নীলাদ্রি দে
এক
হাসপাতালের বহির্বিভাগের করিডোরে হাঁটছিলেন ড. অর্ণব মুখার্জী, সবে মাত্র দুপুর গড়িয়েছে। এক হাতে কফির কাপ, অন্য হাতে মেডিকেল ফাইল। এই হাসপাতালেই তিনি রেডিওলজি বিভাগের প্রধান, গত আট বছর ধরে। সবকিছুই যেন রুটিনের মতো চলছিল, যতক্ষণ না রিসেপশন থেকে ফোন আসে—“ডাক্তারবাবু, একজন নতুন রোগী এসেছেন, বুকের ব্যথা নিয়ে, কিন্তু একটু অদ্ভুত আচরণ করছেন।” ড. অর্ণব চোখ কুঁচকে রুমে ঢুকলেন। রোগীর নাম রোহিত সেন, বয়স আনুমানিক সাতাশ-আটাশ, স্মার্ট পোশাক, চুপচাপ চোখ। প্রথমে দেখে মনে হয় না খুব গুরুতর কিছু, তবে রোহিতের চোখদুটো যেন ঘুমহীন আতঙ্কে ধকধক করছিল। প্রশ্নের জবাব দিল সংক্ষেপে—“বুকটা মাঝে মাঝে এমন টান মারে, যেন কেউ ভিতর থেকে ধাক্কা দিচ্ছে… কখনো কখনো মনে হয় আমার ভেতরে কেউ আছে…” এই কথাগুলো শুনে অর্ণব হালকা হাসলেন। তিনি হাজার রোগীর অদ্ভুত ভাষ্য শুনেছেন, কিন্তু শরীরের ভেতরে “কেউ আছে”—এটা প্রথম। প্রাথমিক পরীক্ষায় হার্ট রেট স্বাভাবিক, প্রেসার সামান্য বেশি। তিনি রুটিন এক্স-রে দিলেন, সঙ্গে বুকের CT স্ক্যানের নির্দেশ, ভাবলেন মানসিক চাপে কিছু ইন্দ্রিয় বিভ্রম—এমনটা অনেক সময় হয়।
ঘণ্টাখানেক পর রেডিওলজি ঘরে অর্ণব নিজের ডেস্কে বসে রিপোর্ট আনতে বললেন। যন্ত্রে রিপোর্ট আপলোড হতেই তার চোখ স্থির হয়ে গেল। কালো-সাদা X-ray ছবিতে বুকের মাঝখানে হাড়গোড়ের ছায়া ছাপিয়ে যেন আরেকটা আকৃতি ফুটে উঠছে—একটা বিকৃত মুখ, মুখ ফাঁসিয়ে চিৎকার করছে! প্রথমে চোখের ভুল ভেবে অর্ণব মনিটর ঘষলেন, ফাইল ক্লোজ করে আবার খুললেন। না, একই ছবি। তিনি টেকনিশিয়ান অনন্ত বসুকে ডাকলেন, “এই রিপোর্টে কিছু দেখছ?” অনন্ত চুপ করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর নিচু গলায় বলল, “স্যার… ওই মুখটা কী? এটা তো… এটা তো… আপনারা কি কোনও এডিটেড ছবি খুলেছেন?” অর্ণব বললেন, “না, এই মুহূর্তে রোহিতের বুকের এক্স-রে স্ক্যান এইমাত্র আপলোড হয়েছে। কোনো ভুল থাকার প্রশ্নই আসে না।” মনিটরের শব্দ আচমকা একটু ভলিউম বাড়িয়ে ওঠে—মৃদু ফিসফিসানির মতো কিছু যেন ভেসে আসে। অনন্ত চমকে ওঠে, কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “স্যার, কেউ কি বলছে… ‘আমায় বের করো?’” অর্ণব রিমোট হাতে নিয়ে ভলিউম বন্ধ করেন, তবে কাঁধের পেছনে শিরদাঁড়ার নিচ দিয়ে ঠাণ্ডা একটা হাওয়া যেন বয়ে যায়। তিনি মনে মনে ভাবেন—এটা হয়ত যন্ত্রের কোনো গ্লিচ, হয়ত কম্পিউটার ভাইরাস। রোহিতকে আবার স্ক্যান করতে হবে। তবে নিজের অজান্তেই অর্ণব বুঝতে পারেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের কাঠামো দিয়ে এই অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করা সহজ হবে না।
সন্ধ্যাবেলা রোহিতকে যখন ডাক পড়ল দ্বিতীয় স্ক্যানের জন্য, তখন সে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। তার চোখে ঘুমহীনতা আর অসহ্য এক চাপা আতঙ্ক। সে আস্তে বলল, “ডাক্তারবাবু, আমি শুনতে পাই… কেউ যেন আমাকে ভিতর থেকে ডাকে। বলে ‘আমায় ছাড়িয়ে দাও।’ আমি আয়নায় নিজেকে দেখলেও ভয় পাই। মাঝে মাঝে আমার মুখটা আমার নিজের মতো মনে হয় না।” অর্ণব মুখে কিছু না বললেও, তার মন দপদপ করে উঠল। স্ক্যান শুরু হতেই রুমের তাপমাত্রা যেন হঠাৎ কমে গেল। পর্দার পেছনে বসে থাকা অনন্ত স্ক্যান মেশিনের আওয়াজের মাঝে আবার সেই ফিসফিসানিটা শুনল—এবার আরও স্পষ্ট: “আমায় বের করো…” অর্ণব শিউরে উঠলেন, যদিও নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করলেন। স্ক্যান শেষ হওয়ার পর রোহিত হঠাৎ বলে উঠল, “আপনারা যদি আমাকে থামাতে না পারেন, সে অন্য কাউকে খুঁজবে…” অর্ণব হতচকিত হয়ে তাকালেন। কে ‘সে’? কাকে খুঁজবে? স্ক্যান রিপোর্টে এবার আগের তুলনায় আরও স্পষ্টভাবে সেই মুখ ফুটে উঠেছে—নাকহীন, চোখ গলে যাওয়া, আর মুখ ফাঁসিয়ে যেন চিৎকার করছে, কিন্তু শব্দহীনভাবে। মেডিকেলের ভাষায় এর কোনও ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু বাস্তবটা এখন চোখের সামনে। অর্ণব টের পান—এই রোগী কেবল বুকের ব্যথা নিয়ে আসেনি। সে নিয়ে এসেছে একটা অদৃশ্য, অবর্ণনীয় ভয়, যা হয়তো কেবল যন্ত্রেই ধরা পড়ে। এই হাসপাতাল, এই যন্ত্র, এই রিপোর্ট… এখন থেকে সবই আর আগের মতো থাকবে না।
দুই
