Bangla - রহস্য গল্প

ঈগল নেস্টের ছায়া

Spread the love

বৈশাখ দত্ত


বারাভটেসগাডেনের ডাক

অনিরুদ্ধ দাশগুপ্তের পায়ের নিচে ক্রঞ্চ করল ঝরাপাতায় ঢাকা পাথুরে রাস্তা। মে মাসের ঠান্ডা বাতাসটা কানের পাশ দিয়ে শিস বাজিয়ে চলে গেল। সে একবার পেছনে তাকাল—রেলস্টেশন থেকে বাসে করে উঠে এসেছে এই পাহাড়ি পথে, এখন দাঁড়িয়ে আছে বারাভটেসগাডেনের ঠিক গা ঘেঁষে। দূরে দেখা যাচ্ছে সেই বিখ্যাত পাহাড়, যার চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে হিটলারের berüchtigte Kehlsteinhaus—ঈগল নেস্ট।

“Sir, are you going up alone?” পাশের একজন ট্যুরিস্ট গাইড জিজ্ঞাসা করল।
“Just exploring the base first,” অনিরুদ্ধ ইংরেজিতে হেসে বলল।

তার ব্যাগের ভেতরে একটা কালো মলাটের ফাইল, যার উপর লেখা: “Third Reich and the Eastern Front: A Subaltern Perspective”. এই গবেষণাপত্রটাই সে নিয়ে এসেছে জার্মানিতে—বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস সম্মেলনে পেশ করার জন্য। কিন্তু বারাভটেসগাডেনে আসাটা নিছক পর্যটন নয়। তার দাদুর পুরোনো ডায়েরিতে একবার উল্লেখ ছিল—১৯৪৪ সালে এক বাঙালি অনুবাদক এখানে নাৎসিদের এক বিশেষ অফিসে কাজ করতেন, যার নাম ছিল দেবাশীষ বসু।

দাদুর লেখা: “…দেবাশীষদা একটা অদ্ভুত কিছু দেখেছিলেন Eagle’s Nest-এর এক গোপন কক্ষে। তারপর থেকেই তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি…”

অনিরুদ্ধ জানত, এটা নিছক গল্প নয়।

সে যখন জায়গাটা ঘুরে দেখছিল, চোখে পড়ল নিচের একটা পুরোনো প্রস্তর-ঘেরা দরজা, যেখানে সাধারণত পর্যটকরা যেত না। দরজার সামনে জংধরা তালা, কিন্তু আশপাশে কেউ নেই। সে নিচু হয়ে দেখল—একটা ছোট লোহার ফাঁক দিয়ে ভেতরে আলো পড়ছে।

কৌতূহল সামলাতে না পেরে সে পকেট থেকে ছোট একটা স্টিলের পেননাইফ বের করল। “Just like the documentaries,” সে ফিসফিস করে হাসল।

তালার ভেতর গুঁজতেই টিক করে একটা শব্দ হলো।

দরজাটা আস্তে ঠেলে খুলতেই গা ছমছমে ঠান্ডা বাতাসের ধাক্কা লাগল। ভিতরটা অন্ধকার, কাঁচের জানালা নেই। মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে সে এগিয়ে গেল।

হঠাৎই একটা ধাতব শব্দ কানে এলো।

“Wer ist da?”—একটা গলা, নিচু ও খসখসে।

অনিরুদ্ধ কেঁপে উঠল। কেউ এখানে আছে?

সে পেছন ঘুরে আসতে চাইছিল, কিন্তু তখনই দেখা গেল এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে, হাতে কাঠের লাঠি। মাথায় পুরোনো জার্মান হ্যাট, চোখে পুরু চশমা।

“Who are you?” অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করল।

বৃদ্ধ লোকটা ইংরেজিতে বলল, “You shouldn’t be here. This place is not open to tourists. Not anymore.”

“I’m a researcher. From India. I’m looking for records… about a man named Debashish Basu. He worked here. Maybe.”

লোকটা তাকাল অনেকক্ষণ। তারপর বলল, “Follow me.”

ভেতরে একটা সরু করিডোর। দেয়ালজুড়ে পুরোনো ফ্রেমে নাৎসি অফিসারদের ছবি, কিছু জায়গায় হিটলারের ভাষণের ছাপা কপি।

বৃদ্ধ লোকটা একটা লোহার দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। পকেট থেকে একটা পিতলের চাবি বের করে ঘুরিয়ে খুলল দরজা।

“Inside. Look carefully.”

অনিরুদ্ধ ঢুকেই চমকে গেল। কাঠের একটা তাক। তাতে পুরোনো নথি, টাইপ করা চিঠি, আর এক কোনায় রাখা একটা কালো ডায়েরি। তার উপর ইংরেজিতে লেখা: “To be found, only when the world forgets…”

সে ডায়েরিটা তুলে নিতেই পিছনে আবার গলার শব্দ—“That belonged to Debashish.”

“Are you—do you know him?” অনিরুদ্ধ চমকে প্রশ্ন করল।

“More than you can imagine.”

হঠাৎ লোকটা পেছনে ঘুরে গেল, দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল। টর্চের আলোয় দেখা গেল লোকটার মুখে অদ্ভুত হাসি।

“Now you must read.”

ডায়েরির প্রথম পাতায় টাইপ করা একটা লাইন:
“Operation Krokodil: Final plans to revive the Fourth Reich, in case of defeat.”

অনিরুদ্ধ গিলে ফেলল থুতু। হাত কাঁপছিল।

সে উচ্চস্বরে পড়তে শুরু করল:
“May 1944. The Führer is increasingly uncertain. I, Debashish Basu, have been told to translate coded telegrams from Berlin. I overheard something—something called ‘Krokodil’… A plan involving India, secret camps in the Himalayas, and a last shipment…”

বৃদ্ধটা হঠাৎ বলল, “That shipment never reached its destination. But the map is still here. Somewhere in this house.”

“Map? To what?”

“To something that must never be found.”

অনিরুদ্ধ হতবাক। “But why me? Why now?”

“Because you’re the last link. And time is running out.”

ঠিক তখন বাইরে গাড়ির শব্দ। বেশ কয়েকজন লোকের কণ্ঠস্বর।

বৃদ্ধটা কাঁচের জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে বলল, “They’ve found us. CIA. Maybe BND too. You must go.”

“Wait—what do I do with the diary?”

“Take it. Protect it. And never trust a man in uniform.”

সাথে সাথেই দেয়ালের পিছনে থাকা একটা গোপন দরজা খুলে গেল। লম্বা আঁধার টানেল।

“Where does this lead?”

“To history. And maybe, to truth.”

অনিরুদ্ধ একটু সময় নিল না—ডায়েরি হাতে নিয়েই ঢুকে পড়ল টানেলে। দরজাটা ধীরে বন্ধ হয়ে গেল।

পিছনে বেজে উঠল একটা গুলি চালানোর শব্দ।

দ্বিতীয় চাবির সন্ধানে

টানেলের মধ্যে দৌড়াতে দৌড়াতে অনিরুদ্ধের বুক ধড়ফড় করছিল। ডায়েরিটা শক্ত করে ধরে রেখেছে। পেছনে গুলির শব্দ থেমে গেছে, কিন্তু মনে হচ্ছে সেই বৃদ্ধ লোকটা… বেঁচে নেই। একটা অদ্ভুত হাওয়া বইছিল টানেলের মধ্যে—পাথরের দেয়ালে জমে থাকা স্যাঁতসেঁতে ইতিহাস যেন নিঃশব্দে চোখ রাঙাচ্ছিল।

প্রায় দশ মিনিট দৌড়ানোর পর, একসময় সে বেরিয়ে এল পাহাড়ের এক নিচু ঢালে, যেখানে একটা পুরোনো কাঠের শেড। তার ঠিক পাশেই ছোট্ট একটা রাস্তায় একটা রেন্টাল বাইক রাখা। হেলমেটটা ঝুলছে হ্যান্ডেলে। পাশে সাঁটা নোট–”Für die, die fliehen müssen.” — “Those who must flee.”

“Seriously?” অনিরুদ্ধ একবার তাকাল চারপাশে। কেউ নেই। গলায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইকে উঠল সে।

ডায়েরির দ্বিতীয় পাতায় ইংরেজিতে লেখা—

“Second Key. Rue des Martyrs, Paris. Apartment 3B. Seek the watchmaker. Trust no one.”

দুদিন পর, প্যারিস।

বৃষ্টিভেজা শহরের ছাউনিতে দাঁড়িয়ে আছে অনিরুদ্ধ। হুডি মাথায়, ব্যাগে গোঁজা সেই ডায়েরি। Rue des Martyrs-এর পুরোনো অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংটা দেখে মনে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার।

তৃতীয় তলায় পৌঁছে দরজা নম্বর 3B-তে তিনবার টোকা দিল।

একটু বাদে দরজা খুলল একজন বৃদ্ধ—পাঞ্জাবি কোট পরে, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। নামplate-এ লেখা “A. Bouchard”।

“Oui?”

“I’m looking for… the watchmaker. A friend of Debashish Basu.”

বৃদ্ধের চেহারায় একটা পরিবর্তন এলো। সে একবার ভালো করে অনিরুদ্ধকে দেখল।

“Come in. Quickly.”

ভেতরে ঢুকতেই একটা পুরোনো ঘড়ি আর যন্ত্রাংশে ভর্তি ঘর। দেয়ালে টাঙানো নানা দেশের ঘড়ি। এককোণে কাঠের আলমারি, তার উপরে হিটলারের সময়কার রেডিও।

“Are you from Calcutta?” বৃদ্ধ ফরাসি উচ্চারণে জিজ্ঞেস করল।

“Close. I’m from Santiniketan. Researcher.”

বৃদ্ধ হালকা হাসল। “Debashish and I worked together. I was his link in the French resistance. He sent me part of the map… and a warning.”

“Map to what?”

“To a cache of documents… a list of names. High-ranking Nazis who fled after the war. And those who helped them.”

“Operation Paperclip?”

“More than that. Operation Krokodil.”

অনিরুদ্ধ অবাক হয়ে বলল, “That word… it’s in the diary.”

বৃদ্ধ তখন একটা ঘড়ির ড্রয়ার খুলে এক টুকরো কাগজ বের করল। “This is your second key. It’s a cipher.”

অনিরুদ্ধ কাগজটা হাতে নিয়ে দেখল—পুরোপুরি জার্মান কোডে লেখা। তার নিচে লাল কালিতে আঁকা একটা ছায়ামূর্তি—ডানায় ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা একটা সরীসৃপ, যেন ড্রাগনের প্রতীক।

“Decode this, and you’ll find the next location.”

“Where?”

“Vienna. There’s a church. Inside its crypt…”

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই দরজায় জোরে ধাক্কা।

“Police!”—একজন ফরাসি কণ্ঠ।

“Go through the back!” বৃদ্ধ চেঁচিয়ে বলল।

অনিরুদ্ধ আবার দৌড়াল—ঘড়ির দোকরের পেছনে সরু গলি, তারপর নেমে গেল একটা বেজমেন্টে। পেছনে গুলির শব্দ।

এক ঘণ্টা পর, সে একটা ট্রেনের কামরায়।
ব্যাগে গোঁজা ডায়েরি, পকেটে সাইফার-কোড, আর মনে ভয়ানক উত্তেজনা। সে জানে—এবার ভিয়েনা।

সে জানে না—তাকে ট্রেনের উল্টো মাথায় বসে চুপচাপ দেখছে একজন মহিলা। সাদা চুল, কানে গোল্ডেন ক্লিপ, হাতে নোটবুক। তার নাম—Clara Stein, জার্মান ইন্টেলিজেন্সের সাবেক সদস্য। এবং তার হাতে আছে অন্য এক আদেশ:
“Follow the Indian. Kill only if necessary.”

ক্রিপ্টের নিচে

ভিয়েনা পৌঁছানোর সময় ট্রেনের জানালা দিয়ে রোদ ভেসে পড়ছিল। তবু অনিরুদ্ধের ভিতরে তখনও জমে থাকা অজানা আশঙ্কা। কোল্ড কফির মতো অস্থিরতা, হালকা কিন্তু গভীর। ব্যাগের মধ্যে চাপা দেওয়া সেই সাইফার-কোড—পিঠে শীতল হয়ে ঠেকছে।

ট্রেন থেকে নামতেই সে ট্যাক্সি ধরল। গন্তব্য: Peterskirche—ভিয়েনার এক প্রাচীন গির্জা, যার নিচে রয়েছে শতাব্দী পুরোনো ক্রিপ্ট। ডায়েরির কোডে ওই নামটাই উঠে এসেছিল একবার—“Sanctum under the Saint, Vienna.”

ট্যাক্সির ড্রাইভার হালকা জার্মান উচ্চারণে বলল, “That’s a beautiful church, sir. Romantic. Many people get married there.”

অনিরুদ্ধ হেসে বলল, “I’m here for something else. A different kind of buried story.”

গির্জার ভিতরে পা রাখতেই হালকা ধূপের গন্ধ এসে লাগল। চোখে পড়ল ঝাড়বাতির নিচে গম্বুজের নকশা—শাদা আর সোনার ছোঁয়া মিলে এক সুর্রিয় চিত্র। চারপাশে কিছু টুরিস্ট ছবি তুলছে। একজন ফাদার দাঁড়িয়ে আছেন, সাদামাটা কালো পোশাকে।

“Hello, Father,” অনিরুদ্ধ এগিয়ে গিয়ে বলল, “I’m a historian. Researching World War documents. I was told there’s a crypt here?”

ফাদার তাকাল গম্ভীর চোখে। “That is not a public tour.”

“I have a document,” অনিরুদ্ধ বলল, ব্যাগ থেকে বের করল সেই সাইফার চিঠি। “I believe it refers to this place.”

ফাদার কাগজটা হাতে নিয়ে তাকাল। কিছু একটা চিনলেন মনে হল। মুখ থমথমে।

“Come with me.”

তারা গির্জার মূল বেদির পেছনে এক সরু দরজা দিয়ে ঢুকল। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে ফাদার বললেন, “During the war, this crypt was used for more than burials. Documents, artefacts, sometimes people.”

“Hidden?”

“Protected. From Nazis. And sometimes, for them.”

নিচে একটা বড় ঘরের মধ্যে চারদিকে পুরনো কফিন আর পাথরের মূর্তি। এক কোনায় ধুলো ঢাকা কাঠের বাক্স। ফাদার একটাকে খুলে দেখালেন। ভিতরে কয়েকটা পুরনো টাইপড পাতা।

অনিরুদ্ধ নিল একটার পর একটা কপি। তার চোখ আটকে গেল এক পাতায়—
“KROKODIL – PHASE II – TO BE REACTIVATED VIA CODE: D13-SHADOW”

তার নিচে চারজন নাম—জার্মান, ফরাসি, আমেরিকান… এবং একটিতে লেখা ছিল ‘Basu, D.’

“Debashish Basu?” অনিরুদ্ধ ফিসফিস করে বলল।

ঠিক তখন দরজার ওপাশে শব্দ।

“Stay quiet,” ফাদার বললেন।

অনিরুদ্ধ ফাদারের ইশারায় একটা ছোট্ট পাশের ঘরে ঢুকে গেল। দরজা অল্প খোলা রাখল। ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল একজন সাদা চুলের মহিলা ঢুকছে। চোখে সানগ্লাস, হাতে ছোট নোটবুক। ফাদার কিছু বলার আগেই সে বলল—

“You’re protecting him?”

“Who?”

“The Indian. I know he’s here.”

“Miss… I don’t know—”

ক্লারা তখনই পেছনের ঘরের দরজায় হেঁটে এলো।

অনিরুদ্ধ বুঝল, সময় নেই। সে ব্যাগ নিয়ে আরেকটি সরু পথে দৌড়াতে শুরু করল। পাথরের দেয়ালের মধ্যে দিয়ে একটা পুরনো গন্ধ নাকে এল—কোন ইতিহাস যেন নিশ্বাস ফেলছে।

ক্লারা চিৎকার করল, “You don’t understand what you’re holding!”

অনিরুদ্ধ থামল না। সে দৌড়াতে দৌড়াতে উপরের দিকে উঠল—একটা পুরনো দরজার ছিটকিনি ঠেলে বেরিয়ে পড়ল গির্জার বাইরের ছোটো উঠোনে।

পেছনে ক্লারা দৌড়াচ্ছে।

“Stop! You’ll put lives in danger!”

অনিরুদ্ধ হঠাৎ থেমে গেল। ঘুরে তাকাল।

“Why are you following me?”

“Because I used to believe in what you’re chasing. I thought truth was sacred. Until I lost my brother trying to uncover the same files you found.”

অনিরুদ্ধ স্তব্ধ। “Then help me. Don’t hunt me.”

ক্লারা একটুখানি থেমে ব্যাগের ভেতরে কিছু খুঁজল। বের করল একটা ছোট ক্যামেরা। “Give me copies. Let me verify. If it’s real, we’ll talk.”

অনিরুদ্ধ বলল, “I’ll share. But we go together.”

ক্লারা একবার তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, “Fine. But the next place isn’t in Europe.”

“Where?”

“Goa.”

“India?”

ক্লারা বলল, “One of the last known Nazi refuge routes passed through Portuguese colonies. Someone from your country helped them hide.”

অনিরুদ্ধ ফিসফিস করে বলল, “Then it’s time to bring that name to light.”

গোয়ার ছায়ায় ছদ্মবেশ

গোয়ার আর্দ্র বাতাস কপালে লেগে থাকার মতো। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আসতেই ক্লারা চশমা খুলে বলল, “So this is tropical espionage?”

অনিরুদ্ধ হেসে বলল, “This is colonial hangover in high humidity.”

পেছনের ট্যাক্সিতে উঠতেই ক্লারা একটা ফোল্ডার বের করল। “The Portuguese controlled Goa until 1961. During that time, they were surprisingly neutral about ex-Nazi presence.”

অনিরুদ্ধ বলল, “My grandfather used to say—Goa was a paradise for runaways. Hippies, exiles, spies… and war criminals.”

গাড়ি ছুটে চলল দক্ষিণ গোয়ার দিকে, রুয়ামের কাছে এক পুরনো পর্তুগিজ দুর্গ—Forte das Sombras। স্থানীয়রা এখন একে ‘ভুতুড়ে কেল্লা’ বলেই চেনে। সরকারি দপ্তরের কাছে পরিত্যক্ত স্থাপনা।

“Do you believe the map will lead us here?” অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করল।

ক্লারা জানাল, “One of Debashish Basu’s intercepted telegrams mentioned ‘Sombra Station’—we believe it’s a codename for this fort.”

সন্ধ্যাবেলা। দুর্গের সামনে দাঁড়িয়ে দুজন। লোহার গেট মরচে ধরা, একপাশে লতাগুল্মে ঢাকা।

ক্লারা ব্যাগ থেকে বার করল এক চ্যাপ্টা টর্চ আর ছোটো crowbar।
“Ladies first?”
“Let’s do equal danger,” অনিরুদ্ধ বলল।

গেট ঠেলে ঢুকতেই একটা শুকনো পাতার গন্ধ, পাথরের দেয়ালে শ্যাওলা জমে থাকা ছাপ, আর দেয়ালে পর্তুগিজ ভাষায় লেখা কিছু পুরনো লাইন। অনিরুদ্ধ পড়তে পারল:
“Aqui esconderam o último nome do dragão…”
(এখানে লুকিয়ে আছে ড্রাগনের শেষ নাম…)

“Dragon again,” অনিরুদ্ধ বলল, “Just like the cipher drawing.”

হঠাৎ ক্লারার টর্চের আলো এক পুরনো দরজার ফাঁকে গিয়ে পড়ে—সেখানে একটা সাইন, ‘Estação de Registo’—রেকর্ডিং স্টেশন।

দরজা ঠেলে ঢুকতেই ঘরের মাঝখানে একটা কাঠের ট্রাঙ্ক। কাঁপা হাতে ক্লারা সেটা খুলল। ভেতরে একগুচ্ছ চিঠি, একটা টাইপড রিপোর্ট আর একজোড়া রৌপ্য-চশমা।

অনিরুদ্ধ চিঠির একটা পড়ল—

“To whoever finds this: I sheltered him. I was a coward. But I feared what truth would do to this young nation. The man called himself Erich Vogel. He was not a tourist. He was SS. And I—Major K.R. Chattopadhyay—gave him shelter in exchange for gold.”

ক্লারা একমুহূর্তের জন্য চুপ করে রইল।

“Your people helped them hide?”

“Some of ours. Not mine.”

অনিরুদ্ধ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ক্লারার চোখে অস্পষ্ট বিস্ময়।

“Your name—Chattopadhyay. That’s Bengali. You think—?”

“Could be a coincidence. Or… a family skeleton I never knew.”

ঠিক তখনই বাইরের দরজায় একটা শব্দ—চুপ চাপ পায়ের আওয়াজ। দুজনেই টর্চ নিভিয়ে ঘরের এক কোণে সরে গেল।

একজন লোক ঢুকল—পাঁচ ফুট দশ, গায়ে কালো শার্ট, মুখে জার্মান অ্যাকসেন্ট। মোবাইলে কথা বলছে—

“Ja, sie sind hier. Ich werde es beenden.”

ক্লারা ফিসফিস করল, “He said—‘They are here. I will end it.’”

অনিরুদ্ধ ইশারা করল অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু পেছনের দরজা ছিল আটকানো।

লোকটা ঘুরে বলল, “No point hiding. We don’t want the world to know what your grandfather did, do we?”

“Who are you?” ক্লারা চিৎকার করল।

“Let’s just say… I’m the janitor of forgotten crimes.”

লোকটা বন্দুক তুলল।

ঠিক তখনই ক্লারা তার হাত থেকে ক্যামেরা ছুড়ে মারল। ক্যামেরাটা মুখে লেগে লোকটা এক সেকেন্ডের জন্য পিছিয়ে গেল। অনিরুদ্ধ ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর হাত থেকে বন্দুকটা ছিনিয়ে নিল। দুজনে মিলে ধাক্কা দিয়ে লোকটাকে ঘরের বাইরে ফেলে দিল।

“Run!” ক্লারা চিৎকার করল।

দুজনেই পেছনের একটা সরু সিঁড়ি দিয়ে দুর্গের ছাদে উঠে এলো। দূরে দেখা যাচ্ছে সমুদ্রের কালো রেখা, বাতাসে লবণের গন্ধ।

অনিরুদ্ধ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “We’re being hunted in paradise.”

ক্লারা বলল, “And we just found the next clue.”

সে রিপোর্টটা বের করল—এক জায়গায় লেখা:
“Vogel was picked up from Goa by a ship named ‘Seeschlange’, docked near Malacca.”

“Next stop… Malaysia?” অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করল।

ক্লারা মাথা নাড়ল। “No. Next stop, Kolkata. Because Major K.R. Chattopadhyay didn’t just shelter the Nazi… he sent the gold to his family estate.”

অনিরুদ্ধ স্তব্ধ হয়ে গেল।

“My family?”

চট্টোপাধ্যায়দের চাবিকাঠি

শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্যাক্সি করে যখন অনিরুদ্ধ কলকাতার বেহালায় পৌঁছোল, তখন সন্ধ্যার আলো ফিকে হয়ে এসেছে। ক্লারা পাশেই বসে, জানালার বাইরে তাকিয়ে। বৃষ্টির পরে রাস্তার উপর একটা সোঁদা গন্ধ, পুরনো শহরের মতোই ধোঁয়াশাচ্ছন্ন।

“Is this where your family lived?” ক্লারা জিজ্ঞেস করল।

“Used to,” অনিরুদ্ধ উত্তর দিল। “My father sold off most of it. But one part… still belongs to us. Locked up, untouched.”

ট্যাক্সি থামল এক পুরনো লোহার ফটকের সামনে। ওপরে লোহার সাইনবোর্ডে লেখা ‘Chattopadhyay Villa, est. 1889’। দেওয়ালের গায়ে শ্যাওলা, ছোট বাগানটা বন্য গাছপালায় ছেয়ে গেছে।

অনিরুদ্ধ নিজের চাবির গোছা থেকে একটা পুরোনো ব্রোঞ্জের চাবি বের করল। “Dadu gave me this when I was ten. Said never to open the back wing.”

ফটক খুলে দুজন ভেতরে ঢুকল। ভিতরে বিশাল বারান্দা, কাঠের মেঝে আর কাঁচের জানালা। কিন্তু তার ডানদিকে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নিচতলায়—ঘন অন্ধকার, যেন ইতিহাস সেখানে নিঃশ্বাস ফেলে।

“Looks like the right kind of creepy,” ক্লারা ফিসফিস করে বলল।

তারা নিচে নামল। কাঠের দরজা। তালা। সেই পুরোনো চাবি দরজায় ঘোরানো মাত্র টিক শব্দ করে খুলে গেল।

ভিতরটা যেন ঠিক সিনেমার সেট—পোকায় খাওয়া বই, কুঁচকে যাওয়া ম্যাপ, পুরোনো আলমারি আর এক কোণে একটা লোহার সিন্দুক। ঠিক উপরে কাঠের ফ্রেমে লাল রঙে লেখা একটা বাক্য—

“বিশ্বাসঘাতকের রক্তে যে রহস্য, সে জানবে তার নামধারী।”

অনিরুদ্ধ পেছনে তাকাল ক্লারার দিকে। “This just got personal.”

সে সিন্দুকের সামনে বসল। তালা ভাঙা নেই—দুইটা রোলিং নক বোতাম। চার অক্ষরের একটা কোড চাই।

“Try… VOGEL?” ক্লারা বলল।

অনিরুদ্ধ ঘুরিয়ে সেট করল—V O G E L। টিক… ক্লিক—তালা খুলে গেল।

ভিতরে ছোট একটা কাঠের বাক্স, যার উপরে খোদাই করে লেখা ‘KROKODIL’। ভেতরে সিল করা এক খাম, তার পাশে একটা রিভলভার, আর একটা হস্তলিখিত চিঠি।

অনিরুদ্ধ ধীরে ধীরে চিঠিটা খুলল—

“Dear descendant, if you are reading this, know that our family’s hands were not clean. I harbored a man wanted for crimes against humanity. I took gold. I bought silence. But guilt never left me. This box contains coordinates to a bunker, where secrets lie deeper than bones.”

চিঠির নিচে এক ম্যাপ—ভূমধ্যসাগরের আশেপাশে, কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো দেশ নয়। শুধু একটা নাম চিহ্নিত করা—”Mitte der Schatten” (ছায়ার কেন্দ্র)।

“German again,” ক্লারা বলল। “Any idea where?”

অনিরুদ্ধ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “No. But someone might.”

ঠিক তখনই বাইরে গাড়ির শব্দ।

ক্লারা দৃষ্টি টানল জানালার ফাঁক দিয়ে। “Black SUV. Three men. Not friendly.”

“BND?” অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করল।

“Could be. Or worse.”

দুজনেই তাড়াতাড়ি চিঠি, ম্যাপ, রিভলভার ব্যাগে গুঁজে দরজার অন্য পাশে ছুটল। ভিতরের ছোট একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাগানের পেছনে এল। দেয়াল টপকে যখন রাস্তায় নামল, তখন রাত পুরোপুরি নামছে।

একটা অটো ঠিক তখনই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। দুজন ঝাঁপিয়ে উঠল।

“Where to?” ড্রাইভার চমকে গেল।

“Anywhere but here!” অনিরুদ্ধ বলল।

এক ঘণ্টা পর, তারা হাজির হল Kolkata German Cultural Institute-এর সামনে। ভিতরে একজন বৃদ্ধ, ধবধবে চুলের ভদ্রলোক চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে।

“Dr. Friedrich Gans,” অনিরুদ্ধ বলল, “He was a friend of my grandfather. A linguist.”

তারা ভিতরে ঢুকতেই ড. গ্যান্স অবাক হয়ে বললেন, “Aniruddho? My God, you look like your dada.”

ক্লারা এগিয়ে গিয়ে বলল, “We need help. Translation. Location.”

ম্যাপটা খুলে দেওয়া হল। গ্যান্স চোখে চশমা পরে দেখলেন। তারপর বললেন—

“‘Mitte der Schatten’ is not a place listed on any map. But it’s a codename used during the Nazi retreat. It refers to a site in North Africa. A bunker near Libya-Algeria border.”

“Desert?” ক্লারা চোখ কুঁচকাল।

“More like hell,” গ্যান্স হালকা হেসে বললেন।

“Then that’s where we go next,” অনিরুদ্ধ দৃঢ় গলায় বলল।

ক্লারা একটুও হেসে না বলে, “And this time, we go armed.”

 

রেখাচিত্র মরুভূমির

লিবিয়ার সীমান্তে সন্ধ্যা নামতে নামতেই অনিরুদ্ধ আর ক্লারা দাঁড়িয়ে রইল এক বিস্তীর্ণ ধূসর মরুভূমির সামনে। মাথার উপর রক্তবর্ণ সূর্যটা যেন ধীরে ধীরে মাটির দিকে গলে যাচ্ছে। গরম বাতাস হালকা ধুলো তুলে নিয়ে এল—চোখে, চুলে, ব্যাগের ভেতর।

“Coordinates say it should be here,” ক্লারা বলল, জিপিএস স্ক্রিনে তাকিয়ে।
অনিরুদ্ধ কপালের ঘাম মুছল। “All I see is sand.”

“History hides itself well,” ক্লারা কাঁধের ব্যাগে হাত রাখল। “Or someone buried it.”

তারা সামনে এগোতে লাগল—বালুর নিচে পাথর, মাঝে মাঝে কংক্রিটের চিহ্ন, ধ্বংসপ্রাপ্ত পুরনো কাঠের গুঁড়ি। হঠাৎ অনিরুদ্ধ একটা উঁচু ঢিবির কাছে এসে থেমে গেল।

“Look,” সে ইশারা করল।

ঢিবির গায়ে আধভাঙা এক চ্যাপ্টা ধাতব দরজা। তার চারপাশে বালুয়াঘাস গজিয়েছে। ক্লারা এগিয়ে গিয়ে ঘষে ঘষে ধুলো মুছে ফেলল—উপরে ছোট ছোট অক্ষরে খোদাই করা একটা নাম:
“Schattentor” — ছায়ার ফটক।

“Bingo,” ক্লারা বলল।
“Or Pandora’s box,” অনিরুদ্ধ ফিসফিস করল।

তারা দরজার লিভার একসাথে চাপ দিল। প্রথমে কিছুই হয়নি। তারপর ঘড় ঘড় করে দরজাটা নিচের দিকে নেমে গেল। একটা ধাতব সিঁড়ি নামছে অন্ধকারে, যেন পৃথিবীর বুকে এক জাহান্নামের পথ।

ভেতরে পা রাখতেই একটা ঘামে ভেজা, লৌহ-গন্ধময় বাতাস এসে লাগল। পেছনে দরজা ধীরে ধীরে আবার বন্ধ হয়ে গেল। ক্লারা টর্চ জ্বালাল। সামনে পাথরের করিডোর, দেয়ালের এক পাশে ঝুলছে আধাভাঙা পোস্টার—“Sieg oder Tod!” (জয় না হলে মৃত্যু!)

“Charming,” ক্লারা বলল।

তারা ধীরে ধীরে এগোল। কয়েকটা ঘর—পুরনো ডেস্ক, টাইপ মেশিন, নথিপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে। দেয়ালে হিটলারের ছবি, তার পাশে জোসেফ গোয়েবলসের কোট পরা একটা ম্যানিকিন, যার মাথা নেই।

একটা ঘরে তারা পেল ধাতব লকার—উপরে লেখা: “Nur für Stufe-7 Zugang” (মাত্র স্তর-৭ প্রবেশাধিকার পাবে)। তালা নেই, শুধু এক ধরনের স্ক্যানার।

“Retina scanner,” ক্লারা বলল। “Old tech, but smart.”

“Then how do we open it?”

হঠাৎ ক্লারা ব্যাগ থেকে এক ছোট ডিভাইস বের করল। “Courtesy of French Intelligence.” সে যন্ত্রটা স্ক্যানারে বসাল। কাঁপতে কাঁপতে দরজাটা খুলে গেল।

ভিতরে তিনটে প্যাকেট—ঢেকে রাখা কালো কভারে, যার গায়ে আবার সেই ড্রাগন চিহ্ন। আর একটি ছোট চিপ বোর্ড, যার নিচে লেখা—“KROKODIL V.3 — Draft Protocols”

অনিরুদ্ধ ধীরে ধীরে প্রথম ফাইলটা খুলল।

ভেতরে এক পাতার হ্যান্ডরিটেন কপি—

“In the event of a Third Reich’s fall, a long-term infiltration shall begin across Asia and Africa. Agents shall assume local identities, infiltrate universities, press, and political systems. Phase V shall include digital warfare under a false nation’s name.”

ক্লারা চুপ। “They planned for defeat… and waited seventy years to re-emerge.”

“India, Africa… that means…?”

“They’re already among us,” অনিরুদ্ধ বলল।

ঠিক তখনই বাইরে সিঁড়ির দিক থেকে শব্দ—লোহার জুতো, জোরে হাঁটার আওয়াজ।

দুজনেই আলো নিভিয়ে এক কোণে সরে গেল।

তিনজন অস্ত্রধারী ভিতরে ঢুকল। একজনের গলায় রেডিও। সে বলল, “Das Ziel ist unten. Ergreifen Sie die Dokumente.”
(টার্গেট নিচে আছে। নথিগুলো দখল করো।)

“Plan?” অনিরুদ্ধ ফিসফিস করে।

“Split. Take chip. Meet back at base,” ক্লারা বলল।

ক্লারা পেছনের এক গোপন করিডোর ধরে পালাল। অনিরুদ্ধ পেছনে দৌড়াল ফাইল গুঁজে।

একজন অস্ত্রধারী তাকে দেখে ফায়ার করল—বুলেট পাথরের দেয়ালে লেগে প্রতিধ্বনি তুলল। অনিরুদ্ধ সিঁড়ির নিচে লাফ দিয়ে পড়ল, হালকা আঘাতে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলেও উঠে দৌড় দিল।

অবশেষে সে পৌঁছোল এক অন্ধকার ভেন্টের মুখে। বাইরের দিকে এক ঢালু গুহা। বালুর স্তর ফুঁড়ে উঠে পড়ল মরুভূমিতে।

পেছনে ক্লারা ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছে। রক্তে কেটে গেছে হাত।

“Got it?” অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করল।

“Got it. But we’re marked now,” ক্লারা বলল।

পেছনে মরুভূমির বুক ফুঁড়ে সেই দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে গেল। ইতিহাস আবার মাটির নিচে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল।

প্রতিটি নোটে এক যুদ্ধ

বার্লিনের আকাশ ছিল ধূসর, জার্মান গ্রীষ্মের সেই অপূর্ণ রোদ যেখানে আলো ঠিকঠাক পৌঁছায় না। একটি কালো ট্যাক্সি টেম্পেলহোফের কাছে থামল। ভিতর থেকে ক্লারা বেরিয়ে এলো, ব্যাগে সেই চিপ আর হাতে ধুলো লাগা কোডেড ফাইল। অনিরুদ্ধ পেছন থেকে বেরিয়ে এল, চোখেমুখে ক্লান্তি, কিন্তু দৃঢ়তা স্পষ্ট।

“Berlin again,” ক্লারা বলল, একটুখানি তিক্ত হেসে। “Where everything began. And maybe… where it ends.”

“Or restarts,” অনিরুদ্ধ বলল। “If we fail.”

তাদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল এক পুরনো ভবন—Hochschule für Musik und Geheimnis, জার্মান এক সংগীত একাডেমি, যার গোপন অংশটা কেবল নির্দিষ্ট অনুমতি ছাড়া প্রবেশযোগ্য। ক্লারার ফরাসি সংযোগ এই জায়গার একটি গোপন চেম্বারে ঢোকার পারমিশন জোগাড় করেছে।

“According to Debashish Basu’s last audio note, the final KROKODIL protocol was encrypted in a musical piece,” ক্লারা বলল। “A symphony that was never performed in public.”

“Musical code? Sounds too Da Vinci Code,” অনিরুদ্ধ বলল।

“History loves repetition,” ক্লারা বলল। “And style.”

ভবনের নিচতলার এক নির্জন ঘরে ঢুকল তারা। পুরোনো গ্র্যান্ড পিয়ানো, পেছনে বইয়ের তাক, দেয়ালে হিটলারের আমলের নোটেশনের প্রিন্ট।

ঘরের মাঝখানে একটি কেসে রাখা পাণ্ডুলিপি—নোটে লেখা:

Symphony No. 0 – Schattenklang (Sound of Shadows)
Composed by: Elias Vogel, 1944
First performed: Never

“Vogel again,” অনিরুদ্ধ ফিসফিস করল।

“Erich Vogel—SS officer, composer, cryptographer,” ক্লারা বলল। “He encoded the final phase of KROKODIL in a musical score.”

তারা কেস খুলে স্কোর বের করল। পাঁচ লাইনের তালে সাজানো সুর, কোথাও কোথাও অসম নোট, কিছু জায়গায় হঠাৎ ছেদ। অনিরুদ্ধ প্রশ্ন করল, “How do we decode this?”

ক্লারা বলল, “Every note represents a number. Every pause is a space. Combine them—we might get a message.”

অনিরুদ্ধ চশমা পরে একটা কাগজে লিখতে শুরু করল। “C – 3, A – 1, pause… H – 8…”

দশ মিনিট পর, একটা লাইনে দাঁড়িয়ে গেল তারা।

“Phase VI begins on November 9, 2025. Media will carry the message. Look for the violinist.”

ক্লারা চোখ বড় করল। “That’s four months from now.”

“Who’s the violinist?” অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করল।

ঠিক তখনই পেছনের দরজা ঠেলে এক ছায়ামূর্তি ঘরে ঢুকল। তার কাঁধে একটা বেগুনি ফিডেল কেস।

“Looking for me?” সেই গলাটা ঠান্ডা, নিঃশব্দ আগ্নেয়গিরির মতো।

দুজনই চমকে উঠল।

“Who are you?” ক্লারা বলল, পেছনে ধীরে ধীরে হাত রাখল তার পকেটে থাকা রিভলভারে।

“Name’s irrelevant. But you can call me… Vogel’s echo,” সে হেসে বলল।

“Are you one of them?”

“Define them. Patriot? Historian? Or a relic of revenge?”

লোকটা পিয়ানোর পাশে এসে দাঁড়াল। তারপর ধীরে ধীরে তার ফিডেলটা বের করল। “Shall I play?”

“Don’t move!” ক্লারা বন্দুক বের করে বলল।

“Too late,” লোকটা হেসে ফিডেল বাজাতে শুরু করল।

তিন সেকেন্ডের মধ্যে চারটা লাল এলইডি আলো জ্বলে উঠল ঘরের চারপাশে।

“Trap,” অনিরুদ্ধ ফিসফিস করল।

লোকটা বলল, “This performance triggers a signal. Copies of KROKODIL V.3 will be uploaded if I complete the piece.”

“Shut it down!” ক্লারা বন্দুক তাক করেই হাঁটুতে গুলি করল লোকটাকে।

সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। ফিডেল নিচে পড়ে গেল, তার তার ছিঁড়ে গিয়েছে।

অনিরুদ্ধ দৌড়ে গিয়ে দেয়ালের পাশে থাকা কন্ট্রোল প্যানেলে ছুটে গেল। স্ক্রিনে টাইপ করা—

Uploading: 26%
Password Required: ____

“Guess the code!” ক্লারা চেঁচিয়ে উঠল।

“Try… VOGEL?” অনিরুদ্ধ টাইপ করল। Invalid।

“Try… BASU?” Invalid।

“Try… KROKODIL?” Invalid।

লোকটা নিচে পড়ে হেসে বলল, “You’ll never find it. It’s not a word. It’s a note. A sound.”

“Wait,” অনিরুদ্ধ বলল। “The symphony—remember? Note E, then B, then C…”

ক্লারা বলল, “Musical notes as letters: E–B–C–A–D.”

“EBCAD?” অনিরুদ্ধ টাইপ করল।

Access Granted.

স্ক্রিনে লেখা এল—

Abort Upload?
[YES] [NO]

অনিরুদ্ধ YES চাপল।

স্ক্রিনে দেখা গেল—

Upload Aborted. Terminal Locked.

তারা দুজন একসাথে নিঃশ্বাস ছাড়ল।

লোকটা নিচে পড়ে ধীরে বলল, “You may have stopped the upload. But the real virus… is already in your cities.”

ক্লারা চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “Then we’ll hunt every echo.”

ছায়ার শেষ প্রহর

বার্লিনের আকাশটা আরও ধূসর হয়ে এসেছে, যেন যুদ্ধের পূর্বাভাস। ক্লারা ও অনিরুদ্ধ হাঁটছিল সেই পুরনো ‘গ্যাস্টেনক্রুগ রিং’-এর দিকে, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোপন রেডিও রেকর্ডিং চেম্বার তৈরি করা হয়েছিল। জায়গাটা এখন বন্ধ, জরাজীর্ণ, কিন্তু একটা চিঠির সূত্রে জানা গেছে, এখানেই Vogel এবং Debashish Basu শেষবার দেখা করেছিলেন।

চিঠিটা পেয়েছিল ক্লারা এক ফরাসি আর্কাইভ থেকে—লাল কালি দিয়ে লেখা শেষ লাইনটা এখনও অনিরুদ্ধের মনে গেঁথে আছে:

“He was not just a translator. He was a mirror. And the mirror cracked.”

“Who do you think it refers to?” ক্লারা জিজ্ঞেস করল, চোখে সেই পরিচিত তীক্ষ্ণতা।

অনিরুদ্ধ একটু থেমে বলল, “I think it refers to Basu. But also someone else.”

“Who?”

“Maybe… someone who never left Germany.”

দুজনেই পুরনো ধাতব দরজার সামনে পৌঁছোল। ক্লারা তার বিশেষ অনুমতিপত্র দেখিয়ে লোহার গেট খুলে দিল। ভিতরে অন্ধকার, পেছনে কুয়াশার মত স্মৃতি। নিচে নামার সময় পায়ে ঘষা ধাতব সিঁড়ির শব্দে যেন পুরনো প্রেতাত্মারা কাঁপছে।

ভিতরে ঢুকেই তারা শুনতে পেল একটা অস্পষ্ট রেকর্ডিং বাজছে। পুরোনো টেপ রিল থেকে ভেসে আসছে সেই কণ্ঠস্বর—উচ্চারণে বাঙালি টান, কিন্তু কণ্ঠস্বর কাঠের মতো শুষ্ক।

“…they wanted us to forget. But I wrote it down. Every name. Every face. Even the Indian who betrayed his own.”

অনিরুদ্ধ থেমে গেল। ক্লারা তাকিয়ে রইল।

“Play that again,” অনিরুদ্ধ বলল।

ক্লারা টেপটা রিওয়াইন্ড করল। আবার চলল সেই কণ্ঠ:

“…Even the Indian who betrayed his own…”

“That’s not Debashish,” অনিরুদ্ধ বলল।

“Then who?”

তারা রেকর্ডিং রুমের পাশে একটা সাইড চেম্বারে ঢুকল। সেখানে একপাশে ধুলো ঢাকা কাঠের কেস। খোলার সঙ্গে সঙ্গে তারা পেল কিছু ছবি—পুরোনো নাৎসি কনফারেন্সের। সব ছবিতে মুখ অচেনা, একমাত্র একটি বাদে।

সাদা-কালো ছবির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন এক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ—কালো কোট, মুখে বুদ্ধিদীপ্ত এক অভিব্যক্তি। তার নিচে জার্মানে লেখা:

“Raja Chattopadhyay – Übersetzer und Freund.”
(রাজা চট্টোপাধ্যায় – অনুবাদক ও বন্ধু।)

“Chattopadhyay?” ক্লারা বিস্ময়ে বলল।

“That’s my great-uncle,” অনিরুদ্ধ ধীরে বলল।

“Then that’s the real traitor?”

অনিরুদ্ধ চুপচাপ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকল। বুকের ভিতরে যেন কেউ একটা হিমখণ্ড রেখে দিয়েছে।

“All this time, I thought Debashish was the key. But it was my family.”

ক্লারা বলল, “Then it’s poetic justice that you’re ending what they began.”

ঠিক তখনই দরজার ওপাশে পায়ের শব্দ।

দুজনেই পেছনে তাকাল।

একজন লোক এসে দাঁড়িয়েছে। বয়স ৫০-এর আশেপাশে। চোখে সরু ফ্রেমের চশমা, মুখে অনিরুদ্ধের মতো কাঠামো।

“Mr. Dutta,” লোকটা বলল। “Or should I say, Mr. Chattopadhyay?”

“Who are you?”

“Rohit Chattopadhyay. Your father’s cousin. I’ve been waiting for you.”

“Here? Why?”

“Because the last phase of KROKODIL needed family. Bloodline. You were the loose end.”

ক্লারা বন্দুক বের করল। “You’re involved?”

Rohit হাসল। “I’m the fail-safe. In case everything else failed, the line had to return home.”

“You mean… me?”

“Yes. But you resisted. So now we erase you.”

সে পকেট থেকে একটা ছোটো রিমোট বের করল।

অনিরুদ্ধ সাথে সাথে তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল, দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল। ক্লারা বন্দুক উঠিয়ে লক্ষ্য করল, কিন্তু রোহিত আর অনিরুদ্ধের মাঝে তফাৎ নেই।

“Don’t shoot!” অনিরুদ্ধ চিৎকার করল।

এক ঘুষিতে রোহিত পিছিয়ে গিয়ে রিমোট ফেলে দিল।

ক্লারা দৌড়ে এসে সেটা তুলে নিয়ে সুইচ বন্ধ করে দিল। তারপর বন্দুকের বাট দিয়ে রোহিতের কপালে বাড়ি মেরে তাকে অজ্ঞান করে ফেলল।

অনিরুদ্ধ হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে বসে পড়ল।

“That was… family,” সে ফিসফিস করে বলল।

“And that,” ক্লারা বলল, “was your closure.”

তারা কেস থেকে শেষ কাগজগুলো তুলে নিল। সেখানে একটা নাম তালিকা ছিল—তাদের মধ্যে কিছু আজকের দিনে বড় কর্পোরেট ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।

“These names,” অনিরুদ্ধ বলল, “could burn governments.”

“Then we publish,” ক্লারা বলল।

“Or donate to the right hands.”

মৃত সিংহের গর্জন

ভোরবেলা। জেনেভা।

অনিরুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে ল্যাকে লেমানে (Lake Geneva) জলের ধারে, চোখে চশমা, গলায় একটি বাদামী স্কার্ফ। তার কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগ, অথচ ক্যামেরা নেই—ভেতরে রয়েছে KROKODIL-এর শেষ ফাইল, সেই তালিকা যা বদলে দিতে পারে আধুনিক ইতিহাসের অভ্যন্তরীণ কাঠামো।

ক্লারা একটু দূরে দাঁড়িয়ে। কফি হাতে, চোখে ক্লান্তি।

“Today’s the day,” সে বলল।
“Or the end,” অনিরুদ্ধ হেসে বলল।

আজকের দিনেই তারা International Democratic Tribunal for Historical Justice নামের এক বিশেষ প্ল্যাটফর্মে এই ডকুমেন্ট জমা দেবে—যেখানে ১৯৪৫ থেকে শুরু করে ২০২5 অবধি চালু থাকা সব অপরাধের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রকাশ করা হবে।

কিন্তু ঠিক এমন সময়, ক্লারার ফোনে একটি মেসেজ এলো। অজানা নম্বর। শুধু একটি বাক্য—
“The Lion still breathes.”

ক্লারা থমকে গেল।
“Who’s the Lion?” অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করল।

ক্লারা বলল, “That was the codename of the original head of KROKODIL. Thought dead since 1987. A man named Dietrich Roth.”

অনিরুদ্ধ চমকে উঠল। “He was declared missing near the Swiss border.”

“Exactly where we are now,” ক্লারা ফিসফিস করল।

দু’ঘণ্টা পর, ট্রাইব্যুনালের ভবনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে দুজন। নিরাপত্তা কড়া—সুইস পুলিশ, UN observer, ইন্টারপোল প্রতিনিধি সবাই হাজির। মিডিয়ার ফ্ল্যাশ ঝলকাচ্ছে চারপাশে।

হঠাৎ একজন নিরাপত্তাকর্মী এগিয়ে এল।

“Ms. Clara Stein and Mr. Dutt?”

“Yes,” ক্লারা বলল।

“Please come with me. Urgent change in schedule. Panel meeting moved to Block C.”

তারা দুজন সন্দেহ না করেই ভিতরে ঢুকে গেল। সাদা করিডোর, শান্ত বাতাস। কিন্তু ক্লারার পায়ের নিচে চটচটে আওয়াজ।

“Something’s off,” সে ফিসফিস করে বলল।

ঠিক তখনই করিডোরের শেষ দরজা খুলে গেল। ভেতরে অন্ধকার ঘর। আর একটি চেয়ার ঘোরানো অবস্থায়।

তারপর সেই কণ্ঠস্বর—
“Welcome to the end of your journey.”

চেয়ার ঘুরে দেখা গেল—এক বৃদ্ধ, মাথাভর্তি সাদা চুল, তীক্ষ্ণ নাক, চোখে শীতলতা।
Dietrich Roth।

“Impossible,” ক্লারা ফিসফিস করল।

“Dead men often walk,” রথ হেসে বলল। “And when history forgets them, they rise again.”

অনিরুদ্ধ এগিয়ে বলল, “You orchestrated a global infiltration, and hid like a coward?”

“I preserved ideas,” রথ বলল। “Empires collapse, but ideas migrate.”

“Your ideas murdered millions,” ক্লারা বলল।

রথ ধীরে চেয়ার থেকে উঠল। “And your democracy killed cultures, flattened differences, and built data empires. Tell me which is worse.”

“Your KROKODIL ends today,” অনিরুদ্ধ বলল।

রথ তখনই পকেট থেকে ছোটো একটি রিমোট বের করল।
“I press this—every file on that chip uploads globally.”

“Then press it,” অনিরুদ্ধ চ্যালেঞ্জ করল। “Let the world see what monsters you fed.”

রথ থমকে গেল।

“Even monsters love control,” ক্লারা বলল, বন্দুক বের করে।

“Shoot me, and you’ll never find the sixth node,” রথ বলল।

“Sixth?” অনিরুদ্ধ কেঁপে উঠল। “There’s another phase?”

“Yes,” রথ হাসল। “This tribunal… is the rehearsal. The real symphony begins in your digital shadows.”

ঠিক তখন ক্লারা গুলি করল—রথের হাত থেকে রিমোট ছিটকে গিয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। কিন্তু রথ পড়ে গেল না। সে ধীরে দাঁড়িয়ে বলল—

“You think that stopped me? My echo is everywhere. I am the algorithm. The click. The comment. The belief.”

অনিরুদ্ধ তখন রিমোট তুলে নিয়ে চেপে ধরল ‘override’ অপশন।

“Then this is the last click,” সে বলল।

এক লাল আলো জ্বলে উঠল। স্ক্রিনে লেখা এলো—
“All access permanently disabled. Central node destroyed.”

রথ হেসে উঠল। তারপর ধপ করে চেয়ারেই বসে পড়ল।

“Then let history remember me,” সে বলল। —“Not as a man. But a mirror.”

বাইরে বেরিয়ে এসে ক্লারা ও অনিরুদ্ধ বসল ভবনের সিঁড়িতে। চারপাশে সাংবাদিক, ক্যামেরা, চিৎকার।

“Do we still submit the files?” ক্লারা জিজ্ঞেস করল।

“Yes,” অনিরুদ্ধ বলল। “Not to expose. But to remember.”

“History doesn’t heal. It haunts,” ক্লারা বলল।

“Then let’s be its voice,” অনিরুদ্ধ চোখ বন্ধ করে বলল।

নীরবতার আর্তনাদ

কলকাতা, একমাস পরে।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পেছনে একটা মিডিয়া কনফারেন্স। প্রচুর সাংবাদিক, ক্যামেরার ঝলকানি, রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে গলদঘর্ম অফিসাররা টেবিলের সামনে ঠোঁট চেপে বসে আছেন। শহরের প্রাণের মাঝে যেন ইতিহাস হঠাৎ বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে।

অনিরুদ্ধ একটা ধূসর কোট পরে স্টেজে উঠল। পাশে ক্লারা, চোখেমুখে সেই পুরোনো ক্লান্তি, কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে স্পষ্ট অটল বিশ্বাস।

মাইকে দাঁড়িয়ে অনিরুদ্ধ বলল—
“আমার নাম অনিরুদ্ধ দাশগুপ্ত। আমি একজন ইতিহাস গবেষক। কিন্তু আজ আমি একজন সাক্ষী। এমন এক ইতিহাসের সাক্ষী, যা আজও লিখে যাচ্ছে নিজেদের ভবিষ্যৎ।”

পেছনের স্ক্রিনে ফুটে উঠল সেই চিহ্ন—KROKODIL। এবং তারপর একে একে ভেসে উঠল সেই ফাইলের অংশ: নাম, তারিখ, ছবি—হাজারো চিহ্ন, যা আজকের দুনিয়ার কিছু অন্ধকার কোণ উন্মোচন করে।

“এই ফাইল আমাদের বলে দেয়, ইতিহাস কখনো পুরোপুরি শেষ হয় না। কিছু গল্প বেঁচে থাকে কোডের আড়ালে, রাজনীতির হাসির ফাঁকে, এবং আমাদের নীরবতায়।”

ক্লারা তখন পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “You may choose not to believe what we found. But you cannot unknow it now. This… is the echo of forgotten screams.”

প্রথম সারিতে একজন বৃদ্ধ উঠলেন। চোখে জল। হাত তুলে বললেন—
“আমি প্যারিসে এক ইহুদি ক্যাম্পে বড় হয়েছি। আমি জানি তারা মরেনি। তারা বদলে গেছে। মুখ পাল্টেছে। ধ্বনি পাল্টেছে। কিন্তু চোখ… চোখ ঠিক ছিল। আপনাদের ধন্যবাদ।”

হঠাৎ করেই বাইরে এক শব্দ। প্রথমে মনে হয় ড্রাম বাজছে। তারপর তা স্পষ্ট হয়—একটা বিস্ফোরণ। অনেক দূরে নয়, প্রেসক্লাবের সামনে।

চিৎকার, হৈচৈ, মানুষ ছুটে পালাচ্ছে। পুলিশের সাইরেন।
অনিরুদ্ধ আর ক্লারা একে অপরের দিকে তাকায়।

কেউ চায় না এই তথ্য বেরিয়ে আসুক। আর তারা থামতে চায় না।

“Phase VI,” অনিরুদ্ধ ফিসফিস করে বলল। “It’s begun.”

ঘণ্টা তিনেক পরে, এক সংবাদ চ্যানেল রাতে বিশেষ সম্প্রচার চালাচ্ছে—
“কী ছিল KROKODIL?”
পর্দায় ভেসে আসছে ক্লারা আর অনিরুদ্ধের ছবি, সাথে সেই চিপের প্রমাণ, নাম, নথি।

পাশের টিভি স্টুডিওতে কেউ একজন ফোনে বলছে—
“Kill the story. Or kill the storyteller.”

সেই রাতে অনিরুদ্ধ বসে আছে তার পুরোনো দাদুর ঘরে। সেই চেয়ারে, যেখানে বসে একদিন Debashish Basu চিঠি লিখেছিলেন।

বাইরে হালকা বৃষ্টি। জানালার পাশে বসে ক্লারা চুপ করে বলল, “What now?”

“Now we live. Loudly. Honestly. Dangerously, maybe,” অনিরুদ্ধ বলল।

“Will they come for us?”

“Yes,” সে হাসল। “But now we’re not alone.”

দেয়ালের পাশে টাঙানো একটা পুরোনো ম্যাপের পেছনে অনিরুদ্ধ হাত রাখল। ধীরে ধীরে সেই খোলা পৃষ্ঠার নিচে সে আঁকতে লাগল একটি চিহ্ন—একটি ড্রাগনের শরীরে সাপের মুখ।

আর নিচে লিখল তিনটি শব্দ—
“Truth Never Sleeps.”

প্রতিশোধের খাতা

কলকাতার নিমগাছঘেরা সেই পুরোনো বাগানবাড়ি, যেখানে একসময় অনিরুদ্ধের দাদু দেশভাগের কাহিনি লিখতেন, এখন সেই বাড়িতেই চলছে এক আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ব্রিফিং। বাড়ির ভেতরের ঘরটাকে অস্থায়ী ওয়ার রুমে বদলে দিয়েছে ইন্টারপোল এবং ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা।

চিপ আর ফাইল জমা দেওয়ার পর, অনিরুদ্ধ আর ক্লারা এখন দুজনেই সেফহাউসে। রাস্তায় বেরনো বারণ। কিন্তু তাদের কাছে পৌঁছে গেছে এক নাম—এক মুখ, যাকে আজও ধরা যায়নি।

রোহিত চট্টোপাধ্যায়।

অজ্ঞান করার পরে রোহিত হঠাৎই নিখোঁজ। হেলিকপ্টারে করে জেনেভা থেকে পালিয়ে গেছে এক অজ্ঞাত সংস্থার সাহায্যে।

“Someone from the inside helped him,” ক্লারা গম্ভীর মুখে বলল।
“He always had someone from the inside,” অনিরুদ্ধ উত্তর দিল।

ড. গ্যান্স, সেই বার্লিনের পুরোনো ভাষাতত্ত্ববিদ, তখন ল্যাপটপ খুলে একটা এনক্রিপ্টেড নথি দেখাচ্ছিল।
“This… this is from the 1977 Geneva protocol leak,” তিনি বললেন। “It shows a funding trail. From a pharmaceutical company in Switzerland… directly to someone named ‘RC Foundation’ in Kolkata.”

“RC—Rohit Chattopadhyay?” ক্লারা জিজ্ঞেস করল।

গ্যান্স মাথা নাড়ল। “Yes. He has deep roots. And dangerous friends.”

রাতে, অনিরুদ্ধ চুপচাপ বসে ছিল দাদুর ডেস্কে। কাঠের নিচে একটা পুরোনো খাতা পাওয়া গিয়েছিল। নাম লেখা ছিল—”দুঃস্বপ্নের দলিল”।

খুলতেই প্রথম পাতায় ডেবাশীষ বসুর লেখা—
“আমি জানতাম, শেষ কথা আমি বলতে পারব না। কিন্তু শুরু করার দায়টা আমার। ভবিষ্যৎ তোমার।”

খাতার শেষ পাতায় আঁকা ছিল একটা ছায়া-মানচিত্র। ভারতের পূর্বদিক থেকে শুরু করে আফ্রিকা পর্যন্ত একটা রেখা টানা—পিছনে ছোট হস্তাক্ষরে লেখা:

“শেষ ঠিকানাটা আগুনের কাছে। পাহাড়ের গা ঘেঁষে।”

“Pahader ga gheshe… near the fire,” অনিরুদ্ধ চুপচাপ বলল।

“Could it be a volcano?” ক্লারা পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল।

“Or… could it mean Darjeeling?” অনিরুদ্ধ বলল।

পরদিন তারা চুপিচুপি রওনা দিল দার্জিলিংয়ের দিকে। ক্লারা ছদ্মবেশে, অনিরুদ্ধ একটি মোটা স্যুটকেস হাতে।

গন্তব্য—টেনজিং নরগে রোডের এক পুরোনো কাঠের বাংলো, যেটি ১৯৩৯-এ এক জার্মান দল ব্যবহার করেছিল হিমালয় অভিযানের জন্য।

স্থানীয়রা বলে, ওই বাড়ি রাতে আলো জ্বলে, অথচ সেখানে কেউ থাকে না।

রাতের পাহাড়ে হাওয়া ঠান্ডা আর কুয়াশায় ভরা। দুজন যখন বাংলোর সামনে পৌঁছায়, তখন পাহাড় নীরব। দরজাটা আধখোলা। ভিতরে একটা হারমোনিয়ামের আওয়াজ আসছে।

অনিরুদ্ধ চুপচাপ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।

ঘরে একটা কেরোসিন ল্যাম্প জ্বলছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে একজন—ঘাড়ে চাদর, মুখ অর্ধেক দেখা যায়। টেবিলের ওপর ছড়ানো বেশ কয়েকটি ফাইল, আর সামনে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা।

“Finally,” লোকটা বলল। “I was waiting.”

“Rohit Chattopadhyay,” ক্লারা বন্দুক বের করে বলল। “Game over.”

রোহিত হেসে ফেলল। “Game never ends. It just changes rules.”

“Why did you do this?” অনিরুদ্ধ চিৎকার করল।

“Because our family was erased from the pages. Debashish got the glory. You got the inheritance. And I got the shadows.”

“Debashish exposed a genocide!”

“And I tried to build an empire.”

“On blood?” ক্লারা বলল।

“On order,” রোহিত বলল। “The world is chaos. We just offered structure.”

ক্লারা ট্রিগার টানতে যাচ্ছে, কিন্তু অনিরুদ্ধ হাত দিয়ে আটকে দিল।
“No,” সে বলল। “Let him burn with his truth.”

অনিরুদ্ধ ব্যাগ খুলে সেই শেষ চিপটা বের করল—সেখানে রোহিতের পুরো নেটওয়ার্কের ব্লুপ্রিন্ট।

সে চিপটা তুলে রোহিতের সামনে রাখল।

“Recognize this?” অনিরুদ্ধ বলল।

রোহিত একবার দেখল। চোখে আশ্চর্য মিশে থাকা আতঙ্ক। তারপর হাসল।

“You wouldn’t dare.”

“Try me.”

অনিরুদ্ধ চিপটা কেরোসিন ল্যাম্পে ছুঁড়ে মারল। একটা ছোট বিস্ফোরণ, সঙ্গে সঙ্গে আগুন লেগে গেল কাগজের গাদায়।

রোহিত চিৎকার করল, “No!”

“Your story ends in the same fire that forged it,” অনিরুদ্ধ বলল।

ঘরটা জ্বলতে লাগল। ক্লারা ও অনিরুদ্ধ পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল।

পেছনে, রোহিতের গলা শোনা যাচ্ছিল—
“History will return. Always. Through someone else…

পাহাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে দুজন চুপচাপ নিচের শহরের দিকে তাকাল।

“Did we just kill history?” ক্লারা বলল।

“No,” অনিরুদ্ধ বলল। “We just made it ours.”

শেষ ছায়ার দিন

কলকাতায় ফিরেছে অনিরুদ্ধ। শহরটা যেমন ছিল, তেমনই আছে—বিকেলের রোদে ট্রাম চলেছে ধীরে, ফুটপাথে বাদামভাজা আর চায়ের দোকানে গল্প। তবু তার ভেতরের মানুষটা আর আগের মতো নেই। ছায়ার ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে আজ আলোতে ফিরেছে, হাতে আগুনের দাগ, চোখে ক্লান্তি আর হৃদয়ে ইতিহাস।

বেহালার সেই পুরোনো বাড়ির এক ঘরে সে দাঁড়িয়ে। দেয়ালের ধুলো ঢাকা তাক ঘেঁটে বার করেছে একটা কফি-রঙা বাক্স। বাক্সের উপর লেখা—“Unopened – For the end.”

চাবি নেই। কিন্তু বাক্সটা যেন অনিরুদ্ধকে চিনে রেখেছিল। সে আস্তে করে ঢাকনা তুলল।

ভিতরে পুরোনো লেখা, ছেঁড়া ডায়েরির পাতা, আর একটা চিঠি—ডেবাশীষ বসুর হাতে লেখা।

“অনিরুদ্ধ,
যদি তুমি এটা পড়ছো, তাহলে হয়ত ছায়া তোমার পাশ কাটিয়ে গেছে। হয়ত তুমি শেষ মানুষ, যাকে আমি ভরসা করতে পারি। আমি জানি, কেউ কেউ ইতিহাস লেখে রাজনীতির কলমে। কিন্তু কিছু মানুষ ইতিহাস লেখে হৃদয়ের রক্তে।

তুমি হয়ত ভাবছো, আমি শুধু একজন অনুবাদক ছিলাম। কিন্তু আসলে আমি ছিলাম এক নীরব সৈনিক। আমি শুধু প্রতিরোধ করিনি—আমি রেকর্ড করেছি। প্রত্যেকটা মিথ্যার নিচে আমি সত্যি লিখে গেছি।

এই বাক্সে যা আছে, তা KROKODIL-এর বাইরের ইতিহাস। যারা রুখেছিল। যারা কিছুই না হয়েও দেয়াল বাঁচিয়েছিল, জার্নাল ছাপিয়েছিল, আর চুপিচুপি বেঁচে থেকেছে।

তারা আমার মতোই—’অপরিচিত সাক্ষী’।

এবার তাদের কাহিনি তোমার হাতে। এখন সময় হয়েছে… সত্যের এক নতুন দলিল লেখার।

— তোমার দাদু”

অনিরুদ্ধ বাক্সের ভেতর থেকে বার করল ডজন খানেক ছোট নোটবুক—তাদের নাম:

জোসেফ, এক ব্লক প্রিন্টার (পোল্যান্ড)

লিনা, এক বেকার মহিলা (ভিয়েনা)

রুদ্র, এক কলেজ শিক্ষক (মাদ্রাস)

আরিফা, এক রেডিও উপস্থাপক (ঢাকা)

Tenzing, এক গাইড (পোখরা)

প্রত্যেকটা ছিল একটা কাহিনি। যেন ছায়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা একেকটা মানুষ, কেউ বন্দুক ছাড়াই, কেউ শব্দ দিয়ে, কেউ শুধু মৌনতায়।

ক্লারা এসে দাঁড়াল পেছনে। তার হাতে একটা ছোট নোট।

“Got this in the mail. No sender. But I think it’s for you.”

খামের ভেতরে একটা মাত্র লাইন:
“History is not over. It’s waiting to be written by those who bled but never wrote.”

অনিরুদ্ধ হেসে বলল, “Then let’s write. Not about KROKODIL. But about the others.”

“Counter-KROKODIL?” ক্লারা চোখ কুঁচকাল।

“No,” অনিরুদ্ধ বলল। “Let’s call it… ECLIPSE.”

“Why Eclipse?”

“Because even the darkest shadow is temporary.”

দুই বছর পর।

লন্ডনে এক আন্তর্জাতিক বইমেলায় নতুন একটি বই প্রকাশিত হল—“ECLIPSE: The Forgotten Resistors”।
লেখক: অনিরুদ্ধ দাশগুপ্ত ও ক্লারা স্টেইন।
ভিতরে ১২টি গল্প। ১২টি সাক্ষ্য। এবং একটা নতুন অধ্যায়।

অনিরুদ্ধের বক্তব্য দিয়ে শুরু হয় বইটা—

“আমি এখন বিশ্বাস করি, ইতিহাস শুধু রাজা আর সেনাপতির নয়।
ইতিহাস সেই চুপ থাকা মেয়েটির, যে তার ভাষার জন্য প্রাণ দিল।
ইতিহাস সেই বৃদ্ধের, যে বুলেটের বদলে বাঁশি বাজিয়ে রাস্তায় নামল।

ইতিহাস এখন আমাদের কাছে আছে—আমরা যারা ছায়া থেকে ফিরে এসেছি, শুধু আলো দেখার জন্য নয়, বরং আলো জ্বালানোর জন্য।”

শেষ দৃশ্য:

বেহালার পুরোনো বাড়িতে ক্লারা একটা দেয়ালে নতুন একটা ছবি লাগাচ্ছে—দুই হাতে লেখা বোর্ড:
“History Room”
নিচে ছোট করে লেখা—
“Silent Witnesses Welcome.”

অনিরুদ্ধ হাসছে। তার পেছনে দাদুর ছেঁড়া ম্যাপ, আগুনে পোড়া কাগজ, আর ভরা বুকের নিঃশ্বাস।

ছায়া কেটে গেছে।

আলো এখন নিজের ভাষায় কথা বলছে।

 

সমাপ্ত

1000024580.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *