Bangla - প্রেমের গল্প

এক কাপ চা ও একফোঁটা প্রেম

Spread the love

অনির্বাণ দত্ত


 সেই বিকেলের দেখা

গড়িয়াহাট মোড়ের ব্যস্ততা তখন বর্ষার বৃষ্টিতে খানিকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। পথঘাট কাদা আর জলের প্যাচপেচে স্রোতে ভারাক্রান্ত, অথচ সেই মেঘলা বিকেলে কলকাতার আকাশে যেন কোনো অচেনা অপেক্ষার আলো ছড়িয়ে ছিল। ভিড় ঠেলে হাঁটছিল ঈশিতা। হাতে ধরা ছাতাটা বারবার উল্টে যাচ্ছিল হাওয়ায়, আর তার চশমার কাচে জলের ছিটে জমে অদ্ভুত একটা ঝাপসা দৃষ্টি তৈরি করছিল। মনে হচ্ছিল, চারপাশের সবকিছু যেন ভুল ঠিকানায় রাখা ছবি—একটু চেনা, একটু অচেনা। হঠাৎই চোখে পড়ল সেই মুখটা—অরণ্য। পাঁচ বছর পর। মাথার চুলে হালকা পাক ধরেছে, চোখের কোণে একটু বয়সের রেখা, কিন্তু হাসিটা এখনও তেমনই—একটু লাজুক, একটু ঠোঁটের কোণে অসমাপ্ত। তার হাতে কাগজে মোড়া কিছু বই—একটা জয় গোস্বামীর কবিতা, আরেকটা জীবনানন্দের “ধানসিঁড়ি”র নতুন সংস্করণ। কিছু একটা বুকের ভেতর কেঁপে উঠল ঈশিতার। পা থেমে গেল। অরণ্যও তাকিয়ে দেখল। কিছুক্ষণ কেবল নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকল দুজন। তারপর সেই চেনা কণ্ঠস্বর, যেটা কত বিকেল জুড়ে ঈশিতার ঘরের জানালায় বাতাস হয়ে বাজত, এবার মাটির কাছাকাছি নেমে বলল—“তুমি?” ঈশিতা একটু চমকে উঠে বলল, “তুমিই তো বলেছিলে, বর্ষা ছাড়া দেখা করো না। আজ তো বর্ষা, তাই বুঝি দেখা হয়ে গেল।” অরণ্য হেসে বলল, “বৃষ্টি সত্যিই অনেক কিছু ফিরিয়ে আনে।” তারপর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ। চারপাশে ট্র্যাফিকের শব্দ, ভিজে গাড়ির চাকা ঘুরছে জলে, ফুটপাতের পাশে চা-ওয়ালার হাঁকডাক। এতকিছুর মাঝেও যেন তারা একটা ছোট্ট নিঃশব্দ গম্বুজের ভিতর দাঁড়িয়ে—যেখানে কেবল তাদের দুজনের অতীত বাজছে। “তুমি এখন কেমন আছো?” অরণ্য প্রশ্ন করল। ঈশিতা একটু মাথা নেড়ে বলল, “ভালো… মানে, মোটামুটি।” তারপর একটু থেমে যোগ করল, “তুমি?” অরণ্য বলল, “চল, একটা চা খাই, তারপর বলি।” ঈশিতা একটু ইতস্তত করল। তারপর মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। তারা রিকশা নেয়নি। ভিজে ভিজে হাঁটছিল। যেন ইচ্ছা করেই—ভিজতে ভিজতে পুরনো সেই বিকেলগুলোকে ছুঁয়ে দেখছিল দুজনে। অরণ্য পেছন ফিরে একবার বলল, “তোমার ছাতা ভিজে গেছে, হাত ধরতে পারো চাইলে।” ঈশিতা একটু হেসে বলল, “তুমি এখনও সেই ছেলেটা আছো, যে