Bangla - সামাজিক গল্প

একতারার ডাকে

Spread the love

মনোরঞ্জন পাল


শীতের ভোর। কুয়াশায় ঢাকা গ্রামের মেঠোপথ যেন সাদা চাদরে ঢাকা নিঃশব্দ প্রান্তর। দূরে কাশবনের ফাঁক গলে লাজুক সূর্য উঁকি দিচ্ছে, আর বাতাসে মিশে আছে গরুর গাড়ির ঘণ্টার শব্দ, কাকের ডাকা আর নদীর জলে কচুরিপানার হালকা দুলুনি। এমন ভোরে যখন গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ উনুনে প্রথম কাঠের আগুন জ্বালাতে ব্যস্ত, তখন নদীর চরে বসে এক মানুষ, নাম তার রামপ্রসাদ বাউল। গায়ে মলিন সাদা ধুতি, লাল পাগড়ি, কাঁধে লম্বা ঝোলানো একতারা, আর গলায় ছোট্ট একটি মাদুলি—যেটা তার বাবার দেওয়া আশীর্বাদপুষ্ট স্মৃতি। তার কালো চুলগুলো এলোমেলো হাওয়ায় উড়ছে, মুখে দাড়ির ভাজে লুকিয়ে আছে জীবনের ক্লান্তি আর সংগ্রামের ছাপ। তিনি চোখ বন্ধ করে একতারা বাজাচ্ছেন, আর তার কণ্ঠের সুর ভোরের নিস্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে। সেই সুরে এমন মাদকতা, এমন প্রার্থনার ছোঁয়া, যা শোনামাত্র কেবল মানুষ নয়, নদীর জল, পাখির ডাক, বাতাসের কাঁপনও থমকে দাঁড়ায়। রামপ্রসাদ গাইছেন—”মানুষ ভজলে সোনার মানুষ পাবি রে ভাই, মানুষের মধ্যে যে মানুষ আছে, সেই মানুষ খুঁজে নে…”। তার সুরে কেবল গান নয়, সুরের মধ্যে মিশে আছে যুগের পর যুগ ধরে চলা লড়াই, মাটির গন্ধ, প্রেম, বেদনা আর ঈশ্বরের খোঁজ। গ্রামের প্রান্ত থেকে ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে, মাঠের মাঝ থেকে গরু চরানো রাখালরা দাঁড়িয়ে পড়ে। কারও হাতে লাঙল, কারও কাঁধে বেহারা, কিন্তু সকলের চোখেই অদ্ভুত এক শিহরণ। এই মানুষটা যে শুধু গান গায় না, সে যেন গানে গানে জীবনের অর্থ খুঁজে পেতে চায়। দূর থেকে নিরুপা জানালার ফাঁক দিয়ে এই দৃশ্য দেখে, তার মুখে একদিকে গর্ব, অন্যদিকে সংসারের দুঃখের চিন্তা। ভেতরের উনুনে হাঁড়িতে জল গরম হচ্ছে, কিন্তু নিরুপার মন তখন উনুনের পাশে নয়, নদীর চরের দিকে, যেখানে তার স্বামী বসে আছেন নিজের সুরের সাধনায়।

রাত পোহালেই গ্রামের হাট বসে, কিন্তু হাটের চেয়ে বড় হাট বসে রামপ্রসাদের সুরের আশেপাশে। কেউ মাঠের কাজ ফেলে আসছে, কেউ বউকে বলে এসেছে “আমি একটু আসছি”, কেউ বা গাঁয়ের মোড়ে চা-দোকান বন্ধ করে তার গান শুনছে। অথচ সেই গানের সুরে লুকিয়ে আছে এক চিরন্তন আর্তি—এই গান আজ আর ক’জন বোঝে? শীতের কনকনে হাওয়ায় তার আঙুলগুলো একতারার তারে বুলিয়ে যাচ্ছে অবিরাম, কিন্তু তার ভিতরে ভিতরে ভয় ঢুকে পড়ছে, যদি এই সুর একদিন বিলীন হয়ে যায়? যদি এই গ্রামের মানুষগুলোও ডিজের আওয়াজে বা শহুরে সুরের ভিড়ে তার গান ভুলে যায়? গ্রামের ছেলেরা এখন শহরের নকল হিপহপ গানে নাচে, মাঠে কৃষকেরা বাউল গান ভুলে বাজায় মোবাইলে রিংটোন। রামপ্রসাদের বুকের ভেতর একদিকে সুরের জেদ, অন্যদিকে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার অসহায়তা। এমন সময় সে চোখ খুলে দেখে, একদল বাচ্চা দৌড়ে তার চারপাশে বসে পড়েছে। তাদের চোখে বিস্ময় আর শ্রদ্ধা। বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে রামপ্রসাদ মনে মনে ভাবে—তাদের মধ্যে হয়তো কেউ একদিন তার সুরের উত্তরাধিকার হবে। একতারা থামিয়ে সে মৃদু হেসে বলে, “তোরা শিখবি গান?” ছেলেমেয়েরা হাততালি দিয়ে ওঠে। দূরে কুয়াশার ভেতর দিয়ে সূর্যটা একটু উজ্জ্বল হয়, যেন আশীর্বাদ করছে এই গান, এই সাধনা, এই মাটির মানুষের প্রতি।

