Bangla - কল্পবিজ্ঞান

ইলেকট্রিক মানিক

Spread the love

হিমাদ্ৰী ঘোষ


মানিক ছিল ছোট্ট এক গ্রামীণ ছেলেবেলা থেকে দুষ্টু আর কৌতূহলী, তবে তার দুষ্টুমির রূপটা অন্যরকম। যখন অন্য বাচ্চারা মাঠে ঘুড়ি ওড়াতো কিংবা নদীর ঘাটে সাঁতার কাটতো, তখন মানিক অচেনা এক জগতে ডুবে থাকতো। সে ভাঙা রেডিওর ভেতর থেকে লাল-সবুজ রঙের তার টেনে বের করতো, পুরোনো ফ্যানের মরিচা ধরা পাখা খুলে এনে হাতে ঘোরাতো, কিংবা ফেলে দেওয়া ব্যাটারির ভেতরের কালো পেস্ট নিয়ে পরীক্ষা করতো। তার চোখে এগুলো নষ্ট জিনিস নয়, বরং একেকটা অজানা খেলার মাঠ। বাবা ছিলেন গ্রামে লোহার কাজের কারিগর, তার হাতের যন্ত্রপাতি অনেক সময় চুপিচুপি নিয়ে গিয়ে মানিক নিজের খেলায় ব্যবহার করতো। মা খেতে কাজ করতেন, মাঠ থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ছেলেকে প্রায়ই বকাঝকা করতেন, “মানিক, তুই সারাদিন এই ভাঙাচোরা নিয়ে কী করিস? পড়াশোনা করবি না?” কিন্তু বকুনি শুনেও ছেলেটা থামতো না। বরং আরও বেশি মন দিতো, কারণ তার মনে হতো এসব ধাতু, তার, ব্যাটারির ভেতরে লুকিয়ে আছে অদ্ভুত এক গোপন শক্তি, যেটা সবাই অবহেলা করে ফেলে দিচ্ছে। গ্রামে যারা মানিককে দেখতো, তারা হাসাহাসি করতো। কারও কাছে সে ছিল উদ্ভট বালক, কেউ বলতো “এই ছেলে বড় হয়ে ভিখারি হবে, সারাদিন লোহা নিয়ে খেলে কী হবে?” কিন্তু মানিকের ভেতরের জেদ আর কৌতূহলকে এসব কটাক্ষ দমাতে পারতো না।

গ্রামের মাটির ঘরে কেরোসিনের আলোয় পড়াশোনা করার সময়েও তার পাশে থাকতো ভাঙাচোরা যন্ত্রপাতির একটা ছোট্ট সিন্দুক। যেদিন স্কুল ছুটি থাকতো, মানিক সারাদিন হাটে-ঘাটে ঘুরে বেড়িয়ে পুরোনো রেডিও, টর্চ, ভাঙা ঘড়ির যন্ত্রাংশ খুঁজে বের করতো। অনেক সময় হাটের দোকানদাররা অবহেলায় যেগুলো ফেলে দিতো, সেগুলোই মানিক ঝুলিতে ভরে নিয়ে আসতো। ঘরে বসে সেগুলো একে একে খুলে দেখতো ভেতরের পেট-যন্ত্র। অনেকটা ডাক্তার যেমন রোগীর শরীর কেটে ভেতরটা বোঝার চেষ্টা করে, তেমনই মানিক যন্ত্রের গায়ে স্ক্রু খুলে ভেতরের প্রতিটা নাট-বল্টু, তার, কয়েল কেমন করে কাজ করে সেটা বোঝার চেষ্টা করতো। সে জানতো না বৈজ্ঞানিক সূত্র, জানতো না বৈদ্যুতিক কারেন্টের নিয়ম, কিন্তু তার সহজাত বুদ্ধি দিয়ে টের পেতো কোন জিনিস কোনটার সাথে জুড়লে আলো জ্বলে ওঠে, ফ্যান ঘুরতে শুরু করে কিংবা টর্চে ঝিলিক আসে। কখনও যন্ত্র হুট করে শর্ট হয়ে গিয়ে ধোঁয়া উড়তো, তখন মা চিৎকার করে ছেলেকে তিরস্কার করতেন, তবু মানিকের চোখে তখনও উচ্ছ্বাস থাকতো, যেন নতুন এক রহস্য আবিষ্কার করেছে। এই রহস্যের খোঁজে দিনরাত মানিক মগ্ন থাকতো, এমনকি স্কুলে পড়ার সময়ও তার মনে থাকতো—কীভাবে ব্যাটারির শক্তিকে আরও বেশি আলোতে রূপান্তর করা যায়। তার সহপাঠীরা মজা করতো, “মানিক তো বিদ্যুতের জ্বিন ধরে ফেলবে একদিন।” অথচ মানিকের মনে হতো সত্যিই যেন সে এমন কিছু আবিষ্কার করবে যেটা বিদ্যুতের জ্বিনকে হাতে এনে মানুষকে আলো দিতে পারে।

এভাবেই বেড়ে উঠছিল মানিক। দরিদ্রতার কষ্ট, পড়াশোনার চাপ আর গ্রামের লোকজনের ঠাট্টা সত্ত্বেও সে নিজের কৌতূহলের জগতে ডুবে থাকতো। বাবার হাতের হাতুড়ি আর ছেনি তার কাছে শুধু লোহা পেটানোর যন্ত্র ছিল না, ছিল অজানা কিছুর চাবি। মায়ের বকুনি, গ্রামবাসীর অবজ্ঞা, বন্ধুদের হাসাহাসি—কিছুই তাকে থামাতে পারতো না। বরং এগুলোই যেন তার ভেতরে এক ধরণের অদম্য জেদ তৈরি করেছিল। সে ভাবতো, একদিন সবার ভুল প্রমাণ করবেই। এই অচেনা যন্ত্রপাতি থেকে একদিন এমন কিছু বের করবে, যেটা গ্রামের নাম দূরে দূরে ছড়িয়ে দেবে। তার স্বপ্ন ছিল—গ্রামের মানুষকে আলো দিতে হবে, যাতে আর কেরোসিনের আঁধার ঘরে বই পড়তে না হয়, মাকে খেতে কাজ শেষে অন্ধকারে ফিরতে না হয়। মানিক জানতো না তার এই সহজ ইচ্ছে আর ছেলেমানুষি কৌতূহল একদিন তাকে এমন পথে নিয়ে যাবে, যেখান থেকে শুরু হবে বড় এক গল্প—যন্ত্র, লোভ, শক্তি আর মানুষের মনের আলো-অন্ধকারের গল্প। কিন্তু তখন সে ছিল শুধু এক দরিদ্র, স্বপ্নদেখা গ্রামীণ ছেলে—যার কাছে ভাঙা যন্ত্রই ছিল মহার্ঘ সম্পদ, আর অদেখা আবিষ্কারই ছিল জীবনের সবচেয়ে বড় খেলনা।

সেদিন দুপুরে গ্রামের মাঠ ফাঁকা, রোদে ধান শুকোচ্ছে, গরুগুলো তালগাছের ছায়ায় জাবর কাটছে। মানিক মায়ের চোখ এড়িয়ে লুকিয়ে চলে গেল পেছনের উঠোনে, যেখানে তার সব “ল্যাবরেটরি” সাজানো—একদিকে ভাঙা ফ্যানের ব্লেড, অন্যদিকে টর্চলাইটের হ্যান্ডেল, মরিচা ধরা স্ক্রু, ফাটা ব্যাটারি, পুরোনো লোহার টুকরো আর নানা রঙের তারের জটলা। দিনের পর দিন এসব নিয়ে খেলতে খেলতে তার মাথায় এক অদ্ভুত চিন্তা জন্ম নিয়েছিল: মানুষের মস্তিষ্ক তো সবসময় কাজ করছে, তার ভেতর যে অদৃশ্য শক্তি আছে, সেটাকে যদি কাজে লাগানো যায় তবে কেরোসিনের বাতি জ্বালানোর জন্য কারও কষ্ট করতে হবে না। সে জানতো না বিজ্ঞানের ভাষায় এই শক্তিকে কী বলে, কিন্তু তার মনে হয়েছিল মানুষের মনোযোগই হলো সবচেয়ে বড় শক্তি। সেদিন হাতে পাওয়া গেল এক পুরোনো সাইকেলের হেডলাইটের বাল্ব, মাটির তলায় পড়ে থাকা মোটা তামার তার আর ভাঙা ব্যাটারি থেকে তুলে আনা সীসা-প্লেট। বাবার হাতুড়ি-স্ক্রু ড্রাইভার চুরি করে এনে সে একে একে জোড়া লাগাতে শুরু করলো। বারবার তার গায়ে বিদ্যুতের খোঁচা লাগলো, আঙুলে রক্ত ঝরলো, কিন্তু চোখে তার এক অদ্ভুত আলো জ্বলছিল। সে গড়তে চাইছিল এমন কিছু, যা আগে কেউ দেখেনি। বিকেল নামতেই উঠোনে জমে গেল এক অদ্ভুত জিনিস—লোহার ফ্রেমের ওপর বসানো ব্যাটারি, পাশে গোল ছোট্ট পাখা, সামনে সাইকেলের হেডলাইটের বাল্ব, আর তার সাথে মাথায় পরার মতো এক ধাতব বেল্ট, যেটা দেখতে অনেকটা অদ্ভুত হেডব্যান্ডের মতো।

প্রথমে সে নিজেই যন্ত্রটা মাথায় পরলো। হেডব্যান্ডটা ঠাণ্ডা, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল এটা যেন ধুকপুক করছে। তার হাতে রাখা হলো যন্ত্রটার মূল সুইচ। কিন্তু যন্ত্রটা একেবারেই স্থির—কোনো আলো জ্বলেনি, ফ্যান নড়লো না। মানিক হতাশ হলো না। আবার তারগুলো আলগা করে জোড়া লাগালো, একেকটা পেরেক শক্ত করলো, বাল্বের ভেতর তার বসালো নতুনভাবে। কয়েকবার ব্যর্থ হওয়ার পর হঠাৎ করেই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। সে চোখ বন্ধ করে মন দিয়ে ভাবলো—“আলো জ্বলো।” মুহূর্তের মধ্যে সাইকেলের হেডলাইটে ঝিলিক দেখা দিলো। মানিক হতবাক হয়ে গেল। সে চোখ খুলে দেখে ফ্যানটা আস্তে আস্তে ঘুরতে শুরু করেছে। বাল্বে একধরনের হলুদ আলো জ্বলে উঠেছে, যদিও সেটা খুব উজ্জ্বল নয়, তবুও স্পষ্ট বোঝা যায় আলোটা কোনো ব্যাটারির নয়, আসছে তার নিজের চিন্তা থেকে। সে বারবার চেষ্টা করলো—যখন মন অন্যদিকে চলে যায় তখন আলো ম্লান হয়ে যায়, কিন্তু যখন সে পূর্ণ মনোযোগ দেয় তখন আলো উজ্জ্বল হয় আর ফ্যানের শব্দ তীব্র হয়। মানিক তখন বুঝলো, সে যা ভেবেছিল সত্যিই সম্ভব। মানুষের চিন্তার ভেতরকার শক্তি সে বিদ্যুতের রূপে নিয়ে আসতে পারছে। তার বুকের ভেতর কাঁপুনি শুরু হলো, হাত-পা ঘেমে উঠলো। সে তো স্রেফ এক গ্রামের ছেলে, কোনো বইয়ের ল্যাবরেটরিতে বসে শিখে আসেনি, অথচ সে তৈরি করে ফেলেছে এমন এক জিনিস যা মানুষের শক্তিকে বদলে দিতে পারে।

রাত নামতেই মানিক ঘরের ভেতরে যন্ত্রটা নিয়ে বসলো। মায়ের চোখে ধরা না পড়ে চুপিচুপি কেরোসিন বাতি নিভিয়ে দিয়ে যন্ত্রের বাল্বে মনোযোগ দিলো। তার মনে হচ্ছিল, পুরো ঘর যেন আলোকিত হয়ে উঠেছে। তার মনে পড়লো, স্কুলে শিক্ষক একদিন বলেছিলেন মানুষ যদি মন দিয়ে কাজ করে তবে অসম্ভব কিছু থাকে না। সেদিন সে শিক্ষকের কথার আসল মানে খুঁজে পেলো। তার মাথার ভেতরের একাগ্রতা এই আলোকে জ্বালাচ্ছে। সে কল্পনা করলো—একদিন যদি পুরো গ্রামবাসী এই যন্ত্র মাথায় পরে বসে থাকে, তাদের চিন্তার শক্তি দিয়ে পুরো গ্রাম আলোকিত হবে, কেউ আর আঁধারে থাকবে না। কিন্তু তার ভেতরেই তখন এক ধরণের ভয়ও জন্ম নিলো। যদি কেউ এই যন্ত্রকে খারাপ কাজে ব্যবহার করে? যদি লোভী লোকেরা মানুষের চিন্তা শোষণ করে নিজেদের স্বার্থে শক্তি বানায়? শিশুমন হলেও মানিকের বুকে তখন হাজার প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। তবুও তার চোখে সেই মুহূর্তে আনন্দই বেশি ছিল—সে জন্ম দিয়েছে এমন এক আবিষ্কারকে, যা আগে কেবল তার স্বপ্নে ছিল। রাতভর যন্ত্রটা বারবার চালিয়ে, বন্ধ করে, আবার নতুন করে গড়ে তুলে মানিক তখন বুঝতে পারছিল—তার জীবন আর আগের মতো সাধারণ থাকবে না। একটা দরিদ্র গ্রামের উঠোন থেকে জন্ম নিলো এক অদ্ভুত যন্ত্র, যেটা মানুষের ইতিহাস বদলে দেওয়ার শক্তি রাখে।

মানিকের যন্ত্র প্রথমে শুধু তারই খেলার বস্তু ছিল। উঠোনে বসে সে আলো জ্বালাতো, ফ্যান ঘোরাতো, আবার বন্ধ করতো। একদিন তার কৌতূহলী বন্ধু জিতেন এসে দেখে ফেলে। জিতেন হেসে বলে ওঠে, “এইটা আবার কেমন যাদু করেছিস? মাথায় লোহার বেল্ট বেঁধে বাতি জ্বলে ওঠে নাকি?” মানিক কিছু না বলে জিতেনকে যন্ত্রটা পরতে দেয়। জিতেন হেসে খেলাচ্ছলে চোখ বন্ধ করে বলে, “আলো জ্বলো।” আর অবিশ্বাস্যভাবে বাতি ঝিলমিল করে ওঠে। জিতেন আঁতকে লাফিয়ে উঠে বেল্ট খুলে ফেলে, তারপর চিৎকার করে বলে, “মানিক জ্বিন ধরে ফেলেছে!” কথা ছড়িয়ে পড়তে দেরি হলো না। বিকেলের দিকে মাঠে, ঘাটে, হাটে মানুষ বলতে লাগলো—“মানিকের মাথায় নাকি জ্বিনের খেলা আছে। তার যন্ত্রে নাকি আলোর জাদু লুকানো।” কেউ কেউ কৌতূহলী হয়ে দেখতে এলো, কেউ আবার ভয় পেয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকলো। গ্রামের বয়স্করা মুখ বাঁকিয়ে বললো, “আজকালকার ছেলেপেলে সব নষ্টামি শিখে গেছে। আলো জ্বালাতে বিদ্যুৎ দরকার হয়, মাথা দিয়ে আলো জ্বালানো আবার কেমন কথা!” কিন্তু ছেলেমেয়েরা দলে দলে এসে মানিকের উঠোনে দাঁড়াতে লাগলো। তারা হেসে বলতো, “মানিক তুই তো জাদুকর হয়ে গেছিস।” আর মানিক অবাক হয়ে দেখলো, তার বানানো ভাঙাচোরা জিনিসটা গ্রামের মানুষের আলোচনার কেন্দ্র হয়ে গেছে।

কিন্তু সেই আলোচনা খুব বেশি সম্মানজনক ছিল না। গ্রামের অনেকে ভেবেছিল এটা নিছক ভেলকি। যেমন মেলা বা হাটে হাতসাফাইয়ের খেলোয়াড়রা করে—তেমনি কোনো চালাকি নিশ্চয় আছে এখানে। কয়েকজন আবার সন্দেহ করলো এটা শয়তানের খেলা। একদিন হাটের মাঠে যখন মানিক সাহস করে সবার সামনে যন্ত্রটা দেখায়, তখন একটা ঘটনা ঘটে। গ্রামের মাতব্বর খোরশেদ আলী তাচ্ছিল্য করে বললেন, “এই সব ফালতু খেলা বন্ধ করো, এসব গ্রামে মানায় না।” কিন্তু তাঁর নাতি, ছোট্ট স্কুলপড়ুয়া ছেলে, একবার মাথায় যন্ত্রটা বেঁধে ফেললো। ছেলেটা হাসতে হাসতে মনোযোগ দিলো, আর তখনই ফ্যান ঘুরে উঠলো আর আলো জ্বলে গেলো। মাতব্বর চমকে উঠলেন, মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। তবে তিনি সেটা স্বীকার না করে বললেন, “এসব অবশ্যই কোনো ফাঁকি আছে। হয়তো আগে থেকে ব্যাটারিতে চার্জ ভরে রেখেছে।” চারদিকের মানুষ তর্ক শুরু করে দিলো—কেউ বললো এটা যাদু, কেউ বললো বিজ্ঞান, কেউ আবার বললো শয়তানের কারসাজি। মানিক তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলো যে এটা কোনো যাদু নয়, কোনো শয়তানের কাজ নয়, বরং মানুষের চিন্তার শক্তি থেকে এসেছে। কিন্তু কে-ই বা তার কথা বিশ্বাস করলো? গ্রামের মানুষ বরাবরই নতুন জিনিসকে সন্দেহের চোখে দেখে।

এই অবিশ্বাস মানিককে কষ্ট দিলো। রাতে শুয়ে সে ভাবলো—কেন মানুষ নতুন কিছু দেখলেই ভয় পায়? সে তো শুধু চেয়েছিল গ্রামের আঁধার কাটাতে, মানুষকে আলো দিতে। অথচ সবাই তাকে ঠাট্টা করছে, কেউ কেউ এমনকি তাকে পাগলও বলছে। তবুও সে হাল ছাড়লো না। ধীরে ধীরে কয়েকজন কৌতূহলী তরুণ ছেলেমেয়ে নিজেরাই যন্ত্রটা ব্যবহার করলো। তারা বিস্মিত হলো, কারণ তাদের মনোযোগে আলো সত্যিই জ্বলে ওঠে। তারা বললো, “হয়তো মানিকের মধ্যে কোনো সত্যিই নতুন কিছু আছে।” কিন্তু গ্রামের মূল ভিড় তেমন গুরুত্ব দিলো না। তাদের কাছে এটা ছিল হাটে নতুন আসা এক মেলা খেলার মতো—কিছুদিন দেখে হইচই করবে, তারপর ভুলে যাবে। তবুও এই অবিশ্বাসের ভিড়ের মাঝেই মানিকের ভেতরে জন্ম নিতে লাগলো নতুন জেদ। সে বুঝতে পারলো, গ্রামের সীমাবদ্ধতায় তার যন্ত্রের আসল মূল্য বোঝানো যাবে না। হয়তো এই আবিষ্কার আরও দূরে পৌঁছাবে, যেখানে মানুষ তাকে ভেলকি নয়, সত্যি মনে করবে। কিন্তু আপাতত তাকে একাই লড়তে হবে—গ্রামের অবিশ্বাস, হাসি-ঠাট্টা আর সন্দেহের দৃষ্টির বিরুদ্ধে।

