অনুত্তমা গাঙ্গুলী
পর্ব ১
রুদ্রপ্রভা সেন সকাল ন’টায় ঠিক সময়েই ‘একান্ত প্রকাশ’-এর কাঠের দরজাটা খুলে দেন। কাঠে জং ধরেছে, একটু ঠেললে কঁকিয়ে ওঠে, যেন অফিসটাও জানে—তাঁর ভিতরটা এখন একরকম বিষণ্নতা আর অভ্যাসের বোঝায় ভারী হয়ে আছে। বাইরে একটানা বৃষ্টি পড়ছে, পার্কস্ট্রিটের সেই পুরনো ইমারতের তিনতলায় তাঁর ছোট্ট অফিস, যার জানালার কাঁচে কুয়াশা জমে থাকে দিনের বেশিরভাগ সময়।
রুদ্রপ্রভা বত্রিশে পা দেওয়া একা মহিলা। না, একা শব্দটা নেহাতই সামাজিকভাবে। ভেতরে তাঁর ভিতর আরেকটা রুদ্রপ্রভা থাকে, যে রাতবিরেতে কাঠের টেবিলের এক কোণে বসে অজস্র পাণ্ডুলিপি পড়ে, যেগুলো হয়তো কেউই পড়বে না। কিন্তু তবুও সে পড়ে।
আজ সকালটা একটু অন্যরকম। রিসেপশন টেবিলের ওপর খামে মোড়া একটা পার্সেল রাখা। বৃষ্টি ভেজা খামের ওপর লেখা—“শ্রদ্ধেয়া রুদ্রপ্রভা সেন, একান্ত পাঠের অনুরোধ।”
তাঁর ভ্রু কুঁচকে ওঠে। কে পাঠাল? কোন নতুন লেখক? কিন্তু কোনো ঠিকানা নেই, শুধু একটি নাম: অনির্বাণ চক্রবর্তী।
প্যাকেট খুলে দেখেন, ভিতরে এক অদ্ভুত বইয়ের পাণ্ডুলিপি—“তোমার ছায়ায় বসে”—নামটাতেই যেন কোথাও গভীর কোনো ব্যক্তিগত ঘনত্ব আছে। প্রথম পাতায় লেখা এক চিঠি:
“আপনার প্রকাশনার একটি বই একসময় আমায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছিল। তখনই স্থির করেছিলাম, আমার প্রথম বই আপনার হাত দিয়েই জন্ম নেবে।
আপনারই,
– অনির্বাণ”
রুদ্রপ্রভা বেশ কয়েক সেকেন্ড ধরে চিঠিটার কাগজে হাত বুলিয়ে থাকেন। এমন গভীর ভাষা, এমন একাকীত্বের খোঁজ, এতটা ব্যক্তিগত লেখা… লেখাটি কী সাহিত্য? নাকি আত্মার চিৎকার?
তিনি পাণ্ডুলিপির প্রথম পাতাটা উল্টে পড়তে শুরু করেন।
“তোমার চোখে আমি আমার ফেলে আসা শহরটাকে দেখি—
জীর্ণ, ছিন্ন, অথচ আশ্চর্য রকম চেনা।”
লেখার মধ্যে এমন এক আবেগ আছে, যেন প্রতিটি শব্দ নিঃশব্দে তাঁর ব্যক্তিগত প্রাচীর ছুঁয়ে যায়। অনির্বাণ চক্রবর্তী যেন তাঁর মনের ভিতর গিয়ে বসে আছে, যেভাবে কেউ পারে না।
দুপুর গড়িয়ে গেলে রুদ্রপ্রভা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকেন। পেছনে সাদা রঙের দেয়ালে জর্জ ওরওয়েলের একটা কোটেশন টাঙানো—“The best books… are those that tell you what you know already.”
এমন সময় মৃদু নক। অফিস বয়ের হাতে এক খাম।
একই হাতের লেখা।
“আপনার পছন্দ না হলেও দোষ দেব না। কিন্তু যদি এই লেখায় আপনার ছায়া দেখতে পান, তবে একদিন দেখা চাই।”
তার সঙ্গে একটা ছোট ভিজিটিং কার্ড—
“অনির্বাণ চক্রবর্তী | কবি (মনে প্রাণে) | যোগাযোগ: শুধু ইমেল”
রুদ্রপ্রভা থেমে যান। তাঁর অতীত কিছু খুঁটে খুঁটে ফিরে আসে। সেই একাকীত্ব, সেই ভয়, সেই সমস্ত ভালোবাসা যা কখনো বলে উঠতে পারেননি। তাঁর নিজের জীবনে কেউ এমন করে কখনো তাঁকে স্পর্শ করেনি—শব্দের ভেতর দিয়ে।
রাতের দিকে তিনি অফিস ছেড়ে যান। কিন্তু পাণ্ডুলিপিটা তাঁর ব্যাগে থাকে। বাসায় ফিরে আলো নিভিয়ে, নীল আলোয় পড়েন।
“তোমাকে ছুঁতে চাইনি কখনো
শুধু চাইতাম তুমি আমার লেখার পাতায় উঠে আসো।
একটা চিহ্ন হয়ে।
একটা কল্পনা নয়, একান্ত সত্য হয়ে।”
রুদ্রপ্রভা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন। তাঁর পায়ের নিচে যেন জমি সরে যাচ্ছে। শব্দের এমন সংলগ্নতা, এমন অন্তরঙ্গতা তিনি আগে কোনো লেখায় পাননি।
সে রাতে তিনি ঘুমোন না। শুধু একটা ইমেল লেখেন, অনেকটা ভেবেচিন্তে—
“লেখাটা নিছক সাহিত্যের চেয়ে বেশি কিছু।
আপনি কি জানেন, আপনার শব্দগুলো
কোথায় গিয়ে আমার ভিতরে বাজে?”
ক্লিক করে ‘Send’ বোতামে চাপ দেন। জানালার বাইরে অন্ধকার। কিন্তু কোথাও একটা আলোর রেখা পড়ছে—সাহিত্যের মতো, যার ভেতর গোপনে বাস করে প্রেম।
পর্ব ২
পরদিন সকালটা অদ্ভুত রকমের হালকা। আকাশ পরিষ্কার, খোলা জানালায় শহরের কোলাহল যেমন আসে, তেমনি আসে এক অজানা অপেক্ষার হাওয়া। রুদ্রপ্রভা চায়ের কাপ হাতে ধরে বসে আছেন অফিস ডেস্কে, ল্যাপটপে চোখ আটকে। অনির্বাণের কোনো উত্তর এখনো আসেনি। অথচ তিনি নিজের অজান্তেই মেল চেক করেছেন অন্তত বারো বার।
তিনি জানেন না, এই অচেনা লেখক কেন এমন প্রভাব ফেলেছেন তাঁর জীবনে। এটাও জানেন না, একজন প্রকাশকের পক্ষে এমন দুর্বল হওয়া কি ঠিক? কিন্তু তিনি আরও জানেন—এই দুর্বলতা যেন কোথাও তাঁকে টেনে নিচ্ছে এক নতুন আত্মপ্রকাশের দিকে।
ঘণ্টাখানেক পরে ইন্টারকম বেজে ওঠে।
“ম্যাডাম, একজন ভিজিটর এসেছেন। নাম বললেন না। বললেন, একটা কবিতার বই রেখে যাবেন।”
রুদ্রপ্রভার কণ্ঠ শুকিয়ে আসে। তিনিও জানেন না কেন বুকের মধ্যে ধুকপুকানিটা বেড়ে গেল।
“তাকে পাঠিয়ে দিন।”
একটু পরে একজন লম্বা, হালকা গড়নের, চোখে বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি—অদ্ভুত শান্ত মুখের একজন লোক অফিসে ঢোকে। বয়স আনুমানিক ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ, পরনে মাটির রঙের কুর্তা, হাতে একটা ছোট কাগজে মোড়া বই।
রুদ্রপ্রভা উঠে দাঁড়ান। “আপনি অনির্বাণ চক্রবর্তী?”
লোকটি হাসে। “তাই ভাবছেন? না, আমি তাঁর বন্ধু। আমার নাম রাজর্ষি। উনি আমাকে দিয়ে বইটা পাঠাতে বলেছেন। বললেন, আপনি যদি এটা পড়ে শেষ করতে পারেন, তবেই দেখা হবে।”
রুদ্রপ্রভা কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন। তিনি জানেন না কেন, তাঁর মধ্যে কোথাও একটা ঠোক্কর খায়। যেন কোনো অজানা খেলায় ঢুকে পড়েছেন তিনি, যার নিয়মটা শুধু অনির্বাণ জানে।
রাজর্ষি বইটা এগিয়ে দেয়—সাদা মোড়কে বাঁধা, হাতের লেখায় লেখা কভারে—“ভাষাহীন দিনে”। নিচে লেখা: অনির্বাণ চক্রবর্তী।
রাজর্ষি চলে যাওয়ার সময় বলে, “উনি বলেন, শব্দ যদি না পৌঁছায়, দেখা ব্যর্থ হবে। আর আপনি যদি সত্যিই তাঁকে খুঁজে পান, তবে এই বইয়ের ভেতরেই তার ঠিকানা আছে।”
রুদ্রপ্রভা বোবা হয়ে বসে থাকেন।
ঠিকানা একটা বইয়ের ভেতরে থাকে—এই ধারণা কেবল প্রেমিকদের বা কবিদের মধ্যেই সম্ভব।
সে দিনটা আর কোনো কাজ হয় না তাঁর। ক্লায়েন্ট ফোন করলেও তিনি ঠিকভাবে কথা বলেন না। অফিস বয় জিজ্ঞেস করে, “ম্যাডাম, কিছু খাবেন?”
তিনি না বলেই মাথা নাড়েন।
দুপুর নাগাদ তিনি বইটা খুলে পড়া শুরু করেন। প্রথম পাতায় আবারও এক চিঠি।
“আপনি কি কখনও এমন কাউকে দেখেছেন যার শব্দ দিয়ে চোখ বেঁধে রাখা যায়?
আপনি আমার জন্য সেই মানুষ।
তাই এই বই, যেখানে শব্দ আমার চোখের ব্যথা খুলে দিয়েছে।”
লেখাগুলো কবিতা নয়, যেন গদ্যের মতো বয়ে যাওয়া পদ্য। সবটা যেন রুদ্রপ্রভার একান্ত অনুভূতির প্রতিবিম্ব।
“আমার প্রতিটি শব্দ, একান্ত প্রকাশ।
আপনি ছুঁলে তা স্পষ্ট হয়।
আপনি না ছুঁলে, তা কেবল কল্পনা।”
রুদ্রপ্রভার মন কেমন করে ওঠে। তিনি জানেন না কে এই অনির্বাণ। সত্যিই কি তিনি অস্তিত্ববান? নাকি নিছক একটা ছায়া?
কিন্তু বইয়ের মাঝখানে এসে তিনি থমকে যান। একটা পাতায় লেখা:
“আমরা একদিন দেখা করেছিলাম। আপনি জানেন না। আমি জানি।
বইমেলায় আপনার এক প্রকাশিত কবিতা সংকলনের সামনে আপনি দাঁড়িয়েছিলেন।
আমি তখন লেখক ছিলাম না। শুধু পাঠক।
আপনি বলেছিলেন এক বন্ধুকে, ‘এই বইটা আমি নিজের হৃদয় ছিঁড়ে লিখেছি।’
সেদিনই ঠিক করেছিলাম—যদি লিখি, তবে আপনাকেই দিয়ে প্রকাশ করাবো।”
রুদ্রপ্রভা চোখ বন্ধ করেন। অনেক স্মৃতি ফিরে আসে। হ্যাঁ, তিনি বলেছিলেন এ কথা এক বন্ধুকে। হয়তো তিন বছর আগে।
তিনি ধীরে ধীরে পাতাগুলি উল্টে যাচ্ছেন। আর যেন সেইসাথে উল্টে যাচ্ছে তাঁর নিজের মন—যেখানে তিনি বহুদিন কিছু অনুভব করেননি।
বইয়ের একেবারে শেষ পাতায় লেখা—
“আপনি যদি এই বইটা সত্যিই মন দিয়ে পড়ে থাকেন,
তাহলে আপনি জানেন, আমি কে।
যদি না জানেন, তবে দেখা অনুচিত।
যদি জানেন,
তবে পরশু বিকেলে, সেই পুরনো কাঠের বইয়ের দোকানে যেখানে আপনার ছোট পত্রিকাটা একসময় প্রথম ছাপা হতো—
আমি অপেক্ষা করব।”
নিচে কোনো নাম নেই।
রুদ্রপ্রভা বইটা বন্ধ করে দেন। মাথা নিচু করে বসে থাকেন। না, তিনি নিশ্চিত—তিনি জানেন না অনির্বাণ কে। তবু বুকের গভীরে কোথাও একটা ডাক আসছে, যা সাহিত্যের বাইরে, প্রেমের ভেতর দিয়ে, অভিজ্ঞতা নয়—আত্মার কণ্ঠস্বর।
তিন দিন পর…
পর্ব শুরু হবে সেই কাঠের বইয়ের দোকানে, যার নাম “তুলি–কলম”। যেখানে একসময় তিনি প্রথম লেখা ছাপিয়েছিলেন।
কিন্তু সে গল্প, পরের পর্বে।
পর্ব ৩
দুই দিন কেটে গেছে। রুদ্রপ্রভা অফিসে থেকেও যেন অনুপস্থিত। চোখের সামনে পড়ে থাকা পাণ্ডুলিপিগুলো আজ আর তাকে উত্তেজিত করে না। কোনো নতুন লেখক, কোনো সাহিত্য পুরস্কারের খবর, এমনকি সামনের মাসের বইমেলার পরিকল্পনাও তাকে ছুঁতে পারছে না।
তার মস্তিষ্কে এখন একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—সে কী সত্যিই যাবে?
অনির্বাণ যে দেখা করতে চেয়েছে, সেই পুরনো “তুলি-কলম” বইয়ের দোকানে, সেখানে না গেলে তার কিছু হারানোর কথা ছিল না। জীবনে কত অনুরোধ আসে, কত পাঠক বা লেখক আসে-যায়, ভালোবাসা চায়—কিন্তু রুদ্রপ্রভা কোনওদিন নিজের জীবনকে ওভাবে উন্মুক্ত করেননি।
কিন্তু অনির্বাণ শুধু প্রেমিক নয়। সে যেন এক আত্মার লেখক, যে তাকে না জেনেও চিনেছে, না দেখে ছুঁয়েছে, না ছুঁয়ে রক্ত চলাচল বদলে দিয়েছে।
পরদিন বিকেল চারটের সময়ে, রুদ্রপ্রভা একটি ছাতা হাতে নেন। সাদা-কালো ছাপা ঢাকাই শাড়ি পরেছেন, চোখে হালকা কাজল, ঠোঁটে গভীর মেরুন। নিজেকে অন্যরকম মনে হচ্ছে আজ।
তিনি হাঁটছেন ধীরে ধীরে, রাস্তার পাশ দিয়ে, বুকের ভেতর অদ্ভুত রকম কাঁপুনি নিয়ে। পনেরো মিনিটে পৌঁছন “তুলি-কলম”-এ।
বইয়ের দোকানটা এখনও আছে। বাঁশের খুঁটি আর টিনের ছাউনিতে বছর পঁচিশের পুরনো গন্ধ লেগে আছে। ভিতরে বাতাস কম, কিন্তু গায়ের চেনা স্পর্শে একটা ঘরোয়া উষ্ণতা আছে।
তিনি ঢুকতেই কাচের ঘণ্টাটা টুনটুন করে ওঠে।
দোকানের কর্তা, কেশববাবু, এক ঝলক তাকিয়ে চিনে ফেলেন রুদ্রপ্রভাকে। “এতদিন পরে! আপনি এখানে?”
রুদ্রপ্রভা হাসেন। “হঠাৎ ইচ্ছে হলো। একসময় তো এখান থেকেই সব শুরু হয়েছিল।”
কেশববাবু তাকান, স্মৃতির খাতা খুলে ফেলেন—“সেই ‘যাবতীয় নিঃশব্দের দলিল’ বইটা… মনে আছে? কী লেখা ছিল!”
রুদ্রপ্রভা লাজুক গলায় বলেন, “আপনার উৎসাহ না পেলে হয়তো ছাপাতেই পারতাম না।”
কথা বলতে বলতেই তিনি চারপাশে তাকান। কেউ কি আছে? কোনো চেনা মুখ? কোনো চোখ, যে তাকিয়ে আছে দূর থেকে?
ঠিক তখনই এক কোণ থেকে উঠে আসে এক দীর্ঘ, শীর্ণ পুরুষ। পরনে পাটকাটা ধুতি, সাদামাটা কুর্তা, হাতে বই। মাথায় হালকা ছাইচুল, চোখে ঘোলা শান্তি। তিনি সামনে এসে দাঁড়ান।
“আপনি কি রুদ্রপ্রভা সেন?”
স্বরটা মৃদু, কিন্তু আশ্চর্যরকম গভীর।
রুদ্রপ্রভা চমকে তাকান। “আপনি… অনির্বাণ?”
লোকটি মাথা নত করে বলেন, “আমি লেখক নই। লেখক হওয়ার সাহস আপনার হাতেই পেয়েছি।”
রুদ্রপ্রভা কিছু বলার আগেই কেশববাবু দুজনের দিকে তাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকান। “তোমরা বসো। আমি চা নিয়ে আসি।”
দোকানের পিছনের ছোট চৌকাঠে বসে দুজন। মাঝে এক টেবিল, যার ওপর পুরনো ‘দেশ’ পত্রিকা, কবিতা সংকলন আর হাতঘষা কাঠের কলম।
অনির্বাণ একটু হেসে বলেন, “আপনার লেখা বহু বছর ধরেই পড়ছি। কিন্তু বলতে পারিনি কিছু। আপনার প্রকাশনার ‘শরীরের মানচিত্র’ বইটা… সেটাই আমার জীবন বদলে দেয়।”
রুদ্রপ্রভা চমকে ওঠেন। “আপনি কি সেই চিঠির লেখক?”
অনির্বাণ মাথা হেঁট করেন। “হ্যাঁ। সেই চিঠিটাই ছিল প্রথম সাহস।”
রুদ্রপ্রভা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। “আপনার শব্দে একটা অদ্ভুত ব্যক্তিগত স্পর্শ থাকে। মনে হয় যেন… যেন আপনি আমাকে চেনেন। আমার ভেতরের দ্বন্দ্বও বোঝেন।”
অনির্বাণ তাকান রুদ্রপ্রভার চোখে। “আমি আপনাকে চিনি না। কিন্তু শব্দের মাধ্যমে চিনেছি। আপনি যে প্রতিটি লেখায় নিজেকে খুঁটিয়ে তুলে ধরেন, সেটাই আমার ভিতরের চোরাগলি খুলে দেয়।”
রুদ্রপ্রভা চুপ করে যান। বাতাসে নীরবতা জমে।
চা আসে, দুজনে হাতে তুলে নেন কাপ। চুমুক দিতে দিতে অনির্বাণ বলেন, “আপনি কি জানেন, আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি?”
প্রশ্নটা ছুরি হয়ে কেটে যায় রুদ্রপ্রভার হৃদয়ে। তিনি কাপ নামিয়ে রাখেন।
“আপনি তো আমায় চেনেন না। আমার জীবন, আমার জটিলতা, আমার দুঃখ—আপনার কিছুই জানা নেই।”
অনির্বাণ বলেন, “আমি আপনাকে ভালোবাসি সেই রুদ্রপ্রভা হয়ে, যে নিজের চারপাশে দেয়াল গড়েছেন, তবু ভিতরে কবিতা লেখেন। আমি জানি আপনি হয়তো এই ভালোবাসা নিতে পারবেন না, কিন্তু আপনাকে বলা দরকার ছিল। কারণ আপনি না জানলে, এই শব্দগুলো অপূর্ণ থেকে যাবে।”
রুদ্রপ্রভা কিছু বলতে পারেন না। শুধু তাকিয়ে থাকেন সেই লোকটির দিকে—যে তাকে চায়, কিন্তু দাবী করে না। যে ভালোবাসে, কিন্তু বন্ধন চায় না।
শেষমেশ, ধীরে বলেন, “আমি জানি না ভবিষ্যতে কী হবে, অনির্বাণ। কিন্তু এটুকু বুঝেছি—আপনার লেখা আমার জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত, সবচেয়ে সুন্দর চিঠি।”
সন্ধের আলো ঝিমিয়ে আসে। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে।
কিন্তু ভিতরে, যেন একটা শান্ত দীপ্তি জ্বলে উঠেছে।
পর্ব ৪
এরপর দিনগুলো যেন অন্য এক গতিতে চলতে শুরু করল। রুদ্রপ্রভা নিজের মধ্যে বেশ কিছুটা বদল টের পেলেন—যেন তার ভিতরের জমে থাকা আবেগের স্তরগুলো এক এক করে খুলে যেতে শুরু করেছে। অফিসে বসে যখন অনির্বাণের লেখা পাণ্ডুলিপি পড়তেন, তখন তা নিছক সাহিত্য হয়ে থাকত না; তা হয়ে উঠত আত্মার আলাপ।
তাদের দেখা হবার পরের দিন থেকেই ইমেল চলা বন্ধ হয়ে গেল। এখন নিয়মিত ফোনে কথা হয়। না, খুব বেশি সময় ধরে নয়, কিন্তু যতটুকু হয়, তা গভীর। প্রতিটি বাক্যে অনির্বাণ যেন তার ভিতরের জমানো প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেন।
একদিন সন্ধেয় অনির্বাণ ফোন করে বললেন,
“আপনার অফিসে কি আমি একদিন বসে থাকতে পারি? কিছু লেখার কথা ভাবছি। এই শহরের কোলাহলের মধ্যে আপনি যেভাবে নির্জনতা খুঁজে পেয়েছেন, সেটাই আমার দরকার।”
রুদ্রপ্রভা একটু থেমে বললেন, “তোমার চাহিদাটা খুব সাহসী, জানো তো?”
হাসি ভেসে আসে ওপাশ থেকে, “আপনাকে চেয়ে বসে থাকা আমার সবচেয়ে সাহসী কাজ।”
রুদ্রপ্রভা সম্মতি দেন। পরদিন থেকেই অনির্বাণ আসতে শুরু করেন ‘একান্ত প্রকাশ’-এর অফিসে। প্রথম দিন এসে বইয়ের তাকের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন অনেকক্ষণ। পুরনো কবিতা সংকলন, ছোট গল্পের বই, অনুবাদিত জার্মান সাহিত্যের প্রুফ কপি—সব যেন তার নিজস্ব ভুবনের মতো।
সেই দিন অফিস শেষ হওয়ার আগে রুদ্রপ্রভা টের পান, তাঁর ডেস্কের পাশে রাখা ব্লটিং প্যাডে অনির্বাণ একটি লাইন লিখে গেছেন—
“এই টেবিলে যদি শব্দ জন্মায়, তবে তারা আপনার প্রেমে পড়েই জন্মাবে।”
দিনগুলি গড়িয়ে যেতে থাকে। অনির্বাণ আর রুদ্রপ্রভার মধ্যে কোনো নামজাদা সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। কেউ কাউকে প্রেমিক বা প্রেমিকা বলে না, কেউ “তুমি” করে ডাকে না। তবু তাদের প্রতিদিনকার নৈশব্দ্যে, চায়ের ভাঁজে, আধখোলা জানালার আলোয় যে কিছু জন্ম নিচ্ছে—তা যে কোনো পুরনো নামের সম্পর্কের চেয়েও গভীর।
একদিন দুপুরবেলা, বৃষ্টি ঝরছিল। অনির্বাণ একটি ছোট বইয়ের প্রুফ নিয়ে বসেছিলেন, আর রুদ্রপ্রভা পড়ছিলেন নতুন কবিতা সংকলনের পাণ্ডুলিপি। হঠাৎ অনির্বাণ বললেন,
“আপনি কি জানেন, আপনার জীবনের প্রথম প্রেমিক আপনি নিজেই?”
রুদ্রপ্রভা থেমে গেলেন। “তুমি ঠিক কী বলতে চাইছ?”
“আপনি নিজেকে এত ভালোবাসতে শিখেছেন, এত গভীরভাবে চিনেছেন… যে কেউ আপনার পাশে দাঁড়ালে তাকে আপনার প্রেমে পড়তেই হয়। কারণ আপনি নিজেই নিজের গল্পের নায়িকা। আমরা যারা শুধু পাঠক, তারাই এই প্রেমে জড়াই।”
এই কথা শুনে রুদ্রপ্রভার গাল রাঙা হয়ে যায়। হয়তো আবেগে, হয়তো অব্যক্ত কোনো প্রশংসায়। তিনি আর কিছু বলেন না। শুধু বলেন, “তুমি খুব ভালো লেখো, জানো তো?”
অনির্বাণ হেসে বলেন, “না, আপনি খুব ভালো করে পড়েন। তাই মনে হয়, আমি ভালো লিখি।”
এরপর আরও কিছু সপ্তাহ কেটে যায়। অনির্বাণের নতুন উপন্যাস “একজোড়া চোখের শহর” শেষ হয়। রুদ্রপ্রভা নিজের হাতে সম্পাদনা করেন, প্রচ্ছদ পরিকল্পনা করেন, এমনকি প্রাককথনও লেখেন—যেখানে লেখেন,
“কিছু বই শুধু লেখকের নয়, প্রকাশকেরও আত্মজ। এই বই ঠিক তেমন।”
বই প্রকাশের দিন রুদ্রপ্রভা প্রথমবার অনির্বাণকে একটি উপহার দেন—একটা পুরনো টাইপরাইটার, যেটা এক সময় তার বাবার ছিল।
“আমি চাই, তুমি এতে লিখো। শব্দ যেন পুরনো ধাতব আওয়াজে জন্ম নেয়, কাগজে ঠেকা শব্দে। যেন স্মৃতি ছাপিয়ে যায় সময়কে।”
অনির্বাণ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন, তারপর বলেন, “আমি তো তোমাকে নিয়েই লিখছি, প্রভা। সেইসব জায়গায় যেখানে কেউ তোমাকে ছুঁতে পারে না, আমি শব্দ দিয়ে ছুঁয়ে রাখি।”
সেদিন রাতে, অফিসের পর, প্রথমবার রুদ্রপ্রভা অনির্বাণকে বললেন “তুমি”।
“তুমি জানো, আমি তো ভালোবাসতে ভয় পাই। আমি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলাম।”
অনির্বাণ ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বললেন, “আমি তো তোমার ভয়কে ভালোবেসে ফেলেছি। ভয়, কাঁপুনি, দ্বিধা—সবকিছু নিয়েই তোমাকে চাই।”
রুদ্রপ্রভা তখন কিছু বলেননি। শুধু জানালার দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। বৃষ্টি পড়ছিল, জানালার কাঁচে ফোঁটা জমছিল। আর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা অনির্বাণ ধীরে ধীরে তার হাত ধরেছিলেন—
একটা আত্মার পাণ্ডুলিপি ছুঁয়ে দেখার মতো করে।
পর্ব ৫
পৃথিবীর সব ভালোবাসা শব্দ চায় না। কিছু সম্পর্ক নীরবতায় জন্ম নেয়, শব্দের বাইরে বাঁচে, চোখের দিকে তাকালেই কথা বলে। রুদ্রপ্রভা আর অনির্বাণের সম্পর্কটা ঠিক তেমন। তারা ‘প্রেমিক-প্রেমিকা’ নয়, ‘দুটি আত্মা যারা নিজেদের চেনার সুযোগ পায়নি আগে’।
“একজোড়া চোখের শহর” প্রকাশের দু’সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। বইমেলায় বইটি হইচই ফেলে দিয়েছে। প্রকাশনা সংস্থার নামে পত্রিকায় বড় সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে। কেউ বলছে—নতুন সময়ের প্রেমের ব্যঞ্জনা, কেউ বলছে—একান্ত আত্মকথনের জার্নাল। কেউ কেউ অনুমান করছে, লেখক কোনো নারীকে নিয়েই লিখেছেন।
রুদ্রপ্রভা এসব চুপচাপ উপভোগ করেন। মুখে কিছু বলেন না, কিন্তু বুকের ভেতর আলো জ্বলে ওঠে। কাগজে যখন দেখে,
“লেখক অনির্বাণ চক্রবর্তী ও প্রকাশক রুদ্রপ্রভা সেন—এক নতুন যুগল আত্মার কথকতা”—
তখন মনে হয়, এইসব বাক্যগুলির মধ্যে এমন কিছু রয়ে গেছে, যা কারও পক্ষেই জানার কথা নয়।
একদিন বিকেলে, রুদ্রপ্রভা অনির্বাণকে ডাকে তার অফিসে।
“তোমার সঙ্গে কথা আছে,” তিনি বলেন।
অনির্বাণ তখন একটি নতুন বইয়ের প্রুফ দেখছিলেন। মাথা তুলে তাকান।
“তুমি এবার অন্য কোথাও পাঠাও তোমার লেখা। আমি চাই না, কেউ বলুক—তুমি আমার কারণেই জনপ্রিয় হলে। তুমি নিজে আলাদা হয়ে ওঠো। আমি জানি, তুমি পারবে।”
অনির্বাণ ধীরে মাথা নাড়েন। “তুমি বিশ্বাস করো, আমি তোমার জন্য লিখি না। আমি লিখি তোমার ভেতর থেকে। তুমি ছাড়া আমি কোথাও পৌঁছাবো না, প্রভা। তবু… যদি তুমি চাও, আমি পাঠাবো অন্য প্রকাশনায়। কারণ আমার কাজের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তুমি।”
এই প্রথমবার, রুদ্রপ্রভা কিছুটা কাঁপেন। এই লোকটার কাছে কিছু হারানোর ভয় তীব্র হয়ে উঠছে।
তিনি জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি আমার জীবনে থাকবেই, নাকি কেবল লেখার উৎস হয়ে চলে যাবে?”
অনির্বাণ বলেন না কিছু। শুধু চোখে তাকান। সেই তাকানোয় এত কথা—প্রেম, দ্বিধা, প্রতিশ্রুতি আর বিদায়ের ভয় মিশে আছে।
এক সপ্তাহ পর, ‘চিরকাল’ অফিসে এক কুরিয়ারে মোড়া খাম আসে। রুদ্রপ্রভা খোলেন। ভিতরে অনির্বাণের একটি চিঠি।
“প্রিয় রুদ্রপ্রভা,
আমি দূরে যাচ্ছি কিছুদিনের জন্য। মেঘালয়ের ছোট একটি গ্রামে—তিনসুকিয়া। সেখানে ইন্টারনেট নেই, শব্দ নেই, চটকদার বইয়ের খবর নেই। আমি চাই, আমার শব্দ আবার নিজের নির্জনতায় ফিরুক। আমি তো তোমাকে দেখেই শব্দে প্রেম খুঁজেছিলাম। এখন শব্দকেই নিয়ে যাচ্ছি আমার মতো করে গড়তে।
আমি জানি না, তুমি আমায় স্মরণে রাখবে কিনা। কিন্তু আমি তো তোমার প্রতিটি ছাপা বইয়ের ভিতরে আছি।
এই নিয়ে যাচ্ছি তোমার দেওয়া টাইপরাইটারটা।
ইতি,
তোমার অক্ষরের ছায়া”
চিঠির শেষ লাইনটা পড়ে রুদ্রপ্রভা দীর্ঘক্ষণ বসে থাকেন। মাথা নিচু করে, যেন বুকের ভেতর হঠাৎ শূন্যতা ঢুকে গেছে।
অনির্বাণ কাউকে বলেনি কোথায় যাচ্ছেন। এমনকি রাজর্ষিকেও না। শুধু একা চলে গেছেন, কাউকে না জানিয়েই।
প্রথম কিছুদিন রুদ্রপ্রভা তাকে মিস করেননি—এমন ভাবতে চেয়েছেন। অফিসে সময় দেন, নতুন লেখককে সময় দেন, একটি সাহিত্য পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার অতিথি সম্পাদক হন। কিন্তু প্রতিরাতে, যখন জানালার পাশে বসে চা খান, তখন অনির্বাণের ছায়া যেন তাঁর কাঁধ ছুঁয়ে যায়।
একদিন টাইপরাইটারটার পাশে রাখা থাকে এক নোটবুক—যেটা আগে তিনি কখনও খেয়াল করেননি। খুলে দেখেন, প্রথম পাতায় লেখা—
“তুমি থাকো বলেই লিখতে পারি। না থাকলেও তুমি থেকেই যাও।”
রুদ্রপ্রভা বোঝেন না, অনির্বাণ এটা রেখে গেছে কি না। হতে পারে, আগে থেকেই ছিল। হতে পারে, চলে যাওয়ার আগে ইচ্ছে করে রেখে গেছে।
সেই রাতেই, তিনি তার ডেস্কে বসেন। এবং বহু বছর পর নিজের জন্য লেখেন এক কবিতা—
“তুমি কি জানো,
আমি এমন একজনকে ভালোবেসেছি
যার সঙ্গে কোনোদিন ভালোবাসা বলিনি।
যে আমার বুকের শব্দ হয়ে থেকেছে,
নামহীন,
ঠিকানাহীন,
কিন্তু
অক্ষরের মতো স্থায়ী।”
লেখা শেষ হলে, তিনি চোখ বন্ধ করে বলেন, “ফিরে এসো।”
সে কথা কেউ শোনে না, শুধু জানালার বাইরে হাওয়া বয়ে যায়।
আর পেছনে রাখা টাইপরাইটারের নিচে জমে থাকা এক ছোট্ট কাগজ যেন নিঃশব্দে বলে ওঠে—
“আমি ফিরব, যখন তুমি লেখায় আমায় খুঁজে পাবে।”
পর্ব ৬
এক মাস কেটে গেছে। অনির্বাণের কোনও খোঁজ নেই। মোবাইল বন্ধ, মেইল অকার্যকর, পোস্টাল ঠিকানা নেই—শুধু সেই শেষ চিঠি আর টাইপরাইটারের পাশে পড়ে থাকা লেখার খাতা।
রুদ্রপ্রভা এবার সত্যিই বুঝলেন, অনির্বাণ তার কাছে শুধু একজন মানুষ ছিলেন না, ছিলেন এক ছায়ার মতো, যিনি হঠাৎ একদিন উঠে এসে তার সমস্ত জীবনটাকে ছুঁয়ে দিয়ে নিঃশব্দে চলে গেলেন।
তবু রুদ্রপ্রভা অপেক্ষা করতে জানেন। কারণ তিনি জানেন—যে সম্পর্ক শব্দে জন্ম নেয়, তার শেষ হয় না। হয়তো থামে, কিন্তু থেমে যাওয়াই শেষ নয়।
তাঁর অফিস ‘একান্ত প্রকাশ’ এবার একটা নতুন সিরিজ শুরু করেছে—“ভবিষ্যতের লেখক” নামে। নতুন নতুন তরুণ লেখকদের থেকে লেখা আসছে। তিনি নিজে বেছে বেছে পাণ্ডুলিপি পড়ছেন, উৎসাহ দিচ্ছেন, এবং প্রতিটি চিঠির উত্তর দিচ্ছেন হাতে লেখা কার্ডে।
এই ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি প্রতিরাতে সেই খাতাটা খুলে দেখেন। অনির্বাণের হাতের লেখা কবিতা, গল্পের স্কেচ, কিছু অসম্পূর্ণ ভাবনা। যেন অনির্বাণ তার অনুপস্থিতিতেও কথা বলে যাচ্ছেন।
এক সন্ধ্যায়, রুদ্রপ্রভা নিজের ডেস্কে বসে আছেন। বাইরের বৃষ্টি শহরটাকে ঝাপসা করে দিয়েছে। ঠিক তখনই ইন্টারকম বেজে ওঠে।
“ম্যাডাম, একজন ভদ্রলোক এসেছেন। তিনি বলছেন, আপনি চিঠির উত্তর দেন না। নিজের হাতে দিতে এসেছেন।”
রুদ্রপ্রভা চমকে ওঠেন। কে হতে পারে?
দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন চিঠি বাহক, হাতে একটা পুরনো খাম। ঠিকানা লেখা—“শ্রদ্ধেয়া রুদ্রপ্রভা সেন, একান্ত প্রকাশ, পার্কস্ট্রিট।”
রুদ্রপ্রভা নিজের হাতে খামটা নেন। খুব চেনা হস্তাক্ষর। হৃদপিণ্ডটা যেন বুক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
অফিস বয় চলে গেলে তিনি দরজা বন্ধ করে দেন। খামটা খুলে কাঁপা হাতে চিঠিটা বের করেন।
“প্রিয় প্রভা,
আমি ভালো আছি। আমার চারপাশে গাছপালা, নীরবতা, আর নিজের সঙ্গে মুখোমুখি সময় কাটানোর সুযোগ।
জানো, আমি শব্দ হারিয়ে ফেলেছিলাম কিছুদিন। কিছুই লিখতে পারছিলাম না। তোমাকে ছাড়া কেমন যেন শূন্য হয়ে গিয়েছিল সব।
কিন্তু কাল হঠাৎ একটি বালিকা, যে স্কুলে যেতে পারত না, সে আমার কাছে এসে বলল—‘আপনি কি কবি? আমার জন্য একটা শব্দ লিখে দিন।’
আমি লিখেছিলাম—“আলোর মতো হও।”
তখন বুঝলাম, আমার শব্দ ফিরে এসেছে। আর সেই শব্দ আমাকে আবার তোমার কাছে টেনে আনছে।
আমি আগামী সপ্তাহে ফিরছি। তবে এবার আমি ফিরে আসছি শুধু লেখক হিসেবে নয়, একজন প্রেমিক হিসেবে। যদি তুমি আমাকে গ্রহণ করো।
যদি না করো, তবু জানবে—আমি তোমাকে ভালোবেসেছি শব্দ দিয়ে, ছায়া হয়ে, অসম্পূর্ণতাকে ভালবেসে।
ইতি,
অনির্বাণ”
রুদ্রপ্রভা চিঠি হাতে চুপচাপ বসে থাকেন। তার মনে হচ্ছিল, সেই পুরনো কাঠের অফিস, ভিজে জানালা, টাইপরাইটারের শব্দ—সব একসঙ্গে জীবন্ত হয়ে উঠছে।
পরদিন তিনি এক কাপ কফি হাতে নিয়ে পুরনো সেই টাইপরাইটারে চিঠি লেখেন—
“অনির্বাণ,
আমি কখনো তোমাকে প্রকাশ্যে ভালোবাসিনি। কাউকে বলিনি। এমনকি নিজেকেও না।
কিন্তু আজ জানি—তুমি ছিলে আমার প্রকাশের গভীরে, প্রতিটি বইয়ের প্রথম পাতায়, লেখার ভাঁজে, পাঠকের চোখে চোখ রেখে লেখা প্রতিটি লাইনে।
আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব না। কারণ আমি জানি তুমি ফিরে আসবে।
শুধু বলি, এবার যখন আসবে, আমার ডেস্কের পাশে একটা খালি চেয়ার থাকবে—যেটা শুধু তোমার জন্য।
– প্রভা”
তারপর তিনি চিঠিটা ডাকবাক্সে ফেলেন না। রাখেন নিজের বুকসেলফের সবচেয়ে গোপন খুঁটে। কারণ এই চিঠি শুধু অনির্বাণের জন্য নয়—এই চিঠি তাঁর নিজের জন্যও, নিজের মুখোমুখি হয়ে বোঝার জন্য যে তিনিও প্রেমে পড়েছেন, এক অনুল্লিখিত অথচ একান্ত প্রেমে।
সপ্তাহ পেরোয়।
একদিন সকালের দিকে রুদ্রপ্রভা অফিসে ঢুকে দেখে ডেস্কের ওপর রাখা টাইপরাইটারে একটি ছোট্ট চিরকুট—
“চেয়ারটা আমি পেয়ে গেছি। এখন তোমার দিকে বসে আছি।
আজ থেকে এই অফিসটাই আমার ঘর।
আর তুমি আমার ঠিকানা।”
রুদ্রপ্রভা দরজার দিকে তাকান। অনির্বাণ দাঁড়িয়ে আছেন—হাতে সেই টাইপরাইটার, মুখে আলতো হাসি, আর চোখে এক গভীর প্রতিজ্ঞা।
রুদ্রপ্রভা এগিয়ে গিয়ে বলেন, “তুমি ফিরেছো।”
অনির্বাণ কেবল মাথা নেড়ে বলেন, “তুমি যে ডেকেছিলে।”
বৃষ্টিভেজা জানালার কাঁচে তখন রোদ পড়ে। আর অফিসঘরের এক কোণে, টাইপরাইটারের নিচে, জমে থাকা সেই চিঠি আর খাতাগুলো নিয়ে দু’টি শব্দ জন্ম নেয়—
“একান্ত প্রকাশ।”
পর্ব ৭
অনির্বাণ ফিরে আসার পর অফিসের প্রতিদিনের ছন্দে এক নতুন রঙ মিশে যায়। ‘একান্ত প্রকাশ’-এর দরজার কাঁচের ওপারে এখন আর শুধু পাঠক নয়, কিছু অনুভব এসে দাঁড়ায়। কিছু অপেক্ষা এসে বসে থাকে জানালার ধারে।
রুদ্রপ্রভার ডেস্কের ঠিক পাশে, কাঠের পুরনো চেয়ারটায় অনির্বাণ এখন রোজ এসে বসেন। কখনো লেখেন, কখনো চুপ করে বসে থাকেন। দু’জনের মধ্যে বেশি কথা হয় না, কিন্তু নীরবতাও কখনও বড্ড গভীর হয়।
একদিন বিকেলে, অফিস প্রায় ফাঁকা। বাকি কর্মীরা বাড়ি চলে গিয়েছে। রুদ্রপ্রভা একটা পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার শেষ প্রান্তে, আর অনির্বাণ তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে।
“তুমি জানো?” অনির্বাণ হঠাৎ বলেন।
“কি?” রুদ্রপ্রভা চোখ না তুলেই জিজ্ঞেস করেন।
“আমি চাই, এবার আমাদের নিয়ে একটা বই হোক। শুধু লেখা নয়, এই নীরবতা, এই না বলা প্রেম, এই প্রতিদিন তোমার পাশে বসে থাকা—সবটা নিয়ে।”
রুদ্রপ্রভা হালকা হেসে বলেন, “কী নাম হবে সেই বইয়ের?”
“একান্ত প্রকাশ।”
রুদ্রপ্রভা এবার চোখ তুলে তাকান। সেই চোখে বিস্ময় নয়, আর ভয়ও নেই। আছে শুধু একধরনের স্বীকৃতি।
“তুমি জানো তো, এই নামটা শুধু একটা অফিসের নয়, এটা আমার জীবনের একটি অব্যক্ত ঘোষণা। আমি এই নাম দিয়েছিলাম আমার বাবার স্মৃতিকে, যিনি কোনোদিন সাহস করে তাঁর ভালোবাসার কথা বলতে পারেননি। তাঁর সমস্ত অনুভব রয়ে গিয়েছিল ‘অপ্রকাশে’। আমি চেয়েছিলাম, কেউ যেন আর না লুকোয়।”
অনির্বাণ একটু থেমে বলেন, “তুমি নিজেও তো অনেক লুকিয়ে রেখেছিলে।”
“হ্যাঁ,” রুদ্রপ্রভা স্বীকার করেন, “তোমার আগে পর্যন্ত। এখন আর লুকোতে ইচ্ছে করে না।”
সে রাতে, রুদ্রপ্রভা বাড়ি ফেরার আগে অফিসের লাইট নিভিয়ে দেয়ার সময় অনির্বাণ হঠাৎ পিছন থেকে বলেন,
“তুমি কি জানো, তুমি আমার জীবনের একমাত্র সত্যি?”
রুদ্রপ্রভা দাঁড়িয়ে যান। কিছু বলেন না। শুধু ধীরে এসে দাঁড়ান অনির্বাণের সামনে। দুজনের মাঝে আর কোনো শব্দ থাকে না। শুধু অনির্বাণের হাত ধরা থাকে রুদ্রপ্রভার কাঁধে, এবং দুজনের মাঝখানে এক অনুচ্চারিত কবিতা ঘুরে বেড়ায়।
এক মাস পেরিয়ে যায়। তাদের বই “একান্ত প্রকাশ” লেখা শুরু হয়ে গেছে। তারা ঠিক করেছে, এই বই হবে সংলাপের মতো—একেকটি অধ্যায়ে একজন করে লিখবে। একটা অধ্যায়ের শেষে অন্যজন জবাব দেবে।
প্রথম অধ্যায়ে অনির্বাণ লিখেন—
“তোমাকে ভালোবাসা মানে নিজেকে খুলে দেয়া।
এমনভাবে, যে নিজের শব্দও অচেনা লাগে।
আমি কাঁপা হাতে লিখি, কারণ জানি, তুমি পড়বে।
আর তোমার পড়া মানেই, আমার সমস্ত পাতা সত্য হয়ে ওঠা।”
পরের অধ্যায়ে রুদ্রপ্রভা জবাব দেন—
“ভালোবাসা শব্দে নয়, দৃষ্টিতে জন্মায়।
আমি তোমার চোখে প্রথম নিজের ছায়া দেখেছিলাম।
সে ছায়া এখন আমার গল্প।
তুমি নও শুধু লেখক, তুমি আমার পাঠকও—
যিনি আমায় প্রথম পড়তে শিখিয়েছেন।”
প্রথম ৪টি অধ্যায় শেষ হবার পর, অনির্বাণ একদিন সন্ধ্যায় অফিসের ছাদে নিয়ে যান রুদ্রপ্রভাকে।
ছাদে রাখা একটি ছোট টেবিল, দুটো চেয়ার, আর এক বাটি জল ভর্তি গোলাপ পাঁপড়ি।
রুদ্রপ্রভা অবাক হয়ে বলেন, “এই আয়োজন?”
অনির্বাণ হেসে বলেন, “তোমার জন্য প্রথমবার একটা লেখা শ্রুতিকথা করে বলতে চেয়েছিলাম।”
তারপর টাইপরাইটারের মতো ভঙ্গিতে হাতে কাগজ না থাকা সত্ত্বেও উচ্চারণ করেন—
“রুদ্রপ্রভা,
একান্ত শব্দ দিয়ে আমি তোমাকে ডেকেছি।
তুমি শব্দ ছাড়াই আমার জবাব হয়ে উঠেছো।
এখন চাই—তুমি আমাকে ‘প্রকাশ’ করে দাও।
ভালোবাসো, যদি পারো,
যদি না পারো, তাও থাকো—
কারণ তুমি না থাকলে, আমি শব্দ লিখে মৃত্যুর দিকে এগোব।
আর তুমি থাকলে, আমি শব্দ লিখে জীবনের দিকে ফিরব।”
রুদ্রপ্রভা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকেন। তারপর বলেন—
“তুমি কি জানো, এতদিন আমি ভালোবাসা বলতে যা বুঝেছি, তা ছিল সাহিত্যের চরিত্রে। কিন্তু আজ, আমি আমার জীবনে প্রথমবার জানলাম, একজন মানুষ কাউকে এইভাবে ভালোবাসতে পারে, যেখানে অধিকার নেই, দাবিও নেই—শুধু সমর্পণ আছে।”
“তোমার উত্তর কি তাহলে হ্যাঁ?” অনির্বাণ মৃদু হাসেন।
রুদ্রপ্রভা ধীরে বলেন, “তোমার প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে আমি আছি, অনির্বাণ। এবং এই গল্পের শেষ পৃষ্ঠায়ও আমি থাকব।”
ছাদের ওপরে তখন রাত নেমে এসেছে। তারা দুজন চুপ করে বসে আছেন। শহরের আলো ছায়ার মতন ধীরে ধীরে তাদের ঘিরে ফেলছে। টাইপরাইটার নেই, পাণ্ডুলিপিও নেই—তবু যেন একখানা অদৃশ্য বই জন্ম নিচ্ছে তাদের মাঝখানে।
নাম—একান্ত প্রকাশ।
পর্ব ৮
“একান্ত প্রকাশ”—এই নামটা এখন আর শুধু একটা অফিস বা বইয়ের নাম নয়। এটা হয়ে উঠেছে রুদ্রপ্রভা আর অনির্বাণের জীবনের একমাত্র সেতু, যেখানে শব্দ, নীরবতা, সময় আর অশ্রুজলের ছায়া এসে মিশেছে।
তাদের যুগল রচনাবলি বইয়ের প্রথম খসড়া শেষ হয়েছে। তেইশটি অধ্যায়—প্রত্যেকটি একেকটি দিন, একেকটি অনুভূতি, একেকটি সংলাপ। এই বইয়ের পাঠকরা জানবেই না, কোন অধ্যায় কার লেখা। কারণ ভাষার ভিতরে তাদের আত্মা এক হয়ে গেছে।
রুদ্রপ্রভা একদিন বিকেলে অফিসে বসে বইটির শেষ অধ্যায় লিখছিলেন। মাথার ভিতর ঘুরছে শেষ বাক্যটি।
“এই গল্পের পাঠক তুমি, অনির্বাণ। আর এই গল্পের প্রকাশকও তুমি—আমার মনের গোপন দ্বার খুলে দিয়ে তুমি আমাকেই আমার সামনে মেলে ধরেছো।”
হঠাৎ ইন্টারকম বেজে ওঠে।
“ম্যাডাম, এক সাংবাদিক এসেছেন—চাইছেন আপনার আর অনির্বাণ স্যারের একটা যুগল সাক্ষাৎকার নিতে। বইমেলার বিশেষ সংখ্যা।”
রুদ্রপ্রভা খানিক থেমে বলেন, “তাকে বসতে বলো। আমি আর অনির্বাণ আসছি।”
অফিসের কনফারেন্স রুমে তারা দুজনে বসেন, সামনের সোফায় হাসিখুশি এক তরুণী সাংবাদিক।
“আপনাদের বই ‘একান্ত প্রকাশ’ নিয়ে অসংখ্য আগ্রহ। এটা কি সত্যি প্রেমের গল্প? নাকি এটা শুধুই সাহিত্যিক অভিসন্ধি?”
অনির্বাণ হালকা হেসে বলেন, “আমরা শুধু একে বলি ‘ভাষার অন্বেষণ’। প্রেম শব্দটা যেন অনেক ছোট হয়ে যায় এই অনুভবের কাছে।”
রুদ্রপ্রভা বলেন, “হ্যাঁ, এটা প্রেম, তবে সেটা কাগজে আঁকা প্রেম নয়। এটা সেই অনুভব, যেখানে একজন মানুষের উপস্থিতি আপনার ভিতরের অনুচ্চারিত অনুভূতিকে ভাষা দেয়। আর কখনো কখনো, সে ভাষাই ভালোবাসা হয়ে ওঠে।”
সাংবাদিক আবার জিজ্ঞেস করেন, “আপনারা তো একে অপরের বিপরীত—একজন প্রকাশক, অন্যজন কবি; একজন কঠিন, বাস্তববাদী, অন্যজন স্বপ্নবিলাসী। এই দূরত্ব কোথায় মিলেছে?”
রুদ্রপ্রভা এবার তাকান অনির্বাণের দিকে। সে এক চাহনি, যেখানে থাকল বহু অনুচ্চারিত দিনের সারমর্ম।
“শব্দ আমাদের এক করেছে। সে শব্দ কখনো কবিতা, কখনো সংলাপ, কখনো শুধু চুপচাপ পাশে থাকা।”
সাংবাদিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বেরিয়ে যান। রুদ্রপ্রভা আর অনির্বাণ তখন নিজেরা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন।
অনির্বাণ বলেন, “এই বইটা কি শেষ?”
রুদ্রপ্রভা মাথা নাড়ে, “না। এখনো শেষ অধ্যায়ের শেষ লাইনটা লেখা হয়নি।”
“কী হবে সেটা?”
“আমি চাই তুমি লেখো। আমার বদলে।”
অনির্বাণ একটু চমকে বলেন, “তুমি নিজের শেষ পৃষ্ঠা কাউকে লিখতে দিচ্ছো? তুমি তো কখনো করো না এমন!”
রুদ্রপ্রভা হেসে বলেন, “এই প্রথম আমি চাই, কেউ আমার হয়ে আমার অনুভব প্রকাশ করুক। আমি বিশ্বাস করি, তুমি পারবে।”
পরদিন অনির্বাণ সারাদিন অফিসে ছিলেন না। কোনও বার্তাও নেই। রুদ্রপ্রভা প্রথমে ভাবলেন, হয়তো বাড়িতে লিখছেন। কিন্তু সন্ধে গড়িয়ে যাওয়ার পরেও যখন কোনও খোঁজ নেই, তখন এক অদ্ভুত উদ্বেগ জমতে থাকে।
রাত দশটায়, অফিস থেকে বেরিয়ে যখন বাড়ি ফিরছেন, তখন তাঁর মোবাইলে একটি মেসেজ আসে—
“ছাদে এসো। শেষ বাক্যটা আমি তোমার চোখে লিখব।”
রুদ্রপ্রভা চোখ বন্ধ করে একবার গভীর নিঃশ্বাস ফেলেন। তারপর ছাদে উঠে যান।
ছাদের কোণে টেবিলের ওপর রাখা সেই পুরনো টাইপরাইটার। পাশে একটি কাগজে লেখা—
“শেষ বাক্য:
আমি তোমাকে ভালোবাসি এমনভাবে, যেখানে শব্দ নয়, নিঃশ্বাস থাকে।
তুমি থাকো, আমি তোমাকে অনুভব করে যাবো প্রতিটি ছুঁয়ে না দেখা স্পর্শে।”
রুদ্রপ্রভা কাগজটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর ধীরে ধীরে টাইপরাইটারে নিজের হাতে একটি বাক্য লেখেন—
“তোমার শেষ বাক্যই আমার জীবনের শুরু।”
অনির্বাণ তখন পিছন থেকে বলেন, “তুমি জানো, এই বইটা আমরা কখনো প্রকাশ করবো না। এটা শুধু আমাদের জন্য।”
রুদ্রপ্রভা বলেন, “হ্যাঁ, কারণ ‘একান্ত প্রকাশ’ কোনো প্রকাশনা নয়। এটা আমাদের আত্মার একান্ত আলাপ।”
তারপর তারা দুজন ছাদের ধারে দাঁড়িয়ে, একে অপরের দিকে চেয়ে থাকেন।
বৃষ্টির ধারা পড়ছে দূরে, কিন্তু তাদের মাঝে তখন কেবল নীরবতার শব্দ। সেই শব্দ যা কেবল ভালোবাসারাই বুঝতে পারে।
পর্ব ৯
বইমেলা এসে গেছে। ‘একান্ত প্রকাশ’ স্টল সাজানো হয়েছে অনির্বাণের নকশায়—সাদা-কাঠের প্যানেল, ঝুলন্ত কাগজের ছায়া, আর একপাশে টাইপরাইটার রাখা একটি কাচের বাক্সের মধ্যে। উপর লেখা—“যেখান থেকে শব্দেরা ভালোবাসতে শিখেছিল”।
এইবারের মেলাতে তাদের যুগল লেখা বই একান্ত প্রকাশ প্রকাশ করা হয়নি। পাণ্ডুলিপি তৈরি হলেও তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এই বই শুধু তাদের জন্য। অথচ স্টলে আসা অনেক পাঠক জিজ্ঞেস করছেন, “সেই প্রেমের বইটা নেই কেন? যার এক পাতায় শব্দ, আর অন্য পাতায় নীরবতা?”
রুদ্রপ্রভা সবাইকে শুধু একটা হাসি দেন, যার মানে—“যেটা তোমরা খুঁজছ, সেটা ছাপা হয়নি, শুধু জেগে আছে।”
বইমেলার তৃতীয় দিন। বিকেলের ঝলমলে রোদে স্টলে ভিড় একটু কম। রুদ্রপ্রভা বসে আছেন চায়ের কাপ হাতে। অনির্বাণ দূরে দাঁড়িয়ে একজন বৃদ্ধ কবির সঙ্গে কথা বলছেন।
তখনই একজন কিশোরী আসে, হাতে ছেঁড়া এক খাতা। সে কিছু বলতে চায়, কিন্তু সংকোচে চুপ করে থাকে।
রুদ্রপ্রভা তার দিকে তাকিয়ে বলেন, “তুমি কিছু দিতে চাও?”
মেয়েটি চুপচাপ খাতাটা এগিয়ে দেয়। ভিতরে হাতের লেখা, অল্প বয়সের জড়তা ও অভিমানে মোড়া কিছু কবিতা।
রুদ্রপ্রভা পাতাগুলো উল্টে বলেন, “তুমি কি জানতে চাও, এগুলো ছাপা হতে পারে কিনা?”
মেয়েটি মাথা নাড়ে। তারপর বলল, “না, আমি শুধু চাই আপনি এগুলো পড়ুন। আপনি আর… উনি, অনির্বাণদা, আপনারা যেভাবে লেখেন, তেমন কিছু আমি হয়তো পারি না। কিন্তু আমার বাবার মৃত্যুর পর, এই লেখাগুলোই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।”
রুদ্রপ্রভার চোখে জল এসে যায়। তিনি মেয়েটির হাত ধরে বলেন, “তুমি জানো, এটাই সাহিত্য। আমরা সবাই নিজেদের ভাঙা কাচ জোড়া দিতেই লিখি। তুমি অনেক বড় লেখক হবে।”
সন্ধে হয়ে আসে। অনির্বাণ পাশে এসে দাঁড়ান। রুদ্রপ্রভা ইশারা করে বলেন, “তোমার মতোই কেউ আবার লিখতে শুরু করেছে। এভাবেই তোমার শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে।”
অনির্বাণ বলেন, “আমার কিছু শব্দ তোমার কাছ থেকে এসেছে। ওদের আবার ছড়িয়ে দাও।”
মেলার শেষ দিন। স্টল গোছানো চলছে। হঠাৎ এক সাংবাদিক এসে বলে,
“একান্ত প্রকাশ এবার কলকাতা লিটারারি প্রাইজ-এর জন্য মনোনীত হয়েছে, নতুন সাহিত্যিক যুগলের জন্য। আপনারা জানতেন?”
রুদ্রপ্রভা আর অনির্বাণ দুজনেই বিস্মিত। এই পুরস্কার তারা চায়নি, চেষ্টাও করেনি। অনির্বাণ বলেন, “আমরা যুগল হতে চেয়েছিলাম লেখার ভেতর, পুরস্কারের জন্য নয়।”
সাংবাদিক বলেন, “তবু আপনারা প্রমাণ করেছেন, প্রকাশক আর লেখক একসঙ্গে কীভাবে তৈরি করতে পারে এক অন্যরকম বই—যেটা পড়া নয়, অনুভব করা যায়।”
বইমেলা শেষ হয়ে গেলে রুদ্রপ্রভা আর অনির্বাণ আবার ফিরে আসেন অফিসঘরে। সেখানে সব কিছু একই আছে—পান্ডুলিপি, টাইপরাইটার, কাঠের চেয়ার, জানালার কাঁচে জমে থাকা পুরনো দিনের ধুলো।
কিন্তু এবার একটা পরিবর্তন আছে—রুদ্রপ্রভা নিজে লিখছেন আবার। বহুদিন পর, একটা উপন্যাস শুরু করেছেন—নাম রেখেছেন: “প্রকাশের ঠিক আগে”।
একদিন দুপুরে অনির্বাণ অফিসে ঢুকে বলেন, “প্রভা, তুমি কি জানো, আমি এবার লিখতে চাই এমন কিছু, যেখানে তুমি নেই। তুমি যদি আপত্তি না করো।”
রুদ্রপ্রভা একটু থেমে বলেন, “আমি তো বরাবর তোমার লেখার কেন্দ্রে ছিলাম। এবার যদি না থাকি, তবুও আমি ছায়া হয়ে থাকবো।”
অনির্বাণ হেসে বলেন, “তুমি শব্দের চেয়েও গভীর। তুমি অনুপ্রেরণা। কখনো সামনে, কখনো পাশে, কখনো পেছনে।”
তারপর তারা দুজন আবার বসে, টাইপরাইটারের কাছে।
কেউ নতুন গল্প শুরু করে।
কেউ পুরনো গল্প সম্পাদনা করে।
শুধু মাঝখানে পড়ে থাকা খাতাটায় লেখা থাকে—
“আমাদের গল্প কেউ জানবে না, তবু জানবে যে—এই শহরে একবার, এক প্রকাশক আর এক লেখক শব্দ দিয়ে একে অপরকে ভালোবেসেছিল।
এবং সেই ভালোবাসা কোনোদিন ছাপা হয়নি।
কারণ তা ছিল একান্ত।
আর প্রকাশ ছিল শুধু চোখে।”
পর্ব ১০
কলকাতার বসন্ত তখন ধীরে ধীরে গ্রীষ্মের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। গাছের পাতায় গোপন হাহাকার, বইমেলার পরে সেই নিঃসাড় শহুরে ক্লান্তি। কিন্তু ‘একান্ত প্রকাশ’–এর অফিসে বসন্ত যেন চুপিচুপি থেকে যায়। কারণ এখানে এখনও প্রতিদিন নতুন শব্দ জন্ম নেয়, আর পুরনো ভালোবাসা প্রতিধ্বনির মতো বেঁচে থাকে।
অনির্বাণ আজকাল সকালে আসে না। রুদ্রপ্রভা জানেন, সে একটা নতুন উপন্যাসে ডুবে গেছে। নিজের ঘরে বসে দিনরাত লিখছে। মাঝে মাঝে রাতে ফোনে বলে ওঠে—
“তোমার অনুপস্থিতিতেই আমি তোমায় সবচেয়ে বেশি টের পাই।”
রুদ্রপ্রভা হেসে বলেন, “তুমি যতবার আমাকে লেখার মধ্য দিয়ে খুঁজে পাও, আমি ততবার নিজের ভেতর নতুন করে জন্মাই।”
এভাবেই কেটে যায় আরও কিছু মাস।
একদিন সকালে রুদ্রপ্রভা টাইপরাইটারের পাশে একটা মোটা খাম দেখতে পান। খোলেন।
ভিতরে অনির্বাণের লেখা সম্পূর্ণ উপন্যাস—“জানালার ওপারে তুমি”। সঙ্গে একটি চিঠি—
প্রিয় প্রভা,
এটা তোমার জন্য। এখানে আমি তোমায় লিখিনি। কিন্তু তুমি আছো প্রতিটি অনুপস্থিতিতে।
তুমি যখন থাকো না, তখনই আমি বুঝি—তোমার পাশে থাকাটা আমার সবচেয়ে বড় স্বস্তি।
আমি চাই, এই বইটা তুমি প্রকাশ করো না। এটা শুধুই তোমার পড়ার জন্য। কারণ আমি যা লিখেছি, তার পাঠক একমাত্র তুমি।
তুমি আমার সবচেয়ে প্রিয় প্রকাশক নও।
তুমি আমার শব্দের ঘর।
– অনির্বাণ
রুদ্রপ্রভা চিঠিটা হাতে ধরে অনেকক্ষণ বসে থাকেন। মনে পড়ে যায় প্রথম সেই পাণ্ডুলিপির খাম, যেখানে একজন অজানা লেখক লিখেছিলেন—“আপনি যদি এই বইটা পড়েন, তাহলে আমি আপনার মতো করে আর কাউকে লিখব না।”
আজ সেই অজানা লেখকই হয়ে উঠেছে তার জীবনের সবচেয়ে জানা মুখ।
রাতের দিকে, রুদ্রপ্রভা সেই চিঠির উত্তর লেখেন—
প্রিয় অনির্বাণ,
আমি তোমার বইটা প্রকাশ করব না। কারণ এই বই আমার কাছে কেবল গল্প নয়—এটা একটি সম্পর্ক, যা ছাপা হলেই তা ভেঙে যাবে।
আমি আজ বুঝি, প্রকাশ সবসময় শব্দ দিয়ে হয় না। কিছু কিছু অনুভব কেবল একান্ত থাকে।
তুমি আমার কাছে থেকে নিজেকে দূরে রেখেও, আমায় আরও কাছাকাছি এনেছো।
আর জানো, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রকাশ তুমি—
যাকে প্রকাশ করার ভাষা আমার ছিল না।
– প্রভা
এরপর তারা আর কখনও একে অপরকে “ভালোবাসি” বলেনি। কারণ প্রতিটি নীরবতা, প্রতিটি লেখা, প্রতিটি ছুঁয়ে না দেখা স্পর্শই সেই কথাগুলো হয়ে উঠেছিল।
অনির্বাণ একদিন বলেছিলেন—
“আমি চাই, তুমি আমার শেষ লেখা হও।”
আর রুদ্রপ্রভা বলেছিলেন—
“তুমি আমার প্রতিটি প্রকাশনার প্রথম পাঠক হয়ে থাকো।”
একদিন সকালে, ‘একান্ত প্রকাশ’-এর অফিসে একটি নতুন লেখক এসেছিলেন। খুব তরুণ, প্রথম বই প্রকাশ করতে চান। একটু ভয়, একটু কৌতূহল। তার হাতে পাণ্ডুলিপি দেখে রুদ্রপ্রভা বলেন, “তোমার লেখা আমি সময় নিয়ে পড়ব। কারণ প্রতিটি প্রথম লেখা একজন লেখকের হৃদয়ের মতো।”
ছেলেটা জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি নিজেও লেখেন?”
রুদ্রপ্রভা হেসে বলেন, “না। আমি প্রকাশ করি। তবে কখনো কখনো কেউ আসে, যার লেখা আমায় নিজের কথাও মনে করিয়ে দেয়।”
ছেলেটা প্রশ্ন করে, “আপনার প্রিয় লেখক কে?”
রুদ্রপ্রভা উত্তর দেন না। শুধু তাকিয়ে থাকেন অফিসের এক কোণে রাখা টাইপরাইটারের দিকে, যার নিচে আজও সেই পুরনো চিঠিটা রাখা আছে—“আমি ফিরব, যখন তুমি লেখায় আমায় খুঁজে পাবে।”
আর তখনই তিনি মনে মনে বলেন,
“আমি আজও খুঁজে যাচ্ছি। আর প্রতিদিন তোমাকেই ফিরে পাই, এক নতুন শব্দে, এক নতুন ছায়ায়।”
সন্ধেবেলা। অফিসের আলো নিভিয়ে দিচ্ছেন রুদ্রপ্রভা। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ পেছন থেকে অনির্বাণ বলে ওঠে,
“চলো, এবার আমরা আমাদের গল্পটা ছেপে ফেলি।
না, বই হয়ে নয়—
জীবন হয়ে।”
রুদ্রপ্রভা ধীরে ঘুরে তাকান। চোখে জল নেই, শুধু এক বিস্তৃত হাসি।
আর তারপর, তারা দুজন মিলে সেই পুরনো খাতাটা বন্ধ করেন।
তাতে লেখা থাকে—
“একান্ত প্রকাশ
– এই গল্প কোনওদিন ছাপা হয়নি।
তবু প্রতিটি পাঠক জানে,
এখানে এক প্রকাশক আর এক লেখক
ভালোবেসেছিল নীরবতার পাতায়।”
সমাপ্ত