সায়ন দত্ত
অয়ন ছোটবেলা থেকেই ভূতের গল্পের প্রতি অদ্ভুত এক আকর্ষণ অনুভব করত। অন্ধকার ঘর, কাঁপতে থাকা মোমবাতি আর দাদুর মুখে শোনা অলীক কাহিনিই যেন তার ভিতরে কৌতূহলের বীজ বুনে দিয়েছিল। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই কৌতূহল রূপ নিল এক নতুন রূপে—একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটরের উচ্চাকাঙ্ক্ষায়। তার ইউটিউব চ্যানেল “ভুতের সত্যি কাহিনি” খুব দ্রুত জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে, কিন্তু অয়ন জানে শুধু সাধারণ গল্প দিয়ে আর কাজ হবে না। দর্শকরা চাইছে কিছু ব্যতিক্রম, কিছু ভয়ঙ্কর অথচ বাস্তব মনে হয় এমন অভিজ্ঞতা। দিনরাত সে ল্যাপটপের পর্দায় বসে খুঁজতে থাকে কোথায় কী রহস্যময় জায়গা আছে, কারা সত্যিই ভুত দেখেছে, অথবা কোন অন্ধকার ইতিহাস আজও মানুষের মনে আতঙ্ক জাগিয়ে রাখে। সেই খোঁজেই সে আবিষ্কার করে শহরের প্রান্তে এক পুরনো কবরস্থান, যার নাম উচ্চারণ করতেই স্থানীয়রা আঁতকে ওঠে। কথিত আছে সেখানে মৃতরা নাকি শান্তিতে ঘুমাতে পারে না—প্রতি পূর্ণিমার রাতে কবরগুলোর পাশে নাকি মানুষ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। এই কাহিনি অয়নকে আরও উত্তেজিত করে তোলে। সে ভাবে, যদি সত্যিই সেখানে গিয়ে সরাসরি লাইভ করা যায়, তাহলে তার চ্যানেল রাতারাতি অন্য মাত্রায় চলে যাবে। তার চোখে তখন শুধু সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা, ভিউ কাউন্ট আর সেই সঙ্গে ফ্যানদের চিৎকার—“অয়ন, তুই অসাধারণ!”—এইসব কল্পনা যেন তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।
কিন্তু এই ভাবনাটাই তৃষার কাছে অদ্ভুত এবং বিপজ্জনক মনে হয়। তৃষা ছোটবেলা থেকে অয়নের বন্ধু, তার সঙ্গে হাসি, কান্না, রাগ সবকিছু ভাগ করে এসেছে। অয়ন যখনই নতুন কোনো কনটেন্ট বানাতে যায়, তৃষাই তার সবচেয়ে কাছের সমর্থক এবং কখনও কখনও কঠোর সমালোচকও। এবারও তৃষা ঠান্ডা মাথায় বোঝাতে চেষ্টা করল—“অয়ন, কবরস্থান নিয়ে এত খেলছিস কেন? এসব জায়গায় মানুষ এমনি এমনি যায় না। তুই যা করছিস সেটা বিনোদন নয়, বিপদ ডেকে আনছিস।” অয়ন হেসে উড়িয়ে দিল, তার চোখে যেন ভয় বা দ্বিধার কোনো অস্তিত্ব নেই। বরং সে পাল্টা বলল—“দেখিস, এই লাইভটা হবে আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। মানুষ তখন আর আমাকে ইউটিউবার বলবে না, বলবে প্রমাণকারী। সত্যিই যদি কিছু থাকে, সেটা আমি দেখাব।” তৃষা বিরক্ত হল, কিন্তু অয়নের একগুঁয়েমি সে আগেও দেখেছে। জানে যখন ওর মাথায় কিছু ঢোকে, তখন কাউকে শোনে না। তৃষার ভেতরে এক অদ্ভুত আশঙ্কা দানা বাঁধলেও বন্ধুকে একা ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে তার নেই। সে ভাবে—যত ভয়ই থাকুক, অয়নের পাশে থাকা উচিত। হয়তো তার উপস্থিতিতেই অয়ন সীমা অতিক্রম করবে না।
তবে এই সময়ের মধ্যে অয়ন তার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। ক্যামেরা, ট্রাইপড, ওয়্যারলেস মাইক্রোফোন, এক্সট্রা ব্যাটারি—সবকিছু সে গুছিয়ে রাখছে। প্রতিটি যন্ত্র তার কাছে একেকটা অস্ত্র, যার মাধ্যমে সে প্রমাণ করবে—অলৌকিক জগতের সত্যিই অস্তিত্ব আছে। তৃষা দেখছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভয় পাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে অয়ন যেন ধীরে ধীরে এমন এক খেলায় পা দিচ্ছে যেখানে জিতলেও হার, হারলেও হার। সে যখন অয়নকে শেষবার বোঝানোর চেষ্টা করে, অয়ন হেসে বলে—“ভয় পাবি না তৃষা, মানুষই ভয় পায়, আমি নয়। ভয় যদি তোর ভেতরে ঢুকতে দিস, তখনই সে তোকে জয় করবে। আমি ভয়কে জয় করব।” কথাগুলো শোনার পর তৃষার শরীর শিউরে ওঠে, কারণ এই আত্মবিশ্বাসের আড়ালে সে স্পষ্ট বুঝতে পারে এক ভয়ংকর বেপরোয়া দিক লুকিয়ে আছে। সেদিন রাতের আকাশে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, দূরে বাতাসে কুকুরের হাহাকার, আর ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল—যেন সময়ও থমকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল এক অজানা যাত্রার। তৃষা জানত, তারা এক অন্ধকারের পথে পা বাড়াতে চলেছে, যেখানে কেবল কনটেন্টের খোঁজ নয়, হয়তো আরও কিছু তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
–
অয়ন তার ঘরের টেবিলে বসে ছোট ছোট বাক্স খুলে একে একে সরঞ্জাম বের করছে। তার চোখে এক ধরনের উত্তেজনার ঝিলিক—ক্যামেরার লেন্সে আঙুল চালিয়ে পরিস্কার করা, ট্রাইপড ঠিক করে দাঁড় করানো, মাইক্রোফোনে নতুন ব্যাটারি বসানো, সবই যেন কোনো যুদ্ধের আগে সৈনিকের অস্ত্র মজুত করার মতো। ঘরটা ভরে উঠেছে আলো-আঁধারির খেলা, একদিকে ল্যাপটপের নীল স্ক্রিন জ্বলছে, অন্যদিকে টেবিল ল্যাম্পে হালকা হলুদ আভা ছড়িয়ে পড়ছে। অয়ন বারবার তার স্ক্রিপ্ট লিখে, মুছে আবার নতুন করে সাজাচ্ছে—কীভাবে শুরু করবে, দর্শকদের কীভাবে আকৃষ্ট করবে, কোথায় ভয়ঙ্কর টুইস্ট দেবে। তার মন পুরোপুরি ব্যস্ত কনটেন্টের খুঁটিনাটি নিয়ে। এদিকে তৃষা এক কোণে বসে চুপচাপ দেখছে। ওর মুখে অস্বস্তি আর চোখে দ্বিধা স্পষ্ট। বারবার মনে হচ্ছে, এই প্রস্তুতির মাঝেই যেন একটা অশুভ শক্তি ঘাপটি মেরে বসে আছে। তৃষা হালকা কণ্ঠে বলল—“অয়ন, সত্যিই কি আমাদের এটা করা উচিত? ভিউ পাওয়ার জন্য এতদূর যাওয়াটা কি সঠিক?” অয়ন হেসে তাকাল, বলল—“তুই বুঝবি না তৃষা, এটা শুধু ভিউয়ের জন্য নয়, সত্য প্রমাণের জন্য। আমি চাই মানুষ জানুক এই দুনিয়ায় শুধু আলো-ঝলমলই নেই, অন্ধকারও আছে।”
তৃষা তর্ক করতে গিয়েও থেমে যায়, কারণ জানে অয়নকে এখন আর ফেরানো যাবে না। তবে তার ভেতরে যে ভয় জমছে, সেটা সে লুকোতে পারছে না। যখন অয়ন বলে—“আজ রাতে আমরা ইতিহাস গড়ব”—তখন তৃষার মনে হয় ইতিহাস নয়, বরং তারা হয়তো নিজেদের ভাগ্যকেই বদলে ফেলতে চলেছে। সে চুপচাপ অয়নকে সাহায্য করতে থাকে—ক্যামেরা ব্যাগে তার, লাইট, পাওয়ার ব্যাংক ভরে দেয়, কিন্তু তার হাত বারবার কেঁপে ওঠে। মনেই মনে সে ভাবে, এ কাজটা যদি আজ কোনো কারণে বন্ধ হয়ে যেত! অয়ন আবার ল্যাপটপে বসে কবরস্থানের ইতিহাস খুঁজে দেখছে। সে জানতে পারে, ওই কবরস্থান একসময় শহরের উপকণ্ঠে একটি যুদ্ধক্ষেত্র ছিল, যেখানে শত শত অজানা সৈন্য দাফন করা হয়েছিল। স্থানীয় মানুষজন বিশ্বাস করে, সেই সৈন্যদের আত্মা এখনও ঘুরে বেড়ায়। “একটা অসাধারণ লোকেশন,” অয়ন চোখ উজ্জ্বল করে বলে। “ভাব, ওই কবরগুলোর পাশেই যদি আমি লাইভ করি, দর্শকেরা পাগল হয়ে যাবে।” তৃষা গলা শুকিয়ে বলে—“হ্যাঁ, পাগল তো হবেই, কিন্তু আমাদের জন্য সেটা ভালো হবে নাকি খারাপ, কে জানে?” তার কণ্ঠে আতঙ্ক থাকলেও অয়ন সেটাকে গুরুত্ব দেয় না। তার কাছে ভয় মানেই প্রচারণা, আর প্রচারণা মানেই সাফল্য।
প্রস্তুতি শেষ হলে তারা বেরোনোর কথা ভাবে, কিন্তু যাওয়ার আগে তৃষা শেষবারের মতো আপত্তি তোলে। সে অয়নকে বলে—“শোন, আমি তোকে আটকাচ্ছি না, কিন্তু অন্তত কাউকে জানিয়ে যাওয়া উচিত আমরা কোথায় যাচ্ছি। যদি কোনো বিপদ হয়…” অয়ন বিরক্ত হয়ে বলে—“তুই সিনেমার মতো ভাবছিস। কিছু হবে না। আমি আছি, ক্যামেরা আছে, সব ঠিক থাকবে।” তৃষা আর কিছু বলে না, তবে তার বুকের ভেতর অদ্ভুতভাবে ধুকপুক করতে থাকে। তারা যখন বেরোতে প্রস্তুত হয়, বাইরে তখন রাত নামতে শুরু করেছে। আকাশ অন্ধকার, বাতাসে ভেজা মাটির গন্ধ, দূরে কুকুরের হাহাকার শোনা যাচ্ছে। গ্রামের মানুষজন এই সময় ঘরের বাইরে বেরোয় না, কিন্তু তবু কয়েকজন বৃদ্ধ যখন দেখল অয়ন-তৃষা হাতে ক্যামেরা-লাইট নিয়ে বেরোচ্ছে, তখন মুখ ফসকে বলে উঠল—“ঐ দিকে যেও না বাবা, ওখানে কেউ ফিরে আসে না।” কথাটা তৃষার শরীর শিউরে তোলে। অয়ন অবশ্য পাত্তা দেয় না, বরং হাসতে হাসতে বলে—“লোকজন সব ভয় পেয়ে গেছে, এটাই তো আমাদের কনটেন্টকে আসল করে তুলবে।” গ্রামের মানুষদের আতঙ্ক আর আশীর্বাদের মাঝেই তারা যাত্রা শুরু করে, কিন্তু অন্ধকারে এগোনোর আগ মুহূর্তে তৃষার মনে হচ্ছিল যেন রাতটা চুপচাপ তাদের গিলে ফেলতে অপেক্ষা করছে।
–
মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা তাদের চারপাশকে ঘিরে ধরে, যেন পৃথিবীটা হঠাৎ সব শব্দ বন্ধ করে দিয়েছে। অয়ন তার কাঁধে ব্যাগটিকে শক্ত করে ধরে, আর তৃষা ধীরে ধীরে তার পাশে হাঁটে, চোখে অদ্ভুতভাবে বিরক্তি আর ভয়ের মিশ্রণ। বাতাসে অদ্ভুত ঠান্ডা, যা শুধু শীত নয়, বরং এমন এক প্রেতাত্মার মতো শীত, যা মাংসের ভেতর গলিয়ে ঢুকে যায়। তারা গ্রামের প্রান্তের ধুলোয় ঢাকা রাস্তা ধরে এগোতে থাকে, যেখানে পুরনো পাথরের দেয়াল এবং পাকা গাছের ছায়া রাতে তাদের পথকে আরও অজানা করে তোলে। অয়ন ক্যামেরা পরীক্ষা করতে থাকে, যেন লাইট আর মাইক্রোফোন ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা। প্রতিটি পায়ের ধ্বনিতে তাদের শরীর যেন আরও সতর্ক হয়ে ওঠে। তৃষা মাঝে মাঝে অল্পস্বরে শ্বাস ফেলে, যেন অজান্তে তার ভীতি বাইরে বের হচ্ছে। তারা একে অপরের দিকে অচেতনভাবে তাকায়, কিন্তু কেউই মুখ খুলে ভয় প্রকাশ করতে চায় না। রাতের অন্ধকার তাদের একে অপরের উপস্থিতি ছাড়া যেন আর কেউ নেই বলে মনে করাচ্ছে।
পথের একেবারে মধ্যভাগে, হঠাৎই তাদের চোখে পড়ে কবরস্থানের প্রবেশদ্বারের পাশে এক বৃদ্ধাকার ব্যক্তি, যার চেহারায় কড়া দৃষ্টির ছাপ। তার চোখ যেন অন্ধকারের সাথে মিশে গেছে, আর দেহটি ঠিক ততোটাই দৃঢ় যে, হঠাৎ মনে হয় তিনি একেবারেই মানুষ নন, বরং অমর কোনো রক্ষক। তিনি ধীর কণ্ঠে বলেন, “এখানে কেউ লাইভ করে না… সাবধান!” এই শব্দগুলো বাতাসে ভেসে উঠে, যেন ঘোরালেখার মতো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। অয়ন ও তৃষা হকচকিয়ে তাকায়; তাদের হৃদস্পন্দন হঠাৎ বেড়ে যায়। ক্যামেরার লেন্সে বৃদ্ধটির ছবি তুলে রাখার জন্য অয়ন হাত এগিয়ে দেয়, কিন্তু বৃদ্ধটি অচঞ্চল থাকে। তৃষার দৃষ্টি বৃদ্ধটির চোখে আটকে যায়—একটানা তাকিয়ে থাকা চোখগুলো যেন তাদের গভীর রহস্যের দিকে টেনে নিচ্ছে। চারপাশে কেবলমাত্র নীরবতা, কেবল অন্ধকার এবং দূরে কোথাও ভেসে আসা অচেনা কানের আওয়াজ। তারা বুঝতে পারে, এটি কোনো সাধারণ রাত নয়; এটি এমন এক রাত, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ তাদের অজানা বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
যাত্রা চলতে থাকে, কিন্তু কবরস্থানের নীরবতা এবং সেই বৃদ্ধকের সতর্কবার্তা তাদের মনকে বারবার ঘিরে ধরে। অয়ন ক্যামেরা ধরে রাখে, যেন প্রতিটি মুহূর্ত সংরক্ষণ করা যায়, আর তৃষা পিছুটান দেয় না, তবে ভেতরে ভয়ের অনুভূতি ক্রমেই বেড়ে যায়। তারা একত্রে ছোট ছোট আলাপ করে, যেন ভয়কে কমিয়ে আনা যায়, কিন্তু শব্দের মাঝে কেবল নিজেদের নিশ্বাস আর ধুলো ওঠা পথের আওয়াজই শুনতে পায়। পথের বাঁকে বাঁকে গাছের ছায়া তাদের দিকে ঝুঁকে আসে, আর হঠাৎ মনে হয় কেউ তাদের চোখে চোখ রেখেছে। অয়ন তৃষাকে পাশে টেনে নেয়, যেন তার উপস্থিতি তাকে সাহস দেয়। তারা জানে, প্রতিটি মুহূর্তে কবরস্থানের গোপন রহস্য তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, এবং সেই রহস্যের মুখোমুখি হতে হলে তাদের সজাগ থাকতে হবে। রাতের নিস্তব্ধতায়, কেবল তাদের পদক্ষেপ এবং দুর্দান্ত এক অজানা ভয়ের ছায়া তাদের পথকে চিহ্নিত করছে, আর অয়ন-তৃষা ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, এই রাতের যাত্রা কেবল শুরু, এখান থেকে তাদের আসল পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে।
–
অয়ন গভীর শ্বাস নেন, ক্যামেরার লেন্সে নিজের মুখটি ঠিক মতো ফ্রেমে আনেন এবং হঠাৎ ক্যামেরা চালু করে “ভুতের সত্যি কাহিনি” লাইভ শুরু করেন। স্ক্রিনে অন্ধকার ঘরের ছবি ছড়িয়ে পড়ে, বাতাসের হালকা নড়াচড়া, পাতার শব্দ, এবং দূরের কোনো অজানা আওয়াজের সঙ্গে মিলে দর্শকরা কৌতূহলপূর্ণভাবে অপেক্ষা করতে থাকে। প্রথম মুহূর্তগুলোতে কিছুই ঘটছিল না; কেবল অয়ন আর তৃষার নীরবতা, বাতাসের ফিসফিস শব্দ এবং ক্যামেরার ছোট ছোট লেন্সে প্রতিফলিত তাদের দারুণ উত্তেজনা। তৃষা বারবার অয়নের কাঁধে হাত রাখে, ভয়কে অনুভব করানোর চেষ্টা করে এবং বলে, “বন্ধ করো, এটা ঠিক হবে না।” কিন্তু অয়ন শুধু তার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসে, যেন ভয়কে পাত্তা না দিয়ে তিনি এক নতুন জগতের দরজা খুলছেন। দর্শকের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যেতে থাকে, লাইভ চ্যাটে প্রশ্ন, মন্তব্য এবং উৎসাহের ছোট ছোট বার্তা ভেসে ওঠে। অয়ন নিজের ভয়ের সঙ্গে লড়াই করে, ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ব্যাখ্যা করতে থাকে কিভাবে তারা কবরস্থানে এসেছেন, কেন এই রাতটি বিশেষ এবং কোথায় তারা প্রথমে প্রবেশ করেছেন।
প্রথমদিকে কোনও অদ্ভুত ঘটনা ঘটেনি, কিন্তু অয়ন নিজের কণ্ঠের স্বর এবং কথার মাধ্যমে দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে থাকেন। তৃষা এখনও অচঞ্চল, চোখে অদ্ভুত উদ্বেগ; সে প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ছায়া এবং প্রতিটি বাতাসের দুলকে ভয় হিসাবে গ্রহণ করছে। অয়ন এই ভয়কে উপেক্ষা করে, প্রতিটি মুহূর্তকে একটি গল্পের অংশ হিসেবে লাইভে তুলে ধরছে। হঠাৎ ক্যামেরার কোণে কিছু অজানা ছায়া দেখা যায়, যা অয়ন প্রথমে চিন্তাভাবনা ছাড়া উপেক্ষা করে। তৃষা সরাসরি তাকিয়ে চিৎকার করতে চায়, কিন্তু জানে যে লাইভ চলছে, এবং এই ভয়ের মুহূর্তটি দর্শকেরা প্রথম হাতেই দেখতে পাবে। দর্শকদের চ্যাটে উচ্ছ্বাস, চমক এবং অবিশ্বাসের মিশ্রণ আসে, এবং অয়ন একটুও দমে যায় না; বরং এটি তাকে আরও উৎসাহিত করে। প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ছায়া যেন লাইভের নাটকীয়তা বাড়াচ্ছে, এবং অয়ন নিজেকে সাহসী প্রমাণ করার মতো অনুভব করছে।
হঠাৎই, তাদের চারপাশে বাতাসের একটি শক্ত হালকা ধাক্কা আসে, যেন কেউ বা কিছু তাদের পাশে উপস্থিত। তৃষা কাঁপতে থাকে, কিন্তু অয়ন ক্যামেরা ধরে রাখে এবং পুরো দৃশ্য লাইভে ধারণ করে। দর্শকরা চ্যাটে শিহরণ অনুভব করছে, কেউ লিখছে “দেখছি কেউ ছায়া দেখেছে কি?”, কেউ আবার ভয়ের সঙ্গে মন্তব্য করছে “এটা কি সত্যি?”। অয়ন জানে যে এই ভয় দর্শকদের মুগ্ধ করছে, এবং সে সাহসীভাবে এগোতে থাকে, ক্যামেরার দিকে বারবার তাকিয়ে বলে কিভাবে তারা কবরস্থানে ঢুকেছেন, এবং কেন রাতের এই নিস্তব্ধতা রহস্যময়। তৃষা ক্রমেই বুঝতে পারে যে অয়নের উদ্দীপনা এবং ভয়কে উপেক্ষা করার ক্ষমতা তাদের লাইভকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। রাতের অন্ধকার, কবরস্থানের নীরবতা, অজানা ছায়া এবং দর্শকদের উত্তেজনা—সব মিলিয়ে প্রথম লাইভটি তাদের জন্য এক অপরূপ অভিজ্ঞতায় রূপ নেয়।
–
ক্যামেরার লেন্সে হঠাৎ অজানা কিছু দৃশ্য ধরা পড়ে। কবরের পাশের কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকারে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে, তাদের আকার-আকৃতি প্রায় মানুষের মতো, কিন্তু কিছুতেই সাধারণ মানুষের সরলতা নেই। তারা যেন স্থির, যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। অয়ন প্রথমে মনে করে হয়তো কেউ মজা করছে—শুধু একটি নেশার খেলা বা প্রতারণা। সে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলে, “দেখো, সম্ভবত কেউ আমাদের ছবি তুলছে বা ঘোরানো চেষ্টা করছে। বেশি ভয় পাওয়ার কিছু নেই।” তৃষা তাত্ক্ষণিকভাবে অয়নের দিকে তাকায়, কিন্তু তার চোখে ভয় এবং অস্বস্তির ছাপ স্পষ্ট। সে বুঝতে পারে যে এই ছায়ারা শুধু অচেনা মানুষ নয়; তাদের চোখ, তাদের মুখভঙ্গি, তাদের নিঃশ্বাস—সবকিছু অস্বাভাবিক। মুখগুলো যেন হাসছে, কিন্তু হাসি নয়, বরং এক অজানা ধরনের ব্যথা এবং বিরক্তি মিশ্রিত ভয় প্রকাশ করছে। হঠাৎ বাতাসে অদ্ভুত শীতলতা ছড়িয়ে পড়ে, যা তাদের চারপাশের বাতাসকে আরও ঘন এবং ভীতিকর করে তোলে।
অয়ন ক্যামেরার লেন্স ঘুরিয়ে এদের দিকে দেখানোর চেষ্টা করে, যেন দর্শকরা নিজেও নিশ্চিত হতে পারে যে কিছু হচ্ছে। কিন্তু যতবার সে লেন্স ঘোরায়, ছায়ারা যেন আরও স্থির হয়ে দাঁড়ায়, তাদের চোখ কেবল অয়নের দিকে নয়, বরং সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকে। তৃষা একটুও দমে যায় না; তার শরীরে এক অদ্ভুত কম্পন ছড়িয়ে পড়ে। সে অয়নের হাতে হালকা চাপ দিয়ে চুপ করে বলতে চায়—“এরা মানুষ নয়।” কিন্তু অয়ন অনড়, সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে চায় যে এটি শুধুই দৃশ্যকল্প, কোনো কারসাজি বা কেউ আড়ালে লুকিয়ে বসে তাদের ভয় দেখাচ্ছে। তৃষা ক্রমেই উপলব্ধি করে, এই ছায়াগুলো বাস্তব, আর তারা তাদের উপস্থিতি থেকে এক মুহূর্তের জন্যও সরতে চায় না। বাতাসের ফিসফিস, পাতার নড়াচড়া এবং ছায়াদের স্থিরতা—সব মিলিয়ে একটি ভয়ঙ্কর আবহ তৈরি করেছে যা অয়নও উপেক্ষা করতে পারছে না, যদিও সে নিজের সাহসকে দৃঢ় দেখানোর চেষ্টা করছে।
যখন তারা কবরের পাশে আরও কাছে আসে, অয়ন লক্ষ্য করে যে তাদের শরীরের আকৃতি সম্পূর্ণ মানুষের মতো, কিন্তু আচরণ একেবারেই অমানবিক। তাদের চোখ, মুখভঙ্গি, হাতের অঙ্গভঙ্গি—সবকিছুই অস্বাভাবিক। তৃষা বোঝে যে তারা তাদের দিকে অব্যাহতভাবে নজর রাখছে, তাদের প্রতিটি পদক্ষেপকে পর্যবেক্ষণ করছে। দর্শকরা লাইভে চ্যাটে উত্তেজনা প্রকাশ করছে, কেউ লিখছে “এরা কি আসলেই মানুষ?” কেউ আবার কৌতূহল প্রকাশ করছে “এই ভিডিও খুবই ভীতিকর।” অয়ন এখন উপলব্ধি করে যে এটি শুধুই খেলা বা মজা নয়, কিছু ভিন্ন, কিছু অজানা। ছায়াগুলো যেন লাইভের মাধ্যমে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়, আর অয়ন ও তৃষা ক্রমেই বুঝতে শুরু করে যে কবরস্থানের রাতের রহস্য কেবল শুরু; এই ছায়ারা তাদের যাত্রার পথকে আরও কঠিন এবং বিপদজনক করে তুলতে এসেছে।
–
ক্যামেরার জুম ফাংশন চালু করার সঙ্গে সঙ্গেই অয়ন লক্ষ্য করে ছায়া-দর্শকদের চোখে কোনো আলোর ছায়া নেই। তাদের চোখ যেন শূন্য, নিঃসঙ্গ, এক অনন্ত অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে অদ্ভুত স্থির হাসি, হাসি নয়, বরং এমন এক অমীমাংসিত চেহারার প্রকাশ, যা দেখতে অদ্ভুতভাবে অস্বাভাবিক। অয়ন প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে চায়, মনে মনে ভাবছে হয়তো ক্যামেরার লেন্স কিছু বিকৃত দেখাচ্ছে বা আলো ঠিকভাবে পড়ছে না। কিন্তু তৃষা, যার ভয় ইতিমধ্যেই বাড়ছে, সে কাঁপতে কাঁপতে ক্যামেরার স্ক্রিনের দিকে তাকায়। তার হাত অজান্তে অয়নের হাত ধরেছে, এবং সে ধীরে ধীরে realizes করে যে এরা কোনো সাধারণ মানুষ নয়। বাতাস হঠাৎ স্তব্ধ, চারপাশের সব শব্দ যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে, এবং শুধু তাদের নিশ্বাসের আওয়াজ এবং দেহে ছড়িয়ে থাকা কম্পন বাকি থাকে। তৃষার চোখের সামনে এই ছায়াগুলো যেন সরাসরি তার ভয়কে খুঁজে বের করছে, প্রতিটি হাসি, প্রতিটি চাহনি যেন তার মনের ভেতরের দুর্বলতাকে লক্ষ্য করছে।
অয়ন চেষ্টা করে চ্যাটে মন্তব্য লিখে দর্শকদের জিজ্ঞেস করতে—“এরা আসলেই লাইভ দেখছে কি?” কিন্তু এক অদ্ভুত এবং অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে। লাইভ চ্যাটে আসা একমাত্র লাইন হলো—“আমরা আছি, তুইও থাকবি।” অয়ন কিছুটা হতবাক হয়, প্রথমে মনে হয় এটি কেউ মজা করছে, কেউ কি তার লাইভের কমেন্ট বক্সে হ্যাক করেছে। কিন্তু তৃষার চোখে অন্ধকারের গভীর ভয় তাকে জানায়, এটি কোনো সাধারণ মজা নয়। তার দেহ কেঁপে ওঠে, হাত অচেতনভাবে তার বুকের দিকে যায়, আর অয়নও অনুভব করে যে তাদের চারপাশে এক অদৃশ্য শক্তি ঘোরাফেরা করছে। ক্যামেরার ফ্রেমে যত ঘনভাবে ছায়াগুলো দেখা যায়, ততই তাদের উপস্থিতি বাস্তবের চেয়ে আরও ভীতিকর মনে হয়। অয়ন, সাহসকে ধরে রাখার চেষ্টা করে, মুখে হালকা হাসি ধরে রাখে এবং বলে, “আমরা তো সবাই এখানে আছি, তাই না?” কিন্তু তার কণ্ঠস্বরও কম্পনের মধ্য দিয়ে ফিসফিস করছে।
ছায়াগুলো ক্রমেই তাদের চারপাশে ঘন হয়ে আসে। অয়ন ক্যামেরা ঘুরিয়ে প্রায় প্রতিটি কোণ চেপে ধরে, কিন্তু প্রতিটি কোণ থেকে একই চেহারা ফিরে আসে—শূন্য চোখ, স্থির হাসি, কোনো শব্দহীন ধাক্কা। তৃষার হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, তার শরীর কেঁপে উঠছে, আর চোখ দিয়ে অজান্তে অশ্রু ঝরে। অয়ন চায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে, লাইভ দর্শকদের সচেতন করতে, কিন্তু চ্যাটে আর কোনো মন্তব্য আসছে না; শুধু সেই একক লাইন ঘুরপাক খাচ্ছে, যেন তাদের উপস্থিতি আরও শক্তিশালী এবং ভয়ঙ্কর প্রমাণিত করতে চায়। তারা বোঝে, কেবল ক্যামেরার মাধ্যমে নয়, এই ছায়ারা তাদের বাস্তবেও নজর রাখছে, তাদের মনস্তত্ত্বে প্রবেশ করছে। রাতের নিস্তব্ধতা, কবরস্থানের অন্ধকার এবং এই ছায়াদের অচেনা উপস্থিতি মিলিয়ে এমন এক ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করছে, যা অয়ন ও তৃষাকে এক ধরনের সত্যের ফাঁকফোকরের মধ্যে ফেলে দিয়েছে—যেখানে বাস্তব আর অজানা ভয়ের মধ্যে লাইন এতই অস্পষ্ট যে, তারা কোথায় সুরক্ষিত এবং কোথায় বিপদ তা বোঝা কঠিন হয়ে উঠেছে।
–
হঠাৎ অন্ধকারের গভীরতা থেকে কবররক্ষক হাজির হন, যেন রাতের অন্ধকারের সঙ্গে একাকার হয়ে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেছেন। তার চোখ কড়া, দৃষ্টি ধারালো, এবং শরীরের ভঙ্গি একেবারেই অচঞ্চল। হঠাৎ তিনি চিৎকার করেন—“ক্যামেরা বন্ধ কর! এরা আসল নয়!” শব্দটি বাতাসে ফেটে পড়ে, যেন কবরস্থানের নিস্তব্ধতাকে ছিঁড়ে দিয়ে তাদের মনে এক ধরনের আতঙ্কের ঢেউ জাগিয়ে দেয়। অয়ন স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়ায়, ক্যামেরা অজান্তেই ঝুলে যায় তার হাতে। সে চেষ্টা করে নিজের যুক্তি খুঁজে বের করতে—কীভাবে এমন কিছু সম্ভব হতে পারে, তারা কি সবাই ছায়া দেখছে, নাকি কেবল তার চোখে ভয় সৃষ্টি হয়েছে। তৃষা এই মুহূর্তে অদ্ভুতভাবে ধীর এবং স্থির, তার কণ্ঠে কম্পন আছে, কিন্তু সে দৃঢ়ভাবে চিৎকার করে বলে, “অয়ন, লাইভ থামাও, আমরা জানি এটা ঠিক নয়।” কিন্তু অয়ন, নিজের সাহসিকতাকে ধরে রাখতে চেষ্টার মধ্যে, কেবল চোখ মেলেই কেবল তার আশেপাশের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কিছুক্ষণ শূন্য স্থিরতা বিরাজ করে, ঠিক তখনই ছায়ারা ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগোতে শুরু করে। তারা যেন অচেনা ও অবাস্তব, কিন্তু প্রত্যেকটি পদক্ষেপ তাদের ভয়কে আরও প্রগাঢ় করে তোলে। অয়ন ক্যামেরার লেন্স ঘুরিয়ে চেষ্টা করে তাদের ছবি ধরে রাখতে, যেন দর্শকরা পুরো দৃশ্য দেখেন। কিন্তু তৃষা জানে, এটি কেবল ক্যামেরার মাধ্যমে সীমিত নয়; ছায়াগুলো তাদের চারপাশে প্রতিটি কোণে ঘন হয়ে এসেছে, এবং প্রতিটি চোখ তাদের দিকে অশ্রদ্ধা নয়, বরং এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপে রাখছে। কবররক্ষক অচঞ্চল, দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখ অয়নকে বারবার সতর্ক করে, যেন তিনি জানাচ্ছেন—এই রাতের যাত্রা সহজ নয়, এবং এই ছায়াগুলো আসল নয়, তবে বিপজ্জনকভাবে বাস্তব। তৃষার হাত কাঁপতে থাকে, সে অয়নের কাঁধে হালকা চাপ দেয়, যেন বোঝাতে চায়—এখনই থামো। কিন্তু অয়ন, যিনি লাইভের জন্য আগ্রহী এবং নিজের সাহস প্রমাণ করতে চাচ্ছেন, সে ভয়কে অজানা করে সামনে এগোতে থাকে।
ছায়াগুলো ক্রমেই আরও কাছে আসে, তাদের চোখে শূন্যতা, মুখে অদ্ভুত স্থির হাসি, এবং নিঃশব্দ উপস্থিতি যেন অয়ন ও তৃষার মনে ভয় সৃষ্টি করছে। বাতাস হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়, প্রতিটি শব্দ নিঃশব্দের মধ্যে মিলিত হয়, আর কেবল তাদের নিশ্বাস ও হৃদস্পন্দন শোনা যায়। কবররক্ষকের সতর্কবার্তা, ছায়াদের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি এবং অন্ধকারের অচেনা গভীরতা মিলিয়ে এক অদ্ভুত এবং ভীতিকর আবহ তৈরি করে। অয়ন বিভ্রান্ত এবং দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে, সে জানে যে তার যাত্রা এবং লাইভের উত্তেজনা এখন বিপদের মুখোমুখি। তৃষা ক্রমেই বুঝতে পারে যে এটি শুধুই পরীক্ষা নয়—এখানে কোনরূপ ভুলও অনুমোদিত নয়। রাতের অন্ধকার, কবরস্থানের নিস্তব্ধতা, কবররক্ষকের সতর্কবার্তা এবং ছায়াদের অচেনা উপস্থিতি একত্রিত হয়ে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যেখানে বাস্তব, ভয় এবং অজানা রহস্যের মধ্যে লাইন এতই অস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ নতুন বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
–
হঠাৎ লাইভের স্ক্রিনে এমন এক দৃশ্য ধরা পড়ে যা তৃষার জন্য কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ক্যামেরার লেন্সের মধ্যে অয়ন নিজেই দেখা যায়, কিন্তু তার দেহ যেন ফ্রেমের ভিতরে আটকা পড়ে। সে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে সাহায্যের সংকেত দিচ্ছে, কিন্তু বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা তৃষা কিছুই করতে পারছে না। তার চিৎকার বাতাসে মিলিয়ে যায়, কিন্তু বাস্তবে সে অয়নের কাছাকাছি যেতে পারছে না। তৃষার হাত কেঁপে ওঠে, সে চিৎকার করে অয়নকে ডাকছে, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর যেন অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। অয়ন ক্যামেরার ভিতর থেকে আরও কাছে আসার চেষ্টা করে, তার চোখে আতঙ্ক, আর মুখে অজানা যন্ত্রণার ছাপ। তৃষা বুঝতে পারে, এটি কোনো সাধারণ জায়গা বা বাস্তব নয়; যেন অয়নকে ফ্রেমের মধ্যে বন্দি করে রাখা হয়েছে, আর সে সত্যিকার অর্থে বাইরে নেই।
অয়ন ক্রমেই ক্যামেরার ভেতরে হারিয়ে যাচ্ছে। সে হাত নাড়িয়ে চিৎকার করছে, কিন্তু তৃষা যতোই এগোতে চায়, তার পা যেন মাটিতে আটকে আছে। বাতাসের মধ্যে হঠাৎ একটি ঠান্ডা স্পর্শ তার গলায় লাগে, এবং সে চিৎকার করতে করতে থমকে যায়। স্ক্রিনে অয়নের চোখে ভয়, আতঙ্ক, এবং সাহায্যের আকুতি সব স্পষ্ট, আর তৃষা তা দেখে নিজেও কেঁপে ওঠে। দর্শকরা লাইভে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে, কিন্তু কেউ বাস্তবের সাহায্য করতে পারছে না; স্ক্রিনের ভিতরে অয়ন যেন সম্পূর্ণ অন্য এক বাস্তবের দিকে ধাবিত হয়েছে। তৃষা বুঝতে পারে, যা কিছু তারা দেখছে, তা কেবল ভয় নয়, বরং এক ধরনের বাস্তবতার ফাঁকফোকর, যেখানে অয়ন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
রাতের অন্ধকার, কবরস্থানের নীরবতা এবং ছায়াদের অচেনা উপস্থিতি একত্রে এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যেখানে অয়ন আর বাস্তবে নেই। সে ক্যামেরার ভিতরে বন্দি, তার চিৎকার কেবল শোনার জন্য, কিন্তু সাহায্যের কোনো হাতছানি নেই। তৃষা নিজেকে অদ্ভুতভাবে দুর্বল ও নিস্প্রভ মনে করে, আর এক অদ্ভুত হতাশার ছায়া তার মনকে ঘিরে ধরে। ক্যামেরার ফ্রেমে অয়নকে আটকে থাকা দেখে সে বুঝতে পারে যে, এই রাতের রহস্য শুধু ভয় বা কৌতূহল নয়; এটি এক বাস্তব বিপদের সূচনা, যেখানে অয়ন হারিয়ে গেছে, এবং তৃষা একা, তাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করতে গিয়ে তার নিজের সাহসিকতা এবং বাস্তবতার সীমার সঙ্গে লড়াই করতে হবে।
–
পরদিন সকালে সূর্যের হালকা আলো গ্রামের প্রান্তের কবরস্থানের ধুলোয় পড়ে, কিন্তু তৃষার মনে এক অদ্ভুত শূন্যতা। সে নিজের ফোন হাতে ধরে বারবার ইউটিউব চ্যানেল খুঁজে দেখছে, কিন্তু কোনো লাইভের চিহ্ন নেই। লাইভ ভিডিও, যা গত রাতের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা ধারণ করেছিল, হঠাৎ যেন সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেছে। তৃষা হতবাক এবং বিভ্রান্ত, নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। সে বারবার খুঁজে দেখে, ক্যাশ মেমোরি, ইতিহাস, বা ডিভাইসের ফাইল—কিছুই তার লাইভের কোনো চিহ্ন দেয় না। মনে হয়, রাতের ঘটনাগুলো শুধুই স্বপ্ন বা ভুল বাস্তবতা। কিন্তু যখন সে শান্ত হয়ে ফোনটি ধরে রাখে, তখন হঠাৎ এক অজানা কণ্ঠ তার কানে ফিসফিস করে—অয়নের কণ্ঠ, যা আগে লাইভে শোনা যেত। অয়ন বলে, “লাইক, শেয়ার, সাবস্ক্রাইব…”—একই স্বর, একই স্পষ্টতা। তৃষা চমকে ওঠে; সে জানে, কোনো মানুষ এত নিখুঁতভাবে লাইভের প্রতিলিপি বানাতে পারবে না।
তৃষা তখন চারপাশের দিকে তাকায়। কবরের পাশে, সেই ছায়া-দর্শকরা দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক গত রাতের মতো। তারা নীরব, স্থির, কিন্তু তাদের চোখে এক ধরনের গভীর নজরদারি। অয়ন ক্যামেরার ভিতর থেকে বারবার হাত নাড়ে, কিন্তু বাস্তবে সে নেই। তৃষা বুঝতে পারে যে অয়ন ‘স্ট্রিমে’ আটকা পড়েছে, কিন্তু এর বাস্তব অর্থ শুধু ডিজিটাল বা ভার্চুয়াল নয়; সে যেন এক অদ্ভুত স্থানীয় বাস্তবতার মধ্যে আবদ্ধ। ছায়াগুলো তার পাশে দাঁড়িয়ে, অয়নের প্রতি তাদের আগ্রহ অদম্য। তৃষা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে, যে লাইভ ভিডিও হারিয়ে গেছে, তা শুধু ফাইল বা ইউটিউবের মাধ্যমেই নয়, বরং বাস্তবতার সংজ্ঞা তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। প্রতিটি মুহূর্তে অয়ন দেখতে পায়, শুনতে পায়, কিন্তু তৃষা বাইরে থেকে তার হাত ধরা বা উদ্ধার করার কোনো সুযোগ পান না।
তৃষার মনে এক অদ্ভুত চাপ সৃষ্টি হয়—বিরক্তি, ভয় এবং দায়িত্বের মিশ্রণ। সে বারবার নিজের কণ্ঠে চিৎকার করে অয়নকে ডাকছে, কিন্তু তার কণ্ঠ যেন বাতাসে মিলিয়ে যায়। অয়ন তার ধ্বনিতে চেনা লাইভের স্বর ধরে রেখেছে, কিন্তু বাস্তবে সে এক অদ্ভুত ফাঁকফোকরে, ছায়ার পর্যবেক্ষণে বন্দি। তৃষা বুঝতে পারে, রাতের কবরস্থানের যাত্রা, ছায়াগুলোর উপস্থিতি, কবররক্ষকের সতর্কবার্তা—সবই একটি বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ, যা তাকে বাস্তবের সীমারেখা এবং অজানা ভয়ের মধ্যে রাখে। তিনি এখন একা, তার পাশে নেই অয়ন, কিন্তু স্ক্রিনে অজানা আকারে অয়নকে দেখছে ছায়াগুলো। এই ভয়ঙ্কর বাস্তবতা তৃষাকে এক গভীর সংকটের মধ্যে ফেলে দেয়, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি নিশ্বাস এবং প্রতিটি দৃষ্টি নতুন রহস্য এবং বিপদের দরজা খুলছে, আর হারানো স্ট্রিম যেন তাদের পৃথিবী থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
–
রাতের অন্ধকার, কবরস্থানের নিস্তব্ধতা এবং ছায়ার উপস্থিতি মিলিয়ে একটি চূড়ান্ত সত্য উন্মোচিত হয়। তৃষা বুঝতে পারে যে অয়ন আর স্বাভাবিক বাস্তবতার অংশ নয়; সে মৃত দর্শকদের এক অনন্ত লাইভের অংশ হয়ে গেছে। ক্যামেরার ফ্রেমে তার কণ্ঠ, তার হাতের নাড়ানো, স্থির হাসি—সবই এখন সেই চিরন্তন বাস্তবতার অংশ। প্রতিটি রাতেই কবরস্থানে কেউ কেউ লাইভে আটকা পড়ে, আর তাদের ভয়, আতঙ্ক এবং কণ্ঠস্বর সেই চিরন্তন ছায়া-দর্শকদের মধ্যে মিলিত হয়। তৃষা জানে, এটি কেবল একটি ঘটনা নয়, বরং একটি চক্র, একটি নিঃশেষ না হওয়া গোপন রহস্য, যা প্রতিটি সাহসী বা কৌতূহলী আত্মাকে তার ফাঁদে ফেলে।
তৃষার মন গভীর শূন্যতা এবং ভয়ের মধ্যে পড়ে। সে জানে, অয়ন চিরতন লাইভে বন্দি, তার নিজস্ব স্বর আর চেহারা ছায়াগুলোর মধ্যে মিলিয়ে গেছে। তৃষা যতই নিজেকে সতর্ক করার চেষ্টা করে, মনে হয় প্রতিটি রাতেই সে অজান্তে সেই অচেনা বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। অয়ন যে এখন মৃত দর্শকের অংশ, তা বোঝা মানেই তার জন্য এক ধরনের আতঙ্কের স্বীকৃতি; আর এই সত্য কাউকে বলা সম্ভব নয়। যদি কেউ জানত, তবে কবরস্থানের সেই ভয়ঙ্কর রহস্য ধ্বংস হয়ে যেত, কিন্তু তৃষা বোঝে, এটি প্রকাশের সাহস তার নেই। তার নিজের মনে অজানা ধাক্কা, অয়নকে হারানোর ব্যথা এবং কেবল তার কণ্ঠ শুনে থাকা আতঙ্ক একত্রে তাকে এক অদ্ভুত নিঃশেষ দুঃখে ভরে দেয়।
রাতের নীরবতা যখন ছড়িয়ে পড়ে, তখন তৃষা আরও স্পষ্টভাবে অনুভব করে যে কবরস্থানের চিরন্তন লাইভ শুধুই অয়নকে নয়, বরং এক এক অজানা আত্মাকে প্রতিনিয়ত ধরে রাখে। সে তার চোখ বন্ধ করে, নিজের কণ্ঠ নীরব রাখে, যেন অয়ন বা ছায়াগুলো তার ভয় উপলব্ধি না করে। কিন্তু মাঝরাতে, অয়ন নিজের ভয়াল হাসি দিয়ে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আবার ফিসফিস করে, “লাইক, শেয়ার, সাবস্ক্রাইব…”—একটি হাসি, যা বাস্তব এবং অচেনা ভয়ের মধ্যে মিলিত। তৃষা জানে, এটি কেবল শুরু, আর অয়ন চিরতন লাইভের একটি চিহ্ন, যা প্রতিটি রাতে নতুন আতঙ্ক এবং অজানা বিপদের দরজা খুলে দেয়। সেই চিরন্তন লাইভের মাঝে, তৃষা একা, তার চোখে অশ্রু, হৃদয়ে ভয়, এবং প্রতিটি মুহূর্তে অজানা বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই—এটাই তার নতুন জীবন, যেখানে স্মৃতি, ভয় এবং অয়ন একত্রিত হয়ে একটি নিঃশেষ রহস্যের অংশ হয়ে গেছে।
___