পর্ব ১
দেবব্রতের প্রথম রাতের ডিউটি। হাওড়ার পুরনো শিল্পাঞ্চলের এক পরিত্যক্ত টেক্সটাইল ফ্যাক্টরিতে সে নিযুক্ত হয়েছে নতুন রাতের প্রহরী হিসেবে। নাম—প্রতুল টেক্সটাইল মিল। মিল বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় তিন বছর, কিন্তু মালিকপক্ষ এখনো জায়গাটা সুরক্ষিত রাখতে চায়—কোনো সরকারি নোটিশ, জমি দখল বা আগুন যেন না লাগে, এইসব ভেবে একজন নিরাপত্তারক্ষী রাখা হয়েছে। নিঃশব্দ এক জায়গা, চারপাশে ভাঙাচোরা কারখানা, পেছনে এক পুরনো জলের ট্যাংকির নিচে গেট ঘর। সন্ধ্যার পরই মিলের সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়, শুধু মূল গেটের একটা নীল আলো ছাড়া। সেই আলোয় আজ প্রথম বসেছে দেবব্রত, মাথায় টুপি, পাশে একটা টর্চ আর বিস্কুটের প্যাকেট।
নীলকমল কাকু, যিনি চাকরিটা জোগাড় করে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, “একটা কথা মনে রাখিস—রাত দুটো নাগাদ খেয়াল রাখবি, ঘুমিয়ে পড়িস না। সময়টা খারাপ।” তখন দেবব্রত হেসেছিল। তার যুক্তিবাদী মন এসব ভয়ভীতি বা কুসংস্কারে বিশ্বাস করত না। কিন্তু রাত যত গভীর হচ্ছিল, বাতাসের শব্দ, দূরের কুকুরের ডাক, মাঝে মাঝে দূরের ট্রেনের কুয়াশামেশানো হুইসেল—সব মিলিয়ে জায়গাটা ধীরে ধীরে যেন বদলে যাচ্ছিল। একটা অদৃশ্য দমবন্ধ করা নিঃশব্দতা জমে উঠছিল তার চারপাশে।
ফ্যাক্টরির মূল অফিস ঘরটা তালা দিয়ে বন্ধ ছিল, কিন্তু ঘুরতে ঘুরতে দেবব্রত দেখল, দরজার তালাটা ভাঙা। কৌতূহলে দরজাটা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকল। আলো জ্বালানোর সুইচ কাজ করল না। মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে সে ঘরের ভেতরে তাকাল—ধুলো ঢাকা ডেস্ক, দুটো ভাঙা চেয়ার, একটা ছেঁড়া ক্যালেন্ডার আর এক কোণে একটা ছোট কাঠের তাক, তার ওপরে রাখা একটা পুরনো নোটবুক। লাল মলাট, কোণাগুলো ছেঁড়া, কিন্তু বাঁধাই শক্ত। ধুলো সাফ করে প্রথম পাতা খুলতেই তার চোখ আটকে গেল:
“যদি এটা রাত ২:১৭-এ পড়ে থাকো, তাহলে পেছনে তাকিও না।”
হৃদস্পন্দন মুহূর্তে দ্বিগুণ হয়ে গেল দেবব্রতের। সে হেসে ফেলল, কিন্তু কণ্ঠে একরকম কাঁপুনি টের পেল। “কেউ নিশ্চয়ই আগে লিখে গেছে, ভয় দেখানোর জন্য।” কিন্তু পাতাগুলো উল্টাতেই লেখাগুলো আরও অদ্ভুত হয়ে উঠল।
“২:২০ – পশ্চিম দিকের টয়লেটের পেছনে আওয়াজ হবে।
২:২৩ – গেটের সামনে দিয়ে একটা বিড়াল যাবে।
২:২৬ – ফোনে অচেনা নম্বর থেকে একটা কল আসবে। ধরো না।”
দেবব্রত ঘড়ি দেখল—রাত ২:১৮। এত নির্দিষ্ট সময়! কৌতূহল আর ভয় মিশে এক ধরনের শীতলতা নামল তার পিঠ বরাবর। সে চুপ করে বসে রইল, চারপাশ নিঃস্তব্ধ। ঠিক ২:২০-তে দেওয়ালের ওপারে একটা ধপধপে শব্দ। একটানা নয়, যেন কিছু একটা হঠাৎ পড়ে গেল। সে জানে ওইদিকে কোনো মানুষ নেই, শুধু একটা পুরনো টয়লেট ঘর। ২:২৩-তে, একদম ঘড়ির কাটার সঙ্গে মিলে, একটা ধূসর রঙের বিড়াল গেটের সামনে দিয়ে ছুটে গেল। এবার তার গলা শুকিয়ে এলো। আর ২:২৬-তে—ফোন বেজে উঠল।
স্ক্রিনে কোনো নাম নেই, শুধু এক কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে অদ্ভুত এক সাদা চিহ্ন—ত্রিভুজের ভিতরে একটা চোখ, চোখের নিচে একটা সিঁদুরের মতো দাগ। সেই মুহূর্তে তার হাত কাঁপতে থাকে। সে ফোনটা তোলে না। ফোন থেমে যাওয়ার পর সে একবার নোটবুকের দিকে তাকাল। সেখানে লেখা:
“ভেবো না এগুলো কাকতালীয়। তুমি এখন একটা খেলা শুরু করেছো। পাতাগুলো যত পড়বে, সময় তত তোমাকে চিনবে।”
ঘাম জমে উঠল কপালে। সে বুঝতে পারল, এটা কোনো সাধারণ জিনিস নয়। কে লিখেছে এইসব? এত সুনির্দিষ্ট সময়ের ভবিষ্যদ্বাণী কেউ লিখল কীভাবে? মোবাইলে নেট নেই, কারখানার ভিতরে কোনো সিগন্যালও ওঠে না। সে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে জানালার বাইরে তাকাল। একটা নিঃশব্দ আলো দেখা যাচ্ছে স্টোরেজ রুমের পাশের জানালা থেকে। অথচ সে জানে, ওই ঘরে কোনো আলো নেই। সে আবার বসে পড়ল। যেন নোটবুকের কাছে বসা মানে একটু নিরাপদ থাকা।
একটা পাতায় লেখা ছিল:
“তুমি এই মুহূর্তে যা ভাবছো, তা তোমার নয়। তা এই পাতার। এখন থেকে আমরা ভাবব, তুমি শুধু পালন করো।”
দেবব্রত এবার বই বন্ধ করতে গেল। কিন্তু হাত আটকে গেল মাঝপথে। যেন বইটা নিজের ইচ্ছায় বন্ধ হতে চাইছে না। বাতাস হঠাৎ ভারি হয়ে এল, আর এক অদ্ভুত শব্দ—যেন বাতাসের ভিতর দিয়ে কারও নিঃশ্বাস। দরজাটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল নিজে থেকে। মোবাইলের আলো নিভে গেল। ঘরে নেমে এলো কালো।
এক মুহূর্তে সে বুঝল—এই জায়গা আর সাধারণ নেই।
তখন সে আবার বইটা খুলল। শেষ পাতায় লেখা:
“তোমার সময় শুরু হয়েছে। শেষ পাতায় দেখা হবে।”
এক অন্ধকারে সে জেগে বসে রইল, হাতে লাল মলাটের নোটবুক। এবং এক গভীর বিশ্বাস তার ভিতরে জন্ম নিচ্ছিল—এই রাত আর শুধু রাত নয়। এটা এক পরীক্ষার সূচনা।
পর্ব ২
ঘড়িতে তখন ২:৩৫। দেবব্রত নিঃশব্দ ঘরে বসে আছে, সামনের টেবিলে লাল মলাটের নোটবুকটা খুলে। বাইরের গেটের নীল আলো নিভে গেছে কিছুক্ষণ আগেই, অথচ সে তো জানে, ওটা কখনো নিভে না। বাতাসের শব্দ নেই, কুকুরের ডাক নেই, এমনকি দূরের ট্রেনের হুইসেলও নেই। যেন পুরো শহর একটা স্তব্ধ ঘুমে ডুবে গেছে। শুধু সে জেগে আছে—আর তার সামনে খোলা একটা ভবিষ্যদ্বাণীময় খাতা।
তার কাঁধের ওপর দিয়ে হঠাৎ যেন ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল। সে চমকে ঘুরে তাকাল। কেউ নেই। কিন্তু তার শরীরে গাঁইটে গাঁইটে কাঁপুনি। সে আবার নোটবুকের পাতায় চোখ রাখল। নতুন লেখা ফুটে উঠছে চোখের সামনে—ঠিক যেন কালি না, আলোয় লেখা:
“২:৩৭ – দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছো তুমি, কিন্তু ভেতরে তুমি বসে। দুটো আমি, একটাই তুমি।”
দেবব্রত ভয় আর বিস্ময়ের দোলাচলে দুলতে দুলতে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজার নিচ দিয়ে ছায়া দেখা যাচ্ছে। কেউ দাঁড়িয়ে আছে, চুপচাপ, নড়ছে না। ভেতর থেকে টর্চ জ্বালাল সে, আলোর রেখা দরজার নিচে গিয়ে পড়তেই ছায়াটা সরে গেল। কিন্তু দরজা খোলার সাহস করল না সে।
সে আবার টেবিলের দিকে ফিরল। খেয়াল করল, ঘরের বাতাস ভারি হয়ে উঠছে। যেন শব্দ ছাড়া কেউ নিঃশ্বাস ফেলছে তার কানের পাশে। মোবাইল বার করে আলো জ্বালাল। সেই অদ্ভুত ত্রিভুজ-চোখ চিহ্নটা ফোনের স্ক্রিনে এখনও আছে—পেছনের ওয়ালপেপার হিসেবে সেট হয়ে গেছে। অথচ সে কিছুই বদলায়নি।
নোটবুকের আরেক পাতা খুলতেই সে দেখল:
“২:৪১ – তুমি যা ভেবেছো বাস্তব, তা কেবলই তোর সঙ্গে ঘটে চলা এক ভবিষ্যতের ছায়া।
২:৪৪ – নিচে গ্যারেজ ঘরের তালা খুলে দে। তোর উত্তর সেখানে।”
সে দাঁড়িয়ে উঠে স্টোররুমের নিচতলার দিকে গেল। সিঁড়ির নিচে গ্যারেজ ঘর, যেখানে পুরনো যন্ত্রপাতি রাখা হতো। দরজার তালা বেশির ভাগ সময়ই বন্ধ থাকে, কিন্তু সে লক্ষ্য করল তালাটা অর্ধেক খোলা। সে এগিয়ে গিয়ে তালাটা খুলল, আর দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।
ঘরটা অন্ধকার, ভেতরে ঠান্ডা, দেওয়ালে ছেঁড়া ক্যালেন্ডার—তারিখ থেমে আছে ২০১৫-র ফেব্রুয়ারিতে। একটা মরা পাখির কঙ্কাল পড়ে আছে এক কোণে, এবং ঘরের মাঝখানে একটা ছোট কাঠের টুলের ওপর রাখা আরেকটা নোটবুক—একদম আগেরটার মতো, কিন্তু কালো মলাটে।
সে বইটা খুলল।
প্রথম পাতায় লেখা:
“নোটবুক ২ | লেখক: শ্যামল দত্ত, রাত্রি প্রহরী, নিখোঁজ – ২০১৫”
দেবব্রত চমকে উঠল। সে তো শুনেছিল, আগে এখানে একজন প্রহরী ছিল যিনি হঠাৎ উধাও হয়ে যান—তার খোঁজ মেলেনি কখনো। কেউ কেউ বলত, বুড়ো বয়সে হারিয়ে গিয়েছিলেন। কেউ বলত, অফিসের কিছু নথি চুরি করে পালিয়েছিলেন। আর সেই মানুষটা, শ্যামল দত্ত, নিজের হাতে এই নোটবুক লিখেছেন?
সে পড়তে শুরু করল:
“প্রথম রাত, ২০১৫। ঘড়িতে ২:১৭। একটা ছায়া পেছনে এসে দাঁড়ায়, কথা বলে না, শুধু শুনে। আমি তার ভাষা বুঝি না, কিন্তু মাথায় একটা শব্দ ঘুরতে থাকে—‘সময় ফিরে আসে।’ দ্বিতীয় রাতে সে আমার নাম ধরে ডাকে। তৃতীয় রাতে আমি দরজা খুলে দিই। চতুর্থ রাতে আমি আর আমি থাকি না।”
দেবব্রতর গলা শুকিয়ে এলো। এই নোটবুক সে সঙ্গে করে নিয়ে উপরে ফিরল। ঘরের বাতাসে যেন চাপা শিসের মতো শব্দ। সে আবার বসে আগের লাল মলাটের খাতাটা হাতে নেয়। এবার সে দেখতে পেল—দু’টো নোটবুক পাশাপাশি রাখলে, তাদের পাতার গঠন, লেখার বিন্যাস—সব এক! ঠিক যেন কেউ একই স্ক্রিপ্ট দিয়ে আলাদা দুটো নাটক লিখেছে।
নোটবুকের পরবর্তী লেখাটি ছিল আরও অস্বস্তিকর:
“২:৫১ – তুই ভাবছিস, তুই এখনও তুই আছিস। কিন্তু শ্যামলও তাই ভাবত। সময় ফিরে আসে না, সময় তোর ভেতরে ঢোকে।”
সে টেবিলের কাঁচে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল। কিন্তু সে যাকে দেখছে, তার চোখে লালচে রঙ। সে চোখ কুঁচকে তাকাল। নিজেকে ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করল।
সে আবার পাতায় তাকায়।
“২:৫৫ – পেছনের আয়নায় যাকে দেখবি, তার হাতে তোর আগামী লেখা। তাকিয়ে থাকিস, চোখ সরাস না।”
সে জানে, ঘরের এক কোণে একটা আয়না আছে—পুরনো অফিসের সাজের অংশ। সে ধীরে ধীরে সে দিকে হাঁটে, বুক ধুকধুক করছে। আয়নার মধ্যে প্রতিফলন—সে নিজেই। কিন্তু তার পিছনে দাঁড়িয়ে কেউ, ঝাপসা, হেঁটে যাচ্ছে এক পাশে। সে হঠাৎ ফিরে তাকাল—কেউ নেই।
আয়নার দিকে আবার তাকাল। এবার আর সে নিজেকে দেখতে পেল না। আয়নায় শুধু নোটবুকের পাতা খোলা, আর তার ওপর লেখা:
“আজ রাতে সব শেষ নয়। আজ রাতে শুরু। ৩:০১ – তুই এবার লিখবি। তোর হাতে কালি থাকবে না, তোর মনে শুধু শব্দ।”
দেবব্রত বুঝল—এ শুধু নোটবুক নয়, এটা এক চক্র। কেউ একটা শুরু করেছিল, এখন এটা তার কাছে এসেছে। প্রতিটা রাত্রি, প্রতিটা সময়, তার চলার গতি ঠিক করে দিচ্ছে এই পাতাগুলো।
ঠিক তখনই পেছন থেকে একটা হালকা গলায় কেউ বলল, “তুই এবার বুঝেছিস, তোই নতুন লেখক।”
সে ঘুরে তাকায়—কেউ নেই।
কিন্তু আয়নায় দেখা যাচ্ছে—সে বসে লিখছে, কিন্তু তার শরীর হালকা, মুখটা অন্যরকম, যেন শ্যামলের মুখ।
এবং তখনই, দরজার বাইরের তালা নিজে থেকে বন্ধ হয়ে যায়।
পর্ব ৩
ঘরের দরজাটা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেল। কোনো বাতাস নেই, কোনো টানও নেই। তবু তালা-লাগানো শব্দটা এত স্পষ্ট যে যেন কেউ বাইরে থেকে ধীরে ধীরে চাবি ঘুরিয়ে দিল। দেবব্রত চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠল। বুক ধড়ফড় করছে। মোবাইলে আলো জ্বালাতে চাইলো, কিন্তু ব্যাটারি মৃত। কেবলমাত্র নীল আলোটা—যেটা মূল গেটে জ্বলছিল, এখন জানালার ফাঁক দিয়ে খুব ধোঁয়াটে ভাবে এসে পড়ছে, যেন আলোর মধ্যে কুয়াশা। তার সামনে লাল মলাটের নোটবুকটা খোলা। পাশে রাখা কালো মলাটের বইটার প্রথম পাতায় যেন হালকা করে ভেসে উঠছে নতুন কিছু শব্দ—যা সে লিখেনি।
“ছায়া যখন দেখে, তখন সে পড়ে না। সে শুধু লেখে। এখন তুই দেখবি। এখন তোর চোখে আলো নেই, শুধু ছায়া আছে।”
দেবব্রত এবার জানালার কাছে গিয়ে দেখতে চাইল, বাইরেটা কেমন। মিলের ভেতরকার উঠোনে কারখানার ছায়া পড়েছে, কিন্তু সেই ছায়ার মধ্যে কেউ দাঁড়িয়ে আছে—নড়ছে না, কেবল ছায়া। সে বুঝতে পারল না, ওটা কার ছায়া। মানুষের মতো, কিন্তু মাথা একটু বাঁকা, হাত লম্বা আর স্পষ্টতই পা নেই, কুয়াশার মধ্যে ভেসে আছে।
সে আবার বইটার দিকে ফিরল। পাতায় লেখা—
“তুই যা দেখছিস, তা ভবিষ্যতের ছায়া নয়। এটা অতীতের দাগ। এখানে যারা ছিল, তারা আজও আছে—আলোয় নয়, ছায়ায়। প্রত্যেক নোটবুক একেকটা দরজা।”
হাতজোড়া দিয়ে সে বইদুটো বন্ধ করতে চাইল। কিন্তু হাত কেঁপে উঠল। টেবিলের কাঁচে আবার নিজের প্রতিবিম্ব দেখল—চোখের কোণ লাল, মুখে ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু কিছু ছিল যা বদলে গেছে। মনে হলো, সেই আগের দেবব্রত নয়। যেন একটা অদৃশ্য ভার এসে পড়েছে তার শরীরে, একটা অসম্পূর্ণ বোধের মতো—যা মানুষ উপলব্ধি করে, বোঝে না।
ঠিক তখনই ছাদ থেকে একটা আওয়াজ এল। ধপ ধপ। যেন ভারী কিছু নামছে নিচে। তার শিরদাঁড়া বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেল। কারখানার ছাদে যাওয়ার কোনো সিঁড়ি নেই। শুধু বাইরের পেছনের দিক দিয়ে লোহার সিঁড়ি উঠে গেছে, যেটা প্রায় ব্যবহার হয় না। সে জানে, সেখানে কেউ যাওয়ার কথা নয়। তবু সে অনুভব করল—ওখানে কেউ আছে।
নোটবুকে লেখা:
“তোর পেছনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছি। আমি তোর সময়। আমি তোর লেখা। এখন থেকে যতক্ষণ তুই লেখবি না, তুই এখান থেকে বের হতে পারবি না।”
দেবব্রত হাঁফাতে শুরু করল। সে কি কিছু লিখবে? সে তো লেখক নয়, সে তো শুধু পড়ছিল। কিন্তু টেবিলের ওপর হঠাৎ করেই দেখা গেল, লাল মলাটের বইয়ের এক খালি পাতা খুলে গেছে। পাশে রাখা একটা পুরনো ফাউন্টেন পেন—যেটা আগেই সেখানে ছিল না—গড়িয়ে এলো পৃষ্ঠার ওপর।
হাতটা নিজে থেকেই উঠল। তার কাঁপা আঙুল পেনটা ধরল।
প্রথম শব্দ—
“আমি এখনও আমি কি?”
তারপর দ্বিতীয় লাইন—
“ছায়া কথা বলে না। ছায়া শুধু অপেক্ষা করে।”
তার হাত চলছে, অথচ সে জানে না কী লিখছে। মনে হলো কেউ তার আঙুলে হাত রেখে লিখিয়ে নিচ্ছে। সে থামতে চাইলো, কিন্তু পারলো না। তিন লাইন, চার লাইন, ছয় লাইন। পাতাটা ভরে গেল। এবং সেই মুহূর্তে বাতাসের গতি বাড়ল। যেন কারখানার ভেতরে একটা নিঃশব্দ ঝড় বইতে শুরু করল।
টেবিলের কাঁচ ফাটতে শুরু করল। চেয়ার হেলে পড়ল। সে টেবিল ধরে কোনোরকমে দাঁড়িয়ে রইল।
আর ঠিক তখনই পিছনে কে যেন খুব হালকা গলায় ফিসফিস করে বলল—
“তুই শ্যামল নস, কিন্তু শ্যামলের লেখা তুই শেষ করবি।”
সে ঘুরে তাকাল। কেউ নেই। কিন্তু পাশের আয়নায় আবার সে দেখতে পেল—শ্যামল দাঁড়িয়ে আছে, কাঁধে একটা ঝোলা, পরনে পুরনো ইউনিফর্ম, চোখে বিস্ময়ের ছাপ। দেবব্রত তাকে বলল, “তুমি কে?”
আয়নার ভিতরের শ্যামল কোনো উত্তর দেয় না। শুধু হাত বাড়িয়ে একটা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে দেয়। দেবব্রত তখনই বোঝে—সে একটা ছায়ার মধ্যে প্রবেশ করেছে, যার আয়তন নেই, শুধু গভীরতা আছে।
সে আবার বইয়ের দিকে ফিরে তাকায়। লেখা পাল্টে গেছে। পাতায় লেখা—
“লিখে যা, যতক্ষণ পর্যন্ত ছায়া তোর ভিতরে না ঢোকে। একবার ঢুকলে, তুই আয়না হয়ে যাবি।”
ঘরের চারপাশে এখন আর শব্দ নেই। শুধু এক অদ্ভুত ঘড়ির টিক টিক—যা দেয়ালের কোথাও নেই, কিন্তু সে শুনতে পাচ্ছে। এই শব্দ সময় নয়, এটা যেন কাউন্টডাউন। তার বুকের ভিতর এখন আর ভয় নেই, শুধু একরকম তীব্র কৌতূহল। সে আবার পেন তুলে লেখে—
“তুমি কে? কেন আমি? কত রাত বাকি আছে?”
আর তখনই দরজার ফাঁক দিয়ে এক টুকরো কাগজ এসে ভেসে পড়ে টেবিলের ওপর। দেবব্রত কাগজটা তুলে দেখে, সেখানে একটাই লাইন লেখা—
“রাত যত বাড়বে, তুই আমি হবি। আমি তুই হব। আর আমরা একসঙ্গে লিখব শেষ পাতা।”
দেবব্রত আর জানে না ঘড়িতে ক’টা বাজে। বাইরের আলো নিভে গেছে। ভিতরে কোনো শব্দ নেই। কিন্তু তার মাথার ভিতর, লেখার শব্দ চলছে। যেন প্রতিটা শব্দই তার দেহ থেকে একটা করে ছায়া বের করছে।
সে জানে—এই খেলায় এখন সে আর শুধুই পাঠক নয়।
পর্ব ৪
আয়নার মধ্যে নিজেকে দেখতে না পেয়ে একধরনের ঠান্ডা ঘাম জমেছিল দেবব্রতের কপালে। সেই আয়নায় এখন কেবল এক ঝাপসা প্রতিচ্ছবি—যা নড়ছে, কিন্তু তার মতো নয়। প্রতিটা মুহূর্তে যেন আয়না নতুন কিছু বলছে, অথচ কোনো শব্দ নেই। সে একটানা তাকিয়ে ছিল, যতক্ষণ না মনে হলো—নিজের দৃষ্টির নিচে কিছু একটা লেখা ফুটে উঠছে। আয়নার নিচের অংশে কুয়াশার মতো আবছা হয়ে ধরা দিচ্ছে এক লাইন লেখা, আয়নার ভেতর, যেন কাচের উল্টো দিক থেকে খোদাই করা—
“যাকে আয়নায় দেখিস না, সে-ই তোকে দেখছে।”
দেবব্রত ধীরে ধীরে পেছনে হাঁটে, তারপর আবার টেবিলের কাছে ফিরে আসে। নোটবুকদুটো ঠিক যেখানে রেখেছিল, সেখানেই আছে। কিন্তু এবার কেমন যেন পাল্টে গেছে পাতার গন্ধ। যেন নতুন লেখা হয়েছে কিছু, কিন্তু কালি শুকোয়নি। সে বই খুলে দেখে—লেখা চলছেই, অথচ সে লিখছে না। লাইনগুলি একটার পর একটা লেখা হচ্ছে, পাতার ওপর নিজে নিজে। কালি বেরোচ্ছে, শব্দ তৈরি হচ্ছে, কিন্তু কেউ পাশে নেই।
“আয়নার পেছনে এক ঘর আছে, আর সেই ঘরে তোর লেখা পড়ে।
তুই প্রতিদিন যা ভাবিস, তারা সেই ভাবনা খেয়ে বাঁচে।
তোর ভয়গুলো, স্বপ্নগুলো, নির্জনতাগুলো—সব তারা সংরক্ষণ করে।”
সে পাতায় হাত রাখল। পাতাটা ঠান্ডা, কিন্তু যেন স্পন্দিত। তার মনে হলো এই শব্দগুলো শুধু লেখা নয়, এগুলো প্রাণ। প্রতিটা লাইন তার ভিতরের কোনো অদৃশ্য স্মৃতি উসকে দিচ্ছে—একটা পুরনো কাচের বোতলের কথা, ছোটবেলায় শোনা একটা গল্প, কলেজের হোস্টেল ঘরে একরাতে হঠাৎ নিভে যাওয়া আলো, একটা মুখ—যা হয়তো কোনোদিন ঠিকভাবে মনে রাখেনি সে।
নোটবুক এবার লিখল:
“তুই যে জীবন বাঁচিস, তা একটা অনুলিপি।
আসল জীবনের ছায়া পড়েছে আয়নার উল্টো পাশে।
যদি সাহস থাকে, আয়নার ঘর খোল।
কিন্তু মনে রাখিস, তুই একবার ঢুকলে আর ফিরে আসবি না।”
এই লেখাটা পড়েই দেবব্রত বুঝতে পারল, এবার সময় এসেছে।
সে আবার আয়নার দিকে এগিয়ে গেল। আয়নার বাঁ পাশে হাত দিয়ে চাপ দিতে গিয়ে দেখতে পেল—ওটা আসলে একটা দরজা। আয়নার চারকোনা ফ্রেমে ক্ষীণ ফাঁক ছিল, যা সে আগেই খেয়াল করেনি। সে দুহাতে ধাক্কা দিল। কাঁচের আয়না ধীরে ধীরে একটা গোপন দরজার মতো সরে গেল—আর তার পেছনে ফুটে উঠল এক সরু সিঁড়ি, যা নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে অন্ধকারে।
সে পেছনে একবার তাকাল। ঘরটা নিঃস্তব্ধ। ফ্যাক্টরির ছাদের ফাঁক দিয়ে আলো আসছে না, ফোন নিঃসাড়, বাইরের শব্দ নেই। ঘড়ির কাঁটা থেমে গেছে ৩:১৩-এ।
সে পা বাড়াল সিঁড়িতে।
প্রতিটা সিঁড়ি নিচের দিকে নামছে ধীরে ধীরে, মাথার ওপর একটাই ক্ষীণ বাল্ব, যেটা চিরে চিরে জ্বলছে আর নিভছে। যেন সময় নিজেই টলছে। নিচে নেমে এসে সে ঢুকল একটা ছোট ঘরে, যেখানে একটাই টেবিল, একটাই চেয়ার আর চারপাশে হাজারো আয়না—ছোট, বড়, গোল, ভাঙা, ফ্রেমবিহীন। প্রতিটা আয়নাতে একটা একটা মুখ। কিছু অচেনা, কিছু পরিচিত।
কিন্তু সব মুখেই একটা মিল—তারা কেউই নিজেদের দিকে তাকিয়ে নেই। তারা তাকিয়ে আছে শুধু একদিকে—দেবব্রতের চোখে।
ঘরের মাঝখানে রাখা টেবিলের ওপর একটা আয়না আর একটা খাতা রাখা। খাতার ওপর লেখা:
“শেষ পৃষ্ঠা”
এবং আয়নার নিচে খোদাই করা:
“যদি লিখতে চাস, তাহলে ভুলে যা তুই কে ছিলি।
তোর নাম নয়, তোর ছায়া এই পৃষ্ঠা ভরবে।”
সে থমকে গেল। নাম ভুলে যাওয়া মানে কি নিজেকে ভুলে যাওয়া?
সে জানত না এই ঘর কার, কেন এত আয়না, কারা এই মুখগুলো। কিন্তু মনে হচ্ছিল, সে যেন সব জানে—কেবল নামগুলো মনে নেই। এই মুখগুলো তার স্বপ্নে এসেছিল বহুবার, অথবা কখনো রাস্তায় হঠাৎ দেখা হয়ে গিয়েছিল। কেউ হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, কেউ চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। সব মিলিয়ে, এই আয়নাগুলোর ভেতরে জমে আছে একজীবন।
সে খাতাটা খুলল। খালি পৃষ্ঠা। কলমটা তুলে ধরল। হাত কাঁপছে না আজ। সে জানে এখন থেকে লেখাটা তার, কিন্তু পাঠক হয়তো সে-ই নয়। হয়তো কেউ দেখছে, কেউ পড়ছে, কেউ অপেক্ষা করছে।
সে লিখল—
“আমি কোনো সময়ের মানুষ নই। আমি কেবল এক সময়ের প্রতিচ্ছবি।
আমার ঘুম ভাঙে রাত ২:১৭-এ, আর শেষ হয় যখন আয়নায় কেউ নিজেকে খুঁজে পায় না।
আমি ছায়া নই, আলোও নই। আমি সেই গল্প, যেটা কেউ লিখতে চায়নি।
তবু লেখা হয়ে গেছে।”
লেখা শেষ হতেই ঘরের সব আয়না হঠাৎ কেঁপে উঠল। আলো নিভে গেল। সমস্ত আয়নাগুলো অন্ধকারে মিশে গেল, কেবল একটাই আয়নায় নিজের মুখ দেখতে পেল দেবব্রত—কিন্তু সেটাও তার মুখ নয়। মুখটা ধীরে ধীরে শ্যামলের, তারপর আরেকটা, তার আগের কারো। একে একে অসংখ্য মুখ তার মুখে আসছে আর যাচ্ছে। তার চেহারা একটাই থেকে যাচ্ছে, কিন্তু চোখ—চোখ শুধু বদলে যাচ্ছে।
আর তখনই ঘরের দেয়ালে ভেসে উঠল এক লাইন:
“আগামী ডিউটি—২:১৭।
নতুন প্রহরীর অপেক্ষায়।”
পর্ব ৫
সেই রাত থেকে ঘড়ির কাঁটা আর আগের মতো চলে না। সময় যেন নিজস্ব গতিপথে চলে—একটা রক্তমাখা পেনের খোঁচায়, আর প্রতিটি পাতায় ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে ভবিষ্যতের নয়, অতীতের নয়—বরং এমন এক মুহূর্তের যা কখনো ঘটেনি, কিন্তু ঘটতে বাধ্য। দেবব্রত এখন আর সময় গুনে না, তার কাছে “দুইটা সতেরো” শুধু একটা সময় নয়—একটা দরজা, যার ভিতর সে ঢুকে গেছে চিরতরে। আয়নার ঘরটা থেকে বেরিয়ে যখন সে আবার মূল অফিস ঘরে ফিরল, তখন চারপাশে আলো ছিল না, জানালায় পোকা ধরার শব্দ ছিল না, এমনকি বাতাসও থেমে গিয়েছিল। শুধু সেই লাল আর কালো মলাটের বইদুটো টেবিলের উপর রাখা, কিন্তু এবার মাঝখানে একটি নতুন খাতা রাখা ছিল—ছেঁড়া ধূসর মলাট, ওপরটা যেন ছাইমাখা। কোনো নাম নেই, লেখকের পরিচয় নেই, শুধু প্রথম পৃষ্ঠায় ছোট করে লেখা: “খাতাকলম”। আর তার নিচে: “শুধু রাতে খোলে।”
সে ধীরে ধীরে বইটা খুলল। প্রথম পাতাটাই ফাঁকা। কিন্তু পরের পাতায় লেখা—“যখন তুই লিখিস, তখন তোর লেখার মধ্যে ঢুকে পড়ে কিছু। প্রতিটা শব্দে ঘুমিয়ে থাকে এক ছায়া। যে জেগে ওঠে, যদি তুই থামিস।” দেবব্রত লেখক ছিল না কখনো, কিন্তু এখন তার আঙুলগুলো পেনের জন্য কাঁপে। একটা পেন যেন তার নিজের নয়, বরং সে নিজে এখন পেন—যাকে ধরা হয়েছে, চালানো হচ্ছে অদৃশ্য কারও দ্বারা। খাতার পাশে রাখা ছিল এক অদ্ভুত কালির শিশি—তার গায়ে নাম নেই, কোনো লেবেল নেই, কেবল ঢাকনাটা সোনালি রঙের আর তার গায়ে খোদাই করা একচোখা মুখ। সে শিশি খুলল না। শুধু পাশে রাখা পেনটা হাতে নিয়ে খাতার দ্বিতীয় পাতায় লিখল: “আমি লিখি, কারণ আমাকে লেখা হয়।” সে জানে না কেন এই লাইনটা এল মাথায়। কিন্তু লিখেই সে দেখতে পেল—শব্দগুলো একটু একটু করে পাতার নিচে গলে যাচ্ছে, যেন কালি নয়, শরীর। সে যত লিখছে, শব্দগুলো পাতার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। আর একসময় পাতাটা আবার সাদা হয়ে যাচ্ছে।
সে দ্বিতীয় বার লিখল:
“আমি কে? আমি কে? আমি কে?”
এইবার শব্দগুলো পাতার ভেতর গলে গিয়ে আরেকটি লাইন হয়ে উঠল—
“তুই যাকে খুঁজছিস, সে তোর ভিতরেই বসে আছে। তোর ছায়া লেখা শুরু করুক।”
সে পিছনে ফিরে তাকাল। কারো উপস্থিতি নেই, অথচ সে জানে—একমাত্র সে এখন একা নেই। ঘরের ছায়াগুলো একটু একটু করে গাঢ় হচ্ছে। জানালার গ্লাসে তার নিজের প্রতিবিম্ব নেই। কিন্তু কোথাও একটা কাঁচের আওয়াজ—মনে হচ্ছে একটা বড় আয়না ফেটে গেল। সে বাইরে তাকাল—মিলের উঠোনে ছাদ থেকে ঝুলে থাকা বাতিটা দুলছে, অথচ বাতাস নেই।
সে আবার খাতার দিকে ফিরল। পাতাগুলো গন্ধ ছড়াচ্ছে, যেন পুরনো পাতা, ভিজে মাটি আর অদ্ভুত এক ধূপের মতোন কিছু মিলে গেছে। পাতার নিচে লেখা উঠছে নিজে থেকেই—
“তুই আজ যদি না লিখিস, আগামী রাতের লেখক আসবে না। সময় বাঁধা আছে কেবল লেখায়।
তোর প্রতিটি বাক্যই এক ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে। ভুল বাক্যে ভুল রাত নামে।”
তার মাথার মধ্যে শব্দ ঘুরতে থাকে। কে এই ভবিষ্যৎ লেখক? আর সে নিজেই বা কাদের পরে এসেছে? সে কি শ্যামলের পরবর্তী? আর তার পর কে আসবে?
ঠিক তখনই দরজার নিচ দিয়ে একটা কাগজ ভেসে আসে। সে তুলে নেয়। মোটা খসখসে পেপার, তার ওপরে কালি দিয়ে লেখা—“আমি এসেছিলাম ১৯৮৯-এ। আমি লিখেছিলাম ২১টি রাত। আমি শ্যামলের আগের জন। আমি এখনও ফিরে যাইনি। আমি এখনও লেখার মধ্যে আছি।”
কোনো নাম নেই, কোনো স্বাক্ষর নেই।
দেবব্রতর পিঠ ঘেমে উঠল। তার মাথার ভেতর যেন কেউ কিসব ফিসফিস করে বলছে—লিখে যা, থামিস না। সে এবার আবার কলম তোলে।
“যদি আমি চলে যাই, তাহলে কি কেউ জানবে আমি ছিলাম?”
“যদি লেখা আমার অস্তিত্ব হয়, তবে পাঠক কে?”
ঠিক তখনই বাইরের লোহার গেটের বড় আওয়াজ—চ্যাঁচামেচি, যেন কেউ ঢুকতে চাইছে। সে চেয়ার থেকে উঠে গেট ক্যামেরার স্ক্রিনটা চালু করল। স্ক্রিনে একটা ছায়া, কুয়াশার ভেতরে ঢাকা মুখ—চোখদুটো শুধু জ্বলছে। হাতের ইশারায় ছায়ামূর্তিটা তাকে বলছে—“সময় শেষ হয়ে আসছে। দরজা খোলো।”
সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। গেটের তালা খুলতে গিয়ে তার আঙুল কাঁপতে থাকে। কিন্তু দরজার পাশেই নোটবুকের পৃষ্ঠায় আবার ভেসে উঠল লাইন—“এই ছায়া লেখে না। এই ছায়া পড়ে। দরজা খোল মানেই সে তোর লেখা চুরি করবে। আর তখন তুই হারিয়ে যাবি পাতার ফাঁকে।”
সে থমকে গেল। দরজা খুলল না। কেবল গেটের দিকে চেয়ে রইল। ছায়ামূর্তিটা ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল, কুয়াশার ভেতরে মিশে গেল।
সে জানে, এই খাতার খেলা এখনও শেষ হয়নি। এখনো অনেক পৃষ্ঠা বাকি। কিন্তু সে যেটা আগে জানত না, আজ সেটা স্পষ্ট হলো—প্রতিটা খাতা কেবল একটা বই নয়। ওগুলো হলো কারাগার, যেখানে বন্দি আছে তাদের স্মৃতি, যারা কোনোদিন প্রকাশ পায়নি। যারা লিখতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি।
আর এখন সেই দায়িত্ব তার—রাত যত গভীর হয়, খাতা তত ক্ষুধার্ত হয়। সে লিখে যায়, পাতার পর পাতা, প্রশ্নের পর প্রশ্ন—
“আমি লেখক নই।
আমি সেই যার কথা কেউ লেখেনি।
আমি এক অনুলিপি,
এক অনির্ধারিত মুখ।”
পর্ব ৬
ফ্যাক্টরির ভিতর যেন একটা গভীর নিঃশ্বাস গুমরে আছে—যা কখনো বাইরে বেরোয় না, কেবল ভিতরে গড়িয়ে পড়ে। দেবব্রত জানে, এই ঘর এখন আর কাগজ আর কালি দিয়ে তৈরি নয়—এটা এক অদৃশ্য পাঠকের শরীর, যে প্রতিটি শব্দ পড়ে, কিন্তু কোনোদিন উচ্চারণ করে না। সে আবার টেবিলের সামনে বসে, সামনে ছাইরঙা খাতা, পাশে কালির শিশি, পেন হাতে। ঘড়িতে রাত তিনটা চল্লিশ, অথচ সময় থমকে আছে, বাতাস চললেও শব্দ নেই। বাইরের আলো নিভে গেছে, মিলের উঠোনে পড়ে থাকা ছেঁড়া কাগজগুলো নড়ে না, পাখির ডাকও শোনা যায় না, যেন শব্দ চলে গেছে অন্য কোথাও, অন্য কোনো পাতায়। খাতার পৃষ্ঠায় এখনও সেই ঘ্রাণ—পুরনো কালি, ছায়া আর অচেনা স্মৃতির গন্ধ।
সে লিখে চলেছে, যেন লিখতেই হবে, যেন শব্দ না এলে শরীর থেমে যাবে। আজকের লেখা শুরু হলো এইভাবে—“আমি জানি না আমি কে, কিন্তু যে আমাকে পড়ছে, সে জানে।” সেই মুহূর্তেই বাতাস ভারী হয়ে উঠল, যেন কোনো অদৃশ্য দৃষ্টি তাকে পেছন থেকে দেখছে, তার প্রতিটি অক্ষরের হিসাব রাখছে। ঘরের কোণে টিক টিক শব্দে একটা পুরনো দেয়াল ঘড়ি বেজে উঠল, অথচ সে ঘড়িটা আগের রাতে থেমে গিয়েছিল। এবার ঘড়ির কাঁটা নয়, শুধু একটাই শব্দ—“এক”।
সে পেন থামাল। চারদিকে তাকিয়ে দেখল—ঘরের ছায়াগুলো গাঢ় হয়েছে, যেন আরও কাছে চলে এসেছে। জানালার গ্লাসে তার মুখ নেই, কেবল আবছা একটা চোখ, ঠোঁট নেই, কান নেই—শুধু দেখছে। সেই চোখের নিচে যেন হালকা এক দাগ, ঠিক যেন কারো চেনা কষ্টের ছাপ। সে জানত না কীভাবে, কিন্তু অনুভব করছিল—কেউ তার লেখা পড়ে যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে, শ্বাসের মতো, নীরবতার মতো। নোটবুক নিজেই পাতার নিচে লেখে—“নীরবতার পাঠক কখনো কিছু লেখে না, সে শুধু অপেক্ষা করে। তুই যদি থামিস, সে তোর ভিতর ঢুকে পড়বে।”
দেবব্রত ভয় পায় না এখন আর, কেবল জানে—তার লেখা মানেই সুরক্ষা, লেখা মানেই অস্তিত্ব। শব্দ ছাড়া সে যেন নিঃশব্দে ভেসে যাবে অন্য কোনো পাতায়, যেখান থেকে ফেরার রাস্তা নেই। সে আবার লিখে—
“আজ আমি যাকে দেখছি না, সে-ই সবচেয়ে বেশি সত্যি।
যে কখনো বলে না, সে-ই সব কথা জানে।
এই লেখার বাইরে যদি কিছু থাকে, তবে আমি তা নই।
আমি এক নীরব প্রশ্ন, যার কোনো উত্তর নেই, কেবল প্রতিধ্বনি।”
ঠিক সেই সময় দরজার বাইরে ধাতব চেঁচামেচির শব্দ। সে ছুটে গিয়ে ক্যামেরা স্ক্রিন অন করে। স্ক্রিনে কেউ নেই। কিন্তু পেছন থেকে টেবিলের ওপর পেনটা পড়ে যায় নিজে থেকেই। সে ঘুরে দেখে—পেনটা গড়িয়ে গিয়ে থেমেছে খাতার পাশে, আর পাতায় উঠে এসেছে এক লাইন—
“তুই শুধু লিখছিস, কিন্তু পড়ছিস না।
লেখক কখনোই পাঠক হতে পারে না।
তুই পাঠ না করলে, তোর লেখা শূন্য।
এবার তোকে পড়তে হবে, কিন্তু খাতা নয়—তোর ভিতর।”
দেবব্রত বসে পড়ে, চোখ বন্ধ করে। সে কল্পনা করে—নিজের ভিতরে একটা ফাঁকা ঘর, সেই ঘরে সে একা বসে, দেয়ালে কোনো আয়না নেই, কেবল একটা নোটবুক রাখা। সে বইটা খুলে দেখে—সব লেখা তার পরিচিত, অথচ কোনো লাইন সে নিজে লেখেনি। সে পড়ে—”তুই যখন চুপ করে থাকিস, তখনও তোর ভিতর কথা বলে কেউ। সেই কেউ-টা কে?”
তার চোখ খুলে যায়। এবার সে আর খাতা দেখে না, বরং জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে—উঠোনে দাঁড়িয়ে একজন, ছায়া নয়, এক অচেনা পুরুষ, যার মুখ অস্পষ্ট, কিন্তু পরনে সেই একই ইউনিফর্ম—যেমনটা সে পরেছে। লোকটা তার দিকে তাকিয়ে, নড়ছে না, ডাকছে না। কিন্তু একটা অনুভূতি বারবার উঁকি দিচ্ছে মনে—“ও আমিই।”
সে বেরিয়ে যেতে চায়, কিন্তু দরজা খুলছে না। খাতায় লেখা—“পাঠকের সামনে তুই যেতে পারিস না। ওর চোখে তুই আয়না, আর আয়নায় ও নিজেকে দেখতে ভয় পায়। শুধু শব্দই পারে ওকে রক্ষা করতে। তুই লিখে যা।”
সে আবার পেন ধরে। এবার তার হাত থেমে যায় না। সে লিখে—
“তুই যে পাঠ করছিস, আমি জানি।
তুই যে শুনছিস, আমি শুনি।
তুই যে নিঃশব্দ, আমি তোর ভাষা।
আর আমি যেটুকু আছি, সেটাই তোর গল্প।
আমি থেমে গেলে তুই নিঃশেষ হবিস।
তাই লিখে যাই, কারণ পড়া মানেই বাঁচা।”
পৃষ্ঠার নিচে যেন রক্তের মতো কালি জমে উঠছে, শব্দগুলো কালো না হয়ে লালচে হয়ে উঠছে, অদ্ভুত এক আলোয় পৃষ্ঠাটা জ্বলে উঠছে। এবং তখনই খাতার শেষ লাইনে লেখা—
“তুই বুঝে গেছিস।
এবার তোর পাঠক তুই নিজে।
তুই আর আমি আলাদা না।
আমরাই নোটবুক।”
সে চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। টেবিলের চারপাশে বাতাস ঘুরছে, কিন্তু সে বসে আছে স্থির। বাইরের ছায়ামূর্তি মিলিয়ে গেছে। জানালায় এখন আবার নিজের মুখ দেখা যাচ্ছে—কিন্তু চোখের গভীরে ঝাঁপসা হয়ে আছে আরেকটা চোখ।
সে জানে, নোটবুক এখন আর বাহ্যিক কিছু নয়। তার শরীরই এখন কাগজ। তার নিঃশ্বাসই এখন কালি। আর তার নীরবতা—এক অদৃশ্য পাঠকের গলা।
পর্ব ৭
খাতার পাতায় যখন লালচে কালি জমছিল, তখন দেবব্রতর মনে হচ্ছিল তার শিরার মধ্যে কেউ যেন শব্দ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। শব্দ, যারা কথা বলে না—শুধু রয়ে যায় ঘরের দেওয়ালে, জানালার কাঁচে, পুরনো টেবিলের আঁচড়ে। এই শব্দগুলোর নাম নেই, ব্যাকরণ নেই, অর্থ নেই—তবে তারা ছায়া হয়ে থেকে যায়। সে বুঝতে পারছিল, তার লেখা আর খাতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই—এখন সে নিজেই এক ছায়া লিখছে। কোনো পৃষ্ঠায় না, বাতাসে, দেয়ালে, নিজের শরীরের কোষে। এই ‘ছায়ালিপি’ চোখে দেখা যায় না, কিন্তু যাদের চোখের পেছনে আরেক জোড়া চোখ আছে, তারা পড়ে নিতে পারে। সে খেয়াল করল, জানালার গ্লাসে অদ্ভুত ধূসর ছোপ ফুটে উঠছে, যেন কেউ কুয়াশা দিয়ে শব্দ লিখছে। কাছে গিয়ে দেখতে পেল—লেখা গুলো বাংলায় নয়, কোনো অজানা লিপিতে, বাঁকা ও ভাঙা রেখায় গড়া। তবে আশ্চর্য, সে বুঝে ফেলল অর্থ—
“তুই যত লিখিস, ততটা তোর ভিতর খালি হয়ে যায়।
তোর শব্দে আমরা জন্ম নিই।
তুই থামলে, আমরাও মরব।”
সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছিল, সে কার জন্য লিখছে? যে-সব ছায়া তার লেখা পড়ছে, তারা কি কল্পনা? না কি পূর্ববর্তী লেখকদের ছায়া, যারা আর ফিরে আসেনি? নাকি এদের মধ্যে সে নিজেই হারিয়ে যাচ্ছে, একসময় কেউ হয়তো লিখবে—“দেবব্রত বিশ্বাস, নিখোঁজ, ২০২৫।”
সে জানত, এখন আর কিছুই ফেলে আসা যায় না। একবার খাতা খুললে ফিরে যাওয়ার রাস্তা থাকে না। পেনটা হাত থেকে ছাড়তে গেলেও পারছিল না, মনে হচ্ছিল হাতের স্নায়ু আর কালি এক হয়ে গেছে। তখনি সে শুনল—আবার সেই শব্দ। ঘড়ির টিকটিকি নয়, পায়ের আওয়াজ। নিচতলার গ্যারেজ ঘর থেকে ওপরে কেউ আসছে। ধাতব সিঁড়িতে চাপা চাপা শব্দ। সে জানত—এই মিল তো অনেকদিন বন্ধ, কেউ থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রতিটা শব্দ বলে দিচ্ছিল—কারও উপস্থিতি আছে, দম আছে, ওজন আছে।
সে ধীরে ধীরে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল, পা টিপে টিপে নিচে নামতে লাগল। আলো নেই, টর্চ কাজ করছে না, কিন্তু অন্ধকারে তার চোখ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। গ্যারেজ ঘরে ঢুকতেই মনে হলো, ঘরের দেয়াল বদলে গেছে। আগের পোকামাকড় ধরা দেওয়াল নেই—এখন পুরো ঘর জুড়ে কেবল এক লিপি—ছায়ালিপি। দেয়ালজুড়ে অস্পষ্ট অক্ষরে লেখা হয়ে আছে অসংখ্য বাক্য—সবই একে অন্যের ভিতর গলে গেছে, কিছুটা যেমন আয়নায় মুখ দেখা যায় জলে, আবার ঠিকমতো নয়।
হঠাৎ এক কোণে সে দেখতে পেল একটি চেহারা—কোনো মানুষ নয়, কোনো ছায়াও নয়। বসে আছে একটা চেয়ার ঘিরে, মুখে টুপি, হাতে সেই লাল নোটবুক। কেউ যেন তাকে ফিরে পেয়ে অপেক্ষা করছিল।
দেবব্রত সাহস করে এগিয়ে গেল। বলল, “তুমি কে?”
ছায়ার মতো সেই বসে থাকা অবয়ব মুখ তুলল না। কিন্তু পাশের দেয়ালে লেখা ভেসে উঠল—
“আমি তোর লেখা। আমি তোর না-বলা কথা।
আমি তোর দ্বিতীয় সম্ভাবনা।
আমি সেই লাইন, যা তুই কেটে দিয়েছিলি।”
হঠাৎ ঘরের ভেতর আলো জ্বলে উঠল না, কিন্তু শব্দের আলো ছড়িয়ে পড়ল। প্রতিটি বাক্য যেন আলোর মতো কাঁপছিল। এবং ঠিক সেই সময়, ছায়া লোকটা উঠে দাঁড়াল, ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, পেছনে রেখে গেল এক ঝলক কালি—যা কেবল লেখা নয়, যেন দাগ, দহন, স্মৃতি।
দেবব্রত পালিয়ে যেতে চাইল না। বরং সে এগিয়ে গিয়ে বলল, “তুমি কি আমিই?”
ছায়া কিছু বলল না। শুধু তার দিকে সেই লাল খাতা এগিয়ে দিল, আর খাতার পৃষ্ঠায় এক লাইন লেখা উঠল—
“এবার তুই লিখবি তোর শেষ প্রশ্ন।
যেটা কেউ কখনো জিজ্ঞেস করতে পারেনি।”
সে থমকে দাঁড়াল। মনে পড়ল কত প্রশ্ন জমে আছে ভিতরে—কেন এই নোটবুক, কে এই ছায়ারা, কোথা থেকে শুরু, কোথায় শেষ? কিন্তু সেগুলো তো সবাই করে। তার নিজের প্রশ্ন কী? এক মুহূর্তে সে কলম ধরে লিখে ফেলল—
“যদি আমি লিখে যাই, আর কেউ না পড়ে, তাহলে কি আমার অস্তিত্ব থাকে?”
ঘরের সব আলো নিভে গেল। সব শব্দ থেমে গেল। কিন্তু দেয়ালের ছায়ালিপি এবার উল্টোদিকে লেখা শুরু করল—ডান থেকে বাঁ দিকে, নিচ থেকে উপরে। সে বোঝে না, কিন্তু সে অনুভব করে—তার প্রশ্ন উত্তর পায়নি, তবে গ্রহণ করা হয়েছে। উত্তর নয়, গ্রহণ—এটাই এখানে সবথেকে জরুরি।
ঠিক তখন সে আবার নিজেকে দেখতে পেল জানালার কাচে। এবার তার মুখ ধরা পড়ছে না, বরং সেখানে ছায়ায় লেখা আছে আরেকটা প্রশ্ন—
“তুই কি চাইবি—তোর গল্প কেউ পড়ুক, নাকি তুই নিজেই পাঠক হবি?”
তার মনে হলো, উত্তর শুধু একটাই হতে পারে। সে লিখে ফেলে—
“আমি এখন পাঠক। নিজের লেখার।”
ঘর জুড়ে ছায়ালিপিগুলো থেমে যায়। যেন সন্তুষ্ট। যেন কোনো দায় মিটে গেল।
ঠিক সেই সময় ছাদের ওপর একটা শব্দ—এক ফোঁটা জল পড়ার মত, কিন্তু ছাদে তো ফুটো নেই। সে তাকিয়ে দেখল—ঘরের ঠিক মাঝে খুলে যাচ্ছে আরেকটা trapdoor, অন্ধকার এক গহ্বর, যেখান থেকে নেমে আসছে হালকা হাওয়ার মতো এক ডাকে—যা অক্ষরের মতো নয়, কিন্তু অনুভবযোগ্য।
খাতার শেষ পাতায় লেখা ভেসে উঠছে—
“পরবর্তী অধ্যায়: যেখান থেকে শব্দ জন্ম নেয়।
তুই যাবি?”
দেবব্রত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সে জানে, এখন সিদ্ধান্ত তার নয়। সে শুধু একটি মাধ্যম। আর মাধ্যম কখনো প্রশ্ন করে না, শুধু প্রবাহিত হয়।
সে পা বাড়ায় অন্ধকারের ভিতরে।
পর্ব ৮
ফ্যাক্টরির ছাদের গা-ঘেঁষে হঠাৎ যে দরজাটা খুলে গেল, তা যেন কোনো বাস্তব দুনিয়ার পথ ছিল না—বরং মনে হচ্ছিল, সময়ের কোনো স্তরের ফাটল। অন্ধকার গহ্বরের ভেতরটা অতল, অথচ ভয়ংকর নয়। দেবব্রত সেই দিকেই পা বাড়াল, কারণ এতদূর এসে সে জানে—পিছনে ফেরা আর সম্ভব নয়। তার চারপাশে ছায়া জমছিল না, বরং শব্দ গন্ধে মিশে এক অদ্ভুত সুর তৈরি করছিল। সিঁড়ি ছিল না, ধাপে ধাপে নামতে হয়নি, সে যেন শুধু হেঁটে যাচ্ছিল বাতাসের উপর দিয়ে, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে শব্দের স্পর্শ। প্রথমে সে শুনতে পেল একটি করুণ শিস, তারপর বৃষ্টি পড়ার মতো শব্দ—যা আসলে অক্ষরের বৃষ্টি। প্রতিটি বিন্দু যেন পৃষ্ঠার উপর পড়ছে, কিন্তু কোনো বই নেই, কেবল কল্পনা।
অবশেষে সে এসে পৌঁছায় এক গোলাকার ঘরে। এই ঘরের দেয়াল নেই—দেয়ালজুড়ে অদৃশ্য কালির রেখা। মাঝখানে একটি বিশাল পাতার মতো কিছু, যা টেবিল নয়, কিন্তু সেখানে লেখা যায়। আর তার একপাশে রাখা রয়েছে একটি পেন, যার গায়ে লেখা—
“শব্দের আগে জন্ম হয় নীরবতার। এই পেন শুধু সেই নীরবতার ভিতর দিয়ে লেখা বোঝে।”
দেবব্রত ধীরে ধীরে পেনটা তোলে। সে জানে না কী লিখবে, কেন লিখবে, কিন্তু তার ভেতরে এমন কিছু জমে উঠছে, যা শুধু বেরোতে চায়। সে পেন ছোঁয়ায় সেই পাতায়। সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে কেঁপে ওঠে এক আলোর তরঙ্গ। পাতায় কোনো কালি পড়ে না, বরং শব্দ বেরোয় বাতাসে, আর ঘরের দেওয়ালে নিজে নিজে ফুটে ওঠে লাইনগুলো। প্রথম বাক্যটি লেখা হলো—
“আমি সেই যন্ত্রণার জন্মস্থান, যেখানে শব্দ আসে কেবল তখনই, যখন কেউ থেমে যায়।”
তারপর একে একে আরও লাইন উঠে আসে, যেন সে লিখছে না—তারই ভেতরের কোনও অব্যক্ত আত্মা লিখে যাচ্ছে, যা এতদিন নীরবে ছিল। ঘরের দেয়ালে লেখা হতে থাকে—
“যারা লেখে, তারা শব্দ সৃষ্টি করে না।
তারা জন্ম দেয় একরকম অতীতকে—
যেটা কখনো ঘটেনি, তবু যার জন্য কেউ কাঁদে।
প্রতিটি লেখার পেছনে থাকে এক মৃত শব্দ,
যে নিজেকে খুঁজে ফেরে পাঠকের দৃষ্টিতে।”
এই ঘর শব্দের জন্মঘর, কিন্তু শব্দ এখানে কালি দিয়ে জন্মায় না। তারা জন্মায় ব্যথা থেকে, অনুশোচনা থেকে, অথবা এমন কিছু স্মৃতি থেকে যা ছিল না, কিন্তু থাকলে ভালো হতো। দেবব্রত বুঝতে পারে, এই ঘরে যত লেখক এসেছে, তারা কেউ নিজের জন্য লেখেনি—তারা লিখেছে সেই পাঠকের জন্য, যে কোনোদিন চোখে পড়েনি, কেবল অনুভবে থেকেছে।
ঠিক তখনই বাতাসে শব্দহীন গুঞ্জন ওঠে। শব্দ নেই, কিন্তু যেন অসংখ্য কণ্ঠ একইসঙ্গে শ্বাস নিচ্ছে। পেনটা তার হাত থেকে পড়ে যায় না, বরং শক্ত হয়ে ধরে থাকে। ঘরের ঠিক এক প্রান্তে অন্ধকার জমাট বাঁধে, আর তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে অস্পষ্ট এক অবয়ব। মুখ নেই, চোখ নেই, কেবল ছায়া। কিন্তু তার সামনে থেমে দাঁড়িয়ে সে বলল, “তুই কে?”
ছায়া বলল না কিছু। তবে ঘরের মাঝের পাতায় উঠে এল একটা প্রশ্ন—
“তুই যদি নিজেকে লেখার মধ্যে খুঁজিস, তবে তোর না-লেখা অংশটাই তুই।”
দেবব্রত কেঁপে ওঠে। এই প্রথম বার মনে হলো, তার যা লেখা হয়েছে, তার বাইরেও কিছু আছে—যেটা সে চেয়েও লিখতে পারেনি। তার অজস্র না-করা প্রশ্ন, না-চেনা অনুভব, অগ্রাহ্য করা ব্যথা। সে অনুভব করল, এই ছায়া আসলে সেই না-লেখা নিজেই—একটা অসম্পূর্ণ আত্মচিত্র।
সে ধীরে ধীরে লিখে—
“তুই কি আমি? না আমি শুধু তোর ছায়া?”
ছায়া এবার পেছন ফিরল, আর তার জায়গায় রেখে গেল একটা খাতা। এই খাতা সেই সব শব্দের, যারা কোনোদিন পাতায় ওঠেনি। খাতা খুললেই দেখা গেল, সেখানে অসংখ্য অক্ষর, কিন্তু সবই উল্টো—ডান থেকে বাঁ, ওপর থেকে নিচে। তবু সে পড়তে পারছিল—
“যে লেখে, সে শুধু শ্বাস নেয় শব্দে।
কিন্তু যে লেখা হয়, সে থামে না কোনো বইয়ে।
তুই সেই লেখনী,
যার পেছনে কেউ নেই—
শুধু এক নিঃশব্দ পাঠক।
আর আমি সেই পাঠক।”
এতক্ষণে সে বুঝল—এই ঘরের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি প্রশ্ন আসলে তার নিজের অভ্যন্তরের ছিন্নভিন্ন অংশ। সে শুধু একজন পাহারাদার নয়—সে একজন আয়না, যে নিজেকে পড়তে শিখছে। শব্দ তৈরি হয় না বাইরে থেকে, শব্দ আসে ভিতরের ভাঙনের ভাষা থেকে। সে মাথা নিচু করে একবার পৃষ্ঠার উপর হাত রাখল।
হাত রাখতেই ঘরের মাঝখানে গজিয়ে উঠল এক আলোভরা দরজা। সেই দরজার উপরে লেখা ছিল—
“শেষ পৃষ্ঠা নয়—
শুরু যেখান থেকে পাঠ শুরু হয়।
তুই প্রস্তুত?”
দেবব্রত পেনটা রাখল, খাতাটা হাতে তুলল, চোখ বুঁজল।
আর একপা এগিয়ে গেল সেই দরজার দিকে।
পর্ব ৯
আলোর সেই দরজার ভেতরে পা রাখতেই যেন একটা হালকা শব্দ হল—না শব্দও নয়, যেন কারো দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা নিঃশ্বাস হঠাৎ বেরিয়ে এলো। চারপাশটা নিঃশব্দ কিন্তু ভারী, যেন বাতাস শব্দ ধরে রেখেছে। দেবব্রত জানে না এই জায়গার নাম কী। সে শুধু অনুভব করতে পারে—এটা একটা অন্তিম কক্ষ। এখানে শব্দেরা মরে না, বরং চুপ করে বসে থাকে, ঠিক সেই মুহূর্তের জন্য যখন কেউ “শেষ” লিখে থেমে যায়। সেই থেমে যাওয়াতেই তারা বাঁচে।
এই ঘরটা আয়তনে ছোট, কিন্তু ঘন। চারদিকে বইয়ের তাক নেই, অথচ বইয়ের গন্ধ আছে। দেয়ালে কিছু নেই, অথচ সে অনুভব করে—কেউ তার লেখা পড়ছে, একাধিক কেউ। ঘরের এক প্রান্তে রাখা রয়েছে একটি খাতা, আর তার ওপরে একটা আঙুলের ছাপ—যেন কেউ মিনিটখানেক আগে রেখে গেছে। খাতার উপরে লেখা একটাই লাইন: “শেষ পাতার পাঠক কে?” এবং নিচে আরও একটি বাক্য, যা বদলে যেতে থাকে সে যতই তাকিয়ে থাকে—
“শেষ পাতায় সবাই পৌঁছায় না। কেউ কেউ শুধু শুরুতেই থেমে যায়।
তুই শেষ পৃষ্ঠায় এসেছিস, কিন্তু এবার তুই পড়বি না—তুই হবে সেই পাঠক, যে প্রশ্ন করে লেখাকেই।”
দেবব্রতের ভিতরে তখন এক অদ্ভুত পরিবর্তন। সে আর আগের মতো দ্বিধান্বিত নয়। তার হাত কাঁপছে না, চোখ ঝাপসা নয়। বরং তার মনে হচ্ছে সে বহু জন্ম ধরে এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। সে খাতার পৃষ্ঠা উল্টায়। পাতা একটাই, কিন্তু লেখাগুলো স্তরে স্তরে সাজানো—যেন একটা লাইন পড়ে ফেললেই নিচ থেকে আরেকটা উঠে আসে। এই পৃষ্ঠাটাই যেন আস্ত একটা উপন্যাস, একটা জীবন, একটা প্রশ্নপত্র।
প্রথম যে লাইনটা চোখে পড়ে, সেটি বলে—
“যে লেখে, সে কি নিজের লেখা পড়ে বোঝে?”
দ্বিতীয় লাইন—
“পাঠক কি লেখককে সৃষ্টি করে, নাকি লেখাই পাঠক তৈরি করে?”
তৃতীয় লাইন—
“যখন কেউ কিছু পড়ে না, তখনও লেখা কি থাকে?”
এই প্রশ্নগুলো কোনো সাহিত্যিক চর্চার বিষয় নয়। এগুলো অস্তিত্বের প্রশ্ন। দেবব্রতের হাত ঠান্ডা হয়ে আসে। কারণ এই লাইনগুলো সে নিজে নিজের জীবনে অনুভব করেছে। কখনো সে নিজেই নিজেকে না-পড়ার মতো করে বেঁচেছে—শব্দে থেকেও নির্জনে থেকেছে।
হঠাৎ খাতার মাঝখান থেকে উঠে এল একটা নতুন প্রশ্ন—
“তুই কি পড়েছিস নিজের লেখা, কিন্তু নিজের ভিতর থেকে?”
সে এবার চোখ বন্ধ করে। আর যে খাতা সে এতদিন লিখে এসেছে, যার প্রতিটি পাতায় কালি গিয়েছে তার আঙুলের নখ দিয়ে, সেই খাতা এবার নিজের মধ্যে পড়ে দেখতে চায়। একে একে মনে পড়ে যায় প্রথম রাত, যখন সে প্রথম শুনেছিল “২:১৭”-এর কথা। মনে পড়ে যায় শ্যামল দত্ত, সেই ছায়া, আয়নার ঘর, সেই গোপন আয়তাকার সিঁড়ি, সেই নোটবুক যেখানে কেউ নাম লেখে না। মনে পড়ে যায় সেই শব্দহীন পাঠকের চোখ, যে চুপ করে বসে থেকে সব পড়ে যাচ্ছে।
সে বুঝতে পারে—এই শেষ পাতায় পৌঁছানোর মানে একেকজনের জন্য একেকরকম। কারো কাছে এটা শেষের শুরু, কারো কাছে শুরুটাই শেষ। কিন্তু তার জন্য এটা এক আত্মস্বীকারোক্তির মুহূর্ত।
সে এবার নিজের কলমটা তুলল, শেষ পৃষ্ঠার নিচে ফাঁকা জায়গায় লিখল—
“আমি এখন আর কিছু লিখব না।
আমি শুধু পড়ব—যতটা পড়তে পারি নিজেকে।
যতক্ষণ না আমি নিজেই হয়ে উঠি এক পৃষ্ঠা।”
ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরটা হালকা হয়ে গেল। আলো ফিকে হয়ে নরম ছায়ায় রূপ নিল। খাতার পৃষ্ঠায় লেখাগুলো হঠাৎ অস্পষ্ট হয়ে গিয়ে মিলিয়ে যেতে লাগল, যেন পড়ে ফেলার পর শব্দেরা বিশ্রামে যাচ্ছে। আর ঠিক তখনই ঘরের একপাশে তৈরি হলো নতুন দরজা। কোনো আলো নেই তার ওপাশে, কিন্তু ভয়ও নেই।
দেবব্রত দাঁড়িয়ে থাকে। তার হাতে এখন আর কোনো খাতা নেই, কোনো কলম নেই, কিন্তু তার শরীর হালকা, মস্তিষ্ক জেগে। সে জানে, তার ভিতরের শব্দেরা এখন শুধু পৃষ্ঠায় লেখা নয়—তারা রয়ে গেছে বাতাসে, অন্য কারো শ্বাসে, হয়তো কোনো ভবিষ্যতের পাহারাদারের অপেক্ষায়।
দরজার গায়ে লেখা একটিমাত্র লাইন—
“যে পড়ে, সে চলে যায়। যে পড়ে ফেলে, সে থেকে যায়।”
দেবব্রত জানে, সে কোনটা হতে চায়। সে চোখ বুজে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। আর পেছনে পড়ে থাকে এক নিঃশব্দ কক্ষ, যার দেয়ালে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে নতুন এক নাম—
“নতুন প্রহরী—দেবব্রত বিশ্বাস।
শব্দের পাঠক।
সময়-রক্ষক।
শেষ পাতার লিখিত পাঠ।”
পর্ব ১০
রাত যত গভীর হয়, শব্দ তত তীক্ষ্ণ হয় না—বরং তত গভীর হয়। যেন প্রতিটি শব্দ তার অর্থ হারিয়ে ফেলে এবং নিজের ছায়া দিয়ে নিজেকে ঢেকে নেয়। দেবব্রত এখন একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, তার ওপাশে আর কিছু নেই—শুধু ফেরা। কিন্তু সে জানে, ফিরে যাওয়া মানেই পুরনো পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া নয়, বরং ফিরে যাওয়া মানে নিজেকে নিয়ে চলা—লেখা হয়ে বেঁচে থাকা। সে দরজাটা খুলে বাইরে বেরোল।
মিলের সেই পুরনো ঘরে আলো ফিরেছে, ঘড়ি আবার চলছে, জানালার বাইরে শহরের দূর হেডলাইট দেখা যাচ্ছে। মোবাইলে আবার সিগন্যাল এসেছে। কিন্তু ঘরটা একইসঙ্গে বদলে গেছে। টেবিলের উপর রাখা লাল মলাটের খাতা, কালো মলাটের দ্বিতীয় খাতা, আর ছাইরঙা শেষ খাতা—সব একসঙ্গে নেই। তারা যেন মিলিয়ে গিয়ে একটিই খাতা হয়ে উঠেছে, আর তাতে লেখা শুধুই একটি নাম—“রাত্রির প্রহরী”।
দেবব্রত চেয়ার টেনে বসল। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে, অনেক কথা লেখা হয়ে গেছে, কিন্তু সে জানে, একটা চক্র এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। সে ঘড়ির দিকে তাকাল—রাত ২:১৪। আর মাত্র তিন মিনিট বাকি।
সে জানে, ২:১৭-এ কিছু হবে। কী, জানে না, কিন্তু সে প্রস্তুত। এইবার সে কোনো উত্তর খুঁজবে না, বরং নিজেই হবে প্রশ্ন। তার মাথায় তখন ভেসে আসছে আগের সেই সব অদ্ভুত প্রশ্নগুলো—যেগুলো কোনো খাতায় লেখা ছিল না, কিন্তু অনুভব করা গিয়েছিল।
সে ধীরে ধীরে লিখতে শুরু করে—
“আমি যখন লিখতাম, তখন জানতাম না কে পড়বে।
এখন আমি জানি, যারা পড়বে, তারা আর আমার বাইরের কেউ নয়—
তারা আমারই প্রতিফলন।
আমি যখন নিজেকে পড়ি, তখনও একটা অংশ থেকে যায় অপঠিত।
সেই অপঠিত অংশই হলো ছায়া।
আর আমি, এখন শুধু ছায়ার পাঠক।”
হঠাৎ দরজার পাশে শব্দ। হালকা টোকা, যেন কেউ আস্তে করে সময় ছুঁয়ে গেল। দেবব্রত উঠে গিয়ে দরজা খুলল। কেউ নেই। কিন্তু দমকা একটা বাতাস তার মুখ ছুঁয়ে গেল। ঠিক তখন ঘড়ির কাঁটা দাঁড়িয়ে পড়ল—২:১৭।
পাশের জানালার কাঁচে ধীরে ধীরে ফুটে উঠল একটি মুখ। ঠিক নয়, স্পষ্ট নয়—ঝাপসা এক প্রতিচ্ছবি। সে নিজেই। কিন্তু বয়সে কিছুটা বড়, চোখে ক্লান্তি, মুখে এক ধরনের অনুপস্থিতি। সে মুখ তার দিকে তাকিয়ে বলল না কিছুই—কেবল চোখের ভেতর প্রশ্ন রেখে গেল।
দেবব্রত জানে, এবার তার দায়িত্ব শেষ। এখন সে শুধু লিখবে না, এখন সে অপেক্ষা করবে। অপেক্ষা সেই নতুন কারো জন্য, যে ঠিক এই চেয়ারটায় বসবে, একদিন তার মতো করে প্রথম খাতা খুলবে, আর খুঁজে পাবে সেই একই পৃষ্ঠা, যেখানে লেখা থাকবে:
“যদি এটা রাত ২:১৭ এ পড়ে থাকো, তাহলে পেছনে তাকিও না।”
দেবব্রত টেবিলের ওপর পেন রেখে উঠে দাঁড়াল। বাইরে ফ্যাক্টরির কাঁচা রাস্তায় ভোরের কুয়াশা জমেছে, দূরের আলো এসে পড়ে তার গায়ে। সে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে। এখন সে মিলের পাহারাদার নয়, সে নিজেই একটা বই। তার শরীরেই লেখা আছে যত অনুপলব্ধ প্রশ্ন, যে শব্দ পাঠকের ভিতরে থেকে যায় অনেক পরে, যখন গল্প ফুরিয়ে যায়।
আর সেই শেষ খাতার একান্ত শেষ পাতায়, অতল পাতায়, সেখানে লেখা থাকে—
“প্রহরীর নাম: দেবব্রত বিশ্বাস
ডিউটির সময়: প্রতিটি ২:১৭
কাজের ধরন: পাঠক, যিনি শব্দ খেয়ে ফেলে না,
শুধু ধরে রাখেন
যেন আলো,
যেন ছায়া,
যেন একটি প্রশ্ন,
যা কেউ কোনোদিন লেখে না—
তবু সবাই পড়ে।”
ঘড়িতে তখন রাত শেষ হয়ে আসছে। দেবব্রতের ছায়া মিলিয়ে যাচ্ছে পূর্বদিগন্তের দিকে।
আর টেবিলে পড়ে আছে খাতা, পেন, আর একটা চেয়ার
খালি, কিন্তু প্রস্তুত।
শেষ