মেঘমল্লার দে
পর্ব ১ : ভেজা চায়ের ঘ্রাণ
কলেজ থেকে বেরিয়ে রোদ্দুরহীন আকাশটার দিকে তাকিয়ে ছিল অয়ন। না মেঘ, না রোদ, একটা ধূসর ধূ-ধূ দুপুর—যে দুপুরে না ফিরে যেতে ইচ্ছে করে, না এগোতে। মাথার ভেতর ঘুরছিল অসমাপ্ত প্রেজেন্টেশনের স্লাইড আর তপতী ম্যামের রাগী মুখ।
একটা মেসেজ এল ফোনে—
“Where are you?”
প্রিয়া। গার্লফ্রেন্ড নয়, আবার বন্ধুও নয়। একটা স্ট্যাটাসের মতো কিছু, যেটা undefined।
অয়ন উত্তর দিল না। শুধু ব্যাগটা কাঁধে তুলে রাস্তায় নেমে এল।
আর তখনই বৃষ্টি পড়ল।
হঠাৎ।
নির্লজ্জ, নির্দয়, নির্ভুল।
অয়ন পকেট থেকে ছাতাটা বার করল না। ইচ্ছে করেই। কেমন একটা শীতল জল এসে কপালের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল গলায়, মনে হল তারই মতো কিছু একটা ভিতরে গলে যাচ্ছে।
এদিকে রাস্তার ওপাশে, এক কোণে, ছোট্ট একটা চায়ের দোকান। টিনের চাল, দু’টো বেঞ্চ, একটা চুল্লি আর একজোড়া চায়ের ভাঁড়।
অয়ন ঢুকে পড়ল ওখানে। ঝপঝপে জামাকাপড়ে জল টপটপ করে পড়ছে।
চা-ওয়ালা লোকটা একবার তাকিয়ে আবার চুল্লির দিকে মন দিল।
— “একটা চা দিন।”
— “ভাঁড়ে না প্লাস্টিকে?”
— “ভাঁড়েই দাও।”
চা এসে গেল। মিষ্টির পরিমাণ ঠিকঠাক, এক চিমটে আদা, হালকা দারচিনি—এই রকম এক কাপ চা বৃষ্টির দিনে অনেক কিছু ফিরিয়ে আনে।
চুমুক দিল অয়ন। গালদুটো ফুঁড়ে উঠল ভাপ।
আর তখনই, চা-ওয়ালার পাশে এসে দাঁড়াল একটা মেয়ে।
হলুদ বুটিক-করা কুর্তি, নীল ছাতাটা ভাঁজ করে ঝুলিয়ে রেখেছে কাঁধে, আর চোখদুটো এত বড় যে এক মুহূর্তে দৃষ্টি আটকে যায়।
— “একটা চা… আমিও ভাঁড়েই নেব।”
ওর গলা বেশ নরম, কিন্তু ভেতরে কোথাও যেন একটা ধরা সুর। যেমন বৃষ্টির দিনে জানলার কাঁচে টোকা দেয় বৃষ্টির ফোঁটা।
অয়ন একটু সরে দাঁড়াল, জায়গা করে দিল মেয়েটার পাশে। কোনও কথা হয়নি।
চা এলো। মেয়েটা চায়ে চুমুক দিল, তারপর হঠাৎ বলল—
— “তুমি ছাতা আনোনি?”
— “আনছিলাম। কিন্তু বের করিনি।”
— “কেন?”
— “বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগে। মনে হয় সবকিছু ধুয়ে যাচ্ছে। মাথা, মন—সব।”
— “তুমি কি খুব সিনেমাটিক কথা বলো সব সময়?”
— “তুমি কি সবসময় ছাতা খুলে রাখো?”
মেয়েটা হেসে ফেলল। হেসে ওর চোখ দুটো আরও গাঢ় হয়ে উঠল।
— “আমি অরণি। তুমি?”
— “অয়ন।”
— “মানে, অরণি আর অয়ন। বেশ মিলমিশ নাম।”
অয়ন হালকা হাসল। এই জায়গাটা যেন একধরনের স্টপগ্যাপ—যেখানে কেউ কাউকে চেনে না, আবার ঠিক অচেনাও নয়।
চা শেষ হয়ে এল।
অরণি বলল, “আজকে আমার জন্মদিন।”
— “সিরিয়াসলি? হ্যাপি বার্থডে!”
— “থ্যাঙ্কস। আমি আসলে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কেউ না জানুক, আমি একা কাটাতে চাই।”
— “সেইজন্যেই এই চায়ের দোকান?”
— “এই জন্যেই এই শহর… রাস্তাগুলো… বৃষ্টির দিনগুলো।”
অয়ন অবাক হয়ে দেখল মেয়েটার চোখে জল নেই, কিন্তু একরকম ভেজাভাব আছে। তার মতোই।
— “আমি তো ফার্স্ট টাইম এই দোকানে এলাম,” বলল অয়ন।
— “আমি রোজ আসি। কিন্তু আজকের মতো এমন কাউকে পাইনি যার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে।”
বাইরে তখন বৃষ্টি একটু কমেছে।
অরণি ছাতাটা খুলল না।
চোখে অদ্ভুত এক দৃষ্টির রেখা রেখে বলল, “চলো, হাঁটি একটু?”
অয়ন বলল, “ভিজবো?”
অরণি বলল, “ভিজি না আজ একটু?”
আর এরপর তারা হাঁটতে শুরু করল।
চায়ের দোকানটা রয়ে গেল পেছনে।
রাস্তা ধরে একজোড়া স্যান্ডেল আর একজোড়া জুতো কাদা ছড়িয়ে চলল পাশাপাশি।
যে দুপুরটা রোদহীন, ক্লান্ত আর ধূসর ছিল, সে এখন বৃষ্টিভেজা নীলচে আলোর মতো হয়ে উঠেছে।
আর সেই আলোর ভেতর দুজন মানুষের পরিচয় শুরু হলো—চা আর ছাতার বাইরেও।
পর্ব ২: নামহীন একটা গল্প
রাস্তার কাদামাখা ফুটপাথ ধরে হাঁটছিল তারা দুজন। কারও মুখে কোনও কথা নেই, শুধু পায়ের তলার শব্দ আর বৃষ্টির ফোঁটার দৌড়। এমন হাঁটায় কোনও লক্ষ্য থাকে না। থাকে একটা তাল, একটা টান।
অয়ন প্রথম বলল, “তুমি এমন হুট করে অচেনা ছেলেকে বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে বললে?”
অরণি হেসে বলল, “তুমি হুট করে ছাতা না খুলে বৃষ্টিতে দাঁড়ালে—আমি তো ভাবলাম, তুমি আমার দলে।”
— “তোমার দল মানে?”
— “যারা বৃষ্টিকে ভয় পায় না। আরেকটু একা থাকতে জানে।”
অয়ন হেসে মাথা নাড়ল। এ মেয়ে সাধারণ নয়। ওর মধ্যে কোথাও যেন শব্দের চেয়ে বেশি নীরবতা, চোখের চেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা।
হঠাৎ একফাঁকে একটা হলুদ অটো বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে গড়িয়ে গেল, তার ধারের কাদা ছিটকে পড়ল ওদের জামায়।
অরণি হালকা চেঁচিয়ে উঠল, “আঃ! এরা একটা কথাও বোঝে না!”
অয়ন বলল, “বৃষ্টির শহরে কোনও গতি নেই। কিন্তু অটোগুলো যেন সবসময় দৌড়োয়।”
অরণি মুচকি হাসল। “তুমি সব কথায় কবিতা মেশাও বুঝি?”
“তোমার ভালো লাগছে?”
“তুমি বলো।”
এই কথোপকথনের ভিতরেই, কখন যেন তারা পৌঁছে গেল একটা পুরোনো মোড়ের কাছে—যেখানে একটা লাইব্রেরির পুরোনো বিল্ডিং আছে, যার সামনে এক বিশাল আমগাছ। গাছের নিচে দাঁড়ানো মানে বৃষ্টির ছায়ায় দাঁড়ানো।
অরণি বলল, “চলো, এখানে একটু দাঁড়াই। জামাটা একটু মুছি।”
অয়ন গাছের গুঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে।
ওর হলুদ কুর্তিটা এখন ভিজে নেমে গেছে হাঁটু অবধি, চুলগুলো জট পাকিয়ে গালে লেগে আছে। আর তবু এমন এক অহংকার রয়েছে মেয়েটার চোখে—যেটা ভেতর থেকে আসে, বাহারি সাজগোজ থেকে নয়।
— “তোমার বয়ফ্রেন্ড নেই?” অয়ন হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।
— “ছিল। ছেলেটার নাম ছিল তন্ময়। কিন্তু ওর সাহস কম ছিল। আমি যেমন, সেটা নিতে পারেনি।”
— “মানে?”
— “আমি একটু বেশি জেদি, স্বাধীন আর ঠোঁটকাটা। মেয়েদের এসব গুণ ছেলেদের পছন্দ হয় না খুব একটা।”
— “তুমি তো ভীষণ রকম real।”
— “আমি তো fake হতে পারি না, চাইলেও।”
একটা নিরবতা নেমে এলো দুজনের মধ্যে। হয়তো সেই নিরবতা আরও কিছু বলে দিচ্ছিল—যা ভাষায় বলা যায় না।
হঠাৎ করে, অরণি ছোট করে বলল, “তুমি ভালো ছেলে।”
অয়ন একটু থমকে গেল। “তুমি কীভাবে বুঝলে?”
— “তোমার চোখ দেখে।”
— “তাহলে তো চোখ দিয়ে সব বোঝা যায়।”
— “তা যায় না। কিন্তু কিছু অনুভব হয়।”
এই মুহূর্তে যেন হঠাৎ করে একটা বাঁধ ভেঙে গেল অয়ন-এর মধ্যে। এতদিন ধরে যে কথাগুলো জমে ছিল, যেগুলো কাউকে বলা হয়নি, সেগুলো ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছিল।
— “আমি মাঝে মাঝে একা হয়ে যাই। সবাই থাকলেও। মা-বাবার মধ্যে ডিভোর্স হয়ে গেছে অনেকদিন। বন্ধুরা আছে, কিন্তু কেউ আমার মত না।
প্রিয়া নামে একটা মেয়ে ছিল, এখনো আছে, কিন্তু কিছুই ক্লিয়ার না। কেমন যেন একটা ঝাপসা স্ট্যাটাসের মধ্যে আটকে আছি।”
অরণি শুনছিল। কিছু বলছিল না। শুধু তাকিয়ে ছিল গভীর মনোযোগে।
— “তুমি জানো? আজ দুপুরে আমি শুধু একটা ভাঁড় চা খেতে চেয়েছিলাম। এখন ভাবছি, বৃষ্টির থেকে তুমি বেশি গায়ে লেগে গেছ।”
অরণির ঠোঁটের কোণ একটু বাঁকা হলো। সে বলল, “তুমি romantic? নাকি emotionally impulsive?”
অয়ন বলল, “তুমি কী বলো?”
— “আমি বলি, তুমি vulnerable. কিন্তু ভীষণ honest.”
এই কথাগুলো শুনে অয়ন জানে না কেন, চুপ করে গেল। ভেতরে কোথাও যেন একটা শিরশিরে অনুভূতি হল। কেউ এমনভাবে ওকে বুঝেছে, সেটা অভ্যেস ছিল না।
তারা আবার হাঁটতে শুরু করল।
রাস্তার মোড়ে একটা পুরনো কফি শপ, যার দরজা এখনো খোলা ছিল।
অরণি বলল, “চলো, ভেজা জামা একটু শুকোই।”
অয়ন বলল, “চায়ের দোকান থেকে কফিশপ—এটা কি কোনো গোপন গল্পের ট্রানজিশন?”
অরণি হেসে বলল, “হয়তো।”
তারা ঢুকে পড়ল। জানলার ধারে একটা দুজনার টেবিল। বাইরের রাস্তায় এখনো বৃষ্টি ঝরছে। কিন্তু ভেতরে একরকম উষ্ণতা।
ওয়েটার এল।
— “Order, sir?”
অরণি বলল, “আমি নেব এক কাপ americano। আর তুমি?”
অয়ন বলল, “এক কাপ hot chocolate।”
— “sweet boy,” অরণি মুচকি হেসে বলল।
অয়ন ভাবছিল, আজকের দিনে কত কিছু ঘটে গেল! আর সবকিছুর শুরু ছিল একটা চায়ের দোকানে, এক কাপ চা আর এক জোড়া চোখের মধ্যে।
অরণি তখন তার মোবাইলটা বের করে ক্যামেরা অন করল।
— “একটা ছবি তুলব?”
— “আমার?”
— “না। এই টেবিলের। এই সময়টার। আজকের দিনটার।”
সে একটা ছবি তুলল জানলা দিয়ে। বাইরে বৃষ্টি, কাঁচের উপর জল, আর ভেতরে দুটো কাপে ধোঁয়া ওঠা কফি আর হট চকলেট।
— “এইটা তোমার Instagram-এ যাবে?”
— “না। এটা যাবে আমার নিজের কাছে। স্মৃতির মতো করে।”
অয়ন চুপ করে গেল।
তারপর সে ধীরে ধীরে বলল, “তুমি আবার কি আসবে সেই চায়ের দোকানে?”
অরণি তাকিয়ে রইল ওর দিকে। তারপর বলল, “যদি তুমি থাকো… হয়তো।”
পর্ব ৩: গন্তব্য নয়, একটা টেম্পোরারি ছায়া
কফিশপ থেকে বেরিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল তারা। বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু রাস্তায় জল জমে আছে। বাতাসে হালকা শীতের গন্ধ। কাঁচভেজা আলোয় শহরটা এক অদ্ভুত ঘোরে মোড়া—যেন ঠিক বাস্তব নয়, স্বপ্নও নয়।
অরণি ছাতাটা খুলে বলল, “তুমি কোনদিকে যাবে?”
অয়ন একটু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “যেদিকে তুমিও যাবে।”
অরণি তাকাল ওর দিকে। ঠোঁটের কোণে একরকম নিঃশব্দ প্রশ্ন ছিল—তুমি কি জানো, তুমি কোথায় যাচ্ছো?
— “আচ্ছা অয়ন,” অরণি বলল, “তুমি জানো, আমাদের দেখা হওয়ার মানে কি?”
— “মানে?”
— “এই যে, দুইজন মানুষ, যারা একে অপরকে একেবারেই চিনত না, তারা একটা চায়ের দোকানে হঠাৎ দেখা করল, হাঁটল, গল্প করল… এটা কি কাকতালীয়?”
অয়ন একটু থেমে বলল, “হয়তো Universe আমাদের কিছুটা সময়ের জন্য একসঙ্গে চেয়েছিল। চিরকালের জন্য না, একটুখানি সময়ের জন্য।”
— “তুমি জানো তো, অনেকে হয়ত চিরকাল একসঙ্গে থাকতে চায়। কিন্তু আমি চাই না। আমি চাই এমন মানুষদের সাথে থাকি, যারা একটা মুহূর্তকে চিরদিন করে দেয়, চিরদিনের মতো কাউকে মুহূর্তে রাখে না।”
অয়ন একটু স্তব্ধ হয়ে গেল।
এমন কথা কেউ ওকে বলেনি আগে।
এমন ভাবে কেউ ওকে ভাবায়নি।
পাশ দিয়ে একটা সাইকেল চলে গেল। একটা কুকুর রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। একটা গাছের ডালে এখনো বৃষ্টির ফোঁটা ঝুলে আছে, পড়ছে না—থেমে আছে।
“তুমি কোথায় থাকো?”
অরণি একটু হেসে বলল, “একটা প্রশ্নের ভেতরে যদি আরেকটা ইচ্ছে লুকিয়ে থাকে, সেটা তুমি বোঝো?”
“মানে?”
“তুমি জানতে চাও, আজকে আবার দেখা হবে কিনা, তাই না?”
অয়ন একটু হেসে বলল, “হয়তো। অথবা আমি জানতে চাইছিলাম, এই দেখা কি শেষ দেখা?”
অরণি ছাতাটা গুটিয়ে ফেলল।
“আসলে, আমি থাকি না কোথাও স্থায়ীভাবে। আমি বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকি, আবার একা একরকম থাকি। আজ যে চায়ের দোকানে আমাদের দেখা, সেটাতে আমি নিয়ম করে আসি না। শুধু যখন নিজেকে হারিয়ে ফেলি তখন ফিরে আসি।”
“তুমি কি হারিয়ে যাও মাঝে মাঝে?”
“রোজই। কিন্তু কেউ খোঁজ নেয় না বলে ফেরা হয় না।”
অয়ন চুপ করে গেল। দুজনেই হাঁটছিল, এবার একটু ধীরে। মেঘভেজা শহরের বাতাসে যেন একটা ক্লান্তি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। যেভাবে সন্ধ্যার আলো ঢুকে পড়ে দিনের শরীরে, ঠিক সেভাবে সময় ঢুকে পড়ছিল এই হঠাৎ পরিচয়ের ভেতরে।
“তুমি কী করো?”
অয়ন বলল, “আমি ফিল্ম স্টাডিজে পড়ছি। মানুষ আর গল্পের সম্পর্কটা বুঝতে চাই।”
“তাই বুঝি চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলো এত?”
“চোখে তো সব লেখা থাকে।”
অরণি হঠাৎ থেমে গেল।
একটা পুরোনো বাড়ির সামনে দাঁড়াল। বাড়িটার রং খসে গেছে, জানলাগুলো কাঠের, আর এক কোণে একটা শিউলি গাছ।
“এটা আমার এক বন্ধুর বাড়ি। ওর দিদা আজ মারা গেছেন। আমি তাই এখানে এসেছিলাম, কিন্তু গিয়ে ভেতরে ঢুকতে ইচ্ছে করল না। মনে হল, একটা চা খাই আগে।”
“তাই আমরা দেখা হলাম?”
“হ্যাঁ,” অরণি বলল। “একটা মৃত্যু, একটা চা আর একটা পরিচয়। খুব সিনেমার মতো লাগছে, না?”
“আর তুমি সেই সিনেমার মুখ্য চরিত্র,” বলল অয়ন।
“তুমি না বললে বুঝতেই পারতাম না আমি এত important!”
“তুমি তার থেকেও বেশি।”
অরণি একটু থেমে বলল, “তুমি কি ভাবছো আমি সুন্দর?”
অয়ন বলল, “তোমার সৌন্দর্য এমন, যেটা প্রথমে বোঝা যায় না, কিন্তু দ্বিতীয়বার দেখলে চোখ সরানো যায় না।”
অরণি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “আমার বয়স বিশ। কিন্তু জীবন আমাকে অনেক আগেই বড় করে দিয়েছে। তাই কাউকে ভালোবাসার সাহস হয়নি। হয়তো হয়েছিল, কিন্তু কেউ থামেনি।”
অয়ন তখন হাত পকেটে রাখল। ঠাণ্ডা লাগছিল একটু। কিন্তু তার থেকেও বেশি লাগছিল একটা অপরিচিত অথচ চেনা আবেগ—যেটা হয়তো প্রেম নয়, কিন্তু প্রেমের দরজা ছুঁয়ে যায়।
“তুমি যদি চাও,” অয়ন বলল, “আমরা আবার দেখা করতে পারি। ঠিক আবার এই জায়গায়, এই চায়ের দোকানে।”
অরণি বলল, “হয়তো করব। কিন্তু আমি কথা দিতে পারি না।”
“আমি অপেক্ষা করব,” বলল অয়ন।
অরণি একটু সামনে এগিয়ে গেল। তারপর পিছন ফিরে বলল, “একটা ছবি তোলো আমাদের।”
অয়ন ব্যাগ থেকে ফোন বের করল। তারা দুজনে দাঁড়াল সেই পুরোনো বাড়ির সামনে। ক্যামেরায় সেই মুহূর্তটা ধরে রাখল—একটা গল্পের মতো, যার নাম নেই, শেষও নেই।
— “তুমি এই ছবিটা কোথায় রাখবে?”
— “মনের মধ্যে।”
— “আর আমি?”
— “তোমাকে রাখব, সেই জায়গায় যেখানে নাম না থাকলেও সব কিছু থাকে।”
তারা আর কথা বলল না।
বাড়িটার গেট খুলে গেল। একজন মহিলা বাইরে এসে দাঁড়াল। অরণি বলল, “আমাকে যেতে হবে।”
অয়ন মাথা নোয়াল।
তারা একে অপরকে স্পর্শ করল না, কিন্তু একটা চোখের চাহনিতে সবকিছু বলে দিল।
অরণি ভেতরে ঢুকে গেল।
অয়ন ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল বিপরীত দিকে।
রাস্তার মোড়ে এসে পিছন ফিরে তাকাল।
বাড়িটার শিউলি গাছে একটা ফুল ঝরে পড়ল।
পর্ব ৪: এক কাপ চা, আর কিছু না
তিন দিন কেটে গেছে।
অয়ন প্রতিদিন সেই চায়ের দোকানে যায়।
একই ভাঁড়, একই আদা-দারচিনির ঘ্রাণ, একই বেঞ্চ।
কিন্তু অরণি আর আসে না।
প্রথম দিন ভাবল—হয়তো সে ব্যস্ত, বন্ধুদের বাড়ি থাকতে হয়েছে।
দ্বিতীয় দিন ভাবল—হয়তো ইচ্ছে করেই আসেনি, আর কিছু না বলেই কথা না রাখার ইচ্ছেটা হয়তো ওর মধ্যেই ছিল।
তৃতীয় দিন বুঝল—অরণি কখনো কথায় কিছুই বলেনি। শুধু একটা চাহনি, একটা হেসে নেওয়া ফাঁকা কথা, আর একটা মুহূর্ত। তাতেই তো সে বিভোর।
অয়নের বন্ধু সায়ন্তন বলল, “তুই চা খাওয়ার নাম করে প্রেমে পড়ে গেলি?”
অয়ন হাসল না, উত্তরও দিল না। শুধু মাথা নাড়িয়ে বলল, “সব প্রেম শুরু হয় না, কিন্তু থেকে যায়।”
সেইদিন বিকেলে, অয়ন বসে ছিল কলেজ লাইব্রেরিতে।
বৃষ্টি হয়নি, রোদও হয়নি—আকাশ কেমন ছাইচাপা।
মনেরও তেমনই অবস্থা।
লাইব্রেরির জানলা দিয়ে রাস্তা দেখা যায়। তার সামনে দিয়ে মাঝে মাঝে ছুটে যায় অচেনা লোকেরা। আর অয়ন ভাবে, তারা কি সবাই কাউকে খুঁজে ফেরে?
হঠাৎ সে উঠে পড়ে, বাইরের দিকে হাঁটা দেয়।
পা আপনাআপনি চলে যায় সেই চায়ের দোকানটার দিকে।
চা-ওয়ালা তাকে দেখে একটু চিনে ফেলে এখন।
“ভাঁড়েই তো, না?”
অয়ন মাথা নাড়ে।
সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে বেঞ্চে। চারদিকে লোক, শব্দ, কিন্তু তার মনে একরকম নির্জনতা।
এবার সে নিজের ফোন বের করে, অরণির তোলা সেই ছবিটা দেখতে থাকে।
ছবিটায় অরণির মুখ স্পষ্ট নয়, হালকা ঝাপসা, যেন সময়ের ভেতর ঢুকে আছে।
তবে ছায়া আছে। আর চোখ। সেই চোখ যেটা একবার দেখলে ফেরার উপায় থাকে না।
সে ছবি দেখে কিছুক্ষণ থেমে থাকল। তারপর ধীরে ধীরে একটা নতুন মেসেজ টাইপ করল—
“If you ever feel like coming back… I’ll be here. Same bench. Same tea.”
কিন্তু কাকে পাঠাবে?
নাম নেই। নম্বর নেই।
একটা দিন, এক কাপ চা, আর একটা অচেনা মুখ—এটাই তো সব কিছু ছিল।
অয়ন ফোন রেখে দিল।
আর তখনই, হঠাৎ পাশের টেবিল থেকে একটা মেয়ে বলল,
— “আচ্ছা ভাই, চিনি একটু কম দিয়েছিলাম, ঠিক আছে?”
অয়ন কাঁপল। গলা… গলাটা একেবারে চেনা।
সে মুখ তুলে তাকাল।
অরণি।
হ্যাঁ, ঠিক ও।
হলুদ কুর্তি নেই। আজ সবুজ টপ, কালো জিনস। চুল খোলা, চোখে হালকা কাজল।
কিন্তু সেই চোখের গাঢ়তা আছে। সেই তাকানো। সেই স্মৃতি।
— “তুমি…?”
অরণি হেসে বলল, “আমি জানি, আমি দেরি করেছি। কিন্তু আমি বলেছিলাম না, কথা দিতে পারি না?”
অয়ন শুধু তাকিয়ে থাকে। কথা হারিয়ে ফেলে।
— “আমি তোমাকে দেখে ফেলেছিলাম দ্বিতীয় দিনেই। দূর থেকে। তুমি অপেক্ষা করছিলে। আমার ভীষণ ভয় হচ্ছিল। ভাবছিলাম, যদি ঠিকঠাক কিছু না বলতে পারি?”
— “তুমি তো এসেছো। এটুকুই তো যথেষ্ট।”
— “তুমি রাগ করোনি?”
— “আমি ভেবেছি। রাগ নয়, অপেক্ষা করেছি। ভাবিনি তুমি আসবে, কিন্তু চা খাওয়া ছাড়িনি।”
অরণি বসে পড়ে ওর পাশে।
এইবার তাদের মধ্যে আর কোনও দূরত্ব নেই।
চা-ওয়ালা এসে জিজ্ঞেস করল, “দুটো ভাঁড় দেব?”
অরণি বলল, “হ্যাঁ, আগের মতোই।”
অয়ন শুধু তাকিয়ে রইল ওর দিকে।
চা এলো। তারা চুপ করে চুমুক দিল।
সেই আগের স্বাদ। কিন্তু এবার একটু বেশি মিষ্টি মনে হলো।
— “আজ কেন এলে?”
— “কারণ আজ বৃষ্টি হয়নি।”
— “মানে?”
— “বৃষ্টি থাকলে নিজের মধ্যে হারিয়ে যেতে সুবিধা হয়। কিন্তু আজ বুঝলাম, আমি যা হারিয়েছি, তাকে ফিরিয়ে আনতে গেলে রোদ লাগবে। আর তুমি সেই রোদ।”
অয়ন এবার বলল, “তুমি আবার কবিতা বলো?”
অরণি হাসল, “তুমি তো কবিতায় বিশ্বাস করো না, তবুও চায়ের দোকানে প্রেম খুঁজতে এসেছো!”
— “তুমি কি আবার হারিয়ে যাবে?”
— “হয়তো। আমি এমনই। পুরনো বাড়ির মতো। কেউ ভালোবাসে, কেউ ভয় পায়।”
— “আমি ভয় পাইনি।”
— “তাই তো আজ এসেছি।”
তারা আবার হাঁটতে শুরু করল।
আজ বৃষ্টি নেই, ছাতা নেই, কিন্তু হাওয়ায় একরকম নরমতা।
তারা একটা খোলা মাঠের দিকে হাঁটছিল, যেখানে ঘাসে শিশির জমেছে।
একটা বেঞ্চে বসে তারা।
চুপচাপ। কোনও কথা নেই।
অরণি বলল, “তুমি চাইলে আমি ঠিকঠাক থাকতে পারি না, জানো?”
অয়ন বলল, “আমি ঠিকঠাক কিছু চাই না। আমি শুধু চাই, তুমি নিজে হও।”
আকাশটা একটু পরিষ্কার হয়েছে।
অরণি হঠাৎ ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বার করল।
— “তোমার জন্য লিখে এনেছি।”
— “কি লিখেছো?”
— “একটা চায়ের গল্প। যেটা চা দিয়ে শুরু, কিন্তু চুমু দিয়ে শেষ।”
অয়ন চোখ বড় করল।
অরণি হেসে বলল, “তুমি ভাবছো আমি এতটা সাহসী?”
“না, আমি ভাবছি, আমার এতটা সৌভাগ্য হতে পারে?”
তারা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল একে অপরের দিকে।
তারপর অরণি আস্তে বলল, “তুমি যদি ইচ্ছে করো, আমি কালকেও আসতে পারি। ঠিক এই দোকানে, এই বেঞ্চে, এই ভাঁড়ে চায়ের পাশে।”
অয়ন বলল, “আর আমি যদি না আসি?”
অরণি বলল, “তাহলে আমার এক দিনের প্রেমটাই চায়ের মতো থাকবে। শেষ ফোঁটা অবধি গরম, তারপর ঠান্ডা। কিন্তু স্মৃতিতে মিষ্টি।”
পর্ব ৫: ফিরে আসার মতো কিছুই ছিল না, তবুও ফিরল
বিকেলের আলো গা ছুঁয়ে যাচ্ছিল। চায়ের দোকানের চারপাশে একরকম সোনালি ছায়া ছড়িয়ে পড়ছিল। অরণি আর অয়ন একই বেঞ্চে বসে, হাতে ভাঁড় ধরে চুপ করে ছিল। কথার প্রয়োজন ছিল না—যতটা বলা দরকার, তার অনেকটাই তারা আগেই বলে ফেলেছে। এখন বাকিটা অনুভবের।
অয়ন বলল, “আজকে মনে হচ্ছে যেন সত্যি করে কোনো কিছু শুরু হচ্ছে।”
অরণি তাকিয়ে বলল, “তুমি জানো তো, শুরু মানেই শেষের ছায়া পড়ে যায়?”
“আমি জানি, কিন্তু আমি তবুও শুরু চাই। অন্তত এইটুকু সময়ের জন্য।”
অরণি চুপ করে গেল।
ওর চোখে ছিল ক্লান্তি। একটা অতীত টেনে ধরে রাখার ক্লান্তি, যা ও চায় না—তবু ছাড়তেও পারে না।
“আমি যেদিন প্রথম তোমাকে দেখেছিলাম, মনে হয়েছিল—এই মেয়ে হয়তো একটা গল্প লিখে ফেলে মানুষকে ভেঙে দেয়,” অয়ন বলল।
অরণি হাসল না, শুধু বলল, “আমি লিখি না। আমার জীবনটাই এমন, যে তাতে অনেক গল্প জমে। আমি শুধু শুনি। মানুষজনের চা খাওয়ার ফাঁকে বলা কথা, ছুটে যাওয়া রিকশার চাকার শব্দ, বৃষ্টির জলে থেমে যাওয়া মুখগুলো… এ সব শুনে ফেলি।”
“তুমি কি কখনও কারো জন্য রুকেছো?”
“হ্যাঁ। কিন্তু সেই মানুষটা আমার থামার মানে বোঝেনি।”
অয়ন জানে, অরণি সহজে কিছু মনে রাখে না। আবার কিছু ভুলতেও পারে না।
সেই ভারি চোখ, ভেজা হাসি, আর বুকের মধ্যে আটকে থাকা কথাগুলো যেন সব মিলিয়ে ওর একটা নিজস্ব ঋতু আছে—যেখানে কেবল অরণির ইচ্ছায় বৃষ্টি নামে, আলো নামে, সম্পর্ক নামে।
সেদিন তারা আর বেশি হাঁটেনি।
চায়ের দোকানের পাশে বসেই সময় কেটেছে।
অরণি মাঝেমাঝে আকাশের দিকে তাকাচ্ছিল—যেন কিছু খুঁজছে।
অয়ন জানে, ও যা খুঁজছে, সেটা সে দিতে পারবে না।
কিন্তু সেই না-পারাটাকেই যদি কেউ মেনে নেয়, সেখানেই তো প্রেম শুরু।
হঠাৎ অরণি বলল, “চলো, তোমায় একটা জায়গা দেখাই।”
“কোথায়?”
“একটা গলির মোড়ে ছোট্ট এক বইয়ের দোকান। কেউ খোঁজও নেয় না, কিন্তু ওখানেই আমি আমার ছোটবেলাকে রেখেছি।”
দুজন রওনা দিল।
চেনা রাস্তা, কিন্তু হাঁটছিল যেন অচেনা হয়ে।
একটা খুদে গলি, মোড়ে এক বৃদ্ধ বসে আছেন পুরোনো বই নিয়ে। ডাস্টবিনের পাশেই বসানো প্লাস্টিক শেলফে বই সাজানো।
“এখানেই আসতাম ক্লাস সিক্স থেকে,” বলল অরণি।
“এই জায়গা কেউ জানে না?”
“শুধু আমি আর এখন তুমি।”
অয়ন বইয়ের পাতায় চোখ রাখে।
চোখে পড়ে একটা পুরোনো নীলচে কাভারের বই—”পিয়ানো বাজানো শেখো”।
“তুমি পিয়ানো শেখো?”
“জানতাম একসময়। এখন আর বাজাই না। কিন্তু শব্দগুলো মনে থাকে, যেমন কিছু অনুভূতি ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলেও থেকে যায়।”
অয়ন বলল, “তুমি জানো, আমি আজকাল ভয় পাই… সম্পর্ক বলতে এখন সবাই স্ক্রিনশট বোঝে, টাইমলাইন বোঝে, কিন্তু টাইম বোঝে না।”
অরণি একটা পুরোনো বই তুলে বলল, “এই যে বইটার মধ্যে যতবার হাত গিয়েছে, ততবার একটা গল্প গড়ে উঠেছে। সম্পর্কও তাই—একটা আঙুল রাখলেই সব বদলে যায়। কিন্তু কেউ পড়ে শেষ করে না বলে, মাঝপথেই ফেলে রাখে।”
বৃদ্ধ দোকানদার হালকা গলায় বলল, “বই নেবে?”
অরণি বলল, “এইটা, পিয়ানোটা। আজ আবার বাজাতে ইচ্ছে করছে।”
অয়ন পয়সা দিতে চাইলে অরণি ওর হাত চেপে ধরে বলল, “তুমি শুধু সঙ্গে থেকো। বাকিটা আমি নিজেই পারি।”
সেই মুহূর্তে, অয়ন বুঝল—সে ভালোবেসে ফেলেছে।
ভালোবাসাটা ঠিক কীভাবে হলো, বোঝা গেল না।
কিন্তু সেই এক কাপ চায়ের ভাঁড় থেকে শুরু করে এই বইয়ের দোকান অবধি, একটা পথ তৈরি হয়েছে।
একটা আশ্রয়, যেটা অস্থায়ী, তবু গভীর।
তারা ফিরে এল সেই চায়ের দোকানে।
এইবার বসে থাকল আর কিছু না বলে।
শুধু, হাওয়ার মধ্যেও একটা স্পষ্ট আভাস—যে কেউ কাউকে চায়, কিন্তু চাওয়াটাই সব নয়।
হঠাৎ অরণি বলল,
“তুমি যদি কখনও চলে যাও, আমায় আগে বলো।”
অয়ন বলল, “আমি কোথাও যাব না।”
“না, সবাই যায়। কেউ চুপ করে, কেউ কথা রেখে। আমি শুধু চাই, তুমি বলে যেও। কারণ আমি অপেক্ষা করতে জানি, কিন্তু অকারণ নয়।”
অয়ন বলল, “তুমি কখনও আমাকে হারিয়ে ফেললে, এই দোকানে ফিরে এসো। এই বেঞ্চে। এই ভাঁড়ের পাশে।”
অরণি বলল, “আমি হারাই না। লুকিয়ে থাকি। আর যারা খোঁজে, তারা পায়।”
তারা আজ কিছুই স্পষ্ট করেনি।
না প্রেম, না ভবিষ্যৎ।
শুধু একটা অনুভূতির ভিতর দাঁড়িয়ে ছিল, যার নাম নেই, সংজ্ঞাও নেই।
কিন্তু তবুও,
সে ছিল।
ছিলই।
পর্ব ৬: আমাদের ছিল না কিছুই, শুধু সেই এক কাপ চা
দিন কেটে যায়, অথচ কিছু কিছু অনুভূতি যেন সময়ের গায়ে আটকে থাকে। অয়ন প্রতিদিন নিজের ডায়েরিতে অরণিকে নিয়ে ছোট ছোট লাইন লেখে।
“আজ চায়ের দোকানে ওর গন্ধটা পেলাম কি?”
“অরণি বলে, সে লুকিয়ে থাকে। আমি কি তবে খুঁজছি?”
“ভাঁড়টা আজ ফাটল। আমার মতো?”
ওর বন্ধুরা বলে, “তুই একটু overthink করিস।”
অয়ন শুধু মাথা নাড়ে, কারণ তারা জানে না, এক কাপ চা-ও কোনো দিন ভেঙে ফেলতে পারে একটা হৃদয়কে।
সেদিন অরণি হঠাৎ ফোন করল।
হ্যাঁ, ফোন।
এরপর অনেকদিন পর তারা নম্বর বিনিময় করেছিল।
তবে এই প্রথম ও নিজে ফোন করল।
— “আজ বিকেলে আসবি?”
— “তুই ডাকলেই যাব।”
— “আজ আসিস। একটু বেশিক্ষণ বসব। কথা কম হবে, তবুও চাই।”
অয়ন যখন পৌঁছয়, অরণি আগে থেকেই বসে।
আজ তার পরনে কালচে সবুজ কুর্তি, চুল খোলা। চোখে কাজলটা একটু হালকা, কিন্তু মুখটা আরও গাঢ়। যেন কোথাও হালকা দুঃখ লেগে আছে, যেটা তোলা যায় না, মোছাও যায় না।
— “আজ চা খাবি না?”
— “তুই বললে খাব। শুধু আজ ভাঁড়টা আমি রাখব।”
— “রাখিস। কিন্তু ভাঙিস না।”
চা এল।
অরণি দুহাতে ধরে রাখল ভাঁড়টা, যেন একটা গোপন কিছু উষ্ণ করে নিচ্ছে নিজের ভিতর।
— “তুই জানিস, আমি কলকাতা ছাড়ছি?”
অয়ন যেন একটা ধাক্কা খেলো।
— “চলেই যাচ্ছিস?”
— “হ্যাঁ। মাসখানেকের মধ্যে। বাবা বদলি হচ্ছে। আমি ওর সঙ্গেই যাব।”
— “আমায় বলিসনি?”
— “আমি নিজেকেই বলতে পারিনি এতদিন। ভাবছিলাম, বলা মানে কষ্ট বাড়ানো। কিন্তু না বলাটাও কষ্টের।”
অয়ন জানে না কী বলবে।
এই তো, ধীরে ধীরে যেন ওদের মাঝে একটা অদৃশ্য দড়ি তৈরি হচ্ছিল—যার একদিকে চায়ের গন্ধ, অন্যদিকে একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা।
আর এখন? এক দমকা বাতাসে সেই দড়ি যেন ছিঁড়ে গেল।
— “তুই কি যাবার পর… ভুলে যাবি?”
— “আমি কি তোকে কোনোদিন মনে রেখেছি?”
— “মানে?”
— “তুই তো আমার অভ্যাস হয়ে গেছিস। মন খারাপ থাকলে চায়ের মতো লাগিস। শরীর কাঁপলে হাত ধরার মতো মনে হইস। আমি তোকে ছুঁইনি, কিন্তু তোর উপস্থিতি আমার গায়ে লেগে থাকে। তুই কি জানিস, এটা মনে রাখা না ছুঁয়ে যাওয়ার ব্যাপার?”
অয়ন চুপ করে।
তার মনে হয়, কিছু কিছু অনুভব শব্দ চাই না। শুধু একটা এক্সপ্রেশন, একটা নিরবতা, একটা ভাঁড়—তাতেই সব কিছু মিলে যায়।
— “তুই কি আমায় ভালোবাসিস?”
প্রশ্নটা হঠাৎ করেই আসে।
অয়ন থেমে গিয়ে শুধু বলে,
— “ভালোবাসি না। ভালোবাসা বলে কিছু হয় না। আমি শুধু চাই, তুই হারিয়ে না যাস। অন্য কোথাও গেলেও যেন আমার মতো একটা লোক তোর জন্য অপেক্ষা করে। জানি, সে হয়তো আমার মতো হবে না। কিন্তু সে যেন তোর ভেতরটা বুঝতে পারে।”
অরণির চোখ চিকচিক করে ওঠে।
সে চা থেকে চোখ সরিয়ে বলে,
— “তুই তো জানিস, আমি থাকি না কোথাও। কোথাও ঠিকঠাক বসত গড়তে পারি না। কিন্তু তোর সঙ্গে বসে মনে হয়, যদি একটা খুপরি বানানো যেত, যেখানে শুধু একটা চায়ের ভাঁড় আর একটা বেঞ্চ থাকত…”
— “সেই খুপরিটাই তো আমার ভিতর। আমি রাখব তোর জন্য।”
অরণি এবার আর তাকিয়ে থাকে না। ও জানে, এ সম্পর্ককে নাম দিলে সেটা ভেঙে যাবে।
এটা সেই এক কাপ চায়ের মতো—যেটা ঠান্ডা হলেও ফেলে দেওয়া যায় না।
তারা আরেকটু হাঁটে।
আজ তাদের শেষ হাঁটা নয়, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন প্রতিটি পায়ের শব্দ হিসেব করে রাখা দরকার।
— “তুই কি কোনোদিন এই সব লিখবি?”
— “হয়তো।”
— “তাহলে গল্পের শেষে কী হবে?”
— “একটা বেঞ্চ থাকবে। তার উপর থাকবে একটা ভাঙা ভাঁড়, যার মধ্যে কিছু ফোঁটা চা শুকিয়ে গেছে। আর কেউ একজন হয়তো আসবে, বসবে, ভাববে—কেউ কি বসেছিল এখানে?”
অরণি এবার হাত বাড়িয়ে অয়নের হাত ছুঁয়ে বলে,
— “তুই যদি লিখিস, আমায় নাম দিয়ো না। শুধু গন্ধটুকু রেখো।”
সন্ধ্যে নেমে আসে।
রাস্তার আলো গায়ে পড়ে।
ট্যাক্সির লাল আলো, বাচ্চাদের স্কুলব্যাগ, ভিজে ছায়া—সব মিলিয়ে শহরটা কেমন যেন গান হয়ে ওঠে।
তারা বিদায় নেয় না।
কারণ যারা জানে, দেখা আবার হবে না, তারা বিদায় দেয় না। তারা শুধু একটু তাকিয়ে থাকে। আর সেই চোখেই রেখে দেয় সব কথা।
অরণি চলে যায়।
অয়ন বসে থাকে একা।
চায়ের দোকানটা বন্ধ হয়ে আসে ধীরে ধীরে। দোকানি চুল্লির আগুন নিভিয়ে দেয়। বেঞ্চে শুধু অয়ন, তার পাশে একটা খালি ভাঁড়।
আর কিছুক্ষণের মধ্যে সে উঠে পড়বে।
কিন্তু জানে, আজ এই খালি বেঞ্চটাই হয়ে থাকবে ওদের সবচেয়ে সত্য জায়গা।
একটা নামহীন সম্পর্ক, সময়হীন ভালোবাসা, ভাষাহীন বন্ধন।
যার সবকিছু ছিল না—
শুধু ছিল সেই এক কাপ চা।
পর্ব ৭: সেদিনের ভাঁড়টা আমি আজও রেখেছি
অরণি চলে গেছে।
ঠিক কোথায় গেছে, জানে না অয়ন।
শুধু এটুকু জানে, সে আর এই শহরে নেই।
তবে শহরের সব কিছুতেই অরণি রয়ে গেছে—রয়ে গেছে বৃষ্টির পর ছাতার গন্ধে, ফুটপাথের জলে ছড়িয়ে থাকা আলোয়, আর সেই চায়ের দোকানে যেখানে ভাঁড়ের পাশে এখনও একটা আসন খালি রাখা থাকে।
একটা সপ্তাহ কেটে গেছে।
অয়ন এখন কম চা খায়। কিন্তু একদিন সে নিজের টেবিলের ড্রয়ার খুলে দেখে, একটা পুরোনো ভাঁড় কাপড় দিয়ে মোড়া। সেটার মুখে এখনও লেগে আছে হালকা বাদামি দাগ—অরণির শেষ চুমুকের দাগ।
সেদিন চা খাওয়া শেষে, অরণি নীরবে ওর হাতে ভাঁড়টা দিয়ে বলেছিল,
— “এটা রেখে দিস। আমি চলে গেলে যদি কিছু রেখে যেতে চাই, এইটাই রাখব।”
অয়ন সেটাকে রেখেছিল বইয়ের পাশে।
আজ আবার সেটা হাতে নেয়। গন্ধ পায় না, তবু মনে হয়—ভাঁড়টা নিঃশব্দে কথা বলছে।
ডায়েরির একটা পাতায় লিখল সে—
“স্মৃতির মতো কোনো বস্তু হয় না, যার ঘ্রাণ নেই, রঙ নেই, তবুও যেটা বুকের ভেতর পুরো পৃথিবীর মতো জায়গা নিয়ে থাকে।”
সেদিন বিকেলে অয়ন আবার গিয়েছিল সেই চায়ের দোকানে।
বসেছিল, অনেকক্ষণ।
এক ভাঁড় চা নিয়েছিল, অরণির মতো করে—আদা, দারচিনি, হালকা চিনি।
চা-ওয়ালা এখন চেনে ওকে।
— “আপনার বান্ধবী আসেন না?”
অয়ন একটু হেসে বলেছিল, “উনি এখন অনেক দূরে।”
চা-ওয়ালা বলেছিল, “কিন্তু ওর বসার জায়গাটা আমি কাউকে বসতে দিই না, জানেন?”
অয়ন থেমে গিয়েছিল।
— “ও এসেছিল সেদিন। যাওয়ার আগের দিন। একটা ছড়া রেখে গিয়েছিল।”
— “ছড়া?”
— “হ্যাঁ, ভাঁড়ের নিচে একটা কাগজ। আমি ভাঁড় পরিষ্কার করতে গিয়ে পেয়েছিলাম।”
চা-ওয়ালা ভাঁড়ের তাক থেকে একটা মুড়োনো কাগজ দিল।
অয়ন খুলে পড়ে—
হাত কাঁপছিল।
—
“এক কাপ চা, আর একটু ভালো লাগা
তুই বলেছিলি — আর আসবি না
আমি বলিনি — থাকিস
তবু মন চেয়েছিল — থামিস।
এই চায়ের দোকানটা জানে —
প্রেম শুরু হয় এখানে, শেষ হয় না জানে।”
— অরণি
—
অয়ন ভাঁড়টা দুই হাতে ধরে।
তার মনে হচ্ছিল, শহরের এক কোণে আজও কেউ চুপ করে বসে—যে চা খায় না, কিন্তু প্রতিটি চুমুকে কাউকে মনে রাখে।
তখনই পেছন থেকে এক কণ্ঠস্বর,
— “আজ এখানে বসে পড়েছিস?”
অয়ন ঘুরে তাকায়।
সায়ন্তন। ওর ক্লাসমেট, কাছের বন্ধু।
— “তুই এখনও এই দোকানে?”
— “এখানে গল্প আছে রে।”
— “গল্প না, আবেশ। তুই এখন romantic ধাঁচের কবি হয়ে যাচ্ছিস।”
— “কবিতা তো ওই মেয়ে লিখে দিয়ে গেছে। আমি শুধু চোখে রেখেছি।”
সায়ন্তন কিছু বলে না। পাশে বসে। চা অর্ডার করে।
দুজন চুপ করে চা খায়।
অয়ন কাগজটা ওকে দেয় পড়তে।
সায়ন্তন পড়ে, তারপর বলে,
— “এটা তো প্রেমের কবিতা নয়, এটা তো প্রত্যাশাহীন প্রেমের চিহ্ন।”
অয়ন মাথা নাড়ে।
— “হ্যাঁ। যা কিছু আমরা চাই না, কিন্তু হয়ে যায়—সেইসব সম্পর্কের মতো।”
তারা উঠে পড়ে।
সন্ধে নামছে।
আকাশে ঝাঁপসা নীল। দোকানটা ধীরে ধীরে গুটোচ্ছে।
অয়ন হাঁটতে হাঁটতে ভাবে—আজ যদি অরণি এখানে হতো, তবে তারা কী বলত?
হয়তো কিছু না।
শুধু পাশে বসে থেকে, এক কাপ চা হাতে, কিছু ফোঁটা নীরবতা শোনার চেষ্টা করত।
সেদিন রাতে অয়ন আবার ভাঁড়টা নিজের বিছানার পাশে রাখে।
একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে, পাশে ডায়েরি খুলে লিখে—
“তুই নেই, তবু তোর জন্য জায়গা ফাঁকা রাখি। যে গল্প শেষ হয়নি, তারই ভাঁড়ে চুমুক দিই প্রতিদিন।”
রাত গভীর হয়।
চুপচাপ।
আর তখনই ফোনে একটা মেসেজ আসে।
অরণি:
“তুই কি এখনও চায়ের দোকানে যাস?”
অয়ন:
“হ্যাঁ। বেঞ্চে কেউ বসতে দিই না।”
অরণি:
“ভাঁড়টা রেখেছিস?”
অয়ন:
“রাখিনি। জাপটে ধরে রেখেছি। যেন আমার হাত থেকে চা ফোঁটা না পড়ে।”
অরণি:
“তুই জানিস তো, একদিনের প্রেমও একটা জীবনের মতো হয়ে থাকতে পারে?”
অয়ন:
“আমি জানি। কারণ একদিন তোকে দেখেছিলাম। আজও দেখছি। শুধু সামনে বসে নেই।”
পর্ব ৮: ভাঁড়টা যদি একদিন ফেটে যায়
অয়ন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে উঠে জানালার দিকে তাকাল।
বাইরে মেঘলা আকাশ।
বৃষ্টি হয়নি, কিন্তু বাতাসে সেই গন্ধ—যেটা আসে শুধু অরণির কথা মনে পড়লে।
টেবিলের পাশে রাখা ভাঁড়টা হাতে তুলে সে আবার দেখল।
হালকা চিড় ধরেছে নিচে, একপাশে ফাটল।
একটা দিন, একটা প্রেম, একটা কথা—সবকিছু এই ভাঁড়টার গায়ে লেগে ছিল এতদিন।
এখন মনে হচ্ছে, ভাঁড়টা বুঝি কথা বলতে চাইছে।
সে ধীরে ধীরে ফাটলটায় আঙুল রাখল।
ভাঙা নয়, কিন্তু হঠাৎ একটা ভয় হলো—ভাঁড়টা যদি একদিন সত্যিই ফেটে যায়?
যদি এই একটা স্মৃতির বস্তুটাও হারিয়ে যায়?
তবে কি অরণিও মুছে যাবে?
সেদিন অয়ন চায়ের দোকানে যায়নি।
সে হাঁটছিল শহরের একান্ত কিছু গলিপথে, যেখানে ওরা একদিন হেঁটেছিল, গল্প করেছিল, হেসেছিল।
তবে আজ সেসব কিছুই নেই।
শুধু আছে ছায়া—একটা হাওয়ার টান, একটা উষ্ণতার শূন্যতা।
ওর মাথায় একটা কথা ঘুরতে থাকে,
“ভাঁড়টা যদি ফেটে যায়, সম্পর্কও কি ফাটে?”
সে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে সেই পুরোনো বইয়ের দোকানের সামনে—যেখানে অরণি একদিন পিয়ানোর বইটা কিনেছিল।
বৃদ্ধ দোকানদার এখনো বসে আছেন।
চেনা মুখ দেখে বললেন, “বাবু, মেয়েটা আর এলো না?”
অয়ন একটু থেমে বলল, “ও গিয়েছে। তবে একটা ভাঁড় রেখে গিয়েছে।”
বৃদ্ধ মাথা নাড়িয়ে বললেন, “কিছু মানুষ ফিরে আসে না। কিন্তু তাদের রেখে যাওয়া জিনিসগুলো আমাদের বুকের মধ্যে রয়ে যায়।”
অয়ন একটা পুরোনো কবিতার বই কিনে নেয়।
তারপর নিজের ডায়েরির ভাঁজে একটা চিরকুট রেখে দেয়
“যদি ফাটেও, ভালোবাসা ফেটে যায় না।
ভাঁড়ের চা ছিটকে পড়লেও, তার গন্ধটা থেকে যায়।”
সে ফিরে আসে বাড়িতে।
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই মনে পড়ে—আজ সন্ধেয় কলেজে একটা রিসাইটেশন প্রোগ্রাম ছিল।
ওর নিজের লেখা পড়ার কথা ছিল—যেটা সে এখন পর্যন্ত ঠিক করে লেখেইনি।
কিন্তু আজ লেখার মতো কিছু যেন তৈরি হয়ে গেছে ভিতরে।
ও উঠে বসে টেবিলে।
ভাঁড়টা সামনে রেখে কলম হাতে নেয়।
পাতায় লেখা শুরু করে—
“এক কাপ চা, যার পাশে একদিন কেউ বসেছিল।
না নাম জেনেছিলাম, না ভবিষ্যৎ চেয়েছিলাম।
শুধু ওর চুলে লেগে ছিল জল,
চোখে লেগে ছিল ঘুমভাঙা আকাশ।
সে চা শেষ হয়ে গেছে বহুদিন,
কিন্তু ভাঁড়টা এখনও ভাঙেনি।
কারণ যাদের ভালোবাসা হয় না,
তাদের স্মৃতি ভাঙে না।”
সন্ধ্যেবেলায় কলেজের অডিটোরিয়াম ভর্তি।
লাল আলো, মাইক, শ্রোতার নিঃশব্দে কান পাতা।
অয়ন উঠে দাঁড়ায়, হাতের কাগজে লেখা তার কবিতা।
সে পড়ে।
না শব্দের ভেতর প্রেম বলে, না দৃষ্টিতে ভরিয়ে দেয় নাটকীয়তা।
শুধু নিঃশব্দে, কাঁপা কাঁপা গলায় পড়ে যায় তার চা আর অরণির গল্প।
শেষে শ্রোতারা তালি দেয়। কেউ কেউ উঠে দাঁড়ায়। কেউ চোখ মোছে।
কিন্তু অয়ন চোখ বুলায় পিছনের সারিতে।
আর তখনই দেখে—একটা ছায়া, একজোড়া চোখ, আর একটা হালকা চুল খোলা মুখ।
অরণি।
না, সে কিছু বলে না।
শুধু দাঁড়িয়ে থাকে, হেসে তাকায়।
তারপর বেরিয়ে যায়।
অয়ন দৌড় দিয়ে অডিটোরিয়াম থেকে বেরোয়।
দেখে, বাইরে রোদ আর বৃষ্টির সন্ধি।
অরণি একটা ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে।
অয়ন পৌঁছয়, দাঁড়ায় সামনে।
অরণি বলে,
— “আমি ভেবেছিলাম, ভাঁড়টা ফেটে যাবে। কিন্তু তুই ভাঙিসনি।”
— “তুই এসেছিস।”
— “হ্যাঁ, কারণ তুই রেখে দিয়েছিলি। আমি না থাকলেও, তুই তো অপেক্ষা করেছিলি।”
— “তুই আর যাবি না তো?”
— “আমি ফিরতে শিখেছি। ভালোবাসা মানে থাকা নয়, ফেরাও।”
— “তাহলে?”
— “তাহলে আসি আবার চা খেতে, ঠিক আগের মতো।”
অয়ন ভিজে হাসে।
হাত ধরে না। কিছু বলে না।
তারা আবার হাঁটতে থাকে।
তাদের পাশে হেঁটে চলে বৃষ্টির শব্দ, স্মৃতির ছায়া, আর সেই একটা ফাটল ধরা ভাঁড়—
যেটা এখনও ভাঙেনি।
পর্ব ৯: একটা চায়ের দোকানই কি একটা গল্প হয়ে ওঠে?
চায়ের দোকানটা একদিন ছিল শুধু একটা টিনের চালের নিচে দাঁড়ানো দুটো বেঞ্চ, একটা পুরোনো কেটলি, আর ভাঁড়ের গন্ধ।
আজ সে জায়গাটা যেন একটা চরিত্র হয়ে উঠেছে।
অয়ন আর অরণি এখন নিয়ম করে আসে না।
তারা অপেক্ষা করে না, প্রতিশ্রুতি দেয় না—তবু ঠিক চলে আসে, কিছু না বলেই।
যখন মন চায়, যখন ভেতরটা বলে, “আজ তাকে দেখলে ভালো লাগত,” তখন তারা এসে বসে।
সেই চা-ওয়ালাও কিছু বলে না।
দুটা ভাঁড় সাজিয়ে রাখে আগেভাগে, যদি তারা আসে।
কেউ আসুক বা না আসুক, তার কাজ ফুরোয় না।
একটা দোকান আর দুটো চায়ের ভাঁড়, যাদের আজকাল আর চায়ের চেয়েও বেশি কিছু হয়ে উঠেছে।
সেদিন সন্ধ্যায় অরণি আগে এসে বসেছিল।
বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই, আকাশ নীলচে ধূসর।
একটা হালকা পাখির পালক উড়ে এসে পড়ল ওর কাঁধে।
সে চুল গুঁজে নিল কানে, মোবাইলে দেখছিল পুরোনো ছবি—একটা ছবিতে তারা দুজনে বসে চায়ের বেঞ্চে, ভাঁড়ের পাশে একটা কবিতার খাতা।
অয়ন এল খানিক পরে।
চুল একটু এলোমেলো, চোখে কাজলের রেশ নেই—মুখে সেই চিরচেনা শান্তি, যা শুধু চায়ের গন্ধেই আসে।
— “আজ তুই আগে এলি?”
— “হ্যাঁ। আমি ভেবেছিলাম, তোকে একটা কথা বলব।”
— “বলো।”
— “আমরা কি গল্প হচ্ছি?”
— “মানে?”
— “এই দোকান, এই বেঞ্চ, এই ভাঁড়—সব কিছু তো এক একটা ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হয়, আমরা একটা গল্প হয়ে যাচ্ছি। যেটা কেউ পড়বে একদিন। কেউ বলে উঠবে—‘এমন ভালোবাসাও হয়!’”
— “তাহলে তো আমরা শেষ হতে চলেছি,” বলল অয়ন হেসে।
— “না, না। আমি বলতে চাইছি, গল্প শেষ হয় না, চরিত্র বদলায়। আমরা যদি গল্প হই, তবে এই দোকানটা আমাদের লেখক।”
তারা হাসে।
সেই হাসির ভেতরে এক রকম নিশ্চিন্ততা থাকে।
যেখানে কেউ কাউকে চায় না, তবু কেউ কাউকে ছাড়েও না।
একটা শান্ত চুমুক, একটা চুপ থাকা।
চা-ওয়ালা এসে বলে,
— “আজ চা একটু বেশি মিষ্টি করে দিলাম। কেমন লাগছে বলবেন।”
অরণি হেসে বলে, “আপনি তো এখন আমাদের চা-আঙ্কেল হয়ে গেছেন!”
— “আপনাদের দু’জনকে আমি দেখে বুঝি দিনটা কেমন যাবে।”
অয়ন বলে, “তাহলে আমাদের ঝগড়া হলে বৃষ্টি পড়ে?”
— “ঝগড়া নয় বাবু, নীরবতা হলে বৃষ্টি পড়ে। আমি তো দেখেছি—যেদিন আপনারা দুজন বেশি চুপ, সেদিন সন্ধ্যাবেলায় ঝুম ঝুম বৃষ্টি আসে।”
তারা আবার হেসে ফেলে।
আজ তারা অনেকক্ষণ বসে থাকে।
চায়ের চেয়ে গল্প বেশি হয়।
আর গল্পের চেয়ে বেশি হয় চোখের ভাষা।
অরণি ধীরে বলে,
— “তুই কি ভাবিস, ভালোবাসা মানে সব সময় হাত ধরা, বলা, লেখা?”
— “না। আমি ভাবি ভালোবাসা মানে পাশে থাকা, চা শেষ হয়ে গেলেও ভাঁড়টা ফেলে না দেওয়া।”
— “তুই জানিস, আমি তোকে নিয়ে লিখি এখন।”
— “আমি তোর কবিতা হয়ে গেছি?”
— “হয়ত। বা একটা আলগা ভাবনা, যা বারবার এসে পড়ে আমার ব্ল্যাঙ্ক পেজে।”
অয়ন মাথা নিচু করে বলে,
— “তুই কি অন্য কারো সঙ্গে থাকবি একদিন?”
অরণি থেমে যায়।
তারপর বলে,
— “সম্ভব। জীবন তো সহজ নয়। সম্পর্কও নয়। কিন্তু তোকে যে জায়গায় রেখেছি, সেইখানে কেউ বসবে না। তুই শুধু গল্প হয়ে থাকবি—আমার নিজের লেখা গল্প।”
চায়ের দোকানের আলো নিভে আসে ধীরে ধীরে।
দোকানদার চুল্লির আগুন নিভিয়ে দেয়।
বাইরে হালকা ঠাণ্ডা বাতাস।
তারা উঠে দাঁড়ায়।
একসঙ্গে হাঁটে।
আজ কোনও হাত ধরা নেই, কোনও কথা নেই—তবুও মনে হয়, এই নীরব হাঁটাটাই পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ স্পর্শ।
রাস্তার মোড়ে এসে অরণি থামে।
বলল,
— “আজ একটা কাগজ রাখলাম ভাঁড়ের পাশে। তুই না থাকলে, যদি কেউ পড়ে, বুঝবে—এখানে একদিন দুইজন চা খেত, যারা কেউ কাউকে দাবি করেনি, তবুও ভুলেওনি।”
অয়ন চেয়ে থাকে।
সে কিছু বলে না।
শুধু চোখে একটা আভাস—যেটা বলে দেয়, ভালোবাসা লিখে রাখা যায় না, তবুও কিছু কিছু জিনিস রয়ে যায়… ঠিক এই ভাঁড়টার মতো।
তারা আলাদা হয়।
কিন্তু সেই ভাঁড়টা চায়ের দোকানে থাকে।
আর তার পাশে পড়ে থাকে কাগজটা—
“তুমি যদি এসে বসো, জানবে না আমি কে।
কিন্তু যদি চা খাও এই ভাঁড় থেকে, বুঝবে—কেউ একজন একদিন ভালোবেসেছিল।
নাম নেই, ঠিকানা নেই।
শুধু ছিল একটা বেঞ্চ, আর একটা চায়ের দোকান।”
পর্ব ১০: শেষ চুমুকটায় আমরা যা রেখে যাই
কয়েক মাস কেটে গেছে।
শহরের রঙ বদলায়নি। শুধু অরণি আর নিয়ম করে আসে না।
সে কোথায়, ঠিক জানা নেই অয়নের। তারা কথা বলে না এখন প্রতিদিন।
তবে এমন এক বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে—যা বলে দেয়, সব যোগাযোগ কথায় হয় না।
তবু, অয়ন মাঝেমাঝে সেই চায়ের দোকানে যায়।
দোকানটা এখনো আগের মতোই। টিনের চাল, সেই চুল্লি, আর দুটি বেঞ্চ।
চা-ওয়ালার চোখে একটু বেশি ঝাপসা চশমা।
তবে মনে একরকম উষ্ণতা—যা শুধু নিয়মিত অপেক্ষার মানুষেরাই বহন করে।
সেদিন সন্ধ্যায় অয়ন হঠাৎ একা গিয়েছিল।
অনেক দিন পর।
কোনও মেসেজ যায়নি, কোনও প্ল্যান ছিল না।
সে গিয়ে বসতেই, চা-ওয়ালা হেসে বলল,
— “আজও একা?”
— “না, কেউ আসবে না। তবু চা খেতে মন চাইল।”
— “ভাঁড়ে, আগের মতোই?”
— “হ্যাঁ। আদা আর একটু বেশি দিয়ো।”
চা এল।
ভাঁড়টা হাতে নিয়ে অয়ন কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।
এখন আর ফাটলটা স্পষ্ট নয়, তবু ও জানে কোন দিকটায় হালকা চিড়।
ওই ফাটলটা হয়ত সম্পর্কেরও চিহ্ন—যা থেকে যায়, তবু গন্ধ ধরে রাখে।
চায়ে চুমুক দিয়ে হঠাৎ ওর মনে হলো—
ভাঁড়ের মধ্যে শুধু চা থাকে না, থাকে সেইসব মুহূর্ত, যা তারা একে অপরকে বলেওনি।
যেমন অরণি কখনো বলেনি—
ওর পায়ের বাঁ-দিকের কড়ার কাছে একটা ছোট তিল আছে, আর ও সেটা লুকিয়ে রাখতে চায়।
অথচ অয়ন একদিন দেখেছিল। কিছু বলেনি।
সেই না-বলার মধ্যেও ভালোবাসা ছিল।
যেমন অয়ন কখনো বলেনি—
সে একা থাকতে ভয় পায়। চায়ের দোকানে বসে যতই সে আত্মবিশ্বাসী দেখাক, ও আসলে ভীষণ ভাঙা একটা মানুষ।
অরণি সেটা জানত। কিছু বলেনি।
তবে একদিন ওর পাশে চুপচাপ বসে থেকেছিল—চায়ের ফাঁকে চোখে চোখ রেখেছিল দীর্ঘক্ষণ।
এই না-বলা, না-ছোঁয়া মুহূর্তগুলোই ছিল ওদের সম্পর্কের ভিত্তি।
একটা ভাঁড় শেষ হয়ে এল।
অয়ন চোখ বন্ধ করে ফেলে মাথাটা হালকা নিচু করে বসে থাকে।
তখনই এক জোড়া পায়ের শব্দ।
চেনা স্যান্ডেলের আওয়াজ।
সে চোখ খুলে দেখে—
অরণি।
একটুও পাল্টায়নি। শুধু চুলটা একটু কাটা, একটা নীল টোট ব্যাগ কাঁধে।
আর মুখে সেই চিরচেনা আলতো ক্লান্তি—যেটা অভিমান নয়, কিন্তু অভ্যেস।
— “তুই?”
— “তুই আসবি বলেই এসেছিলাম।”
— “আমি তো কাউকে বলিনি…”
— “তুই তো এই দোকানেই লিখে রাখিস সব কথা। আমি চুপ করে পড়ি।”
অয়ন কিছু বলে না।
অরণি বসে পড়ে।
চা-ওয়ালা তাদের দেখে হাসে।
— “আজ তো পুরো হয়ে গেল আবার! আমি বুঝেছিলাম, আজ সন্ধে ভালো যাবে।”
দুজনেই হেসে ফেলে।
চা আসে।
এবার অরণি বলে,
— “তুই জানিস? আমি খুব চেষ্টা করেছিলাম তোকে ভুলে যেতে।
নতুন শহর, নতুন ছাদ, নতুন চায়ের কাপ।
কিন্তু কোনও কিছুতেই সেই ভাঁড়ের মতো গন্ধ পাইনি।”
— “তুই জানিস, আমি খুব চেষ্টা করেছিলাম তোকে মনে না রাখতে।
ডায়েরি বন্ধ করেছিলাম।
কিন্তু চা খেতে গেলেই তোর গলা শুনতাম।”
তারা একসঙ্গে চায়ে চুমুক দেয়।
এইবার আর কোনও কথা নেই।
একটা সম্পর্ক, যা কিছুকাল থেমে গিয়েছিল, আবার নিঃশব্দে বেঁচে ওঠে।
না, তারা প্রেমে নেই এখন।
তারা কিছু দাবি করে না।
তারা কেবল জানে—
কোনও কোনও মানুষ হারিয়ে যায় না।
শুধু আমাদের ভিতরের চায়ের দোকানে বসে থাকে।
যেখান থেকে প্রতিদিন এক ফোঁটা করে ভালোলাগা চুইয়ে পড়ে।
অরণি শেষ চুমুকে ঠোঁট রাখে।
তাকায় অয়নের দিকে।
— “আমরা কি আবার শুরু করছি?”
অয়ন একটু হেসে বলে,
— “না, আমরা শেষ হচ্ছি না। সেটাই যথেষ্ট।”
চায়ের দোকান ধীরে ধীরে গুটিয়ে যায়।
চুল্লির আগুন নিভে আসে।
শহরের বাতাসে গন্ধ থাকে শুধু—
ভাঁড়ের, চায়ের, আর কিছু চুপ থাকা কথার।
তারা উঠে পড়ে।
হাঁটে পাশাপাশি, কিন্তু কোনও গন্তব্যে নয়।
হয়তো তারা আজ আর কোনওদিন প্রেমিক-প্রেমিকা হবে না।
হয়তো কারও জীবনে অন্য কেউ থাকবে।
হয়তো কারও ঘর হবে, পরিবার হবে।
তবু তারা জানবে—
“একদিন, এক কাপ চায়ের পাশে, তারা একে অপরকে চুপ করে ভালোবেসেছিল।
আর শেষ চুমুকটায় তারা যা রেখে গেছে—সেটাই তাদের সবচেয়ে সত্য অনুভব।”
সমাপ্ত