Bangla - ভূতের গল্প

কবরস্থান রোড

Spread the love

অরুণাভ দাশগুপ্ত


এক

নৈহাটি শহরের এক নিরিবিলি কোণে ছোট্ট একটা গলি, যার নাম শুনেই অনেকের মুখ থমকে যায়—“কবরস্থান রোড”। শহরের অন্য অংশে আলো ঝলমলে বাজার, রঙিন দোকান আর ব্যস্ততা থাকলেও এই গলিটা যেন স্থির এক মৃত অতীতের বুক ছুঁয়ে বেঁচে আছে। পুরনো বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে প্যাঁচপেঁচে গলির পাশে, যেন কারো দীর্ঘশ্বাস জমে আছে দেয়ালের ফাটলে। সেই গলিরই একদিকে, ধূসর রঙের তিনতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় ভাড়া নেয় অভিক সেন, তার স্ত্রী তৃণা এবং তাদের চার বছরের ছেলে বিভান। শহুরে কোলাহল থেকে দূরে এক চিলতে শান্তি আর স্থিরতার খোঁজে তারা কলকাতা ছেড়ে এই শহরে এসেছে। অভিক একজন ফ্রিল্যান্স গ্রাফিক ডিজাইনার, ঘরে বসেই কাজ করেন, তাই জায়গার নির্জনতা তার মন ছুঁয়ে যায়। তৃণা সদ্য এক স্থানীয় স্কুলে যোগ দিয়েছেন শিক্ষকতা করতে। বাড়িটা বাইরে থেকে যতটা জরাজীর্ণ, ভিতরে ঠিক ততটাই গোছানো—মাটির রঙের দেয়াল, কাঠের জানালা, একটা পুরনো কাঠের বারান্দা আর মাথার ওপর লাল টালির ছাদ। প্রথম দিনেই মালিক বিশ্বজিৎ মন্ডল বাড়ি বুঝিয়ে দিয়ে বলেন, “ঘরের কিছু জায়গায় যেতে হয় না, পুরনো জিনিস রাখার ঘর। দরজা বন্ধ রাখলেই ভালো।” কথা শুনে অভিক হাসে, “ঠিক আছে, আমরা তো নতুন, ভাঙচোরা কিছু খুলব না।” বিশ্বজিৎবাবুর গলায় একধরনের অদ্ভুত জড়তা ছিল, মুখে হাসি থাকলেও চোখের কোণে জমে থাকা অতীতের ধুলোটা যেন স্পষ্ট দেখেছিল তৃণা।

প্রথম কয়েকদিন বেশ স্বাভাবিক কেটেছিল। বিভান ঘরের এক কোণে খেলত, তৃণা স্কুলে যেত আর অভিক বারান্দায় বসে ল্যাপটপে ছবি আঁকত। রাতে ঘর ঠান্ডা হয়ে যেত, বাতাসে একরকম শুষ্কতা ছড়িয়ে থাকত—যা প্রথমে তৃণার মনে কল্পনা বলে ঠেকেছিল। কিন্তু চতুর্থ রাতে বিভান ঘুম থেকে উঠে বসে পড়ে এবং ফিসফিস করে বলে, “দাদু এসেছে, আমায় গল্প শোনাবে।” তৃণা হেসে জিজ্ঞেস করে, “কে দাদু? আমরা তো কাউকে চিনি না!” বিভান ছোট্ট মুখে রহস্যময় হাসি নিয়ে জানায়, “ও থাকেন বাড়ির ওপরে। আমাকে দেখে খুব ভালোবাসেন।” অভিক তখন ঘুমন্ত অবস্থায় পাশ ফিরে শুয়ে ছিল, কিন্তু তৃণার মনটা খচখচ করে ওঠে। পরদিন সকালে তৃণা যখন স্কুলে যায়, অভিক বিভানের সঙ্গে খেলা করতে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোর দাদুর নাম কী?” বিভান উত্তর দেয় না, শুধু পেন্সিলে একটা মুখ আঁকে—দুটি গাঢ় চোখ, লম্বা মুখ, কপালে চুল নেই, আর হাসিমুখে দাঁড়ানো ছায়ার মতো এক অবয়ব। অভিক ঠাট্টা করে বলে, “তুই তো ভয়ংকর আঁকিস রে!” কিন্তু সেদিন রাতে অভিক হঠাৎ চোখ মেলে দেখে, বিভান বিছানায় নেই। দরজা হালকা খোলা। সে উঠে গিয়ে দেখে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিভান নিচের দিকে তাকিয়ে বলছে, “আজ দাদু চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন, কথা বলছেন না।” অভিক নিচে তাকায়, কিন্তু খালি রাস্তা। পেঁচানো গলির ধারে শুধু সাদা কুয়াশা গড়াগড়ি খাচ্ছে। পরদিন থেকে তৃণাও লক্ষ্য করে, বিভান একা খেলতে ভালোবাসছে না, কিছু একটা তার আশেপাশে সারাক্ষণ আছে—যা তাকে টানছে, যাকে সে মা-বাবার থেকেও বেশি আপন ভাবছে।

একদিন বিকেলে বাড়ির পুরনো কাঠের আলমারির নিচে তৃণা খুঁজে পায় একটি ছোট লোহার চাবি আর তার পাশে মোটা চামড়ার বাঁধানো একটি খাতা। প্রথমে ভাবেন হয়তো পুরনো কোনো কাগজ, কিন্তু খাতা খুলতেই ভিতরে মলিন হাতে লেখা কিছু লাইন দেখা যায়—“আজও কেউ আসেনি। আমি আর অপেক্ষা করব না। এই ঘরেই থাকব, একদিন কেউ আসবে, কেউ কথা বলবে আমার সঙ্গে।” তারিখটা লেখা—১৯৯৯ সালের এপ্রিল। চোখে জল লেগে যাওয়ার মতো হাতের লেখা, আর এক ধরনের হাহাকার ছড়িয়ে রয়েছে শব্দে শব্দে। তৃণা অবাক হয়ে অভিককে খাতাটি দেখায়। অভিক মুখে হেসে বলে, “কে জানে, হয়তো আগের কোনো বাসিন্দার ডায়েরি।” কিন্তু সে রাতেই বিভান খাটের নিচে বসে মাটিতে আঙুল দিয়ে কিছু আঁকছিল। তৃণা জিজ্ঞেস করে, “কি করছো বাবা?” বিভান বলে, “দাদুর নাম লিখছি। ও বলেছে আমার নামও শিখিয়ে দেবে।” মাটিতে আঁকাটা অস্পষ্ট, কিন্তু ধুলোর ওপর জগাখিচুড়ি লেখার মাঝে স্পষ্ট দেখা যায়—“নরেন দা…”। শব্দটা অসম্পূর্ণ, হাত কাঁপছে বিভানের। অভিক এবার কিছুটা চিন্তিত হয়। সে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরে রাত নামছে, কুয়াশায় ঢাকা কবরস্থান রোড ধীরে ধীরে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ এক ভ্যানগাড়ি চলে যায় গলিপথে, আর তাতে চাকা ঘষে পুরনো ইট। সেই শব্দে যেন অতীতের এক ঘুম ভাঙে। অভিক জানালায় কাঁচে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পায়। কিন্তু চোখের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা এক বৃদ্ধ মুখ ঘুরিয়ে হাসছে—যাকে সে ছুঁতে পারে না, যার ছায়াও এক মুহূর্তে মিলিয়ে যায়।