এখনও নদীর ধার দিয়ে হালকা কুয়াশা বইছে। গাছের ডালে বসা পাখিগুলো ডানা মেলে উড়ছে আকাশের দিকে। সেই ভোরের হাওয়ায় রামপ্রসাদ যেন নিজের ভেতর নতুন শক্তি খুঁজে পায়। সুরের মধ্যে ঈশ্বরকে পাওয়ার যে সাধনা, তা যে সহজ নয়—তা সে জানে। কিন্তু গ্রামের মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে সে ঠিক করে, যতদিন দেহে প্রাণ থাকবে, ততদিন এই সুরের দীপ জ্বেলে রাখবে। দূরে নিরুপা মৃদু স্বরে ডাক দেয়, “ঘরে আয় গো, পিঠে রেঁধে রেখেছি, খা আয়…”। রামপ্রসাদ একতারা বুকে জড়িয়ে নদীর দিকে শেষবার তাকায়। তার চোখে জল টলমল করে ওঠে, কিন্তু সে বুঝতে পারে না এ জল দারিদ্র্যের যন্ত্রণার, না কি এ জল সুরের সাধনার আনন্দের। ঘরে ফিরতে ফিরতে সে ভাবে, এই নদী, এই মাটি, এই মানুষ আর তার গান—সব মিলিয়ে জীবন। যতই আধুনিকতার ঝড় আসুক, সে লড়াই করে যাবে, কারণ এ সুর শুধু তার নয়, এ সুর বাংলার মাটির।

গ্রামের সকালটা কুয়াশা সরিয়ে একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছে। বাড়ির উঠোনে নিরুপা হাঁড়ি বসিয়েছে, চুলোয় কাঠের আগুন জ্বলছে আর ধোঁয়া উঠে গিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে হাওয়ার সঙ্গে। তার চোখে ঘুমের রেশ নেই, মুখে ক্লান্তি আর চিন্তার ভাঁজ। চুল খোঁপা করা, শাড়ি একপাশে গোঁজা, কিন্তু চোখে ভেসে আছে জীবনের হাজারো হিসাবের বোঝা। পিঠে পাটালি গুড় দিয়ে গরম পিঠে সাজাচ্ছে, কিন্তু তার মন বসে নেই। মাঝে মাঝেই সে চেয়ে চেয়ে দেখে দরজার ফাঁক দিয়ে দূরের পথে, যদি রামপ্রসাদ ফিরতে ফিরতে দেখা যায়। মনে মনে ভাবে, “প্রতিদিন ভোর হতেই সেই এক গান, একতারা নিয়ে বসা, আর আমি একা এই সংসার টানছি। কবে হবে সুখের দিন? ছেলের পড়া, ঘরের খরচ, এতকিছু নিয়ে রোজ লড়তে লড়তে ক্লান্ত হয়ে গেলাম!” এমন সময় রবি স্কুলের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে উঠোনে আসে। তার চোখে ঘুমের ঝিলিক, কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সে কিছু বলে না। নিরুপা মৃদু হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, পিঠে একটুখানি গুড় দিয়ে দেয়। রবি খেতে খেতে বলল, “মা, বাবা কি গান গাইছে আবার?” নিরুপা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “হ্যাঁ রে, তোর বাবার তো ওই গানই সব… সংসারের কথা ভাবে ক’দিন বল তো?” রবির ছোট ছোট পায়ে স্কুলের পথে হাঁটতে হাঁটতে বাবার গান কানে আসে, দূরের বাতাসে ভেসে আসে সেই সুর। রবি থমকে দাঁড়িয়ে শোনে—অজান্তেই তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে, কিন্তু সে বুঝতে পারে না মায়ের কষ্টের গভীরতা।

এদিকে রামপ্রসাদ ফিরে আসে চুপচাপ। একতারা হাতে, চোখে ক্লান্তি আর মুখে অপূর্ণতার ছাপ। উঠোনে ঢুকতেই নিরুপার চোখ মুখে রাগের ছাপ ফুটে ওঠে, কিন্তু স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে সব কথা বুকের ভেতর চেপে রাখে। “পিঠে রেঁধে রেখেছি, খা গে…”—এইটুকু বলেই নিরুপা চুলোর কাছে চলে যায়। রামপ্রসাদ চুপচাপ বসে পিঠে মুখে তোলে। পিঠের মিষ্টি স্বাদে তার চোখে জল এসে যায়, মাটির ঘ্রাণ, সংসারের ঘ্রাণ তাকে গভীর করে তোলে, আর সে ভাবে—এই মাটিই তো তার গান, এই সংসারই তো তার সাধনা। কিন্তু তারপরই ভেসে ওঠে সংসারের হিসাব: ঘরের ভাঙা চাল, ছেলের পড়াশোনার খরচ, নিরুপার শেষ হয়ে আসা শাড়ি, আর নিজের সাধনার জন্য দরকার নতুন একতারা। সব মিলিয়ে মনটা ভারী হয়ে ওঠে। নিরুপা আস্তে আস্তে বলে, “রামপ্রসাদ, তুই শহরে গিয়ে কিছু কাজ কর না? কত আর চলবে এই গান দিয়ে? রবি বড় হচ্ছে, তার পড়াশোনা, পরীক্ষা—সবই তো টাকা চাই রে। আমি তো বুঝি তোর গান, কিন্তু গান দিয়ে তো পেট চলে না!” রামপ্রসাদ চুপ থাকে। চোখের কোণে জল টলমল করে, কিন্তু কথা বেরোয় না। সে জানে নিরুপা মিথ্যে কিছু বলছে না। তবু সে বলতে পারে না তার গান ছেড়ে কিছু করা। সেই যে সুর সে বুকে বেঁধেছে, তা কি এভাবে ফেলে দেওয়া যায়?

রাত নামে। চাঁদের আলোয় গ্রামের ঘরগুলো রূপোলি হয়ে ওঠে। চিলেকোঠার জানালা দিয়ে রামপ্রসাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। দূর আকাশের তারা দেখে ভাবে—ওই তারারাও কি তার গান শোনে? মৃদু হাওয়ায় দূরের বাঁশবন কাঁপে, আর রামপ্রসাদ ধীরে ধীরে একতারায় টোকা দেয়। একতারা যেন তার মনের কষ্টের সুর হয়ে বাজে। নিরুপা ঘরের কোণে বসে চুপচাপ চোখ মুছে। সে জানে তার স্বামী অন্যরকম, সংসারের হিসাবের চেয়ে তার মনের জগৎ আলাদা। কিন্তু তার দুঃখ হলো—এই আলাদা জগৎ তাদের ছেলেকে, তাদের সংসারকে কিভাবে বাঁচাবে? রবি খাটের একপাশে শুয়ে বাবার সুরে ঘুমিয়ে পড়ে। ভোর হতেই আবার নতুন দিনের লড়াই শুরু হবে। কিন্তু সেই লড়াই গান দিয়ে হবে, না সংসারের হিসাব মিলিয়ে হবে—সেই দ্বন্দ্বের উত্তর কেউ জানে না। দূরের কুয়াশা ঢেকে দেয় গ্রামটাকে, কিন্তু সেই কুয়াশার ফাঁক দিয়ে ভেসে আসে একতারার সুর—যেন মাটির বুক ফুঁড়ে গান বেঁচে থাকার শপথ নিচ্ছে।

গ্রামের হাট বসেছে। শীতের রোদ্দুরে জমজমাট হাট, চারপাশে নানারকম দোকান, হাতে তৈরি মাটির হাঁড়ি-পাতিল, বেতের ঝুড়ি, পাটের দড়ি, আর ফল-মূলের স্তূপ। মানুষের কোলাহলে হাট প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু এবারের হাটের এক কোণে যেন ভিন্ন চিত্র। বড় বড় স্পিকারের পাহাড় সাজিয়ে শহর থেকে আসা এক ব্যবসায়ী সেখানে ডিজে সাউন্ড বসিয়েছে। সে সঙ্গে এনেছে চকচকে মোবাইল, হেডফোন, ইলেকট্রনিক খেলনা আর ডিস্কো লাইট। বড় বড় পোস্টারে হিন্দি সিনেমার নায়কের ছবি, গানের জোরালো শব্দে কাঁপছে বাতাস। গ্রামের কিশোরেরা সেই সাউন্ডের কাছে ভিড় জমিয়েছে। হাত তালি, নাচ আর মোবাইল তোলার হিড়িক চলছে। রামপ্রসাদ দূর থেকে সব দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তার একতারা কাঁধে ঝোলানো, কিন্তু তার সুর সেখানে হারিয়ে গেছে। সেই সুর এখন যেন কেউ শোনে না, সবাই ব্যস্ত বড় শহরের হাওয়ায় ভেসে আসা নকল সুরে। এক কোণে তার চিরপরিচিত বাউল বন্ধুদের কেউ কেউ চুপ করে বসে আছে, তাদের চোখে অনিশ্চয়তা। “আমাদের গান আর কারও দরকার নেই বোধহয়…”—মনে মনে ভাবে রামপ্রসাদ। কোলাহলের মধ্যে তার একতারার তারে হাত বুলিয়ে মৃদু সুর তোলে, কিন্তু সেই সুর স্পিকারের গর্জনে ঢাকা পড়ে যায়। সে বুঝতে পারে, এই হাট, এই গ্রাম বদলে যাচ্ছে। মানুষের মন বদলাচ্ছে। তার বুকের ভেতর মোচড় দেয়—এই বদল কি শুধুই সময়ের দাবি, নাকি মানুষের হৃদয় থেকে মাটির টান হারিয়ে যাচ্ছে?

হাটের এক কোণে ছোট্ট চায়ের দোকানে বসে থাকে সে। এক কাপ চায়ের টেবিলে ঠান্ডা হতে হতে সে চোখ মেলে চেয়ে থাকে হাটের ভিড়ে। একসময় যেখানে তার গান শুনতে মানুষ হাটে আসত, এখন সেখানে শুধু মোবাইলের ফ্ল্যাশ, ডিজে সাউন্ডের আওয়াজ আর নকল হাসির মেলা। এক বুড়ো চা-ওয়ালা দাদু এসে বলে, “কী রে রামপ্রসাদ, আজ তোর গলা শুনলাম না তো? এই যে সব হট্টগোল, তোর গান কেউ শোনে?” রামপ্রসাদ মৃদু হেসে বলে, “যা চলছে, তাতে গান কি আর কেউ শুনতে পাবে দাদু?” বুড়ো মানুষটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “ঠিক বলেছিস বাবা। এই ডিজে-সাউন্ডে কানের পর্দা ফেটে যাবে, আর তোর মত মানুষের সুর হারিয়ে যাবে কালের গর্ভে।” কথা বলতে বলতে বুড়োর চোখেও জল আসে। রামপ্রসাদ অনুভব করে, এই হাটের মাটিতে পা রাখা আছে ঠিকই, কিন্তু মনে হচ্ছে সে যেন অচেনা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে মাটির ঘ্রাণ হারিয়ে যাচ্ছে, যেখানে মানুষের সুরের সঙ্গে হৃদয়ের টান আলগা হয়ে যাচ্ছে। সে চোখ বন্ধ করে ভাবে—এই গান, এই সুর কি তবে হারিয়ে যাবে? না, হারাতে দেওয়া যাবে না। বুকের গভীরে জেদ জন্মায়, যে জেদ তার বাবার কাছ থেকে পাওয়া, যে জেদ তার মাটির টান থেকে পাওয়া। সে ঠিক করে, ফিরে গিয়ে আবার তার একতারা নিয়ে বসবে, যে সুর হারিয়ে যাচ্ছে, সেই সুরকে নতুন প্রাণ দেবে।

রাত বাড়ে। গ্রামের আকাশে বড় বড় তারা দেখা যায়, মাটিতে কুয়াশার চাদর বিছানো। দূর থেকে এখনও হাটের ডিজে সাউন্ডের আওয়াজ আসে, হালকা ঝাঁকুনির মতো বাতাসে মিশে। রামপ্রসাদ ঘরের বাইরে চাতালে বসে থাকে। তার পাশে একতারা রাখা। সে ধীরে ধীরে তারের ওপর আঙুল বুলিয়ে সুর তোলে। সেই সুর রাতের নীরবতায় অন্যরকম ভাসে। যেন মাটি আর আকাশ একসঙ্গে তার সুরকে আশীর্বাদ করছে। নিরুপা এসে দরজার আড়াল থেকে দেখে, তার স্বামী গান বাঁচানোর লড়াইয়ে কোমর বেঁধেছে। সে কিছু বলে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ভাবে—এই মানুষটা এমনই। সংসারের হিসাবের বাইরে তার এক জগৎ, যেখানে সে সুরের মধ্যে বেঁচে থাকতে চায়। রামপ্রসাদ ভাবে, আধুনিকতার হাওয়া আসুক, শহরের ঝড় আসুক—এই সুরকে সে শেষ হতে দেবে না। গ্রামের শিশুদের কাছে সে আবার বাউল গান পৌঁছে দেবে। হাটের ভিড় যতই মোবাইলের দিকে ছুটুক, এই মাটির গান একদিন আবার তাদের মনে সাড়া দেবে। সে জানে না কিভাবে করবে, কিন্তু প্রতিজ্ঞা করে—এই লড়াই সে লড়বেই।

পূর্বরাতের নিস্তব্ধ গ্রামে কেবল শোনা যায় ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর দূরের বাঁশবনে বাতাসের মৃদু শব্দ। সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে অজানা পায়ের শব্দ শোনা যায় গ্রামের মাটির রাস্তায়। চাঁদের আলোয় দেখা যায়, নকু—যে ছিল রামপ্রসাদের প্রিয় শিষ্য, বাউল গান শিখতে যার চোখে ছিল স্বপ্নের আলো—সে ফিরছে শহর থেকে। কিন্তু তার পোশাক, হাবভাব আর আগের মতো নেই। সাদা ধুতি আর মলিন চাদর ছেড়ে সে পরেছে টাইট প্যান্ট, চকচকে শার্ট, কানে আধুনিক ইয়ারফোন। তার চোখে নতুন শহুরে জীবনের ঝলকানি আর ঠোঁটে একরাশ অবজ্ঞা, যেন গ্রাম আর বাউল গান তার কাছে মলিন হয়ে গেছে। গ্রামের মোড়ের চায়ের দোকানের বুড়ো যখন ডাকে, “নকু রে! কতদিন পর এলি বাবা!” নকু কেবল হাত নাড়িয়ে চলে যায়, কানে তখন বাজছে শহরের বিখ্যাত ডিজে গানের সুর। ভোরবেলা রামপ্রসাদ খবর পায় নকু ফিরে এসেছে। সে আশায় বুক বাঁধে, “হয়তো শহর দেখে ফিরে আবার মাটির টান বুঝেছে…”। কিন্তু নকুকে কাছে পেয়ে তার বুকটা ভারী হয়ে যায়। নকুর চোখে সেই শ্রদ্ধার দীপ্তি নেই, সেই সুরের টান নেই। নকু বলে, “গুরু, আপনার গান বড় ভালো, কিন্তু তা দিয়ে কিছু হয় না। শহরে টাকা আছে, নাম আছে, আর এসব গানে কেউ শোনে না আজকাল। আমি নতুন সঙ্গীত শিখছি—ডিজে বাজাই, বিট মিক্স করি। এই গানেই লোকে নাচে, টাকা ফেলে।” নকুর কথা শুনে রামপ্রসাদের বুকের ভেতর কেমন হু হু করে ওঠে। মনে হয় যেন তার একতারার তার ছিঁড়ে গেছে। কিন্তু সে চুপ থাকে, গভীর মমতায় নকুর দিকে তাকিয়ে থাকে।

বিকেলের আলো নরম হয়ে এলে রামপ্রসাদ নকুকে ডাকে। একতারার তারে মৃদু টোকা দিয়ে বলে, “বসো নকু। শুনে যাও একটু সুর। এই সুরে মাটির গন্ধ আছে, মানুষের কান্না আছে, আছে হৃদয়ের ডাক। শহরের গান যতই জোরে বাজুক, এই সুর হারায় না। তুই শুনে দেখ, হয়তো তোর মন ফিরবে।” নকু একটু বসে, কিন্তু তার চোখে আর সেই মুগ্ধতা নেই। সে বলে, “গুরু, এই গান লোকে শোনে না এখন। বড় শহরে সবাই চায় লাউড মিউজিক, নাচের বিট, শোরগোল। এই একতারা দিয়ে কী হবে? এ তো কেবল হাটের কোণে বসে থাকার গান!” রামপ্রসাদ চুপ করে থাকে। বাতাসে ভেসে আসে তার একতারার সুর—সেই সুরে কেবল নকুর নয়, মাটির সন্তানেরা হারিয়ে যাওয়া পথ খুঁজে পায়। নকুর চোখে এক মুহূর্তের জন্য পুরোনো স্মৃতি ভেসে ওঠে—ছোটবেলায় সে কাঁধে একতারা নিয়ে মাঠের ধারে বসে গাইত, গুরু পাশে বসে শেখাতেন। কিন্তু সে মুহূর্তেই সেই চোখের আলো নিভে যায়। সে উঠে দাঁড়ায়। বলে, “গুরু, সময় বদলে গেছে। মাফ করবেন, আমি এই সুরে আর ফিরতে পারব না।” দূরে পাখিরা উড়ে যায়, নকুর পায়ের ধুলো উড়িয়ে সে দূরের পথে হারিয়ে যায়। রামপ্রসাদ তার সুরে থামে না। সে জানে, এই সুর থামলে মাটির সুর থেমে যাবে।

রাত গভীর হয়। আকাশে পূর্ণিমার আলো, গ্রাম নিঝুম। রামপ্রসাদ একতারা বুকে চেপে বসে থাকে উঠোনে। নিরুপা এসে চুপচাপ পাশে বসে। সে জানে, স্বামী ব্যথা পেয়েছে, কিন্তু সে কথা বলতে পারে না। বাতাসে ভেসে আসে দূরের মেলার ডিজে সাউন্ড। সেই শব্দ ভেদ করে রামপ্রসাদের একতারার সুর ভেসে আসে। সে ভাবে, নকুর মতো আরও কত ছেলে হয়তো মাটির গান ভুলে যাবে, শহরের মায়ায় হারিয়ে যাবে। তবু সে লড়াই ছাড়বে না। তার সুর থাকবে শিশুদের কানে, মাঠের প্রান্তে, নদীর জলে। একদিন হয়তো নকু বা তার মতো কোনো ছেলে আবার ফিরে আসবে, মাটির গন্ধ খুঁজতে। সে প্রতিজ্ঞা করে, যতদিন দেহে প্রাণ থাকবে, এই সুর সে বাঁচিয়ে রাখবে। একতারার তারে আঙুল বুলিয়ে সে সুর তোলে, আর সেই সুর রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে গ্রামবাংলার বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, যেন মাটির বুক থেকে উঠে আসে প্রতিজ্ঞার মন্ত্র।

ভোরবেলার মলিন আলোয় রামপ্রসাদ যখন শহরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে, তখন গ্রামের মাটির রাস্তা তার পায়ের তলায় নরম হয়ে আসে। কাঁধে একতারা, গলায় বাবার দেওয়া মাদুলি, আর বুকের মধ্যে শত বছরের বাউল সুরের শক্তি। সে ভাবে, “হয়তো শহরে এই সুর পৌঁছাতে পারব, হয়তো নতুন শ্রোতা পাবে আমার গান…”। পথে যেতে যেতে সে দেখে, ফ্লাইওভারের ছায়ায় ভিখারি বসে আছে, রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে চকচকে গাড়ি, বড় বড় হোর্ডিংয়ে আধুনিক গানের বিজ্ঞাপন, আর তাতে উজ্জ্বল মুখের শিল্পীরা। শহরের কোলাহল তাকে প্রথমেই যেন গিলে খেতে চায়। সে ব্যস্ত মানুষের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। প্রতিটি মুখ ব্যস্ত, প্রতিটি চোখ যেন কেবল টাকার খোঁজে ছুটছে। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে সে একতারার তারে মৃদু টোকা দেয়। সুর ভেসে আসে, কিন্তু কানে কেউ দেয় না। লোকেরা পাশ দিয়ে যায়, কেউ কেউ চোখ তুলে তাকিয়ে হেসে বলে, “এ আবার কেমন সুর! এখন তো ডিজে-র সময়।” তার বুকের মধ্যে কেমন হাহাকার করে ওঠে। নদীর ধারে বসে গাইলে যেমন বাতাস থেমে যেত, পাখিরা শুনত, এই শহরে সেই সুর বাতাসেই হারিয়ে যায়। সে হেঁটে হেঁটে এক চায়ের দোকানের পাশে বসে। দোকানদার অবাক হয়ে বলে, “এই কাকার গান শোনাবে নাকি? এখানে টাকাপয়সা ফেলা লোক নেই, কাকা। যান না মেট্রোর নিচে, ভিড় পাবেন।” রামপ্রসাদ চোখ বুজে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। এই শহরের কোলাহলে তার মাটির সুর একটুও পৌঁছায় না।

দিন গড়িয়ে পড়ে। রোদ নেমে গিয়ে চারপাশে নেমে আসে ম্লান আলো। শহরের ব্যস্ত রাস্তা, ট্রাফিকের হর্ণ, দোকানের ঝলমলে আলোয় সেই মাটির মানুষ যেন আরও একলা হয়ে যায়। সে মেট্রোর নিচে দাঁড়ায়, একতারার সুর তুলতে চায়। দু-একজন থামে, কিন্তু মোবাইলে ছবি তুলে হেসে চলে যায়। কেউ কেউ কয়েকটা মুদ্রা ছুঁড়ে দেয়, যেন করুণা করে। রামপ্রসাদ বোঝে, শহরের মানুষের কাছে তার গান শুধু দয়া পাওয়ার উপকরণ। এই শহর তার সুর বোঝে না, বোঝে না তার সাধনা। এক মুহূর্তে সে চুপ করে যায়। একতারার তারে হাত বুলিয়ে থেমে যায়। সে আকাশের দিকে তাকায়—আকাশও এখানে যেন অন্যরকম। গ্রামের মতো খোলা নয়, দূরের তারা দেখা যায় না, কেবল উজ্জ্বল আলো আর ধোঁয়ার আস্তরণ। সে ভাবে, এই শহর হয়তো তাকে মেনে নেবে না, এই সুর হয়তো শহরের কানে পৌঁছাবে না। কিন্তু সেই মুহূর্তে তার মনে হয়, “যেখানে মাটি, যেখানে নদী, যেখানে বাতাসের ঘ্রাণ—সেখানে এই সুর বাঁচবে। এখানে নয়।” সে আবার চায়ের দোকানের কাছে ফিরে আসে, চুপচাপ বসে। চায়ের দোকানদার বলে, “কাকা, ফিরে যান। এই শহর আপনার নয়।” রামপ্রসাদ মৃদু হাসে, চোখে জল টলমল করে ওঠে।

রাত গভীর হয়। শহরের বাতাসে মিশে থাকে হর্নের আওয়াজ, মানুষের ব্যস্ততার গুঞ্জন। রামপ্রসাদ ট্রেন ধরে ফিরে আসে গ্রামের দিকে। ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখে দূরে আলো মিলিয়ে যাচ্ছে, কুয়াশার আস্তরণ নামছে মাটির ওপর। গ্রামের স্টেশনে নামতেই তার বুক হালকা লাগে। দূরের মাঠ, বাতাসের গন্ধ, পাখির ডাক—সব যেন তাকে ফের বুকে টেনে নেয়। সে হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে যায়। কুয়াশা ঢাকা নদীর ধারে বসে সে একতারায় টোকা দেয়। সেই সুর ভোরের বাতাসে ভেসে আসে, দূরের পাখি ডাকতে শুরু করে, গরুর ঘণ্টা বেজে ওঠে, আর মনে হয়, মাটিই তার সুরের আশ্রয়। শহর তার নয়, এ মাটি, এ মানুষ, এ বাতাসই তার গানকে বাঁচিয়ে রাখবে। সে প্রতিজ্ঞা করে, শহরের ব্যর্থতা তাকে ভাঙতে পারবে না। সে আবার শিশুদের শেখাবে, আবার মাটির গানকে ছড়িয়ে দেবে। দূরের কুয়াশার ফাঁক দিয়ে সূর্য উঠতে থাকে, আর তার সুর নতুন দিনের প্রতিজ্ঞার মতো ভেসে আসে বাতাসে।

শীতের হালকা কুয়াশার মধ্যে সকাল সকাল গ্রামের স্কুলের ঘণ্টা বাজে। স্কুলের মাঠে শিশুরা খেলে, আর দূর থেকে ভেসে আসে পাখির ডাক। সেই মাঠের এক প্রান্তে স্কুলের শিক্ষক বিশ্বজিত স্যার দাঁড়িয়ে থাকেন, তিনি বাউল গান ভালোবাসেন, মাটির সুর তার প্রাণে মিশে আছে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মুখে রামপ্রসাদের সুর শোনার পর তার মনে হয়, এই মানুষটিকে কাছে ডাকা দরকার। একদিন সকালে তিনি রামপ্রসাদকে ডেকে পাঠান। ধুতি-পাঞ্জাবি পরে চশমা ঠিক করতে করতে স্যার বলেন, “রামপ্রসাদদা, তোমার গান শোনার ইচ্ছে বহুদিনের। তুমি গ্রামের ঐতিহ্য, তোমার সুর নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছানো দরকার। আমাদের স্কুলের মাঠেই বসুক তোমার আসর, শিশুদের শেখাও বাউল সুর।” কথাগুলো শুনে প্রথমে রামপ্রসাদ লজ্জা পায়, তারপর মৃদু হাসে। সে ভাবে, “শহর যেখানে বুঝতে পারেনি, এই স্কুলের মাঠ কি পারে?” কিন্তু বিশ্বজিত স্যারের চোখে সেই আন্তরিকতার দীপ্তি দেখে সে রাজি হয়। স্কুলের খোলা মাঠে, শিশুদের ঘিরে, প্রথম দিন বসে সে একতারা হাতে তুলে নেয়। বাচ্চারা মুগ্ধ হয়ে তার সুর শোনে, ছোট্ট হাততালি দেয়। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে সেই সুর—যেন মাটির গন্ধে ভরে ওঠে চারদিক।

প্রতিদিন বিকেল হলেই স্কুলের মাঠে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা একতারা, খোল আর করতাল নিয়ে ভিড় জমায়। রামপ্রসাদ তাদের বাউল গানের মূল কথা বোঝায়—”মানুষের মধ্যে যে মানুষ আছে, তাকেই খুঁজতে হয়, সেই মানুষই ঈশ্বর”। গ্রামের প্রান্তে দাঁড়িয়ে কিছু মানুষ হাসাহাসি করে, কেউ কেউ কটু কথা বলে, “এ গান শেখায় কী হবে? পেট ভরবে?” কিন্তু মাঠের শিশুরা সেসব শুনতে পায় না, তারা মগ্ন সুরে। বিশ্বজিত স্যার পাশে বসে থাকেন, সাহস জোগান। একদিন স্যার বলেন, “তোমার এই গান দিয়ে একদিন আমাদের গ্রাম গর্ব করবে। হাল ছেড়ো না, রামপ্রসাদদা।” সেই কথা শুনে রামপ্রসাদের বুক ভরে ওঠে। সন্ধ্যা নামে, স্কুলের মাঠ থেকে শিশুরা ঘরে ফেরে, আর বাতাসে ভেসে থাকে সেই সুর, যা অদৃশ্যভাবে গ্রামবাংলার মাটিতে বেঁধে রাখে তাদের হৃদয়।

রাতের নরম চাঁদনি রাতে বাড়ির উঠোনে বসে রামপ্রসাদ ভাবে, এই পথ সহজ নয়, কিন্তু এই পথেই সে বাঁচবে। নিরুপা এসে চুপচাপ বসে, স্বামীর চোখের দীপ্তি দেখে সে বোঝে, এই গান তাকে নতুন করে বাঁচিয়ে তুলেছে। দূরের বাঁশবনে হাওয়ার শব্দ, নদীর পাড়ের কুয়াশা, আর একতারার সুর মিশে এক অপার্থিব পরিবেশ তৈরি করে। সে ভাবে, বিশ্বজিত স্যারের মতো মানুষরা যদি থাকে, এই লড়াই সহজ হবে। সে প্রতিজ্ঞা করে, শিশুদের মধ্যে সে বাউল সুরের বীজ বুনে দেবে। শহরের কোলাহল, আধুনিকতার ঝড় সব একদিন থামবে, কিন্তু এই মাটির গান থাকবে। সে একতারার তারে টোকা দেয়, আর সুর ভেসে যায় রাতের আকাশে—যেন আশার এক নতুন প্রদীপ জ্বলে ওঠে।

বছরের শেষভাগে গ্রামের মেলা বসে নদীর ধারে। কাশবনের ফাঁক গলে শীতের হালকা রোদ মেলার মাঠে ছড়িয়ে পড়ে। দূরদূরান্ত থেকে হকাররা আসে, বাজনা বাজে, নাগরদোলা ঘোরে, আর চারপাশে কোলাহলে ভরে ওঠে বাতাস। এই মেলায় আগে যেখানে বাউল গান প্রধান আকর্ষণ ছিল, সেখানে এখন ডিজে সাউন্ড আর বড় বড় হিন্দি গানের প্যান্ডেল দখল নিয়েছে মানুষের মন। কিন্তু এ বছরের মেলায় বিশ্বজিত স্যারের অনুরোধে পঞ্চায়েত থেকে অনুমতি মেলে রামপ্রসাদের বাউল গানের আসর বসানোর। রামপ্রসাদ প্রথমে দ্বিধায় ভোগে—এই ভিড়ে তার সুর কি কেউ শুনবে? কিন্তু শিশুদের উল্লাস আর বিশ্বজিত স্যারের ভরসা তার বুকের মধ্যে সাহস জোগায়। মেলার এক প্রান্তে গাছের ছায়ায় বসে সে একতারা হাতে তোলে, পাশে শিশুরা খোল, করতাল নিয়ে বসে। প্রথমে হট্টগোলের মধ্যে তার সুর ডুবে যায়, কিন্তু একসময় সেই সুরের টানেই মানুষ আসতে শুরু করে। কোলাহলের ভিড় কেটে কেউ থামে, কেউ চুপ করে শোনে—কেউ বা চোখের কোণে জল মুছে। বাতাসে ভেসে যায় সেই অমল সুর—“মানুষ ভজলে সোনার মানুষ পাবি রে ভাই…”। গ্রামের বয়স্ক মানুষরা নিজেদের হারানো দিন মনে করে আবেগে ভেসে যায়।

রাত গড়িয়ে যায়। মেলার আলো, নাগরদোলার চিৎকার, মোবাইলের ফ্ল্যাশের ভিড়ে কোথায় যেন এক সময় বাউল আসর প্রধান হয়ে ওঠে। দূর থেকে ডিজে সাউন্ডের আওয়াজ থেমে যায়। সেই সুরে মুগ্ধ হয়ে গ্রাম্য মাতব্বর থেকে শুরু করে তরুণরাও একপাশে দাঁড়িয়ে শোনে। ছেলেমেয়েরা তালি দেয়, বয়স্করা বলে, “এই তো আমাদের গান, এই তো আমাদের শিকড়!”। রামপ্রসাদের চোখ ভিজে ওঠে, কিন্তু গলা শক্ত করে সে সুর তোলায় ব্যস্ত থাকে। বিশ্বজিত স্যার পাশে বসে গর্বের হাসি হাসেন। সারা রাত ধরে গান চলে, আর সেই সুর বাতাসের সঙ্গে মিশে নদীর ওপারে পৌঁছে যায়। এক মুহূর্তে মেলার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা নকু থেমে শোনে সেই গান। তার চোখে ভেসে ওঠে গুরু-শিষ্যের হারানো দিন। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, আর মনে মনে ভাবে, “গুরু তো থামেনি… গানকে মাটি থেকে তুলেই নিয়েছে…”।

সকালের হালকা আলোয় মেলা প্রাঙ্গণ ফাঁকা হতে থাকে। কিন্তু বাতাসে তখনও লেগে থাকে সেই সুরের ঘ্রাণ। মানুষজন রামপ্রসাদের কাছে এসে হাতজোড় করে, কেউ বলে, “বাবা, তুমিই আমাদের মাটির মুখ।” কেউ বা বলে, “তোমার গান ছাড়া মেলা তো মেলা নয়!”। রামপ্রসাদের মনে হয়, এ শুধু এক রাতের সাফল্য নয়, এ তার লড়াইয়ের প্রথম জয়। নিরুপা পাশে এসে দাঁড়ায়, তার চোখে গর্বের দীপ্তি। রবি বাবার হাত ধরে বলে, “বাবা, আমি তোমার মতই গাইব একদিন!”। রামপ্রসাদ একতারার তারে মৃদু টোকা দেয়, আর মনে মনে ভাবে, এই গান থাকবে, এই মাটির সুর বেঁচে থাকবে যতদিন নদী বয়, বাতাস বয়, আর এই মাটিতে মানুষের হৃদয় আছে। সূর্য ওঠে, আর সেই সুরের সঙ্গে নতুন দিনের আশা ছড়িয়ে পড়ে।

মেলার সেই রাতের সাফল্যের পর রামপ্রসাদের জীবনে নতুন সময় শুরু হয়। তার সুর আর শুধু মেলার মাঠে আটকে থাকে না। আশেপাশের গ্রামের মানুষজনও তার কথা জানতে শুরু করে। কেউ নদীপারের গ্রাম থেকে আসে তার গান শুনতে, কেউ দূরের হাটে তার নাম করে। সকালে গ্রামের শিশুরা স্কুলের মাঠে ভিড় করে, বিকেলে নদীর ধারে বসে শোনে তার বাউল সুর। রামপ্রসাদ বুঝতে পারে, সুরের শক্তি কতটা গভীর—যা এক গ্রামের সীমানা পেরিয়ে মানুষের হৃদয়ে পৌঁছাতে পারে। তার গান এখন শুধু সুর নয়, মানুষের আত্মার খোঁজ, মাটির ঘ্রাণ, আর হারিয়ে যাওয়া শিকড়ের ডাক। একদিন হঠাৎই পাশের বড় হাটের উদ্যোক্তারা আসে। তারা বলে, “রামপ্রসাদদা, এবার আমাদের হাটে আসর বসাও। তোমার সুর শোনার জন্য লোকে মুখিয়ে আছে।” সেই প্রস্তাবে প্রথমে রামপ্রসাদ দ্বিধায় পড়ে। এত বড় হাটে তার সুর লোকে শুনবে তো? কিন্তু বিশ্বজিত স্যারের ভরসা আর গ্রামের মানুষের উল্লাস তাকে সাহসী করে তোলে। সে একতারা হাতে তোলে, আর ভাবে—এ সুর তো তার নয়, এ সুর মাটির, মানুষের, নদীর।

হাটের দিন আসে। বিশাল মাঠে দোকান, প্যান্ডেল, আর মানুষের ঢল নামে। বড় বড় স্পিকারের আওয়াজ, সিনেমার গানের শব্দে প্রথমে তার সুর হারিয়ে যায়। কিন্তু যখন সে একতারা হাতে আসরে বসে, বাতাস যেন থমকে যায়। প্রথম টোকায় একতারার সুর ছড়িয়ে পড়ে মাঠ জুড়ে। ধীরে ধীরে মানুষের কোলাহল থামে। দোকানিরা থামে, পথচারীরা দাঁড়ায়, শিশুদের হাসি থামে—সকলের মনে সুরের ঢেউ লাগে। “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ পাবি রে ভাই…”—গান ভেসে যায় বাতাসে, নদীর ওপারে পৌঁছায়। মানুষ তালি দেয়, কারও চোখে জল আসে। নকু, যে সে হাটে ডিজে বাজাতে এসেছে, দূর থেকে দাঁড়িয়ে থাকে। তার কানে যেন গুরু-শিষ্যের পুরোনো দিনের স্মৃতি বাজে। সে মৃদু কাঁপতে থাকে। শহরের ঝলমলে গান আর মাটির সুরের মধ্যে পার্থক্য সে হঠাৎ বুঝতে পারে। রামপ্রসাদের সুর নকুর হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছে যায়—যেন পুরোনো সেই শিকড়ের ডাক সে আবার পায়।

রাত বাড়ে। হাট শেষ হয়, কিন্তু মানুষের মুখে মুখে সেই সুর রয়ে যায়। গ্রামের মানুষ ফিরে গিয়ে বলে, “আজ আমরা মাটির গান শুনে এলাম, বাউলির সুরে মন ভরল।” রামপ্রসাদ চুপচাপ স্কুলের মাঠে বসে থাকে, পাশে একতারা। সে জানে, লড়াই শেষ হয়নি। কিন্তু আজ সে বুঝেছে—সুর বাঁচে মানুষের ভালোবাসায়, মাটির শক্তিতে। শহরের ঝলমলে আলো, মোবাইলের ফ্ল্যাশ, ডিজে সাউন্ডের জোর যতই থাকুক, বাউল সুর মাটির মতো স্থায়ী। নিরুপা পাশে বসে বলে, “আজ তোর গান মানুষ ঠিকমতো বুঝল রে। তুই জিতেছিস।” রামপ্রসাদ মৃদু হাসে। সে জানে, লড়াই চলবে। সে প্রতিজ্ঞা করে, যতদিন বেঁচে থাকবে, শিশুদের হাতে একতারা তুলে দেবে, মানুষের মনে মাটির সুর বুনে দেবে। দূরের আকাশে তারা জ্বলে ওঠে, বাতাসে ভেসে যায় সেই সুর—যেন নদী, আকাশ, মাটি সব মিলে আশীর্বাদ করছে সেই সুরের পথযাত্রাকে।

___

 

1000031078.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *