছে।
তবে গ্রামের মুখে মুখে নতুন ফিসফাস। আগের মতো আতঙ্ক নয়, বরং এক গোপন উন্মাদনা। গ্রামের মাঝখানে শুকনো পাকুড় গাছটার নিচে কিছু ছেলেমেয়ে এক নতুন গল্প ফিসফিস করে বলে—
“ওই রাতে চাঁদের আলোয় সোহম কবরের মধ্যে ঢুকেছিল।”
“আর শুনলি না, সে নাকি ফেরার পথে কথা বলছিল নিজের ছায়ার সঙ্গে!”
“কারও কারও মতে সে ফিরে আসেনি—যে এসেছে, সে আর মানুষ নয়!”
এই সব কথা শুনে আয়েশা বিবি কেবল নিঃশব্দে হাসেন। তাঁর চোখ দুটো আজ যেন আরও দূরে তাকিয়ে থাকে।
একদিন সকালবেলা, সোহম বাজারে গিয়ে দেখে, লোকজন হঠাৎ করে অদ্ভুত ব্যবহার করছে। কেউ চোখের দিকে তাকাচ্ছে না, কেউ আবার তার দিকে অতিরিক্ত কৌতূহল নিয়ে ঝুঁকে পড়ছে। একটা ছোট ছেলে তো বলেই ফেলল, “আপনি কি সত্যিই মৃতদের সঙ্গে কথা বলেন?”
সোহম চুপ। সে উত্তর দেয় না। কিন্তু তার মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন উঁকি দেয়—“তবে কি সত্যিই কিছু একটা আমার মধ্যে থেকে গেছে?”
তারপরই ঘটনা ঘটল।
সন্ধ্যাবেলা এক বৃদ্ধ গ্রামবাসী, যার নাম মতিউর কাকা, হঠাৎ করে হারিয়ে গেলেন। বাড়ির লোক জানায়, তিনি প্রতিদিনের মতো মাগরিবের নামাজ পড়ে উঠেই চলে গেছেন, কিন্তু আর ফেরেননি।
সন্ধ্যার আলো ফুরিয়ে গেলে গ্রামে আবার কুয়াশা নামে। বহুদিন পর আবার, একেবারে হঠাৎ—কেউ যেন পুরোনো আজানের সুরে আওয়াজ তোলে—কিন্তু সেই সুর কানে গিয়ে খচখচ করে।
সোহমের ঘুম ভাঙে।
সে জানে, কিছু একটা আবার শুরু হয়েছে।
সকালে লোকজন খুঁজতে বেরোয়। মসজিদের পেছনের ঝোপ থেকে মতিউর কাকার জুতো মেলে। কিন্তু কাকাকে পাওয়া যায় না। আশ্চর্যের বিষয় হলো, যেখানে জুতোগুলো পড়ে ছিল, সেখানে কুয়াশার মধ্যে যেন একটা গাঢ় ছায়া জমে আছে—একটা মানুষের মতো অবয়ব, কিন্তু স্থির, ঠান্ডা, কুয়াশার শরীরে তৈরি।
একজন পাগলা ভিক্ষুক দৌড়ে এসে বলে, “ও ফিরে এসেছে। যার নাম ছিল না, যার প্রার্থনা ছিল অসমাপ্ত, তার জায়গা কে নিয়েছে—জানো?”
সবাই চুপ।
ভিক্ষুক বলে, “যে মুখোশ খুলে দেয়, সে-ই মুখোশ হয়ে যায়।”
এই কথা শুনে গ্রামের মৌলভী সাহেব হঠাৎ কাঁপতে কাঁপতে বলেন, “আমি তো সব জানি না… আমি শুধু শুনেছিলাম, একটা অভিশাপ ছিল, যা পূর্ণিমার চাঁদে সক্রিয় হয়। যার নাম নেই, সে অন্যের নাম নেয়। এবার সে নাম নিয়েছে মতিউরের।”
একজন কিশোর বলে, “তাহলে কি মতিউর কাকাই… মৃত?”
ভিক্ষুক হেসে বলে, “না। সে এখন নাম নয়, ছায়া। যে ছায়া চাঁদের নিচে দাঁড়িয়ে আছে আর খুঁজছে পরবর্তী নাম…”
সোহম আর বসে থাকতে পারে না। সে সোজা চলে যায় কবরস্থানের পেছনে। এবার সে দেখে, সেই ফাঁকা জমিতে নতুন একটা কবর উঠেছে—কেউ না বসানো, না খোঁড়া। যেন নিজেই উঠে এসেছে মাটি ফুঁড়ে। সামনে কোনও নাম নেই। কেবল একটা দাগ—যেখানে চাঁদের আলো পড়লেই তা স্পষ্ট হয়।
সোহম কাছে যেতেই তার মাথায় একরাশ যন্ত্রণার ঢেউ। মনে হল, কেউ যেন তার নাম স্মরণ করছে। কানে ভেসে আসে শত শত ফিসফাস—“সোহম… সোহম… তুই মুখোশ খুলেছিস, এখন তোর মুখ কে পরবে?”
তখনই সে দেখে, তার ছায়া মাটি থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। নিজের শরীর থেকে আলগা হয়ে একটা ভিন্ন অবয়ব নিচ্ছে।
সে ছুটে পালাতে চায়, কিন্তু পা চলেনা।
তখন হঠাৎ কেউ পেছন থেকে তার কাঁধে হাত রাখে। সে ঘুরে দেখে—আয়েশা বিবি।
তিনি বললেন, “ভয় পেয়ো না। এখন যা হচ্ছে, তা তোমার কাজের ফল নয়, বরং তোমার দেখার ক্ষমতার ফল। তুমি যা খুলেছ, তা আর বন্ধ হয় না। এই গ্রামে তুমি না থাকলে, রফিকের আত্মা হয়তো চিরকাল বেঁচে থাকত যন্ত্রণায়। কিন্তু এখন… এখন নতুন নাম চাই তার জায়গায়। কারণ ভূতেরও উত্তরাধিকার লাগে।”
সোহম ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “আমার ছায়াটা তাহলে কী?”
আয়েশা বললেন, “তোমারই একটা অংশ, যেটা মৃত্যুর সঙ্গে কথা বলে ফেলেছে। এখন সেটা আর পুরোপুরি তোমার নয়। যদি ওর জায়গায় নতুন কেউ না আসে, তবে ও তোমার শরীর দাবি করবে।”
সোহম চুপ।
তবে এর মাঝে গ্রামের লোকেরা এক নতুন কথা ছড়ায়—একটা কিশোর, নাম রাজিব, সে নাকি রাতে হঠাৎ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নামাজের শব্দ বলে, চোখ খোলা রেখেই। তার মা কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমার ছেলে তো নামাজ জানেই না। তাহলে ওই কথাগুলো তার মুখে আসে কোত্থেকে?”
মৌলভী বললেন, “সে হয়তো পরবর্তী বাহক।”
সোহম জানে—সময় খুব কম। যদি সে কিছু না করে, তাহলে সেই চাঁদের নিচে আবার গড়ে উঠবে আরও একটা নামহীন কাহিনি। আবার কারও ছায়া আলগা হয়ে যাবে।
সে তখন ঠিক করে—এই চক্র ভাঙতে হবে।
আর সেটা করতে হলে তাকে যেতে হবে, কবরেরও নিচে—সেই জিজ্ঞাসার কেন্দ্রে, যেখানে জন্ম নিয়েছে ‘কবরের চাঁদ’।
***
ছায়া কি কেবল আলোহীনতা? নাকি একান্তই আমাদেরই বিকল্প সত্তা—যা কথা বলে না, তবু শোনে সব? সোহম এখন জানে, তার ছায়া আর নিছক ছায়া নয়। সেটা এখন একটা স্বতন্ত্র সত্তা, যার নিজের স্মৃতি, অভিমান আর… এক ভয়ানক অভিপ্রায় আছে।
সন্ধ্যে নামতেই সোহম আবার ফিরে গেল কবরস্থানের সেই একঘেয়ে নিঃসঙ্গতার মধ্যে। চারদিক নিস্তব্ধ, কিন্তু আকাশে চাঁদ আজ অসম্ভব উজ্জ্বল। এত উজ্জ্বল, যেন তার আলো ছায়াকে পুড়িয়ে দিচ্ছে না—বরং জাগিয়ে তুলছে।
কবরের পেছনের সেই নতুন কবরটা আজ আরও স্পষ্ট। সেখানে এখনও কোনও নাম নেই, শুধু একটা মাটি-চাপা ফাঁক—যেটা দেখে বোঝা যায়, ভিতরে কিছু একটা আছে। নড়ছে।
তখনই হঠাৎ মাটি ফেটে বেরিয়ে এল… ছায়া।
একটি অবয়ব—সোহমের মতো, কিন্তু চোখ নেই। মুখ আছে, কিন্তু ঠোঁট নেই। ছায়া যেন কুয়াশার গায়ে তৈরি এক মানুষ।
সে কথা বলে না, কিন্তু সোহম শুনতে পায় তার ভেতরের শব্দ।
“তুই চলে যেতে চাস, তাই তো?”
“তুই মুক্তি চাস, কিন্তু আমাকে রেখে?”
“আমি তো তোরই—তুই মুখ খুললি, আমিও জেগে উঠলাম।”
সোহম পেছনে সরে যায়, কিন্তু তার পা চলেনা। হঠাৎ তার মনে হয়, তার বুক ভারী হয়ে আসছে, নিশ্বাস নিতে পারছে না। চারপাশের কবরগুলো যেন জেগে উঠেছে। প্রত্যেকটা কবরের উপরে এক-একটা ছায়া।
কেউ নামহীন, কেউ মৃত, কেউ অপেক্ষমাণ।
ছায়া বলল, “তুই আমাকে জন্ম দিয়েছিস, এখন আমায় বোঝ। আমি কেবল রফিকের অভিশাপ নই, আমি এই গ্রামের সমস্ত অপূরণীয় প্রার্থনার ছায়া। যার কথা কেউ শোনে না, যাকে কেউ মনে রাখে না, আমি তার ছায়া। আমি সেই মৃত আত্মার ইতিহাস, যার মুখ কেউ মনে রাখে না।”
তারপর ছায়া শুরু করল বলার মতো, কিন্তু সেটা কোনও ভাষায় নয়—স্মৃতির মতো এসে পড়ল সোহমের মনে:
একজন হিন্দু বিধবা, যাকে কবরস্থানের পেছনে গলা কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, কারণ সে এক মুসলিম যুবককে ভালোবেসেছিল। তার দেহ কবর পায়নি। তার আত্মাও রয়ে গেছে, ছায়ার অংশ হয়ে।
একজন মুসলিম বৃদ্ধ, যাকে দাঙ্গার রাতে নিজের ছেলেরা পিটিয়ে মেরেছিল কারণ সে “ভয় না পেয়ে” মসজিদে প্রার্থনায় গিয়েছিল।
একটা শিশু, নামহীন, যার গলিতে পা ছিল বাঁকা। সবাই বলত, ও অভিশপ্ত। একদিন হারিয়ে গিয়েছিল, কারও জানা হয়নি কোথায়।
এইসব ইতিহাস, যাদের নাম কেউ রাখে না, তাদের সবকটাই গড়িয়ে আসে সোহমের চোখের সামনে। সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। তার চোখ দিয়ে জল পড়ে কবরের শুকনো মাটিতে।
তখন ছায়া বলে,
“তুই চাইলে আমি তোর শরীরে ঢুকে যেতে পারি। আমি চাইলে তোকে মুখহীন করে দিতে পারি। কিন্তু আমি চাই একটা নাম। আমি চাই কেউ আমাকে চিনুক। আমার জন্য কেউ দাঁড়াক।”
সোহম ধীরে ধীরে বলে, “তুই কি চাইছিস… আমি তোর কাহিনি লিখি?”
ছায়া চুপ করে থাকে।
সোহম বলে, “তুই যদি আমায় সব বলিস, আমি লিখে যাব সব নামহীন ইতিহাস। ছায়াদের কাহিনি, যাদের আমরা কেবল ভয় পাই, চিনতে পারি না।”
ছায়া তখন ধীরে ধীরে সরে আসে, তার অবয়ব ক্ষীণ হয়।
তার গলায় শোনা যায় কেবল একটি বাক্য—
“তাহলে আমায় লেখো… যেন আমি আর ছায়া না থাকি।”
তারপর ছায়া কবরের ভিতরে ফিরে যায়। কুয়াশা মিলিয়ে যায় চাঁদের আলোয়।
সোহম একা দাঁড়িয়ে থাকে। রাত নিঃশব্দ। বাতাসে যেন এক নতুন গন্ধ—মাটি, নামহীন ফুল আর মুক্তির।
সেদিন রাতেই সে লেখে প্রথম বাক্য:
“কবরের ছায়ারা কাঁদে না, তারা শুধু দেখে—আমরা কীভাবে মুখ ফিরিয়ে নেই।”
***
সকালের আলোয় যখন গ্রাম জেগে উঠল, তখনই অদ্ভুত কিছু একটা চোখে পড়ল সবার। কবরস্থানের চারপাশে যে শ শুকনো ঘাস, তা আজ অস্বাভাবিকভাবে ভিজে—যেন ভোরের শিশির নয়, কোনও দীর্ঘশ্বাসের ছায়া। কবরগুলোর পাশে ছোট ছোট ধুলোছোঁয়া কাগজের মতো কিছু পড়ে আছে।
একজন ছেলেপেলে দৌড়ে গিয়ে দেখে, ওগুলো সত্যিই কাগজ। পুরোনো, হলুদে পোড়া ধরনের। যেন বহু বছর আগের—কিন্তু স্পষ্ট লেখা।
প্রথম চিঠিটা পাওয়া যায় রফিকের কবরে।
লেখা:
“আমার নাম শুধু রফিক ছিল না।
আমার নাম ছিল সজল, সোহেল, এবং তারা—যাদের কখনও ডাকিনি।
আমার জানাজা হয়নি। আমি কবরের দিকে তাকিয়েছিলাম শুধু এক আশায়—
কেউ যদি আমার দোষ নয়, আমার দুঃখটা মনে রাখে।”
মৌলভী সাহেব সেই চিঠিটা পড়ে আঁতকে ওঠেন। চোখের চশমাটা খসে পড়ে। তিনি বলেন, “এটা তো রফিকের হাতের লেখা! কিন্তু এত বছর ধরে এই লেখা গেল কোথায়?”
পরের চিঠিটা মেলে পাশের এক নামহীন কবরের কাছে।
“আমার কোনও নাম ছিল না, কারণ আমার বাবা-মা আমাকে জন্ম দিয়েই ফেলে দিয়েছিল।
কিন্তু আমি জানতাম, আমি গান গাইতে পারতাম।
একবার শুধু কেউ শুনেছিল, তারপর আমি হারিয়ে যাই।
আমার জন্য কেউ কাঁদেনি, আমি কাঁদিনি।
শুধু চুপ করে শুনতাম—আর একটা ছায়া আমায় বলেছিল, একদিন আমার কথা কেউ লিখবে।
সেই তুমিই, সোহম।”
সোহম তখন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, চোখে জল। তার মনে পড়ে, আগের রাতে ছায়া যা বলেছিল—
“তাহলে আমায় লেখো… যেন আমি আর ছায়া না থাকি।”
কিন্তু শুধু সে-ই নয়, এখন পুরো গ্রাম এই লেখাগুলোর সাক্ষী।
আরও কবরের পাশে মিলল আরও চিঠি—
“আমার নাম ছিল শাইস্তা। আমি এক বিধবা, কিন্তু আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম। আমাকে পাথর মেরে মারা হয়েছিল, কারণ আমি হেসেছিলাম।”
“আমার নাম জানোয়ার রেখেছিল। কারণ আমি দাঙ্গায় জন্মেছিলাম। কিন্তু আমি একবার একজনকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। সেই ইচ্ছে নিয়েই মরেছিলাম।”
চিঠিগুলো একটার পর একটা গ্রামবাসীদের সামনে খুলে পড়ে। কেউ পড়ে কাঁদে, কেউ ভয়ে পড়ে বসে পড়ে।
তখনই গ্রামের প্রবীণতম মানুষ হাজি করিম চুপ করে বলেন, “এসব কবরের আত্মারা কথা বলে না—কিন্তু তারা চায় কেউ শুনুক। তারা আর চায় না শুধু নামহীন হয়ে থাকা। তারা চাইছে আত্মজীবনী।”
তারপরই একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। যাদের পরিবারে কোনও পুরোনো অদৃশ্য মৃত্যু হয়েছিল, যাদের সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না, তারাও নিজেদের বাড়িতে পায় একেকটা ভিজে চিঠি।
শুধু একজনকে কেউ কিছু দেয়নি—সোহম।
সে রাতে সোহম ঘুমোতে পারছিল না। তার জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল এক ছায়া। সেই ছায়া আগের মতো ভয়ংকর নয়, যেন ক্লান্ত।
তখন ছায়া বলে,
“তুই তোর কাজ করেছিস, সোহম। তোকে আর কিছু দিতে হয়নি।
কারণ তোকে যা দেওয়া হয়েছে, তা বাকিদের থেকে আলাদা—
তুই চিঠির প্রাপক নও, তুই চিঠির লেখক।”
সোহম জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু আমি তো সব জানি না!”
ছায়া মৃদু হেসে বলল, “তুই কেবল শুনবি। প্রতিদিন এক কবর, এক আত্মা।
তুই কেবল লিখে যাবি। তাহলেই এই অভিশপ্ত বৃত্ত ভাঙবে।”
সোহম জানত না, সে পারবে কি না।
কিন্তু তখন জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখে, কবরস্থান থেকে উঠে আসছে অসংখ্য আলোর রেখা—প্রতিটি মৃতের মনে হয় যেন জ্বলে উঠেছে এক নামের শিখা।
পরদিন থেকে সোহম শুরু করল তার লেখা—“মৃতদের চিঠি” নামে একটি খাতা।
প্রতিদিন এক পৃষ্ঠা, এক গল্প, এক আত্মা।
গল্পগুলো ভয়ের ছিল না, ছিল গভীর, নিঃসঙ্গ, অথচ সত্য।
গ্রামে আর অন্ধকার নামেনি ঠিক সেইভাবে।
আর কবরস্থানের কুয়াশা হঠাৎ কমে গেছিল।
তবে শেষ চিঠিটা যে কখন আসবে, কে দেবে, এবং সে কার?
সেটা এখনও কেউ জানে না।
***
সোহম আজ অনেকটা শান্ত। “মৃতদের চিঠি” নামের তার ডায়েরি এখন প্রায় ভরে এসেছে। তেত্রিশটি কবরের তেত্রিশটি আত্মার গল্প সে শুনেছে, লিখেছে, এবং কেঁদেছে।
প্রত্যেকটা রাত ছিল আলাদা: কখনও করুণ, কখনও অন্ধকার, আবার কখনও আলোয় মোড়া এক নিঃসঙ্গতা।
কিন্তু একটাই কবর রয়ে গেছে।
সবচেয়ে পুরোনো।
সেই কবরের উপর আজও কোনও নামফলক নেই।
নেই কোনও আত্মার ছায়া।
নেই কোনও ফুল, কোনও মোমবাতি।
শুধু একটা রুক্ষ পাথরের ঢিপি।
চারপাশে যেন বাতাসও থেমে থাকে ওখানে।
গ্রামে অনেকে বলে, “এই কবরটা ওখানে ছিল না। কবরস্থান তৈরির বহু আগেই এটা ছিল।”
কেউ বলে, “এখানে কোনও আত্মা নেই—এখানে সময় ঘুমিয়ে আছে।”
কেউ কেউ তো আরও ভয়াবহ দাবি করে, “এই কবরটার মধ্যে শুয়ে আছে সেই আত্মা, যে অন্য আত্মাদের চুপ করিয়ে দেয়।”
সোহম বারবার চাইছিল, কোনও চিঠি আসুক।
কিন্তু কিছুই এল না।
তাই এক রাতে, পূর্ণিমার রাতে, সোহম সিদ্ধান্ত নিল—সে নিজেই যাবে ওই কবরটার সামনে, অপেক্ষা করবে। হয়তো তখন কিছু বলবে কেউ।
রাত তখন সাড়ে বারোটা। চাঁদের আলো সরাসরি এসে পড়ছে ওই নামহীন কবরে।
কোনও ছায়া নেই।
কোনও আওয়াজ নেই।
তখন সোহম ধীরে ধীরে বলল—
“আমি জানি না আপনি কে।
আমি জানি না আপনার কোনও ভাষা আছে কিনা।
কিন্তু আমি চাই, আপনি যদি থাকেন, আপনার কথাও যেন লেখা হয়।
আপনার কাহিনি যদি কেউ শোনে না, আমি শুনতে চাই।”
সেই মুহূর্তে, কবরের উপর থেকে ধীরে ধীরে সরতে থাকে পাথরের মাটি।
নামহীন পাথরের নীচ থেকে ভেসে আসে এক অদ্ভুত আলো।
একটি ছায়া ওঠে—কিন্তু সেটা মানুষ না।
না পুরুষ, না নারী।
না শিশু, না বৃদ্ধ।
সেটা এক বিকৃত গড়নের মুখ—কিন্তু চোখ দু’টো অদ্ভুত শান্ত।
ছায়া নয়, যেন আলোর মধ্যেও অন্ধকার জেগে আছে।
তখন সেই সত্তা বলে,
“আমি সেই যাকে কেউ কখনও নাম দেয়নি।
আমি সেই যার জন্ম হয়নি।
আমি সেই যাকে কবর দিয়েছিল পৃথিবী, জন্মের আগেই।
আমি সেই, যে একদিন নিজের অস্তিত্ব চাইতে এসেছিল, কিন্তু সবাই ভয় পেয়ে তাকে চাপা দিয়েছিল।
আমি সেই, যার শরীর নেই, শুধু স্মৃতি আছে।
আমি সেই, যে মৃত নয়, আর জীবিতও নয়।”
সোহম শিউরে ওঠে।
সে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কী চাও?”
সত্তা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে।
“আমি চাই না কেউ আমায় মনে রাখুক।
আমি চাই না গল্প হোক আমার।
আমি চাই শুধু একটা নাম।
একটা নাম, যেটা আমাকে মানুষ করে।
কারণ আমি তো সৃষ্টি হয়েছিলাম—কিন্তু আমাকে মানুষ হতে দেওয়া হয়নি।”
সোহম স্তব্ধ হয়ে থাকে।
তখন তার হাতে থাকা কলমটা হঠাৎই ছায়ার স্পর্শে কাঁপতে থাকে।
একটি অদ্ভুত আলোয় কাগজ ভরে ওঠে।
সেখানে নিজে থেকেই লেখা হতে থাকে শেষ চিঠি—
“আমার জন্ম হয়নি, তাই আমার মৃত্যু নেই।
আমার গল্প কেউ শোনেনি, তাই আমি প্রতিদিন কাঁদি।
আমি ভয় নই, আমি বিস্মরণ।
আমার নামে কবর নেই, কবরেই আমার নাম।
তুমি যদি আমাকে মানুষ মনে করো, তবে আমার নাম রাখো—
আলোক।
হয়তো আমি আলো হব একদিন, যদি কেউ আমায় ছায়া বলে ডাক না দেয়।”
লেখা শেষ হতেই ছায়াটা অদৃশ্য হয়ে যায়।
কবরের চারপাশে হঠাৎ ফুল ফোটে।
জোনাকিরা ঘিরে ধরে জায়গাটা।
সোহমের চোখে জল চলে আসে।
সকালে গ্রামের লোকেরা দেখে, ওই নামহীন কবরের পাথরে একটা নতুন নাম খোদাই হয়ে গেছে—
“আলোক”
তার নিচে লেখা,
“নামহীন আত্মাদের স্মৃতিতে।”
গ্রাম জুড়ে সেদিন একটি কথা ছড়িয়ে পড়ে—
“এই কবর আর ভয় দেয় না।
এটা এখন আশ্রয়।
যারা নামহীন ছিল, তাদের আলোর পথ।”
সোহমের ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা:
“শেষ কবরের চিঠি আমার কাছে নয়—তা সকলের জন্য।
কারণ সত্যিকারের প্রেত নয় সেই, যে চিত্কারে আসে।
প্রেত হল সে, যাকে আমরা ভুলে যাই।
আর একবার যদি তাকে মনে করি…
সে আর ভূত থাকে না।
সে হয়ে ওঠে… আলো।”
সমাপ্ত