রাত তখন প্রায় ১০টা ছুঁইছুঁই। হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগ প্রায় ফাঁকা। গার্ডরা চায়ের কাপ হাতে হাই তুলছে, পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা ধীরে ধীরে করিডোরে মুছতে ব্যস্ত। এই সময়েই ড. অর্ণব মুখার্জী নিজের ডেস্কে বসে দ্বিতীয়বার রোহিত সেনের রিপোর্ট খুঁটিয়ে দেখছিলেন। প্রথম এক্স-রে’র সেই মুখচ্ছবি এখনো তার চোখের সামনে ঘুরছে—একটা মানুষের মতো কিছু, কিন্তু বিকৃত। তবুও চিকিৎসক হিসেবে যুক্তির বাইরে যাওয়া তার পেশাদারীত্বে আঘাত করে। তবুও একটা চাপা ভয় তাকে ঘিরে ধরেছিল, যার জন্যই রাত ১০টাতেও তিনি বসে ছিলেন হাসপাতালে। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ে। দরজা খুলে দেখা যায় অনন্ত বসু, টেকনিশিয়ান, মুখে স্পষ্ট অস্বস্তির ছাপ। “স্যার, আজকের স্ক্যানটা আবার চালাবো? রোহিতকে নিয়ে এসেছি। ওর বুকে ওই… ওই অদ্ভুত আকৃতি আবার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এবার… স্ক্যান চলাকালীন আমি একটা আওয়াজ শুনেছি, মানুষের গলার মতো নয়।” ড. অর্ণব চমকে উঠলেন। “কী শুনেছ?” অনন্ত গলা নিচু করে বলে, “একটা ফিসফিসানি… স্পষ্ট শব্দ… যেন কেউ বারবার বলছে, ‘আমায় বের করো… আমায় বের করো…’ আমি এত ভয় পেয়েছি যে মনে হচ্ছিল যন্ত্রটাই কথা বলছে।” অর্ণব উঠে দাঁড়ালেন। “চলো, নিজের চোখে দেখে নিই।”
রেডিওলজি কক্ষে আলো ক্ষীণ, মনিটরের আলোয় ছায়া লাফিয়ে বেড়ায়। রোহিত সেন শুয়ে আছে স্ক্যান টেবিলে, চোখ বন্ধ, ঠোঁট কাপছে। স্ক্যান চালু হতেই যন্ত্রের ভিতর থেকে এক অদ্ভুত কাঁপুনি শুরু হয়। প্রথমে শব্দ ছিল যন্ত্রের চলার মতোই, কিন্তু ধীরে ধীরে সে আওয়াজের মাঝে এক অপার্থিব কণ্ঠ মিশে যায়—একজন মহিলা গলা, অথবা অনেকগুলো গলার মিশ্র প্রতিধ্বনি—“আমায় বের করো… আমি এখানে আটকে আছি…” অনন্তর হাত থেকে রিমোট পড়ে যায়, সে পেছনে হটতে থাকে, চোখ কোটরে ঢুকে যাচ্ছে যেন। অর্ণব দাঁড়িয়ে থাকলেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, আর বুকের মধ্যে অজানা স্নায়বিক গুঁতো। স্ক্যান শেষ হওয়ার পর রোহিত ধীরে চোখ মেলে বলে ওঠে, “এই ঘরটা… এই ঘরটা আমি আগে দেখেছি… আমি এখানে মারা গিয়েছিলাম…” ড. অর্ণব আর অনন্ত দু’জনেই পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল। এটা কী মানসিক রোগীর বকবকানি? নাকি স্মৃতি? পূর্বজন্ম? নাকি সত্যিই তার শরীরে অন্য কেউ বাস করছে? স্ক্যান রিপোর্ট মনিটরে ফুটে উঠল—আরো ভয়ংকর চিত্র। আগের মুখটার পাশাপাশি এবার দেখা যাচ্ছে আরও এক ছায়ামূর্তি, যেটি যেন মুখ ঘুরিয়ে রোহিতের বুকের ভেতর ঢুকে পড়ছে।
রাত তখন গভীর, হাসপাতালের চারদিক স্তব্ধ। অনন্ত বলল, “স্যার, আমাদের এ রিপোর্ট রিমুভ করতে হবে… কেউ জানলে—” অর্ণব থামিয়ে দিলেন। “এ রিপোর্ট থাকবে। তুমি যা শুনেছো, তার রেকর্ড আছে?” অনন্ত মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, মেশিনের অডিও ট্র্যাকে আছে।” অর্ণব সেটা কম্পিউটারে কপি করে হেডফোনে শুনতে গেলেন। চোখ বন্ধ করে শুনলেন এক দীর্ঘ, মৃদু ফিসফিস—যেন কয়েকটি কণ্ঠ একসাথে আকুতি করছে, “আমায় বের করো… আমি খুব কষ্টে আছি…” হঠাৎ হেডফোনের মধ্যে উচ্চতর ফ্রিকোয়েন্সির এক চিৎকার—ধরাশায়ী করার মতো। তিনি কেঁপে উঠলেন, চেয়ার থেকে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে রুমের আলো নিভে গেল। কয়েক সেকেন্ড অন্ধকার। কম্পিউটারের মনিটরে ঝাঁপসা ছায়া, একটা চোরা হাসির মতো পটভূমিতে ছড়িয়ে পড়ছে। ফের আলো জ্বলতেই অর্ণব দেখলেন—রোহিত টেবিল থেকে উঠে গেছে। সে এখন দাঁড়িয়ে আছে রেডিওলজি ঘরের কোণায়, অন্ধকারে, এবং চোখ দুটি… পুরো কালো। ঠোঁটে একটি মৃদু হাসি। সে বলল, “ডাক্তারবাবু, আমি এখন আপনার ভিতরেও আছি। শুধু রিপোর্টে না। অপেক্ষা করুন… আমি বেরিয়ে আসছি।”
তিন
সকালের আলো হাসপাতালের জানালায় আছড়ে পড়ছিল, কিন্তু ড. নিহারিকা ধরের কেবিনের ভিতরটা ছিল অবিশ্বাস আর অস্বস্তিতে ঘেরা। তিনি বেশ কিছু বছর ধরে মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করছেন, কিন্তু আজকের রোগী রোহিত সেন তাকে বিভ্রান্ত করে দিয়েছে। তার মুখে আতঙ্ক, কিন্তু চোখে যেন অন্য এক অস্তিত্বের ছাপ। “আমি জানি এটা সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার,” নিজেকে বোঝাচ্ছিলেন নিহারিকা, “হয়তো প্যারানয়েড স্কিজোফ্রেনিয়া। তবে… তবে ওর চোখ?” রোহিত তার সামনে বসে, শান্ত গলায় বলল, “ডাক্তার, আমার শরীরটা আমার মতো লাগছে না। মাঝেমাঝে মনে হয়, আমি কে সেটা আমি ভুলে যাচ্ছি। আর রাতে যখন ঘুমোই… আমি যেন কারও স্বপ্ন দেখি, যে আমি নই। একটা গলা, একটা ছায়া আমার ভিতর দিয়ে হাঁটে… আর আমি তাকিয়ে দেখি।” ড. নিহারিকা তার রেকর্ডিং অন করে প্রশ্ন করলেন, “আপনি কী সেই স্বপ্নে নিজের শরীর দেখেন?” রোহিত চোখ বন্ধ করল, চাপা গলায় বলল, “না… আমি দেখি, আমার শরীরটা কেউ চালাচ্ছে, আর আমি কোথাও জানালার ওপারে আটকে আছি… জানালাটা কাচের, আমি বেরোতে পারি না… আমি কেবল চিৎকার করতে পারি—কিন্তু আওয়াজ হয় না।”
এই কথাগুলো শুনে ড. নিহারিকা কিছু লিখতে গেলেন, কিন্তু কলম থেমে গেল মাঝপথে। স্বপ্ন, দেহান্তর, নিজের ভিতরে অন্য কেউ থাকার অনুভব—এসব অনেক সময় সাইকোসিসের লক্ষণ হতে পারে, কিন্তু রোহিতের চোখের ভিতরে যে নিরেট শূন্যতা, সেটা একমাত্র মানসিক রোগে সম্ভব নয়। ড. অর্ণব তাকে আগেই সাবধান করেছিলেন—“তুমি যতটা ভাবছো, ব্যাপারটা ততটাই সাধারণ নয়। স্ক্যানে দেখা যাচ্ছে যা সাধারণত কল্পনার বাইরে।” নিহারিকা সেই স্ক্যান রিপোর্টগুলো ভালোভাবে পরীক্ষা করলেন। টিস্যু ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের স্বাভাবিক গঠন ছাড়াও দেখা যাচ্ছে এক রহস্যময় রেখা—যেটা কার্বন ছায়ার মতো বুকে জমে রয়েছে। আর সবচেয়ে ভয়ংকর, সেই ছায়ার আকৃতি ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে প্রতিটি স্ক্যানে। এমনটা হওয়ার কথা নয়। এক্স-রে যন্ত্রের ভুল? টেকনিক্যাল গ্লিচ? কিন্তু সব রিপোর্টে একটাই ছায়া, যা সময়ের সঙ্গে প্রাণ পেয়ে উঠছে? তার মানে… এটা কোনো বাইরের কারচুপি নয়, বরং… হয়তো রোহিতের ভেতরে সত্যিই ‘কেউ’ আছে। কিংবা, সে এমন কিছু নিয়ে এসেছে, যা অন্য মানুষদের ভেতরেও ঢুকে পড়তে চায়।
সেদিন রাতেই, হাসপাতালের নীচে পার্কিং গ্যারেজের পাশে রোহিত একা দাঁড়িয়ে ছিল। গার্ড সন্দেহ করে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এই সময় এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?” রোহিত ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। চোখে অদ্ভুত স্থিরতা। সে বলল, “আমার শরীরটা আজ একটু শান্ত। কারণ সে ঘুমোচ্ছে।” গার্ড কিছুই বুঝল না, শুধু হাসিমুখে বলল, “ঠিক আছে বাবু, বাইরে থাকবেন না।” গার্ড চলে যাওয়ার পর সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেল—রোহিত ধীরে ধীরে পেছনের দেয়ালে হাত রাখল, আর তার হাতের ছায়া দেওয়ালে আলাদা হয়ে গিয়ে নিচে পড়ে রইল—হয়তো সেটি ছায়া নয়, আরেকটি অস্তিত্বের ছাপ। সেই রাতেই ড. নিহারিকা তার ফ্ল্যাটে ফিরে ঘুমোতে গেলেন, এবং প্রথমবার দেখলেন সেই স্বপ্ন—একটা কাচের ঘরে আটকে থাকা ছেলেটি, জানালার ওপারে তাকিয়ে আছে, চোখে জ্বালা আর হতাশা। সে নিঃশব্দে বলছে, “আমাকে বের করো… সে আমার শরীরটা নিয়ে নিয়েছে…” ঘুম ভেঙে গায়ের ঘামে ভিজে যান তিনি। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখেন, কিছুই নেই। তবে আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবিতে অল্প সময়ের জন্য ভেসে ওঠে সেই বিকৃত মুখ—এক মুহূর্ত, তারপর মিলিয়ে যায়। কিন্তু এতেই তিনি বুঝতে পারেন, রোহিত একা নয়। এবং সে যা বহন করছে, তা কেবল একটি রোগ নয়। এটা এক অস্তিত্ব—যে জাগতে চাইছে, শরীর চাইছে, মুখ চাইছে, এবং এক্স-রে রিপোর্ট কেবল তার ছায়া মাত্র।
চার
বৃষ্টি নামছিল ঝিরঝিরে, হাসপাতালের ছাদের টিনে শব্দ করে টপটপ করে পড়ছিল জল। বাইরে রাত, ভিজে করিডোরের এক কোণায় কুয়াশার মতো অন্ধকার জমে ছিল। ঠিক সেই সময়, রেডিওলজি বিভাগের বাইরে কাঠের পুরনো বেঞ্চিতে বসে ছিল একজন বয়স্কা নারী—জাহানারা খাতুন। মাথায় পুরনো ওড়না, চোখদুটো ধূসর হয়ে গেছে বয়সের ভারে, কিন্তু তবুও তার দৃষ্টিতে ছিল কিছু একটা… এমন কিছু, যা তিনি অনেক আগেই দেখে ফেলেছেন। জাহানারা এই হাসপাতালের সবচেয়ে পুরনো পরিচারিকা, প্রায় ৩৫ বছর ধরে কাজ করছেন। এখন আর ক্লিনিং-এর কাজ করেন না, শুধু মাঝে মাঝে এসে বসেন, কিছু কথা বলেন, যেগুলো সবাই “পাগলের প্রলাপ” ভেবে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু আজ ড. অর্ণব নিজে এসে বসলেন তার পাশে, হাতে রোহিতের এক্স-রে রিপোর্টের কপি। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর তিনি বললেন, “তুমি কি এইরকম কিছু আগেও দেখেছ?” জাহানারা চোখ সরালেন না, কেবল বললেন, “হ্যাঁ, একবার… বহু বছর আগে… আর তারপর থেকেই আমি আর ঘুমোতে পারি না।” অর্ণব চমকে উঠলেন। “কী ঘটেছিল?” জাহানারা তখন ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন—এক অন্ধকার গল্প, যা হাসপাতালের অজানা ইতিহাসে চাপা পড়ে ছিল।
“বছর কুড়ি আগে,” জাহানারা বলতে শুরু করলেন, “এই হাসপাতালের এক্স-রে ঘরে একদিন রাতে একটা ছেলে এসেছিল বুকের ব্যথা নিয়ে। তার নাম কেউ মনে রাখেনি। সে নিঃসঙ্গ, পরিচয়বিহীন, বলে বেড়াত—‘আমার ভিতর কেউ থাকেন।’ ডাক্তাররা হেসেছিল। কিন্তু যখন তার এক্স-রে রিপোর্ট বেরোয়, তখন… তখন ভয় পেয়ে গিয়েছিল সবাই। আমি সেদিন ওর ঘরটা পরিষ্কার করতে গিয়েছিলাম। দেখি, দেয়ালে একটা ছবি আঁকা… ছায়ার মতো, যেন একজনে আরেকজনের গলা চেপে ধরেছে। ভয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। পরদিন সকালে হাসপাতাল কাঁপছিল এক খবরে—ছেলেটি রাতে নিখোঁজ। কক্ষ তালাবদ্ধ, কিন্তু তার ভেতরে কেউ নেই। তবে এক্স-রে রিপোর্ট তখনও ছাপা হয়ে ছিল—ছবিটা ঠিক যেমন আজ তোমার হাতে রয়েছে। ওই দিন থেকেই ঘরটা বন্ধ করে দেওয়া হয়, আর রিপোর্টটা… কোথায় যেন মিলিয়ে যায়।” অর্ণব হতবাক। “তাহলে সেই ‘সে’ কি আবার ফিরে এসেছে?” জাহানারা মাথা নেড়ে বলেন, “সে কোনোদিন যায়নি, শুধু শরীর পায়নি… এখন রোহিত এসেছে। কিন্তু রোহিতের ভিতরে কে আছে, সেটাই প্রশ্ন।”
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ড. অর্ণব ও ড. নিহারিকা দুজনেই বুঝলেন—এটা কেবল এক রোগীর মানসিক সমস্যা নয়। এই হাসপাতালের কোথাও এক ছায়া ঘোরে, যেটা এক সময় ছিল, এবং এখন ফিরে এসেছে। জাহানারার কথায় এক সময়ের সত্য উন্মোচিত হতে থাকে—এক মৃত আত্মা, যাকে কখনো কবর দেওয়া হয়নি, যার দেহ পাওয়া যায়নি, কিন্তু যার অস্তিত্ব থেকে গিয়েছে যন্ত্রের ভিতর, ফিল্মে, কার্বনের ছাপে। রোহিত হয়তো সেই দেহ—বা সেই দেহের আশ্রয়। ড. নিহারিকা জিজ্ঞেস করলেন, “তাহলে কী করা যায়?” জাহানারা উত্তর দিলেন, “তাকে বের করতে হবে… কিন্তু তার আগে জানতে হবে, সে কে ছিল। নাম জানলে তাকে নাম ধরে ডাকা যাবে… আর তাহলেই হয়তো তার বৃত্ত ভাঙবে। কিন্তু সাবধান, ও একা নয়, ওর মতো আরও আছে… হয়তো তোমাদের ভেতরেও।” অর্ণব শিউরে উঠলেন। সেই রাতেই হাসপাতালের পুরনো রেকর্ড ঘেঁটে তাঁরা খুঁজতে শুরু করলেন সেই নামহীন ছেলেটির তথ্য। কিন্তু ফাইলের পাতা শূন্য—যেন কেউ সব তথ্য গিলে ফেলেছে। তখনই করিডোরে বাতি দপদপ করে উঠল। বাতাসে একটা গন্ধ—পোড়া মাংস, ভেজা কাচ আর পুরনো রিপোর্টের। দেয়ালের এক কোণে এক ছায়া নড়ে উঠল—চোখ নেই, মুখ নেই, কিন্তু ফিসফিসানি আবার ভেসে আসছে—“আমায় মনে রেখেছো? এবার আমি ডাক্তার…”
পাঁচ
রাত তখন ১টা ২০, চারদিক নিস্তব্ধ। হাসপাতালের নিচের তলায় ছোট একটি কনফারেন্স রুমে ড. অর্ণব, ড. নিহারিকা ও অনন্ত বসু মোমবাতির আলোয় বসে ছিল। বিদ্যুৎ হঠাৎ করে চলে গিয়েছে, জেনারেটর কাজ করছে না—যেন ইচ্ছাকৃত। কম্পিউটার বন্ধ, ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন। চারদিক নিঃশব্দ অথচ বোঝা যাচ্ছে কোথাও যেন কারও হাঁটার ধ্বনি হচ্ছে… ছায়ার ফাঁকে ফাঁকে। আলো আসার অপেক্ষায় নয়নমণির মতো তাকিয়ে ছিল তাদের সামনে রাখা পুরনো কাগজের ফাইলগুলোর দিকে। অবশেষে অনন্ত একটা জীর্ণ রিপোর্ট ফাইলে আঙুল রাখল—”স্যার, এই নামটা দেখুন… ‘Subject No. 11’… কোনো রোগীর নাম নেই, বয়স নেই, কেবল এক্স-রে কোড এবং যন্ত্রের সিরিয়াল নম্বর।” অর্ণব ফাইলটা তুলে নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন, যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছেন না। যন্ত্রটির কোড মিলিয়ে দেখা গেল—সেটিই বর্তমান রেডিওলজি রুমের পুরনো এক্স-রে যন্ত্র, যেটা ১৫ বছর আগে নতুনের বদলে ‘কম দামে’ কেনা হয়েছিল এক প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে। কিন্তু কেন সেই যন্ত্র এত কম দামে বিক্রি হয়েছিল? কেন তার আগের মালিক, এক বিখ্যাত রেডিওলজিস্ট, হঠাৎ করে আত্মহত্যা করেছিলেন? প্রশ্নগুলোর উত্তর তখনও কুয়াশার মতো ছড়ানো।
সেই রাতে অর্ণব সিদ্ধান্ত নিলেন—তাঁকে যন্ত্রটি খুলে দেখতে হবে, যেভাবেই হোক। তিনি অনন্তকে নিয়ে রেডিওলজি কক্ষে ঢুকলেন, ড্রিল মেশিন নিয়ে যন্ত্রের পিছনের ক্যাবিনেট খুলতে শুরু করলেন। পুরনো ধুলোমাখা তার, জং ধরা লোহার ফ্রেম খুলতেই একটা অদ্ভুত গন্ধ নাকে এল—কিছু পোড়া, কিছু পচা, কিছু অজানা। ভিতরে একটা ছোট্ট বাক্স পাওয়া গেল, যার গায়ে লেখা ছিল ‘EX-11’—বক্স খুলতেই তাদের চোখ স্থির হয়ে গেল। ভিতরে একটা পুরনো X-ray ফিল্ম, যা ছিল এক অজানা দেহের, কিন্তু সেই দেহের বুকের মধ্যে স্পষ্ট এক মুখ—ফাঁসানো চোয়াল, চোখের গর্ত, যেন ছবি নয়, বাস্তব। আর তার নিচে হস্তাক্ষরে লেখা:
“He is still inside. Don’t let him out.”
তারপরই হঠাৎ বাতি জ্বলে উঠল। যন্ত্রের স্ক্রিন নিজে থেকেই অন হয়ে গেল, স্ক্যানারের আলো নিজে নিজেই ঘুরতে লাগল। স্ক্রিনে দেখা যেতে লাগল এক ছায়ামূর্তি, রোহিতের মতো কিন্তু আরও বিবর্তিত, তার চোখ দুটো জ্বলছে আগুনে, মুখ ফাঁসিয়ে বলছে—“তোমরা খুঁজে পেয়েছো… এবার পালাতে পারবে না।” অনন্ত আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে, পিছিয়ে যায়, হঠাৎ করে তার শরীর জমে যায়। অর্ণব তাকিয়ে দেখেন—অনন্ত দাঁড়িয়ে আছে যন্ত্রের সামনে, চোখ দুটি কাঁচের মতো ফাঁকা, ঠোঁটে হাসি, আর তার গলা থেকে একেবারে রোবটিক গলায় একটা লাইন বারবার উচ্চারিত হচ্ছে—“আমায় বের করো… আমি এখানে আর থাকতে পারছি না…”
পরদিন সকালে অনন্তকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সিসিটিভিতে দেখা যায় সে রাত ৩টা ৪৫ মিনিটে রেডিওলজি কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়, কিন্তু তারপর কোথাও তার অস্তিত্ব নেই। হাসপাতালের করিডোর, গেট, পার্কিং—সব ভিডিও ব্ল্যাঙ্ক। শুধু একটা মাত্র ফুটেজে ধরা পড়ে—এক ছায়ামূর্তি, যেটা মেঝের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে, আর অনন্ত তাকে অনুসরণ করছে কাঁচের চোখে, স্থির পায়ে। সেই ঘটনা ড. অর্ণব আর ড. নিহারিকার মাঝে গভীর ভয়ের দানা বাঁধিয়ে দেয়। এতদিন তারা ভেবেছিলেন এটা কোনো অসুখ, কোনো মানসিক বিভ্রম, কোনো অতীতের কুৎসিত গোপন ইতিহাস। এখন তারা বুঝলেন—এই যন্ত্রটা একটা জানালা… এমন এক জগতে পৌঁছানোর দরজা, যেখান থেকে কেউ একজন ফিরে আসতে চাইছে। সে এক ভয়ানক অস্তিত্ব, কার্বনের মতো এক ছায়া, যেটা শুধুমাত্র যন্ত্রের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে। রোহিত সম্ভবত সেই জানালার প্রথম শিকার নয়, বরং সেই ছায়ার বাহক। কিন্তু এখন প্রশ্ন—সে কে? কেন সে আটকে ছিল? এবং… কে হবে পরবর্তী?
ছয়
রোহিত সেনের দ্বিতীয় স্ক্যানের রিপোর্ট যখন মনিটরে ফুটে উঠল, তখন রেডিওলজি কক্ষের ভিতরটা যেন মুহূর্তেই আরও ঠান্ডা হয়ে উঠল। সাদা-কালো চিত্রের মাঝখানে আগের সেই বিকৃত মুখ তো ছিলই, কিন্তু এবার তার পাশে আরেকটি ছায়ামূর্তি—একটা নারীমূর্তি, যার মুখ কুয়াশার মতো অস্পষ্ট, মাথার পাশে চুল ছড়িয়ে আছে একরকম প্রবাহের মতো, আর চোখের গহ্বর থেকে যেন কিছু বেরিয়ে আসতে চাইছে। “এটা কী?” ড. নিহারিকা বললেন ফিসফিস করে, তার গলা যেন শুকিয়ে এসেছে। ড. অর্ণব শুধু বললেন, “দ্বিতীয়টি এসেছে।” রিপোর্ট বিশ্লেষণ করতে গিয়েও কিছুই বোঝা গেল না—কোনও টিস্যু নয়, কোনও হাড় নয়, কেবল এক অন্ধকার আকৃতি যা প্রতিটি ফ্রেমে ধীরে ধীরে রোহিতের বাম ফুসফুসের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ছে। রোহিত নিজে তখন শুয়ে, চোখ বন্ধ করে অনবরত বিড়বিড় করছিল—“সে চলে আসছে… এবার ওকেও নিয়ে আসবে…” কে ‘সে’? আর ও কে? প্রশ্নগুলো ঘনিয়ে আসছিল, উত্তর কিছুই মিলছিল না।
রাত বাড়ছিল, হাসপাতালের গেট বন্ধ হয়ে গেছে, অথচ রেডিওলজি ঘরের এক্সেস দরজা খোলা। ভেতরে অর্ণব আর নিহারিকা রিপোর্ট হাতে বসে, মাথা নিচু করে ভাবছিলেন এখন কী করা যায়। ঠিক সেই সময় স্ক্রিন ঝাপসা হয়ে ওঠে। একটি ভিডিও ফাইল অটোপ্লে শুরু হয়, যা কেউ চালায়নি। ভিডিওটা শুরু হয় এক রোগীর স্ক্যান দিয়ে, মুখ ঢাকা, শরীর নিথর। এরপর হঠাৎ ভিডিওতে ভেসে ওঠে সেই দুই মুখ—একটি পুরুষ, একটি মহিলা। দুটো মুখ একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে, তারপর ধীরে ধীরে একে অপরকে গ্রাস করে নিচ্ছে—এক নিঃশব্দ কুৎসিত মিলন। এবং ঠিক সেই মুহূর্তে পুরো হাসপাতালের আলো নিভে যায়। স্ক্রিনের আলোয় দেখা যায়, দরজার ফাঁকে একটি নারী অবয়ব দাঁড়িয়ে—কুয়াশায় মোড়া, কিন্তু চোখে লাল রেখা। অনন্ত বসু, যে রাত দু’টোর পরে নিখোঁজ হয়েছিল, হঠাৎ সেই নারীর পাশে দাঁড়িয়ে বলে, “স্যার, দেরি হয়ে গেছে। এখন তারা নিজেরাই খুঁজে নিচ্ছে পথ।” দরজা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়, এবং আবার খুলতেই দেখা যায়, সেখানে কেউ নেই। কিন্তু স্ক্রিনে সেই দ্বিতীয় মুখটি এবার আরও স্পষ্ট, এবং রোহিতের ফুসফুসের মাঝখানে স্থায়ী হয়ে গেছে। সে শুধু শরীরে নয়, এখন রক্তে মিশে যাচ্ছে।
পরদিন সকালে হাসপাতাল চত্বর চুপচাপ। তবে রেডিওলজি বিভাগের এক নার্স বলেন, রাত তিনটার দিকে কেউ একজন রেডিওলজি ঘরের দেয়ালে আঙুল চালিয়ে কিছুর ছায়া আঁকছিল। যখন সে ডাকতে গেল, তখন লোকটা ঘুরে তাকাল—সে রোহিত। কিন্তু তার চোখ কোটরে ছিল না, বরং শূন্য গর্ত। আর ঠোঁটের পাশে ছিল একটা হাসি, যেটা মানুষের নয়। তারপর সে হেঁটে চলে গেল দেয়ালের ভেতর দিয়ে। সেই দেয়ালে পরদিন সকালে দেখা গেল—দুটি মুখের ছাপ, যেন কার্বনে ছাপা পড়েছে। এক্স-রে রিপোর্ট এবার আর কেবল প্রযুক্তিগত কাগজ নয়, এ যেন একটা জীবন্ত দলিল হয়ে উঠেছে, যা বলছে—দ্বিতীয় শয়তান এসেছিল, এবং হয়তো সে একা নয়। অর্ণব আর নিহারিকা বুঝে যান, এখন আর রোহিতকে বাঁচানোই প্রধান উদ্দেশ্য নয়—বাঁচাতে হবে সবাইকে… কারণ এক্স-রে যন্ত্র আর কেবল যন্ত্র নয়, এটি এক পথ, আর রোহিত হয়েছে এক পথিক—যার ভেতর দিয়ে এখন পৃথিবীর ভেতরে ঢুকছে এক অজানা ছায়াজগৎ।
সাত
হাসপাতালের বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে ঢুকে পড়ছে অদৃশ্য কিছু। ড. নিহারিকা নিজের কেবিনে বসে আছেন, চোখ লাল, ক্লান্ত ও উদ্বিগ্ন। একের পর এক রাত জেগে থাকা, ভয়াবহ রিপোর্ট, অদ্ভুত স্বপ্ন—সব মিলিয়ে তার মানসিক ভারসাম্য টলতে শুরু করেছে। কিন্তু আজকের রাতটা আলাদা। তিনি নিজের গলা ও বুকের ভিতর একরকম চাপ অনুভব করছেন, যেন কিছু ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। তিনি জানেন, এটা কেবল মানসিক সমস্যা নয়। বারবার মনে পড়ছে রোহিতের সেই কথা—“সে তোমার ভিতরেও ঢুকতে পারে, যদি তুমি তাকাও, যদি তুমি বিশ্বাস করো।” আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখের দিকে তাকালেন নিহারিকা। প্রথমে কিছু বোঝা গেল না। কিন্তু একটু পরেই তার প্রতিচ্ছবির ঠোঁট হাসল—যেটা সে নিজে হাসেনি। সে চমকে পেছনে সরে গেল। শিরদাঁড়ার নিচে ঠান্ডা এক শিরশিরে ভাব। আয়নার মাঝে থাকা সেই প্রতিচ্ছবি এবার মুখ খুলে বলে, “তুমিও আমায় ডাকছো, তাই না?”
এক্স-রে রিপোর্টের বিকৃত মুখের মতোই আজ নিহারিকার চোখে সেই ‘দ্বিতীয় ছায়া’ স্পষ্ট হয়ে উঠছে—কিন্তু এবার বাইরের নয়, নিজস্ব ভেতরের এক রূপে। রোহিত যেমন তার দেহকে বাহন করেছিল, তেমনই এখন সে নিজে একটা আধা-খোলা দরজা। দিনের আলোয় সুস্থ, যুক্তিবাদী, চিকিৎসক—রাতে অচেনা এক কণ্ঠ, এক শ্বাস, এক ছায়া তার অস্তিত্বে জমে উঠছে। তিনি একাধিকবার মনোবিদ হিসেবে নিজেকে পরীক্ষা করেছেন, নিজের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করার চেষ্টায় আত্মনিয়ন্ত্রণ চর্চা করেছেন, মেডিটেশন করেছেন—কিন্তু এসবের কোনোটা কাজে আসেনি। রাত গভীর হতেই তার ভিতরের কণ্ঠ বলে ওঠে, “আমাকে বের হতে দাও… তুমি জানো, আমি কে… তুমি তো আমিই।” সেই কণ্ঠ যেন তার স্মৃতিকে দখল করছে। সে ভাবতে শুরু করেছে, রোহিতের আগে সেই মুখ কোথাও দেখেছেন—একবার এক ছোটবেলায়… এক পুরনো চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে। হয়তো এই আত্মা, এই ছায়া তাকে বহু আগেই দেখে রেখেছিল। সে তার শিকারে ফেরত এসেছে।
পরদিন, যখন ড. অর্ণব হাসপাতালের কনফারেন্স রুমে নিহারিকার সঙ্গে দেখা করলেন, তখন তিনি তাকে দেখে চমকে গেলেন। তার চোখ লালচে, গলা খানিক শুকনো, ঠোঁটে এক চোরা হাসি। কথা বলার সময় তার স্বরের মধ্যে যেন দ্বিতীয় একটা গলা ফিসফিস করে চলেছে—একদমই অবিকল সেই ভয়াল অডিও রেকর্ডের মতো। অর্ণব চুপচাপ রিপোর্টগুলো তার সামনে রাখলেন—তৃতীয় এক্স-রে রিপোর্ট, এবার অন্য একজন রোগীর। কিন্তু সে এক্স-রেতেও সেই একই ছায়া, একই বিকৃত মুখ। এবার সে মুখ নিহারিকার চেহারার সঙ্গে ভয়ানকভাবে মিলছে! অর্ণব ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেলেন, আর তখনই নিহারিকা ফিসফিস করে বললেন, “তোমার শরীরটা সুন্দর, অর্ণব… জানো, সে তোমার দিকেও তাকিয়ে আছে।” মুহূর্তেই ঘরের বাতি নিভে গেল, এবং অন্ধকারে নিহারিকার চোখজোড়া জ্বলে উঠল এক অস্পষ্ট লাল আলোয়। অর্ণব চিৎকার করতে গিয়েও গলা খুঁজে পেলেন না। তিনি বুঝলেন—ছায়াটা এখন শুধুই রোহিতের ভিতর নেই, নিহারিকার মধ্যেও ঢুকে পড়েছে। তার মানে, ছায়াটা এখন ছড়িয়ে পড়ছে—এক রোগ নয়, এক সংক্রমণ… এক অভিশাপ… যা এক্স-রে’র মাধ্যমে দেখা যায়, কিন্তু ছায়া হিসেবে ঘুরে বেড়ায় মানুষের মন ও শরীরের গভীরে। নিজের শরীরের মধ্যেই এখন নিজের সবচেয়ে বড় শত্রু লুকিয়ে আছে।
আট
রাতের শহর, জেগে থাকা আলোর নীচে অসংখ্য ছায়া হেঁটে বেড়াচ্ছে—কিন্তু সব ছায়া মানুষের নয়। কিছু ছায়া ঘন, গাঢ়, এবং একরকম তরল, যেন তারা শহরের শরীর বেয়ে চুপচাপ বয়ে চলেছে। দক্ষিণ কলকাতার হাসপাতালপাড়া এখন অদ্ভুতভাবে নিস্তব্ধ, যেন বাতাসে কিছুর ভার আছে। এই নিঃশব্দ অস্থিরতার ভিতরে বসে ছিলেন ড. অর্ণব, চোখের নিচে কালি, মগে ঠান্ডা কফি, আর টেবিল জুড়ে এক্স-রে রিপোর্টের স্তূপ। প্রতিটি রিপোর্টে একের পর এক ছায়া জন্ম নিচ্ছে—কেউ রোহিতের, কেউ অন্য রোগীদের, কেউ কেউ এমনকি হাসপাতালের স্টাফদেরও। যেন এই অভিশপ্ত উপস্থিতি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে। আর সবচেয়ে ভয়ের কথা—রোগীরা জানেই না, তারা আক্রান্ত। “শহরের এক কোণে এক্স-রে যন্ত্রটা একটা নতুন মুখ ধরলেই, এক নতুন অস্তিত্ব ঘুম থেকে জেগে উঠছে,” ভাবলেন অর্ণব। হঠাৎ সেই মুহূর্তে ফোন বেজে উঠল—ড. নিহারিকা নিজেই ফোন করেছে। তার কণ্ঠ স্তব্ধ, কেবল বলল, “তুমি যদি দেখতে চাও আসলটা কী, তাহলে এসো ৩২ নম্বর ল্যাব-রুমে… আমি প্রস্তুত।”
অর্ণব বুঝলেন, আর দেরি করার সময় নেই। তিনি রিপোর্টগুলো ব্যাগে ভরে ছুটে গেলেন। হাসপাতালের সেই পুরনো দিকের ল্যাব-রুম, বহুদিন বন্ধ, ধুলোমাখা দরজা, আজ অদ্ভুতভাবে খোলা। ভেতরে ঢুকতেই তিনি বুঝলেন, এটা কেবল এক ল্যাব নয়—এটা যেন ছায়ার গর্ভগৃহ। দেয়ালে দেয়ালে এক্স-রে ফিল্ম ঝোলানো, প্রতিটাতে সেই মুখ—কখনো পুরুষ, কখনো নারী, কখনো অর্ধেক, কখনো চোখবিহীন। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিহারিকা, তার চারপাশে মোমবাতি, তার পেছনে সেই পুরনো এক্স-রে যন্ত্র। মুখে হাসি, চোখে ক্লান্তি, এবং কণ্ঠে একটা শান্তি। সে বলল, “তুমি কি জানো, শহরের কতজন মানুষ ইতিমধ্যে ওদের বাহক হয়ে উঠেছে? শুধু রোহিত না, শুধু আমি না—রাতভর এক্স-রে করা যত রোগী, তাদের অনেকেই এখন দ্বৈত সত্তার অধিকারী। তারা নিজেরাও জানে না, তারা এক একটা দরজা হয়ে উঠেছে।” অর্ণব ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। এরপর নিহারিকা যন্ত্রটা অন করল—স্ক্রিনে ফুটে উঠল শহরের একটি মানচিত্র, যেখানে একের পর এক পয়েন্ট জ্বলছে, একেকটা এক্স-রে রিপোর্টের অবস্থান। প্রতিটা পয়েন্ট একেকটা ‘ছায়া বাহক’—ছায়ার শহরের বাসিন্দা।
“তুমি ভাবো, মানুষ কেবল শরীর?” নিহারিকা বলল, “না অর্ণব, মানুষ আসলে তথ্য। আর তথ্যের ভেতরেই ওরা বাস করে—এক্স-রের ভিতর, স্ক্যান রিপোর্টের কোডে, ডিজিটাল টিস্যু প্যাটার্নে। ওরা একটা ‘ফর্ম’, যাকে তোমরা অস্পষ্টতা বলে চালিয়ে দাও। কিন্তু এ অস্পষ্টতা একটা ছায়া নয়, এটা একটা মস্তিষ্ক। একটা ইচ্ছা। একটা ‘পূর্ব-সত্তা’—যা নিজের শরীর খুঁজছে। এই শহরের ফুসফুসে ওরা ঢুকে পড়ছে, যেমন রোহিতের বুক দিয়ে শুরু হয়েছিল।” অর্ণব এগিয়ে গেলেন, বললেন, “তুমি কি তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছো?”—নিহারিকা ধীরে হাসল। “আমি তাদের ভিতরেই ছিলাম সবসময়। তুমি কি বুঝতে পারোনি, ছায়া বাইরে থেকে আসেনি, আমরা নিজেদেরই প্রতিচ্ছবি দেখছি।” ঘরের বাতি নিভে যায়। ঘর জুড়ে অন্ধকারে দেখা যায় অজস্র মুখ—এক্স-রে’র মুখগুলো এবার বাস্তব, তিন-মাত্রিক। দেয়াল ভেদ করে তারা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে, আর অর্ণব অনুভব করছেন, তার চারপাশের শহরটা এখন আর আলোকময় নয়—এটা ছায়ার শহর, যেখানে প্রতিটি মানুষই এক এক্স-রে রিপোর্ট, আর প্রতিটি রিপোর্টে কেউ না কেউ চিৎকার করছে—“আমায় বের করো…”
নয়
রাত তখন ৩টা ৪৫। চারদিকে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, যেন শহর নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেছে। হাসপাতালের সেই পুরনো রেডিওলজি কক্ষে ড. অর্ণব দাঁড়িয়ে আছেন একা, সামনে সেই যন্ত্র, যেটির মাধ্যমে ছায়ারা জন্ম নেয়, দেহ খোঁজে, মুখ খোঁজে, শ্বাস খোঁজে। কিন্তু আজকের রাত আলাদা—কারণ এবার স্ক্যান হবে তাঁর নিজের। তিনি জানেন, শরীর ঠিক আছে, সিজারিয়ান ক্লিন, ভেতরে কোনো ফিজিক্যাল অস্বাভাবিকতা নেই। কিন্তু মন? স্মৃতি? আত্মা? সেখানে তো দিনের পর দিন ধরে ঢুকে পড়েছে প্রশ্ন, ভয়, ও সেই বিকৃত মুখ। স্ক্যানের আগে তিনি নিঃশব্দে বসে থাকেন কিছুক্ষণ। চোখের সামনে একে একে ভেসে ওঠে রোহিত, অনন্ত, নিহারিকা, জাহানারা—সবার মুখেই ছায়ার ছাপ। হয়তো তিনিও সংক্রামিত হয়েছেন অনেক আগে, শুধু এখনও তা স্পষ্ট হয়নি রিপোর্টে। তাই তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন—এই স্ক্যান হবে শেষ স্ক্যান। নিজেকে এক্স-রে যন্ত্রে শুইয়ে দিলেন, যন্ত্রের আলো ধীরে ধীরে ঘুরতে শুরু করল, ও মনিটরে একের পর এক স্তরে বিভক্ত চিত্র ফুটে উঠল। প্রথমত, সাধারণ হাড়, পাঁজর, হৃদপিণ্ড—সব স্বাভাবিক। কিন্তু পরের স্তরে… এক বিকৃততা। যেন বুকের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়ামূর্তি, মাথা নিচু করে, ধীরে ধীরে মুখ তুলছে—এবং সেই মুখ হুবহু অর্ণবের নিজের!
মেশিনের মধ্যে লুকানো মাইক্রোফোন থেকে শব্দ আসতে শুরু করল—না, যন্ত্রের নয়, কোনও মানুষও নয়, বরং একটা গলা যেন ঘরে ঘরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। “অর্ণব… অনেক খুঁজেছি তোকে… এবার তুই নিজেই দেখতে চাইলি… তাই না?” গলা শুনেই বোঝা যায়, এটা কোনও পরিচিত কণ্ঠ, যেন শৈশবের ভিতর থেকে উঠে আসা কোনো ভূত। সেই কণ্ঠ আবার বলে, “তুই ভুলে গেছিস, আমি কবে ঢুকেছিলাম… যখন তোর মা মারা গেল, তুই প্রথম মৃত্যুকে দেখলি… তখন আমি ঢুকেছিলাম তোকে জড়িয়ে… আর এক্স-রে যন্ত্র? এটা শুধু একটা দরজা… আমি তোর ভিতরেই ছিলাম, আজ তুই নিজেই আমায় ডেকে তুলেছিস।” অর্ণবের চোখের পাতা কাঁপছে, মগজের ভেতর গুলিয়ে যাচ্ছে স্মৃতি—পুরনো ছবি, অন্ধকার ঘর, হাসপাতালের গন্ধ, এবং সেই এক্স-রে রুমের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক সাদা ওড়না পরা নারী… যাকে তিনি ভুলে থাকতে চেয়েছিলেন। হঠাৎ করে স্ক্যান বন্ধ হয়ে যায়। রুমের আলো নিভে যায়। আর ঠিক সেই মুহূর্তে যন্ত্রের স্ক্রিনে ফুটে ওঠে সেই চূড়ান্ত মুখ—এক বিকৃত, বিভৎস, রক্তে মাখা মুখ—যেটা এবার শুধু ছায়া নয়, বরং প্রতিটি কোষে ছড়িয়ে পড়ছে। মুখটা ক্যামেরার সামনে এসে ফিসফিস করে বলে, “শেষ স্ক্যান… শুরু হলো আসল জন্ম।”
রাত কাটে না। ভোরের আলো ফোটে না। হাসপাতালের কেউ অর্ণবকে খুঁজে পায় না। শুধু রেডিওলজি কক্ষের দরজা বন্ধ, ভেতরে যন্ত্রের আলো জ্বলছে টিমটিম করে। এবং স্ক্রিনে চলছে একের পর এক এক্স-রে রিপোর্ট—সব একই রকম, সবখানে একই ছায়ামুখ। রোগীর নাম অর্ণব মুখার্জী। কিন্তু তার নিচে লেখা—Host: Active. Parasite: Integrated. Status: Untraceable. জাহানারা সকালে কক্ষ খুলে ভেতরে ঢুকতে সাহস করেন না। তিনি কেবল চোখ বুজে বলেন, “সে বেরিয়ে গেছে… এবার হয়তো আর কেউ দেখতে পাবে না তাকে… কারণ সে এখন তোমার ভিতরে নেই, সে শহরের ভিতরে… আমাদের ভিতরে… সবার ভিতরে।”
ছায়া নিজেকে আর রিপোর্টে সীমাবদ্ধ রাখেনি। এবার সে মানুষ হয়েছে।
দশ
তিন মাস কেটে গেছে। দক্ষিণ কলকাতার সেই সরকারি হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগে আর রোগী আসেন না। এক্স-রে যন্ত্রটিকে “আংশিক বিকল” ঘোষণা করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ড. অর্ণব মুখার্জীর নিখোঁজের তদন্ত বন্ধ হয়ে গেছে প্রমাণাভাবে। হাসপাতালের করিডোরে মাঝে মাঝে হুইসপার শোনা যায়—কেউ ফিসফিস করে ডাকছে, “এই দেহটা তোমার নয়… আমি ফিরেছি…”—তবে কেউ এগিয়ে আসে না। নিশুতি রাতে পুরনো রোগীরা স্বপ্নে সেই বিকৃত মুখ দেখতে পান, আর সকালে এক অদ্ভুত অসুস্থতা অনুভব করেন। কেউ কেউ চোখের পাতা ফেলে বলে ওঠেন—“আমার ভিতরেও কেউ আছে…” তবু হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ সবকিছু ধামাচাপা দিয়ে রাখে। রিপোর্টের ভাষা পরিচিত—“সাইকোজেনিক ইলিউশন, ক্লিনিকাল হ্যালুসিনেশন, অনির্দেশ্য ডিজঅর্ডার।” কিন্তু এইসব শব্দে যেটা লেখা থাকে না, সেটা হলো ভয়। যে ভয় একটা যন্ত্রের ভিতর লুকিয়ে ছিল, এখন শহরের ভেতর বাস করছে।
ড. নিহারিকা এখন নিখোঁজ। তার ফ্ল্যাটে গিয়ে পাওয়া যায় শুধু একটা খোলা ল্যাপটপ, যার স্ক্রিনে একটিই লাইন—
“আমি আর আমিই নই।”
আর একটা পেনড্রাইভ, যার ভিতর ছিল ১৪৩টি এক্স-রে রিপোর্ট—সব রিপোর্টেই সেই একই ছায়ামুখ, শুধু রূপ বদলায়, চোখের দিক বদলায়, কেউ হেসে থাকে, কেউ চিৎকার করছে। এই সব ফাইল কেউ আর খোলার সাহস করে না। জাহানারা খাতুন মাঝেমাঝে পুরনো বেঞ্চিতে বসে থাকেন হাসপাতালের বাইরে, মুখে ওড়না টেনে বলেন, “ওরা তো কেবল আস্তে আস্তে ঢুকছিল… এখন তো তারা শহরের শরীরে মিশে গেছে। কেউ আর ফসকে যেতে পারবে না।” সে জানে, যাদের একবার এক্স-রে করা হয়েছে, তাদের ভিতরে ‘কে’ আছে সেটা কেবল সময় বলতে পারবে। এমনকি সাধারণ লোকজন যারা অর্ণব, নিহারিকার নাম জানত না, এখন ধীরে ধীরে তাদের চোখের নীচে অন্ধকার বাড়ছে, মুখে ভাষাহীন ক্লান্তি। যেন কেউ প্রতিদিন একটু একটু করে তাদের দেহে ঘর বানিয়ে নিচ্ছে।
তবে শেষ কথা এই—এক্স-রে রিপোর্টে সব কিছু ধরা পড়ে না। সেখানে কেবল হাড়, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, পেশি আর ছায়া দেখা যায়। কিন্তু কেউ ভাবে না—যে ছায়া দেখা যায়, তা শুধু আলো আটকে যায় বলে নয়, বরং কেউ হয়তো ইচ্ছা করে নিজের অস্তিত্ব আড়াল করে রাখে, ঠিক যেন ছায়ার মতোই। রোহিত সেন মারা গেছে বলে ঘোষণা করা হয়েছে, অথচ তার পরিবারের কেউ সেই দেহ দেখে না। স্ক্যান রিপোর্টগুলো ধ্বংস করা হয়েছে, কিন্তু প্রতিটি পুড়োনো মেশিনে সেই মুখ আবার ফুটে ওঠে। হাসপাতালে নতুন এক্স-রে যন্ত্র বসানো হয়েছে, কিন্তু তার প্রথম রিপোর্টেই দেখা গেছে এক অচেনা মুখ… বিকৃত ঠোঁট, কাঁচের মতো চোখ, আর চিবুকের নিচে কুয়াশার রেখা—ঠিক যেমন ছিল অর্ণব মুখার্জীর শেষ স্ক্যানে। ডাক্তাররা আবার হাসছে, যেমন তারা রোহিতকে দেখে হেসেছিল… “ফ্যান্টাসি! মানসিক সমস্যা!” কিন্তু এই গল্পে শেষ নেই। কারণ ছায়ারা মরে না।
তারা শুধু দেহ বদলায়।
—
শেষ