অহনা মিত্র
পর্ব ১: “হ্যালো মানেই কি শুরু?”
ইনস্টাগ্রামের নীল-সাদা ইন্টারফেসটা যেন নীল আকাশের মতোই অচেনা। কিন্তু সেই আকাশেই একদিন একটা মেঘ ভেসে আসে যার নাম ScribbledSoul77—একটা স্টোরিতে হঠাৎ রিপ্লাই: “তোমার প্লেলিস্ট অসাধারণ।” ততদিনে সোহিনী তার কলেজ লাইফের একঘেয়ে গল্পগুলো ইনস্টার স্টোরিতে সুরে বাঁধা শুরু করেছে—আর সেইদিন স্টোরিতে ছিল পিন ব্যাকের “Autumn Tree”।
সেই হ্যালোটা আর দশটা ইনস্টা চ্যাটের মতো সাধারণ ছিল না। কারণ হ্যালোয়ের পরেই ছিল একটা গানের লিঙ্ক—Cold/Mess। ছেলেটার নাম ছিল ঋভু। একঝলকে প্রোফাইলটা খুব স্পষ্ট কিছু বলে না—একটা বইয়ের ছবি, কয়েকটা মিম আর ঢাউস ক্যাপশন ছাড়া—“Mostly offline. Online only for music and madness.” অথচ ওই মেসেজেই ছিল এক অদ্ভুত টান।
“তুমি মিউজিক ভালোবাসো? Indie playlist বানাও না?” — সোহিনী তখনও রিপ্লাই দেয়নি। আধঘণ্টা পরে শুধু লিখেছিল, “বাসি চা আর বাসি গান—দুটোই আমার প্রিয়।” তারপর দুজনেই চুপ।
পরের দিন সকাল সাড়ে আটটায় একটা নতুন স্টোরি—ঋভুর। ছবিতে একটা পুরনো ছাই রঙা মগ, আর ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে Khalid – Talk। নিচে লেখা, “বাসি চা। কে বলেছিল?” সোহিনীর ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে যায়। সে প্রথম বার হেসে উত্তর দেয়—“তুমি খুব মন দিয়ে শুনো, তাই না?”
এইভাবেই শুরু। দুজন দুজনের স্টোরিতে হঠাৎ করে মিউজিক ট্যাগ করে। “এই গানটা তোমার জন্য।” “আজ তোমার মতো একটা দিন।” মাঝে মাঝে দু’একটা মিম, কাঁধে মাথা রাখার গল্প, সিনেমার ডায়লগ—“কিছু কিছু কথা ইনবক্সেই ভালো লাগে”—আর সেই ইনবক্সে একটু একটু করে জমতে থাকে অভিমান, অনুরাগ আর অনুচ্চারিত অনুভব।
“তুমি কী পড়ো?” — একদিন সোহিনী জিজ্ঞেস করেছিল। “কখনও সমাজতত্ত্ব, কখনও মানুষ। তুমি?” — “আমি? মানুষের মুখ পড়ি, তবে মানুষ পড়া এখনো শেখা হয়নি।” তারপর একসঙ্গে রাত ২টো পর্যন্ত চলে আলাপ—কেমন করে নীল রঙ ভালোবাসা হয়ে যায়, আর গান মানুষ চিনিয়ে দেয়।
তাদের দেখা হয়নি কখনও। অথচ প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙে একে অপরের মেসেজে। “সকালটা কেমন?” “আজ আকাশ মেঘলা, তোমার মন?” মাঝে মাঝে সোহিনী টেক্সট না পাঠালে ঋভু এক লাইন লেখে—“তুমি চুপ মানেই কি আমি ভুল কিছু বলেছি?”
আরও অদ্ভুত ছিল যেদিন ঋভু সোহিনীর পাঠানো গান দিয়ে একটা ছোট্ট ভিডিও বানায়। তারা তখনও একে অপরের মোবাইল নম্বর জানে না, ফলোয়ার লিস্টেও কেউ কাউকে ট্যাগ করে না—তাদের প্রেমটা যেন স্ক্রিনের পেছনে এক নিঃশব্দ প্রতিশ্রুতি।
তবে ইনস্টার এই চ্যাটে একটা অলিখিত নিয়ম ছিল—“কখনও দেখা হবে না।” কেবল চ্যাট, কেবল গান, কেবল গল্প।
এক রাতে সোহিনী লিখে—“তুমি জানো, যদি হঠাৎ করে একদিন ইনস্টাগ্রাম ডিলিট করে দিই, তাহলে আমরা থাকব কোথায়?” ঋভু অনেকক্ষণ পর উত্তর দেয়—“আমরা থাকব না, কিন্তু আমাদের গানগুলো রয়ে যাবে—আমাদের মতো কিছু জোড়া হেডফোনে বাজতে থাকা দুই অচেনা আত্মার গান।”
কিন্তু এই ইনবক্সে প্রেম কি সত্যি প্রেম? না কি এই অনুরণন শুধু একটা ডিজিটাল ফাঁদ, যেখানে মানুষ বাস্তব থেকে পালিয়ে মনের ভেতরের গল্প লিখে যায় একে অপরকে?
তাদের প্রেমের ঠিকানা নেই, তাদের ডিপি একসঙ্গে নয়, কিন্তু একটা অদৃশ্য তারে বাঁধা থাকে প্রতিদিনের মেসেজ, একটা ইমোজির হাসি, একটা গানের কমা… আর একটা দেখা না হওয়া ভালোবাসা।
পর্ব ২: “Sure. Break free.”
সন্ধেটা হালকা গাঢ় হয়ে আসছিল। সোহিনী জানলার পাশে বসে হেডফোনে Aurora – Runaway শুনছিল। সে জানে ঋভু হয়তো এই সময়টাতেই তাকে একটা নতুন গান পাঠাবে। কিংবা একটা মিম—“এই তো তুমিই তো!” টাইপ ক্যাপশন দিয়ে। কিন্তু আজ কিছুই এল না।
দুই ঘণ্টা কেটে গেল।
অস্থিরতার মতো লাগছিল। সেই মৃদু উত্তেজনা, যেটা সোহিনী প্রথম বুঝেছিল যখন ঋভু হঠাৎ একদিন লিখেছিল—
“Sure. Break free.”
সেদিন সোহিনী একটা স্টোরি দিয়েছিল—
“আমার চারপাশটা যেন একটা জেলখানা। কেউ যদি বলত, বাইরে এসো। শুধু একটা লাইন লিখে: ‘Sure. Break free.’”
আর ওই একই মিনিটে ঋভু ইনবক্সে লিখেছিল সেই চারটা শব্দ।
সেই দিনটার পর থেকেই যেন কিছু বদলেছিল। ইনস্টা মেসেজে প্রেম না হোক, একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল—নতুন সময়ের ভাষায়, নতুন সংজ্ঞায়। না দেখেও কেউ কারও ভালোবাসা হয়ে উঠতে পারে—এই বিশ্বাসটা সেদিন জন্মেছিল।
আজ সেই বিশ্বাসটা একটু কেঁপে উঠছে।
সোহিনী চুপচাপ একটা টেক্সট লেখে—
“Where are you?”
এক মিনিট। পাঁচ মিনিট। ত্রিশ মিনিট। সিঙ্গেল টিক। না, ইনস্টাগ্রাম ওপেনই হয়নি।
এইরকম আগে হয়নি।
আগের দিন রাতেই তো কথা হচ্ছিল—জেমস ব্লান্ট থেকে শুরু করে দোর্দারানার মতো চলে গিয়েছিল একটা নীরব ভোর পর্যন্ত।
ঋভু লিখেছিল—
“আমার শহরটা এখন কনক্রিটের দুঃস্বপ্ন। তুমি কীভাবে পালিয়ে যাও নিজের জায়গা থেকে?”
সোহিনী লিখেছিল—
“আমি মিউজিকে পালিয়ে যাই। গল্পে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। তোমার মতো কাউকে খুঁজে নিই।”
ঋভু হাসির ইমোজি দিয়ে বলেছিল—
“Break free. বললেই পালানো যায় না, নাকি?”
সোহিনী তো সেইরাতেই লিখেছিল—
“চলো, একদিন শুধু প্লেলিস্টে হেঁটে যাই। না দেখা, না ধরা, শুধু অনুভব।”
আজ সেই ইনবক্সই নিঃশব্দ।
রাত বাড়ে। হঠাৎ একটা নোটিফিকেশন।
@scribbledsoul77 has updated a story.
সোহিনীর বুকটা কেঁপে ওঠে।
স্টোরি ওপেন করে। ছবিতে—একটা পুরনো জানলা, জানলার ওপারে বৃষ্টি, আর নিচে লেখা—
“Some storms come only to show us who stays inside.”
তাও ইনবক্সে কোনো মেসেজ নেই।
সোহিনী অপেক্ষা করে না।
সে লিখে—
“তুমি ঠিক আছো তো?”
এবার সিঙ্গেল টিক হয় ডাবল।
ঋভু উত্তর দেয় না।
কিন্তু পরদিন সকালে সে জবাব দেয়—
“হ্যাঁ। ঠিকই আছি। শুধু একটু… ভাঙা।”
সোহিনী লেখা শুরু করে—
“তাহলে ইনবক্সে এসো। কথা বলো। জানো তো, ইনবক্স মানেই চার দেওয়াল নয়, এক রকম আশ্রয়।”
ঋভু উত্তর দেয়—
“তুমি জানো? আমি প্রতিদিন ভাবি, এই স্ক্রিনের ও পারে যদি একটা হাত থাকত, আমি কি ধরতে পারতাম?”
সোহিনী লিখে—
“আমিও তো ভাবি। কিন্তু আমরা কি সেই মানুষ যারা একে অপরকে পাওয়ার জন্য বানানো? নাকি শুধুই ইনস্টার একরাতের গল্প?”
ঋভু বলে—
“তোমার পাঠানো গানগুলো শুনে যে ভোর নামে, সেটা কি শুধুই গল্প হয়?”
সোহিনী চুপ করে থাকে।
তারা কথা বলে সারা রাত। ভোরের দিকে ঋভু লেখে—
“তোমার যদি কোনোদিন মনে হয়, দেখা হওয়া দরকার, শুধু একটা কথা বলো—‘Break free.’ আমি ঠিক পৌঁছে যাব।”
সোহিনী আর কিছু লেখে না।
শুধু একটা গান পাঠায়—“Strangers in the night, exchanging glances…”
তাদের প্রেমের গল্পটা এখনও স্টোরির সাউন্ডে বাঁচে, ইনবক্সে জমে থাকা ছোট ছোট নীল বাক্সে। দেখা না হলেও তারা জানে—একটা জায়গা আছে যেখানে তাদের ভালোবাসা মুক্ত।
তারা হয়তো ইনবক্সে আটকে আছে।
কিন্তু…
তারা ঠিকই ভালোবাসে।
পর্ব ৩: “Seen”
সোহিনী হঠাৎ করেই বদলে গেছে। মানে ইনস্টা প্রোফাইলে হয়তো না, স্টোরির রংও সেই আগের মতোই—সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে সাদা মন, হালকা মিউজিক, একটা লাইন: “আজ আকাশটা মন খারাপ।” কিন্তু ইনবক্সে সোহিনী অনেক কম কথা বলে।
ঋভু সেটা বোঝে।
সে টের পায়—একটা দূরত্ব জমে উঠেছে যা না বলা প্রশ্নে ভরে গেছে।
একদিন সে সরাসরি লিখে—
“তুমি কি আমার ওপর বিরক্ত?”
সোহিনী তখন বেশ কয়েক ঘন্টা অনলাইনে ছিল, কিন্তু উত্তর দেয় না।
শুধু একটা নীল ছোট্ট লেখার নিচে লেখা থাকে—“Seen”
ঋভুর বুকটা ধ্বংসস্তূপের মতো লাগে।
সে জানে, ‘Seen’ মানেই সবসময় প্রতিক্রিয়া নয়, অনেকসময় প্রতিরোধও হয়।
দিন কেটে যায়।
তারা দুজনেই একে অপরের প্রোফাইলে ঢুকে দেখে—কেউ কাউকে আনফলো করেনি, কেউ কোনো ব্লক দেয়নি, অথচ চ্যাট বক্সে এক অদ্ভুত শূন্যতা।
ঋভু একদিন সাহস করে লিখে ফেলে—
“তুমি কি আমার জন্যই ইনবক্সটা চুপ করে রেখেছো?”
সোহিনী এবার রিপ্লাই দেয়।
“তুমি জানো, একদিন এক বন্ধু বলেছিল—ডিজিটাল ভালোবাসা হলো কাঁচের জানলা, যার ওপারে সবকিছু দেখা যায় কিন্তু ছোঁয়া যায় না। এখন বুঝি, সেটা সত্যি।”
ঋভু ব্যথা চেপে উত্তর দেয়—
“তুমি তো কখনও চাইলে না ছুঁতে, আমি তো চাইনি ছোঁয়ার দাবি রাখতে।”
সোহিনী দীর্ঘ এক টেক্সট পাঠায়—
“প্রতিদিন একটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। সকালে তোমার মেসেজ, রাতে তোমার গান। মাঝে মিম, হাসি, দুঃখ। কিন্তু জানো, মাঝে মাঝে মনে হয়—তুমি কি আছো? না কি শুধু তোমার প্রোফাইলটাই বেঁচে আছে?”
ঋভু থমকে যায়।
সে আস্তে করে লিখে—
“আমি বেঁচে আছি। তবে হয়তো ঠিকভাবে নেই। সোহিনী, আমি ক’দিন ধরেই একধরনের বিষাদে ডুবে আছি। কিছু বলতে পারছিলাম না। তুমি দূরে চলে যাবে ভেবেছিলাম। তাই চুপ ছিলাম।”
সোহিনী এবার বলে—
“দূরে তো আগেই চলে এসেছি। কেবল স্টোরির লিঙ্কগুলোই জুড়ে রেখেছিল আমাদের। জানো, একটা মেসেজ আসেনি তোমার, অথচ নতুন স্টোরি এসেছে—তা মানেই কি তুমি আমাকে ভুলে যাওনি, না কি সেটা শুধুই অভ্যাস ছিল?”
ঋভু লিখে—
“প্রেম হয়তো অভ্যাসেই পরিণত হয়। কিন্তু তুমি তো আমার অভ্যাস নও, তুমি আমার সেই অনুচ্চারিত ভোর, যে আমার গান হয়ে ওঠে। আমি ভেঙে পড়েছিলাম, সেটাই সত্যি।”
তারা চুপ থাকে কিছুক্ষণ।
তারপর সোহিনী একটাই লাইন লেখে—
“আমি এখন একটা গান শুনছি। শুনবে?”
ঋভু বলে—
“তুমি বললেই শুনি।”
সোহিনী ইউটিউব লিঙ্ক পাঠায়—“You Should Be Here” by Kehlani.
গানটা শেষ হলে ঋভু চোখ বন্ধ করে বলে—
“আমি এখানে আছি। হয়তো দেখা হবে না কোনোদিন। কিন্তু আমি থাকি, ঠিক এই ইনবক্সের মধ্যে। ওই Seen-এর নিচে। তোমার অপেক্ষায়।”
সোহিনী জানে, কথাটা সত্যি।
তারা হয়তো সেলফি নেয়নি, হাতে হাত রাখেনি, রেস্টুরেন্টে চা খায়নি, কিংবা বইয়ের দোকানে একসাথে ঘুরেওনি।
কিন্তু তারা ভালোবেসেছে। একপ্রকার চুপ থাকা ভালোবাসা।
যেখানে চ্যাটের শেষ শব্দ “Seen”, আর মানে হয়—
“তুমি এখনো আমার মধ্যে আছো।”
পর্ব ৪: “স্টোরির পেছনে যে মুখ”
শনিবার রাতে ইনস্টাগ্রামের আলো-আঁধারি স্ক্রল করতে করতে সোহিনী একটা নতুন ফিচার খুঁজে পেল—“Close Friends Only Stories।” একটা ফিচার, যার মানে—সবাইকে নয়, কাউকে বিশেষভাবে দেখা দেখানোর মতো গল্প। সে অনেক ভেবে একটা ছবি তোলে—মাথা হেলানো, চোখে চশমা, ব্যাকগ্রাউন্ডে লাইট ভাঙা আলোয় হাসছে। নিচে ছোট করে লেখে—“এই ছবিটা তার জন্য, যে কখনোই আমাকে পুরো দেখেনি, কিন্তু সবটা বুঝেছে।”
আর সেটাই সে পোস্ট করে Close Friends লিস্টে—যেখানে মাত্র একজন, ঋভু।
সোহিনী জানে, ঋভু দেখবেই।
এক ঘণ্টা পরেই ইনবক্সে মেসেজ আসে—
“তুমি কি হেসেছিলে? না কি শুধু ক্যামেরার জন্য?”
সোহিনী লেখে—
“তুমি দেখেছো?”
“হ্যাঁ, দেখেছি। অনেকবার দেখেছি। মনে হচ্ছিল, এই ছবিটার ভেতরে লুকিয়ে আছে অনেক না বলা কথা।”
সোহিনী একটু থেমে টাইপ করে—
“তুমি তো আমার মুখ কখনো দেখোনি, তাই না? ওই ছবিটাতেই প্রথমবার চোখে চোখ পড়ল। কেমন লাগল?”
ঋভু উত্তর দেয়—
“মনে হল, আমি চ্যাট না করে যদি সামনে বসে তোমার কথা শুনতাম, তাহলে তুমি এমনভাবেই তাকাতে। মুখে কিছু না বলেও আমার ভিতরটা দেখে ফেলতে।”
তারপর দুজনে অনেকক্ষণ চুপ থাকে।
চ্যাটের ওই নিঃশব্দ সময়টাও তারা ভাগ করে নেয়।
আসলে ইনবক্সে প্রেম মানেই শুধু লেখা নয়—চুপ করে থাকা, লেখা না লেখা, একটা Seen, একটা তিনটে ডটের ওঠানামাও ভালোবাসা।
ঋভু লিখে—
“সোহিনী, আমি একটা কথা বলব?”
“বলো।”
“আমার মনে হয়, আমি যেভাবে তোমাকে কল্পনা করেছি—তোমার গলা, তোমার অভিমান, তোমার গানপাগলামি—তুমি ঠিক সেরকমই। এমনকি ছবির চেয়ে বেশি।”
সোহিনী বলে—
“তোমার কল্পনাগুলো কী রকম ছিল?”
“একটা মেয়েকে ভাবতাম, যে রাতে ঘুমোবার আগে একটা গানের শেষ লাইনে কান রাখে, আর মনে মনে ভাবে—কে যেন ওর জন্য অপেক্ষা করছে। সে মেয়েটা নিজের ভয়গুলো কাউকে বলে না, কিন্তু কারও একটা ‘আজকের গানটা তোমার জন্য’ শুনলেই ভেঙে পড়ে। সে মেয়েটা তুমি।”
সোহিনী এবার চুপ করে যায়।
তারপর হঠাৎ একটা ভয়েস মেসেজ পাঠায়। প্রথমবার।
গলায় কাঁপন, কিন্তু স্বর স্পষ্ট—
“এই গলা, এই মেয়েটা, আসলে বাস্তব। কিন্তু জানো, আমি খুব ভয় পাই। যদি কখনো দেখা হয়ে যায়, যদি সবকিছু ভেঙে পড়ে? যদি আমাদের ইনবক্সটা বাস্তবে রূপ নিলে সবটাই কৃত্রিম মনে হয়?”
ঋভু তৎক্ষণাৎ লিখে—
“আমি চাই না কিছু ভাঙুক। তাই তো এখনও তোমার ছবি সেভ করিনি, ফোন নম্বর চাইনি, ভিডিও কল করিনি। আমি চাই, তোমার ওই মেসেজের শব্দগুলোর মধ্যেই থাকুক সবকিছু। স্টোরির পেছনে যে মুখ, তাকে আমি শুধু অনুভব করতে চাই।”
সোহিনী হালকা হেসে লেখে—
“তুমি কি জানো, আমার সবচেয়ে প্রিয় মুহূর্ত কোনটা?”
“বলো।”
“যখন দেখি তোমার নাম পাশে লেখা—Typing…”
ঋভু জবাব দেয়—
“আর আমার প্রিয় মুহূর্ত? যখন বুঝি, আমার প্রতিটা টেক্সট তুমি চোখে চোখে রাখো। আর ইনবক্সটাই হয়ে ওঠে আমাদের নিরালা গল্পের ঘর।”
সেই রাতে আর কোনো নতুন গান যায় না, কোনো মিমও না।
শুধু একটা স্ক্রিনে দুটো মানুষ চুপচাপ বসে থাকে, না দেখা ভালোবাসায়।
পর্ব ৫: “তোমার মেসেজ আসবে, জানতাম”
রবিবার সকালটা যেন একটু বেশিই নরম। জানলার কাঁচে জমে থাকা শিশিরের মতো মন। সোহিনী ঠিক সেদিনই ভাবে, আজ আর কোনো মেসেজ পাঠাবে না। অনেকদিন ধরে ওই-ই তো করছে—আগে লেখা, আগে গান পাঠানো, আগে হেসে ফেলা। আজ সে কিছু বলবে না, কিছু পাঠাবে না।
মনে মনে ভাবে, যদি ঋভু লেখে…
একটা ঘণ্টা কেটে যায়। তারপর দুটো। ইনস্টার নোটিফিকেশন দেখে চোখ যায়—না, কোনো নতুন স্টোরি নেই, মেসেজও না।
হঠাৎ দুপুর দেড়টায় ফোন স্ক্রিনে একটুখানি আলো—
“ঋভু: তোমার মেসেজ আসবে, জানতাম। কিন্তু আজ আসেনি।”
সোহিনীর ঠোঁটে একচিলতে হাসি।
সে জবাব দেয়—
“আমি চেয়েছিলাম তুমি লেখো। ভাবছিলাম যদি না লেখো, তাহলে বুঝব, তুমি ক্লান্ত।”
ঋভু লেখে—
“না, ক্লান্ত না। বরং ভীষণ তৃষ্ণার্ত। তোমার একটা মেসেজের জন্য।”
সোহিনী খুব আস্তে করে লেখে—
“তুমি কি ভাবো, একদিন আমরা এমন একটা জায়গায় বসে থাকব, দুজনেই ফোন হাতে কিন্তু মেসেজ না করে চুপচাপ পাশে বসে থাকব?”
ঋভু বলে—
“ভেবেছি বহুবার। একটা ঘর, জানলার পাশে বসে থাকা তুমি, তোমার পাশে আমি। তুমি হেডফোনে গান শুনছ, আর আমি তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবছি—এই মেয়েটাই আমার ইনবক্সের ভিতর লুকিয়ে ছিল।”
সোহিনী এবার প্রশ্ন করে—
“তুমি কি কখনও সত্যিই চেয়েছো দেখা করতে?”
ঋভু একটু সময় নেয়।
তারপর উত্তর দেয়—
“হ্যাঁ। কিন্তু ভয় পেয়েছি। যদি তোমার বাস্তব রূপটা আমার কল্পনাকে ভেঙে দেয়?”
সোহিনী লেখে—
“আর যদি আমার কল্পনার ঋভু হঠাৎ সামনে এসে পড়ে, আর আমি তাকিয়ে দেখি, ইনবক্সের সেই মায়া আর নেই?”
দুজনে একসঙ্গে ভয় পায়।
ভয়, যে সম্পর্কটা এত নিঃশব্দে গড়ে উঠেছে, সেটা হয়তো শব্দের চেয়ে বাস্তবতায় বেশি নড়বড়ে।
ঋভু বলে—
“তবে একটা কথা বলি, সোহিনী?”
“বলো।”
“তুমি আমার দেখা না হওয়া প্রেম। হয়তো এই পৃথিবীর কোনো স্টেশনেই আমাদের দেখা হবে না, কিন্তু প্রতিদিন সকালে ইনবক্সে তোমার একটা টেক্সট পাওয়ার আশায় আমি জেগে উঠি। তুমি জানো তো?”
সোহিনী একটাই লাইন লেখে—
“তোমার মেসেজ আসবে, জানতাম।”
ঋভু এবার একটা নতুন মেসেজ পাঠায়—
“আজ একটা গান তোমার জন্য লিখেছি। পুরোটা হয়নি, কিন্তু লাইনটা শুনবে?”
“শুনবো।”
“‘যতদিন দেখা হবে না, থাকুক এই চ্যাটে আমার ছোঁয়া / ইনবক্সের ভেতরে জমে থাকুক, তোমার ঠোঁটের খোলা কথা।’”
সোহিনী হেসে ফেলে।
“তুমি তো একদিন কবিও হয়ে যাবে!”
“না। আমি শুধু তোমার পাঠানো গানগুলো নিয়ে যেভাবে ভাবি, সেভাবেই লিখে ফেলি কিছু।”
সেদিন বিকেলটা কেটে যায় এভাবেই—টেক্সটের লাইন, কয়েকটা থেমে থাকা টাইপিং, একটুখানি অপেক্ষা।
তাদের প্রেমটাও এমনই—নিরব, কিন্তু নিশ্চিত।
যেন চা ঠান্ডা হয়ে গেলেও ভালোবাসা গরম থাকে।
পর্ব ৬: “এই গানটা শুধু তোমার জন্য”
সন্ধ্যা তখন ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে, জানলার বাইরের বাতিগুলো এক এক করে জ্বলে উঠছে। সোহিনী ঘরের কোণে বসে ল্যাপটপে একটা অ্যাসাইনমেন্টের টাইপ করতে করতে ঘন ঘন ইনস্টা খুলে দেখছিল—ঋভুর কোনো নতুন স্টোরি এসেছে কি না। আসেনি।
তবু সে অপেক্ষা করে।
হঠাৎ রাত ৮:৪২-তে ইনবক্সে একটা মেসেজ আসে—
“আজ একটা গান খুঁজে পেয়েছি, এমন গান তুমি আগে শুনোনি। এই গানটা শুধু তোমার জন্য।”
সঙ্গে সঙ্গে একটা ইউটিউব লিঙ্ক—
🎵 Peter Sandberg – Deep
সোহিনী চোখ বন্ধ করে গানটা চালায়। একটা পিয়ানোর সুর, মাঝরাতে একটা নদীর মতো বইছে।
মেসেজের নিচে লেখা ছিল—
“এই সুরটা শুনে তোমার কথা মনে পড়ল। ঠিক যেমন তুমি কথা না বলেও অনেক কিছু বলে ফেলো।”
সোহিনী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর লেখে—
“তুমি কি জানো, আমিও একটা গান খুঁজছিলাম আজ। কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিল, কোনো সুরই আমার মনের মতো নয়। অথচ তুমি পাঠালে এটা… ঠিক যেন আমার হৃদয়ের শব্দ।”
ঋভু বলে—
“তুমি জানো, আমি যখন তোমাকে গান পাঠাই, তখন শব্দে তোমার মুখ ভাবি। মনে হয়, তুমি যেন ঠিক ওই লাইনটায় একটু চোখ বুজে হাসছো।”
সোহিনী হেসে ফেলে।
“আমার হাসি তো তুমি কখনো দেখোনি।”
“না, কিন্তু আমি শুনতে পেয়েছি। মেসেজের ফাঁকে, Voice Notes-এর থেমে যাওয়া নিঃশ্বাসে, মাঝরাতের Goodnight টেক্সটের ইমোজির পাশে।”
একটু থেমে আবার লেখে—
“সোহিনী, আমি মাঝে মাঝে ভাবি, আমরা কি শেষ পর্যন্ত শুধু ইনবক্সেই থাকব?”
সোহিনী লেখে—
“তুমি চাইলে, একদিন দেখা হতেই পারে। কিন্তু জানো, তখন যদি আমাদের কথার খেই হারিয়ে যায়? যদি ইনবক্সের সেই মিষ্টি, ছোট ছোট জবাবগুলো আর না থাকে?”
ঋভু বলে—
“হয়তো হারিয়ে যাবে। কিন্তু যদি তা না হারায়? যদি বাস্তবে বসে আমরা একসঙ্গে গান শুনতে পারি? তখন তো ইনবক্সও স্মৃতি হয়ে থাকবে।”
সোহিনী ভাবে, ঋভুর কথার মধ্যে একটা সাহস আছে, আবার একটা ভয়ও।
সে লেখে—
“তুমি তো সবসময় বলো, ‘Break Free’। আজ যদি আমি বলি—এসো, তাহলে তুমি আসবে?”
ঋভু লেখে—
“আসবো। কিন্তু জানো, আমি চেয়েছি এই প্রেমটা থাকুক নিখুঁত। তোমাকে না দেখেই ভালোবেসে ফেলেছি—তোমার চিন্তাধারা, তোমার টাইপিংয়ের ভঙ্গি, স্টোরিতে দেয়া গানের লাইন, তোমার বিরক্ত মুখের ইমোজি। যদি দেখা করে ফেলে ফেলি কোনো কৃত্রিমতা?”
সোহিনী বলে—
“কিন্তু যদি দেখা করেই কৃত্রিমতার ভয়টা ভেঙে দিই?”
ঋভু তখন চুপ করে থাকে।
দুজনে আবার সেই গানটা শোনে—পিয়ানোর সুর।
গানের মাঝেই সোহিনী হঠাৎ মেসেজ পাঠায়—
“এই গানটা শুধু তোমার জন্য—কারণ তুমি ছাড়া কেউ আমাকে এভাবে বোঝেনি।”
আর তারা একসঙ্গে একটা গান শোনে—
দূরে, আলাদা শহরে, আলাদা বিছানায় শুয়ে।
কিন্তু হৃদয়ের মাঝে একটা সুর বাজে একসঙ্গে।
এটাই তো প্রেম—না দেখা, না ছোঁয়া, কেবল অনুভব।
পর্ব ৭: “Unsend করো না, আমি পড়ে ফেলেছি”
রাত তখন ১টা ১৭। জানলার বাইরে দূর থেকে ট্রেনের হুইসেল শোনা যায়। সোহিনী ফোনটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে ইনস্টাগ্রামের ইনবক্সে। নতুন কোনো মেসেজ নেই।
হঠাৎ সে impulsively একটা লম্বা টেক্সট টাইপ করে—
“আমার মনে হয়, আমি তোমায় ছাড়া আর কাউকে এভাবে বিশ্বাস করিনি। হয়তো আমরা কোনোদিন একসঙ্গে হাঁটব না, কিন্তু তুমি জানো, তোমার Voice Note শুনে আমার মন শান্ত হয়ে যায়। ভালো থেকো, ঋভু। আর হ্যাঁ, আমি বোধহয় তোমায়… খুব ভালোবাসি।”
তারপর ভয় করে।
তড়িঘড়ি করে টেক্সটটা Unsend করে দেয়।
ঠিক তখনই ইনবক্সে মেসেজ আসে—
“Unsend করো না, আমি পড়ে ফেলেছি।”
হাতটা কেঁপে ওঠে সোহিনীর।
“তুমি…?”
“হ্যাঁ। আমি চোখের সামনে দেখলাম—তুমি টেক্সট করলে, তারপর সরিয়ে নিলে। আমি পড়ার আগেই দেখেছিলাম—‘ভালোবাসি’ শব্দটা।”
সোহিনী মৃদু গলায় লিখে—
“আমি তো ভয় পেয়েছিলাম।”
ঋভু লেখে—
“ভয় পাওয়ার মতো কিছু নয়। আমি প্রতিদিন তোমার voice, তোমার typing, তোমার হেসে লেখা reply-এর প্রেমে পড়ি। Unsend করে তুমি শুধু screen থেকে সরালে, মন থেকে না।”
সোহিনী এবার চোখ ভিজে যায়।
তারপর সে একটা Voice Note পাঠায়—এই প্রথম, কোনো গান নয়, কোনো লাইন নয়, শুধুই নিজের স্বর—
“তুমি জানো, ঋভু, আমি অনেকবার ভাবি তোমার ছবি দেখে ফেলি। একটা real image। কিন্তু আমি পারি না। আমি চাই না আমার কল্পনার ভেতরকার তুমিটা বদলে যাক। সেই ঋভু, যে আমার লেখা গানের লাইনে meaning খোঁজে, যে চুপচাপ Seen করে, তারপর একটা গানের লিঙ্ক পাঠায়—সেই ছেলেটাই আমার হৃদয়ের আলোকপাত।”
ঋভু জবাব দেয়—
“তোমার জন্য আমিও আমার Profile Picture বদলাই না। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলি—ওই পেইজটা শুধু একজনের জন্য। যে দেখে, কিন্তু screenshot নেয় না। যে পড়ে, কিন্তু Judge করে না।”
একটা নীরবতা নেমে আসে চ্যাটে। কিন্তু সেই নীরবতাও যেন একরকম ভালোলাগায় ভরা।
সোহিনী আবার লেখে—
“Unsend করব না আর। যা বলব, বলব স্পষ্ট করে। আজ থেকেই।”
ঋভু লেখে—
“তবে আমিও বলি—তোমার Voice Notes আমার দিন শুরু করার গান। তুমি আমার ইচ্ছে না পূরণের গল্প, তবু মন ভরা প্রাপ্তি।”
সোহিনী এবার একটা লাইন লেখে—
“তুমি না থাকলে হয়তো আমি বিশ্বাস করতাম না, যে চ্যাটেও প্রেম হয়।”
ঋভু হেসে পাঠায়—
“আর আমি তোমায় না পেলে বুঝতেই পারতাম না, ‘Seen’ মানে শুধু পড়ে ফেলা নয়, অনেকটা ভালোবাসাও।”
রাত বাড়ে। তারা কথা বলে না আর। শুধু একে অপরের last seen দেখেই বুঝে নেয়—এই তো, এখনও আছে। এখনও পাশে।
একটা না বলা মেসেজের মাঝেও অনেকটা বলা হয়ে যায়।
পর্ব ৮: “আমাদের প্রেম স্ক্রিনশট হয় না”
সোমবার সকালটা একটু অদ্ভুতভাবে শুরু হয়। ইনস্টাগ্রামে ঢুকে সোহিনী দেখে, ঋভুর প্রোফাইলে একটা নতুন পোস্ট এসেছে—ছবি নয়, রিল নয়—শুধু একটা নোট।
“তোমার ইনবক্সেই রয়ে যেতে চাই। কারণ আমাদের প্রেমটা স্ক্রিনশট হয় না।”
লিখে—@scribbledsoul77
সোহিনীর গা শিউরে ওঠে।
এই প্রথম ঋভু কিছু পোস্ট করল যা কারও জন্য নয়, শুধুই তার জন্য। না ট্যাগ করে, না নাম লিখে, তবু এই শব্দগুলো এত তার পরিচিত লাগে যে মনে হয় আয়নার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
সে রিপ্লাই করে—
“তুমি কি জানো, এই কথাগুলো পড়ে আমার মনে হল, আমাদের সম্পর্কটা হলো সেই চায়ের কাপে জমে থাকা শেষ চুমুক—গরম না, ঠান্ডা না, কিন্তু ঠিক ঠিক অনুভূত।”
ঋভু লেখে—
“তোমার সাথে আমার প্রতিটা মুহূর্ত একটা টাইপিং বক্সে আটকে থাকে, কিন্তু তাও তুমি যেন আমার কণ্ঠে গেঁথে যাও। কেউ জানে না আমরা কে, কোথা থেকে, কীভাবে—তবু আমাদের একটা ‘তোমার জন্য গান’, একটা ‘আজকের দিনটা কেমন’ আছে।”
সোহিনী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
তারপর লেখে—
“তুমি কি জানো, আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি তোমার voice save করে রাখতে। কিন্তু পারিনি। কারণ আমার ভয়—যদি তুমি আর না থাকো, সেই রেকর্ড শুনে কাঁদতে থাকি।”
ঋভু লেখে—
“আমি চাই না আমার voice তোমার ফোনে থাকুক, আমি চাই আমার voice তোমার মনেই বাজুক।”
সেই সন্ধ্যেতে দুজনেই একসঙ্গে কিছু না বলেও অনেক কিছু বলার মতো অনুভব করে।
ঋভু হঠাৎ করে একটা Screenshot পাঠায়।
Insta Chat Box। ওপরের দিকে লেখা—Conversation with ScribbledSoul77, started 194 days ago.
সঙ্গে একটা টাইপ করা লাইন—
“১৯৪ দিন, একটাও দেখা না, একটাও ফোন না—তবু আমার সবচেয়ে গভীর প্রেম এখানেই।”
সোহিনী এবার চোখের কোণে জল চেপে লেখে—
“তোমাকে প্রতিদিন না দেখে ভাবি, যদি দেখা হত… যদি হ্যান্ডশেক হত, কিংবা কফি শেয়ার করা হত, হয়তো এত গভীর কিছু গড়ে উঠত না। এই যে আমাদের অদৃশ্য বন্ধন—এটাই তো আমাদের প্রেমের স্পর্শ।”
ঋভু লেখে—
“তুমি জানো, এই পৃথিবীতে হয়তো হাজার প্রেম হয়, কিন্তু ক’জন এমন হয়, যারা একটা ইমোজি দিয়ে কান্না বোঝায়, একটা গান দিয়ে ভালোবাসা?”
সোহিনী একটা ছবি পাঠায়। নিজের হাতের ছবি—তর্জনিতে আঙুলে লেখা—“R for Real, V for Virtual”
সঙ্গে একটা ক্যাপশন—
“আমাদের প্রেমটা হয়তো ভার্চুয়াল, কিন্তু অনুভবটা ছিল বাস্তবের চেয়েও বেশি সত্যি।”
সেই রাতে কোনো চ্যাট হয় না। তারা শুধু নিজেদের পুরনো মেসেজগুলো স্ক্রল করে।
প্রতিটা Voice Note, প্রতিটা “Seen”, প্রতিটা রিপ্লাই—
হয়তো এভাবেই প্রেম জমে থাকে ক্লাউডে।
একটা ইনবক্স, যেখানে ভালোবাসা টাইপ করা হয়।
কিন্তু… স্ক্রিনশট হয় না।
পর্ব ৯: “একদিন হঠাৎ চ্যাটটা বন্ধ হয়ে যায়”
তারিখটা ছিল ২১শে মার্চ। ঠিক রাত ১১টা ৪৬। সোহিনী একটা গান পাঠিয়েছিল—Sleeping at Last – Saturn। সঙ্গে ক্যাপশন—
“তুমি শুনে নিও, যদি কখনো সব থেমে যায়।”
ঋভু উত্তর দেয়নি।
সাধারণত রাতের কোনো না কোনো সময় একটা রিপ্লাই আসে। একটা স্টিকার, একটা লাইন, না হলে অন্তত “❤️” রিঅ্যাকশন। কিন্তু সেদিন আসেনি কিছুই।
সোহিনী ভেবেছিল, হয়তো ফোন দূরে আছে, হয়তো মন ভালো নেই। হয়তো সেও ভাবছে—আজ না, কাল বলব।
কিন্তু পরদিন, ইনস্টাগ্রামে ঢুকে সে দেখে—@scribbledsoul77 আর একটিভ নেই।
অ্যাকাউন্টটা “User Not Found।”
হাত কেঁপে ওঠে।
সেই স্ক্রিনে এতদিন ধরে যে একটা সম্পর্ক ছিল, একটা জীবন্ত ছায়া, একটা অপরিচিত অথচ চেনা হৃদয়—তা যেন হঠাৎ এক নিমেষে মুছে গেল।
সে বারবার চেক করে—Search বার, ডিএম লিস্ট, পুরনো রিলের রিঅ্যাকশন—সব জায়গা থেকে সে নেই।
Unfollow হয়নি, ব্লকও না। হয়তো… ঋভু ডিলিট করেছে প্রোফাইল।
সোহিনী কিছুক্ষণ ফোনটাকে তাকিয়ে থাকে। তারপর নিজেই একটা নোট লিখে পোস্ট করে নিজের প্রোফাইলে—
“একটা চ্যাট ছিল, যেটা সেভ হয়নি, কিন্তু প্রতিটা মেসেজ এখনো হৃদয়ে বাজে।”
দিন কেটে যায়।
রাতের পর রাত সোহিনী চ্যাটবক্স খুলে বসে থাকে। পুরনো গানগুলো শোনে, পুরনো Voice Note-গুলো মনে করে—যেগুলো সে কখনও সেভ করেনি।
তার মনে পড়ে, ঋভু বলেছিল—
“তুমি যদি কোনোদিন মেসেজ না পাও, ভাববে না আমি চলে গেছি। ভাববে, আমি pause দিয়েছি—স্মৃতি হয়ে থাকব তোমার inbox-এর সেই typing cursor-এর মতো। দেখা না গেলেও জানবে, আমি আছি।”
সেই কথা আজ যেন বুকের ভেতর পাথরের মতো বসে।
একদিন হঠাৎ, চারদিন পর, সোহিনী একটা নতুন মেসেজ পায়।
প্রোফাইল নতুন—@rhythm.in.exile
ডিপি নেই, ফলোয়ার কম, কিন্তু প্রথম মেসেজটা লেখা—
“তুমি কি এখনো ওই গানটা শোনো? Saturn?”
সোহিনীর চোখে জল চলে আসে।
“তুমি?”
“আমি pause দিয়েছিলাম, হারিয়ে যাইনি। চারদিন ফোন ছুঁইনি। নিজেকে খুঁজছিলাম। কিন্তু জানতাম, ফিরে আসব ঠিক। কারণ তোমার কাছে ফেরার মতো আর কোনো জায়গা নেই আমার।”
সোহিনী কিছু বলে না, শুধু একটা লাইন টাইপ করে—
“একটা মেসেজে ফিরতে পারে কেউ? হ্যাঁ, যদি সে হয় আমার ইনবক্সের প্রেম।”
ঋভু লেখে—
“তুমি তো জানোই, আমি না থাকলেও, তোমার টাইপিং cursor-এ আমি থাকি। নতুন ইনবক্সে, পুরনো ভালোবাসা নিয়ে ফিরলাম।”
সেই রাতে তারা আবার শুরু করে—গান, গল্প, Voice Note, হেসে ফেলা মিম।
একটা চ্যাট হয়তো বন্ধ হয়েছিল, কিন্তু সম্পর্কটা কখনও মুছে যায়নি।
তারা বুঝে যায়—
এই যুগে সব কিছু মুছে গেলেও, ভালোবাসা বেঁচে থাকে আঙুলের ছোঁয়ায়।
পর্ব ১০: “যদি কখনো দেখা হয়”
সন্ধ্যা নামার আগে ফোনে একটা নতুন ইনস্টা নোটিফিকেশন আসে—@rhythm.in.exile added a new story. সোহিনী তৎক্ষণাৎ খুলে দেখে—
ছবিতে একটা পুরনো নীল ট্রাম, ভেতরে শূন্য সিট আর জানলার বাইরের দৃষ্টি। নিচে লেখা—
“যদি কখনো দেখা হয়, আমি ঠিক এমনভাবেই তাকিয়ে থাকব।”
সোহিনীর বুকের ভেতর হঠাৎ কেঁপে ওঠে কিছু।
সে একটাও রিপ্লাই না দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। তারপর এক গ্লাস জল খেয়ে ধীরে ধীরে ইনবক্সে গিয়ে একটা লাইন টাইপ করে—
“এই যদি তোমার চাওয়াই হয়, তবে একটা কথা বলি… যদি দেখা হয়, আমি কি ইনবক্সের মতো করে কথা বলতে পারব?”
ঋভু তৎক্ষণাৎ লেখে—
“তুমি বলবে। প্রথমে একটু চুপ করে থাকবে, তারপর নিজের মতো করে একটা গানের লাইন বলবে, আর আমি দেখব—আমার ফোনের পর্দার মানুষটা হঠাৎ রক্তমাংসে এসে দাঁড়িয়েছে আমার সামনে।”
সোহিনী হাসে।
“আর যদি ভয় পাই?”
“তবে আমি বলে দেব—চলো, আবার ইনবক্সে ফিরে যাই। বাস্তবের দুনিয়া তোমায় না মানলেও, আমি তো জানি তুমি কে।”
কয়েক মুহূর্তের নীরবতা।
তারপর সোহিনী লেখে—
“এই যে এতদিন ধরে আমরা গল্প লিখলাম, প্রতিটা টাইপিং, প্রতিটা Seen, প্রতিটা গান, প্রতিটা ইমোজির মাঝখানে—একটা প্রেম গড়ে উঠল, যেটা কোনোদিন Real life-এ হ্যান্ডশেক পায়নি, কিংবা Coffee Table-এ জায়গা পায়নি… এটাই আমাদের গল্প।”
ঋভু লেখে—
“তোমার জন্য আমি নতুন ইনবক্স খুলেছি, পুরনো স্মৃতি নিয়ে ফিরেছি। এখন চাই, তুমি যেন জানো—তুমি শুধু আমার টাইপ করা শব্দ নও। তুমি আমার অনুভব।”
সোহিনী আবার প্রশ্ন করে—
“তবে কি আমরা কোনোদিন দেখব না?”
ঋভু এবার উত্তর দেয় না।
কেবল একটা Voice Note পাঠায়—তার গলায়, প্রথমবার, সেই কথা—
“যদি দেখা হয়, তুমি হেসে ফেলো, আমি কান্না চাপব না। যদি হ্যান্ডশেক হয়, জানব, আমার হাত আর তোমার হাতের মাঝখানে ১৯৪ দিনের গল্প গাঁথা। যদি দেখা না-ও হয়, জানবে, আমি সবসময় তোমার ইনবক্সেই ছিলাম, আছি, থাকব। ভালো থেকো, সোহিনী।”
তারপর অনেকক্ষণ কোনো মেসেজ আসে না।
সোহিনী স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ সেই তিনটে ছোট ছোট ডট ভেসে ওঠে—Typing…
আর লেখা আসে—
“Love, always — your unseen, unheard, unread rhythm.”
সোহিনী এবার আর কিছু লেখে না।
শুধু ফোনটা বুকের কাছে টেনে নেয়, চোখ বুজে গুনগুন করে সেই গানটা—
“This love will not break, though it never touched skin.”
কারণ প্রেমটা তো সত্যিই ছিল।
চ্যাটে, মিউজিকে, Inboxes-এ—একটা ভালোবাসা, যা কোনোদিন দেখা চায়নি, ছোঁয়া চায়নি, শুধু অনুভব করতে চেয়েছে।
শেষ।