দুই

পরের কয়েকদিন তৃণা বিভানের কথাবার্তায় ক্রমশ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। শিশুটি একধরনের গভীর মনোযোগে “দাদু” নামের অদৃশ্য কারও সঙ্গে কথা বলে, তার মুখে এমন সব শব্দ ও কথা শুনতে পায় যা তার বয়সের ছেলের মুখে শোনার কথা নয়। এক রাতে গল্প পড়ে শোনানোর সময় তৃণা বিভানকে জিজ্ঞেস করে, “দাদু কেমন দেখতে?” বিভান তখন তার ছোট ছোট হাত দিয়ে মায়ের কপাল ছুঁয়ে বলে, “দাদুর চোখ বড়ো, কপালে রেখা আছে, মাথায় চুল নেই, আর গলা দিয়ে হুঁ-হুঁ আওয়াজ আসে।” সেই বর্ণনা শুনে তৃণার শরীরে কাঁটা দেয়—যেন বিভান কোনো মৃত মানুষের বিবরণ দিচ্ছে। অভিক এ কথাগুলো শুনে হেসে উড়িয়ে দেয়, বলে, “তুমি এসব ভাবছো বলেই ওর কথা ভয়ংকর ঠেকছে।” কিন্তু তৃণার বিশ্বাস, শুধু কল্পনা বলে এতটা গভীর ও ধারাবাহিক ব্যাখ্যা আসা সম্ভব নয়। তার মনে হয় বাড়িতে কিছু আছে—কিছু এমন যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়। এক সন্ধ্যায়, যখন অভিক বাজারে, তৃণা একা বসে বিভানকে নিয়ে। হঠাৎ আলো যায়। পুরো ঘর অন্ধকার। কিছুক্ষণ পর মোম জ্বালিয়ে তৃণা যখন ঘরে ঢোকে, দেখে বিভান বিছানার এক পাশে বসে কারও দিকে তাকিয়ে বলছে, “আজ তুমি কেন কথা বলছো না? মা ভয় পায় বলেই?” তৃণা দ্রুত ছুটে গিয়ে ঘরের আলো জ্বালায়, কিন্তু কারও ছায়াও নেই। বিভান তখন মাথা নিচু করে বলে, “ও বলেছে মা ওকে ভয় পায় বলে আর আসবে না। কিন্তু আমি ওকে ভালোবাসি।”

পরদিন সকালে অভিক যখন নিচতলার দোকান থেকে ব্রেড আর দুধ আনতে বের হয়, তার চোখ পড়ে বাড়ির পাশের গলির মাথায় বসে থাকা এক বৃদ্ধের দিকে—চুল প্রায় সাদা, পরনে মলিন ধুতি ও ফাটা শাল। বৃদ্ধ তাকিয়ে আছে বাড়ির দিকেই। চোখে যেন অনন্ত এক শূন্যতা। অভিক একটু কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কিছু বলবেন?” কিন্তু বৃদ্ধ কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু ধীরে ধীরে উঠে চলে যান, গলির ওপাশে হারিয়ে যান। সেই রাতে আবার বিভান কথা বলে ওঠে ঘুমের মধ্যেই—“দাদু আজ এসেছিল, কিন্তু তোমার সঙ্গে দেখা করেনি। তোমাকে দেখে উনি কাঁদলেন।” অভিক প্রথমবার একটু ধাক্কা খায়। সে বুঝতে পারে, এই ‘দাদু’ শুধুমাত্র বিভানের কল্পনা হতে পারে না, কিছু একটা ছায়া, কিছু অতীত সত্য এই বাড়িতে থেকে গেছে। রাত তিনটা নাগাদ অভিক টের পায়, তার খাটের পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। চোখ খুলতেই দেখি বিভান ঘুমন্ত, কিন্তু দরজাটা খানিকটা খোলা। বাইরে বারান্দা থেকে যেন কেউ কাঁপা গলায় হাসছে। অভিক দ্রুত উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। পরদিন তৃণা পুরনো কাঠের আলমারিতে একটা ছোট ছবি খুঁজে পায়, যার কোণ ছেঁড়া। তাতে দেখা যাচ্ছে—একজন বৃদ্ধ, সাদামাটা পোশাকে, হাতে ছড়ি, চোখে গাঢ় দৃষ্টি। বিভান ছবিটা দেখেই চিৎকার করে ওঠে, “দাদু!” অভিক আর তৃণা পরস্পরের দিকে তাকায়। ঘাড়ে যেন ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায়।

এই ঘটনায় বিভানের প্রতি তাদের মনোযোগ আরও বেড়ে যায়। তারা ঠিক করে, কয়েকদিনের জন্য কোথাও বেড়িয়ে যাবে, যাতে মন ঘোরানো যায়। কিন্তু বিভান যেতে রাজি নয়। সে বলে, “দাদু আমায় ছেড়ে যেতে দেবে না। ও বলেছে, আমি গেলে ও একা হয়ে যাবে। আর একা থাকতে চায় না।” অভিক বিভানকে বোঝায়, “তুই যদি ভালো করে ঘুমোস, খেলিস, তাহলে দাদুও খুশি হবে।” বিভান তখন হঠাৎ চোখ বড় করে বলে, “দাদু বলে তুমি মিথ্যে বলছো। তুমি ওকে ভয় পাও।” সেই রাতে তৃণা নিজের ঘরের জানালায় পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখেছিল, বারান্দার এক কোণে যেন কেউ দাঁড়িয়ে আছে—অন্ধকারে একটানা তাকিয়ে থাকা একটি ছায়া। চোখ নেই, মুখ নেই, তবু তাকানোর অনুভূতি স্পষ্ট। পরদিন সকালে তারা বিশ্বজিৎ মন্ডলের কাছে গিয়ে বাড়ির ইতিহাস জানতে চায়। প্রথমে তিনি এড়িয়ে যান, তারপর এক গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, “অনেক বছর আগে এই বাড়িতে থাকতেন নরেন দত্ত। একা ছিলেন, কোনো পরিবার ছিল না। পাড়ার কেউ খুব একটা মিশত না। একদিন হঠাৎ নিখোঁজ হন, কেউ খোঁজও করেনি বেশি। তার পর থেকে এই বাড়িতে কেউ বেশিদিন থাকতে পারেনি। যারা থেকেছে, সবাই কিছুদিনের মধ্যেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। বলত—এই বাড়িতে ‘কারও নিঃশ্বাস’ শোনা যায়।” অভিক আর তৃণা কথা না বাড়িয়ে বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু রাত নামার সঙ্গে সঙ্গেই তৃণার মনে হয়, যেন দেয়ালের ফাঁক দিয়ে কেউ তাদের কথা শুনছে। বিভান তখন ঘরের এক কোণে বসে পেন্সিল দিয়ে মেঝেতে একটা শব্দ লিখছে—“সঙ্গ”। তৃণা দম বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে, যেন শব্দটা এক নিঃসঙ্গ আত্মার আকুতি।

তিন

বাড়িটির একটি অংশ এতদিন অব্যবহৃতই ছিল—দোতলার শেষপ্রান্তের একটি ঘর, যেখানে বিশ্বজিৎ মন্ডল ভাড়া দেওয়ার সময়ই বলেছিলেন, “ও ঘরটা বন্ধই থাক, ওখানে পুরনো জিনিস রাখা আছে, দরজা খোলার দরকার নেই।” অভিক ও তৃণা কথাটি গুরুত্ব না দিয়ে মেনে নিয়েছিল, কিন্তু আজ বিভানের আচরণ ও বাড়ির ঘটমান ঘটনাগুলোর পর, তৃণার কৌতূহল সংযত থাকে না। বিকেলের পড়ন্ত রোদে, ঘরদোর পরিষ্কার করার সময় সে সেই পুরনো ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজার তালা ধুলে ভরা, ঝুলছে একটি মরচে ধরা লোহার ছেঁড়া টুকরোয়। তৃণা কিছুক্ষণের জন্য স্থির দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর ফিরে গিয়ে ঘরের পুরনো কাঠের আলমারির নিচে খুঁজতে খুঁজতে একটি ছোট, ভারী লোহার চাবি পায়। তার মনে পড়ে—সেদিন এই চাবি ও সেই চামড়ার খাতা একসাথে পেয়েছিল। বুক কাঁপলেও সে চাবিটি হাতে নিয়ে ঘরের সামনে এসে দরজায় লাগিয়ে ঘোরায়। তালা খচ করে খুলে যায়। দরজা ঠেলেই এক ধরণের আটকে থাকা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ মুখে এসে লাগে—মাটি, পচা কাঠ আর সময়ের ধুলো মিশে এক অদ্ভুত গন্ধ তৈরি করেছে। ঘরের ভিতরে আলো ঢোকে না বললেই চলে, এক কোণায় ছেঁড়া চেয়ার, কাঠের ছোট একটি টেবিল, আর দেয়ালে অদ্ভুত অদ্ভুত আঁকিবুঁকি। তার মাঝে সবচেয়ে চোখে পড়ে একটি পুরনো ফটোফ্রেম—যার কাঁচে ধুলো জমেছে, তবু স্পষ্ট বোঝা যায় এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন, পেছনে সেই বাড়ির বারান্দা। কাঁচের মধ্যে কে যেন নখ দিয়ে আঁচড় কেটেছে, যেন কেউ ভেতর থেকে বাইরে বেরোতে চাইছিল।

তৃণা সেই ফ্রেমটি তুলে ঘর থেকে বেরোতে যাবে, এমন সময় দরজার পেছনে একটা খটাস শব্দ হয়—সে চমকে ঘুরে দেখে, বিভান দাঁড়িয়ে। তার চোখ ঘোলা, কপালে ঘাম, ঠোঁটে হাসি। সে বলে, “এটাই দাদুর ঘর। আমি বলেছিলাম না?” তৃণার হাত কাঁপে, সে কিছু বলার আগেই বিভান ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ে, মেঝের ধারে বসে পড়ে আর বলে, “এইখানে দাদু বসে থাকেন। এই চেয়ারে। আর ওই জানালায় দাঁড়িয়ে থাকেন, যখন মা ঘুমায়।” অভিক তখনো বাড়ি ফেরেনি। তৃণা বিভানকে কোলে তুলে ঘর থেকে বের করে আনতে চায়, কিন্তু সে চিৎকার করে ওঠে, “দাদু বলেছে কেউ যেন ওর জিনিস ছোঁয় না! তুমি আমার দাদুর ওপর রাগ করছো কেন?” ঠিক তখনই জানালার ফাঁক দিয়ে বাতাস ঢুকে পড়ে ঘরে, আর ফ্রেমটা তৃণার হাত থেকে পড়ে ভেঙে যায়। ফ্রেমের ভিতর থেকে একটা কাগজের টুকরো বেরিয়ে আসে—হাতে লেখা, “আমার সঙ্গ দরকার, আমি একা থাকি। একা মানুষ বেশি দিন বাঁচে না, তাই সঙ্গ খুঁজি। যদি কেউ আসে, তাকে আমি ছেড়ে দেব না।” হাতের লেখা হুবহু মিলে যায় সেই চামড়ার খাতার লেখার সঙ্গে। তৃণা পড়ে বসে থাকে, বিভান তখন মাটির ওপর ঝুঁকে পড়ে শূন্যে তাকিয়ে বলে, “দাদু, মা তো কিছু করেনি। তুমি রাগ করো না, আমি তোমার সঙ্গে থাকব।” হঠাৎ ঘরের বাতাস ভারী হয়ে আসে, দরজার ওপাশে যেন পায়ের আওয়াজ শোনা যায়—খরখরে পায়ে টানাটানি, পুরনো চটি জুতোর শব্দের মতো। তৃণা বিভানকে কোলে তুলে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে, চাবিটি মেঝেতে পড়ে থাকে।

সন্ধ্যার পর অভিক বাড়ি ফিরে ঘটনাটা শুনে প্রথমে রাগ করে, “তোমার ভয় আর কৌতূহল মিলিয়ে ছেলেটার মাথায় এসব ঢুকিয়ে দিচ্ছো!” কিন্তু তারপর তৃণা সেই লেখা কাগজটা, আর ফ্রেমে থাকা বৃদ্ধের ছবিটা দেখায়। অভিক চুপ করে যায়, অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকে বৃদ্ধের মুখের দিকে। সেই চোখ—যেন এক অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা, এক নির্জনতার যন্ত্রণা নিয়ে তাকিয়ে আছে। অভিক ধীরে ধীরে বলে, “এই মুখটাই আমি একদিন নিচে দেখেছিলাম… সত্যি বলছি।” সেই রাতে বিভান চুপচাপ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। অভিক ও তৃণা তার পাশে বসে থাকে, আলো জ্বালিয়ে। হঠাৎ মধ্যরাতের একটু আগে বিভান চোখ মেলে তাকায় এবং মৃদু স্বরে বলে, “তোমরা কেন আজ ঘুমাওনি? দাদু এলে লুকিয়ে যাবে।” তার এই ঠান্ডা স্বরের মধ্যে কোনো শিশুসুলভতা নেই, বরং এক ভয়ানক শান্তি আছে—যা দেখে অভিক আর কিছু বলার সাহস পায় না। সেই মুহূর্তে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে আসে, জানালার কাচে আচমকা শিশির জমে ওঠে, আর সেই শিশিরের মধ্যে তৃণা স্পষ্ট দেখতে পায় এক ছায়ামূর্তি—হাত বাড়িয়ে রেখেছে জানালার বাইরে থেকে, যেন ডাকছে, তৃণাদের ভেতর থেকে কাউকে নিয়ে যেতে চায়।

চার

ঈশানীর চোখে তখনো ঘুম জমেনি। আগের রাতের বিভীষিকা যেন ঘরের ছায়াগুলোকে আরও গাঢ় করে তুলেছে। অভিক পাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে, তার মুখে ক্লান্তির ছাপ। ঈশানী জানে, বিভান যা বলেছিল সেটা কল্পনা হতে পারে না। চার বছরের একটি ছেলে যেভাবে “দাদু”র উপস্থিতির বর্ণনা দিয়েছিল, তার ভাষা, চোখের তাকানো, তা কোনো নাটক ছিল না। সে কিছু দেখেছে। ঈশানী বিছানা ছেড়ে ধীরে ধীরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। কবরস্থান রোডের সেই অন্ধকার গলির দিকে তাকিয়ে, অদ্ভুত এক স্নিগ্ধতা অনুভব করল — যেন ছায়ারা তার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করেই, তার চোখ পড়ল রাস্তার মোড়ে একটা সাদা ধুতি-পরা ছায়ামূর্তির ওপর, যার মাথায় উঁচু সাদা পাগড়ি। বুক কাঁপতে লাগল ঈশানীর। কিন্তু চোখ সরাতে পারল না। মুহূর্তে সেই ছায়াটি গলির আরেক প্রান্তে মিলিয়ে গেল, যেন কিছু ছিলই না। ঈশানী দৌড়ে ঘরে ফিরে এল, বিভানকে জড়িয়ে ধরল, আর বুঝতে পারল— কিছু আছে এই বাড়িতে, এই গলিতে, যা ওদের নজর রাখছে।

পরদিন সকালে ঈশানী সোজা চলে গেল পাশের বৃদ্ধা বাসিন্দা শিবানী দেবীর কাছে, যিনি প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এই রোডে থাকেন। তার মুখে শুনল প্রথমবার “কালীপদ দত্ত” নামটি। একসময় এই বাড়িতে থাকতেন কালীপদবাবু — একজন প্রখ্যাত কবি, যিনি নাকি মৃত আত্মাদের নিয়ে কবিতা লিখতেন। তাকে নিয়ে মানুষের মুখে অনেক গল্প। কেউ বলে তিনি নেকড়ে আত্মার সাথে কথা বলতেন, কেউ বলে তার মৃত্যুর পর বাড়ি খালি হয়ে যায়, আর তারপর থেকেই অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে। শিবানী দেবী জানালেন, প্রায় দশ বছর ধরে এই বাড়িতে কেউ স্থায়ী হতে পারেনি। সবাই এক মাস-দু’মাসের মধ্যেই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। কেউ কিছু বলে না, শুধু মুখ থুবড়ে চুপ করে থাকে। ঈশানীর গা কাঁপতে লাগল। সে বাড়ি ফিরে অভিককে সব বলল। অভিক প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিলেও ঈশানীর চোখের ভেতরের ভয়টা দেখে চুপ হয়ে গেল। তারা ঠিক করল, আর একদিন এমন কিছু হলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।

কিন্তু সেই রাতেই বিভান আবার “দাদু”র কথা বলতে শুরু করল। এবার তার কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত শীতলতা, যা ঈশানীর মেরুদণ্ডে বিদ্যুৎ বুলিয়ে দিল। বিভান বলল, “দাদু বলেছে মা, তুমি জানো না, আমি এখানেই থাকতাম আগেও। তোমরা এলেই তো আমি ফিরে এলাম।” অভিক, ঈশানী দুজনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। একটি চার বছরের ছেলে এমন কথা কীভাবে বলল? সেই রাতে, ঘুমের মধ্যে ঈশানী স্বপ্ন দেখল — একটি বৃদ্ধ মানুষ বারান্দায় বসে কবিতা লিখছেন, পাশে বিভান বসে আছে, আর তার হাতে একটা পুরোনো কালি-কলম। হঠাৎ সেই বৃদ্ধ তাকিয়ে বললেন, “ও আমার ছিল, আবার ফিরে এসেছে। ওকে নিয়েই আমি আবার কবিতা লিখব, তুমরা ওকে নিয়ে গেলে সে কষ্ট পাবে।” ঘাম ভিজে উঠে ঈশানীর ঘুম ভেঙে গেল। পাশের বিছানায় বিভান নেই! সে উঠে দেখে, বারান্দায় একটা ছায়ামূর্তি বিভানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে — মাথায় পাগড়ি, চোখে শূন্য দৃষ্টি, ঠোঁটে হালকা হাসি। ঈশানী চিৎকার করে উঠতেই মুহূর্তে ছায়ামূর্তি মিলিয়ে গেল। বিভান আবার বিছানায়, যেন কিছু হয়নি। এবার আর কোনো সন্দেহ নেই— ঈশানী বুঝল, এই বাড়ির ছায়ারা নিঃসন্দেহে জেগে উঠেছে, এবং তাদের নজর এখন ওদের সন্তানের ওপর।

পাঁচ

সন্ধে ছয়টা। বিভান স্কুল থেকে ফিরে একটু চুপচাপ, খাওয়ার টেবিলে এসে সে একবারও জিজ্ঞেস করেনি, “আজ কী রান্না হয়েছে মা?” ঋজু ভ্রু কুঁচকে ঈশানের দিকে তাকাল, ঈশান ধীরে মাথা নাড়ল—সে-ও লক্ষ্য করেছে ছেলের অদ্ভুত আচরণ। খাওয়ার পরে, বিভান নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়, আর কিছুক্ষণ পর থেকে শোনা যেতে থাকে ফিসফিস কথা। ঋজু কান পেতে শোনে—না, ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলছে না; বরং মনে হচ্ছে, সে যেন কারো কথা শুনছে, মাঝে মাঝে মাথা নাড়ছে। “দাদু বলছে ওকে কার্ড খেলতে হবে,” হঠাৎ বিভানের কণ্ঠ ভেসে আসে। “কিন্তু আমার তো স্কুল আছে দাদু! রাত করে খেলতে পারব না।” এই কথা শুনে ঈশান তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ায়, ছেলের ঘরের দরজা খুলে দেখে বিভান একা বসে আছে বিছানায়, সামনে ছড়ানো তাসের গেম, আর চোখে-মুখে এমন এক অভিব্যক্তি—যা কোনও শিশুর নয়। যেন কোনও বয়স্ক মানুষের সঙ্গে বোঝাপড়া চলছে। ঈশান কাঁধে হাত রাখতেই বিভান তড়াক করে চমকে ওঠে। চোখ দুটো লাল, pupils খানিকটা বড়, আর ঠোঁট শুকনো। “দাদু বলছিলেন, আজ রাতে তিনি আমাদের সঙ্গে রাতের খাবার খাবেন,” বিভান এমন স্বাভাবিকভাবে বলল, যেন ব্যাপারটা রোজকার।

ঋজু সিদ্ধান্ত নেন, এভাবে আর চলতে পারে না। তিনি পরদিন সকালে পাশের বাড়ির প্রৌঢ়া শোভা দিদিকে ডাকেন। তিনি এই গলিতে প্রায় পঁচিশ বছর ধরে থাকছেন, এককথায় এক জীবন্ত ইতিহাস। শোভাদিদি গল্প করতে ভালোবাসেন, আর এ বাড়ির কথা তুলতেই তার চোখ দুটো বিস্ময়ে বড় হয়ে ওঠে। “এই বাড়িতে তোমরা ভাড়া নিয়েছ? ও মা রে, আমি ভেবেছিলাম কেউ আর নেবে না!” তারপর ফিসফিস করে বলতে শুরু করলেন, “বছর দশেক আগের কথা। এক বৃদ্ধ—অভিক রায় নাম ছিল তার—এই বাড়িতে থাকতেন একা। খুবই অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। সারা রাত বসে বসে কাচের চোখ ঘোরাতেন, এমনকি নিজে নিজেই কার্ড খেলতেন, কথা বলতেন অদৃশ্য কাউকে সঙ্গে। কেউ কখনো আসে-যায় করত না। তারপর একদিন ওনার মৃতদেহ পাওয়া গেল বিছানায়—কাচের চোখ খোলা, আর এক হাতে ছিল তাসের প্যাকেট। সবাই বলত, উনি মরে গিয়েও শান্তি পাননি।” শুনে ঋজু গলা শুকিয়ে ফেলেন, কারণ বিভান বারবার যে ‘দাদু’র কথা বলছে, সেই দাদুর একটা চেনা বৈশিষ্ট্য বারবার উঠে আসছে—কাচের চোখ।

ঈশান এবার আর দেরি না করে এক স্থানীয় পুরোহিতের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পুরোহিত মশাই দুপুরবেলা বাড়িতে এসে কিছু বিশেষ মন্ত্র পড়ে, গঙ্গাজল ছিটিয়ে দেন ঘরের কোণায় কোণায়। কিন্তু বিভান যেন এতে আর বেশি বিরক্ত হয়। “আপনারা দাদুকে বিরক্ত করছেন,” সোজাসুজি বলে দেয় সে। রাতে আবার কার্ডের খেলা শুরু হয়, আর এবার ঘড়ির কাঁটা ঠিক তিনটে বাজতেই হঠাৎ ঘরের দরজাটা ঠাস করে খুলে যায়। বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা ছায়ামূর্তি—দীর্ঘদেহী, পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, চোখে অদ্ভুত কাঁচের মতো উজ্জ্বলতা, আর ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি। “ভয় পেয়ো না, মা,” ছায়াটা বলে ওঠে, “আমি ওর খেলার সঙ্গী, আর কিছু না।” ঋজু চিৎকার করতে পারে না, গলার স্বর যেন আটকে যায়। বিভান তখন হাত ধরে টানছে দাদুর, যেন বলছে, “আজ আবার সেই মুনলাইট টুর্নামেন্ট খেলতে হবে, দাদু।” রাতের অন্ধকারে ঈশান একবার চোখ মেলে দেখে, ছেলেটা আর একা নয়—তার পাশে কেউ বসে আছে, আর সেই লোকটার এক চোখে যেন কাঁচের মতো আলো জ্বলছে…

ছয়

ঋজু এখন যেন এক ভয়ানক দুঃস্বপ্নের মাঝখানে আটকে পড়েছে। দিনগুলো কেটে গেলেও, বিভানের সঙ্গে “দাদু”-র কথোপকথন থামছে না। বরং আরও গভীর আর জটিল হয়ে উঠেছে। ঈশান এই সময় অফিসের কাজে দু’দিনের জন্য বাইরে, ঋজু একা বিভানকে নিয়ে বাড়িতে থাকছে। রাতে ঘুমানোর আগে ছেলেকে দুধ খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সে ঘরের আলো নিভিয়ে দেয়, কিন্তু জানালার ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্নার মতো সাদা আলো এসে পড়ে। হঠাৎ বিভান বলে ওঠে, “মা, দাদু এসেছেন। দেখো, আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।” ঋজুর গলা শুকিয়ে যায়। বুকের মধ্যে কাঁপুনি ধরে, সে আলো জ্বালায়, কিন্তু কারো দেখা মেলে না। বিভান তখনও হাসছে, যেন কেউ তাকে কানে কানে গল্প বলছে। রাতটা যেন কোনোভাবেই শেষ হতে চায় না। ঘড়ির কাঁটা যেন থেমে গেছে, এবং ঋজু বুঝতে পারে—এই বাড়িতে কিছু আছে যা তারা বোঝার আগেই তাদের জীবনকে জড়িয়ে ফেলেছে।

পরদিন সকালে ঋজু ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়ে খালি বাড়ির নীরবতায় এক অদ্ভুত চাপ অনুভব করে। সে একবার সমস্ত ঘর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে দূরে কবরস্থানটিকে লক্ষ্য করে। বাতাস যেন সেখানে থেমে থাকে, পাখি উড়ে না, শব্দ হয় না। হঠাৎ এক বৃদ্ধ লোককে কবরের কাছে বসে থাকতে দেখে তার মনে পড়ে—এতদিন তো কাউকে ওই এলাকায় দেখেনি। লোকটা তাকিয়েই আছে, তার দিকে। চোখে কোনও অভিব্যক্তি নেই, তবু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে বিদ্ধ করছে। ঋজু তাড়াতাড়ি ভিতরে ফিরে আসে, দরজা বন্ধ করে দেয়, এবং হৃদয়ের গতি যেন বেড়ে যায়। বিকেলে ঈশান ফিরে এলে ঋজু সব কিছু বলে। ঈশানের চেহারা থমথমে হয়ে ওঠে, কিন্তু সে বাস্তববাদী মনোভাব দেখিয়ে বলে, “তোমার ভয় হচ্ছে, এটা আমাদের মানসিক চাপের ফল। তবে আমি কাল এক পুরোনো পরিচিতকে ডাকব, যিনি ভূতপ্রেত বিষয় একটু বোঝেন।” এই প্রথম ঈশানও বুঝতে পারে, এ বাড়ির মধ্যে কিছু অদ্ভুত ঘটছে, যার ব্যাখ্যা বিজ্ঞানে পাওয়া যাবে না।

সন্ধ্যার সময় বাড়িতে সেই পরিচিত ব্যক্তি আসেন—নাম তার অগ্নিদেব, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং লোকবিশ্বাস নিয়ে গবেষণা করেছেন বহু বছর। তাঁর চোখে ভারী চশমা, কণ্ঠে স্থিরতা আর মাথা ভর্তি সাদা চুল। তিনি বাড়ির ভেতরে ঢুকেই থমকে যান। “তোমরা এই বাড়িটা ভাড়া নিয়েছ? কবরস্থান রোডের এই শেষ প্রান্তে যে বাড়িটা বহু বছর তালাবন্ধ ছিল?” তিনি নিচু গলায় বলেন। ঋজু আর ঈশান স্তব্ধ হয়ে পড়ে। অগ্নিদেব জানালেন, এই বাড়ির আগে তিনজন ভাড়াটে এসেছিল, আর প্রত্যেকেই তিন মাসের মধ্যেই পালিয়ে গিয়েছিল। কারণ, এখানে এক বৃদ্ধ মানুষ, গৌরীশঙ্কর মিত্র নামে একজন, তাঁর মৃত্যুর পরও ঘোরাফেরা করেন বলে বহুবার অভিযোগ উঠেছিল। “তিনি একমাত্র মানুষ যিনি জীবদ্দশায় প্রতিদিন কবরস্থানে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন। মৃত্যুর পরও তাঁর আত্মা সেখানে শান্তি পায়নি,” বলেন অগ্নিদেব। ঈশান থমথমে গলায় বলেন, “তাহলে আমাদের ছেলে যা বলছে, সত্যি?” অগ্নিদেব কেবল বলেন, “তোমাদের সময় বেশি নেই। এই আত্মা যদি বিভানকে পুরোপুরি নিজের জগতে টেনে নেয়, তাহলে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না।” কথাটা যেন একটা বজ্রপাতের মতো বাড়ির ভিতরে নেমে আসে। সমস্ত অন্ধকার যেন আরও গাঢ় হয়ে যায়।

সাত

শীতের রাত আরও গভীর হচ্ছিল। বাতাস যেন থমকে আছে, নৈহাটির সেই পুরনো গলির মাথায় অন্ধকার জমাট বেঁধে। অভিক ব্যালকনিতে সিগারেট হাতে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল—কিন্তু তার চোখ বারবার চলে যাচ্ছিল সামনের কবরস্থানের দিকে। বিভান ঘুমিয়ে পড়েছে, ঋজুও স্নান সেরে বিছানায় ঢুকেছে, কিন্তু অভিকের ভিতরের অস্থিরতা বাড়ছিল ক্রমশ। আজ সন্ধ্যায় বিভান যেভাবে বলে উঠেছিল, “আজ দাদু বলেছে তোমরা আমাকে নিয়ে দূরে চলে যাবে না,” তাতে অভিক কাঁপতে কাঁপতে ছেলের দিকে তাকিয়েছিল। “দাদু” নামটার সাথে তাদের পরিচিত কোনো আত্মীয় নেই, কিন্তু এখন বুঝতে পারছে—এই ‘দাদু’ একজন নয়, কিছু একটা। সেই কিছু একটা, যার অস্তিত্ব চোখে দেখা যায় না, কিন্তু ছায়ার মতো তাদের চারপাশে ঘোরে। অভিকের মনে পড়ে গেল বিকেলের সেই ফোনটা—যেখানে তাদের পুরোনো বাড়ির মালিক অদ্ভুতভাবে জানতে চেয়েছিল, “আপনারা এখনও ওখানেই আছেন? ওই জায়গাটা তো… কবরস্থান রোডের বাড়ি তো… খালি রাখতেই বলা হয়েছিল!” অভিক ফোন কেটে ভাবছিল, তবে কি এই বাড়িতে থাকার কথাই ছিল না?

ঋজু তখন বিছানায়, আলো নিভিয়ে মোবাইলে খবর পড়ছিল। আচমকাই বাতাস যেন হিম হয়ে গেল ঘরের ভিতর। জানালার পর্দা নিজে থেকেই দুলতে লাগল, যেন কোনো অদৃশ্য উপস্থিতি তার নীচে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ বিছানার পাশে রাখা বিভানের খেলনার গাড়িটা গড়াতে গড়াতে দরজার দিকে চলে গেল। ঋজু চমকে উঠে বসে, আলোর সুইচ জ্বালিয়ে দেয়। সাদা আলোয় ঘরটা স্বাভাবিক, কিন্তু তার গলা শুকিয়ে যায়। বিভান ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করছিল—“দাদু বলেছে, কাল সন্ধ্যেয় সে আসবে তোমাদের সাথে কথা বলতে।” ভয় পেয়ে ঋজু উঠে গিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে। তার মনে হচ্ছিল যেন দেয়ালের ছায়াগুলো এখন বড় হয়ে উঠছে, একটু একটু করে ঘরের দিকে এগোচ্ছে। তখনই অভিক ঘরে ঢুকে বলে, “ঋজু, আমাদের হয়তো এখান থেকে চলে যেতে হবে। আমি আর পারছি না।” কিন্তু ঋজু তাকিয়ে বলে, “চলে গেলে যদি কিছু আরও খারাপ হয়?”

রাতটা যেন আর কাটছিল না। বিভান হঠাৎ ঘুমের মধ্যেই বসে পড়ে। তার চোখদুটো আধখোলা, কিন্তু দৃষ্টিশূন্য। সে বলে, “দাদু বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বলছে মা-বাবাকে এখন দেখা দরকার।” ঋজু আর অভিক হতবাক। বিভান আবার বিছানায় শুয়ে পড়ে, গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। দুজনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে—কিছু একটা জানালা দিয়ে তাদের দেখছে, এই অনুভূতি তাদের শিরদাঁড়ায় ঠাণ্ডা স্রোত বইয়ে দেয়। হঠাৎ মোবাইল বেজে ওঠে। স্ক্রিনে নাম নেই—শুধু লেখা ‘কবরস্থান’। অভিক কাঁপতে কাঁপতে কল ধরে, ওপাশ থেকে ফিসফিসে কণ্ঠে বলা হয়—“তোমাদের সময় শেষ হয়ে এসেছে।” মুহূর্তেই ফোন কেটে যায়। অভিক আর ঋজু বুঝে যায়—এখন আর সময় নেই। ঘরের ভিতরেই কেউ বা কিছু ঢুকে পড়েছে—ছায়া নয়, রক্তমাংসের নয়—তবু ভয়াবহভাবে সত্যি।

আট

বৃষ্টির এক অন্ধকার সন্ধ্যায় বিভান যখন দরজা খুলে বাইরে বেরোল, তখন তার চোখে পড়ল বাড়ির গেটের নিচে গোঁজা একটি লাল রঙের খাম। সে অবাক হয়ে সেটি তুলে এনে ঋজুর হাতে দিল। ঋজু খামটি খোলার সাথে সাথেই ভেতর থেকে বেরোল একটি অদ্ভুত গন্ধমাখা চিঠি—রক্তে লেখা, যেন কারও নিঃশেষ কান্না। চিঠিতে লেখা ছিল: “আমার কণ্যা মাধবীলতার দেহ এখানেই পুঁতে রেখেছে আমার আত্মীয়রা। আমি খুঁজে পেয়েছিলাম সত্যি, তাই আমাকে মেরে এখানে পুঁতে দিল। সেই রাতেই প্রথম আলাপ তোমাদের ছেলের সাথে। ও খুব মিষ্টি, তাই ওকে বলেছি গল্প, সত্যি গল্প। কিন্তু আমার ঘুম ভাঙে না যতদিন না মাধবীলতার দেহকে আলোয় আনা হয়।” এই অস্বাভাবিক বার্তা পড়ে ঋজু এক মুহূর্তের জন্যও আর নিশ্চিন্ত থাকতে পারল না। বিভান এক নিঃশ্বাসে বলল, “ঋজু, এটা নিছক কৌতুক নয়। এখন সময় এসেছে সত্যি খোঁজার।”

ঋজু আর বিভান দু’জনেই সেই রাতেই ঠিক করল পুরোনো নথিপত্র, পুরসভা রেকর্ড এবং স্থানীয় পুরনোদের সঙ্গে কথা বলবে। পরদিন সকালে তারা গিয়ে হাজির হল স্থানীয় পুরনো বইয়ের দোকানে, যেখানে তারা পেয়েছিল এক পুরনো সংবাদপত্র—তারিখ ১৯৭৪। সেখানে ছাপা এক ছোট খবরে লেখা ছিল, “নৈহাটির কবরস্থান রোডে রহস্যময় মৃত্যু। বৃদ্ধ বিনয় ভট্টাচার্যের মৃতদেহ বাড়ির পেছনের বাগান থেকে উদ্ধার, মৃত্যুর কারণ অজানা। প্রতিবেশীরা বলছেন, শেষ ক’দিন তিনি বলছিলেন বাড়ির গাছের নিচে তাঁর মেয়ের কঙ্কাল পুঁতে রাখা হয়েছে।” সংবাদটি পড়ার পর বিভান কাঁপতে কাঁপতে বলল, “ঋজু, এ তো সেই ‘দাদু’-ই হবে, যাঁর সঙ্গে অভিক কথা বলে।” ঋজুর চোখে জল জমে উঠল—এক ভয়ংকর অতীত আজও বেঁচে আছে, কারণ সে ন্যায় চায়।

দুপুরের দিকে তারা ফিরে এল ঘরে, ছাদে ওঠার সিঁড়ির নিচের জায়গায় একটু খুঁড়তেই বেরিয়ে এল জং ধরা একটা ছোট বাক্স। বাক্সের ভেতরে ছিল একটি ছোট গোলাপি ফ্রকের ছেঁড়া অংশ, কিছু হাড়ের টুকরো আর একটি নীলচে পাথরের মালা। বিভান হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “ঋজু, তুমি দেখেছ? এটা কোনো গল্প নয়, সত্যিই কেউ এখানে পুঁতে রাখা হয়েছে।” তখনই অভিক ছুটে এসে বলল, “দাদু এখন খুব খুশি। বলল আজ রাতে তোমাদের সঙ্গে কথা বলবে।” রাত নামতেই ঘরে ছড়িয়ে পড়ল এক শীতলতা, বাতাস নিঃশব্দে কেঁদে উঠল, আর ঘড়ির কাঁটা আটকে গেল রাত ১২:০১ এ। ‘দাদু’-র ছায়া আবার দরজার ফাঁক গলে ঢুকে পড়ল ঘরে, এবার প্রথমবার সে মুখ খুলল ঋজুর সামনে—“তোমরা খুঁজে পেয়েছ সত্যি, এবার আমার ঘুমের সময়।” এবং সেই সাথে একটি দীর্ঘশ্বাস যেন কালের গহ্বরে মিলিয়ে গেল—চিরতরে।

নয়

নৈহাটির সেই ‘কবরস্থান রোড’-এর নিঃসঙ্গতা যেন হঠাৎ করে আরও বেড়ে গিয়েছে। অভিক আর ঋজু বুঝতে পারছে, বিভান এখন আর শুধু খেলার ছলে কল্পনার দাদুর সঙ্গে কথা বলে না—সে যেন কোনো বাস্তব উপস্থিতির সঙ্গে মানসিকভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছে। গত কয়েকদিন ধরে তার ঘুম ভেঙে যায় মাঝরাতে, সে চিৎকার করে ওঠে—“দাদু বলছে, তোমরা আমাকে নিচে নিয়ে যাবে না!” এক রাতে, অভিক বিভানের ঘরে যায় চিৎকার শুনে, দেখে সে ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে অন্ধকারের দিকে আঙুল তুলে কিছু বলছে। অন্ধকার কোণটা ঠান্ডা, যেন হিমের মতো। সেদিনই অভিক ঠিক করে, রহস্যের গভীরে না গিয়ে উপায় নেই। পরদিন সকালে সে পুরোনো এলাকার বাসিন্দা এক প্রৌঢ়র সঙ্গে কথা বলে, যার নাম মিহির দত্ত। তিনি একসময় স্থানীয় পুরনো রেকর্ড রক্ষণাবেক্ষণের কাজে যুক্ত ছিলেন। মিহিরবাবু অভিককে জানালেন, কবরস্থান রোডে একসময় একটি শিশু আশ্রম ছিল, যেখানে যুদ্ধকালীন এক বৃদ্ধ স্বেচ্ছাসেবক বাচ্চাদের দেখাশোনা করতেন। কিন্তু আশ্রমটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যে সে বৃদ্ধ অস্বাভাবিক ভাবে নিখোঁজ হয়ে যায়—মৃতদেহ মেলেনি কখনও। তবে সেই ঘরেই পরে বহুবার শিশুরা ‘একজন সাদা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ’-কে দেখতে পেয়েছে বলে অভিযোগ করে। আশ্রমটি বহু বছর আগেই ভেঙে ফেলে বাড়িঘর তৈরি হয়—তাদের ভাড়ার বাড়িটিও সেই পুরনো কাঠামোর একাংশ।

ঋজু এ খবর শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, সে বিভানকে নিয়ে এক তান্ত্রিকের কাছে যায়, যিনি নামকরা হলেও একটু বিতর্কিত। সেই তান্ত্রিক শিশুটিকে দেখে বলেন—“ও এখন এক আত্মার সঙ্গে মানসিকভাবে জড়িয়ে গেছে, যে তাকে নিজের উত্তরসূরি ভাবছে। সেই আত্মা শান্ত নয়, মুক্তি পায়নি, তাই সে বিভানকে নিজের মতো করে রাখতে চাইছে।” তিনি কিছু মন্ত্র পড়ে কিছু তাবিজ দেন, এবং বাড়ির উত্তর কোণের একটা নির্দিষ্ট অংশে ধূপ জ্বালাতে বলেন সাত রাত ধরে। অভিক এসবকিছুকে পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও ছেলের জন্য সব করতে রাজি। তারা বাড়ি ফিরে রাতে ধূপ জ্বালিয়ে রাখে। প্রথম দুইদিন কিছু পরিবর্তন না হলেও তৃতীয় দিন থেকে বিভান যেন কিছুটা স্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে। কিন্তু ষষ্ঠ রাত, অর্থাৎ শনিবার, আবার বিভান গভীর রাতে চিৎকার করে ওঠে। ঘরে ঢুকে দেখে, বিছানায় বিভান নেই। চেয়ারের পাশে পড়ে আছে তাবিজ, আর জানলার পর্দা বাতাসে দুলছে।

দুজনেই ছুটে জানলার বাইরে তাকায়, কিন্তু কিছু দেখা যায় না। হঠাৎ তারা দেখে, সামনের কবরস্থান সংলগ্ন গাছের নিচে একটি সাদা পোশাক পরা অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে, আর তার সামনে বিভান—নীরব দাঁড়িয়ে, যেন মন্ত্রমুগ্ধ। মুহূর্তের মধ্যে অভিক দৌঁড়ে যায়, কিন্তু সেই অবয়ব মিলিয়ে যায় অন্ধকারে। বিভান কিছু বলতে পারে না, ঠোঁট কাঁপে। ওর হাতের তালুতে একটা ছাই রঙা দাগ পড়েছে—যেন কেউ আগুনে ছুঁয়ে দিয়েছে। ফিরে এসে ঋজু ভেঙে পড়ে, ওর মুখে কেবল একটাই কথা—“আমরা এই বাড়িতে আর একরাতও থাকবো না।” অভিক বুঝতে পারে, পরের পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে—কারণ বিভান কেবল ভয় পাচ্ছে না, সে আসলে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে অন্য কোনো অস্তিত্বের মধ্যে। সেই অস্তিত্ব, যেটা এখনও এই ‘কবরস্থান রোড’-এ ঘোরাফেরা করে—অমীমাংসিত এক অপেক্ষার ছায়ায়।

দশ

তীব্র গন্ধটা এবার আর সহ্য করা গেল না। অভিক গলা চেপে ধরে টয়লেটের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল, আর বিভান ওর পেছনে দাঁড়িয়ে থমকে গেছে। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল না, কেবল হালকা ঠেলতেই খুলে গেল। ভিতরে ঢুকেই গা শিউরে উঠল অভিকের। বেসিনের নিচে রক্তে ভেজা একটা পুরনো কাঠের ছিপি পড়ে ছিল, আর ওটার পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছেঁড়া শিশুর জামা। বিভান ফুঁপিয়ে উঠল, মা ঋজু তৎক্ষণাৎ ওকে বুকে টেনে নিল। অথচ, ঘরের বাকি অংশে কেউ নেই। যেন কেউ কেবলমাত্র কিছু চিহ্ন রেখে গেছে—কেউ যে এখানে এসেছিল, এবং আবার গায়েব হয়ে গেছে। অভিক জানত, এটা নিছক ভৌতিক কাণ্ড নয়, এখানে একটা মানবিক রহস্য আছে, এমন কিছু যা অন্ধকারের আড়ালে গুম হয়ে আছে বহু বছর ধরে। হঠাৎ ঘরের কোণ থেকে একটা ঠাণ্ডা হাওয়া এসে ওদের গায়ে লাগল, জানালা বন্ধ, তবুও যেন কোনো পুরনো আত্মা নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।

ঋজু বলল, “তুমি দেখেছো বিভান কাকে ‘দাদু’ বলে ডাকছে? আমি বারবার জিজ্ঞেস করেছি, ও শুধু বলে ‘ওই যে… কবরের দাদু’। এই টয়লেটের জানালার পাশের ওই পুরনো কবরটা, ঠিক সেখানেই বসে ওর সঙ্গে কথা বলে সেই বৃদ্ধ লোকটা। বিভান বলেছিল, দাদু নাকি অনেক গল্প বলেন, আর ওকে নিয়ে নাকি খেলতে চায়।” অভিক সিগারেট ধরাল, আর জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঋজু, আমরা এটা বুঝতে পারছি না—এটা কেবল আত্মার উপস্থিতি নয়, এখানে কোন দুঃখবোধ, কোন অপরাধ চাপা পড়ে আছে, যেটা এখন এই শিশুটার সঙ্গে যোগাযোগ করছে।” সেই রাতে অভিক একা বারান্দায় বসে ছিল। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ও শুনতে পেল শিশুর কণ্ঠস্বর, আরেকটি ভিন্ন স্বরও, যেন গভীর এক কণ্ঠে ফিসফিসানি—“আমাকে মাফ করো… আমি চাইনি…”। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, কেউ নেই। অথচ সেই মুহূর্তে, আকাশে যেন মেঘ জমে আসে, হালকা বৃষ্টি নামে, আর কবরস্থান পেছন থেকে একটা হারমোনিয়ামের সুর ভেসে আসে—পুরনো দিনের কোনো মেলোডি।

পরদিন সকালে অভিক সিদ্ধান্ত নেয়, সে সরাসরি পুরনো রেকর্ড ঘেঁটে বের করবে বাড়িটার ইতিহাস। পুরসভার নথিপত্র ঘেঁটে, পৌর পাঠাগারে গিয়ে বহু পুরনো খবরের কাগজে সে যা খুঁজে পায়, তা যেন বিশ্বাসের অতীত। এই বাড়ির জায়গাতেই আগে ছিল একটি বৃদ্ধাশ্রম—নাম ছিল ‘শান্তি নিবাস’। ১৯৭৫ সালে রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ডে মারা যান আটজন বৃদ্ধ। তাদের দেহ উদ্ধার করা গিয়েছিল বাথরুমের পাশের সেই জায়গা থেকেই, যেটা এখন টয়লেট। প্রতিবেশীরা অভিযোগ জানিয়েছিল, বৃদ্ধাশ্রমের ম্যানেজার জয়নাল সরকার তৎকালীন সরকারী অনুদান আত্মসাৎ করত আর বৃদ্ধদের প্রতি অমানবিক অত্যাচার করত। সেই জয়নাল পালিয়ে যায় অগ্নিকাণ্ডের পর, আর বৃদ্ধাশ্রমটি বন্ধ হয়ে যায়। ওই আট বৃদ্ধের একজন ছিলেন বিনোদ ঘোষাল—অন্ধ, নির্জন, যিনি বিভানকে আজ ‘দাদু’ হিসেবে দেখা দেন। সে সময়কার একটা খবরের ফটোকপি এনে ঋজুকে দেখাল অভিক, যেখানে বিনোদের ছবির নিচে লেখা—”শেষ ইচ্ছা ছিল, যেন মৃত্যুর পরও কেউ গল্প শোনে তার”। এই বক্তব্যটা পড়ে দুজনে স্তব্ধ হয়ে যায়। ঘরের ভেতর বিভান তখন টুকটুক করে ছবি আঁকছে—এক বৃদ্ধ, এক শিশু আর একটা কবর।

 

1000045413.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *