সুদীপ্ত চৌধুরী
পর্ব ১
আমার জন্ম হয়েছিল এক গরম দুপুরে, হাওড়ার একটি ছোট গ্যারেজের ভেতর। চারপাশে ধুলো, কাঠের গন্ধ, আর যন্ত্রপাতির আওয়াজ। তখন আমি কিছুই বুঝতাম না—শুধু টের পাচ্ছিলাম, কিছু একটা নতুন হচ্ছে। লোহা, রাবার আর রঙের গন্ধে ভরা সেই অদ্ভুত পরিবেশে কেউ আমাকে তৈরি করছিল, নিঃশব্দে, নিখুঁতভাবে। আমার কঙ্কাল জুড়ে নিচ্ছিল একে একে চাকা, হ্যান্ডেল, প্যাডেল। আমার গায়ে পড়ছিল চকচকে লাল রঙ, ঠিক যেন একটা নতুন জামা। সেই রঙে আমার আত্মা খুঁজে পেল নিজেকে।
আমার গায়ে প্রথম স্পর্শ দিয়েছিল একটি খুদে হাত—সে ছিল শিবু, বছর আটেকের এক ছেলেমানুষ। ওর বাবা সেই গ্যারেজে কাজ করত, আর আমাকে তৈরি করেছিল তাঁরই হাত। শিবু প্রথম যেদিন আমাকে ছুঁল, আমি যেন প্রথমবার অনুভব করলাম স্পর্শের আনন্দ। সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলেছিল, “এইটা আমার?” তার বাবার হাসি তখন আমার রঙের থেকেও উজ্জ্বল ছিল। “হ্যাঁ রে, তোর জন্মদিনের উপহার।”
সেদিনই প্রথম শিবু আমাকে ঠেলে রাস্তায় বের করল। আমি তখনও সোজা চলতে পারি না, হেলে পড়ি একদিকে। পেছনে দুটো ছোট চাকা ছিল, আমার ‘ট্রেনিং হুইল’। ওদের পাশে আমি নিরাপদ ছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম, একদিন আমায় একলা চলতে শিখতেই হবে।
আমাদের গলি ছিল সরু, বাঁকানো, কাঁচা রাস্তা। মাঝেমধ্যে গরু-ছাগল ঘুরে বেড়াত, রিকশার শব্দ শোনা যেত, আর পাড়ার মাসিমারা কলের পাশে পাট ভিজিয়ে রাখত। সেই রাস্তায় আমার প্রথম চলা, প্রথম প্যাডেল ঘোরানো—তখন যেন আমি হাওয়ার সঙ্গে কথা বলছিলাম।
প্রথম দিকে শিবু আমায় একটু ঠেলে দিত, আমি এগিয়ে যেতাম। কখনো হোঁচট খেতাম, কখনো থেমে যেতাম। একদিন পেছনের চাকা দুটি খুলে ফেলা হলো। শিবুর বাবা বলল, “এবার একা চালা।” আমি ভয় পেতাম, কিন্তু শিবুর পায়ে ছিল সাহস। সে বলল, “চল, আমি আছি।”
আমি কাঁপতে কাঁপতে চললাম, শিবুর হাওয়ার মতো ছোট্ট হাত আমার হ্যান্ডেল ধরে রাখল। তারপর হঠাৎ করেই সে ছেড়ে দিল। আমি বুঝতে পারিনি। বুঝলাম যখন শিবুর চিৎকার শুনলাম—“তুই চলছিস! একাই চলছিস!”
সে ছিল আমার জীবনের প্রথম স্বাধীনতা।
একটা ছোট লাল সাইকেল, তার ছোট্ট চালক, আর আমাদের অদ্ভুত বন্ধুত্বের শুরু সেদিন।
আমরা একসঙ্গে পেরিয়ে গেলাম গলি, মাঠ, খেলার পার্ক, স্কুলের সামনের রাস্তা। শিবু যখন খুশি হতো, আমার প্যাডেল দমে উঠত। যখন কাঁদত, আমি ধীরে চলতাম, যেন বুঝি—তার চোখের জল যেন আমারও চাকা ভিজিয়ে দিত।
একদিন শিবু আমায় নিয়ে গিয়েছিল মাঠে, যেখানে বড়োদের সাইকেল রেস হয়। আমি ভয় পেয়েছিলাম—আমার পাশে তখন সব বড়ো বড়ো সাইকেল, তাদের হ্যান্ডেল মোটা, চাকা বিশাল। আমি ছোট, সরু আর হালকা। শিবু বলল, “আমরা জিততে নাও পারি, কিন্তু দৌড়াতে পারি তো!”
সেই দৌড়টা আমি কোনোদিন ভুলব না। সূর্যের আলোয় আমাদের ছায়া পড়েছিল মাঠজুড়ে। আমরা শেষ হয়েছিলাম সাত নম্বরে, কিন্তু শিবু বলেছিল, “তুই তো আমার হিরো।”
আমার গায়ে তখন ধুলো, প্যাডেল গরম, কিন্তু আমার হৃদয় যেন হাওয়ার মতো উড়ছিল।
আমি জানতাম না, সময় একদিন আমার চাকা ধীরে ধীরে থামিয়ে দেবে।
পর্ব ২
সময় একটা অদ্ভুত যন্ত্র। সে কখনো জোরে ছুটে চলে, কখনো থেমে থাকে কিছু মুহূর্তের জন্য। আমার জীবনের সেই প্রথম কয়েক বছর যেন ঘুরে চলা এক ঘূর্ণির মতো—সকাল, বিকেল, ছুটির দিন, পরীক্ষা ফুরনো বিকেল কিংবা সন্ধ্যার ঠিক আগে শেষ চক্কর—সবেতেই আমি আর শিবু জুটি বেঁধে ছিলাম।
শিবু তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। স্কুলের ব্যাগ আমার হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে দিত, আর পেছনে সে তার নীল টিফিন বক্স বেঁধে দিত রশি দিয়ে। “যদি পড়ে যায়,” বলে হেসে ফেলত। আমি হাসতে পারতাম না, কিন্তু মনে মনে হাসতাম বোধহয়। কারণ ওর হাতের টিফিনের গন্ধ আমার গায়ে লেগে থাকত—লুচি, আলুর দম, আর শুকনো নারকেল বরফি।
একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে বৃষ্টি এলো। আচমকা। আকাশ কালো হয়ে গিয়েছিল, যেন কেউ রঙ উল্টে দিয়েছে। আমরা ভিজতে শুরু করলাম, পলিথিন ছিল না, ছাতা ছিল না। শিবু বলল, “চল, বাড়ি না গিয়ে একটু মাঠে যাই।” আমি কিছু বলিনি। প্যাডেল ঘুরল।
মাঠটা কাদায় ভরে গিয়েছিল, চাকা ঢুকে যাচ্ছিল ভিতরে। কিন্তু শিবু থামেনি। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চালাচ্ছিল আমাকে, তার মুখে এক অদ্ভুত উন্মাদনা। যেন মুক্তি, যেন মজা, যেন স্বপ্নের ভিতর একটা রোলার কোস্টার। আমি পিছলে যাচ্ছিলাম, আবার উঠছিলাম। একসময় ও পড়ে গেল, আমি উল্টে গেলাম।
আমার হ্যান্ডেলের একপাশে দাগ পড়ল। চামড়া ছিঁড়ে লোহার আভাস ফুটে উঠল। সেটা আমার প্রথম ক্ষত।
সেদিন রাতে আমাকে বাইরে ফেলে রাখা হয়েছিল। ভিজে গিয়েছিলাম। গায়ে ঠান্ডা জমে ছিল, চাকা ঘোরাতে মন চাইছিল না। শিবু সকালে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর চোখে দুঃখ ছিল। হাতে এক টুকরো কাপড় আর একটু তেল। ও আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিল, হ্যান্ডেলের দাগে আঙুল দিয়ে ঘষে ঘষে তেল লাগাল। বলল, “দুঃখ পেয়েছিস? আমিও পেয়ে থাকি মাঝে মাঝে। কিন্তু আমরা না, বন্ধু।”
ওর এই কথাগুলো আমার লোহা গায়ে বুলিয়ে যাওয়া উষ্ণতার মতো লাগল। বুঝলাম, আমি শুধুই লোহার তৈরি নই। আমি আর ও একসঙ্গে তৈরি একটা সময়ের গল্প।
এরপর শুরু হলো নতুন পর্ব—শিবুর বন্ধুরা। তারা সবাই আমাকে নিয়ে টানাটানি শুরু করল। কে চালাবে, কে পেছনে বসবে, কে সাইকেলের হর্ন বাজাবে। হ্যাঁ, আমার গায়ে তখন ছোট্ট একটা ঘণ্টা লাগানো হয়েছিল, ‘টিং টিং’ শব্দ হত। শিবু সেটা নিজেই লাগিয়েছিল, বলেছিল, “তুই এখন আসল সাইকেল।”
কিন্তু একদিন, সেই বন্ধুত্বের ভিড়ে, আমি বুঝলাম—শিবু আমার গায়ে আর আগের মতো হাত বোলায় না। আগে আমি ছিলাম একমাত্র, এখন আমি একটা জিনিসের মতো। একদিন বিকেলে রমেন নামের এক ছেলে জোর করে আমাকে চালাতে চাইল। শিবু বলেছিল, “না না, তুই সামলাতে পারবি না।” রমেন জেদ করে বসে পড়ল, আমি জানতাম ওর ভারসাম্য নেই।
পাঁচ মিনিটও হয়নি, আমি উল্টে গেলাম। হ্যান্ডেলের দাগ বড়ো হলো, সিটের নিচে একটু ফেটে গেল। রমেন উঠে দাঁড়িয়ে হেসে চলে গেল, আর শিবু শুধু বলল, “তুই ঠিক আছিস তো?”
সেদিন আমি উত্তর দিতে পারিনি। চাইছিলাম চিৎকার করে বলতে, “আমি তোকে ছাড়া ভালো নেই!”
কিন্তু সময় থামে না। শিবুর নতুন বন্ধুরা, বড়ো হয়ে যাওয়া ক্লাস, নতুন বই, নতুন ঝোঁক—সব কিছুর মাঝে আমি ক্রমে দাঁড়িয়ে থাকি বাড়ির বারান্দার কোণে। আগে যেখান থেকে দিনে দশবার বের হতাম, এখন সেখানে সপ্তাহে একদিন ডাক পড়ে।
চাকা একটু শক্ত হয়ে গিয়েছে, প্যাডেল ঘোরাতে কষ্ট হয়। টায়ারে হাওয়া কম, কিন্তু কেউ টের পায় না। আমি শুধু চুপ করে দেখি, শিবু প্রতিদিন একটু একটু করে বড়ো হয়ে উঠছে।
একদিন রাতে ও বলল, “বাবা, এবার একটা বড়ো সাইকেল চাই।”
আমার গায়ে তখন ধুলো জমে, রঙ ফ্যাকাসে, ঘণ্টা চুপ। আমি শুনলাম। আমার হ্যান্ডেলটা যেন নিজেই ঢলে পড়ল কিছুটা।
পর্ব ৩
বাড়ির বারান্দার এক কোণায় আমি তখন দাঁড়িয়ে থাকি দিনের পর দিন। আগে যেখানে সকালবেলা সূর্য উঠতেই আমি ঘুরে বেড়াতাম রাস্তায়, মাঠে, স্কুলের পথে, এখন সেখানে সূর্য ডোবে আমার চাকা না ঘুরিয়েই। আমার চারপাশে পড়ে থাকে ভাঙা বালিশ, পুরোনো ছাতার হাড়, পাটকাঠির ঝুড়ি। কেউ আর আমার ওপর হাত বোলায় না, কেউ বলে না, “চল তো, একটু চক্কর মেরে আসি।”
শিবু তখন ক্লাস সেভেনে উঠেছে। ওর কাঁধে এখন ভারি ব্যাগ, পায়ে স্কুলশু, হাতে নতুন স্বপ্ন। আমি বুঝতাম, একটা সময় আসে যখন ছেলেরা বড়ো হয়, আর ছোটো জিনিসগুলো ধীরে ধীরে ছোটোই থেকে যায়—তাদের আর দরকার পড়ে না।
তবু আমি প্রতিদিন অপেক্ষা করতাম। কোনোদিন হয়তো শিবু আবার বলবে, “চল, একবার স্কুলের মোড় অবধি ঘুরে আসি।” কিন্তু সে ডাক আর আসে না।
তার বদলে একদিন সকালে আমি দেখলাম, বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে একটা নতুন চকচকে সাইকেল। রঙ কালো আর নীলের মিশ্রণে, সামনে গিয়ার, পেছনে বড়ো হেডলাইট। হ্যান্ডেল ঘোরালেই যেন হাওয়ায় সুর বাজে।
শিবু তার দিকে তাকিয়ে ছিল মুগ্ধ হয়ে। তার বাবা বলল, “এইটা তোকে দিলাম, ক্লাস এইটে উঠেছিস, এখন তোর জন্য বড়ো সাইকেল দরকার।”
শিবু প্রথমে কিছু বলল না, তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল নতুন সাইকেলের দিকে। তার চোখে ছিল আলো, পায়ে উত্তেজনার ছন্দ। আমি তখন এক কোণে, চুপচাপ।
সেইদিন বিকেলবেলা ও প্রথমবার নতুন সাইকেল চালাতে বের হলো। পেছনে ছোট্ট ব্যাগ, হাওয়ায় উড়তে থাকা চুল, আর তার চোখে ছিল জয় করার উল্লাস। আমি জানি, ওই মুহূর্তে শিবু পুরোপুরি আমাকে ভুলে গিয়েছিল।
যখন সে ফিরে এল, তার মুখে ঘাম, গায়ে ধুলো, কিন্তু মুখে ছিল তৃপ্তি। তার মা বলল, “খুব মজা পেয়েছিস না?” শিবু মাথা নেড়ে বলল, “অসাধারণ!”
আমি ভেতরে ভেঙে পড়ছিলাম। আমি জানতাম না, একটা সাইকেলের হৃদয় কতটা নরম হতে পারে।
এরপর কয়েকদিন আমাকে আর কেউ ছুঁয়েই দেখল না। আমার গায়ে ধুলো জমে যাচ্ছিল, টায়ার পুরো ফাঁপা, প্যাডেল শক্ত হয়ে গিয়েছে। ঘণ্টা চাপলে আর আওয়াজ হয় না।
একদিন ঝড় উঠল। সবাই তাড়াহুড়ো করে ঘরের ভেতর, কেউ ছাদে কাপড় তুলছে, কেউ গাছ টেনে বেঁধে দিচ্ছে। আমি তখনও বাইরে। বাতাসে উড়ছিল পাতা, আমার হ্যান্ডেল বারবার ঘুরছিল ডান-বামে, টিনের আওয়াজে গা কেঁপে যাচ্ছিল।
তবু কেউ আমায় ঘরে তুলল না। আমি একটা পুরনো জিনিস মাত্র।
পরদিন সকালে শিবু বেরিয়ে এসে দেখে আমার চেন ছিঁড়ে গেছে, সিটে ভাঙা। ও একটু থেমে দাঁড়াল, তারপর বলল, “বাবা, এটা তো এখন নষ্ট হয়ে গেছে।”
ওর বাবা বলল, “আর চালাবি না তো, ফেলেই দে।”
সেই মুহূর্তে আমার ভিতরটা যেন চূর্ণ হয়ে গেল।
আমি কি তাই শুধু? একটা খেলনা? যাকে দিয়ে দিন কাটানো যায়, আর পুরনো হলে ফেলে দেওয়া যায়?
কয়েকদিন পর আমি উঠোন থেকে হারিয়ে গেলাম। পাড়ার কাকু যিনি লোহা কিনতেন, তিনি আমাকে রিকশায় তুলে নিয়ে গেলেন। আমার শরীর তখন ভারি, প্যাডেলগুলো আটকে আছে, হ্যান্ডেল ঢলে পড়ছে।
পেছনে দাঁড়িয়ে শিবু একবারও ফিরে তাকাল না।
পর্ব ৪
আমার গায়ে যখন পুরোনো লোহা চেপে বসেছিল, তখন রিকশার ঝাঁকুনিতে শরীরের সব খুঁটি যেন খসে পড়ছিল। পথের ধুলো আমার রঙকে আরও মলিন করে দিয়েছিল। চারপাশে হর্নের শব্দ, মানুষজনের ভিড়, কিন্তু আমার পৃথিবী তখন নিঃশব্দ।
যিনি আমাকে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি ধাতব জিনিস কিনে ফেরি করেন। তাঁর হাতে ছিল সাদা থলি, কোমরে মোটা দড়ি বাঁধা। তিনি আমাকে চেন দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন রিকশার পেছনে। আমার চাকা তখনও একবার ঘুরতে চাইছিল, কিন্তু আগের মতো ছন্দে নয়—অসুস্থ, অবসন্ন।
গন্তব্য ছিল একটি পুরনো গ্যারেজ। তবে এটা সেই গ্যারেজ নয় যেখানে আমার জন্ম হয়েছিল। এই গ্যারেজে কেউ আমাকে আদর করে তেল মাখায় না, নতুন রঙ দেয় না। এখানে আমি একজন ‘স্ক্র্যাপ’—ফেলে দেওয়ার জিনিস।
আমাকে নামানো হলো কয়েকটা লোহার রড আর ভাঙা দরজার পাশে। সেখানে আগে থেকে পড়ে ছিল খুড়ো চেয়ার, ভাঙা ট্রাঙ্ক, আর আরও কিছু অচেনা সাইকেলের অংশ। কেউ কারো সঙ্গে কথা বলে না, শুধু জং ধরা নিঃশব্দতা।
কয়েকদিন আমি শুধু চুপ করে থাকলাম। কেউ আমায় ছুঁয়েও দেখল না। রাত হলে গ্যারেজে শুধু পেছনের গেটের কুকুর ঘেউ ঘেউ করে। হঠাৎ একটা রাত, এক কিশোর এলো। তার গায়ে ময়লা জামা, চোখে ছিল কৌতূহল। সে আমার দিকে তাকাল। তার চোখে বিস্ময়।
সে বলল, “এইটা কারো পুরনো সাইকেল? চলেও না?”
গ্যারেজ মালিক বলল, “চলে না রে, ভাঙা লোহা। যদি চানিস, নিয়ে যা। সারিয়ে চালাতে পারিস তো তোর কপাল।”
ছেলেটি নাম নিতেশ। সে তার নিজের হাতে আমায় তুললে। আমার গায়ে হাত দিয়ে বলল, “একেবারে মরিসনি তুই। একটু ভালোবাসা পেলেই চলবি।”
সেই কথাটা ছিল আমার জন্য নতুন প্রাণের মতন।
পরদিন সে আমাকে নিয়ে গেল তার ছোট্ট বাড়িতে। মাটির উঠোন, পাশে একটা আমগাছ, আর বাড়ির কোণে তার মা রান্না করছিলেন। তিনি অবাক হয়ে বললেন, “এই ভাঙা সাইকেল আনলি?”
নিতেশ বলল, “সারিয়ে চালাবো মা, রোজ স্কুলে হাঁটতে হাঁটতে হাঁফ ধরে যায়।”
তারপর শুরু হলো আমার পুনর্জন্ম।
নিতেশ তার সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে নতুন টায়ার আনল, পুরনো চেন পাল্টাল, আর ঘণ্টা লাগাতে পারল না, তাই একটা ছোট্ট ঘুঙুর বেঁধে দিল হ্যান্ডেলে। ঘুঙুরটা হাওয়ায় হেলে হেলে বাজত—টিংটিং নয়, টুংটাং।
আমি আবার চলতে শিখলাম। ধীরে, কষ্টে, কিন্তু চললাম।
নিতেশের পা ছিল আমার নতুন প্রাণ, তার চোখে ছিল আশার আলো। ও যখন স্কুলে যেত, আমি সাথে থাকতাম। মাঠে যেতাম, মেলায় যেতাম, এমনকি পাড়ার ফটোকেও আমি চিনে ফেলেছিলাম নতুন করে।
কিন্তু আমি জানতাম, এই দিনও চিরকাল থাকবে না।
একদিন হঠাৎ স্কুল থেকে ফেরার পথে পুলিশ কাকু আমাদের থামাল। বলল, “সাইকেল চালানোর লাইসেন্স আছে তোমার?”
নিতেশ ভয় পেয়ে গেল। বলল, “আমি তো স্কুলে পড়ি, ক্লাস নাইন।”
তারা কিছু না বলে হেসে চলে গেল। কিন্তু সেই হাসির মধ্যে ব্যঙ্গ ছিল, অবহেলা ছিল।
নিতেশ বলল, “সবাই ভাবে, ভাঙা সাইকেল মানেই ভাঙা মানুষ। তারা বোঝে না, আমার সঙ্গী শুধু একটা যন্ত্র নয়।”
আমি তখনও প্যাডেল ঘোরাতাম—না নিজের জন্য, না কোনো পুরস্কারের আশায়—শুধু তার জন্য, যে আমায় দ্বিতীয়বার বাঁচিয়েছিল।
পর্ব ৫
নিতেশ আমার চাকা ঘোরায় ঠিক যেমন কেউ প্রিয় বইয়ের পাতা উল্টায়—সাবধানে, মমতায়। তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব দিনে দিনে যেন নতুন রূপ নিচ্ছিল। আমি আর সে একসঙ্গে চলতাম গলির গলি, রেললাইনের ধারে, বটতলার মোড়ে।
স্কুল থেকে ফেরার পথে একদিন সে আমায় নিয়ে একটা ছোট্ট লাইব্রেরির সামনে দাঁড়াল। ছিমছাম, দোতলা, ধুলোমাখা বারান্দা, আর বারান্দার এক কোণে বসে ছিল এক মেয়ে। তার গায়ে নীল পিনফার্ক, কাঁধে লাল ব্যাগ। সে নিচের দিকে তাকিয়ে কী যেন লিখছিল।
নিতেশ থেমে গেল হঠাৎ। আমি বুঝলাম, তার চোখে একটা আলাদা আলো ফুটেছে।
সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল লাইব্রেরির দিকে, আমায় গাছতলায় দাঁড় করিয়ে। আমি তখন একা, কিন্তু চোখ ছিল ওই মেয়ের দিকে—কারণ আমি নিতেশের চোখ দিয়ে দেখতাম, তার হৃদয় দিয়ে টের পেতাম।
তার নাম ছিল প্রজ্ঞা। সে নিতেশের ক্লাসেরই ছিল, কিন্তু অন্য সেকশনে। লাইব্রেরিতে সে নিয়মিত আসত গল্পের বই পড়তে। আর সেদিন থেকে, নিতেশও রোজ আমায় নিয়ে লাইব্রেরির বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখত।
প্রজ্ঞা কখনো একবার তাকাত, কখনো তাকাত না। কিন্তু নিতেশ রোজ যেত। কিছু না বলেই ফিরে আসত, শুধু চোখের ভাষায় কিছু একটা বোঝাত।
একদিন হঠাৎ, এক শনিবার বিকেলে, প্রজ্ঞা লাইব্রেরির গেট পেরিয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়াল। সে আমার হ্যান্ডেলে হাত বুলিয়ে বলল, “তুমি প্রতিদিন আসো, তাই না?”
আমি কিছু বলতে পারি না, শুধু বুঝি—আমার রঙ ফ্যাকাসে হলেও, আমার হৃদয় এখনও লালচে।
নিতেশ সেই মুহূর্তে বইয়ের তাকের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, চুপি চুপি তাকিয়ে। প্রজ্ঞা একটা কাগজ বের করে আমায় দিল—মানে, আমার বাস্কেটের ভেতর রাখল।
তারপর চলে গেল।
নিতেশ দৌড়ে এসে কাগজটা বের করল। সেখানে লেখা ছিল—
“আমার একটা সাইকেল নেই, কিন্তু তোর সঙ্গীকে দেখেই ভালো লেগে গেল। তুই সাইকেলটা চালাস সুন্দর করে, নিজের মনের মতো করেই থেকো। – প্রজ্ঞা”
নিতেশ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমি কেবল অনুভব করছিলাম, আমার বাস্কেট যেন হঠাৎ ফুলে উঠছে ভালোবাসার হাওয়ায়।
সেই রাতটা অন্যরকম ছিল। বারান্দার নিচে পড়ে থাকা আমি, সেই পুরনো আমি—প্রথমবার সত্যিকারের একটা প্রেমের দূত বনে গেছি।
পরদিন সে আমায় নতুন কাপড় দিয়ে মুছে দিল, হুইল গ্রীজ লাগাল, প্যাডেল ঘুরিয়ে পরীক্ষা করল। আমি যেন তার প্রিয় জিনিসে পরিণত হয়েছি।
প্রজ্ঞার সঙ্গে তার কথা বলার সাহস এখনো হয়নি, কিন্তু তাদের চোখে চোখ রাখা—তাতেই যেন এক গল্প তৈরি হচ্ছে।
আমি সেই গল্পের সাইকেল, যার চাকা ঘোরে দু’জনের দূরত্ব কমাতে।
একদিন বিকেলে নিতেশ বলল, “চল তো একটু রেলগেটের দিকে ঘুরি।”
সেই রেলগেটের পাশেই ছিল ছোট্ট এক চায়ের দোকান। সেদিন নিতেশ আমায় থামিয়ে রেখে প্রজ্ঞার জন্য একটা মিঠাই কিনল। তারপরে ধীরে ধীরে গিয়েছিল লাইব্রেরির পেছনদিকে, যেখানে প্রজ্ঞা বসে বই পড়ছিল।
সে কিছু না বলে তার পাশে বসে মিঠাইটা বাড়িয়ে দিল। প্রজ্ঞা প্রথমে কিছু না বললেও, পরে মুচকি হেসে নিয়েছিল।
আমি দূর থেকে দেখছিলাম—দু’জন মানুষের বন্ধুত্বের শুরু, এক লালচে সন্ধের আভায়।
পর্ব ৬
জীবনের যে কোনো সম্পর্ক ঠিক তখনই গভীর হয় যখন তা হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। আমার আর নিতেশের সম্পর্কও তখন এমন এক বাঁক নিচ্ছিল।
প্রজ্ঞার সঙ্গে ছোট ছোট দেখা, গল্প, টুকরো হাসি—সব কিছু যেন এক মৃদু ভালোবাসার হাওয়ায় ভেসে চলেছিল। আমি সেই হাওয়ায় নিজের পুরনো ব্যথা ভুলে নিতেশের সঙ্গে আবার নতুন করে পথ হাঁটছিলাম।
কিন্তু এক দুপুরে সব বদলে গেল।
সেদিন ছিল মেলা। স্টেশন মাঠে একটা ছোট্ট হস্তশিল্প মেলা বসেছিল। চারদিক আলোর মালা, বাজনার শব্দ, আর ভিড়ের ভেতর নানা মুখ। নিতেশ আর প্রজ্ঞা মিলে ঠিক করেছিল দুপুরে যাবে।
নিতেশ আমাকে চকচকে করে তুলেছিল। নতুন বেল্ট বেঁধেছিল সিটে, এক পাশে সাদা কাপড় বেঁধে দিয়েছিল “মেলা” লেখা একটা ছোট্ট ফেস্টুন। আমি যেন আবার সেই শিবুর সময়ের উজ্জ্বল আমি হয়ে উঠেছিলাম।
আমরা তিনজন—নিতেশ, প্রজ্ঞা আর আমি—চলে গেলাম মাঠের দিকে। পথে অনেকেই তাকিয়ে দেখছিল। কেউ বলছিল, “দেখো ছেলেটা নিজের হাতে সাইকেল ঠিক করেছে।”
মেলায় পৌঁছে আমাকে একটা গাছতলায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে ওরা ভেতরে ঢুকল।
“তুই থাক এখানেই,” নিতেশ বলেছিল, “দূরে যাস না।”
আমি তো যন্ত্র, কিন্তু আমারও মন কাঁপছিল। কারণ আমি বুঝতে পারছিলাম, ভিড়টা অস্বাভাবিক, লোকজনের মুখে অস্থিরতা, শিশুর কান্না, হকারদের চিৎকার—সব মিলে একটা অশান্ত পরিবেশ।
একসময় হঠাৎ চারদিকে হুলুস্থুল পড়ে গেল। কে যেন পকেটমার ধরা পড়েছে, পুলিশ এসেছে, কনফিউশনের মাঝে লোকে দৌড়চ্ছে। কেউ একে ধাক্কা দিচ্ছে, কেউ ওকে।
এই ভিড়ের মাঝে হঠাৎ কেউ আমায় ঠেলে দিল। আমি একদিকে উল্টে পড়লাম। ব্যথা পেলাম না, কিন্তু হ্যান্ডেলের একটা অংশ বাঁকিয়ে গেল।
তারপর দেখি, এক ছেলে আমার হ্যান্ডেল ধরেছে। চোখে ছিল চোরের মতন তীক্ষ্ণতা। সে আমার সিটে বসে পড়ল, হুইল ঘোরালো, আমি বাধা দিতে পারলাম না।
সে আমায় নিয়ে পালিয়ে গেল।
আমার গায়ে তখন হাওয়ার ঝাঁপটা, কিন্তু মনটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। আমি পালাতে চাইনি, কিন্তু চাকা ঘুরছিল জোর করে। রেলগেট পেরিয়ে, ছোটো রাস্তা পেরিয়ে, এক অচেনা বস্তির গলিতে সে থামল।
আমায় একটা ছোট ঘরের সামনে ফেলে রেখে ঢুকে গেল ভেতরে। আমি চুপচাপ পড়ে রইলাম।
সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল। সন্ধ্যা নেমে এল, আমি নিঃসঙ্গ।
নিতেশ কি জানে আমি নেই? ও কি খুঁজছে? প্রজ্ঞা কি ভাবছে কিছু?
রাত হয়ে গেল। আমি তখনো অচেনা বাড়ির সামনের ছোট উঠোনে পড়ে আছি।
হঠাৎ দেখি, সেই ছেলেটি আবার এল। এবার তার সঙ্গে আরও দুজন। তারা আমায় পরীক্ষা করছে। এক জন বলল, “চাকার হাওয়া কম, রঙও ফ্যাকাসে।”
অপরজন বলল, “না, চলবে এখনো। কাল বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেব।”
আমি চুপ। কিন্তু ভেতরে জ্বলছে আগুন। আমি নিতেশকে চাই। আমি প্রজ্ঞার সেই স্পর্শটুকু আবার পেতে চাই।
আমি শুধু একটা সাইকেল নই, আমি কারো শৈশব, কারো প্রেম, কারো ভরসা। আমাকে যদি হারিয়ে ফেলো, কারও একটা গল্প অসম্পূর্ণ হয়ে যাবে।
পর্ব ৭
রাত গভীর হয়ে এলো, বস্তির উঠোনে আমি পড়ে রইলাম একা। আমার চাকা থেমে গিয়েছে, হ্যান্ডেল বাঁকা, বাস্কেটের কোণে জমেছে ধুলো। আমার মনে হচ্ছিল, এবার বুঝি শেষ।
কিন্তু যন্ত্রেরও কিছু স্বপ্ন থাকে—যা হয়তো মানুষের মতোই সাদা আর কোমল। আমি স্বপ্ন দেখছিলাম—নিতেশ এসে বলছে, “তুই তো আমার জীবনের গল্প, তোকে আমি হারাতে পারি না।”
হঠাৎ মাঝরাতে দরজায় টোকা। তিনজন ছেলেমানুষ বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। এক জন বলল, “চুপ করে থাকিস, বাইরের লোক দেখলে ঝামেলা হবে।”
আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই দূরে একটা চেনা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। “আমার সাইকেল কোথায়? কেউ দেখেছেন কি লাল রঙের একটা পুরনো সাইকেল?”
সে কণ্ঠস্বর ছিল নিতেশের।
তার গলায় ছিল আতঙ্ক, নিঃশ্বাসে ছিল ছুটে চলার ক্লান্তি। সে ডাকছিল, এক এক দোকানে, পাড়ার মানুষের কাছে।
বস্তির গলির এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিল প্রজ্ঞা। হাতে ছিল একটা ছোট্ট পোস্টার—আমার ছবিসহ, নিচে লেখা, “হারানো সাইকেল, দয়া করে জানান।”
আমার বুক কেঁপে উঠল। এত ভালোবাসা, এত খোঁজ—আমি কি তার যোগ্য ছিলাম?
যেই মুহূর্তে সেই তিন চোর আমাকে আবার তুলতে গেল, ঠিক তখনই একজন বস্তির ছেলেমানুষ, যে সেই রাতে সবটা দেখেছিল, চিৎকার করে উঠল, “এই সাইকেল তো সেই ছেলের! এই যে ছবি, ওই তো!”
প্রজ্ঞা দৌড়ে এসে পৌঁছল, নিতেশও। চোখে জল, গলায় কাঁপুনি।
চোরেরা পালিয়ে গেল, ভিড় জমে গেল চারপাশে। কেউ বলল, “পুলিশ ডাকো,” কেউ বলল, “এত পুরনো সাইকেল নিয়েও এত কান্না?”
কিন্তু নিতেশ কিছু বলেনি। সে চুপচাপ এগিয়ে এসে আমার হ্যান্ডেল ছুঁয়ে বলল, “তুই ঠিক আছিস?”
আমি উত্তর দিতে পারলাম না, কিন্তু আমার ঘণ্টার ঘুঙুর একবার বাজল—টুংটাং।
সে আমাকে কোলে তুলে রিকশায় তুলল। ফেরার পথে প্রজ্ঞা পাশে বসে ছিল, গায়ে হাওয়ার স্পর্শ, চোখে শান্তি।
সেদিন রাতেই বাড়ি ফিরে সে আমার চাকা ঠিক করল, হ্যান্ডেল সোজা করল, বাস্কেট ঝাড়ল।
তারপর আমায় গ্যারেজে না রেখে শোবার ঘরের বারান্দায় রাখল। আমি জানতাম, আমি আর হারাব না।
প্রজ্ঞা বলল, “তুই শুধু সাইকেল না, একটা গল্প। তুমি-আমি-নিতেশ, সবাই মিলে একটা সাহসিকতার গল্প।”
আমি তখনও ভাঙা, কিছুটা ক্লান্ত, কিন্তু ভালোবাসার ভিতর জুড়ে নিচ্ছিলাম নিজেকে।
আমার শরীরে এখন দাগ, কিন্তু আত্মায় নেই কোনো ক্ষয়। আমি ফিরে এসেছি। আমার গল্প আবার শুরু হচ্ছে।
পর্ব ৮
আমার শরীরটা যতই পুরনো হয়ে যাক, মনটা যেন ঠিক তার বিপরীত—দিনে দিনে তরতাজা হয়ে উঠছিল। কারণ ভালোবাসা কখনও জং ধরতে দেয় না।
নিতেশ এখন ক্লাস টেনের শেষ প্রান্তে। তার ব্যস্ততা বাড়ছে, বইয়ের চাপ, টিউশনের গতি, ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা।
তবুও সে আমাকে প্রতিদিন একবার স্পর্শ করে। কখনও জাস্ট হ্যান্ডেলে হাত রেখে বলে, “আজ তোকে নিয়ে বেরনো হলো না,” কখনও শুধু চোখের চাহনিতে বলে, “তোকে ভুলিনি।”
প্রজ্ঞা এখন নিয়মিত আসে না। সে মেয়েদের স্কুলে ভর্তি হয়েছে। দূরেই পড়ে, অন্য রুট। একদিন সে আমায় দেখে হেসে বলেছিল, “তুমি এখন ইতিহাসের পাতায়, কিন্তু এখনও চলমান!”
তারপর হঠাৎ একদিন—এক গরম দুপুরে, নিতেশ আমার সামনে এসে দাঁড়াল কিছুটা চুপ করে। আমি বুঝলাম, আজ কিছু বলবে।
সে ধীরে ধীরে বলল, “আমার ভাই এবার স্কুলে যাচ্ছে। তার নাম পল্লব। সে তোকে চালাতে চায়।”
আমি চুপ করে থাকলাম। ভিতরে অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছিল। যেন নিজের ছায়াকেও কাউকে দিয়ে দিচ্ছি।
নিতেশ আমার হ্যান্ডেল ছুঁয়ে বলল, “তুই তো আমার ছেলেবেলা, কিন্তু এবার ওরও সঙ্গী হতে হবে তো। চল, একটা নতুন গল্প শুরু হোক।”
পল্লব তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে। তার চোখে আগ্রহ, ভয়, উত্তেজনা—যেমনটা একদিন ছিল শিবুর চোখে, তারপর ছিল নিতেশের চোখে।
আমাকে নামানো হলো উঠোনে। হালকা তেল দেওয়া হলো চেনে, বাস্কেট পরিষ্কার করা হলো। পল্লব প্রথমবার আমার সিটে বসল।
সে থরথর করে বলল, “আমি পারব তো?”
নিতেশ হেসে বলল, “তুই পারবি, কারণ সে তোকে কখনও ফেলতে দেবে না। ও আমাদের মতো কাউকে কখনও ফেলে দেয় না।”
আমি অনুভব করলাম, আমার মধ্যে একটা নতুন প্রাণ এসেছে। পল্লবের প্রথম প্যাডেল ঘোরানো, তার প্রথম হোঁচট, প্রথম হাসি—সবটাই যেন déjà vu, আবার দেখা এক পুরনো স্বপ্ন।
তবে এবার আমি ভাঙতে ভয় পাই না, কারণ জানি, যারা ভালোবাসে তারা ভাঙলেও জোড়া দেয়।
আমার শরীরে শিবুর হাতের স্মৃতি, নিতেশের ভালবাসার দাগ, প্রজ্ঞার চিঠির হাওয়া আর পল্লবের প্রথম প্যাডেলের কাঁপুনি—সব একসঙ্গে গেঁথে আছে।
আমি এখন কেবল একটা সাইকেল নই, আমি তিনটি ছেলের, একটি মেয়ের আর অনেক অনেক ভালোবাসার সাক্ষী।
যন্ত্রও যদি কথা বলত, আমি বলতাম—জীবন মানে শুধু নতুনত্ব নয়, জীবনের সৌন্দর্য সেই পুরনোতাই, যাকে কেউ আঁকড়ে রাখে যত্নে, স্মৃতিতে।
আমার গল্প শেষ নয়। আমি হয়তো আরও পুরনো হব, কিন্তু আমার স্মৃতি থাকবে সেই উঠোনে, সেই লাইব্রেরির গেটে, সেই মেলার মাঠে।
আমি একটা সাইকেল।
তবু আমার জীবনটা ছিল একদম মানুষের মতোই।
সমাপ্ত




