বহ্নি চক্রবর্তী
পর্ব ১
পদ্মার ওপার থেকে সূর্য যখন মাথার ঠিক ওপর উঠে এল, তখন রমিজ আলী তার নৌকাটা ধীরে ধীরে ঘাটে বাঁধছিল। ঘাটটা এখন অস্থায়ী—বাঁশের খুঁটি দিয়ে বাধানো, পেছনে শুকনো খড়ের ছাউনি। সকালে তিনটে পরিবার পার করে এনেছে ওপার থেকে, এখন আবার পাঁচজন অপেক্ষা করছে যাবার জন্য। রমিজ কারো নাম জিজ্ঞেস করে না, ধর্মও না, শুধু বলে—“চুপচাপ বসেন, ভয় পাইয়েন না।” তার নৌকায় ওঠা মানেই যেন এক নীরব চুক্তি—পদ্মা কিছুই মনে রাখে না, আর মাঝিও না। বছরখানেক আগেও এই নদীর পাশে ছিল তার স্ত্রী আর ছেলের কুটির, দুজনেই এক রাতে উধাও। কেউ বলে হিন্দুদের দাঙ্গাকারীরা তুলে নিয়ে গেছে, কেউ বলে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে গেছে জেরা করতে। রমিজ এখন আর কিছু খোঁজেন না, শুধু নৌকা চালান, আর মনে মনে নদীর বুকে ছুঁড়ে দেন হাজারো মুখ, নামহীন কাহিনি।
সকালবেলার দলটায় ছিল এক বৃদ্ধা, গিরিজা চক্রবর্তী, সাথে তার সাত বছরের নাতি। গিরিজার মুখে ছিল দগদগে পোড়া দাগ, আগুনে পুড়ে যাওয়া শরীরের চিহ্ন। ঘরবাড়ি পুড়েছে, আত্মীয়স্বজন খুঁজে পায়নি, শুধু এই একরত্তি নাতিটাকে নিয়ে রমিজের ঘাটে এসে দাঁড়িয়েছিল। নাতির নাম কী, জিজ্ঞেস করলে মৃদু গলায় বলেছিল, “ভয় পেয়েছে… কথা বলে না এখন। বাবার নাম রঘুনাথ, কিন্তু ও বাঁচেনি।” রমিজ মাথা নেড়ে বলেছিল, “এই পারে পৌঁছে দেবো ঠিকমতো, কোনো ভয় নেই।” নদীটা ছিল সেদিনও শান্ত, অস্বাভাবিকভাবে শান্ত। যেন জানত—নৌকায় এক হারানো অধ্যায় ভেসে যাচ্ছে। মাঝ নদীতে হঠাৎ বন্দুকের শব্দ, কেউ চিৎকার করে উঠল—“ওপাশে মিলিটারি!” সবাই নীচু হয়ে বসে পড়ল, কেউ কেউ কাঁদতে লাগল চুপিসারে। গিরিজা বাচ্চাটাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল, কিন্তু একসময় হঠাৎ ধাক্কায় ছেলেটা হাত ছুটে জলে পড়ে গেল। সেকেন্ডের মধ্যেই চোখের আড়াল, আর কেউ তাকে খুঁজে পায়নি। গিরিজা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে, চোখে জল নেই, মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই—যেন তার শরীরটা নদীতে পড়ে থাকা খড়ের পাটার মতো নিথর।
সেই ঘটনার পরদিনই রমিজের ঘাটে এসেছিল এক মুসলিম দম্পতি—কাদির আর রোশনা। তাদের গলায় ক্লান্তি, চোখে ছিল দীর্ঘ অনিশ্চয়তার ছায়া। তারা বলেছিল, “নৌকায় যেতে পারব? একটুখানি আশ্রয় চাই।” রমিজ তাদের বসতে দিয়েছিল, কিন্তু রোশনার কোলে একটা শিশু ছিল। ছেলেটার চুল ভিজে, চোখে কৌতূহল, মুখে একটুও ভাষা নেই—শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। রমিজ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনাদের ছেলে?” কাদির বলেছিল, “নয়। নদীর কিনারে পেলাম ভাসতে ভাসতে। বাচ্চাটা কাউকে খুঁজছিল, আমরাই তুলে নিই। আমরা তো নিজের ছেলেকে হারিয়ে ফেলেছি, এইটাকে আগলে রাখছি এখন।” রোশনাও মাথা নিচু করে বলেছিল, “ওর ভাষা আলাদা, কিন্তু চোখের ভাষা তো এক।”
রমিজ কিছু বলেনি। তিনি বুঝতে পারছিলেন, এই বাচ্চাটাই হয়তো সেই হারিয়ে যাওয়া নাতি। কিন্তু তিনি চুপ করে ছিলেন। কারণ কোনোদিন কোনো কিছু বললেই মানুষ সন্দেহ করে, প্রশ্ন করে, ধর্ম খোঁজে। রমিজ এখন শুধু নদীর ভাষা বোঝে—যে ভাষা কারো না, সবার।
এরপর বছর কেটে যায়, দশক। রমিজ বুড়িয়ে যান, কিন্তু ঘাট ছাড়েন না। পদ্মার ধারে একটা কুঁড়ে ঘরে থাকেন, নৌকা এখন আর চালান না, শুধু বসে থাকেন পা ছড়িয়ে। মাঝে মাঝে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকেন, যেন পুরনো মুখগুলো ভেসে উঠবে। তার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত বোঝা জমে থাকে—সে কিছু জানে, কিন্তু বলার সাহস পায় না।
একদিন শহর থেকে সরকারি কিছু লোক আসে জরিপ করতে, পদ্মার পাড়ে নতুন ব্রিজ হবে। তাঁদের একজন তরুণ কর্মী, নাম সাদেক রহমান। চেহারায় গ্রাম্য সরলতা আর চোখে প্রশ্নের ঝলক। সাদেক জন্মেছিল যুদ্ধ শেষ হওয়ার কিছুদিন পর, কোনো অনাথ আশ্রমে। পরে দত্তক নেয় কাদির আর রোশনা। এখন সে সরকারি কাজ করে, কিন্তু মনে একটা ফাঁকা জায়গা রয়ে গেছে সবসময়। মাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, “আমার নাম কেন সাদেক? আমি কোথাকার?” রোশনা মাথায় হাত রেখে বলেছিল, “তুই আমার ছেলে, নদী দিয়েই এসেছিস তো।”
সাদেক নদীর পাড়ে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক দুপুরে, রমিজ তখন ছায়ার নিচে বসে ছিলেন। চোখ তুলে তাকিয়েই যেন চমকে গেলেন। যেন বহু বছর আগের সেই শিশুর চোখ।
রমিজ ধীরে ধীরে উঠে এলেন। পকেট থেকে বের করলেন একটা কাঠের ঘোড়া—ছোট্ট, ভাঙা কান। তিনি বললেন, “এইটা কেউ আমার নৌকায় ফেলে গেছিল… বলছিল, যদি কোনোদিন ফিরে আসে, দিয়ে দিও।”
সাদেক অবাক হয়ে বলল, “আমি ছোটবেলায় একটা কাঠের ঘোড়া নিয়ে ঘুমাতাম… কিন্তু পরে সেটা হারিয়ে ফেলি।”
রমিজ আর কিছু বলেননি। শুধু চুপচাপ ঘাটের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। নদীটা তখনো বইছে, ঠিক আগের মতো।
পর্ব ২
সাদেক রহমান কাঠের ঘোড়াটিকে হাতের তালুতে ধরে রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। যেন অতীতের কোনো দরজা হঠাৎ খোলা পড়ে গেছে, আর সেই দরজার ভেতর থেকে কুয়াশা গড়িয়ে আসছে স্মৃতির মতো। চোখ বুজে ঘোড়াটার গায়ে হাত বুলিয়ে দিল সে, যেন এক অজানা পরিচিতিকে ছুঁয়ে দেখছে। রমিজ আলী দূরে তাকিয়ে ছিলেন পদ্মার জলের দিকে, যেখানে সূর্যের আলো ভেঙে ভেঙে খেলছিল জলের ঢেউয়ে। সময় যেন সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, কেবল মানুষের জীবনই যেন এগিয়ে গেছে।
“চেনেন আপনি আমাকে?” সাদেকের গলায় ছিল দ্বিধা। রমিজ একবার তাকালেন তার চোখের দিকে, তারপর বললেন, “তোর চোখ চিনেছি রে পোলা, অনেক বছর আগেও দেখছিলাম এই চাহনি। তখন তুই একটা বাচ্চা ছিলি, ভয়ে ভয়ে তাকিয়েছিলি জলের দিকে। তোর ঠাকুমা কাঁদছিল, আর আমি কিছুই করতে পারি নাই।” এই প্রথম সাদেক শোনে নিজের অতীতের এক টুকরো। ঠাকুমা! মানে তার কোনো হিন্দু পরিবার ছিল একসময়? মাথার মধ্যে চিন্তার ঝড় উঠতে থাকে। রোশনা মা সবসময় বলতেন, “জন্ম দিয়ে কেউ মা হয় না, আগলে রাখলে তবে হয়।” কিন্তু সাদেকের মন আজ এই অচেনা মাঝির কথা শুনে ধাক্কা খায়।
“আপনি আমার ঠাকুমার কথা জানেন?” গলা শুকিয়ে আসে সাদেকের। রমিজ মাথা ঝাঁকিয়ে বলেন, “উনি একদিন আমার নৌকায় উঠেছিলেন, একটা ছোট্ট পোলাপান সঙ্গে ছিল। ঝড় উঠেছিল হঠাৎ, গুলির শব্দ, হুট করে ছেলেটা পড়ে গেল জলে। আমি খুঁজেছি, পাইনি। পরে কাদির ভাই আর রোশনা বৌদি এই পোলাটারে পাইছিল নদীর পাড়ে। তুই-ই হবি সেই পোলা।” সাদেক হাঁ করে তাকায়। মানে, তার নাম সাদেক নয়? তার আসল নাম কী ছিল? সে কার ছেলে? তার ঠাকুমা কোথায় গেলেন? মরে গেছেন, নাকি কোথাও অপেক্ষা করছেন?
রমিজ যেন তার মনের কথা পড়ে ফেলেন। তিনি আস্তে বলেন, “তোর আসল নাম আমি জানি না রে, পোলাটার নাম ও বলতে পারত না ভয়ে। তবে ওর ঠাকুমা একটা নাম উচ্চারণ করছিল বারবার—‘ভুবন’। তুই হইতে পারিস সেই ভুবন।” সাদেক দাঁড়িয়ে থাকে নদীর ধারে, আর নামটা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে। ভুবন… ভুবন… শব্দটা যেন তার ভেতরকার শূন্য জায়গায় ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। হঠাৎ মনে পড়ে—ছোটবেলায় কোনো এক স্বপ্নে এক মহিলা ডাকছিল তাকে, “ভুবন, আয় তো একটুখানি…” আর সেই ডাক কানে লেগে থাকত সারাদিন। রোশনা বলত, “সাদেক, আবার স্বপ্নে ভেসে গেছিস নাকি?” কিন্তু সে কখনও বোঝাতে পারত না কেন ওই ডাকটা এত আপন।
সেই রাতে সাদেক ঘুমোতে পারে না। সরকারি দল ঘাটের কাছেই তাঁবু ফেলেছে জরিপের জন্য। সকলে ঘুমিয়ে পড়লেও সাদেক জেগে থাকে, তার সামনে হেঁটে চলে সেই নাম—ভুবন। সে জানে, তার জীবনটা যে সত্যি সে জানত বলে মনে করত, তা আসলে অনেকখানি ভুলে মোড়া। রোশনা মা কি জানতেন এসব? তাকে ইচ্ছা করে বলেননি? নাকি নিজের সন্তানের মতো আগলে রেখে সবটুকু ঢেকে দিতে চেয়েছেন?
পরদিন সকালে সে আবার রমিজের কাছে আসে। বলে, “আমার জন্মের সময় বা জায়গা কিছু জানেন?” রমিজ বলেন, “ঘটনা হয়েছিল সাতচল্লিশের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। নদীতে তখন গুলির ভয়, মানুষ পালাচ্ছে দুই পারে। যেই মহিলা তোমারে নিয়ে আসছিলেন, তার গায়ের শাড়িটা ছিল ধুতি রঙের, আর কপালে একটা ছোট সিঁদুরের টিপ। আমি তাকে বলে দিয়েছিলাম, ঘাট পার করে দেব। কিন্তু মাঝপথে যে কী হল…” রমিজ থেমে যান। স্মৃতির ভারে তার চোখ জলজল করে ওঠে।
সাদেক মাথা নিচু করে বসে পড়ে। বলে, “আমি এখন কোথায় যাব? মা-বাবা বলেই যাদের জেনেছি, তারা যদি আমার আসল না হন, তাহলে আমি কার?” রমিজ হাত রাখেন তার পিঠে। বলেন, “তোর দুইটা নাম আছে, দুইটা পরিবার আছে। একটা যেটা তোকে জন্ম দিয়েছে, আরেকটা যেটা তোকে বাঁচিয়ে রেখেছে। দুইটাই তোর। এখন তুই ঠিক করবি তুই কে।”
সেই সন্ধ্যেয় সাদেক নদীর ধারে বসে কাঠের ঘোড়াটা হাতে নেয়। তার চোখে জল আসে, কারণ সে বুঝে গেছে—মানুষের ইতিহাস শুধু জন্ম দিয়ে গড়ে উঠে না, ভালোবাসা, স্মৃতি, আর হারিয়ে যাওয়া ডাকও একটা ইতিহাস। সে জানে, এখন তার সামনে দুটো রাস্তা—একটা অনুসন্ধান, নিজের শেকড় খোঁজা; আরেকটা ফিরে যাওয়া রোশনার কাছে, যিনি কোনোদিন তাকে ছেড়ে দেননি।
পদ্মার জলে তখন চাঁদের আলো পড়ে। রমিজ দূরে বসে থাকেন, আর মনে মনে ভাবেন—“জীবনটা আসলে নদীর মতোই। কেউ পার হয়, কেউ তলিয়ে যায়। কিন্তু কেউ কেউ দু’পারের মানুষ হয়েও মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে, একসঙ্গে দুটি নাম নিয়ে।”
পর্ব ৩
রাত গভীর হলে পদ্মার পাড় যেন আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। সাদেক তাঁবুতে ফিরে এলেও ঘুম আসে না। বারবার মাথার মধ্যে ঘুরে ফিরে আসে রমিজ আলীর সেই কথা—”তুই হইতে পারিস সেই ভুবন।” নিজের নামটাই যদি আসল না হয়, তবে তার এতদিনকার পরিচয়টাই কি ভুল ছিল? একটা মানুষ যদি নিজের শেকড় না জানে, তবে সে কি কেবল ভাসমান? গাছ যেমন মাটি ছাড়া টিকে থাকতে পারে না, তেমনি মানুষও কি পারে না? রোশনা মা-র মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। যিনি কোনোদিন কোনো প্রশ্ন তোলেননি, বরং বুকের ভেতর আগলে রেখেছেন তাকে যেন এক পাহাড়। মা তাঁকে নিজের করে নিয়েছিলেন নিঃশর্তে, কোনো দলিল ছাড়াই।
সকালে জরিপের কাজ আবার শুরু হয়। সাদেককে পাঠানো হয় গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলতে, কে কার জমি কোথায় রেখেছিল, সেইসব তথ্য সংগ্রহের জন্য। গ্রামের এক প্রৌঢ় হিন্দু ভদ্রলোক, মাধব লাহা, তাঁর স্মৃতি অনুযায়ী একটা ম্যাপ আঁকেন। তিনি বললেন, “দেশভাগের সময় হিন্দু-মুসলমান গুলিয়ে গেল রে বাবা, কে কার ঘর সেটা বোঝা যেত না। আমাদের পেছনের বাড়িটা ছিল নাকি এক ব্রাহ্মণ পরিবারের, নাম মনে নেই। তবে ছোট একটা বাচ্চা ছিল, চোখে ঘোর লাগা ভাব। একবার আমার স্ত্রী ওকে হাতে চিনি দিলেন, সে কিছু না বলে দৌড়ে এসে মায়ের আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে পড়ল।”
সাদেক তার কথা শুনে কেঁপে ওঠে। চোখে ঘোর লাগা বাচ্চা? মায়ের আঁচল? সেই তো সে নিজে? হয়তো। নইলে কেন এত চেনা লাগে কথাগুলো?
দিনের শেষে আবার দেখা হয় রমিজ আলীর সঙ্গে। তিনি ধীরে ধীরে হাঁটেন এখন, পা কাঁপে, শ্বাস ওঠে। তবু ছেলেটাকে দেখে চোখে আশার আলো। তিনি বলেন, “তুই চাইলে আমি তোর ঠাকুমার কবর দেখাতে পারি। উনি মরেননি গুলিতে, কিন্তু নদীর পাড়ে বসে থাকতে থাকতে একদিন আর চোখ খোলেননি। আমি আরেক মাঝিকে বলে দিয়েছিলাম, উনাকে যেন মাটি দিয়ে দেয়।” সাদেক চুপ করে থাকে। ভাবতে পারে না, যার মুখটাও ঠিকভাবে মনে নেই, সেই মানুষ তার সবচেয়ে বড় আত্মীয় ছিলেন একসময়।
পরদিন রমিজ আর সাদেক একটা ছোট নৌকায় চড়ে যায় নদীর অন্য পাড়ে। মাঝপথে সাদেক বলে, “আপনি তো তখন অনেক মানুষ পার করে দিয়েছিলেন। কাউকে কি মনে পড়ে?” রমিজ হেসে বলেন, “মনে থাকে না, কিন্তু গলার শব্দটা, চোখের চাহনিটা থেকে যায়। তুই যেমন আছিস।”
নৌকা ভিড়তেই দেখা যায় এক পরিত্যক্ত পুকুরের ধারে ছোট এক উঁচু জায়গা, জঙ্গলে ঢাকা। রমিজ ইশারা করেন, “এইখানেই শুইয়ে দিছিলাম। কেউ ছিল না পাশে, শুধু আমি, আর একটা কাঠের পুতুল।”
সাদেক নেমে যায় ঘাসের উপর, হাত রাখে মাটির গায়ে। কোনো স্মৃতি নেই, তবু বুকটা ভার হয়ে আসে। যেন হৃদয়ের গভীর থেকে কেউ হাত বাড়িয়ে বলছে—“তুই ফিরেছিস, ভুবন।”
সেদিন সন্ধ্যায় তারা ফিরে আসে। রমিজ বলেন, “তুই চাইলে খুঁজতে পারিস তোর আসল পরিবার, কেউ কেউ এখনো বেঁচে থাকতে পারে। তবে একটা কথা মনে রাখিস, তোর নাম ভুবন হলেও, তুই সাদেকও। এই দুই নামই তোর পরিচয়।”
সাদেক মাথা হেঁট করে বসে। দু’চোখ বেয়ে জল পড়ে। একটা মানুষ দুটি নাম নিয়ে বাঁচতে পারে কি? নাকি একটা নাম বেছে নিলে অন্যটা মুছে যায়?
রমিজ শেষবারের মতো তার কাঁধে হাত রেখে বলেন, “ভুবন মানে যে বিশ্বে বাস করে। আর সাদেক মানে সত্যবাদী। তুই দুই নামেই ভালোবাসার মানুষ হ, এই নদী সাক্ষী থাক।”
পর্ব ৪
ফিরে এসে সাদেক চুপচাপ বসে রইল নদীর ধারে, কাঠের ঘোড়াটাকে কোলে নিয়ে। নৌকার বাঁধন ছিঁড়ে বয়ে চলা নদীর মতোই তার জীবনের বাঁধনগুলো একে একে আলগা হয়ে যাচ্ছে। এতদিন যাকে নিজের বলেই জেনেছে, সেই পরিচয় আজ প্রশ্নের মুখে। আবার যাদের হারিয়ে ফেলেছিল জন্মের আগেই, তাদের ছায়া যেন এখন ভেসে উঠছে জলের ঢেউয়ের ফাঁকে।
জরিপের কাজ প্রায় শেষ, আর দুদিনের মধ্যেই শহরে ফিরে যেতে হবে। সেই ভাবনায় মন অস্থির হয়ে ওঠে সাদেকের। সে ভাবে, এবার কি সব কথা বলে ফেলা উচিত রোশনা মা’র কাছে? যদি বলেন—“তুই আর আমার ছেলে নোস”, তাহলে কী হবে? তবু সে জানে, সত্যিটা জানানো দরকার।
রাতে তাঁবুতে ফিরে এসে সে চুপচাপ ডায়েরি খুলে লিখতে থাকে—
“আজ আমি জানলাম আমার নাম ভুবন হতে পারত। কিন্তু আমি সাদেক হয়ে উঠেছি, মায়ের ভালোবাসায়, বাবার সাহসিকতায়। আমার দেহ হয়তো এক ধর্মের, কিন্তু আত্মা তৈরি হয়েছে ভালোবাসায়।”
পরদিন সকালে রোশনা মা-কে ফোন করে। একটু দ্বিধা নিয়ে বলে, “মা, আমি একটা কথা জানতে পেরেছি।” ওপাশে নিঃশব্দ। তারপর রোশনার কণ্ঠে আসে চাপা দমবন্ধ স্বর—“তুই জেনে গেছিস তাই তো?” সাদেক চমকে যায়। “আপনি জানতেন?”
“হ্যাঁ রে। তোর মুখে যে ভাষা ছিল, চোখে যে গল্প, তা কি আমি বুঝিনি? আমরা বলিনি কারণ ভয় পেতাম—তুই যদি একদিন চলে যাস, যদি বলিস, তুমি আমার কিছু না। তাই বলিনি। কিন্তু মনে মনে জানতাম, তুই একদিন জানতে চাইবি।”
সাদেকের চোখে জল এসে যায়। সে বলে, “তুমি আমার মা। আমি আর কিছু চাই না। আমি শুধু জানাতে চেয়েছিলাম, আমি খুঁজে পেয়েছি সেই নাম, সেই হারানো ঠাকুমা, যিনি আমাকে আঁকড়ে রেখেছিলেন সেই ভয়াল দিনেও।”
ওপাশে রোশনাও কাঁদছেন, কিন্তু গলায় প্রশান্তি—“ভুবন হ না হ, তুই আমার সাদেকই থাকবি।”
সেদিন সন্ধ্যাবেলা সাদেক সিদ্ধান্ত নেয়, সে ঢাকায় ফিরে যাবে না সরাসরি। সে প্রথমে যাবে সেই পুরোনো গ্রামে, যেখানে মাধব লাহারা থাকেন। খুঁজে বের করবে পুরোনো প্রতিবেশীদের, কেউ যদি ভুবনের কথা মনে রাখে!
রমিজ আলী তাকে বিদায় জানাতে আসেন ঘাটে। হাতে একটা ছোট পুঁটলি—তার ভাঙা রেডিও আর পাটকাঠির ছাঁচে গড়া একটি ছোট বাঁশি। “তোর ঠাকুমা গান গাইতেন। এই বাঁশি তুই রাখ, যদি কখনো মনে হয় ডাক শোনার দরকার, বাজা এইটা।”
সাদেক জড়িয়ে ধরে বৃদ্ধ মাঝিকে। তাদের দুজনের চোখে জল, তবু ঠোঁটে এক টুকরো হাসি।
তিনি বলেন, “নৌকা চালিয়ে অনেক বছর কাটাইলাম। অনেক মানুষ পার করাইলাম। কিন্তু তোকে দেখে মনে হয়, আমি নিজেই যেন একদিন ওপার থেকে ফিরে আসছি।”
সাদেক তখন নিজের কাঁধে ব্যাগ তুলে নেয়। সামনে গ্রাম, পেছনে নদী। আর বুকের ভিতর এক অদ্ভুত ভার—যে ভার একসঙ্গে দুটো নামের, দুটো ইতিহাসের, দুটো ভালোবাসার।
রোদের আলোতে পদ্মা তখন ঝলমল করছে। সে হাঁটতে শুরু করে, পায়ের ছায়া পড়ে নদীর জলে।
কেউ একজন তখন নিশ্চয়ই আকাশ থেকে দেখছেন—এক ছেলে দুই নাম নিয়ে ফিরছে, একদিন হারিয়ে যাওয়া নদীর ঘাটে।
পর্ব ৫
গ্রামটা এখন অনেক বদলে গেছে, তবুও কিছু পুরোনো ইটের গন্ধ, কিছু ধুলোমাখা সরু গলি আর কুয়োর পাশে শুকনো তুলসী গাছ এখনো বেঁচে আছে স্মৃতির মতো। সাদেক ধীরে ধীরে হাঁটে, যেন প্রতিটি পদক্ষেপে মাটি তার পায়ের নিচে নিজেকে চিনে নিচ্ছে। সে এসে দাঁড়ায় সেই মাধব লাহার বাড়ির সামনে। দরজায় কড়া নাড়তেই বৃদ্ধ বেরিয়ে আসেন, হাতে লাঠি, কপালে দাগ কাটা বয়সের ছায়া।
“আপনি আমাকে চিনবেন না,” সাদেক বলল, “কিন্তু আমি একটা ছেলের খোঁজে এসেছি। নাম ভুবন হতে পারে। সাতচল্লিশ সালে হারিয়ে গিয়েছিল।” মাধববাবু গভীরভাবে তাকান সাদেকের মুখে। “তোর মুখে একরকম চেনা চেহারা আছে… তুই কি রঘুনাথ চক্রবর্তীর ছেলের খোঁজ করছিস?” সাদেক মাথা নেড়ে বলে, “হ্যাঁ, সম্ভবত।”
মাধববাবু ভিতরে গিয়ে একটা পুরোনো খাতা নিয়ে আসেন। “দেশভাগের পরে আমরা এখানে থেকে গিয়েছিলাম। আমার স্ত্রী সবকিছু লিখে রাখতেন। এই দেখো—‘ভুবন নামে ছোট্ট একটা ছেলে ছিল, ঠাকুমার সাথে পালিয়ে যাচ্ছিল, নদীতে হারিয়ে যায়। তার ঠাকুমার নাম গিরিজা।’” সাদেক কেঁপে ওঠে। সব মিলে যাচ্ছে। রমিজ আলী যেমন বলেছিলেন, তেমনি এঁর লেখাতেও মিল।
“আপনি কি জানেন রঘুনাথবাবুর আর কেউ বেঁচে আছেন?” সাদেক জিজ্ঞেস করে। মাধববাবু বলেন, “ওনার বড় ভাইয়ের মেয়ে এখনো আছে, কলকাতায়। নাম রানু চক্রবর্তী। পণ্ডিত মেয়েমানুষ। মাঝে মাঝে আসে গাঁয়ে। তোকে ওর খোঁজ করতে হবে।” সাদেক বলেন, “আপনি যোগাযোগ করতে পারবেন?” বৃদ্ধ একটা নম্বর লিখে দেন পুরোনো নীলচে খাতার পেছনে।
পরদিন খুব ভোরে, ট্রেন ধরে সাদেক কলকাতায় পৌঁছায়। শহরটা তার কাছে নতুন, তবুও অচেনা নয়। রোড সাইডে চায়ের দোকান, হলুদ ট্যাক্সি, পানের দোকান, আর ব্যস্ত মানুষের ভিড়—সব যেন তার ভেতরে কোনো হারানো স্মৃতির দরজা খোলে।
রানু চক্রবর্তীর বাড়িতে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে যায়। ছোট্ট একটি বইপড়া বাড়ি, জানালার ধারে রোদে ভেজানো ধুতি, আর একপাশে কাগজে মোড়ানো গরম পাঁউরুটি। কলিং বেল চাপতেই এক শাড়ি পরা মাঝবয়সী মহিলা দরজা খোলেন। গলায় শান্ত এক রাগ, চোখে বুদ্ধির দীপ্তি। “আমি রানু চক্রবর্তী,” তিনি বলেন।
সাদেক কাঁপা কণ্ঠে বলে, “আমি ভুবন হতে পারি… আমি আপনার আত্মীয়।” রানু চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। তারপর আস্তে বলেন, “ভুবন? আমাদের পরিবারের সেই হারিয়ে যাওয়া নাম… তুমি কোথায় ছিলে এতদিন?” সাদেক ধীরে ধীরে সবটা বলে, রোশনার পরিবার, কাদির, রমিজ মাঝি, কাঠের ঘোড়া, আর নদীর পাড়ে হারানো সেই রাতের কথা।
রানু চুপ করে থাকেন, তারপর তার চোখ দিয়ে ধীরে ধীরে জল গড়ায়। “তুই যদি ভুবন হোস, তবে তোর ঠাকুমা আমার কাকিমা ছিলেন। তিনি একাই পার হচ্ছিলেন তোকে নিয়ে। আমরা ধরে নিয়েছিলাম, দুজনেই মারা গেছ।” তারপর রানু নিয়ে আসেন একটি ছোট ফটো অ্যালবাম। পুরোনো ছবি, কালচে হয়ে যাওয়া, তবুও একটি ছবিতে সাদেক থমকে যায়—এক বৃদ্ধা, কোলে একটি শিশু, আর পাশে এক যুবক।
“এই তোমার ঠাকুরদা রঘুনাথ, আর এই ছবিটা নদীতে যাওয়ার কয়েকদিন আগে তোলা হয়েছিল।” সাদেক সেই শিশুর মুখে তাকিয়ে থাকে। হ্যাঁ, এটাই সে। তার চোখের আকৃতি এখনো বদলায়নি। সাদেক ফুঁপিয়ে ওঠে। তার সামনে এখন তার অতীত দাঁড়িয়ে, যেন অনেক বছর পরে আয়নাটা ফিরিয়ে দিয়েছে হারানো মুখ।
রানু তার হাত চেপে ধরে বলেন, “তুই একটাই ছেলে বেঁচেছিলি। তোর খোঁজ তো কেউ পায়নি। আজ এতদিন পরে ফিরে এলি, এখন থেকে এই ঘরও তোর। আমি তো কখনও বিয়ে করিনি, তুই চাইলে এখানেই থাক।”
সাদেক মাথা নোয়ায়, তার দুই চোখ ভেসে যায় জলস্রোতে। সে জানে, সে শুধু ভুবন নয়, সে সাদেকও। কিন্তু আজ, এই ঘরের মধ্যে, সে তার হারানো অক্ষরগুলো খুঁজে পেয়েছে—নিজের গল্প, নিজের শুরু।
পর্ব ৬
রানু চক্রবর্তীর ছোট্ট বইপড়া ঘরটা যেন এক আর্কাইভ, যেখানে দেয়ালে দেয়ালে ধুলো জমেছে ইতিহাসের মতো, আর তাকজোড়া বইয়ের ভেতর আটকে আছে সময়। সাদেক ধীরে ধীরে ঘরের প্রতিটি কোণ স্পর্শ করে, যেন তার নিজস্ব কোনো কিছু খুঁজছে—শুধু বস্তু নয়, বরং সেই হারিয়ে যাওয়া শিকড়ের গন্ধ, যা সে কখনও জানত না, কিন্তু আজ হঠাৎ করে তার সমস্ত অস্তিত্বকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। রানু তাকে দিয়ে দেন কিছু চিঠি—রঘুনাথ চক্রবর্তীর হাতের লেখা, কাকিমাকে লেখা। সেখানে লেখা—“ভুবনকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি, যেন সে নদীর ওপারে হাসছে।”
চিঠিগুলো পড়তে পড়তে সাদেকের চোখে জল আসে। তার তো এইসব জানার কথা ছিল না। এইসব চিঠির ভাষা, এইসব পরিবারের গল্প—সবটাই কেবল বইয়ে পড়া গল্পের মতো ছিল। অথচ আজ, বাস্তব হয়ে এগুলো তার হাতে ধরা দিয়েছে। রানু বলেন, “তুই চাইলে এখানে থেকে যেতে পারিস, এই বাড়ি তোর। আমি তো একা মানুষ।” কিন্তু সাদেক জানে, তার আরেকটা বাড়ি আছে, আরেকটা মা আছে, আরেকটা নাম আছে। সে জানে—দুই নদীর মাঝে সে দাঁড়িয়ে, এক পায়ে ভুবন, এক পায়ে সাদেক।
সন্ধ্যেবেলায় সে হাঁটতে বের হয়। কলেজ স্ট্রিটের ধারে কিছু পুরোনো বইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে থাকে, দেখে ‘পূর্ববঙ্গের দেশভাগ স্মৃতি’ বইয়ের খোলা পাতা। সেখানে কেউ লিখেছেন, “ভাঙন শুধু নদীর মাটি টানে না, মানুষের আত্মাকেও টানে।” সাদেক সে লাইনটা পড়ে থেমে যায়। কারণ ঠিক সেরকমই তো তার জীবনের গল্প।
রাতে রানু খিচুড়ি আর বেগুনভাজা বানান, আর বলেন, “তুই জানিস? তোর ঠাকুমা খুব ভালো রান্না করতেন। নদীপাড়ে বসে কচুশাক দিয়ে মুড়িঘন্ট খাওয়াতেন সবাইকে।” সাদেক হেসে ওঠে। বলে, “রোশনা মা-ও তাই করেন। শুধু বলতেন, ‘তুই তো নদীর পোলা, পান্তাভাতে তোর মন।’” রানু তাকিয়ে থাকেন গভীরভাবে। বলেন, “তুই তো দুই জায়গার সন্তান। তোর রক্তে আছে দুই মাটির ঘ্রাণ।”
পরদিন সকালে সাদেক রানুকে বলেন, “আমি এখন ঢাকায় ফিরব, কিন্তু এখানে ফিরে আসব আবার।” রানু কেঁদে ফেলেন। বলেন, “তুই চলে যাস না, তুইই তো আমাদের শেষ ভুবন।” সাদেক কাছে এসে বলেন, “ভুবন থাকবো, কিন্তু সাদেক হিসেবেই ফিরে যাব। রোশনা মা অপেক্ষা করছেন। আমার দুই নামই এখন দরকার, কারণ এই দুই নাম ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ।”
রানু তখন তাকে নিয়ে যান বাড়ির পেছনে। সেখানে একটা ছোট গাছ লাগানো ছিল, শুকিয়ে গেছে অনেকটা, তবু তলায় একটা প্লেট। তাতে খোদাই করা—“ভুবনের অপেক্ষায়।” সাদেক সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। তার সামনে তার নাম, পেছনে তার ইতিহাস, আর মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায় একটা সাদা কাক। রানু বলেন, “তোর ঠাকুমা মরার আগের রাতে বলেছিলেন—‘আমার ভুবন একদিন ফিরে আসবে, হয়তো অন্য নামে, তবু চিনে নেব।’”
সাদেক জানে, তার ফেরা হয়েছে। তবু তার সামনে আরেক নদী, আরেক তীর—সেইখানে রোশনা বসে আছেন, এক ছেলে ফিরে আসবে বলে। সে এবার ফিরবে, রমিজ আলীর দেওয়া বাঁশিটা হাতে নিয়ে, যার সুর বয়ে আনবে দুই পাড়ের গান।
পর্ব ৭
ঢাকায় ফিরে আসার সময় ট্রেনের জানালার পাশে বসে ছিল সাদেক, মাথায় হালকা পাগড়ি, কাঁধে পুরোনো ব্যাগ, আর হাতে আঁকড়ে ধরা ছিল সেই কাঠের ঘোড়া ও বাঁশিটা—দুটি বস্তু, দুই নামের দুই স্মৃতি। রাত্রির অন্ধকারে ট্রেন ছুটে চলেছিল, আর তার ভিতরে সাদেক ভুবনের গল্প বুনে চলেছিল চুপচাপ। সে জানত, এই ফিরফিরে বাতাসের মধ্যে তার হৃদয়ের মধ্যে নদীর দুই পাড় একে অপরকে খুঁজে ফিরছে।
রোশনা দরজা খুলে তাকিয়ে ছিলেন। পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল কাদির, মুখে ক্লান্তি আর চোখে অপেক্ষা। সাদেক দরজার ধারে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি ফিরে এলাম মা।” রোশনা কোনো কথা না বলে তাকে বুকে টেনে নিলেন, এতটুকু দ্বিধা না রেখে, এমনকি চোখের জল লুকোতে না পেরে। “তুই তো আমারই ছেলে,” তিনি ফিসফিস করে বললেন, “তুই যদি অন্য নামও হোস, আমি তোকে ছাড়তে পারি না।”
সেদিন রাতে তিনজন একসাথে খেয়ে ছিল। রোশনা সাদেকের পাতে তুলে দিয়েছিলেন শুটকির ভর্তা আর ভাত। সাদেক প্রথমে থেমে গিয়েছিল—এই খাবার তো এখন তাকে কেমন অপরিচিত লাগে। কিন্তু খেতে খেতেই বুঝেছিল, স্বাদের সঙ্গে জুড়ে থাকে সময়, আর ভালোবাসা। পরদিন কাদির তাকে নিয়ে যায় পাশের মসজিদে। হুজুর জিজ্ঞেস করেন, “তুমি তো দেশের কাজ করছো, নাম কী বললাম?” সাদেক একটু থেমে বলে, “সাদেক ভুবন রহমান।” হুজুর একটু অবাক হয়ে তাকান, তারপর মাথা নেড়ে বলেন, “নাম তো মানুষের পরিচয় নয়, তার কাজই বড় পরিচয়।”
এরপর সাদেক চাকরিতে আবার যোগ দেয়, কিন্তু সে এখন আর শুধু এক সরকারি কর্মচারী নয়, সে এক যাত্রী, যে দুটি পাড়ের মধ্যখানে সেতু হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে রোশনা দেখেন, সে বাঁশি বাজাচ্ছে বারান্দায় বসে, খুব মৃদু সুরে। রোশনাও হাসেন, বলেন, “তোর সুরের ভেতরে নদীর কান্না আছে রে।”
একদিন সে রমিজ আলীকে চিঠি লেখে—“আপনি আমার জীবন পাল্টে দিয়েছেন। আপনি শুধু মাঝি নন, আপনি হলেন সেই সেতু, যার ওপর দিয়ে আমি ফিরে পেয়েছি আমার দুই নাম, দুই মাটি, দুই মা।”
রমিজ সেই চিঠি হাতে পান এক সন্ধ্যায়, চোখে চোখ রেখে পড়েন চিঠির প্রতিটি শব্দ। চিঠির শেষ লাইনে লেখা—
“আমি এখন শুধু এক নামের মানুষ নই, আমি সেই নৌকার সন্তান, যে দুটি নাম নিয়ে বাঁচে।”
পরদিন সকালে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে খবর—রমিজ মাঝি আর নেই। নদীর ধারে তার ঘরে পাওয়া যায় একখানি বাঁশি, আর পাশে সেই কাঠের ঘোড়ার একটা প্রতিরূপ, যেন তিনি রেখে গেছেন তার সমস্ত স্মৃতি সেই নদীর জন্য।
সাদেক খবর শুনে চুপ করে থাকেন, চোখে জল আসে না, আসে এক অদ্ভুত শান্তি। তিনি জানেন, মাঝি নিজের গন্তব্যে পৌঁছেছেন।
তারপর একদিন সে কলকাতায় ফিরে যায়। রানু তখন এক সাহিত্যসভার আয়োজন করছেন—দেশভাগ স্মৃতিচারণ। সাদেক সেখানে বক্তৃতা দেয়। বলে, “আমি দুই দেশের, দুই ধর্মের, দুই নামের মানুষ। আমি ভুবন হয়েছি জন্মসূত্রে, আর সাদেক হয়েছি ভালোবাসায়। এই দুই নাম একে অপরকে ছুঁয়ে থাকে আমার হৃদয়ের মতো। আমি সেই নৌকার সন্তান, যার পাড় নেই, কিন্তু দিক আছে—ভালোবাসার দিক।”
তার কথায় সভা স্তব্ধ হয়ে যায়। কেউ ফিসফিস করে বলে, “এ তো শুধু গল্প নয়, এ তো ইতিহাস।”
পর্ব ৮
সেদিন সন্ধ্যায়, কলকাতার সেই সাহিত্যসভার পর, সাদেক ভুবন রহমান একা হাঁটছিল কলেজ স্ট্রিটের ধারে। বইয়ের গন্ধে ভেজা বাতাস, ফুটপাথে ছড়ানো পুরোনো পত্রিকা আর বাতির নিচে বসে থাকা বৃদ্ধ বই বিক্রেতা—সব কিছু যেন তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল, সে এখন একটা গল্পের শেষ পাতার দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু শেষ মানেই কি ফুরিয়ে যাওয়া? নাকি, নতুন করে শুরুর সুযোগ?
রানু তখন চায়ের কাপ হাতে এসে পাশে দাঁড়ান। বলেন, “তুই চাইলে এখানেই থেকে যেতে পারিস।” সাদেক হেসে মাথা নাড়ে। “আমার থাকার জায়গা তো এখন শুধু একটা শহর নয়। আমার গন্তব্য হচ্ছে দুই মাটির মাঝে, দুই মা’র বুকে। আমি থাকব ওদের মাঝখানে, ঠিক যেমন মাঝি থাকে নদীর মাঝপথে, যাত্রী পার করিয়ে দিয়ে আবার নিজের ঘাটে ফেরে না।”
সেদিন রাতেই সে লিখতে বসে। গল্প নয়, স্মৃতিচারণ। লেখার নাম দেয়—“একটি নৌকা, দুটি নাম”। সে লেখে, “নাম আমাদের পরিচয় দেয়, কিন্তু আমরা কেবল নাম নই। আমরা সেইসব গল্প, যেগুলো বলা হয়নি, সেইসব কান্না যেগুলো হারিয়ে গেছে ঢেউয়ের নিচে, আর সেইসব মানুষ যাদের মুখ আজ কেবল সুরভির মতো রয়ে গেছে মনে।”
এরপর কিছুদিন পেরিয়ে যায়। একদিন ডাক আসে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ মানবিক পুরস্কার বিতরণীর। তার লেখা পুরস্কার পায়। কিন্তু মঞ্চে উঠেই সাদেক বলে, “আমি এই সম্মান নিচ্ছি দুই মা’র নামে—একজন আমাকে জন্ম দিয়েছিলেন, আর একজন আমাকে ধরে রেখেছিলেন।” সারা হল তখন দাঁড়িয়ে করতালি দেয়, কিন্তু তার চোখে শুধু ভেসে ওঠে রোশনা আর রানু, দুজনের চোখের জল মিশে গেছে দুই নদীর জলে।
শেষবার পদ্মার ঘাটে এসে দাঁড়ায় সাদেক। আজ আর কোনো মানুষ পার করাতে হবে না, আজ সে এসছে নিজের দুটো নামকে একবার ছুঁয়ে দেখতে। সে মাটির ভেতর পুঁতে দেয় কাঠের ঘোড়াটা। পাশে রাখে বাঁশিটা। দুটো জিনিস, যা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল হারানো পরিচয়।
বসে পড়ে ঘাটের সিঁড়িতে, আর মন্থর স্বরে বলে, “এই নদী আমায় দুই দিকে ভাগ করেছে, কিন্তু আমার ভিতরটা জুড়ে দিয়েছে।” হঠাৎ এক পাখি উড়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে। হাওয়ায় ভেসে আসে একটা পুরোনো গান—কোনো কালে গাওয়া হয়েছিল কি না জানা নেই, কিন্তু মনে হয় সেই সুরেই হয়তো একদিন গিরিজা চক্রবর্তী ঘুম পাড়াতেন তার নাতিকে।
ঘাটে তখন আর কেউ নেই। কেবল সাদেক বসে আছে, মাথায় হালকা পাগড়ি, মুখে স্থির এক তৃপ্তি। তার পেছনে পদ্মার ঢেউ ধীরে ধীরে ঘাটে এসে লাগে, আবার ফিরে যায়। সেই জল কখনো সাদা, কখনো মাটি রঙা, কিন্তু তাতে মিশে থাকে সেইসব মুখ, নাম আর গল্প, যাদের কেউ আলাদা করে রাখতে পারে না।
শেষে, সাদেক উঠে দাঁড়িয়ে বাঁশিটা তুলে নেয়। ঠোঁটে নিয়ে একটা টান দেয়। নদী চুপচাপ শোনে, আকাশে কেউ হয়তো হাসে, আর ইতিহাসের বুকের ভেতর লেখা হয় একটি নতুন লাইন—
“সে একজন মানুষ, যার দুই নাম ছিল, কিন্তু একটাই হৃদয়।”
(শেষ)
				
	

	


