ঈশিতা
পর্ব ১
কলকাতার একঘেয়ে বৃষ্টির দুপুরে বালিগঞ্জের এক ক্যাফেতে বসে ছিল অনিন্দিতা। তার চোখে ছিল হালকা চশমা, এক কাপ দার্জিলিং চায়ে ধোঁয়া উঠছে সামনে। বয়স হয়েছে পঁয়ত্রিশ, কিন্তু মুখে সেই শীতল সংযম—যেটা কেউ গড়ে তোলে হেরে গিয়ে বা জিতে। চুলে একটুখানি পাক ধরেছে, যা সে লুকোয় না। গলায় এক সরু রুপোর হার। ক্লায়েন্ট মিটিং বাতিল হওয়ায় সে এসে পড়েছিল এই ক্যাফেতে—নিজের সঙ্গেই কিছুটা সময় কাটাতে।
তখনই দরজা ঠেলেই ঢুকল ছেলেটা। ভেজা চুল, হাতে একটা ক্যামেরা, পরনে সাদা শার্ট আর জিন্স। চোখে ছিল কৌতূহল আর হাসিতে হালকা ছেলেমানুষি। সে এসে সামনের টেবিলে বসলো, আর অর্ডার দিল—”একটা ব্ল্যাক কফি, খুব স্ট্রং।”
অনিন্দিতা তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ছেলেটার মুখে একটা স্বচ্ছতা ছিল—যেটা বয়সের সাথে সাথে মানুষের মুখ থেকে লোপ পায়। সে ফোনে কিছু একটা টাইপ করছিল। হঠাৎই ছেলেটার ক্যামেরাটা টেবিল থেকে গড়িয়ে পড়ে, আর অনিন্দিতা দ্রুত ঝুঁকে সেটাকে ধরল। তাদের হাত একসাথে ছুঁয়ে গেল ক্যামেরার ওপরে।
ছেলেটি হেসে বলল, “Thank you! আমি একটু অসাবধান ছিলাম। আমি ঈশান।”
“অনিন্দিতা,” সে বলে, ক্যামেরাটা ফিরিয়ে দিল।
“আপনি ফটোগ্রাফি করেন?”
“হ্যাঁ, মাঝে মাঝে। এখন একটা প্রজেক্ট করছি—‘Faces of the City’।”
অনিন্দিতা আগ্রহী হল, তার লেখালিখির অভ্যাস আছে, মানুষের মুখ পড়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তার। তারা কথা বলতে লাগল—রাজনীতি থেকে বই, সিনেমা থেকে চা। ঈশানের বয়স বাইশ, কিন্তু তার দৃষ্টিভঙ্গি যেন কোথাও গিয়ে অনিন্দিতার অভিজ্ঞতার সাথে মিলে যায়। এক অদ্ভুত মায়াবী সংযোগ তৈরি হতে লাগল ধীরে ধীরে।
বৃষ্টি কমে আসছিল। অনিন্দিতা ভাবল, এই আলাপ এখানেই থাক—এই টেবিল, এই বৃষ্টি, এই হাসি। কিন্তু ঈশান বলল, “আপনার গল্পগুলো শুনে ভালো লাগছে। আর দেখা হবে?”
অনিন্দিতা একটু চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “হবে হয়তো। যদি তুমিই চাও।”
“আমি তো চাই। আপনার মুখে একটা গল্প আছে।”
ঈশান তখনো জানত না—এই গল্পটা ধীরে ধীরে তাকে ঘিরে ফেলবে।
সেদিনের পরে আরও কয়েকবার দেখা হল তাদের। প্রথমে বইয়ের দোকানে, পরে প্রিন্সেপ ঘাটে, একটা মেট্রো স্টেশনের চৌকাঠে। ঈশান মাঝে মাঝে ওর তোলা ছবি দেখাত, আর অনিন্দিতা তার লেখাগুলো। দুজনেই দেখল, তাদের কথা শেষ হয় না। হাসির মধ্যেও কোথাও একটা শূন্যতা জায়গা করে আছে।
একদিন অনিন্দিতার ফ্ল্যাটে দেখা। গলায় সুতির ওড়না, রান্নাঘরে সে কফি বানাচ্ছিল। ঈশান এসে হঠাৎ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল তাকে। অনিন্দিতা প্রথমে অবাক হল, তারপর ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়ল সেই আলতো কোমলতায়। ঈশানের ঠোঁট তার ঘাড় ছুঁয়ে বলল, “তুমি জানো তো, আমি তোমার থেকে কতটা ছোট, কিন্তু আমার ইচ্ছেগুলো তোমার স্পর্শেই জেগে ওঠে।”
অনিন্দিতা সেই মূহূর্তে বুঝতে পারল, ভালোবাসা কোনো নিয়ম মানে না। তার শরীর, তার একাকীত্ব, তার জেদ—all melted in that touch. তারা কিছু না বলে, কেবল কাছাকাছি এল। প্রথমবার, সত্যিই কাছাকাছি।
রাত্রে ঈশান ঘুমিয়ে পড়েছিল তার কাঁধে মাথা রেখে। অনিন্দিতা তাকিয়ে ছিল ছেলেটার ঘুমন্ত মুখের দিকে। বয়সের ফারাকটা চোখে পড়ছিল ঠিকই, কিন্তু ভালোবাসা তো বয়সের কাছে হার মানে না। হয়তো সমাজ বলবে, ‘অপরিণত প্রেম’। কিন্তু তারা জানত, ওই রাতে কিছু বদলে গেছে।
অনিন্দিতা জানত, শহরটা বদলাবে না। মানুষ কটাক্ষ করবে। কিন্তু এই মুহূর্তটা, এই ত্বকের উষ্ণতা, এই নির্ভরতা—এ সবই তো তার নিজের, চাওয়ার মতো, পাওয়ার মতো।
তখনও জানত না—সামনের দিনগুলো কী নিয়ে আসবে। ঈশানের পরিবার, বন্ধু, অনিন্দিতার একঘেয়ে পেশাজীবন—সব মিলিয়ে এক অসম্পূর্ণ কাঠামো। তবুও, সে সিদ্ধান্ত নিল, সে আর পালাবে না। জীবনে বহুবার সে ‘ঠিক’ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এবার একটা ভুল হোক—ভালোবাসার ভুল।
পর্ব ২
রাতটা অদ্ভুতভাবে শান্ত ছিল। অনিন্দিতা কখন যেন ঈশানের কাঁধে ঘুমিয়ে পড়েছিল, আবার কখন যেন নিজের বিছানায় এসে শুয়েছে। জানে না। শুধু জানে, ঘুম ভাঙতেই ফোনে একটা মেসেজ—“Good morning, অ্যানি। তোমার গন্ধ এখনো আমার আঙুলে লেগে আছে।”
অ্যানি—এই নামে কেউ তাকে কতদিন ডাকেনি! ঈশানের মুখে এই ডাকটা যেন আলতো লাজুক একটা ভালোবাসার মতো। অনিন্দিতা মুচকি হাসল। বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় মেসেজ টাইপ করল, “তুমি এত সহজেই ঘুমিয়ে গেলে?”
ঈশান সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই করল, “তুমি আমার পাশে ছিলে, তাই তো।”
এই কথোপকথনগুলো ছোট, কিন্তু কোথাও যেন ভিতরে ভিতরে জমতে থাকা বিশ্বাস আর আকাঙ্ক্ষার স্তরগুলো খুলে দিচ্ছিল। একটা চোরাস্রোতের মতো প্রেম এগিয়ে চলেছিল, যেখানে জলস্বচ্ছ কিন্তু গভীর।
ঐদিন সন্ধ্যেয় তারা বেরোল দক্ষিণ কলকাতার এক ছোট গ্যালারিতে। ঈশান তার কিছু ছবির এক্সিবিশনে নিমন্ত্রিত ছিল। শহরের তরুণ শিল্পীদের ভিড়, প্যানেল আলোচনার শব্দ, আর মাঝেমাঝে কারোর হালকা মদ্যপ কণ্ঠে হাসি—এইসবের মধ্যে অনিন্দিতা ছিল স্বচ্ছ সাদা শাড়িতে, চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে নীলচে বাদামি লিপস্টিক। ঈশান তাকে দেখে খানিকটা থমকে গেল।
“তুমি যদি ছবির মধ্যে থাকতে, আমি কিছুতেই অন্যদিকে তাকাতে পারতাম না,” বলল সে।
অনিন্দিতা হেসে বলল, “তুমি সবসময় এত বলিউডি কথা বলো?”
“না, শুধু তোমার জন্য।”
গ্যালারির এক কোণায় দাঁড়িয়ে তারা একসাথে একটি ছবি দেখছিল—এক বৃদ্ধার মুখ, যার চোখদুটো কেবল দুঃখ নয়, ইতিহাসও ধরে রেখেছে। অনিন্দিতা দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “চোখ দিয়ে এত কথা কেউ বলতে পারে? এই ছবিটা তুমি তুলেছ?”
“হ্যাঁ,” ঈশান বলল ধীরে, “এই দৃষ্টিটার মধ্যে তোমাকে দেখেছিলাম আমি। সেই প্রথম দিন ক্যাফেতে।”
অনিন্দিতা একটু চুপ করে থাকল। এই তরুণ ছেলেটার অনুভূতির গভীরতা ওকে কেমনভাবে হঠাৎ ছুঁয়ে যাচ্ছে বুঝে উঠতে পারছিল না। তার অভ্যস্ত ছিল না এমন মনোযোগে, এমন খাঁটি তৃষ্ণায়।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা ফিরে এল অনিন্দিতার ফ্ল্যাটে। দরজা বন্ধ হতে না হতেই ঈশান তাকে কাছে টেনে নিল। আর অনিন্দিতা কোনো প্রতিরোধ করল না। সে আজ আর কোনও হিসেব রাখতে চায় না। বুকের মধ্যে জমে থাকা শূন্যতা, শরীরের নিঃসঙ্গতা, মুখে জমে থাকা হাওয়া—সব একসাথে ঢেউ তুলে উঠল।
ঈশান ধীরে ধীরে তার চুল সরিয়ে ঠোঁটে একটি চুমু দিল, তারপর ঘাড়ে, তারপর আরও নিচে। অনিন্দিতা চোখ বন্ধ করে অনুভব করল—সে আবার বেঁচে আছে। প্রতিটি ছোঁয়ায় যেন শরীরটা শুধু উত্তেজিত নয়, আত্মস্থ হয়ে উঠছে। ঈশানের হাতের মধ্যে নিজের শরীরটাকে ভরসা করা সম্ভব হচ্ছে।
কিন্তু হঠাৎ, এই মুহূর্তের মধ্যেই, মনে পড়ল—সে বারো বছর বড়। সমাজ যেটা নাম দেয় ‘খারাপ’, সেটা সে করছিল এই মুহূর্তে। এবং, আশ্চর্যভাবে, একটুও খারাপ লাগছিল না।
“তুমি নিশ্চিত তো?” সে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।
ঈশান বলল, “তোমার স্পর্শে আমার সমস্ত সংশয় গলে যায়। তুমি শুধু শরীর নও, অ্যানি। তুমি আমার সময়েরও অনেক আগে থেকে অপেক্ষা করছিলে, আমি যেন জানতাম।”
সে রাতটা শুধু শরীরের ছিল না। ছিল বিশ্বাসের, আত্মসমর্পণের, হালকা ঘামজড়ানো ভালোবাসার। যখন তারা একে অপরকে জড়িয়ে ঘুমোতে গেল, তখন শহরটা যেন একটু থেমে গিয়েছিল তাদের জন্য।
রাত সাড়ে তিনটের দিকে ঈশান জাগল। অনিন্দিতার চুলের গন্ধ তার নাকে লেগে ছিল। সে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় এল। বাইরে হালকা বৃষ্টি পড়ছে আবার। সে একটা সিগারেট ধরাল, আর নিজের ক্যামেরা নিয়ে অনিন্দিতার ঘুমন্ত মুখটা তুলল। এমন একটা মুখ, যা রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে জেগে থেকেছে কারোর অপেক্ষায়।
পিছনে এসে অনিন্দিতা ধরা গলায় বলল, “আমার ছবি তুলছো?”
“তোমাকে ঠিক যেমন তুমি, ঠিক তেমন করেই রাখতে চাই।”
“কিন্তু আমি তো পারফেক্ট নই।”
“ভালোবাসা কখনও পারফেকশন খোঁজে না, অ্যানি। শুধু উপস্থিতি।”
অনিন্দিতা তখন বুঝল, এই সম্পর্কটা একসময় হয়তো জটিল হয়ে উঠবে। চারপাশের মানুষের কথা, ঈশানের ভবিষ্যৎ, তার নিজের একাকীত্ব—সবকিছুই ঝড় হয়ে আসবে। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে, তারা কেবল দুজন মানুষ, দুজন শরীর, দুটো নিঃসঙ্গতা—যা একে অপরকে একটু বেশি কাছাকাছি এনেছে।
পর্ব ৩
রবিবারের অলস দুপুর। কলকাতার আকাশে মেঘ নেই, রোদ্দুর ঝাঁকুনির মতো জানালার কাচে লেগে আছে। অনিন্দিতা ড্রয়িংরুমে বসে বই পড়ছিল—কিন্তু বইয়ের পাতাগুলো আর এগোচ্ছে না। বারবার মন চলে যাচ্ছে সেই রাতের দিকে। ঈশান এখনো ঘুমোচ্ছে—অন্তত সে ধরেই নিচ্ছে। শুয়ে আছে তার ঘরে, বুকের ওপর হাত রেখে, এমন নিস্তব্ধভাবে যেন কোনো শব্দ তাকে না জাগিয়ে দেয়।
একটা অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছে তার মধ্যে—ভালোলাগা, অস্থিরতা আর একটু অপরাধবোধ মিলেমিশে একটা ঢেউ তুলেছে। আজকে ঈশানের বন্ধুরা সবাই মিলে লেক গার্ডেনে একটা পার্টি করছে, কিন্তু ঈশান তাতে যাবে না বলে সকালেই জানিয়ে দিয়েছে। “আমি এখানে থাকব, তোমার পাশে। ওদের সঙ্গে অনেকদিন পড়ে দেখা যাবে। তোমাকে একা ফেলে কোথাও যাব না।”
অনিন্দিতা চুপচাপ শুনেছিল। এই ‘থাকা’ কথাটা তার জীবনে বড় দুর্লভ ছিল। কারো সঙ্গে থাকা মানে কেবল শরীরের পাশে নয়, মনেও জায়গা করে নেওয়া। সে জানত, ঈশান এখনো জানে না, কী ভয়াবহ শূন্যতা মানুষ নিজের ভিতরে বয়ে নিয়ে বেড়ায়।
কিন্তু তবু, সে আছে। এটাই কি যথেষ্ট নয়?
“তুমি এত ভাবো কেন?” পেছন থেকে হঠাৎ এসে ঈশান তার চুলে আঙুল চালিয়ে বলল। গলার স্বরে হালকা ঘুমঘুম ভাব।
“আমি সবকিছুই একটু বেশিই ভাবি। বয়সটা সেদিক থেকে সুবিধাজনক নয়।”
ঈশান হাসল। “তোমার বয়স যদি ভাবার কারণ হয়, তাহলে আমি তো দশটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি ইতিমধ্যেই।”
অনিন্দিতা কিছু না বলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল। চোখের নিচে ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু ঠোঁটে সেই হাসি। সে ঈশানের মুখে হাত ছুঁইয়ে বলল, “তুমি জানো তো, আমাদের সম্পর্কটা সমাজ মেনে নেবে না?”
“তুমি কী সেটা নিয়ে ভাবছো?”
“হ্যাঁ। কারণ সমাজ আমার গায়ে লিপস্টিকের রঙ দেখে বিচার করবে না, করবে আমার জন্মসাল দেখে। তুমি যতই সাহসী হও, এই লড়াই সহজ নয়।”
“তাহলে?”
“তাহলে কিছু না। আমরা যা করছি, সেটা যে কতখানি বাস্তব, তা জানিয়ে রাখছি নিজেকে। যেন পরের কষ্টটা হজম করা যায়।”
ঈশান কিছু বলল না। শুধু এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। “আমার কাছে তুমি শুধু একজন প্রিয় মুখ না, তুমি আমার জীবনের সব থেকে স্থির জায়গা।”
এই কথাটা এমনভাবে বলল, যেন শরীরের মধ্যেই ঢুকে পড়ল। তাদের ঠোঁট মিলল। প্রথমে আলতো, তারপর ধীরে ধীরে গভীর। এই চুমুর মধ্যে কোনো জোর ছিল না, ছিল বিশ্বাস। অনিন্দিতা জানত, এই মুহূর্তে সে আর কোনও দায়িত্ব পালন করছে না। শুধু নিজেকে ঈশানের মধ্যে বিলিয়ে দিচ্ছে। তাদের দেহ একে অপরকে চিনে নিচ্ছে—নতুন, অথচ পরিচিত।
বিছানায় শুয়ে ঈশান তার গাল স্পর্শ করল। “তুমি এত সুন্দর কেন?”
“আমি? সুন্দর?”
“তোমার শরীর সুন্দর না, অ্যানি। তোমার ক্লান্তি, তোমার হাসি, তোমার চুলে থাকা grey strands—সবই সুন্দর। তুমি নিজে জানো না, তুমি কীভাবে আমাকে পাল্টে দিচ্ছো।”
অনিন্দিতা সেই মুহূর্তে আর কিছু বলল না। সে শুধু চোখ বন্ধ করল। ঈশানের কণ্ঠস্বর, তার শ্বাসের গতি, তার আলতো ছোঁয়া—সবকিছু যেন তাকে এক অন্যরকম শান্তিতে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। ঈশান উঠে ফোন ধরল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার মুখটা বদলে গেল।
“কে?”
“আমার মা,” ঈশান বলল, হালকা চোয়াল শক্ত করে, “জানতে চায় আমি কোথায়, এত দেরি কেন হলো।”
“বললে কি?”
“না, মিথ্যে বললাম। বললাম, বন্ধুর বাড়ি আছি। কিন্তু বেশিদিন চেপে রাখা যাবে না।”
অনিন্দিতা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। এই সম্পর্কটা বাস্তব, কিন্তু ঠিক কতটা সময় তাকে এই বাস্তব টেনে রাখবে, তা সে জানে না। সমাজের চোখ রক্তচক্ষু হয়ে ওঠে যখন নারীর প্রেম তার চিরাচরিত কাঠামো ভেঙে দেয়।
ঈশান আবার তার পাশে এল। “তুমি চাইলে আমি মাকে বলে দিতে পারি।”
“না,” অনিন্দিতা বলল ধীরে, “এখন না। কিছু সম্পর্ক শুধু সময় চাই। আর সময়ই আমাদের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।”
ঈশান চুপ করে থাকল। কেবল তার আঙুলে অনিন্দিতার আঙুল লেগে থাকল। সেদিন বিকেলে রোদ গরম ছিল, কিন্তু মনটা ছিল হিমের মতো ঠান্ডা। হয়তো এই সম্পর্ক একদিন বিপন্ন হবে, হয়তো ভেঙে যাবে।
কিন্তু এখন, এই দুপুরে, এই ছায়ার মুখে, তারা ছিল… একটু বেশি কাছাকাছি।
পর্ব ৪
শহরের রাস্তাগুলো জানে তাদের গল্প। সেই ফ্ল্যাটবাড়ি, সেই ক্যাফে, সেই গলি যার একপাশে ফুচকার দোকান, অন্যপাশে পুরনো সিনেমা হল—এই সবের মাঝেই গড়ে উঠছে এক অসম প্রেম, যার প্রতিটা পদক্ষেপে আছে দ্বিধা, কিন্তু তার চেয়েও বেশি আছে টান।
সেই বিকেলে তারা বেরিয়েছিল হাত ধরে, যেন এটা খুব স্বাভাবিক কোনো সম্পর্ক। যেন ঈশান তার কোনো ক্লাসমেট, আর অনিন্দিতা তার প্রেমিকা—একটু বয়সে বড়, তাতে কী আসে যায়? কিন্তু ওদের চারপাশের চোখগুলো যেন প্রতিটা ছায়া গুনে নিচ্ছিল।
তবুও ঈশান কিছুতেই হাত ছাড়ল না। বরং আরও শক্ত করে ধরল।
“তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো?” সে জিজ্ঞেস করল।
“না,” অনিন্দিতা বলল হালকা গলায়, “তবে এই সমাজটা বড় বেশি কৌতূহলী। তাদের কাছে তুমি আমার প্রেমিক না, হয়তো ছেলে, হয়তো ভাগ্নে। তারা ভাববে আমি ভুল করছি।”
“আর আমি?”
“তোমার ভুল মানে হবে তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন।”
“ভবিষ্যৎ কি আমি নিজে ঠিক করব না?” ঈশান থেমে দাঁড়াল, “তুমি কি আমাকে এতটাই নরম ভাবো, যে আমি সমাজের কথায় ভেঙে পড়ব?”
অনিন্দিতা চুপ করে গেল। এমন জেদি উত্তর সে আশা করেনি। ঈশানের চোখে আগুন ছিল না, ছিল নিশ্চিতি। সে যেন জানে, ভালোবাসা যদি গভীর হয়, তবে তাতে সময়ের হিসেব গোনার দরকার নেই।
তারা পৌঁছেছিল পার্ক স্ট্রিটের এক রেস্টোরেন্টে—ঝাঁ চকচকে, কিন্তু মাঝেমাঝে অদ্ভুতভাবে কৃত্রিম। বসে খাবার অর্ডার দিতে দিতে অনিন্দিতা লক্ষ্য করল, ঈশান প্রতিটা ডিটেলস মনে রাখছে—সে কোন চা পছন্দ করে, কোন মিষ্টি খায় না, কোন গান শুনলে চোখে জল আসে। এতটা মনোযোগ কতদিন কেউ দেয়নি ওকে।
খাবার আসার আগেই ঈশান তার ফোনে একটা ভিডিও চালালো—একটা নতুন শর্টফিল্মের আইডিয়া দেখাতে চায়। ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত। গল্পটা একটা মাঝবয়সী নারীর, যে হঠাৎ একদিন একটা বাচ্চা ছেলের বন্ধু হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। কেমন অদ্ভুত! যেন ওদেরই গল্প।
অনিন্দিতা একটু হেসে বলল, “তুমি কি আমার জীবন নিয়েই ছবি বানাতে চাও?”
“না, তোমার জীবন আমার ছবির থেকেও বেশি সুন্দর। আমি শুধু একটা ছায়া তুলছি।”
তারা খেতে খেতে গল্প করছিল। এমন সময় রেস্টোরেন্টে ঢুকল অনিন্দিতার এক পুরনো পরিচিত—তার সহকর্মী, রণদীপ। সে দূর থেকে তাদের দেখে অবাক হল, চোখ তুলে তাকাল, এবং ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা ভাবল। অনিন্দিতা বুঝল, প্রশ্ন আসবে। কিছু একটা ছড়াবে। এই শহরে গুজব বাতাসের চেয়েও দ্রুত ছড়ায়।
রণদীপ চলে গেল, কিন্তু অনিন্দিতার ভেতরটা ছটফট করতে লাগল। ঈশান সেটা বুঝে বলল, “আমি চাই না তোমার জীবনে কোনো অশান্তি আসুক। চাইলে আমি একটু দূরে থাকি।”
অনিন্দিতা চমকে তাকাল। “তুমি কি আমাকে ছেড়ে যেতে চাও?”
“না, কখনো না। কিন্তু আমি যদি তোমার জীবনের শান্তিটা কেড়ে নিই, তাহলে কী করে ভালোবাসব তোমায়?”
এই কথাটা এমনভাবে বলল, যেন ঈশান এখনো যুবক, কিন্তু তার হৃদয় অনেক বেশি পরিণত।
অনিন্দিতা তার হাত ধরল টেবিলের নিচে। “তুমি কিছু নাওনি। তুমি শুধু আমাকে একটু বেশি করে দেখতে চাও। সেটা কোনো অপরাধ নয়।”
তারা ফিরছিল উবরে। কলকাতার রাত তখন নিঃশব্দ নয়, কিন্তু নরম। গাড়ির জানালা দিয়ে হাওয়া ঢুকছিল, চুল উড়ে যাচ্ছিল অনিন্দিতার মুখে। ঈশান তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি জানো, আজ আমি তোমাকে পুরো শহরটার মধ্যে খুঁজে পেয়েছি।”
“মানে?”
“এই লাইট, এই ট্রামলাইন, এই গোলদিঘির ধারে—সব যেন তোমার মতো। অতীতমাখা, অথচ জ্যান্ত। ক্লান্ত, কিন্তু আশাবাদী। আমি বুঝি না কিভাবে এত ভালোবাসা তৈরি হলো তোমার জন্য।”
“ভালোবাসা তৈরি হয় না, ঈশান। সেটা অজান্তে ঢুকে পড়ে—যেমন তুমি ঢুকে পড়েছো আমার ভেতরে।”
ঘরে ফিরে অনিন্দিতা গায়ে একটানা জল ঢালছিল, ঈশান এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। তার ঠোঁট ছুঁল গলার কাছে, কাঁধের কাছে। শরীর আবার সেই পুরনো আলোড়নে সাড়া দিল। তবু আজকের আলিঙ্গনে ছিল আরও বেশি আকুলতা—যেন শরীরের চেয়ে বেশি কিছু বলা বাকি আছে। তারা বিছানায় গড়িয়ে পড়ল, আলতো, ধীরে। ঠোঁট আর শরীর একে অপরের ভিতরেই খুঁজে নিচ্ছিল উত্তর।
সেই রাতে কেউ কিছু বলেনি। শুধু নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস মিশেছিল, নখ ছুঁয়ে গিয়েছিল পিঠে। ভালোবাসা সবসময় শব্দ চায় না, চায় উপস্থিতি।
সকালে অনিন্দিতা জানত, কিছু বদলে গেছে। এই শহরের অলিগলিতে তারা শুধু হেঁটেই যাচ্ছে না, নিজেদের জীবনের নতুন রাস্তা বানিয়ে ফেলছে—একটু বেশি কাছাকাছি থেকে।
পর্ব ৫
সকালে সূর্য উঠতেই অনিন্দিতার চোখ খুলে যায়। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে সাতটা ছুঁইছুঁই, অথচ আজ তার অফিস নেই। আজ বৃহস্পতিবার, ছুটির দিন, কিন্তু শরীর অভ্যস্ত রুটিনে নিজেই জেগে যায়। পাশে তাকিয়ে দেখে ঈশান নেই। বালিশে তার ঘুমন্ত গন্ধ এখনো টিকে আছে—হালকা শ্যাম্পু, ঘামের মতো নরম উষ্ণতা আর শরীরের একধরনের গভীরতার গন্ধ।
রান্নাঘর থেকে হালকা চা ফুটছে—ঈশান।
ছেলেটা ঠিক যেন পুরনো দিনের চিঠির মতো—সবকিছু লিখে না, কিন্তু অনুভব করিয়ে দেয়।
“তুমি জেগে গেলে?” সে বলল, চায়ের কাপ হাতে নিয়ে।
“হ্যাঁ। তুমি এত সকালে উঠলে কেন?”
“তোমার জন্য চা বানালাম। আর… আজ একটা প্রজেক্ট জমা দিতে হবে। রাত্রে একটু বেশিই ভালোবাসা হয়েছিল, তাই আজ সকালটা ভারসাম্য রাখতে চাই।”
অনিন্দিতা হেসে ফেলল। হাসিটা নরম, কিন্তু ভেতরে কোথাও একটু হালকা ভয়।
ঈশান চা এগিয়ে দিল। তারপর কৌতূহলী চোখে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি আমাকে নিয়ে ভবিষ্যৎ ভাবো?”
এই প্রশ্নটা অনিন্দিতা প্রত্যাশা করেনি। অনেক কিছু ভেবেছে, অনেক হিসেব, অনেক না বলা কথা। কিন্তু এই প্রশ্নটা এত সরাসরি কেউ কখনও করেনি।
সে ধীরে বলল, “ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি না মানে না যে সেটা আমার মধ্যে নেই। তবে সেটা ভাবলেই ভয় পাই। আমি চাই না আমাদের এই মুহূর্তটা নষ্ট হোক ভবিষ্যতের শঙ্কায়।”
“তুমি আমাকে বিশ্বাস করো তো?”
“হ্যাঁ। একদম করি।”
“তাহলে আমাকে নিজের জীবনে একটা নাম দাও।”
“নাম?”
“মানে, আমি কী? বন্ধু? প্রেমিক? শরীরের আশ্রয়? নাকি একরকম দুঃসাহস?”
অনিন্দিতা চুপ করে থাকল। প্রশ্নটা সহজ, কিন্তু উত্তরটা সহজ নয়। সে জানে, ঈশান শুধুই একরকম সম্পর্ক নয়। তার মধ্যে ভালোবাসা আছে, শরীর আছে, নির্ভরতা আছে, আবার সেই নিষিদ্ধরকম এক অপূর্ণতা—যা সমাজে ‘চালাক মেয়ে’ বলে চিহ্নিত করে। অথচ সে জানে, এই ছেলেটা তাকে নিজের মতো করে ভালোবাসে, সম্পূর্ণ করে।
সে এক মুহূর্ত থেমে বলল, “তুমি আমার নিজের মতো—নামহীন, কিন্তু ছুঁয়ে থাকা।”
ঈশান একটু নীরব হয়ে গেল। তারপর বলল, “আমাকে নামহীন কোরো না, অ্যানি। যদি সমাজে আমার পরিচয় না থাকে, আমি কোথাও খুঁজে পাব না নিজেকে।”
এই কথাটা অনিন্দিতার বুকের ভেতরে ঢুকে গেল কাঁটার মতো। সত্যি তো—ঈশান যদি নিজের জায়গা না পায়, সে এই সম্পর্কটা কেবল তার শরীরেই সীমাবদ্ধ থাকবে না তো?
“তুমি চাও আমি আমার বন্ধুদের বলি তোমার কথা?” সে জিজ্ঞেস করল।
“না, আমি চাই তুমি একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বলো—‘আমি একজনকে ভালোবাসি, যে আমার থেকে ছোট, কিন্তু সমানভাবে প্রিয়।’ যদি সেটা করতে পারো, আমি নিশ্চিত আমি ঠিক জায়গায় আছি।”
অনিন্দিতা ধীরে মাথা নাড়ল। সে বুঝল, এই ভালোবাসা শুধু গোপন ঘর আর আলতো স্পর্শে আটকে থাকবে না। একদিন তাকে সামনে দাঁড়িয়ে বলতে হবে, চিৎকার করে নয়—শান্ত গলায়, নিজের গায়ে বিশ্বাস রেখে।
সেই সন্ধ্যায় তারা একসাথে গিয়েছিল এক পুরনো বইয়ের দোকানে। বইয়ের তাক ঘেঁটে ঈশান একটা কবিতার বই বের করল—জীবনানন্দের।
পড়ে শোনাল—
“আমার ভিতরে তুমি জেগে ওঠো ধীরে
জ্যোৎস্নার মতন, অথচ নিঃশব্দে।”
অনিন্দিতা জানে, সে এই প্রেমে পড়েছে। ধীরে, নিঃশব্দে।
সেই রাতে তারা আবার একসাথে শুয়েছিল। কিন্তু আজ অন্যরকম। আজ আর শুধু তৃষ্ণা নেই, আজ আছে একরকম বোঝাপড়া, একরকম নাম দেওয়ার চেষ্টা।
ঈশান তার গায়ে হালকা করে বলল, “আজ তুমি কাঁপছো?”
“না, আমি বুঝছি। আমি আর পালাতে চাই না।”
“তবে বলো, আমি কে তোমার কাছে?”
অনিন্দিতা আলতো করে বলল, “তুমি আমার প্রাপ্তি—যেটা বয়স নয়, সাহস দিয়েছে।”
ওরা সেদিন চুপচাপ জড়িয়ে ঘুমোলো। জানল, এখনো অনেকটা পথ বাকি। এখনো এই শহর, এই সমাজ, এই ভয়—সব আছে। কিন্তু তার মধ্যেও, কোনো এক ভোরে, যখন চোখ খুলে দেখবে ঈশানের মুখ—তখন হয়তো নিজের নামটা নতুন করে চিনে নেবে।
পর্ব ৬
ঈশান তিন দিন ধরে দেখা দেয়নি। না ফোন, না মেসেজ।
অনিন্দিতা প্রথম দিনটা ভেবেছিল, হয়তো কাজে ব্যস্ত। দ্বিতীয় দিন নিজের মনকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল—আজকাল তো কেউই প্রতিদিন যোগাযোগ করে না। তৃতীয় দিনে, যখন দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হল, তখন তার ভেতরের চিন্তারা আর কথামতো চলতে রাজি নয়। বারান্দার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল সে, শহরের দিকে তাকিয়ে—যেখানে আলো জ্বলে, কিন্তু কারো মুখ স্পষ্ট নয়।
ঈশান বলেছিল, “আমি হারিয়ে গেলে কী করবে তুমি?”
সে বলেছিল, “তুমি হারাবে না। তুমি আমার গন্ধে লেগে থাকবে।”
আজ মনে হচ্ছে, সেই গন্ধও মুছে যাচ্ছে।
রাতে চা বানাতে বানাতে সে নিজেকে বলল—নাহ, ফোন করবে না। যে মানুষ নিজে থেকে ফিরে আসে না, তাকে ডেকে ফেরানো চলে না।
কিন্তু তারপরেই বেল বাজল।
দরজা খুলতেই ঈশান। চোখের নিচে কালি, চুল এলোমেলো, ঠোঁট ফাটল ধরা। কাঁধে ব্যাগ, হাতে একটা সাদা গোলাপ।
“সরি…”
এটাই ছিল প্রথম কথা।
“তিন দিন তুমি কোথায় ছিলে?” গলা সোজা, কিন্তু কাঁপছে ভিতরটা।
“বাড়ি গেছিলাম… হঠাৎ… মা জানতে পারল।”
“সব?”
“সব না, কিছু। একজন আছে, বয়সে বড়। আমি তাকে ভালোবাসি। মা প্রথমে বিশ্বাসই করতে চায়নি, তারপর অনেক কথা হল। সে বলল, এটা একরকম ভুল। তুমি বিভ্রান্ত।”
“আর তুমি?”
“আমি চুপ করেছিলাম। শুধু বললাম, আমি যদি বিভ্রান্ত হই, তবে সেই বিভ্রান্তিতেই আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি। মা এখনো মানেনি। কিন্তু আমি জানি, তুমি যদি না থাকো, আমি আর আমি থাকবো না।”
অনিন্দিতা কিছু বলল না। শুধু চায়ের কাপটা এগিয়ে দিল।
ঈশান বসল, চা খেল, তারপর ধীরে ধীরে তার কাঁধে মাথা রাখল। “আমি তোমার গন্ধ মিস করেছি, অ্যানি। এই চুলে যে হালকা নারকেল তেলের গন্ধ থাকে, এই কুশনের একপাশে যে বালিশটা একটু নরম, এই চুপচাপ সন্ধ্যেটা—সব কিছু মিস করেছি। আর জানো? আমার মনে হয়েছে, আমি যদি তোমার কাছে ফিরতে না পারতাম, তবে আর কোনো প্রেমে নিজেকে খুঁজে পেতাম না।”
অনিন্দিতা হাত ছুঁয়ে বলল, “তুমি পালিয়ে গেছিলে?”
“না, আমি ভয় পেয়েছিলাম। আমাদের বয়সের ব্যবধানটা যেন কাঁটার মতো বিঁধে থাকছিল চারপাশে। মা বলেছিল, ‘তুমি আজ যা ভাবছ, দশ বছর পরেও কি তাই থাকবে?’ আমি জানি না, কিন্তু আমি এটুকু জানি—তুমি ছাড়া আমি ভাবতেই পারি না।”
সে রাতে ওরা আবার কাছাকাছি এল। কিন্তু এবার আলিঙ্গনে রাগ ছিল, অভিমান ছিল, আবার ছিল ক্ষমা চাওয়ার রকমফের।
অনিন্দিতা ঈশানকে কাছে টেনে বলল, “তুমি জানো, আমি কী ভয় পাই?”
“কি?”
“যদি তুমি একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখো, তুমি আর আমাকে চাও না। যদি তুমি ভাবো, আমার গায়ে বয়সের রেখা পড়ে গেছে, আমার কথা বোরিং, আমার শরীর আর তোমার আগুন ছুঁতে পারে না…”
ঈশান তার ঠোঁটে আঙুল রাখল।
“আমি তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম, তখনো তুমি বয়সে বড় ছিলে। কিন্তু জানো? আমার চোখে তুমি কোনোদিনও বয়স্ক নও। তুমি সেই গল্পটা, যেটা সবাই পড়ে না—কারণ পড়তে সাহস লাগে। আমি সেই সাহস করি।”
তারপর সে আলতো করে অনিন্দিতার ব্লাউজের হুক খুলতে খুলতে বলল, “এই দাগগুলো, এই শরীরের প্রতিটি রেখা—আমি ভালোবাসি, কারণ তারা বলে তোমার গল্প। তোমার রাত্রি, তোমার প্রতীক্ষা, তোমার ভালোবাসা।”
বিছানায় ওরা একে অপরের ভিতরে নিজেকে খুঁজে নিল। ধীরে, অনেকটা শব্দহীন ভালোবাসায়, যেখানে শরীর আর মনের মাঝখানে আর কোনো ফাঁক রইল না।
সকালে ঈশান ঘুম থেকে উঠে বলল, “তুমি আমার নাম দাও।”
“তুমি তো ঈশান।”
“না, তোমার কাছে আমি কী? অ্যানি, এবার বলো। আমি শুধু শরীর না, আমি তোমার জীবনের ঠিক কোন জায়গাটা জুড়ে আছি?”
অনিন্দিতা একটু ভেবে বলল, “তুমি আমার সাহস। আমি যতদিন বাঁচব, তোমার স্পর্শে আমি ভয়কে জয় করতে পারব।”
ঈশান হেসে উঠল, “তাহলে আমি তুমিই—তোমারই এক অসম্পূর্ণ ছায়া, যা তোমাকেই পূর্ণ করে।”
সেই মুহূর্তে, জানালার কাঁচে সূর্য উঠছিল। গন্ধটা ফিরে এসেছিল—ভেজা শাড়ির, ঘামে ভেজা প্রেমের, আর হালকা অনুতাপের।
তাদের প্রেম হয়তো অসময় জন্মেছে, কিন্তু তারা জানে, এই ভালোবাসা কোনোদিনও সহজ হবে না।
তবুও তারা ছিল… একটু বেশি কাছাকাছি।
পর্ব ৭
বৃষ্টি নামে যেদিন, কলকাতার রাস্তাগুলো যেন বেশি খালি লাগে। ট্র্যাফিক কমে যায়, মানুষ তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরে, আর ক্যাফেগুলোর কোণায় জমে থাকে চুপচাপ চা আর ঠোঁট ছোঁয়া কিছু না বলা গল্প।
সেই রকম এক বিকেলে অনিন্দিতা একা বসে ছিল। ঈশান আসবে বলেছিল, কিন্তু দেরি হচ্ছে। তার ফোনেও সাড়া নেই। ব্যাগে রাখা বইটা খুলে সে পড়ার চেষ্টা করছিল, কিন্তু চোখ বারবার কাঁচের বাইরে বৃষ্টির রেখার দিকেই চলে যাচ্ছিল।
তখনই দরজা ঠেলে ঢুকল ঈশান—চুল ভেজা, মুখে এক অদ্ভুত অভিব্যক্তি। চোখে ক্লান্তি, আর ঠোঁটে অস্বস্তির ছাপ।
“তুমি তো ভিজেই গেলে,” অনিন্দিতা বলল, কাপ এগিয়ে দিতে দিতে।
“ছাতা আনিনি,” ঈশান বলল, বসে পড়ে।
“তুমি কিছু বলছো না কেন?”
“কিছু বলার নেই হয়তো।”
অনিন্দিতা বুঝতে পারল, আজকের ঈশান কেমন যেন অন্যরকম। শরীরে তার একই গন্ধ, কাঁধে সেই চেনা ভর, কিন্তু চোখের মধ্যে একটা অচেনা ধোঁয়া।
চুপচাপ কিছু সময় কেটে গেল। চা ঠান্ডা হয়ে এল।
“বলো, কী হয়েছে?”
ঈশান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আজ মা আমাকে একজন মেয়ের সঙ্গে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। বলল, এবার বিয়ের কথা ভাবতে হবে। আমি কিছু বলিনি। শুধু বসে ছিলাম, শুনছিলাম। সেই মেয়েটা খুব স্মার্ট, খুব স্বাভাবিক। কিন্তু আমি কিছুতেই খাপ খাওয়াতে পারিনি। কারণ মাথায় শুধু তোমার কথা ঘুরছিল।”
অনিন্দিতা চুপ। একটা অদ্ভুত দোলাচল তার ভেতর। ঈশান বলল, “তুমি চাও আমি বলি মাকে, আমি কাউকে বিয়ে করব না, কারণ আমি একজনকে ভালোবাসি, যে আমার চেয়ে বারো বছর বড়?”
“আমি চাই না তুমি কিছু করো আমার জন্য যা তুমি নিজে থেকে না চাও।”
“তবে তুমি চাও না, আমি এই সম্পর্কটাকে সামনে আনবো?”
“আমি চাই না তুমি জোর করে একটা যুদ্ধ লড়ো, যার জন্য তুমি এখনও তৈরি নও।”
ঈশান দাঁত চেপে বলল, “তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না?”
“বিশ্বাস করি, তাই তোমাকে আটকাই না। জানি তুমি নিজে থেকেই ফিরবে।”
তবু কথাগুলোর মধ্যে ভিজে জল জমে থাকল—যা মুছে যায় না, শুকোয় না।
ঈশান উঠে দাঁড়াল, “আমি ভাবতে পারছি না আজ কিছু। একটু সময় দাও। আমি নিজেকে নিয়ে ভাবছি। একদিকে তুমি, অন্যদিকে আমার পরিবার, ভবিষ্যৎ—সব একসাথে এসে দাঁড়িয়েছে আমার কাঁধে।”
অনিন্দিতা উঠে দাঁড়িয়ে তার মুখের দিকে তাকাল। “তুমি যেতে চাও?”
“না, কিন্তু থাকাটাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কারণ আমি যদি আজ কিছু না বলি, কাল হয়তো আর বলার সুযোগ থাকবে না।”
“তুমি কি এই সম্পর্কটা শেষ করতে চাইছো?”
“না, আমি চাই এটাকে একটা রূপ দিতে। ছায়া নয়, বাস্তব হোক। আর সেটা করতে গিয়ে যদি কিছু ভেঙে পড়ে, তাহলে তার দায় আমি নেব।”
অনিন্দিতা তাকে জড়িয়ে ধরল। চোখে জল এসেছিল তার, কিন্তু শব্দ হয়নি। শুধু শরীর জানাল, এই মানুষটা চলে গেলে, আর কেউ আসবে না যে এতখানি জায়গা নিয়ে তার জীবনটা পূর্ণ করতে পারবে।
ঈশান তার কপালে চুমু খেয়ে বলল, “আমি যাচ্ছি, কিন্তু আবার ফিরব। যদি তুমি আজও অপেক্ষা করো, আমি এসে দাঁড়াব তোমার দরজায়। নিজের নামে।”
সেদিন রাতটা ভীষণ দীর্ঘ ছিল। অনিন্দিতা একা ছিল, জানলার পাশে বসে, বুকের মধ্যে একটা ভার নিয়ে।
বৃষ্টি পড়ছিল… যেমন পড়ে কোনো সম্পর্ক শেষ হওয়ার রাতে, অথবা নতুন কিছু শুরু হওয়ার আগে।
সে জানে না, ঈশান ফিরবে কিনা।
কিন্তু সে জানে, ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, তবে শব্দ না থাকলেও স্পর্শ ফিরেই আসে।
পর্ব ৮
অনিন্দিতা আজকাল আর কাউকে কিছু বোঝাতে চায় না। ফোন অফ করে রাখে না ঠিক, কিন্তু ভলিউম মিউট। কেউ কল করলে বুঝতে পারে, কিন্তু ধরে না। ঘরের কোণায় রাখা বইগুলোর পাতা ওল্টাতে গিয়ে মন পড়ে যায় জানালার বাইরে। সেই বারান্দা—যেখানে ঈশান দাঁড়িয়ে বলেছিল, “আমি যদি নিজেকে খুঁজি, সেটা তোমার চোখে।”
এখন সেই চোখে কেবল একরাশ জ্যোৎস্না পড়ে, কিন্তু কোনো মুখ দেখা যায় না।
তিন সপ্তাহ কেটে গেছে। না কোনো ফোন, না কোনো খোঁজ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষ্ক্রিয়, বন্ধুদের কাছেও কোনো খবর নেই।
একবার ভেবেছিল নিজে ফোন করবে। তারপর থেমে গেছে। সম্পর্কের কিছু কিছু মুহূর্ত থাকে—যেখানে অপেক্ষাই একমাত্র প্রমাণ, যে ভালোবাসা ছিল সত্যি।
রাতে অনিন্দিতা শুয়ে পড়ে অন্ধকার ঘরে। হঠাৎই ঘরের বেল বাজে। প্রথমে ভাবে ভুল শুনেছে। তারপর আবার…
ধীরে দরজা খোলে।
ঈশান।
চোখের নিচে ক্লান্তি, মুখে একটা কঠিন অভিব্যক্তি। কিন্তু সে হাসে—সেই পুরনো হাসি, যেটা অনিন্দিতা এতদিন ধরে শুধু মনে মনে রেখেছে।
“তুমি?”
“হ্যাঁ। ফিরে এলাম।”
“এতদিন কোথায় ছিলে?”
“নিজের সঙ্গে। যুদ্ধ করছিলাম—তোমার সঙ্গে না, আমার নিজের সঙ্গে।”
অনিন্দিতা চুপ করে তাকিয়ে থাকে। চোখ জ্বলে উঠেছে, কিন্তু জল গড়ায় না।
ঈশান ব্যাগ নামিয়ে বলে, “আমি মাকে বলেছি। সব। নাম, বয়স, সম্পর্ক—সব। মা চুপ করে শুনেছে। শেষে বলেছে, ‘তুমি যদি নিশ্চিত হও, তাহলে আমাকে আর কিছু বলার নেই।’ এটা না বলা সম্মতির মতো।”
অনিন্দিতা ধীরে বলে, “তুমি নিশ্চিত?”
“তোমাকে জড়িয়ে না ধরলে আমার দিন শেষ হয় না। তোমার শরীরের গন্ধে আমি ঘুমাতে পারি। তুমি ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ, আর এটা আমি মেনে নিয়েছি। তুমি যদি না চাও, আমি আর এক পা এগোবো না। কিন্তু যদি চাও, তাহলে আজ, এই রাতেই আমি তোমার পাশে দাঁড়াতে চাই—আমার নামে, তোমার চোখের সামনে, সব সত্যি করে।”
এই কথাগুলো এমনভাবে বলা, যেন এটাই ঈশানের প্রস্তাব—নাম ছাড়া একরকম বিয়ে, গোপন না থাকা একরকম প্রকাশ।
অনিন্দিতা কিছু বলে না। শুধু ধীরে এগিয়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে।
চোখ বন্ধ করে বলে, “তুমি খুব দেরি করেছো।”
“তবুও এসেছি।”
“তাই এবার আমি তোমাকে ছাড়তে চাই না।”
ওরা একসাথে বিছানায় যায়। কিন্তু আজ আর আগের মতো শুধু শরীরের খিদে নেই। আজ আছে নতুন করে একে অপরকে পাওয়ার তাগিদ। ঈশানের ঠোঁট অনিন্দিতার কপালে, ঘাড়ে, বুকে—এভাবেই বলে তার প্রতিজ্ঞা। আর অনিন্দিতা শরীরের প্রতিটি ছোঁয়ায় বিশ্বাস করে, ঈশান সত্যি ফিরেছে—নামসহ, ইচ্ছেসহ, দায়িত্বসহ।
“তুমি জানো,” অনিন্দিতা বলে ফিসফিস করে, “তুমি না ফিরলে আমি হয়তো ভালো থাকতাম… কিন্তু আর নিজেকে খুঁজে পেতাম না।”
“তাহলে আজ থেকে আমরা দুজন দুজনকে খুঁজে চলি,” ঈশান বলল, “প্রতিদিন, নতুনভাবে। নিজের নামে, একসাথে।”
রাতের অন্ধকারে শহর ঘুমিয়ে পড়েছিল, কিন্তু ওদের ঘরে আলো জ্বলছিল—চুপচাপ, টানা জেগে থাকা প্রেমের আলো।
পর্ব ৯
রাত যত গভীর হয়, মন তত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বালিশে মাথা রাখলে শরীর যে নরম আর ক্লান্ত, সেটা বোঝা যায়, কিন্তু মনের গোপন কোণগুলো তখন খুলে বসে। অনিন্দিতা আর ঈশান একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিল অন্ধকার ঘরের ভেতরে। কোনো আলো নেই, তবুও তারা দেখতে পাচ্ছিল। শরীর দিয়ে নয়—ভেতরের সেই চেনা স্পর্শে।
“তুমি জানো তো,” অনিন্দিতা ফিসফিস করে বলে, “আমার মনে হয়, আমি তোমায় প্রথমবার চা খেতে দেখে প্রেমে পড়েছিলাম। এতখানি আগ্রহ আর স্পর্শ, যেন প্রতিটা চুমুক তোমার মধ্যে ঢুকে যায়।”
“আর আমি?”
“তুমি? তুমি আমার শাড়ির খোঁচা ধরে টেনেছিলে। আমি ভেবেছিলাম, তুমি হয়তো চট করে চলে যাবে। কিন্তু তুমি ঠিক থেকে গেলে। সেই থাকার দায়বদ্ধতাই তোমায় আলাদা করেছে।”
ঈশান উঠে বসে। তার চোখে হালকা লালচে রেখা—জেগে থাকা, ভাবনা, আর অস্থিরতা সব মিলিয়ে।
“তুমি কি জানো, অনিন্দিতা, আমার বন্ধুরা সবাই বলেছে, আমি একরকম সাহস করছি। একটা এমন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখছি, যা অনিশ্চিত। তারা বলে, তুমি একদিন ক্লান্ত হয়ে যাবে। আমার শৈশবের মতোই ফিকে হয়ে যাবে।”
“তুমি কী বলেছো?”
“বলেছি, শৈশব ফিকে হতে পারে, কিন্তু তার গন্ধ চলে না। তুমি আমার শৈশব না, তুমি আমার পরিণতি। এই শহরে সব ছেলেরা ভালোবাসা খোঁজে শরীরে, আর আমি ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছি তোমার অভিমানী চুপ করে থাকায়।”
অনিন্দিতা হাসে। তারপর ধীরে ঈশানকে টেনে আনে নিজের বুকে। “তোমাকে এখন শুধু রাখার জায়গা দরকার, নাম নয়। সমাজের শব্দগুলোকে আমিও একসময় পাত্তা দিয়েছিলাম, এখন আর দিই না।”
“তুমি কীভাবে পারো?”
“কারণ আমি বেঁচে থাকার চেয়ে ভালোবাসতে শিখেছি আগে। সেই ভালোবাসা বয়স, ধর্ম, লিঙ্গ কিছুই মানে না। শুধু চায়, থাকো।”
ঈশান তখন তার বুকে মুখ রেখে একটানা শ্বাস নিচ্ছে। যেন সেই স্পন্দন তার নিজেদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাইছে।
সেই রাতে তারা কথা না বলে, শুধু ছুঁয়ে ছিল একে অপরকে। স্পর্শে, জ্যোৎস্নায়, দমবন্ধ করা নীরবতায়।
চোখে চোখ রাখা কোনো চুক্তির চেয়ে বেশি দৃঢ়—তারা সেই চুক্তি করেছিল।
সকাল হতেই ঈশান অনিন্দিতার জন্য চা বানাল। কিন্তু এবার টেবিলে দুই কাপ নয়—একটা কাপের পাশে রাখা ছোট্ট নোটে লেখা ছিল—
“তোমার চায়ের স্বাদেই আমি নিজের নাম খুঁজে পেয়েছি।”
অনিন্দিতা তাকিয়ে দেখল, ঈশান একরকম নিশ্চিন্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়, সূর্য উঠছে পেছনে। তার কাঁধে এখন আর শুধু যুবকের জেদ নয়, প্রাপ্তবয়স্ক প্রেমিকের দায়িত্ব।
সে জানে, ঈশান বদলে গেছে। তারা একসাথে আছে, সমাজের ভাষায় না হোক, নিজেদের ভাষায়।
তারা দুজনে বেরিয়ে পড়ে শহরের রাস্তায়। আজ আর কারো চোখ তাদের থামাতে পারে না। আর কোনো লুকিয়ে রাখা নেই, কোনো প্রশ্ন নেই।
ট্যাক্সিতে বসে অনিন্দিতা তার কাঁধে মাথা রাখে। ঈশান বলে, “আমরা কি তখনও অসমবয়সী যখন ভালোবাসা সমান ভাগে ভাগ হয়?”
অনিন্দিতা হাসে। “তুমি এখন আমারই বয়সের—যেখানে ভালোবাসা একসাথে জেগে ওঠে, আর কোনো ফারাক থাকেনা। আমরা এখন কেবল… একে অপরের।”
শহর তাদের চেনে না। কিন্তু তারা চেনে একে অপরের ত্বকের নিচের সেই নীরব, সাহসী, নামহীন ভালোবাসা—
যা আজ, অনেক কথার পর,
একটু বেশি কাছাকাছি।
পর্ব ১০
ঈশান আর অনিন্দিতা এখন আর একসাথে থাকে না প্রতিদিন, কিন্তু তাদের মধ্যে কোনও দূরত্ব নেই। এই শহরে তারা আলাদা বাড়িতে জেগে ওঠে, আলাদা বিছানায় ঘুমোয়, কিন্তু একটা একান্ত জায়গা তৈরি হয়েছে—যেখানে কেউ পৌঁছাতে পারে না, এমনকি বাস্তবও না।
অনিন্দিতার ফ্ল্যাটের একচিলতে বারান্দা আর ঈশানের সেই পুরনো DSLR—এই দুটোর মাঝখানে তৈরি হয়েছে তাদের পৃথিবী। তাতে না আছে বয়সের হিসেব, না সামাজিক স্বীকৃতি—আছে কেবল কিছু গল্প, কিছু স্পর্শ, আর অদ্ভুত নির্ভরতা।
সেদিন ছিল অনিন্দিতার জন্মদিন। পঁইত্রিশ ছুঁয়ে ছত্রিশে পা। ফোন অফ রেখেছে, ফেসবুকে পোস্ট দেয়নি, অফিস ছুটি নিয়েছে। চুপচাপ বসে আছে জানালার পাশে। পুরোনো অভ্যাস—বৃষ্টির দিনে মন খারাপ আর জন্মদিনে নিঃসঙ্গতা।
তখনই দরজায় কড়া নাড়ল কেউ।
খুলতেই ঈশান। পরনে সাদা শার্ট, হাতে বইয়ের প্যাকেট, চোখে সেই পুরনো, নরম বিশ্বাস।
“তুমি তো বলেছিলে আসবে না,” অনিন্দিতা মৃদু হেসে বলল।
“আমি তো ঠিক বলি না সবসময়। আমি আসলে যেটা অনুভব করি, সেটা করে ফেলি।”
“তুমি কী এনেছো?”
“নিজেকে। আর… তোমার জন্য একটা নতুন চমক।”
সে ব্যাগ থেকে বের করল একটা খাম। খুলতেই অনিন্দিতা দেখে—একটা ফটোগ্রাফি ওয়ার্কশপের চূড়ান্ত তালিকা। ঈশান সেখানে অনিন্দিতাকে অতিথি বক্তা হিসেবে নাম দিয়েছে—‘বর্ণনাকারী’, যার শব্দেরা ছবিকে ব্যাখ্যা দেয়।
“তুমি আমাকে এভাবে নাও?”
“তুমি আমার সব গল্পের ভাষা। তুমি না থাকলে আমি কিছুই সম্পূর্ণ করতে পারি না।”
সেই রাতে ওরা আবার একসাথে থাকল। শরীর তখন আর শুধুই শরীর ছিল না। তা যেন পুরনো অভ্যেসের মতো, আলতোভাবে ফিরে পাওয়ার মতো।
ওরা বিছানায় গড়িয়ে পড়ল, আর ঈশান তার পেটের উপর হাত রেখে বলল, “তুমি জানো, এই শরীরটাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কারণ এখানে আমি ঘুমোতে পারি, কান্না করতে পারি, নিজের মতো করে থাকতে পারি।”
অনিন্দিতা বলল, “তুমি যখন বলেছিলে, তোমার জন্য আমি সাহস, তখন আমি ভেবেছিলাম, ভুল বুঝছো। এখন বুঝি, সেই সাহস আসলে ভালোবাসার চেয়ে বড় কিছু নয়।”
ঈশান চুপ করে তার ঠোঁটে ঠোঁট রাখল। এবার আর জোর নেই, নেই তাড়াহুড়ো—শুধু আছে থাকা।
ঘরটা একরকম চুপচাপ। দেওয়ালে ঈশানের তোলা কয়েকটা ছবি—অনিন্দিতার মুখ, জানলার পাশে দাঁড়ানো তার ছায়া, রোদ মাখা চোখের তলা।
সকালে ঘুম ভাঙতেই ঈশান আর নেই। টেবিলের উপর একটা ছোট চিরকুট রাখা—
“তোমার সকাল হয়ে উঠি প্রতিদিন, অথচ তোমার ছায়ায় থেকেও কেউ যেন জানে না আমার নাম।
তবে আমি জানি, আমি কে—তোমার। শুধু তোমার।”
অনিন্দিতা জানে, ঈশান এখন আর পালাবে না। সম্পর্কটাকে নিয়ে আর কোথাও লুকিয়ে থাকবে না। তারা একসাথে আছে, নিজেদের মতো করে। হয়তো এখনো সমাজ কিছু বলে না, হয়তো ভবিষ্যতে কিছু বলবে।
কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না।
তারা একসাথে…
তার মাঝখানে, নামের ঊর্ধ্বে, সাহস আর নরম ভালোবাসায় গাঁথা—
একটু বেশি কাছাকাছি।
—সমাপ্ত।