তমোঘ্ন সাহা
অধ্যায় ১: চাঁদেরডিহির ছায়া
পুরুলিয়ার পাহাড়ি রাস্তায় হেলেদুলে চলছিল জিপটা। চারপাশে যেন নিস্তব্ধতার শ্বাস পড়ে আছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। গাছের ডালে বসে থাকা বেজিগুলোও চুপ, যেন কোনও রহস্যের গন্ধ পেয়েছে। অগ্নিবেশ মুখার্জী জানালার ধারে বসে মোটা কাঁচের চশমা ঠেলে সামনে তাকিয়ে আছেন, তাঁর চোখে ক্লান্তি থাকলেও উৎসাহের ঝলক স্পষ্ট। তাঁর হাতে ধরা একটা পুরনো চামড়ার খাতা—চণ্ডীমুখার মন্দির থেকে সংগৃহীত এক তান্ত্রিক পাণ্ডুলিপি, যেখানে কপালকুণ্ডলিনীর গুহার উল্লেখ পাওয়া গেছে। সাথে রয়েছেন তাঁর সহকর্মী ডঃ সরোজিনী রায়, যার চোখে ঝকঝকে বুদ্ধি ও ঠোঁটে লেগে থাকা সংশয়। তাঁদের গাইড জয়ন্তী হাঁসদা বসে আছে সামনের সিটে, একদৃষ্টে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে। তার চিবুকের রেখা শক্ত, চোখে এক আশ্চর্য বিষণ্নতা।
“চাঁদেরডিহি পৌঁছাতে আর আধঘণ্টা,” জয়ন্তী বলল হঠাৎ।
“এই গুহা কি সত্যিই আছে?” সরোজিনী প্রশ্ন করলেন।
“আছে। কিন্তু ওখানে কেউ যায় না… কারণ সবাই জানে, ওই গুহা ঘুমন্ত নয়, শ্বাস নিচ্ছে,” জয়ন্তী মৃদুস্বরে বলল।
চাঁদেরডিহি পৌঁছানোর পর যেন সময় আটকে গেল। আধাপাথরের ঘরবাড়ি, গাছপালায় ঢাকা সরু গলি, আর দূরের পাহাড় যেন পেছন থেকে নজর রাখছে। গ্রামের মানুষজনও অদ্ভুত নিরবতা পালন করে। কেউ যেন কথাও বলে না শহুরে আগন্তুকদের সঙ্গে। অগ্নিবেশ ও সরোজিনী থাকছেন গ্রামের এক প্রাচীন কুটিরে, যেখানে এক বৃদ্ধ বাস করতেন—মৌনী ঠাকুরদা। জয়ন্তী জানাল, “এই ঠাকুরদাই একমাত্র মানুষ যে ছোটবেলায় কপালকুণ্ডলিনীর ঘুম শুনেছে। তখন সে কিশোর, পাহাড়ে গিয়েছিল শিকার করতে। ফিরে আসে চুপ হয়ে। আর কোনোদিন কথা বলেনি।” সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে হঠাৎ বাঁশির সুর ভেসে এলো পাহাড় থেকে। অগ্নিবেশ চোখ তুলে তাকালেন। “কে বাঁশি বাজাচ্ছে?”
জয়ন্তী জানাল, “ওই ঠাকুরদা। প্রতিরাতেই বাজান। বিশ্বাস করা হয়, এই সুরেই ঘুমিয়ে থাকে গুহার শক্তি।”
এক অলক্ষ্য শীতলতা যেন চারদিক ঘিরে ধরলো। শরীরে হালকা কাঁপুনি। সরোজিনী চাপা গলায় বললেন, “আমি এই বাঁশির কম্পনটা অনুভব করতে পারছি… এটা যেন কোথাও প্রবেশ করছে মনে।”
রাত বাড়তেই সেই কুটিরে বাতি নিভে আসে। বাইরে শুধুই ঝিঁঝিঁ আর দূরের বাঁশির সুর। অগ্নিবেশ একা বসে আছেন পাণ্ডুলিপি নিয়ে। সরোজিনী ঘুমিয়ে পড়েছেন, আর জয়ন্তী বারান্দায় বসে চাঁদের আলোয় গাছেদের ওপর পড়া ছায়া দেখছে। পাণ্ডুলিপির পাতায় চোখ বোলাতে বোলাতে হঠাৎ একটা বাক্য থমকে দেয় অগ্নিবেশকে—
“যদি কপালকুণ্ডলিনীর নিঃশ্বাস থেমে যায়, তবে শুরু হবে রক্তের বৃষ্টি, আর পাহাড় হবে অগ্নির গর্ভ।”
এমন সময় দরজায় টোকা পড়ে। খুলতেই দেখা যায় একজন বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে, চোখে সাদা ঝাপসা দৃষ্টি, ঠোঁটে কিছু না বলার অভিব্যক্তি। জয়ন্তী হুড়মুড় করে উঠে আসে, “ঠাকুরদা?”
বৃদ্ধ শুধু একটিবার মাথা নাড়েন, তারপর মাটিতে কাঠি দিয়ে আঁকেন একটা চক্র, তার ভেতরে তিনটি বিন্দু—ত্রিকোণ। অগ্নিবেশ চিনতে পারেন—তন্ত্রমতে এ চিহ্ন ‘ত্রিকুণ্ডল’ — শক্তি জাগরণের পূর্বচিহ্ন।
বৃদ্ধ আঙুল তুলে পাহাড়ের দিকে দেখান, আবার বাঁশির সুর বাজাতে শুরু করেন। সেই সুরে যেন পাহাড় কেঁপে ওঠে।
আর ঠিক তখনই, পাহাড়ের গুহামুখে এক ঝলক আগুনের রেখা জ্বলে উঠে নিভে যায়।
কপালকুণ্ডলিনীর নিঃশ্বাস কি তবে সত্যিই জাগছে?
অধ্যায় ২: গুহার দ্বারে ত্রিকুণ্ডল
পরদিন সকাল। পাহাড়ের পাদদেশে হালকা কুয়াশা ঝুলে আছে। চাঁদেরডিহির ঘরগুলোর জানালা খুললে ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে হালকা পুড়ে যাওয়া ধূপের গন্ধ ভেসে আসে। অগ্নিবেশ মুখার্জী উঠে বাইরে এসে দাঁড়াতেই জয়ন্তী তার পাশে এসে দাঁড়ায়, গলায় পাথরের মুদ্রা ঝোলানো। সে বলল, “আজ আমি আপনাদের গুহার মুখ পর্যন্ত নিয়ে যাব। তবে ভিতরে যাব না। আমার ঠাকুরমা বলতেন, গুহার দরজা আসলে এক প্রাচীন বন্ধন—তাকে ছোঁয়া মানেই বন্ধন ভাঙা।”
অগ্নিবেশ উত্তর দিলেন, “যদি সত্যিই এমন শক্তি থেকে থাকে, তবে তাকে বুঝতে হবে। বৈজ্ঞানিকভাবে না হোক, অন্তত ঐতিহাসিক গুরুত্বে।”
জয়ন্তী যেন কিছুর সাথে লড়াই করে মেনে নেয়। সরোজিনী ইতিমধ্যে পাণ্ডুলিপির অনুবাদে ব্যস্ত। তিনি এক জায়গায় একটি শব্দ পেয়েছেন—“ত্রিকুণ্ডল উৎস”। অর্থাৎ, এমন এক বিন্দু যেখান থেকে তিনটি শক্তির রেখা ছড়িয়ে পড়ে: তামসিক, রজসিক ও সাত্ত্বিক। তিনশত বছরের পুরনো লিখন মতে, এই উৎস কপালকুণ্ডলিনীর কপালে চিহ্নিত ছিল, আর সেই বিন্দুই গুহার ঠিক নিচে অবস্থিত।
তাঁরা পাহাড়ে ওঠার প্রস্তুতি নেন। মৌনী ঠাকুরদা দূর থেকে তাকিয়ে থাকেন—চোখে আশীর্বাদ নয়, বরং ভয় আর অনিবার্য ভবিষ্যতের ছায়া।
পাহাড়ের পথটা মসৃণ নয়—অর্ধেক জায়গা কাঁকুরে মাটি, মাঝে মাঝে উঁচু শিকড়ের ফাঁক গলে যেতে হয়। মাঝে মাঝে পাহাড়ের গায়ে প্রাচীন ঝর্ণার শব্দ শোনা যায়, যেগুলো গ্রীষ্মেও শুকায় না। জয়ন্তী পথ দেখাতে দেখাতে বলে, “এই পাহাড়ের নাম মায়াডাঙ্গা, কারণ এখানকার প্রতিটি শিলা নাকি এককালে তান্ত্রিকদের ধ্যানস্থানে ব্যবহৃত হত। গুহার মুখে গেলে আপনি নিজেই অনুভব করবেন জায়গাটা কেমন ভারী।”
প্রায় একঘণ্টা পর, তাঁরা এক অদ্ভুত খোলামেলা জায়গায় পৌঁছান—এক পাথুরে চাতাল, যার মাঝে বৃত্তাকার এক গহ্বর, আর তার চারপাশে তিনটি ছোট পাথরের স্তম্ভ। গুহার মুখে শিকড় ঝুলে আছে, আর তার ওপর বড় পাথরে খোদাই করা ত্রিকোণ চিহ্ন।
অগ্নিবেশ অবাক হয়ে বলেন, “ত্রিকুণ্ডল! ঠিক যেমনটা পাণ্ডুলিপিতে লেখা।”
সরোজিনী সেই চিহ্নে আঙুল ছোঁয়াতেই হঠাৎ কেঁপে ওঠে মাটি, এক ঠান্ডা হাওয়া মুখে আছড়ে পড়ে। জয়ন্তী আতঙ্কিত হয়ে বলে, “নাঃ! এটা হওয়া উচিত ছিল না!”
তখনই গুহার গা বেয়ে কালো ধোঁয়ার মতো কিছুর আবরণ ঘুরতে থাকে। মনে হয়, গুহার ভেতর কেউ নিঃশ্বাস ফেলছে—গম্ভীর, ভারী, নিঃশব্দে বেজে চলা প্রাণের সুর।
হঠাৎ এক হিমশীতল কণ্ঠস্বর বাতাসে ভেসে আসে—“ত্রিকুণ্ডল ছুঁয়েছো, এবার দরজা খুলবে। সময় এসেছে।”
অগ্নিবেশ পিছিয়ে আসেন, কিন্তু কণ্ঠস্বরটা কার, বোঝা যায় না। জয়ন্তী হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে, কাঁপতে থাকে। সরোজিনী তার কাঁধে হাত রাখতেই সে বলে, “আমি এই সুর আগে শুনেছি… এটা আমার ঠাকুরমার গলায় ছিল, যখন উনি কপালকুণ্ডলিনীর গল্প বলতেন, গলায় ভয় নিয়ে। কণ্ঠটা যেন তাঁরই।”
এই মুহূর্তে তাদের কেউ বুঝতে পারেননি, পাহাড়ের নিচ থেকে ভীমচরণ গিরি ধীরে ধীরে উঠছে। তার হাতে রুদ্রাক্ষ-গাঁথা মালা, কপালে ভস্মের দাগ। দূর থেকে সে সেই গুহার মুখ দেখে বিড়বিড় করে বলে, “জেগে উঠো, কপালকুণ্ডলিনী… তোমার নতুন অধিকারী হাজির।”
তার পেছনে ছায়ার মতো ছয়জন অনুসারী, যারা রক্তের ত্রিকোণ এঁকে পাথরে সিঁদুর ছিটিয়ে চলেছে।
গুহার প্রবেশদ্বারে তখন বাতাস জমাট—হঠাৎ একটা দপ করে আলো ফুটে উঠলো সেই ত্রিকোণে।
আর অগ্নিবেশ মুখার্জী বুঝলেন—তাঁরা শুধু ইতিহাসের নয়, এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের দ্বারে দাঁড়িয়ে।
অধ্যায় ৩: অভিশপ্ত ত্রিকোণ
গুহার মুখে আলোটা যেভাবে দপ করে উঠেছিল, ঠিক সেভাবেই নিভে গেল। মুহূর্তের জন্য সেই আলোয় দৃশ্যমান হয়েছিল এক নারীমূর্তি—গা ঘেরা দীর্ঘ কেশ, উজ্জ্বল ত্রিনয়ন, আর রক্তাভ কপাল। দৃশ্যটা এত দ্রুত ঘটল যে সরোজিনী চিৎকার করে উঠলেও কেউ বুঝে উঠতে পারল না, তারা কী দেখল। জয়ন্তী তখন গুহার সামনে মাটিতে বসে কাঁপছে, আর তার শরীর থেকে বেরিয়ে আসা মৃদু গুঞ্জন যেন পাহাড় প্রতিধ্বনি করে ফিরিয়ে দিচ্ছে। অগ্নিবেশ তার কাঁধে হাত রাখতেই সে চোখ মেলে তাকায়—কিন্তু সেই চোখ জয়ন্তীর ছিল না। সেগুলো ফাঁকা, রক্তজমাট আলোয় ভরা। মুখ দিয়ে একটা নিম্নস্বরে মন্ত্রোচ্চারণ বেরোয়—”ত্রিকুণ্ডল ভেঙেছে, বৃত্ত খুলেছে, এবার শক্তি প্রবাহিত হবে…”
সরোজিনী সঙ্গে সঙ্গে জয়ন্তীর কপালে ঠান্ডা জল ছিটিয়ে দেয়। মেয়েটি চমকে ওঠে, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল যেন। সে গলা চেপে ধরে বলে, “ওই আলোটা আমাকে ডাকছিল… আমার ভিতরে কিছু ঢুকে পড়েছিল।”
অগ্নিবেশ এবার পাণ্ডুলিপির সেই অংশ খুলে পড়েন, যেখানে লেখা—
“যার শরীরে কুণ্ডলিনী বাসা বাঁধে, সে আর নিজের থাকে না; সে হয় শক্তির বাহক, পরিণামে উৎসর্গিত আত্মা।”
তাদের স্পষ্ট হয়, জয়ন্তী এখন কেবল গাইড নয়—সে শক্তির ছোঁয়ায় আংশিক স্পর্শে থাকা এক জীবন্ত পাত্র।
ঠিক সেই মুহূর্তে পাহাড়ের নিচ থেকে ভেসে আসে এক কাঁপানো ধ্বনি—ঢোলের তালে শঙ্খ আর মন্ত্রোচ্চারণ। ভীমচরণ গিরি এবং তার তান্ত্রিক অনুসারীরা শুরু করেছে জাগরণ তন্ত্র।
ভীমচরণের চোখে জ্বলছে লোভ আর বিশ্বাস—সে যেন নিশ্চিত যে এবার কপালকুণ্ডলিনীর শক্তি তার আয়ত্তে আসবেই। পাণ্ডুলিপির এক গোপন অংশে সে আগেই পড়েছিল—
“যদি ত্রিকুণ্ডল তিন দিক থেকে রক্তে সিঁদুরিত হয়, তবে শক্তি উঠে আসবে গুহা ছেড়ে বাহকের দেহে প্রবেশ করতে।”
সেই তিন বিন্দুতে তার লোকেরা ইতিমধ্যেই ছিঁড়ে এনেছে তিন পশু—পাঁঠা, অজগর আর কালো মুরগি—তন্ত্রসাধনার অঙ্গস্বরূপ।
এখন দরকার জয়ন্তীকে সেই কেন্দ্রচক্রে বসানো—যে কিনা অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই গুহার মুখে দাঁড়িয়ে ত্রিকুণ্ডল স্পর্শ করেছিল।
তাদের পরিকল্পনা স্পষ্ট: জয়ন্তীকে বলিপাঁঠা নয়, বানাতে হবে বাহক, আর সেই বাহকের মাধ্যমেই তন্ত্রিক শক্তিকে বন্দী করে ব্যবহার করা যাবে।
অগ্নিবেশ, সরোজিনী এবং জয়ন্তী তখন পাহাড় থেকে নেমে আসতে চেষ্টা করছে। কিন্তু অদৃশ্য একটা অরণ্যঘেরা বলয়ের ভেতরে আটকে পড়েছে যেন। প্রতিটা পথ তাদের আবার গুহার দিকেই ফেরাচ্ছে।
“এটা কি সময়চক্র?” সরোজিনী বললেন, “গুহার চারপাশে সময়-মণ্ডল তৈরি হয়েছে, যে বাইরে যেতে চায় সে আবার ফিরে আসবে ভেতরে।”
অগ্নিবেশ এক পাথরের গায়ে হাত ছোঁয়ালেই সেখান থেকে জ্যোতির্ময় রেখা বেরিয়ে এসে তার কবজিতে জড়িয়ে পড়ে—গরম, আগুনের মতো। পাথরে তখন এক ছবি জ্বলজ্বল করে উঠল—তাতে দেখা যাচ্ছে এক নারী দাঁড়িয়ে আছে আগুনের পেছনে, আর তার মাথায় তিনটি সাপ, তিনটি চোখ এবং এক ভিন্ন শরীররূপ: মানুষ, পশু ও দেবী মিশ্রিত।
“এটাই কপালকুণ্ডলিনী…” অগ্নিবেশ ফিসফিস করে বলে।
হঠাৎ জয়ন্তীর চোখ ফেটে কান্না আসে। সে বলে, “আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলুন… আমি স্বপ্নে ওঁকে দেখছি… উনি আমাকে বলছেন, ‘শুধু শরীর নয়, আমার শক্তিও তুমি…’”
এতক্ষণে তারা বুঝতে পারে, এ কেবল অতীতের গবেষণা নয়—এই গুহা, এই পাহাড়, এই চিহ্ন—সব এখন বাস্তব হয়ে উঠেছে, এবং তারা কেউই এর বাইরে বেরোতে পারবে না যতক্ষণ না শক্তির জাগরণ সম্পূর্ণ হয় অথবা তাকে ফের ঘুম পাড়ানো যায়।
কিন্তু কীভাবে?
আর ঠিক তখনই পাহাড় কেঁপে উঠে, গুহার ভেতর থেকে গর্জনের মতো এক নারীকণ্ঠ বেরোয়—
“আমি কপালকুণ্ডলিনী। যে আমাকে জাগিয়েছে, সে কি প্রস্তুত আমার অভিশাপ বহন করতে?”
অধ্যায় ৪: শক্তির বাহক
পাহাড়ের বুক কেঁপে উঠছে। গুহার ভেতর থেকে যে নারীস্বর ভেসে এল, তা এক মুহূর্তেই জয়ন্তীকে নিস্তব্ধ করে দেয়। তার চোখ আবার রক্তাভ হয়ে ওঠে, মুখ থেকে ফিসফিস করে এক অচেনা ভাষায় মন্ত্র ভেসে আসে। অগ্নিবেশ আতঙ্কে জয়ন্তীর পাশে এসে দাঁড়ান, কিন্তু সরোজিনী তাকে ধরে বলেন, “এটা জয়ন্তী নেই… এখন ও এক পাত্র, ওর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সেই শক্তি।”
চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। পাথরের ওপর লতাগুল্ম হঠাৎ শুকিয়ে যেতে শুরু করে—গাছের পাতা ঝরে পড়ছে যেন কারও ছোঁয়ায় দগ্ধ হয়ে। অগ্নিবেশ বুঝতে পারেন, এই মুহূর্তে যা ঘটছে তা কেবল তান্ত্রিক নয়, এটি প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ভাঙন।
“তিনটি বিন্দু, তিনটি দিক, তিনটি সত্তা—মানব, শক্তি ও শত্রু,”—তিনি পাণ্ডুলিপির সেই অংশ মনে করার চেষ্টা করেন। “যদি এই শক্তিকে ঘুম পাড়াতে হয়, তবে দরকার এই তিনটি সত্তার সম্মিলন। জয়ন্তী শক্তির বাহক, আমি হয়তো জ্ঞানের দিকটা, কিন্তু শত্রু… কে?”
ঠিক সেই সময় দূরে দেখা যায় আগুন জ্বলে উঠেছে পাহাড়ের আরেক পাশে। মন্ত্রোচ্চারণের কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। ভীমচরণ গিরি ও তার অনুসারীরা গুহার কাছে চলে এসেছে।
ভীমচরণ দাঁড়িয়ে বলেন, “এটাই সময়। বাহক তৈরি, গুহা খোলা, শক্তি জেগে উঠছে—আমার প্রার্থনা সফল হবে। কপালকুণ্ডলিনী, আমাকে গ্রহণ করো!”
তার এই আর্তি যেন গর্জে ওঠে বাতাসে, আর তার প্রতিধ্বনি জয়ন্তীর শরীরে ধাক্কা খায়। সে ধপ করে মাটিতে পড়ে যায়, নিস্তেজ।
সরোজিনী ছুটে যায় জয়ন্তীর দিকে, তার কপালে জল ছিটিয়ে দেয়, শ্বাস পরীক্ষা করে—সে বেঁচে আছে, কিন্তু চোখ খুলছে না। মুখটা হিম, ঠোঁট নীলচে। অগ্নিবেশ জয়ন্তীর দেহ থেকে কিছুটা দূরে পাথরে খোদাই চিহ্ন খুঁজে পায়—ত্রিকুণ্ডল চক্রের কেন্দ্রে একটা ক্ষুদ্র সূক্ষ্ম ফাটল।
“এই চিহ্ন… এটা সম্ভবত শক্তির শ্বাসপ্রবাহের কেন্দ্র,”—সে বলেন।
তিনি পাণ্ডুলিপি খুলে সেই প্রতীক চিহ্নের সামনে একটি রুদ্রাক্ষ রাখেন—একধরনের শক্তি সংবরণ রীতি, যাতে শক্তির প্রবাহ রোধ হয়। কিন্তু ঠিক তখনই ভীমচরণের এক শিষ্য ছুটে এসে সেই রুদ্রাক্ষ তুলে ফেলে, আর বলে, “ওই শক্তি আমাদের অধিকার—ওকে বন্ধ করা যাবে না।”
অগ্নিবেশ তাকে ঠেলে সরাতে চাইলেও ভীমচরণ এগিয়ে আসে। “তুমি যদি সামনে আসো, তোমার জ্ঞান মাটিতে মিশে যাবে,” সে হুঁশিয়ারি দেয়।
সরোজিনী বলেন, “তুমি জানো না, তুমি কী জাগাতে চলেছ। এটা দেবী নয়—এ অভিশাপ।”
ভীমচরণ হেসে ওঠে, “অভিশাপ নয়, মুক্তি। আমি চিরজীবী হব, দেবতাদের ঊর্ধ্বে।”
এই মুহূর্তে পাহাড়ের গায়ে হঠাৎ জ্বলে ওঠে রক্তবর্ণ রেখা—তিনটি দিক থেকে তিনটি রেখা এসে মিলছে জয়ন্তীর কপালে। সেই জায়গাটিতে হঠাৎ ফুসফুসভরা শ্বাস নিয়ে সে উঠে বসে, আর মুখে আওড়ায়—
“আমি কপালকুণ্ডলিনী… আমি এসেছি। কে প্রস্তুত আমার আশীর্বাদ নিতে?”
ভীমচরণ এগিয়ে যায়, কিন্তু তার কপাল থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করে—যেন নিজেই সেই শক্তির সহনশীল নয়।
“তুমি আমার ডাক দিয়েছ, কিন্তু আমাকে ধারণ করতে পারবে না,”—জয়ন্তীর কণ্ঠে তখন কপালকুণ্ডলিনীর গর্জন।
তিনটি সাপের মতো ছায়া গুহার মুখ থেকে বেরিয়ে এসে ভীমচরণকে ঘিরে ধরে। তার মুখ বিকৃত হয়ে যায়, সে চিৎকার করে উঠে—“না! না! আমি তো তোমার উপাসক!”
কিন্তু সেই শক্তি কেবল একটাই চায়—সাম্য আর ভারসাম্য। আর ভীমচরণ ছিল লোভ incarnate।
সেই মুহূর্তে তার দেহ গুহার পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ে, চুপচাপ পড়ে থাকে—জীবনহীন, কালো ছায়ায় ঢেকে।
অগ্নিবেশ ও সরোজিনী তখন জয়ন্তীর দিকে এগিয়ে আসে। তার চোখ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে, কণ্ঠ ফিসফিস করে বলে, “আমার ভিতর কিছু ঢুকেছিল… আমি তাকেই ঠেকিয়ে দিয়েছি।”
অগ্নিবেশ তাকে ধরে বলেন, “তুমি করেছ ঠিক, কিন্তু যুদ্ধ শেষ নয়। গুহার শক্তি এখন ঘুমায়নি। শুধু বাহক পাল্টেছে।”
আকাশের দিক থেকে এক ঝাঁক কালো পাখি উড়ে যায় গুহার মাথার ওপর দিয়ে।
আর গুহার ভেতর থেকে ভেসে আসে সেই একই নারীকণ্ঠ—“আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকবো। কিন্তু আমি যাকে পছন্দ করি, তার ভিতরেই আমি জাগব।”
অধ্যায় ৫: গুহার গভীরে
রাত গভীর হতে হতে পাহাড় যেন নিজের রূপ বদলে ফেলেছে। গাছের ছায়া লম্বা হয়ে গুহার মুখে পড়ছে, পাথরের গায়ে যেন আগুনের দাগ। চাঁদেরডিহি এখন এক ঘুমন্ত গ্রাম নয়—এ যেন পাহাড়ের কোল ঘেঁষা এক জাগ্রত অভিশপ্ত ভূমি। ভীমচরণ গিরির দেহকে তার অনুসারীরা টেনে নিয়ে গেছে নীচে, কিন্তু কারো মুখে কোনও শব্দ নেই। আর জয়ন্তী? সে যেন নিঃশব্দ দৃষ্টি নিয়ে বসে আছে গুহার সামনে, কপালে এখনো ত্রিকোণ লাল রেখা, শরীরটা নিস্তেজ কিন্তু চোখ—চোখ যেন অন্য কিছুর।
অগ্নিবেশ আর সরোজিনী গুহার প্রাচীন অলিখিত ইতিহাসের চক্রে ঢুকে পড়েছেন। “আমাদের এখানেই থেমে গেলে চলবে না,” অগ্নিবেশ বলেন, “গুহার অভ্যন্তরে ঢুকতেই হবে। যতদিন সেই মূল উৎস, ‘চেতনা-সূত্র’, সক্রিয় থাকবে, ততদিন এই শক্তি অন্য বাহক খুঁজবে। কাল হয়তো আমি বা আপনি।”
সরোজিনী দম নেন, মাথা হেলে বলেন, “তবে আমরা যাব—গুহার গভীরে, যেখানে ত্রিকুণ্ডল চক্রের উৎস। আর যাই হোক, এটাকে বন্ধ না করলে মানুষ বারবার জেগে উঠবে এই শয়তানের আরাধনায়।”
তারা প্রস্তুতি নিয়ে এগোয় গুহার ভিতরে। মুখে ছোট্ট আগুনের মশাল, হাতে রুদ্রাক্ষ মালা ও এক সাদা কাপড়ে বাঁধা পাণ্ডুলিপির শেষ অনুবাদ। জয়ন্তী তাদের দিকে চেয়ে বলেন, “আমি তোমাদের সঙ্গে যাব না। আমি বাইরে অপেক্ষা করব—যদি কিছু হয়…”
অগ্নিবেশ মৃদু হেসে বলেন, “তুমি ইতিমধ্যেই অনেক কিছু সহ্য করেছ। এখন আমাদের পালা।”
গুহার প্রবেশদ্বার পেরিয়ে তারা নামে নিচের দিকে। গুহা যেন এক জীবন্ত শরীর—ভেতরে প্রবেশ করলে হালকা ধোঁয়া, জ্যোতির রেখা ও এক নিঃশব্দ স্পন্দন অনুভব হয়।
প্রথম গহ্বরে একটি বিশাল বৃত্তাকার পাথরের চাতাল, তার চারপাশে ১২টি ক্ষুদ্র স্তম্ভ—হয়তো এক তন্ত্রচক্র। তার কেন্দ্রে এক মূর্তি—এক নারীমূর্তি যার কপাল থেকে জ্যোতির্ময় রেখা বেরিয়ে গুহার ছাদে মিলিয়ে যাচ্ছে।
“এটাই কপালকুণ্ডলিনীর আদিম আকৃতি… শক্তির উৎস,” সরোজিনী ফিসফিস করে।
কিন্তু হঠাৎ সেই মূর্তির চোখ জ্বলে ওঠে, আর তাদের সামনে ভেসে ওঠে তিনটি রূপ—তারা নিজেরাই।
তাদের রূপের প্রতিবিম্ব, কিন্তু বিকৃত, কুৎসিত, লোভী, বিভ্রান্ত। যেন গুহা তাদের মনের অন্ধকারটাই ফিরিয়ে দিচ্ছে।
মুহূর্তে চারদিকের বাতাস ভারী হয়ে যায়। মূর্তির সামনে হঠাৎ আগুন জ্বলে ওঠে, আর সেই আগুনের মধ্য থেকে উঠে আসে এক কণ্ঠস্বর—
“যতক্ষণ না নিজের ছায়াকে তুমি অস্বীকার করো, ততক্ষণ তুমি শক্তিকে জয় করতে পারো না।”
অগ্নিবেশ তখন চোখ বন্ধ করে পাণ্ডুলিপির সেই মন্ত্র আওড়ান—“বিজ্ঞানময় সংযমে শক্তির উৎস শুদ্ধ হয়, অহং ত্যাগে জাগে বোধ।”
এক শক্তিশালী আলো এসে আঘাত করে মূর্তির কপালে। আগুনের প্রতিবিম্ব কাঁপে, অন্ধকার সরে যায়। প্রতিবিম্বগুলি হালকা হয়ে মিলিয়ে যায় বাতাসে।
গুহার ভেতর তখন স্পন্দন থেমে আসে। গায়ে হালকা বাতাসের ছোঁয়া। যেন পাহাড় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে।
“আমরা কি… শেষ করলাম?” সরোজিনী বলেন নিঃশ্বাস ফেলে।
কিন্তু ঠিক তখনই, পেছনে সেই নারীমূর্তি ফেটে যায়। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে এক শুদ্ধ, কোমল, দুধসাদা আলো।
এ আলো কারও চোখ জ্বালায় না, বরং মনে হয়, হাজার বছরের ক্লান্তি ধুয়ে দিচ্ছে।
গুহার ছাদ থেকে সেই আলো বেরিয়ে উঠে আকাশ ছুঁয়ে আবার নেমে আসে জয়ন্তীর দিকে। সে এবার মৃদু হাসে, চোখ বন্ধ করে বলে—
“তাঁর ঘুম এবার গভীর, কারণ আমরা নিজেরাই শুদ্ধ হয়েছি।”
অগ্নিবেশ ও সরোজিনী গুহা থেকে বেরিয়ে দেখে চারপাশ আগের মতো শান্ত। গ্রামের মানুষজন যেন আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
মৌনী ঠাকুরদা বাঁশি বাজাচ্ছেন দূরে বসে—সেই সুর, এবার যেন স্বস্তির, ভয়ের নয়।
আর পাহাড়?
সে এখন যেন আবার শুধুই পাহাড়, আর কপালকুণ্ডলিনী?
সে ঘুমিয়ে… গভীর ঘুমে…
তবে সত্যিই কি চিরদিনের জন্য?
অধ্যায় ৬: পরশখণ্ডিত আত্মা
পুরুলিয়ার পাহাড় যেন আবার তার চিরাচরিত ছায়ায় ফিরে এসেছে। গুহা এখন নিঃশব্দ, তার প্রবেশপথ ঝোপে ঢাকা, আর গ্রামের মানুষজন একরকম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। কিন্তু সেই স্বস্তির ফাঁকেই লুকিয়ে আছে এক অব্যক্ত অস্থিরতা—জয়ন্তীর মাঝে, অগ্নিবেশের চোখে, আর সরোজিনীর গভীর চেতনায়। গুহা থেকে ফেরার পর জয়ন্তী যেন বদলে গেছে। সে চুপচাপ থাকে, দূর কোথাও তাকিয়ে থাকে, আর মাঝেমধ্যে মাটিতে অদ্ভুত চিহ্ন আঁকে—তিনটি রেখার মাঝে এক বিন্দু।
“সে এখনো ঠিক ফিরেনি,” সরোজিনী বলেন। “তার শরীর আমাদের মাঝে আছে, কিন্তু তার কিছু অংশ ওখানেই রয়ে গেছে—গুহার গভীরে, আলোয় ভেসে থাকা সেই শক্তির টানে।”
অগ্নিবেশ মনে করেন, এটা “পরশখণ্ডন”—তন্ত্রমতে এমন অবস্থা, যেখানে আত্মা আর চেতনা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির সংস্পর্শে এসে।
এটা ঘটে চেতনার এক গভীর সংকটের সময়ে। আর জয়ন্তীর ক্ষেত্রে, সে তো শক্তির বাহক হয়েছিল।
অগ্নিবেশ স্থির করেন, চুপ করে থাকলে হবে না। তিনি চান কলকাতার তন্ত্র গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যাপক গৌরাঙ্গ ভট্টাচার্যর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি পরশখণ্ডন তত্ত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন।
গৌরাঙ্গবাবুর সঙ্গে দেখা হয় কোলাহলময় কলেজ স্ট্রিটের মাঝেই। তিনি শোনেন সব ঘটনা, কপালকুণ্ডলিনীর পাণ্ডুলিপি, গুহার আলো, জয়ন্তীর অস্বাভাবিক আচরণ—সবকিছু।
তার মুখ থমথমে, গলা মৃদু—“তোমরা যা বলছ, সেটা নিছক লোককথা নয়। কুণ্ডলিনী শক্তি নিজেই এক পরম সত্য। কিন্তু সে যখন জাগে, তখন সে চেতনার মালিক নয়, সে চেতনা-গ্রাসী। জয়ন্তীর আত্মার একাংশ এখনও কপালকুণ্ডলিনীর ছায়ায় বাঁধা।”
“তাহলে তাকে ফেরানো যাবে না?” সরোজিনী প্রশ্ন করে।
গৌরাঙ্গ বলেন, “ফেরানো সম্ভব। তবে তার জন্য চাই আরও গভীর প্রবেশ—সেই গুহার গভীরে, যেখানে ‘তালচক্র’ রয়েছে। ওটাই আত্মার সংযোগস্থল।”
অগ্নিবেশ বিস্মিত হন। “তালচক্র? পাণ্ডুলিপিতে তো এমন কিছু ছিল না!”
গৌরাঙ্গ হেসে বলেন, “সব জ্ঞান পাণ্ডুলিপিতে থাকে না, কিছু অভিজ্ঞতাতেও খোঁজ মেলে। আমি তোমাকে দেব রুদ্রবীজ তন্ত্র—এই তন্ত্রপাঠেই আত্মা ফিরিয়ে আনার উপায় আছে।”
পরের দিন তারা আবার যায় গুহার পথে—এইবার জয়ন্তীকে নিয়ে, তবে এক ভিন্ন উদ্দেশ্যে।
এই অভিযানের নেতৃত্বে গৌরাঙ্গবাবু নিজে। চারজন মিলে পৌঁছে যায় সেই পুরনো স্থানটিতে—যেখানে একদিন নারীমূর্তি থেকে আলো বেরিয়ে এসেছিল।
জয়ন্তী নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়ায় চত্বরের কেন্দ্রে। চোখ বন্ধ করে ফিসফিস করে, “আমি ওকে দেখছি… তিনি আলো হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন… আমি ওর মধ্যেই ভেসে যাচ্ছি…”
গৌরাঙ্গ শুরু করেন মন্ত্রপাঠ—রুদ্রবীজ তন্ত্রের জটিল ছন্দ।
তাদের চারপাশে বাতাস হঠাৎ চেপে আসে। মাটি কম্পন করে, গুহার গায়ে পাথর থেকে ধুলো ঝরে পড়ে।
মন্ত্রপাঠের এক পর্যায়ে গৌরাঙ্গ বলেন, “অগ্নিবেশ, রক্তপাত ছাড়া আত্মার টান তৈরি হবে না। দরকার আত্মত্যাগ, আত্মদান।”
অগ্নিবেশ নিজের আঙুলে কেটে রক্ত ছিটিয়ে দেয় তালচক্রের প্রতিকে।
হঠাৎ সে দেখে—জয়ন্তীর কপালের লাল রেখাটা মুছে যাচ্ছে। তার দেহ ধপ করে পড়ে যায়।
তিনজন ছুটে আসে তার কাছে। সরোজিনী কান ধরেন—জীবনের সঙ্কেত দুর্বল, কিন্তু আছে।
তার চোখ খুলে যায় ধীরে ধীরে—এইবার সত্যিকার জয়ন্তী ফিরে এসেছে।
সে শুধু একটা বাক্য বলে—“আমি ফিরে এলাম, কিন্তু সে ঘুমায়নি।”
গুহার দেয়ালে তখন একটি নতুন চিহ্ন ফুটে ওঠে—এইবার এক নারীমূর্তি, যার চোখ বন্ধ, কিন্তু ঠোঁটে হালকা হাসি।
গৌরাঙ্গ বলেন, “ঘুমেছে ঠিকই, তবে এবার পার্থিব বাহক জেগে উঠেছে। মানে—এই শক্তি এখন আলো-অন্ধকারের মাঝে ভারসাম্য খুঁজবে।”
অগ্নিবেশের মুখ থমথমে। “তাহলে কপালকুণ্ডলিনী শেষ হয়নি।”
গৌরাঙ্গ বলেন, “না, কারণ সে একবার মাত্র বাহক খোঁজেনি। সে বারবার খোঁজে।”
অধ্যায় ৭: নীরব পাহাড়ের অশ্রু
চাঁদেরডিহির আকাশে এখন আবার পরিচিত পাখির ডানা ঝাপটায়। শিশুরা খেলে, বাজারে লোকজন ভিড় জমায়। কিন্তু পাহাড়ের কোলে দাঁড়িয়ে থাকা ক’জন মানুষ জানে—এই স্বাভাবিকতা কত বড় এক অনিশ্চয়তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। গুহার মুখ আপাতত বন্ধ, জয়ন্তী সুস্থ, অগ্নিবেশ ও সরোজিনী ফিরে এসেছে কলকাতায়। কিন্তু চুপিচুপি এক অদৃশ্য দাগ তাদের সবার মনের মধ্যে গেঁথে গেছে। জয়ন্তী রাতে এখনও স্বপ্নে জেগে ওঠে, তার হাতে আঁকা হয়ে যায় সেই চিহ্ন—ত্রিকুণ্ডল। গৌরাঙ্গবাবু বারবার বলেন, “এই শক্তি নিঃশেষ হয় না, কেবল বাহন বদলায়। তুমি বাহক ছিলে, এখন তুমি তার শাখা।”
অগ্নিবেশ আবার তার পুরোনো গবেষণায় ফিরেছেন, কিন্তু এই অভিজ্ঞতার পর বইয়ের পাতা আর আগের মতো লাগে না। পাণ্ডুলিপি খুললে এখন শব্দ নয়, মনে পড়ে আগুন, রক্ত, আলো, আর সেই কণ্ঠস্বর—“আমি কপালকুণ্ডলিনী…”
তিনি জানেন, এই অভিজ্ঞতা কেবল একটা ইতিহাস নয়, বরং তাঁর নিজের জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে।
কয়েক সপ্তাহ পরে, কলকাতার গঙ্গার ঘাটে বসে সরোজিনী, জয়ন্তী ও অগ্নিবেশ একসঙ্গে চা খাচ্ছেন। জয়ন্তী অনেক শান্ত, কিন্তু এক ধরনের ভার নিয়ে বাঁচছে। “আমি কী স্বাভাবিক হবো না কোনোদিন?” সে জিজ্ঞাসা করে।
অগ্নিবেশ বলেন, “তুমি স্বাভাবিক হয়েছ, কিন্তু অন্যরকমভাবে। তোমার ভেতরে আলো ও অন্ধকার একসাথে বাস করে।”
জয়ন্তী চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, “তবে আমি পাহাড়ে ফিরব।”
“পাহাড়ে?”—সরোজিনী অবাক হন।
“হ্যাঁ,” সে বলে, “কারণ আমি জানি, যতক্ষণ না কেউ পাহাড়ের গোপন দুঃখ বোঝে, ততক্ষণ সে শুধুই এক ঘুমন্ত দৈত্য। আমি পাহাড়ের বন্ধু হতে চাই, পাহাড়ের শোক বুঝতে চাই।”
অগ্নিবেশ কিছু বলেন না, শুধু মৃদু হেসে মাথা নাড়েন। কারণ তিনি জানেন, কপালকুণ্ডলিনীর শক্তির ঘুম যতটা বাইরে থেকে ভয়ঙ্কর মনে হয়, ভিতরে থেকে তা আরও গভীর।
তারপর একদিন খবর আসে—পুরুলিয়ার পাশের গ্রাম ঘাঘরডাঙা-তে, এক পুরনো বটগাছের নিচে একটা কিশোরী আচমকা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, এবং জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর সে বলতে থাকে:
“আমি পাহাড়ের কন্যা। আমি আবার এসেছি। তুমি ডাকো—আমি শুনি।”
গ্রামের লোকেরা ভয় পেয়ে তাকে মন্দিরে নিয়ে যায়।
আর কলকাতায়, চায়ের কাপ হাতে, টিভির খবর দেখতে থাকা অগ্নিবেশ চুপ করে তাকিয়ে থাকেন সেই মেয়েটির দিকে।
তার ঠোঁটে একটুখানি কাঁপন ওঠে, চোখে ধরা পড়ে পুরোনো আলোর ঝলক।
তিনি বুঝে যান—
“এই চক্র শেষ নয়। এ কেবল শুরু…”
সময় চলে যায় নিজের গতিতে। পাহাড় থাকে স্থির, অথচ তার বুকে জমে ওঠে অজস্র অনুচ্চারিত গল্প। চাঁদেরডিহি আজও আছে—তবে অন্যরকম। লোকেরা আবার মেলা বসায়, বউভাত হয়, সন্ধ্যায় ধূপ-ধুনোর গন্ধে ভেসে যায় শালবনের গলি। কিন্তু যারা জেনেছে তার কথা—তারা জানে, এ শান্তি ভেতরে ভেতরে এক নিঃশব্দ সমঝোতা। যেন একটা শক্তিকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে এক চুক্তির বিনিময়ে—”তুমি ঘুমোবে, আমরাও ভুলে যাবো।”
জয়ন্তী এখন সেই পাহাড়েই থাকে, একা। সরকারি সাহায্যে সে একটা গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তুলেছে—আধুনিকতা আর লোকবিশ্বাসের সংযোগস্থল। স্থানীয়রা তাকে এখন “পাহাড়ের রক্ষক দিদি” বলে ডাকে। সে হাসে, গল্প করে, কিন্তু রাতের পর রাতে জেগে বসে থাকে গুহার মুখোমুখি। মাঝেমধ্যে তার শরীর কেঁপে ওঠে, ঘুমের ভেতর সে যেন কারও সঙ্গে কথা বলে।
“তুমি আবার ডাকছো?”
তার ঠোঁটে আসে সেই পুরোনো কন্ঠস্বরের ছায়া।
কপালকুণ্ডলিনী কখনও সত্যিই ঘুমায় না, সে শুধু অপেক্ষা করে তার পরবর্তী বাহকের।
অগ্নিবেশ মুখার্জী কলকাতায় ফিরে লিখে ফেলেছেন সেই গুহা অভিযানের পূর্ণ বিবরণ—তবে তা কোনো প্রকাশকের কাছে যাননি। সে ডায়েরি আজও বন্ধ করে রাখা এক টিনের বাক্সে তালাবদ্ধ। কেউ পড়ুক তা তিনি চান না। কারণ তার লেখা শেষ হয়েছিল এই লাইনটিতে—
“আমরা কপালকুণ্ডলিনীকে জাগাইনি, সে নিজেই জেগেছিল, কারণ আমরা তাকে খুঁজেছি। আর মানুষ যা খোঁজে, তা একদিন তাকে গ্রাস করেই।”
সরোজিনী তার পাঠ্যক্রমে কুণ্ডলিনী যোগ আর শক্তি-তত্ত্বকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন—অবৈজ্ঞানিক বলে নয়, বরং মানবচেতনার গভীর প্রশ্নগুলো ছুঁয়ে দেখার এক মাধ্যম হিসেবে। তার ক্লাসে মাঝেমাঝেই কেউ কেউ প্রশ্ন তোলে—
“ম্যাম, সত্যিই কি আত্মা ছিন্ন হয়?”
তিনি হাসেন, উত্তর দেন না। কারণ কিছু উত্তর জানলেও বলা যায় না, আর কিছু উত্তর বললেও শোনা যায় না।
শুধু এক রাতে, পূর্ণিমার আলোয়, সরোজিনী একবার জয়ন্তীর পাঠানো একটা চিঠি পড়ে থেমে যান।
চিঠিতে লেখা ছিল— “ওর (কপালকুণ্ডলিনীর) আলো এবার আর আগুন নয়, ও শান্ত। ও শুধু জানে—যার মনে লোভ, তার মধ্যেই সে ছায়া ফেলে। তাই নিজেকে আলো রাখাই আমাদের একমাত্র অস্ত্র।”
পাহাড়, গুহা, কপালকুণ্ডলিনী—সবকিছু মিশে যায় কুয়াশায়।
কিন্তু কেউ কেউ জানে, সে আজও পাহাড়ে অপেক্ষা করে।
যদি কেউ আবার ডাকে…
যদি কেউ আবার তার চিহ্ন আঁকে…
তবে তার চোখ খুলবে।
তখন?
তখন আবার সব শুরু হবে।