কবিতার লাইন দিয়ে হাত ধরতে চায়।” তারা গিয়ে পৌঁছাল সেই পুরোনো চায়ের দোকানে। বালিগঞ্জ ফাঁড়ি রোডের বাঁদিকে। দোকানটার অর্ধেক টিনের চালা, টিনে জল পড়ার শব্দে এখনো সেই পুরনো সুর। ভেতরের কাঠের বেঞ্চি একটু ভাঙা, দেয়ালে ক্রিকেটারদের পুরনো পোস্টার, আর কাঁচের শোকেসে বিস্কুট আর নিমকি। তারা চুপচাপ বসল। দোকানদার চিনল না, নতুন ছেলে। অর্ডার দিল অরণ্য—“দু কাপ চা, একটু কড়া।” ঈশিতা তাকিয়ে রইল জানালার বাইরের বৃষ্টিতে। মনে পড়ছিল সেই দিন, যেদিন এই দোকানে বসেই অরণ্য তার হাতে দিয়েছিল প্রথম কবিতা। কবিতাটা একটা পুরোনো খামের ভিতরে, উপরে লেখা ছিল—“ঈশিতার নামে বর্ষা নামিয়ে দিলাম।” সে কিছু বলেনি, শুধু অনেকক্ষণ ধরে চায়ের কাপে ধোঁয়ার ভিতর সেই লাইনগুলো পড়েছিল। তখন তাদের বয়স কম, কথা অনেক, স্বপ্ন অসমাপ্ত। অরণ্য বলল, “এই পাঁচ বছরে অনেকবার ভেবেছি, তোমার সঙ্গে আবার যদি দেখা হয়, কী বলব। কিন্তু আজ দাঁড়িয়ে কেবল মনে হচ্ছে, চুপ থাকাটাই সবচেয়ে সত্য।” ঈশিতা চা হাতে নিয়ে বলল, “চুপ থাকলে শব্দরা বাঁচে।” তারপর চা-টা ঠোঁটে তুলল। গরম, কড়া, অথচ নরম। ঠিক যেন সেই অনুভব, যেটা বহুদিন পরেও গলার নিচে নেমে যায়। অরণ্য একটু থেমে বলল, “তুমি কি এখনো লেখো?” ঈশিতা মাথা নাড়ল, “লিখি না। এখন শুধু পড়ি। আর পড়তে পড়তে তোমার কথা মনে পড়ে।” “আমার?” “হ্যাঁ, কারণ তুমিই তো একদিন বলেছিলে, ‘ভালোবাসা শব্দে নয়, ছায়ায় বাঁচে।’ আমি সেই ছায়া হয়ে গেছি।” অরণ্য একটু চুপ করে গেল। বাইরে তখন বৃষ্টির শব্দ বেড়েছে। ভিজে পথের গায়ে রিকশার চাকায় জল ছিটিয়ে যাচ্ছে। কাঁচের কাপে চায়ের শেষ ফোঁটাটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ঈশিতা বলল, “তুমি কবিতা লেখো না এখন?” অরণ্য বলল, “লিখতে পারি না। যেন শব্দেরা তোমার গন্ধ খুঁজে ফেরে। আর না পেলে কাগজ সাদা থেকে যায়।” ঈশিতা একটু হাসল। তারপর চুপচাপ জানালার বাইরে তাকিয়ে বলল, “আজ যদি একটা কবিতা লিখো, আমার নাম রাখবে?” অরণ্য বলল, “না, আজ নাম নয়, তোমার চোখের ভাষায় একটা পঙক্তি রাখব—যেখানে তুমি থাকবে, কিন্তু কেউ জানবে না। ঠিক যেমন একফোঁটা প্রেম, যা বোঝা যায়, কিন্তু ধরা যায় না।” সেই বিকেলের শেষে, বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল দুই মানুষ—ভিজে যাচ্ছে, কিন্তু ভেতরটা আস্তে আস্তে শুকিয়ে উঠছে। বর্ষা যেন আবার নতুন করে কিছু বুনতে শুরু করল।