মানিকের জীবন তখনো একেবারে সাধারণ ছিল, প্রতিদিনের মতো সকালবেলা সে তার যন্ত্রটা ব্যাগে ভরে নিয়ে হাটে গিয়েছিল। গ্রামের হাটে ভিড় জমেছিল গরু-ছাগল, ধান-চাল, শাকসবজি আর নানারকম হাটুব্যবসায়ীদের নিয়ে। কৌতূহলী কয়েকজন গ্রামবাসী, যারা আগে মানিকের যন্ত্র দেখে হেসেছিল বা অবিশ্বাস করেছিল, তারা এবারও ভিড় করে দাঁড়াল। মানিক লাজুকভাবে কাঠের টেবিলের উপর যন্ত্রটা বসিয়ে দিল, আর পাশে রাখা ব্যাটারি, লোহার টুকরো আর তারগুলো জুড়ে দিল। প্রথমে লোকজন ভাবল সে আবার বাচ্চাদের মতো কিছু খেলনা বানিয়েছে। কিন্তু মানিক নিজে হেডব্যান্ডটা পরে চোখ বন্ধ করে মনোযোগ দিল, আর মুহূর্তেই বাতিটা ঝলমল করে জ্বলে উঠল, ছোট্ট ফ্যানটা ঘুরতে শুরু করল। লোকজনের মুখে শোরগোল উঠল। অনেকেই ভেবেছিল আগে হয়তো কাকতালীয় ছিল, কিন্তু এবার যখন কয়েকজনকে মানিক নিজ হাতে হেডব্যান্ড পরিয়ে দিল, আর তাদের চিন্তার জোরে আলো জ্বলে উঠতে শুরু করল, তখন ভিড়ের মধ্যে বিস্ময় আর উত্তেজনার ঢেউ বয়ে গেল। কেউ বিস্ময়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইল, কেউ নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারল না। কিন্তু সবকিছুর মধ্যে মানিকের কাছে মনে হচ্ছিল, এটা এখনো তার খেলার মতোই, কোনো গুরুতর ব্যাপার নয়। সে ভাবতেও পারছিল না, এই ছোট্ট যন্ত্রই তার গ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে এত বড় আলোড়ন তুলতে যাচ্ছে।

হাটে ভিড়ের মধ্যে তখন একজন স্থানীয় সাংবাদিকও উপস্থিত ছিল, যিনি সাধারণত হাটবাজারের ঝামেলা, দামদর বা ছোটখাটো গ্রামের ঘটনা শহরে লিখে পাঠাতেন। তিনি হাটের ভিড়ে দাঁড়িয়ে সবটা দেখলেন, আর মনে মনে ভাবলেন—এটা নিছক একটা খেলনা নয়, এর পেছনে কোনো অজানা শক্তি কাজ করছে। তিনি দ্রুত মানিকের ছবি তুললেন, যন্ত্রটার খুঁটিনাটি লিখে রাখলেন, আর বাড়ি ফিরে এক নিশ্বাসে খবরটা লিখে ফেললেন—“গ্রামের ছেলেটি মানুষের চিন্তা দিয়ে বিদ্যুৎ জ্বালালো!”। খবরটা প্রথমে ছাপা হল স্থানীয় সাপ্তাহিক পত্রিকায়, যেখানে সাধারণত গ্রামের বাজার, স্কুল, দুর্ঘটনা বা চাষাবাদের রিপোর্ট ছাপা হত। প্রথম দিন কেউ বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি, তবে যারা পড়ল তারা অদ্ভুত বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে ভেবে নিল—এটা কি আদৌ সম্ভব? কেউ এটাকে নিছক মজার খবর বলে পাশ কাটিয়ে দিল, কেউ আবার মনে মনে ভাবতে লাগল—হয়তো নতুন কোনো প্রতারণার খেলা শুরু হয়েছে। কিন্তু সাংবাদিকের লেখা আর ছবির ভেতরে এক ধরনের সততা ছিল, যা পাঠকদের মনে কৌতূহলের স্ফুলিঙ্গ জ্বালাল।

খবরটা কয়েক দিনের মধ্যে আশ্চর্যভাবে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। স্থানীয় পত্রিকার সেই রিপোর্ট কোনোভাবে শহরের এক জনপ্রিয় দৈনিকে পৌঁছে গেল। সেখানে ছাপা হল—“চিন্তাশক্তিতে আলো জ্বালানো গ্রামীণ প্রতিভা।” শহরের পাঠকরা হঠাৎ করেই কৌতূহলী হয়ে উঠল। বিজ্ঞানমনস্ক মানুষরা খবরটা নিয়ে আলোচনায় বসলো, কেউ বিশ্বাস করল, কেউ আবার বলল এটা ভেলকি ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু যতই বিতর্ক শুরু হল, ততই খবরটা ছড়িয়ে পড়ল। সামাজিক মেলামেশার জায়গায়, স্কুল-কলেজে, চায়ের দোকানে মানুষ কথা বলতে লাগল সেই গ্রামের ছেলে মানিকের অদ্ভুত যন্ত্র নিয়ে। অথচ মানিক তখনো কিছুই জানত না—সে ভেবেছিল যন্ত্রটা নিয়ে লোকজন হেসে আবার ভুলে যাবে। কিন্তু অজান্তেই সে গ্রাম থেকে শহরে, আর শহর থেকে আরও দূরে ছড়িয়ে পড়া এক ঝড়ের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। তার ছোট্ট খেলা হয়ে উঠছিল এক মহা বিস্ময়ের আলো, যা তাকে এক অচেনা পথে টেনে নিতে চলেছে।

মানিকের গ্রামের শান্তি হঠাৎ করেই ভাঙতে থাকে, যখন এক সকালে গ্রামের প্রধান পথে হঠাৎ কয়েকটি নতুন গাড়ি থামল। শহরের বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা গাড়ি থেকে নেমে এলেন, তাদের চেহারায় কৌতূহল আর বিস্ময়ের মিশ্রণ ছিল। গ্রামের মানুষজন প্রথমে অবাক হয়ে দেখছিল, তারা বুঝতে পারছিল না এই উজ্জ্বল পোশাক এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির লোকেরা কেন এমন হঠাৎ এসেছে। মানিকও কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত, কারণ তার হাতে থাকা ছোট্ট যন্ত্রটি এখন আর শুধু তার খেলার বস্তু ছিল না; এটা হঠাৎ করে শহরের ক্ষমতাশালী মানুষের নজর কেড়ে নিয়েছে। বিজ্ঞানীরা যন্ত্রটির উপরে চোখ বুলাচ্ছিল, একে পরীক্ষা করে দেখছিল এবং একে কীভাবে ব্যবহার করা যায় তার সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা করছিল। কেউ বলছিল এটা ভবিষ্যতের শক্তির উৎস হতে পারে, কেউ আবার বলছিল এর মাধ্যমে মানুষকে এমনভাবে প্রভাবিত করা সম্ভব, যে তারা নিজেদের স্বাধীনতা হারাবে। মানিকের মনে একটা অদ্ভুত অশান্তি কাজ করছিল—তার সৃজনশীল আনন্দটি এখন হঠাৎ করে অন্যদের পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গ্রামের মানুষজন ধীরে ধীরে ওই নতুন অতিথিদের চারপাশে জমায়েত হতে লাগল। ব্যবসায়ীরা পাকা পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিল, যন্ত্রটি কিনে তাদের নিজস্ব সুবিধার জন্য ব্যবহার করতে চেয়েছিল। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা চাইছিল এটি সামাজিক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হবার মতো শক্তি তৈরি করবে। বিজ্ঞানীরা ব্যস্তভাবে যন্ত্রটির অদ্ভুত প্রযুক্তি বিশ্লেষণ করছিল, তারা মনে করছিল এটি এমন কিছু যা মানুষের জীবন ধ্বংস বা গঠন উভয়ই করতে পারে। মানিক দেখছিল, তার খেলার মতো যন্ত্রটি কীভাবে বড় বড় শহুরে প্রকল্প এবং শক্তির খেলা হয়ে যাচ্ছে। তার ছোট্ট গ্রামের মাটিতে হঠাৎ করেই এমন শক্তিশালী দৃষ্টিভঙ্গি এসে ভিড় জমাল, যা আগে কখনো তিনি দেখেননি। তার মনে প্রশ্ন জন্মায়—আমি কি সত্যিই এমন কিছু তৈরি করেছি, যা মানুষের জন্য বিপদও হতে পারে, নাকি এটি এক নতুন সম্ভাবনার সূচনা? গ্রামের মানুষদের মধ্যে ভয় আর বিস্ময়ের মিশ্রণ তৈরি হয়। কেউ বলছিল, ‘এই যন্ত্রের মতো কিছু আগে কখনো দেখিনি,’ কেউ আবার বলছিল, ‘মানুষকে এভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব কি!’ মানিক তখন বুঝতে পারল, তার ছোট্ট সৃজন এখন আর তার একমাত্র দায়িত্ব নয়; এটি যেন একটি বৃহৎ জগৎকে চ্যালেঞ্জ করার মতো শক্তি ধারণ করছে।

মানিকের মনে ধীরে ধীরে একটা অদ্ভুত দায়বোধ তৈরি হলো। তার কাছে যন্ত্রটি এখন আর শুধু খেলার জিনিস নয়, বরং এটি এমন একটি বস্তু, যা মানুষের ভবিষ্যত, স্বাধীনতা, এবং সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করতে পারে। শহরের অতিথিরা একে একে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে লাগল—কীভাবে এটি কাজ করে, এর শক্তি সীমা কত, কোন পরিমাণে এটি মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। মানিক হতভম্ব হয়ে এসব প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াল, তাকে ভাবতে হলো, তার এই ছোট্ট আবিষ্কার এখন কেবল একটি গ্রামের আনন্দ নয়; এটি এক বৃহৎ দুনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিজ্ঞানীরা নোট নিচ্ছিল, ব্যবসায়ীরা চুক্তির কথাবার্তা শুরু করল, আর রাজনৈতিক ব্যক্তিরা কৌশল নিয়ে ভাবছিল। মানিক বুঝতে পারল, তার হাতে থাকা ছোট্ট যন্ত্রটি এখন আর তার নিজস্ব সীমার মধ্যে নেই; এটি যেন একটি বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা নিয়ে দাঁড়িয়েছে। এই উপলব্ধি তাকে উদ্বিগ্ন করেছিল, কারণ সে জানত, এটি যদি ভুল হাতে পড়ে, তা মানবিক মূল্যবোধকে বিপন্ন করতে পারে। তখন তার মনের ভেতর এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব জেগে ওঠে—একদিকে এই যন্ত্রটি উদ্ভাবনের আনন্দ, অন্যদিকে এর ক্ষমতা মানুষকে বিপদে ফেলতে পারে এই সত্য। মানিক সেই মুহূর্তে বুঝতে পারল, তার খেলার মতো যন্ত্রটি এখন শুধু একটি খেলা নয়, বরং এটি একটি বাস্তব দুনিয়ার চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গ্রামের শান্তি ধীরে ধীরে এক নতুন উত্তেজনার স্রোতে ভেসে আসে, যখন একটি বিশাল কর্পোরেট কোম্পানি মানিকের গ্রামের মূলপথে প্রবেশ করে। তাদের প্রতিনিধি মানিকের কাছে আসে, হাতে নানারকম কাগজপত্র, প্রেজেন্টেশন এবং চকচকে প্রমোশনাল ম্যাটেরিয়াল। তারা মানিককে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে, তার যন্ত্রটির বিপুল ক্ষমতা আর সম্ভাবনাকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করে। তারা বলেন, এই যন্ত্রটি শুধুমাত্র একটি খেলার বস্তু নয়, বরং এটি এমন কিছু, যা মানুষের জীবন পরিবর্তন করতে পারে, সমাজকে নতুন মাত্রা দিতে পারে এবং প্রযুক্তির সীমাকে ছুঁয়ে যেতে পারে। তারা প্রতিশ্রুতি দেয় মানিককে বিপুল অর্থ, শহরের অভিজাত মানুষদের সঙ্গে পরিচয়, এবং এমন খ্যাতি যা একদিন তার নাম ইতিহাসের পাতায় স্থির করে দেবে। মানিক প্রথমে একটু অবাক হয়—তার ছোট্ট গ্রামীণ জীবন, যেখানে প্রতিটি দিন সাদাসিধে, আত্মীয়-পরিজনের মধ্যে কাটে, হঠাৎ করেই এমন এক বড় জগতের দরজায় পৌঁছে গেছে, যেখানে সবকিছুই সম্ভাবনার আলোকে ঘিরে আছে।

কোম্পানির কর্মকর্তারা পরবর্তী কয়েক ঘন্টার মধ্যে মানিকের সামনে বিভিন্ন চুক্তির খসড়া রাখে। একে এমনভাবে সাজানো হয় যে মনে হয়, তার হাতে থাকা যন্ত্রটি যেন তাদের হাত ধরেই পুরো পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে। তারা একদিকে মানিককে বোঝায়, এই যন্ত্র দিয়ে মানুষকে শিক্ষার নতুন দিক, চিকিৎসার উন্নতি, এমনকি পরিবেশগত সমাধান পর্যন্ত করা সম্ভব, অন্যদিকে হালকা ইঙ্গিত দেয়, যারা এই সুযোগ হারাবে, তাদের জীবনে সাধারণত্ব এবং সীমাবদ্ধতা ছাড়া কিছু থাকবে না। মানিকের মনে দ্বন্দ্ব জন্মায়—একদিকে তার গ্রামীণ সাধারণ জীবন, যেখানে প্রতিটি দিন শান্তিপূর্ণ, প্রকৃতির মাঝে কাটে এবং পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পায়, অন্যদিকে শহুরে সুযোগ এবং বিপুল অর্থ তাকে এক নতুন জীবনের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চায়। তার মনের ভেতর একটি অদৃশ্য যুদ্ধ শুরু হয়—কীভাবে সে এই যন্ত্রটির সত্যিকারের ক্ষমতা ব্যবহার করবে এবং কীভাবে তার নিজের জীবন ও মানুষের জীবনকে সংরক্ষণ করবে।

মানিক ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, তার কাছে শুধু দুটি পথ নেই, বরং অনেকগুলি জটিল দিক রয়েছে। যদি সে যন্ত্রটি কর্পোরেট কোম্পানির হাতে দেয়, তা হয়তো তাকে স্বপ্নের মতো জীবন এনে দেবে—সুন্দর ভবনের, আধুনিক প্রযুক্তির, মানসম্পন্ন জীবনযাত্রার, যেখানে প্রতিটি ইচ্ছা পূরণের সম্ভাবনা থাকবে। তবে সেই সম্ভাবনার মধ্যে লুকিয়ে আছে মানুষের স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা, প্রযুক্তির অপব্যবহার এবং মানিকের নিজের নৈতিকতার প্রশ্ন। অন্যদিকে গ্রামীণ জীবন বেছে নিলে, হয়তো বড় কোনো খ্যাতি বা অর্থ পাওয়া যাবে না, কিন্তু নিজের মূল্যবোধ, প্রিয় মানুষদের সাথে সম্পর্ক এবং প্রকৃতির মাঝে শান্তি অটুট থাকবে। মানিক সেই মুহূর্তে উপলব্ধি করে, তার হাতে থাকা ছোট্ট যন্ত্রটি কেবল তার জন্য নয়, বরং এটি এক বৃহৎ দুনিয়ার সম্ভাবনার প্রতীক, এবং এই সম্ভাবনা কীভাবে ব্যবহার করা হবে তা তার নিজের মনোভাব ও নৈতিকতার উপর নির্ভর করছে। তিনি সিদ্ধান্ত নেয়, এই সিদ্ধান্ত তার জীবনের ধারাকে পরিবর্তন করবে, এবং হয়তো পুরো গ্রামের জীবনেও প্রভাব ফেলবে। এই দ্বিধার মধ্যে মানিক ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে, কখনো কখনো বড় সুযোগ মানেই সহজ সিদ্ধান্ত নয়; বরং এটি এমন এক পরীক্ষা, যেখানে তার মূল বিশ্বাস, মানবিকতা, এবং সাহসী মনোবলই সবচেয়ে বড় শক্তি হবে।

গ্রামের শান্তি এখন ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে থাকে, যখন হঠাৎ করেই আশেপাশে অদৃশ্য ভয়ের ছায়া নেমে আসে। প্রথমে ছোট ছোট ঘটনা—কেউ রাতের অন্ধকারে মানিকের ঘরের জানালার দিকে সন্দেহজনক চোখ বুলায়, কেউ বা তার খেলার মতো যন্ত্রটি দেখতে চায়, আবার কেউ গোপনে তাকে হুমকি দেয়। গ্রামের মানুষজনের মুখে অস্থিরতা দেখা দেয়। একসময় মনে হয়, সবকিছু যেন এক অদৃশ্য কুয়াশার ভেতর গিয়ে মিলিয়ে গেছে, যেখানে কেউ ঠিক ঠিক জানে না কার বিশ্বাসযোগ্যতা আছে, কার নয়। মানিক দেখছে, তার হাতের ছোট্ট যন্ত্রটি এখন শুধু খেলার বস্তু নয়, বরং গ্রামের মানুষদের মনোবল, তাদের লোভ এবং ভয়ের প্রতিফলন হয়ে উঠেছে। কেউ চায় এই যন্ত্রটি নিজের ক্ষমতা বাড়ানোর হাতিয়ার হোক, কেউ আবার চাইছে এটি দিয়ে মানিককে প্রভাবিত করা হোক। প্রথমবারের মতো মানিক বুঝতে পারে, তার সৃষ্টির মধ্যে এত শক্তি লুকিয়ে আছে যে এটি সাধারণ মানুষের মধ্যে লোভ ও ভয় উভয়ই উস্কে দিতে পারে।

কিন্তু এই ভয় ও লোভ শুধু মানিকের চারপাশেই সীমাবদ্ধ থাকে না; ধীরে ধীরে কিছু প্রভাবশালী গ্রামবাসী কর্পোরেট কোম্পানির সঙ্গে হাত মেলায়। তারা চায়, মানিককে প্রলুব্ধ করে তাদের সুবিধার জন্য যন্ত্রটি ব্যবহার করা হোক। শহরের লোকেরা তাদের সঙ্গে যোগ দেয়, ব্যবসায়িক চুক্তি, চোরাশিকারির মতো কৌশল এবং নানারকম প্রলোভনের মাধ্যমে গ্রামের অস্থিরতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। মানিক দেখছে, তার এক সময়ের মধুর গ্রামীণ জীবন এখন একটি অদৃশ্য রাজনৈতিক ও আর্থিক খেলায় পরিণত হয়েছে, যেখানে কেউ সততার সঙ্গে নেই, এবং প্রত্যেকের লক্ষ্য শুধু নিজেদের সুবিধা অর্জন করা। সে নিজের ছোট্ট আত্মবিশ্বাসকে ধরে রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপে তার মনে ভয় কাজ করে—কেউ তার যন্ত্রটি কেড়ে নিতে চাইলে বা তার নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়লে কি হবে? এই পরিস্থিতি মানিককে শেখায়, যে কোন সৃজনশীল শক্তি যদি ঠিকমত রক্ষিত না হয়, তা সহজেই মানুষের লোভ ও ভয়ের খেলায় রূপান্তরিত হতে পারে।

মানিক বুঝতে পারে, এটি এখন আর শুধু যন্ত্রের খেলা নয়, এটি টিকে থাকার লড়াই। প্রতিটি সিদ্ধান্তে তার মনের ভেতর দ্বন্দ্ব তৈরি হয়—কাকে বিশ্বাস করা যায়, কার প্রতি সতর্ক থাকা উচিত। গ্রামীণ জীবনের পরিচিত মুখগুলির মধ্যেও সে খুঁজে পায় অচেনা রূপ, যেখানে একসময় প্রিয় মানুষরা হঠাৎ করে নিজের স্বার্থে অন্যায় কৌশল চালাতে শুরু করে। মানিক উপলব্ধি করে, এই যন্ত্রটি শুধু প্রযুক্তি নয়, বরং এটি মানুষের প্রকৃতি এবং চরিত্রের আভ্যন্তরীণ গঠনকে প্রকাশ করছে। লোভ ও ভয়ের এই খেলা তাকে শিক্ষা দিচ্ছে, যে শক্তি মানেই ক্ষমতা নয়, বরং নৈতিকতার পরীক্ষা; এবং এই পরীক্ষায় যারা সঠিকভাবে নিজের মনোবল ও বিচক্ষণতা ব্যবহার করতে পারে, শুধুমাত্র তারা টিকে থাকতে পারবে। গ্রামের আকাশে অন্ধকার কুয়াশার মতো নেমে এসেছে, কিন্তু মানিকের মনে অদম্য সংকল্প জন্ম নিচ্ছে—সে যন্ত্রটির সঠিক ব্যবহার, নিজের নিরাপত্তা এবং গ্রামীণ জীবনের সাদাসিধে মূল্যের মধ্যে সমন্বয় স্থাপন করতে চায়, যাতে এই লোভ আর ভয়ের খেলা তাকে এবং গ্রামের মানুষদের ধ্বংস না করে।

রাত যখন গভীর হয়, গ্রামজীবনের সমস্ত আওয়াজ নিস্তব্ধ হয়ে আসে, মানিক তার ঘরে একা বসে যন্ত্রটির সামনে। তাকে বুঝতে হয়েছিল, শুধুমাত্র যন্ত্রটি দেখানো বা খেলায় ব্যবহার করা আর যথেষ্ট নয়; তার আসল শক্তি কোথায় লুকিয়ে আছে তা নিজেই পরীক্ষা করতে হবে। সে ধীরে ধীরে যন্ত্রটি চালু করে, প্রথমে হালকা সিগন্যাল পাঠায়, শুধু নিজের অনুভূতি এবং সাধারণ চিন্তার প্রতিক্রিয়া দেখতে চায়। আশ্চর্যজনকভাবে, যন্ত্রটি প্রতিক্রিয়া দেখায়, তবে তা কেবল মানিকের ভাবনায় সীমাবদ্ধ থাকে না; এটা যেন তার মনের ভেতরের গোপন ইচ্ছা, অজানা আশঙ্কা এবং ছোট ছোট স্বপ্ন পর্যন্ত অনুভব করতে পারে। মানিকের হৃদয় দ্রুত ধড়ফড় করতে থাকে, কারণ সে বুঝতে পারে, এই যন্ত্রটি মানুষের মনের গভীর স্তরে প্রবেশ করতে সক্ষম। প্রতিটি অনুভূতি, প্রতিটি স্বপ্ন, এমনকি অজানা ভয়ও যন্ত্রের মাধ্যমে শক্তি হিসেবে বেরিয়ে আসে, যা কেবল প্রযুক্তিগত যন্ত্র নয়, বরং মানুষের মন এবং আবেগের এক অদৃশ্য আয়না হয়ে দাঁড়ায়।

পরীক্ষা আরও গভীরে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানিক লক্ষ্য করে, যন্ত্রটির ক্ষমতা কেবল ইতিবাচক শক্তি নয়; এটি মানুষের ভয়, সন্দেহ, লোভ এবং অজানা আতঙ্কও শক্তি হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। সে একটি ছোট্ট প্রয়োগে দেখল, গ্রামের কিছু লোকের গভীর আতঙ্ক এবং লুকানো ইচ্ছাগুলি যন্ত্রের প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রায় বাস্তবসম্মত আকার নেয়। একদিকে এটি তাকে বিস্মিত করে, অন্যদিকে ভীত করে, কারণ সে বুঝতে পারে, যদি কেউ এই শক্তি অপব্যবহার করে, তা সহজেই মানুষের মনের উপর প্রভাব ফেলতে পারে, তাদেরকে অনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করতে পারে। মানিক উপলব্ধি করে, এই যন্ত্রটি শুধু প্রযুক্তির সীমা নয়, বরং এটি মানুষের ভিতরের সত্য, তাদের বাস্তবতা এবং লুকানো মনস্তাত্ত্বিক দিককে প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখে। এই আবিষ্কার তাকে চিন্তিত করে, কারণ শক্তি যত বড়, বিপদও তত বৃহৎ—মানুষের অজানা অনুভূতি এবং গভীর ভয় যদি ভুল হাতে পড়ে, তা সমাজ এবং মানুষের জীবনে হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়াবে।

মানিক রাতভর পরীক্ষা চালিয়ে যায়, একসময় সে নিজের মনের ভেতরের অন্ধকারে চোখ রাখে। সে দেখল, তার নিজের ভয়, দুশ্চিন্তা, এবং অজানা আশঙ্কা যন্ত্রকে শক্তি দিচ্ছে, যা তাকে নিজেকেও অবাক করে দেয়। প্রতিটি মানুষের ভেতরের সত্য এবং গভীর অনুভূতি এই যন্ত্রের মাধ্যমে প্রকাশ পেতে পারে—এটি একদিকে শিক্ষণীয়, অন্যদিকে বিপজ্জনক। মানিক বুঝতে পারে, যন্ত্রটি শুধু একটি আবিষ্কার নয়; এটি মানুষের নৈতিকতা, চেতনা এবং মানবিক দায়িত্বের পরীক্ষা। এই উপলব্ধি তাকে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে, যে এটি যদি ভুল হাতে পড়ে, তা কেবল ক্ষতি নয়, বরং মানুষের স্বাধীনতা এবং সমাজের স্থিতিশীলতাকেও বিপন্ন করতে পারে। রাতে তার ঘরে, ল্যাম্পের আলোয়, মানিক ধীরে ধীরে নিজের সংকল্প শক্ত করে—যন্ত্রটির আসল শক্তি এখন তার হাতে, এবং তার দায়িত্ব হলো তা সঠিকভাবে ব্যবহার করা, যাতে মানুষের ভেতরের সত্য উন্মোচিত হলেও তা বিপদের কারণ না হয়।

গ্রামের শান্তি হঠাৎ ভেঙে পড়ে যখন কর্পোরেট বাহিনী ভোরের প্রথম আলোতেই প্রবেশ করে। তাদের চোখে কেবল একটি লক্ষ্য—মানিকের হাতের যন্ত্রটি দখল করা। বিশাল যানবাহন, আধুনিক সরঞ্জাম এবং অভিজ্ঞ লোকেদের উপস্থিতি গ্রামের ছোট্ট পথ এবং পাকা ঘরগুলোর সঙ্গে যেন অদ্ভুতভাবে মিশে যায়। গ্রামের মানুষজন প্রথমে হতবাক হয়ে যায়, তারা বুঝতে পারে যে এই পরিস্থিতি সাধারণ কোনও সমস্যার মতো নয়। মানিক দ্রুত বুঝতে পারে, এটি আর শুধু কথার বা প্রলোভনের খেলা নয়; এটি এখন সরাসরি সংঘর্ষের মাঠে রূপ নিয়েছে। কিছু গ্রামের মানুষ, যারা মানিককে বিশ্বাস করেছিল এবং তার নৈতিকতা ও সততার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তার পাশে দাঁড়ায়, তাদের চোখে দৃঢ়তা এবং সাহসের প্রকাশ। অন্যদিকে, যারা টাকার লোভে প্রলুব্ধ হয়েছে, তারা কর্পোরেট বাহিনীর সঙ্গে হাত মেলায়, মানিকের প্রতি বিদ্বেষ এবং লোভের প্রতিফলন দেখায়। এই দ্বন্দ্ব গ্রামের আকাশকে অন্ধকারের ছায়ায় ঢেকে দেয়, আর প্রতিটি মুহূর্ত যেন আগুনের মধ্যে জল ঢালার মতো উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে।

সংঘর্ষ শুরু হয় হঠাৎ এবং অবরোধহীনভাবে। কর্পোরেট বাহিনী আধুনিক প্রযুক্তি এবং কৌশল ব্যবহার করে, মানিকের যন্ত্রের দিকে এগোতে চায়, আর গ্রামের প্রিয় মানুষদের মধ্যে কিছু মানুষ সাহসী হয়ে দাঁড়ায় তাকে রক্ষা করার জন্য। মানিক নিজেও জানে, তার যন্ত্রটি যদি তাদের হাতে চলে যায়, তা শুধুমাত্র তার নয়, গ্রামের মানুষের স্বাধীনতা এবং ভবিষ্যতও বিপন্ন হবে। সে নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে সংঘর্ষে নেমে পড়ে। গ্রামজুড়ে ধাক্কাধাক্কি, চিৎকার, এবং ভয়ানক দাপটের মধ্য দিয়ে মানিক একে একে প্রতিটি আক্রমণ সামলে যায়। সে দেখছে, লোভ ও শক্তি মানুষের মনকে কত সহজে অন্ধ করে দিতে পারে, আর ভয় কতটা বড় অবাধ্য শক্তি। তার পাশে থাকা গ্রামবাসীরা তাদের সাহসিকতা এবং একতা দিয়ে তাকে সমর্থন করে, তাদের চোখে দৃঢ় সংকল্প, যা একটি সাধারণ গ্রামীণ জীবনের স্থির বিশ্বাসের মতো দৃঢ়।

শেষে মানিক বুঝতে পারে, যন্ত্রটি কারও হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। সে তার সমস্ত সাহস, কৌশল এবং নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়। নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে, সে প্রতিটি আক্রমণ প্রতিহত করে, যন্ত্রটিকে রক্ষা করার জন্য সব কিছু করে। গ্রামে সংঘর্ষ চলে অবিরাম, মানুষের মনোবল, লোভ এবং ভয় একে অপরের সঙ্গে লড়ে, আর মানিকের একাগ্রতা ও সংকল্প এই সমস্ত সংঘাতের মধ্যে আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠে। সে উপলব্ধি করে, শক্তি কেবল হাতে থাকলেই যথেষ্ট নয়, বরং সেটি সঠিক নৈতিক এবং মানবিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পরিচালিত হতে হবে। রাত শেষে, যখন সংঘর্ষের উত্তেজনা ধীরে ধীরে কমতে থাকে, মানিক জানে, তার যন্ত্রের সঠিক ব্যবহার না হলে এটি বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে, এবং সেই উপলব্ধি তাকে আরও দৃঢ় করে—সে কারও হাতে যন্ত্রটি দিয়ে দিবে না, তার জীবনই হোক তাতে বিনিয়োগ। এই রাত গ্রামবাসীর মনে গভীর ছাপ ফেলে, আর মানিকের সাহস এবং নৈতিক সংকল্পকে অনন্তকাল ধরে স্মরণীয় করে রাখে।

১০

রাত যখন গভীরতম অন্ধকারে ডুবে থাকে, মানিক ধীরে ধীরে যন্ত্রটির দিকে এগিয়ে যায়। তার হাত কাঁপছে না, বরং মনে এক গভীর শান্তি আর দৃঢ় সংকল্প কাজ করছে। এতদিনের উত্তেজনা, লোভ, ভয় এবং সংঘর্ষের সমস্ত স্মৃতি এক মুহূর্তে তার মনের ভেতরে জমে উঠেছে। সে জানে, এই যন্ত্রটি কারও হাতে গেলে কত বড় বিপদ হতে পারে, আর তাই সিদ্ধান্ত নেয়—এটি আর কারও কাছে যাবে না। গ্রামের মানুষজন ঘরে ঘরে নিজেদের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছে, কিছুটা কৌতূহল, কিছুটা অবিশ্বাসের মিশ্রণে। মানিক ধীরে ধীরে যন্ত্রটি চালু করে, আর হঠাৎ যেন সমস্ত গ্রামের আকাশ আলোতে ভরে যায়। যন্ত্রটির আলো মৃদু, কিন্তু বিস্তৃত—এটি শুধুমাত্র শারীরিক আলোক নয়, বরং মানুষের হৃদয়, চিন্তা এবং একতার শক্তিকে প্রতিফলিত করছে। গ্রামের মানুষজন এই আলোতে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারে, যে শক্তি আসলেই কার্যকর, তা যন্ত্রে নয়; বরং মানুষের একতা, বিশ্বাস এবং মনোবলের মধ্যে নিহিত।

মানিক দেখছে, গ্রামের মানুষজনের চোখে কৌতূহল, ভয় এবং আশা একসাথে ফুটে উঠছে। আলোতে ধীরে ধীরে গ্রামীণ পথ, মাঠ, নদীর তীর, আর ছোট ছোট ঘর সবকিছু জ্বলজ্বল করছে, যেন সমস্ত গ্রাম এক বিশাল সঙ্গীতের অংশ হয়ে উঠেছে। মানুষের মনে এক অদ্ভুত আবেগের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে—একসাথে দাঁড়ানোর শক্তি, পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস এবং কঠিন সময়েও একত্রিত থাকার মনোবল। মানিক ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, তার হাতের ছোট্ট যন্ত্রটি শুধু মানুষকে আলোকিত করার মাধ্যম ছিল, কিন্তু আসল আলো মানুষ নিজেই তৈরি করেছে। এটি একটি শিক্ষা—যন্ত্রের শক্তি সীমিত, কিন্তু মানুষের মন ও চিন্তার শক্তি অসীম। গ্রামবাসী একে অপরের দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত আনন্দ এবং গর্বের অনুভূতি পায়, যেন তারা নিজেই এই আলো তৈরি করেছে।

শেষে মানিক তার সমস্ত সংকল্পে যন্ত্রটি ধ্বংস করে ফেলে। একটি মুহূর্তের জন্য পৃথিবী নিস্তব্ধ হয়ে যায়, সব আলো নিভে যায়, কিন্তু মানুষের চোখে এবং মনের ভেতরে আলো জ্বলজ্বল করে। তারা বুঝতে পারে, এই আলো কখনও নিভে যায় না, কারণ এটি মানুষের চিন্তা, একতা এবং বিশ্বাসের মধ্যে নিহিত। মানিক ঘামে ভিজে, ক্লান্ত, কিন্তু সুখী—সে জানে, যে সবচেয়ে মূল্যবান শক্তি মানুষের ভেতরে, তা কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। গ্রামের মানুষজন তার পাশে আসে, শান্তি, সম্মান এবং প্রগাঢ় কৃতজ্ঞতার সঙ্গে। যন্ত্রটি ধ্বংস হলেও, তার শিক্ষা চিরস্থায়ী হয়ে যায়—যন্ত্র নয়, মানুষের চিন্তা, মনের আলো, এবং একতার শক্তি সবচেয়ে বড় শক্তি। সেই রাতের শেষ আলো শুধু গ্রামকে আলোকিত করে না; এটি মানুষের মনে অমর শিক্ষা হিসেবে জ্বলজ্বল করে—একটি শক্তি, যা কোনো বাহিনী, কোনো লোভ বা ভয়ের দ্বারা কখনও নষ্ট করা যায় না।

শেষ

 

1000065969.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *