Bangla - প্রেমের গল্প

একটি বিছানার গল্প

Spread the love

তিথি সেন


অভ্যস্ত দুপুর যেন প্রতিদিন একইভাবে ফিরে আসে অর্পিতা আর অনির্বাণের জীবনে—একটি ছকে বাঁধা নিঃশব্দ যাপন। দুপুরটা শহরের অন্যান্য মধ্যবিত্ত দম্পতির মতোই নিস্তরঙ্গ; রান্নাঘর থেকে বের হওয়া মৃদু মসলার গন্ধ, দেয়ালে লেগে থাকা পুরনো ঘড়ির টিক টিক শব্দ, আর সামনের বারান্দা দিয়ে ঢুকে পড়া ক্লান্ত রোদের আলোয় অর্পিতা সেলাই করা কুশনের দিকে তাকিয়ে থাকে। আজ দুপুরে তার মনটা একটু ভারী। সে জানে না ঠিক কেন, কিন্তু কোথাও একটা শূন্যতা যেন জমে উঠেছে বুকের ভেতর, অথচ বাইরে থেকে সবকিছু ঠিকঠাকই চলছে। অনির্বাণ অফিসে বসে ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রাখলেও, মন তার বেশিরভাগ সময়ই এদিক-সেদিক ছুটে বেড়ায়। একসময় যে ঘর ছিল তাদের প্রেমের আস্তানা, এখন তা হয়ে উঠেছে নিছক রুটিনের মিলনক্ষেত্র—একটা ছায়াঘেরা দুপুড়, যেখানে আলাপ হয় কম, অথচ অজস্র অনুভূতি বাতাসে উড়ে বেড়ায়।

দুপুরে খাওয়ার পর অর্পিতা ড্রইংরুমে শুয়ে পড়েন একটুখানি। ভেতরের ঘরে অনির্বাণ তখনো অফিসের মিটিংয়ে ব্যস্ত, অথচ দুজনের মাঝখানে যে দেয়াল, তা শুধু ইট-সিমেন্টে তৈরি নয়—বছরের পর বছর জমা হওয়া না বলা কথা, উপেক্ষিত ইশারা, আর নিঃশব্দ অভিমান দিয়ে তৈরি। দুজনেই বোঝেন সম্পর্কটা বদলে গেছে, কিন্তু কেউ মুখ ফুটে কিছু বলেন না। বরং সেই বদলকে ঢেকে রাখেন ‘ব্যস্ততা’, ‘দায়িত্ব’, আর ‘সময় নেই’ জাতীয় ছাঁদে। একসময় যেই অর্পিতা সকালে উঠে অনির্বাণকে না দেখে ব্যাকুল হতেন, আজ সেই একই মানুষ সকালে তার পাশে ঘুমন্ত অনির্বাণকে দেখে আর কোনো রোমাঞ্চ অনুভব করেন না—শুধু একটা দৈনন্দিন স্বস্তি বোধ করেন।

অন্যদিকে অনির্বাণের দিন কাটে ক্লান্তিকর কল, কাগজপত্র, আর কম্পিউটারের আলোয় চোখ গরম করে। মাঝেমধ্যে মিটিংয়ের মাঝে সে একটা বিরতি নেয়, আর চোখ বুজে পুরনো দিনের কথা ভাবে—যখন অর্পিতা তাকে চায়ের কাপ হাতে এগিয়ে দিত, আর হালকা গলায় বলত, “আজ শুধু আমাদের জন্য বানালাম।” সেই স্বরটা এখন আর শোনা যায় না। অর্পিতা এখন চা দেন, কিন্তু কোনো বিশেষত্ব থাকে না তাতে। শারীরিক দূরত্বটা তাদের জীবনের ছোট ছোট মুহূর্তগুলোকে আড়াল করে দিয়েছে। বিছানা তারা ভাগ করে নেয়, তবু স্পর্শ খুব কম আসে। রাতে পাশাপাশি শুয়ে থাকেন, কিন্তু কারও হাত আর কারও কাঁধে পড়ে না। কেউ ঠান্ডা লাগলে নিজেই চাদর টেনে নেয়, কেউ কষ্ট পেলে নিজের ভেতরে গুটিয়ে যায়—যেন সেই মানুষটি আর ঘরের কেউ নয়, শুধুই সহবাসকারী।

সেই দুপুরে, ঠিক খাবার পরে, অর্পিতা রান্নাঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাইরে একটা পাখি ডেকে উঠেছিল, অনেকটা পুরনো সুরের মতো। তার মনে হচ্ছিল, কেউ যেন তাকে ভেতর থেকে ডাকছে—না, কোনো মানুষ নয়, কোনো সময়কাল। সেই সময়, যখন তারা দুজনে একে অপরকে অবাক করত। অনির্বাণ হঠাৎ পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরত, আর অর্পিতা লজ্জা মেশানো রাগ দেখাত। আজকাল অনির্বাণ বাড়িতে থাকলেও আর পেছনে আসে না, আর অর্পিতাও কোনো জড়ানো চায় না। তবু সেই দুপুরে এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হয়েছিল, যদি সে আজ পেছন থেকে এসে হাত রাখে, তাহলে কি সে আবার তাকিয়ে হাসবে? না কি আরও দূরে সরে যাবে? এই প্রশ্নগুলো জমে ওঠে অর্পিতার চোখে, কিন্তু তার মুখে কোনো শব্দ আসে না। ঘরের ভেতর অনির্বাণ তখনও মিটিংয়ে কথা বলছে, তবে তার স্বরটা যেন কেমন ম্লান—যেন কেবল ডিউটি পালন করছে, তাতে আবেগ নেই।

এইভাবেই কাটে তাদের ‘অভ্যস্ত দুপুর’। নিঃশব্দ, নিস্তরঙ্গ, তবু এক অদ্ভুত রকমের ভারে পরিপূর্ণ। বিছানার চাদর, দেয়ালের রং, জানালার পর্দা—সব যেন এই দূরত্ব জানে। কেউ মুখ ফুটে কিছু বলে না, কিন্তু কেউ-না-কেউ শুনতে চায়। কেউ হয়তো আজ রাতে এগিয়ে আসবে, কেউ হয়তো একটুখানি হাসবে, বা একটুখানি কান্না লুকিয়ে রাখবে। অভ্যস্ততা তাদের আলাদা করেছে, তবু এই অভ্যস্ত দুপুরেই কোথাও একটা সম্ভাবনা জমে আছে—নতুন করে ফিরে আসার, নতুন করে ছুঁয়ে দেওয়ার, কিংবা নীরবতার ভেতর একটা শব্দ খোঁজার। সেই শব্দের প্রতীক্ষাতেই অর্পিতা চোখ বন্ধ করেন, আর অনির্বাণ জানেন না—এই দুপুরটা, হয়তো তাদের গল্পের প্রথম মোড়।

বৃষ্টি নামছিল হালকা করে, জানালার কাঁচে জলরঙের মতো আঁচড় কাটছিল অস্পষ্ট ফোঁটা। দুপুরটা কেমন যেন বিষণ্ণ, আর অর্পিতা আজ হঠাৎ করেই হুড়মুড় করে নামলেন স্টোররুমে, পুরনো ট্রাঙ্কটা খুঁজতে। ভেতরে ছিল একটা লাল কাপড়ের মোড়া — তার পুরনো ডায়েরিগুলো, যেগুলোকে বহুদিন স্পর্শ করা হয়নি। হাতে তুলতেই ধুলোর গন্ধে চোখে জল এসে যায়, কিন্তু একটা অদ্ভুত কৌতূহল তার বুকের ভেতর কাঁপিয়ে তোলে। মেঝেতে বসে ধীরে ধীরে একটার পর একটা পৃষ্ঠা উল্টিয়ে পড়তে থাকেন—সেই দিনগুলো, যখন অনির্বাণ তাকে প্রথম “চোখে চোখ রেখে” চিঠি দিয়েছিল, প্রথম সিনেমা দেখার দিন, কিংবা সেই অন্ধকার গলিতে হঠাৎ চুমু খাওয়ার মুহূর্ত। কী উন্মাদ ছিল সেইসব দিন! প্রতিটি শব্দে ছিল কাঁপুনি, প্রত্যেকটি বাক্যে ছিল প্রতিশ্রুতি, যা সময়ের সঙ্গে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। ডায়েরির পাতায় অর্পিতা নিজের লেখা এক জায়গায় আটকে যান—“আজ অনির্বাণের চোখে আমার জন্য যে তৃষ্ণা দেখলাম, তাতে ভয় লাগছে। আমি এমন করে কখনো দেখিনি।” এই লাইনটা পড়ে তার শরীর হালকা কেঁপে ওঠে। যে চাহনি তাকে তীব্র করে তুলত, আজ সেই চোখের দিকে তাকালেও যেন ফাঁকা লাগে।

অন্যদিকে অনির্বাণ তার অফিসঘরের ডেস্কে বসে, মিটিংয়ের বিরতিতে ফোনে ছবি খুঁজছিলেন। এক পুরনো ফোল্ডারে হঠাৎ চোখে পড়ে একটা রাতের ছবি—অর্পিতা একটা সাদা চাদর পেঁচিয়ে বিছানায় বসে আছে, চুল এলোমেলো, চোখে দুষ্টু হাসি। ছবির তারিখ দেখে চমকে ওঠেন—ঠিক তাদের বিয়ের ছয় মাস পরে, এক পাহাড়ি রিসর্টে তোলা। অনির্বাণের মনে পড়ে যায় সেই রাতের সবকিছু—হিমশীতল বাতাসের মধ্যে অর্পিতার শরীরের উষ্ণতা, কুয়াশায় মোড়া জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মুহূর্ত, আর তার দৃষ্টির গভীরতায় হারিয়ে যাওয়ার স্মৃতি। তিনি ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকেন বেশ কিছুক্ষণ, শব্দহীন। সেই রাতে কোনো মোমবাতি ছিল না, তবু চোখে আলো ছিল; কোনো সাজসজ্জা ছিল না, তবু শরীরে সৌন্দর্য ছিল। আজ এত বছর পরে, সেই শরীরই আছে, সেই মানুষটিও, কিন্তু আলো আর উষ্ণতা যেন কোথাও গায়েব হয়ে গেছে। ছবি দেখে হঠাৎ মনে হয়, এখন যদি সেই অর্পিতা এসে পাশে বসত, তিনি কি আবার তাকে আগের মতো ভালোবাসতে পারতেন?

সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরে এসে অর্পিতা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ডায়েরির কথা ভাবছিলেন। ডায়েরি আবার হাতের কাছে রাখা, কিন্তু প্রকাশ করার সাহস হয়নি। অনির্বাণ সোফায় বসে মোবাইল স্ক্রলে ছবি দেখে কিন্তু কারো সাথে ভাগ করে নেওয়ার কথা মাথায় আসে না। দুইজনেই আলাদা জগতে একসঙ্গে বাস করছে, আর নিজেদের ভেতরে জমে থাকা স্মৃতির আলপথে হাঁটছে একা একা। রাতে বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় অর্পিতা মনে মনে ভাবেন—ডায়েরির একটা পাতাও যদি অনির্বাণের সামনে পড়েন, তাহলে কি সে বুঝবে, তাকে হারানো শুরু হয়েছে তখন থেকেই যখন সে অর্পিতার চোখের ভাষা পড়া ছেড়ে দিয়েছিল? অনির্বাণ, পাশ ফিরে শুয়ে থেকেও ফোনে সেই ছবিটার দিকে বারবার তাকিয়ে ভাবেন—এই ছবির মেয়েটার পাশে আজ এই মহিলা শুয়ে, অথচ কেউই কাউকে চেনে না, ছুঁয়েও না। শারীরিকভাবে তারা দুজনেই কাছাকাছি, কিন্তু মানসিক দূরত্ব যেন আলপথে ফেলে রাখা পায়ের ছাপ—একবার খুঁজতে গেলে আর শেষ পাওয়া যাবে না।

রাতটা কেটে যায় নিঃশব্দে। কেউ কিছু বলে না, কেউ জিজ্ঞেস করে না, কেউ ভাগ করে নেয় না পুরনো অনুভবের গল্প। তবু দেয়ালে যেন জমে ওঠে সেই না-বলা কথা, সেই অস্পষ্ট আকাঙ্ক্ষা—একটা পুরনো প্রেমের ছায়া, যেটা এখন আর চোখে দেখা যায় না, কেবল অনুভবে ভেসে ওঠে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে অর্পিতা ডায়েরিটা আবার লুকিয়ে রাখেন ট্রাঙ্কে, ঠিক যেমনভাবে নিজের অভিমানগুলো লুকিয়ে রাখেন মনের গভীরে। আর অনির্বাণ, ফোন থেকে ছবিটা মুছে ফেলেন না, কিন্তু সেটাও কারো সঙ্গে ভাগ করেন না। এইভাবে জমে ওঠে দেয়ালের নৈঃশব্দ্য—স্মৃতি, আকাঙ্ক্ষা, অপরাধবোধ আর একটুখানি আশা মিশিয়ে, যা হয়তো একদিন ফেটে পড়বে, অথবা চিরকাল আড়ালে থাকবে। দুইজনেই জানেন, পুরনো প্রেম ফিরে আসে না আগের মতো করে, তবে সেই প্রেমের ছায়া একদিন হয়তো আবার তাদের এক করে দিতে পারে, যদি কেউ আগে কথা বলে।

সন্ধেটা ছিল একেবারেই সাধারণ—শহরের ট্র্যাফিকের শব্দ, পাশের ফ্ল্যাটে রান্নার কড়াচড়ার আওয়াজ, আর নিঃশব্দভাবে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরা অনির্বাণ। অফিস থেকে ফিরে দরজা খোলার শব্দে অর্পিতা রান্নাঘর থেকে একবার বেরিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু কোনো বিশেষ অভিব্যক্তি মুখে ছিল না—একটা অভ্যস্ত ‘ফিরলে?’ প্রশ্নের মতো। অনির্বাণ জুতো খুলে সোফায় বসে পড়েন, ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা পেছনে হেলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করেন কিছুক্ষণ। বাড়িটা যেন নিঃশব্দের খাঁচা হয়ে উঠেছিল, অথচ বাইরে শহর চিৎকার করছিল। হঠাৎ চোখ মেলেই অনির্বাণ খেয়াল করেন, অর্পিতা কিছু বলছে না, এমনকি সন্ধ্যাবেলার ছোটখাটো আলাপও নেই। তিনি ধীরে প্রশ্ন করেন—“আজ চুপচাপ কেন?” প্রশ্নটা হয়তো হালকা ছিল, কিন্তু শব্দের ভেতরে একটা দ্বিধা, একটা নরম হাত রাখার প্রচেষ্টা লুকিয়ে ছিল। অর্পিতা থমকে দাঁড়িয়ে থাকেন কিছুক্ষণ, তারপর রান্নাঘরের সিঙ্কে রাখা কাপ ধুতে ধুতে জবাব দেন—“আমরা তো আর কফি খেতে বসি না। আগে কতবার একসঙ্গে খেতাম, মনে আছে?”

সেই কথাটা যেন বাতাসে ধাক্কা খায়—মেঝেতে রাখা পুরনো মগের মতো, যেটা ধুলো জমে গেলেও ফেলে দেওয়া হয়নি। অনির্বাণ চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ। মনে পড়ে, একসময় সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে ফিরে অর্পিতা কফির মগ হাতে দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেন, আর অনির্বাণ তাকে চোখের চাহনিতে ‘ধন্যবাদ’ জানিয়ে ঠোঁটে এক চুমু দিতেন। তারা দুজনেই জানত, সেই কফির স্বাদ শুধু দুধ-চিনি বা কফিপাউডারে আসত না, আসত অপেক্ষা আর ভালোবাসা থেকে। এখন কফি হয়তো মাঝে মাঝে বানানো হয়, কিন্তু একসঙ্গে খাওয়া হয় না—একজন রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে চুমুক দেন, আরেকজন বিছানায় বসে ফোন স্ক্রল করেন। কথাটার ভেতরে লুকিয়ে ছিল কষ্ট, অভিমান, আর একটু নরম আবেদন—“আমাকে আরেকটু মনে করো, আগের মতো।” অনির্বাণ কোনো জবাব দেন না। একপলক অর্পিতার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নেন। ঘরের ভেতরে তখন শুধু প্রেসার কুকারের হালকা শিস, আর একটা অদৃশ্য শূন্যতা, যেটা কোনো শব্দে ভরাট হয় না।

রাতটা আরও নিঃশব্দ হয়ে আসে। খাওয়া-দাওয়া শেষে দুজনে নিজেদের রুটিনমাফিক বিছানায় যান। বাতি নিভে যায়, কিন্তু ঘুম নামে না। অন্ধকার ঘরে দুজনেই পাশাপাশি শুয়ে থাকেন, তবু কেউ কারো গায়ে হাত রাখেন না। শরীরের মাঝখানে এক হাত জায়গা খালি—সেখানে হয়তো একসময় চুমুর স্থান ছিল, এখন আছে দূরত্ব। অর্পিতা বিছানায় শুয়ে ছাদ দেখে, মনে মনে ভাবে, আজ যদি অনির্বাণ তাকে বলত—“চল, কফি খেতে বসি”—তাহলে সে কিছু না বলেই হাসত, মগ এনে দিত। অথচ অনির্বাণ কিছু বলেনি, শুধু জবাব না দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। তার নিজের মধ্যেও দ্বিধা—কি এমন হয়ে গেছে, যে শুধু কফির টেবিলটাই আর নেই? সেই টেবিলেই তো কতবার হাত ছুঁয়ে গিয়েছিল, কতবার ঠোঁটের ফাঁকে কথা আটকে ছিল, কতবার চোখে চোখ রেখে অপ্রকাশিত ভাষা লেখা হয়েছিল। আজ তা নেই, শুধু একই বিছানায় নিঃশ্বাসের শব্দ আছে—দুজনের, কিন্তু একে অপরের জন্য নয়।

ঘুম আসেনি সেই রাতে, তবে কেউ কাউকে জাগিয়ে তোলেনি। একটা রাত পার হলো, যেখানে কথার চেয়ে অনেক বেশি ছিল চুপ করে থাকা ইচ্ছেগুলো। অনির্বাণের মনে বারবার ভেসে উঠছিল অর্পিতার বলা সেই সরল বাক্য—“আমরা তো আর কফি খেতে বসি না।” এই বাক্যটাই যেন তাকে খোঁচা দিচ্ছিল, মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে সম্পর্কটা শুধু সঙ্গী থাকা নয়, একে অপরের সঙ্গে সময় কাটানোর ইচ্ছে থাকা। আর অর্পিতার বুকের ভিতর জমে থাকা কথাগুলো দুঃখ হয়ে নিঃশ্বাসে বের হচ্ছিল। সে জানে, এই সম্পর্কটা বাঁচানো এখনো সম্ভব, যদি দুজনেই চায়, যদি কেউ আগে হাত বাড়ায়। রাতটা শেষ হলো না, কেবল পাল্টে গেল নিঃশব্দ রাত থেকে এক ভারী ভোরে—যেখানে দুজনেই বুঝল, তারা কিছু হারাচ্ছে, ধীরে ধীরে, এক কাপ কফির অভাবে।

সন্ধ্যেটা ছিল অফিস পার্টির, অনির্বাণ জোর করে গিয়েছিলেন—মনচাইলেও নয়, না চাইলেও নয়, অনেকটা বাধ্য হয়ে। কর্পোরেট জগতে এমন সামাজিকতা এড়ানো মানে নিজের মুখে ‘অসংবেদনশীল’ তকমা লাগানো। পার্টির ভেতর এক সময় এক তরুণী সহকর্মী এসে পাশে দাঁড়ায়—চটপটে, স্মার্ট, চোখে ঝকঝকে আত্মবিশ্বাস। অনির্বাণ তাকে চিনতেন, মাঝে মাঝে মিটিংয়ে আলাপ হয়েছে, কিন্তু এভাবে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা হয় না প্রায়। কথার ফাঁকে মেয়েটি হালকা করে বলে ফেলে—“আপনাকে দেখে বোঝা যায় না আপনি ম্যারেড! এখনও বেশ হ্যান্ডসাম!” অনির্বাণ প্রথমে হেসে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কে জানে কোন অভ্যস্ত অভাব তার ভিতরে চাড়া দিয়েছিল, তিনি নিজেও হালকা ঠাট্টা করে জবাব দেন—“তাহলে তো কাজ চলছে!” মেয়েটি হেসে ফেলে, এবং আরেকটু ঘন হয়ে দাঁড়ায়। মদ্যপান বা বেহায়াপনা ছিল না তাতে, তবু মুহূর্তটা অনির্বাণের মনে কেমন একটা অস্থিরতা তৈরি করে। হয়তো কথার ভার নেই, কিন্তু ইশারার ওজন ছিল। তিনি জানতেন, এটা কোনো বড় কিছু নয়, তবু নিজের ঠোঁটের ওপর পড়া সেই হাসি, নিজের চোখের দৃষ্টিটা, সব কিছু নিয়ে ফেরার সময় নিজের কাছেই কেমন একটা অপরিচিত লজ্জা লাগছিল।

বাড়ি ফিরে অর্পিতার মুখে কোনো প্রশ্ন ছিল না, কেবল ‘চা দেবো?’ জাতীয় একটা বাক্য, যেটা কেবল অভ্যাসবশত বলা। অনির্বাণও মাথা নাড়িয়ে সায় দেন। কিন্তু তার ভেতরটা কেমন জানি পচন ধরেছে—হালকা, গোপন, কাঁটা ধরা রকমের। রাতে শোবার আগে বাথরুমে দাঁড়িয়ে মুখ ধোয়ার সময় আয়নায় নিজের চোখে তাকিয়ে মনে হয়, এই চোখে কি সেই পুরনো উন্মাদনা আর নেই? সেই চোখ দিয়েই তো একসময় অর্পিতাকে আকৃষ্ট করেছিল। আজ সেই চোখ অন্য কাউকে দেখে কী খুঁজছে? নিজের মুখটাও তার চেনা মনে হয় না। নিজেকে নিয়ে একধরনের অপরাধবোধে ভুগতে থাকেন—যেখানে কিছু করাও হয়নি, কিন্তু মনের মধ্যে কাঁটা গেঁথে গেছে। তার মনে হয়, সাত বছরের দাম্পত্য হয়তো তাকে এমন জায়গায় নিয়ে এসেছে যেখানে সে নিজেই নিজের কাছে অপরিচিত। সেই অপরিচিতিকে ছুঁয়ে দেখলে আরাম নয়, কেবল অস্বস্তি জন্ম নেয়। আর এই অস্বস্তি অনির্বাণের মতো একজন পরিণত পুরুষের বুকের ভেতর নিঃশব্দ কাঁপুনি তোলে।

অন্যদিকে, অর্পিতা তখন নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন আয়নায়। জামা খুলে চুল বাঁধতে গিয়ে হঠাৎ আয়নায় চোখ পড়ে যায়—নিজের শরীরকে যেন অন্য চোখে দেখতে শুরু করেন সেদিন। কিছুটা ক্লান্ত, কিছুটা বিবর্ণ, কিছুটা উপেক্ষিত। চোখে তার নিজের মুখের চেনা পরিচয় যেন হালকা ঝাপসা। স্তনদ্বয় ঝুলে পড়েছে কিনা, কোমরের গড়ন আগের মতো আছে কিনা, চামড়ায় কাঁটা পড়ে গেছে কিনা—এইসব কিছু দেখে তিনি নিজের মধ্যেই এক অদ্ভুত হতাশা অনুভব করেন। মনে মনে বলেন—“আমি কি এখনও ওর চোখে আকর্ষণীয়? নাকি শুধুই একজন সহধর্মিণী, বাড়ির একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষ?” তার বুকের মধ্যে হালকা খালি লাগতে থাকে, যেন সে নিজেই নিজেকে সন্দেহ করছে—নিজের নারীত্ব, সৌন্দর্য ও অস্তিত্বকে। একসময় যে শরীর অনির্বাণ একা হতে না দেখলে অস্থির হতো, আজ সেই শরীর বিছানায় এসে পড়ে থাকলেও সে আর স্পর্শ করে না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অর্পিতা আর নিজেকে ভালোবাসতে পারেন না, কেবল একটা ফিকে হয়ে যাওয়া সংস্করণ মনে হয় তার।

রাতে বিছানায় এসে দুজনেই নিঃশব্দে শুয়ে পড়েন। কেউ কোনো কথা বলে না। মুখ ঘুরিয়ে ঘুমানোর অভিনয় করেন তারা দুজনেই। বিছানার মাঝখানে জমে থাকা শূন্যতা কাঁথার মতো ভারি হয়ে ওঠে। অর্পিতা জানেন না অনির্বাণ আজ এত চুপ কেন, আর অনির্বাণও জানেন না কীভাবে বলা যায় তার ভিতরের অপরাধবোধের কথা। এ যেন এক অদ্ভুত সম্পর্ক—যেখানে না কোনো বিশ্বাস ভাঙে, না তৈরি হয় নতুন কিছু—শুধু চুপচাপ পাল্টে যায় অনুভবগুলো। ঘুম আসেনা কারোরই, কিন্তু চোখ বন্ধ করে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। অপরাধবোধ আর আত্মবিশ্বাসহীনতা—দুজন দুই জায়গা থেকে একই বিছানায় শুয়ে, একে অপরকে না ছুঁয়ে, নিঃশব্দভাবে দগ্ধ হতে থাকে। বাইরে রাত গভীর হয়, কিন্তু ঘরের ভেতরে ঘুম নামে না—শুধু অপরাধবোধের গন্ধ ছড়িয়ে থাকে বাতাসে।

বাইরে হঠাৎ করে গড়গড় শব্দ তুলে বিদ্যুৎ চলে গেল। পাখার বাতাস থেমে গেল, টিভির পর্দা অন্ধকার হয়ে গেল, শহরের সব আওয়াজ যেন এক মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেলো। ঘড়ির কাঁটার শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, জানালার পর্দা একটু নড়ে উঠছে হালকা বাতাসে। অর্পিতা বিছানার কোণায় বসে ছিল একটা উপন্যাস হাতে, কিন্তু এখন আর পড়ায় মন বসছে না। ঘর জুড়ে একরকম অদ্ভুত নিরবতা নেমে এসেছে—যেটা অস্বস্তিকর নয়, বরং আবেশময়। অনির্বাণ বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ছিল, মোবাইল স্ক্রল করছিলো, কিন্তু বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় সে ফোনটা নামিয়ে রেখে শুধু শুয়ে থাকল। বাইরে থেকে কিছু অচেনা পাখির ডাক আসছিল, যেন কোনও অজানা গোপন কথা বলতে চাইছে। বিছানায় তাদের মাঝখানে অনেকদিনের অভ্যস্ত ফাঁকাটুকু আজ হঠাৎ করে আরও গভীর মনে হচ্ছে। অর্পিতা উঠে পাশের টেবিল থেকে একটা মোমবাতি নিতে চাইল, কিন্তু অন্ধকারে হাতটা কোথায় যাচ্ছে বুঝতে পারছিল না—ঠিক তখনই অনির্বাণের হাতে তার হাতটা অল্প ছুঁয়ে গেল।

একটি ছোট্ট, হঠাৎ ছোঁয়া—না চাওয়ার থেকেও বেশি অনিচ্ছাকৃত, কিন্তু ঠিক ততটাই বাস্তব। কোনও শব্দ হলো না, কিন্তু দুজনের মাঝখানে যেন বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। অর্পিতা হঠাৎ থেমে গেল, নিজের ভিতরে কেমন একটা ঢেউ উঠতে দেখল। সাত বছরের অভ্যস্ত সহবাসে এমন ছোঁয়া হয়তো হাজারবার হয়েছে, কিন্তু এই ছোঁয়াটা ছিল অন্যরকম—অবাঞ্ছিত নয়, আবার নির্দ্বিধাও নয়। অনির্বাণও হাতটা সরিয়ে নিল না, বরং হালকা ভাবে অনুভব করল সেই উষ্ণতা। অন্ধকারের মধ্যে তারা কেউ কারও মুখ দেখতে পাচ্ছিল না, কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারছিল—এই নৈঃশব্দ্যের মধ্যেই তারা একে অপরকে নতুন করে অনুভব করছে। বাইরে একটা গাড়ির হেডলাইট ঘরের কোণ ছুঁয়ে সরে গেল, কিছু মুহূর্তের জন্য আলো তৈরি করল তাদের মুখে—কিন্তু ততক্ষণে চোখে চোখ পড়ার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। নিঃশ্বাসের শব্দ যেন আরও গভীর হয়ে উঠল, ঘরের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা জমে উঠছে, যা কেউ মুখে আনছে না, কিন্তু দুজনেই বুঝতে পারছে।

অর্পিতা আবার ধীরে ধীরে বিছানায় ফিরে এল, কিন্তু এবার তার শরীরটা অনির্বাণের একটু কাছাকাছি থেমে গেল। কাঁধের পাশ দিয়ে হালকা বাতাস বয়ে যাচ্ছে, আর অনির্বাণের উষ্ণ শরীরের গন্ধ সে যেন বহুদিন পর আবার নতুনভাবে টের পাচ্ছে। অনির্বাণ মনে মনে ভাবছিল, এই মুহূর্তে কি এগিয়ে আসবে? হাত বাড়িয়ে দেবে, না কি আবার চুপ করে শুয়ে থাকবে? আরেকটা ছোঁয়ার অপেক্ষা করছে যেন চারদিক। কিন্তু কে আগে বলবে, কে আগে অনুভব স্বীকার করবে—এই প্রশ্ন দুজনের মধ্যেই টান তৈরি করছে। হয়তো প্রেমের গল্পে অনেক উত্তেজনা থাকে, কিন্তু দাম্পত্যে এই নীরব উত্তেজনাগুলো অনেক বেশি সত্যি, অনেক বেশি গভীর। অর্পিতা চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল, কিন্তু ভিতরে ভিতরে অনুভব করছিল, যেন তার বুকের মধ্যে জমে থাকা একটা দীর্ঘশ্বাস ভেঙে পড়তে চাইছে। এই অন্ধকার, এই নিঃশব্দতা আর এই ছোট্ট ছোঁয়াটুকু মিলিয়ে যেন এক অনুচ্চারিত প্রেমের ভাষা গড়ে উঠেছে—যা আর শব্দের মধ্যে ধরে রাখা যাচ্ছে না।

রাতটা কাটে নিঃশব্দে। কেউ এগোয় না, কেউ কথা বলে না, কেউ কোলের কাছে হাত রাখে না—কিন্তু দুজনেই ঘুমোতে পারে না। ঘড়ির কাঁটা ধীরে ধীরে রাত তিনটা ছুঁয়ে যায়, তবুও অর্পিতা অনুভব করে অনির্বাণের নিঃশ্বাস এখনও ছন্দে বদলায়নি। সে জানে, সেও ঘুমায়নি। এক সময় এমন রাতেও তাদের গল্প চলত, শরীর ছুঁয়ে যেত শরীর, চুমু ঠোঁট ছুঁয়ে দিত গালে। কিন্তু আজকের অন্ধকারে সেই সমস্ত কিছু অনুচ্চারিতভাবে ফিরে এসেছে, যেন প্রথম প্রেমের দিনে ফেরার অপেক্ষা। শুধুমাত্র একটি স্পর্শ, একটি অস্পষ্ট কাঁপুনি, আর একটি শব্দহীন রাত—এই দিয়েই যেন তাদের সাত বছরের দাম্পত্যে নতুন কিছু শুরু হওয়ার মৃদু কাঁপুনি বাজতে শুরু করেছে।

শনিবার বিকেলটা অন্যরকম নীরব ছিল, তবে তার নীরবতা ছিল প্রস্তুতির—অর্পিতার ভেতরের আলোড়নের নীরবতা। সে সেই সকাল থেকেই এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ নিয়ে কাটাচ্ছিল, বুকের ভেতর কেমন একটা খুকখুকে সিকিউরিটি গার্ডের মতো ভাবনাগুলো পাহারা দিচ্ছিল, যাতে সবকিছু ঠিকঠাক চলে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে তার নতুন কেনা কালো স্যাটিন নাইটি খুলে আবার পরছিল, একবার চুলটা খোলা, একবার পোনিটেইল—কীভাবে তাকে অচেনা লাগবে, যেন নতুন কোনো নারী সে, যেন এই বাড়ির অর্পিতা নয়, আর এই রাতটা যেন কোনো গল্পের এক রুদ্ধদ্বার পর্ব। তার মাথায় আসছিল পুরনো সিনেমার দৃশ্য, কোনো রহস্যময় নারীর ছায়া, আর অনির্বাণের চোখে সেই চমক তোলার আকাঙ্ক্ষা। বিছানার পাশে রাখা ল্যাম্পের আলো কিছুটা কমিয়ে রাখে সে, মোবাইল সাইলেন্ট, একটা অদ্ভুত প্লেলিস্ট চালিয়ে দেয়—কণ্ঠে নেই গান, তবু সুর আছে, একটা গা ছমছমে আবেশে ঘরটা ভরে ওঠে। সে জানত, অনির্বাণ একটু পরেই দরজা খুলবে, যেমন প্রতিদিন খোলে, কিন্তু আজ দরজার ও-পাশে থাকবে অন্য এক নারী, যার নাম হয়তো অর্পিতা নয়।

অনির্বাণ দরজা খোলার মুহূর্তে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল। ঘরের আলো বদলে গেছে, ঘ্রাণটা নতুন, আর যেখানে সে প্রতিদিনের সেই আলুথালু টিশার্ট-পরা স্ত্রীকে দেখে অভ্যস্ত, সেখানে দাঁড়িয়ে এক অপরিচিত নারীর মতো কেউ তাকিয়ে আছে তার দিকে—চোখে সোজা চাওয়া, ঠোঁটে এক বিন্দু টান, যেন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে, “চেনো আমাকে?” সে জুতো খুলে রাখতেই অর্পিতা একটু এগিয়ে আসে, বলল, “নতুন ভাড়াটে তুমি তো?” অনির্বাণ এক মুহূর্ত বুঝে উঠতে পারেনি, এরপর সে মৃদু হাসে, এবং বুঝে যায় খেলা শুরু হয়েছে। প্রথমে তার কণ্ঠে দ্বিধা ছিল, হাতটা খোঁজে ব্যাগের চেন, কিন্তু কিছু বলার আগেই অর্পিতা তার হাতে একটা কফির কাপ ধরিয়ে দেয়—”রুমের ভাড়া নয়, গল্পের দাম দিতে হবে আজ।” অনির্বাণ কিছুটা লজ্জা পেলেও তাতে ছিল উত্তেজনা, যেন নিজের ঘরেই এক অচেনা খেলায় ঢুকে পড়েছে, যার নিয়ম কেউ জানে না, শুধু অনুভবই পথ দেখাবে। তারা ডাইনিং টেবিলে না বসে বিছানার কিনারায় বসে, কফির চুমুকে নয়, চোখের দৃষ্টিতে কথা বলে—অর্পিতা জানে, আজকে তারা নতুন প্রেমিক-প্রেমিকা, যারা একে অপরকে যাচাই করছে চাহনির মাপজোখে।

বিছানার আলো যখন আরও ম্লান হয়, তখন ভাষা আর বাস্তবতার পার্থক্য মুছে যেতে থাকে। অনির্বাণ তার পাশে বসে কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল, তারপর হঠাৎ বলল, “তুমি আগে কোথায় ছিলে?” অর্পিতা চোখ নামিয়ে বলল, “তোমার স্বপ্নে, যেখানে কেউ জেগে থাকতে চায় না।” এই কথার মধ্যে যে সাহস ছিল, তা অনির্বাণকে একদম ছুঁয়ে যায়। এত বছরেও সে এমন ভাষা অর্পিতার মুখে শুনেনি। এই খেলার মধ্যে ছিল স্বাধীনতা, চেনা সম্পর্কের বাইরে গিয়ে কিছু আবিষ্কারের সুযোগ, সেই প্রথম স্পর্শের আগে যেরকম কাঁপা-কাঁপা মুহূর্ত থাকে—তারা একে অপরকে ছুঁয়েছিল সেদিন, তবে সেটা ছিল ঠিক সেইভাবে, যেমন করে প্রথমবার কেউ ধরা দেয় না, বরং ধরা দেয়ার আগে একটু পিছিয়ে যায়, আর তাতেই ছোঁয়াগুলো হয়ে ওঠে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট। বিছানার চাদরটা যেন নেমে আসে তাদের বুকের ভেতরের লুকোনো কামনার দিকে, যা এতদিন স্রেফ অভ্যাসের নিচে চাপা ছিল, আজ সে কামনা চুপিচুপি চোখ খুলেছে, নতুন পোশাক পরে দাঁড়িয়েছে সেই চেনা ঘরের এক ভিন্ন কোণে।

রাতটা অদ্ভুত ছিল, কারণ তাতে কোনো দায় ছিল না—ছিল কেবল ইচ্ছে। ওদের এই অভিনয়ের ভেতর একটা আশ্চর্য সত্যি ঢুকে পড়েছিল—তারা একে অপরকে আবার নতুন করে দেখতে শিখছিল। অনির্বাণের চোখে অর্পিতা যেন ফিরে গিয়েছিল সেই প্রথম প্রেমের দিনে, যখন তাকে ছুঁতে চাইত কিন্তু সাহস পেত না। অর্পিতার কাছে অনির্বাণ নতুন এক পুরুষ, যার চোখে লোভ নেই, আছে অনুসন্ধান। সেই রাতের চুমুগুলো ছিল প্রশ্নের মতো, আর আলতো জড়িয়ে ধরা ছিল উত্তর পাওয়ার চেষ্টা। তারা কোনো উচ্চ শব্দ করেনি, তবুও সেই বিছানা সাক্ষী হয়ে থাকল এক গভীর আর ধীরে-ধীরে জেগে ওঠা আগুনের, যা কোনো জোরে নয়, বরং সংবেদনে জ্বলে ওঠে। তারা কেউ বলেনি, “ভালোবাসি”, কিন্তু যে শরীর আর মন একে অপরকে স্পর্শ করেছিল, তাতে ভাষার প্রমাণের দরকার ছিল না। রাতের শেষে তারা পাশাপাশি শুয়ে ছিল, এবার আর পিঠ ঘুরিয়ে নয়—চোখে চোখ, ঘামে ভেজা চাদরের নিচে, এক নিষিদ্ধ খেলার নিষ্পাপ আর অমূল্য ঘোরে।

সকালটা আবার সেই পুরনো ছকে গড়া—ঘড়ির অ্যালার্ম, জল ফোটানো, স্কুল ব্যাগ গুছানো, অনির্বাণের শার্টে শেষ মুহূর্তে বোতাম লাগানো, আর অর্পিতার এক নিঃশ্বাসে রান্নাঘর থেকে বাথরুম পর্যন্ত দৌড়ানো। কিন্তু আজ যেন সময়টা একটু ধীর। দু’জনেই নিজেদের কাজ করলেও, চোখাচোখির মুহূর্তে একধরনের নতুন চুম্বক টের পায়। সেই চুম্বকতা হয়ত রোল-প্লে রাতের পরবর্তী প্রভাব, কিংবা বিছানায় নতুন করে গড়ে ওঠা নৈকট্যের প্রতিফলন। অনির্বাণ ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে চায়ের কাপের ওপারে তাকিয়ে দেখে—অর্পিতার চোখে ঘুমের ধোঁয়াশা থাকলেও সেখানে একধরনের নরম উষ্ণতা আছে, যা সে বহুদিন দেখেনি। অর্পিতা একটু চুপচাপ, কিন্তু তার ভেতরের আলো যেন চোখের কোল ঘেঁষে উঁকি দিচ্ছে। ছেলেটার বাস পৌঁছানোর সময় হলে হুড়োহুড়ি শুরু হয়, কিন্তু সে সময়েও দুজনের মধ্যে এক বিনিময় ঘটে—ভাষাহীন, কিন্তু পরস্পর-সচেতন।

অফিসে পৌঁছেও অনির্বাণের মন বারবার বিছানার রাতে গড়াপড়ার বদলে অর্পিতার চোখের দিকে ফিরে যায়। সে ভাবতে থাকে, তারা কি শুধুই সেই রাতে ভালোবাসতে পারে? বাস্তবের জটিলতা কি সব সময় রোমান্সকে গিলে ফেলে? এক মিটিং শেষে সে চুপচাপ টয়লেটের আয়নায় নিজের মুখ দেখে। ক্লান্ত, কুঁচকে যাওয়া চোখ—তবুও সেখানে এক নতুন ছায়া। ওদিকে অর্পিতাও, বাসায় ফিরে প্রতিদিনকার মতো বাসন মাজছে, রান্না করছে, কিন্তু বারবার মন ফিরে যাচ্ছে বিছানার নতুন অনুরণনে। তার মনে হয়, এতদিন ধরে সে নিজেকে কেবল ‘মা’ বা ‘স্ত্রী’ হিসেবে দেখেছে—কিন্তু গত রাতে সে নিজের শরীরকে নতুন করে অনুভব করেছে, নতুন করে আবিষ্কার করেছে নারী হিসেবে। কিন্তু এই আত্ম-আবিষ্কারের বাইরের বাস্তব তো খুবই কঠিন—বাজারের দাম বাড়ছে, ইলেক্ট্রিক বিল এসেছে বেশি, এবং সন্ধ্যায় ছেলেটার হোমওয়ার্কে বসতে হবে। প্রেম কি এই সবের মধ্যেও টিকে থাকতে পারে?

রাতের খাওয়া শেষ করে, ছেলে ঘুমিয়ে পড়লে, দুজনেই নিজেদের ফোন নিয়ে বিছানায় এল। কিন্তু আজ যেন ফোনটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অর্পিতা একটু সরে গিয়ে পাশে তাকিয়ে বলে, “তুই কি মনে করিস, শুধু বিছানায় প্রেম করলেই হয়ে যায়?” অনির্বাণ একটু চমকে উঠে—তার মুখে কোনো রসিকতা নেই, বরং এক ধরণের প্রাপ্তবয়স্ক ব্যথা। সে বলে, “মানে?” অর্পিতা ধীরে বলে, “আমরা যতই রোমান্স করি বিছানায়, যদি বাইরে তোর মুখে সেই মন খারাপের ভাঁজ থাকে, বা আমি আবার একা একা বাজারে ঘুরি—তাহলে এটা প্রেম না, অভিনয়।” অনির্বাণ কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। তারপর ধীরে বলে, “তুই ঠিক বলছিস। গতকাল যা হল সেটা স্বপ্নের মতো ছিল, কিন্তু স্বপ্নও তো ভাঙে সকাল হলে।” তারা দুজনেই বুঝতে পারে—প্রেমটা শুধু চাদরের নিচে না, সে ঘরের প্রতিটা কোণ ঘিরে থাকতে হয়, রান্নাঘরের ভাপে, অফিসের ক্লান্ত রিপোর্টে, অথবা হঠাৎ করে ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুপচাপ এক কাপ কফি ভাগ করে নেওয়াতেও।

রাত বাড়ে। জানালার বাইরের বাতাসে হালকা ঠান্ডা। বিছানায় দুজন পাশাপাশি শুয়ে থাকে, কিন্তু এবার আর মুখ ঘুরিয়ে নয়। অনির্বাণ তার হাত অর্পিতার গালে রাখে, কোনো যৌন ইঙ্গিত নয়, বরং এক আত্মিক ছোঁয়া। অর্পিতা চোখ বন্ধ করে সেই স্পর্শ গ্রহণ করে, যেন সেই হাতের উষ্ণতায় সে আশ্বস্ত হতে চায়—এই লড়াইটা শুধু বিছানার মধ্যে নয়, বাইরেটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সেই মুহূর্তে তারা বুঝতে পারে, দাম্পত্য শুধু অভ্যাসের বন্দি নয়, বরং প্রতিদিনের নতুন করে চেষ্টার নাম। ভালোবাসা মানে রাতের রোমান্স নয়, বরং সকালে একসঙ্গে ছেলেকে স্কুলে পাঠানো, বাজারের ব্যাগটা কাঁধে নেওয়া, ক্লান্ত শরীর নিয়েও একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকা। তারা চুপচাপ একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোনো কথা নেই, তবু যেন হাজারটা কথা আদানপ্রদান হয়। বিছানার বাইরের এই লড়াইটা হয়তো অনেক কঠিন, অনেক সময় ক্লান্তিকর, কিন্তু তার মধ্যেই ভালোবাসার সত্যিকার ভিত্তি গড়ে ওঠে।

অন্ধকার ঘর, মৃদু পাখার শব্দ, আর আধখোলা জানালা দিয়ে আসা গরম হাওয়ার মধ্যে গভীর রাতটা যেন থমকে আছে। অর্পিতা হঠাৎ করেই বলে ওঠে—একটা ভাঙা স্বরে, “আমরা তো আর তেমন কথা বলি না, তাই না?” অনির্বাণ পাশ ফিরে চেয়ে থাকে, যেন প্রশ্নটা অনেক দূর থেকে এসেছে। সেই চাহনির মধ্যে ছিল কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা গ্লানি। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সে জবাব দেয় না, শুধু একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। এভাবে আরেকটা মুহূর্ত কেটে যায়, যেটা আবারও তাদের মধ্যে এক অদৃশ্য দেয়াল তোলে। কিন্তু এবার অর্পিতা থামেনি। সে বলে, “আমার মনে হয়, আমি অনেক কিছু চেপে রাখি। আমার শরীর, আমার ইচ্ছে, আমার না-পাওয়া গুলো সব কিছু যেন ঘুমিয়ে পড়ে গেছে, শুধু তোমার স্ত্রী হয়ে থেকে গেছি। কিন্তু আমি তো তোমার প্রেমিকাও হতে চেয়েছিলাম, এখনও চাই।”

এই স্বীকারোক্তি যেন অনির্বাণকে থামিয়ে দেয়। অর্পিতার কণ্ঠে ছিল এক ধরনের কাঁপুনির ছোঁয়া, তবুও তা ছিল সাহসী। অনির্বাণ চুপচাপ উঠে বসে, বিছানার কিনারায় বসে বাইরে তাকায়। এরপর ধীরে ধীরে বলে, “তোমার এমন মনে হয়, আমার হয় না মনে করো? আমি অনেক সময় ভেবেছি, তোমাকে জড়িয়ে ধরি, যেমন করে একসময় ধরতাম। কিন্তু ভয় পেয়েছি, তুমি বুঝি আর চাও না। তোমার শরীর কি এখনও আমায় চায়?” এই প্রশ্নটা ছুড়ে দেওয়ার পর ঘরটা যেন আরও স্তব্ধ হয়ে ওঠে। অর্পিতা একটু হাসে, একটা দুঃখমাখা হাসি, আর বলে, “আমার শরীর আজও অপেক্ষা করে, শুধু তুমি ছুঁয়ে দাও—ভালোবাসা নিয়ে, আগ্রহ নিয়ে—not out of duty।”

এই মুহূর্তে তারা দুজনই নিজেদের শরীর থেকে মানসিক পর্দা সরিয়ে ফেলে। কথার মধ্যে দিয়ে তারা নিজের ভেতরের ভয়, অপরাধবোধ, কামনা আর বিরক্তি—সব কিছু উলঙ্গ করে দেয় একে অপরের সামনে। এই নগ্নতা কেবল শরীরের নয়, আত্মারও। অর্পিতা বলে, “আমি ভয় পাই—তুমি আমাকে আর সুন্দর মনে করো না। আমার চুল ঝরে গেছে, শরীরেও বয়সের ছাপ পড়েছে। কিন্তু জানো, আমার এখনো তোমাকে ছুঁতে ইচ্ছে করে, আগের থেকেও বেশি। কিন্তু তুমিই তো সরে গেছো, তোমার স্পর্শগুলো কেমন যান্ত্রিক হয়ে গেছিল।” অনির্বাণ মাথা নিচু করে বলে, “আমি হয়তো আমার অফিস, টার্গেট, ক্লান্তি সব কিছুতেই এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, যে বুঝতেই পারিনি, তুমি কেমন একা হয়ে যাচ্ছো আমার পাশেই। আমার মধ্যেও ইচ্ছে ছিল, কিন্তু আমি ভুলে গেছিলাম তোমাকে চাওয়া, তোমার চোখে চোখ রাখা।”

তাদের কথার মধ্যে দিয়ে ভোর হতে থাকে। বিছানার চাদরে জড়িয়ে তারা পাশাপাশি বসে থাকে, কিন্তু এবার আর কোনো দূরত্ব নেই। এই কথোপকথনের পর তারা প্রথমবার একে অপরকে শুধু চেনা মানুষ হিসেবে নয়, নতুন মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করে। তারা বোঝে, ভালোবাসা শুধু শারীরিক নয়, তার গভীরে রয়েছে অসংখ্য না-বলা কথা, স্পর্শহীন টান, চোখের ভাষা। অর্পিতা বলে, “আমরা আবার শুরু করতে পারি, কিন্তু এবার অভিনয় না করে। আমি চাই তুমি আমাকে নতুন করে চাও, যেমন করে অচেনা কাউকে চাওয়া যায়। আমি চাই আবার প্রেম করি, কিন্তু এবার দায়িত্বের বাইরে গিয়ে। আমি শুধু তোমার স্ত্রী হতে চাই না, আবার তোমার প্রেমিকা হতে চাই।” অনির্বাণ চোখে জল নিয়ে বলে, “তাহলে আজ থেকে আবার শুরু হোক—তোমাকে নতুন করে চাওয়ার গল্প।” এই ভোরটা তাদের দাম্পত্যের গল্পে নতুন এক সূর্য ওঠার ইঙ্গিত দেয়।

রাতের নীরবতা এখন আর নিঃসঙ্গতা নয়, বরং একটি প্রতীক্ষার অনুভূতি হয়ে উঠেছে। দিনের শেষে, ছেলেমেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে, অফিসের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে, অর্পিতা আর অনির্বাণ নিজেদের জন্য এক নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ করেছে—একটা নির্ভরযোগ্য ঘরোয়া পর্ব, যা শুধুই তাদের দুজনের। মোবাইল, টিভি, কাজের চাপ, বাইরের দুনিয়ার কোনও কিছুই সেই সময়ের মাঝে ঢুকতে পারে না। বিছানার চাদরের নিচে দুজনে এখন শুধু শরীরের কাছে নয়, হৃদয়ের কাছেও পৌঁছাতে চায়। প্রতিদিন রাত ঠিক দশটায় তাদের ঘরের বাতিটা নিভে যায়, কিন্তু অন্ধকারে আলো জ্বলে ওঠে স্পর্শ, কথোপকথন আর নিরাবরণের আন্তরিকতায়। অনেকদিন পর আবার অনির্বাণ অর্পিতার কপালে চুমু খায় বিনা প্রয়োজনে, আর অর্পিতা সেই ছোঁয়াকে ধরে রাখে দীর্ঘ সময়, যেন পুরনো কিছু মনে পড়ে যায়।

এই নতুন অধ্যায়ে, তারা শিখে গেছে কামনা মানেই শুধু তীব্রতা নয়, বরং ধীরতায়ও থাকে এক অপূর্ব উত্তাপ। তারা এখন একে অপরের শরীর আবিষ্কার করে সময় নিয়ে, এক নতুন চোখে। অর্পিতা যেমন চায় অনির্বাণের গলা ছুঁয়ে তার ক্লান্তির ব্যাখ্যা বুঝতে, তেমনি অনির্বাণ চায় অর্পিতার ঘাড়ে ঠোঁট রেখে তার নিঃশ্বাসের ভেতর কী গল্প লুকিয়ে থাকে তা অনুভব করতে। মাঝে মাঝে তারা শুধুই বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে, কিছু না বলে, কিন্তু চোখের ভিতর কথা বলে যায় অসংখ্য। সেই দৃষ্টির ভেতর হাসি থাকে, অভিমান থাকে, কামনা থাকে, এমনকি ছোট ছোট লজ্জার ঢেউও থাকে—যা একসময় হারিয়ে গেছিল তাদের দৈনন্দিনতার গাড্ডায়। এখন আবার অনির্বাণ অর্পিতার শাড়ির আঁচলে খেলতে ভালোবাসে, আর অর্পিতা অনির্বাণের চুলে আঙুল চালিয়ে বলে, “এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই তো ভালোবাসা।” তারা আবার জানে, সঙ্গম মানে শুধু শরীরের মেলবন্ধন নয়—সেই মেলবন্ধনে মিশে থাকে আলো-আঁধারির আবেগ, মনখারাপের নিরাময়।

তারা নিজেদের ভেতর নতুন সংবেদন তৈরি করে নেয়—যেখানে শুধু যৌনতা নয়, প্রেমের স্পর্শও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আগের দিনের মত হঠাৎ উত্তেজনায় নয়, বরং ইচ্ছের ধারায় ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে গভীর সংযোগ। এখন তারা বোঝে, কখনও শুধু আলতো চুম্বনেই সম্পূর্ণ হয়ে যেতে পারে একটি রাত, আবার কখনও একটি দীর্ঘ আলিঙ্গনেই মিশে যেতে পারে হাজার কথার ভার। অর্পিতা আর অনির্বাণ শিখে গেছে—আত্মার ছোঁয়া ছাড়া শরীরের মিলন অপূর্ণ থেকে যায়। অনেক রাতে তারা একে অপরকে শুধু ধরে থাকে, কথা বলে না, কিন্তু সেই নীরবতায় এমন এক গভীর সংবেদন তৈরি হয় যা ভাষার অতীত। তাদের বিছানায় এখন আর নেই নিষ্প্রাণ অভ্যাসের ক্লান্তি, বরং আছে সচেতন ভালোবাসা, সচেতন চাওয়া। একটা নতুন গল্প বোনা হচ্ছে প্রতিটি রাতে—যেখানে পুরনো দাম্পত্যের গ্লানিকে ছুঁড়ে ফেলে তারা নতুন প্রেমিক-প্রেমিকার মতো নিজেদের রচনা করে নিচ্ছে আবার।

এই রাতগুলোর ভেতর জন্ম নিচ্ছে এমন এক সম্পর্ক, যেটা শরীরের মধ্যেও মনকে খুঁজে পায়, আর মনের মধ্যে শরীরের তীব্রতাও টের পায়। অর্পিতা একদিন বলে, “তুমি জানো, এখন তোমার প্রতিটি ছোঁয়া আমার আত্মার গায়ে লাগে।” অনির্বাণ উত্তর দেয়, “কারণ আমি এখন শুধু তোমার দেহ নয়, মনকেও ভালোবাসি নতুন করে।” তাদের এই নতুন অভ্যেসটা আর কেবল যৌনতা নয়, বরং প্রতিদিন একে অপরকে নতুনভাবে চাওয়ার অভ্যাস। চাদরের নিচে তাদের এখন আর কোনো গোপন কথা নেই, কোনো অসমাপ্ত স্পর্শ নেই। প্রতিটি রাত এক একটি গল্প—যেখানে কামনা, লজ্জা, হাসি, ব্যথা সব একসঙ্গে বাস করে। তারা জানে, পরের দিন সকালে আবার সেই একঘেয়ে জীবন, অফিস, স্কুল, রুটি-বাজার—তবুও রাতে তারা নিজেদের জন্য একটুকরো স্বর্গ তৈরি করে নেয়, শুধু দুজন মানুষ, একে অপরকে নতুন করে ভালোবাসতে শেখা মানুষ।

১০

সেই সকালটা যেন অন্য রকম আলোর রং নিয়ে এসেছে, জানালা দিয়ে ঢুকছে না শুধু রোদ, বরং একটি নরম উষ্ণতা, যা ঘরের নিস্তব্ধতাকে পূর্ণ করে তুলছে এক মুগ্ধ আশ্বাসে। অনির্বাণ প্রথমে চোখ মেলেই দেখে অর্পিতা পাশে ঘুমিয়ে, তার মুখে একটি শিশুর মতো প্রশান্তি। কিছু না ভেবেই সে হাত বাড়িয়ে দেয়, আলতোভাবে ছুঁয়ে দেয় অর্পিতার চুল। দিনের আলোয়, প্রথমবার এইভাবে, বিনা তাড়ায়, কোনো রাখঢাক ছাড়া, সে অনুভব করে অর্পিতার শরীর নয়—তার পাশে থাকা মানুষটিকে। যেন রাতের সমস্ত পর্ব শেষে এই ছোঁয়ায় লুকিয়ে আছে তাদের গল্পের নবজন্ম। আর অর্পিতা, যিনি এতকাল দিনের শুরু মানেই বুঝতেন দুধ গরম, টিফিন প্যাক, ছেলে ঘুম ভাঙানো, অফিসের শাড়ি বাছাই—তিনি আজও ঘুম থেকে ওঠেন, কিন্তু তার আগে চোখ খোলে অনির্বাণের সেই স্পর্শে, যা ঘড়ির কাঁটার নির্দেশ নয়, হৃদয়ের আহ্বান।

তারা দুজনেই হাসে। না, এটা সেই হেসে ফেলার হাসি নয় যা সংকোচ ঢাকতে হয়, না-ই সেই হাসি যা সামাজিকতা রক্ষার জন্য ঠোঁটে উঠে আসে। এটা আত্মার আরাম থেকে উঠে আসা নিঃশব্দ আনন্দ, যেন কেউ বলছে, “আমরা পারলাম!” গত কয়েক সপ্তাহের প্রতিটি রাতের ভেতর দিয়ে তারা যে ভাঙাগড়ার খেলায় অংশ নিয়েছিল, তার ফল আজকের এই সকাল। বিছানায় দুজন পাশাপাশি বসে, রোদ গায়ে মেখে, তারা অনুভব করে এক অদ্ভুত প্রশান্তি। এ এমন এক সম্পর্কের মোড় যেখানে বিছানা আর শুধুই যৌনতার প্রতীক নয়, বরং হয়ে উঠেছে সম্পর্কের এক নতুন নোঙ্গর। অর্পিতা চাদরটা টেনে ঠিক করতে করতে হেসে বলে ওঠে—“এই বিছানাটা এবার যেন আমাদের আবার প্রেমে পড়তে সাহায্য করছে।” সেই বাক্যে কোনো নাটকীয়তা নেই, আছে সাদামাটা সত্য, যা হয়তো আগেও ছিল, কিন্তু আজই প্রথম তারা একসঙ্গে বুঝতে পেরেছে।

এই বিছানায় তারা একসময় কেবল ঘুমাতে আসত, নাড়াচাড়া ছাড়াই পাশ ফিরে পড়ে থাকত, কখনও দূরত্ব নিয়ে, কখনও বিরক্তি নিয়ে। কিন্তু এখন এখানে ফেরত এসেছে সান্নিধ্যের রসায়ন, নতুন করে জেগে উঠেছে সংযোগের রেশ। রাতে যে গল্প শুরু হয় কামনা দিয়ে, তা শেষ হয় আস্থায়—আর সকালটা জেগে ওঠে ভালোবাসায়। তারা জানে এই মুহূর্ত স্থায়ী নয়, আবারও জীবন তার রুটিন নিয়ে ফিরবে—চাকরি, দায়িত্ব, সন্তান, সমাজ। তবু এই একটি সকাল যেন চুপিচুপি বলে যায়—জীবনের ভেতরও প্রেম থাকতে পারে, শুধু খুঁজে নিতে হয়, সময় দিতে হয়, আর সবচেয়ে বেশি দরকার নিজেদের ছোট ছোট মুহূর্তে গুরুত্ব দেওয়ার অভ্যাস। অনির্বাণ এখন বুঝতে পারে, অর্পিতার চুলে হাত রাখা মানে শুধুই আদর নয়, বরং তার পাশে থেকে থাকা, তাকে দেখা, তাকে বোঝার চেষ্টার প্রতীক। আর অর্পিতা বোঝে, অনির্বাণের পাশে ঘুম ভাঙা মানে সেই পুরোনো সম্পর্কের বেদনাগুলোর ওপর নতুন রঙের তুলির টান।

গল্পটা এখানেই শেষ হয়—কিন্তু তাদের গল্প নয়। কারণ যেসব গল্প শুধু সম্পর্কের শেষ বা বিবাহের ক্লান্তি দেখায়, তারা হয়তো শুরুতেই ভুল পথে হেঁটেছিল। এই গল্পের আসল সৌন্দর্য এই যে, প্রেম, চাওয়া, আবেগ, স্পর্শ—সবই ফিরে আসতে পারে, যদি মানুষরা নিজেদের দিকে তাকায় নতুন করে। অনির্বাণ আর অর্পিতার চোখে আজ যে উজ্জ্বলতা, তা রাতের বিছানার গোপনীয়তা থেকে নয়, বরং একে অপরকে মন দিয়ে ভালোবাসার সিদ্ধান্ত থেকে। আর এটাই তাদের নতুন শুরু—একটি সম্পর্ক যেখানে বয়স, দায়িত্ব, ক্লান্তি—কোনোটিই আর অজুহাত নয়, বরং সবকিছুর মাঝেও ভালোবাসাকে সক্রিয় রাখার এক সচেতন প্রয়াস। তাদের দিন শুরু হয় এক হাসিতে, এক স্পর্শে, এক বিশ্বাসে—যেখানে তারা জানে, ভালোবাসা আবারও সম্ভব, প্রতিদিন, প্রতিরাত, প্রতিসকাল, যদি আমরা চাই সত্যিকারের সংযোগ গড়তে।

সমাপ্ত

 

1000050714.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *