Bangla - প্রেমের গল্প

এক মুঠো কুয়াশা

Spread the love

পৌলমী দে


শীতকাল তার নিঃশব্দ পায়ে গ্রামের উঠোনে নেমে এসেছে বেশ কিছুদিন হল। মাঠের ঘাসে জমে থাকা শিশিরের ওপর দিয়ে হাঁটলে পায়ের শব্দ হয় না, কিন্তু শীতে মোড়া সেই স্তব্ধতায় সায়ন্তী প্রতিদিন একটা পরিচিত শব্দের অপেক্ষা করে থাকে—স্কুলঘরের প্রথম ঘণ্টা বাজা। সে দিনের শুরুটা হয় ঘুম ভাঙা মায়ের কাশির আওয়াজে, চায়ের কাপ গুনে ফেরা সংসারে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মাথায় উলের চাদর জড়ানো, ব্যাগে খাতা বইয়ের ভার; বাকি সব দিনের মতোই যেন। কিন্তু আজকের সকালে কুয়াশাটা একটু বেশি জমাট, আর হাওয়াটা যেন অতীতের গন্ধ নিয়ে আসে। গলির ধারে সেই পুরনো দোতলা বাড়িটা, যেটায় একসময় খেলাধুলা চলত, কাঁঠাল গাছের ডালে চড়া হতো, আজ তার সামনে দাঁড়িয়ে কেউ একজন চা খাচ্ছে। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, পরনে ধূসর সোয়েটার আর গলায় এক ফালি লাল গামছা—চেনা কি? কুয়াশার ভেতর থেকেও চোখ চিনে নেয়, সময়ের ধুলো মুছে দেয়। সায়ন্তীর পা থেমে যায়। সেই চা-খাওয়া লোকটিও তাকায় তার দিকে—চোখে একচিলতে হাসি। ঋষভ। দশ বছর পর ফিরেছে। শহরের চাকরি ছেড়ে এসেছে শুনেছিল, কিন্তু চোখে দেখা হয়নি এতদিন। দেখা হয়েও কথা হয়নি—আজ সেই কথাহীনতা ভেঙে গেল এক নিঃশব্দ দৃষ্টিতে।

স্কুলের পথ যেন আজ একটু বেশি লম্বা মনে হচ্ছিল সায়ন্তীর। ক্লাসে ঢুকে সে স্বাভাবিক মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকলেও মনের মধ্যে যেন কোনও কুয়াশার পর্দা বারবার উড়ে এসে চোখ ঢেকে দিচ্ছিল। পড়ানো, ছাত্রছাত্রীদের সাড়া, সাদামাটা দুপুর—সবই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু চা-বিক্রেতা হারাধনের দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় সে আবার একবার সেই পুরনো বাড়ির দিকে তাকায়। এবার দেখল, ঋষভ নিচে দাঁড়িয়ে মাটি দেখছে, হাতে একটা ছোট কোদাল, পাশে গাঁয়ের একজন চাষি—মনে হচ্ছে জমি নিয়ে কী একটা আলোচনা করছে। সায়ন্তীর মনে পড়ে যায় ছোটবেলার দিনগুলো। ঋষভের সঙ্গে তার বই বদল, স্কুল পালানো, পুকুরে নেমে মাছ ধরার সেই রঙিন গল্পগুলো। পরে ঋষভ শহরে চলে যায় উচ্চশিক্ষার জন্য, আর তার জীবন আটকে যায় এই গ্রামের টানাপোড়েন, সংসারের দায় আর একরাশ না বলা স্বপ্নের ভেতরে। সে ভেবেছিল ঋষভ হয়তো আর কোনোদিন ফিরবে না, কেউই ফিরে না, শহরের মানুষরা শহরেই হারিয়ে যায়। কিন্তু ঋষভ ফিরেছে, জমি নিয়ে কিছু করছে, মানে সে থাকতে এসেছে, নতুন করে শুরু করতে। এই ভাবনার ফাঁকেই একটা অনাহুত কণ্ঠ বলে ওঠে মাথার ভেতরে—”তোর মনে এত প্রশ্ন কেন, সায়ন্তী?” উত্তর দিতে গিয়ে নিজের মনেই সে হেসে ফেলে। সেই হাসি কানে আসে তার এক সহকর্মী রেনুকার। সে জিজ্ঞাসা করে, “কি গো, নতুন কি খবর?” সায়ন্তী চোখ সরিয়ে নেয়, বলে, “কিছু না রে, কুয়াশা মনে হয় চোখে ঢুকে গেছে।”

বিকেলের দিকে স্কুল ছুটি হয়ে গেলে ঘরে ফেরার পথে একটা খেতের ধারে হঠাৎ ঋষভের সঙ্গে আবার দেখা হয়ে যায়। এবার আর দৃষ্টিবিনিময়েই থেমে থাকেনি, সরাসরি কথা হয়। ঋষভ আগে কথা বলে—“সায়ন্তী, চিনলি?” সায়ন্তী হালকা হাসে, “তোর গলা শুনেই চিনে ফেলেছিলাম। এতদিন পর?” ঋষভ বলে, “অনেক তো হল শহরের দৌড়ঝাঁপ, ভাবলাম একটু নিজের ফেলে আসা জায়গাটাকে আবার খুঁড়ে দেখি।” দুজনেই হাঁটতে হাঁটতে গল্প করে, যেন কোনও বাধা নেই মাঝখানে। গ্রামের রাস্তায় তখন কুয়াশার হালকা পরত, খেজুরগাছের পাতায় রোদ পড়েছে, দু’পাশের ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে হাওয়ায় তামাম শীতের গন্ধ। সায়ন্তী অবাক হয়—ঋষভ কত সহজে গ্রামের জীবন মেনে নিয়েছে, জমি, ফসল, সব নিয়ে নতুন পরিকল্পনা করছে। ঋষভও দেখে, সায়ন্তী কতটা পরিণত হয়ে গেছে—সে আর সেই খেলার সাথি নেই, বরং একটা গোটা সংসারের ভিত এখন। আলাপে আলাপে বোঝা যায়, তাদের মধ্যে এখনও পুরনো সেই সহজ সম্পর্কটা রয়ে গেছে, কিন্তু তার মধ্যে ঢুকে পড়েছে সময়, অভিজ্ঞতা আর একরাশ নীরবতা। এই প্রথম দিনে কোনও রোমাঞ্চ ছিল না, কোনও নাটকীয়তা নয়—শুধু কুয়াশার ভেতরে পুরনো চেনা দুই প্রাণের আলতো ছোঁয়া। তবে কুয়াশা মানেই তো সব ধরা পড়ে না, কিছু আবছা থেকেই যায়—যেমন এই সম্পর্কটা, যা হয়তো আবার গড়তে যাচ্ছে, হয়তো বা নয়।

কয়েকদিন কেটে গেছে। ঋষভ এখন রোজ সকালেই মাঠে যায়, গায়ে পুরনো সোয়েটার, কাঁধে ঝোলা আর হাতে একখানা নোটবই থাকে—কী যেন লেখে সারাক্ষণ। সায়ন্তী তাকে দূর থেকে দেখে মাঝে মাঝে—স্কুলে যাওয়ার পথে বা ছুটির সময়। কিন্তু মুখোমুখি হওয়া হয়নি আবার। গ্রামের লোকজনও একটু একটু করে খেয়াল করতে শুরু করেছে—ঋষভ একেবারে শহুরে লোক নয়, তার গায়ে মাটির গন্ধ এখনও আছে। সে চাষিদের সঙ্গে জমিতে কাজ করছে, মাটি পরীক্ষা করছে, সেচ ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলছে—সব মিলিয়ে তাকে একটু ব্যতিক্রম মনে হচ্ছে, আর এই ব্যতিক্রমটাই আগ্রহ তৈরি করছে। সায়ন্তী নিজেও অবাক হয়—একটা মানুষ শহরের চাকরি ছেড়ে কীভাবে এমন আত্মবিশ্বাসে ফিরে এসে নিজের শিকড় খুঁজে নিতে পারে? এই ভাবনা নিয়ে সে তার ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গল্প বলার সময় নিজের অজান্তেই বলে ফেলে—“জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা আসে অভিজ্ঞতা থেকে, কেবল বই থেকে নয়।” কথাটা বলার পরেই তার মনে পড়ে যায় ঋষভকে, আর সে নিজেই হাসে, যেন কথাটা তারই জন্য লেখা।

একদিন দুপুরে স্কুলে নতুন একটি প্রকল্প নিয়ে আলোচনা চলছিল—সরকারি উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুল চত্বর সাজানোর কাজ। প্রধান শিক্ষিকা জানালেন, একজন স্থানীয় সহযোগীর প্রয়োজন, যিনি জায়গা বুঝে বাগান আর খেলার জায়গার পরিকল্পনা করে দিতে পারেন। সায়ন্তীর মনে পড়ে গেল ঋষভের কথা—সে তো এখন গ্রামের পরিবেশ নিয়ে খুব কাজ করছে। একটু ইতস্তত করেও শেষমেশ বলেই ফেলল, “আমি কাউকে চিনি, যিনি সাহায্য করতে পারেন।” পরদিন ঋষভ এল স্কুলে, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে কথা বলল, জায়গা ঘুরে দেখল, আর পরের দিনেই একটা পরিকল্পনার খসড়া নিয়ে হাজির। সবার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল—এত যত্ন নিয়ে বানানো একটা মানচিত্র! সায়ন্তীর চোখে পড়ে, ঋষভ এখন আরও পরিণত হয়েছে—তার দৃষ্টি, ভাষা, আর ভাবনার গভীরতা বেড়েছে অনেকগুণ। তারা একসঙ্গে স্কুলের পেছনের মাঠে বসে কাজের খুঁটিনাটি ঠিক করছিল, সেই সময় আচমকা এক ছাত্র এসে বলে—“ম্যাডাম, ওঁর সঙ্গে কি আপনি আগে থেকেই চেনা?” সায়ন্তী একটু থমকে যায়, তারপর হাসে—“হ্যাঁ রে, ছোটবেলার বন্ধু।” সেই হাসির মাঝে একধরনের কুয়াশার পর্দা থাকে—একটু পুরনো দিনের গন্ধ, একটু বর্তমানের দ্বিধা।

এভাবে কাজ চলতে থাকে কয়েকদিন। ঋষভ স্কুলে যাওয়া-আসা করতে থাকে, কখনও মাঠে, কখনও শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে দেখে নেয় শিশুদের খেলাধুলোর জায়গা, গাছ লাগানোর পরিকল্পনা। গ্রামের মানুষ খুশি—“ভালো ছেলে তো, শহর দেখে এসে এমন গ্রামে পড়ে আছে, প্রশংসা করতেই হয়।” কিন্তু সমাজ তো কেবল প্রশংসা দিয়ে চলে না। একদিন বাজারে গিয়ে সায়ন্তী দেখল, কমলা বৌদি আরেকজনের সঙ্গে ফিসফিস করে বলছে—“তোর সায়ন্তী আর শহরের ঋষভ… কিছু একটা আছে মনে হয়।” কথাটা কানেও এল, গায়েও লাগল। সায়ন্তী বুঝতে পারল—এই বন্ধুত্ব আর আগের মতো সহজ নেই। তবে সে মুখ ফিরিয়ে নেয় না, বরং মাথা তুলে হেঁটে যায়। আর বাড়ি ফিরে সে জানলায় দাঁড়িয়ে দেখে, কুয়াশার ভেতর দিয়ে ঋষভ যাচ্ছিল ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে। তাদের সম্পর্কের মধ্যে যেটুকু আলো জন্ম নিচ্ছে, তা হয়তো সমাজের চোখে কুয়াশার মধ্যেও দৃশ্যমান হয়ে উঠছে—আর সেই আলোয়ই ছায়া পড়ে যাচ্ছে, প্রশ্ন উঠছে, গুজব ছড়াচ্ছে। কিন্তু সায়ন্তী জানে, এই বন্ধুত্ব আগের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান—কারণ এখন তার মধ্যে ভালোবাসার সম্ভাবনা আছে, ভয় থাকলেও সেই সম্ভাবনাকে মুছে ফেলা যায় না।

শীতটা আরও জমে উঠেছে, আর সেই সঙ্গে জমেছে গ্রামে ফিসফিসানির গন্ধ। সকালবেলা সায়ন্তী যখন স্কুলে যাচ্ছিল, তখন তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া দুই মহিলা মুখ চেপে হাসছিল। সায়ন্তীর অভ্যস্ত চোখ বুঝে নেয়, এই হাসির পেছনে কিছু আছে। স্কুলে পৌঁছেই সে শুনতে পেল, প্রধান শিক্ষিকা তাকে আলাদা করে ডেকে বললেন, “সায়ন্তী, তোমার বিষয়ে কিছু কথা শুনছি… তুমি কি ঋষভবাবুর সঙ্গে অতটা মেলামেশা করছ? লোকজন বলাবলি করছে…” বাকিটা আর না শুনেও সায়ন্তী বুঝে যায়, কী ঘটছে। সে মাথা নিচু করে বলে, “আমরা ছোটবেলার বন্ধু ম্যাডাম, স্কুলের কাজেই এসেছে।” উত্তর দেওয়ার মতো যুক্তি থাকলেও, সমাজের প্রশ্নগুলোর মানে সবসময় যুক্তির চেয়ে বেশি হয়—তার চেহারা, তার চোখ, তার হাঁটার ভঙ্গিমায় তারা খুঁজে নিতে চায় নিষিদ্ধ কিছু। সেই দিনটা ক্লাস নেওয়ার সময়েও মনে হচ্ছিল, যেন সকলের চোখে আছে অদৃশ্য এক অভিযোগ। শিশুরাও বুঝে না বুঝে জিজ্ঞেস করে—“ঋষভকাকু কি রোজ আসবেন?” প্রশ্নটা নিষ্পাপ হলেও সায়ন্তীর মনে হয়, যেন একটা ঢেউ এসে ধাক্কা দিল হৃদয়ের শান্ত পাড়ে।

ঋষভ নিজেও বুঝে ফেলেছে, চারদিকে কী ধরণের গুজব ছড়াচ্ছে। সে এক বিকেলে সায়ন্তীকে ডেকে বলে, “তুই চাইলে আমি আর স্কুলে আসব না, ওই প্রকল্পটা অন্য কাউকে দিয়ে দে। আমি চাই না তোকে কোন সমস্যায় পড়তে হোক।” সায়ন্তী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “তুই কি জানিস, আমার জীবনের কত বড় অংশ এখন এই সমাজের অনুমোদনের ওপর নির্ভর করে? আমার মায়ের চিকিৎসা, আমার ভাইয়ের পড়াশোনা—সবই চলে এই চাকরি আর এই সমাজের দৃষ্টির ওপর দাঁড়িয়ে। আমি তো তোর মতো স্বাধীন না রে ঋষভ।” কথাগুলো বলার সময় তার চোখ ভিজে আসে, কিন্তু গলা ভাঙে না। ঋষভ এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে, “তুই স্বাধীন হবার চেষ্টা করিসনি বলেই তো সমাজ তোকে বাধা দিতে পারে। আমি থাকব, যদি তুই সাহস করিস।” কথাগুলো একদিকে সাহস জোগায়, অন্যদিকে প্রশ্ন তোলে—সত্যিই কি সায়ন্তী সাহস করতে পারবে? একটা মেয়ে, যার প্রতিদিনের জীবন বাঁধা নিয়মে গড়া, সে কি সমাজের বাঁধ ভেঙে নতুন কিছু ভাবতে পারে?

সন্ধ্যাবেলায় মৃণাল, সায়ন্তীর ভাই, বাড়ি ফিরে এসে রাগে ফুঁসতে থাকে—“দিদি, আমি শুনলাম স্কুলে তোর নামে বাজে কথা বলছে, কেউ আবার বলেছে ঋষভদা নাকি রোজ তোকে দেখা করতে আসে!” সায়ন্তী জানে, ভাইয়ের রাগ আসলে ভালোবাসা থেকে, কিন্তু সে এটাও জানে, এই রকম রটনা যদি আরও বাড়ে, তাহলে তার চাকরি পর্যন্ত ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। সে মৃণালকে শান্ত করে বলে, “তুই এসব কানে তুলিস না রে, আমি জানি আমি কী করছি।” কিন্তু সায়ন্তীর নিজের মনে তখন তীব্র এক দ্বন্দ্ব চলছে—একদিকে ঋষভর সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো তাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে, অন্যদিকে এই সমাজের এক একটা ফিসফাস তাকে দিনকে দিন নিঃস্ব করে দিচ্ছে। রাতে ঘুমোতে গিয়ে জানালার কাচে কুয়াশা জমা দেখে তার মনে হয়, যেন চারপাশ ঢেকে আছে একটা অদৃশ্য বেড়ায়—ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, আত্মবিশ্বাস—সবকিছুর মধ্যেই ঢুকে পড়েছে সমাজের চোখ। তবুও, জানলার বাইরের কুয়াশার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় দূরের গাছ, তার পাতায় হালকা আলো পড়ছে—সেই আলো দেখে সে মনে মনে ভাবে, হয়তো সবটুকু এখনও হারিয়ে যায়নি, হয়তো এখনও কিছু আলোর রেখা বাকি আছে।

সায়ন্তী কয়েকদিন ধরে একটু নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। স্কুল শেষে আর সে কারও সঙ্গে বেশি কথা বলে না, কাজের বাইরে কেউ ডাকলেও সে এড়িয়ে যায়। ঋষভও বুঝতে পারছে, তাদের মধ্যে একটা অদৃশ্য দূরত্ব এসে দাঁড়িয়েছে। যদিও সে এখনও প্রতিদিন তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে—চাষের জমিতে নতুন পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ, পুকুর সংস্কার, বা শিশুদের খেলার জায়গা সাজানো—তবুও তার চোখ প্রতিদিন সন্ধের দিকে সায়ন্তীর বাড়ির দিকেই চলে যায়, ঠিক যেন অভ্যাস হয়ে গেছে। আর সেই অভ্যাসের ভেতরেও সে টের পায়, কিছু একটা বদলে গেছে। একদিন সে ঠিক করে, আর না। সরাসরি বলবে যা বলার। সেই বিকেলেই, স্কুল ছুটির পর মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা সায়ন্তীকে সে ডাকে। সায়ন্তী চমকে তাকায়, বলে, “তুই এখানে?” ঋষভ হালকা হেসে বলে, “তোর সঙ্গে একটু কথা আছে। বসবি?” তারা পাশের বটগাছের নিচে বসে। কুয়াশা ধীরে ধীরে চারপাশে নামছে, আর সেই সঙ্গে ঋষভর গলা গভীর হয়ে আসে—“সায়ন্তী, আমি জানি লোকজন যা বলছে তা আমাদের মধ্যে সত্যি নয়, কিন্তু আমি চাই সেটা সত্যি হোক। আমি তোকে শুধু ভালোবাসি না, আমি তোর পাশে থাকতে চাই, তোর সমস্তটাকে গ্রহণ করতে চাই—তোর সংসার, দায়িত্ব, ভয়, সবকিছু। আমি তোকে নিয়ে একটা ঘর বাঁধতে চাই, শহরের চাকরি ছেড়ে এই মাটির কাছে ফিরে আসার সবচেয়ে বড় কারণ তুই।”

সায়ন্তীর চোখ ছলছল করে ওঠে। সে মাথা নিচু করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর ধীরে বলে, “ঋষভ, তোকে জানি সেই ছোটবেলা থেকে। তুই আমার জীবনের সবচেয়ে আপন মানুষ। কিন্তু তুই জানিস না, আমার বুকে কী রকম বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছি। আমি একা একটা সংসার চালাই—মা অসুস্থ, ভাই এখনও চাকরি পায়নি। আমি এই গ্রামের মুখচেনা ‘ভালো মেয়ে’, আমার একটুও ভুল পা ফেললে সব ভেঙে পড়বে। আমি তোকে ভালোবাসি না বলছি না, কিন্তু আমি ভয় পাই। ভয় পাই যে এই সমাজ তোর জীবনকেও নষ্ট করে দেবে, তোর স্বপ্নগুলোকেও।” কথাগুলো বলতে গিয়ে তার গলা কেঁপে ওঠে। কুয়াশার ভেতর দিয়ে একটা শীতল বাতাস বয়ে যায়, যেন সময়ও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। ঋষভ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে, “আমি সব জানি সায়ন্তী, কিন্তু জানিস, তুই যেটাকে দায় ভাবছিস, সেটাই আমি নিজের কর্তব্য ভাবি। যদি তুই চাইিস, তবে আমি পাশে থাকতে পারি। কিন্তু যদি না চাইিস… আমি বুঝব, তুই স্বাধীন।” এই কথার পর আর কিছু বলে না সে, শুধু উঠে দাঁড়িয়ে যায়, ধীরে ধীরে হেঁটে চলে যায় দূরের দিকে। সায়ন্তী চেয়ে থাকে তার চলে যাওয়ার পথের দিকে, কুয়াশার মধ্যে ঋষভর ছায়া একসময় মিলিয়ে যায়।

সেদিন রাতে সায়ন্তী ঘুমোতে পারে না। একটার পর একটা স্মৃতি ফিরে আসে—ছোটবেলায় কাঁঠাল গাছের নিচে একসঙ্গে খেলা, বই বদল, সেই প্রথম বার শহরে ঋষভ চলে যাওয়ার দিন, আর আজকের সন্ধ্যা। তার বুকের মধ্যে একটা ঝড় উঠেছে—ঋষভের ভালোবাসার স্বীকৃতি, আর নিজের ভয়ের দ্বন্দ্ব। সে জানে, সমাজের চোখে তারা অচেনা, সম্পর্কের চেনা সংজ্ঞায় ফেলা যাবে না তাদের কথোপকথন। তবুও তার মন একটানা কাঁপছে—যদি সাহস না করে, তবে কি এই ভালোবাসা চিরদিনের মতো হারিয়ে যাবে? জানলার বাইরে তাকিয়ে সে দেখে, কুয়াশা জমেছে চারপাশে। কিন্তু দূরের গাছে একফালি আলো পড়েছে চাঁদের, আর সেই আলোর নিচে দাঁড়িয়ে যেন এক ছায়া বলছে—”ভয় পেয়ো না, সায়ন্তী।” কিন্তু ভয় যে একদিনে কাটে না, সাহস জন্মায় সময়ের ভিতরে। তাই সায়ন্তী জানে, এই দূরত্বের রেখা ভাঙতে হলে তাকে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। আর সেই যুদ্ধের শুরু হল আজ, এই রাতে, নিজের হৃদয়ের কুয়াশা ভেদ করে প্রথম প্রশ্ন তুলে—”আমি কি শুধু দায়িত্ব? আমি কি বাঁচতে পারি না আমার নিজের মতো করে?”

পরদিন সকালে সায়ন্তী যখন স্কুলে যাওয়ার জন্য বেরোয়, তখন গ্রামের মোড় ঘুরতেই সে দেখতে পায় বিজন কাকা বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছেন, পাশে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা। তিনি এক সময় এই গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন—আজ অবসর জীবনে থেকেও গ্রামের প্রতিটি পরিবর্তনের নিরব সাক্ষী। সায়ন্তী মাথা নিচু করে যেতে যেতেই শুনল, “এই যে সায়ন্তী মা, এক মিনিট দাঁড়া তো।” সে থমকে দাঁড়ায়। বিজন কাকা হাসিমুখে বলে ওঠেন, “তোকে আজকাল কেমন চুপচাপ দেখছি রে, সব ঠিক তো?” সায়ন্তী একটু হাসে, “ঠিকই আছি কাকা, কাজের চাপ…” কিন্তু কথাটা মুখে রেখেই তার চোখ দুটো জলে ভিজে ওঠে। বিজন কাকা তার দিকে তাকিয়ে বলেন, “কাজের চাপ না মনে চাপ, বুঝে নিস। আয়, একটু বস।” সায়ন্তী বসে পড়ে বারান্দার একপাশে, আর কাকা তার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন, “তুই জানিস, তোর বয়সে তোর মতোই এক মেয়েকে পড়াতাম—স্মিতা নাম ছিল, খুব মেধাবী। এক ছেলের সঙ্গে তার খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়েছিল, কিন্তু সমাজ কিছুই মেনে নেয়নি। শেষমেশ স্মিতা ভয় পেয়ে ছেলেটিকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। পরে শুনলাম সেই ছেলেটা আর বাঁচতেই চায়নি। বলছি না তোর অবস্থাও তেমন, কিন্তু বলছি—ভয় যদি তোর সিদ্ধান্ত ঠিক করে দেয়, তাহলে তো তুই নিজের জীবনটা হারাবি।” সায়ন্তীর চোখে জল জমে, সে চুপচাপ কাকার কাঁধের দিকে তাকিয়ে থাকে।

বিজন কাকা চায়ের শেষ চুমুক নিয়ে বলে ওঠেন, “সাহস থাকলে সমাজ বদলায়। কেউ না কেউ তো শুরু করতেই হবে। আর তুই যদি তোর দায়িত্ব, পরিবারের কথা মাথায় রেখেই চলতে চাস, তবে তোকে আরও সাহসী হতে হবে। ভালোবাসা মানে শুধু হাত ধরা না—ভালোবাসা মানে একসাথে দাঁড়ানো, একসাথে সহ্য করা। যদি তুই তোর ভালোবাসায় বিশ্বাস করিস, তবে তোকে সমাজের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই।” কথাগুলো শুনে সায়ন্তীর মনের মধ্যে যেন একটা পর্দা সরে যায়। সে যেন বুঝতে পারে—ঋষভ তাকে শুধু ভালোবাসে না, বরং এক জীবনসঙ্গীর মতো তাকে সবটুকু নিয়েই মেনে নিতে চায়। সে কখনও শুধু প্রেমের কথা বলেনি, বরং বলেছে পাশে থাকার কথা, সহযাত্রার কথা। এই জায়গাটা সমাজ বোঝে না, কিন্তু সায়ন্তী বোঝে। হ্যাঁ, সমাজের ভয় তারও আছে, কিন্তু ভয় থাকলেও কি বাঁচা যায় না? মনের এই দ্বন্দ্ব আর দ্বিধার মাঝেই আজ যেন প্রথমবার একটু সাহস জন্মায় তার মধ্যে—একটা স্বপ্নের মতো সাহস, যা ধীরে ধীরে বাস্তবে রূপ নিতে চায়।

সেদিন বিকেলে সায়ন্তী আবার হাঁটতে হাঁটতে মাঠের পথ দিয়ে যায়, যেখানে ঋষভকে প্রথম দেখেছিল সেই দিনের সকালে। দূর থেকে দেখে, সে এখনও জমিতে কাজ করছে, মাটিতে বসে একটা পোকামাকড়ের ঘেরাও খুঁটিয়ে দেখছে। সায়ন্তীর মন বলে, “এমন একজন মানুষ, যে প্রকৃতির এত কাছে, সে আমার ভয়ের চেয়ে বেশি বড়।” পেছন থেকে ঋষভ তাকিয়ে দেখে তাকে, চোখে জিজ্ঞাসু অভিব্যক্তি। কিন্তু এবার সায়ন্তী মুখ ফিরিয়ে নেয় না, বরং একটু এগিয়ে এসে বলে, “আজ বিজন কাকার সঙ্গে কথা বললাম।” ঋষভ অবাক হয়, “আচ্ছা? কী বললেন?” সায়ন্তী হালকা হেসে বলে, “বললেন, ভয় পেলে জীবন দাঁড়ায় না, আর ভালোবাসা থাকলে সমাজও বদলাতে বাধ্য হয়।” কথাটা বলে সে হেঁটে চলে যায়, পিছনে না তাকিয়ে। ঋষভ তার চলে যাওয়া দেখে, আর হঠাৎ তার চোখে এক ফালি আলো পড়ে—না, সেটা কুয়াশার ফাঁক গলে আসা রোদের নয়, বরং সেই আলো, যা জন্ম নেয় মন খুলে আসার মুহূর্তে। এখনও সবকিছু অস্থির, সমাজের গুজব, দায়িত্বের ভার, নিজের দ্বিধা—কিছুই যায়নি। কিন্তু আজ প্রথমবার, সায়ন্তী নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাব খুঁজেছে, এবং সেই উত্তরে আছে সাহসের বীজ। হয়তো সেই বীজ একদিন ফুল দেবে—যে ফুল কুয়াশার মধ্যে থেকেও আলো ছড়াবে।

সায়ন্তীর চোখে কুয়াশার পর্দা ছিল যেন সবসময়। চারপাশে স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না, শুধু অস্পষ্ট শীতলতা—যার ভেতর দিয়ে হাঁটতে গেলে হাঁফ ধরে যায়, পা ডুবতে থাকে নিজেরই সন্দেহে। স্কুলে আজকাল সে মন বসিয়ে পড়াতে পারছে না। শিশুরা জানে না, কিন্তু টের পায় তাদের “সায়ন্তী মিস” আগের মতো হাসেন না, চোখে সেই কোমল চাহনি নেই। গত কিছুদিনের ঘটনার পর গ্রামে গুঞ্জন থেমে যায়নি—বরং আরও বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। কারও বাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটলে ফিসফাস কানে আসে, কুমন্তব্য ভেসে আসে বাজারে যাবার পথে। সায়ন্তী নিজেকে বোঝাতে থাকে, এসব সাময়িক, সময়ই সব ভুলিয়ে দেবে। কিন্তু তার মনের ভিতরকার নীরব চিৎকার চাপা দিতে গিয়ে সে প্রায় প্রতিদিনই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। মায়ের শরীর খারাপ, ওষুধ কিনে আনতে হয়, আবার রান্না, স্কুল, কচিকাঁচাদের পড়ানো—সবই যেন তাকে গ্রাস করছে। এত কিছুর মধ্যেও ঋষভ প্রতিদিন, নিঃশব্দে তার পাশে থাকার চেষ্টা করে যায়—মাঠের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া, স্কুলের সামনে থেমে থাকা, কোন কথা না বলেও যেন সান্ত্বনা দেওয়া।

ঋষভ নিজেও বুঝতে পারছে, এই লড়াইটা শুধু সায়ন্তীর একার নয়। সে নিজের মধ্যে এক গভীর দ্বন্দ্ব টের পাচ্ছে—একদিকে সে জানে, সে কাউকে না জানিয়ে সায়ন্তীর পাশে দাঁড়ালে গ্রাম তাকে ‘অসভ্য’, ‘অন্যরকম’ বলবে। আবার অন্যদিকে, সে তো এমনই ছিল সবসময়—আলোচনার ধার ধারে না, নিজের ভালোবাসাকে বুঝে নেয় নিজের মতো করে। কিন্তু এবার ব্যাপারটা ভিন্ন। সে চায় না সায়ন্তী কষ্ট পাক তার জন্য। বিজন কাকাকে নিয়ে একদিন মাঠের ধারে চা খেতে বসে সে বলল, “আমি থাকলে যদি ওর জীবন আরও কঠিন হয়, তাহলে কি দূরে সরে যাওয়া উচিত?” বিজন কাকা হেসে বললেন, “ভালোবাসা কুয়াশার মতো নয় রে ঋষভ, যা চোখে পড়ে না। ভালোবাসা আগুনের মতো—যা ছুঁয়ে গেলেই চিনে নেওয়া যায়। ওকে জিজ্ঞেস করেছিস? ও চায় তুই দূরে সরে যা?” ঋষভ মাথা নেড়ে বলল না। বিজন কাকার চোখে তখন এক আলোকময় দৃঢ়তা, “তাহলে শোন, কেউ যদি তোর পাশে দাঁড়ায়, তার কাঁধে হাত রাখিস। কিন্তু যদি তোর মানুষ পিছনে পড়ে যায়, তাকে একা ফেলে আগাতে নেই।” সেই রাতে ঋষভ একটা চিঠি লেখে—সায়ন্তীকে—একটি ছোট সাদা খামে রেখে দিয়ে আসে স্কুলের দরজায়। চিঠিতে সে শুধু লেখে, “আমি আছি। যদি তোমার দরকার হয়, একবার ডাকলেই ফিরবো। যদি চাও না আমি থাকি, কুয়াশার ভেতর হারিয়ে যাব।”

সায়ন্তী চিঠিটা পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কুয়াশা ধীরে ধীরে পাতলা হচ্ছিল, কিন্তু চিঠির একটুকরো কাগজ যেন বাতাসে আলো এনেছিল। কতদিন পর মনে হয়েছিল কেউ তাকে বুঝেছে, তার ভয়কে, লজ্জাকে, দ্বিধাকে। সেই রাতে সে জানলায় দাঁড়িয়ে চাঁদের আলোয় ভাবছিল—এ জীবনে কতবার মেয়েদেরই পিছিয়ে আসতে হয়! সমাজ বলে, মুখ ঢাকো; হৃদয় চায়, বাঁচো! কোথায় দাঁড়াবে সে? মায়ের দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়ে, মা বলতেন, “ভালোবাসা একা একা হয় না, দু’জন মিলে গড়ে তোলে।” এবং সেই মুহূর্তে সায়ন্তী ঠিক করেছিল, পরেরদিন সকালেই ঋষভকে মুখোমুখি বসিয়ে বলবে, সে কী চায়। কুয়াশা চিরে হাঁটা শুরু হয়েছিল। সামনে অজানা পথ, কিন্তু তার বুকের ভিতরটা তখন অনেক হালকা—যেন কেউ মুঠো মুঠো করে কুয়াশা সরিয়ে দিচ্ছে।

সায়ন্তী বাড়ির দাওয়ায় বসে রুক্ষ বাতাসে ওড়ানো শাড়ির আঁচল সামলাতে সামলাতে বোঝার চেষ্টা করছিল—এখন সে কী চায়, কোথায় তার ঠিকানা। সবকিছু যেন কুয়াশার মতো অস্পষ্ট, ভাসমান। গ্রামের লোকের মুখরতা কিছুটা থেমেছে ঠিকই, কিন্তু সে জানে—চোখের আড়াল মানেই মন থেকে মুছে যাওয়া নয়। সেইদিনের অগ্নিকাণ্ডের পর তার আর ঋষভের মাঝে এক অদ্ভুত নিরবতা ঘনিয়ে উঠেছে। যেন কথা না বলেও তারা একে অপরকে বোঝে, অথচ সেই বোঝাপড়ার মধ্যে কোথাও এক চুপচাপ ভয়, অনিশ্চয়তা লুকিয়ে আছে। বিজন কাকু এখন প্রায়ই আসে—চুপচাপ বসে চা খায়, একটা পানের ডিবে খুঁজে নেয়, তারপর বলে, “ভালোবাসার বীজ যদি সত্যি হয়, তো তার ফল সময়েই আসে।” এইসব কথাগুলো সায়ন্তীর মনে পাথরের মতো জমে থাকে। সে ভাবছিল ঋষভ এখন কেমন আছে, কাজের কী অবস্থা, তার জমির ফসলের কি হল, কিন্তু মুখে কিছু বলে না। তাকে ভুল বুঝেছে কিনা—এই দ্বিধা মাঝে মাঝে বুকের মধ্যে গুমোট তৈরি করে।

ঋষভ ঠিক তখনই আসে, দুপুরবেলা, কাঁধে একটা ছোট ব্যাগ, হাতে বই। আজকে সে এসেছে স্কুলে কিছু পড়াতে, সায়ন্তীর অনুমতিতে। গ্রামে একটা পাঠশালার মতো কিছু শুরু করার স্বপ্ন দেখছে ঋষভ—সায়ন্তীকে সেই কাজে পাশে চায়। কিন্তু আজকের আগমনটা ছিল একটু অন্যরকম। সে সরাসরি সায়ন্তীর সামনে এসে বলে, “আমার সঙ্গে একটু হাঁটবি?” সায়ন্তী কিছু না বলে মাথা নাড়ে। তারা হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় বাঁশবনের পথ ধরে, যেখানে শীতের হাওয়া ফিসফিস করে। ঋষভ চুপ করে থাকে খানিকক্ষণ, তারপর হঠাৎ বলে ওঠে, “তুই জানিস তো, আমি যতদূরই যাই না কেন, এই গ্রামটা, এই মানুষগুলো, তোর মতো কেউ আমার জীবনে আর আসেনি। আমি পালাতে চাইনি কখনো। কিন্তু তোর ভয়টা বুঝি।” সায়ন্তী তখন চোখ নামিয়ে বলে, “ভয় না রে, দায়। পরিবারের, সমাজের, নিজের—এই সবকিছুর মাঝে আমি মাঝপথে আটকে গেছি। তুই সাহস করেছিস, আমি পারিনি।” ঋষভ ধীরে তার হাত ছুঁয়ে বলে, “তুই পাশে থাকলে আমি সমাজের সামনে দাঁড়াতে পারি, তুই কি পারবি আমার পাশে থাকতে?” অনেকক্ষণ চুপ থেকে সায়ন্তী বলে, “আমাকে একটু সময় দে… আমি নিজেকেই বুঝে উঠতে পারিনি এখনও।”

ঋষভ কিছু না বলে মাথা নাড়ে। তারা দুজনেই জানে, এই পথ সহজ নয়। প্রেম কখনওই সহজ ছিল না, বিশেষ করে যদি তার শিকড় সমাজের বাঁধনে আটকে থাকে। কিন্তু সেইদিন সায়ন্তীর চোখে যে আলো দেখা গিয়েছিল—তা একধরনের প্রস্তুতির। যেমন করে আকাশে মেঘ কাটলে রোদ আসে, তেমনিই মনে হয় এই সম্পর্কেও আলো আসবে। সেইদিন সায়ন্তী ঘরে ফিরে জানালার পর্দা টেনে দেয় না, মৃদু কুয়াশায় ঢাকা পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মনে হয়, হঠাৎ করেই যেন কুয়াশার মধ্য দিয়ে এক আশ্রয়ের ছায়া এগিয়ে আসছে, যে ছায়ায় তার ভয়গুলো লুকাতে পারে, আর এক নতুন ভোরের অপেক্ষায় বুক বেঁধে থাকতে পারে।

বিকেলের রোদের আলো ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছিল মাঠের কিনারা থেকে। আকাশে হালকা কুয়াশার আস্তরণ, তার মধ্যেই গ্রামটা যেন চুপচাপ অপেক্ষা করছে একটা নিঃশব্দ উত্তরণের জন্য। স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আজ, সায়ন্তী ছাত্রীদের নিয়ে মঞ্চের পেছনে প্রস্তুত। ছেলেমেয়েদের মুখে আনন্দ, গানে নাচে আজ যেন গ্রামের অন্যরকম একটা উৎসব। কিন্তু সায়ন্তীর মনে আজও একটা অদৃশ্য চাপ, কারণ আজকের দিনটাই শেষ সিদ্ধান্তের দিন। পেছনে ঋষভ দাঁড়িয়ে, এক হাতে পোস্টারের দড়ি বাঁধছে, চোখে শান্ত অথচ দৃঢ় দৃষ্টি। বিগত কয়েক সপ্তাহে তাদের জীবনে অনেক কিছু ঘটে গেছে। পাড়া-প্রতিবেশী প্রথমে যেমন হিংস্র ফিসফিসে শব্দে আক্রমণ করছিল, সময়ের সঙ্গে তা নরম হয়েছে। বিজন কাকার খোলা চিঠি, যেখানে তিনি সমাজের দ্বিমুখীতার কথা তুলে ধরেন, তা গ্রামের পঞ্চায়েতে পড়ে শোনানো হয়েছিল। তারপর থেকেই গ্রামের মানুষদের মধ্যে যেন একটা চুপচাপ উপলব্ধি তৈরি হয়। সায়ন্তীর স্কুলে পড়ানো নিয়ে কেউ আর কিছু বলেনি, বরং সম্মান জানাতে শুরু করেছে। ঋষভও আর লুকিয়ে চলেনি, সে প্রতিদিন সায়ন্তীর স্কুলে এসে স্বেচ্ছাশ্রম দেয়—শিশুদের জন্য মাটি দিয়ে খেলার উঠোন বানায়, দেয়ালে ছবি আঁকে।

আজকের অনুষ্ঠানে শেষে একটা নাটক মঞ্চস্থ হবে—‘মেঘের আড়ালে রোদ’। এই নাটকের ভাবনা, চিত্রনাট্য সবটাই সায়ন্তীর লেখা। চরিত্রগুলো যেন তাদের নিজেদের গল্প—এক শিক্ষিকা, এক কৃষক, সমাজের চোখ, ভালোবাসার বাধা, আর শেষে একটা নতুন ভোর। মঞ্চ আলোকিত হচ্ছে, শিশুরা সাজছে, দর্শকেরা জমে উঠেছে। সায়ন্তী মঞ্চের কোণে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতে একটা নতুন সাহস খুঁজে পায়। অনুষ্ঠানের শেষে গ্রামের মেম্বার হঠাৎ মাইক্রোফোনে উঠে দাঁড়ান। তাঁর কণ্ঠ শান্ত—তিনি বলেন, “আমরা অনেক সময় বুঝি না কার ভালোবাসা কতটা গভীর। কিন্তু আজকের এই নাটক, আজকের স্কুল আর এই দুই মানুষের আন্তরিকতা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। আমি পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে অনুরোধ করছি, সায়ন্তীদি আর ঋষভ একসঙ্গে যদি থাকতে চায়, আমাদের কোনও আপত্তি নেই। বরং আশীর্বাদই থাকবে।” জনতা স্তব্ধ, তারপর হালকা হাততালি, তারপর প্রবল করতালি, কিছু শিশু এসে সায়ন্তীর পা জড়িয়ে ধরে।

ঋষভ ধীরে ধীরে মঞ্চে উঠে আসে, হাত বাড়িয়ে দেয়। সায়ন্তী চুপচাপ এগিয়ে আসে, কুয়াশার মধ্যে সেই হাতটা যেন ভেসে আসে তার দিকে। চোখে জল, মুখে হাসি—সে হাত ধরে ফেলে। চারপাশের কুয়াশা যেন মিলিয়ে যেতে শুরু করে, সূর্যের শেষ আলো তাদের চোখের মধ্যে আলোড়ন তোলে। সেই এক মুঠো কুয়াশা, যে এতদিন তাদের ঘিরে ছিল, আজ তা হাতের তালু দিয়ে গলে গিয়ে হৃদয়ে পৌঁছে যায়। ভালোবাসার কোনও জয়ধ্বনি হয় না, হয় নিঃশব্দ আত্মসমর্পণ। আর সেই আত্মসমর্পণের মধ্যে হয়ত সত্যিকারের সাহস লুকিয়ে থাকে—একসাথে হেঁটে চলার সাহস, সমাজের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস, আর এক মুঠো কুয়াশার মাঝেই পথ খোঁজার সাহস। গল্প শেষ হয় না, বরং নতুনভাবে শুরু হয়—সায়ন্তী আর ঋষভের জীবনে, কুয়াশার গায়ে লেখা এক নতুন ভোরের গল্প।

_____

1000045644.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *