Bangla - স্মৃতিকথা

এক মুঠো পুরোনো আলো

Spread the love

সোমা মিত্র


আমার স্মৃতি পুরোনো অ্যালবামের মতো—কিছু ছবি রঙ হারিয়েছে, কিছু এখনো ঝকঝকে। উত্তর কলকাতার যে বাড়িটাতে আমার জন্ম, সেই লালবাড়িটা এখন আর নেই। সেটার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে চকচকে অ্যাপার্টমেন্ট, নাম—“মঙ্গলতারা হাইটস”। মাঝে মাঝে ভাবি, নামটা কত গ্ল্যামারাস, অথচ সেই নামের নিচেই চাপা পড়ে গেছে আমার ছোটবেলার চটি পায়ে দৌড়ানো বারান্দা, কাঁঠালের গন্ধমাখা দুপুর, আর দিদার হাতে বাঁধা তুলসী মালা।

আমাদের বাড়িটা ছিল এক রকম রেওয়াজি—সকালে প্রার্থনা, দুপুরে শব্দ করে পাখার ঘুরন্ত আওয়াজ, আর সন্ধ্যেবেলা harmonium-এর একঘেয়ে সুর। বাবা অফিসফেরতা এককাপ চায়ে দিন শেষ করতেন, আর মা রান্নাঘরের কোণে বসে চুপচাপ মাছ কুটতেন—কখনোই অকারণে হাসতেন না। তবু আমি জানতাম, মা ভালোবাসেন, কেবল তার ভালোবাসার ভাষা আলাদা।

বাবা ছিলেন ধীরস্থির, নরম স্বভাবের মানুষ। পেশায় একজন অ্যাকাউন্ট অফিসার। ছুটির দিনে বসতেন বই নিয়ে—সেটাও গল্পের বই নয়, ইতিহাস আর ভূগোল। আমি পড়তে বসলে, তিনিও পাশে বসতেন। বলতেন, “মাথার ভেতরে ছবি আঁকো, তাহলে পড়া মনে থাকবে।” তাঁর বলা কথাগুলোই আজ জীবনের জটিল সময়ে মনে পড়ে, ঠিক যেন পুরোনো কোনো উপদেশ, যেটা তখন গুরুত্ব দিইনি, অথচ এখন পথ দেখায়।

আমার দিদা ছিলেন আমাদের পরিবারের গল্পকথার ভাণ্ডার। তাঁর মুখে শুনেছি দেশভাগের সময় কীভাবে তিনি দুই সন্তানকে নিয়ে রাতের ট্রেনে কলকাতায় আসেন, কাঁধে পেতলের হাঁড়ি, বুকে সাহস, আর চোখে জল। দিদার গল্পে আমি শিখেছিলাম, বেঁচে থাকার জন্য শুধু খাদ্য নয়, গল্পও দরকার।

শৈশব মানে তখন—কাঁসার থালায় রুটি আর চিনি, পরেশদার দোকান থেকে কিনে আনা নারকোল নাড়ু, আর পুজোর আগে স্কুলে নাটকের মহড়া। তখন স্বপ্ন মানে বড় হয়ে শিক্ষক হওয়া, মঞ্চে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়া, আর একদিন হয়তো শহরের খবরের কাগজে নিজের নাম ছাপা হওয়া।

কিন্তু বাস্তব বরাবরই কল্পনার তুলনায় কঠিন ছিল। মাধ্যমিকের পর, আমি কলা বিভাগে ভর্তি হলাম, আর মা সেটা সহজে নেননি। তিনি বললেন, “জীবনে দাঁড়াতে হলে চাকরি পেতে হবে। এই সাহিত্য দিয়ে কি সংসার চলবে?” তখন বুঝিনি, মা আমার স্বপ্নকে না করছেন না, তিনি আসলে সেই কঠিন বাস্তবটাকে চিনে নিয়েছিলেন অনেক আগেই।

কলেজে উঠেই আমি এক নতুন শহরের মুখ দেখলাম। কলেজ স্ট্রিটের ধুলোবালিতে, কফিহাউসের গন্ধে, প্রেসিডেন্সির চাতালে আমি যেন নতুনভাবে নিজেকে চিনলাম। প্রথম প্রেমও সেখানেই—তানভীর নামের এক ছেলেকে ভালো লেগে গেল। সে কবিতা পড়ত, সিনেমা বানাতে চাইত, আর মাঝেমাঝে গান গাইত। আমি ওর গলায় “আমায় প্রশ্ন করে নি…” শুনে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।

তানভীর আমাকে বলত, “তোমার চোখে একটা দীর্ঘশ্বাস আছে।” আমি বুঝতাম না, ও কি বলতে চায়। এখন বুঝি, ও অনুভব করত আমার অদৃশ্য কষ্টগুলো—যেগুলো আমি মুখে বলিনি, কিন্তু চোখের কোনে লুকিয়ে ছিল।

তবু সেই প্রেম, শহরের মতনই—দুরন্ত, কিন্তু অনিশ্চিত। কলেজ শেষ হতেই ও দিল্লি চলে গেল, আর আমি থেকে গেলাম। আমরা চিঠি লিখতাম একে অপরকে, কিন্তু একটা সময় পরে সেই চিঠিগুলো থেমে গেল। যোগাযোগের বদলে রয়ে গেল অপেক্ষা, আর তারপর শুধুই নীরবতা।

আমার জীবনে তারপরে এসেছিল শিক্ষকতার পর্ব। আমি একটি মিশনারি স্কুলে ইংরেজি পড়াতে শুরু করি। প্রথম ক্লাসে আমি যতটা নার্ভাস, ছাত্ররা ততটাই উৎসাহী। ধীরে ধীরে বুঝলাম—শুধু বই পড়ানো নয়, একটা নতুন প্রজন্মের সঙ্গে হাঁটতে শেখাটাও দারুণ এক অভিজ্ঞতা।

ছাত্রদের মধ্যে কেউ কেউ আজও যোগাযোগ রাখে। কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ লেখক, কেউ কানাডায় থাকেন। যখন তারা বলেন, “ম্যাম, আপনার ক্লাস না থাকলে আমি সাহিত্যে আগ্রহী হতাম না”—তখন মনে হয়, এই ছোট ছোট বীজই তো জীবন।

বাবা মারা গেলেন ষাট বছর বয়সে, স্ট্রোক। মাকে একা রেখে গেলেন চিরতরে। মা ধীরে ধীরে কথা কমিয়ে দিলেন, আর স্মৃতি ভুলে যেতে শুরু করলেন। Alzheimer’s-এ আক্রান্ত একজন প্রিয় মানুষকে দেখার যন্ত্রণা ভাষায় বলা যায় না। কখনো আমাকে ভুলে যেতেন, কখনো নিজেকেই চিনতেন না। একদিন বললেন, “তুই কে বল তো? খুব চেনা চেনা লাগছে।”

আমি হেসে বলেছিলাম, “আমি তোমার লেখা না-পড়া চিঠি, মা।”

এক সময় মাও চলে গেলেন, এক শান্ত দুপুরে। চারিদিকে কোনো শব্দ ছিল না, কেবল জানালার পর্দা হাওয়ায় দুলছিল। মায়ের মৃত্যুর পর আমি তাঁর একটা পুরোনো কাঁসার পেটিকেস খুলে দেখলাম—ভেতরে রাখা একজোড়া সিঁদুর কৌটো, মেজবৌদিকে লেখা একটা চিঠি, আর একটি পুরোনো রেকর্ড—সুরে “তুমি রবে নিরবে”।

সেদিন আমি বসে কেঁদেছিলাম অনেকটা সময়। তারপর ভাবলাম, মানুষের জীবন হয়তো এতটুকুই—ছোট ছোট জিনিসে জমে থাকা অগোছালো ভালোবাসা।

আজ, আমি একা থাকি। আমার দেওয়ালে ঝুলে থাকা বাবার ফ্রেম করা কবিতা, বুকশেলফে রাখা মা’র রান্নার পুরোনো রেসিপির খাতা, আর দিদার শাড়ির ফিতে—এই সবকিছুই আমার নিত্যসঙ্গী।

আমি জানি, এই স্মৃতিকথা বড় কিছুর বিবরণ নয়। কোনো বিপ্লব, কোনো বিশ্ববিখ্যাত ঘটনার রূপরেখা নেই এখানে। আছে শুধু এক নারীর চোখ দিয়ে দেখা জীবন—যা ছিল মলিন, কিন্তু ছিল আলোছায়ায় ভরা।

সেই আলোই এখন আমার পথ দেখায়। সেই আলোই এক মুঠো পুরোনো হয়ে থেকেছে বুকের ভিতর। আমি যেখানেই যাই, সেই আলো আমায় ছুঁয়ে থাকে—একটা প্রভাতে, এক কাপ চায়ে, কিংবা পুরোনো কোনো চিঠির গন্ধে।

জীবন কখনোই একরৈখিক নয়। এটি ফিরে ফিরে আসে, নিজস্ব কণ্ঠে, নিজের গতিতে। আর আমি, সোমা মিত্র, সেই জীবনকে ধরে রাখি যতটুকু পারি—শব্দে, স্মৃতিতে, আর এক মুঠো পুরোনো আলোয়।

Lipighor_1749656805131.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *