দেবজয় ঘোষ
(এক)
কলকাতার উত্তর শহরের শোভাবাজার অঞ্চলে শীতকাল প্রবেশ করার আগেই বাতাসে একটা অদ্ভুত শিরশিরে অনুভব জাগে — যেন গলির অন্ধকার কোণাগুলো আরও গভীর হয়, পুরনো বারান্দাগুলো থেকে ছায়ারা লাফিয়ে পড়ে রাস্তায়। সেই শহরেরই এক কোণে, চৌবাগান স্ট্রিটের শেষ প্রান্তে পড়ে থাকা একটি পুরনো, বন্ধ হয়ে যাওয়া দুর্গা মণ্ডপ — “মিত্র চৌধুরী পরিবার মণ্ডপ” নামে পরিচিত — আজও বেঁচে আছে স্মৃতির মধ্যে, কিন্তু সকালের আলোয়ও কেমন ছায়াচ্ছন্ন লাগে। ঋদ্ধিমা রায়, কলকাতার এক সাহসী তদন্তকারী সাংবাদিক, বহুদিন ধরে এই স্থানটির গুজব নিয়ে শুনে এসেছে— আশ্বিন মাসের প্রতি দশমীর রাতে এখানে ঘটে কিছু অলৌকিক, তান্ত্রিক আচার, যেগুলোর স্বাক্ষী শুধু বাতাস আর মরা কাঠের মণ্ডপ। সে ঠিক করল, এবারের দুর্গোৎসবেই সে নিজে তদন্তে নামবে, প্রমাণ সংগ্রহ করবে, কারণ বছর খানেক আগে এক তরুণ ছাত্রীর নিখোঁজের খবর পাওয়া গিয়েছিল এই অঞ্চল থেকেই, কিন্তু কোনো মিডিয়া তার পেছনে তেমন আগ্রহ দেখায়নি।
ঋদ্ধিমা সন্ধ্যা নামার ঠিক আগেই তার ক্যামেরাম্যান সহকারী সায়ন বসুকে নিয়ে গলির ভেতর ঢুকে পড়ল। দুজনেই ক্যামেরা, ভয়েস রেকর্ডার ও একটি নোটবুক নিয়ে তৈরি। গলির মাথায় আলো থাকলেও এই পুরনো মণ্ডপের আশেপাশে পৌঁছাতেই একটা শীতল বাতাস গায়ে এসে লাগল, যেন শরৎকালের নয় — বরং কোনো মৃত সময়ের শ্বাস। মণ্ডপে ঢোকার দরজা অর্ধেক খোলা, ধাতব কারুকার্য ঢেকে গেছে ধুলো ও জালায়। ভেতরে ঢুকতেই তাদের দুজনের চোখ স্থির হয়ে যায়— প্রতিমা নেই, কিন্তু বেদীর মাঝে বসানো হয়েছে একটি বিশাল কাঠের আসন, তার চারপাশে কাঁচা সিঁদুরের রেখা, পোড়া ধুপের গন্ধ আর জ্বলন্ত একটি প্রদীপ। কে যেন এখানে এখনও নিয়মিত আগুন জ্বালে! সায়ন ফিসফিস করে বলে, “এ তো কেউ আছে…!” কিন্তু ঋদ্ধিমা এগিয়ে যায়, তার চোখ পড়ে বেদীর গায়ে আঁকা অর্ধেক-ভাঙা এক প্রতীক, যার মাঝখানে অদ্ভুত এক সাপের মতো বৃত্ত ও পাঁচটি বিন্দু। সে জানে, এটা কোনও সাধারণ মণ্ডল নয়— তন্ত্রবিদ্যার সঙ্গে এর সংযোগ রয়েছে। তখনই আচমকা, ছাদ থেকে এক সাদা কাপড় নেমে পড়ে মাটিতে — মনে হয় যেন কেউ উপরে দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেছে।
ঋদ্ধিমা আতঙ্কিত হলেও পিছু হটে না। সে ক্যামেরা চালু করে নিজে কথা বলতে শুরু করে— “এই মুহূর্তে আমরা রয়েছি শোভাবাজারের পুরনো মণ্ডপে, যেখানে রাত্রির ছায়া নামে আগে থেকেই। আমাদের চারপাশে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, আর এই বেদীতে যে প্রতীক আমরা দেখছি, তা বিশুদ্ধ কালতন্ত্রের লক্ষণ।” ক্যামেরার লেন্সে কিছু ধরা পড়ে না, কিন্তু সায়ন বলে, “দেখো, আলোটা কাঁপছে, অথচ বাতাস নেই।” ঠিক তখনই ঋদ্ধিমার কানের কাছে কারো নিশ্বাস পড়ার শব্দ আসে — স্পষ্ট, কিন্তু কাউকে দেখা যায় না। সে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল, আর চোখে পড়ল— মণ্ডপের এক কোণে, যেখানে ছায়া গাঢ় — সেখানে এক মহিলা, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন, পরনে শাদা শাড়ি, লাল পাড়। মুখ দেখা যায় না। ঋদ্ধিমা এগিয়ে গেলে মহিলা ধীরে মাথা তোলে — চোখদুটো যেন রক্তবর্ণ আগুনের মতো জ্বলছে। হঠাৎ সে মিলিয়ে যায় বাতাসে, আর মুহূর্তেই প্রদীপের আলো নিভে যায়। চারদিক অন্ধকার। একটা গলা যেন বলে ওঠে, “তুমি ফিরে এসেছো… চক্র আবার জাগবে। দশমী আসছে…”— এবং ঋদ্ধিমার পেনডেন্ট নিজে নিজেই গরম হতে থাকে, যেন কারো স্পর্শে জেগে উঠেছে। সেই রাতে, গলির বাইরে বেরিয়ে আসার পর তারা আর একবারও পেছনে তাকায় না। কিন্তু মণ্ডপের ছায়া, সেই নারীসত্তা, আর সেই রক্তরেখা — সবকিছু গভীরভাবে চিহ্ন ফেলে যায় ঋদ্ধিমার মধ্যে, এবং সে বোঝে, এই অনুসন্ধান শুধুই একটি রিপোর্ট নয় — বরং তার নিজের অতীত ও ভবিষ্যতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক অভিশপ্ত সেতু।
(দুই)
পরদিন সকালে ঋদ্ধিমা সেই অদ্ভুত রাতে দেখা ঘটনাগুলোর ভিডিও ফুটেজ পুনরায় পর্যবেক্ষণ করতে বসল, কিন্তু অবাক হয়ে দেখে— অনেক অংশেই ক্যামেরা হঠাৎ ঝাঁকুনি খেয়েছে, আলো নিভে গেছে, এবং সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার — সেই সাদা শাড়ি পরা মহিলার উপস্থিতির কোনও চিহ্ন ফুটেজে নেই। সায়নের ক্যামেরাতেও একই ঘটনা। অথচ তারা দুজনেই দেখেছে ও শুনেছে স্পষ্ট শব্দ, স্পষ্ট উপস্থিতি। এমনকি সায়নের রেকর্ডারে “তুমি ফিরে এসেছো… চক্র আবার জাগবে…” এই শব্দটুকু কেবল হালকা ইলেকট্রিক হিউম সহ শোনা যায়, যেন কোনও অনুচ্চারিত মন্ত্র। ঋদ্ধিমা বুঝতে পারে এটা শুধুই অতিপ্রাকৃত নয়— এ যেন কারো পরিকল্পিত আচার। সে ফিরে যায় তার দাদুর রেখে যাওয়া পুরনো বইগুলোয়, যেগুলোর কিছুতে তন্ত্রবিদ্যা সম্পর্কিত তথ্য ছিল। বহু খোঁজাখুঁজির পর সে একটা কাঠের বাক্সে খুঁজে পায় একটা পুরনো, ছেঁড়া কাগজ, যেখানে আঁকা আছে সেই প্রতীক — পাঁচ বিন্দু ও সাপের মতো পাকানো রেখা। নিচে লেখা: “নাগচক্রের চিহ্ন— আদিপঞ্চতত্ত্বকে বাঁধার চিহ্ন।”
এই “নাগচক্র” শব্দটি তার কানে এতদিন অজানা ছিল না। দাদু বলতেন, এটা এক নিষিদ্ধ তান্ত্রিক সংগঠন ছিল, যারা শক্তির পূজার আড়ালে আত্মিক বলি, চক্রমন্ত্র, ও দেহধারণের সাধনা করত। তারা বিশ্বাস করত, শক্তি হলো জীবন্ত রূপ— যাকে প্রণাম নয়, অধীনতা করতে হয়। ঋদ্ধিমা জানত, তার দাদু এই মতবাদের বিরোধিতা করতেন। তিনি বলতেন, “নাগচক্রের চিহ্ন একবার যেখানে আঁকা হয়, সেখানে শুধু রক্তেই তার মুছে যায়।” এই কথা শোনার পর থেকে, ছোটবেলায় সে মণ্ডপ, প্রতিমা কিংবা শ্মশানের ধারে গেলে বুক ধড়ফড় করত। সেই ভয় ভুলেই সে সাংবাদিকতায় এসেছে, যুক্তির ওপর বিশ্বাস রেখে। কিন্তু এখন, মণ্ডপের সেই রক্তচোখ, আগুনের পেনডেন্ট, অদৃশ্য নারীসত্তা— সব মিলিয়ে যেন দাদুর পুরনো কাহিনিগুলো বাস্তব হয়ে উঠছে। সে সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে যেতে হবে শহরের একটি মাত্র জায়গায়, যেখানে হয়তো সত্যি ইতিহাস পাওয়া যাবে — কলকাতা পুরাতত্ত্ব গ্রন্থাগার, কলেজ স্ট্রিটের ভেতরে এক নির্জন, ধূলিধরা কক্ষে।
গ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান বৃদ্ধ রমেশবাবু প্রথমে কিছু দিতে রাজি হন না, কারণ নাগচক্র নিয়ে যে বই আছে তা শুধুই রেফারেন্স সেকশনে — কেউ বাইরে নিতে পারে না। কিন্তু যখন ঋদ্ধিমা তার দাদুর নাম বলেন — বিভূতিভূষণ রায়, প্রাক্তন তান্ত্রিক গবেষক ও লেখক — রমেশবাবুর চোখে একটা আলাদা চমক জাগে। “আপনার দাদু তো একবার এই লাইব্রেরির অনেক জিনিস রক্ষা করেছিলেন। তার জন্যই এই বইগুলো আজও আছে।” তিনি একটা পুরনো কাঠের তাকের পেছন থেকে বের করে আনেন ধুলো-ধরা একটা চামড়া বাঁধানো রেকর্ড — “অশুভ তন্ত্রচক্র ও নাগবাঁধনের ইতিহাস”। বইটা খুলতেই ঋদ্ধিমা দেখে, একটা অধ্যায়ে লেখা — “ত্রিলোকেশ্বর মিশ্র: নাগচক্রের সর্বশেষ শিরোমণি, ১৯৬৫ সালে গায়েব — শোভাবাজার দুর্গামণ্ডপে শেষ দেখা গিয়েছিল।” এক মুহূর্তে সবকিছু ঠান্ডা হয়ে যায়। ত্রিলোকেশ্বর মিশ্র — এই নামটা যেন কিছুর ইঙ্গিত দেয়। বইয়ের শেষে একটি লাল কালি দিয়ে আঁকা পঙক্তি — “ত্রয়োদশী পূর্ণিমা ও দশমীর যুগ্ম লগ্নে নাগচক্র পুনরুদ্ধার সম্ভব, যদি পঞ্চতত্ত্ব অধিষ্ঠিত হয় একই স্থানে।” এবং তার নিচে আঁকা সেই প্রতীক — আগুন, জল, বায়ু, মৃত্তিকা ও আকাশ— পঞ্চতত্ত্বের সংকেতযুক্ত বিন্দু, যার কেন্দ্রবিন্দুতে একটি চোখ — ‘চক্ষুরূপী সত্তা’। সেই চোখ যেন… সেই রাতে মণ্ডপে দেখা রক্তচোখ! ঋদ্ধিমা জানে, তার সময় খুব কম — কারণ চলতি আশ্বিন মাসে পূর্ণিমা ও দশমী একই দিনে পড়ছে, আর সেই বিরল লগ্ন ৩০ বছরের মধ্যে এই প্রথম ঘটবে। সে জানে, কিছু একটা ফিরে আসছে — এবং সে নিজে হয়তো শুধু অনুসন্ধানকারী নয়, সেই চক্রের ভেতরের কেউ।
(তিন)
কলকাতার গলির ধারে বসে থাকা ফুলওয়ালারা শহরের সবচেয়ে কম নজরে পড়া মানুষ — কিন্তু শহরের সবচেয়ে পবিত্র ও সবচেয়ে অন্ধকার জায়গাতেও তারাই সবার আগে পৌঁছয়। ঠাকুরের পুজো, বিবাহ, শ্রাদ্ধ, কিংবা কোনও গোপন রাতের যজ্ঞ — সবকিছুতেই প্রয়োজন এই ফুল, এই মানুষগুলো। ঋদ্ধিমা যখন ফের মণ্ডপঘাটার আশপাশে তথ্য খুঁজতে যায়, তখনই তার চোখে পড়ে এক ফুলের দোকান, নাম নেই, শুধু একটা কাঠের পিঁড়িতে বসে থাকা এক মধ্যবয়সী মানুষ, যার পরনে সাদা ধুতি আর গা ঘেঁষা ধূলিধরা পাঞ্জাবি। তার গলা অবধি দাড়ি, কপালে সিঁদুরের ছোট্ট টিপ, কিন্তু চোখজোড়া যেন কাঁচের মতো — স্বচ্ছ, অথচ উঁকি দিয়ে যেন কিছু কালো স্রোত ভেসে আসে। দোকানটায় থেমে ফুল নেয় ঋদ্ধিমা, এবং লোকটি হালকা হাসি দিয়ে বলে, “আপনার পেনডেন্টটা খুব পুরনো লাগছে, মেয়েমণি… কোথা থেকে পেলেন?” প্রশ্নটা সরল শোনালেও, শব্দগুলো কেমন যেন অতিরিক্ত ধীরে উচ্চারিত — যেন প্রতিটা ধ্বনি কাউকে জাগাতে চায়। ঋদ্ধিমা সামান্য চমকে উঠে উত্তর দেয়, “পারিবারিক স্মৃতি, দাদুর।” তখন লোকটি আরেকটু এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলে, “দাদু কি বিভূতিভূষণ রায়?” মুহূর্তে তার মুখ কেঁপে ওঠে — কীভাবে জানে এই লোক?
ঋদ্ধিমা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে লোকটি নিজের নাম বলে — “আমি অচিন্ত্য ব্যানার্জী। অনেক আগে আপনার দাদুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। একসময় আমি তাঁকে অনুসরণ করতাম — কিছু সত্য খোঁজার জন্য।” সে আর কিছু না বলে আবার ফুল গোছাতে ব্যস্ত হয়। কিন্তু ঋদ্ধিমার মনে কেমন অস্বস্তি জাগে, যেন এই লোকটির কথার নিচে অন্য সুর বাজছে। সে সায়নের সঙ্গে মিলে লোকটিকে নজরে রাখতে শুরু করে। কয়েক রাত পরে, পূজোর অষ্টমীর আগের দিন, তারা দেখে — অচিন্ত্য ফুলের দোকান গুটিয়ে মধ্যরাতে একা মণ্ডপের দিকে যাচ্ছে। গলির প্রতিটা বাতি নিভে আসে, আর তারা ধীরে ধীরে অনুসরণ করে। মণ্ডপে পৌঁছে দেখে — অচিন্ত্য একা একা মণ্ডপের ভেতরে প্রবেশ করেছে, সঙ্গে এক কাপড়ের থলি। তারা জানালার ফাঁক দিয়ে দেখে — অচিন্ত্য বেদীর সামনে বসে, চারপাশে আগুন জ্বেলে ধূপ ধুঁয়েছে, তারপর থলি থেকে বের করছে হাড়, লাল সিঁদুর, আর একটা ছোট্ট মানুষের আঙুলের হাড়ের মালা। সে মন্ত্র পড়ছে এক ছন্দে — “ওঁ হ্রিম নাগশক্তি চক্রে নমঃ। অন্তঃ তন্ত্র, বাহ্য রক্ত। চক্ষু জাগ্রত হোক…”
ঋদ্ধিমার শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়, এবং হঠাৎ পেছন থেকে কারা যেন ছায়ার মতো ঘুরতে থাকে — ৩-৪ জন মানুষ, যাদের মুখ ঢাকা, পোশাক কালো, চোখে সাদা সুতার ফিতে। সায়ন কাঁপা গলায় বলে, “এ তো কোনও ফুলওয়ালা নয়… এ তো তান্ত্রিক। আর এই চক্র… এগুলো মানুষ নয়। চক্রের লোক।” তাদের সামনে হঠাৎ আগুনের আঁচ বেড়ে যায়, যেন কেবল আগুন নয় — সাদা আলোয় কেউ জেগে উঠছে। অচিন্ত্য তখন বলে, “ত্রিলোকেশ্বর গুরুদেব, আশ্বিন লগ্ন আবার ফিরে এসেছে। এবার আপনার আগমনের প্রস্তুতি শুরু।” শব্দগুলো শেষ হতেই বেদীর ওপরের বাতাস কাঁপে, আর একটা অদৃশ্য ছায়া ধীরে ধীরে মণ্ডপের ছাদ থেকে নেমে আসে — তার শরীর দেখা যায় না, শুধু চোখদুটো আগুনের মতো জ্বলছে, আর চারপাশে বাতাস ভারী হতে থাকে ধূপ আর সিঁদুরের গন্ধে। ঠিক তখনই সায়নের হাতে ধরা ক্যামেরা নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে যায়। ঋদ্ধিমা পেনডেন্টে হাত রাখে — এবং গরম অনুভব করে, যেন কেউ সেটা ভিতর থেকে স্পর্শ করছে। সেই মুহূর্তে, একটা অদৃশ্য কণ্ঠ কানে আসে — “তুমি ফিরে এসেছো… তুমি রক্তের ধারক… চক্রের পঞ্চম সত্তা…”
(চার)
পরদিন সকালে, ঋদ্ধিমা বিছানা থেকে উঠে অনুভব করল যেন গলার কাছে কেউ কিছু চেপে ধরে রেখেছিল সারারাত — নিঃশ্বাসে ভার, মনে অদ্ভুত ক্লান্তি। বিছানার পাশের ডেস্কে তার পেনডেন্ট রাখা, যা রাতে গরম হয়েছিল, সেটি এখনও কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া লাগছে — যেন ধাতুর গায়ে কিছু লেগে আছে। সে তুলে নিয়ে দেখল, পেনডেন্টের একপাশে খুব ক্ষীণভাবে দগ্ধ হয়ে উঠেছে একটি নতুন প্রতীক — একটি উল্টে দেওয়া ত্রিভুজ, যার কেন্দ্রবিন্দুতে একটি চোখ। এ প্রতীক আগে কোথাও দেখেছে সে — গ্রন্থাগারে, ত্রিলোকেশ্বরের অধ্যায়ের নিচে। অবিকল একই চিহ্ন, যেন কেউ তার শরীরের অংশ বানিয়ে নিচ্ছে কিছু একটা। আতঙ্কিত হলেও সে স্থিরভাবে আবার তথ্য জোগাড়ে নামে। কলেজ স্ট্রিটের গ্রন্থাগারে সে পুনরায় যায়, কিন্তু রমেশবাবু এবার তাকে গোপনে আলাদা করে বলেন, “ত্রিলোকেশ্বরের নাম আবার উচ্চারিত হয়েছে, এই শহরে… সেটা অশুভ লক্ষণ। তিনি মারা যাননি, মিস রায়… তিনি তো নিজেই মৃত্যুকে বশ করেছিলেন।”
ঋদ্ধিমার প্রশ্নে রমেশবাবু বলেন — “ত্রিলোকেশ্বর মিশ্র ছিলেন ভারতের অন্যতম শক্তিশালী তান্ত্রিক, যিনি দেবীসাধনার নামে এক আদিশক্তিকে বন্দি করেন — একটি প্রাচীন নারীর আত্মা, যার মধ্যে ছিল পঞ্চতত্ত্বের শক্তি। দুর্গা প্রতিমার ভেতর সেই আত্মাকে বেঁধে রেখে চক্র জাগ্রত রাখতেন তিনি। প্রতি আশ্বিন মাসে, বিশেষত যদি দশমী ও পূর্ণিমা একসাথে পড়ে, তখন সেই চক্র পূর্ণতা পায়। তখন ফের তাঁর জাগরণ সম্ভব হয়।” এই কথাগুলো শুনে ঋদ্ধিমা বুঝতে পারে — এ কেবল অতীত নয়, ভবিষ্যতের এক সংকেত। এবারের আশ্বিন মাসে দশমী ও পূর্ণিমা একই দিনে পড়ছে — এমন একটি জোড়া লগ্ন, যেটা ১৯৬৫ সালের পর প্রথম ঘটছে। ঠিক সেই বছরই ত্রিলোকেশ্বর গায়েব হয়েছিলেন। এমন হলে এটা নিছক কাকতাল নয়, বরং বহুদিন আগে শুরু করা একটি পরিকল্পিত পুনরাগমন।
ঋদ্ধিমা ও সায়ন এবার চৌবাগান শ্মশানে যায়, যেখান থেকে আগের নিখোঁজ ছাত্রীর শেষ ফোন লোকেশন এসেছিল। সেখানে পৌঁছে তারা দেখতে পায় — একদম পিছনের ঘাসঝোপের মধ্যে মাটিতে আধা পোঁতা রয়েছে একটা লোহার বাক্স। খোলার পর দেখা যায় — ভেতরে রাখা এক খণ্ড পোড়া কাগজ, একটা পুরনো কাঠের প্রলেপে বাঁধানো কালীমূর্তির ভগ্ন মূর্তি, এবং অদ্ভুত এক হাড়ের মালা। কাগজটিতে হাতে লেখা — “পঞ্চতত্ত্ব একত্র হলে, চক্র জাগে। নারীসত্তা তখন মুক্তি চায়, অথবা ভয়ংকর রূপ ধারণ করে।” সেখানে নিচে লেখা — “এই বারে সেই নারী ফিরে আসবে, পঞ্চম রক্ত ধারককে গ্রহণ করবে।”
ঋদ্ধিমা স্তব্ধ। রক্ত ধারক? তার হাতের পেনডেন্টই কি সেই চিহ্ন? তার জন্ম তো হয়েছিল একই দশমী-পূর্ণিমা লগ্নে… সেই আশ্বিনে?
সে বোঝে, এই অনুসন্ধান আর কেবল সাংবাদিকতার খাতিরে নয় — সে নিজেই এই তান্ত্রিক চক্রের অংশ। জন্মসূত্রে, সময়সূত্রে, রক্তসূত্রে।
(পাঁচ)
শ্মশানের মাটি শুকনো ছিল, কিন্তু একধরনের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ নাকে লাগছিল — যেন বহুদিন আগে পচে যাওয়া কিছু হাড় বা দাহ করা শরীরের ধোঁয়া এখনও বাতাসে জেগে আছে। সায়নের পকেট টর্চের আলোয় ধরা পড়ল — লোহার সেই বাক্সের নিচে জমে থাকা ছাইরঙা ধুলোয় মানুষের আঙুলের ছাপ, আর একটি রক্তরঙা রেখা, যা বাক্স থেকে বেরিয়ে পেছনের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। ঋদ্ধিমা, দম বন্ধ করে, কাগজটি পড়তে শুরু করল — তার প্রান্ত ছেঁড়া, কিছু লেখা অস্পষ্ট, কিন্তু মাঝখানে স্পষ্ট লেখা আছে — “অষ্টতন্ত্র সাধনার বিধি।” কালি অনেক পুরনো, কিন্তু প্রতিটি শব্দ যেন এখনো জীবন্ত। সেখানে লেখা — “পঞ্চতত্ত্ব অধিষ্ঠানকালে রক্তের মাধ্যমে বন্ধন সম্ভব। এক নারীসত্তা, যার জন্ম দেবীমূর্তির দিন, যিনি বহন করেন পূর্বপুরুষ তান্ত্রিকের চিহ্ন, তিনি হলেন রক্তপাত্র। তাকে কেন্দ্র করেই চক্র সম্পূর্ণ হবে।” ঋদ্ধিমার চোখে অন্ধকার নেমে আসে — সেই নারী তো সে-ই! দশমীতে জন্ম, তার দাদু তান্ত্রিক ছিলেন, আর সে নিজেই বহন করে সেই রহস্যময় পেনডেন্ট। সে বোঝে, এখন থেকে তাকে কেবল একজন অনুসন্ধানকারী নয়, একজন যোদ্ধা হিসেবেও প্রস্তুত থাকতে হবে।
সায়ন, যিনি এখনও পুরোটা মানতে পারছিল না, কাগজটা পড়ে কাঁপা গলায় বলে, “তুই বলতে চাইছিস… এরা তোকে বলি দিতে চায়?”
ঋদ্ধিমা মাথা নাড়ে, “বলির চেয়েও ভয়ানক কিছু… ওরা আমাকে ব্যবহার করে কোনো আত্মাকে ফিরিয়ে আনতে চায়। আর সেই আত্মা যদি পঞ্চতত্ত্বে মুক্ত হয়ে ওঠে, তাহলে—”
হঠাৎ পেছন থেকে একটা ঝোড়ো বাতাস উঠে আসে, আর সেই বাতাসে শোনা যায় এক নারীকণ্ঠ, নিঃস্বরে উচ্চারিত — “আমি বন্দি… আমি রক্ত চাই না… মুক্তি চাই…”
তারা দ্রুত চারদিকে তাকালেও কেউ নেই। অথচ পেনডেন্ট আবার গরম হচ্ছে, আর সেই কাগজে যেন অদৃশ্য অক্ষরে নতুন কিছু লেখা হয়ে উঠছে — “ত্রিলোকেশ্বর জাগ্রত হবেন দশমীর পূর্ণিমায়। রক্ততলায় চক্র সম্পূর্ণ হবে।” তারা আর সেখানে থাকে না — ছুটে বেরিয়ে আসে, আর তখন দূর থেকে কে যেন খুব ধীরে, নিঃশব্দে হাসে — যেন বাতাসের মধ্যেই কারো ছায়া হেঁটে যাচ্ছে তাদের পেছনে।
ফিরে এসে ঋদ্ধিমা সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে এর শেষ দেখতে হবে। সে তার দাদুর রেখে যাওয়া একমাত্র পাণ্ডুলিপি — “তান্ত্রিক বিপর্যয় ও নারীশক্তির মন্ত্ররূপ” — খুলে পড়তে শুরু করে। দাদু সেখানে লিখেছিলেন — “নারীশক্তি বন্দি নয় — তাকে যদি শক্তির চক্রে বেঁধে ফেলা হয়, তাহলে তার রূপ পরিণত হয় এক অভিশপ্ত দেবীসত্তায়। তার ক্রোধ অসীম, কারণ সে দেবী নয় — সে প্রতিশোধ।” ঋদ্ধিমা বোঝে, অচিন্ত্য ও ত্রিলোকেশ্বর কেবল একটা পুরনো চক্র জাগাতে চায় না — তারা একটি অস্তিত্বহীন সময় ফিরিয়ে আনতে চায়, যেখানে দেবীসত্তা হবে তাদের অধীন, আর মানুষ হারাবে ইচ্ছাশক্তি। এবং সেই পরিকল্পনার কেন্দ্রে আছে সে নিজে — রক্তপাত্র। দশমী আসছে। সময় ফুরাচ্ছে।
(ছয়)
কলকাতার আকাশ সেই সন্ধ্যায় ছিল অদ্ভুত রঙের — যেমন হয় না কোনও সাধারণ শরৎকালের দিনে। সাদা-নীল মেঘের জায়গায় ছায়াময় ধূসরতা যেন ধীরে ধীরে ঢেকে দিচ্ছিল গোটা শহরের মাথার উপর। আর সেই সাথে একটা অনুভব — বাতাস যেন ভারি, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, এবং পথঘাটে কুকুরগুলো হঠাৎ করে নিরব হয়ে গেছে। এই নিস্তব্ধতা শহরের পরিচিত নয়। সায়ন প্রথম টের পায়, তার ক্যামেরার ব্যাটারি পরপর তিনবার চার্জ দেওয়া সত্ত্বেও অদ্ভুতভাবে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। একই সময়ে, ঋদ্ধিমার মোবাইল স্ক্রিনে ছায়া পড়ে — এক অচেনা নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ: “ত্রিলোকেশ্বর আসছেন। প্রস্তুত তো?” সেই নম্বর খুঁজে পাওয়া যায় না। এক মুহূর্তে সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন — ইন্টারনেট নেই, মোবাইল টাওয়ার অদৃশ্য। আর তখনই, দূরে বাজে কালীঘাটের দিক থেকে এক অলৌকিক ঘণ্টাধ্বনি — যেন কেউ মন্দির ছেড়ে উঠে এসেছে শহরের বুকের উপর।
ঋদ্ধিমা সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে ফিরতে হবে সেই মণ্ডপে — কারণ যত তথ্যই সে খুঁজে আনুক, সব কিছুর কেন্দ্র সেখানে। সেই রাতে, সে ও সায়ন গিয়ে পৌঁছায় মণ্ডপে ঠিক অষ্টমীর রাত বারোটা নাগাদ। চারপাশে অদ্ভুত স্তব্ধতা, শুধু পেছনের গলিতে দূর থেকে শোনা যায়, কারা যেন মন্ত্র পড়ছে — কিন্তু স্বরে কোনও ভক্তি নেই, বরং হিংসা, কামনা ও জাগরণের আকুলতা। ভেতরে ঢুকতেই তারা দেখে, সেই চেনা বেদীর চারপাশে আগুন জ্বলছে, আর তার মাঝে বসে আছে অচিন্ত্য — নগ্নবক্ষ, চোখে কালী রঙের তিলক, কপালে রক্তের দাগ, গলায় মৃত হাড়ের মালা। সে আজ আর সেই ফুলওয়ালা নয় — তার সামনে ধূপের ধোঁয়ায় ধরা পড়ছে আরও কিছু মুখ — কালো পোশাকের পুরুষ, যার মুখে ত্রিশূলের ছাপ, আর মাঝখানে এক সিংহাসনের মতো কাঠের গদিতে রাখা একটা মৃতদেহ — অর্ধপোড়া, তবুও মাথাটা উঁচু। সায়ন ফিসফিস করে বলে, “ওটা… ওটা ত্রিলোকেশ্বর?”
ঠিক সেই সময় অচিন্ত্য মুখ তোলে, এবং সরাসরি ঋদ্ধিমার দিকে তাকিয়ে বলে — “তুমি এসেছো, যথাসময়ে। এবার চক্র সম্পূর্ণ হবে। তুমি জানো না, তোমার জন্ম কী উদ্দেশ্যে। তুমি রক্তধারক, বিভূতিভূষণের উত্তরসূরি — কিন্তু তার দীক্ষা পূর্ণ হয়নি। আমি হয়েছি তার চিরশত্রুর শিষ্য — অঘোর জাগরণের অনন্ত স্রোতে শিষ্যত্ব পেয়েছি ত্রিলোকেশ্বর গুরুদেবের। তোমার রক্ত, আমার তন্ত্র — এই দু’য়ে খুলবে পঞ্চতত্ত্বের তালা।”
এই ঘোষণার পরেই বেদির চারপাশে দাঁড়ানো তান্ত্রিকেরা উচ্চারণ করতে থাকে: “ওঁ কালী নাগিণী জাগো। রক্তে রক্ত, ছায়ায় ছায়া। পঞ্চতত্ত্বে পূর্ণ দেহ, অশুভে শুভের অবসান।” হঠাৎ মৃতদেহের গায়ে চোরা আগুন জ্বলে ওঠে, আর সেই আগুন থেকে ধীরে ধীরে উঠতে থাকে এক ছায়া — ত্রিলোকেশ্বরের আত্মা। তার চোখ জ্বলছে, কণ্ঠে নেই কোনও শব্দ, কিন্তু হাত তুলে ইশারা করছে ঋদ্ধিমার দিকে। সে যেন নির্দেশ দিচ্ছে — “আসো। তুমি আমার উপাদান।”
ঋদ্ধিমা বুঝতে পারে, পালানোর কোনও পথ নেই। কিন্তু তখনই, তার বুকের পেনডেন্ট গলে পড়ে যায়, আর বুকের উপর লালচে আগুনের মতো ফুটে ওঠে সেই চোখের প্রতীক। বাতাস থেমে যায়। অচিন্ত্য থমকে যায়। আর সেই মুহূর্তে, মণ্ডপের চারদিকে প্রতিমার খালি কাঠামো থেকে জেগে ওঠে ছায়াসত্তাগুলো — সেই নারী, যাকে সে প্রথম রাতে দেখেছিল। সে বলে — “আমি বলি চাই না… আমি চেতনা চাই… আমার আত্মা এখন জাগ্রত… এবং এ চক্র ভাঙতে পারে একমাত্র আমার রক্তপাত্র… তুমি।” তখনই চারপাশের প্রদীপগুলো একে একে নিভে যেতে থাকে। অচিন্ত্য চিৎকার করে ওঠে — “না! চক্র অসম্পূর্ণ! ত্রিলোকেশ্বর, রক্তপাত্র এখন আমাদের বিরুদ্ধে!”
(সাত)
চারপাশের বাতাস থেমে যায়। যেন সময় নিজেই ভয় পেয়ে গিয়েছে — কিংবা পিছু হটেছে এক প্রাচীন শক্তির পুনর্জাগরণের সামনে। ঋদ্ধিমার বুকের ওপর ফুটে থাকা চোখের প্রতীক থেকে আগুনের একটি সূক্ষ্ম রেখা ছুটে যায় বেদির দিকে — সোজা সেই অর্ধপোড়া মৃতদেহের চোখে। সেই চোখ তখন খুলে যায় — না, খোলা নয় — ফেটে যায়। ভিতর থেকে ছিটকে পড়ে পিচ্ছিল কালি, যেন শতাব্দী ধরে জমে থাকা ক্রোধ আর অভিশাপ। ত্রিলোকেশ্বরের শরীর ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করে — মাংসের ফাঁকে রক্ত নেই, হাড়ের গাঁটে মাংস নেই, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপে শোনা যায় হাড় গুঁড়ো হওয়ার মতো শব্দ। সে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে না — বরং এক গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “অবশেষে… পূর্ণতা।”
অচিন্ত্য পেছনে হটে যায়, মাথা নিচু করে প্রণাম করে — “গুরুদেব… আমার সাধনা সম্পূর্ণ হল।”
ত্রিলোকেশ্বর তার দিকে তাকিয়ে ধীরে বলে, “সাধনা অসম্পূর্ণ… পঞ্চম সত্তা এখনও অধীন নয়।”
তার দৃষ্টি ঋদ্ধিমার ওপর। সেই চোখে ছিল না মায়া, না হিংসা — ছিল অধিকার। ঋদ্ধিমা প্রথমবার অনুভব করে, এই চাহনি কোনও মানুষ অথবা ভূতের নয়, বরং এক দেবতা অথবা দৈত্যের — যার লক্ষ্য একটাই: নিয়ন্ত্রণ।
ঠিক সেই মুহূর্তে, মণ্ডপের ভিতরের কাঠামো কেঁপে ওঠে। প্রতিমার ভাঙা শরীরগুলোতে জেগে ওঠে ছায়া — নারীর শরীর, কিন্তু চোখে শূন্যতা, হাতে অদৃশ্য অস্ত্র। একেকটি শরীর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে দগ্ধ আত্মা, যারা ত্রিলোকেশ্বরের তান্ত্রিক বন্দীত্বের শিকার হয়েছিল বহু দশক ধরে। তারা ঘুরে ঘুরে বলতে থাকে — “আমরা মুক্তি চাই… রক্ত নয়… চক্র নয়… সময় নয়… আলো।”
ত্রিলোকেশ্বর তখন রেগে ওঠে, আগুনের ঢেউ ছুঁড়ে মারে বাতাসে — সেই আগুন অদৃশ্য আত্মাদের পোড়াতে পারে না, কিন্তু সায়ন চিৎকার করে ওঠে — তার হাতে আগুন ধরে গেছে। ঋদ্ধিমা ছুটে যায় তাকে বাঁচাতে, আর তখনই তার পেনডেন্টের স্থান থেকে এক সোনালি আলো বেরিয়ে আসে — সরু এক রেখা, যা সায়নের শরীর ছুঁয়ে তার দাহ ঠেকায়। এই আলো কোনো আগুন নয় — এটি তাঁতের অগ্নিসূত্র — নারীশক্তির অভ্যন্তরীণ মন্ত্র, যা কেবল তখনই জাগে যখন আত্মা চায় রক্ষা, রক্ত নয়।
ত্রিলোকেশ্বর পিছিয়ে যায়। সে বলে, “তুমি তার দেহ, কিন্তু এখনো নয় তার চেতনা। আমাকে চাই সম্পূর্ণ আত্মরূপ — পঞ্চতত্ত্বের উৎসর্গ।”
ঋদ্ধিমা তখন মাটিতে বসে পড়ে, চোখ বন্ধ করে মনে করে তার দাদুর শেখানো শ্লোক —
“যা তন্ত্রে নিয়ন্ত্রিতা, তা মনেই নিরুদ্ধ। যা মুক্তি, তা কণ্ঠে নয় — হৃদয়ে।”
সে জোরে বলে ওঠে, “আমার আত্মা স্বাধীন। তোমার চক্র শুধু ভয় দিয়ে চলে, কিন্তু আমি হলাম সেই আলো — যে কোনও চক্রের কেন্দ্রে জন্ম নেয়, আর ছিন্ন করে সেই বন্ধন।”
এই ঘোষণার পর বাতাসে কাঁপে ত্রিলোকেশ্বর। তার গলা থেকে বের হয় একটি পশুর মতো গর্জন। সে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঋদ্ধিমার দিকে — কিন্তু সেই মুহূর্তে, চারদিক থেকে ছুটে আসে আত্মারা, যারা আগে বন্দী ছিল। তারা মিলে তার গায়ে জড়িয়ে ধরে। তাদের দেহ নেই, কিন্তু শক্তি আছে — এক এক করে তারা তার শরীরের পচা হাড় থেকে আলো বের করে আনে — যার প্রতিটি কণা এক একটি দুঃসহ পাপ।
ত্রিলোকেশ্বর চিৎকার করে — “চক্র অসম্পূর্ণ… অসম্পূর্ণ… অসম্পূর্ণ…”
ত্রিলোকেশ্বরের দেহ জ্বলতে শুরু করে — কোনও আগুন নয়, এক অভ্যন্তরীণ স্ফুলিঙ্গে। ধীরে ধীরে গলে যায় তার মুখ, চোখ, আর শেষে সে মিলিয়ে যায় বাতাসে।
অচিন্ত্য ততক্ষণে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে।
ঋদ্ধিমা জানে, এটা শেষ নয় — শুধু প্রথম বাঁধন ভেঙেছে। কিন্তু চক্রের মূল, যা জন্ম দেয় এই ঘূর্ণিতে — সে এখনও বেঁচে। আর দশমী এখনো আসেনি।
(আট)
শহর জেগে উঠেছিল দশমীর সকাল নিয়ে — ধুনুচি নাচ, সিঁদুর খেলা, ঢাকের তাল, আর দেবীকে বিদায় জানানোর সেই চিরন্তন আনন্দময় বিষাদ। কিন্তু কলকাতার এক কোণে, যেখানে কোনো প্রতিমা নেই, কোনো সিঁদুর নয়, সেখানে প্রস্তুত হচ্ছিল এক ভিন্নরকম বিদায় — এক চক্র ভাঙার কিংবা নতুন করে বাঁধার দিন। ঋদ্ধিমা জানত, মণ্ডপের আগের রাতের সংঘর্ষ শুধু এক অলৌকিক আত্মার সঙ্গে ছিল না — তার নিজের আত্মার ভেতর এক স্ফুলিঙ্গ জেগেছে, যেটি শুধু আত্মরক্ষা করে না, প্রতিরোধও করতে চায়। কিন্তু আজকের লগ্ন আলাদা — পূর্ণিমা ও দশমী একসঙ্গে পড়েছে। তার দাদুর লেখা পাণ্ডুলিপিতে স্পষ্ট লেখা ছিল, “এই লগ্নে চক্র নিজে চেতনার খোঁজে জাগে। যদি ধারক নিজে পথ বেছে নেয়, চক্র দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু যদি সে দ্বিধায় থাকে, তখন চক্র গ্রহণ করে অধিকার।”
সায়ন তখনো দুর্বল, মণ্ডপের আগুনে তার বাঁ হাতের কিছুটা অংশ পুড়ে গিয়েছিল, কিন্তু তার কথাগুলো স্পষ্ট — “ঋদ্ধি, তুইই এখন এই শহরের একমাত্র রক্ষাকর্তা। কাকেই বা বলব? কেউ বিশ্বাস করবে?”
ঋদ্ধিমা বলল, “কারোর বিশ্বাস লাগবে না। শুধু আমাকে নিজেকে বিশ্বাস করতে হবে।”
সে আরেকবার খুলে পড়ে সেই পুরনো তন্ত্রপাণ্ডুলিপি — এক বিশেষ অধ্যায় ছিল রক্তবিন্দু সংযোগ, যেখানে বলা হয়েছে, “পঞ্চতত্ত্বে বাঁধা নারীসত্তা যদি নিজেই চক্রভেদী হয়, তবে চক্রের মূল বিভাজিত হয়, এবং বন্দী আত্মারা মুক্তি পায়।” এই রক্তবিন্দু মানেই আত্মদান নয়, বরং ইচ্ছা ও শক্তির একত্রতা।
সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলে, ঠিক দশমীর লগ্নে, মণ্ডপে ফিরে আসে ঋদ্ধিমা। এবার সে একা নয় — তার চারপাশে ছায়ার মতো ঘুরছে সেই সব নারীর আত্মারা, যারা শতাব্দী ধরে এখানে বলিপ্রদত্ত ছিল। এবার তারা নিঃশব্দ নয় — একত্র, জাগ্রত।
অচিন্ত্য তখনো জীবিত — তবে বিভ্রান্ত, শয্যাশায়ী। হঠাৎ করেই মণ্ডপের ভিতরে এক নতুন স্পন্দন — মাটি কেঁপে উঠছে, বাতাস গরম হয়ে যাচ্ছে, আর মাঝখান থেকে উঠে আসছে এক পাথরের বেদী — যেন মাটির নিচে শতাব্দী ধরে গোপন রাখা হয়েছিল। সেই বেদীতে উৎকীর্ণ সেই পুরনো চিহ্ন — নাগচক্র, আর তার মাঝে খালি একটি স্থান — এক রক্তবিন্দুর জায়গা।
ত্রিলোকেশ্বরের ছায়া এখনও রয়েছে — পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি। বাতাসে তার কণ্ঠস্বর ঘোরে —
“তুমি ভাবছ, আমায় শেষ করেছো? না, আমি এখন তোমার মধ্যেই… তুমি রক্তপাত্র, আমার বাহন… তুমি নিজেই আমার পূর্ণতা!”
ঋদ্ধিমা সেই বেদীর সামনে বসে পড়ে। তার পেনডেন্ট পুড়ে গিয়ে হালকা ধূম্র হয়ে গেছে, কিন্তু বুকের প্রতীকটি তখন আগুনের মতো জ্বলছে। সে চোখ বন্ধ করে ডাকে সেই নারীদের আত্মা, যারা মুক্তি চেয়েছে। একে একে তারা এসে মণ্ডপ ঘিরে দাঁড়ায় — পঞ্চতত্ত্বের প্রতিনিধির মতো —
এক নারী বাতাসের মতো ঘুরে,
একজনের গায়ে আছে জলের কণা,
কেউ দাউদাউ আগুনের ছায়া,
কেউ মাটির শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে,
আর একজন একেবারে শূন্য — আকাশের মতো।
ঋদ্ধিমা চিৎকার করে বলে — “আমি আর রক্তপাত্র নই। আমি চক্রভেদী। আমার চেতনা আমার নিজের। আজ আমি তোমাদের প্রতিটাকে মুক্তি দেব। আর আমি নিজেও হব আমার অস্তিত্বের অধিকারী।”
সে কেটে ফেলে নিজের কপালের মাঝখান — একটি সামান্য ক্ষত, যেখান থেকে একটি একফোঁটা রক্ত পড়ে সেই বেদীতে। ঠিক তখনই চারপাশ কেঁপে ওঠে — যেন বিদ্যুৎ ছুটে যায় ধরণীতে। সেই রক্তবিন্দু ছুঁয়ে যায় প্রতিটি তত্ত্বসত্তাকে, আর মুহূর্তেই তারা আলোর রূপে ভেঙে পড়ে আকাশে। একটি বিকট আওয়াজে ছিঁড়ে যায় বাতাস — আর ত্রিলোকেশ্বরের ছায়া ধ্বংস হয়ে যায়… না, নয় — চুরমার হয়ে ছড়িয়ে যায় অনন্তে।
মণ্ডপে তখন অশান্তি নেই — শুধু এক নিস্তব্ধতা, এক শান্ত নিরবতা, যেন দীর্ঘদিনের কান্না থেমে গেছে।
অচিন্ত্য তখনো নিথর, চক্র ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার শরীর থেকেও চলে গেছে সেই অঘোর শক্তি।
সায়ন ধীরে আসে ঋদ্ধিমার পাশে, আর বলে — “শেষ হল?”
ঋদ্ধিমা ধীরে তাকিয়ে বলে — “চক্র ভেঙেছে। কিন্তু যারা চক্র সৃষ্টি করে, তারা বারবার জন্ম নেবে। আমরাও আবার দাঁড়াব। শুধু এবার আমরা একা থাকব না। নারীর আত্মা আর কাঁদবে না। সে জেগে থাকবে।”
(নয়)
দশমীর সেই রাতের পর শহর ফিরে পায় তার স্বাভাবিক ছন্দ। কালীঘাটে মণ্ডপ ভেঙে ফেলা হয়েছে, মায়ের প্রতিমা বিসর্জনে গিয়েছে, শঙ্খধ্বনি আর উলুধ্বনির সঙ্গে শেষ হয়েছে বাঙালির শারদোৎসব। কিন্তু মণ্ডপঘাটার সেই পুরনো, নির্জন দুর্গা কাঠামোটা এখনও পড়ে আছে অরক্ষিত — কেউ ছুঁয়েও দেখেনি, যেন ওটা আজও কারও দখলে। ঋদ্ধিমা শহরে ফিরে আসে, নিজ অফিসে রিপোর্ট জমা দেয় না — কারণ তার অভিজ্ঞতা কোনও সাংবাদিক প্রমাণ রাখতে পারবে না। সায়ন এখনও নিরব — তার হাতে আগুনের পোড়া দাগ একটা অদ্ভুত নকশা হয়ে উঠেছে, যেন চক্রেরই অংশবিশেষ। তারা দুজনেই জানে, কিছু একটা থেকে গেছে… অপূর্ণ।
তবে মণ্ডপঘাটা ছেড়ে যাওয়ার আগেই, ঋদ্ধিমা একটা কাঁচের শিশি কুড়িয়ে পেয়েছিল — অচিন্ত্যর শয্যার পাশে লুকিয়ে রাখা, এক গোপন গর্তে পোঁতা। শিশির ভিতরে ছিল কালি রঙের এক ধরনের তরল, যা না ছিল জল, না তেল। তার গায়ে ছোট্ট একটা পাণ্ডুলিপি লিপিবদ্ধ — “আংশিক চক্ররক্ষা: মূল মন্ত্রের বিভাজিত সত্তা।” তার মানে, ত্রিলোকেশ্বর চক্র ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কায় আগে থেকেই কিছু ‘চেতনা’ অন্য কোথাও পাঠিয়েছিল। এবং শিশির নিচে লেখা ছিল একটি নাম — “শ্রেয়সী সেন”।
এই নামটা ঋদ্ধিমার চেনা নয়। সে খোঁজ শুরু করে — কালীঘাটের পুরনো রেকর্ড, নাগচক্র সংক্রান্ত পুরাতন দলিল, এমনকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অক্সালটন সার্কুলার আর্কাইভ। কয়েক ঘণ্টা গবেষণার পর উঠে আসে একটি নাম — শ্রেয়সী সেন, ১৯৮৬ সালে কুমারতুলির এক চিত্রশিল্পী পরিবারের কন্যা, যিনি হঠাৎ একদিন নিখোঁজ হয়ে যান। তার শেষ চিহ্ন ছিল একটি তান্ত্রিক প্রতিমার চোখ আঁকার সময় — সে একটি প্রতিমার চোখে পুঁতে দিয়েছিল রক্ত-চক্রের চিহ্ন। পরে সেই প্রতিমা বিসর্জনের পর তিনজন গ্রামবাসী মানসিক ভারসাম্য হারায়।
আরও গভীরে খুঁড়ে পেয়ে যায় এক চমক — সেই শ্রেয়সীই ছিল ত্রিলোকেশ্বরের আধ্যাত্মিক শিষ্যা, এবং তার শরীর ছিল ‘ভবিষ্যৎ চেতনা ধারক’। সে নিজে কোনওদিন দীক্ষা নেয়নি, কিন্তু সে ছিল এমন একজন যাকে ব্যবহার করা হতো ত্রিলোকেশ্বরের আত্মা ‘ভাগ’ করে সংরক্ষণের জন্য — যেন একটা চক্র ভেঙে গেলেও, অন্য কোথাও থেকে আবার সে গড়ে ওঠে।
ঋদ্ধিমা বুঝে যায় — শিশির কালি আসলে চেতনার পাত্র — যেখানে এক অংশ ত্রিলোকেশ্বরের সত্তা এখনো রক্ষিত আছে।
ঠিক তখনই সে টের পায় — তার পেনডেন্ট ছাড়াই, বুকের মাঝখানে সেই চোখের চিহ্ন আবার ফুটে উঠেছে — আগুন নয়, এবার যেন বরফের মতো ঠান্ডা। সে ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, চক্র শুধুমাত্র আগুনে জাগে না — বরং নিরব চেতনায় জন্ম নেয় নীরব বিকরণ।
তার মাথায় আসে — যদি শ্রেয়সী সেন জীবিত থাকে, তবে সে-ই এখন চক্রের নতুন ধারক। কিংবা তার শরীর দিয়ে আবার সেই ছায়া ফিরতে পারে।
ঋদ্ধিমা সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে শ্রেয়সীকে খুঁজতেই হবে।
সায়ন বাধা দিতে চায়, “তুই তো চক্র বন্ধ করেছিলি! আবার কেন?”
ঋদ্ধিমা উত্তর দেয়, “চক্র কখনও পুরোপুরি শেষ হয় না। শুধু রূপ বদলায়। এবার, আমি শেষ করব তার বীজ। তার গোড়া।”
সেই রাতে, শহরের এক পুরনো রেল কোয়ার্টার, যেখানে কেউ এখন থাকে না, হঠাৎ দেখা যায় — জানালায় এক নারী মুখ… ঠোঁটে হালকা হাসি… চোখে আগুনের প্রতিফলন…
আর তার হাতে সেই শিশি — যেখানে কালি এখনও ঘূর্ণায়মান, আর তার ভিতর দেখা যায় এক চোখ — একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে… ঠিক ঋদ্ধিমার দিকে।
(দশ)
শহরের অন্ধকার এক বেজায় জ্বলজ্বলানো কোণে দাঁড়িয়ে আছে শ্রেয়সী সেন — একাধারে শিল্পী, তান্ত্রিক এবং সেই চক্রের নতুন ধারক। তার চোখে আগুনের মতো ঝলক, কিন্তু মুখে আছে এক ধরণের বিষণ্ণতা, যাকে দেখে বুঝা যায়— সে নিজেই এক বন্দী, যার মুক্তি অপেক্ষায়। হাতে কালি ভর্তি শিশিটি, যা ত্রিলোকেশ্বরের চেতনার অংশ বহন করে। ঋদ্ধিমা ও সায়ন রেল কোয়ার্টারে পৌঁছায় ঠিক সেই সময়, যখন শ্রেয়সী তার শিল্পীর রুমে আঁকছে — কিন্তু না, ক্যানভাস নয়, বরং একটা জীবন্ত চক্রের বৃত্ত যা ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে। সে শুনতে পায় পেছন থেকে ধীর ধাপের শব্দ — তিনজন গা ঢাকা লোক।
ঋদ্ধিমা গলায় ফিসফিসিয়ে বলে, “শ্রেয়সী, তোমার সাহায্য ছাড়া আর কোনো পথ নেই। তোমার শরীরে সেই চক্রের বীজ আছে, কিন্তু তুমি নিজেই নিজের মুক্তির চাবিকাঠি।” শ্রেয়সী তাকিয়ে বলে, “তুমি জানো না, এ চক্র শুধু আমারই নয়, আমাদের সবার। যারা জড়িয়ে পড়েছে… তাদেরই রক্তে তা প্রবাহিত। ছাড়া পাওয়া সহজ নয়।”
তিন জন গা ঢাকা লোক এসে হাজির হয় — যারা চক্রের বাকী অংশ রক্ষা করতে প্রেরিত। তারা শূন্য চোখে তাকিয়ে, আঙুল তুলে ঝাপটায়, আর অদ্ভুত মন্ত্র উচ্চারণ করে। এক মুহূর্তে, রুমের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে কালো ছায়া। কিন্তু ঋদ্ধিমার হাতে তখন নতুন শক্তি — পেনডেন্টের জ্বলজ্বল করে ওঠা আলো আর বুকের অগ্নিচিহ্ন মিলিয়ে একটা ত্রিমাত্রিক মন্ত্রের বৃত্ত তৈরি করে। সেই আলো ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, ছায়াগুলো ঝলসে যায়।
শ্রেয়সী নিজের শরীর ছুঁয়ে বলল, “আমার রক্তবিন্দুটা একত্র করো।”
ঋদ্ধিমা ধীরে ধীরে শ্রেয়সীর হাতে শিশি ছুঁয়ে দেয়, আর শিশির ভিতর থেকে এক প্রবল জ্বলজ্বলানি ছুটে আসে। চক্রের বৃত্ত স্ফুটে ফেটে যায় — রক্তবিন্দুর কেন্দ্রে ফুটে ওঠে এক মুক্ত আত্মা। চক্রের যাঁরা ছিল, তাঁরা সবাই ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে পড়ে, একে একে বিলীন হতে থাকে। চক্র ভেঙে যায়, আর সেই সঙ্গে মুক্তি পায় শতাব্দীর কষ্টীণ আত্মারা।
শ্রেয়সী বলে, “এবার আমি মুক্ত।”
ঋদ্ধিমা হাসে, “আমরাও। কিন্তু আমাদের জীবনেও এক নতুন চক্র শুরু হয়েছে — নিজেরই নিয়ন্ত্রণে।”
সায়ন মাথা নাড়ে, “আসলে এই যুদ্ধ কখনো শেষ হয় না, কেবল রূপ বদলায়।”
তারা তিনজনে একসঙ্গে উঠে বাইরে আসে — কলকাতার প্রথম রোদ ঝলমলে ফুটে উঠছে। আশ্বিনের সেই ভয়ঙ্কর রাত শেষ, কিন্তু নতুন দিন, নতুন আশা।
সমাপ্ত