পুরোনো চায়ের দোকান

চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁইয়ে ঈশিতা একটু থেমে থাকল। তার চোখের দৃষ্টি বাইরে, অথচ মন যেন কোথাও এক পুরোনো বিকেলের ভেতর আটকে আছে। অরণ্য মুখ নিচু করে কাপে চা নাড়ছিল, অথচ চোখ দুটো ছায়ার মতো ঈশিতার গলার নিচের দিকটায় গিয়ে আটকে ছিল। যেন পাঁচ বছরের সমস্ত না বলা কথা জমে এই নৈঃশব্দ্যের ভিতর পাখির মতো ধুকে ধুকে কাঁপছে। “এই দোকানটার গন্ধ বদলায়নি,” ঈশিতা বলল। “তোমার মতোন,” অরণ্য যোগ করল। ঈশিতা তাকাল না, শুধু মৃদু হাসল। চারপাশে জলের গন্ধ, ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ, চায়ের ভাপ আর রোদ না-থাকা আলোতে ভিজে কাঠের গন্ধ। সেই চায়ের দোকান—যেটা একসময় তাদের নিজেদের বলে মনে হত। সেই টেবিল, যেটায় একদিন ঈশিতা নিজের খসড়া কবিতার খাতা খুলে বলেছিল, “দেখো, আমি আজ রাতে তোমার স্বপ্নটা লিখে এনেছি।” সেই বেঞ্চিটা, যেটার ডানদিকে অরণ্য একটা লাইন খোদাই করে দিয়েছিল—“তোমার নামটাই তো ছিল আমার প্রথম কবিতা।” ঈশিতা চা থেকে মুখ তুলে বলল, “জানো, এই কদিনে অনেকবার ভেবেছি এখানে আর আসব না। কারণ যেখানেই বসতাম, মনে হত পাশে তুমি বসে আছো। আর তারপর হঠাৎ মনে পড়ত, তুমি তো নেই।” অরণ্য একটু নড়েচড়ে বসল, তারপর ধীরে বলল, “আমি ছিলাম ঈশিতা, শুধু দেখা দিইনি। এই শহরের যত বৃষ্টি পড়েছে, তার সবটায় আমি ছুঁয়ে গেছি তোমাকে।” এই কথাটুকু বলতেই যেন দোকানটা একটু নিস্তব্ধ হয়ে গেল। বাইরের হর্নের শব্দ কমে এল, কেবল টিনের ছাঁদে বৃষ্টির শব্দ খানিকটা কানের ভিতর ঢুকে গেল। ঈশিতা তার হাতের খালি কাপটা টেবিলে রাখল। দোকানদার তখন অন্য টেবিলে ব্যস্ত। ঈশিতা বলল, “তুমি এখন কোথায় থাকো?” “সাউথ এন্ড পার্কে, একটা ভাড়া বাড়িতে। জানালার বাইরে গাছ, ভেতরে কাগজ।” “একা?” “হ্যাঁ। একাই তো বরাবর ছিলাম, শুধু তখন বুঝতে পারিনি।” “আমি মাঝে মাঝে ভাবতাম তোমার খবর নেব। হঠাৎ কোথাও চলে গেলে যদি…” “আমি কোথাও যাইনি। শুধু ভেতর থেকে হাওয়া হয়ে গেছিলাম। নিজের কাছেই।” ঈশিতা হঠাৎ বলল, “তুমি কি জানো, তুমি চলে যাওয়ার পর আমি খুব চিঠি লিখতাম তোমাকে? কখনো পোস্ট করিনি। শুধু লিখতাম আর রেখে দিতাম ড্রয়ারে। আজও আছে সেগুলো।” অরণ্য এবার সত্যিই তাকাল। চোখে একটা অভিমান ভরা আলো। “তাহলে সেই চিঠিরা কোথাও গিয়েও পৌঁছায়নি?” ঈশিতা হাসল না, কাঁদল না, কেবল বলল, “তুমি ঠিক বলেছিলে, আমরা শুরু করিনি, তাই শেষটাও হয়নি। কিন্তু মাঝে মাঝে যে যা অসম্পূর্ণ থাকে, সেটাই সবচেয়ে বেশি টিকে যায়।” অরণ্য বলল, “আমি এখনও মাঝে মাঝে তোমার জন্য লেখি। কিন্তু তোমার নাম দিই না। কাগজে শুধু লিখি—একটি মেয়ের চোখ, যার ভিতরে বৃষ্টি ধরে রাখা থাকে।” ঈশিতা বলল, “আমিও মাঝে মাঝে তোমার লেখা কবিতা পড়ি, যেগুলো তুমি পুরোনো ব্লগে রেখেছিলে। সব তুলে নিয়েছ এখন, কিন্তু আমি স্ক্রিনশট করে রেখেছি।” দুজনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। যেন এতদিন পর কথা বলতে গিয়ে তারা বুঝতে পারছে, আসলে সবটাই থেকে গেছে—শুধু মানুষটা পাশ থেকে সরে গিয়েছিল। “তুমি কি জানো অরণ্য,” ঈশিতা বলল, “আমি এখন অন্য কারো সঙ্গে থেকেও তোমার কথা ভুলি না। এমনকি যখন নতুন কাউকে ভালো লাগত, তখনও মনে হত, তুমি যেন চুপ করে পাশেই দাঁড়িয়ে আছো। চোখ নামিয়ে দেখছি, তুমি লিখে রাখছো—এই অনুভবটা আজকের। কোনো এক কবিতার জন্য।” অরণ্য হেসে বলল, “তুমি এখনও সেই মেয়েটা, যার ডায়রির এক পৃষ্ঠাও ফাঁকা থাকে না। আর আমি সেই ছেলেটা, যে প্রতিটা পৃষ্ঠায় একটা না দেখা চিঠি রেখে যায়।” চায়ের দোকানের বাতিটা একটু দুলে উঠল হাওয়ায়। তার পর একদম নিঃশব্দ হয়ে গেল চারপাশ। যেন শহরটা হঠাৎ থেমে গিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎই ঈশিতা বলল, “চল, আজ এই বৃষ্টির দিনে আবার নতুন করে হাঁটা শুরু করি?” অরণ্য বলল, “তবে একটা শর্ত।” “কি শর্ত?” “চা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ার আগেই বলো, তুমি কি আবার ভালোবাসতে চাও?” ঈশিতা কিছু বলল না। শুধু একফোঁটা ঠাণ্ডা চা তুলে ঠোঁটে ছুঁইয়ে বলল, “এক ফোঁটা থেকেই তো শুরু হয় নদী।”

ফিরে দেখা সেই পথ

চায়ের দোকান থেকে বেরোতেই চোখে মুখে ধাক্কা খেল হালকা ঠান্ডা বাতাস আর ছিটকে পড়া বৃষ্টির জল। অরণ্য একবার পাশ ফিরে তাকাল ঈশিতার দিকে। তার কাঁধে ঝুলছে ভিজে ব্যাগ, কপালের পাশে ভেজা চুলগুলো একরকম এলোমেলোভাবে আটকে আছে কানের পেছনে, আর ঠোঁটে যেন কোনও নির্জন কবিতার মতো জমে আছে একটা স্থিরতা। “ছাতা খোলো,” অরণ্য বলল। “ভিজতে চাই,” ঈশিতা জবাব দিল। “আজকের এই ভিজে রাস্তাগুলোয় পায়ে হেঁটে চলতে চাই, যেমন একসময় চলতাম।” অরণ্য কাঁধ ঝাঁকাল। ছাতা বন্ধ করে সেও ঈশিতার পাশে হেঁটে চলল। গড়িয়াহাট মোড় থেকে দক্ষিণ দিকে নামার পথটা ভিজে আছে, কোথাও কোথাও জলে থৈ থৈ, আর চায়ের দোকান থেকে ভেসে আসছে পুরনো বাংলা গানের সুর—“এই পথ যদি না শেষ হয়…” ঈশিতা বলল, “তুমি জানো, আমি প্রায়ই ভিজতে ভালোবাসি। আগে তুমি যখন থাকত, আমরা মেঘ দেখলেই বেরিয়ে পড়তাম। আর এখন, আমি একা হাঁটি, কিন্তু মনে হয় পাশে কেউ হাঁটছে। জানি সে নেই, তবু থাকে।” অরণ্য বলল, “কেউ কেউ থেকে যায়, ছায়ার মতো। অথবা স্মৃতির মতো।” ঈশিতা চুপ করে গেল। রাস্তার পাশে একটা পুরনো বাড়ি, যার জানালায় কাঁচ ভিজে গেছে বৃষ্টির জলে। সেই বাড়িটার সামনে একবার দাঁড়িয়েছিল তারা—এক বিকেলে, প্রথম হাত ধরেছিল। অরণ্য বলল, “এই বাড়িটার কথা মনে আছে?” ঈশিতা মাথা নাড়ল। “আমি ভাবতাম, যদি কোনোদিন ঘর নিই, এমনই জানালাওয়ালা বাড়ি নেব। যেখানে বাইরের বৃষ্টি ভেতরের কাঁচে জমে থাকবে।” “আর কাঁচের ওধারে থাকবে কেউ, যার চোখে থাকবে একটা অপ্রকাশিত কবিতা।” ঈশিতা বলল। “তুমি এখনও ঠিক যেমন ছিলে,” অরণ্য বলল, “একদিকে প্রচণ্ড শক্ত, অন্যদিকে ভিজে কাগজের মতো নরম।” ঈশিতা মুচকি হেসে বলল, “তুমি তো বরাবরই ছিলে, সেই ছেলেটা যে বইয়ের পাতায় আমাকে খোঁজে, কিন্তু কোনোদিন বলে না—ভালোবাসি।” অরণ্য থেমে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর বলল, “বলিনি, কারণ ভয় ছিল। বললে যদি হারিয়ে ফেলি। আজ বলছি—ভালোবাসি। আজকের মতো করে, নতুনভাবে, আবার।” ঈশিতা তাকাল না তার দিকে। চোখ রাখল সামনের ভিজে পিচের রাস্তায়। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “এই কথাটা আমি কতবার শুনেছি অন্যদের মুখে। কিন্তু তোমার মুখে এই প্রথম, এইরকম বর্ষার দিনে… একটু দেরি করে এলেও, ঠিক মতো এল।” বৃষ্টি তখন নেমে এসেছে আরও গভীর হয়ে। রিকশা নেই, ট্রাম থেমে গেছে, কেবল ভিজে থাকা ভিড়, আর সেই দুজন মানুষ—যারা অনেক কিছু হারিয়েও যেন কিছু ফেরত পাচ্ছে একফোঁটা করে। “তুমি কি এখনও বিশ্বাস করো, একটা চুম্বন দিয়ে সব ঠিক হয়ে যেতে পারে?” ঈশিতা জিজ্ঞেস করল। “না,” অরণ্য বলল, “আমি এখন বিশ্বাস করি, একটা চা ভাগ করে খাওয়ার মধ্যেও এক জীবনের আস্থার ছাপ থাকতে পারে।” তারা হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে পৌঁছাল রবীন্দ্র সরোবরের ধারে। লেকের জল বৃষ্টিতে ছলছল করছে। চারপাশে ঘন সবুজ গাছ, ঝিরঝিরে বাতাস। একটা বেঞ্চির সামনে দাঁড়াল দুজন। বসে পড়ল। একটু দূরে এক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা ছাতা ভাগ করে দাঁড়িয়ে আছে, মাথা একে অপরের দিকে ঝুঁকে। ঈশিতা বলল, “তাদের দেখে মনে হচ্ছে আমরা… পাঁচ বছর আগের নিজেদের দেখতে পাচ্ছি।” “তবে আজ আমরা তারা নই। আজ আমরা নতুন, কিন্তু পুরনো প্রেমে রাঙানো,” অরণ্য বলল। ঈশিতা তার ভিজে হাতটা অরণ্যের হাতের ওপর রাখল। একটু ঠান্ডা, একটু কাঁপা। “তুমি কি এখনো কবিতা লেখো আমার জন্য?” ঈশিতা জিজ্ঞেস করল। অরণ্য বলল, “আজ রাতে লিখব। লিখব, ‘যদি ভালোবাসা নামে বৃষ্টি হয়, তবে সেই প্রতিটি ফোঁটা ছিল ঈশিতার নামে।’” ঈশিতা একবার চোখ বন্ধ করল। মনে হল, যেন সব কথা থেমে গিয়ে বৃষ্টি, কবিতা আর হৃদয়ের নিঃশব্দ শব্দগুলো মিশে গেছে এই এক মুহূর্তে।

অনাহ্বান চিঠির পাতা

রাতে ঈশিতা জানালার ধারে বসেছিল, তার ঘরটা শান্ত, শুধু বাইরে থেকে ভেসে আসছিল টুপটাপ বৃষ্টির শব্দ। জানালার কাঁচে জলের রেখা নামছিল আঁকাবাঁকা পথে। হাতে ধরা ছিল একটা পুরোনো খাতা—নীল মলাট, ভেতরে হলুদ হয়ে যাওয়া পাতাগুলোয় হস্তাক্ষরের ভাঁজ। এগুলো কোনোদিন কাউকে দেওয়া হয়নি। লেখা ছিল অরণ্যের নামে, কিন্তু চিঠিগুলো কখনও ডাকবাক্সের মুখ দেখেনি। একেকটা চিঠিতে একেকটা দিন, একেকটা অভিযোগ, আবার কোথাও এক চিলতে মায়া। ঈশিতা ভেতরে ভেতরে সব কিছু পড়ে ফেলেছিল—নিজের লেখা যেন অন্য কারও কণ্ঠে বাজছিল সেই রাতে। “প্রিয় অরণ্য,” লেখা ছিল প্রথম পাতায়, “তুমি চলে যাওয়ার পর বৃষ্টি আর একা ভিজতে আসে। জানো, আমি আজও চা খেতে গিয়ে ভুল করে দুটো কাপ চা অর্ডার করে ফেলি।” দ্বিতীয় পাতায় লেখা, “আজ বিকেলে বইমেলাতে গিয়েছিলাম। তোমার প্রিয় কবির নতুন সংকলন বেরিয়েছে। তুমি থাকলে হয়তো লাইনে দাঁড়াতে বলতে, অথচ আমি একা দাঁড়ালাম না। ফিরে এলাম, যেন কিছুই হয়নি।” ঈশিতা পড়তে পড়তে থেমে গেল। এক ফোঁটা জল পড়ে গেল পাতায়। বৃষ্টি না, নয়তো চোখের জল? সে বুঝতে পারল না। তারপর খাতাটা বন্ধ করে টেবিলে রাখল। বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছে। সে উঠে জানালার কাছে গেল। মনে পড়ল, অরণ্য আজ বলেছিল সে আবার কবিতা লিখবে। ঈশিতা মনে মনে ভাবল, “আমি কি পারতাম কিছুটা আগেই এভাবে বলতে, পারতাম কি একটু সাহসী হতে?” হঠাৎ করেই একটা অদ্ভুত অস্থিরতা নামল তার মনে। সে ড্রয়ার খুলে একটা সাদা খাতা বের করল। প্রথম পাতায় লিখল, “অরণ্য, আজ আমি প্রথমবার তোমাকে লিখছি, কিন্তু এবার পাঠাব। যদি পেয়ে যাও, বুঝে নিও—এইবার আমি সত্যি ভিজেছি, এক কাপ চা আর একফোঁটা প্রেমে।”

অন্যদিকে অরণ্য তখন তার ছোট্ট ভাড়া ঘরে বসে। তার জানালার বাইরেও বৃষ্টি পড়ছে। সে ল্যাম্পের নিচে বসে একটা খাতা খুলেছে। পাতায় লিখছে—

“তোমার নাম যখন উচ্চারণ করি না, তখনো শব্দগুলো তোমার গন্ধ পায়। তুমি থাকো না এখন, কিন্তু জানো, চায়ের কাপের ধোঁয়া আজও তোমার মতো গায়ে মেঘ জড়ায়।” হঠাৎ সে কলম থামাল। স্মৃতির মধ্যে ডুবে যেতে যেতে মনে পড়ল সেই সন্ধ্যেটা, যেদিন ঈশিতা বলে উঠেছিল—”ভালোবাসা বললে ভয় পাই। কারণ তা ফুরিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। তাই আমি চুপ থাকতে চাই।” আজ মনে হচ্ছে, চুপ থাকার দিন শেষ।সে উঠে টেবিলের উপরের তাক থেকে একটা খাম বের করল। পুরোনো। তাতে লেখা ছিল—“তোমার নাম, বৃষ্টির কালি দিয়ে লেখা।” সে খামটা খুলল না। শুধু জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল, বৃষ্টির ফোঁটাগুলো কাঁচে নেমে আসছে, ঠিক যেন অক্ষরের মতো।তারপর ফিসফিস করে বলল, “ভালোবাসা হয়তো শব্দে নয়, কিন্তু এক কাপ চা আর একফোঁটা প্রেমেই তার সম্পূর্ণতা।”

আবার একসাথে হাঁটা

পরদিন সকালটা অদ্ভুতভাবে আলতো। কলকাতার আকাশ ধোয়া ধোয়া মেঘে ঢাকা, বৃষ্টির ধারাটা মাঝে মাঝেই আসে-যায়, আর হাওয়া যেন আগের দিনের সমস্ত কথা নিজের পাঁজরে জমিয়ে রেখে ধীরে ধীরে খুঁড়িয়ে হাঁটে। ঈশিতা খুব ভোরে উঠে চায়ের কাপ হাতে বসেছিল জানালার ধারে। আজ তার মনটা ভারী না, হালকা। তার চিঠিগুলো সে আর গোপন করে রাখেনি। রাত্রেই সে সেগুলোর কয়েকটা টাইপ করে মেইল করেছিল অরণ্যকে। সাবজেক্টে লিখেছিল—“ভিজে থাকা শব্দগুলো”। কোনো প্রত্যুত্তর আসেনি এখনো, কিন্তু ঈশিতা জানে, অরণ্য নিশ্চয় পড়ে ফেলেছে। এবং নিশ্চয় চুপ করে বসে আছে কোথাও—যেমন করে ও চুপ থাকত, যেদিন সে কবিতা পড়ে আবেগে ভিজে যেত, অথচ কিছু বলত না।

এদিকে অরণ্য ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হওয়ার আগেই মেইলটা খুলেছিল। প্রথম চিঠির প্রথম লাইনটাই বুক কেঁপে দিয়েছিল—

“তোমার চলে যাওয়া মানে আমি নিজের ভেতরেই ছিটকে পড়া একটা দরজা খুঁজে পেলাম, যেটা খোলার সাহস আজও পাইনি।”

সে পুরো চিঠিটা পড়ল নিঃশব্দে। চোখের নিচে হালকা এক কালি জমে থাকা ক্লান্তি নিয়েও সে হাসল। তারপর মনে মনে বলল, “তুমি ঠিক বলেছিলে, আমরা কখনো শুরু করিনি, তাই শেষও হয়নি। হয়তো আজ শুরু হতে পারে।”

দুপুর নাগাদ তারা ঠিক করল দেখা করবে—শুধু হাঁটবে, কথা না বললেও চলবে। শুধু একসঙ্গে হাঁটা।

মিলল তারা রবীন্দ্র সরোবরের ঠিক পেছনের রাস্তায়, যেখানে এখনো গাছের পাতায় টুপটাপ করে জল পড়ে, আর হাঁটার পথটা ভিজে চকচকে হয়ে আছে।

অরণ্য সাদা শার্ট পরে এসেছে, হালকা ভেজা, আর হাতে একটা খাতা। ঈশিতা আজ সালোয়ার পরে এসেছে, মাটির রঙের, আর কাঁধে একটা ছাতা ঝোলানো থাকলেও খুলে রাখেনি।

“আজ আর কিছু না,” অরণ্য বলল, “শুধু পাশে হাঁটব, আর জানব, তুমি আর আমি আছি।”

“তুমি যদি আবার হারিয়ে যাও?” ঈশিতা বলল।

“তবে তুমি খুঁজবে?”

“খুঁজে পেয়েই তো আবার হাঁটছি,” ঈশিতা মৃদু হাসল।

তারা হাঁটতে লাগল। দু’জনের হাত পাশাপাশি, মাঝেমাঝে ছুঁয়ে যাচ্ছে, কখনো ছুঁয়ে যাচ্ছে না। এমন একটা বন্ধুত্ব, যার ভিতর এত অভিমান, এত চাওয়া, এত পেছনে ফেলে আসা বিকেল জমে আছে, তবুও যেন আজ নতুন।

“তুমি কি জানো,” ঈশিতা বলল, “আজ এতদিন পর মনে হচ্ছে বৃষ্টিকে ভয় নেই। কারণ পাশে তুমি আছো।”

অরণ্য কিছু বলল না। সে খাতাটা খুলল। তাতে লেখা—“আমাদের গল্পটা কখনো ছন্দে বাঁধা ছিল না, তবু যতবার বৃষ্টি পড়ে, শব্দেরা তোমার মুখ মনে করিয়ে দেয়। যদি কোনোদিন হারিয়ে যাও, এই লাইনে ফিরে এসো।”

ঈশিতা হাত বাড়িয়ে খাতার পাতায় আঙুল রাখল। “এই লাইনে ফিরে আসা মানে হয়তো আবার এক কাপ চা আর একফোঁটা প্রেম দিয়ে শুরু করা।” অরণ্য বলল, “তাহলে চল, আজ সেই চায়ের দোকানে আবার যাই। চা ভাগ করে খাই। না হয় আজ থেকে প্রতিদিন বর্ষা হোক।” তারপর তারা আবার হাঁটতে লাগল। পাশে পাশে। কোথাও কোনো শব্দ নেই, কেবল ভেজা পাতা আর প্রেমের ভেতরে নিঃশব্দে ফিরে আসা সময়।

শেষ না হওয়া শেষটা

বিকেলটা ভিজে উঠছিল ধীরে ধীরে, কিন্তু আজ যেন সেই ভেজাটার মধ্যে একরকম উষ্ণতা ছিল। চায়ের দোকানে ফিরে এসেছে তারা—ঠিক যেমন প্রথমদিন, আবার সেই কাঠের বেঞ্চ, সেই টিনের ছাদ, আর টেবিলে দুটো কাঁচের কাপ। দোকানদার এবার চিনে ফেলেছে, মুখে মৃদু হাসি। “আজও দু কাপ, না তিন?” সে জিজ্ঞেস করল মজা করে। ঈশিতা হেসে বলল, “দু’জনের জন্য এক কাপ, আরেকটা ভাগ করে নেব।” অরণ্য বলল, “ভাগ করতেই তো এসেছি। আজ শুধু চা না, আমাদের ভেজা সময়টাও ভাগ করে নিতে চাই।” তারা বসল, দুজনের মাঝে আগের তুলনায় কম দূরত্ব, আর চোখে মুখে সেই অদ্ভুত স্বচ্ছ আলোর রেখা, যেটা কেবল ফিরে আসার ভিতরেই দেখা যায়।

অরণ্য একটা পকেট থেকে পুরনো চিঠির খাম বের করল। খামের ওপর কালচে দাগ, পাতলা কালি দিয়ে লেখা—“তোমার নামে বৃষ্টি নামে।” ঈশিতা ধীরে হাত বাড়িয়ে খামটা নিল। ভেতরে একটা ছোট্ট কবিতা।

“যদি কোনোদিন চা খেতে গিয়ে কেউ বসে পাশে,

তবে জেনে নিও, আমি ছিলাম সেই ফোঁটা,

যা ঠোঁটের ছোঁয়া খেয়ে প্রেম হয়ে গিয়েছিল।”

ঈশিতা পড়া শেষে কাগজটা ভাঁজ করল। তারপর কাপটা হাতে তুলে বলল, “তুমি কি জানো, এই কবিতাটার অপেক্ষায় ছিলাম?”

অরণ্য চোখ নামিয়ে বলল, “আমি নিজেও ছিলাম। শুধু সাহস করতে পারিনি। আজ যদি না দেখতে পেতাম তোমায়, হয়তো জীবনের সব গল্পটাই অসমাপ্ত থেকে যেত।”

“অসমাপ্ত বলেই হয়তো এত সুন্দর,” ঈশিতা বলল।

চা শেষ হয়েছে ততক্ষণে। কিন্তু দুজনের ভিতরকার ভিজে পৃষ্ঠাগুলো যেন আস্তে আস্তে শুকিয়ে আসছিল রোদ না থাকা এক সন্ধেয়। বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছে, কিন্তু আর ভয় নেই।

চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে তারা হাঁটতে লাগল। হাতে হাত, কিন্তু তাতে কোনো মালিকানা নেই। কেবল একটা স্বতঃসিদ্ধ ছায়া, যেটা বুঝিয়ে দেয়—ভালোবাসা কখনো শব্দে নয়, কখনো ছোঁয়ায় নয়, বরং ছোট ছোট অভ্যেসে বেঁচে থাকে।

ঈশিতা বলল, “কাল দেখা হবে?”

অরণ্য বলল, “যদি বৃষ্টি হয়।”

“আর না হলে?”

“তবে আমরা নিজেরাই বৃষ্টি হয়ে যাব।”

সেদিন বিকেল শেষ হয়েছিল কিন্তু গল্পটা নয়। তাদের গল্প আজও হয়তো কোনো চায়ের দোকানে, কোনো বইয়ের পাতায়, বা কোনো অসমাপ্ত চিঠিতে নিজের মতো করে বাঁচে—এক কাপ চা আর একফোঁটা প্রেমের মধ্যে।

শেষ

Lipighor_1749968411484.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *