মৌসুমী ধর
অধ্যায় ১: আয়নার ওপারে
মেহেরা দত্ত সকালবেলার সূর্যের মৃদু আলোয় ঘুম থেকে উঠে আয়নার দিকে তাকালেন। আয়নাটা ছোট্ট, বাথরুমের দরজার ভেতর লাগানো, আর সেই আয়নাতেই প্রতিদিনই তার ছায়াটা দেখতে হয়। ছায়াটা যেন কিছুক্ষণ আগের থেকে একটু ভিন্ন হয়ে গেছে—একটু ক্লান্ত, একটু বিষণ্ণ, আর কখনো কখনো যেন আড়ালে চুপ করে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। গৃহবধূ মেহেরা, যিনি স্বামী কৌশিক ও দুই সন্তানের জন্য জীবন গড়েছেন, আজও রাঁধুনির কাজ থেকে একটু বিরতি নিয়ে চুপচাপ সেই আয়নার দিকে তাকালেন। দেড় দশক আগে কলেজে ইংরেজিতে অনার্স করার স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা করেছিল সে; শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছে ছিল, বইয়ের সঙ্গেই জীবন কাটানোর তাগিদ ছিল। কিন্তু বিয়ে, সংসারের দায়ভার, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা—সব কিছু যেন একে একে তার নিজের স্বপ্নকে চাপা দিয়ে দিয়েছে। চোখ বন্ধ করে তিনি নিজেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই কি সব আমার জীবন? একদিন কি আমি নিজেকে খুঁজে পাব?’ আর রাত হলে, যখন সব ঘর নিস্তব্ধ হয়, মেহেরা স্বপ্নে দেখতে পেতেন এক অপরিচিত, শান্ত এক নারীর মুখ—যিনি বলতেন, “আমি তোমার এক অন্যরূপ।” কষ্টটা তেমনই ছিল, তার ভিতরে এক গভীর আকাঙ্ক্ষা ঘুরপাক খাচ্ছিল, “আমি কি শুধু একজন গৃহবধূ, নাকি এরও কিছু বেশি?” আজও সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল তার মনে, যেন একদিন তাকে অন্য কোনো পথে ডেকে নিয়ে যাবে।
কলকাতার কালীঘাটে, রাস্তার এক প্রান্তে মেহেরা রায় স্বপ্নের রাজনীতির ঝড় তুলছিলেন। তরুণী রাজনীতিক, যিনি একসময়ে ছাত্র সংগঠনে ছিলেন আলোচিত মুখ, এখন দলের কোন্দলে ছিটকে পড়া একাকী বীরাঙ্গনা। রাজনীতি তার ছিল এক যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে প্রতিটি দিনই লড়াই, কিন্তু মনখারাপের গভীর গভীরে সে একাকীত্ব ও হতাশায় ডুবে গেছে। মিডিয়ার সামনে দৃঢ়চেতা, স্পষ্টভাষী, কিন্তু রাতে ঘুমের মাঝে আসে অদ্ভুত স্বপ্ন—রান্নাঘরের এক শান্তশিষ্ট নারী, যিনি মেহেরার মতোই দেখতে, কিন্তু ভিন্ন এক বাস্তবতার প্রতীক। তিনটি জীবনকে বয়ে নিয়ে তার অন্তরজুড়ে বারবার প্রশ্নের জন্ম হয়, “আমিই কি আসল মেহেরা? আমার আদর্শ কি বেঁচে আছে, নাকি আমি হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে?” রাজনীতির শত্রুরা তাকে ছোট করেছেন, নিজের দলের লোকেরা অবজ্ঞা করেছেন, আর স্বপ্নের ভেতরে সেই শান্ত নারীর ডাক যেন এক ভিন্ন জীবনের ডাক। একসময়ে যে তরুণীর রক্ত ঝরত জনসভায়, আজ সে বয়ে বেড়াচ্ছে নিজের অস্তিত্বের সন্ধানে, আত্মার একাকীত্বে।
দিল্লির এক বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে মেহেরা বন্দ্যোপাধ্যায় বসেছিলেন উইন্ডোতে। সারা জীবন কোর্টরুমে যুদ্ধ করে এই অ্যাডভোকেট হয়েছে দেশের সুপ্রিম কোর্টের এক নামী মুখ। সফল, স্বচ্ছন্দ, কিন্তু তার অন্তর গভীরে লুকিয়ে আছে এক টুকরো যন্ত্রণার ইতিহাস—শৈশবে পিতার নিগ্রহ ও অবহেলার কাহিনি, যাকে সে গোপন রেখেছে বারোয়ার ঘরের আড়ালে। আজও মাঝে মাঝে হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখেন আয়নাতে অন্য কেউ দাঁড়িয়ে আছে, লাল শাড়ি পরা এক নারীর ছায়া, যে বলে, “আমার ব্যথা তুমি বুঝতে পারবে না।” সব কিছু নিজের কন্ট্রোলের মধ্যে রাখতে চাওয়া এই নারী আজ নিজেই হারিয়ে যাচ্ছে নিজের আবেগের সাগরে। কারো কাছে সে কিছু জানায় না, কারণ তার মনে হয় দুর্বলতা প্রকাশ মানে পরাজয়। তবু সে জানে, তার তিনটি জীবন এক অন্যায় পথে বিভক্ত—তিন ভিন্ন শহর, তিন ভিন্ন বাস্তবতা, তিন ভিন্ন মেহেরা, কিন্তু তিনজনেই যেন একে অপরের প্রতিবিম্ব। আর সেই প্রতিচ্ছবি তাকে বারবার ডাকে, জিজ্ঞাসা করে, “তুমি আসলেই কি একজন?”
অধ্যায় ২: এক স্বপ্নের তিন ছায়া
মেহেরা দত্তের ঘরের বাতাস আজ একটু অন্যরকম। দিনের কাজ শেষ করে সে বিছানায় পা দিয়ে লুটিয়ে পড়লো। চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছে, কিন্তু আজ তার ঘুম যেন ঘরোয়া অন্ধকারে কিছু আলোর ঝলকানি নিয়ে এল। স্বপ্নে সে নিজেকে দেখল এক আলোকিত আদালতের কক্ষে, যেখানে বিচারপতির রোস্টার থেকে ছুটে আসছে আলো। সে দাঁড়িয়ে ছিলো কারো সাক্ষ্য শুনছে, এক গৃহবধূর নিঃশব্দ কষ্ট ও নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে লিপ্ত। ওই নারী, যে আরেক জীবন থেকে এসেছে, যেন মেহেরা দত্তেরই প্রতিবিম্ব—তার গৃহবধূর মুখ, যার চোখে আশা আর ত্যাগের মিশেল। আদালতের দেয়ালগুলো থেকে যেন ফিসফিস করছিল, “এটাই তুই হতে পারত”, “এটাই তুই হয়েছ।” স্বপ্নের সেই কোর্টরুম থেকে বেরিয়ে সে পেয়ে গেল এক অজানা শান্তি, আর সেই শান্তি তাকে জাগ্রত করল। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে মেহেরা বুঝতে পারল, তার মনের ভিতর এক অন্য জীবনের গল্প ধীরে ধীরে জাগছে।
অন্যদিকে কলকাতার কালীঘাটের ছোট ঘরে মেহেরা রায় গভীর রাতে একটি স্বপ্ন দেখল। স্বপ্নে সে ফিরে গিয়েছিল সেই রান্নাঘরে, যেখানে ঠান্ডা চাঁদের আলোয় এক শান্তশিষ্ট নারী দাঁড়িয়ে আছে, যেন স্বপ্নের মধ্যে হারানো সময়ের প্রতীক। ওই নারী ছিলো তার নিজের এক অন্য রূপ, যার চুপচাপ ভঙ্গি, চোখের নিচে একটু বিষাদ আর হালকা হাসি যেন এক অজানা গানের সুর। মেহেরা রায় স্বপ্নে শুনতে পায় সেই নারী ধীরে ধীরে বলে উঠলো, “তুই আমার কথা শোনিস না, আমি তোরই একটা অংশ।” স্বপ্নের মাঝে মেহেরা রায় অনুভব করল নিজের হৃদয়ের ভেতর এক দুর্লভ আবেগের স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে, যেখানে আদর্শ আর বাস্তবতার মাঝখানে সে হারিয়ে গেছে। স্বপ্ন ভেঙে গেলেও সেই মুখ ও শব্দ যেন তার কাছে নতুন জীবন দান করল, মনে করিয়ে দিল—তুমি শুধু রাজনীতির মেহেরা নও, তোর ভিতরে আরও অনেক কিছু আছে।
দিল্লির বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে মেহেরা বন্দ্যোপাধ্যায় গভীর রাতে ঘুমের দেশে হারিয়ে গিয়েছিল। স্বপ্নের ভেতর সে পেল এক অদ্ভুত পরিদৃশ্য — আয়নায় দাঁড়িয়ে ছিল তার নিজের প্রতিবিম্ব, কিন্তু তার চারপাশে ভাসছিল এক লাল শাড়ি পরা নেত্রী, যার চোখে কঠোরতা আর অবিচলিত সংকল্প। সেই নেত্রী ছিল আরেক মেহেরা — যিনি নিজের জোরে, নিজের মেধায় পৃথিবীর বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন, কিন্তু নিজের হৃদয়ে অসীম কষ্ট লুকিয়ে রেখেছিলেন। আয়নার সেসব ছায়া ধীরে ধীরে তাকে ডাকছিল, বলছিল, “আমি তোরই এক বিকল্প পথ।” সে ঘুম ভেঙে উঠল, হাত মুছে নিয়েছিল দেহের ওপর জমে থাকা ঘাম, কিন্তু মনে হচ্ছিল, তার ভিতর এক ঝড় উঠেছে — তিনটি ভিন্ন জীবনের ছায়া তার অন্তরকে বেঁধে রেখেছে, আর তারা যেন বলছে, “আমরা একসঙ্গে বাঁচবো না, তুই একবার আমাদেরকে বাঁচিয়ে দেখ।”
অধ্যায় ৩: ফিরে আসা স্মৃতিরা
মেহেরা দত্ত এক দুপুরে আলমারি থেকে পুরনো ডায়েরি বের করল, যেটা কলেজের দিনে লেখা তার স্বপ্ন আর ভাঙা প্রত্যাশার সাক্ষী। ডায়েরির পাতায় ছাপা ছিল রাজনৈতিক স্লোগান, কবিতার টুকরো আর জীবনের বড় বড় প্রশ্ন—“আমি কে?” “আমি কি এই সংসারের বাইরে কিছু হতে পারব?” সে একসময়ে স্বপ্ন দেখেছিল শিক্ষক হবার, ছেলেমেয়েদের পড়ানোর, নতুন জীবন গড়ার। কিন্তু বিয়ে, সংসারের দায়ভার, আর সময়ের চাপ তাকে সেই স্বপ্ন থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। ডায়েরির পাতাগুলো পড়ে সে নিজেকে প্রশ্ন করল, “এই আমি কি আমার স্বপ্নের মেহেরা?” তার মনে হল যেন এক অদৃশ্য হাত তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেই পুরনো জীবনের স্মৃতির ভেতর, যেখানে সে নিজের গৃহবধূর মুখোমুখি হয়—যে মুখে হতাশা আর আশা মিশে আছে। ডায়েরির শব্দগুলো যেন বলছিল, “তুই একা নও, তোর ভেতর অনেক মানুষ আছে।” এই আবেগের স্রোতে মেহেরা হারিয়ে গেল এক অচেনা স্মৃতির মাঝে, যেখানে তার তিনটি জীবন একসঙ্গে ঢেউ খেলছিল।
কলকাতার কালীঘাটে মেহেরা রায় এক বিকেলে এক পুরোনো কোর্ট কেসের নথি হাতে নিয়ে বসে ছিল। কেসটি ছিল এক গৃহবধূর স্বত্ব ও অধিকার নিয়ে, যার কষ্ট আর সংগ্রাম তার নিজের জীবনের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। নথির পাতা থেকে যেন শোনা যাচ্ছিল সেই নারীটির কাহিনি, যে এক সময় রাজনীতির মঞ্চ থেকে সমাজ পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিল, কিন্তু পরে হারিয়ে গিয়েছিল। মেহেরা রায় সেই কেসের মধ্যে নিজের ছায়া দেখতে পায়—একজন যোদ্ধার, যার লড়াই এখনো অসম্পূর্ণ। কোর্টের দলিল পড়তে পড়তে সে ভাবতে থাকে, “আমিই কি সেই গৃহবধূ, নাকি আমি রাজনীতির হারানো মেহেরা?” এই প্রশ্ন তার মনকে ভাঙছিল, জ্বালছিল। সেই পুরোনো কাগজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা গন্ধ ও শব্দগুলো যেন তাকে ফিরে নিয়ে গেল এক অন্য সময়ের রাজনীতির রোডে, যেখানে সে একা, কিন্তু দৃঢ়চেতা ছিল। এই স্মৃতিরা তাকে আবার নতুন করে শক্তি দিল, কিন্তু একই সঙ্গে তার মনকে বিভ্রান্ত করল—তিনটি জীবন, এক আত্মা, আর তিনটি ছায়া।
দিল্লির বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে মেহেরা বন্দ্যোপাধ্যায় এক বিকেলে একটা পুরনো চিঠি পেল। চিঠিটা ছিল ছোটবেলার, যার মাঝে লেখা ছিল “আমাকে ক্ষমা করো” — এটি ছিল তার বাবার কাছ থেকে, যে একসময় কঠোর ও নিগ্রহমূলক ছিল। চিঠিটা পড়তে পড়তে তার চোখে পানি এসে গেল। বাবার সেই অপরিষ্কার সম্পর্ক তাকে আজও টেনে নিয়ে যায় অতীতের এক গোপন কোণে, যেখানে আবেগ আর ব্যথা জড়িয়ে আছে। সেই চিঠি যেন তাকে ডাকছিল, “আমরা একই নদীর দুই তীর, একসময় মিলবই।” মেহেরা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝতে পারল, তার কন্ট্রোলের নীচে থাকা আবেগ ও স্মৃতি তাকে ধরে রেখেছে। ছোটবেলার সেই চিঠির শব্দগুলো যেন তার হৃদয়ে এক নতুন আলো জ্বালাল, যা তার তিনটি জীবনের সেতুবন্ধন গড়ে দিল। সে ভাবল, “আমরা আলাদা নই, আমরা তিনটি আমি — আর আমাদের মিলন বাধ্যতামূলক।”
অধ্যায় ৪: প্রতিবিম্বে প্রতিচ্ছবি
মেহেরা দত্ত ঢেউ খেলানো শহরের এক ছোট ক্লিনিকে বসেছিলো। আজকের তার জন্য বিশেষ দিন, কারণ তিনি মানসিক থেরাপিতে প্রথম আসলেন। থেরাপিস্টের শান্ত মুখ তাকে আশ্বস্ত করল, আর প্রথম কথা বলে তিনি যেন বুঝতে পারলেন মেহেরার অজানা যন্ত্রণা। “তুমি নিজেকে অনেক সময় হারিয়ে ফেলেছো,” থেরাপিস্ট বললেন, “তুমি শুধু গৃহবধূ নও, তোর ভেতর একাধিক জীবনের ছায়া বাস করে।” মেহেরা একটু চমকে গেলেন, কিন্তু সত্যি কথা বলার সাহস পেলেন। তিনি বললেন, “আমার স্বপ্নগুলো কোথায় গেল? আমি কখনো নিজের জন্য বেঁচে আছি কি?” থেরাপিস্ট ধীরে ধীরে তাকে বোঝালেন যে তার মনের গভীরে তিনটি পৃথক সত্তার সংঘাত চলছে, যেগুলো হয়ত একদিন মিলিত হবে। মেহেরা প্রথমবার অনুভব করলেন, তার একাকীত্বের ভেতর শুধু সংসার নয়, এক গভীর আত্মার খোঁজ লুকিয়ে আছে।
কলকাতার কালীঘাটে, মেহেরা রায় নিজের কনফারেন্স রুমে বসে ছিলো। তার সামনের থেরাপিস্ট ছিলেন অত্যন্ত সাবলীল ও বুদ্ধিমান। “তুমি এক কঠোর যোদ্ধা,” তিনি বললেন, “তোমার আদর্শ ও বাস্তবতার মাঝে একটা যুদ্ধ চলছে, আর সেটা তোর মনের বিভিন্ন অংশকে আলাদা করে দিয়েছে।” মেহেরা রায় কিছুক্ষণ চুপ করল, তারপর বলল, “আমার রাজনীতি আমার সব, কিন্তু আমি হারিয়ে যাচ্ছি নিজের মাঝেই।” থেরাপিস্ট তাঁকে প্রথমবার বুঝতে দিলেন, এটা স্বাভাবিক যে কখনো কখনো আমাদের ভেতরে একাধিক ‘আমি’ থাকে, যাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। এই কথাগুলো শুনে মেহেরা রায়ের মনের ভেতরে শান্তির স্রোত বইতে শুরু করল, যদিও সে জানত এই যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। স্বপ্ন ও বাস্তবতার মাঝে তার জাহাজ ডুবে যাচ্ছিল, আর থেরাপির এই প্রথম আলো তাকে অন্ধকার থেকে বের করার প্রাথমিক চেষ্টা।
দিল্লির বিলাসবহুল অফিসে, মেহেরা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন—নিজেকে মেনে নেওয়ার লড়াই। থেরাপিস্টের সাথে প্রথম সেশনে তিনি বললেন, “আমি সব সময় সব নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাই, কিন্তু আমার ভেতর এক অদ্ভুত ফাটল আছে।” থেরাপিস্ট অবজার্ভ করে বললেন, “তোর ভেতর তিনটি আলাদা সত্তার সংঘাত চলছে, আর তোমার কাজ হবে তাদের একত্রিত করা।” মেহেরা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমবার নিজের অদৃশ্য ভয় ও ব্যথাকে সম্মুখীন হলেন। থেরাপির ওই ঘর যেন আয়নার মতো, যেখানে তিনটি ভিন্ন মেহেরার প্রতিবিম্ব দেখা যায়—একজন গৃহবধূ, একজন রাজনীতিক, আর একজন অ্যাডভোকেট। প্রতিটা প্রতিবিম্ব তার জীবনের আলাদা অধ্যায়, আলাদা ব্যথার ছাপ, কিন্তু এখন সময় এসেছে তাদের একসূত্রে বাঁধার।
অধ্যায় ৫: মনের আদালত
বিকেলের আলো মেহেরা দত্তের রান্নাঘর ছুঁয়ে গিয়ে পড়ছিল তার কপালের উপরে। আজ সে কিছুটা অন্যমনস্ক — দুপুরে ছেলেমেয়ের স্কুল থেকে ফেরার পরেও সে কিচ্ছু বলেনি, কৌশিক জিজ্ঞাসা করলে শুধু বলেছিল, “কিছু হয়নি।” কিন্তু আসলে অনেক কিছুই হয়েছে। আজ তার থেরাপিস্ট তাকে বলেছিলেন, “তোমার ভেতর একটা দানা বাঁধা হতাশা আছে, যা তোর আত্মাকে ভেঙে দিয়েছে ধীরে ধীরে।” এই কথাগুলো সারাদিন ধরে তার কানে বাজছিল। সে চুপচাপ বসেছিল ডাইনিং টেবিলে, আর ভাবছিল নিজের কলেজজীবনের সেই দিনগুলোর কথা, যেখানে সে ক্লাসরুমে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়ত, সাহিত্যের ব্যাখ্যা করত। তারপর ভাবল সেই জীবন কোথায় হারাল? কীভাবে এমন করে একদিন রান্নার ধোঁয়া, গ্যাসের শব্দ, বাজারের দামের হিসাব — সব মুছে দিল তার পরিচয়? তার চোখ জ্বলে উঠল, কিন্তু সে কাঁদল না। তার বদলে ডায়েরির পাতা খুলে লিখতে শুরু করল — “আমি যে আমি, সে হয়তো তিনবার জন্ম নিয়েছে। একবার পরিবারের জন্য, একবার সমাজের জন্য, আর একবার নিজের জন্য। তিনবারই আমি হারিয়ে গেছি।” সেই মুহূর্তে যেন তার ভিতরে আদালতের মতোন এক বিচারসভা বসে গেল — মেহেরা দত্ত, সেই সাধারণ গৃহবধূ, আজ নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন।
কলকাতার রাজনীতিক মেহেরা রায় আজ একটি টিভি চ্যানেলের বিতর্কে যোগ দিয়েছিলেন। আলোচ্য বিষয় ছিল—নারীর অধিকার বনাম বাস্তব রাজনীতি। তর্কের মাঝখানে, অন্য এক প্যানেলিস্ট আচমকা বলে উঠল, “আপনার কথায় যত আদর্শই থাকুক, আপনি নিজেই তো নির্বাচনে হেরে গেছেন, আপনার আদর্শ কি আজও কার্যকর?” এই কথা শুনে তার মুখটা শক্ত হয়ে উঠল, সে বলল, “আমি হেরেছি, কারণ আমি নিজেকে কখনো বেচিনি। আমি হারিনি, আমি প্রমাণ করেছি।” শো শেষ হওয়ার পর সে ক্লান্ত হয়ে নিজের অফিসে ফিরে এল। গ্লাসে জল ঢালতে ঢালতে সে আয়নায় চোখ রাখল — সেখানে একজন অন্য নারী তাকিয়ে ছিল, যেন চুপ করে জিজ্ঞাসা করছে, “তুমি কি কখনো ভালোবাসতে চেয়েছিলে?” মেহেরা থেমে গেল। ভালোবাসা? একসময়ে সে কাউকে ভালোবেসেছিল, কিন্তু সে তো হারিয়ে গেছে তার রাজনৈতিক সংকল্পের ঝড়ে। আর এখন? এখন শুধু নিঃসঙ্গতা। হঠাৎ মনে পড়ল, কলেজে এক সহপাঠিনী বলত, “তুই যদি রাজনীতি না করতি, তুই খুব ভালো শিক্ষক হতে পারতি।” সেই কথা মনে পড়তেই আবার মনে পড়ল, সেই গৃহবধূর মুখ — স্বপ্নে দেখা সেই চোখজোড়া, যাদের মধ্যে ছিল একরাশ শান্তি আর চাপা কষ্ট। মেহেরা রায়ের হৃদয়ের ভেতর আবারও বাজতে লাগল সেই পুরনো সুর — “আমি কে?”
দিল্লির আদালতে আজ মেহেরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রিমিনাল কেস ছিল। একটি মায়ের সন্তানের হেফাজত নিয়ে লড়াই। মেহেরা নিপুণ যুক্তিতে মামলা জিতিয়ে দিলেন, কিন্তু কোর্টরুম থেকে বের হওয়ার সময় সেই মা হঠাৎ কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তোমার তো সন্তান নেই, তুমি কী বুঝবে আমার যন্ত্রণা?” কথাটা ছুরির মতো বিঁধল মেহেরার মনে। নিজের গাড়িতে চেপে অফিসে ফিরে আসার পর সে দরজা বন্ধ করে চুপ করে বসে রইল। আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকতেই আবার সেই পুরনো মুখ ফিরে এল — রান্নাঘরের গৃহবধূ, তার চোখে অপার যন্ত্রণা। “আমি যদি তাকে বুঝতে না পারি, তাহলে আমি কে?” সে নিজেকে প্রশ্ন করল। এরপর ধীরে ধীরে তার চোখে জল চলে এল। জীবনের এতদিন সে আইন, যুক্তি, প্রমাণ — এসব নিয়েই লড়েছে, কিন্তু আজ নিজের মনের আদালতে সে নিজেই অভিযুক্ত হয়ে দাঁড়াল। হয়তো সে এতদিন নিজের অতীতকে, নিজের মানবিকতাকে চাপা দিয়ে রেখেছিল, কিন্তু আজ সেসব অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে এসেছে। তার টেবিলের উপর রাখা ছিল সেই পুরনো চিঠি — বাবার লেখা। সে চিঠিটা আবার খুলে পড়ল, আর বলল, “আজ থেকে আমি শুধু জিততে চাই না, আমি চাই বুঝতে, অনুভব করতে। যদি আমি নিজেকে না বুঝি, তাহলে আমি আর কার আইন করব?”
অধ্যায় ৬: সাইকোলজিকাল সংঘর্ষ
রাত বারোটা বেজে গেছে। বহরমপুরের মেহেরা দত্ত চুপচাপ বিছানায় শুয়ে আছেন, জানলার পাশ দিয়ে নরম চাঁদের আলো ঘরে ঢুকছে। আজ স্বপ্ন যেন অপেক্ষা করছিল তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ঘুমের মধ্যেই সে দেখতে পেল একটা অন্ধকার ঘর, যার মাঝখানে বসানো একটিমাত্র চেয়ার। দেয়ালের চারপাশে আয়না। সেই আয়নাগুলোয় বারবার নিজের প্রতিচ্ছবি দেখছে — কিন্তু প্রতিটি প্রতিচ্ছবির চেহারা আলাদা, দৃষ্টি ভিন্ন, আর চোখে ধরা পড়ছে তীব্র আত্মজিজ্ঞাসা। হঠাৎ করেই ঘরটি আলোকিত হয়ে উঠল, আর সামনে এসে দাঁড়াল দুই নারী — একজন লাল পাড়ের শাড়িতে শক্ত মেরুদণ্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, অন্যজন কালো কোট আর চোখে ঠান্ডা যুক্তিবাদী দৃষ্টি। মেহেরা দত্ত চমকে উঠলেন — এরা তো সেই স্বপ্নে দেখা নারীরা, যাদের মুখে তার নিজের ছায়া আছে। তিনজন একে অপরকে দেখছে, চিনছে, আর ক্রমশ বুঝতে পারছে — এরা কেউই অপরিচিত নয়। তারপর এক জিজ্ঞাসা ছুঁড়ে আসে — কে আসল? কে মিথ্যা? কে অস্তিত্বের যোগ্য?
মেহেরা রায় স্বপ্নের মধ্যেই শুনতে পেল এক কণ্ঠস্বর — “তুই নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে আমাদের শেষ করেছিস।” সে মুখ ফিরিয়ে দেখে, একটি নারী — একেবারে তার মতো দেখতে, কিন্তু চোখে ঠান্ডা রাগ — রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে বলছে, “আমার স্বপ্ন কোথায় গেল? আমি শুধু সংসারের জন্য বেঁচে থাকলাম?” মেহেরা রায় চিৎকার করে ওঠে, “তুই তো হেরে গেছিস! তুই কিচ্ছু করিসনি, শুধু মেনে নিয়েছিস!” তখন তৃতীয় মেহেরা — সেই কোর্টরুমের লড়াকু অ্যাডভোকেট — ধীরে ধীরে সামনে এসে বলে, “তোমরা কেউই সম্পূর্ণ নও। একজন নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে, অন্যজন অহংকারে হারিয়ে গেছে। কিন্তু তৃতীয়জন… আমি, আমি কেবল পাথরের মত সবকিছু আটকে রেখেছি।” শব্দগুলো ধাক্কা দিয়ে দিল মনকে — যেন এক আইনি সাক্ষ্যে নিজের আত্মার বিচারের মুহূর্ত। ঘরটি আবার ঝাপসা হয়ে এল, আর তিনজনে হাঁপাতে লাগল, রাগে, কান্নায়, দোষারোপে। “তুই আমার ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছিস”, “তুই আমার শিক্ষা বিসর্জন দিয়েছিস”, “তুই শুধু নিজের সম্মান নিয়ে ভেবেছিস”— কথাগুলো বজ্রের মত নেমে আসছিল। তারা যেন নিজের মধ্যেই নিজেদের ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে, আর প্রতিটি বাক্যে উঠে আসছে — ‘আমি’ কার?
এই মানসিক সংঘর্ষ এমন এক স্থানে পৌঁছল, যেখানে সময় আর জায়গা মিলিয়ে গেল। তিনটি মেহেরা এখন তিন দিক থেকে মুখোমুখি — গৃহবধূ, রাজনীতিক, অ্যাডভোকেট। তারা আর একে অপরকে সহ্য করতে পারছে না, আবার ছিন্ন করতেও পারছে না। একে অপরকে দেখলে মনে হয় আয়নাতে নিজেকে ঘৃণা করছে। হঠাৎ ঘরের মাঝে একদম নিঃশব্দে একটি আয়না পড়ল, চুরমার হয়ে গেল। তার মধ্যেই একটা প্রতিচ্ছবি — ছোট্ট এক কিশোরী, কাঁদছে একটা স্কুলড্রেস পরে। মেয়েটি থেমে থেমে বলছে, “তোমরা আমায় ভুলে গেলে কেন? আমি তো তোমাদেরই শুরু ছিলাম।” তিনজন থেমে গেলেন। এই শিশুটি সেই মূল সত্তা — সেই কিশোরী মেহেরা, যাকে জীবনের বিভিন্ন দুঃখ, দায়িত্ব, হতাশা ভাগ করে ফেলেছে। গৃহবধূ সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন, “আমি তোকে ভুলিনি… আমি শুধু তোকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলাম।” রাজনীতিক বলল, “আমি তোকে শক্ত করতে চেয়েছিলাম… যাতে কেউ তোকে আঘাত না করতে পারে।” অ্যাডভোকেট বলল, “আমি তোকে সবকিছু থেকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করেছিলাম।” শিশুটি তখন ধীরে ধীরে হাসল, বলল, “তবে এবার এক হও… আমি একা থাকতে পারছি না আর।” ঘরের অন্ধকার আস্তে আস্তে আলোতে রূপ নিল। তিনটি মেহেরা — প্রথমবার — পরস্পরের দিকে হাত বাড়ালেন।
অধ্যায় ৭: অচেনা চিঠির খামে
সকালবেলা মেহেরা দত্তের বাড়ির দরজায় একটা চিঠি পড়ে থাকতে দেখে সে চমকে উঠেছিল। কোন ডাকপিয়ন আসেনি, কোন কুরিয়ারও না — অথচ সাদা খামে কালো কালি দিয়ে স্পষ্ট করে লেখা—”তিনজন তুমি, একটাই আমি।” চিঠিটা খুলতেই ভেতরে পাওয়া গেল হাতের লেখা, কিন্তু কাগজে কোনো স্বাক্ষর নেই। সেখানে লেখা, “তুমি যদি সত্যিই জানতে চাও তুমি কে, তাহলে যেতে হবে সেই তিন ঠিকানায়, যেখান থেকে তুই নিজেকে আলাদা করেছিস। ফিরে যেতে হবে অতীতে, যেখানে আমরা এক ছিলাম।” চিঠির নিচে লেখা তিনটি ঠিকানা — এক কলেজের পুরনো ভবন (যেখানে সে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল), এক আদালতের রেকর্ড রুম, আর এক পরিত্যক্ত খোলা মাঠ যেখানে একসময় সে বন্ধুদের নিয়ে কবিতা পড়ত। চিঠি পড়েই তার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। কে লিখল? কিভাবে জানল তার ভেতরের কথা? চিঠিটা যেন তার মনের কথা আগেভাগেই পড়ে ফেলেছে। সে দরজা বন্ধ করে ধীরে ধীরে আয়নার সামনে দাঁড়াল — এবং মনে হল, আজ তার মুখে ছায়া পড়েছে আরও দু’জন নারীর — যারা কথা বলছে না, কিন্তু চেয়ে আছে গভীর দৃষ্টিতে।
কলকাতায় মেহেরা রায় নিজের বাড়ির নিচের পোস্টবক্সে চিঠি খুঁজে পেয়েছিল — একদম একই সাদা খাম, একই অক্ষরে লেখা, “তিনজন তুমি, একটাই আমি।” চিঠি খুলে দেখল, সেখানে আবারো তিনটি ঠিকানা — কিন্তু এবার তারা তার স্মৃতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত: কলেজের সেই ছাদ, যেখানে প্রথমবার সে রাজনৈতিক ভাষণ দিয়েছিল; হাসপাতালের করিডর, যেখানে তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মৃত্যু হয়েছিল; আর সেই নির্জন লেকে পাথরের গায়ে বসে লেখা তার প্রথম কবিতা। চিঠির শেষ লাইনে লেখা — “যদি সাহস থাকে, ফিরে যাও। আমরা তিনজন হয়েছি অনেকদিন। এখন সময়, এক হবার।” মেহেরা রায় প্রথমে ধাক্কা খেলেন — কে জানে এসব কথা? এত নিখুঁতভাবে তার স্মৃতিগুলো লিখল কে? কিন্তু একটা মুহূর্ত পরেই মনে হল, এসব তো তার ভেতরের কথাই — হয়ত সে নিজেই লিখেছে একসময়, কোনো অচেনা সত্তা হয়ে। সে জানত, এই চিঠিগুলো ইঙ্গিত নয়, নির্দেশ — তাকে ফিরতে হবে। অতীতের সেই ঠিকানায়, যেখানে সে প্রথম ভেঙেছিল। তাকে মুখোমুখি হতে হবে সেই স্মৃতির, যা এতোদিন চাপা ছিল।
দিল্লির আবছা শীতের সকাল। মেহেরা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের অ্যাপার্টমেন্টের টেবিলে কাজ করছিলেন, যখন তার ঘরের নিচে কেয়ারটেকার একখানা খাম তুলে দিয়ে বলল, “দিদি, কেউ রেখে গেছে।” খামটি হাতে নিয়েই তার হাত কেঁপে উঠল — খামের গায়ে লেখা সেই চেনা বাক্য — “তিনজন তুমি, একটাই আমি।” এবার আর বিস্ময় নয়, বরং আতঙ্ক। খুলে দেখা গেল তার অতীতের তিনটি স্পর্শকাতর জায়গার নাম — দিল্লি ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরির পুরনো এক কোণ, যেখান থেকে সে পড়ালেখার স্বপ্ন গড়েছিল; পার্ক স্ট্রিটের এক নির্জন ক্যাফে, যেখানে জীবনের প্রথম প্রেমের গল্প শেষ হয়েছিল; আর তৃতীয়টি — নিজের বাবার পুরনো ফ্ল্যাট, এখন পরিত্যক্ত। সেই জায়গাগুলোর নাম লেখা ছিল স্পষ্ট কালি দিয়ে, আর নিচে লেখা ছিল — “একজন হতে হলে তিনটিকে জাগাতে হবে। না হলে আমরা সবই মুছে যাব।” মেহেরা বন্দ্যোপাধ্যায় এবার জানত, এটা কেবল মনস্তাত্ত্বিক সংকেত নয়, বরং এক আত্মার ডাকে সাড়া দেওয়া। সে জানত, এই চিঠিগুলোর প্রাপক একমাত্র সে নিজেই — তিনটি আলাদা জীবন একসঙ্গে মিলতে চাইছে, আর এই চিঠি সেই পুনর্মিলনের প্রথম পদক্ষেপ।
অধ্যায় ৮: মুখোমুখি সময়
কলকাতা শহরের দক্ষিণ প্রান্তে একটা পুরনো হেরিটেজ ক্যাফে — “ক্যালিপসো”, যার দেয়ালে কবিতা আঁকা, আর বেতের চেয়ারগুলো অতীতের গল্প বলে। আজ বিকেলে সেখানেই তিনজন নারী চুপচাপ ঢুকলেন। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলেন দীর্ঘ সময়, কিন্তু কেউ প্রথমে কথা বললেন না। তিনজনের চোখে এক অদ্ভুত পরিচিতি, যেন তারা বহুদিন আগে আলাদা হয়েছিল, এখন আবার এক জায়গায় ফিরে এসেছে। মেহেরা দত্ত একটু হেসে বললেন, “তোমরা… আমার মতো দেখতে।” মেহেরা রায় ঠোঁট চেপে রাখলেন, কড়া দৃষ্টিতে বললেন, “তুমি আমি—তবে আমি ভিন্ন পথে চলে গেছি।” আর অ্যাডভোকেট মেহেরা শান্ত গলায় বললেন, “আমরা প্রত্যেকে একে অপরের অসম্পূর্ণ প্রতিফলন।” পরিবেশটা অদ্ভুতভাবে অস্বস্তিকর ছিল, যেন এক আত্মিক বিভাজনের শারীরিক মিলন ঘটেছে। টেবিলে তিনটা কফি এসে গেল, আর তারা তিনজনই সেই কফির ধোঁয়ার ভেতর নিজেদের অতীত খুঁজতে লাগলেন — তিনটি পথ, তিনটি যুদ্ধ, তিনটি ক্ষত। এই মুখোমুখি হওয়া তাদের কাছে শুধু এক চমক নয়, এক অনিবার্য সত্যের সম্মুখীন হওয়া — যে তারা আলাদা ছিল, কিন্তু ভাঙনটা একজায়গা থেকেই শুরু হয়েছিল।
“তুমি স্বপ্ন ছেড়ে দিয়েছিলে,” মেহেরা রায় বললেন, গৃহবধূর দিকে তাকিয়ে। “তুমি নিজেকে বিসর্জন দিয়েছিলে শুধু অন্যদের জন্য। তাই আমি উঠে দাঁড়িয়েছিলাম, যাতে কেউ আমাদের মুছে দিতে না পারে।” মেহেরা দত্ত নিচু গলায় বললেন, “হয়তো আমি ছাড়িনি, শুধু… থেমে গিয়েছিলাম। সবাইকে আগলে রাখার দায়িত্বটা একসময় এত ভারি হয়ে গিয়েছিল যে নিজের জায়গাটাই ভুলে গেছিলাম।” তখন মেহেরা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ তুললেন, চোখে ক্লান্তি, অথচ কঠোর সত্য — “আর আমি সব অনুভবকে আটকে রেখেছিলাম, যাতে আমরা আর কখনো না কাঁদি। আমি যুক্তি দিয়ে সব ব্যথা ঢাকতে চেয়েছি।” তিনজনে একটু নীরব হলেন। বাইরে ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে, যেন শহর নিজেও তাদের মিলনের সাক্ষী হয়ে ধুয়ে দিচ্ছে পুরনো ক্ষত। তখন মেহেরা রায় বললেন, “তুমি জানো, আমাদের ভিতরে আজও সেই ছোট্ট মেয়েটি আছে, যে ছাদে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়ত? যাকে কেউ থামিয়ে দিতে পারেনি?” মেহেরা দত্ত একটু মাথা নাড়লেন। “আমার মেয়ের চোখে আজকাল সেই মেয়েটাকে দেখি… মাঝে মাঝে ভাবি, যদি ওর পথটাও আমি আটকে দিই?” তখন অ্যাডভোকেট মেহেরা বললেন, “তাই আমরা একত্র হয়েছি। এবার সময় এসেছে আমাদের ভাঙা অংশগুলোকে জোড়া লাগানোর।”
তিনজনে আবার নীরব হলেন। বাইরে বাজ পড়ছে, মেঘ ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তারা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। ক্যাফের এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল আয়না — বড়ো, প্রাচীন কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো। তিনজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সেই আয়নায় তাকালেন। কিন্তু এবার আর তিনটি মুখ নয় — একটা একক প্রতিবিম্ব। তারা বুঝলেন, এতদিন ধরে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, কারণ ভয় ছিল — যদি একটি সত্তা অন্যটিকে গ্রাস করে। কিন্তু বাস্তব হলো, এই তিনজন একে অপরকে ছুঁয়ে থাকলেই সম্পূর্ণ। গৃহবধূর ত্যাগ, রাজনীতিকের সংগ্রাম, অ্যাডভোকেটের আত্মনিয়ন্ত্রণ — সব মিলেই তারা ‘মেহেরা’। একটাই আমি — কিন্তু বহুরূপী। তখনই কেউ একদম নিচু স্বরে বলল, “এই আমরা—একজন তুমি, তিনটি জীবন। এবার নতুন করে বাঁচা শুরু হোক।” তিনজনে কফির কাপ ফেলে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন, রাস্তায় তখন বৃষ্টি থেমেছে। তারা তিনজন নয় — এখন একজন মেহেরা হেঁটে চলেছে, তার নিজের সম্পূর্ণতার দিকে, তার নিজের জীবনের দিকে।
অধ্যায় ৯: জাগরণে যাত্রা
সকালের প্রথম আলোয় মেহেরা দত্ত নিজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তার চোখে এখন আর শুধু রান্নাঘর, বাজারের খরচ বা সন্তানের পরীক্ষার চিন্তা নেই — বরং এখন তার চোখে প্রতিফলিত হচ্ছে এক দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে পাওয়া উপলব্ধি। বহু বছর পর সে আবার নিজের ডায়েরির পাতা খুলেছে, লিখছে — “আমি আজ স্বপ্ন দেখলাম না, আমি আজ স্বপ্ন তৈরি করলাম।” সে অনুভব করছিল যে, গৃহবধূ হিসেবে সে যা যা ত্যাগ করেছে, তা বৃথা নয় — বরং সেই অভিজ্ঞতা তাকে আরও গভীর করেছে। দুপুরে সে স্থানীয় একটি স্কুলে গিয়ে শিক্ষিকার জন্য আবেদন করল — প্রথমে ভয় পেয়েছিল, কিন্তু মুখে একরাশ আত্মবিশ্বাস ছিল। হ্যাঁ, বয়স বেড়েছে, কিন্তু মন এখনও সজীব। সে নিজের ভেতরের রাজনৈতিক আর আইনি সচেতনতাকে মিলিয়ে একটি নতুন লক্ষ্য গড়ে তুলতে চায় — নারীশিক্ষা নিয়ে কাজ করা। তার চোখে এখন যে মেহেরা রয়েছে, সে শুধু কারো স্ত্রী বা মা নয় — সে নিজেও একজন পূর্ণ মানুষ। ঘরে ফিরে মেয়ের মাথায় হাত রেখে সে বলল, “তুই যা হতে চাস, তোর জন্য আমি লড়ব।”
কলকাতার পার্কস্ট্রিটের এক বুকস্টোরে মেহেরা রায় বসে ছিল, সামনে খোলা ল্যাপটপ। বহুদিন বাদে সে নিজের পুরনো ব্লগে লিখছিল, “আমি হেরেছি, কিন্তু আমি কখনো মুছে যাইনি। আমি এখন বুঝেছি, আদর্শ একা নয়, সেটা অন্তর ও বাস্তবতার মিলনে গড়ে ওঠে।” সে ঠিক করেছে, আর নির্বাচনের লড়াই নয় — এবার সে লড়বে কলম দিয়ে। বিভিন্ন এনজিও, নারী অধিকার সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সে কাজ শুরু করেছে — কিন্তু এবার তার চেহারাটা নরম, হৃদয়ের কাছে ঘনিষ্ঠ। রাজনীতির আগ্রাসী রূপকে সে এখন অন্যভাবে দেখছে — মানুষ হিসেবে বদলে গেছে সে। বিকেলে তার এক সময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী একটি বার্তা পাঠাল — “তুমি সত্যিই বদলে গেছো, আমি এখন তোমাকে শ্রদ্ধা করি।” সেই বার্তায় মেহেরা রায় হেসে ফেলল, বলল, “না, আমি আসলে ফিরে গেছি। ফিরে গেছি সেই আমি-তে, যাকে এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলাম।” সে জানে, তার রাজনৈতিক পরিচয়ই সব নয়, বরং এখন সে এক নীরব বিপ্লব শুরু করেছে — নিজের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে, সময়ের সঙ্গে।
দিল্লির আদালত পাড়ায়, মেহেরা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ আর কেবল পেশাদার যুক্তিবাদী নয় — সে একজন শ্রোতা, একজন বোঝার মানুষ। আগে সে যুক্তি দিয়ে ক্লায়েন্টের কষ্টকে চেপে রাখত, এখন সে আগে শুনে, পরে লড়াই করে। সে নিজেকে বলেছে, “আমি কেবল জিততে চাই না, আমি চাই তাদের হয়ে অনুভব করতে।” কিছুদিন ধরে সে একটি নতুন উদ্যোগ শুরু করেছে — আদালতের বাইরেও ‘সাইকোলজিক্যাল কনফ্লিক্ট রিজলভেশন’ নিয়ে কাজ করছে, বিশেষত মেয়েদের সঙ্গে, যারা নিজেদের মধ্যে হারিয়ে গেছে। তার নিজের অভিজ্ঞতা, নিজের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব তাকে দিয়েছে এক গভীর উপলব্ধি — সবকিছুর গভীরে একটা নরম হৃদয়, একটা সাহসী আত্মা থাকে, যাকে দেখা দরকার। আদালতের বাইরে আজ এক তরুণী এসে বলল, “আপনার কথা শুনেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি ছাড়ব না, আমি লড়ব।” মেহেরা শুধু বলল, “তুমি একা নও, তোর ভেতরেও অনেক আমি আছে — তাদের এক করলেই সব পারবি।” সে জানে, তার লড়াই আজও চলছে — কিন্তু আজ সে একা নয়, কারণ তার ভেতরের তিনটি ‘আমি’ এখন একসাথে হাঁটে, একসাথে জাগে, আর একসাথে গড়ে তোলে ভবিষ্যৎ।
অধ্যায় ১০: একজন আমি
বিকেলের রোদ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো ঘরজুড়ে। বইয়ের তাকের ওপরে রাখা পুরনো ডায়েরির পাশে আজ এক নতুন খাতা খুলে বসেছেন মেহেরা। খাতার প্রথম পাতায় লিখেছেন, “আমি এখন এক।” এক সময়ের সেই দ্বিধাগ্রস্ত গৃহবধূ আজ আর শুধু ছাদের কোনে একলা কাঁদেন না; তিনি জানেন, সেই কান্না আজ জীবনের শক্তি হয়ে উঠেছে। সংসার, সন্তান, দায়িত্ব—সবকিছু তাকে ভেঙেছে, কিন্তু সেই ভাঙন থেকেই গড়েছে এক নতুন আমি। এখন সে রান্না ঘরের তাপ আর আদালতের ঠাণ্ডা যুক্তি দুটিকেই নিজের বলেই অনুভব করে। মাঝেমধ্যেই আয়নায় তাকিয়ে সে বলে, “আজ আমি তোমায় ক্ষমা করলাম” — এই কথাটা সে বলে নিজের তিনটি ছায়াকে, যারা এতদিন ধরে শুধু লড়েছে, পালিয়েছে, মুখ ফিরিয়েছে। আর এখন, তারা এক হয়ে গেছে। মেহেরা বুঝেছেন — আমি মানে একটা নির্দিষ্ট পেশা নয়, নির্দিষ্ট ভূমিকা নয় — আমি মানে একটি চলমান নদী, যার বিভিন্ন বাঁকে ছিলো ভিন্ন আমি, কিন্তু উৎস ছিল একটাই।
কলকাতার এক নতুন সাহিত্য উৎসবে প্রধান বক্তা হিসেবে ডাক পেয়েছেন মেহেরা রায়। অনুষ্ঠানের মঞ্চে দাঁড়িয়ে, মাইক্রোফোনের সামনে তিনি বললেন, “আজ আমি লিখতে এসেছি কাগজে নয়, জীবনের পাতায়। আমি কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, আমি বলতে এসেছি একজন নারীর গল্প — যে একদিন নিজেকে খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল, আর তিন টুকরো হয়ে গিয়েছিল।” গোটা হলে নীরবতা। তারপর তিনি বলেন, “আমি সেই আমি, যে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে সমাজ দেখেছে, মঞ্চে দাঁড়িয়ে আদর্শ বলেছে, আর আদালতের বেঞ্চে দাঁড়িয়ে ন্যায় খুঁজেছে। আজ আমি শুধু মেহেরা নই, আমি তুমিও — যে আজও লড়ছে নিজের ভেতরের সত্যের সঙ্গে।” তার কণ্ঠে কোনো উচ্চকিত প্রতিবাদ নেই, কিন্তু গভীরতায় ছিলো বজ্রের গর্জন। দর্শকরা নিশ্চুপ, কিছুজন চোখ মুছছিল। এই মেহেরা রায় আর রাজনৈতিক স্লোগানের মুখ নয় — সে আত্মচেতন নারীর প্রতীক, যিনি নিজের ভেতরের বিভক্তিকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, আর তাতেই নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন নতুন আলোয়। মেহেরা হাসলেন। এ হাসি জয়ের নয় — এ নিজেকে চেনার হাসি।
সন্ধেবেলায় দিল্লির একটি ছোটো সভাঘরে, যেখানে কিছু নারী-পুরুষ জড়ো হয়েছেন ‘সেলফ-রিফ্লেকশন’ বিষয়ক এক ওয়ার্কশপে, সেখানে মেহেরা বন্দ্যোপাধ্যায় বক্তৃতা দিচ্ছেন না, বরং সবাইকে বলছেন, “চোখ বন্ধ করো, আর মনে করো এমন একটি সময়, যখন তুমি নিজেকে অচেনা মনে করেছিলে।” ঘরজুড়ে নীরবতা। সবাই চোখ বন্ধ করছে, নিঃশ্বাস নিচ্ছে। মেহেরা হেঁটে হেঁটে বলছেন, “সেই অচেনা আমি কে ছিল? তাকে কি তোমরা আজ চিনতে পারো?” নিজের ভেতরে উত্তর দিচ্ছে সবাই — আর মেহেরা জানেন, তার তিনটি সত্তা — গৃহবধূ, রাজনীতিক, অ্যাডভোকেট — আজ আর বিভক্ত নয়। তারা এখন একই হৃদয়ের ছায়া। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে তারা আবার আলাদা হয়ে যেতে চায়, তর্ক করে, কান্না করে — কিন্তু মেহেরা জানেন, তিনি এখন তাদের মা, তাদের বন্ধন। সময় এসেছে অন্যদের জন্য সেই পথ দেখানোর, যা তিনি নিজে পেরিয়ে এসেছেন। কর্ম, আত্মচর্চা, ভালোবাসা—সবকিছু মিলিয়ে এখন তিনি শুধুই একজন — একজন সম্পূর্ণ, একক আমি।
—
শেষ
				
	

	


